কাউন্টার-অফেন্সিভ : ইউক্রেনের নিপার নদী অতিক্রম; খেরসন ও বাখমুতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য; সামনে কী?

গত এক মাস মানে জুন মাসের বেশির ভাগ সময় ধরে ইউক্রেন জ্যাপরিঝিয়া এবং কিছুটা সময়ে বাখমুতে কাউন্টার-অফেন্সিভ চালিয়েছে। কিন্তু এদের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি এলো বোধ হয় খেরসনেই। কেননা নোভা কাখোভকা ড্যামে বিস্ফোরণ ও এরপর সেই অঞ্চলে বন্যার পরও তারা নিপার নদী অতিক্রম করে এর বাম তীরে একটি স্থায়ী শক্তিশালী মিলিটারি পজিশন বা ব্রিজহেড স্থাপন করেছে। এখানে ইউক্রেইন এখন কোথায় কোথায় সফল হচ্ছে, কেন তারা নিপার যদি অতিক্রম করেছে, এবং সামনে কী হতে চলেছে – এসব নিয়ে আলোচনা করা হবে।

জ্যাপরিঝিয়া ও বাখমুতে ইউক্রেইনের সাফল্য

খেরসনে যাবার পূর্বে অন্য অঞ্চল দুটির কথা আলোচনা করে নেয়া যাক যেখানে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ চলছে। জ্যাপরিঝিয়ার ফ্রন্ট লাইনে ইউক্রেইন চাপ অব্যাহত রেখেছে তবে সেখানে ইউক্রেইনের সাফল্য সীমিত। এখানে গত এক সপ্তাহে ইউক্রেনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লাভ হল রিভনোপিল শহর যেখানে ইউক্রেনীয়রা মূলত পূর্ব ও পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে রাশিয়ানদের ঘিরে রেখেছে। তবে এখানে ইউক্রেইনের ধীর গতির পেছনে বাজে আবহাওয়া দায়ী। গত কয়েক দিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে যা আক্রমণাত্মক ক্রিয়াকলাপগুলিকে আরও কঠিন করে তুলেছে এবং আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি কমে যাওয়ার সাথে সাথে কিছু পরিবর্তন হয় কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে।

এদিকে ইউক্রেনীয়রা সম্প্রতি বাখমুতে আরো বেশি সাফল্য অর্জন করেছে। মে মাসে ওয়াগনার বাহিনী শহরটি দখল করার পর থেকে ইউক্রেনীয়রা উত্তর এবং দক্ষিণ দিক দিয়ে পিছনে রিট্রিট করছিল। তবে গত কয়েক দিনে ইউক্রেনীয়রা এই অঞ্চলে, বিশেষ করে ক্লিশিভকার শহরতলির আশেপাশে দক্ষিণে বেশি ভাল পরিমাণেই সাফল্য পেয়েছে ও অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করেছে। বৃহস্পতিবার সকালে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে যে তারা শহরতলিতে প্রবেশ করেছে এবং এখনও লড়াই চলছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা তখন জানান, তাদের উদ্দেশ্য আসলে শীঘ্রই বাখমুতে প্রবেশ করা নয়, বরং মূলত এটি ঘিরে ফেলা এবং শহর এবং শহরের আশেপাশে রাশিয়ার লজিস্টিক অপারেশনের উপর চাপ সৃষ্টি করা। দেখে মনে হচ্ছে ইউক্রেনীয়রা মূলত শহরটির উত্তর ও দক্ষিণে তাদের আক্রমণ সরিয়ে নিয়েছে রাশিয়ানদের ঘিরে ফেলার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। জুনের শুরুতে, তারা মূলত শহরের দক্ষিণে মনোনিবেশ করেছিল, তারপর কয়েক সপ্তাহ আগে উত্তরের দিকে নতুন করে চাপ দেওয়া হয় এবং এখন গত কয়েক দিনে আমরা দক্ষিণে আরও একটি প্রচেষ্টা দেখতে পারছি। এক মাস আগে ওয়াগনার-সম্পর্কিত বিশৃঙ্খলার কারণে এই অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সৈন্যরাও উত্তেজিত হয়েছিল। তাই ওয়াগনার এই মাসের শুরুতে বাখমুতকে নিয়মিত রাশিয়ান সৈন্যদের কাছে হস্তান্তর করেছিল। তবে ইউক্রেন স্পষ্টতই আশা করেছিল যে ওয়াগনার ভবিষ্যতে কোনও সময় ফিরে আসবে। তাই বেলারুশে ওয়াগনার নির্বাসন এখানে ইউক্রেনের সৈন্যদের মনোবল অনেক বাড়িয়ে তুলেছে।

খেরসনে ইউক্রেইনের অসাধারণ সাফল্য

যাইহোক, ইউক্রেইন এই দুই অঞ্চলে অঞ্চল পুনরুদ্ধার করলেও, ইউক্রেইনের সবচেয়ে বেশি সাফল্য এসেছে খেরসনে। রুশ সেনাবাহিনী খেরোশন শহর থেকে সরে আসার পর থেকে ইউক্রেন নদীর ওপারে তাদের একটি স্থায়ী অবস্থান স্থাপনের চেষ্টা করছে এবং এই অঞ্চলে রাশিয়ার ফ্রন্ট লাইনের দুর্বলতা খুঁজতে শুরু করেছে। এই অঞ্চলের সমস্ত সেতু ধ্বংস হয়ে গেছে। আর তাই ইউক্রেন নদী অতিক্রম করার জন্য ডিঙ্গিতে করে তাদের বিশেষ বাহিনীকে পাঠিয়েছে, যারা নদীর ওপারে মার্শল্যান্ডে পৌঁছেছে। এখন ইউক্রেন এপ্রিলে এখানে বেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনকরেছিল। তারা নদীটির বাম তীরে ডাকি নাম একটি এলাকায় একটি ছোট ব্রিজহেড বা পজিশন প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার বিপরীতে খেরসনের কিছু শহুরে এলাকা ছিল। তবে এই মাসের শুরুতে রাশিয়ানরা নোভা কাখোভকা বাঁধটি ভেঙে দেওয়ার ফলে এই অঞ্চলটি পুরো বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায়, যার ফলে খেরসন নিয়ে ইউক্রেইনের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভাটা পড়েছিল।

তখন সন্দেহ থাকলেও এখন আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে এই বাঁধটি রাশিয়াই উড়িয়ে দিয়েছিল। উত্তর ইউক্রেন এবং রোমানিয়ার ভূমিকম্প সেন্সরগুলি বাঁধটি বিস্ফোরিত হওয়ার দিন রাত ৩টায় জলের নীচে বড় বিস্ফোরণ সনাক্ত করেছিল যা দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত দেয় যে এটি আগে থেকেই খনন করা হয়েছিল। সুতরাং যেহেতু রাশিয়ানদের বাঁধ এবং বাঁধের নীচে পরিচালিত মেশিন রুমে অ্যাক্সেস – উভয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল, এর অর্থ হ’ল এটি প্রায় নিশ্চিতভাবে এর পেছনে রাশিয়ানরাই ছিল, এবং ইউক্রেনীয় আর্টিলারি আক্রমণ ছিল না। একইভাবে, জল নেমে যাওয়ার সাথে সাথে এটি দেখা যায় যে, বাঁধের গোড়ায় কংক্রিটের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে গেছে, যা আবার ইঙ্গিত দেয় যে এটি খনন করা হয়েছিল এবং ইউক্রেনীয় আর্টিলারি দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি।

যাইহোক, গত কয়েক দিনে বন্যা হ্রাস পেয়েছে এবং অঞ্চলটি বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে শুকিয়ে গেছে যা নদীগুলোকে অতিক্রম করা অনেক সহজ করে দিয়েছে। তবে এখানে একটি বিষয় উল্টে ইউক্রেনীয়দের সুবিধাই দেয়। সেটা হল, বাঁধটি ভাঙার ফলে রাশিয়ান-অধিকৃত ওলেশকি শহরটি মারাত্মকভাবে প্লাবিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, রাশিয়ানদের জন্য কেউ ওলেশকি শহরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি হচ্ছে এই অঞ্চলের বৃহত্তম বসতি, আর এটি মূলত এই অঞ্চলে রাশিয়ান সৈন্যদের ফরোয়ার্ড অপারেটিং বেস হিসাবে কাজ করছে। বন্যার জল শুকিয়ে যাবার পর ইউক্রেইন গত সপ্তাহে আরও নিয়মিত ক্রসিং তৈরি শুরু করে। সেই সাথে রাশিয়ান টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলি রিপোর্ট করে যে, ইউক্রেন অ্যান্টি-এয়ার সিস্টেম সহ এই অঞ্চলে ভারী সরঞ্জাম স্থানান্তর করতে শুরু করেছে। এরপর ২৬শে জুন, ইউক্রেনীয় সৈন্যরা সফলভাবে রাশিয়ানদেরকে ডাকি থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে, এবং কয়েক দিন পরে ইউক্রেনীয় বাহিনী কনকুয়ার ব্রিজের উপর একটি রাশিয়ান ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে যা ইঙ্গিত দেয় যে ইউক্রেনীয়রা কমপক্ষে ওলেশকির উপকণ্ঠে সক্রিয়। এ কারণেই হয়তো বৃহস্পতিবার রাশিয়ার টেলিগ্রাম চ্যানেলে খবর এসেছে যে দখলদার রুশ বাহিনী নিপারের বাম তীরের পূর্বদিকে ১৫ কিলোমিটার জোন থেকে দূরে সরে গেছে।

সামনে কী হতে চলেছে

এখন এখন থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীর সামনে অগ্রসর হওয়া কঠিন হবে মূলত দুটি কারণে – প্রথমত, নিপার যদি ক্রস করে মেটারিয়াল পাঠানোটা কঠিন হবে; দ্বিতীয়ত, ওলেশকিতে যাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে কনকুয়ার ব্রিজ অতিক্রম করা। ওলেশকি পুনরুদ্ধার করা ইউক্রেনের জন্য একটি বিশাল কৌশলগত জয় হবে। এটি এই অঞ্চলের মাত্র দুটি বড় বসতিগুলির মধ্যে একটি এবং এটি পুনরুদ্ধার করার পর ইউক্রেনীয় বাহিনী এম১৭ সড়ক ধরে খেরসন ওব্লাস্টের আরো অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে সক্ষম হবে। অবশ্য সেটাও মসৃণ হবেনা, কেননা স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়া এই সড়কে তাদের রেগুলার ব্লকেড বসিয়েছে।

যাই হোক, এসব থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, ইউক্রেন স্পষ্টতই খেরসনের দিকে পুনরায় মনোনিবেশ করছে। আর খেরসনে যদি ইউক্রেইনের এই কাউন্টার-অফেন্সিভ সফল নাও হয়, মানে এখন থেকে তেমন অঞ্চল পুনরুদ্ধার নাও হয়, তবুও এই অঞ্চলে হওয়া কাউন্টার-অফেন্সিভ রাশিয়াকে বাধ্য করবে জ্যাপরিঝিয়া থেকে রুশ সৈন্যকে খেরসনে নিয়ে আসতে, যা আবার জ্যাপরিঝিয়ায় যুদ্ধ করা ইউক্রেইনীয় বাহিনীকে সুবিধা দেবে।

সর্বোপরি, গত কয়েক সপ্তাহে ফ্রন্ট লাইনে খুব বেশি পরিবর্তন নাহলেও বাখমুত ও খেরসনে ইউক্রেইন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তাই ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের আগে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেন আরো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখায় কিনা তা নিয়ে চোখ রাখতে হবে। উল্লেখ্য, ইউক্রেইন এখনও তার পশ্চিমা-সমর্থিত ব্রিগেডগুলোর বেশিরভাগকেই যুদ্ধে ব্যবহার করতে শুরু করেনি। আর আগামী সপ্তাহগুলোতে যদি এগুলো যুদ্ধে ভাল ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারে ও উল্লেখযোগ্য অঞ্চল পুনরুদ্ধার  করতে পারে তবে জেলেনস্কি রাশিয়ার বর্তমান অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার সুবিধা নিতে পশ্চিমাদেরকে ইউক্রেইনে তাদের অস্ত্র সরবরাহ ত্বরান্বিত করতে রাজি করাতে সক্ষম হতে পারেন।

তথ্যসূত্র

1 – https://twitter.com/wartranslated/status/1673278004707901443/photo/1
2 – https://twitter.com/GeromanAT/status/1674363296256761858/photo/1
3 – https://twitter.com/NOELreports/status/1674329533497896960?s=20
4 – https://www.nytimes.com/interactive/2023/06/16/world/europe/ukraine-kakhovka-dam-collapse.html
5 – https://twitter.com/Textyorgua_Eng/status/1673382315915870208/photo/1
6 – https://twitter.com/visegrad24/status/1672652041435398144?s=20
7 – https://twitter.com/squatsons/status/1673777838376497152?s=20
8 – https://twitter.com/LvivJournal/status/1674404453393350656/photo/1

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.