চীনের মুদ্রার সাম্প্রতিক পতন ও এর ফলে আসন্ন ক্ষতি

সাম্প্রতিক ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়, পিপলস ব্যাংক অফ চায়না বা পিবিওসি ইচ্ছাকৃতভাবে তার মুদ্রা ইউয়ান এর অবমূল্যায়ন করেছে, যাতে চীনা রফতানি প্রতিযোগিতামূলক থাকে এবং চীনের উত্পাদন খাতকে উদ্দীপিত করে। কিন্তু, গত কয়েক মাসে, ডলারের সাথে সুদের হারের ডাইভার্জেন্স এবং চীনের সাধারণ অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে ইউয়ানের মান পিবিওসি আপাতদৃষ্টিতে যা চায় তার চেয়ে আরও হ্রাস পেয়েছে, আর সোমবার ইউয়ানের আরও তীব্র পতন হয়েছে। তাই এখানে পিবিওসি কীভাবে ইউয়ান নিয়ন্ত্রণ করে, কেন এটি হ্রাস পাচ্ছে এবং কেন এটি সিসিপির জন্য খারাপ খবর সেটাই আলোচনা করা হচ্ছে…

ইউয়ানের ইতিহাস

সবচেয়ে সাম্প্রতিক সংবাদগুলিতে যাওয়ার আগে, ইউয়ানের একটি দ্রুত ইতিহাস বলে নিচ্ছি। মূলত ৮০র দশকের আগে, ইউয়ান আসলে অত্যধিক মূল্যায়িত কারেন্সি। সেই সময় অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো, চীনা সরকার ডলারের সাথে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হারে এর মূল্য নির্ধারণ করেছিল, তবে তারা ইউয়ানকে সেই হারকে তার চেয়ে বেশি নির্ধারণ করেছিল কারণ তারা ভেবেছিল যে এটি তাদের ক্রয় ক্ষমতার জন্য ভাল হবে। এর কারণ হল ইউয়ানের স্থির বিনিময় হার যা হওয়া উচিত তার চেয়ে বেশি করে চীন আরো বেশি জিনিস কিনতে বা আমদানি করতে চেয়েছে।

কিন্তু ৮০র দশকে চীন তার মূলধন নিয়ন্ত্রণ বা ক্যাপিটাল কন্ট্রোল প্রয়োগ করা নিয়ে ঝামেলায় পড়লে ও ইউয়ান চাপের মধ্যে পড়লে তারা ধীরে ধীরে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু করেছিল। তখনও এর একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হার ছিল, তবে ডলারে ইউয়ানের সংখ্যা ধীরে ধীরে ১৯৮০ সালে প্রতি ডলারে ১.৬ থেকে ১৯৯৩ সালে ৫.৮ হয়ে যায়। আর এরপর ১৯৯৪ সালে পিপলস ব্যাংক অব চায়না হঠাৎ করে ইউয়ানকে ডলার প্রতি ৫.৮ ইউয়ান থেকে এক তৃতীয়াংশ অবমূল্যায়ন করে ৮.৭ ইউয়ানে নামিয়ে আনে। এটি মূলত ইউয়ানকে অত্যধিক মূল্যায়িত থেকে নাটকীয়ভাবে অবমূল্যায়নে নিয়ে যায়। চীনের ৮০ এর দশক ও ৯০ দশকের প্রথম দিকের বাণিজ্য ঘাটতি থেকে ২০০০ এর দশকে বাণিজ্য উদবৃত্তে চলে যাবার পেছনে যেসব কারণ কাজ করেছিল, এটি ছিল তার অন্যতম প্রধান কারণ।

মূলত, ৮০ এবং ৯০ এর দশকে যখন মুদ্রার অত্যধিক মূল্য ছিল, তখন চীন বিক্রির চেয়ে বেশি জিনিস কিনছিল। কিন্তু ৯০ এর দশকের শেষের দিকে ও ২০০০-এর দশকে তা পাল্টে যায়। চীনের মুদ্রা এখন অবমূল্যায়িত ছিল, যার অর্থ চীনা উত্পাদিত পণ্যগুলি বাকি বিশ্বের কাছে অত্যধিক সস্তা ছিল, তাই চীন ক্রয়ের চেয়ে বেশি বিক্রি করেছিল। ১৯৯৫ সালের মধ্যে ডলারের বিপরীতে ৮.৩ ইউয়ান ধার্য করা হয়, আর ২০০৫ সালের মাঝ অব্দি এটাই বজায় থাকে। পূর্বে যদি ইউয়ানকে অবমূল্যায়িত নাও করা হতো, তবুও টানা দশ বছর যাবৎ ধরে ডলারের সাথে এর বিনিময় হারকে স্থির করে রাখার জন্য অবশ্যই এটি অবমূল্যায়িত হয়ে যেত। আর এর কারণ ছিল ১৯৯৫ থেকে ২০০৫ – এই দশ বছরের মধ্যে চীন দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল এবং যখন বিদেশীদের চীনে বিনিয়োগ করতে উত্সাহিত করা হয়েছিল, যেখানে চীনের জনগণের তাদের অর্থকে দেশের বাইরে পাঠাতে পারত না।

সাধারণত এই দুটি ফ্যাক্টরই মুদ্রার মান বাড়িয়ে তুলবে, কিন্তু চীন সিদ্ধান্ত নেয় যে, তাদের অর্থনীতির জন্য কম মূল্যায়িত মুদ্রাই আসলে ভাল, কারণ সেটা চীনের রফতানিতে সহায়তা করছিল। ব্যাংক অফ ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের অনুমান অনুযায়ী, প্রতি ডলারে ৮.৩ ইউয়ান বজায় রেখে চীন কার্যকরভাবে ‘৯৫ থেকে ‘০৫ এর মধ্যে তার মুদ্রার আরও ২০% অবমূল্যায়ন করেছে। ২০০৫ সালে চীন অবশেষে ইউয়ানকে কিছুটা পতনের অনুমতি দেয়, যা তারা করেছিল ইউয়ানকে নির্দিষ্ট স্থির মান থেকে ম্যানেজড ফ্লোট-এ নিয়ে এসে। এটা ইউয়ানকে কিছুটা পরিবর্তিত হবার সুযোগ দেয়। এখানে প্রতিদিন সকালে বেইজিং সময় সোয়া নয়টায় পিবিওসি একটি তথাকথিত রেফারেন্স রেট নির্ধারণ করা হবে এবং ইউয়ানকে সেই হারের উভয় পাশে কয়েক শতাংশ পয়েন্টের মধ্যে ট্রেড করার অনুমতি দেয়া হবে। প্রাথমিকভাবে, চীন ইউয়ানকে ২০০৬ সালে রেফারেন্স রেটের ০.৩% এর মধ্যে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়। এরপর তা ২০০৬ সালের মে মাসে ০.৫%, ২০১২ সালের এপ্রিলে ১% এবং ২০১৪ সালের মার্চের মধ্যে ২%-এ প্রসারিত হয়। এই নতুন পরিচালিত হার পিবিওসিকে কিছুটা নমনীয়তা দেয় এবং তাদের চীনের মুদ্রাকে কম মূল্যায়িত রাখার অনুমতি দেয়, যা চীনের রফতানিকে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতামূলক রাখে।

বর্তমান অবস্থা ও তার কারণ

কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ইউয়ান ডলারের বিপরীতে তীব্রভাবে হ্রাস পেতে শুরু করেছে, আর এবার মনে হচ্ছে না যে পিবিওসি আসলে এমনটা চায়। এই বছরের শুরুতে প্রতি ডলারে ৬.৭ ইউয়ান পাওয়া যেত, কিন্তু আজ ইউয়ানের মান কমে এখন ডলার প্রতি ৭.২ ইউয়ান পাওয়া যাচ্ছে। আর সর্বশেষ স্লিপটি কেবল সোমবার এসেছিল যখন ইউয়ান আরও ০.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল। অন্যান্য মুদ্রার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনটা অত নাটকীয় কিছু ছিলনা। কিন্তু যদি সেটা হয় ইউয়ান, যা কিনা ব্যাপকভাবে ট্রেড করা হয়, আর সেই সাথে তার বিনিময় হারও সক্রিয়ভাবে পিবিওসি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে অবশ্যই এটা যথেষ্ঠ নাটকীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। চীনের সংক্ষিপ্ত সময়ের লকডাউনের কথা বাদ দিলে ২০০৮ সালের ক্রাইসিসের পর থেকে এটা ইউয়ানের সর্বনিম্ন মান।

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? তবে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হলো চীনের সাধারণ অর্থনৈতিক দুর্দশা। এটা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আলাদাভাবে লিখতে হবে। তবে কিছু কথা বলে রাখি। এই বছরের শুরুতে মনে হয়েছিল যে চীনা অর্থনীতি মহামারী পরবর্তী জীবনে ফিরে আসছে। প্রপার্টি মার্কেটে আবাসনের বিক্রয় আশাব্যঞ্জক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দুর্বল বৈশ্বিক চাহিদা সত্ত্বেও মার্চ মাসে চীনা রফতানি বেড়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের অর্থনীতি এই বছরের প্রথম কোয়ার্টারে ৪.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিশ্লেষকদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, চীন এ বছরের জন্য সিসিপির ৫% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা করছিল।

তবে চলতি মাসের শুরুতে প্রকাশিত মে মাসের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিকের তুলনায় পরিস্থিতি খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। চীনা ভোক্তারা কম ব্যয় করছে, চীনা কারখানাগুলি কম উত্পাদন করছে, এবং চীনের ঋণে জর্জরিত প্রপার্টি মার্কেট (যা চীনের সমস্ত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ৩০% এর মতো) আরেকটি মন্দার দিকে যাচ্ছে। এই মন্দা চীনের যুব বেকারত্বের সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে এবং মে মাসের মধ্যে চীনের শহুরে যুব বেকারত্বের হার ২০.৮%-তে পৌঁছেছে, যা ২০১৮ সালে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর সর্বোচ্চ। এই বিষয়গুলো সম্মিলিতভাবে ইউয়ানের বিক্রয় বাড়িয়ে দিয়েছে, যা চীনের রফতানির দুর্বল পারফরম্যান্সের কারণে আরও খারাপ হয়েছে, আর সেটা এই বছরে ৭.৫% হ্রাস পেয়েছে।

তবে এটি কেবল সাধারণ অর্থনৈতিক অস্থিরতা নয়। আরেকটি যে কারণে এই সমস্যাটি দেখা যাচ্ছে তা হ’ল সুদের হারের সমস্যা। মূলত, যখন কোনও দেশ সুদের হার বাড়ায়, তখন এটি সাধারণত তার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে, কারণ মানুষ তখন মুদ্রা দিয়ে কিছু না কিনে তা সঞ্চয় করতে চায় (কারণ সুদের হার বাড়ায় অর্থ ব্যাংকে সঞ্চয় করলে বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে), আর এর ফলে সেই মুদ্রার চাহিদা বাড়ে আর তা শক্তিশালী হয়। এই কারণেই মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ আমেরিকায় সুদের হার বাড়ানোর সাথে সাথে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। বিপরীতে, যেহেতু দুর্বল অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে চীনে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে না, পিবিওসি সুদের হারও বাড়াচ্ছে না, এবং এই মাসের শুরুতে, তারা আসলে দেশে প্রোডাক্ট ও সার্ভিসের চাহিদা উত্সাহিত করার জন্য সুদের হার হ্রাস করেছে (যাতে মানুষ বেশি করে ঋণ করে ও ভোগ করে, কারণ সেটাও চীনের জিডিপি গ্রোথের জন্য দরকারি, যেহেতু তারা ৫% প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে)। দুই দেশে সুদের হারের এই ভিন্নতা ও ব্যবধান বৃদ্ধি পাওয়া, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ সুদের হার এবং চীনে নিম্ন সুদের হার সম্প্রতি ইউয়ানের মান ডলারের তুলনায় কমে যাবার দ্বিতীয় কারণ।

এখন, ইউয়ানের এই পড়তি মানের ব্যাপারটি চীনের জন্য খুব বেশি যে খারাপ হবে তা নয়, কারণ ইউয়ান সস্তা হলে তা চীনের রফতানিকে আরও প্রতিযোগিতামূলক রাখছে। কিন্তু চীন এখন তাদের অর্থনৈতিক মডেল কিছুটা পরিবর্তন করতে চাইছে। চীনের প্রবৃদ্ধি এতদিন কেবল আন্তর্জাতিক রফতানির উপরই নির্ভর করতো, দেশের অভ্যন্তরে কনজাম্পশন খুব কম ছিল, নাগরিকের ক্রয়ক্ষমতা কম থাকার কারণে। সেখান থেকে চীন এখন চাইছে দেশে অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি পাক, যাতে দেশটি অধিকতর টেকসই অর্থনৈতিক মডেলের দিকে যায় ও তার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে (কারণ পূর্বের ওই মডেলের খারাপ দিকগুলো এখন চীনের অর্থনীতিকে আঘাত করছে)। কিন্তু ইউয়ানের এই নিম্ন মান চীনের এই নতুন লক্ষ্য পূরণে বাধার সৃষ্টি করবে। কারণ দুর্বল ইউয়ান সাধারণ চীনা নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করবে, তাদের খরচ হ্রাস করবে এবং দেশটির রফতানিকে আরো উত্সাহিত করবে। এটা দেশের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি ও চীন এখন যে সমস্যাগুলো থেকে বের হতে চাইছে সেটা করতে বাধার সৃষ্টি করবে। চীন যে ঋণ সংকট বা ডেট ক্রাইসিসে ভুগছে এই দুর্বল ইউয়ান তাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, বিশেষত প্রপার্টি সেক্টরে যেখানে অনেক প্রপার্টি ডেভলপার ডলারে লোন নিয়েছে, কিন্তু ইউয়ানের তুলনায় ডলারের দাম এখন বেড়ে যাওয়ায় সেটার ঋণ পরিশোধ করা আরও কঠিন হয়ে যাবে। অর্থাৎ চীনের এক্সিস্টিং ডেট ক্রাইসিস আরো বাড়ছে।

সর্বোপরি, যদিও ইউয়ানের মান কমে যাবার এই সমস্যাটি চীনের জন্য মারাত্মক নয়, এই দুর্বল ইউয়ান চীনা অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারীদের কনফিডেন্স বা আস্থা হ্রাস করবে, এবং এটি প্রায় নিশ্চিতভাবে চীনা অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার সিসিপির প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে। এখন যেটা দেখতে হবে তা হচ্ছে চীন কীভাবে এই সংকটের প্রতিক্রিয়া জানায়…

তথ্যসূত্র

1 – https://www.macrotrends.net/2575/us-dollar-yuan-exchange-rate-historical-chart
2 – https://www.macrotrends.net/countries/CHN/china/trade-balance-deficit#:~:text=External%20balance%20on%20goods%20and,a%2030.16%25%20increase%20from%202020.
3 – KLEIN, MATTHEW C., and MICHAEL PETTIS. Trade Wars Are Class Wars: How Rising Inequality Distorts the Global Economy and Threatens International Peace. Yale University Press, 2020
4 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2022-09-02/from-fixing-to-signaling-how-china-manages-the-yuan-quicktake
5 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2022-09-02/from-fixing-to-signaling-how-china-manages-the-yuan-quicktake
6 – https://www.ft.com/content/bc1b3695-b832-4d99-8712-fc9b53984acb
7 – https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-04-13/chinese-exports-unexpectedly-rise-in-positive-sign-for-economy
8 – https://www.ft.com/content/e2aaaa56-5dee-41be-9ed4-181496de6bf3
9 – https://www.ft.com/content/0ae934ac-29c6-4ac0-aea2-a33e9388f47e

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.