রাশিয়ার জ্বালানিতে প্রাইসে ক্যাপ কি কাজ করবে?

(ডয়েচে ভেলা নিউজের রব ওয়াটস এই বিষয়ে ইয়েল স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের জেফরি সোনেনফিল্ডের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। তাদের কথোপকথনটাই সংক্ষেপে তুলে ধরছি, কোন রকম নাম ও কোলনের ব্যবহার ছাড়াই…)

ইউক্রেইন যুদ্ধের শুরুর পর থেকে রাশিয়া তার তেল বিক্রি করে যুদ্ধে ফান্ড করছে। কিন্তু এখন জি৭ গ্রুপ বলছে তারা এটার সমাপ্তি টানতে চায় আর এর মাধ্যমে রাশিয়ার লাভে সীমা টানতে চায়। ইউএস, ইউকে, জার্মানি, জাপান তেল কেনার জন্য যে অর্থ পরিশোধ করছে তার সীমা টানতে চায়। এই প্রাইস ক্যাপ কি কাজ করবে? এটার মাত্রা কী হবে? আর অন্যান্য দেশ কি এটা মেনে নেবে? তো কেন জি৭ মনে করে রাশিয়ান অয়েল প্রাইসে ক্যাপ বসানো উচিৎ?

অনেকে মনে করছেন যে, বর্তমান স্ট্যাটাস কুও, অর্থাৎ রাশিয়ার দ্বারা এই চাপ সৃষ্টি এত খারাপ না, কারণ মনে হচ্ছে পুতিন খুব উন্নতি করছে, এখন পুতিনের ভাল সময় যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম নয়। গ্যাস ইইউ-তে না যাওয়া মানে এই না যে গ্যাস এশিয়ায় যাবে, কারণ ভেপর গ্যাস ট্রান্সপোর্টের জন্য যে পাইপলাইন দরকার তা নেই। রাশিয়া এলএনজি তৈরি করে না যাকে জাহাজ দিয়ে পাঠানো যাবে। তাই ইউরোপে তাদের যে ৮৬% গ্যাস যেত তার মাত্র একটা অংশ এখন ইইউতে যাচ্ছে বলে গ্যাজপ্রমের গ্যাস সাপ্লাই এক তৃতীয়াংশে নেমে গেছে, এর ফলে তাদের সমস্যা হয়েছে, অন্যদিকে ইইউ যে গ্যাস চায় তা অন্যান্য সোর্স থেকে তাদের কাছে আসার ব্যবস্থা হচ্ছে আর গ্যাসও চলে আসছে। প্রধাণত ইউএস ও নরওয়ে থেকে থেকে এখন রাশিয়া গ্যাস নিচ্ছে, এবং শীঘ্রই তারা আরও বেশি পাবে। তাই এখন আরও এক্সপেন্সিভ গ্যাস নিতে হবে, কিন্তু দামের তো কোন লিমিট নেই। দামী এলএনজি সেখানে আসছে। জার্মানি যার ৪৩% গ্যাস রাশিয়া থেকে আসত, তারা এখন ১০% এরও কম পাচ্ছে। আর ইতিমধ্যে ৮৫% স্টোরেজ পুরণ হয়ে গেছে। উইন্টার স্টোরেজ অলরেডি গত বছরের চেয়ে বেশি পূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তেল নিয়ে। রাশিয়া এখন তেল থেকে লাভ করছে। কিন্তু সত্য হলো রাশিয়া তেল থেকে আসলে অত লাভ করছে না। রাশিয়া খুবই ইনেফিশিয়েন্ট প্রোডিউসার। আর কেবল মূলত ভারত ও চীনেই তারা তেল বিক্রি করতে পারছে। আর এটার জন্য ইন্ডিয়া ও চায়না অনেক বড় ডিসকাউন্টও পেয়েছে, আর সেই ডিসকাউন্ট দিয়ে রাশিয়াকে মোটামুটি ব্রেক-ইভেন, অর্থাৎ খরচ আর রিটার্ন সমানের কাছাকাছি যেতে হয়েছে। তাই রাশিয়ার রেভিনিউ বেশি হলেও প্রোফিট বেশি নয়। তাই এই স্ট্যাটাস কুও কাজ করবে না। এছাড়া স্যাংকশন আসছে, যা ৫ই ডিসেম্বর থেকে সব ক্রুড অয়েলকে ইইউ ও অন্যান্য স্থানে বিক্রি আটকে দেবে, আর ৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসোলিন ও এর মত সব রিফাইনড প্রোডাক্টের বিক্রিও বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে অয়েল শক তৈরি হবে। তাই তেলের অন্যান্য স্থানে ফ্লো হওয়াটাকে ক্যাপ লাগিয়ে দেয়া ও বাকি বিশ্বকে দিয়ে এটা এনফোর্স করানোটা খুব স্মার্ট একটা মুভ।

বাস্তবে ক্যাপ কিভাবে কাজ করবে? কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে যে কোম্পানিগুলো রাশিয়ান ক্রুডের একটি ব্যারেল কেনার সময় কম অর্থ পরিশোধ করবে?

আমরা জানি একটি দেশ প্রতি ব্যারেল রাশিয়ান ক্রুড অয়েল কেনার জন্য কত অর্থ পরিশোধ করছে। ফুয়েলের শিপার, মেরিটাইম ইনশিউরার, ট্রেডারদের মত যারা থার্ড পার্টি লজিস্টিক হ্যান্ডল করে, আর তার মাধ্যমে এই বিক্রিগুলোকে সম্ভব করে, তাদের ৯০% এরই শিপিং হয় ইইউ বা ইউকে শিপ দ্বারা; তাদের ফাইনান্স ইনশিউর করা হয় ইইউ বা ইউকে মেরিটাইম ইনসিউরারদের দ্বারা, আর তাদেরকে এই আইনের অধীনে যেতে হবে। কোন কোন স্কেপ্টিক বলতে পারে যে, এটা কাজ করবে না, কিন্তু তারা এও বলেছিল যে অন্যান্য এন্টি-টেরোরিজম স্যাংকশনও কাজ করবে না, কিন্তু সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকটি ফাইনানশিয়াল ইনস্টিটিউশনই স্যাংকশন মানতে বাধ্য, এবং যারাই এখানে চিট করেছে তাদেরই আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তাই এখন পর্যন্ত এগুলো এনফোর্স করার ও থার্ড পার্টিরও এগুলোকে এনফোর্স করার ভাল ইতিহাস আছে।

কিন্তু পুতিন বলছেন যে এটা করলে ইতিমধ্যেই স্ট্রাগল করা জি৭ এর দেশগুলোর জন্য তা ব্যাকফায়ার করবে। তিনি বলছেন, “এমনটা করা হলে আমরা কোন কিছুই সাপ্লাই করব না, কেননা এটা আমাদের ইকোনমিক ইন্টারেস্টের বিরোধী। আমরা এক্ষেত্রে গ্যাস, তেল, কয়লা বা ফুয়েল অয়েল সাপ্লাই করব না। কিন্তু যারা আমাদের ওপর কিছু চাপাতে চাইছে, তাদের এখন নিজেদেরকে চাকা সামলানোর কোন অবস্থা নেই, তাদের উচিৎ নিজেদের সেন্সে ফিরে আসা।” এখন আমাদের কি প্রেসিডেন্ট পুতিনের কথাকে গ্রহণ করা উচিৎ? রাশিয়া কি জি৭ এবং তাদের সাথে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর কাছে তেল বিক্রি করা বন্ধ করে দিতে পারেনা?

পুতিনের কথাকে ধরা উচিৎই নয়। তার নাম ভ্লাদিমির পুতিন – এটা ছাড়া তিনি যাই বলুন না কেন, কিছুই বিশ্বাস করা যাবে না। তিনি তার জিডিপি নাম্বার ইনভার্ট করেছেন, এবং নিজেদের সব ন্যাশনাল ইনকাম স্ট্যাটিস্টিক্সকে লুকিয়েছেন, তার এই ইনভার্টেড জিডিপিকে সাপোর্ট করার জন্য। তাই আইএমএফ ও অন্যান্য সবাই বুঝতে পেরেছে যে, এগুলো জাল, আর তার কারেন্সি রুবল কেবই আর্বিট্রারি নাম্বার যা তিনি আরোপ করেছেন, এটা কোন ট্রেডেড কারেন্সি নয়। তিনি নিজের দেশকে একটি সাপ্লাইয়ারস মারকেট হিসেবে তুলে ধরতে চান, দেখাতে চান যে তার অয়েলের মারকেট একটা সাপ্লাইয়ার মারকেট, যা নির্ধারিত হয় সাপ্লাইয়ার, অর্থাৎ তার দেশের দ্বারাই। কিন্তু এটা ভুল, তার মারকেট আসলে একটা বাইয়ারস মারকেট, মানে ক্রেতা দেশগুলোই এখানে মারকেটটা নিয়ন্ত্রণ করে, সাপ্লাইয়ার রাশিয়া না। আর তিনি এসব দেখান ইইউ এর একতাবদ্ধতা, ইইউ এর প্রতিজ্ঞাগুলোকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য, বলেন যে তোমরা ভুক্তভোগী হবে, এর ফলে দাম বেড়ে যাবে। কিন্তু ক্যাপের উদ্দেশ্যই দাম কমিয়ে আনা।

কিন্তু একমাত্র প্রেসিডেন্ট পুতিনই এটা বলছেন না। অনেকে বলছেন, এর অর্থ হচ্ছে একটি দোকানে যাওয়া, এরপর দোকানদারের কাছে কম দামে তার পণ্য বিক্রি করতে বলা। কিন্তু এর ফলে কি তেলের বাজারে দাম উলটে বেড়ে যেতে পারেনা?

এরকমটা হয় যদি ওপেন বারগেইনিং থাকে। কখনও কখনও এমন প্রাইস সেট করা হয় যা কাজই করেনা। আর যে স্কেপ্টিকই এটা বলে থাকুক, তার বোঝা উচিৎ যে, দুই সপ্তাহের মধ্যেই সব জায়গাতেই বারগেইনিং শুরু হবে, কারণ সবকিছুই ডিসকাউন্টেড হবে, রাশিয়া ডিসকাউন্টে তেল বেচতে বাধ্য হবে, কারণ তার তেলের কনজিউমাররা প্রিমিয়াম সেপ্টেম্বর প্রাইস পে করছে না, তারা লেইট অগাস্ট বা আর্লি সেপ্টেম্বর প্রাইস পে করছে না, আর প্রাইস যদি সেট না হয় তাহলে পণ্যই কমে যায়, আর কখনও কখনও কনজিউমারও কমে যায়। আর রাশিয়ার মারকেট হলো বাইয়ারস মারকেট, আর স্টক মারচেন্ডাইজ ছাড়া এটি এরকম বাইয়ারস মারকেটই থাকবে। আর তেলের ক্ষেত্রেও তাই এমনটাই চলতে থাকবে। বিশ্ব যত কিনবে রাশিয়াকে তার চেয়ে বেশি বিক্রি করতে হবে। রাশিয়ার ক্যাশ স্টার্ভড রেভিনিউ এর ৬০%-ই আসছে জ্বালানি থেকে। তাকে এখন থেকেই তার দেশকে ও তার যুদ্ধকেও ফুয়েল করতে হবে। যদি রাশিয়া হুট করে কেবল তেল খেয়ে বেঁচে থাকার টেকনোলজি আবিষ্কার করতে না পারে তাহলে তারা বিপদে পড়ে যাবে। রাশিয়া যদি তেল বিক্রি করতে নাই চায়, তাহলে তাকে তেল খেয়েই বেঁচে থাকতে হবে, কারণ আর কোন উপায় অবশিষ্ট থাকছে না রাশিয়ার টিকে থাকার জন্য। বাকি বিশ্বের যতটা না তেল কেনা জরুরি, রাশিয়ার জন্য তার থেকেও বেশি জরুরি তার জ্বালানি বিক্রি করা। আর পুতিন যদি তার তেলের কূপগুলোকে বন্ধ করে দেন, তাহলে সেগুলোকে আবার চালু করতে কয়েক বছর লেগে যাবে, আর সেটা রাশিয়ার জন্য ডেভাস্টেটিং হয়ে যাবে।

ইউক্রেইনে রাশিয়ান ইনভ্যাশনের পর থেকে ওয়েস্টার্ন ন্যাশনগুলো তাদের রাশিয়ান অয়েল কনজাম্পশন কম করছে। ইউএস ইম্পোর্ট ব্যান করেছে, ইইউ-ও এমবার্গো দেয়া শুরু করছে। কিন্তু চীন আগের মতই রাশিয়ান অয়েল ইম্পোর্ট করছে, ভারত তাদের ইম্পোর্ট অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বলতে গেলে রাশিয়ান ইনভ্যাশনের আগে ভারত তেল সেভাবে রাশিয়া থেকে ইম্পোর্টই করত না, কিন্তু এখন তাদের ইম্পোর্ট চীনের কাছাকাছি। তাই যেখানে ভারত আর চীন রাশিয়ার তেল আমদানি করছে সেখানে এই প্রাইস ক্যাপ কি কাজ করবে?

ভারতের এনার্জি মিনিস্টার বলেছিল, আমরা গ্লোবাল মোরাল নিয়ে আগ্রহী নই, বরং আমাদের নিজেদের ইন্টারেস্ট নিয়ে আগ্রহী, আমরা দেখব কিভাবে সবচেয়ে সস্তায় আমরা এনার্জি পাচ্ছি সেই দিকটা। আর তারা ভুল নয়, আমরাও এর সাথে একমত। তারা এখানে সস্তায় এনার্জি পাচ্ছে, কেন তারা অন্য কোন জায়গা থেকে বেশি দামে এনার্জি কিনবে? কিন্তু রাশিয়া টেম্পোরারিলি ভারতে বেশি তেল বিক্রি করছে বলে ইন্ডিয়ার স্টোরেজ ক্যাপাবিলিটি প্রায় পূর্ণ হয়ে এসেছে। চীনও এখনও কিনছে, কিন্তু এই সপ্তাহে চীনে তেল বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে। তাদেরও আর তেল রাখার জায়গা নেই। আর এটা এতটাই বায়ারস মারকেট যে, ইন্ডিয়া ও চায়না রাশিয়ার থেকে ব্যারেল প্রতি ৩৫ ডলার ডিসকাউন্ট আদায় করে নিয়েছে। রাশিয়া এখন পার ব্যারেল ৮০ ডলারের মত দামে তেল বিক্রি করছে। পুতিন বা জে পি মরগানের এনার্জি অ্যানালিস্টের কথা বিবেচনা করলে এখন ব্যারেল প্রতি ৪০০ ডলার পে করার কথা ছিল। কিন্তু তারা ভুল, তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতি ব্যারেল ৮০ থেকে ৮৪ ডলারে। আর তাই ৩৫ ডলার ডিসকাউন্টে রাশিয়া ভারত ও চীনে প্রতি ব্যারেল ৫০ ডলারের মত দামে তেল বিক্রি করছে। অন্যদিকে রাশিয়ার তেল এক্সট্র্যাক্ট করতেই খরচ হয় ব্যারেল প্রতি ৪৪-৪৫ ডলার, মানে ব্রেক ইভেনের একেবারে কাছাকাছি। এরা এতটাই ইনেফিশিয়েন্ট। হ্যাঁ, রাশিয়া ওপেকের তৃতীয় বৃহত্তম এনার্জি প্রোডিউসার, কিন্তু তাদের এফিশিয়েন্সি সবচেয়ে কম। অন্যদিকে অনেক পুরনো টেকনোলজি নিয়ে ভেনিজুয়েলাই রাশিয়ার থেকে বেশি এফিশিয়েন্ট প্রোডিউসার। সৌদি আরব যেখানে প্রতি ব্যারেল তেল উৎপাদন করে মাত্র ২২ ডলারে, সেখানে রাশিয়া তেল উৎপাদন করছে তার দ্বিগুণ দামে। তাই তেল দিয়ে রাশিয়া তেমন লাভ করছে না। কিন্তু তারা কিছু লাভ করছেই, আর তাদের সেই কিছু লাভটা লাগবে।

আপনি যা বললেন তা ইউএস সরকার থেকেও বলা হয়েছে। আর ইউএস-ই প্রাইস ক্যাপ পরিকল্পনাটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। হোয়াইট হাউজ প্রেস সেক্রেটারি কেরিন জঁ-পিয়ের বলছেন, “একটি গ্লোবাল প্রাইস ক্যাপ আমাদেরকে দুটো লক্ষ্য অর্জন করতে সাহায্য করবে, প্রথমত, যুদ্ধের রসদের জন্য পুতিন যে রেভিনিউ এর ওপর নির্ভরশীল তা অনেকটাই কমিয়ে দেবে, দ্বিতীয়ত, বাজারে তেল কম মূল্যে আসবে, এবং সাপ্লাই ডিমান্ডকে পুরণ করবে। আমাদের এই প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছে, কারণ রাশিয়া ইতিমধ্যেই বেশ কিছু দেশে ৩০% পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দিতে ও লং-টার্ম কন্ট্রাক্ট করতে শুরু করেছে। এটা এও বোঝাচ্ছে যে রাশিয়া তার তেল রপ্তানি অব্যাহত রাখবে এবং আরও বড় ডিসকাউন্ট হজম করবে।” রাশিয়া আরও বড় ডিসকাউন্ট হজম করবে মানে তেলের জন্য তারা আরও কম অর্থ নেবে। মানি আপনি যা প্রেডিক্ট করছিলেন তাই ঘটছে। কিন্তু যখন প্রাইস ক্যাপ সেট করার প্রসঙ্গ আসে সেটা আপনি কিভাবে করবেন, ধরে নেই আপনি এটা রাশিয়ার প্রোডাকশন কস্টের নিচে যেতে পারবেন না।

রাশিয়ার জন্য তেল থেকে প্রোফিট নিশ্চিত করাই কঠিন হয়ে যায়। তাই প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৪৬ ডলার করলেও তা খুব থিন মার্জিন হয়ে যায়। আর আমার মনে হয়না, এর চেয়ে নিচে যাওয়া উচিৎ। এটা রাশিয়ার ব্রেক ইভেনের খুবই কাছাকাছি। মনে করিয়ে দিতে চাই, রাশিয়া প্রতি ব্যারেল তেলের জন্য ৪৪ ডলার খরচ করছে, যা অলরেডি খুব এক্সপেন্সিভ। কিন্তু তার ওপর তাদের শিপিং কস্ট আছে। ইইউ এর ক্ষেত্রে না হয় জাহাজ যেতে সর্বোচ্চ তিন দিন লাগবে, কিন্তু এশিয়ার পোর্টগুলোতে যেতে প্রায় ৩৪ দিন লাগবে, এর ফলে শিপিং কস্টও অনেক বেড়ে যাবে।

যদি রাশিয়ার তেলের উৎপাদন খরচই এত বেশি হয় তাহলে প্রাইস ক্যাপ না বসিয়ে কেন রাশিয়ার তেলের আমদানি জাস্ট ব্যান করে দেয়া হচ্ছে না?

কারণ গ্লোবাল মার্কেটপ্লেসে আমাদের এখনও রাশিয়ার তেল দরকার। কেন রাশিয়ার সাপ্লাইকে বাদ দিয়ে ওপেকের প্রাইসিং আরও বাড়ানো হবে? বরং এভাবেই দামটা কার্যকরীভাবে কমিয়ে আনা যাবে। এর ফলে ওপেকও কিছুটা নার্ভাস হবে। সবাই মনে করে সবসময় ওপেককেই, অর্থাৎ তেল সেক্টরে সেলারদেরকেই কার্টেইল করতে দেখা যায়, কিন্তু বাইয়ারদের কেন কার্টেইল দেখা যায় না। ওপেকের সেলার কারটেইল খুব কার্যকরী দেখা যাচ্ছে বিগত বছরগুলোর ক্ষেত্রে। গত সপ্তাহে আমরা ওপেক ও সৌদি আরব সহ তার কিছু সদস্য দেশ দ্বারা তেলের প্রাইস নিয়ে কিছু ম্যানুয়েভারিংও দেখেছি। তবে এর দ্বারা তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। তারা মাঠ কিছুটা উত্তপ্ত করেছে। এগুলো তাদের নার্ভাসনেসের প্রকাশ। কারণ তারা প্রাইস ক্যাপকে ভয় পাচ্ছে, আর ভাবছে এর ফলে বাইয়ারসরাও কার্টেল তৈরি করবে ও তার মাধ্যমে প্রভাব সৃষ্টি করবে। সবসময়ই কার্টেইলগুলো চিট করতে চায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তেলের দাম নাটকীয়ভাবে কমে আসবে। আমরা রাশিয়ার তেলকে শতভাগ বাদ দিতে চাইনা। আমরা কেবল চাই যাতে পুতিন এখান থেকে লাভ করতে না পারে। আর অবশ্যই চীন এটা বুঝতে পেরেছে। তারা রাশিয়ার তেল পছন্দ করে। কিন্তু আর কোন এভিডেন্স নেই যে চীন এখন পুতিনের সমর্থক হিসেবে কাজ করছে। আমরা জাস্ট দেখলাম, রাশিয়ার টপ ফিজিসিস্টদের মধ্যে কয়েকজনকে গত সপ্তাহে চীনের পক্ষে এস্পিয়নাজের অভিযোগে রাশিয়ায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এটা ছাড়াও অন্য কিছু ক্ষেত্রে চীনের সাথে রাশিয়ার বিরোধ আছে। জিওপলিটিকাল ক্ষেত্রে তাদের বিরোধ আছে। গত দশ দিনে তা নিয়ে টেনশন উল্লেখযোগ্য ছিল। তাই চীন যে নর্থ কোরিয়ার মত রাশিয়ারও পেট্রন সেইন্ট হিসেবে কাজ করছে তা বলা যায়না।

তেলের সাথে গ্যাস থেকেও রাশিয়া লাভ করে। আর যুদ্ধের পূর্বে ইইউ-ই রাশিয়ার থেকে সবচেয়ে বেশি গ্যাস আমদানি করত। ইইউ গ্যাসের ওপরেও প্রাইস ক্যাপ দিতে চাইছে, এদিকে রাশিয়াও ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইন থেকে গ্যাস সাপ্লাই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে। রাশিয়া কি এভাবে একই সাথে গ্যাস ও অয়েল ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে পারবে?

রাশিয়ার একটি ফ্রন্টেও যুদ্ধ করার লেভারেজ নেই। রাশিয়া নর্ড স্ট্রিম ১-এ গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আরও দুটো পাইপলাইন থেকে রাশিয়ান গ্যাস আসছে। জার্মানি ও ইইউ যুদ্ধের আগে রাশিয়া থেকে তাদের মোট আমদানির ৪৪% এর মত রাশিয়া থেকে নিত, যা এখন ১০% হয়ে গেছে। কিন্তু রাশিয়া যদি বাকি দুটো পাইপলাইনেও গ্যাস সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইইউ ইউএস, আলজেরিয়ার মত অন্য আরও সোর্স থেকে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস নিতে পারবে, যা এখনও জার্মানিতে আসা শুরু হয়নি। এইসব দেশ থেকে ইউরোপে এলএনজি শিপমেন্ট আসার জন্য প্রস্তুত আছে। জার্মানি ব্রিলিয়েন্টলি তার ছয়টি মেসিভ কনভারশন প্ল্যান্ট চালু করেছে, যেগুলো এলএনজি থেকে ভেপর ন্যাচারাল গ্যাসে কনভার্ট করবে, যা সমগ্র ইইউ জুড়ে প্রবাহিত হবে। মাত্র ছয় মাসের নোটিশে খুব দ্রুত এই প্ল্যান্টগুলো তৈরি করছে। এত দ্রুতগতিতে এগুলোর নির্মাণ আসলে ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ক্ষেত্রে মিরাকলের মত ব্যাপার। ডিসেম্বরেই এই মেসিভ কনভারশন প্ল্যান্টগুলো তৈরি হয়ে যাবে। এছাড়া ইইউ যে ১৫% ভলান্টারি র‍্যাশনিং-এ রাজি হয়েছে তা আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। স্পেইন ও পর্তুগালের কাছে এই ক্রাইসিসের সাথে তাল মিলিয়ে চলবার মত সামর্থ ছিলনা। অবশ্যই আমরা অনেক সময়ই হাঙ্গেরি ও তুরস্কে সমস্যা দেখেছি, অনেক মিডিয়া ও পলিটিকাল সাইন্টিস্ট অবাক হয়ে গেছে যে, ৩ সপ্তাহ আগে ইইউ ১৫% র‍্যাশনিং এডপ্ট করেছে, হয়তো এর প্রয়োজনও ছিলনা। কিন্তু যুদ্ধের সময় এগুলোর গুরুত্ব আছেই। আমি বলছি না যে এনার্জি এক্সপেনসিভ হবে না, শীতকাল কোল্ড হবে না, সেই সাথে যুদ্ধের ফলে কোন কোন ইন্ডাস্ট্রিকেও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। কারণ শর্ট টার্মে এনার্জির প্রাইস বেশি হচ্ছে।

(জেফরি সোনেনফিল্ড ঠিক বলছেন কিনা তা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করে দেখেছি। রাশিয়ার এনার্জি এক্সপোর্ট যে তাদের মোট এক্সপোর্টের ৬০%, তেমন কিছু পাইনি, তবে দেখেছি এদের তেল আর গ্যাস নিয়ে এক্সপোর্ট ৪৫%, কয়লা নিয়ে তা ৬০% হচ্ছে কিনা শিওর না। রাশিয়ার তেলের দাম লাস্ট চেক করেছিলাম ব্যারেল প্রতি ৮৬ ডলার সামথিং ছিল। তবে তাদের অয়েলের প্রোডাকশন কস্ট ব্যারেল প্রতি ৪৪ ডলারের বদলে ৩০ থেকে ৪০ ডলার পেয়েছি, যেখানে সৌদির প্রোডাকশন কস্ট ১০ ডলারের মত। রাশিয়া সম্প্রতি এশিয়ার সাথে তেল নিয়ে ৩০% ডিসকাউন্ট আর লং টার্ম কনট্রাক্টে গেছে সত্য। রাশিয়া ইন্ডিয়াকে কত ডিসকাউন্টে আগে তেল বেচছিল জানিনা, কিন্তু এই ২ সেপ্টেম্বরে রাশিয়া ডিসকাউন্ট কমিয়ে ২০ ডলার করে দিয়েছে। ভারতের ক্রুড অয়েল ক্যাপাসিটি তেমন বেশি না। চীনের ক্ষেত্রে যেখানে ৫৫০ মিলিয়ন ব্যারেল, সেখানে ভারতের ক্ষেত্রে ৩৯ মিলিয়ন ব্যারেল, তাদের স্টোরেজ ক্যাপাসিটি যে দ্রুত ফুলফিল হয়ে যাবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই, আর এটাই বাংলাদেশের সাথে ভারতের উদ্বৃত্ত জ্বালানি রপ্তানি নিয়ে চুক্তির একটি কারণ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু চীনের স্টোরেজ শেষ হয়েছে কিনা তা নিয়ে কিছু পাইনি, কেউ পেলে জানাবেন, তবে এটা জানি যে চীন যুদ্ধের আগে থেকেই বিভিন্ন সোর্স থেকে তাদের ক্রুড অয়েল স্টোরেজ বা স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ যাই বলুন, সেটা ফুল করছিল, সেক্ষেত্রে রাশিয়ার তেল তারা আর কতটা কিনতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়, এছাড়া চীন যে গত মাসে রাশিয়ার তেল কেনা কমিয়ে দিয়েছে তা সত্য। চীনের সাথে রাশিয়ার কিছু জিওপলিটিকাল রেশারেশি আছে তা সত্য। এই রেশারেশিটা হচ্ছে বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে। চীনের পক্ষে এসপিওনাজের জন্য রাশিয়া তার দেশের কতিপয় পদার্থবিদকে গ্রেফতার করেছে, তাও সত্য। রাশিয়া তাদের জিডিপি সহ বিভিন্ন হিসাব ম্যানিপুলেট করে সেটার কথা একটা পেপারে উঠে এসেছিল। ইইউ এর মেম্বার স্টেটগুলো জুলাই এর শেষের দিকে ১৫% র‍্যাশনিং এর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ৬টি কিনা জানিনা, জার্মানি এপ্রিলে এলএনজি টার্মিনালগুলোর জন্য ৩ বিলিয়ন ইউরো অর্থায়ন করেছিল, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই কাজের ছয় মাস হয়ে গেছে। আমি এই কটা বিষয়ই জাস্ট ভেরিফাই করেছি। আপনারা আরও কিছু পেলে বা সোনেনফিল্ডের কথায় ভুল কিছু পেলে কমেন্টে নিশ্চই জানাবেন।)

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.