সত্যপীর-সত্যনারায়ণ

সত্যপীরের প্রভাব সত্যপীরের পাঁচালি ও মাহাত্ম্যের লেখক ও লেখার সময়কাল : সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর পূজার্চনা উপাসনা ভারতের বিভিন্ন অংশে অনেক অনেক হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত আছে বহু শতাব্দী হতে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা প্রদেশের প্রায় সর্বত্র এবং পাঞ্জাবের জলন্ধর ও দাক্ষিণাত্যের মহীশূর অঞ্চলে এর প্রাধান্য লক্ষিত হয়। বাংলায় সত্যপীরের প্রভাব সবচেয়ে ব্যাপক। অজ্ঞাত পরিচয় পল্লীকবি থেকে উচ্চ শিক্ষিত সভাকবি সকলেই সত্যপীরের ছড়া-কথা, পুঁথি-পাঁচালি রচনা করেছেন। শিক্ষিত কবিদের মধ্যে আছেন ১৬শ শতকের গোড়ার দিকে কবি কঙ্ক, শেষের দিকে ফয়জুল্লাহ, ১৮শ শতকে বিদ্যাপতি, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, ভারতচন্দ্র, গরীবুল্লাহ, শঙ্কর আচার্য, কৃষ্ণ হরিদাস প্রমুখ পুঁথি ও পাঁচালি রচয়িতা। লোকসাহিত্যের ছড়া, ব্রতকথা ও পালাগানের ভেতর দিয়ে সত্যপীরের মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছে। কঙ্ক ময়মনসিংহের কবি। ফয়জুল্লাহ কুমিল্লার (মতান্তরে দক্ষিণ রাঢ়), ভারতচন্দ্র বর্ধমানের, গরীবুল্লাহ হুগলির, রামেশ্বর মেদিনীপুরের। রাজশাহী জেলায় ‘সত্যপীরের ভিটা’ আছে। (Social History of the Muslims in Bengal, p. 137.)। ‘সত্যপীরের শিরনি’, ‘সত্যপীরের পাট’ প্রভৃতি আচার এবং পীরের অলৌকিক কেরামতি সম্বন্ধে লোকবিশ্বাস বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। (বাংলার বাইরেও সত্যপীরের প্রভাব আছে। পাঞ্জাবের জালন্ধরে সত্যপীর আছেন। সেখানে পীরের নামে মেলা হয়, তার নাম ‘সঙের মেলা’। পঞ্চানন মণ্ডল, পুঁথি-পরিচয়, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২)।

সত্যপীরের ঐতিহাসিকতা :

সত্যপীর কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন কিনা এ পর্যন্ত তার কোন প্রমাণসূত্র পাওয়া যায়নি। তবে দাবি করা হয়, যেমন –

  • উত্তর বঙ্গের কবি কৃষ্ণ হরিদাস তাঁর সত্যপীরের পাঁচালি কাব্যে পীরকে ঐতিহাসিক ব্যক্তি রূপে উপস্থাপিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর বর্ণনা মতে, মালঞ্চার রাজা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ময়দানবের অবিবাহিতা কন্যা সন্ধ্যাবতীর গর্ভে সত্যপীরের জন্ম হয়।
  • আঠারো শতকের কবি শঙ্কর আচার্য বলেছেন, সত্যপীর আলা বাদশাহের কানীন দৌহিত্র। (ইসলামি বাংলা সাহিত্য, পৃ. ৮১)
  • আদি মধ্যযুগে সাধকপীর-মনুসুর হাল্লাদ সত্যদর্শী ধর্মনেতা ছিলেন, তিনি নিজেকে ‘সত্যদর্শী’ বা ‘সত্য’ বলে প্রচার করেন (এ কারণে তিনি স্বধর্মীদের দ্বারা নিহত হন) তাঁর মুরিদ বা শিষ্যগণ তাঁকে ‘সত্যপী’ আখ্যা দেন এবং তিনি পরে উপাস্য পদে উন্নীত হয়ে যান।

মুসলিম পূর্ব হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও লোকধর্মে উল্লেখ :

বিষ্ণুর অপর নাম নারায়ণ। তিনি ঈশ্বর, চিরসত্য। এ অর্থে সত্যনারায়ণের পরিকল্পনা অসম্ভব নয়। হিন্দুর পৌরাণিক দেবতা সত্যনারায়ণের সাথে সত্যপীরের অভিন্নতা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। মুসলিম পূর্ব হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ও লোকধর্মে উল্লেখ –

  • সত্যনারায়ণের প্রাচীনতম উল্লেখ ‘স্কন্দপুরাণে’র রেবাখণ্ডে এবং ‘বৃহদ্ধর্ধপুরাণে’র উত্তরখণ্ডে পাওয়া যায়। (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮৯৪)। স্কন্দপুরাণে সত্যপীরেরই উল্লেখ আছে। (স্কন্দপুরাণে দ্বিজ সদানন্দ, কাঠুরিয়া ও লীলাবতী-কলাবতী দ্বারা সত্যপীরের মাহাত্ম্য প্রচারের কথা আছে। স্কন্ধপুরাণ, বঙ্গবাসী সংস্করণ, ১৩১৮, পৃ. ৩৬০-৬২)।
  • মহাভারতে সত্যনারায়ণের অনুরূপ দেবতা—সত্যবিনায়ক নামটি পাওয়া যায়। মহারাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেক হিন্দুর গৃহে সত্যবিনায়ক দেবতার পূজা হয়ে থাকে।
  • বাংলার মুসলমান সমাজের উপাস্য-সত্যপীর ও ভক্ত সত্যনারায়ণ অনুরূপ দেবতা—‘সত্যদেব’ বাংলার নাথ যোগী জাতির উপাস্য দেবতাদের অন্যতম।
  • ধর্মঠাকুরের পূজা থেকে সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের পূজার্চনা এসেছে বা ধর্মঠাকুর সত্যনারায়ণে বিবর্তিত হয়েছে – এমন একটা সম্ভাবনাও রয়েছে।

মহারাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেক হিন্দুর গৃহে সত্যবিনায়ক দেবতার পূজা হয়ে থাকলেও মহাভারতে বর্ণিত সত্যবিনায়ক বা স্কন্দ পুরাণে উল্লিখিত সত্যনারায়ণ পূজার্চনা বা পূজার বিধি-বিধান ভক্তজনের ধারণা-বিশ্বাসের সঙ্গে বর্তমানকালে (বা গত কয়েক শতাব্দী হতে) ব্যাপক প্রচলিত সত্যনারায়ণ পূজার্চনায় পার্থক্য দেখা যায় এবং শাস্ত্রীয় অপেক্ষা যে সকল লোকায়ত বা শাস্ত্রেতর বিধানের প্রাধান্য লক্ষিত হয়, সেগুলি থেকে ধারণা আসে যে, সত্যনারায়ণ পূর্ণ ভাবে শাস্ত্রীয় দেবতা বা প্রাচীন যুগীয় না হতেও পারেন। সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের কাহিনী পরিকল্পনায় লৌকিক প্রভাব, বাংলায় পীরদরবেশদের আবির্ভাব ও প্রতিপত্তি এবং হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক সমন্বয় সূত্রে পীরস্তুতি ও পীরপূজার উদ্ভব ইত্যাদি বিষয় লক্ষ্য করে পণ্ডিতগণ মনে করেন, পুরাণের পীরবাদ অংশ সম্পূর্ণ প্রক্ষিপ্ত এবং অর্বাচীন। (আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৩১ (৩য় সং))।

মাহাত্মজ্ঞাপক কাহিনীর হিন্দুয়ানী বিষয় : সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের মাহাত্ম্যজ্ঞাপক যে কটি কাহিনী-ধারা প্রচলিত আছে সেগুলির অধিকাংশের বিষয় হিন্দুয়ানি।

  • কাঠুরিয়া, সদাগর, মদনসুন্দর, লালমোন, মালঞ্চা, শিশুপাল রাজার পালা, হীরামুচির পালা, শশীবেশ্যার পালা, বগজোড়ের যশমন্ত সাধুর পালা, বনগ্রামের শুন্দি সওদাগরের পালা ও মনোহর ফাসিয়ারার পালা নামে মোট ১১টি কাহিনী বাংলায় প্রচলিত আছে। এগুলি সত্যপীরের কাহিনী। (সুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড, পৃ. ৮২০ (২য় সং); পঞ্চানন মণ্ডল, পুঁথি-পরিচয়, ১ম খণ্ড, ১৭ (ভূমিকা))।
  • কবি কঙ্কের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ কাব্যের নায়ক সুন্দর কর্তৃক পীরস্তুতি ও পূজাপ্রচারের কাহিনী বিদ্যাসুন্দর কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। পীরের কৃপাতেই সুন্দর বিদ্যাকে লাভ করেছিল। (দ্রষ্টব্য : বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৬)।
  • রামেশ্বরের ‘সত্যপীরের পাঁচালীতে’ প্রথম অংশে দরিদ্র ব্রাহ্মণ কর্তৃক ও দ্বিতীয় অংশে সদানন্দ বণিক কর্তৃক শিরনি দিয়ে পীরপূজার কথা রামেশ্বরের কাব্যে আছে। (দ্রষ্টব্য: ঐ পৃ. ৮৯৫-৯৬)।
  • গরীবুল্লাহর ‘সত্যপীর’-এ ‘মদনকামদেব পালা’য় সওদাগর পুত্রত্রয় কর্তৃক পীরের শিরনি দেওয়ার কথা সত্যপীরের পুঁথিতে বর্ণিত হয়েছে। (গোলাম সাকলায়েন, ফকীর গরীবুল্লাহ, পৃ. ৩৫)।
  • এগুলো ছাড়াও অনেক রচনায় সত্যপীরের উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি কঙ্ক স্বয়ং সত্যপীরের পূজা করেছেন এবং তাঁরই নির্দেশ শিরোধার্য করে কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছেন।

হিন্দুদের রচনায় সত্যপীরের এই উল্লেখ ও মাহাত্ম্যারোপের কারণ অনুমান : এদিক থেকে কেউ কেউ মনে করেন, সত্যপীরের ধারণাটা হিন্দুরাই আবিষ্কার করেন এবং কখন সত্যনারায়ণ কখন সত্যপীরের মিশ্র নামে প্রচার করতে থাকেন। (Social and Cultural History of Bengal, Vol. 11. pp. 378-88.)। অনেকে মনে করেন, সত্যনারায়ণ পূজা আদি মধ্য যুগে পরিকল্পিত হয় এবং এদেশে হিন্দু সমাজের মধ্যে প্রচলিত থাকে ; পরে ভারতে মুসলমান অধিকারের পর, সে পূজার্চনা পল্লীর ধর্মান্তরিত মুসলমান সমাজের লোকেরা, জন্মগত বা বংশগত সংস্কারের প্রভাবে গ্রহণ করেন, কিন্তু তারা, অত্যধিক নিষ্ঠাবান মোল্লা মৌলভির আপত্তির বা বিরক্তির আশঙ্কায় সত্যনারায়ণের ‘নারায়ণ’ পরিবর্তে ‘পীর’ শব্দ যুক্ত করে সত্যপীর নাম করে নেন, ফলে জনপদ সমাজে সকল শ্রেণীর মুসলমানের সত্যপীর উপাসনায় কোন শংকা থাকে না। তবে এটা অনুমান মাত্র। আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেন যে, হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐক্য স্থাপন ও সামঞ্জস্য রক্ষার উদ্দেশ্যে জনজীবনে পীরদরবেশদের অলৌকিক মাহাত্ম্য কাহিনীকে আশ্রয় করে মঙ্গলকাব্যের আদর্শে প্রথম হিন্দুগণই পীরপাঁচালি রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এসূত্রে হিন্দু পৌরাণিক সত্যনারায়ণ কোন ঐতিহাসিক মুসলমান পীরের ছায়াবলম্বনে সত্যপীর রূপে পরিকল্পিত ও রূপায়িত হতে পারেন। (বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, পৃ. ৩১ (৩য় সং))। কালক্রমে নামের দিক থেকে কিছু ভিন্ন, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পৃথক পরিবেশে ও প্রথায় পূজা বা উপাসনা অনুষ্ঠিত হলেও আদি ধারা লুপ্ত হয় না, সে কারণ সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর পূজার্চনায় ভক্তদের স্ব স্ব উপাস্যের প্রতি ধারণা বিশ্বাস বিভক্ত হয়নি। সে কারণে একটি উপাস্যের সঙ্গে অপরটি বহু দিক হতে মিল দেখা যায়। মধ্য যুগে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবিদের রচিত সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের মাহাত্ম্য বিষয়ক কাব্য বা পাঁচালীগুলির মধ্যে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর অভিন্ন বলে প্রচার থাকে। এ সকল দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে মনে হতেই পারে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর আদিতে যাই থাকুন বর্তমানে গত কয়েক শতাব্দী বা মধ্যযুগ হতে হিন্দু ও মুসলমানদের একটি সমন্বিত দেবতা। কিন্তু অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ঠিক সংস্কৃতি সমন্বয় সাধন প্রচেষ্টা নয়, ‘মুসলমান শাসকের চণ্ডনীতি’ থেকে আত্মরক্ষার জন্য হিন্দুরা এরূপ মিশ্রদেবতার উদ্ভাবন করে নিজ নিজ ধর্মের মুসলমানি রূপান্তর ঘটিয়েছিল। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮৯৭)। কিন্তু সত্যপীরের পূজা-শিরনি, কথা-কাহিনীর উদ্ভব-উদ্ভাবনের সত্যকারের ইতিহাস তা নয়। অর্থাৎ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে সত্যনারায়ণ সত্যপীরের রূপান্তর গ্রহণ করেছেন এমত স্বীকার্য নয়।

মুসলিম পীর হবার সম্ভাবনা : সত্যপীরের চরিত্রের সূত্রানুসন্ধান করা যায় না। কিন্তু এমন পীরও আছেন, যাঁরা ঐতিহাসিক সূত্রে মুসলমান দরবেশ হয়েও হিন্দু-মুসলমান কর্তৃক সমানভাবে পূজিত হয়েছেন। তাঁদের কাহিনী পরিকল্পনাতেও হিন্দুয়ানির ভাব পুরোপুরি সংরক্ষিত। গাজীর অধিকাংশ পালাগান হিন্দু বণিক ও ব্রাহ্মণের নায়কত্বে রচিত, যেমন ‘মানিক সদাগরের পালাগান’, ‘সুনাই কন্যার পালাগান’ ইত্যাদি। মুসলমানদের আগমনের শুরু থেকেই পীরদরবেশগণ এদেশের জনসাধারণের জীবনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে এসেছেন। তসলীমুদ্দীন আহমদ বোগদাদের পীর শেখ আবদুল কাদের জিলানীকে সত্যপীরের সহিত সম্পর্কান্বিত করেছেন। (পূর্বোক্ত, রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ-পত্রিকা, ১০ম ভাগ, ১ম সংখ্যা, ১৩২২, পৃ. ৪১)। এটা অনুমান মাত্র, নিঃসন্দেহে তা স্বীকার করা যায় না। সত্যপীর ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলেও লৌকিক চেতনায় তাঁর মানব পরিচয় সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছে। আরেকটি ব্যাপারে শোনা যায়। আদি মধ্যযুগে সাধকপীর-মনুসুর হাল্লাদ সত্যদর্শী ধর্মনেতা ছিলেন, তিনি নিজেকে ‘সত্যদর্শী’ বা ‘সত্য’ বলে প্রচার করেন (এ কারণে তিনি স্বধর্মীদের দ্বারা নিহত হন) তাঁর মুরিদ বা শিষ্যগণ তাঁকে ‘সত্যপী’ আখ্যা দেন এবং তিনি পরে উপাস্য পদে উন্নীত হয়ে যান। তাঁর অনুরাগী বা ভক্তদের প্রচারের ফলে হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজে সত্যপীর অর্চনা প্রচলিত হয়।

ভাবাত্মক নাম হবার সম্ভাবনা : সত্যপীর ভাবাত্মক নাম হতে পারে। তসলীমুদ্দীন সাহেব সত্যপীর ‘পীরবরহক’ শব্দের অবিকল অনুবাদ বলে মনে করেছেন। বরহক শব্দের অর্থ সত্য বা প্রকৃত। (ঐ, পৃ. ৪১)। ড. হক ‘পীরই সত্য’ এ অর্থে সত্যপীরের ধারণা লোকমানস থেকে জন্মগ্রহণ করতে পারে বলে মনে করেছেন। তিনি বলেছেন, সত্যপীরের উদ্ভাবন সম্পূর্ণ মুসলমানদের কল্পনাজাত, পরে হিন্দুরা একেই সত্যনারায়ণ রূপ দিয়েছে। (মুসলিম বাংলা সাহিত্য, পৃ. ১১২)। ‘প্রমূর্ত সত্য’ অর্থে ড. আহমদ শরীফ সত্যপীরের নামকরণ সমর্থন করেন। (আহমদ শরীফ সম্পাদিত, পুথির ফসল, পাকিস্তান পাবলিকেশানস, ঢাকা ১৯৬৬, পৃ. গ (ভূমিকা))। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এমত পোষণ করেন। তিনি লিখেছেন, “মুসলমানের পীরকে লোকে যেমনি পূজো দিতে আরম্ভ করেছে অমনি তাকে সত্যনারায়ণ বলে প্রচার করে ব্রতটির উপর হিন্দুধর্ম দখল বসালেন। কিন্তু বাংলায় সত্যনারায়ণের যে পাঁচালী তাতে পীরকে মুসলমানী পোষাকই দেওয়া হয়েছে। কথা পর্যন্ত উর্দু, যেমন— জয় জয় সত্যপীর, সনাতন দস্তগীর ইত্যাদি। এই মুসলমান পীরের উপাসনা ও শিরনী ভট্টাচার্যদেরও ঘরে চলে এসেছে ও চলছে। পীরের শিরনী বা ভোগটা হচ্ছে সুজি, বাতাসা, হিন্দুয়ানিতে বাধে না এমন সব জিনিষ এবং পায়েসের দলে সেটা প্রায় চলে গেছে।” (অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার ব্রত, পৃ. ১৬–১৭)।

সত্যপীর মতবাদের প্রথম প্রচারক হিসেবে হুসেন শাহ : সত্যপীর মতবাদের প্রথম প্রচারক হিসেবে সুলতান হুসেন শাহের নাম তারিফ রচিত ‘লালমোনের কেচ্ছা’য় বিবৃত হয়েছে। তিনি পীরের উদ্দেশ্যে লক্ষাধিক টাকা মূল্যের শিরনি দিয়ে পীরের বরে মগানের রাজত্ব লাভ করেন। (“খোসালে করেন দোও আপে সত্যপীরে/ হোছেন সা বাদসাই পাইল যোগান সহরে।।”- আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ‘পুঁথির বিবরণ’, সাহিত্য পরিষৎ-পত্রিকা, ৩য় ও ৪র্থ সংখ্যা, ১৩১০, কলিকাতা।)। সত্যপীরের মতবাদ প্রচারে হুসেন শাহের ভূমিকার ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তাঁর প্রথম জীবন হিন্দু জমিদারের (সুবুদ্ধি রায়) অধীনে কাটে। (কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে এ সম্বন্ধে উল্লেখ আছে। গ্রন্থখানি ১৬১২ (মতান্তরে ১৬১৫) খ্রিস্টাব্দে রচিত।)। তাঁর রাজসভায় অনেক হিন্দু অমাত্য ও কর্মচারী ছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেব তাঁরই আমলে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন। হুসেন শাহ বৈষ্ণবধর্মের বিরোধিতা করেননি, বরং চৈতন্যদেবকে ‘গোসাঞি’ (গোস্বামী) বা ধর্মগুরু রূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। (“গৌড়েশ্বর যবনরাজা প্রভাব শুনিঞা।/ কহিতে লাগিল কিছু বিস্মিত হইয়া।।/ বিনা দানে এত লোক যার পাছে ধায়।/ সেই ত গোসাঞি ইহা জানিহ নিশ্চয়।।/ কাজি যবন কেহো ঞিহার না কর হিংসন।/ আপন ইচ্ছায় বলুন যাহা ইঁহার মন।।” উদ্ধৃত : চৈতন্যচরিতামৃত।)। এ সময় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের কোন মধ্যম পন্থার চিন্তা গণমানসে উদিত হতে পারে। এজন্য ইসলামি ভাবধারায় পীরবাদের ভিত্তিতে কাল্পনিক সত্যপীরের প্রচার অসম্ভব নয়। সত্যপীর-সত্যনারায়ণ নাম সে সমন্বয়কে সূচিত করে। যুগ ও জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ ধারণা অনুমান মাত্র, অন্যথায় হুসেন শাহের সাথে সত্যপীরের মাহাত্ম্য প্রচারের যোগসূত্র কৌতূহলোদ্দীপক লোকমনের সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত হতে পারে। অনেকে বলেন গৌড়ের এই স্বাধীন ও উদার মতাবলম্বী সুলতান হুশেন শাহ বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মিলন কামনায় হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষা ‘সত্য’ এবং মুসলমানদের ফারসী ভাষা ‘পীর’ মিশ্রিত করে ‘সত্যপীর’ পূজা অর্চনার প্রবর্তন করেছিলেন।

সত্যপীর নিয়ে হিন্দু ও মুসলিমের সমন্বয় ও এর কারণ : সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর একই উপাস্য। হিন্দুসমাজে যিনি সত্যনারায়ণ তিনিই মুসলমান সমাজে সত্যপীর। সত্যনারায়ণ পূজা হিন্দুসমাজে প্রাচীনকাল হতে প্রচলিত, পরে অর্থাৎ মধ্যযুগে কোন কোন পল্লীর মুসলমানরা ওই পূজা বা উপাসনা গ্রহণ করেন এবং (অতি-নিষ্ঠাবান মোল্লা-মৌলভির বিরক্তির কারণ হতে পারে এই আশংকায়) সত্যনারায়ণের ‘নারায়ণ’ শব্দের স্থানে পীর শব্দ যুক্ত করে নেন। (এবিষয়ে একটি অভিমত প্রচলিত আছে—গৌড়ের সুলতান হুশেন শাহ তাঁর সময়ে হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের মধ্যে ধর্মীয় একতা সৃষ্টির কামনায় হিন্দুদের সংস্কৃত ভাষার ‘সত্য’ শব্দ মুসলমানদের আরবী শব্দ ‘পীর’ মিশ্রিত করে—সত্যপীর পূজাউপাসনা প্রবর্তন করেছিলেন। বর্তমান প্রবন্ধে এ বিষয়টি পরে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।) পরিবেশ বিশেষে নামের দিক থেকে ও অপর দু’একটি বিষয়ে কিছু পার্থক্য থাকলেও সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর উপাসনা একটি সমন্বিত পূজাচার। এখন প্রশ্ন হতে পারে,—ধর্মাচার সম্বন্ধে রক্ষণশীল দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কি কারণে বা কিসের প্রভাবে এই সমন্বয় ঘটা সম্ভব হয়েছিল। ওই প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি গবেষণালব্ধ অনুমান উপস্থিত করা যায় –

  • ১। ভারতে মুসলমান অধিকারের পর হিন্দুরা স্বধর্ম রক্ষার ব্যাপারে শংকিত হলেও মুসলমান সংস্কৃতির প্রভাব কিছু কিছু হিন্দুসমাজে বিস্তার লাভ করেছিল এবং এইভাবে ধর্মীয় বিষয়ে একটা একতা এসে যায়।
  • ২। নবব্রাহ্মণ্য যুগে বা ওই সময়ের কিছুকাল পরেও অনুন্নত বা নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা স্বধর্মী-উন্নত বা উচ্চকোটি সমাজে অবহেলা অমর্যাদা পেতে থাকে, এমন কি হিন্দু হয়েও হিন্দু-শাস্ত্রীয় দেবতার পূজার্চনার অধিকারচ্যুত হয়, ফলে লৌকিক দেবতা বা লোকায়ত ধর্ম ব্যতীত তাদের উপাস্য বা ধর্মাচার রলে কিছু থাকে না, এ সময় পীর গাজীদের উদার বা শ্রেণী ভেদাভেদহীন ধর্ম প্রচারে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, কিন্তু সকলে স্বধর্ম ত্যাগ না করলেও মুসলমান ধর্মের প্রতি কিছু কিছু আকৃষ্ট হন। ওই সময়ে এদেশে বৌদ্ধধর্ম লুপ্তপ্রায় ও নাস্তিক ধর্ম বলে নিন্দনীয় হলে ভিক্ষুহীন বৌদ্ধরা বা তাঁদের বংশধরগণ, ব্রাহ্মণ শাসিত হিন্দুসমাজে প্রবেশ লাভ করতে পারেনি আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ; তাঁরাও সকলে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ না করলেও পীর গাজীদের উদার ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট হন।
  • ৩। পল্লীবাসী শান্তিপ্রিয় সাধারণ বা নিম্নবিত্ত সমাজে মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের মিলনের আগ্রহ দেখা যায় — তারা উপলব্ধি করেছিলেন একই দেশে বা পল্লীতে বংশ পরম্পরায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে বিরুদ্ধভাব রাখা বা হানাহানি করায় লাভবান হয়-উন্নত সমাজের ব্যক্তিরা বা শাসকশ্রেণি, ক্ষতি হয়—নিম্নস্তরের মুসলমানদের। উভয় সম্প্রদায়ের বিজ্ঞরা বা সমাজপতিগণ বুঝেছিলেন, ধর্মের দিক থেকে পার্থক্য থাকায় সে মিলনে বাধার সৃষ্টি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্ব স্ব ধর্ম ত্যাগ না করেও ধর্ম ব্যাপারে একটি সমন্বিত মতবাদ গ্রহণ করলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরুদ্ধভাব লোপ পেতে পারে।
  • ৪। এদেশে মুসলমানদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজ থেকে ধর্মান্তরিত। মুসলমান শাসক বা শাসন কার্যে সহায়ক কিছু ধর্মপ্রচারকদের প্ররোচনায় হিন্দুদের প্রতি বিরুদ্ধভাবাপন্ন হলেও ধর্মান্তরিতরা বংশগত সংস্কার বশতঃ হিন্দুধর্ম বিরোধী ছিল না। হিন্দুধর্মের মুসলমানরা অনেকে হিন্দুনারী গৃহিণী করেন। ওই সকল হিন্দুকন্যার মাধ্যমে মুসলমান অন্তঃপুরে হিন্দু সংস্কার কিছু প্রভাব বিস্তার করে। হিন্দুদের সমারোহে পূজাপার্বণ, দেব-দেবীর সুন্দর সুন্দর আকৃতি ও তাঁদের বিষয়ে প্রচারিত গুণাবলী, মুসলমানদের মনে একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
  • ৫। ধর্মীয় সমন্বয় ব্যাপারে একটি বৈজ্ঞানিক কারণও দেখানো যেতে পারে। ‘সমাজতত্ত্ব’ হতে জানা যায়-যখন দুটি ভিন্ন বা স্বতন্ত্র মানব সম্প্রদায় (বা ধর্মাবলম্বী প্রথম সংস্পর্শে আসে সে সময় উভয়ের মধ্যে বিরুদ্ধভাব দেখা দেয়, কিন্তু দীর্ঘকাল একত্র ও সমপর্যায় থাকার ফলে তাদেরই মধ্যে আবার আচরণ চিন্তা ভাবনা ও অপরাপর সাংস্কৃতিক দিক থেকে (Domistication of ideas and habits) একটা সমন্বয় (Cynchronism of diffusion) আপনা হতে গড়ে ওঠে। ধারণা করা যায় বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর (মুসলমানদের হিন্দু লৌকিকদেবতা পূজা এবং পীরগাজী বিবিদের প্রতি হিন্দুদের ভক্তি শ্রদ্ধা) পূজা-উপাসনা মধ্যে সমন্বয়ের সৃষ্টি হয়েছে এবং বাংলায় তার ফলে সাহেব ধর্মী, কর্তাজা প্রভৃতি ধর্মমতও প্রবর্তিত হয়।
  • ৬। বিভেদকারী বা শাসকদের সঙ্গে সম্পর্কিত মুসলমান ধর্ম প্রচারকদের জন্য প্রথমে এদেশীয় মুসলমানরা হিন্দুদের সঙ্গে কোন ধর্মীয় ব্যাপারে সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারেনি, পরে বা মধ্যযুগে কয়েকটি উদার-ধর্মবাদের বা মিলন প্রয়াসীদের প্রভাবে ও প্রচারে সে বিষয়টি বহুলাংশে সম্ভব হয়েছিল। ভারতবর্ষে দুই ধর্মের মধ্যে বেশ কিছু সমন্বয়বাদী প্রয়াস ঘটেছে, যেমন –
    • ১। মধ্যযুগে বঙ্গে সুফীবাদ ও দরবেশদের প্রচার।
    • ২। কাশ্মীরের মহিলা সাধিকা লাল বাক্যানীর উদার-ধর্মপ্রচার।
    • ৩। শ্রীচৈতন্যদেবের জাতি বর্ণ ও ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি সমভাব।
    • ৪। গৌড়ের সুলতান হুশেন শাহের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মিলন প্রচেষ্টা। (কিংবদন্তী আছে হুশেন শাহ হিন্দুর ‘সত্য’ এবং মুসলমানের ‘পীর’ শব্দ মিশ্রিত করে একটি সমন্বিত ধর্ম প্রবর্তন করেন আচার্য “দীনেন্দ্রচন্দ্র সেন রচিত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে এ-কথা আছে)
    • ৫। বাদশাহ আকবরের উদার ‘দীন-ই-ইলাহী’ ধর্মবাদ।
    • ৬। আগ্রার স্বামিজী মহারাজ ও হুজুর মহারাজ প্রচারিত রাধাস্বামী এবং সম্ভবাদ।
    • ৭। প্রসঙ্গত এই সমন্বয়ের ব্যাপারে আরও একটি বিশেষ কথা বলা যায় রামানন্দ, কবীর, গণক প্রভৃতি সমাজহিতৈষী ধর্মসংস্কারকদের উদার ও মিলনধর্মী প্রচার উভয় ধর্মাবলম্বীদের অন্তরে এককালে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা একেবারে লুপ্ত হয়নি পরবর্তীকালেও।

সত্যপীরের পাট : গাজীপীর, বদরপীর যেভাবে অধিপতি দেবতারূপে পরিগণিত, সত্যপীরকে সেরূপে কোন নির্দিষ্ট শক্তি বা ভাবের প্রতিভূ মনে করা হয় না। তিনি সাধারণভাবে মনস্কামনা পূর্ণকারী দেবশক্তি রূপেই পূজা পেয়ে থাকেন। হিন্দুসমাজে সত্যনারায়ণের কোন মূর্তিপূজা নেই, তবে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘সত্যপীরের পাট’ নামে প্রতীক পূজা প্রচলিত আছে। বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কাঠের তক্তার তৈরি পাটকে পীরের আসন মনে করা হয়। লোকে ফুলের অর্ঘ্য দিয়ে পাট পূজা করে। (Social and Cultural History of Bengal, Vol. 11. p. 389.) নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে ‘ধর্মঠাকুরের পাটপূজা’র প্রচলন আছে। (আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকশ্রুতি, পুরোগামী প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৫১)। এটি তারই প্রভাবজাত।

সত্যপীরের শিরনি : শুভফল কামনায় মানসিক করে সত্যপীরের শিরনি দেয়া হয়। রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘সত্যপীর’ কাব্যে নিঃসন্তান বণিক সদানন্দ সত্যপীরের শিরনি মেনে চন্দ্ৰকলা নাম্নী এক কন্যা লাভ করেছিল। চন্দ্রকলা পীরের শিরনি দিয়ে তাঁর কৃপা লাভ করে বিদেশে স্বামী ও শ্বশুরকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করে এবং তাদের স্বগৃহে ফিরে পায়। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮৯৫-৯৬)। ভারতচন্দ্রের সত্যপীর বিষয়ক কাব্যে বিষ্ণুশর্মা সত্যপীরের শিরনি দিয়ে ধনসম্পদ লাভ করে। (ঐ, পৃ. ৯৬০)। সত্যপীরের শিরনির রীতিপদ্ধতি সম্বন্ধে বিবরণ পাওয়া যায় বটতলার প্রকাশিত সত্যপীরের পুঁথিতে। সদাগর পুত্র মদন ও কামদেব বাণিজ্য শেষে ফিরে এসে নিম্নরূপে সত্যপীরের শিরনি করে : “ডাকিয়া কুটুম্বগণ আপনার ঘরে।/ ছামানা করিয়া সত্যপীরের শিরনী করে।।/ সোয়া মন আনে আটা সোয়া মন চিনি।/ সোয়া মন আনে দধি আর যে বিরণী।।/ পাকা কলা আটা আদি তাহাতে ডালিয়া।/ ভরিল বাসন সব হালুয়া করিয়া।।/ এক হাজার পান আর যে সুপারি।/ আগর চন্দন চোত্তা গোলা কস্তুরি।।/ সকল ফুলের হার আস্তানাতে দিয়া।/ চৌকির উপরে সবে সাজাইল লিয়া।।/ ঘর পুর নারিকেল রাখে তার পরে।/ চার তীর চারিধারে গাড়িল যে জোরে।।/মোল্লাজি আসিয়া ফাতেহা করিল তামাম।”

সত্যনারায়ণ পূজা : দেবদেবীর মূর্তি-পূজক হিন্দুসমাজেও সত্যনারায়ণের বিশিষ্ট কোন মূর্তি দেখা যায় না। উন্নত বা বর্ণহিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সত্যনারায়ণ ও বিষ্ণু অভিন্ন বলে প্রচার করে থাকেন এবং সত্যনারায়ণের প্রতীক রূপে (বিষ্ণুর প্রতীক) শালগ্রাম শিলা পূজিত হয়। কিন্তু অনুন্নত কিংবা পল্লীর হিন্দুসমাজে যে সকল স্থানে সত্যনারায়ণ পূজায় পৌরোহিত্য করেন ব্রাহ্মণেতর কোন জাতি, যে সকল ক্ষেত্রে শালগ্রাম শিলা থাকে না, তবে যে প্রতীক থাকে তার বিবরণ দেওয়া হল কয়েকটি লোহার সরু শিক চার-পাঁচ ফুট লম্বা, সেগুলি একত্র করে ঠিক মাঝ বরাবর দু পাঠ করা হয়, পরে শিকগুলির শেষ অংশ তার দিয়ে বেঁধে সমগ্র অংশ লাল রংয়ের কাপড়ে আচ্ছাদিত করা হয়, ফলে প্রতীকটি দেখতে হয় গদার মত। পল্লীর সত্যনারায়ণের একান্ত পুরোহিতের কাছে এরূপ প্রতীক থাকে, গৃহস্থের বাড়ি সত্যনারায়ণ পূজার সময় পুরোহিতরা ওইরূপ প্রতীকটিকে সেখানে নিয়ে যান। সত্যনারায়ণের ডোম-পণ্ডিত বা পুরোহিতরা, একটি মাটির ছোট ভাঁড় বা পিতলের কলসীর উপর সিঁদুর মাখিয়ে সত্যনারায়ণের প্রতীক করে নেন, ওইরূপ প্রতীকটি একটি থালা বা বারকোষের উপর স্থাপন করে পল্লীর সকল শ্রেণির গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি ভ্রমণ ও সত্যনারায়ণের গান করে থাকেন, পল্লীর বধূরা সত্যনারায়ণের পূজার উদ্দেশ্যে ডোম পুরোহিতের হাতে ভাল ফলমূল পাঁচটি বা সংপায় আশা করে পয়সা দিয়ে থাকেন। কোন কোন ডোম পুরোহিতের সত্যনারায়ণ পূজার স্থায়ী থান (বা খড়ে ছাওয়া মাটির মন্দির) থাকে, তার কেন্দ্রস্থলে প্রতীক ঘট স্থাপিত হয়—পল্লীর সকল শ্রেণীর হিন্দু-মুসলমান সেরূপ থানে পূজা দিয়ে থাকেন। গৃহস্থের গরুর বাচ্চা হবার পর দুধ বা বাগানের কলা পাকাবার পর একছড়া কলা সত্যনারায়ণের থানে দিয়া আসেন। পল্লী অঞ্চলে এরূপ লোকায়ত বিধান বর্তমানেও কিছু কিছু প্রচলিত আছে। নিষ্ঠাবান উচ্চ বর্ণের হিন্দু সমাজে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পুরোহিত দ্বারা সত্যনারায়ণের (বিষ্ণুর) শালগ্রাম প্রতীকে এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধ্যান মন্ত্রে পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, পুরোহিতরা প্রচার করেন বিষ্ণু ও সত্যনারায়ণ অভিন্ন, কিন্তু পূজার নৈবেদ্যের মধ্যে শিরনি ও পাঁচটি মোকাম এবং প্রতীকের আসনের উপর একটি ক্ষুদ্রাকৃতি লৌহ অস্ত্র রাখা আবশ্যিক রীতি বা বিধান দেখা যায়। হিন্দুদের কোনও শাস্ত্রীয় বা লৌকিক দেবতার পূজায় শিরনি বা কাম নৈবেদ্য রূপে থাকে না বা দেবতার মূর্তি-প্রতীকের আসনের উপর কোন অস্ত্রও রাখার রীতি নেই। উপাস্যের উদ্দেশ্যে শিরনি বা মোকাম উৎসর্গ করা সম্পূর্ণ মুসলমানি প্রথা। ‘শিরনি’ ও ‘মোকাম’ দুটিই ফারসী শব্দ। সত্যনারায়ণ পূজায় হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধানে ধ্যান-মন্ত্র-আবৃত্তি ও আরতি অন্তে পূজার অঙ্গ হিসাবে পুরোহিতগণ, সত্যনারায়ণ দেবতার যে মাহাত্ম্য প্রচারক কাব্য (পুঁথি) বা ‘ব্রত কথা’ পাঠ করে থাকেন, তার মধ্যে মুসলমান ফকীরের বা পীরের উল্লেখ শুধু নয়- সত্যনারায়ণ যে পীরের রূপ ধরেছিলেন এবং সত্যপীর ও সত্যনারায়ণ অভিন্ন এরূপ প্রকার থাকে। হিন্দুরা বহু দেবতার মূর্তি গড়ে বা প্রতীকে পূজা করতে পারে শাস্ত্রীয় বাধা নেই, কিন্তু মুসলমানদের শরিয়তে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারুর উপাসনা করা নিষিদ্ধ, কোরানে পীরবাদও নেই, মুসলমানদের উপাস্যের মূর্তি বা প্রতীক পূজা গর্হিত কর্ম। অথচ দেখা যায়, বাংলার বহু স্থানে কোন কোন মুসলমান সত্যপীরের (বা অপর পীরগাজী বিবির) প্রতীক—মাটির তৈরি ছোট স্তূপ বা ঢিপি সম্মুখে রেখে উপাসনা করে থাকেন। নিষ্ঠাবান বা শাস্ত্রশাসিত মুসলমান সমাজে উপাস্যের মূর্তি এমনকি প্রতীক পূজা নিষিদ্ধ হলেও পল্লীর লোকায়ত বিধান অনুসরণকারী কোন মুসলমান সমাজে বা সত্যপীরের দরগায় প্রতীক দেখা যায় একটি পিঁড়ির উপর বৃত্ত এঁকে তার মধ্যস্থলে মাটির একটি ক্ষুদ্র স্তূপ রাখা হয় উহার উপর একটি ক্ষুদ্র লৌহ অস্ত্র বা ছোরা ও ফুলের মালা দেওয়া হয়। সত্যপীরের দরগায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের (ও বর্ণের) ব্যক্তি পূজা হাজোত দিয়ে থাকেন।

বাংলায় সাধারণ মানুষের সত্যপীরের পূজা : বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের পল্লীতে বা উন্নত স্থানে সত্যপীরের একান্ত উপাসক এক শ্রেণীর মুসলমান ফকির দেখা যায় তাঁরা ধর্মমতের দিক থেকে উদার, এবং হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে দরগায় সত্যপীরের আরাধনা করে থাকেন, পল্লীর সকল ধর্মের ও বর্ণের ভক্ত বা বিশ্বাসী রোগীদের রোগের নিরাময় কামনায় সত্যপীরের প্রসাদী ‘তেলপড়া’, ‘জলপড়া’, টোটকা বা হাকিমি ঔষধ, কবচ মাদুলী প্রভৃতি বিতরণ করেন। পল্লীতে কোন রোগ মহামারীরূপে প্রাদুর্ভূত হলেও সত্যপীরের উপর বিশ্বাসী হিন্দু-মুসলমান পীরের দরগায় পূজা হাজোত দেন, দরগার ফকীরের দেওয়া পীরের প্রসাদী-বাতাসা এলাচদানা, পল্লীর ব্রাহ্মণরাও গ্রহণ করেন। অন্য কোন পূজাচারে বা প্রসাদ গ্রহণে এরূপ একতা বা উদারতা পল্লীর (বিশেষ করে উষ্ণকোষ্টির) লোকদের মধ্যে দেখা যায় না। হিন্দু গৃহে অনুষ্ঠিত সত্যনারায়ণ পূজার নৈবেদ্য-শিরনি, খানদানী মুসলমানরা অনেকে গ্রহণ করেন।

বাংলা সাহিত্যে সত্যপীর বা সত্যনারায়ণের উল্লেখ : 

  • প্রায় দু’শ বৎসর পূর্বে রচিত শঙ্কর আচার্যের ‘সত্যনারায়ণের পুঁথি’ হতে কয়েক ছত্র উদ্ধৃত করা যাক – “একদা বৈকুণ্ঠ ধামে চিত্তে নারায়ণ।/ মর্ত্যেতে কলহ সকল ধর্মের কারণ।।/ সকল আপদের সেরা ধর্মের কলহ।/ পৃথিবী ভাসিয়ে যায় রক্ত অহরহ।/ মিলাতে সকল ধর্ম কামনা আমার।/ সত্যপীর রূপে আমি হব অবতার।/ ফকিরের বেশে আমি ধরায় যাইব।/ নরধর্ম রীতি শিক্ষা প্রচার করিব।/ কেহ বা ডাকিবে মোরে সত্যপীর বলি।/ পীর আর নারায়ণ একই সকলি।।”
  • অষ্টাদশ শতকের ‘শিবায়ন’ রচয়িতা-কর্ণগড় রাজসভার বিখ্যাত পণ্ডিত-রামেশ্বর ভট্টাচার্য যদিও তিনি স্কন্দপুরাণ অনুসরণ করেছিলেন ও তাঁর কাব্যটির নাম ‘সত্যনারায়ণের কথা’, তিনি বলেছেন, “সত্য সত্য সত্যপীর সর্ব সিদ্ধিদাতা।/ বাঞ্ছা বড় বাড়িল বর্ণিব এব কথা।”, “জয় জয় সত্যপীর, সনাতন দস্তগীর।/ দেব দেব জগতের নাথ॥” “কে জানে তোমার তত্ত্ব, তুমি রজঃ তমঃ সত্ব/ তোমার চরণে প্রণিপাত ৷”
  • রাজকবি-রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, নিষ্ঠাবান শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণ, তাঁর কাব্যের নাম দিয়েছিলেন ‘সত্যপীরের কথা’ (বা ব্রতকথা) তিনি লিখেছেন “ফকির শরীর ধরি, হরি হৈলা অবতরি, এক বৃক্ষতলে কৈল স্থান।”
  • কবি কৃষ্ণহরি দাস, মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত সত্যবীরের পাঁচালীকার, তিনি তাঁর কাব্যে সত্যনারায়ণের বিষয় একটি অভিনব কথা বলেছেন, তিনি লিখেছেন, —সত্যনারায়ণ মানুষ ছিলেন-মালঞ্চা নামক স্থানের রাজকন্যার গর্ভে জন্মেছিলেন। সত্যনারায়ণ বাল্যকালে এক স্থান থেকে একটি পুঁথি কুড়িয়ে পেয়ে রাজগুরুকে দেখান। রাজগুরু সত্যনারায়ণকে ওই পুঁথিটির প্রাপ্তিস্থানে রেখে আসবার নির্দেশ দেন ও বলেন, —ওই পুঁথিটি মুসলমানদের ধর্ম কাব্য। হিন্দু উহা পাঠ করলে তার জাতি নষ্ট হয়। গুরুর কথা সত্যনারায়ণ বিশ্বাস করলেন না – “হাসিয়া কহিছে সত্যনারায়ণ।/ নাম নিলে জাতি নষ্ট করে কোন জন।/ এক ব্রহ্ম ভিন্ন আর দুই ব্রহ্ম নাই।/ সেই নিরঞ্জন নাম বিশমোল্লা হয়।/ বিষ্ণু আর বিশমোল্লা কভু ভিন্ন নয়।/ সংসারের কথা (ধাতা) এক নিরঞ্জন গোঁসাই।।”
  • সত্যপীরের মহিমাকাব্য রচয়িতা মুসলমান কবিদের মধ্যে বিখ্যাত ফয়েজুল্লাহ, ওয়াজিদ আলি তাঁর সত্যপীরের পাঁচালীতে বহুস্থানে ‘সত্যপীরের’ পরিবর্তে বা উদ্দেশ্যে ‘সত্যনারায়ণ’ উল্লেখ করেছেন। উক্ত কাব্যের স্থান বিশেষ উদ্ধৃত করা হল : (বনে ব্যাধেরা শিকার না পেয়ে হতাশ হয়ে, নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে) – “সাত রোজ আমরা শিকার না পাই।/ বুঝিনু নছিব বুরা চল ঘরে যাই।/ হেন কালে দেখা দিলেন সত্যনারায়ণ।/ ফকিরে দেখিয়ে তারা ফিরিল তখন।” এ কাব্যের নায়ককে শত্রুরা বনের মধ্যে পুঁতে রাখে, কিন্তু সত্যপীরকে স্মরণ করিতে সে মুক্ত হয়, পরে নায়ক ওই মুক্তির কথা বলছে : “বনেতে গাড়িয়া আইল আমার কারণ।/ বাঁচাইয়া দিল মোরে সত্যনারায়ণ।”

তথ্যসূত্র

  • বাংলার লোক-সংস্কৃতি, ওয়াকিল আহমদ, গতিধারা, ঢাকা
  • বাংলার লৌকিক দেবতা, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
  • অন্যান্য তথ্যসূত্রগুলো লেখার মধ্যেই রয়েছে

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.