বুদ্ধিজীবী শ্রেণি – আনতোনিও গ্রামসি

অনুবাদকের ভূমিকা – সৌরীন ভট্টাচার্য ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলায় ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। প্রয়াত সুশোভন সরকার যখন ‘বুদ্ধিবাদী’ শব্দটি প্রস্তাব করেন কিংবা অম্লান দত্ত যখন ‘চিন্তক’ ব্যবহার করেন, তাঁরা বুদ্ধিজীবীর যে সংজ্ঞা নির্দেশ করেন, তা হল প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের আওতা থেকে মুক্ত তথা স্বাধীন কোনো চিন্তাশীল মানুষ যিনি প্রয়োজনে গরিষ্ঠ জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও তাঁর বিশ্বাস মতো সত্যভাষণের সাহস ও স্পর্ধা রাখেন। বুদ্ধিজীবীর এই বিশেষ সংজ্ঞাটি মুখ্যত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর ঠাণ্ডা লড়াই, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবিরাম প্রবাহ, পারমাণবিক যুদ্ধের আতঙ্ক ইত্যাদির মধ্যে গড়ে উঠে ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুব বিদ্রোহের বিস্ফোরণের মধ্যেও অর্থবহ ছিল। এই কালসীমার মধ্যেই জোলিও কুরি, বার্ট্রান্ড রাসেল, জাঁ-পল সার্ত্র, নোয়াম চমস্কি প্রমুখ ওই বুদ্ধিজীবী ভূমিকার প্রতিভূ তথা উপমান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের এক-একটি বিবৃতি, এক-একটি ক্রিয়া, এক-একটি প্রতীকী আচরণ পর্যন্ত (যেমন ১৯৭০ সালে পারি শহরে মাওপন্থী পত্রিকা ‘লা কোজ দ্যু প্যপল্’ রাস্তায় ফেরি করতে গিয়ে সার্ত্র-এর গ্রেপ্তারবরণ) প্রতিবাদী মাত্রা পরিগ্রহ করে জনসাধারণের বিবেককে তাড়িত করে। সত্তর থেকে নব্বই-এর দশকের মধ্যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীর ওই ভূমিকা বা চারিত্র্যই দ্বিধাসংশয়ে বিদীর্ণ হয়। ওইসব প্রতিবাদী ভঙ্গিমাই অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়, নয়তো প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদেরই অচিরেই দেখা যায় কর্তৃত্বের নরম আয়েসি গদিতে— যেমন দেখা গেল চেক নাট্যকার ভাৎস্লাভ হাভেলকে।

ইতিহাসের উর্ধ্বে কিংবা তার টানাপোড়েনের বাইরে বুদ্ধিজীবীর স্থান নির্দেশ করতে গিয়ে যে অনৈতিহাসিকতা দোষ ঘটেছিল, যার ফলে বুদ্ধিজীবীরাই যেন এক ধরনের অবান্তরতায় বাতিল হয়ে যাচ্ছিলেন, আর যার সুযোগে স্বৈরাচারি কর্তৃত্বই আরো শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছিল, তার নিষ্কৃতির সম্ভাবনা নিহিত আছে আনতোনিও গ্রামসির এই প্রবন্ধটিতে। এটিকে হয়তো প্রবন্ধ বলা ঠিক হবে না। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৫ একটানা কারাবাসের মধ্যে সূত্রাকারে তিনি তাঁর চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। তারই একটি অংশ এই লেখাটি। সোভিয়েত ইউনিয়নে লেনিন জমানা থেকে স্তালিন জমানার বিবর্তন, মার্কসবাদী আন্দোলনের মধ্যেই ত্রত্‌স্কি, বুখারিন ও রোজা লুকসেমবুর্গ-এর অন্যমতের প্রভাব ও পরিণতি এবং ফ্যাসিবাদের উন্বেষ, এই সবেরই সাক্ষি গ্রামসি কারান্তরালের দূরত্বে সুযোগ পেয়েছিলেন মার্কসবাদের প্রাথমিক কয়েকটি প্রশ্নের পুনর্বিবেচনার, পুনর্বিচারের। যেমন ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর সম্পর্কের প্রশ্নটি, এবং তার সঙ্গে মিলিয়ে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা ও শিক্ষার লক্ষ্যের প্রশ্ন।

গ্রামসি-র চিন্তায় ‘হেজিমনি’ (আমরা যার বাংলা করেছি ‘আধিপত্য’) এবং ‘ডমিনান্স’ (আমরা যার বাংলা করেছি ‘প্রাধান্য’) শব্দ দুটি বিশেষ অর্থ পরিগ্রহ করেছে। যেকোনো শ্রেণি (কারাগারের বিধিনিষেধ তথা সেন্সরের কাটাকুটি এড়াতে গ্রামসি অবশ্য ‘শ্রেণি’ কথাটি না ব্যবহার করে ‘সামাজিক গোষ্ঠী’ বা ‘মৌল সামাজিক গোষ্ঠী’ জাতীয় শব্দবদ্ধ ব্যবহার করেন, খুঁটিয়ে পড়লে অবশ্য তার যথার্থ তাৎপর্য ধরতে এতটুকু অসুবিধা হয় না) ক্ষমতা লাভ করতে কোনো-না-কোনো ভাবে জোর খাটায়, জোর খাটিয়ে সেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে। এর অবশ্যম্ভাবিতা মানতে গ্রামসির কোনো বাধা নেই। এই যে ক্ষমতা যা জোর বা শক্তিরই দান, তাকেই গ্রামসি বলেন ‘প্রাধান্য’। কিন্তু এই প্রাধান্যকে যদি যথার্থই প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তবে তার পত্তনের আগেই এবং পত্তনের অব্যবহিত পরেও চালিয়ে যেতে হবে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, অর্থাৎ সমগ্র জনসমাজের মধ্যে ওই শ্রেণির ভাবাদর্শ তথা মূল্যবোধ তথা সামগ্রিক চিন্তাপদ্ধতি সর্বস্তরে প্রোথিত করে দিতে হবে। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের অভিযানে, নির্বিত্ত শ্রেণির আন্দোলনে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নয়, শুধু রাষ্ট্রীয় বা সরকারি যন্ত্রের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নয়, জনসমাজের সমগ্র বিস্তার ব্যেপে শিক্ষা, সংস্কৃতি, নীতিবোধ, বুদ্ধিচর্চা, সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসেই বিপ্লবের পরিপূর্ণ বিকাশের সম্ভাবনা। প্রাধান্য ও আধিপত্য, এক অন্যের অপরিহার্য পরিপূরক। বস্তুত, যে শ্রেণির প্রাধান্যকে উৎখাত করে নতুন শ্রেণি ক্ষমতায় আসে, তার আধিপত্য আপনা-আপনি ভেঙে পড়ে না, বরং তাকে সংযত না করতে পারলে তা অলক্ষ্যে নতুন শ্রেণির প্রাধান্যকেই জীর্ণ করতে পারে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই গুরুত্ব অনুধাবন করলে তারই পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীর নতুন সংজ্ঞা তথা ভূমিকা চিহ্নিত হয়। গ্রামসি দুই বর্গের বুদ্ধিজীবীর কথা বলেছেন। একটি বর্গকে তিনি বলেন ‘জৈব’। অর্থাৎ একটি শ্রেণি তার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই তার নিজস্ব পরিচয়, ভূমিকা, আন্তর সমজাতীয়তা ইত্যাদি গুছিয়ে নির্দেশ করে দেবার দায়িত্ব নিজে থেকেই যাদের প্রতিষ্ঠিত করে, সেই বুদ্ধিজীবীকুল ওই শ্রেণির উন্মেষের ইতিহাসের এক স্বাভাবিক অঙ্গ এবং ওই শ্রেণির সত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্য বৰ্গ ‘প্রথাগত’। এই বুদ্ধিজীবীরা আপাতদৃষ্টিতে কোনো বিশেষ শ্রেণির বিকাশ অবলম্বন করে আবির্ভূত হয়নি, বরং যেন প্রাচীনতর কোনো পরম্পরার প্রতিভূ। গ্রামসি পুরোহিত শ্রেণির ইতিহাস পর্যালোচনা করে ধরিয়ে দেন যে এই ‘প্রথাগত’ বুদ্ধিজীবীরাও কোনো শুদ্ধ, স্বতন্ত্র স্বাধীন শ্রেণি নয়, তাদের শ্রেণি পরিচয় তথা শ্রেণিগত আনুগত্য প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে মাত্র।

বুদ্ধিজীবী শ্রেণির বর্গবিভাজন এবং বিভিন্ন বর্গের ইতিহাস তথা চরিত্রলক্ষণ বিশ্লেষণে গ্রামসি যথেষ্ট আগ্রহ দেখালেও তাঁর আসল লক্ষ্য শ্রমিকশ্রেণির বৈপ্লবিক ভূমিকার দিকনির্দেশ। তাই তিনি প্রকারান্তরে বলেন, শ্রমিকশ্রেণি যে সমাজরূপান্তরে অঙ্গিকারাবদ্ধ তা যথার্থ ও সার্বিকভাবে সিদ্ধ করতে গেলে তাঁদের নিজেদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করতে হবে এক নতুন জৈব’ বুদ্ধিজীবী বর্গ যাঁরা শ্রমিকদের দৈনন্দিন কর্মভিজ্ঞতার মধ্যেই কর্মপ্রক্রিয়ার পরিচালনায় প্রথমে নেতৃত্ব নেবেন, তারপর ক্রমে ইতিহাসের মানবিকী বোধ থেকে শ্রমিকদের জীবনে ‘অগ্রগণ্য’ তথা রাজনীতিগতভাবে নির্দেশক-নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে থাকবেন। শ্রমিকশ্রেণি তার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার নিজস্ব ‘জৈব’ বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যে ক্রমে ‘প্রথাগত’ বুদ্ধিজীবীদের তার সপক্ষে আহ্বান করে আনবে। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্য দিয়েই শ্রমিকশ্রেণির মতাদর্শ জনসমাজের মধ্যে ছড়াবে, তা ‘সম্মতি’ আয়ত্ত করবে, এবং সেই ‘সম্মতি’র সমর্থনেই সমাজের রূপান্তর ঘটানো যাবে। ইতালীয় ইতিহাসের যে বিভিন্ন পর্ব থেকে গ্রামসি তাঁর তথ্য সাক্ষ্য আহরণ করেছেন তার এক প্রান্তে রয়েছে ইতালীয় ক্ল্যাসিকাল যুগ যার বিস্তার খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দি থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দি, অন্য প্রান্তে গ্রামসির সমকাল, যখন সাহিত্যের শুদ্ধ নান্দনিক ধর্মের প্রবক্তা দার্শনিক বেনেদেত্তো ক্রোচে (১৮৬৬-১৯৫২) যানবাহনশিল্পের প্রবাদপ্রতিম ব্যবসায়ী ফিয়্যাট-মালিক আইনিয়েল্লি পরিবার বা রাসায়নিক শিল্পের বড়ো ব্যবসায়ী মন্তেকাতিনি-মালিক বেন্নি-র সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গোপন করেন না। জাভান্নি আইনিয়েল্লি, বেন্নি ও ক্রোচে নিজে, তিনজনই বিশের দশকে ইতালির সেনেটের অর্থাৎ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। তুরিন-এর ফিয়্যাট কারখানায় শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি আদায় করবার আন্দোলনে কারখানা দখল করলে আইনিয়েল্লি প্রগতিশীলতার ভান করে শ্রমিকদের কিনে নেবার চেষ্টা করেন। তাঁর সেই প্রয়াসের মুখে শ্রমিক প্রতিরোধের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রামসি, ১৯২০ সালে। ক্রোচে তখন ফ্যাসিস্ত মুসোলিনির প্রথম মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রী। একদা ক্রোচের দার্শনিক চিন্তায় প্রভাবিত গ্রামসি এখন আর ক্রোচের ‘বুদ্ধিজীবীসুলভ’ উদারতা তথা নিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন না। যেমন বিশ্বাস করেন না দার্শনিক ও শিক্ষাতাত্ত্বিক জেনতিল (১৮৭৫ ১৯৪৪)-এর আদর্শবাদে। বহুদিন ক্রোচেরই সহযোগী ও অনুগামী জেনভিল পরে ফ্যাসিবিরোধীদের হাতে নিহত হন। শুদ্ধ মননের যে আদর্শ ক্রোচে ও জেনতিল তুলে ধরেছিলেন, তার মধ্যে গ্রামসি যে বিপদ দেখেছেন, সেই বিপদই দেখেছেন আদি মার্কিন ম্যানেজমেন্ট-তাত্ত্বিক ফ্রেডেরিক টেলর (১৮৫৬-১৯১৫)-এর মধ্যেও। জেনতিল ও ক্রোচে মানুষকে এক তুরীয় বৌদ্ধিক স্তরে উন্নীত করতে যেমনই আগ্রহী, টেলরও তেমনই কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করতে শ্রমিক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা’য় রূপান্তরিত করতে আগ্রহী।

শিল্পোন্নত সমাজে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে যে বুদ্ধিজীবীবর্গ তাঁদের স্থান নেবেন, তাঁরা একাধারে ‘প্রযুক্তিশিক্ষা’, ইতিহাস ও শ্রমিকশ্রেণির পরিবর্তনমুখি দর্শনে সমান পারঙ্গম হবেন। সেই বুদ্ধিজীবীবর্গকে তৈরি করা ও লালন করার কাজেই গ্রামসি তাঁর ‘অরদিনে নুওভো’ পত্রিকাকে লাগিয়েছিলেন। শিল্পনগরী তুরিন-এ বাসকালে ১৯১৯-২০ সালে “সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাপ্তাহিক সমীক্ষা’রূপে বর্ণিত এই পত্রিকাটি গ্রামসি সম্পাদনা করেছিলেন। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সম্প্রসারণ ও বিকাশে শিক্ষাব্যবস্থা তথা নানা ধরনের ও নানা স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকার উপরও গ্রামসি জোর দিয়েছেন।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যতই জটিল হয়েছে, ততই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির নানা বর্গেরও বিকাশ ঘটেছে। ফলে এমন অনেক বর্গ দেখা যায় যাদের সঙ্গে উৎপাদনপ্রক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনেই হয় না। আকিলি লোরিয়া (১৮৫৭-১৯৪৩) এদেরই অনুৎপাদনক্ষম শ্রমিক বলে বর্ণনা করেছেন। গ্রামসি এদের ‘অনুৎপাদনক্ষম’ বলে মনে করেন না, উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রমিকদের ‘সম্মতি’ বা ‘আস্থা’ গড়ে তোলার কাজে এদেরও ভূমিকা আছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে গ্রামসি দেখেন এক একটি সামাজিক গোষ্ঠী তথা শ্রেণির সংগঠন হিসেবে। এই সংগঠনের কাজই হল ওই শ্রেণির ‘জৈব’ বুদ্ধিজীবীদের গড়ে তোলা, লালন করা, এবং প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাদের মেলবন্ধন ঘটানো। প্রধান শ্রেণির আধিপত্য বিস্তারে রাজনৈতিক দল তন্নিষ্ঠভাবে কাজ করে যায়।

ইতালিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীবর্গের বিকাশ ও এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সঙ্গে প্রধান শ্রেণি তথা শাসক সম্পর্কের চরিত্র বিশ্লেষণ করে গ্রামসি দেখান, যেখানেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি শাসকশ্রেণি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে (যেমন ইতালিতে, রোমক সাম্রাজ্যের পতন থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত), সেখানেই রাষ্ট্রব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ফ্রান্স-এ ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে শ্রেণি রাষ্ট্রে ‘প্রাধান্যে’ আসে তাদের সঙ্গে সঙ্গেই তারা ‘জৈব’ বুদ্ধিজীবীবর্গের উন্মেষ ঘটায় জনসমাজের প্রত্যেক ক্ষেত্রে। এমনকি খ্রিস্টীয় ধর্মসংঘ তথা ধর্মসংগঠনের মধ্যেও গ্যালিকান ধারা (অর্থাৎ ফরাসি ক্যাথলিক ধর্মসংঘ রোমক ধর্মসংঘের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রক্ষার যে ধারা চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দি থেকেই প্রচলিত ছিল) এই সময়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জর্মনির ইয়ুংকার শ্রেণির ভূমিকা লক্ষ করেছেন গ্রামসি। ইয়ুংকাররা ভূম্যধিকারী কিন্তু নিজেরা নিজেদের জমির সরাসরি খবরদারি করতে অভ্যস্ত, তারা জমি চাষ করায় ভূমিহীন কৃষিজীবীদের দিয়ে। তাদের জমিদারিকে এজেপি টেলর বর্ণনা করেন ‘পুঁজিবাদী সংস্থা’ বলে, ইয়ুংকারদের তিনি বলেন, ‘কৃষিক্ষেত্রে পুঁজিপতি। ইয়ুংকারদের স্বনির্ভরতা তাদের কখনোই প্রধান শ্রেণির বশ্যতায় নামায়নি। তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ জর্মন শিল্পপতিদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। বিশের দশকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিগ্রো বুদ্ধিজীবী বর্গের সম্প্রসারণ ও বিকাশ লক্ষ করে গ্রামসি যে কটি সম্ভাবনা দেখেছেন, তার সবকটিই আমরা পরবর্তীকালে বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। আমরা একদিকে দেখেছি সেই সুবিধাভোগী ভাগ্যবান নিগ্রো বুদ্ধিজীবীদের যাদের লালন করা হয়েছে আকর্ষক দৃশ্যবস্তু রূপে বর্ণবৈষম্যের নগ্ন সত্যকে গোপন করার প্রয়াসে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই বর্ণবৈষম্যের শিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নিগ্রো সম্প্রদায়ের সামনে প্রলুদ্ধকর টোপ হিসেবে। অন্যদিকে আমরা দেখেছি উইলিয়াম ই বি ডুবয়স্ (১৮৬৮-১৯৬৩) প্রমুখের নেতৃত্বে সর্ব-আফ্রিকী আন্দোলনে মার্কিন নিগ্রো বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায় মার্কিন শাসকশ্রেণির প্রাধান্যের সবল অস্বীকৃতি। গ্রামসি-র পদ্ধতি অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে সত্তর আশির দশকে এই দ্বিতীয় ধারার পতন ও প্রায় বিলোপের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মার্কিন রাষ্ট্রে প্রধান শ্রেণি তার আধিপত্যের প্রভাবেই নিগ্রো সমাজের এই প্রতিবাদী বুহির্মুখি প্রবণতাকে বশ করে ফেলেছে। রাজনৈতিক প্রাধান্যের দিকে অগ্রসরমান কোনো শ্রেণির সমর্থন ছাড়া নিগ্রো স্বাতন্ত্র্যবাদের আত্মপ্রকাশের প্রয়াস অবধারিতভাবেই চাপা পড়ে যায়। ঊনবিংশ শতাব্দির ইতালীয় ইতিহাসে পিডমন্ট নগর-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে নেতৃত্বের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়, কিংবা ইজরায়েল যেমন পৃথিবীর সর্বদেশের ইহুদিদের পবিত্র আশ্রয়স্থলে (‘জায়ন’) পরিণত হয়েছে, কোনো আফ্রিকি রাষ্ট্রই শেষ পর্যন্ত সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের অনুরূপ কোনো নেতৃত্ববিন্দুতে পৌঁছয়নি। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বৈপ্লবিক রূপান্তরের সম্ভাবনা বা আন্দোলন বারংবার পর্যুদস্ত হয়েছে।। গ্রামসি তার ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন এইসব দেশে লাতিফুনদিউম নামে পরিচিত বিশাল জমিদারি সম্পত্তির মালিকানায় ধর্মসংঘের অবস্থান এবং সেই ভূম্যধিকারী ধর্মসংঘকে ঘিরে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানে। স্বভাবতই এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ধর্মনিরপেক্ষ ও বুর্জোয়া কোনো অবস্থানে পৌঁছতে পারেনি, আধুনিক রাষ্ট্রের স্বার্থে ধর্মসংঘ ও প্রথাগত সামরিক কর্তৃত্বের দাপটকে সংযত করতে পারেনি। জর্মনিতে ১৮৭০-এর দশকে বিসমার্ক-এর নেতৃত্বে কুলটুরকাম্‌প্‌ফ নামে বর্ণিত আন্দোলনে এবং ফ্রান্স-এ ১৮৯৪-১৯০৬-এর মধ্যে দ্রেইফাস মামলাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ও ব্যাপকতম চিন্তারাজ্যে পুরনো ক্যাথলিক ধর্মনির্ভর সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে উদারপন্থী প্রগতিশীল চিন্তাধারার যে সরাসরি সংঘাত বাধে, তাতে সমাজরূপান্তরের পথই সুগম হয়েছিল, দুই সংস্কৃতির বিরোধ ও বিরোধ-নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত হয়েছিল। লাতিন আমেরিকায় অনুরূপ কোনো ঘটনা ঘটলে তবেই সেখানে নতুন শ্রেণি ও তার নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ সম্ভব বলে গ্রামসির বিশ্বাস। কারাগারে বসেই ১৯২৪-২৮-এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি প্লুতারকো এলিয়াস কালেস-এর নেতৃত্বে মেক্সিকোয় নতুন সংবিধানে ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে নববিধানের খবর পেয়ে গ্রামসি স্বভাবতই আশান্বিত হয়ে ওঠেন। আবার চীন ও ভারতে জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মারাত্মক বিচ্ছেদের চিত্র দেখে ভয় পান।

বুদ্ধিজীবীদের গঠনবৃত্তান্ত

বুদ্ধিজীবীরা কি কোনো স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সামাজিক গোষ্ঠী, না-কি প্রত্যেক সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে তার নিজস্ব বুদ্ধিজীবীর বিশিষ্ট এক শ্রেণি? বিভিন্ন অভিধার বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আত্মপ্রকাশের আসল ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় অদ্যাবধি যে বিচিত্র রূপভেদ দেখা গেছে তাতেই সমস্যাটি জটিল হয়ে উঠেছে। এই বিভিন্ন রূপের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এই দুটি –

১। অর্থনৈতিক উৎপাদনের জগতে কোনো আবশ্যিক ভূমিকার মৌল ক্ষেত্র অবলম্বন করে যখনই কোনো সামাজিক গোষ্ঠী আবির্ভূত হয়, তখনই সেই গোষ্ঠী তার নিজের ভেতর থেকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির এক বা একাধিক বর্গের জন্ম দেয়। এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ওই গোষ্ঠীকে সমজাতীয়তার বোধ দেয় এবং তার ভূমিকা সম্পর্কে তাকে সচেতন করে তোলে। ধনতান্ত্রিক আঁত্রেপ্রনর তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই সৃষ্টি করে শিল্পপ্রযুক্তিবিদ, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, নতুন সংস্কৃতির সংগঠন, এক নতুন আইনব্যবস্থার সংগঠক ইত্যাদি। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে আত্রেপ্রনর নিজেই সমাজবিকাশের এক উচ্চতর স্তরের প্রতিভূ, এবং এক ধরনের অগ্রগণ্য ও প্রয়োগগত (বা বুদ্ধিবৃত্তিগত) ক্ষমতাও তার চরিত্রস্বরূপ। তার কর্মক্ষেত্র ও উদ্যোগের সীমার বাইরে অন্য ক্ষেত্রেও, বিশেষত অর্থনৈতিক উৎপাদনের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে তার খানিকটা প্রয়োগগত দক্ষতা থাকবেই। জনসাধারণকে সংগঠিত করা, ব্যবসায়ে যারা অর্থ লগ্নি করবে তাদের ‘আস্থা’কে সংগঠিত করা, তার উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতাদের ‘আস্থা’কে সংগঠিত করা তার দায়স্বরূপ।

সব আঁত্রেপ্রনর না হলেও তাদের মধ্যে অন্তত এলিট অংশের সেই ক্ষমতা থাকতেই হবে যার বলে তারা সমগ্র সমাজের সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারে; সমাজ বলতে রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃত তার যাবতীয় জটিল ক্রিয়াবিন্যাস; কারণ তাদের নিজেদের শ্রেণির প্রসারের পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে নিতে গেলে এই দায়িত্ব তাদের নিজেদের হাতে তুলে নিতেই হবে। নয়তো অন্তত সেই ক্ষমতা তাদের থাকতেই হবে যার জোরে তারা এমন সহযোগী (বিশেষভাবে দীক্ষিত কর্মচারী) খুঁজে নিতে পারবে যাদের উপর ব্যবসাক্ষেত্রের বাইরে সম্পর্কসমূহের ব্যাপকতর বিন্যাসকে সংগঠিত করে তোলার দায়িত্ব ন্যস্ত করা যায়। বলা যায়, প্রত্যেক নতুন শ্রেণি তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই যে জৈব’ বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টি করে এবং তার নিজ বিকাশের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাদের সম্প্রসারিত করে তারা মুখ্যত নতুন শ্রেণির দ্বারা প্রতিস্থাপিত নতুন সামাজিক বর্গের আদি ক্রিয়ার অংশবিশেষে ‘কৃতবিদ্যা’। (এই সূত্রে মস্কার ‘রাজনীতিবিজ্ঞানের উপাদান’ (নতুন বর্ধিত সংস্করণ, ১৯২৩) দেখা যেতে পারে। মস্কার তথাকথিত ‘রাজনৈতিক শ্রেণি’ প্রধান সামাজিক গোষ্ঠীর বুদ্ধিজীবী বর্গেরই নামান্তর। মস্কার এই ‘রাজনৈতিক শ্রেণি’র ধারণার সঙ্গে পারেতোর ‘এলিট’-এর ধারণা মিলিয়ে দেখা যায়। পারেতোর ধারণাও রাষ্ট্র ও সমাজের জীবনে বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহাসিক উপস্থিতি ও ভূমিকা ব্যাখ্যা করার আরেকটি প্রয়াস। মস্কার বইটি এর অতিকায় জগাখিচুড়ি যার ধাঁচটা সমাজতাত্ত্বিক ও দৃষ্টবাদী, এবং তারই সঙ্গে রয়েছে প্রত্যক্ষ রাজনীতির একদেশদর্শিতা, যার গুণে লেখাটি ততটা দুষ্পাচ্য হয়ে ওঠে না এবং সাহিত্যমূল্যবিচারে সজীবতর হয়ে ওঠে।)

সামন্তপ্রভুরাও এক বিশেষ প্রয়োগদক্ষতা ও সামরিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। বস্তুত যে অভিজাত শ্রেণি প্রায়োগিক সামরিক দক্ষতায় তাদের একচেটিয়া অধিকার হারাতে শুরু করে, সেই মুহূর্তেই সামন্ততন্ত্রের সংকটের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক জগৎ ও তার পূর্ববর্তী ক্ল্যাসিকাল জগতে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির গঠনের প্রশ্নটি স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করতে হবে। এই গঠন ও সম্প্রসারণ যে পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে তার বস্তুধর্মী বিচার আবশ্যক। যেমন ধরুন লক্ষ করা যায় যে উৎপাদনক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করলেও কৃষিজীবী শ্রেণি তার নিজস্ব কোনো ‘জৈব’ বুদ্ধিজীবী শ্রেণির জন্ম দেয় না বা ‘প্রথাগত’ বুদ্ধিজীবীদের কোনো বর্গকে আত্মসাৎও করে না, যদিও ওই কৃষিজীবী শ্রেণি থেকেই অন্য সামাজিক গোষ্ঠী তাদের অনেক বুদ্ধিজীবীকেই আহরণ করে। প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশই কৃষকবংশোদ্ভূত।

২। পূর্বতন অর্থনৈতিক কাঠামো থেকে এবং ওই কাঠামোর ক্রমবিকাশের পরিণামস্বরূপ যখনই কোনো ‘অপরিহার্য’ সামাজিক শ্রেণি ইতিহাসে তার স্থান করে নিয়েছে, তখনই সেই শ্রেণি (অন্তত বৰ্তমান কাল পর্যন্ত সমগ্র ইতিহাস জুড়েই) বুদ্ধিজীবীদের এমন কোনো বর্গের সন্ধান পেয়ে গেছে যাতে একটা ঐতিহাসিক ক্রমান্বয়তার বোধ আসে। এই ক্রমান্বয়তা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিন্যাসের জটিলতম ও মৌল রূপান্তরেও ব্যাহত হয় না।

বুদ্ধিজীবীদের এই বর্গগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রতিনিধিস্থানীয় হল পুরোহিত শ্রেণি। এরা দীর্ঘকাল জুড়ে (ইতিহাসের একটা সমগ্র পর্ব জুড়েই যার অন্যতম বৈশিষ্ট্যই ছিল এই একচেটিয়া অধিকার) অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুকৃতির একচেটিয়া দায়ভার বহন, ধর্মীয় মতাদর্শ, অর্থাৎ ওই যুগের দর্শন ও বিজ্ঞান, এবং তৎসহ বিদ্যালয়, শিক্ষা, নীতিজ্ঞান, বিচারব্যবস্থা, দায়ধর্ম, সদাচার ইত্যাদি। পুরোহিতবর্গকে ভূম্যধিকারী অভিজাতশ্রেণির সঙ্গে জৈব যোগে সম্পৃক্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বলে গণ্য করা যায়। আইনের চোখে এরা অভিজাত শ্রেণির সমমর্যাদা ভোগ করেছে, তাদেরই মতো জমির উপর সামন্ততান্ত্রিক মালিকানা এবং সম্পত্তির অধিকারে রাষ্ট্রীয় বিশেষাধিকারের সুযোগ লাভ করেছে। (প্রাচীন সমাজের মর্যাদা ও সামাজিক ভূমিকার কারণে পুরোহিত শ্রেণির ঠিক পরেই গুরুত্বের বিচারে যাদের স্থান, ব্যাপক অর্থে চিকিৎসক বলে যাদের চিহ্নিত করা যায়, অর্থাৎ যারাই মৃত্যু ও ব্যাধির বিরুদ্ধে ‘সংগ্রামে’ রত বা যাদের রত বলে মনে হয়, তাদের বিবরণের জন্য আর্তুরো কাস্তিলিওনির ‘ভেষজের কাহিনী’ দ্রষ্টব্য। লক্ষ করবেন, ধর্ম ও ভেষজের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে অনেক দিন ধরেই, এখনও কোনো কোনো অঞ্চলে সেই সম্পর্ক রয়ে গেছে: বিশেষ সাংগঠনিক ভূমিকায় নিয়োজিত ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে অনেক হাসপাতাল রয়েছে; আর তা ছাড়াও যেখানেই ডাক্তারের আবির্ভাব ঘটে সেখানেই পুরোহিতেরও আবির্ভাব ঘটে (ঝাড়ফুঁক, নানা ধরনের সহায়তা ইত্যাদি) বহু মহান ধর্মীয় ব্যক্তি মহান ‘উপশমক’ রূপে কীর্তিত হয়েছেন এবং হন। তার সঙ্গেই রয়েছে মৃতের পুনরুজ্জীবন নিরাময়ের ধারণা। রাজাদের ক্ষেত্রেও বহুদিন পর্যন্ত এমন বিশ্বাস থেকে গিয়েছিল যে তাঁরা স্পর্শমাত্রে রোগ নিরাময় ঘটাতে পারেন ইত্যাদি।) উপরিকাঠামোর স্তরে পুরোহিত শ্রেণি যে একচেটিয়া ক্ষমতা ধারণ করে গেছে তা প্রয়োগ করতে গিয়ে তাদের সংঘর্ষের সম্মুখীন হতে হয়েছে, ব্যাঘাত মেনে নিতে হয়েছে। (রোম্যানস্ ভাষাগোষ্ঠীর অনেক ভাষাতেই বা খ্রিস্টীয় ধর্মচর্যায় ব্যবহৃত লাতিন ভাষার মধ্য দিয়ে রোম্যানস্ ভাষা দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত। অনেক ভাষাতেই এই সূত্র থেকেই ‘কিয়েরিকো’ (ধর্মসংঘের সদস্য) শব্দটির একটা সাধারণ অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে ‘বুদ্ধিজীবী’ বা ‘বিশেষজ্ঞ’, যেমন তারই বিপরীত ‘লাইকো’ (ধর্মসংঘের বহিঃস্থ) শব্দের অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘ধর্মবিচ্যুত’, ‘অবিশেষজ্ঞ।) তারই পরিণামস্বরূপ নানা আকারে (যা নিয়ে আরো গভীরভাবে ও বস্তুগতভাবে বিচার করে দেখা যাবে) এমন অন্য বর্গের জন্ম হয় যারা সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্র পর্যন্ত রাজতন্ত্রের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে তারই সাহায্যে বিস্তৃতি লাভ করে। এইভাবেই গড়ে ওঠে বিশেষ অধিকারপুষ্ট এক নব্য অভিজাতশ্রেণি, যার অন্তর্গত হয় প্রশাসক সম্প্রদায় ইত্যাদি, বিদ্বান ও বিজ্ঞানী, তাত্ত্বিক ও পুরোহিত শ্রেণির বাইরেকার দার্শনিককুল ইত্যাদি।

যেহেতু এই বিভিন্ন বর্গের প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা এক ধরনের ‘গোষ্ঠীবোধ’ থেকে তাঁদের অব্যাহত ঐতিহাসিক ক্রমান্বয়তা এবং তাঁদের বিশেষ যোগ্যতার বিশিষ্টতা অনুধাবন করেন, তাই তারই জোরে তাঁরা প্রধান সামাজিক শ্রেণি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বলে নিজেদের পরিচয় দেন। এই স্বমূল্যায়নের পরিণাম দেখা যায় মতাদর্শ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে। বহুদূরপ্রসারী সেই পরিণাম। বুদ্ধিজীবীদের এই সামাজিক গোষ্ঠী এই যে অবস্থানে নিজেদের স্থাপন করেন, তার সঙ্গে সহজেই সমগ্র ভাববাদী দর্শনের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। যে সামাজিক কল্পরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের ‘স্বাধীন’, সম্পূর্ণ স্বয়ংচালিত, স্বকীয় চরিত্রের গুণে বিশিষ্ট বলে বিবেচনা করেন, ওই দর্শনকে তারই প্রকাশ বলে চিহ্নিত করা যায়।

সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এও লক্ষ করতে হবে যে পোপ ও ধর্মসংঘের উর্ধ্বতম স্তরগুলো যদিও বা সেনেট-সদস্য আইনিয়েল্লি ও বেন্নি’র চেয়ে খ্রিস্ট ও তাঁর সন্তদের সঙ্গেই নিজেদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর বলে মনে করেন, তবুও জেনভিল ও ক্রোচে সম্পর্কে সেকথা খাটে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ক্রোচে এরিস্টটল ও প্লেটোর সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠ যোগ অনুভব করলেও অন্যদিকে তিনি কখনোই সেনেট সদস্য আইনিয়েল্লি ও বেন্নির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গোপন করেন না। ঠিক এইখানেই ক্রোচের দর্শনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষণটিকে লক্ষ করা যায়।

‘বুদ্ধিজীবী’ কথাটিকে গ্রহণ করলে শেষ পর্যন্ত কত দূর যাওয়া যায়? এমন কোনো একক লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় কি যা দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের যাবতীয় বিচিত্র ও স্বতন্ত্র ক্রিয়াকলাপের চারিত্র্য ধরা যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে তার মৌলিক প্রভেদটাও চিনে নেওয়া যায়? আমার মনে হয় পদ্ধতির সবচেয়ে ব্যাপক যে ভুল হয়েছে তা হল সামাজিক সম্পর্কসমূহের জটিল ক্ষেত্রে যে বিশেষ সম্পর্ক বিন্যাসের মধ্যে এই ক্রিয়াকলাপ (এবং স্বভাবতই যে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীগুলো তা সাধন করে) সংঘটিত হয়, তার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যচিহ্ন সন্ধান না করে মননধর্মী ক্রিয়াকলাপের অন্তর্লীন চারিত্র্যের মধ্যে তার সন্ধান করা হয়েছে। উদাহরণত, শ্রমিক বা নির্বিত্তের বিশেষ চারিত্র্য তার হাতের কাজ বা যন্ত্রচালনার মধ্যে নিহিত নয়। যে বিশিষ্ট অবস্থায় এবং যে বিশেষ সামাজিক সম্পর্কের আওতায় এই কাজ সে সাধন করে, তাতেই সেই চারিত্র্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তা ছাড়াও অবশ্য বিবেচ্য যে শুদ্ধ শারীরিক শ্রম বলে কিছু নেই, এবং টেলর ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোরিলা’র যে অভিধাটি ব্যবহার করেন তাও একটি অলংকারমাত্র এবং একটি বিশেষ দিকের সীমা নির্দেশ করেই ক্ষান্ত হয়। যেকোনো শারীরিক ক্রিয়ায়, তা যতই নিচু ধরনের ও যান্ত্রিক হোক না কেন, প্রয়োগগত দক্ষতার একটা ন্যূনতম মান থাকবেই। আমরা আগেই বলেছি, আঁত্রেপ্রনর-এর বিশেষ ভূমিকার কারণেই বুদ্ধিজীবী লক্ষণাক্রান্ত কিছু যোগ্যতা তাঁর থাকতেই হবে যদিও সমাজে তাঁর স্থান যোগ্যতাবলীর কারণে নির্ধারিত হয় না; ব্যাপকতর যে সামাজিক সম্পর্কবিন্যাসে শিল্পক্ষেত্রে আঁত্রেপ্রনর-এর বিশেষ অবস্থান নির্ধারিত হয়ে যায়, তাই তাঁর সামাজিক ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেয়।

কেউ তাই বলতেই পারেন যে সব মানুষই বুদ্ধিজীবী; কিন্তু তাই বলে সমাজে সব মানুষকে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করতে হয় না। (ঠিক যেমন প্রত্যেকেই জীবনে কোনো-না-কোনো সময়ে এক জোড়া ডিম ভেজেছেন কিংবা জ্যাকেটের একটা ছেঁড়া অংশ রিপু করেছেন বলেই আমরা প্রত্যেককে পাচক বা দর্জি বলে বসব না।)

যখন কেউ বুদ্ধিজীবী ও অ-বুদ্ধিজীবীর মধ্যে প্রভেদ করেন তখন তিনি কার্যত কেবলমাত্র বুদ্ধিজীবী নামধেয় পেশাদার বর্গের প্রত্যক্ষ সামাজিক ভূমিকার দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। অর্থাৎ তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে সেই দিকে যেদিকে বুদ্ধিজীবীদের বিশিষ্ট পেশাদার বৃত্তিতে জোর পড়ে; অর্থাৎ যা বিচার করা হচ্ছে তা হল, জোরটা কোনদিকে পড়ছে, বুদ্ধিগত বিস্তারের দিকে, না কি পেশিগত-স্নায়ুগত প্রসারের দিকে। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কথা বলা গেলেও অ-বুদ্ধিজীবী কোনো শ্রেণির কথা বলা যাবে না, কারণ অ-বুদ্ধিজীবীদের কোনো অস্তিত্বই নেই কিন্তু বুদ্ধিগত-মস্তিষ্কচালিত বিস্তার ও পেশিগত-স্নায়ুগত প্রয়াসের মধ্যেও যে সম্পর্ক, তা সবসময় এক থাকে না, ফলে বিশেষ কোনো বুদ্ধিগত ক্রিয়ার মানগত তারতম্য ঘটে। এমন কোনো মানবিক ক্রিয়া নেই যা থেকে বুদ্ধিগত অংশগ্রহণের সমস্ত সম্ভাবনা সম্পূর্ণ বর্জন করা যায়; যে মানুষ নির্মাতা এবং যে মানুষ চিন্তাশীল তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা যায় না। চূড়ান্ত বিচারে প্রত্যেক মানুষই তার পেশাগত ভূমিকার বাইরে কোনো কোনো ধরনের বুদ্ধিগত ক্রিয়ায় ব্যাপৃত থাকে; অর্থাৎ, সে তখন একজন ‘’দার্শনিক’, একজন শিল্পী, একজন রুচিবান মানুষ, সে এক বিশেষ বিশ্বদর্শনে নিরত, তার মধ্যে রয়েছে নৈতিক আচরণের এক সচেতন বিধি, ফলে এক বিশেষ বিশ্ববোধকে লালন করা বা তার সংস্কার সাধনের কাজে, অর্থাৎ নতুন চিন্তাপদ্ধতির জন্ম দেওয়ার কাজে তার ভূমিকা থাকে।

কোনো নতুন পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে গেলে একটা সমস্যা এসে দাঁড়ায়। প্রত্যেকের মধ্যেই বিকাশের কোনো একটি স্তরে যে বুদ্ধিগত ক্রিয়া সচল তার বিচারসমৃদ্ধ বিস্তার ঘটিয়ে এমন এক নতুন স্থিতির দিকে এগোনোর সমস্যা দেখা দেয় যাতে সর্বব্যাপী ক্রিয়াকর্মের অন্যতম উপাদান এবং বস্তুজগৎ ও সমাজের ক্রমাগত নবরূপান্তরে সদা সক্রিয় শক্তি রূপে ওই পেশিগত-স্নায়ুগত প্রয়াসই পৃথিবীর এক নতুন ও অন্তর্লীন ধারণার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। লেখক, দার্শনিক ও শিল্পীদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসেন প্রথাগত ও সবচেয়ে সাধারণ স্তরের বুদ্ধিজীবী। ফলে সাংবাদিকেরা নিজেদের লেখক, দার্শনিক বা শিল্পী বিবেচনা করে নিজেদের ‘যথার্থ’ বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য করতে থাকেন। আধুনিক জগতে শিল্পে শ্রমের সঙ্গে আদিমতম ও অদক্ষতম স্তরেও ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিশিক্ষাকেই হতে হবে নতুন শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের ভিত্তিভূমি।

এই ভিত্তি থেকেই সাপ্তাহিক ‘অরদিনে নুওভো’ পত্রিকা নব্য বুদ্ধিজীবীতন্ত্রের কয়েকটি ধারার বিকাশ ও তার নতুন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছিল। এই পত্রিকার সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল এইটেই, কারণ সমাজজীবনের বাস্তব কাঠামোগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্ন আকাঙ্ক্ষা ও তাদের বিকাশের সঙ্গে এই নব্য বুদ্ধিজীবীতন্ত্রের সাযুজ্য ছিল। নবা বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্ব আর কেবল বাগ্মিতার উপর নির্ভরশীল থাকতে পারে না, কারণ বাগ্মিতা অনুভূতি ও আবেগকে বাইরে থেকে তাৎক্ষণিক নাড়া দিতে পারে মাত্র। নব্য বুদ্ধিজীবীকে সরাসরি বাস্তব জীবনে অংশগ্রহণ করতে হবে, কেবলমাত্র মামুলি বক্তা হিসেবে নয়, নির্মাতা, সংগঠক ও স্থায়ী সম্মতিগ্রাহী রূপে, সঙ্গে সঙ্গেই তাকে বস্তুবিচ্ছিন্ন কোনো গাণিতিক স্তরের চেয়ে উন্নততর স্তরে সক্রিয় হতে হবে। কাজের মধ্যে প্রয়োগবিদ্যা আয়ত্ত করেই সেই প্রয়োগবিদ্যাকে বিজ্ঞানে পরিণত করতে হয়, তার থেকেই পৌঁছতে হয় ইতিহাসের মানবিকবাদী ধারায় যা ছাড়া একজন কেবল ‘বিশেষজ্ঞ’ই থেকে যায়, একাধারে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক, অর্থাৎ ‘অগ্রগণ্য’ ভূমিকায় পৌঁছতে পারে না।

বুদ্ধিজীবী ভূমিকা পালনের ইতিহাস-নির্দিষ্ট বিশেষত বিভিন্ন বৃত্তি আছে। সমস্ত সামাজিক গোষ্ঠীকে ঘিরেই এই বৃত্তিগুলো গড়ে ওঠে, বিশেষত অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গেই এই বৃত্তিগুলো গড়ে ওঠে, প্রধান সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে তাদের ব্যাপকতর ও জটিলতর সম্প্রসারণ ঘটে। যেকোনো গোষ্ঠী যখন প্রাধান্যের দিকে অগ্রসরমান তখন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের আত্মসাৎ করা ও মতাদর্শগতভাবে তাদের জয় করে নেবার জন্য ওই গোষ্ঠীর সংগ্রাম। কিন্তু ওই গোষ্ঠী সঙ্গে সঙ্গেই তার নিজস্ব জৈব বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সম্প্রসারণে যতই সফল হয় প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের আত্মসাৎ ও জয় করে নেবার প্রয়াস ততই দ্রুত ও সার্থকতর হয়।

মধ্যযুগীয় সভ্যতা থেকে যে-সব সমাজের অভ্যুদয় ঘটে সেই সব সমাজে ব্যাপক অর্থে শিক্ষার কর্মকাণ্ড ও সংগঠনের যে বিপুল বিকাশ লক্ষ করা যায় তাতেই আধুনিক পৃথিবীতে বুদ্ধিজীবী ভূমিকা ও বৃত্তির নবপ্রতিষ্ঠিত গুরুত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রত্যেক ব্যক্তির ‘বুদ্ধিজীবী চারিত্র্য’কে গভীরতর ও প্রশস্ততর করার পাশাপাশি বিভিন্ন বিশেষিত বৃত্তিগুলোকেও আরো সংকীর্ণ করে তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা চলেছে। এই প্রবণতা লক্ষ করা যায় সর্বস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একেবারে সেইসব জৈব সংগঠন পর্যন্ত যাদের অস্তিত্বের শর্তই হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সর্বক্ষেত্রে তথাকথিত ‘উচ্চমার্গের সংস্কৃতি’র প্রসার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই সেই মাধ্যম যার মধ্য দিয়ে নানা স্তরের বুদ্ধিজীবীর সম্প্রসারণ ঘটে। বিভিন্ন রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবী ভূমিকার জটিলতার একটা বাস্তব পরিমাপ পাওয়া যায় বিশেষ বিদ্যার অনুশীলনে নিয়োজিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও মানবিন্যাস থেকে। যেখানে শিক্ষার আওতার ‘ক্ষেত্র’ যত বেশি বিস্তৃত, যেখানে শিক্ষাদানের স্তর ওপর থেকে নিচে সংখ্যায় যত বেশি সেই রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক জগৎ তথা সভ্যতা তত বেশি জটিল। শিল্পপ্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একটা তুলনীয় ব্যাপার দেখা যায়। যে যন্ত্র দ্বারা অন্য যন্ত্র নির্মাণ করা যায়, যন্ত্র নির্মাণের জন্য উদ্ভাবন যন্ত্র ক্রমাগতই উন্নততর এবং যন্ত্র নির্মাণের জন্য যন্ত্র উৎপাদনে যে দেশ যত কর্মক্ষম তারই ভিত্তিতে তার শিল্পায়নের মান পরিমাপ করা যায়। পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারের জন্য যন্ত্র নির্মাণে এবং প্রথম স্তরের যন্ত্রগুলোর পরীক্ষার জন্য যন্ত্র নির্মাণে যে দেশ সবচেয়ে দক্ষ তাকেই প্রযুক্তিগত শিল্পগত ক্ষেত্রে জটিলতম এবং সভ্যতার উন্নততম স্তরে প্রতিষ্ঠিত বলে গণ্য করা যায়। এই একই মানদণ্ড প্রয়োগ করা যায় বুদ্ধিজীবী তৈরি করে তোলার ব্যাপারে এবং এই তৈরি করার কাজে নিয়োজিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও। উচ্চমানের সংস্কৃতির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চর্চাকেন্দ্র পরস্পরের পরিপূরক। এক্ষেত্রেও পরিমাণ ও গুণগত মানের মধ্যে প্রভেদ করা যায় না। যেখানেই প্রযুক্তিগত-সংস্কৃতিগত বিশেষানুশীলন যত সূক্ষ্ম স্তরে উঠেছে, সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপকতম সম্ভবপর বিস্তার ঘটেছে এবং পরিমাণগতভাবে মাধ্যমিক স্তরে প্রসার ঘটাবার জন্য প্রচণ্ডতম প্রয়াস ঘটেছে। স্বভাবতই আবার উচ্চতম বুদ্ধিজীবী যোগ্যতার জন্য মানুষ বাছাই ও ওই যোগ্যতার সম্প্রসারণের জন্যই যে ব্যাপকতম সম্ভবপর ভিত্তির প্রয়োজন তথা উচ্চমার্গের সংস্কৃতি ও উন্নততম স্তরের প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োজনেই এক গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার যে তাগিদ অনুভূত হয়েছিল, তার মধ্যে কিছু অসুবিধার বীজও নিহিত ছিল; কারণ মধ্য বুদ্ধিজীবী স্তরে বেকারির প্রবল সংকটের সম্ভাবনা এইভাবেই সৃষ্টি হয়। সমস্ত আধুনিক সমাজেই বাস্তবে তা-ই ঘটেছে।

প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, বাস্তব ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সম্প্রসারণ ঘটে নির্বস্তুক গণতন্ত্রের কোনো পটভূমিকায় নয়, বরং বাস্তব প্রথানুগ বিভিন্ন ঐতিহাসিক পারম্পর্যের মধ্যেই। এইভাবেই অনেক শ্রেণি গড়ে উঠেছে যার মধ্য থেকে প্রথাগতভাবেই বুদ্ধিজীবী বর্গ ‘উৎপন্ন হয়। আবার দেখা যায় যে এইসব শ্রেণিই সেইসব শ্রেণি যারা ‘সঞ্চয়েই’ বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছে, অর্থাৎ ভূম্যধিকারী নিম্ন ও মধ্য বুর্জোয়া শ্রেণি এবং নিম্ন ও মধ্য নাগরিক বুর্জোয়া শ্রেণির কয়েকটি শ্রেণি। ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্র জুড়ে নানা ধরনের (চিরায়ত ও পেশাগত) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিচিত্র সমাবেশ এবং এইসব বিভিন্ন শ্রেণির অন্তর্গত বিভিন্ন বর্গের বিচিত্র আকাঙ্ক্ষাই বুদ্ধিজীবী বিশেষানুশীলনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উপস্থিতি নির্দেশ বা নির্ধারণ করে। এই ধারাতেই ইতালিতে গ্রামীণ বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে যেমন প্রধানত রাষ্ট্রের প্রশাসক ও বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞরা বেরিয়ে আসেন, তেমনই নাগরিক বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে বেরিয়ে আসেন শিল্পের প্রযুক্তিবিদেরা। ফলে মুখ্যত উত্তর ইতালি থেকেই আসেন প্রযুক্তিবিদেরা আর দক্ষিণ থেকে আসেন প্রশাসক ও পেশাদার মানুষেরা।

মৌল সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্ক যতটা প্রত্যক্ষ, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ততটা প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু সমাজের সমগ্র বিন্যাস দ্বারা এই সম্পর্ক নানা মাত্রায় প্রভাবিত হয়, যেমন প্রভাবিত হয় বিভিন্ন পরিকাঠামোর জটাজাল; বুদ্ধিজীবীরা আসলে ওই উপরিকাঠামোগুলোরই ‘প্রয়োগকর্তা’। বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী বর্গ এবং কোনো মৌলিক সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের মাত্রার জৈব চারিত্রের’ মূল্যায়ন করে তাঁদের ভূমিকা এবং পরিকাঠামোগুলোর একেবারে অধস্তন স্তর থেকে শীর্ষস্তর পর্যন্ত (অর্থাৎ কাঠামোগত ভিত্তি থেকে উর্ধ্বমুখী) একটা ক্রম তৈরি করা যেতে পারে। আপাতত আমরা দুটি মুখ্য উপরিকাঠামোগত ‘স্তর’ ঠিক করে নিতে পারি। একটিকে বলা যাবে জনসমাজ, অর্থাৎ সচরাচর ‘ব্যক্তিগত’ বলে বর্ণিত জৈব সম্পর্কগুলোর সমাহার; অন্যটি হল ‘রাজনৈতিক সমাজ’ বা ‘রাষ্ট্র’। এই দুটি স্তরের সঙ্গে সাযুজ্য থাকে একদিকে সেই আধিপত্যের যা প্রধান গোষ্ঠী সমগ্র সমাজের উপর খাটায়, অন্যদিকে রাষ্ট্র ও ‘আইনানুগ’ সরকারের মধ্য দিয়ে যে ‘প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব’ বা শাসন চালিত হয়, তার যে ভূমিকাগুলো আমরা বিবেচনা করছি, তা সম্পূর্ণতই সাংগঠনিক ও যোগসূত্রস্বরূপ। প্রধান গোষ্ঠীর ‘প্রতিনিধি’ স্বরূপ বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক দেশশাসনের নিম্নবর্গীয় দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এর মধ্যে আছে :

  • ১। প্রধান মৌল গোষ্ঠী সমাজজীবনের উপর যে সাধারণ লক্ষ্য চাপিয়ে দেয় তার সপক্ষে ব্যাপক জনসাধারণের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ সম্মতি আদায়; উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রধান গোষ্ঠী তার স্থান ও ভূমিকার কারণে যে মর্যাদায় (ও তারই পরিণামস্বরূপ, আস্থার) অধিকারী, তারই জোরে ‘ঐতিহাসিক’ কারণেই সম্মতি পাওয়া যায়।
  • ২। যে-সব গোষ্ঠী সক্রিয়তায় বা নিষ্ক্রিয়তায় ওই ‘সম্মতি দেয় না, তাদের উপর ‘আইনবলে’ চাপ সৃষ্টি করার জন্য রাষ্ট্রের বশকারী ক্ষমতাযন্ত্রের প্রয়োগ। স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি অনাদায়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনের সংকটমুহূর্তের সম্ভাবনায়ই সমগ্র সমাজের জন্যই অবশ্য এই ক্ষমতাযন্ত্র তৈরি করা থাকে।

এইভাবে সমস্যাটি সাজালে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সংজ্ঞার যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটে। বস্তুত কেবল এই পথেই প্রকৃত বাস্তবের সমীপবর্তী হওয়া যাবে। এতে কোনো বিশেষ জাতের বদ্ধমূল ধারণাও ধাক্কা খায়। সামাজিক আধিপত্য ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সংগঠিত করার দায়িত্ব থেকেই নিশ্চিতভাবেই এক বিশেষ শ্রমবিভাজন ঘটে যায়, ফলে বিশেষ যোগ্যতার এই সামগ্রিক মানক্রম তৈরি হয়ে যায় যাতে নিয়ামক ও সাংগঠনিক ভূমিকার সরাসরি কোনো ইঙ্গিত আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় না। যেমন দেখা যায়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্দেশনার ক্ষমতাযন্ত্রে এক ধরনের অনেক কর্মের সংস্থান থাকে যা একেবারেই হাতে-কলমে করার বা একান্তই যান্ত্রিক (নির্বাহী পর্যায়ের নয়, পদাধিকারী বা দায়িত্বসম্পন্ন নয়, বরং নিতান্ত ই আজ্ঞাধীন মাত্র)। অন্য পার্থক্যের মতো এইরকম একটা পার্থক্যও যে করতেই হবে তা বলাই বাহুল্য। অন্তর্লীন লক্ষণ ধরেও বুদ্ধিজীবী ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য বিচার করতে হবে, তাতে যে সব স্তর পর্যায় বেরিয়ে আসবে তাদের তীব্রতম বিরোধের মুহূর্তে যথার্থ গুণগত পার্থক্য ধরা পড়বে সবচেয়ে উপরের স্তরে স্থান হবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, দর্শন, শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রের স্রষ্টাদের, সবচেয়ে নিচের স্তরে স্থান হবে সবচেয়ে অধস্তন ‘প্রশাসকদের’ এবং পূর্বতন, প্রথাগত, সঞ্চিত বুদ্ধিপ্রসূত সম্পদের বিবরকদের। (নিম্নবর্গীয় আধিকারিক, ঊর্ধ্বতন আধিকারিক, জেনারেল স্টাফ এবং সচরাচর স্বীকৃত না হলেও যাদের গুরুত্ব সমধিক সেই এনসিওদের নিয়ে সামরিক সংগঠনের মধ্যে জটিল মানবৈচিত্র্যের এক উপমান পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, এই অংশগুলোই নিজেদের মধ্যে এক সৌহার্দ্য অনুভব করে এবং বস্তুত অধস্তন স্তরগুলোতেই এক অখণ্ড গোষ্ঠীবোধের সবচেয়ে প্রকট দৃষ্টান্ত দেখা যায় যাতে তারা নিজেরা এক ধরনের ‘আত্মশ্লাঘা বোধ করলেও তা নিয়ে আবার অন্যেরা ঠাট্টা-তামাশাও করে থাকে।)

এই অর্থে যারা বুদ্ধিজীবী বর্গ বলে চিহ্নিত আধুনিক জগতে তাঁদের অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। গণতান্ত্রিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার এমন বহুসংখ্যক কার্যাবলীর উদয় হয়েছে যার সবগুলো উৎপাদনের সামাজিক তাগিদের দান নয়, বরং প্রধান মৌল গোষ্ঠীর রাজনৈতিক চাহিদায় তাদের সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে উঠেছে লোরিয়ার অনুৎপাদনক্ষম ‘শ্রমিকের ধারণা (কিন্তু কার সূত্রে বা কোন উৎপাদনব্যবস্থার সূত্রে অনুৎপাদনক্ষম?)! এই জনসম্প্রদায় তাদের অবস্থানের সুযোগ নিয়ে জাতীয় আয়ের একটা বড় অংশ আদায় করে নেয়, এই কথাটি মনে রাখলে এই ধারণাটিকে খানিকটা যুক্তিসঙ্গত বলে মেনে নেওয়া যায়। যেমন অনেক প্রমাণ চরিত্রের জনসম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে, তেমনই এই ক্ষেত্রেও এই জনসম্প্রদায়ের অন্তর্গত থাকে মনস্তাত্ত্বিক বিচারে ও ব্যক্তিগত যোগ্যতার মান অনুযায়ী প্রমাণচরিত্রের ব্যক্তিসমূহ, এবং তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণেই স্বাভাবিক হয়ে দেখা দেবে সেইসব সংগঠন যারা পেশাগুলোকে মদত দেবে, বেকারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতি উৎপাদন, অভিবাসন ইত্যাদি সামলাবে।

নাগরিক ও গ্রামীণ চরিত্রের বুদ্ধিজীবীদের ভিন্ন অবস্থান

নাগরিক চরিত্রের বুদ্ধিজীবীরা গড়ে উঠেছেন শিল্পব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গেই, এবং তাঁদের ভবিষ্যৎ তারই সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে অধস্তন অফিসারদের ভূমিকার সঙ্গে তাঁদের ভূমিকার তুলনা করা যায়। নির্মাণকর্মের পরিকল্পনার সম্প্রসারণে তাঁদের কোনো স্বাধীন উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ নেই। তাঁদের কাজ বলতে আঁত্রেপ্রনর ও প্রয়োগকারী জনসম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক রচনা করা এবং শিল্পোদ্যোগের জেনারেল স্টাফ যে উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তার তাৎক্ষণিক রূপায়ণের খবরদারি করা, কাজটির প্রাথমিক পর্বের দেখাশোনা করা। সব মিলিয়ে সাধারণ স্তরের নাগরিক বুদ্ধিজীবীরা একেবারেই গড়পড়তা। ওপরের স্তরের বুদ্ধিজীবীরা তেমনই আবার শিল্পব্যবস্থার জেনারেল স্টাফ-এর সঙ্গে বহুলাংশে অবিচ্ছেদ্যরূপে একাত্ম।

গ্রামীণ চরিত্রের বুদ্ধিজীবীরা বহুলাংশেই ‘প্রথাগত’ অর্থাৎ তাঁরা যে গ্রামদেশবাসী জনসমষ্টি এবং শহরের (বিশেষত মফস্বল শহরের) পেটি-বুর্জোয়াশ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ তারা এখনও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আওতায় পড়ে সম্প্রসারিত বা কর্মতৎপর হয়ে ওঠেনি। এই ধরনের বুদ্ধিজীবীরা (আইনব্যবসায়ী, নোটারি প্রভৃতি) কৃষিজীবী জনসাধারণের সঙ্গে স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সম্পর্ক স্থাপন করে। এই কাজের খাতিরেই তাঁদের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক-সামাজিক ভূমিকা থাকে, কারণ পেশাগত মধ্যস্থতা ও রাজনৈতিক মধ্যস্থতার মধ্যে তফাত করা শক্ত তাছাড়াও গ্রামদেশে বুদ্ধিজীবীদের (পুরোহিত, আইনজীবী, নোটারি, শিক্ষক, ডাক্তার ইত্যাদি) জীবনযাত্রার মান সাধারণভাবে সাধারণ কৃষকের মানের চেয়ে উঁচুতে বা অন্তত পৃথক; ফলে তাঁরা হয়ে ওঠেন এমন এক সামাজিক উপমান যে কৃষক তাঁকে তাঁর নিজের অবস্থা থেকে পালিয়ে বা তার উন্নতি ঘটিয়ে অন্য কোথায়ও পৌঁছবার আকাঙ্ক্ষায় একটা লক্ষ্য বলে ধরতে পারেন। কৃষক সবসময়ই ভাবেন যে তাঁর অন্তত এক পুত্ৰ বুদ্ধিজীবী (বিশেষত পুরোহিত) হতে পারবে, এবং ওইভাবে ভদ্রলোক হয়ে উঠে বাকি অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে তার যে যোগাযোগসূত্র গড়ে উঠতে বাধ্য তারই সুযোগ নিয়ে সে তার পরিবারের অর্থনৈতিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করে তার সামাজিক অবস্থানটাও কিছুটা তুলতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের প্রতি কৃষকের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বৈতভাবাপন্ন এবং আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্বিরোধে পরিকীর্ণ। বুদ্ধিজীবীদের ও সাধারণভাবে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের সামাজিক অবস্থানের প্রতি সম্ভ্রম সত্ত্বেও কৃষকেরা কখনও কখনও তাদের প্রতি বিদ্বেষের ভাব দেখান। তাতে বোঝা যায় তাঁদের সম্ভ্রমের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ঈর্ষা ও ক্রোধাবেগের সহজাত প্রবৃত্তি। বুদ্ধিজীবীদের কাছে কৃষকশ্রেণির এই বাস্তবিক পরবশতা লক্ষ করে তার বস্তুনিষ্ঠ ও গভীর পর্যালোচনা না করতে পারলে কৃষকশ্রেণির সামূহিক জীবন ও তার মধ্যে অন্তর্লীন বিকাশের বীজ ও তাড়নার কিছুই বোঝা যাবে না। কৃষক জনতার মধ্যে প্রত্যেকটি জৈব বিকাশ একটা পর্যায় পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কান্বিত এবং তার উপর নির্ভরশীলও বটে।

নাগরিক বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপার আলাদা। যন্ত্রজীবী জনতার উপর কারখানার প্রযুক্তিবিদদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার নেই। বা বলা যায় যে এই পর্বটি পেরিয়ে আসা গেছে। বরং কখনও কখনও উল্টোটাই দেখা যায়। তখন যন্ত্রজীবী জনগণ তাঁদের মধ্য থেকে প্রসূত জৈব বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে প্রযুক্তিবিদদের উপরই রাজনৈতিক প্রভাব খাটান।

আসল প্রশ্নটা হল প্রত্যেক মৌল সামাজিক গোষ্ঠীর একটি জৈববর্গরূপে উদ্ভূত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এবং প্রথাগত একটি বর্গরূপে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রভেদ। এই প্রভেদ থেকেই বেরিয়ে আসে এমন অনেকগুলো সমস্যা ও সম্ভাব্য প্রশ্ন যা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয় হবার যোগ্য।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে দেখলে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে আধুনিক রাজনৈতিক দল ও তার যথার্থ উৎস, বিকাশ ও সম্ভাব্য নানা রূপের। বুদ্ধিজীবীদের সমস্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে রাজনৈতিক দলের চরিত্র কী দাঁড়াবে? কয়েকটি প্রভেদ আগেই চিহ্নিত করা যায় –

  • ১। কিছু সামাজিক গোষ্ঠী রাজনৈতিক দল তৈরি করে কেবলমাত্র তাদের নিজস্ব জৈব বুদ্ধিজীবীদের উৎপাদনী প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের সরাসরি রাজনৈতিক ও দার্শনিক ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেবার একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা হিসেবে। এইসব সামাজিক গোষ্ঠীর সাধারণ চারিত্র্য এবং তাদের গঠন, জীবন ও বিকাশ বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায় যে এই বুদ্ধিজীবীরা কেবলমাত্র এইভাবেই তৈরি হতে পারেন, অন্য কোনোভাবে তৈরি হয়ে ওঠা সম্ভবই নয়। (উৎপাদনী প্রয়োগের মধ্যে যে বর্গগুলো গঠিত হয় তারা সেনাবাহিনীতে এনসিওদের সমবর্গীয়, অর্থাৎ শহরে দক্ষ ও বিশেষ কর্মে দক্ষ শ্রমিকেরা এবং গ্রামে (আরো জটিল ভাবে) ভাগচাষি বা অন্যের জমিতে খাজনা দিয়ে কর্মরত কৃষিজীবীরা-কারণ সাধারণ বিচারে এই শ্রেণির কৃষিজীবীরা অনেকটা কারিগরদের সমবর্গীয়। কারিগরই মধ্যযুগীয় অর্থনীতিতে দক্ষ শ্রমিক।)
  • ২। রাজনৈতিক সমাজে রাষ্ট্র আরো সর্বাঙ্গীণভাবে ও ব্যাপকতর মাত্রায় যে ভূমিকা পালন করে থাকে, সকল সামাজিক গোষ্ঠীর পক্ষেই রাজনৈতিক দলগুলো জনসমাজে সেই ভূমিকাই পালন করে। অর্থাৎ কোনো গোষ্ঠীবিশেষের প্রধান গোষ্ঠীর—জৈব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের সুদৃঢ় সম্বন্ধবন্ধন রচনা রাজনৈতিক দলেরই দায়িত্ব। দল যখন এই ভূমিকা পালন করে, তখন সে পুরোপুরি নির্ভর করছে তার মূল দায়িত্বের উপর। এই দায়িত্ব বলতে তার নিজস্ব অঙ্গগুলোকে, অর্থাৎ কোনো সামাজিক গোষ্ঠীর সেই প্রতিভূদের যারা এক ‘অর্থনৈতিক’ গোষ্ঠী রূপে জন্মেছে ও বিকশিত হয়েছে, তাদের প্রসারিত করা এবং সুযোগ্য রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী তথা জনসমাজে ও রাজনৈতিক সমাজে একটি সুসংবদ্ধ সমাজের জৈব বিকাশে অন্তলীন যাবতীয় ক্রিয়াকর্মের নেতা (অগ্রগণ্য) ও সংগঠকে পরিণত করে তোলা। জোর দিয়েই বলা যায়, রাষ্ট্র স্পষ্টতই তার অনেকটা বৃহত্তর ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করে, রাজনৈতিক দল তার নিজস্ব ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা আরো সামগ্রিকভাবে ও জৈবভাবে পালন করে থাকে। একজন বুদ্ধিজীবী যখন কোনো বিশেষ সামাজিক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দলে যোগ দেন তখন তিনি ওই গোষ্ঠীর জৈব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে ওই গোষ্ঠীর সঙ্গে আরো সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রজীবনে সীমিত মাত্রায় যোগদানের মধ্য দিয়ে কিংবা কখনও তা ছাড়াই এই সম্পর্কবন্ধন স্থাপিত হয়। এমনও ঘটে যে অনেক বুদ্ধিজীবী ভেবে বসেন যে তাঁরাই রাষ্ট্র। যে-বর্গের বুদ্ধিজীবীরা এমন ভাবতে থাকেন, তা যদি যথেষ্ট লোকবলে বলীয়ান হয়, তবে এই ভাবনা থেকেই কখনও কখনও গুরুত্বপূর্ণ পরিণাম ঘটতে পারে। ফলে যে মৌল অর্থনৈতিক গোষ্ঠী যথার্থই রাষ্ট্র পদবাচ্য সেই গোষ্ঠীকেই অপ্রীতিকর জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়।

কোনো রাজনৈতিক দলের সব সদস্যকেই বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য করতে হবে এমন দাবি করলে তা স্বতঃই পরিহাস বা ব্যঙ্গের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। অথচ কথাটা একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে এর চেয়ে যথার্থ কিছু হতেই পারে না। বিভিন্ন স্তরের মধ্যে কিছু প্রভেদ অবশ্য করতেই হবে। কোনো দলের মধ্যে উচ্চতর বা নিম্নতর বর্গের মানুষের সংখ্যা বেশি বা কম হতেই পারে। তাতে কিছু আসে যায় না। তার ভূমিকারই আসলে যা কিছু গুরুত্ব। সেই ভূমিকা হবে নিয়ামক ও সাংগঠনিক, অর্থাৎ শিক্ষকোচিত তথা মননধর্মী। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কৃষিজীবীর স্বাভাবিক দাবির কিছু কিছু অংশ দলের মধ্যে চরিতার্থ হলেও কোনো ব্যবসায়ী ব্যবসা করার জন্য, কোনো শিল্পপতি আরো কম ব্যয়ে আরো বেশি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে বা কোনো কৃষিজীবী কৃষিকর্মের নতুন পদ্ধতি শিখবার জন্য রাজনৈতিক দলে যোগ দেন না; যদিও ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কৃষকের এই জাতীয় চাহিদার খানিকটা দল পুষ্ট করতে পারে। (জনমত এটা মানতেই চায় না। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, যে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বা কৃষিজীবী ‘রাজনৈতিক ধান্দাবাজি’তে নামে তার লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয় এবং তার নিজস্ব শ্রেণির মধ্যে সেই নিকৃষ্টতম। এই ধারণাটাই বিতর্কিত।)

ওই বিশেষ উদ্দেশ্যে সীমিত দায় পালনের জন্য রয়েছে বৃত্তিগত সংগঠন যার মধ্যে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, কৃষিজীবীর অর্থনৈতিক শ্রেণিগত ক্রিয়াকলাপ যথার্থ সমর্থনে পুষ্ট হয়। রাজনৈতিক দলের মধ্যে কোনো-একটি অর্থনৈতিক সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতিভূরা তাদের ঐতিহাসিক বিকাশের ওই বিশেষ মুহূর্তের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মাত্রার বৃহত্তর সর্বজনীন ক্রিয়াকর্মের ধারক হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে জৈব ও প্রথাগত বর্গের বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে বিকশিত হয়েছে এবং প্রত্যেক জাতির মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক গোষ্ঠী ও বিশেষত যে-সব গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে, তাদের বস্তুনির্ভর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ থেকেই রাজনৈতিক দলের এই ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের গঠন ঐতিহাসিক বিচারে এক অত্যন্ত মনোগ্রাহী সমস্যা। এই সমস্যার সঙ্গে নিঃসন্দেহেই সম্পর্ক রয়েছে ক্ল্যাসিকাল যুগে দাসপ্রথার এবং রোমক সাম্রাজ্যের সামাজিক বিন্যাসে গ্রিক বা প্রাচ্যদেশজাত দাসত্বমুক্ত সম্প্রদায়ের অবস্থানের। প্রজাতন্ত্রী আমল ও সাম্রাজিক আমলের মধ্যে (অভিজাত সম্প্রদায়গত থেকে গণতান্ত্রিক-আমলাতান্ত্রিক শাসনে রূপান্তর) রোমে বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক স্থিতির যে পরিবর্তন ঘটে তার উদ্যোগ সীজার-এর। তিনি চিকিৎসকদের ও মানবিকী বিদ্যার বিদ্বানদের নাগরিকত্ব দান করেন যাতে তাঁরা রোমে বাস করতে আগ্রহী হন এবং তাঁদের দেখে অন্যেরাও সেখানে আসতে প্রণোদিত হয় (দ্র. সুয়েতোনিয়স, ‘সীজার জীবনী’, ৪২ অধ্যায়)। সীজার প্রস্তাব করেন –

  • ১। রোমে যেসব বুদ্ধিজীবী ইতোমধ্যেই বসবাস করছেন, তাঁদের রোমে পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠা করে এক স্থায়ী বুদ্ধিজীবী বর্গ সৃষ্টি করা হোক, কারণ তাঁরা এখানে স্থায়ী অধিবাসী না হলে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করা যাবে না; এবং
  • ২। সারা রোমক সাম্রাজ্য থেকে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের রোমে আকৃষ্ট করা হোক যাতে ব্যাপক মাত্রায় কেন্দ্রীয় প্রবণতা বাড়ানো যায়। এইভাবেই রোমে ‘সাম্রাজ্যিক’ বুদ্ধিজীবীদের যে বর্গের পত্তন হয়, সেই ধারাতেই আসে ক্যাথলিক পুরোহিত বর্গ। তার বহু প্রভাবচিহ্ন থেকে যায় ইতালীয় বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাসে যেমন ধরা যায় অষ্টাদশ শতাব্দি পর্যন্ত অব্যাহত তাঁদের বিশিষ্ট বিশ্বজনীনতা’।

বুদ্ধিজীবীদের বিরাট অংশের সঙ্গে রোমক সাম্রাজ্যের প্রধান শ্রেণির এই যে সামাজিক, দেশীয় ও জাতীয় বিভেদ তারই পুনরাবৃত্তি দেখা যায় রোমক সাম্রাজ্যের পতনের পর জর্মানীয় যোদ্ধৃকুলের সঙ্গে (দাসত্বমুক্ত বর্গের উত্তরসূরি) রোমক জাতির মধ্যে জাত বুদ্ধিজীবীদের ব্যবধানে। এই ব্যাপারের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ক্যাথলিকদের জন্ম ও বিকাশ। এরই মধ্যে থেকে যে ধর্মসংগঠন গড়ে ওঠে তা বহু শতাব্দি ধরে মননধর্মী ক্রিয়াকলাপের একটি বিরাট অংশই ধারণ করে থাকে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এমন এক একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করে যার বিরোধিতা করবার বা যাকে কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলেই যে-কেউ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হতেন। ইতালিতে এই উপদ্বীপের বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বজনীন ভূমিকার যে পরিচয় আমরা পেয়েছি কালভেদে তার তীব্রতার তারতম্য ঘটেছে। এবার আমি দৃষ্টি ফেরাব আরো গুরুত্বপূর্ণ অন্য কয়েকটি দেশের দিকে যেখানে বুদ্ধিজীবীদের বিকাশে অন্যবিধ লক্ষণ সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যাবে। অবশ্য এই সতর্কবাণীও উচ্চারণ করে রাখছি যে এই বিচার আরো গভীরভাবে পরীক্ষা ও সুসংযত করার সুযোগ রয়েছে।

ইতালির ক্ষেত্রে মূল কথাই হল তার বুদ্ধিজীবীদের এই আন্তর্জাতিক বা বিশ্বজনীন ভূমিকা যা একাধারেই রোমক সাম্রাজ্যের পতন থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপ্ত ইতালির বিপর্যস্ত দশার কারণ ও পরিণাম।

ফ্রান্স-এ দেখা যায় একটি জাতির অন্তর্নিহিত যাবতীয় শক্তির এবং বিশেষভাবেই তার মননধর্মী ক্ষেত্রগুলোর সুষম বিকাশের একটি পরিণত দৃষ্টান্ত। ১৭৮৯ সালে যখন একটি নতুন সামাজিক গোষ্ঠী ইতিহাসের জমিতে তার রাজনৈতিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করে, তখনই সেই গোষ্ঠী তার সামাজিক ভূমিকা গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং স্বভাবতই সমগ্র জাতির উপর সর্বাঙ্গীণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমে পড়তেও পারঙ্গম। পুরনো শ্রেণিগুলোর সঙ্গে কোনো মৌল প্রশ্নে আপোস করার দায় তাকে নিতে হয় না, বরং তার নিজস্ব লক্ষ্য সাধনে তাদেরই সে তার ক্ষমতায় বশীভূত করতে পারে। এই নতুন শ্রেণির প্রথম অর্থনৈতিক অনুসংগঠনগুলোর সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রথম বুদ্ধিজীবী অনুসংগঠনগুলোও আবির্ভূত হয়। তার প্রভাব পড়ে ধর্মসংগঠনের উপরেও—যা ধরা পড়ে গ্যালিকানইজম্-এর মধ্যে, রাষ্ট্র ও ধর্মসংঘের মধ্যে অকালপরিণত লড়াইয়ের মধ্যে। এই বিপুল মননধর্মী কাঠামো থেকেই অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ফ্রান্স-এ সংস্কৃতির ভূমিকার চারিত্র্য বোঝা যায়। এই ভূমিকা ছিল একদিকে আন্তর্জাতিক তথা বিশ্বজনীন বহির্মুখী বিকিরণের, অন্যদিকে জৈব পদ্ধতিতে সাম্রাজ্যিক ও আধিপত্যকামী প্রসারণের। ফলে এই ভূমিকা ইতালীয় অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতালীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তি ছিল বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত পরিমানের উপর, ফলে জাতীয় ভিত্তি থেকে প্রতিক্রিয়া আহরণ করে তাতে শক্তি সঞ্চার করতে তাঁরা সমর্থ হননি। বরং তাঁরা একটি শক্তপোক্ত জাতীয় ভিত্তি নির্মাণের সম্ভাবনাকেই বিনষ্ট করতে মদত জুগিয়েছেন।

ইংলন্ডের বিকাশ ফ্রান্স থেকে খুবই আলাদা রকমের। আধুনিক শিল্পব্যবস্থার ভিতের উপর যে নতুন সামাজিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তার লক্ষণীয় অর্থনৈতিক সাংগঠনিক বিকাশ ঘটলেও বৌদ্ধিক রাজনৈতিক স্তরে তার অগ্রগতি থেকে যায় অনিশ্চিত অনির্দেশ্য। এখানে জৈব বুদ্ধিজীবীদের এক বিশাল সম্প্রদায় দেখা যায় যারা অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে একই শিল্পভূমিতে আবির্ভূত হয়। কিন্তু উচ্চতর স্তরে দেখা যায়, পুরনো ভূম্যধিকারী শ্রেণিই কার্যত একচেটিয়া ক্ষমতার আসনে বহাল রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রাধান্য হারিয়েও তারা বহুদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক-বৌদ্ধিক প্রাধান্য রক্ষা করে যায়, ‘প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এবং নতুন ক্ষমতাসীনদের দৃষ্টিতে অগ্রগণ্য (‘দিরিজেনৃতে) গোষ্ঠী বলে গণ্য হয়। অন্য দেশে যে ধরনের সূত্রে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা নতুন প্রধান শ্রেণিগুলোর সঙ্গে যুক্ত হন, ঠিক সেই রকম সূত্রেই এখানে পুরনো ভূম্যধিকারী অভিজাত সম্প্রদায় শিল্পপতিদের সঙ্গে যুক্ত হয়।

ইংলন্ডের এই ঘটনা-পরম্পরা জর্মনিতেও দেখা যায়, সেখানে অবশ্য অন্য কিছু ঐতিহাসিক ও প্রথাগত ব্যাপার জটিলতা সৃষ্টি করে। ইতালির মতো জর্মনিও ছিল একটি অতিজাতিক প্রতিষ্ঠান ও ভাবাদর্শের পীঠস্থান। জর্মন জাতির পবিত্র রোমক সাম্রাজ্য নামে পরিচিত এই মধ্যযুগীয় বিশ্বরাষ্ট্রের চালনার জন্য বিশেষ সংখ্যক কর্মী জোগাতে গিয়ে জর্মনি তার নিজস্ব শক্তিক্ষয় করেছে এবং এমন সংঘাতের জন্ম দিয়েছে যাতে জাতীয় সংহতির সমস্যাগুলোতে হাত দেওয়ার অবকাশ মেলেনি; ফলত মধ্যযুগের ভৌগলিক বিশৃঙ্খলা অব্যাহত রয়ে গেছে। শিল্পবিকাশ ঘটেছে এক আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যা ১৯১৮-র নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ইংলন্ডে অনুরূপ অবস্থানের গোষ্ঠীর চেয়ে জর্মনিতে ইয়ুংকার-রা আরো সুদৃঢ় রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক প্রাধান্য কায়েম রেখেছে। তারাই ছিল জর্মন শিল্পপতিদের প্রথাগত বুদ্ধিজীবী। কিন্তু তাদের ছিল বিশেষ কিছু অধিকার এবং এক স্বাধীন সামাজিক গোষ্ঠীর প্রবল বোধ। এই বোধের ভিত্তি ছিল জমির উপর তাদের সমধিক অর্থনৈতিক ক্ষমতা যা ইংলন্ডের চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনক্ষম’ ছিল। প্রুশিয়ার ইয়ুংকার-রা ছিল একাধারে পুরোহিত ও সামরিক একটি গোত্রস্বরূপ। রাজনৈতিক সমাজে নিয়ামক-সাংগঠনিক ভূমিকায় তাদের যেমন কার্যত একচেটিয়া অধিকার ছিল, তেমনই ছিল নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তি; ফলে প্রধান অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর দাক্ষিণ্যের উপর তাদের সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হত না। উপরন্তু ইংলন্ডের ভূম্যধিকারী অভিজাততন্ত্রের থেকে ইয়ুংকারদের আরেকটি পার্থক্য ছিল, তারা ছিল একটি বিশাল স্থায়ী সামরিক বাহিনীর অফিসার শ্রেণি, ফলে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক অতি পোক্ত সাংগঠনিক ক্যাডার শ্রেণি যারা তাদের অভ্যন্তরীণ শ্রেণিবোধ ও তাদের একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষায় সহায় ছিল। (ম্যাক্স ভেবার-এর ‘জর্মনিতে নয়া জমানায় পার্লামেন্ট ও সরকার’ নামে বইতে কিছু উপাদান পাওয়া যায় যাতে দেখা যায় অভিজাত বর্গের একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা কীভাবে বুর্জোয়া রাজনৈতিক কর্মীদের এক ব্যাপক ও অভিজ্ঞ শ্রেণির সম্প্রসারণকে ব্যাহত করেছে এবং কীভাবে ক্রমাগত পার্লামেন্টের সংকট ও উদারপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহের ভাঙনের মূলে তা কাজ করে চলেছে। এই কারণেই ক্যাথলিক কেন্দ্র ও সোশাল ডেমক্রাসি নিজেদের পার্লামেন্টারি ও নিয়ামক স্তর ইত্যাদি গড়ে তুলতে অনেক দূর পর্যন্ত সফল হয়েছিল।)

রুশ দেশে দেখে গেছে বিভিন্ন লক্ষণ। নরম্যান (ভ্যারানজিয়ান)-রা এখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবসায়িক সংগঠন সৃষ্টি করে ; বাইজ্যানটাইন গ্রিকেরা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সংগঠন। পরবর্তীকালে জর্মনরা ও ফরাসিরা রুশ দেশে ইয়োরোপীয় অভিজ্ঞতা বয়ে আনে এবং রুশ ইতিহাসের প্রোটোপ্ল্যাজমকে প্রথম সুসমন্বিত এক কাঠামো দেয়। জাতির নিজস্ব শক্তি তখন নির্জীব, নিষ্ক্রিয়, কিন্তু গ্রহণে আগ্রহী; বোধ হয় সেই কারণেই এই জাতি বিদেশি প্রভাবসমূহ এবং বিদেশিদেরও সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে নেয়, তাদের সম্পূর্ণ রুশ করে নেয়। ইতিহাসে আরো সাম্প্রতিককালে কিন্তু উল্টো ব্যাপারটাই দেখা গেছে। সমাজের সবচেয়ে সক্রিয়, তাজা, উদ্যোগী ও সুশৃঙ্খল ব্যক্তিদের একাংশকে নিয়ে গঠিত এক এলিট শ্রেণি বিদেশে চলে গিয়ে পশ্চিমের সবচেয়ে অগ্রগামী দেশগুলোর সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা আত্মস্থ করে ফেলে, অথচ তাদের নিজেদের জাতীয় চরিত্রের মৌল লক্ষণগুলো অটুট রাখে, নিজেদের স্বজাতীয়দের সঙ্গে আবেগ ও ইতিহাসের যোগসূত্রগুলো অক্ষুণ্ণ রাখে। অথচ বৌদ্ধিক শিক্ষানবিশি সম্পূর্ণ করে তারা স্বদেশে ফিরে এসে জনসাধারণকে জোর করে জাগিয়ে তোলে, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ এইভাবে তারা টপকে যেতে পারে। জর্মনি থেকে আমদানি করা এলিট (যেমন আমদানি করেছিলেন রুশ দেশের মহান পিটার) থেকে এই এলিটের পার্থক্য এদের মূলত জাতীয় জনপ্রিয় চারিত্র্য। রুশ জনসাধারণের নির্জীব অক্রিয়তা এই শ্রেণিকে গ্রাস করে নিতে পারেনি, কারণ এই শ্রেণি ছিল রুশ দেশের নিজের ঐতিহাসিক নির্জীবতার বিরুদ্ধে তার সবল প্রতিক্রিয়ার প্রতিমূর্তি।

আরেক ভৌগোলিক ক্ষেত্রে, একেবারেই ভিন্ন স্থান-কালের পরিবেশে রুশ ঘটনাপরম্পরার তুল্য ব্যাপার লক্ষ করা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিন জাতির উন্মেষের ইতিহাসে। যে অ্যাংলো-স্যাক্সন সম্প্রদায় ইংলন্ড থেকে এখানে এসে বসতি করেন তাঁরা নিজেরাই ছিলেন এক বুদ্ধিজীবী এলিট; শুধু বুদ্ধিজীবী নয়, বরং আরো বিশেষ ভাবেই এক নীতিসচেতন এলিট। আমি বলছি স্বভাবতই সেই প্রথম অভিবাসীদের কথা, সেই অগ্রগামী শ্রেণির কথা, যাঁরা ইংলভে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগ্রামের পুরোভাগে থেকে পরাভূত হয়েছিলেন কিন্তু স্বদেশে আত্মবমাননা বা হীনতা মেনে নেননি। নিজেদের নৈতিক বল ও প্রবল ইচ্ছাশক্তির সঙ্গেই তাঁরা আমেরিকায় নিয়ে এসেছিলেন এক বিশেষ জনের সভ্যতা, ইয়োরোপের ঐতিহাসিক বিকাশের একটি বিশেষ স্তর। আমেরিকার অনাবাদী মাটিতে এই রকম মানুষেরা যখন তা বপন করলেন, তখন থেকেই তা তার অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোকে বিকশিত করে চলেছে। এখানকার বিকাশ তাই পুরনো ইয়োরোপের ভুলনায় অনেক দ্রুত। কারণ ইয়োরোপে রয়েছে একরাশ প্রতিবন্ধক (নৈতিক, বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা জনসাধারণের বিশেষ বিশেষ অংশের মধ্যে জমাট বেঁধে রয়েছে, অতীত শাসনের সেই সব চিহ্ন যা কিছুতেই মরতে চায় না), যা দ্রুত অগ্রগতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেই এবং উদ্যোগকে এনে দাঁড় করাবেই মাঝারিপনার ভারসাম্যে যাতে তার শক্তি স্থানকালের আবহে নিঃশেষিত হয়ে যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের অপ্রতুলতা। ফলে সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যায় অন্য ধরনের একটা ভারসাম্য। একটা শিল্পনির্ভর ভিত্তির উপরে এখানে আধুনিক উপরিকাঠামোগুলোর সমগ্র ক্ষেত্রের বিপুল বিকাশ ঘটেছে। জৈব বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের মেলবন্ধন ঘটাবার তাগিদ থেকে ভারসাম্য রচনার আবশ্যকতা নির্ধারিত হয় না। বরং একক সংস্কৃতির এক জাতীয় ক্রুসিবল-এ বিভিন্ন জাতীয় অভিবাসীদের বয়ে আনা নানা ধরনের সংস্কৃতিকে গলিয়ে এক করে দেবার তাগিদেই ভারসাম্য সৃষ্টির তাগিদ নির্ধারিত হয়। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসসমৃদ্ধ দেশগুলোতে প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের যে ব্যাপক পলল দেখা যায় তার অবর্তমানেই দুটি মাত্র মুখ্য রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বের অন্তত আংশিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বস্তুত এই দুটি দলকে কমিয়ে একটাও করা যায়। (এর সঙ্গে ফ্রান্স-এর পরিস্থিতির তফাৎ লক্ষ করুন; কেবলমাত্র যুদ্ধোত্তর পর্বেই নয়, যদিও তখন বহুসংখ্যক দলের অস্তিত্বই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল)। উল্টো দিকে ধর্মীয় অনুগোষ্ঠির বিপুল সংখ্যার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় এই একই তথ্যে। (আমার ধারণা, দুশোরও বেশি এমনি উপদলের হিসেব পাওয়া গেছে। আবার তুলনা করে দেখা যায় ফ্রান্স-এর ঘটনাপরম্পরার সঙ্গে, যেখানে ফরাসি জনসাধারণের ধর্মীয় ও নৈতিক সংহতি বজায় রাখার জন্য প্রবল সংগ্রাম চলে।)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরো একটি ব্যাপার প্রণিধানযোগ্য। এই ব্যাপারটি হল বিস্ময়কর হারে এমন নিগ্রো বুদ্ধিজীবীদের গঠন যারা মার্কিন সংস্কৃতি ও প্রযুক্তিবিজ্ঞান আত্মস্থ করে নেন। এই নিগ্রো বুদ্ধিজীবীরা আফ্রিকার পশ্চাৎপদ জনগণের উপর কী অপ্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে পারেন, তা মাথায় রাখা উচিত। বস্তুত নিম্নোক্ত সম্ভাবনাগুলোর যেকোনো একটি কখনও বাস্তব হয়ে উঠলে ওই প্রভাব প্রত্যক্ষও হয়ে উঠতে পারে :

  • (১) যদি মার্কিন সম্প্রসারণবাদ আফ্রিকার বাজার দখল ও মার্কিন সভ্যতা বিস্তারের (এই রকম একটা কিছু ইতোমধ্যেই ঘটেছে, তা কত দূর পর্যন্ত গেছে তা আমার জানা নেই) অভিযানে মার্কিন নিগ্রোদের তার প্রবক্তা হিসেবে ব্যবহার করে;
  • (২) যদি মার্কিন জাতির ঐক্য সাধনের সংগ্রাম এমনভাবে তীব্র হয়ে ওঠে যাতে নিগ্রোদের মধ্যে সবচেয়ে স্বাধীনচেতা ও বলবান বুদ্ধিজীবীরা দেশ ত্যাগ করে আফ্রিকায় ফিরে যেতে বাধ্য হন; কারণ বর্তমানে প্রচলিত ব্যাপক সামাজিক বিধির চেয়েও অবমাননাকর কোনো সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আইন মেনে নিতে এঁরাই সবচেয়ে পরাঙ্মুখ হবেন। এই ব্যাপারটি যদি ঘটে যায় তা থেকে দুটি মৌল প্রশ্ন উঠে আসবে :
    • (১) ভাষাগত: ইংরেজি কি তখন আফ্রিকার শিক্ষিত মানুষের ভাষা হয়ে উঠে বর্তমানের বিপুলসংখ্যক উপভাষার ভিড়ের মধ্যে ঐক্য বিধান করতে পারবে?
    • (২) আফ্রিকী জাতিসমূহের মধ্যে অবজ্ঞাত জাতিরূপে গণ্য বলে যে প্রাচীন গ্লানিবোধ বর্তমান, তা থেকে তাঁদের মধ্যে এমন এক ‘জাতীয়’ ভাবের সৃষ্টি করা যাতে আফ্রিকা মহাদেশ সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ জাতির আদি পিতৃভূমির এক পুরাণোপম মর্যাদা লাভ করে—এই রূপান্তর ঘটাবার মতো যথেষ্ট সাঙ্গীকরণ ও সংগঠনের ক্ষমতা কি এই বুদ্ধিজীবী বর্গের আয়ত্ত?

আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে মার্কিন নিগ্রোদের মধ্যে যে জাতীয়তাবোধ বা জাতিকূলবোধ দেখা যাচ্ছে তা সদর্থক নয়, নঞর্থক, তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে হতাশায় নিমজ্জিত করার জন্য শ্বেতাঙ্গরা যে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, তারই প্রতিক্রিয়া মাত্র। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দি পর্যন্ত এবং তারপরও ওই গোটা শতাব্দি জুড়ে ইহুদিদেরও কি ওই একই অবস্থায় থাকতে হয়নি? লাইবেরিয়া ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ মার্কিনি বনে গেছে, ইংরেজিই তার সরকারি ভাষা। এই লাইবেরিয়াই হয়ে উঠতে পারে মার্কিন নিগ্রোদের জাইঅন, এক আফ্রিকি পিডমন্ট প্রতিষ্ঠার পথে পদক্ষেপ।

মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্ন বিবেচনা করতে গেলে আমার মনে হয় কয়েকটি মৌলিক ব্যাপার মনে রাখতে হবে। মধ্য বা দক্ষিণ আমেরিকাতেও প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের কোনো বিপুল সমাবেশ নেই, কিন্তু প্রশ্নটি এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো চরিত্র নিয়ে দেখা দেয় না। বস্তুত এই সমস্ত দেশে এই বিকাশের মূলে আমরা যা দেখি তা হল, কাউনটাররিফর্মেশন ও সামরিক পরজীবীতন্ত্রের পরিণামে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দিতে স্পেনীয় ও পর্তুগিজ সভ্যতা যে ধরন লাভ করেছিল, তাই এই দেশগুলোতে যে দুটি সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের চাপ প্রতিহত করে অদ্যাবধি টিকে রয়েছে তারা হল পুরোহিত শ্রেণি ও সামরিক শ্রেণি। এই দুই বৰ্গই প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণি বলে গণ্য হবে, ইয়োরোপীয় উৎসভূমি থেকে যে আকারে তারা এসে পৌঁছেছিল, সেই আকারেই তারা প্রস্তরীভূত হয়ে রয়ে গেছে। এই দেশগুলোতে শিল্পের ভিত্তি খুবই সংকীর্ণ। সেই ভিত্তি থেকে কোনো জটিল উপরিকাঠামোও গড়ে ওঠেনি। এখানে বুদ্ধিজীবীদের বৃহদংশই গ্রামীণ বর্গের, এবং যেহেতু এখানে এক-একটি বিশাল জমিদারি সম্পত্তিরই প্রাধান্য এবং ধর্মসংঘের আয়ত্তে রয়েছে বিপুল সম্পত্তি তাই স্বভাবতই এই বুদ্ধিজীবীদের ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে পুরোহিত শ্রেণি ও বড় ভূম্যধিকারীদের সঙ্গে। শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির মধ্যেও জাতিগত বিন্যাস অত্যন্ত অসম্বন্ধ। এই পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছে বিপুলসংখ্যক ইন্ডিয়ান জাতিভুক্ত অধিবাসীর উপস্থিতি; কোনো কোনো দেশে এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। বলা যায়, আমেরিকা মহাদেশের এই অঞ্চলগুলোতে এখনও কুলটুরকমপফ ও দ্রেইফাস মামলার সময়কার পরিস্থিতি রয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ এমন একটা অবস্থা যাতে ধর্মনিরপেক্ষ বুর্জোয়া অংশ এখনও সেই স্তরে পৌঁছয়নি যেখানে পৌঁছলে আধুনিক রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির শক্তি প্রয়োগ করে তারা পুরোহিততন্ত্রের ও সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রভাব ও স্বার্থকে খর্ব করতে পারে। ফলে ফ্রীমেসন সম্প্রদায় ও পজিটিভিস্ট চার্চ-এর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ জেসুইটবাদের বিরুদ্ধতায় প্রবল প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মেক্সিকোয় কালেসের কুলটুরকামপফ থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পেরু, চিলি ও বলিভিয়া প্রভৃতি দেশে খুবই সাম্প্রতিক কালে যা ঘটেছে তা থেকে এই সিদ্ধান্তের যাথার্থ্য প্রমাণ হয়ে যায়।

বুদ্ধিজীবীদের অন্য ধরনের বর্গের গঠন ও জাতীয় শক্তিসমূহের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অন্যতর বিন্যাস দেখা যায় ভারত, চীন ও জাপানে। জাপানে আছে ইংলন্ডের ও জর্মনির ধাঁচের বিন্যাস; অর্থাৎ এমন এক শিল্পনির্ভর সভ্যতা যা অভ্রান্তভাবেই স্বকীয় সব লক্ষণ সমন্বিত এক সামন্ততান্ত্রিক আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বিকাশ লাভ করে।

চীনে আছে লিপি—যা আসলে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও জনসাধারণের মধ্যে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের দ্যোতক। ভারত ও চীন, দুই দেশেই বুদ্ধিজীবী সমাজ ও জনগণের মধ্যে দুস্তর বিচ্ছেদের প্রকাশ দেখা যায় ধর্মের ক্ষেত্রেও। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকমের বিশ্বাস এবং একই ধর্ম ঘিরে বিভিন্ন ধারণা ও আচারবিধি এবং বিশেষত তারই ভিত্তিতে পুরোহিত শ্রেণি, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠা বিভাজন নিয়ে গবেষণা করা দরকার, কারণ এই ব্যাপারটি সর্বত্রই খানিকটা ঘটে থাকে; কিন্তু পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেই এই ব্যাপারটি তার চরম রূপ পরিগ্রহ করে। প্রটেস্টান্ট দেশগুলোতে এই বিভাজন অপেক্ষাকৃত কম (জনগণের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের নিখুঁত জোড় রচনার তাগিদেই ধর্মীয় উপদলের ছড়াছড়ি, ফলে জনগণের প্রাত্যহিক ধ্যানধারণার যাবতীয় স্থূলতা উচ্চতর সাংগঠনিক পরিমণ্ডলে প্রতিফলিত হয়)। এই বিভাজন ব্যাপারটি ক্যাথলিক দেশগুলোতেই বেশি লক্ষণীয়, যদিও তার মাত্রার তারতম্য আছে। জর্মনি ও ফ্রান্সের ক্যাথলিক অঞ্চলগুলোতে এই প্রবণতা কম; ইতালিতে অপেক্ষাকৃত বেশি, বিশেষত দক্ষিণাংশে এবং দ্বীপগুলোতে; এবং খুবই বেশি আইবেরীয় উপদ্বীপে ও দ্বীপপুঞ্জে। অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের দেশগুলোতে এই প্রবণতার মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী; সেখানে একই ধর্মের তিনটি পৃথক ধাপের কথা এসে পড়ে; উচ্চতর পুরোহিত শ্রেণি ও সন্ন্যাসীরা, ধর্মসংঘ-বহির্ভূত পুরোহিত শ্রেণি এবং জনসাধারণ। এই প্রবণতা পূর্ব এশিয়ায় এক ধরনের অসারতায় পর্যবসিত হয় যখন জনসাধারণের আচরিত ধর্মের সঙ্গে প্রায়শই বইতে লিপিবদ্ধ ধর্মের কোনো সম্পর্কই থাকে না, যদিও দুই-ই একই ধর্মের নামে চিহ্নিত হয়।

সূত্র : বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষা, আনতোনিও গ্রামসি, পার্ল পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০১

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.