২০২২ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে কাতারে, যা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এখানে মানবাধিকার ইস্যু থেকে শুরু করে জলবায়ু, দুর্নীতি থেকে শুরু করে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর মতো বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। ভাবলাম সেসব নিয়েই কিছু লিখি। কাতারে মানবাধিকার কনসার্নগুলি এলজিবিটিকিউ+ এবং নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি খারাপ আচরণ এসব নিয়েই।
শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত একটি দেশ হিসাবে কাতার যেসব কাজকে অনৈতিক বলে মনে করে দেশটিতে তাই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং শাস্তিগুলি সত্যিই খুব কঠোর হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৩ সালের কাতারি দণ্ডবিধির ২৯৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, যে কেউ ব্যভিচারের জন্য কোনও মহিলাকে ইনস্টিগেট, ইনডিউস বা সিডিউস করে (বাংলায় সমার্থক মনে হতে পারে বলে ইংরেজিই লিখলাম) তবে তার জন্য শাস্তি হল এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড। উপরন্তু, কেউ যদি প্রকাশ্য স্থানে অঙ্গভঙ্গি করে, বাচনিকভাবে, বা গান গেয়ে অনৈতিক কিছু বলে বা অশ্লীল কাজ করে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৩,০০০ কাতারি রিয়াল জরিমানা করা যেতে পারে, এবং এখানেই জিনিসগুলি শেষ হয় না।
ঐতিহাসিকভাবে, কাতারে উপর্যুল্লিখিত অপরাধের জন্য ফ্লগিং এর মানে বেত্রাঘাত বা চাবকানোর শাস্তির বিধান আছে। মুশকিল হলো বর্তমান দণ্ডবিধিতে কারাবাস ও জরিমানার জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট করা হলেও, তাতে এই চাবুক মারার শাস্তির উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ফ্লগিং হচ্ছে না। ২০০৮ সালে নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণের বিষয়ে ইউনাইটেড ন্যাশন্স এর কিছু বিষয় নিয়ে তাদের প্রতিবেদনে স্বীকার করেছে। এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উল্লেখ করেছে যে, দুর্ভাগ্যবশত কাতারের দণ্ডবিধিতে ফ্লগিংকে শাস্তি হিসাবে উল্লেখ করা না হলেও তাদের দণ্ডবিধির ১ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে যে হুদুদ অপরাধগুলো যদি কোনও মুসলিম দ্বারা বা মুসলিমের প্রতি সংঘটিত হয় তবে সেক্ষেত্রে শরিয়া শাস্তি প্রযোজ্য হবে। এখন এদিকে সরকারও স্পষ্ট করে বলে না যে কোন অপরাধগুলি কোন শাস্তি বহন করে। যেমন প্রতিটি বিশেষ হুদুদ অপরাধের জন্য কতবার ফ্লগিং করা হবে। অন্যদিকে এই সিস্টেমটি বিশেষ করে নারীদের জন্য কঠোর, যারা প্রায়শই কাতারি সরকার কর্তৃক নিষ্ঠুর শাস্তির শিকার হয়। এমনকি কারও সাথে ঘুমানোর জন্য, গর্ভবতী হওয়ার জন্য মহিলাদের শাস্তি দেওয়ার এবং তারপরে কারাগারে দণ্ডিত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিছু মহিলাকে চাবুক মারা বা পাথর ছোড়ার শাস্তি দেওয়া হয়, যদিও প্রায়শই নিম্ন আদালত, সাজা কমিয়ে দেয়।
এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের ওপরও সহিংসতা বিদ্যমান। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পুলিশ হেফাজতে থাকা এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর ও বারবার মারধরের ছয়টি মামলা নথিভুক্ত করেছে, পাশাপাশি যৌন হয়রানির মারাত্মক ঘটনাও নথিভুক্ত করেছে। চারজন রূপান্তরকামী মহিলা এবং একজন সমকামী পুরুষ বলেন, কীভাবে পুলিশ বন্দীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করে, এবং রক্তপাত না হওয়া পর্যন্ত বন্দীদের চড়, লাথি এবং ঘুষি মারে। আরেকজন রূপান্তরকামী মহিলা বলেন যে তাকে প্রতিদিন পুলিশ মারধর করে, সেই মারধরের সময় তিনি বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, তার মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয় এবং তার স্তনের ছবি তোলা হয়।
এখন, কাতারি সরকার বলেছে যে এই অভিযোগগুলি স্পষ্টভাবে এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে মিথ্যা এবং সেই সাথে তারা বৈশ্বিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে যে এলজিবিটিকিউ+ দর্শকরা দেশটিতে নিরাপদই থাকবে। যাইহোক, ফিফা এবং কাতার উভয়েরই এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতিও নিষ্প্রভই ছিল। এমনকি ২০১০ সালে, যখন কাতারকে টুর্নামেন্টটি হোস্ট করার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, তখন ফিফা সভাপতি, সেপ ব্লাটার, সমকামীদের জন্য রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “বিশ্বকাপে সমকামী ফুটবল ফ্যানদেরকে কোনও যৌন ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকা উচিত।” তারপর মাত্র কয়েক মাস আগে, কাতারের আমির বলেছিলেন যে সমকামী সম্প্রদায়কে ২০২২ সালের বিশ্বকাপে স্বাগত জানানো হবে, যদি তারা দেশের সংস্কৃতিকে সম্মান করে। তিনি নিশ্চিত করেছেন যে সমকামী দম্পতিরা জনসমক্ষে হাত ধরার জন্য গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হবেন না এবং বিক্ষোভকারীরা প্রাইড পতাকা প্রদর্শনের জন্য শাস্তির মুখোমুখি হবেন না, তবে সেক্ষেত্রে শর্ত ছিল যে তারা এটি মসজিদের উপর ফেলবে না।
যাইহোক, সমকামী কার্যকলাপ এবং অনৈতিক বিক্ষোভের জন্য বিদেশীদের শাস্তি দেওয়ার আইনি ক্ষমতা তাদের ছিল তা বিবেচনা করে, সরকার কেবল বিশ্বকাপ দর্শকদেরকে এটা বিশ্বাস করতে বলছে যে তারা তাদের ওপর এই নিয়মগুলি প্রয়োগ করবে না। যখন একজন জার্মান সাংবাদিক কাতারি বিশ্বকাপের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার নেন, তখন সমকামী সম্প্রদায় সম্পর্কে সাক্ষাতকারটি এরকম ছিল –
” – কিন্তু আপনি কি মনে করেন সমকামিতা হারাম?
– এটা হারাম। কেন হারাম? আমি একজন বড় মুসলিম নই, কিন্তু এটা হারাম কারণ, এটি মনকে ক্ষতি করে (তার ভাষায় ড্যামেজিং দ্য মাইন্ড)”
স্পষ্টতই, সরকার প্রকাশ্যে সমকামীরা ওয়েলকাম বলছে, কিন্তু কমিউনিটিটির প্রতি তাদের ঘৃণা স্পষ্টই। তবে একটি গ্রুপ যারা বিশ্বকাপের কারণে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তারা বিদেশী শ্রমিক। এখন, কাতারে কাফালা নামে একটি সিস্টেম রয়েছে, যা বিদেশী শ্রমিকদের দেশে আনার চেষ্টা করার জন্য প্রয়োগ করা হয়। সমস্যাটি হ’ল এই সিস্টেমটি তার শোষণমূলক অনুশীলনের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এর কারণ হল, সংক্ষেপে, এই কাফেলা সিস্টেম অনুসারে এটি সমস্ত বিদেশী কর্মীদের একজন স্থানীয় স্পনসর থাকতে হবে। কিন্তু শ্রমিকেরা কাতারে আসার পর তাদের ওপর এই স্থানীয় স্পন্সরদের প্রচুর নিয়ন্ত্রণ থাকে। এদের ওয়ার্কিং কন্ডিশন কেমন হবে আর এরা কোথায় বাস করবে তা এরাই ঠিক করে দেয়। স্পনসররা প্রায়শই শ্রমিকদের ডর্ম-এর মতো বাসস্থানের ব্যবস্থা করে।
অবস্থা যখন এই তখনা, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কাতারি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, এমপ্লয়িরা তাদের এমপ্লয়ারদের কাছ থেকে চাকরি অদলবদল করার অনুমতি পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্তি পাবে, আর এর মাধ্যমে সিস্টেমটির সংস্কার করা হবে। তারা সিস্টেমের অধীনে ন্যূনতম মজুরিও বৃদ্ধি করেছিল, যদিও এটি এখনও সমালোচিত হয় কারণ সেটা কেবলমাত্র এক পাউন্ড বা এক ডলার ছিল। যদিও একই মাসে এই পরিবর্তনগুলি সত্ত্বেও, অ্যামনেস্টি কাতারি সরকারকে দেশটির অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর তদন্ত করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সমালোচনা করেছিল এবং দুই বছর পরেও এই সংস্কারগুলি আদৌ কার্যকর হয়েছে কিনা তা বলা কঠিন। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কাতার সরকার প্রকাশ করে যে সংস্কারগুলি বাস্তবায়িত হওয়ার পর থেকে প্রায় এক মিলিয়ন অভিবাসী শ্রমিকের প্রায় এক চতুর্থাংশ চাকরি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এই শ্রমিকদের মধ্যে কতজন তাদের এমপ্লয়ারদের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার কারণে চাকরি পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং কতজন এই অনুমতি থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করেছেন তা স্পষ্ট করা হয়নি।
এমনকি যদি আমরা কাতারি সরকারকে তাদের কথা মতে গ্রহণও করি, এবং স্বীকার করি যে তারা এই ব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি করেছে, তবুও তারা এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না যে, ২০১০ সালে কাতারকে এই টুর্নামেন্টে পুরস্কৃত করার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই ১২ বছরের মধ্যে দেশটিতে প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়, আর এই সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের ওপর প্রচুর পরিমাণে এবিউজ সংঘটিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে, দ্য গার্ডিয়ানে উঠে আসে যে, কাতারের সংস্থাগুলি শ্রমিকদের কাছ থেকে তাদের ওয়ার্ক আইডি পারমিট কেড়ে নেয়, যাতে তাদেরকে অবৈধ প্রমাণ করা যায়, আর এর ফলে তাদেরকে আর প্রতিশ্রুত বেতন না দিতে হয়। সেখানে এও উঠে আসে যে, সেই বছরেই দেশটিতে কমপক্ষে ৪৪ জন শ্রমিক মারা যায়। এরপর ২০১৪ সালে, অভিবাসী শ্রমিকদের নির্যাতনের বিষয়ে প্রতিবেদন করার চেষ্টা করার জন্য বিবিসির সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং এমনকি ২০১৯ সালের শেষের দিকে, দ্য মিররের সাংবাদিকরা দেখতে পান যে স্টেডিয়ামগুলি নির্মাণকারী শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকজনকে প্রতি মাসে ৭৫০ কাতারি রিয়াল দেওয়া হচ্ছে, যা একটি ৪৮ ঘন্টার ওয়ার্ক উইকের কথা বিবেচনা করলে প্রতি ঘণ্টায় দাঁড়ায় মাত্র ১ ডলার। তাই এটা বোঝা খুব একটা কঠিন নয় যে কেন দাবি করা হচ্ছে যে এই বিশ্বকাপের অবকাঠামো আসলে স্লেইভ লেবর বা ক্রীতদাস শ্রম দ্বারা নির্মিত। সর্বোপরি এটি স্পষ্ট যে, কাতারের মানবাধিকার পরিস্থিতি আইডিয়াল সিচুয়েশন থেকে অনেক দূরে, আর যে ফুটবল অবকাঠামোর কারণে আমরা এবারের বিশ্বকাপটি অর্জন করছি তা আসলে এই শ্রমিকদের স্লেইভ লেবরেই নির্মিত। উল্লেখ্য, কাতারে প্রায় ২১ লক্ষ বিদেশী শ্রমিক কাজ করে, যাদের মধ্যে প্রায় সোয়া আট লক্ষ শ্রমিক বাংলাদেশী আর প্রায় সাত লক্ষ শ্রমিক ভারতীয়।
তথ্যসূত্র
1. https://finance.yahoo.com/news/14-reasons-qatar-world-cup-174400894.html
2. https://www.amnesty.org/en/latest/press-release/2013/11/qatar-end-corporate-exploitation-migrant-construction-workers/
3. https://www.bbc.com/sport/football/61635340
4. https://www.theguardian.com/football/2022/nov/11/world-cup-qatar-watching-boycotting
5. https://www.hrw.org/sites/default/files/media_2021/08/lgbt_mena0418_annex.pdf
6. https://evaw-global-database.unwomen.org/en/countries/asia/qatar/2004/penal-code-law-no-11-of-2004#:~:text=Obscene%20gestures%2C%20words%20or%20actions,unwelcome%20advances%20(article%20291).
7. https://www.amnesty.org/en/wp-content/uploads/2021/08/mde220022006en.pdf
8. https://www.axios.com/2022/10/24/hrw-report-lgbtq-qatar-jail-beatings-before-world-cup
9. https://sports.yahoo.com/at-qatars-world-cup-lgbtq-fans-are-supposedly-welcome-but-still-afraid-163049856.html
10. https://www.gaytimes.co.uk/life/qatar-says-lgbtq-fans-welcome-to-world-cup-despite-homosexuality-ban/
11. https://www.amnesty.org/en/latest/press-release/2013/11/qatar-end-corporate-exploitation-migrant-construction-workers/
12. https://www.theguardian.com/global-development/2020/sep/01/new-employment-law-effectively-ends-qatars-exploitative-kafala-system
13. https://www.amnesty.org/en/latest/news/2021/08/qatar-failure-to-investigate-migrant-worker-deaths-leaves-families-in-despair/
14. https://www.theguardian.com/world/2013/sep/25/revealed-qatars-world-cup-slaves
15. https://www.theguardian.com/world/2015/may/18/fifa-to-investigate-arrest-of-bbc-news-team-in-qatar
16. https://www.mirror.co.uk/news/world-news/qatar-world-cup-stadium-migrant-16170439
17. https://www.business-humanrights.org/en/latest-news/qatar-population-of-migrant-workers-swells-to-21-million-ahead-of-2022-fifa-world-cup/
18. https://www.dhakatribune.com/middle-east/2022/08/23/qatar-deports-bangladeshi-migrant-workers-over-wage-protests
19. https://en.wikipedia.org/wiki/Demographics_of_Qatar
Leave a Reply