নারীবাদে বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজম ও ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসি ঢুকলে যে সমস্যা হয়…

রেডিটের আস্কফেমিনিস্টস সাবরেডিটে একটা পোস্ট দেখেছিলাম। “ফিমেল চয়েস” নামে একটা বই এর রিভিউ নিয়ে পোস্টটা করা হয়। বই এর লেখক জার্মান ফেমিনিস্ট মেইকে স্টোভারক। পোস্টে বলা হয়েছিল, নারীবিদ্বেষী ইনসেলরা নারীদের যে মেট সিলেকশন বা সঙ্গী নির্বাচনের মেকানিজমের বায়োলজিকাল ডিটারমিনিস্ট বয়ান দেয়, তা একেবারেই সঠিক। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সেটাই দেখা যায়। আসলেই ৮০% নারী কেবল মোটামুটি ২০% পুরুষের প্রতিই আকৃষ্ট হবে। আর নারীরা যদি স্বাধীনভাবে সঙ্গী নির্বাচন করেই তাহলে ৮০% পুরুষই যৌনতা থেকে বঞ্চিত হবে। মানে নারীবিদ্বেষী ইনসেলরা যা দাবি করে তাই সত্য। মানবেতিহাসের কালচারাল অ্যানালাইসিস করে তিনি লেখন, পিতৃতন্ত্রের পূর্বের শিকারী-সংগ্রাহক যুগে ৮০% পুরুষ সেক্স পেতনা, তাই পেট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্র আসলে ছিল নারীদের ওপর একটি অপ্রেশন, যেখানে নারীদেরকে এই ২০% পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত করার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, প্রত্যেক পুরুষের জন্য একজন যৌনসঙ্গী নির্বাচন করা হয় আর এর মাধ্যমে পুরুষেরা নিজেদের যৌনতাহীনতা বা যৌনবঞ্চনা থেকে মুক্তি লাভ করে, কিন্তু নিজেদের এই সুবিধা লাভ করতে গিয়ে তারা নারীদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয় ও তাদেরকে এই বঞ্চনার দিকে ঠেলে দেয়। আর এভাবেই পুরুষেরা কৃত্রিমভাবে একটি মেট চয়েস ইকুয়ালিটি বা সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করে, যে সমানাধিকার বা সাম্যের মাধ্যমে নারীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ, যা নারীর জন্যই ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।

এইসব বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, নারীর একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন সমাজ ও নারীরা যৌন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে এমন একটি সমাজের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক যে, নারীরা কেবল ২০% পুরুষকেই তাদের সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করবে। আর এজন্যই মানুষকে এমন একটি বাস্তবতায় বেঁচে থাকাটা শিখে নেয়া উচিৎ যেখানে ৮০% পুরুষ কখনই আর একজন ঘনিষ্ঠ জীবন সঙ্গী পাবে না। কেননা এটাই হলো স্বাধীনভাবে নারীর মেটিং চয়েসের একমাত্র ফল। তার সমাধান হচ্ছে, ছোটবেলা থেকেই পুরুষদেরকে শেখাতে হবে যে, নারীদের দ্বারা সঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত না হওয়াটা ওকে, এতে খারাপ কিছু নেই, এবং রোমান্টিক সাকসেস দিয়ে নিজেকে মূল্যায়ন করারও কিছু নেই। সেই সাথে পুরুষদের জন্যও সেক্স ওয়ার্ককে ডিস্টিগমাটাইজ করা, অর্থাৎ বিকলঙ্কায়ন করা, অর্থাৎ পুরুষদের প্রস্টিটিউশনকে আর সামাজিকভাবে কলঙ্ক বলে না ভাবাটাকে প্রমোট করা উচিৎ।

পোস্ট অনুসারে এই ছিল লেখিকার বয়ান। আমি বইটি পড়িনি, কিন্তু তিনি যদি সত্যি এরকম লিখে থাকেন তাহলে দুটো সমস্যা দেখা যায় – (১) ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসির সমস্যা, (২) বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজমের সমস্যা। এই দুই সমস্যা নিয়েই আলোচনা করব, কিন্তু তার আগে লেখিকার বয়ানে কী কী অসঙ্গতি আছে বলে আমি মনে করছি সেগুলো উল্লেখ করা যাক…

(১) প্রাণীজগতে নারীরা চুজিয়ার বা নির্বাচক সেক্স, এখানে পুরুষেরা নারীদের জয় করার জন্য কম্পিটিশনে যায়, আর নারীরা বিজয়ীদেরকে বা টপে থাকা লোকেদেরকে নির্বাচন করে। এটা নারীরা একারণে করে যে, সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে নারীর কস্ট অনেক, ৯ মাস গর্ভধারণ করতে হয়। তাই নারীকে দেখতে হয় যাতে তার এই কষ্ট বিফলে না যায়, সবচেয়ে ভাল মানের স্পার্মটাই গর্ভে ঢোকে আর সবচেয়ে ভাল সন্তানের জন্ম হয়, আর এজন্য পুরুষদের মধ্য থেকে নারীদেরকে উৎকৃষ্ট পুরুষদেরকেই নির্বাচন করতে হয়। এদিকে পুরুষদের জন্য সন্তান জন্ম দিতে তেমন কষ্ট করতে হয়না, কেবল স্পার্ম দিতে হয়। তাই সফল পুরুষদের কাজ যত বেশি পারা যায় স্পার্ম বিলিয়ে দেয়া, আর পারলে সব নারীর মধ্যে নিজের স্পার্ম দেয়া আর নিজের লেগেছি তৈরি করা। এই ব্যাপারটার মাধ্যমে শিকারী সংগ্রাহক সমাজের শত সংগ্রামের মধ্যে সমাজের টিকে থাকা নিশ্চিত হয়, কারণ সফল পুরুষের স্পার্ম থেকে উৎকৃষ্ট সন্তানের জন্ম হয়, যারা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভাল করে টিকতে পারবে।

যাই হোক, এই রকম সমাজের মধ্যে যেটা অভিয়াস হচ্ছে তা হলো, সব নারী কম সংখ্যক, ধরুন ২০% পুরুষকে নির্বাচন করছে, যেখানে ২০% পুরুষ সকল নারীর সাথে সঙ্গম করছে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে হারেম। মানে বর্তমান বহুবিবাহের অবস্থা। আর পুরুষেরাও সব নারীকে গর্ভধারণ করাচ্ছে সন্তানের জন্মের জন্য, কম রিসোর্সের শিকারী-সংগ্রাহক সমাজে টিকে থাকার জন্য অধিক জনসংখ্যার নিশ্চিতকরণ জরুরি। তাই নারীরা পরিণত হচ্ছে সন্তান জন্মদানকারী মেশিনে। আর সেখানে তাদেরকে করতে হচ্ছে সতীন নিয়ে সংসার। এখানে ইন্টিমেট রিলেশন আর ভালোবাসার জায়গা কতটুকু থাকে তা বোঝাই যায়। তাই এখানে সঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সেই সাথে আছে প্রভূত বঞ্চনাও। উল্লেখ্য, তখনও পেট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্র আসেনি। আর শুধু তাই নয়, ৮০% এর মত পুরুষ যে যৌনতা থেকে বঞ্চিত তারও একটা বড় চাপ আছে। সেটা হলো অন্যান্য স্তন্যপায়ীদের মধ্যে যৌনতা থেকে বঞ্চনার ফলে পুরুষ সদস্যরা যে শর্টকাট মেটিং স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে, ধর্ষণ… মানুষ অবশ্যই যৌনতা চাইবে, সব নারী ২০% এর হারেমে প্রবেশ করলে যৌনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে বাকি ৮০% পুরুষ শর্ট টার্ম মেটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ধর্ষণকেই বেছে নেয়। আর এটাও স্তন্যপায়ীদের মধ্যে নেচারাল। আর এই টপ ২০% পুরুষের পক্ষে সবসময় তার এত বিশাল সংখ্যক নারীকে প্রোটেকশন দেয়া সম্ভব হতোও না। তাই সেই সমাজে নারীর ফ্রি মেট চয়েসের সাথে যেমন ছিল হারেমে এক্সপ্লয়টেশন, সন্তান জন্মদানের চাপ, সেই সাথে ছিল ধর্ষণের ভীতি। সুখের জীবন ছিলনা। আরও একটা ব্যাপার আছে, মানে নারীর চয়েসের ক্রাইটেরিয়া কেবল শক্তির ভিত্তিতে ছিলনা, সেই সাথে শিল্প ও সৌন্দর্যের ভিত্তিতেও চয়েস হতো। আর অনেকের মতে শিল্প ও সৌন্দর্যের চয়েসের ব্যাপারটাই ছিল মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশের অন্যতম কারণ। একই সাথে ভাষার বিকাশেরও কারণ। কিন্তু ভেবে দেখুন, সেই সমাজে নারীরা কি এরকম শিল্প-সচেতন পুরুষকে চয়েস করলেই তার সাথে মেট করার সুযোগ পেত? শক্তিশালী হারেম বিল্ডারদের তা আটকাবার কথা। কেননা নারীরা সেই সময়ে ছিল শক্তিশালী হারেম বিল্ডার ও লিডারদের সম্পদস্বরূপ। তো এই জায়গাতেও একটা চাপ কাজ করার কথা। (যদিও এই বিষয়ে আমি শিওর নেই, এগুলো নিয়ে কাজ তেমন পাইনি)।

এসব কারণে নারীবাদীদের একাংশের মধ্যে পেট্রিয়ার্কি পূর্ব সমাজকে যে মেট্রিয়ার্কাল বা মাতৃতান্ত্রিক ছিল দাবি করা হয়, নারীদের জন্য পরিস্থিত স্বর্গময় ছিল দাবি করা হয়, আধুনিককালে এসব মত গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, সেই সাথে এখন এইসব যুক্তিকে প্রোপাগান্ডাই ধরা হয়। পিতৃতন্ত্রপূর্ব শিকারী-সংগ্রাহক সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়ই বঞ্চিত ও শোষিত হতো। যাই হোক, পিতৃতন্ত্র বা পেট্রিয়ার্কির উদ্ভবের মাধ্যমে যা হলো বলে লেখিকা বর্ণনা করলেন তাতে সত্যতা আছে। এই পিতৃতন্ত্র এসেছিল কৃষির উদ্ভবের মধ্য দিয়েই আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে। উপরে উল্লিখিত হারেম ও যৌনবঞ্চনার সমাজ যেমন শিকারী-সংগ্রাহক সমাজের টিকে থাকা নিশ্চিত হয়, তেমনি কৃষিভিত্তিক সমাজে সর্বাধিক ফলন ও উৎপাদন নিশ্চিত হবে যদি সকল পুরুষের গৃহে স্ত্রী থাকে, অর্থাৎ সকলেই যৌনতার সমানাধিকার লাভ করে। এজন্য পিতৃতন্ত্র নারীদের পূর্বোক্ত যৌন-স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, গৃহে বন্দি করে, ধর্মগুলো তৈরি করে সেটাকে জাস্টিফাই করে। এর মাধ্যমে সকল পুরুষ যৌনতার সুযোগ লাভ করে। টপ ২০% বঞ্চিত হয় হারেম তৈরি করা থেকে। এই সমাজে রেইপ তুলনামূলকভাবে কমে যায়, হারেম ফেনোমেনাটাও খুব ধনিদের জন্য সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এই সমাজেও স্ট্র্যাটিফিকেশন বা স্তরায়ন আসে, কিন্তু যৌনতার অধিকার সবারই থাকে। এদিকে পুরুষদের ওপর যুক্ত হয় পরিবারের ভরনপোষণ, স্ত্রী-সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণের বার্ডেন। যাই হোক, আমার প্রথম পয়েন্টটা হচ্ছে নারীর ফ্রি মেটিং চয়েসের শিকারী-সংগ্রাহক সমাজই যে নারীর জন্য সুবিধাজনক ছিল তা বলা যায়না।

(২) কৃষিভিত্তিক পিতৃতন্ত্রের পর আসে পুঁজিবাদের যুগ। নারীরা ঘর থেকে বের হতে শুরু করে। পিতৃতন্ত্রের মূলে যে কৃষিব্যবস্থা ছিল সেটার উর্ধ্বে গিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হয়। পুঁজিবাদ অনেকটাই পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করতে থাকে। অনেক নারীবাদীই বলেন যে, পুঁজিবাদের প্রভাবে পিতৃতন্ত্র নতুনভাবে নারীদের ওপর শোষণ করেছে। আমার মতে এভাবে বলা উচিৎ নয়। একেকটা উৎপাদন ব্যবস্থায় সেক্স-জেন্ডারগুলোতে শোষণ একেক রকম হয়। বর্তমানে পুঁজিবাদী সমাজে যে পিতৃতান্ত্রিক শোষণ দেখা যায় তা অবশিষ্ট পিতৃতন্ত্রের ফলে আসা শোষণ। পুঁজিবাদের কারণে সেক্স-জেন্ডারের ওপর শোষণ ভিন্ন রকমের শোষণ। এগুলোকে আলাদা করে দেখাই বিশ্লেষণের জন্য ভাল। যাই হোক, এই পুঁজিবাদী সমাজ আস্তে আস্তে পিতৃতান্ত্রিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে গেছে, নারীদেরকে পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে তুলনামূলকভাবে স্বাধীন করছে পিতৃতন্ত্রের প্রভাব কমিয়ে, এর মানে এই নয় যে এর মাধ্যমে মানুষ শিকারী সংগ্রাহক যুগে ফিরে যাচ্ছে। মূল পার্থক্যটা হচ্ছে রিসোর্স ও রিসোর্স ডিস্ট্রিবিউশনে। শিকারী সংগ্রাহক সমাজে রিসোর্স ছিল খুব কম, পুঁজিবাদী সমাজে তা অনেক বেশি। আবার শিকারী সংগ্রাহক সমাজে রিসোর্স নিয়ে স্তরায়ন কম ছিল, বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে ধনি থেকে দরিদ্রের মধ্যে নানান স্তর আছে। তাই পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই পার্থক্যটা কি লেখিকা যেরকম সমাজ চেয়েছেন সেরকম সমাজকে সামনে আনতে পারবে? মানে নারীরা শিকারী সংগ্রাহক যুগের মত এক্সপ্লয়েটেড না হয়ে ও বহুবিবাহের সমাজে না গিয়েই ২০% পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে, যেখানে অবশিষ্ট ৮০% পুরুষ ইন্টিমেট পার্টনার থেকে বঞ্চিত হবে, ও সেই বঞ্চনাকেই রিয়ালিটি হিসেবে মেনে নিতে শিখবে? মনে হয়না, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ নারীদের জন্য মেটিং চয়েসে সেরকম কিছু অফার করে। এক্ষেত্রেও যদি ৮০% নারী ২০% পুরুষের সাথে সম্পর্কে যেতে চায় তাহলে অনিবার্যভাবে বহুবিবাহই ঘটবে, যা আবার নারীরাই মেনে নেবে না। আর বাকি ৮০% পুরুষ যৌনবঞ্চনায় থাকার কারণে ঠিকই শিকারী সংগ্রাহক সমাজের মতই শর্ট টার্ম স্ট্র্যাটেজি হিসেবে রেইপ ও সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট শুরু করবে, সেক্স ওয়ার্কার ও সেক্স বটের অপশন থাকলেও।

লেখিকা বলছেন, পুরুষদেরকে ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দিয়ে এর সমাধান করতে হবে। কিন্তু এটা অবাস্তব কারণ, ৮০% পুরুষের কাছে মাত্র ২০% নারী এভেইলেবল থাকা মানে হলো এই পুরুষদের কাছে নারীর হাই ডিমান্ড আর তাই অনেক বেশি কম্পিটিশন। পুরুষের মধ্যে এই কম্পিটিশন অনেক বেশি বেড়ে যাবে, তারা আরও বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠবে। আর বায়োলজিকাল ডিটারমিনিস্ট এই লেখিকার বোঝা উচিৎ স্তন্যপায়ীদের মধ্যে পুরুষেরা কম্পিট করার একটা অন্যতম কারণ নারীদেরকে আকৃষ্ট করাই। এখানে আমি ফ্রি মেটিং চয়েসের বিরুদ্ধে কিছুই বলছি না, কেবল বলছি আধুনিক হাই রিসোর্সের সমাজও নারীদেরকে শিকারী সংগ্রাহক সমাজের ফ্রি মেটিং চয়েজের সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারেনা। এখানেও হারেম ও রেইপের সমস্যা আসছে। বলতে গেলে ফ্রি মেটিং চয়েসের সমাজ তৈরি করতে আগে বহুবিবাহবিরোধী আইনগুলোকে ভেঙ্গে ফেলতেই হচ্ছে। আর সেই বহুবিবাহবিরোধী আইন নারীরাই মানতে চাইবে না, কারণ শিকারী সংগ্রাহক সমাজের পরও মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিবর্তন ঘটেছে, নৈতিক বিকাশ ঘটেছে। সতীনের ঘরে কনফ্লিক্ট মেয়েদের মধ্যেই লাগবে। আর মেয়েরাই ইনসিকিউরিটিতে থাকবে কখন তার স্বামী অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কে যায়। রাষ্ট্র তার পক্ষে থাকবে না এবারে। রাষ্ট্রকে বরং তখন ভাবতে হবে কিভাবে ধর্ষণ ও সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের হার কমিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে!

(৩) তবে এখন এই হাই রিসোর্সের সমাজ অন্য দিয়ে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে যার কারণে লেখিকার এই মডেলটাই ফল করে। শিকারী সংগ্রাহক সমাজে রিসোর্স কম ছিল, টিকে থাকাই ছিল অন্যতম লক্ষ্য, পুরুষদের এরকম অবস্থায় চুজি বা নির্বাচক হলে চলে না। সফল পুরুষদেরকে তখন সকলের মধ্যেই স্পার্ম ছড়িয়ে দিতে হবে, আর তারা তা করত। কিন্তু এখন তো সেই রিসোর্স স্বল্পতা, টিকে থাকার জন্য ভালনারেবিলিটি নেই। তাহলে এখন কেন এই ২০% পুরুষই বা বাছবিচারহীন হয়ে সকল নারীর মধ্যে স্পার্ম ছড়িয়ে দিতে যাবে? সময়ের বিবর্তনে পুরুষদের মধ্যেও টেস্ট তৈরি হয়েছে। দেখা যাবে টপের ২০% পুরুষও শেষ পর্যন্ত সঙ্গী হিসেবে ২০% নারীকেই নির্বাচন করছে। এরপর বাকি ৮০% এরও প্রথম ২০%, বাকি ৮০% নারীর প্রথম ২০%-কে নির্বাচন করছে। আর এভাবেই চলছে। এর ফলে লেখিকার ধারণাটি আর টেকেনা। মানে বর্তমান হাই রিসোর্সযুক্ত সমাজে নারীরা চুজি হলেও ফ্রি মেটিং চয়েসে তাদেরকেও একটা ভাল কম্পিটিশনে যেতে হচ্ছে। কেননা এই সমাজে পুরুষেরাও চুজিয়ার হয়ে গেছে। কোন টপের নারীকে নির্বাচনের আগে পুরুষ কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস করবে। যদি দেখে টপের দিকে নারীর জন্য বেনিফিটের চেয়ে কস্টই বেশি তাহলে সে নিচের দিকে নারীকে বাছবে যার ক্ষেত্রে বেনিফিট বেশি। আর এতে ফ্রি মারকেটের নীতিতে টপের নারীও তার কস্ট কমাতে বাধ্য হবে, আর এখানে অবশ্যই বহুবিবাহের ব্যাপারটা নারীর জন্য কস্টলি বিবেচিত হবে, যা শিকারী সংগ্রহের সময়ে ছিলনা।

(৪) বর্তমানে এই টপের ২০% পুরুষের মধ্যেও ভেরিয়েশন আছে যা শিকারী সংগ্রাহক যুগে ছিলনা। এখন এই টপ ২০% এর মধ্যে কেউ পয়সাওয়ালা বলে নারীর কাছে আকর্ষণীয় হছে, কেউ আকর্ষণীয় হচ্ছে অধিকতর উপযুক্ত ও স্বাস্থ্যবান সন্তান দেবে বলে (সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যই ফিটনেস মার্কার) (লেখিকার বায়োলজিকাল ডিটারমিনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলছি)। এখন একই ব্যক্তির মধ্যে এই দুই কোয়ালিটি পাওয়া বিরল। তাই এক্ষেত্রে ডুয়েল মেটিং স্ট্র্যাটেজি কাজ করে, যেখানে নারীরা সিকিউরিটির জন্য পয়সাওয়ালা লোক এবং সন্তানের জন্য স্বাস্থ্যবান লোককে বেছে নেয়। এই অবস্থায় পরকিয়া বাড়ছে, কনফ্লিক্ট বাড়ছে, আর মেট চয়েসও নিরাপদ বা স্মুদ হচ্ছে না। রাষ্ট্রকেও এখানে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেখা যাবে, কারণ রাষ্ট্র কনফ্লিক্ট কমাতে চাইবে।

ওপরের ৪টি কাউন্টারের মধ্যে প্রথম দুটি ছিল এই নিয়ে যে নারীর ফ্রি মেট চয়েসকে যে নারীর জন্য ইতিবাচক বলে ভাবা হচ্ছে তা নারীর জন্য অতটা ইতিবাচক বা বাস্তবসম্মত নয়। লেখিকা বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজমকে অর্থাৎ বায়োলজি দিয়ে মানব সমাজের সব কিছু ব্যাখ্যা করা যায় – এই অবস্থান গ্রহণ করেছেন। আর এটার ভিত্তিতে তিনি বলেছেন শিকারী-সংগ্রাহক যুগের সমাজ ন্যাচারাল ও নারীবান্ধব, যেখানে কৃষিভিত্তিক পেট্রিয়ার্কি আর্টিফ্রিশিয়াল বা কৃত্রিম ও নারীবিরোধী, সেই সাথে বায়োলজি-বিরোধী (যেহেতু আর্টিফিশিয়াল)। আর তিনি তাই কেবল বায়োলজিকাল ডিটারমিনিস্টিক পথেই হাঁটেননি, সেই সাথে এনেছেন ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসিকে, যা বলে, ন্যাচারাল জিনিসই সঠিক, তাই এর দিকেই ফিরে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু কোন কিছু ন্যাচারাল হলেই তা মোরাল বা নৈতিক হয়ে যায়না। হারেম, ধর্ষণ সবই ন্যাচারাল, মানব সমাজের টিকে থাকা নিশ্চিত করতেই মেটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে এগুলোর বিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু তাই বলে সেগুলো নৈতিক হয়ে যায়না। বিবর্তনগত উৎপত্তি থাকলেও কোন কিছু অনৈতিক হতে পারে যদি তা মানুষকে কষ্ট দেয়; মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অসুবিধার সৃষ্টি করে; নিগ্রহণ-নিপীড়ণ-বঞ্চনার কারণ হয়। তাই যদি লেখিকার বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজমকে আপাতভাবে ঠিক ধরেও নেই, সেখান থেকে আসা নৈতিক বিধানগুলোকে নৈতিক ধরে গ্রহণ করা যায়না। শিকারী সংগ্রাহক সমাজের ফ্রি মেটিং চয়েসে (যাতে মানুষ বিবর্তিত) হারেম, রেইপের মত ব্যাপার আসবে, এক্সপ্লয়টেশন আসবে, আর তাকে নৈতিক ধরা যায়না। একইভাবে সেটা ধরে যদি ৮০% পুরুষের যৌনবঞ্চনাকে স্বাভাবিক ধরতে বলা হয় সেটাকেও না।

আমার কাউন্টারের শেষের দুটো পয়েন্ট বলছে কেন এই বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজমের পথটাই ভুল। মানুষ কেবল বায়োলজিকাল জীব নয়, সামাজিক জীব। আমি এই পয়েন্টগুলোতেই উল্লেখ করেছি যে, কিভাবে লো রিসোর্সের শিকারী-সংগ্রাহক সমাজে মানুষের আচরণ আর হাই রিসোর্সের আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের আচরণে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এখন এই দুটো সমাজেই কিন্তু বাইরে থেকে আরোপিত চাপ কম, ও তুলনামূলকভাবে মুক্ত কম্পিটিশনের। কিন্তু তাও আচরণে পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে কেননা সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভিন্ন। এটাই দেখিয়ে দেয় যে কেন সমাজের ব্যাখ্যায় কেবল বায়োলজিকে ব্যবহার করা, অর্থাৎ বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজম ভুল। সেই সাথে দেখিয়ে দেয়, নারীবাদী (এবং ইনসেলরা) যদি বায়োলজিকাল ডিটারমিনিজমের ভিত্তিতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে তাদের কতটা বড় ভুল হতে পারে।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.