এরদোয়ানের ইউ-টার্ন, তুরস্কে সুদের হার বৃদ্ধি, কিন্তু পতনশীল অর্থনীতিকে বাঁচাতে পারবে কি?

একটি দেশে যদি ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে যায়, তাহলে এর সমাধান হিসেবে প্রথমেই যেটা করা হয় তা হচ্ছে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া। মূলত দু’ভাবে এটা বর্ধিত ইনফ্লেশন রেটকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সহায়তা করে – প্রথমত, এর ফলে মানুষ ব্যাংক থেকে কম ঋণ নেয়, ফলে কম ব্যয় করে ও বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে যায়, যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে, আর দ্বিতীয়ত, সুদ বেশি হলে বিদেশী বিনিয়োগ বেশি আসে, কারণ বেশি সুদের দেশে বিনিয়োগ করে লাভ বেশি হয় আর এটাও মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনায় অবদান রাখে। কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বরাবরই ভিন্ন রাস্তায় হেঁটেছেন। সুদ বা সুদের হার বৃদ্ধিকে কখনোই তিনি ভাল নজরে দেখেননি। তুরস্কের মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির পরও তিনি সুদের হার বাড়াতে দেননি, আর তার ফলে তুরস্কের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও বাজে হয় [৩]। এর প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়, আর এই নির্বাচনে এরদোয়ানের ভোট পার্সেন্টেজ এত বেশি ড্রপ করার অন্যতম কারণ হিসেবেও তার এই একগুঁয়ে অর্থনৈতিক অবস্থানকেই দায়ী করা হয়। আর সেজন্য এরদোয়ানও এবারে ক্ষমতায় এসে সুদের হার বৃদ্ধি নিয়ে তার নীতির পরিবর্তন করলেন। অবশেষে…

হ্যা, এরদোয়ান ইউ-টার্ন নিয়েছেন। এতদিন খুব কষ্ট করে হলেও সুদের হার না বাড়িয়েই এরদোয়ান একরকম ম্যানেজ করছিলেন, কিন্তু তাতে খুব একটা ভাল কিছু হয়নি, বরং সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ দিকে চলে যাচ্ছিল। এরপর গত মাসে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করে যে তাদের অর্থ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দেশটার জন্য বা এরদোয়ানের জন্য এখন ইউ-টার্ন নেয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে। শেষমেষ এই বৃহস্পতিবার দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর সুদের হার ৮.৫% থেকে বাড়িয়ে ১৫% করে দিলেন [১২]। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশটির অর্থনীতি যে অবস্থায় চলে গেছে, এই অবস্থায় একে পুনরায় সচল করার জন্য কি কেবল সুদের হার বৃদ্ধি যথেষ্ট? ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই এখন আলোচনা করা হবে। উল্লেখ্য, সুদের হারের এই বৃদ্ধির পরেই দেখা যায় বাজারে লিরার মান আরও কমে গেছে, এখন এখন এক ডলারের দাম ২৫ লিরার উপরে [১৩]।

শুরু থেকে বলছি। তুর্কি অর্থনীতি কয়েক বছর ধরেই খুব বাজে অবস্থায়। লিরার মানের হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও, এরদোয়ান সুদের হার বাড়াতে অস্বীকার করে এসেছেন কারণ তার চোখে সেটা অনৈসলামিক এবং তথাকথিত ইন্টারেস্ট রেইট লবির ষড়যন্ত্র [৪]। উল্টে তিনি সুদের হার হ্রাস করেছেন এবং কোনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকারকে তার বিরোধিতা করলেই তাকে বরখাস্ত করেছেন। আর তার এই নীতিগুলো লিরাকে পঙ্গু করে দেয় ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করে [৯]।

তুরস্কের দেখানো হিসেব অনুযায়ী দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার গত বছরের অক্টোবরে শীর্ষ ৮৫.৫%-এ পৌঁছেছিল, আর এই মে মাসে এটি ৪০%-এ নেমে এসেছে। তবে মুদ্রাস্ফীতির হার কমে এলেও এর অর্থ হ’ল গত দুই বছরে দেশটির দ্রব্যমূল্য প্রায় ১৫০% বেড়েছে। তবে এটা তুরস্কের সরকারী হিসাব। আনঅফিশিয়াল হিসাবগুলো অন্য কিছু দেখায়। যেমন Istanbul Ticaret Odasi বলছে মে মাসে ইনফ্লেশন রেইট ছিল ৭৩%, আর ENAG বলছে এটি ছিল ১০৫%, মানে তুরস্ক যা দাবি করেছে, তার থেকে অনেক বেশি [১]। 

যাই হোক, এখন সুদের হার তো কমানো যাবে না, তাহলে উপায়? এই অবস্থায় তুরস্কের সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার না বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে [৩]। যেমন, দেশটি প্রথমে মূলধন নিয়ন্ত্রণ শুরু করে, কিন্তু সেটা তুর্কি নাগরিক এবং বিজনেসগুলোর জন্য তাদের লিরা বিক্রি করা আরও কঠিন করে তোলে। এরপর এরদোয়ান তার দেশের প্রধান রপ্তানিকারকদেরকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের কমপক্ষে ২৫%-কে লিরাতে রূপান্তর করতে বাধ্য করে। দেশটি “সোনার বিনিময়ে নতুন লিরা” নাম একটা স্কিম তৈরি করেছিল, যেখানে রাষ্ট্র দেশটির নাগরিকদের সোনার বিনিময়ে নতুন লিরা প্রদান করছিল, উদ্দেশ্য ছিল দেশটিতে স্বর্ণের রিজার্ভ বাড়িয়ে লিরাকে স্থিতিশীল করা [৩]। এদিকে লিরার দাম কমতে থাকায় মানুষ তাদের লিরা দিয়ে ডলার কিনছিল, এরকম পরিস্থিতিতে যা হয় আরকি। কেননা লিরার মান এত দ্রুত বেগে কমার মানে হল আজ ১০০ ডলার যে দামে কিনব, কাল সেই ১০০ ডলার তুলনায় অনেক বেশি দামে বিক্রি করব, মানে লাভ। কিন্তু এরকমটা দেশের অর্থনীতির জন্য খুব ক্ষতিকর, কেননা তাতে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যায়। 

তাই এটা আটকাবার জন্যেও এরদোয়ান লিরা ডিপোজিট স্কিম নাম একটা স্কিম চালু করেন [২]। এক্ষেত্রে ব্যাংক বা ক্রেডিট ইউনিয়নের মতো বিভিন্ন ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনে যাদের লিরা ডিপোজিট বা লিরা আমানত রয়েছে তাদের এটা সুবিধা দান করে। এক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে যাতে সেই লিরা ডিপোজিটের দাম না কমে তাই লিরার ম্যান কমলে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, যাতে লিরার কনফিডেন্স বজায় থাকে, অর্থাৎ এরা লিরা বেচে ডলার না কেনে। তো স্কিমগুলো কতটা ভালভাবে এক্সিকিউট করা হয়েছে কে জানে, কিন্তু যদি ঠিক মত বাস্তবায়ন হয়, বিশেষ করে শেষেরটি ঠিক মত বাস্তবায়ন হয় তাহলে বলতে হবে তা সাধারণ তুর্কি জনগণের আমানতকে ঝুঁকিমুক্ত করেছে, আর এজন্যই এই স্কিমগুলো পপুলারও হয়ে থাকবে। এখন মুদ্রাস্ফীতির মোকাবেলায় এগুলো কতটা কার্যকর সেই আলাপ পরে হবে, কিন্তু কেবল আমানত ঝুঁকিমুক্ত করাটা হয়তো এরদোয়ানকে নির্বাচনের আগে আগে ভালোই পলিটিকাল ক্যাপিটাল দিয়ে থাকবে, যা তার নির্বাচনে জয়লাভ হয়তো অবদান রাখে। (নির্বাচনের আগে পর্যন্ত সুদের হার বৃদ্ধি আটকে রাখাটাও এমনই একটি চাল হয়ে থাকতে পারে, যা দেশের সুদ বা সুদের বর্ধিত হার পছন্দ না করা রক্ষণশীলদের হাতে রাখাকে নিশ্চিত করেছিল। নির্বাচনের পরপরই নিজের অবস্থান থেকে ইউ টার্ন নেয়াটা হয়তো এটাই ইঙ্গিত করে। সেই সাথে অনেকেই বলেন, ইকোনোমি আরো বাজে হয়ে যাতে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা আরও কমিয়ে না দেয় সেই ভয়েই তিনি নির্বাচনের ডেইট ১৮ই জুন থেকে এক মাস এগিয়ে ১৪ই মে-তে নিয়ে আসেন।)

আসল কথায় আসা যাক। এই সমস্ত স্কিমগুলির পরেও, লিরার মানের হ্রাস অব্যাহত ছিল যা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাধ্য করেছিল বাজারে হস্তক্ষেপ করতে [৩]। মূলত, লিরাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিক্রি করে লিরা কিনতে শুরু করে। এটার উপকারী দিকটা হচ্ছে, এতে লিরার মূল্য কৃত্রিমভাবে বেড়ে যায়, আর তার ফলে মুদ্রাস্ফীতি কম হয়। এই পদ্ধতিকে মুদ্রার রক্ষা বা ডিফেন্ডিং বলে। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগেই কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে এত এত ফরেইন রিজার্ভ ডিপ্লেট করে এই কাজটা করবে? এর কারণ ছিল – (১) ইনভেস্টর বা বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পেরেছিল যে নির্বাচনে এরদোগানই জিতবে, আর তারা এরদোগানের আচরণ সম্পর্কেও ভালোই জানত, জানতো যে এরদোয়ানের যা ইকোনোমিক পলিসি তাতে এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পরও মুদ্রাস্ফীতি চলতে থাকবে, আর তাই তারা তাদের লিরা বিক্রি করতে মরিয়া হয়ে যায় ও বিক্রি করতে শুরু করে। এর ফলে দেশটির ইকোনোমি আরও খারাপ হবার সম্ভাবনা দেখা যায়, মুদ্রাস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকাবার চেষ্টা করেছিল। আর (২) কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায়নি যে নির্বাচনের আগে এরদোয়ান কোন বোরো রকমের ইকোনোমিক ক্রাইসিসের মুখে পড়ুক, আর তাই তারা এরদোয়ানকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ও এই স্টেপ নেয় [৫]। 

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেন এর্দোয়ানকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে? এর কারণ হতে পারে নির্বাচনের পূর্বে দেশের পলিটিকাল স্ট্যাবিলিটি ধরে রাখা যা ব্যাহত হলে দেশের ইকোনোমিতেও টানাপোড়েনের সৃষ্টি হবে; আবার হতে পারে তারা তুরস্কের সরকার ও এরদোয়ানের প্রেসিডেন্সিয়াল পাওয়ারের রেপুটেশনকে আক্রান্ত হতে দিতে চায়নি, কারণ সেটাও দেশের ইকোনমিতে হুমকির সৃষ্টি করতে পারে। আবার এটাও হতে পারে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বুঝে গেছিল যে এরদোয়ানই নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে, আর তাই তারা যদি এরদোয়ানকে সাপোর্ট না দেয় তাহলে পুনরায় ক্ষমতায় এসে এরদোয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হস্তক্ষেপ বাড়াতে পারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ক্ষমতাসীন সরকারের সাপোর্ট কমে গিয়ে ইকোনোমিতে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে, আর তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সবসময় মার্কেট এক্সপেক্টেশন আর পোটেনশিয়াল ইলেকটোরাল আউটকাম মানে সামনের নির্বাচনে কে জিততে পারে তা চিন্তা করেই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্কেট কনফিডেন্স কমে যায়, মার্কেট আর্টিসিপেন্টরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। সব মিলে বলতে গেলে, সেন্ট্রাল ব্যাংকের অনেক সিদ্ধান্তেই ইকোনমিকসের সাথে পলিটিক্স সম্পর্কিত থাকে, এগুলো বুঝে নিতে হবে।

তো তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংক শুধু এই মে মাসেই প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার এবং নির্বাচনের আগের সপ্তাহে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার ডিপ্লেট করে দেয় [৬]। আর এভাবে তুরস্ক তাদের নিজস্ব রিজার্ভ শেষ করার পর বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলির কাছে সহায়তা চাইতে শুরু করে। এর ফলে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সৌদি আরবের কাছ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের ডিপোজিট বা আমানত লাভ করে, সেই সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে উদার সোয়াপ লাইন লাভ করে [৭]। সোয়াপ লাইন হল সেই ব্যবস্থা যার মাধ্যমে কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য মুদ্রার সমতুল্য পরিমাণের বিনিময়ে অন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার মুদ্রার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ দিতে সম্মত হয়। এক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ, সুদের হার এবং সময়কলের সহ বিনিময়ের বিভিন্ন শর্তাবলী থাকে। তুরস্ক দেশগুলোর সাথে যে সোয়াপ লাইনে যায় তার শর্তগুলো তুরস্কের জন্য উদার বা অনুকূলই ছিল।

কিন্তু দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে এটাও তুরস্কের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। আর যখন দেখা যায় এটা যথেষ্ট নয়, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশটির কয়েকটি ক্ষুদ্রতর ব্যাংক সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আরও বৈদেশিক মুদ্রা ধার নেওয়া শুরু করতে হয়েছিল [৮]। জেপি মরগানের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট রিজার্ভ নেতিবাচক হয়ে গেছে। এর অর্থ হ’ল তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আসলে তার হাতে যত বৈদেশিক মুদ্রার রয়েছে, তার চেয়েও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা ধার করেছে, যা দেশটিকে নিয়ে গেছে এক অনিশ্চিত অবস্থানে [৮]। অবশ্য এর মানে এই নয় যে তাদের অর্থ ফুরিয়ে গেছে, কেননা এখনও তারা প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক, তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের দেন ১০০ বিলিয়নেরও বেশি। তার মানে তাদের কাছে যত আছে, ধার করেছে তার চেয়ে বেশি। মানে নেট অর্থ নেগেটিভ [৮]। 

সব মিলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল যে, এরদোয়ানের সময় ফুরিয়ে আসছে। তার যা যা করার ছিল, যার যার কাছ থেকে সহায়তা নেবার ছিল, সব ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব বাজে। আর কয়েক সপ্তাহ আগে লিরা মার্কিন ডলারের তুলনায় তদকালীন সময়ের সর্বকালের সর্বনিম্ন স্তরে ট্রেড করছিল, যা ছিল প্রতি ডলারের বিনিময়ে ২৩.৫ লিরা [৫]। অবস্থা যখন এই, তখন এরদোয়ান শেষ পর্যন্ত তার নিজের নীতি থেকে ইউ-টার্ন নেয়া শুরু করেন, যা আলামত পাওয়া যায় মে মাসের শুরুতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আগের লোকদের বাদ দিয়ে নতুন লোকজনকে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে [৪]। নিশ্চিতভাবেই এই ইউ-টার্ন এরদোয়ানের জন্য বিব্রতকর, সেই সাথে তার জনপ্রিয়তাকেও হ্রাস করবে। কিন্তু তাতে এরদোয়ানের কী এমন আসে যায়? ইতিমধ্যেই নির্বাচনে জিতে তিনি আরো ৫ বছরের ক্ষমতা নিশ্চিত করে ফেলেছেন। তাই এই ইউ-টার্ন আর তার নির্বাচনী সম্ভাবনাকে হুমকিতে ফেলছে না [৪]।

তো দেখা যাক তিনি কিভাবে ইউ-টার্নটা নিলেন। এর জন্য তিনি যাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুজন প্রধান নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মেহমেত সিমসেক (Mehmet Simsek), যিনি ৩রা জুন তুরস্কের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন; আরেকজন হচ্ছেন হাফিজে গায়ে এরকান (Hafize Gaye Erkan), যিনি ৯ই জুন তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন [১০]। এই দুজনই দেশটির মার্কেট পার্টিসিপেন্ট, ইনভেস্টর ও ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোর খুব পছন্দের। তারা উভয়ই এটি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে তারা এরদোয়ানের অপ্রচলিত আর্থিক নীতির সাথে একেবারেই একমত নন, এবং তারা উভয়ই তাদের ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় বড় বড় পশ্চিমা ব্যাংকে কাটিয়েছেন [১০]। তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হবার আগে এরকান ছিলেন ইউএস এর ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের কো-সিইও এবং প্রেসিডেন্ট, আর তারও আগে তিনি গোল্ডম্যান স্যাকসে কাজ করতেন। আর সিমসেক ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তুরস্কের অর্থমন্ত্রী হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শন করেছিলেন, আর তার আগে তিনি ইউএস এর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক মেরিল লিঞ্চের উদীয়মান বাজার বিভাগ বা এমার্জিং মার্কেট ডিভিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন [১০]।

যাই হোক, এই নতুন নিয়োগগুলো স্পষ্টতই তুরস্কের অর্থনৈতিক নীতিতে একটি ইউ-টার্নের ইঙ্গিত দিয়েছিল। বাজার বুঝতে পেরেছিল যে এবারে যোগ্য লোকেরাই দেশটির অর্থনীতির হাল ধরছে [১১]। আর এতে একরকম ফলও পাওয়া যায়। এটা ঠিক যে, জুনের প্রথম কয়েক দিনে, লিরা প্রতি ডলারে ২১ থেকে প্রায় ২৪ লিরাতে নেমে এসেছিল, তবে এরকানের নিয়োগের পরে লিরা সেই স্তরেই স্থিতিশীল হয় [১১]। কয়েক সপ্তাহ পর, সিমসেক অবশেষে এরদোয়ানকে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে রাজি করান এবং বৃহস্পতিবার তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশেষে ঘোষণা করে যে তারা তার বেঞ্চমার্ক রেইট ৮.৫% থেকে বাড়িয়ে ১৫% শতাংশ করবে, আর ইঙ্গিত দেয় যে ভবিষ্যতে তা আরও বৃদ্ধি হবে [১২]।

তবে দুর্ভাগ্যবশত এরপরও এরদোয়ান এবং তুরস্কের জন্য খারাপ সংবাদ এসেছে, এই পরিবর্তন বাজারের সাথে ভাল যায়নি, এবং লিরার মান আরও কমে এখন এক ডলারের দাম ২৫ লিরা [১৩]। কেন  এমনটা হল? কারণ বাজারগুলি আশা করেছিল যে, এই সুদের হার বেড়ে ১৫% নয়, আরও বেশি করা হবে, কারণ বাজারগুলো তুরস্কের সরকারি হিসেবে যে ৪০% মুদ্রাস্ফীতির হার দেখানো হয়েছে তা বিশ্বাসই করেনা, তাদের মতে এই হার আরও অনেক বেশি (অনানুষ্ঠানিক মতে এই হার কত তা আগেই বলা হয়েছে)। অর্থাৎ তাদের মতে সুদের হার বা ইন্টারেস্ট রেইট ১৫% করলেও তাতে সমস্যার সমাধান হবে  না কেননা দেশটির প্রকৃত ইনফ্লেশন রেইট সরকারের দেখানো ৪০% নয়, বরং আরও বেশি। 

ব্যাপারটা বোঝার জন্য নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট নামে একটা কনসেপ্ট বোঝা দরকার। যদি কোন দেশের ইনফ্লেশন রেইট দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নমিনাল ইন্টারেস্ট রেইটের চেয়ে বেশি হয় তাহলে নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট তৈরী হয়, আর এর মান পাওয়া যায় দুটোর পার্থক্য থেকেই। কোন দেশে নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট থাকার অর্থ হচ্ছে দেশটির মুদ্রার মূল্য কমছে। আর এর মান যত বেশি হবে মুদ্রার মান তত দ্রুত হ্রাস পায়। তুরস্কের ৪০% ইনফ্লেশন রেইটের সরকারি হিসাব অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমিনাল ইন্টারেস্ট রেইট ১৫% করে দেয়ার পর দেশটির নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট হচ্ছে ৪০-১৫ = ২৫%। কিন্তু তুরস্কের বাজারগুলো এই হিসাব মানে না, তারা মনে করে দেশটির নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট আরও অনেক বেশি (কেননা তাদের মতে দেশটির ইনফ্লেশন রেইট অনেক বেশি। অনানুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী সেই ইনফ্লেশন রেইট কত তা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে)। উল্লেখ্য, গোল্ডম্যান স্যাকস পূর্বাভাস দিয়েছিল যে দেশটির নেগেটিভ রিয়্যাল ইনফ্লেশন রেইট ৪০%-এ জাম্প করবে [৯]।

বাজারের এই নতুন মোড়ের কারণে স্পষ্টতই এরদোয়ান ও তার নতুন দলের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বাজারগুলি আশা করেছিল যে, ইন্টারেস্ট রেইট বা সুদের হার ১৫% নয়, বরং আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। আর সম্ভবত সেটাই একমাত্র উপায় যা লিরার পতন থামাতে পারে। তবে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে তুরস্কের অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হবে। উদাহরণস্বরূপ তুরস্কের আবাসন বাজার বা হাউজিং মার্কেটের কথাই ধরা যাক। তুরস্কে বাড়ির দাম সম্প্রতি আকাশছোঁয়া হয়েছে কারণ তুর্কিরা তাদের ক্রমহ্রাসমান লিরাকে কাজে লাগানোর জন্য একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজছে। একটু বুঝিয়ে বলি। লিরার মান কমতে থাকা মানে হল আজ একটি জিনিস  কিনতে যত লিরা লাগবে, কাল সেটাই কিনতে আরও বেশি লিরা লাগবে। এর মানে হল যা কেনার আছে শীঘ্রই কিনে ফেলতে হবে, আর হাতে লিরা রাখা যাবে না, কেননা হাতে সঞ্চিত লিরা থাকাটা লস, সেই লিরা দিয়ে এখন যা কেনা যায় দুদিন পর তা আর কেনা যাবে না। এদিকে এরদোয়ান তুরস্কতে প্রচুর হাউজিং প্রজেক্ট করেছিল, হাউজিং মার্কেটকে অনেক প্রিভিলেজও দিয়েছিল। ফলে হাউজিং এর ভালোই সাপ্লাই ছিল। এর ফলে  তুর্কিরা তাদের লিরা দিয়ে হাউজিং বা আবাসন ক্রয় করতে শুরু করে। ইনফ্লেশন বৃদ্ধির ফলে এভাবে ডিমান্ড বাড়ে, কারণ মানুষ তাদের হাতে থাকা মুদ্রা খরচ করে ফেলতে চায়। আর এর ফলে বাজারে আরও বেশি অর্থ প্রবেশ করে ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেয়। আর সেটা আটকাতেই ইন্টারেস্ট রেইট বাড়াতে হয়, যার ফলে মানুষ বেশি সুদের হারের কারণে লোন নিয়ে খরচ করতে না পারে। 

কিন্তু তুরস্ক ইন্টারেস্ট রেইট বাড়ায়নি। তাই মানুষ উল্টে ক্রয় করা বা লিরা খরচ করা বাড়িয়েছে। আর ইনফ্লেশনও বেড়েছে। যাই হোক, এর ফলে দেশটিতে আবাসনের মূল্যও এখন আকাশছোঁয়া। কিন্তু ইন্টারেস্ট রেইট বাড়িয়ে দিলে স্বভাবতই এই সব মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা যেখানে ইতিমধ্যেই দাম আকাশছোঁয়া সেখানে লোনের ক্ষেত্রে সুদের হারও যদি অনেক বেড়ে যায় তাহলে মানুষ আর এই আবাসনের মত প্রোডাক্ট বা সার্ভিস কিনবেই না, ফলে বাজারই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দেশের ইকোনোমিক বাঁচাতে হলে দেশের ইন্টারেস্ট রেইট যতটা বাড়ানো দরকার ততটা বাড়ানো হলে দেশটির হাউজিং মার্কেট ধ্বংস হয়ে যাবার কথা। ব্রেক্সিটের কারণে ইউকে যে অর্থনৈতিক ধাক্কা খেয়েছে, তার ফলে ইউকে বা যুক্তরাজ্যও এই একই রকম ক্রাইসিস ফেইস করছে, কিন্তু তুরস্কের অবস্থাটা আরও অনেক বেশি গুরুতর [৯]।

একটি ইংরেজি প্রবাদ হল “as you sow, so shall you reap” (বাইবেলের গালাতিয়ান ৬:৭ এর “whatsoever a man soweth, that shall he also reap.” থেকে এটা এসেছে, মানে যেরকম বীজ বপন করা হবে, ফসলটাও সেরকম হবে)। এরদোয়ান ঠিক তেমন ফসলই পাচ্ছেন, যেরকম বীজ তিনি বপন করেছিলেন। এরদোয়ান অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন উপায়ে দেশটির ইকোনোমিক কলাপ্স আটকে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এখন সব অপশন ফুরিয়ে গেছে। এখন যা হবে তা সত্যিই বেদনাদায়ক হতে পারে। 

তথ্যসূত্র

  • ১। https://www.duvarenglish.com/chamber-of-commerce-reports-istanbul-inflation-rate-as-73-percent-news-62137
  • ২। https://enagrup.org/
  • ৩। https://www.ft.com/content/246951b4-1bcd-4144-a9c9-33f9f6c3e107
  • ৪। https://www.france24.com/en/europe/20230529-from-inflation-to-nato-turkey-s-erdogan-has-stacked-in-tray-for-last-presidential-term
  • ৫। https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-05-18/turkish-fx-reserves-shrank-by-record-in-week-before-elections
  • ৬। https://www.bloomberg.com/news/articles/2023-05-18/turkish-fx-reserves-shrank-by-record-in-week-before-elections
  • ৭। https://www.reuters.com/world/middle-east/turkish-cenbank-data-shows-3-bln-inflow-abroad-bankers-2023-06-08/
  • ৮। https://www.ft.com/content/246951b4-1bcd-4144-a9c9-33f9f6c3e107
  • ৯। https://www.politico.eu/article/end-recep-tayyip-erdogan-economics-turkey-double-interest-rate-inflation/
  • ১০। https://en.wikipedia.org/wiki/Hafize_Gaye_Erkan
  • ১১। https://www.ft.com/content/4d6a4a42-e000-4cc7-9541-70fd15e405a0
  • ১২। https://www.ft.com/content/4d6a4a42-e000-4cc7-9541-70fd15e405a0
  • ১৩। https://asia.nikkei.com/Economy/Turkey-raises-interest-rate-to-15-from-8.5-to-fight-inflation

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.