হিজাব ইস মাই চয়েস প্রশ্নে

আমি হিজাবকে নেতিবাচক হিসেবে দেখেই একে চয়েস বলে মনে করি। মনে করি যে, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে হিজাব পরে তারা ছোটবেলা থেকে তৈরি হওয়া পূর্বসংস্কার, অভ্যাস, বিশ্বাস হিসেবেই তা পরে না, সেই সাথে নিজের চয়েস হিসেবে স্বেচ্ছায়, একে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেই হিজাবকে গ্রহণ করে, এর সাথে তার আদর্শ ও পরিচয়ও জড়িত থাকে, এখানে তার এজেন্সিকে অস্বীকার করা যায়না। স্বেচ্ছায় ভাল জিনিস না খারাপ জিনিস চয়েস করছে তা ভিন্ন প্রশ্ন কিন্তু যা করছে স্বেচ্ছায়ই করছে। অনেকে জোর করে হিজাব খুলে নেয়ার বিরোধিতা করেন, আর বেশিরভাগ মূলত এই কারণে এর বিরোধিতা করেন যে, কোন কাজে অন্যের ক্ষতি না হলে ও সেই কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করা হলে তাতে জোর জবরদস্তি আরোপ করা ব্যক্তির অধিকারে হস্তক্ষেপ। তারা যেকারণে বাকস্বাধীনতা সমর্থন করেন, সে কারণেই পোশাকের স্বাধীনতা সমর্থন করেন। আমিও তাদের মত জোর করে হিজাব খুলে নেয়ার বিরোধিতা করি, কিন্তু আমার কারণ আর ওদের কারণ এক না। আমি তাদের মত স্বাধীনতাকে নেসেসারিলি ইতিবাচক ও পরাধীনতা বা স্বাধীনতার অভাবকে নেসেসারিলি নেতিবাচকভাবে দেখিনা। স্বাধীনতা ও পরাধীনতা দুইই ভাল ও খারাপ হতে পারে। চরম মাত্রায় বাকস্বাধীনতাতেও নেতিবাচক এফেক্ট থাকতে পারে, তাই পরাধীনতা আরোপ করতে হয়। অনেকেই স্বাধীনতার জন্য অপরাধ করছে, আর অপরাধকে ডেটার করার জন্য যখন শাস্তিমূলক আইন ও ব্যবস্থা নির্ধারিত করা হচ্ছে তখন পরাধীনতাই সৃষ্টি করা হচ্ছে, আর এক্ষেত্রে সেটা ইতিবাচকও হচ্ছে। লেইসেজ ফেয়ার বা মুক্ত বাজার স্বাধীনতা, কিন্তু জনতার স্বার্থে ট্যাক্স আরোপ করে ইতিবাচক কারণেই কিছু পরাধীনতা বা স্বাধীনতার অভাব আরোপ করা হয়। একইভাবে হিজাবে স্বাধীনতা কাজ করলেই তাকে নেসেসারিলি ইতিবাচক ধরার আবশ্যক নয়, স্বাধীনতা সহই তা নেতিবাচক হতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে আমি গণতন্ত্রের বিরোধিতা করছি। গণতন্ত্রকে যেমন জনতার স্বাধীনতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনি শাসকের পরাধীনতা বা স্বাধীনতার অভাব দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়, বরং পরাধীনতা দিয়ে আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, এখানেও পরাধীনতা ইতিবাচকই হচ্ছে। (স্বাধীনতা নিয়ে ঠিক একই কথাগুলো আমি অন্য প্রসঙ্গে পরে আবার উল্লেখ করব। যারা পড়ে বিরক্ত হবেন তারা স্কিপ করবেন।)

আমি জোর জবরদস্তিমূলকভাবে হিজাব খুলে নেয়া বা হিজাবের বিরুদ্ধে আইন জারি করাকে সমর্থন করিনা, কেননা আমি মনে করি এগুলো করা হলে উলটে মানুষ বেশি করে হিজাব পরা শুরু করবে, কারণ তারা তখন একে তাদের আইডেন্টিটির সাথে অবিচ্ছিন্ন বলে ভাবতে শুরু করবে। হিজাব বিরোধিতা নিঃসন্দেহে ইসলামিক কালচারের বিরোধিতা হিসেবে দাঁড় করানো হবে, যদি কোন মুসলিম শাসক এগুলো চাপিয়ে দেয় তারপরও, আর এমন অবস্থাতেই মানুষ বেশি করে ইসলামিক আইডেন্টিটির দিকে ঝোঁকে আর হিজাবের মত সিম্বলকে সেই আইডেন্টিটিকে প্রকাশের কাজে ব্যবহার করে আর টাজফেল-টার্নারদের মতে পজিটিভ ডিসটিংকটিভনেস বা ইতিবাচক পৃথকত্ব প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ এই হিজাব ইসলামের সিম্বলিজম হয়ে ওঠায় এটার নিষিদ্ধকরণ তাদের ইসলামিক আইডেন্টিটিতে আঘাত করে, আর তার প্রতিক্রিয়ায় তারা আরও বেশি করে সেই আইডেন্টিটিকে আঁকড়ে ধরে এবং তারা তার প্রকাশ করে হিজাবের মত সিম্বলিজমগুলোকেই ব্যবহার করে, হিজাব হয়ে ওঠে নিজেদের পরিচয়ের পৃথক অস্তিত্বকে প্রকাশ করার ও বোধ করার মাধ্যম। ফলে আরও বেশি করে মানুষ হিজাব পরা শুরু করে। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলোতে মুসলিমরা আইডেন্টিটি হিসেবে হিজাব গ্রহণ করেছে। ইরানে এককালে ওয়েস্টার্নাইজেশনের বিরোধিতা করতে নারীরা হিজাব বেশি করে গ্রহণ করেছিল, এরকম অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। এইসব এফেক্টের জন্যই আমি হিজাবে নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করি। আমি বরং এমন সামাজিক পরিবর্তন চাই যার ফলে নারী স্বেচ্ছায় হিজাব ত্যাগ করবে। সেটার জন্য পলিসি নেয়া দরকার, কিন্তু নিষিদ্ধকরণ টাইপ আইন দিয়ে কাজ হবেনা।

স্বাধীনতার যুক্তি বরং দুর্বল। প্রথমত, স্বাধীনতাকে ডেফাইন করা যায়না, সব স্বাধীনতাই রিলেটিভ স্বাধীনতা, চরম স্বাধীনতা কেউ চাইবেও না, সম্ভবও না, ভবিষ্যতে রিসোর্সের এবান্ডেন্সি বা প্রাচুর্য এলে কিছুটা সম্ভব হয়তো। যা যা সমর্থন করি তা গুরুত্বপূর্ণ ভেল্যু, বৃহত্তর সামাজিক মঙ্গলের কথা ভেবেই করি। যেমন হিজাবের ভেল্যু নেগেটিভ ভাবি, বা একে খারাপ বলে মনে করি কারণ এটা দেহকে দেহের অধিকারীর থেকে এলিয়েনেটেড করে, দেহে পবিত্রতা আরোপ করে, দেহকে ভোগ্যবস্তু বানায়, ইন্দ্রীয় প্রবণতাকে প্রমোট করে বৌদ্ধিক ও নৈতিক বিকাশে হস্তক্ষেপ করে, যারা হিজাব পরেনা তাদের প্রতি ডিমনাইজেশন বৃদ্ধি করে ইত্যাদি, সবই বৃহত্তর সামাজিক এফেক্ট, যেগুলোকে ক্ষতিকর ভাবি বলেই হিজাবের বিরোধিতা করি। এখানে স্বাধীনতার যুক্তি ইম্পরটেন্ট না। এইসব সামাজিক এফেক্টের কথা ভেবেই বৃহত্তর সামাজিক মঙ্গলের জন্য মানুষের স্বাধীনতায় লিমিটেশন আনা হয়। তবে মানুষের স্বাধীনতার ভেল্যু আছেই, আর এটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই মানুষকে এতটাও জোর জবরদস্তি করা ঠিক না তাতে সামগ্রিকভাবে অমঙ্গল হোক। সামাজিক মঙ্গলের একটা অংশ মানুষের স্বাধীনতাও, আমার কথা কেবল এই যে, কেবল স্বাধীনতাকেই নৈতিকতার একমাত্র ভিত্তি মনে না করা হোক, একে নৈতিকতার অনেক ভিত্তির মধ্যে একটি বলে মনে করা হোক, যাকে বৃহত্তর সামাজিক মঙ্গলের জন্য কম্প্রোমাইজ করা যায়। আর বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণের কথা ভাবতে হয় কারণ স্বাধীনতা ছাড়াও আরও অনেক রকমের ভেল্যুজ আছে। এই কথাগুলোকে মোরালাইজিং লাগতেই পারে, স্বাধারণত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে অন্য কোন ভেল্যুর কথা ভেবে নৈতিকতাকে ঠিক করে দেয়া হলেই মোরালাইজিং, মোরালাইজার টাইপ শব্দের প্রয়োগ করা হয়। করা হোক, তবুও মোরালাইজিং গুরুত্বপূর্ণ। আল্টিমেটলি কখনই এই সীমিত রিসোর্সের দুনিয়ায় স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না, বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই হোক বা না হোক স্বাধীনতা কম্প্রোমাইজ হবেই, যদি এই স্বাধীনতার কম্প্রোমাইজেশন হয়ই তাহলে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য হওয়াই ভাল। আপনি বলতে পারেন একেকজন বৃহত্তর কল্যাণ বলতে একেক জিনিস বোঝে। অনেকে ধর্ম, অনেকে ফ্যাসিজমে বৃহত্তর কল্যাণ হিসেবে দেখবে। আমি সেক্ষেত্রে বলব, আপনি কখনই স্বাধীনতাকে সেই সব বৃহত্তর কল্যাণ মতাদর্শের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন না, স্বাধীনতার যুক্তি ইটসেলফ খুব ভঙ্গুর বলে এটা ভেঙ্গে যাবেই। আপনাকে নিজের বৃহত্তর কল্যাণের ভেল্যু দিয়েই তাদের বৃহত্তর কল্যাণের ভেল্যুকে ফাইট করতে হবে।

(গণতন্ত্র এক্ষেত্রে একটা ফেয়ার ফাইটের ইকোসিস্টেম দেয় বলেই তা সাপোর্ট করি। আপনাকে আপনার ভেল্যুগুলো কেন অন্য ভেল্যুগুলোর থেকে উন্নত ও কল্যাণকর তা বোঝাতে হবে, তা নিয়ে লড়াই করতে হবে। লাভ-ক্ষতি সবেতেই আছে, কিন্তু কোন জিনিসে কিরকম ভাল, কিরকম খারাপ আছে তা ফিক্সড, রিলেটিভ কিছু না, সেই সত্যের দিকেই এগোতে হবে। তবে লিমিটেড রিসোর্সের দুনিয়ায় কোন কোন ভেল্যুকে কম্প্রোমাইজ করব, আর তাতে অনিশ্চয়তা কেমন তার ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক সিস্টেমে ডান থেকে বাম বিভিন্ন অবস্থান তৈরি হবে, আর লড়াই হবে। কিন্তু কতটা লাভ, কতটা ক্ষতি তা আবিষ্কার্য। সুতরাং কল্যাণের পথ কি তা নিয়ে একটা নির্দিষ্ট ছক আছে বা পাওয়া যাবে, সেটা রিলেটিভ না। কিন্তু প্রশ্নটা হলো সীমিত সম্পদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে সর্বোচ্চ কল্যাণ ও সর্বনিম্ন ক্ষতির জন্য কোন কোন ভেল্যু কম্প্রোমাইজ করতে পারি সেটা, এখানে অনিশ্চয়তা বেশি বলে বিভিন্ন মতের মধ্যে ফাইটও বেশি, এর ভিত্তিতেই বিভিন্ন অবস্থান তৈরি হয়, তাই গণতান্ত্রিক সিস্টেমেরও প্রয়োজন হয় নিষ্পত্তির জন্য। জটিল হয়ে যাচ্ছে, পরে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করব, মুভ অন করি)

আজকে “হিজাব ইজ মাই চয়েস” এর বিরুদ্ধে কিছু কথা দেখেছিলাম নিউজ ফিডে, বলা হচ্ছিল হিজাব একটা ফলস চয়েস, এটা আসলে স্বাধীনতা নয়, বরং স্বাধীনতাহীনতা, এটা চয়েসই না। আমি লিখেছিলাম হিজাবকে বিভিন্ন কারণে চয়েস বা স্বাধীনতা বলতেই হয়, না হলে সমস্যা দেখা যায়। যা যা লিখেছিলাম সেগুলোই এখানে আবার উল্লেখ করছি…

১। সংস্কার আর স্বাধীনতার অভাব তো এক না ( এখানে পূর্ব সংস্কার ধাচের শব্দ, রিফর্ম না)। একটা সময় স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে সংস্কার তৈরি করা হয়েছে, এরপর স্বাধীনতা অর্জন করার পরও সংস্কার থেকে গেছে। এই অবস্থায় তার সংস্কারের ভিত্তিতে পোশাক নির্বাচন চয়েস বা স্বাধীনতাই হয়। (হিজাব সম্পর্কিত সংস্কার বলতে হিজাবের সাথে সম্পর্কিত আদর্শ, পরিচয়, অভ্যস্ততা, ধর্মবিশ্বাস, পাশ্চাত্য বিদ্বেষ, অমুসলিমদের শাসকদের শোষণ সব মিলেই বোঝাচ্ছি। এই সংস্কার ইটসেল্ফ নেতিবাচক কিছু না। যেমন যেকোন কনশাস পলিটিকাল চয়েস মানেই বিশেষ মতাদর্শভিত্তিক অবস্থান, আর সেই মতাদর্শও এখানে সংস্কার। সংস্কারটার নেচার কী তার ভিত্তিতে তাকে কেউ ভাল কেউ খারাপ ভাবে। আমি যেমন হিজাব রিলেটেড সংস্কারগুলোকে বিভিন্ন কারণে নেতিবাচক হিসেবে নেই।)। এটা একটু উলটে বললে বা নেগেটিভ করে বললে, আরেকটু স্পষ্ট হয়। সংস্কার তৈরির পর যখন জোর করে তাকে সংস্কারবিরোধী পোশাক পরতে বাধ্য করা হচ্ছে, তখন সংজ্ঞাগতভাবে এই বাধ্যবাধকতার জন্যই তা স্বাধীনতার অভাব বা পরাধীনতা হচ্ছে৷ কিন্তু তুমি যা বললে তা অনুসারে সেটাই স্বাধীনতা কারণ সংস্কারাচ্ছন্ন পোশাক নির্বাচনই সেটায় পরাধীনতা ছিল। এখন একই জিনিস একই সাথে স্বাধীনতা ও পরাধীনতা হতে পারেনা৷

২। দ্বিতীয় একটি যুক্তি দিচ্ছি যা আসছে পলিসির দিক দিয়ে। তার আগে বলি, যদি কেউ চায় মেয়েরা আর হিজাব পরবে না। সেক্ষেত্রে সে কী কী পলিসি ঠিক করতে পারে? এক হতে পারে, জোর করে হিজাব খুলে নেবে। আরেক হতে পারে সংস্কার দূর করবে যার ফলে মেয়েরা নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিক মনে করে হিজাব খুলে ফেলবে। (এই পলিসিটা অনেকে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতে পারে, কারণ প্রথম পলিসির ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে থাকা সংস্কার কাজ করছে এই অবস্থায় হিজাব তুলে নেয়া মানে জোর করে তুলে দেয়া, আর তাতে দেখা যায় আইডেন্টিটির জন্য এরা আরও বেশি করে হিজাব গ্রহণ করা শুরু করে। সোশ্যাল আইডেন্টিটি থিওরি এমনটাই নির্দেশ করে। এক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হচ্ছে। এটা নিয়ে উপরে অলরেডি লিখেছি।) দ্বিতীয় পলিসির এই আপনা আপনি হিজাব খুলে ফেলা অর্থাৎ স্বাধীনভাবে হিজাব খোলার ব্যাপারটাকে যদি স্বীকার করতে হয় তবে মেয়েটি হিজাব যখন পড়েছিল তখনও তা স্বাধীনভাবেই পড়েছিল স্বীকার করতে হয়। যদি জোর করে হিজাব পরানো হয় তাহলে হিজাব খোলার জন্য জোর-জবরদস্তির অভাবই যথেষ্ট হতো, নতুন করে অনুধাবন, সংস্কার দমন ইত্যাদি প্রোসেসে যেতে হত না। কিন্তু সংস্কারের অস্তিত্বই বলছে স্বাধীনতা ধরতে হচ্ছে।

৩। তৃতীয় যুক্তি হচ্ছে, যখন বলা হচ্ছে নারী পরাধীন হয়ে হিজাব পরছে, তখন বোঝানো হচ্ছে হিজাব পরায় নারীর এজেন্সি কাজ করছে না। কিন্তু যে সংস্কারের জন্য নারী হিজাব পরল তার জন্য যদি সে কোন অপরাধ করে তাহলে তাতে তার এজেন্সি ছিল ধরে বিচার করতে হবে, কারণ অপরাধ এক্সিডেন্টালি হচ্ছে না, এজেন্সি ছিল বলে হচ্ছে। পরাধীন করে তাকে বড় করা হয়েছে বললেও তাক্ব এজেন্সিহীন ভাবা যায়না, আর সত্যি বলতে যখন হিজাব ইজ মাই চয়েসের পক্ষে যুক্তিগুলো দেয়া হয় আর জোর করে হিজাব খোলানো যাবে না বলা হয় তখন এজেন্সির বিরুদ্ধে কাজ করানোটাকেই সমস্যা হিসেবে দেখানো হয়। তাই এজেন্সি দিয়েই স্বাধীনতা-পরাধীনতা, চয়েস সম্পর্কিত শব্দগুলোকে সংজ্ঞায়িত করতে হবে এখানে। তাই “হিজাব পরা স্বাধীনতা বা চয়েস না বলা” এখানে হয় নিরর্থক, না হয় আলঙ্কারিক হচ্ছে, যা যৌক্তিক আলোচনায় ব্যবহার করা যায়না।

৪। চতুর্থ যুক্তি হচ্ছে, ছোটবেলা থেকে যে সংস্কার গঠনের ফলে নারীর মধ্যে হিজাবের প্রতি ইতিবাচকতা বা বাধ্যবাধকতা গড়ে ওঠে, পুরুষের ক্ষেত্রেও একইভাবে তা গড়ে ওঠে৷ তাই অনেক পুরুষ নারীদের ওপর হিজাব চাপাতে চায়। একেই হিজাব নিয়ে পরাধীনতা বা চয়েসের অভাবের সোর্স ধরা হচ্ছে। কিন্তু একই সংস্কার গঠনের ফলে নারীর হিজাব পরাকে পরাধীনতা ধরা হচ্ছে, কিন্তু নারীর ওপর হিজাব চাপানোকে পরাধীনতা ধরা হচ্ছে না। কারণ একটা সিস্টেমে দুটো এজেন্ট থাকলে দুটোই বাধ্যতামূলক কাজ করলে পুরো কাজটাকে অনিবার্য বা স্বতস্ফূর্ত ধরতে হয়, কিন্তু হিজাব পরা তো সেরকম না, কারণ মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে হিজাব ত্যাগ বা অস্বীকারও করে।

৫। পঞ্চমত, যদি ডিটারমিনিজম বা নির্ধারণবাদ ভিত্তিক যুক্তি দেয়া হয়, মানে ছোটবেলা চলে আসা পরিস্থিতির কারণে এটা হয়েছে বলে এজেন্সি কাজ করছে না বলা হয়, তাহলে বলতে হবে মানুষের সব আচরণই কার্যকারণগত বলে কোন না কোন কিছু দ্বারা নির্ধারিত হয়, ফলে কোন কিছুরই এজেন্সি বলা যাবে না, চয়েস ধারণাটির অস্তিত্বই থাকছে না, সেক্ষেত্রে হিজাব চয়েস নাকি চয়েস না সেসম্পর্কিত বিতর্কও বৃথা।

৬। ষষ্ঠত, এমন না যে জোর করে হিজাব পরানো হচ্ছে বলে চয়েস কেড়ে নেয়া হলো আর মেয়েও হিজাব পরায় অভ্যস্ত হয়ে একেই চয়েস বলে ভাবার ইল্যুশনে চলে গেল। এরকমটা হওয়া নেসেসারি না। হিজাব পরানোর সাথে হিজাব ও দেহ সম্পর্কিত বিশেষ আইডিওলজি শেখানো হয়। দেহের পবিত্রতা, মডেস্টি সম্পর্কিত, দেহ একটি ভোগ্যবস্তু, যার দেহ তার সাবজেক্টের সাথে সম্পর্কিত নয় বা কম সম্পর্ক এমন মতাদর্শ প্রদান করা হয়। অনেক সময় হিজাব না চাপিয়ে কেবল মতাদর্শগুলোই চাপানো হয়। কখনও বা আইডেন্টিটি চাপানো হয়। আর এগুলোর কারণে নারী কর্তব্য ভেবেই হিজাব পরতে শুরু করে, স্বেচ্ছায়ই। এখন যদি বলা হয় হিজাব চয়েস নয়, তাহলে এসব মতাদর্শ, পরিচয় যে মেকানিজমে কাজ করছে সেগুলোকে ও এগুলোর অস্তিত্বকেও অস্বীকার করতে হচ্ছে, যা করা যায়না।

আমাদের মধ্যে এরকম “হিজাব চয়েস হতে পারেনা”, “হিজাব পরিধান স্বাধীনতা নয়” – এসব চিন্তা কাজ করায় আমার মতে দুটো ধারণা অবদান রাখে (১ম যুক্তিটা অলরেডি লিখেছি, আবার একই কথা লিখছি) –

(১) আমরা স্বাধীনতাকে ইতিবাচক ও পরাধীনতাকে নেতিবাচক ভেল্যু হিসেবে দেখছি। কিন্তু স্বাধীনতা হলেই যে ব্যাপারটা ভাল আর পরাধীনতা হলেই ব্যাপারটা খারাপ হবে এমন না। অনেকেই স্বাধীনতার জন্য অপরাধ করছে, আর অপরাধকে ডেটার করার জন্য যখন শাস্তিমূলক আইন ও ব্যবস্থা নির্ধারিত করা হচ্ছে তখন পরাধীনতাই সৃষ্টি করা হচ্ছে, আর এক্ষেত্রে সেটা ইতিবাচকও হচ্ছে। লেইসেজ ফেয়ার বা মুক্ত বাজার স্বাধীনতা, কিন্তু জনতার স্বার্থে ট্যাক্স আরোপ করে ইতিবাচক কারণেই কিছু পরাধীনতা বা স্বাধীনতার অভাব আরোপ করা হয়। একইভাবে হিজাবে স্বাধীনতা কাজ করলেই তাকে নেসেসারিলি ইতিবাচক ধরার আবশ্যক নয়, স্বাধীনতা সহই তা নেতিবাচক হতে পারে। (আর এর মানে এই নয় যে আমি গণতন্ত্রের বিরোধিতা করছি। গণতন্ত্রকে যেমন জনতার স্বাধীনতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনি শাসকের পরাধীনতা বা স্বাধীনতার অভাব দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়, বরং পরাধীনতা দিয়ে আরও ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, এখানেও পরাধীনতা ইতিবাচকই হচ্ছে।) (আর এর মানে এও নয় যে জোর করে হিজাব খুলে ফেলা ঠিক। স্বাধীনতার অভাব তৈরি সব সময়)

(২) একশন বায়াস – কিছু করা যেমন একটা সিদ্ধান্ত, তাতে এজেন্সি বিদ্যমান থাকে, কিছু না করাতেও তেমন সিদ্ধান্ত কাজ করে, এজেন্সি বিদ্যমান থাকে, কিছু না করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, যা চলছে সেটাই উত্তম, সেটাই মঙ্গলকর, সেটাই উপযুক্ত… কিন্তু আমাদের মধ্যে একশন বায়াস থাকায় আমরা কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকাকে উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তের অভাব বলে মনে করতে চাই, আর এতে এজেন্সিরও অভাব রয়েছে বলে মনে করি। তাই হিজাব ত্যাগ করাকে স্বাধীনতা ভাবলেও, হিজাব পরা অব্যাহত রাখা স্বাধীনতা নয় এমন চিন্তা মাথায় আসে, কিন্তু সত্যি বলতে এখানে এজেন্সি থেকে যায়, চয়েস থেকে যায়।

শেষ কথা… মোরাল ভেল্যু নিজের জন্যই, যার কালেক্টিভ রূপ বা বৃহত্তর সমাজের ওপর আরোপনমূলক রূপ হলো পলিটিকাল ভেল্যু। আর পলিটিকাল ভেল্যুগুলো তাই যার জন্য আপনি অন্যের স্বাধীনতাকে কম্প্রোমাইজ করতে চাইবেন, এটা না হলে তা আসলে ভেল্যুই না। আপনাকে হয় অ্যাপলিটিকাল থাকতে হবে, অর্থাৎ সমাজের ভাল মন্দ নিয়ে কিছু ভাবা যাবে না (যা বেশিরভাগের জন্য সম্ভবই না, কারণ আমরা সামাজিক জীব, রাজনৈতিক পলিসির সাথে আমাদের লাভ-ক্ষতি জড়িত বলে শেষ পর্যন্ত ভাবতেই হয়। কিন্তু তারপরও মানুষ অ্যাপলিটিকাল থাকতে পারে, এটা সম্ভব।), না হয় আপনাকে অন্যের স্বাধীনতা কম্প্রোমাইজ করার কথা ভাবতে হবে, ভাবতেই হবে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.