সৌদি আরবে সম্ভবত আর অত তেল নেই, কিন্তু তাদের অবস্থা খারাপ না

সৌদি আরবের বিবর্তন

খুব বেশি দিন আগে, সৌদি আরব টিকে থাকার জন্য লড়াই করা উপজাতিতে পরিপূর্ণ একটি নির্জন জলাভূমি ছিল। এই অঞ্চলে অত্যন্ত কম অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ছিল, এবং মক্কা ছাড়া, তাদের জন্য কিছুই ছিল না। তবে, ১৯৩৮ সালের ৩রা মার্চ মার্কিনীরা বিশ্বের বৃহত্তম পেট্রোলিয়াম মজুদটি খুঁজে পাবার পর এই অবস্থায় পরিবর্তন ঘটে। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চল থেকে বেশিরভাগ লাভ মার্কিনীদের কাছে চলে যায় যখন সৌদি আরবকে সামান্য লভ্যাংশ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু, সৌদি আরব ধীরে ধীরে এই লভ্যাংশগুলো সংরক্ষণ করে এবং এই তেল কোম্পানিগুলো কেনা শুরু করে যেগুলো তাদের দেশ জুড়ে তেল উত্তোলন করে আসছিল। এবং শেষ পর্যন্ত, ১৯৮০ সালের মধ্যে সৌদি সরকার তাদের অংশীদারিত্ব ১০০% বৃদ্ধি করে যা তাদের বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানি – সৌদি আরামকো এর মালিক করে তোলে। সৌদি আরামকো তখন থেকে এই অঞ্চলটিকে একটি আধুনিক মরুভূমির মরুদ্যানে রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু, তাদের শহরগুলো পশ্চিমা শহরগুলোর চেয়ে বেশি আধুনিক হলেও তাদের একটি মারাত্মক বাধা রয়েছে, আর তা হলো তাদের বাজেটের ৯২%-ই আসে তেল থেকে। এখন, আমাদের বেশিরভাগই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে যে সৌদি আরবের কাছে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের জন্য না হলেও কয়েক দশক ধরে চালানোর জন্য পর্যাপ্ত তেল রয়েছে। কিন্তু, অনেক বিশেষজ্ঞ তাতে একমত নন, কারণ এমন প্রমাণও রয়েছে যে সৌদি আরব তাদের তেলের মজুদ সম্পর্কে মিথ্যা বলে থাকতে পারে। সুতরাং, সৌদি আরবের তেল আর কতদিন পর শেষ হয়ে যাবে?

সন্দেহজনক সৌদি উপাত্ত

সৌদি আরবের হাতে কতটা সময় বাকি আছে তা খুঁজে বের করার জন্য, আমরা দুটি উপায়ে সমস্যাটি নিয়ে কাজ করতে পারি : যোগান পদ্ধতি বা সাপ্লাই এপ্রোচ এবং চাহিদা পদ্ধতি বা ডিমান্ড এপ্রোচ। এখানে আমরা প্রধানত যোগান পদ্ধতির দিকে মনোনিবেশ করতে যাচ্ছি। সৌদি আরবের কাছে ২৬০ বিলিয়ন ব্যারেল তেল অবশিষ্ট রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ১০ বছরে সৌদি আরব প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। এর মানে হল যে পুরো এক বছরে, সৌদি আরব প্রায় ৩.৬৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। কিছু সহজ গণিত করে আমরা জানতে পারি যে, যদি সৌদি আরব তাদের বর্তমান নিষ্কাশন বজায় রাখে ৭১.২ বছরের মধ্যে বা ২০৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাদের তেল শেষ হয়ে যাবে। এটি একটি দীর্ঘ সময়ের মতো মনে হতে পারে, তবে মনে রাখতে হবে যে সৌদি আরব তেলের রাজস্ব টানতে শুরু করার পরে ইতিমধ্যে ৮৪ বছর হয়ে গেছে। এর মানে হল যে সৌদি আরব তাদের তেল উত্তোলন পথের অর্ধেকেরও বেশি পথ অতিক্রম করেছে। তবে পরিস্থিতি এর চেয়ে অনেক খারাপ হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে সৌদি আরব তাদের তেলের মজুদ সম্পর্কে মিথ্যা বলছে। কয়েক দশক ধরে আমরা যে সমস্ত তেল মজুদ সম্পর্কিত উপাত্ত পেয়েছি তা সৌদি আরবের কাছ থেকে এসেছে এবং তথ্যগুলো সন্দেহজনক।

প্রথমত, ১৯৮৯ সালে সৌদি আরবের তেলের মজুদ হুট করেই ১৭০ বিলিয়ন থেকে ২৬০ বিলিয়নে উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯৩৬ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যেই সৌদি আরবের সবচেয়ে বিস্তৃত তৈলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। এবং গত ৫০ বছরে সৌদি আরবে সেরকম কোনও আবিষ্কারই হয়নি। সুতরাং কীভাবে তাদের তেল মজুদগুলো রাতারাতি ৯০ বিলিয়ন ব্যারেল লাফিয়ে উঠল? কোত্থেকে এই তেলের মজুদ এলো? আবার এই লাফের সময়টিও কিন্তু খুব সন্দেহজনক ছিল। ১৯৮০ সালে সৌদি আরব আরামকোর নিয়ন্ত্রণ নিলেও ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত মার্কিনীদেরকে পুরোপুরি তাড়িয়ে দেওয়া হয় নি এবং তখনই সৌদি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং কোনওভাবে নেতৃত্বের এই পরিবর্তনের মাত্র এক বছর পরে তাদের তেলের মজুদ ৫০% বেড়ে যায়, যা অবশ্যই বেশ সন্দেহজনক। সৌদি আরব দাবি করে আসছে, গত ৩৩ বছরে তাদের তেলের মজুদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত ৩৩ বছরে দেশটির তেল মজুদের উপাত্ত দেখে তা মনে হয় না। সৌদি তেল উত্তোলনের উপাত্তের গ্রাফ দেখলে আমরা দেখি, দেশটি গত ৩ দশক ধরে প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। তাতে এটি মোট ১০২ বিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। এছাড়াও, যদি আমরা সৌদি আরবের মজুদ উপাত্তের দিকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে তাকাই, তবে আমরা দেখতে পাব যে তারা কেবল দাবি করছে না যে তাদের তেলের মজুদ স্থির রয়েছে, তবে তারা আসলে দাবি করছে যে এটি বাড়ছে। ১৯৯০ সালে ২৫৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ছিল, কিন্তু ২০১৬ সালের হিসাবে, ২৬৬ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ছিল। এর মানে হল যে সৌদি আরব এই ৩০ বছরে কেবল ১০২ বিলিয়ন ব্যারেল উত্তোলন করতে সক্ষম হয়নি, তারা আরও ৮ বিলিয়ন তেল বেশি উত্তোলন করেছে। অন্য কথায়, মার্কিনীরা চলে যাবার পর থেকে সৌদি আরব ১১০ বিলিয়ন ব্যারেল তেল খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে। আর সেটা ছাড়াও পূর্বের ৯০ বিলিয়ন ব্যারেলের লাফ আছেই। সুতরাং, দৃশ্যত, সৌদি আরব তাদের তেলের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মোট ২০০ বিলিয়ন ব্যারেল তেল খুঁজে পেয়েছে। মনে রাখবেন, এই সংখ্যাটি ১৯৮০-এর দশকে সৌদি আরবের মার্কিনীদের অনুমানের চেয়ে ৩০ বিলিয়ন ব্যারেল বেশি। এদিকে মার্কিনীরা পুঁজিবাদী শোষণে অসাধারণ। সুতরাং, মার্কিনীরা ৫০ বছর ধরে সৌদি আরবকে শোষণ করেছে এবং তাদের তেলের মজুদের অর্ধেকও (অর্থাৎ ২০০ বিলিয়ন ব্যারেল) খুঁজে পায়নি – এটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়না।

কেন মিথ্যা?

কেবলমাত্র উপাত্ততেই যে অসঙ্গতি আছে তা নয়। বছরের পর বছর ধরে কিছু বড় ফাঁস হয়েছে যা ইঙ্গিত করেছে যে সৌদিরা আসলেই মিথ্যা বলে আসছে। যেমন, ২০১১ সালে উইকিলিকস উচ্চ স্তরের সৌদি তেল নির্বাহীর কাছ থেকে দেশটির অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস করেছিল। সেই নির্বাহীর মতে, বছরের পর বছর ধরে, সৌদি আরব তাদের তেলের মজুদের কথা ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেল বাড়িয়ে বলে আসছে। এছাড়াও, আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে সৌদি আরব কখনই এত বেশি তেলের উত্তোলন বাড়াতে সক্ষম হয়নি। তারা আরও ২০০ বিলিয়ন তেলের মজুদ খুঁজে পেলেই যে তাদের উত্তোলন বাড়ানোর জন্য প্রচুর নতুন তৈলক্ষেত্র থাকবে এমন না। মার্কিনীরা তাদের যে তেলের সন্ধান দিয়ে গেছে তারা তাই এখনও উত্তোলন করতে পারেনি। প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন ব্যারেল নতুন কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে, মার্কিনীরা ১৯৮০ সালেই সৌদি আরব থেকে প্রতিদিন ৯.৯ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করত। তারপর থেকে ৪২ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু সৌদি আরব প্রতিদিন মাত্র ১০.৭ মিলিয়ন ব্যারেল উত্তোলনে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও, মনে হচ্ছে না যে সৌদিরা তাদের সামর্থ থাকার পরও ইচ্ছে করে নিজেদেরকে তেল উত্তোলন থেকে আটকে রেখেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সামরিক সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দিলেও সৌদি আরব তেল উত্তোলন দৈনিক ১০.৫ মিলিয়নের বেশি বাড়াতে পারেনি। এখন, এমনটা ভাবা যেতেই পারে যে সৌদি আরব মার্কিনী হুমকির জবাব দিতে অস্বীকার করেছে, কিন্তু তারা নিজেরা যখন হুমকি জারি করেছিল, তখনও তারা নিজেদের তেল উত্তোলন বাড়াতে সক্ষম হয়নি। যেমন, যখন ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তেলের দাম হ্রাস পাবার সময়ে, তখন তেলের দাম ১২০ ডলার থেকে কমে মাত্র ৪২ ডলারে নেমে এসেছিল এবং এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সৌদি আরব। তেলের শেলগুলো থেকে তেল বের করার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নিচ্ছিল। এর মানে হল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেলের জন্য মধ্য প্রাচ্যের উপর কম নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তাই সৌদি আরব এবং ওপেক শেল তেল নিষ্কাশনকারীদের বিরুদ্ধে মূল্য যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের কৌশলটি ছিল এই যে, তারা তেল উত্তোলন বাড়াবে এবং এর দাম কমিয়ে নতুন ব্যবসায় নামা নতুন উত্তোলনকারীদেরকে তেলের বাণিজ্য থেকে তাড়িয়ে দেবে। আর ঠিক এই পরিস্থিতিটাই ছিল সৌদি আরবের জন্য প্রতিদিন ১৫ বা এমনকি ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়, কিন্তু তারা তাদের তেল উত্তোলন দৈনিক ১১ মিলিয়নের বেশি বাড়াতে পারেনি। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, সৌদি আরবকে মার্কিনীরা যে তেল উত্তোলনের সামর্থ দিয়ে গিয়েছিল তারা সেটাকে অতিক্রম করতে পারেনি, যা তাদের নিজস্ব তেল-মজুদ সম্পর্কে মিথ্যা বলার সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কেন মিথ্যা বলছে। সবাই যদি জানতো যে সৌদির তেলের মজুদ এত বেশি নয়, তাহলেই কি সৌদির লাভ হতো না? কম যোগান মানে দাম বেশি, যার অর্থ সৌদি আরবের লাভও বেশি, তাই নয়কি? হ্যা, এই ব্যাপারটা প্রথম দিকের জন্য সত্যই হবে, কিন্তু লাভটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সৌদি আরব দাবি করলেও তাদের কাছে বিশ্বের বৃহত্তম তেলের মজুদ নেই। এটি আছে আসলে ভেনিজুয়েলার কাছে, যেখানে ৩০০ বিলিয়ন ব্যারেলের তেল মজুদ রয়েছে। ভেনেজুয়েলার তেল কখনোই বিশ্বের জন্য এতটা সহায়ক ছিল না কারণ দেশটি দুর্নীতি, হাইপারইনফ্লেশনে জর্জরিত হয়ে পড়েছে এবং কে জানে আর কী কী সমস্যা আছে দেশটিতে। কিন্তু যখনই নিশ্চিতভাবে জানা যাবে যে সৌদি আরবের কাছে যতটা তেল আছে বলে দাবি করা হচ্ছে এদের কাছে ততটা নেই, তখনই বিশ্ব তাদের পুরো মনোযোগ অবশিষ্ট দেশগুলোর দিকে ঘুরিয়ে দেবে। তখনই আমরা দেখতে পারব ভেনেজুয়েলা এবং কানাডায় একরকম নতুন ঐতিহাসিক অগ্রগতি। এমনকি আমরা এও দেখব যে, পশ্চিমা বিশ্বকে রাশিয়ার সাথে নানা রকম বোঝাপড়ায় আসছে। একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানির চাপও আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠবে, যার ফলে সৌদি আরবের ওপর বিশ্বের নির্ভরশীলতা কমে আসবে। এবং যেহেতু একমাত্র তেলই সৌদি আরবকে বিশ্ব অর্থনৈতিক পর্যায়ে মূল্যায়ন করে, তাই এটি কখনই সৌদি আরবের জন্য ভালো হবেনা। তাদের জন্য বাকি বিশ্বকে যতটা সম্ভব তাদের তেলের উপর নির্ভরশীল রাখা দরকার, আর সেটার জন্য যদি তাদেরকে নিজেদের দেশের তেলের মজুদ সম্পর্কে মিথ্যা বলতে হয়, তবে তাই হোক।

কাউন্টডাউন

কিন্তু, যদি সৌদি আরব এই পুরো সময় তাদের তেলের মজুদ সম্পর্কে মিথ্যা বলে থাকে, তবে সেই মজুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কাছে আসলে কতটা সময় আছে? যদি আমরা ধরে নেই যে আমাদের কাছে থাকা সর্বশেষ সঠিক তথ্যটি হচ্ছে সৌদি থেকে ১৯৮৮ সালে যখন মার্কিনীরা চলে গিয়েছিল সেই সময়ের তথ্য। তবে এর মানে হয় যে, সৌদি আরবকে ১৭০ বিলিয়ন ব্যারেল তেল দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, এটি সম্ভব যে তারা গত ৩৪ বছরে এই পরিমাণ ১০-২০% বৃদ্ধি করেছে, তাই তাদেরকে এই বেনিফিট অফ ডাউট দিলে ধরতে পারি যে, তাদের কাছে ২০০ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের মজুদ আছে। দেশটি ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৮.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করলে ১৯৮৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা ১০৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহার করেছে। তার মানে তাদের কাছে অবশিষ্ট তেলের মজুদ আছে ৯৫ বিলিয়ন ব্যারেল। এখন যদি দেশটি প্রতিদিন গড়ে ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করতে থাকে, তবে বলতে হয় দেশটির কাছে বাকি আহচে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ বছরের তেলের মজুদ। যদি সৌদি আরব মিথ্যা বলে থাকে, তাহলে এটাই হবে তাদের তেলের মজুদ নিয়ে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত অনুমান। কিন্তু এই হিসেবটা বেশ উদারভাবেই করা হলো। এমন যদি হয়ে থাকে যে, মার্কিনীরা চলে যাওয়ার পরে সৌদি আরব কোনও নতুন তেলই খুঁজে পায়নি, আর এমন যদি হয় যে, দেশটির বাকি ১৭০ বিলিয়নের ২০%-ই ব্যবহারযোগ্য নয়, তাহলে বলতে হয়, ১৯৮৮ সালে সৌদি আরবে মাত্র ১৩৬ বিলিয়ন ব্যারেল ব্যবহারযোগ্য তেল ছিল, আর গত ৩৪ বছরে দেশটির ১০৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের ব্যবহার হওয়ায় তাদের কাছে আছে আর মাত্র ৩১ বিলিয়ন ব্যারেল, যা মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

তবে এই সবচেয়ে রক্ষণশীল হিসাবটিও সম্ভবত আসল পরিস্থিতি নয়, দেশটিতে সম্ভবত কমপক্ষে দেড়-দুই দশকের তেলের মজুদই বাকি থেকে থাকবে, আর এটা দেশটির সাম্প্রতিক ক্রিয়াকলাপের সাথেও মিলে যায়। যদি সত্যিই তাদের কাছে তাদের দাবি অনুযায়ি এত বেশি মজুদের তেল অবশিষ্ট থাকে, তবে মনে হয়না তারা আয়ের অন্যান্য উৎসগুলোর দিকে এভাবে ক্রমবর্ধমান গতিতে এগিয়ে যেত। গত কয়েক বছর ধরে দেশটিকে পশ্চিমা মানদণ্ডগুলো গ্রহণ করার জন্য উন্মত্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। তাদের দেশের নারীর অধিকার ও মানবাধিকারের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে এবং তারা প্রথমবারের মতো দেশকে পর্যটনের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তারা বিমানবন্দর এবং পর্যটন আকর্ষণগুলোতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছে, তাই মনে হচ্ছে তারা দুবাইয়ের মতোই নিজেদের দেশকেও একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করতে বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে পুরো ভিশন ২০৩০ প্রকল্পও রয়েছে যার লক্ষ্য হল তেলের উপর দেশের নির্ভরশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা। যদি এই ধরনের প্রকল্পগুলো ভাল ভাবে চলে, তবে মনে হয় সৌদি আরবের পক্ষে তেল নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হওয়া ও দেশটির তেল শেষ হয়ে এলেও একটি ভাল অর্থনীতি হিসেবে দেশটির দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব। তাই দেশটি তাদের তেলের মজুদ সম্পর্কে পুরো বিশ্বকে ধোকা দিলেও তারা নিজেদেরকে ধোকা দিচ্ছেনা, বরং তারা এখন একটি তেলবিহীন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ

যদিও আমরা বলতেই পারি যে দেশটি তাদের তেলের মজুদ সম্পর্কে মিথ্যা বলাটা অনৈতিক এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্ররোচনামূলক, তবুও এটা বলতেই হবে যে তারা আসলে তাদের কার্ডগুলো ভালভাবেই খেলছে। তারা তাদের তেলের মজুদকে অতিরঞ্জিত করে তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাদের অপরিশোধিত তেল রপ্তানি আক্ষরিক অর্থেই দ্বিতীয় স্থানের দেশটির চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। এটি তাদের প্রায় অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের অর্থের ফরেইন রিজার্ভের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, যাকে ওয়ার চেস্ট বা যুদ্ধসিন্দুক বা বিপদের দিনের ভরসা বলা যায়। তারা কয়েক বছর আগে সৌদি আরামকোকে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের মূল্যায়নে নিয়ে গিয়েছিল, তাই মনে হচ্ছে তারা ধীরে ধীরে সেখানেও নগদ অর্থ উপার্জন করতে চায়। ইতিমধ্যে, তারা আক্রমনাত্মকভাবে তাদের আয়ের প্রবাহকে বৈচিত্র্যময় করতে শুরু করেছে, তাই মনে হচ্ছে সৌদি আরব তেল শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অত্যন্ত ভাল কাজ করছে। আর অন্য দিকে সৌদি আরব ছাড়া অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বলা যায়, তারা মূলত যতটা ভেবেছিল ততটা তেল বিশ্বে আর সম্ভবত নেই, আর সম্ভবত এটি একটি ভাল জিনিস। অবশেষে বিশ্ব বাধ্য হবে শক্তির পুনর্নবীকরণযোগ্য আকারগুলোতে চলে যেতে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.