রাশিয়ায় প্রিগোজিনের অভ্যুত্থান : পটভূমি, পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ

Table of Contents

ভূমিকা

২৩ শে জুন শুক্রবার রাশিয়ায় এমন কিছু ঘটে যা পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। রাশিয়ায় একটি সামরিক অভ্যুথান শুরু হয়। কেননা ওয়াগনার মার্সেনারি গ্রূপের আধাসামরিক নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার ভূখণ্ড আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার ভারী সশস্ত্র আধাসামরিক বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রোস্তোভ ও দোনেৎস্ক দখল করে নেয়। প্রিগোজিনের সেনাবাহিনী এয়ারফিল্ড সহ শহরের সামরিক সুবিধাগুলি দখল করে। শহরের রাস্তায় যে ট্যাঙ্কগুলি পড়ে ছিল তার একটিতে “সাইবেরিয়া” লেখা ছিল, যার অর্থ প্রিগোজিন পুরো রাশিয়া দখল করতে চেয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান রুশ সরকারকে উৎখাত করা, অন্তত রাশিয়ার জেনারেলরা তাই বলছেন। এদিকে পুতিন প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ এনেছেন। তিনি রাশিয়ার অভ্যন্তরে এই নতুন সংঘাতকে এক শতাব্দী আগে রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। 

সংঘাতের শুরুতে মনে হচ্ছিল এটি পুতিন এবং প্রিগোজিনের মধ্যকার গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। তবে পরে জানা গেল রক্তপাত এড়াতে প্রিগোজিন ২৪ ঘন্টার মধ্যে পিছু হটেছেন। বেলারুশের নেতা লুকাশেঙ্কো দাবি করেছেন যে তিনি একটি শান্তি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেন। কিন্তু সেই শুক্রবার যা ঘটেছিল তা অবশ্যই একটি অদ্ভুত ঘটনা ছিল যা সমস্ত বড় মিডিয়া আউটলেটের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তো এবারে পুতিনের বিরুদ্ধে হওয়া এই প্রথম সামরিক অভ্যুত্থানটি সম্পর্কে জানা যাক…আর তার আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড জানা যাক…

অভ্যুত্থানের পটভূমি : প্রিগোজিন বনাম শোইগু

রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধ শুরু হলে পুতিনের প্রিয় ভাড়াটে সংগঠন ওয়াগনার গ্রুপকে রাশিয়ার গোপন অস্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। প্রিগোজিনকে পুতিনের শেফ বলা হত কারণ তার ওয়াগনার ভাড়াটে দলটি ছিল অনেকটা পুতিনের নিজের ব্যবহারের জন্য কিছুটা ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী। সিরিয়া, লিবিয়া এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনারের সাফল্য তাদের একটি কার্যকর যুদ্ধ বাহিনী হিসাবে খ্যাতি এনে দেয়। পুতিন যখন ইউক্রেনে তার আগ্রাসন শুরু করেছিলেন, তখন তার যতটা সম্ভব ততটা সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। সেখানেই তিনি তার পুরোনো বন্ধু প্রিগোজিনকে সাহায্যের জন্য ডাকেন। এবং ধীর সূচনা সত্ত্বেও, যখন তারা কয়েক মাস আগে বাখমুত দখল করেছিল তখন মনে হয়েছিল যে তারা তাদের সেই খ্যাতি ধরেই রেখেছে।

তবে বাখমুতে ওয়াগনারের সাফল্য স্পষ্টতই প্রিগোজিনকে অতিরিক্ত সাহস এনে দেয়, যার পর থেকে তিনি গত কয়েক মাস ধরে রাশিয়ান সেনাবাহিনী এবং বিশেষত প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং চিফ অফ স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের সমালোচনা করেছেন। বেশিরভাগ সময়, শোইগু চুপ করে ছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রিগোজিন ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে শোইগুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলার পর শোইগুর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। শোইগুর নেতৃত্বে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১ জুলাইয়ের মধ্যে সমস্ত বেসরকারী সামরিক সংস্থাগুলিকে নিয়মিত রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করে, যা অবশ্যই প্রিগোজিনকে রাগিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। 

আগে ওয়াগনার গ্রুপ এবং বেসরকারী সামরিক সংগঠনগুলির প্রতি ক্রেমলিনের বিস্তৃত সম্পর্ক সম্পর্কে কিছুটা বলে নেই। গত এক দশকে রাশিয়া বেসরকারী বা আধাসামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করার একটা অভ্যাস গড়ে তুলেছে। এই সব বাহিনীর মধ্যে রয়েছে পুতিনের এতদিন পর্যন্ত থাকা ঘনিষ্ঠ মিত্র প্রিগজিনের নেতৃত্বাধীন ওয়াগনার গ্রুপ, এবং রমজান কাদিরভের চেচেন ভাড়াটে সৈন্য বা ডিপিআর এবং এলপিআর মিলিশিয়া, যারা রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পেয়ে এসেছে। রাশিয়া এই গোষ্ঠীগুলি ব্যবহার করে কারণ তারা কেবল রাশিয়ান রাষ্ট্রের কাছে আধা-দায়বদ্ধ, যার অর্থ তারা হচ্ছে এরা পুতিন এবং ক্রেমলিনের পক্ষে যেকোন রকম নৃশংস কাজ করতে পারে, কিন্তু এর দায় পুতিন বা ক্রেমলিনকে নিতে হবেনা (রাশিয়ার প্লসিবল ডিয়ানাবিলিটি থাকছে)। এই গোষ্ঠীগুলির কারণে ক্রেমলিন তার যুদ্ধের প্রকৃত ব্যয় আড়াল করতে পারে, কারণ এই গোষ্ঠীগুলির সেনাদের মৃত্যু এবং এদের পেছনে হওয়া সামরিক ব্যয় সরকারী পরিসংখ্যানে প্রদর্শিত হয় না, এমনকি ক্রেমলিন তাদেরকে পরোক্ষভাবে অর্থায়ন করলেও।

এই “অসাধারণ” সিস্টেমটা খুব ভালোই কাজ করছিল, কিন্তু জানুয়ারি মাস পর্যন্তই, যখন ওয়াগনারের সাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সেই সময় ওয়াগনার বাখমুতের উত্তর দিকে সোলেদার নামে একটি শহরতলি দখল করেছিল। এর জন্য ওয়াগনারকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অভিনন্দন জানায়। এই অভিনন্দন একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল, আগে কখনও প্রতিরক্ষা মন্তণালয় (যার নেতৃত্বে আছেন শোইগু) ওয়াগনারকে কখনও স্বীকৃতি দেয়নি বা প্রশংসা করেনি। প্রতিক্রিয়ায় প্রিগোজিন টেলিগ্রামে একটি ভিডিও পোস্ট করে এর প্রতিক্রিয়া জানান, যেখানে তিনি ইঙ্গিত করে বলেন যে, ওয়াগনার রাশিয়ান সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি কার্যকর এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন সমর্থন তাদের প্রয়োজন নেই। আর এরই প্রতিশোধ হিসেবে রুশ সেনাবাহিনী ওয়াগনারকে এমিউনিশন সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয়। অবশ্যই এতে প্রিগোজিন অনেক ক্ষিপ্ত হন, এবং বারবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে তাদেরকে এমিউনিশন সাপ্লাই করার জন্য বার বার  চাপ দিতে শুরু করেন। তখন থেকেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আর ওয়াগনারের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। রাশিয়ান সেনাবাহিনী এমিউনিশন আটকে রাখে, এদিকে প্রিগোজিন এই বিষয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ করে ও রাশিয়ান সেনাবাহিনী তাদের সাপ্লাই পুনরুদ্ধার করে ব্যস্ত থাকে, আর এদিকে ওয়াগনার বাহিনী যুদ্ধে ঠিকই জয়লাভ করতে থাকে। ফলে প্রিগোজিন রুশদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন। সেই সাথে গর্ব করে তিনি বলতে থাকেন যে, তার ওয়াগনারকে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর চেয়ে ভাল ও উন্নত। আর তার এই আচরণে রাশিয়ান সেনাবাহিনী মানে শোইগুর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আবার ওয়াগনারকে এমিউনিশন সরবরাহ করা বন্ধ করে দেয়।

যাই হোক, সময়ের সাথে সাথে, এদের সম্পর্ক ক্রমাগত অবনতি হয়েছে, প্রিগোজিন ক্রমবর্ধমানভাবে শোইগু এবং গেরাসিমভের বিরুদ্ধে তীব্র মৌখিক আক্রমণ প্রকাশ করেছেন। এমনকি প্রিগোজিন গত মাসে পুতিনকে বেশ কয়েকটি ভিডিও পাঠান, যেগুলোর মধ্যে একটিতে তিনি পুতিনকে “Happy grandpa” এবং “a complete as*wh*le” হিসেবে অভিহিত করেন। দ্বন্দ্বটি আরও বেড়ে যায়, এবং যুদ্ধক্ষেত্র অব্দি পৌঁছয়। জুনের শুরুতে, ওয়াগনার রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে বাখমুত থেকে রাশিয়ায় তাদের ফেরার পথে মাইন পুঁতে রাখার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন এবং ওয়াগনার বাহিনী আক্ষরিক অর্থেই একজন রাশিয়ান কর্নেলকে বন্দী করে কারণ তিনি স্পষ্টতই ওয়াগনার সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিলেন। 

মাসখানেক আগে ওয়াগনার গ্রুপ বাখমুত শহর থেকে পিছু হটে, যে শহরটি তারা কয়েক মাস ধরে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর দখল করে নিয়েছিল। এর কারণ ছিল তাদের এমিউনিশন শেষ হয়ে যাচ্ছিল, যে এমিউনিশনের সরবরাহ আসার কথা ছিল রাশিয়া থেকে। প্রিগোজিন অনলাইনে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন যেখানে ওয়াগনার হতাহতের ঘটনা দেখানো হয়েছে এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই সমস্ত মৃত্যুর জন্য রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে দোষারোপ করেছেন। প্রিগোজিন শোইগুর দিকে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে এমিউনিশন কোথায়। আর স্বাভাবিকভাবেই এই ভিডিওটি জনসাধারণের মধ্যে শোইগুর ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল। স্পষ্টতই, রাশিয়ান সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য তাদের সৈন্যদের পর্যাপ্ত এমিউনিশন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়নি। ওয়াগনার প্রধানের মতে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগু ইচ্ছাকৃতভাবে তাদেরকে এমিউনিশন সরবরাহ করেননি। তিনি দাবি করেন, রুশ সেনাবাহিনী ওয়াগনার গ্রুপকে দুর্বল করতে চেয়েছিল। এরপর প্রিগোজিন তার সৈন্যদের পিছু হটতে বলে বলেছিলেন যে, ভবিষ্যতের কাজের জন্য তাদেরকে পুনর্গঠিত হতে হবে। আমরা এখন বুঝতে পারছি সেই ভবিষ্যতের কাজটি আসলে কী ছিল…  রাশিয়া আক্রমণ। 

যাই হোক, বেশি দিন হয়নি, প্রিগোজিন পাঁচ ঘন্টার একটি দীর্ঘ ইন্টারভিউ প্রকাশ করেছিলেন যেখানে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে শোইগু এবং গেরাসিমভকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করা উচিত। আর এরপর আসে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘোষণাটি, যেখানে ১লা জুলাই এর মধ্যে ওয়াগনারের সব সেনাকে রুশ বাহিনীতে অঙ্গীভূত করা হবে। 

নিশ্চিতভাবেই এটা প্রিগোজিনের ভাল লাগেনি, তিনি বলেন ওয়াগনার এখনও রাশিয়ান ফেডারেশনের স্বার্থের অধীনস্থ, ওয়াগনার সৈন্যরা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে কোন চুক্তি স্বাক্ষর করবে না কারণ- “শোইগু সামরিক বাহিনী পরিচালনা করতে পারে না।” অবশ্যই রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই জবাবে বিস্মিত হয়নি। নিশ্চই তারা ধরেই নিয়েছিল যে প্রিগোজিন এভাবে তার ক্ষমতা ছাড়বে না। প্রথমত, এই কারণে যে প্রিগোজিন ওয়াগনারের প্রধান হবার ব্যাপারটাকে উপভোগ করেন, আর দ্বিতীয়ত, প্রিগোজিন ওয়াগনারকে আর কেবলই ক্রেমলিনের “গোপন অস্ত্র” হিসেবে রাখতে চাননা, কয়েক মাস আগেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি ওয়াগনারকে “এন আর্মি উইথ যেন আইডিওলজি” বা “মতাদর্শযুক্ত সেনাবাহিনীতে” পরিণত করতে চান। মানে প্রিগোজিন ওয়াগনারকে এমন একটি সেনাবাহিনীতে পরিণত করতে চান যা নিজস্ব মতাদর্শ অনুযায়ী চলবে, এবং প্রয়োজনে ক্রেমলিনের স্বার্থকে অগ্রাহ্যও করবে। হয়তো প্রিগজিনের এরকম পরিবর্তিত আচরণ ও সেই সাথে তার উঠতি জনপ্রিয়তা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও ক্রেমলিনের জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছিল। আর তাই ১লা জুলাইতে ওয়াগনারকে “ভেঙ্গে ফেলার” এক্সট্রিম পদক্ষেপের দিকে তারা গিয়েছিল। কিন্তু এর জবাবে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে পারে তা নিয়ে কি তারা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি?

চিন্তা করাটা দরকার ছিল। একটি দেশে কোন মার্সেনারি বাহিনী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেলে সেই বাহিনীকে বিলুপ্ত করা হয়, বা বাহিনীর প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়, ঠিকই। সব দেশের আইন এটাই বলে, রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়া আসলেই এই অবস্থায় ছিলনা, বা শোইগুর কাছে সেটার অপশন ছিলনা। ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ক্রেমলিনের কাছে ওয়াগনার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী ছিল। এতই গুরুত্বপূর্ণ যে রাশিয়া একে ভেঙে ফেলতে বা বিলুপ্ত করতে পারতো না। আবার প্রিগোজিনকে গ্রেফতার করাটাও খুবই কঠিন একটা ব্যাপার ছিল তাদের জন্য। প্রথমত রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী সার্কেলে প্রিগোজিনের প্রভাব অনেক বেশি, আর দ্বিতীয়ত প্রিগোজিনকে গ্রেফতার করতে হলে ৫০ হাজার সেনার ওয়াগনার বাহিনীকে পরাজিত করে তাকে গ্রেফতার করতে হবে, মানে আরেকটি যুদ্ধ (তাও আবার যেখানে রুশ বাহিনীতেই ওয়াগনারের অনেক ভক্ত আছে বলে মনে করা হয়)। সুতরাং পরিস্থিতি শোইগু আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটা ডিলেমার মধ্যে ফেলে দেয়। হয় আইন মেনে প্রিগোজিনকে গ্রেফতার করতে বা/ও ওয়াগনারকেই বিলুপ্ত করতে হতো, অথবা আইনের দ্বারস্থ না হয়ে পিছিয়ে আসতে হত। কিন্তু এই দুটোই ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ প্রিগোজিনকে গ্রেফতার করলে সামরিক অভ্যুত্থান নিশ্চিত ছিল, আর গ্রেফতার না করলে প্রিগোজিন আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠত, আর রুশ বাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বড় রকমের হুমকি হয়ে উঠত, যার পরিণতিও সেই সামরিক অভ্যুত্থানই। মানে প্রিগোজিনের দ্বারা রাশিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থান হওয়াটা বোধ হয় অনিবার্যই ছিল। তবে প্রিগোজিন একটি তাড়াতাড়ি কাজ করে ফেলেছেন, ১ জুলাই এর আগেই সামরিক অভ্যুত্থান করে ফেলেছেন। 

এক দিক দিয়ে দেখলে ক্রেমলিনেরও উচিৎ ছিল এরকম পরিণতি সম্পর্কে আগেভাগেই অনুমান করা, কেননা ওয়াগনারের উপর রাশিয়ার অতিরিক্ত নির্ভরতা সর্বদাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অন্যান্য দেশও রাশিয়ার মতো একই কারণে মার্সেনারি বাহিনী ব্যবহার করে। কারণ এই বাহিনীগুলো কম দায়বদ্ধ, এবং তারা সম্প্রতি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, কারণ অর্থ-সংকটে থাকা সরকারগুলি তাদের নিয়মিত বাহিনীর চেয়ে বেশি সস্তা বলে মনে করে। অবশ্যই কোন সেনাবাহিনীকে মেইনটেইন করার চেয়ে কোন সেনাবাহিনীকে ভাড়া করা সস্তা। তবে রাশিয়ার মার্সেনারি বাহিনী অন্য দেশের মার্সেনারি বাহিনীর থেকে একটু আলাদা। এই ভিন্নতার কারণ হচ্ছে রাশিয়ার বাহিনীর তুলনায় ওয়াগনার গ্রুপের আকার। পশ্চিমা গোয়েন্দাদের অনুমান অনুসারে ইউক্রেনে ওয়াগনারের ৫০,০০০ সৈন্য লড়াই করছে, আফ্রিকায় আরও ৫০০০ সেনা, এবং সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যেও এদের ৫০০০ করে সেনা রয়েছে। এদিকে ইউক্রেইনে নিয়মিত রাশিয়ান সেনাবাহিনীর রয়েছে ১.৯ লক্ষ সেনা। মানে ইউক্রেইনে ওয়েগনারের সেনা হচ্ছে সমস্ত রুশ সেনার ২০%, যা অনেক বেশি। আর এজন্য ওয়াগনার নিয়ে ক্রেমলিনে হুমকিও বেশি। অবশ্যই ক্রেমলিনের উচিৎ ছিল এই পরিণতি আগেভাবে অনুমান করা। নাকি অন্তত শোইগু তা অনুমান করেছিল, আর তাই তাদেরকে এমিউনিশন সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছিল…কে জানে?!

যাই হোক, এর আগে কোনও বড় দেশ কোন একক মার্সেনারি বাহিনীর ওপর এত নির্ভরশীল ছিল না। এমনকি ইরাক যুদ্ধের শীর্ষে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্ল্যাকওয়াটারের মতো মার্সেনারি বাহিনীর উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, তখনও ইরাকে অবস্থিত সেই বৃহত্তম মার্সেনারি বাহিনী নিয়মিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর ৫% এরও কম ছিল। এই একই কারণে অন্যান্য দেশও কোন একক মার্সেনারি বাহিনী বা পিএমসির উপর এতো বেশি নির্ভর করেন, ঠিক এই পরিণতিটার কারণেই। আপনি যদি তাদের উপর খুব বেশি নির্ভর করেন এবং তাদের উপর লিভারেজ না থাকে তবে এগুলি নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন হয়ে যায়।

টেলিগ্রামে ওয়াগনার পোস্ট করা একটি ভিডিও অনুসারে, প্রিগোজিন রাশিয়া আক্রমণ করার ঠিক আগে রাশিয়ান বাহিনী ওয়াগনার সামরিক শিবিরে বোমা বর্ষণ করেছিল। রাশিয়ান সরকার অবশ্যই এটি অস্বীকার করেছিল, তবে ওয়াগনার গ্রুপ ক্ষুব্ধ হয় ও বলে যে, রাশিয়া তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। প্রিগোজিন বলেছিলেন যে তিনি একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এবং তিনি এর প্রতিশোধ নেবেন।

পুরো ব্যাপারটাকে অবশ্য একটু অন্যভাবেও দেখা যায়। কয়েক মাস ধরে ওয়াগনার গ্রুপের নেতা তার লোকদের প্রয়োজনীয় এমিউনিশন এবং সরঞ্জাম সরবরাহ না করার জন্য রাশিয়ার বড় বড় ব্যক্তিদের নিন্দা করেছেন। বড় ধরনের ক্ষতির জন্য ওনাদের দায়ী করেছেন তিনি। এখান থেকে এও অনুমান করা যায় যে, এগুলো হচ্ছে কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক ব্যর্থতা রাশিয়াকে এর পেছনের কালপ্রিটদের সন্ধান করতে বাধ্য করছে। একদিকে, এটি সিস্টেমে ফাটল তৈরি করছে যা অনেকে তাদের শক্তি বাড়ানোর জন্য কাজে লাগাতে চাইতে পারে, আর গত কয়েক মাস ধরে প্রিগোজিন ঠিক তাই করে আসছেন বলেই মনে হচ্ছে। এদিকে, অন্যরা তার দিকে আঙ্গুল তোলার আগে তিনি নিজেকে তার দায়িত্ব অন্যদের দোষী হিসাবে চিহ্নিত করে নিজেকে দায়মুক্ত করছেন। একই সঙ্গে তিনি ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছেন। এটি ব্যাখ্যা করে যে কেন ওয়াগনার নেতা বারবার রাশিয়ান সরকারের উচ্চপদস্থদের বরখাস্ত করার দাবি করেছেন এবং ক্রমাগত তাদের সমালোচনা করেছেন। আশ্চর্যের কিছু নেই, শোইগু এবং গারাজিমভ চুপ চাপ দাঁড়াননি। আর এভাবেই সামরিক অভ্যুত্থানের মতো অবস্থা সামনে এসেছে। অর্থাৎ যুদ্ধে রুশদের সামরিক ব্যর্থতাই প্রিগোজিনকে শোইগুদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে, সংঘাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে এই অভ্যুত্থান। 

প্রিগোজিনের সামরিক অভ্যুত্থান

যাই হোক, এবারে প্রিগোজিনের অভ্যুত্থানের দিকে যাওয়া যাক। ২০২৩ সালের ২৪ শে জুন বিশ্বের বৃহত্তম দেশটি রাশিয়ায় সবাই একটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করছিল। একটি ভারী সশস্ত্র, অত্যন্ত দক্ষ সামরিক বাহিনী রাশিয়ার মধ্য দিয়ে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিল যার মূল লক্ষ্য কিনা বর্তমান রাশিয়ান সরকারকে উৎখাত করা। এই ওয়াগনার কনভয় মস্কোর দিকে যাচ্ছিল। ওয়াগনার বাহিনী রোস্তভের সাউদার্ন মিলিটারি কমান্ড হেডকোয়ার্টারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং তারপরে রাশিয়ার এম৪ হাইওয়ে দিয়ে মস্কোর দিকে উত্তরদিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। শনিবার বিকেলের মধ্যে মনে হচ্ছিল ওয়াগনার রবিবার সকালে মস্কো পৌঁছানোর পথে রয়েছেন, কিন্তু হঠাৎ করে ওয়াগনার নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন হঠাৎ মত পরিবর্তন করলেন ও বললেন, আরও রক্তপাত এড়ানোর জন্য একটি চুক্তি করা হয়েছে।

তারা মস্কো প্রদেশে প্রবেশ করে এবং শহর থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় আগ্রাসনের পরে, রাশিয়ান সেনাবাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, মস্কো এবং অন্যান্য অনেক রাশিয়ান শহরের রাস্তায় সৈন্য এবং সামরিক যানবাহন সরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা এতটাই গুরুতর ছিল। আক্রমণের আগে একটি ভিডিওতে প্রিগোজিন যা বলেছিলেন তা এটি কতটা গুরুতর ছিল সে সম্পর্কে অনেক কিছুই বলে: “আমরা সবাই মরতে প্রস্তুত, প্রথমে ২৫,০০০ সৈন্যের সকলে, আর তারপর আরও ২৫,০০০ সৈন্য। আমরা রাশিয়ার জনগণের জন্য মরছি।” পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে পুতিনের মস্কো ছেড়ে পালানোর খবর পাওয়া যায়, যখন তার সেনাবাহিনী ওয়াগনার সৈন্যদের আক্রমণের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করছিল। পুতিন কাছে ওয়াগনার ভাড়াটে সৈন্যদের থামানোর আশা এতটাই কম ছিল যে, রাশিয়ান কর্মকর্তারা পারমাণবিক ওয়ারহেডগুলিকে ওয়াগনার হাত থেকে দূরে রাখার জন্য সরিয়ে নিচ্ছিলেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় এবং শনিবার ভোরে ওয়াগনার সৈন্যরা প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ায় চলে আসে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের সমন্বয়ের জন্য রাশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর রোস্তোভে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তারা সরাসরি রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের সদর দফতর দখল করে নিয়ন্ত্রণ নেয়। প্রিগোজিন তখন তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে রোস্তভ থেকে দুটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। প্রথমটিতে, তিনি রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে কথা বলছেন, যিনি বেশ আতঙ্কিত ছিলেন এবং দাবি করেন যে তিনি রাশিয়াকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয়টিতে, তিনি বলেছেন যে সামরিক কমান্ড এখনও কাজ করছে এবং ওয়াগনার এমন নথি পেয়েছেন যা নিশ্চিত করে যে রাশিয়ান সেনাবাহিনী তাদের দাবির চেয়ে তিন থেকে চারগুণ বেশি লোককে হারিয়েছে। প্রিগোজিন তখন গেরাসিমভ এবং শোইগুর সাথে আলোচনার দাবি জানিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে “যতক্ষণ তারা এখানে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা রোস্তোভকে ব্লক করে রাখবে ও মস্কোর দিকে রওনা হবে”।

এর জবাবে পুতিন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে একটি জরুরি ভাষণ দেন যেখানে তিনি প্রিগোজিনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এর জবাবে ওয়াগনার বলেন, পুতিন ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ নিয়েছেন এবং রাশিয়া শিগগিরই নতুন প্রেসিডেন্ট পাবে। এর পর, শনিবার সকালে, ওয়াগনার সৈন্যরা রোস্তোভ থেকে মস্কো পর্যন্ত এম৪ মহাসড়ক ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হয় এবং মস্কো থেকে মাত্র ৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ভেরোনিজ ওব্লাস্টে প্রবেশ করে।

এখন এটি পুরোপুরি পরিষ্কার নয় যে এখান থেকে কী ঘটেছিল, তবে উপলব্ধ ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স থেকে মনে হচ্ছে যে ওয়াগনারকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার জন্য কয়েকটি রাশিয়ান এভিয়েশন এসেট পাঠানো হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত ওয়াগনার কমপক্ষে একটি রাশিয়ান হেলিকপ্টারকে গুলি করে ভূপাতিত করেছিল। এখন সত্যিকারের প্রতিরোধের এই অভাব দুটি সম্ভাবনাকে ইঙ্গিত করতে পারে। এক হতে পারে, যেহেতু ওয়াগনারের সক্রিয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যে কোনও বিমান হামলা সত্যিই অনেক উচ্চতায় উড়তে থাকা বিমানগুলি থেকে আসতে হবে, যা আবার এগুলোর নির্ভুলতা বা একিউরেসিকে হ্রাস করবে এবং মোটরওয়েতে বেসামরিক নাগরিকদের আঘাত করার ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে, যা দৃশ্যত ইতিমধ্যে ঘটেছে। আর দ্বিতীয়ত এটি হতে পারে যে বেশিরভাগ রাশিয়ান সৈন্য ওয়াগনারের সাথে লড়াই করতে অনিচ্ছুক ছিল। মজার ব্যাপার হলো, ওয়াগনারের বিরোধিতা করতে আগ্রহী একমাত্র গ্ৰুপ ছিল রমজান কাদিরভের চেচেন, যারা শনিবার বিকেলে রোস্তোভে প্রবেশ করে। এরপরও রাশিয়ান সেনাবাহিনী ওয়াগনারের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেবল পিছু হটেনি, নিরাপত্তা বাহিনী মহাসড়ক বরাবর ওয়াগনারের অগ্রগতি রোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল, যার মধ্যে বালি ভর্তি ডাম্পস্টার দিয়ে রাস্তা অবরোধ করা এবং আক্ষরিক অর্থে রাস্তা খনন করা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ওয়াগনার হয় বুলডোজ করে সামনে এগিয়ে যায় বা শেষ পর্যন্ত বিকল্প পথ বেছে নেয়। ওয়াগনার আগমনের প্রত্যাশায় মস্কোর পুলিশ এমনকি মেশিনগান ব্যারিকেড তৈরি করেছিল এবং এয়ার ট্র্যাফিক ডেটা থেকে জানা যায় যে পুতিন তাদের আগমনের পূর্বাভাস দিয়ে মস্কো ছেড়ে পিটার্সবার্গের কিছু জায়গায় পালিয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু এরপর প্রিগোজিন একটি অডিও রেকর্ডিং প্রকাশ করেন যা পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। সেখানে প্রিগজিন বলেন, “তারা (রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়) পিএমসি (বা প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি) ওয়াগনারকে ধ্বংস করতে যাচ্ছিল। আমরা ২৩শে জুন ন্যায়বিচারের পদযাত্রায় বেরিয়ে এসেছি। একদিনে আমরা মস্কো থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে চলে গেলাম। এই সময়ে আমরা আমাদের যোদ্ধাদের রক্তের এক ফোঁটাও ঝরাইনি। এখন এমন সময় এসেছে যখন রক্ত ঝরতে পারে। এ জন্য রাশিয়ার এক পক্ষের ওপর রক্ত ঝরানোর দায় বুঝতে পেরে আমরা আমাদের গাড়ির বহর ফিরিয়ে নিচ্ছি এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিল্ড ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি।” আর এভাবেই এক সেকেন্ডের চোখের পলকে সব শেষ হয়ে গেল। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ঐতিহাসিক ঘটনাটি এমনভাবে শেষ হয়ে গেল যেন কিছুই ঘটেনি। হয়তো তখনও বিশেষজ্ঞ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের  চোখের পলক পড়েনি, চোয়াল উপরে ওঠেনি, এরকম এন্টিক্লাইমেটিক সমাপ্তির পরও। আর এরপর প্রিগোজিন রাশিয়া ছেড়ে বেলারুশে চলে যেতে সম্মত হলেন, আর ক্রেমলিনও তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের একটি ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করে নিতে সম্মত হল।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে প্রিগোজিন যখন রক্তের কথা বলেন, তিনি বিশেষত ওয়াগনার রক্তের কথা বলছেন কারণ যদিও কোনও ওয়াগনার সৈন্য নিহত হয়নি, তবে রাশিয়ার ৭টির মোট হেলিকপ্টারের পাইলট নিহত হয়েছে। অবশ্য প্রিগোজিন পরে দাবি করেছেন যে রুশদের রক্তের কথাই বলা হয়েছে যা তিনি ঝরাতে চাননি, আর এই পাইলটদেরকে তারা কেবল আত্মরক্ষার্থে হত্যা করেছিল।

লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় চুক্তি, চুক্তির বিষয়বস্তু ও প্রিগোজিনের সাথে হওয়া সম্ভাব্য ধোকা

পুতিন লুকাশেঙ্কোর খুব ভাল মিত্র। ২০২০ সালে, যখন লুকাশেঙ্কো বেলারুশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। এদিকে তিনি বেলারুশের নাগরিকদের মধ্যে অত্যন্ত অজনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও, তার জয়ের পর বেলারুশ জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং মনে হয়েছিল এটি লুকাশেঙ্কোর শাসনের অবসান ঘটাতে পারে। তখনই লুকাশেঙ্কো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুতিনের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন এবং পুতিন বেলারুশের পরিস্থিতি শান্ত করতে রাশিয়ান সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। তারপর থেকে লুকাশেঙ্কো বেলারুশে তার শাসন বজায় রেখেছেন এবং পুতিনের অনুগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কাজ করেছেন। রুশ সেনাবাহিনী বেলারুশকে অন্য ফ্রন্ট থেকে ইউক্রেন আক্রমণ করতে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে, এবং বেলারুশে রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের খবরও রয়েছে। এখন, লুকাশেঙ্কো তার বন্ধু পুতিনকে রাশিয়ায় ক্ষমতা হারাতে দিতে পারেন না কারণ পুতিন যদি ক্ষমতা হারান তবে লুকাশেঙ্কো জানেন যে এরপর তিনিও ক্ষমতা হারাবেন। সুতরাং প্রিগোজিন যখন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে তার অভ্যুত্থান শুরু করেছিলেন তখন তিনি আলোচনার অগ্রভাগে ছিলেন। লুকাশেঙ্কো এই ওয়াগনার কনভয়কে মস্কোর দিকে যাত্রা থামাতে প্রিগোজিনের সাথে মধ্যস্থতার চুক্তির পুরো কৃতিত্বও নিয়েছিলেন।

বেলারুশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, বেলারুশের রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো একটি চুক্তি করেছিলেন, যিনি কেবল পুতিনের বন্ধুই নন, তিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রিগোজিনের সাথেও পরিচিত। কয়েক ঘণ্টা পর ক্রেমলিন এই চুক্তির শর্তাবলী প্রকাশ করে। প্রথমত, প্রিগোজিন এবং যে ওয়াগনার সৈন্যরা বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল তারা আইনী ছাড় পাবে। প্রিগোজিন কিছু সময়ের জন্য এক ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ নির্বাসন হিসাবে বেলারুশে যাবেন। দ্বিতীয়ত, ওয়াগনার সৈন্যরা যারা অংশ নেয়নি তাদেরকে প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী নিয়মিত রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে অঙ্গীভূত করা হবে। এবং তৃতীয়ত, কোথাও কোথাও এমনটি বলা হয়েছে যে, চুক্তিতে শোইগু এবং সম্ভবত গেরাসিমভকে তাদের পদ থেকে অপসারণের কথা বলা হয়েছিল, যেমনটা ওয়াগনার চায়, কিন্তু এটির ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এখন, এই চুক্তিটিতেই সমস্যার শুরু হয়। চুক্তির বিশদ বিবরণটা প্রথম আসে ওয়াগনার ক্যাম্প থেকে। প্রিগোজিন পক্ষের মতে, এই চুক্তিতে ওয়াগনার যোদ্ধাদের জন্য নিরাপত্তা অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা প্রিগোজিনকে সমর্থন করেছিল, ছিল প্রিগোজিনের জন্য সম্পূর্ণ সুরক্ষা বা ইমিউনিটি, আর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যেটা ছিল সেটা হল রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব (মানে সের্গেই শোইগুর) পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি। শুরু থেকেই প্রিগোজিনের লক্ষ্য ছিল শোইগুকে সরিয়ে দেয়া। অভ্যুত্থান শুরুর আগে তিনি যে দুটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন যেখানে তা বোঝা যায়। প্রথমে প্রিগোজিন যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যর্থতার জন্য পুতিনকে কোনও দোষারোপ করেননি। পুতিনের ভাষণের পরে তিনি পুতিনকে টার্গেট করতে শুরু করেছিলেন, যেখানে পুতিন প্রিগোজিনের পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতা এবং পিঠে ছুরিকাঘাত বলে অভিহিত করেছিলেন। পুতিন তার দেশদ্রোহিতার জন্য তাকে শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পুতিনের এই কথার পরেই প্রিগোজিন তাকে আক্রমণ করেছিলেন এবং জবাব দিয়েছিলেন যে পুতিন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং শীঘ্রই রাশিয়া একটি নতুন রাষ্ট্রপতি পাবে। অনেক জায়গা থেকে যেমনটা শোনা যাচ্ছে, প্রিগোজিনকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেই তার আক্রমণ বন্ধ করেন, যদিও এটা নিশ্চিত নয়। কিন্তু যদি এটা হয়ে থাকে তাহলে প্রিগোজিন ক্রেমলিনের কাছে ধোকা খেয়ে গেছেন। প্রিগোজিনের ঘোষণার পরপরই ক্রেমলিনের মুখপাত্র পেসকভ প্রিগোজিনের সাথে একটি চুক্তিতে সম্মত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন, তবে তিনি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মী পরিবর্তন বিষয়ে কোনও আলোচনার কথা অস্বীকার করেছেন। আর পরে এও জানানো হয়েছে যে শোইগু ও গেরাসিমভকে সরানো হবেনা। এখন মনে হচ্ছে প্রিগোজিন এই চুক্তি থেকে ইমিউনিটি ছাড়া আর কিছুই পাননি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধানদের সরানো নিয়ে তার যে প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল তাতে কোনও অগ্রগতি আসেনি। অবশ্য গুজব শোনা যাচ্ছে শোইগুকে বরখাস্ত করা হবে। দেখা যাক কী হয়…

“ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার” পর পুতিনের ভাষণ ও ইউক্রেইনে থাকা অবশিষ্ট ওয়াগনার বাহিনীর ভবিষ্যৎ  

প্রথমে প্রিগোজিন একটা অডিও রেকর্ড প্রকাশ করে তার এই ‘বিদ্রোহের’ ব্যাখ্যা দেন। (সেটা নিয়ে লেখা হবে)। প্রিগোজিনের অডিও রেকর্ডিং প্রকাশিত হওয়ার পর পুতিনের জনসমক্ষে ভাষণ দেবার একটি ঘোষণা আসে, এবং লুকাশেঙ্কো বেলারুশ থেকে একই সময়ে জনসমক্ষে ভাষণ দেবেন বলা হয়। প্রায় একই সময়ে এয়ার ডেটা থেকে জানা যায়, পুতিনের বিমান সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে মস্কোতে অবতরণ করেছে। উল্লেখ্য, ওয়াগনার মস্কোর দিকে অগ্রসর হবার সময় পুতিন মস্কোকে রক্ষা করার জন্য তার সেনাবাহিনীর উপর এতটাই কম বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি শহর ছেড়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে গিয়েছিলেন। এবং এখন যেহেতু তিনি নিরাপদ বোধ করছেন, তিনি ফিরে এসেছেন এবং জনসাধারণের সামনে নিজের শক্তি প্রকাশ করতে প্রস্তুত। কিছু কারণে লুকাশেঙ্কো তার ভাষণ পরের দিন পর্যন্ত স্থগিত করেন।

পুতিনের ভাষণটি প্রত্যাশার মতোই ছিল। তিনি বিজয় ঘোষণা করেন। জানি না পুতিনের মস্কো থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং রাশিয়ার হয়ে বেলারুশের রাষ্ট্রপতি লুকাশেঙ্কোর চুক্তি করা, এবং ওয়াগনারের রাশিয়ায় আক্রমণ করে রুশ বিমান বিধ্বস্ত করে আবার নির্বিঘ্নে রাশিয়া ত্যাগ করার ব্যাপারটা কিভাবে রাশিয়ার জন্য বিজয় হতে পারে, তবে এটাও ঠিক যে, একজন স্বৈরশাসক যা চান তাই বলতে পারেন। পুরো বক্তৃতা জুড়েই তিনি বেশ রাগান্বিত ছিলেন। তিনি এই অভ্যুত্থানের জন্য পশ্চিমা এবং ইউক্রেনের নাৎসিদের দোষারোপ করেছিলেন। যদিও এই কথাগুলো আসলে তেমন কোনও অর্থ বহন করে না। পুতিনের অন্যতম বিশ্বস্ত উপদেষ্টা, যিনি কিনা একটি প্রাইভেট ভাড়াটে সেনাবাহিনীর প্রধান, যার উপর পুতিন ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন, তার অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টাও কিনা পশ্চিমাদের দোষ!?

ভাষণে তিনি জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চাইছিলেন যে, প্রিগোজিন না থামলে তিনি যেভাবেই হোক যুদ্ধে জিততেন এবং অভ্যুত্থানটি ধ্বংস করতে পারতেন। তিনি আরও বলেন যে অভ্যুত্থানের আয়োজকরা তাদের নিজের দেশ এবং জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি বলেন, ওয়াগনার যোদ্ধারাও দেশপ্রেমিক, তারা তাদের নিজ দেশের অন্তর্গত ভূমিকে শত্রুমুক্ত করেছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে একজন এই অন্ধকার অভিযানে তাদেরকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন।

সবশেষে তিনি একটা কথা বলেন যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ওয়াগনার সেনাদের তিনটি বিকল্প দেন। কিন্তু সেটাই যাবার আগে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। পূর্বে প্রিগোজিনের ভিডিও দেখে মনে হচ্ছে তার সাথে রাশিয়ায় আসা ২৫ হাজার সৈন্য আর ইউক্রেইনে ইতিমধ্যে থাকা আরোও প্রায় ২৫ হাজার সৈন্য সবাই প্রিগোজিনের পক্ষে। আর এই ৫০ হাজার ওয়াগনার সৈন্যই তার পক্ষে আছে যারা মস্কোতে যাবার জন্য তৈরি। কিন্তু পরে জানা গেল, প্রিগোজিনের সমর্থকরাই কেবল তার সাথে রাশিয়ায় এসেছে, যাদের সংখ্যা ২৫ হাজার। বাকি সৈন্যরা যারা উক্রেইনে থেকে গেছে তারা প্রিগোজিনের অভ্যুত্থানে যুক্ত হতে চায়নি। আর এদের সংখ্যাটাও প্রিগোজিনের কথা মতো আসলেই ২৫ হাজার কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। কিন্তু এদের সংখ্যা কত? ইউএস এর হিসাব অনুযায়ী ইউক্রেইনে মোট ৫০ হাজার ওয়াগনার সেনা ছিল যাদের মধ্যে ১০ হাজার ছিল ওয়াগনারের দ্বারা চুক্তিবদ্ধ সেনা, আর বাকি ৪০ হাজার ছিল রাশিয়ার কারাগারের আসামী যাদেরকে ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে স্পেশাল মিলিটারি অপারেশনের জন্য ওয়াগনার ক্রেমলিনের অনুমোদনে ওয়াগনার নিয়েছিল।

তো এই ৫০ হাজারের মধ্যে ২৫ হাজার সেনা নিয়ে প্রিগোজিন রাশিয়ায় এসেছিলেন। কিন্তু অবশিষ্ট সেনাদের মধ্যে যুদ্ধে নিহতদের বাদ দিতে হবে। ইউক্রেইনে ওয়াগনারের হতাহতের পরিমাণ নিয়ে মতানৈক্য আছে। ইউএস বলছে ইউক্রেইনে ওয়াগনারের মোট হতাহতের সংখ্যা ৩০ হাজার, আর নিহতের সংখ্যা ৯ হাজার। যদি ইউএস এর এই নিহতের হিসাব সঠিক ধরি তবে আহত ও সক্ষম সেনা মিলে ইউক্রেইনে আছে অবশিষ্ট ১৬ হাজার ওয়াগনার সেনা, যারা প্রিগোজিনের এই বিদ্রোহ সমর্থন করেনি। আর এজন্য পুতিন এদেরকে ধন্যবাদও জানান। এখন রাশিয়ায় প্রিগোজিনের ২৫ হাজার সেনার কারো কোন ক্ষতি হয়নি। এরা সবাই প্রিগোজিনের সাথে বেলারুশে যাচ্ছে। চুক্তি অনুসারে এরাও প্রিগোজিনের সাথে রাশিয়া থেকে বিতাড়িত ও রাষ্ট্রদ্রোহের দায় থেকে মুক্ত, আর অবশ্যই এরা প্রিগোজিনের ওয়াগনারেই থাকবে। একটা জিনিস চিন্তা করুন, রাশিয়ায় প্রথমে প্রিগোজিনের ওয়াগনার ১০ হাজার সেনা ছিল (আফ্রিকায় ও মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা ওয়াগনার সেনাদের কথা আলাদা)। এরপর তিনি পুতিনের অনুমতি নিয়ে রাশিয়ার কারাগারের ৪০ হাজার জনকে ওয়াগনারে নিলেন। আর এখন তার হাতে ২৫ হাজার সেনা আছে, এদিক থেকে তার জন্য লাভই।

যাই হোক, ইউক্রেইনে থাকা অবশিষ্ট সেনাদেরকে (সংখ্যায় ১৬ হাজার হোক বা না হোক) পুতিন তিনটি বিকল্প দেন, যেগুলোর একটিকে তাদের বেছে নিতে হবে –

  • এক. রাশিয়ান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা অন্যান্য শক্তি কাঠামোর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর, মানে ওয়াগনার ত্যাগ করে রুশ বাহিনীতে যুক্ত হওয়া;
  • দুই. তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া, মানে সেনাজীবন থেকে অবসর গ্রহণ; অথবা
  • তিন. বেলারুশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া, মানে রাশিয়া ত্যাগ করে বেলারুশে চলে যাওয়া, অবশ্যই যার মাধ্যমে তারা ওয়াগনারে যুক্ত হতে পারে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র পেশকভ বলেছিলেন, ইউক্রেইনে থাকা অবশিষ্ট সকল ওয়াগনার সেনাকে রুশ বাহিনীতে অঙ্গীভূত করা হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেটা নেসেসারি নয়, তাদের হাতে আরো অপশন থাকছে, যার একটি তাদেরকে ওয়াগনারে ফিরে যাবারও সুযোগ দেয়। এক্ষেত্রে পুতিনকে বেশ নমনীয় দেখা যাচ্ছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র পেশকভ যখন ইউক্রেইনে থাকা অবশিষ্ট ওয়াগনার সেনাদের রুশ বাহিনীতে অঙ্গীভূত করার কথা বলেছিলেন তখন অনেকেই বলছিলেন রুশ বাহিনী আদৌ ইটা সহজে করতে পারবে কিনা, আবার নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি হবে কিনা, বা তা পুনরায় রাশিয়ায় অভ্যুথানের সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে কিনা। কিন্তু এই বিকল্পগুলো দেবার মাধ্যমে দেখাচ্ছেন যে তিনি আর এদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নন। তাছাড়া প্রথমে পুতিন অভ্যূত্থানকারী ওয়াগনার সেনাদের উপর যে শাস্তিমূলক একশন নেবার কথা বলছিলেন সেটাও একই কারণে করা হবেনা বলেই মনে হচ্ছে, বরং তার ভাষণ চুক্তিকে শ্রদ্ধা করার দিকেই যাচ্ছে। এমনকি সেই সাথে এই গুজবও রয়েছে যে শোইগু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে, ঠিক যেমনটা প্রিগোজিন চেয়েছিলেন।

যাই হোক, অবশিষ্ট ওয়াগনার বাহিনীকে দেয়া এই তিন বিকল্প দেখে মনে হচ্ছে পুতিন এদের নিয়ে খুব একটা নিরাপদ বোধ করছেন না, এবং ওয়াগনার পুনরায় আক্রমণ করুন এমন কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। আর তাই তিনি ওয়াগনারকে বেশি চটাতে চাননি। ভাষণের পর ক্রেমলিন দেশটির নিরাপত্তা নেতৃত্বের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের ফুটেজও প্রকাশ করে। শোইগু সেখানে ছিলেন এবং তাকে খুব একটা ফোকাসড বা নিবিষ্ট মনে হচ্ছিল না।

যাই হোক, ইউএস এর হিসাব আহত ওয়াগনার সেনা সংখ্যা অনেক বেশি (৩০ – ৯ = ২১ হাজার)। কিন্তু এই সংখ্যা এত বেশি না হলেও যুদ্ধে অক্ষম বা আর যুদ্ধ করতে না চাওয়া আহত সেনা ইউক্রেইনে থেকে যাবে, তারা হয়তো তাদের সামরিক জীবন থেকে অবসর নিয়ে রাশিয়ায় ফিরে যাবে। অবশিষ্ট যতজন ইউক্রেইনে থাকবে মনে হয়না তাদেরও খুব একটা বড় অংশ রুশ বাহিনীতে যুক্ত হতে চাইবে। এর কারণ হচ্ছে রুশ বাহিনীতে শ্রম দিয়ে এরা যত বেতন পাবে তার থেকে বেশি পাবে ওয়াগনারে থেকে। তাছাড়া রুশ বাহিনীতে যুক্ত হলে তাদেরকে ইউক্রেইনে পুনরায় মোবিলাইজ করা হবে যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী ইউক্রেইনে রুশ বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা এক থেকে দু লক্ষ। সব মিলে প্রিগোজিনের কাছে যত সেনা আসছে তাদেরকে বেলারুশের রাখা হবে অথবা মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকায় পাঠানো হবে। উল্লেখ্য, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াগনার সোনিদের একটি উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে এবং বর্তমানে সুদানে চলমান গৃহযুদ্ধেও ওয়াগনার জড়িত।

এর আরেকটা অর্থ হচ্ছে ওয়াগনার থেকে খুব কম অংশই রুশ বাহিনীতে অঙ্গীভূত হচ্ছে। অন্যভাবে দেখলে রাশিয়া ওয়াগনারের প্রায় পুরোটাই হারাচ্ছে। আর  ইউক্রেইনের বিরুদ্ধ রাশিয়ার যুদ্ধ ও পুতিনের জন্য এর একটি বাজে পরিণতি রয়েছে। সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করা হবে।

“ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার” পর প্রিগোজিন কী বলছেন? 

অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর প্রিগোজিন অবশেষে প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে কথা বলেছেন এবং তার সুর পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সে পুরো বিশ্বকে ধোঁকা দিয়েছে।

সুতরাং প্রিগোজিন তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে অবশেষে একটি অডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন কেন তিনি রাশিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন সেটা ব্যাখ্যা করে। পুরো অডিওর দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ মিনিট। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তিনি নিশ্চিত করেছিলেন তা হ’ল এই বিদ্রোহের পিছনে পুরো কারণটি ছিল শোইগুর ১০ই জুনের আদেশ, যেখানে শোইগু বলেছিলেন, ওয়াগনার গ্রুপটি অবশ্যই বিলুপ্ত করতে হবে এবং ওয়াগনার সৈন্যদের রাশিয়ান সামরিক বাহিনীতে অঙ্গীভূত করতে হবে। স্পষ্টতই, পুতিনও এই আদেশটি অনুমোদন করেছিলেন এবং প্রিগোজিনের বক্তব্য অনুসারে ওয়াগনার ৩০শে জুন রোস্তোভে তাদের সমস্ত সামরিক প্রযুক্তি হস্তান্তর করার পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু তারপরে ওয়াগনার বাহিনীর ওপর বোমা বর্ষণ হয় যার ফলে তারা ৩০ জন সৈন্যকে হারায়, এবং প্রিগোজিনের বিশ্বাস ছিল, এই হামলার পেছনে আসলে রাশিয়ান সেনাবাহিনীরই ছিল। এর পরে প্রিগোজিন মস্কোতে অভিযান করার এবং শোইগুকে বিচারে নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রিগোজিন নিশ্চিত করেছেন যে এই আক্রমণটিই ছিল তার অভিযানের পেছনের ট্রিগার। অভিযানটির লক্ষ্য ছিল ওয়াগনারের ধ্বংস রোধ করা। তিনি ইউক্রেইনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান বা স্পেশাল মিলিটারি অপারেশনে যারা ভুল করেছেন তাদের জবাবদিহিতার মুখে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি পুনরায় বলেন যে অভিযানের উদ্দেশ্য কখনই আগ্রাসন দেখানো ছিল না। সেই সাথে তিনি এটি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ওয়াগনার কেউই রাশিয়ার মাটিতে মারা যায়নি এবং রাশিয়ান বাহিনীর পাইলটদের মৃত্যু তার দোষ নয়। আত্মরক্ষার্থে তিনি তাদের হত্যা করেন।

তারপর তিনি সেই অভিযানটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমরা থামলাম যখন আমরা বুঝতে পারলাম যে মস্কোর কাছে যুদ্ধ হবে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে সেই পয়েন্ট পর্যন্ত বিক্ষোভই যথেষ্ট ছিল।” তার মতে, অভিযান থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত দুটি কারণের উপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়েছিল। প্রথমত, তিনি রাশিয়ার রক্ত ঝরাতে চাননি এবং দ্বিতীয়ত, মার্চের পুরো লক্ষ্য ছিল ওয়াগনারের বিভ্রান্তির প্রতিবাদ করা। কখনই ক্রেমলিনের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া লক্ষ্য ছিল না। সুতরাং লুকাশেঙ্কো যখন বেলারুশে ওয়াগনারকে সংরক্ষণের জন্য একটি সমাধান প্রস্তাব করেছিলেন, তখন তিনি এটি গ্রহণ করেছিলেন এবং অভিযানটি বন্ধ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি রাশিয়ান সেনাবাহিনীর উপর তার এই ফাইনাল একশন নেয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান বাহিনী কিয়েভে যে দূরত্ব অতিক্রম করতে পারত, ২৪ ঘণ্টায় ওয়াগনার সেই দূরত্ব অতিক্রম করেছেন। তারা যদি ওয়াগনারের মতো প্রস্তুত থাকত, তবে যুদ্ধটি একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যেত।

তো সব মিলে প্রিগোজিন বলতে চাইছেন যে অভ্যুত্থান করা তার লক্ষ্য ছিলই না, যেমনটা এতক্ষণ যাবৎ ভাবা হচ্ছিল। তার পরিকল্পনা ছিল কেবল ওয়াগনার এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য একটি চুক্তিতে যাওয়া। যখন আদেশ আসে যে ওয়াগনারকে বিলুপ্ত করতে হবে, তখন তিনি সম্ভবত তার জীবনের জন্য ভয় পেয়েছিলেন কারণ তার সাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক খুব একটা ভাল নয়। আর সর্বোপরি তিনি একজন ব্যবসায়ী এবং ওয়াগনারকে ছেড়ে দিতে চান নি, যেখানে এটি এমন একটি ব্যবসা যা তাকে বিলিয়ন করে তুলছে। তিনি পুতিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন বলে খবর পাওয়া গেছে তবে তার সমস্ত প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। সুতরাং সম্ভবত এই পুরো অভিযানটি তার সুরক্ষা এবং তার সৈন্যদের সুরক্ষা নিয়ে আলোচনার একমাত্র উপায় ছিল।

কিন্তু এখানে একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। যদি শোইগুকে বিচারের আওতায় আনাই তার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে তিনি তার মস্কোগামী কনভয়তে কেন ছিলেন না? তার বদলে তিনি রোস্তভে কেন থেকে গিয়েছিলেন? হ্যা, মস্কোর দিকে ওয়াগনারের যে কনভয় অগ্রসর হয় তাতে প্রিগোজিন ছিলেন না। তিনি রোস্তোভেই বসে ছিলেন। হ্যাঁ এটা ঠিক যে রোস্তভ এসে তিনি ভিডিওতে বলেছেন যে তিনি শোইগুর সাথে কথা বলতে চান। রোস্তোভ সরকারের নেতাদের সঙ্গে তার কথোপকথনের ভিডিওতে আমরা তা দেখতে পাই। কিন্তু মস্কোতে যদি তিনি নাই যান তবে তিনি শোইগুর সাথে কথাই বা বলবেন কিভাবে? আর কেবল তাই যদি হবে তাহলে তিনি ভিডিওতে কেন বলেছিলেন যে, শীঘ্রই রাশিয়া একটি নতুন রাষ্ট্রপতি পাবে। এসব কারণে মনে হয়না প্রিগোজিন এখন যা যা বলছে তা আসলেই ঠিক। বরং তিনি কেন অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন তা নিয়ে দুটো থিওরিকে ভ্যালিড বলে মনে হয়, এক হচ্ছে তিনি আসলেই সরকার পতনের জন্য সামরিক অভ্যুত্থান করেছিলেন। আর দুই. সরকার পরিবর্তনের কোন ইচ্ছা তার ছিলনা, তিনি জাস্ট এমিউনিশনের অভাবের জন্য হোক, বাখমুতে লসের কারণে হোক, বা রাশিয়ার হাত থেকে ওয়াগনারকে বাঁচাবার জন্যই হোক তিনি জাস্ট ইউক্রেইন ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, আর তাও এমনভাবে যাতে তার রেপুটেশনে আঘাত না লাগে, কেননা তাতে তার বিলিয়ন ডলারের প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি বা পিএমসি এর বিজনেসের ক্ষতি হবে। আর তাই তাকে এরকম নাটক করতে হল। এটা না করলে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কথা মতো ওয়াগনার হারাতে হতো, যেটা পুতিনের ভাষণ অনুসারে এখন আর হারাতে হবেনা।

কেন প্রিগোজিন অভ্যুত্থানকে সম্ভবপর ভাবলেন?

২৫ হাজার সৈন্য নিয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করার সম্ভাব্য যে দুটো কারণের কথা বলেছিলাম তার একটি হচ্ছে সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে রাশিয়ার সরকারের পতনের চেষ্টা। কিন্তু মাত্র ২৫হাজার সেনাকে সাথে নিয়ে ১১.৫ লক্ষ সৈন্য এবং ২০ লক্ষ রিজার্ভ সৈন্যের সেনাবাহিনী সংবলিত পৃথিবীর বৃহত্তম দেশটির সরকার পতন একটু বেশি বাড়াবাড়ি রকমের সাহস দেখানো হয়ে যায়। তবে ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে পুতিন এই রাশিয়ান সৈন্যদের অনেককে ইউক্রেনে মোতায়েন করেছেন, তাই পুতিন অবিলম্বে ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অবিলম্বে এই সৈন্যদেরকে দেশে আনতে পারবেন না। কিন্তু তারপরও সংখ্যার দিক থেকে পুতিনের একটা সুবিধা আছে, অন্তত এমনটাই মনে হচ্ছে। তাহলে প্রিগোজিন কেন এই আক্রমণটা করতে গেলেন?

রুশ সেনাদের পাশে পাওয়ার আশা

কোন রকম পরিকল্পনা ছাড়া এভাবে আক্রমণ করাটা বোকামি হতো। এক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি তাকে অভ্যুত্থানে চালিত করে থাকতে পারে তা হচ্ছে এই আশা যে বেশিরভাগ রাশিয়ানরা পুতিনের পরিবর্তে তাকেই সমর্থন করবে। আর এটা কল্পনা করাও কঠিন নয় যে কিছু রাশিয়ান সৈন্য ওয়াগনার গ্রুপের সাথে লড়াই করতে অস্বীকার করবে কারণ তারা তাদের সহকর্মী রাশিয়ানদের উপর গুলি চালাতে চাইবেনা। এক্ষত্রে যে সব ফ্যাক্টরগুলো কাজ করেছে –

১. পুতিনের চেয়ে অনেক বেশি রাশিয়ান প্রিগোজিনকে বেশি পছন্দ করে, এটা বলাও হয়তো খুব বেশি ভুল হবে না। আমরা যখন রাশিয়ার জনগণের ইন্টারনেট অনুসন্ধানের দিকে তাকাই, তখন একটা প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, আর তা হচ্ছে পুতিন এখন আর রাশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি নন। মে মাসে, রাশিয়ানরা পুতিনের নামের চেয়ে দ্বিগুণ প্রিগোজিনের নাম অনুসন্ধান করে। মনে রাখতে হবে যে পুতিন দেশটির সব মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন, কিন্তু তারপরও পুতিন এখন আর অত জনপ্রিয় নন যেমনটা তিনি প্রায় দুই বছর আগে ছিলেন। জরিপের দিকে তাকালে দেখা যায় বেশিরভাগ রাশিয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধকে সমর্থন করে। কিছু জরিপে দেখা গেছে যে দুই-তৃতীয়াংশ রাশিয়ান ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে (যাকে স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন বলা হচ্ছে) সমর্থন করে। তবে পুতিনের প্রতি প্রকৃত সমর্থন সম্পর্কে এটি খুব বেশি কিছু বলে না। আপনারা দেখুন, যেসব রাশিয়ান যুদ্ধকে সমর্থন করে না তারা জরিপে তা স্বীকার করবে না, কারণ তারা যখন পুতিনের নীতির প্রকাশ্যে সমালোচনা করে তখন এটি তাদের জীবিকার জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। এমনকি যখন তারা পুতিনের প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করে এবং মনে করে যে রাশিয়াকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধটি খুব প্রয়োজনীয়, তখনও বেশিরভাগ রাশিয়ান পুতিনের যুদ্ধের জন্য মরতে প্রস্তুত থাকেনা।

২. পুতিন যখন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রায় ৩ লক্ষ রাশিয়ানকে নিয়োগ করেছিলেন, তখন অনেক রাশিয়ান তাদের দেশকে যেভাবে শাসন করা হচ্ছে তা আর পছন্দ করেননি। ফোর্বস জানিয়েছে, এই ঘোষণার পর থেকে প্রায় সাত লাখ রুশ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, যা পুতিনের আংশিক সমাবেশের বা পার্শেল মোবিলাইজেশনের প্রতি ব্যাপক অসন্তোষকে প্রকাশ করে। এমনকি জরিপে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রতি বিপুল সমর্থন দেখানো হলেও, রাশিয়ানদের একটি বড় দল রয়েছে যারা পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে চায়। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী নিয়েও একই কথা বলা যেতে পারে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে ইউক্রেনে রাশিয়ার অনেক ইউনিট পুরানো সরঞ্জামগুলির উপর নির্ভরশীল দুর্বল প্রশিক্ষিত রিজার্ভিস্টদের সমন্বয়ে গঠিত। রাশিয়ান সৈন্যদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, খারাপ আচরণ করা হয়েছে এবং যথাযথ সরঞ্জাম ছাড়াই ফ্রন্ট লাইনে প্রেরণ করা হয়েছে – এরকম অনেক খবর পাওয়া গেছে। রাশিয়ান হতাহতের সংখ্যা একেক জায়গায় একেক রকম, তবে কিছু অনুমান অনুসারে রাশিয়ার সেনাদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার নিহত ও ১.৮ লক্ষ আহত হয়েছে।  রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনে খারাপ সময় কাটাচ্ছে এবং এটি নিঃসন্দেহে পুতিনের প্রতি তাদের ভাবমূর্তির উপর প্রভাব ফেলছে। যুদ্ধে যখন আপনি আপনার বন্ধুকে হারাবেন তখন সম্ভাবনা আছে যে এই বিশেষ সামরিক অভিযানটিকে আপনি একটু ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করবেন, বিশেষত যখন আপনি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জাম পাননি। তাই এটা মোটেও অসম্ভব নয় যে, রাশিয়ান সৈন্যদের মধ্যে একটি বড় দল রয়েছে যারা রাশিয়ার বর্তমান সরকারের ক্ষমতা উৎখাত করার ক্ষেত্রে প্রিগোজিনকে সমর্থন করত। কেননা তারা রাশিয়ান সামরিক নেতৃত্বের অযোগ্যতা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছে।

এবং আসলেই অনেক রাশিয়ান সৈন্য প্রিগোজিনের আক্রমণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ওয়াগনার ভাড়াটে সৈন্যদের সাথে লড়াই করতে অস্বীকার করে। প্রিগোজিন একটি গুলিও না ছুড়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর দখল করে নেয়। এই হেডকোয়ার্টারগুলোতে সৈন্যরা যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে সরাসরি পুতিনকে অমান্য করেছে কারণ পুতিন তার সেনাবাহিনীকে অপরাধী প্রিগোজিনকে দমন করার আদেশ দিয়েছিলেন, কারণ ইতিমধ্যেই তার অনেক সৈন্য তাকে অমান্য করতে শুরু করেছিল। তাই এই পরিস্থিতিতে যে রুশ সেনাবাহিনীর ওপর পুতিনের অপার হ্যান্ড ছিল তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। তবে, এটি দেখা গেছে যে অনেক সেনাই পুতিনের বিরুদ্ধে গেলেও, অনেক সেনাই পুতিনের পক্ষে ছিল, এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল যারা প্রিগোজিনকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। প্রিগোজিন রক্তপাত এড়ানোর জন্য রাশিয়ার রাজধানী শহরে তার অভিযান বাতিল করেন, যার অর্থ এই যে, তিনি অনুমান করেছিলেন যে রুশ বাহিনী তার বিরুদ্ধে কিছু প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে। এটি ওয়াগনারের একটি ভুল অনুমানও হতে পারে। তারা আশা করেছিল যে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পুতিনকে অমান্য করবে এবং এমনকি কিছু রাশিয়ান সৈন্য তাদের পক্ষে যোগ দেবে। অন্যথায়, তারা মাত্র ২৫,০০০ সেনা নিয়ে ১০ লাখেরও বেশি সংখ্যার রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যেত না। প্রিগোজিন সম্ভবত ধারণা করেছিলেন যে পুতিনের কিছু জেনারেল তার বিরুদ্ধে চলে যাবেন। কিন্তু হামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তা ঘটেনি।

বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ

কিন্তু রাশিয়ান বাহিনীর বিদ্রোহ ছাড়াও প্রিগোজিন ভেবেছিলেন যে তার হাতে আরও একটি কার্ড রয়েছে। পুতিনের জন্য এই হুমকিটি রাশিয়ারই ভেতর থেকে এসেছিল, তবে এর অর্থ এই নয় যে বাইরের শক্তি হস্তক্ষেপ করবে না। হ্যা, ইউক্রেনীয় যুদ্ধের কথা বলছি। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নিজেই লড়াই করা সত্ত্বেও, প্রিগোজিন ইউক্রেনের ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকতে পারেন। গত শুক্রবার টেলিগ্রামে পোস্ট করা ভিডিওতে প্রিগোজিন প্রথমে যুদ্ধ শুরু করার জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করেন। তিনি বলেন,, রাশিয়ানরা খবরে গত কয়েক মাস ধরে যেসব রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা মূলত শুনে আসছে সেগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি বলেন, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রুশ সমাজ ও প্রেসিডেন্টকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রিগোজিন দাবি করেছেন যে, রাশিয়া যেমনটা দাবি করে, ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য তেমন কোনও বড় রকমের হুমকি নয়, এবং ন্যাটো রাশিয়াকে আক্রমণ করবে এই গুজবগুলি মিথ্যা। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনকে অসামরিকীকরণ বা অস্থিতিশীল করার কোনো প্রয়োজন নেই এবং এগুলো সবই মিথ্যা তত্ত্ব। অন্য কথায়, তিনি যুদ্ধ শুরু করার জন্য পুতিনের সমস্ত প্রেরণাকে, অর্থাৎ ন্যাটো আগ্রাসন মোকাবেলা করা, আমাদের ইউক্রেনীয় ভাই-বোনদের সহায়তা করা এবং ইউক্রেনে নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করা – এগুলোকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। প্রিগোজিনের তত্ত্ব হলো, বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র একটি কারণে, আর তা হচ্ছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে আরও শক্তিশালী করার জন্য। লক্ষ্য করুন যে ওয়াগনার নেতা কেবল সের্গেই শোইগুর সমালোচনা করেছিলেন এবং তিনি পুতিনকে কোনোভাবে দোষারোপ করেন নি। প্রিগোজিনের দৃষ্টিতে, পুতিন আসলে শোইগুর প্রতারণার শিকার, কেননা শোইগুর লোকেরাই পুতিনকে এসব বুঝিয়ে তাকে বিশ্বাস করিয়েছেন যে যুদ্ধটি প্রয়োজনীয়।

সংঘাতের সময় প্রিগোজিন এটা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, তিনি পুতিনকে উৎখাত করার চেষ্টা করছেন না, বরং তিনি সের্গেই শোইগুকে উৎখাত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সংঘাতের ক্ষেত্রে এই টেকনিক্যালিটি খুব একটা ম্যাটার করেনা। পুতিন তার প্রাক্তন ওয়াগনার মিত্রকে বিশ্বাস করেন না কারণ তিনি শোইগুর পক্ষে থাকাকেই ঠিক মনে করেন। পুতিন রাশিয়ার ভূখণ্ডে প্রিগোজিনের অগ্রগতি থামাতে, অবরোধ আরোপ এবং ওয়াগনার কলামে আক্রমণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। যাই হোক, প্রিগোজিন বিশ্বাস করতেন না যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। তিনি ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন যে, ইউক্রেন মিথ্যা প্রলোভনে আক্রমণ করা হয়েছিল, আর স্পষ্টতই তার এই অবস্থানের কারণে তিনি কিছু মিত্রও লাভ করে থাকবেন। কিছু দেশ আছে যারা রাশিয়ার সীমানায় চলা এই অশান্তিকে পছন্দ করে। সেই সাথে ইউক্রেনের সরকারও চায় যে রাশিয়ায় পুতিনের পরিবর্তে এমন কেউ ক্ষমতায় আসুক যিনি ইউক্রেইনের প্রতি একটু ইতিবাচক হবেন, এমন কেউ যিনি অন্তত কোন স্পষ্ট কারণ ছাড়াই ইউক্রেইনে আক্রমণ করবেন না। সম্ভবত প্রিগোজিন পুতিনের চেয়ে রাশিয়ার জন্য আরও ভাল নেতা হতে পারতেন। ইউক্রেনের দৃষ্টিতে তাই অবশ্যই প্রিগোজিন দুই মন্দের মধ্যে ভাল। ইউক্রেনের জন্য, প্রিগোজিনের পদক্ষেপগুলি একটি সুযোগ উপস্থাপন করেছিল। তারা পুতিনকে উৎখাত করার প্রয়াসে প্রিগোজিনকে সহায়তা করার সুযোগ দেখেছিল। ওয়াগনার তাদের বন্ধু না হলেও শত্রুর শত্রুকে স্ট্র্যাটেজিকালি বন্ধু ভাবাই যায়। একইভাবে ন্যাটোও রাশিয়ার সরকারের বিকল্পকে বিবেচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করেছে যে ওয়াগনার অভ্যুত্থান বাস্তব এবং গুরুতর ছিল এবং রাষ্ট্রপতি বাইডেন পরবর্তীতে কী করা উচিত সে সম্পর্কে তার মিত্রদের সাথে পরামর্শ করেছেন। অনেক পশ্চিমা নেতা বারবার পুতিনের প্রতি তাদের অপছন্দ প্রকাশ করেছেন। ব্যাপারটি হচ্ছে যে তারা পুতিনের চেয়ে অপরাধী প্রিগোজিনকে বেশি পছন্দ করে কারণ তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন।

তবে এটাও ঠিক যে পারমাণবিক বৃদ্ধি বা নিউক্লিয়ার এস্কেলেশনের ঝুঁকির কারণে ওয়াগনার গ্রুপকে সরাসরি সামরিক সহায়তা প্রেরণ একটি বিপজ্জনক পদক্ষেপ হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, কোন কিছু রাশিয়ার অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি হলে পুতিনও লাল বোতাম চাপার সুযোগ পেয়ে যান। তবে এটাও উল্লেখ্য যে, এরকম ক্ষেত্রে পুতিনের স্বাধীনতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের তুলনায় একটু কম, কেননা পারমাণবিক হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য পুতিনকে তার কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ড, জেনারেল স্টাফেরও মতের প্রয়োজন। পারমাণবিক অস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হলে পরোক্ষভাবে প্রতিশোধমূলক হামলা বা রিটেলিয়েশন স্ট্রাইকের কারণে রাশিয়ার বেশিরভাগ জনগণই মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়বে। এটা ঠিক যে, জেনারেল স্টাফরা পুতিনের আদেশ অন্ধভাবে অনুসরণ করবে না, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এই ঝুঁকির দিকে যাবে না, আর তারা ওয়াগনার গ্রুপকেও সরাসরি সামরিক সহায়তা পাঠাবে না। তবে গোপন সহায়তা পাঠানোর প্রশ্নটি কিন্তু অগ্রাহ্য করা যায়না। প্রিগোজিন রাশিয়ার অভ্যন্তরে এবং বাইরে উভয় দিক থেকেই সমর্থন পেতে পারতেন। তিনি সম্ভবত ভেবেছিলেন পুতিনের বিরুদ্ধে তার সত্যিকারের সুযোগ রয়েছে।

প্রিগোজিনের অভ্যুত্থান থেকে সরে আসার অন্যান্য কারণ

ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকার সম্ভাবনা

প্রিগোজিনের সেনাসমেত রাশিয়ায় যাবার আরেকটি কারণ হিসেবে বলেছিলাম লস এড়াতে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার জন্য প্রিগোজিন এমনটা করে থাকতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে এভাবে অভ্যুত্থান থেকে সরে আসাটাও এই পরিকল্পনাটিরও একটি অংশই হবে। প্রিগোজিন একজন ব্যবসায়ী, এবং তিনি যে অভ্যূত্থানটি ঘটাচ্ছিলেন তার পুরোটাই ব্যবসায়িক স্বার্থেই। তার ওয়াগনার একটি প্রাইভেট বা বেসরকারি মিলিটারি কোম্পানি, যা তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারা যুদ্ধের জন্য ভাড়া করা হয়। রুশ সরকারের আদেশ অনুযায়ী রাশিয়া তাদের এমন জায়গায় যেতে ব্যবহার করেছিল যেখানে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে যেতে চায়নি এবং এদেরকে দিয়ে রাশিয়া এমন কিছু করিয়েছিল যা তারা বিশ্বকে জানাতে চায়নি। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াগনার সিরিয়ায় রাশিয়ার মিত্র রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদের সরকার ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করার জন্য একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এ জন্য তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। তাদের কর্মকাণ্ডে বেসামরিক নাগরিক, ত্রাণকর্মী এবং বন্দীদের হত্যা করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। তারা খুব বাজেভাবে যুদ্ধাপরাধও সংঘটিত করেছে (এই বিষয়ে লিখতে গেলে আরেকটা বিশাল আর্টিকেল হয়ে যাবে)।

নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিনিময়ে ওয়াগনার সিরিয়ায় তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের চুক্তি পেয়েছে, যার মাধ্যমে প্রিগোজিন বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। শুধু সিরিয়া নয়; ওয়াগনার বিশ্বজুড়ে এই ব্যবসায়িক মডেলটি কার্যকর করেছে। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনার তার ভাড়াটে সৈন্যদের দিয়ে স্বৈরাচারী নেতাকে সমর্থন করার পরে স্বর্ণ এবং হীরার খনির অধিকার রয়েছে। সুদানে, ওয়াগনার গৃহযুদ্ধে সরকারকে সহায়তা করার বিনিময়ে এখন সেখানকার সোনার খনি এবং তার প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট নিয়ন্ত্রণ করে। আর লিবিয়ায়, গৃহযুদ্ধে সরকারকে সহায়তা করার জন্য ওয়াগনার তার তেল ক্ষেত্রগুলির কয়েকটিতে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এগুলি ওয়াগনারের ব্যবসায়িক লেনদেনের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। তবে আশা করি পয়েন্টটি বুঝতে পেরেছেন। প্রিগোজিন একজন ব্যবসায়ী, এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ সম্ভবত তার জন্য একটি ব্যবসায়িক চুক্তি ছিল, যেখানে আক্রমণ চালানোর জন্য তাকে রাশিয়ান সরকার অর্থ প্রদান করছিল, আর বিনিময়ে তাদেরকে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর হয়ে ইউক্রেইনে এমন সব নৃশংস কাজ করার কথা ছিল যা রাশিয়া তার সেনাবাহিনী দিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সেই ব্যবসায়িক চুক্তিটি তার পক্ষে আর অনুকূল নেই। রাশিয়ার অর্থনীতি স্যাঙ্কশনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, আর তার ফলে ওয়াগনারের প্রাপ্য অর্থে হয়তো টান পড়ে থাকবে। আবার এমনটা নাও হতে পারে। (রাশিয়ার উপর স্যাঙ্গকশন কতটা কার্যকর তা ভিন্ন আলোচনা, সেখানে যাচ্ছিনা।) তবে যে আরেকটা ফ্যাক্টর প্রিগজিনের এমনটা মনে করায় অবদান রাখতে পারে, তা হচ্ছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে, মানে সের্গেই শোইগুর সাথে তার সম্পর্ক। ধরুন আপনি একজনের হয়ে কাজ করছেন, কিন্তু যে আপনার এই কাজের জন্য অর্থ পরিশোধ করবে সে আপনাকে পছন্দ করেন। এই অবস্থায় এরকম ক্রিটিকাল টাইমে অবিশ্বাস তৈরী হওয়া আর সেজন্য এরকম সংঘাতের পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেক্ষেত্রে প্রাপ্য অর্থ পাবার জন্য এরকম ভয় দেখানোটা প্রয়োজনীয় হতে পারে। আবার প্রাপ্যের দিকে না গিয়ে জাস্ট লস এড়াতে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা, আর সেই সাথে নিজের সম্মানটুকুও বজায় রাখার জন্য এসব করাটাও স্মার্ট বিজনেস মুভ হতে পারে।

রুশ অভিজাতদের থেকে আসা সমর্থন

আরেকটি তত্ত্ব সম্পর্কে বলা যায়। সেটা হচ্ছে, প্রিগোজিন যখন তার অভ্যুত্থান শুরু করেছিলেন, তখন এটি ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়েছিল যে তিনি রাশিয়ান সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অভিজাতদের কাছ থেকে অভ্যন্তরীণ সমর্থন পেয়েছিলেন। এই তত্ত্বের পক্ষে জনপ্রিয় সমর্থন হ’ল ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ায় প্রবেশের সময় ইউক্রেন-রাশিয়ান সীমান্তে এফএসবি (ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস) এজেন্টদের কাছ থেকে কোনও বিরোধিতার মুখোমুখি হয়নি, যেন এফএসবি এজেন্টদের ওপর ওয়াগনার কনভয়কে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল। রোস্তোভ শহরে অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল যখন ওয়াগনার খুব বেশি বিরোধিতা ছাড়াই শহর এবং সরকারী সদর দফতর দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। এখানেই আমরা প্রিগোজিনের জনপ্রিয় ভিডিওটি দেখতে পাই যেখানে প্রিগোজিন রোস্তভ সরকারের একজন কর্মকর্তার সাথে বসে বলছেন যে তিনি কীভাবে শোইগুর সাথে কথা বলতে চান। তবে এটি বেশ সম্ভব যে তখন তিনি ইতিমধ্যেই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তার সমর্থন হারিয়েছিলেন যারা পূর্বে তার পেছনে ছিলেন। আমরা দেখতে পাই, ওয়াগনার রোস্তোভের দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রতিটি উচ্চ পর্যায়ের রাশিয়ান কর্মকর্তা প্রকাশ্যে পুতিনের প্রতি তাদের আনুগত্যের অঙ্গীকার করেছিলেন। এটি সম্ভবত জনসাধারণকে শান্ত করার জন্য এবং পুতিনকে দেখানোর জন্য করা হয়েছিল যে তারা প্রিগোজিনের ক্রিয়াকলাপের পিছনে নেই। প্রিগোজিন এবং তার ছায়া সমর্থকরা সম্ভবত এটি আশা করেননি। তারা আশা করছিলেন যে ওয়াগনার গ্রুপ মস্কোর নিকটবর্তী হওয়ার সাথে সাথে আরও বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা পুতিনের সরকারের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসবেন এবং ওয়াগনারকে তাদের সমর্থন প্রদর্শন করবেন। কিন্তু একজন কর্মকর্তাও প্রকাশ্যে ওয়াগনারকে সমর্থন করেননি। আর বাস্তবতা বোঝার সাথে সাথে, প্রিগোজিনকে সমর্থনকারী যে কোনও কর্মকর্তা তাকে সহায়তা করে জীবনের ঝুঁকি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং প্রকাশ্যে পুতিনের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন। তবে এটা একটা তত্ত্ব মাত্র। নিশ্চিত করে কিছু বলা যায়না।

পরিবারকে রক্ষা

টেলিগ্রাফে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অনুসারে, যুক্তরাজ্যের নিরাপত্তা সূত্র অনুসারে, প্রিগোজিন মস্কোতে তার অগ্রগতি বন্ধ করার আগে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থাগুলি ওয়াগনার নেতাদের পরিবারের ক্ষতি করার হুমকি দিয়েছিল। আর পরিবারের এই ঝুঁকির জন্য প্রিগোজিনের পিছু হত্যা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই তত্ত্ব কতটা সম্ভবপর তা নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রিগোজিন পুতিনের বিরুদ্ধে ফেলে পুতিন যে তার প্রিয়জনদেরকে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন তা প্রিগোজিনের ভালোভাবেই জানার কথা। তাই প্রিগোজিনেরও আগে থেকেই তাদেরকে কোন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেবার কথা। তবে যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে প্রিগোজিনের পরিবারের সেই সেইফ হাউজও পুতিনের এজেন্টরা খুঁজে বের করে ফেলেছিল, আর তাই প্রিগোজিনকে পিছু হটতে হয়েছিল। কে জানে এর সত্যতা কতটুকু। কিন্তু এটি নিশ্চিত করার মত অধিক তথ্য আর পাওয়া যায়নি। শুধু এটাই জানা যায় যে, বেলারুশে যাওয়ার আগে প্রিগোজিনের বিমানটি তার নিজ শহরে থেমেছিল। এখন তার পরিবার আসলেই ঝুঁকিতে ছিল কিনা সে সম্পর্কে আর কোনও তথ্য পাওয়া যায়না। এখন এটাও সম্ভব যে বেলারুশে নির্বাসিত হওয়ার আগে তিনি কেবল তার শহর পরিদর্শন করতে চেয়েছিলেন।

পুরোটাই কি ওয়াগনারের বেলারুশ থেকে কিভে আক্রমণ করার কৌশল? না, সেটা হাইলি আনলাইকলি!

অনেক পুতিনপন্থী তো এও বলছে যে, ওয়াগনারের এই কাজ আসলে কোন অভ্যুত্থান ছিলনা। তারা জাস্ট এর মধ্যে দিয়ে ওয়াগনার বাহিনীকে বেলারুশে নিয়ে যেতে চেয়েছিল যার মাধ্যমে তারা বেলারুশ থেকে কিভের নিকটবর্তী হতে পারে ও সেখান থেকে কিভে আক্রমণ করতে পারে। এরকম এক্সট্রিম ওয়াইল্ড স্পেকুলেশন হাসির উদ্রেক করে, কিন্তু অনেক এক্সপার্টই বলবেন এটা পুরোপুরি অসম্ভবও নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রিগোজিনকে এত কাণ্ড করে সেনাবাহিনী নিয়ে রাশিয়ায় অভিযান করতে হল কেন? উত্তর হতে পারে প্রিগোজিনের রেপুটেশন বাঁচানোর জন্য, কারণ তিনি একজন ব্যবসায়ী যার জন্য রেপুটেশন গুরুত্বপূর্ণ। থিওরিটি এই থিওরীর সম্ভাবনাকেও বাড়িয়ে তোলে যে, প্রিগোজিন আসলে শেষের দিকে বাখমুতে তার পরাজয়কে লুকোতে বারবার রুশ বাহিনী ও রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করে আসছিলেন। কারণ নিজের রেপুটেশন বাঁচানো। এটা একেও ব্যাখ্যা করে যে কেন রুশ বাহিনী এত সহজে তাকে মস্কোর দিকে অভিযান করতে দিল।

তবে এই থিওরিটিতে দুটি দুর্বল দিক আছ। প্রথমত, পুতিনের পলিটিকাল ক্যাপিটালের ক্ষতির দিকটা। যার ফলে পুতিন তার জনপ্রিয়তা হারাবেন, তার সেনাবাহিনীর মোরাল ভেঙে যাবে, নিজে  ক্ষমতা হারানোর ও অন্তন্ত সামনের নির্বাচনে হারার ঝুঁকিতে পড়বেন, সেটা তিনি এপ্রুভ করবেন কেন? দ্বিতীয়ত, বর্তমান যুগে অতির্কিত বা আকস্মিক আক্রমণ সম্ভব নয়। এই যুগে স্যাটেলাইট রয়েছে, আর তাই ওয়াগনার যদি বেলারুশ থেকে এরকম কোন আক্রমণের পরিকল্পনা করে তবে তার জন্য বেলারুশে যে সেনা ও সরঞ্জামের সমাবেশ প্রয়োজন তা যখন ঘটবে তখনই বুঝে যাওয়া সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইউক্রেইনে রাশিয়া হামলা চালানোর পূর্বে মার্কিন ইন্টেলিজেন্স ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার মিলিটারি বিল্ড আপ নিয়ে ইউক্রেইনকে প্রচুর ওয়ার্নিং দিয়েছিল। তাছাড়া একটি অতর্কিত আক্রমণের একটি বড় সুবিধা হ’ল আপনি আপনার প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রমণ করা। কিন্তু কিভ তাদের ডিফেন্সর ডঃ দিয়ে খুব ভালভাবেই প্রস্তুত। তাই সব মিলে এই থিওরিটি দুর্বল ও অনেকটাই অসম্ভব।

প্রিগোজিনের পুনরায় আক্রমণের সম্ভাবনা

ওয়াগনার বাহিনী আক্ষরিক অর্থেই রাশিয়ান বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারগুলোকে ভূপাতিত করেছে এবং সেখান থেকে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে ফিরেও গেছে। শুধু তাই নয়, গত কয়েক দিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ওয়াগনার মনে করে যে তারা নিয়মিত রাশিয়ান সৈন্যদের চেয়ে ভাল। এক অর্থে, পুতিন যা বপন করেছিলেন তার ফসল কাটছেন। আপনি যদি একজন পাগল অপরাধী শেফকে তার নিজস্ব ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী তৈরি করতে দেন যার উপর আপনি অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নির্ভর করেন,  তাহলে আপনি সমস্যাকেই ডেকে আনছেন।

এখন প্রিগোজিনের সঠিক পরিকল্পনা কী তা স্পষ্ট নয়। একটা বিষয় নিশ্চিত, তা হচ্ছে পুতিনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের অবসান হয়েছে। পুতিন ইউক্রেইনে অবশিষ্ট ওয়াগনার সৈন্যদেরকে তিনটি বিকল্প দিয়েছেন, এর মানে হল পুতিন নিজেও ওয়াগনারের পুনর্বার আক্রমণ নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। এছাড়া তিনি ইটা নিয়েও নিশ্চিত নন যে, ওয়াগনার পুনরায় আক্রমণ করলে রুশ বাহিনীর লোকেরা তাকে কতটা সমর্থন করবে, বা তারা প্রিগোজিনের পক্ষে যোগ দেয় কিনা। এই ভয়টা আছে বলেই পুতিন আক্রমণের সময় মস্কো ত্যাগ করে সেইন্ট পিটার্সবার্গে গিয়েছিলেন। 

এদিকে প্রিগোজিন পিছু হটেছেন ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অভ্যুত্থান পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে। ওয়াগনারের বেশিরভাগ সেনারই বেলারুশে প্রিগোজিনের কাছে আসার কথা। এদের নিয়ে যে তিনি আবার রাজধানী মস্কোতে আরেকটি অভিযান-প্রচেষ্টা করবেন না তা তো বলা যায়না। সেক্ষেত্রে হয়তো এবার রাশিয়ার অভ্যন্তরের এবং সম্ভবত ইউক্রেনের মতো অন্যান্য দেশ থেকেও সমর্থন নিয়ে তিনি রাশিয়ায় আক্রমণ করবেন। প্রিগোজিন বলছেন এটি অভ্যুথান নয়, কেবল আন্দোলন ছিল। কিন্তু তা কতটাই বা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে।

এদিকে স্পষ্টতই, পুতিন ইউক্রেনের যুদ্ধ জয়ের চেয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসাবে তার অবস্থানকে অগ্রাধিকার দেন। যখন তাকে প্রিগোজিন ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্যে একটি বেছে নিতে হবে, তখন অবশ্যই তিনি প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে লড়াই করাটাকেই বেছে নেবেন। ওয়াগনার ভাড়াটে সৈন্যরা রাশিয়ায় পুতিনের নেতৃত্বকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। যদি তারা আবার আক্রমণ করতে সক্ষম হয়, তবে পুতিনের জন্য একই সময়ে দুটি আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা কঠিন হবে, যার একটি সম্ভবত দেশের অভ্যন্তরের, আরেকটি দেশের বাইরের।

যদি প্রিগোজিনের পরিকল্পনায় আরেকটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা থেকে থাকে, তবে শুক্রবার, ২৩ শে জুন, রাশিয়ার ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। এই দিনে যা ঘটেছিল তা পুতিনের শাসনের অবসান ঘটানোর প্রথম প্রচেষ্টা হিসাবে ইতিহাসের বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে পরবর্তীতে কী ঘটবে? এর অর্থ কি এই যে পুতিনের দিন শেষ হতে চলেছে? আর ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্যই বা এর তাৎপর্য কী?

পুতিন ও রাশিয়ার দুর্বলতার আভাস, কোন পথে রাশিয়া?

তবে এই পুরো গল্পটি আমাদের বেশ কয়েকটি প্রশ্ন রেখে যায়। কেন বিমান বাহিনী সহ সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান প্রতিহত করার জন্য দৃঢ়ভাবে একত্রিত হয়নি? ক্রেমলিনের মধ্যে কি অবিশ্বাস ছিল যে উত্তেজনা আরও বেড়ে গেলে কিছু ডিভিশন তার আদেশ নাও মানতে পারে, এবং পরিবর্তে বিদ্রোহীদের পক্ষ নিতে পারে? কেন পুতিন নিজে সকালে ওয়াগনার সদস্যদের বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তারা কঠোর শাস্তি পাবেন, কিন্তু এর কয়েক ঘন্টা পরেই তাদেরকে চুক্তির মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হল? ক্রেমলিনে কি তাদের স্পষ্ট ধারণা ছিল না যে তারা সহজেই এই ধরনের প্রতিরোধকে দমন করতে পারে? লুকাশেঙ্কোর মতো মধ্যস্থতাকারীর আশ্রয় কেন? ক্রেমলিন কি ভয় পেয়েছিল যে তারা মস্কো, বা রাজধানীর অন্তত কিছু অংশ হারিয়ে যেতে পারে? পুতিন এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা এত দূরে ছিলেন কেন? পুতিন কি আসলেই ভয়ে মস্কো ত্যাগ করেছিলেন? নাকি তিনি তার ইনার সার্কলকে আর বিশ্বাস করে না?

এটা কীভাবে সম্ভব যে, (যেমনটা মার্কিন গোয়েন্দাদের দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে) ক্রেমলিন কয়েক দিন ধরে ওয়াগনারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানত এবং তবুও তারা কোনও কার্যকর প্রস্তুতি ছাড়াই বিস্মিত হয়েছিল বলে মনে হয়েছিল? এখন কি সেই তথ্য আর প্রবাহিত হচ্ছে না? প্রিগোজিন কেন মস্কোর দিকে এগিয়ে গেলেন, এবং যখন তিনি এত কাছাকাছি ছিলেন, তখন তিনি দৃশ্যত কোনও সুনির্দিষ্ট সাফল্য ছাড়াই ফিরে গেলেন? তিনি কি সম্ভবত সরকারের সমালোচক কোনও গোষ্ঠীর সমর্থন আশা করেছিলেন যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি? এর মধ্যে কি অ্যারোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল সিরোভাকিন এবং জিআরইউ-এর ডেপুটি চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল আলেক্সায়েভ জড়িত থাকতে পারে, যারা ওয়াগনার বাহিনীকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে কিছুটা অদ্ভুত বিবৃতি দিয়েছিলেন? এই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার সময় তারা কি সম্ভবত আটক বা চাপের মধ্যে ছিলেন? এটা কি হতে পারে যে ওয়াগনার নেতা সামরিক পদ এবং সরকারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব সনাক্ত করেছেন এবং তাই ভেবেছিলেন যে তার পদক্ষেপটি একটি ডোমিনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি? আমরা জানি না, তবে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলির দ্বারা প্রস্তাবিত তত্ত্বটি এটি। এটি ব্যাখ্যা করতে পারে যে তিনি কেন সরে দাঁড়ালেন এবং পুতিন কেন সশস্ত্র বাহিনীকে একত্রিত করতে বা ওয়াগনারকে সরাসরি মোকাবেলা করতে চাননি।

যাই হোক না কেন, আপনি দেখতে পারেন যে এই পুরো পর্বটি প্রচুর প্রশ্ন তৈরি করে, যেগুলোর উত্তর নেই, কেবল অনুমান আছে। কিন্তু শুনুন, এটি সুসংগঠিত হোক বা না হোক এবং এটি যে প্রকৃত ঝুঁকি তৈরি করেছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সত্যটি হ’ল প্রিগোজিনের অভ্যুত্থান একটি জিনিস খুব স্পষ্ট করে দিয়েছে, যা এই উক্তিতে পাওয়া যায় : “মাফিয়ারা মাফিয়াদের মতোই। আজ যে চুক্তিই হোক না কেন, রক্ত ঝরেছে এবং পুতিনের অপরাজেয়তার বিভ্রম চলে গেছে। তিনি এবং তার সহকর্মীরা সত্যিকারের ভয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। মস্কো হুমকির শিকার হয়েছে।”- গ্যারি কাস্পারভ। পুতিনের ক্ষমতা এখন আর আগের মতো নেই।

বস কি প্রশ্নবিদ্ধ?

ইউক্রেন যুদ্ধের সময়, ওয়াগনার গ্রুপ এবং বিশেষত এর নেতা প্রিগোজিন আরও বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে – প্রথমে মূল অভিযানের নেতা হিসাবে, তারপরে সামরিক নেতৃত্বের উপর অভিশাপ হিসাবে, এবং সম্প্রতি দুর্ভাগ্যজনক রাশিয়ান সৈন্যদের রক্ষক হিসাবেও। এটি করার জন্য, তিনি রাশিয়ান সৈন্যদের হারানোর নিন্দা জানিয়ে ভিডিও রেকর্ড করতে দ্বিধা করেননি, তাদের বিধবা স্ত্রী এবং মায়েদের উপহার দিয়েছেন এবং সর্বোপরি, যুদ্ধ সম্পর্কে সত্য বলেছেন যা রাশিয়ার অন্য কেউ বলার সাহস করেনি। ঠিক আছে, এগুলি এমন পদক্ষেপ যা রাশিয়ায় খুব ভাল বিক্রি হয়, যা তার জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি করেছে। সরকারের সাথে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পরে তিনি কীভাবে হাততালি এবং উল্লাসের মধ্যে রোস্তোভ-অন-ডন ত্যাগ করেছিলেন তা দেখলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। ওয়াগনার বাহিনী চলে যাওয়ার সময় রোস্তোভের নাগরিকরা এমনকি উল্লাস করেছিল এবং পুলিশ ফিরে আসার সাথে সাথে ঠাট্টা করেছিল।

কিন্তু আপনি হয়তো ভাবছেন, পুতিন কেন এই ব্যক্তিকে এত দিন ধরে তার সরকারকে নিরলসভাবে মৌখিক আক্রমণ করতে দিয়েছিলেন? এর অন্যতম কারণ হ’ল এই সমস্ত নিন্দার সাথে, তিনি আসলে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করছিলেন। প্রিগোজিন শোইগু এবং কারাসিমভের মতো ব্যক্তিত্বদেরকে অভিযুক্ত করে বলেন, খারাপ অবস্থার জন্য তারাই আসল অপরাধী, প্রেসিডেন্ট নয়। কিন্তু ২৩ শে জুন শুক্রবার তার ভিডিওর সাথে সবকিছু পাল্টে যায়। কারণ এমিউনিশনের অভাবের সমালোচনা করা এক জিনিস, এবং আক্রমণকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য এসব যুক্তি দেয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। আর এ কারণেই পুতিন টিভিতে সরাসরি বলেছিলেন প্রিগোজিন একজন বিশ্বাসঘাতক বা রাষ্ট্রদ্রোহী।

কিন্তু প্রিগোজিন রাষ্ট্রদ্রোহী হবার পরও তাকে না অনুসরণ করা বা না দমন করাটা আসলে পুতিনের  জন্য নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেবার মতোই ব্যাপার। মনে হচ্ছে তিনি আর তাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছেন না, এবং এটি একটি সমস্যা কারণ এটি স্পষ্ট করে দেয় যে রাশিয়ার বসের আর আগের মতো ক্ষমতা নেই। “আমি তিক্ততার সাথে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি যে রাশিয়ান ফেডারেশন তার অনিবার্য এবং অপূরণীয় মৃত্যুর দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে।” – ভিক্টর এমানদোভিচ এলকনেস, সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রাক্তন সদস্য এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের স্টেট ডুমার প্রাক্তন ডেপুটি। “আজ, বিশ্ব দেখেছে যে রাশিয়ার মালিকরা কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে না, কিছুই নয়। সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা।” – জেলেনস্কি।

এটি সত্য যে এটি প্রতীয়মান হয় যে সমঝোতা অনুযায়ী, প্রিগোজিন রাশিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এর মানে কি এই যে তিনি তার ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে পিছনে ফেলে যাবেন? তিনি কি অন্যের কাঁধে তার ভূমিকা হস্তান্তর করবেন? এসব নিয়ে সন্দেহ আছে। পুতিন যদি ওয়াগনারের সাথে চুক্তির কোন অংশ পরিবর্তন করেন তবে রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের সাথে কী ঘটবে তাও দেখার বিষয়। কিন্তু যাই ঘটুক না কেন, যদি কিছু হয়, তবে এটা স্পষ্ট যে এই সবকিছুই পুতিনের জন্য একটি বড় আঘাত। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনে বিপর্যয় ডেকে এনেছেন। বর্তমানে তিনি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন এবং এখন এই অবস্থা। রাশিয়ার সাংবাদিক মিখাইল জাইগার জানুয়ারিতে যা বলেছিলেন তা দেখুন: “রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন অবশেষে লক্ষ্য করেছেন যে ইউক্রেনের যুদ্ধ তৈরি করেছে তার ক্ষমতার বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়েভগেনি প্রেগুজিনকে।”

এর মাধ্যমে রাশিয়ার সরকার-বিরোধী বিদ্রোহ আরও বেশি বেগ পাবে। পুতিনকে এখন আর অতীতের মত ভয় লাগবে না, এবং এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় স্বৈরশাসকের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে খারাপ ঘটনা। এখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গড়ে ওঠে মূলত তার ভয় দেখানো, শ্রদ্ধা বোধ জাগ্রত করা এবং যে কোনও ভিন্নমতকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে। কিন্তু এবার আমরা দেখেছি কিভাবে ২৫,০০০ ভাড়াটে সৈন্যের একটি সংগঠন ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য অপারেশনের স্নায়ুকেন্দ্র দখল করে নেয় এবং কোন প্রতিক্রিয়া ছাড়াই মস্কোর দিকে অগ্রসর হয়। “লুকাশেঙ্কো যে এই পরিস্থিতিটি শান্ত করলেন সেটা আমাকে চরমভাবে বিব্রত করে। পুতিনের সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য কাউকে প্রয়োজন।” – স্যাম গ্রিন, রাশিয়ান রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, সিইপিএর পরিচালক এবং কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক।

ভুলে যাবেন না যে সামনে নির্বাচন

রাশিয়ার সামনের নির্বাচন ২০২৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হবে। হ্যাঁ, আমরা জানি, কাতার বিশ্বকাপের বাছাই প্রক্রিয়ার চেয়ে রাশিয়ার নির্বাচনে বেশি কারচুপি হয়। কিন্তু তারপরও দেখা যাক, পুতিন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন কি না এবং তিনি পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন কিনা।

চিন্তা করুন। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির মহান প্রস্তাব, মহান অঙ্গীকার ছিল সর্বদা রাশিয়াকে নৈরাজ্য থেকে উদ্ধার করা এবং রাশিয়ার মহত্ত্বকে পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু এখন সব কিছুই ভেঙ্গে গেছে। রাশিয়া শক্তিশালী নয়, তার সামরিক বাহিনী আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশে কোনো সমৃদ্ধি নেই। মহান অলিগার্করা হেরে যাচ্ছে, এবং সর্বোপরি, দেশে বিশৃঙ্খলা এতটাই বেশি যে একজন সেনাপতি সারা দেশে শান্তভাবে হাঁটতে পারে, তার সাথে কিছুই ঘটে না, তাকে কোনোরকম বাঁধা দেয়া হয়না, আর সে রাজধানী দখল করার হুমকি দেয়। আর চুক্তিটা কী হয়েছে দেখুন। একটি রাশিয়ার অধীনস্ত একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী সেই যুদ্ধ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে যে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।

আর তাও এমন একটি গোষ্ঠী যা সেই যুদ্ধের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওয়াগনার ছিলেন রাশিয়ান আক্রমণের একমাত্র সফল উপাদান। এক বছরের জন্য, এর সাফল্য খুব সীমিত ছিল এবং একটি ছোট শহরে (বাখমুত)  মনোনিবেশ করেছিল এবং এর কৌশলগুলি বর্বর ছিল, এমনকি ওয়াগনার কর্মীদের প্রেক্ষিতেও। কিন্তু তারা অন্তত এমন কিছু অর্জন করতে পেরেছে, যা রুশ সেনাবাহিনী অর্জন করতে পারেনি।” – আন্দ্রে জাগোরোদনিউক, ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

এটি আমাদের যে ছাপ বা ইম্প্রেশন ফেলে যায় তা একটি ক্ষয়প্রাপ্ত দেশের মতোই। আর রাশিয়ায় এর অতীত উদাহরণও রয়েছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ একটি সামরিক অভ্যুত্থান থেকে বাঁচতে সক্ষম হন। তা সত্ত্বেও মাত্র চার মাস পর তিনি ক্ষমতার বাইরে চলে যান। অভ্যুত্থান তার বিশাল দুর্বলতাকে তুলে ধরেছিল। বর্তমান রাশিয়ার সাথেই কি ঠিক তাই হতে চলেছে?

যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়াগনার বিদ্রোহ রাশিয়া-ইউক্রেইনের যুদ্ধকে কীভাবে প্রভাবিত করবে?

আগেই বলা হয়েছে যে রাশিয়া মোটের ওপর ওয়াগনারকে হারাচ্ছে। কথা হচ্ছে এটা যুদ্ধে ইউক্রেইন ও রাশিয়াকে কিভাবে প্রভাবিত করবে? ওয়াগনার যেহেতু রাশিয়ার পক্ষে ছিল, তাই বলা যায় প্রশ্নটি হচ্ছে, রাশিয়ার ওয়াগনারকে এভাবে হারানোটা ইউক্রেইনের জন্য কতটা লাভজনক ও রাশিয়ার জন্য কতটা ক্ষতিকর হবে। ইউক্রেইনের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, এটি তাৎক্ষণিক মেয়াদে বা ইমিডিয়েট টার্মে ইউক্রেইনের কোন কাজে আসবে না। প্রথমত, ওয়াগনারের বেশিরভাগ সৈন্য পূর্বে বাখমুত এবং তার আশেপাশে যুদ্ধ করছিল। আর সেখানেও এই বাহিনী মে মাসের শেষে এবং জুনের শুরুতে নিয়মিত রাশিয়ান সেনাবাহিনী দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণে খেরসনের আশপাশে ওয়াগনারের কোন উপস্থিতি নেই, যেখানে এই মাসে সবচেয়ে ভারী লড়াই চলছে। আর তৃতীয়ত, বিশেষ করে কাউন্টারঅফেন্সিভের পর থেকে ইউক্রেইনে এখন রুশ বাহিনীর কাজ মূলত প্রতিরক্ষামূলক। এখন সেটাই রুশ বাহিনীকে করতে হবে, কিন্তু ওয়াগনার বাহিনীকে ডিজাইন ও ট্রেইন করাই হয়েছে মূলত আক্রমণাত্মক অপারেশনের জন্য, প্রতিরক্ষামূলক কাজের জন্য না। তাই ওয়াগনারের অভ্যূথানে রুশ বাহিনীর মনোবল ভীষণভাবে আহত হলেও (বিশেষ করে বিমানবাহিনীর মনোবল বেশি আহত হয়েছে কারণ অভ্যুত্থানের সময় ওয়াগনার বাহিনী ৭টির মতো হেলিকপ্টারকে ভূপতিত করেছে) এগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ইউক্রেনের কাউন্টার-অফেন্সিভে কোনোরকম সহায়তা করবেনা। তবে মিডিয়াম টার্ম বা মধ্যে মেয়াদে ওয়াগনার অভ্যুত্থান ইউক্রেনের জন্য কিছুটা আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠবে, কেননা রাশিয়া থেকে ওয়াগনারের বিলুপ্তি বা প্রত্যাহার রাশিয়ার জনশক্তির ঘাটতির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে, কেননা ইউক্রেইনে লড়ার জন্য রাশিয়ার ট্ৰেইনড ও স্কিলড জনবল প্রয়োজন। তবে যদি এর ফলে রুশ বাহিনীর মনোবল হারাবার ব্যাপারে বলা হয়, আর তাৎক্ষণিক ক্ষেত্রে যুদ্ধে তার প্রভাবের কথা ভাবা হয় তাহলে ইউক্রেইন উপকৃত হতে পারে। সম্পর্কিত কিনা জানিনা, কিন্তু এই ঘটনার অল্প সুময়ের মধ্যেই ইউক্রেনীয়  বাহিনী নিপার নদী ক্রস করে খেরসনের ওপর তীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে করতে খেরসন শহরের নিকটে চলে এসেছে, আর সেখানকার রাশিয়ান সৈন্যরা এমিউনিশন ও সাপোর্টের সন্ধান করছে।

এদিকে ওয়াগনারকে হারানোর রুশ বাহিনীর জন্য বেশ বড় রকমের ক্ষতিই নিয়ে আসছে। কিছু প্রভিশনাল বা প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে যেগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, গত বছর পুতিনের আংশিক সমাবেশের কারণে রাশিয়ায় হাজার হাজার সৈন্য সংরক্ষিত রয়েছে এমন দাবি সত্ত্বেও, রাশিয়ান সেনাবাহিনী আসলে সৈন্য এবং অস্ত্র উভয়েরই অভাব বোধ করছে। এবং এটি ব্যাখ্যা করছে যে, ক্রেমলিন কেন বিভিন্ন বেসরকারী সামরিক সংস্থাগুলিকে নিয়মিত রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করার জন্য এত চেষ্টা করছে, যদিও এটি সবসময়ই প্রিগোজিনদের এরকম অভ্যুত্থানকে উস্কে দেবে। একইভাবে, রাশিয়া স্পষ্টতই মিয়ানমার থেকে ট্যাঙ্ক এবং ক্ষেপণাস্ত্রের কিছু অংশ কিনছে এবং ভারতে অস্ত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে রাশিয়ার কাছে উপাদানের অভাব রয়েছে। এখন, এর অর্থ এই নয় যে রাশিয়া অদূর ভবিষ্যতে কর্মী বা উপাদানের গুরুতর ঘাটতির মুখোমুখি হবে বলে আশা করা উচিত, তবে মিডিয়াম টার্ম বা মাঝারি মেয়াদে ওয়াগনারকে হারানো রাশিয়ার জনশক্তির এই রিজার্ভের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে। সব মিলিয়ে ওয়াগনারের অভাবের অর্থ এই নয় যে, ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণের দ্বারা কোন আকস্মিক অগ্রগতি আশা করা উচিত, তবে এটি মধ্যমেয়াদে রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।

এটা ছাড়াও আরেকটা গুরুতর ব্যাপার আছে। ওয়াগনারকে হারাবার কারণে এখনও ক্রেমলিনকে যুদ্ধটি নিয়ে তাদের কৌশলও পরিবর্তন করতে হবে, আর সেটা তিনটি কারণে –

প্রথমত, এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। যদিও বেশিরভাগ রাশিয়ান স্পষ্টতই তথাকথিত বিশেষ সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে, তারা স্পষ্টতই এটির পদ্ধতি নিয়ে খুশি নয়, আর এ কারণেই ওয়াগনারকে রোস্তোভে এত উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, এবং সেই সাথে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তনকারী নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জনতা ক্রোধ-বর্ষণ করেছিল। এছাড়াও, রাশিয়ানরা এখন যুদ্ধকে সমর্থন করবে তার সম্ভাবনাও কম, কারণ যুদ্ধটি রাশিয়ায় এসে গেছে। বেলগরদে ইউক্রেনপন্থী গোষ্ঠীগুলি নিয়মিত আক্রমণ করছে এবং এখন ওয়াগনার অভ্যুত্থান মধ্য রাশিয়ায়। মূলত, যুদ্ধটি এখন সাধারণ রাশিয়ানদের প্রভাবিত করছে যারা এতে খুশি নয়, আর এটাই পুতিনের উপর যে কোনওভাবে ইউক্রেইনের এই বিশেষ সামরিক অভিযান শেষ করার জন্য গুরুতর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।

দ্বিতীয়ত, ওয়াগনার গ্রুপ হারাবার অর্থ হল, ইউক্রেইনে রাশিয়ার ভবিষ্যতে কোনও অঞ্চল অর্জন করার সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে। এর কারণ হল নিয়মিত রাশিয়ান সেনাবাহিনী উল্লেখযোগ্য অঞ্চল অধিগ্রহণ করতে পুরোপুরি অক্ষম প্রমাণিত হয়েছে, যে কারণে ক্রেমলিনকে ওয়াগনারের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল যারা বাখমুত প্রায় দখল করে ফেলেছিল। এর মানে হল, ওয়াগনারের এই অভাবের কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ততটা প্রভাবিত না হলেও, আক্রমণাত্মক ক্ষমতা খুবই কমে যায়, আর যুদ্ধে যদি আপনার কোনো আক্রমণাত্মক ক্ষমতা না থাকে, তাহলে আপনি কেবল পেছনের দিকেই যেতে পারেন, সামনে এগোতে পারেন না। এটার পরিণতি একটাই, ইউক্রেইনে রুশ বাহিনীর আরো বেশি অঞ্চল হারানো। আর তাই এভাবে চলতে থাকলে ইউক্রেইন আরও বেশি অঞ্চল হারাবে বলে পুতিনও শান্তির প্রক্রিয়ায় যাবার চাপে পড়বেন।

তৃতীয়ত, একটি অভ্যুত্থান রাশিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা আরও কমিয়ে দিয়েছে। সর্বোপরি, কোনও দেশই যে কোনও মুহুর্তে পতন হতে পারে এমন একটি সরকারকে সমর্থন করতে চাইবে না, কেননা তাতে সম্ভাব্য নতুন সরকারের সাথে ভাল সম্পর্কের সম্ভাবনা কমে যায়। একইভাবে, পুতিন হয়তো আশা করছিলেন যে চীন বা বেলারুশের মতো মিত্রদের মধ্যে একটি এসে তাকে এক ধরণের নির্ণায়ক সামরিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাকে মুক্তি দিতে পারে, তবে এই দেশগুলি তাকে সমর্থন করবে এমন সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে কম কারণ ক) মনে হচ্ছে যে কোনও মুহুর্তে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হতে পারে, এবং খ) এখন পুতিনকে রাশিয়াকে সামলানোর জন্য একটু অযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। (যদিও বেলারুশের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু কমপ্লেক্স. লুকাশেঙ্কো চাইবে পুতিন যাতে ক্ষমতাচ্যুত না হন, কেননা পুতিনের পতন হলে নিজ দেশে লুকাশেঙ্কোর পতন হবার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যাবে)।

তো এই তিনটি কারণে এখন পুতিনের হাতে দুটো রাস্তা খোলা আছে – ইউক্রেইনে যেভাবেই হোক উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করা, অথবা যেটা করা যায় সেটা হল শান্তির জন্য চেষ্টা করা। বলাই বাহুল্য যে, উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য পুতিনের একমাত্র বাস্তব রাস্তা হ’ল নতুন আরেকটি মোবিলাইজেশন ঘটানো, বা ট্যাকটিক্যাল নিউক বা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র। কিন্তু এগুলোর কোনোটাই আসলে ক্রেমলিনের জন্য খুব একটা ভাল রাস্তা নয়, মানে নতুন করে মোবিলাইজেশন বা ইউক্রেইনে সেনা পাঠানোর জন্য যে জনশক্তি, উপাদান, আর সবচেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট যেটা, পুতিনের পলিটিকাল ক্যাপিটাল দরকার সেটা কম বলে মনে হচ্ছে, আর নিউক্লিয়ার অপশনের ক্ষেত্রে রিস্ক অনেক বেশি, কেননা তাতে ন্যাটো এর রিটেলিয়েটরি স্ট্রাইক হবে যাকে ভালোভাবে বা ক্ষমতা  টিকিয়ে রাখার মতো পলিটিকাল ক্যাপিটাল বাঁচিয়ে রেখে প্রতিহত করা এই মুহূর্তে রাশিয়ার জন্য একটি বেশি কঠিন। তাই মনে হচ্ছে রাশিয়ার জন্য আগামীতে শান্তির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, যদিও এটারও একটা ব্যাকলাশ আছে, রাশিয়ার মতো দেশের লোকেরা, বিশেষ করে পুতিনের ফ্যানরা তার এভাবে শান্তিতে বাধ্য হবার ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেবে বলে মনে হয়না। আর তাতেও পুতিনের জনপ্রিয়তা ও পলিটিকাল ক্যাপিটাল কমে যেতে পারে, যার ফল সামনের নির্বাচনে পড়বে। দু দিকেই রিস্ক আছে, কিন্তু শান্তির দিকে রিস্ক হয়তো তুলনামূলকভাবে কম। দেখা যাক পুতিন কোন দিকে যান।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.