বাংলায় ইসলাম প্রচারে পীরদের সাফল্য ব্যাখায় অসীম রায় ও রিচার্ড এম. ইটনের তত্ত্ব ও দুর্বলতা

(লেখাটি আকবর আলী খান এর “বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ” গ্রন্থটির অবলম্বনে লেখা। তার অতিরিক্ত হিসেবে লেখাটিতে ইংরেজি উদ্ধৃতির বঙ্গানুবাদ, তথ্যসূত্রসমূহের অন্তর্ভূক্তকরণ, সাজানো ও কিছু এডিটিং করা হয়েছে।) 

ভূমিকা

ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিকদের মধ্যে এ বিষয়ে প্রায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে পীরদের ঐকান্তিক উদ্যোগই বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠা করেছে। অনুরূপভাবে ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ থেকে দেখা যাচ্ছে যে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্রই মুসলিম ধর্ম-প্রচারকেরা ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন। তবে অঞ্চলভেদে এসব পীর-দরবেশের উদ্যোগের সাফল্যের তারতম্য ঘটেছিল। ফলে প্রশ্ন দাড়ায়, দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে মুসলমান পীর-দরবেশদের ধর্মান্তরকরণ-উদ্যোগের ব্যর্থতা সত্ত্বেও বাংলায় তারা কেন তুলনামূলক সাফল্য লাভ করেছিলেন। আধ্যাত্মিক সাধনায় সাফল্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশের পীরগণ কোনােক্রমেই বাংলার পীরদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের ছিলেন না। অবিসংবাদিত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, বাংলায় পীরদের সাফল্যের কারণ তাদের আধিক্য, অধ্যবসায় বা দক্ষতা নয়; বরং ধর্মান্তরকরণের জন্য উপযােগী পরিবেশ-পরিস্থিতিই তাদের সাফল্যের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

সম্প্রতি ঐতিহাসিকগণ অনুধাবন করতে পেরেছেন যে পীরদের দ্বারা বাংলায় ইসলাম প্রচারিত হয়েছে—এ কথা প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট নয়। বাংলায় পীরেরা এত মানুষজনকে ধর্মান্তরের জন্য কেন আকৃষ্ট করতে পারল, অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশের অধিবাসীরা পীরদের বাণী কেন গ্রহণ করল না, তা ব্যাখ্যা করাও জরুরি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলার পীরদের অনন্যতা ব্যাখ্যা করার প্রয়ােজন রয়েছে।

অসীম রায়ের তত্ত্ব

তত্ত্বের মূল বক্তব্য

আক্ষরিক অর্থে পীর হচ্ছে ভবত্রিক পরিচালক বা পথপ্রদর্শক। পীর-প্রতিষ্ঠান কোনােক্রমেই বাংলার ক্ষেত্রে অনন্য নয়। রায়ের বক্তব্য হলাে যদিও বাংলার পীর এবং ভারতের নান্যান্য অঞ্চলের পীরদের মধ্যে কোনাে তফাত ছিল না তবু বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশে পীরদের যে ভূমিকা ছিল, সে ধরনের ভূমিকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে ছিল না। তার মতে, বাংলায় পীরদের তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

  • ১। বাংলায় পীরের সংজ্ঞা ব্যাপক। পীর বলতে ভারতে সর্বত্র আধ্যাত্মিক মরশিদ বা ফকির-দরবেশ বােঝায়। কিন্তু বাংলায় শুধু ফকির-দরবেশরাই পীর নন; দেবতার পর্যায়ে উন্নীত সৈনিক, অনাবাদি এলাকায় অগ্রণী বসতকার, রূপান্তরিত হিন্দুু ও বৌদ্ধ দেবতাদেরও বাংলার পীর হিসেবে পূজা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে জড় পদার্থে আত্মা আরােপ করে, এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে জড়কে পীররূপে পূজা করা হয় অলৌকিক ও বিস্ময়কর ক্ষমতার কারণে এদের শ্রদ্ধা-ভক্তি করা হয়।
  • ২। বাংলায় পীর প্রতিষ্ঠান লােক-ধর্মের সংমিশ্রণ প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ফলে বাংলায় পীরবাদ অনন্য ও স্থানিক হয়ে উঠেছিল। ব্যাঘ্র দেবতা, সর্প দেবী, কুমির দেবীর মতাে দেবত্ব লাভকারী প্রাণবাদী আত্মাকে বাংলায় গীরের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভত করা হয়েছিল। বাংলার হিন্দু ও মুসলমান লােকসাহিত্যে গাজী মিঞা, তার সহযােগী কালু ও তার প্রতিপক্ষ দক্ষিণা রায়ের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেখা যায়। সাধারণ লােকের বিশ্বাস ছিল যে গাজী মিঞার দক্ষিণা রায়ের ব্যাঘ, কুমিরের ওপর প্রভাব ছিল। হজরত শাহজালাল (র.) এবং তার ৩৩০ জন শাগরেদ যারা শ্রীহট্টের জলাভূমিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন তাদেরও অনুরূপ ক্ষমতা ছিল।
  • ৩। বাংলায় অস্থিতিশীল সমাজে পীরগণ সংঘবদ্ধকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। রায়ের ভাষায়, “প্রকৃতির হিংস্রতা এবং সক্রিয় বদ্বীপে নৈরাজ্যমূলক অবস্থা, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রতুলতার অবস্থার দ্বারা তীব্র, মূলত অস্থিতিশীল শারীরিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ব, স্থিতিশীলতা এবং আশ্বাসের কিছু বাধ্যবাধকতা বলের (binding force) মারাত্মক প্রয়োজনের উপর মনোনিবেশ করেছিল।” (অনুদিত, পৃ. ৫০)

প্রতিদিনের দুঃখ-দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার জন্য পীরদের আধ্যাত্মিক পরামর্শের প্রয়ােজন ছিল বাংলার সুবিধাবঞ্চিত মানুষজনের। তিনি ইঙ্গিত করেছেন যে নিম্ন বাংলায় সামাজিকভাবে অবহেলিত জনগােষ্ঠীর লােকজন যে দলে দলে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে তার কারণ হলাে পীরবাদ তাদের আধ্যাত্মিক প্রয়ােজন মিটিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে অসীম রায়ের আরও দুটি বক্তব্য প্রণিধানযােগ্য।

  • ১। রায় মনে করেন বাংলা অঞ্চলে ধর্মান্তর ধe প্রণােদনায় ঘটেনি। তিনি লিখেছেন, “এই অঞ্চলে ধর্মান্তর আধ্যাত্মিকের চেয়ে সামাজিক পরিভাষায় বেশি অর্থবহ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাৎক্ষণিক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা খুব কমই ধর্মান্তরের সাথে জড়িত ছিল, এবং এর অর্থ ছিল অভ্যন্তরীণ জীবনের আচরণের চেয়ে ফেলোশিপের অধিকতর পরিবর্তন- যদিও সেই আভ্যন্তরীন জীবনের আচরণের পরে সময়ের সাথে ঘটতে পারে। ধর্মান্তরিতরা একটি নতুন সামাজিক দলে যোগ দেয় যা মূলত আন্তঃবিবাহ, আন্তঃ-খাদ্যগ্রহণ এবং আংশিক আচার পালনের সীমার ভিত্তিতে তাদের পরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করে।” (অনুদিত, পৃ. ৩৮-৩৯)। যেহেতু ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরে কোনাে আধ্যাত্মিক প্রণােদনার প্রয়ােজন ছিল না, সেহেতু ইসলাম ধর্ম গ্রহণে হিন্দুদের মধ্যে কোনাে বাধা ছিল না।
  • ২। অসীম রায় মনে করেন যে এত বিপুলসংখ্যক হিন্দুর ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া ব্যক্তিক পর্যায়ে ঘটেনি। ব্যক্তিক পর্যায়ে ধর্মান্তরের জন্য অনেক সময়ের প্রয়ােজন। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছে গণধর্মান্তর। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “এই ধরনের বিচ্ছিন্ন এবং স্বতন্ত্র ধর্মান্তরণ অবশ্য বাংলার মুসলমানদের, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ইসলামের প্রাধান্যের জন্য পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এর জন্য গণরূপান্তরের ঘটনা এবং এর সামাজিক প্রেক্ষাপটের দিকে ফিরে যেতে হবে।” (অনুদিত, পৃ. ৪২)।

তত্ত্বের দুর্বলতা

অসীম রায়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তিনটি প্রধান দুর্বলতা রয়েছে –

  • ১। অসীম রায় বাংলায় পীরবাদের অনন্যতাকে অতিরঞ্জিত করেছেন। পীরবাদের মূল বৈশিষ্ট্য বাংলা বা ভারতের অন্যান্য অংশের মুসলমানদের কাছে অপরিচিত নয়। মারে টি. টাইটাস তার Islam in India and Pakistan (1959) গ্রন্থে বলছেন, প্রাচীনকালের গুরু-চেলা সম্পর্ক এবং স্থানীয় দেব-দেবীতে সর্বজনীন বিশ্বাস হিন্দুধর্মের অপরিহার্য উপাদান। (পৃ. ১৩৭)। মুসলমানদের মধ্যে পীরবাদের চল দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষণীয়ভাবে সমধর্মী। বাংলার কোনাে কোনাে কিংবদন্তি-পীরকে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশেও সমভাবে শ্রদ্ধা-ভক্তির চোখে দেখা হয়। এইচ. এ. রোজ তার Religious History of Islam গ্রন্থে বলছেন, উত্তর ভারতের সর্বত্র মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পাঁচ পীরের পূজা সমভাবে জনপ্রিয়। একইভাবে টাইটাস বলছেন, সমভাবে খাজা খিজিরকে বাংলায় পীর বদর বলে পূজা করা হয়; মুসলমান বিশ্বের সর্বত্র তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করা হয়। গাজী মিঞাকে বাংলায় বিয়ে-শাদি আর গর্ভধারণের দরবেশ বলে পূজা করা হয়; উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবেও তাকে সমভাবে শ্রদ্ধা-ভক্তি করা হয়। (পৃ. ১৩৭)। বাংলার কিছু কিছু কিংবদন্তি-পীর স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত পীরও বটে। যেমন প্রেমের দরবেশ হচ্ছেন মনাই পীর, গরু-বাছুরের রক্ষক হচ্ছেন তিননাথ, গ্রাম-রক্ষাকারী দরবেশ হচ্ছেন মানিক পীর, বাঘের আক্রমণ হতে কাকারী হচ্ছেন গাজী সাহেব এবং জানমালের হেফাজতকারী হচ্ছেন সত্যপীর। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যেও একই ধরনের স্থানীয় পীর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। বাঙালি মানিক পীরের পাঞ্জাবি প্রতিরূপ হচ্ছে শাখি সরওয়ার সুলতান। শেখ সাদ্দু হচ্ছে মনাই পীরের অন্য এক রূপ। উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের স্থানীয় পীরদের মধ্যে গুপ্পা পীর লালবাগ, পীর শাহতার পীর মিলা, পীর দিদার, কাঠ বাওয়া সাহেব, পীর ইমাম জামিন ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ধরে নেওয়া ঠিক নয় যে বাংলার প্রকৃতি নিষ্ঠুর হওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য কৃষকের চেয়ে বাংলার কষকদের জন্য পীরের প্রয়ােজন অধিক জরুরি ছিল। ভারতের অন্যান্য অংশে প্রকৃতিও বাংলার তুলনায় খুব একটা সদয় ছিল না। উপমহাদেশের সর্বত্রই কৃষক জীবনের সমস্যা ছিল একই ধরনের। ফলে প্রকৃতির রুদ্ররােষ থেকে রক্ষাকর্তা হিসেবে পীরদের জনপ্রিয়তা বাংলার ক্ষেত্রে অনন্য প্রবণতা নয়।
  • ২। অসীম রায় লিখেছেন, বাংলার হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণে কোনাে আধ্যাত্মিক প্রণােদনা দরকার ছিল না। শুধু ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা একটি সামাজিক গােষ্ঠী থেকে আরেকটি সামাজিক গােষ্ঠীতে অবস্থান নেন। এই ব্যাখ্যা মােটেও গ্রহণযােগ্য নয়। ভারতে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামাজিক আচার-আচরণ মেনে চলা। একজন হিন্দুর পক্ষে ঈশ্বরকে বহুরূপে উপাসনা করা সম্ভব ছিল কিন্তু সামাজিক রীতিনীতি অস্বীকার করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। মুসলমানদের সংস্পর্শে আসার জন্য অনেক হিন্দু কুলীন পরিবারকে জাতিভ্রষ্ট হতে হয়েছে কিন্তু জাতিভ্রষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা ধর্মান্তরিত হতে রাজি হয়নি। তারা পীরালি ব্রাহ্মণ, শেরশাহী ব্রাহ্মণ, শ্ৰীমন্তখানি ব্রাহ্মণ, শুভরাজখানি ব্রাহ্মণ ইত্যাদি নাম নিয়ে ভগ্নকুলীন মর্যাদা নিয়েও হিন্দুধর্মের মধ্যে টিকে ছিল। সুতরাং আধ্যাত্মিক প্রণােদনা ছাড়া হিন্দুদের পক্ষে ইসলাম গ্রহণ সম্ভব ছিল না।
  • ৩। বাংলায় গণধর্মান্তরের কোনাে ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে গণধর্মান্তরের উদাহরণ মেলে। টাইটাস তার গ্রন্থটিতে বলছেন, পাঞ্জাবে অনেক পুরাে উপজাতি (Tribe) নব ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। কিংবদন্তি খ্যাত পাক-পত্তনের বাবা ফরিদ উদ্দিনের ধর্ম-জীবনী মতে, তিনি ষােলােটি পাঞ্জাবি উপজাতিকে নব ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। (পৃ. ৪৫)। যখন কোনাে রাজা বা উপজাতীয় নেতা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেন, তখন প্রায়শ গণধর্মান্তর ঘটত। বাংলায় এ ধরনের কোনাে গণধর্মান্তরের ঘটনা নেই। অসীম রায় ব্যক্তিগত ধর্মান্তরের কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি গণধর্মান্তরের একটি উদাহরণও তুলে ধরতে পারেননি। অধ্যাপক মােহর আলি তার History of Muslim of Bengal গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, “এটা লক্ষণীয় যে সাহিত্যিক বা অন্য কোন উৎসে, কোনও সময় বা স্থানে কোনও বড় আকারের ধর্মান্তরের কোনও উল্লেখ নেই যদি উচ্চ বা নিম্ন কোনও শ্রেণীর মানুষের গণধর্মান্তরের কোনও ঘটনা ঘটত তবে এটি অবশ্যই সমসাময়িক ইতিহাস বা হ্যাজিওলজিক্যাল সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখ পেত, বিশেষ করে যেহেতু সেই সময়ের লেখকরা তাদের নায়কদের জন্য ধর্মীয় যোগ্যতার যে কোনও বিষয় প্রকাশ করতে সতর্ক ছিলেন।” (অনুদিত, পৃ. ৭৮২)। যখন পুরাে জনগােষ্ঠী বা গােষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ নতুন ধর্ম-বিশ্বাস গ্রহণ করে, তখনই গণধর্মান্তর ঘটে। এ ধরনের সামাজিক গােষ্ঠীর মধ্যে উপজাতি, গ্রাম-সমাজ, বর্ণ-গােষ্ঠী অথবা পেশাজীবী গােষ্ঠী ইত্যাদি থাকতে পারে। বাংলায় কোন ধরনের গােষ্ঠী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তা অসীম রায় নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। অপর দিকে, ব্যক্তিগতভাবে ধর্মান্তরের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত স্পষ্টভাবেই তুলে ধরে যে বাংলায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মান্তর ঘটেছে। অসীম রায় নিজেই তার গ্রন্থে বলছেন, যদু যখন মুসলমান হন তখন তার পিতা ও ভাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেননি। একজন মেচ উপজাতীয় প্রধান বখতিয়ার খিলজির হাতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। কিন্তু তার অনুসারীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। (পৃ. ২৩)। বাংলায় কোনাে উপজাতি বা পুরাে গ্রাম ধর্মান্তরিত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। এমনকি পূর্ব বাংলায় যেখানে মুসলমানরা উল্লেখযােগ্যভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেও এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যা পুরােপুরি মুসলমান-অধ্যুষিত। গণধর্মান্তর যদি ধর্মান্তরের প্রধান প্রক্রিয়া হতাে তাহলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলাে থেকে হিন্দুধর্ম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কিন্তু ১৮৮১ সালের বাংলার জেলাওয়ারি বিভিন্ন ধর্ম-অনুসারীর শৎকরা হারের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে মুসলমান-প্রধান জেলাগুলােতেও হিন্দু জনসংখ্যা নগণ্য ছিল না। এখানে সিলেট জেলায় ধর্মান্তরের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। ১৪শ শতকে হজরত শাহজালাল (র.) ৭০০ জন ধর্মপ্রচারক নিয়ে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। ৫০০ বছর ধরে মুসলিম ধর্মপ্রচারকদের অব্যাহত চেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৩১ সালে সিলেট জেলায় জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি ছিল হিন্দু। ইতিহাস বলছে, বাংলায় ইসলাম প্রচারে ছয়-সাত শ বছর সময় লেগেছে। যদি বাংলায় গণধর্মান্তরকরণ ঘটত, তাহলে এক অথবা দুই শতাব্দীর মধ্যেই বাংলার সর্বত্র ইসলাম ছড়িয়ে পড়ত। তাই অসীম রায়ের এই অনুমানের পক্ষে যথেষ্ট জোরালাে ঐতিহাসিক তথ্য দেখা যায় না।

রিচার্ড এম. ইটনের তত্ত্ব 

তত্ত্বের মূল বক্তব্য

রিচার্ড এম. ইটন একজন মার্কিন ঐতিহাসিক। তিনি অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। পারস্যের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে তার গবেষণা শুরু হয়, পরবর্তীকালে ইরান ও ভারতের সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি The Rise of Islam and the Bengal Frontier বইটি প্রকাশ করেন। এই বই বাংলাদেশের মুসলিম শাসন সম্পর্কে একটি মূল্যবান অবদান। নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা বাঙালির ইতিহাস প্রাচীন বাংলার ইতিহাসচর্চার জন্য যেমন (যদুনাথ সরকারের ভাষায়) “অবশ্য পঠিতব্য প্রামাণ্য পুস্তক” হিসেবে সর্বজনের স্বীকৃতি লাভ করেছে, তেমনি ইটনের বইটিও মুসলিম বাংলার ইতিহাসচর্চার জন্য অপরিহার্য।

এই বইয়ে ইটনের একটি বড় অবদান হলাে এই যে তিনি হচ্ছেন প্রথম ঐতিহাসিক, যিনি একটি তাত্ত্বিক কাঠামাের (paradigm) মধ্যে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন। এই তত্ত্ব প্রখ্যাত মার্কিন ঐতিহাসিক এফ. জে. টার্নারের The Frontier in American History (1953) গ্রন্থে উল্লিখিত সীমান্ত তত্ত্বের একটি অভিনব উপস্থাপন। টার্নারের মতে, সীমান্ত সর্বদাই বিদ্রোহী, ভিন্নমতাবলম্বী ও সমাজের সঙ্গে যেসব লােক খাপ খায় না তাদের আকৃষ্ট করে। কেন্দ্র থেকে বিদ্রোহী ব্যক্তিদের সীমান্তে অভিবাসন সামান্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চেতনা বাচিয়ে রাখে। যেসব দেশে স্বল্প জন-অধ্যুষিত সামান্ত রয়েছে, সেসব দেশে সীমান্ত ও কেন্দ্রের নিরন্তর মিথস্ক্রিয়ায় ইতিহাস নিয়ন্ত্রিত হয়। ইটনের মতে বাংলার সীমান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের পৰাত থেকে অনেক জটিল। প্রথমত, এখানে সীমান্ত স্থির নয়, চলমান। দ্বিতীয়ত এখানে একটি নয়, তিনটি সীমান্ত ছিল –

  • প্রথমত, এখানে রাজনৈতিক সীমান্ত। এই সীমান্ত দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব সম্প্রসারিত হয়েছে।
  • দ্বিতীয়ত, কৃষি সীমান্ত। এই সীমান্ত সম্প্রসারণের ফলে পলি দিয়ে সৃষ্ট নতুন অনাবাদি জমিতে কৃষির সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং স্থানীয় শিকারি ও মৎস্যজীবীরা কৃষকে পরিণত হয়েছে।
  • তৃতীয়ত ছিল ধর্মের সীমান্ত। এর মাধ্যমে পশ্চিম থেকে পূর্বে ইসলাম সম্প্রসারিত হয়েছে। ১৬শ ও ১৭শ শতকে মােগল শাসন আমলে চলমান সীমান্তসমূহ সমস্থিতি লাভ করে।

বাংলায় ইসলাম প্রচার সম্পর্কে ইটনের ব্যাখ্যায় নিম্নলিখিত বক্তব্যসমূহ গুরুত্বপূর্ণ –

  • ১। ১৬শ শতকের শেষ দিকে বাংলার জলাভূমিতে একটি বড় পরিবেশগত পরিবর্তন হয়। পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবহমান ভাগীরথী খাত পরিবর্তন করে পূর্ব দিকের পদ্মা খাত দিয়ে বাংলার অন্যতম বড় নদী গঙ্গার জলধারার প্রবাহ শুরু হয়। এর ফলে পশ্চিমাঞ্চলে গঙ্গার প্রবাহ কমে যায়। এই অঞ্চলে পলি আসা কমে যায়। পশ্চিম অঞ্চলে জমি অনুর্বর হয়ে যায়। গঙ্গার জলরাশি নিশ্চল হয়ে পড়ায় বাংলার পশ্চিমাঞ্চল মারি-মড়কের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। বিশেষ করে ম্যালেরিয়া মহামারি আকারে দেখা দেয়। প্রতিতুলনায় পূর্ব বাংলায় নবগঠিত বদ্বীপ অঞ্চলে প্রচুর উর্বর জমি ভেসে ওঠে। এখানে চলমান স্রোতােধারায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপও ছিল কম। ভৌগােলিকদের ভাষায় নদীর খাত পরিবর্তনের ফলে বাংলার পশ্চিমাঞ্চল মৃতপ্রায় বদ্বীপে (moribund delta) এবং পূর্ব বাংলার দক্ষিণ অঞ্চল সক্রিয় বদ্বীপে (active delta) পরিণত হয়। কাজেই পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে নবগঠিত অঞ্চলে বসতি স্থাপন করা ছিল অত্যন্ত লােভনীয়। 
  • ২। পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্বাঞ্চলে অভিবাসনে দুটি জটিলতা ছিল –
    • প্রথমত, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে নবগঠিত ভূমিতে ঘন জঙ্গল ছিল। এ জঙ্গল পরিষ্কার না করলে চাষাবাদ সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়ােজন সাংগঠনিক দক্ষতা ও পুঁজি।
    • দ্বিতীয়ত, পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা আবেগগতভাবে জন্মভূমির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। তাদের পক্ষে অভিবাসনের চিন্তা সম্ভব ছিল না। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করেন পশ্চিম থেকে আগত পীরেরা। এদের শুধু সম্মােহনী শক্তিই ছিল না, ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা এবং চাষবাস সম্পর্কে প্রগাঢ় জ্ঞান। 
  • ৩। পীরদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার দক্ষিণ অঞ্চলে নবগঠিত জমিতে মুসলমানরা বসতি প্রতিষ্ঠা করে। এই মুসলমানদের পরিচয় সম্পর্কে ইটন লিখেছেন, “পূর্ব বঙ্গ-উপনিবেশ, অন্তর্ভুক্তি, প্রাকৃতিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে নতুন কৃষক সম্প্রদায়ের উত্থানে অবদান রাখার প্রধান কারণগুলি ছিল- সবই পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বদ্বীপের সক্রিয় অংশের স্থানান্তরের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
    • প্রথমত, এই পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গের অপেক্ষাকৃত কম উর্বর উপরের বদ্বীপ থেকে আসা অভিবাসীদের দ্বারা সক্রিয় বদ্বীপের উপনিবেশকে উদ্দীপিত করেছিল। অথবা এমনকি উত্তর ভারত এবং তার বাইরেও।
    • দ্বিতীয়ত, যেমনটি ঘটেছিল, জেলেদের আদিবাসী সম্প্রদায় এবং স্থানান্তরিত চাষীরা সেডেন্টারি সম্প্রদায়গুলিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যা মুসলিম পায়োনিয়ারদের ক্যারিশমা এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার উপর মনোনিবেশ করেছিল।
    • তৃতীয়ত, দক্ষিণ ও পূর্বে বদ্বীপের সক্রিয় অংশের স্থানান্তর প্রাকৃতিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছিল, যেহেতু এই অঞ্চলে ভেজা ধান চাষের সূচনা বা তীব্রতা নাটকীয়ভাবে স্থানীয় খাদ্য সরবরাহ বৃদ্ধি করেছিল।” (অনুদিত, পৃ. ২২৬-২৭)।
  • ৪। জঙ্গল পরিষ্কার করে মুসলমান বসতিসমূহ গড়ে ওঠে। এ বসতিগুলাে কীভাবে গড়ে ওঠে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ইটন খানজাহান আলীর উদ্যোগে মুসলমান বসতির উদাহরণ তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “খান জাহান স্পষ্টতই একজন কার্যকর নেতা ছিলেন, যেহেতু এই অঞ্চলের পূর্বের পুরু জঙ্গলকে ধানক্ষেতে রূপান্তরিত করার জন্য উচ্চতর সাংগঠনিক দক্ষতা এবং প্রচুর জনবল প্রয়োজন ছিল: লবণজল বাইরে রাখার জন্য জমিতে স্রোত বরাবর বাধ দিতে হয়েছিল, বন পরিষ্কার করতে হয়েছিল, জল সরবরাহ এবং সংরক্ষণের জন্য ট্যাঙ্ক খনন করতে হয়েছিল, এবং শ্রমিকদের জন্য কুঁড়েঘর তৈরি করতে হয়েছিল। যখন এই কাজগুলি সম্পন্ন হয়েছিল, তখন অবিলম্বে চাল রোপণ করতে হয়েছিল, পাছে শীঘ্রই একটি রিড জঙ্গল ফিরে আসে। এগুলি ছিল কঠিন কার্যক্রম, বাঘ এবং জ্বরের বর্তমান বিপদের কারণে এগুলো আরও কঠিন হয়ে পড়েছিল।” (অনুদিত, পৃ. ২১০)। ইটন এ ধরনের পীরদের উদ্যোক্তা পীর বা ‘entreprenuer-peer’ নাম দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বত্র অনেক পীর ছিল কিন্তু উদ্যোক্তা পীর’ শুধু বাংলাতেই দেখা যায়। 
  • ৫। উদ্যোক্তা পীরেরা পশ্চিম বাংলা থেকে আগত অভিবাসী ও স্থানীয় মাছচাষি এবং জুম চাষিদের একত্র করে মুসলমান বসতি গড়ে তােলেন। এদের কাছে পীরেরা কিংবদন্তি পুরুষ হিসেবে প্রতিভাত হন। ইটনের ভাষায়, “সাধারণত, এই বীররা পবিত্র মানুষের ধর্মভীরুতাকে বন পরিষ্কার এবং ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক দক্ষতার সাথে একত্রিত করেছিলেন; তাই তারা কেবল মসজিদ ও মাজার স্থাপনের জন্য নয়, বন কেটে জমি বসতি স্থাপনের জন্য সম্প্রদায়গুলিকে একত্রিত করার জন্যও স্মরণীয় হয়ে ছিল। এই ঘটনা ঘটার সাথে সাথে, লোকেরা ধীরে ধীরে এই লোকদের শ্রদ্ধা করতে এসেছিল, যারা সাধারণত মুসলিম ছিল। সক্রিয় বদ্বীপে, তখন, ইসলাম একটি সভ্যতা-নির্মাণ মতাদর্শ হিসাবে প্রবর্তিত হয়েছিল যা জমি বসতি স্থাপন এবং জনবসতি এবং সেই প্রক্রিয়ার সাথে একটি অতীন্দ্রিয় বাস্তবতা নির্মাণের সাথে সম্পর্কিত।” (অনুদিত, পৃ. ২১৭)।

ইটনের বক্তব্য প্রণিধানযােগ্য এ কারণে যে তিনি দেখিয়েছেন যে বাংলার পীরেরা উত্তর ভারতের পীরদের থেকে ভিন্ন। উত্তর ভারতের পীরেরা তাদের মুরিদকে আধ্যাত্মিক শান্তি দিয়েছেন, কিন্তু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিতে পারেননি। বাংলায় পীরেরা একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়েছেন। পশ্চিমাঞ্চলে বিপর্যস্ত কৃষকদের পূর্ব বাংলার নবগঠিত জমিতে স্থানান্তর করে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। 

তত্ত্বের দুর্বলতা

বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য সম্পর্কে ইটনের বক্তব্য ব্যতিক্রমধর্মী। এর আগে কোনাে ঐতিহাসিক ইসলাম প্রচারের সঙ্গে বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশের সম্পর্ক এবং বাংলার দরবেশদের অনন্যতা (যাকে ইটন নাম দিয়েছেন entreprenur-peer বা উদ্যোক্তা পীর) নিয়ে কোনাে আলােচনা করেননি। তবে এ ধরনের বক্তব্য প্রমাণের জন্য প্রয়ােজন রয়েছে তার অনুমানসমূহ যে অভ্রান্ত তা প্রমাণ করা। ইটনের বক্তব্য যতই অভিনব হােক না কেন, তার অনুমানসমূহ সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তার দুঃসাহসী ব্যাখ্যার অনুমানগুলাে নিয়ে এখানে আলােচনা করা হলাে –

১। ইটনের সীমান্ত তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা

  • (ক) সীমান্ত তত্ত্ব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কতটুকু প্রযােজ্য, সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করে স্বল্প জনসংখ্যা-অধ্যুষিত অঞ্চলে। ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে সীমান্ত পরিস্থিতি থাকে না। ব্রিটিশ শাসন আমলে বাংলা প্রেসিডেন্সি ছিল সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চল। ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ পর্যালােচনা করলে এ কথা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে যে বাংলার মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলায় উত্তর ভারতের চেয়ে ঘনবসতি ছিল। সুতরাং এ ধরনের ঘনবসতি অঞ্চলে সীমান্ত তত্ত্ব খাপ খায় না।
  • (খ) ইটনের সীমান্ত তত্ত্বের জন্য তিনটি অনুমান অত্যাবশ্যক, কিন্তু এর কোনােটিই বাস্তব নয় –
    • প্রথমত, ইটন অনুমান করছেন যে রাজনৈতিক শক্তি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়েছে। মােগল আমলে এ কথা মােটামুটি সত্যি হলেও সুলতানি আমলে ও মােগল আমলের প্রথম দিকে যেথা শের শাহের সময় পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
    • দ্বিতীয়ত, কৃষি সীমান্ত সম্পর্কে তিনি অনুমান করছেন যে পশ্চিম অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থা পূর্ব অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে এবং পূর্ব অঞ্চলে স্বল্প-জন-অধ্যুষিত অঞ্চলে মাছচাষিরা ও জুম চাষিরা বাস করত। পশ্চিমাঞ্চল থেকে কৃষক এনে এবং মাছচাষিদের ও জুম চাষিদের কষিকাজ শিখিয়ে বাংলার কৃষিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অনুমান ভুল। মােগল শাসনের অনেক আগে থেকেই বাংলায় কৃষিব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
    • সবশেষে তিনি অনুমান করছেন যে পশ্চিম অঞ্চল থেকে ইসলাম ধর্ম পূর্বাঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে। এ অনুমান নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

২. ইটন কর্তৃক নদীর খাত পরিবর্তনের প্রভাব অতিরঞ্জন

  • (ক) বাংলার মতাে বৃহৎ বদ্বীপে নদীর খাত পরিবর্তন নৈমিত্তিক ঘটনা। বাংলায় এ ধরনের খাত পরিবর্তন শুধু গঙ্গার ক্ষেত্রেই ঘটেনি, গঙ্গার চেয়ে অধিক জলবহনকারী ব্রহ্মপুত্র নদেও ঘটেছে। নীহাররঞ্জন রায় তার “বাঙ্গালির ইতিহাস : আদিপর্ব” গ্রন্থে বলছেন, ১৮৩০ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের মূল খাত ময়মনসিংহ খাত থেকে ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে বর্তমান যমুনা নদীর খাতে পরিবর্তিত হয়। (পৃ. ৮৬-৮৭)। কিন্তু ১৮৩০-এর দুর্বিপাক ১৯শ শতকে বড় ধরনের কোনাে পরিবেশগত প্রভাব ফেলেনি। আস্তে আস্তে পুরােনাে খাত শুকিয়ে যায় এবং নদীর খাত ও এর পাশের জলাভূমিতে প্রভাব ফেলে। তাই ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত লােকদের বড় ধরনের অভিবাসন ঘটেনি। ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূল খাত গঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হতাে। ১৭৮৭ সালে অকস্মাৎ তিস্তা তার খাত পরিবর্তন করে এবং মূল খাত ব্ৰহ্মপুত্র নদীতে চলে যায়। নীতিশ সেনগুপ্ত তার History of Bengali Speaking People গ্রন্থে লিখছেন, ব্রিটিশ প্রশাসক Hunter এই খাত পরিবর্তনের ফলাফল স্বচক্ষে দেখেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। (পৃ. ৬)। কিন্তু হান্টার কোথাও লেখেননি যে ক্ষতিগ্রস্ত লােকেরা অন্যত্র অভিবাসন করেছে।
  • (খ) গঙ্গার মূল খাতের পরিবর্তন হয়েছে ১৬শ শতাব্দীর শেষ দিকে, কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব সঙ্গে সঙ্গে অনুভূত হয়নি। ১৬শ ও ১৭শ শতকে গঙ্গার স্রোতােধারার পরিবর্তনের ফলে বড় ধরনের কোনাে প্রভাব পরিবেশের ওপর দেখা যায়নি। প্রায় তিনশ বছর পরে ১৯শ শতাব্দীর শেষ দিকে এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেই এ সমস্যা দেখা দেয়নি। আর্থার গেডেস তার The Regions of Bengal (1929) গ্রন্থে ও বি. এন. গাঙ্গুলি তার Trends of Agriculture and Population of Ganges Valley (1938) গ্রন্থে বলেব, এই সমস্যা দেখা দেয় এ জন্য যে প্রকৃতির সৃষ্ট এই সমস্যাকে মানুষ আরও তীব্র করে তােলে সড়ক ও বাঁধ নির্মাণ করে জলের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। ইটন অনুমান করছেন, গঙ্গার মূলধারায় পরিবর্তনের ফলে পশ্চিমাঞ্চল থেকে অনেক মানুষ পূর্বাঞ্চলে অভিবাসন করে। অথচ তিনি যে ধরনের পরিবেশগত পরিবর্তন হয়েছে বলে বলছেন, তার পক্ষে যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
  • (গ) বাংলার ঐতিহাসিক গ্রন্থসমূহে গঙ্গার মূল খাত পরিবর্তনের ফলে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনাে ইঙ্গিত নেই। ইটন বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মােগলদের রাজস্বের দাবি সম্পর্কে তথ্য থেকে এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে বাংলার উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে গঙ্গার খাতা পরিবর্তনের ফলে ওই অঞ্চলে রাজস্ব কমে যায়। ইটনের হিসাব অনুসারে ১৫৯৫ থেকে ১৬৫৯ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে রাজস্বের দাবি বাড়ে ৬২%, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বৃদ্ধি পায় ১১৭%, দক্ষিণ-পশ্চিমে বাড়ে ৫৪% আর উত্তর-পশ্চিমে কমে ১৯%।৯৬ এসব উপাত্ত যথেষ্ট নির্ভরযােগ্য নয়। যদি ধরেও নিই যে এসব উপাত্ত নির্ভরযােগ্য, তবু ইটনের মূল বক্তব্য যে গঙ্গার খাত পরিবর্তনের ফলে চাল উৎপাদন কমে গেছে, তা প্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তর অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি অঞ্চলজুড়ে জলপাইগুড়ি, রংপুর ও দিনাজপুর জেলা অবস্থিত। এই অঞ্চলে গঙ্গার খাত পরিবর্তনের কোনাে প্রভাব পড়তে পারে না। কাজেই গঙ্গার প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে চাল উৎপাদন কমে যাওয়া মােটেও বিশ্বাসযােগ্য নয়। 

৩। বাংলায় অভিবাসন সম্পর্কে ইটনের ভুল ধারণা

  • (ক) পৃথিবীর সব দেশেই অভিবাসন একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। এতে শুধু আর্থিক খরচ ও বিনিয়ােগই যথেষ্ট নয়, অভিবাসনকারীদের তাদের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ও পরিচিতজনদের ছেড়ে দিতে হয়। এর ফলে আবেগের দিক থেকে প্রচুর লােকসান হয়। তাই বাধ্য না হলে কেউ কৃষিপ্রধান সমাজে অভিবাসন করে না। বাধ্য অবশ্যই হয় যখন প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে (যথা নদীভাঙনে) অন্যত্র বসতি স্থাপন ছাড়া কোনাে উপায়ে থাকে না। দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে যেসব চর জেগে উঠত, সেগুলাে অনেক ক্ষেত্রেই চিরস্থায়ী ছিল না। একদিকে চর জাগত, অন্যদিকে নদী চর ভেঙে নিত। অনেক সময় গােটা নব উথিত ভূমি তলিয়ে যেত। তাই পশ্চিমবঙ্গের মতাে দূর অঞ্চল থেকে সাধারণত কৃষকেরা নােয়াখালী, বাকেরগঞ্জ বা খুলনা অঞ্চলে অভিবাসন করতে উৎসাহী হতাে না। এসব অঞ্চলে নিকটবর্তী অঞ্চলের নদীভাঙনের শিকার যেসব পরিবার তারাই মূলত বসতি স্থাপন করেছে।
  • (খ)শ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় বদ্বীপের কৃষকদের দক্ষিণ পূর্ববঙ্গের সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে অভিবাসনের আরেকটি বাধা হলাে এই যে নব উথিত ভূমিখণ্ড সামদিক জলােচ্ছাস ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। একমাত্র কাছাকাছি অঞ্চলের লােকেরাই এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে অভ্যস্ত ছিল। এদের মধ্যে যারা নদীভাঙনে গৃহহীন হতাে, তারাই বাধ্য হয়ে অভিবাসন করত। মােগল ইতিহাসে ১৬শ শতকের শেষ দিকে দক্ষিণবঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের বর্ণনা হয়েছে। মােগল ঐতিহাসিক আল্লামা আবুল ফজল তার আইনি আকবরি গন্তের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছেন, “ঐশ্বরিক যুগের ২৯তম বর্ষে দুপুর তিনটায় ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস ঘটে, যা পুরো সরকারের উপর দিয়ে বয়ে যায় : রাজা সেই সময় একটি বিনোদনের আয়োজন করেছিলেন। তিনি একবারে একটি নৌকায় উঠেছিলেন, আর তার ছেলে পরমানন্দ রায় অন্য কয়েকজনের সাথে একটি মন্দিরের শীর্ষে উঠেছিলেন এবং একজন বণিক একটি উঁচু লফটে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সাড়ে চার ঘন্টা ধরে বজ্রপাত এবং বাতাসের হারিকেনের মধ্যে সমুদ্র জ্বলছিল। বাড়ি ঘর এবং নৌকাগুলি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তবে মন্দির বা লফটের কোনও ক্ষতি হয়নি। এই বন্যায় প্রায় দুই লক্ষ জীবিত প্রাণী মারা গেছে।” (অনুদিত, পৃ. ১৩৫-৩৬)। আবুল ফজলের ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাকেরগঞ্জ অঞ্চলে এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এবং এই ঝড়ে প্রায় ২ লাখ প্রাণীর প্রাণহানি ঘটে। ১৮৭২ সালের আদমশুমারি থেকে দেখা যায় যে বাকেরগঞ্জ জেলায় মােট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৩ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৩। বাকেরগঞ্জ জেলার অনেক অঞ্চলে কয়েক শ বছর ধরে নতুন ভূমি জেগে উঠেছে, যেখানে অভিবাসীরা বসতি গড়ে তােলে। সুতরাং ১৫৮৪ সালে বাকেরগঞ্জের জনসংখ্যা কোনােমতেই ২০ লাখের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। নিহত প্রাণীদের মধ্যে মানুষের সংখ্যা যদি ৫০ শতাংশ হয়, তাহলে এই ঝড়ে কমপক্ষে ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মৃত্যু ঘটে। মৃতদের সংখ্যার চার-পাঁচ গুণ মানুষ এই ধরনের ঝড়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। অর্থাৎ এই ঝড়ে বাকেরগঞ্জ জেলার ৫ শতাংশ মানুষ মারা যায় এবং আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। ঝড়ের এই ক্ষতির তথ্য দিল্লির দরবারে যেমন জানা ছিল, তেমনি বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছেও তা জানা থাকা ছিল স্বাভাবিক। অবশ্য এ ধরনের ভয়ংকর ঝড় প্রতি বছর ঘটে, কিন্তু প্রতি বছরই ঝড় ও জলােচ্ছাস এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি করে থাকে। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় ব-দ্বীপ এলাকার মানুষের পক্ষে পূর্ব বাংলার সক্রিয় ব-দ্বীপ এলাকায় অভিবাসন একটি অতি দুঃসাহসিক ভাবনা। পশ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় ব-দ্বীপের হিন্দু কৃষকেরা পীরদের পর বাংলায় দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অভিবাসন করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এ ধরনের বক্তব্য তাই অবাস্তব বলে মনে হয়। ইটন মনে করেন যে পশ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় বদ্বীপ (যথা : নদীয়া, যশোর ও মুর্শিদাবাদ জেলা) অঞ্চলে জল নিষ্কাশনের অপ্রতুলতায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ছিল প্রচণ্ড। মৃত বদ্বীপ অঞ্চলের ভূমি ছিল সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের তুলনায় অনেক অনুর্বর। অথচ বাকেরগঞ্জ, নােয়াখালী অঞ্চলে সক্রিয় বদ্বীপে নতুন ভূমি গড়ে উঠছিল। যেখানে মৃত বদ্বীপ অঞ্চলের তুলনায় আর্থিক সচ্ছলতা অর্জনের সম্ভাবনা ছিল অনেক বেশি। ইটনের ধারণা হলাে, উদ্যোক্তা পীররা পশ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চলের প্রান্তিক জনগােষ্ঠীকে সচ্ছলতার লোভ দেখিয়ে মেঘনার মােহনায় নবগঠিত অঞ্চলে বসতি স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই অনুমানের একটি দুর্বলতা হলাে যে মেঘনার মােহনায় নবগঠিত অঞ্চলে সাধারণত ফলন বেশি হলেও এই অঞ্চলে প্রায়ই প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছ্বাস ঘটত। ১৫৮৪ সালে বাকেরগঞ্জ জেলায় সামদ্রিক জলােচ্ছ্বাসের পরিণাম ভয়াবহ ছিল। তবে শুধু প্রাকৃতিক জলােচ্ছাসই মেঘনা নদীর নবগঠিত মােহনায় নতুন আবাদ স্থাপনের অন্তরায় ছিল না। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অত্যাচারও একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ১৬শ শতাব্দী থেকে আরাকানের রাজার পক্ষে পর্তুগিজ জলদস্যরা চট্টগ্রাম, নােয়াখালী ও বাকেরগঞ্জ অঞ্চল থেকে নারী-পুরুষদের অপহরণ করে দাস হিসেবে বিক্রয় করত। এই অবস্থাকে বর্ণনা করে আধুনিক ঐতিহাসিক বেনজামিন কিংসবেরি An Imperial Disaster : The Bengal Cyclone of 1876 (2018)-এ লিখেছেন : “ফরাসি ভ্রমণকারী ফ্রাঙ্কোইস বার্নিয়ার লিখেছিলেন, ‘তারা সমুদ্র উপকূল বরাবর সব ধুয়ে মুছে দেয়, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সকলেই দাস বানায়, তাদের অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে হতো, আর যা এরা বহন করতে পারেনি তাকে তারা পুড়িয়ে দেয়।’ ১৭শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলার দক্ষিণ অংশ প্রায় সম্পূর্ণভাবে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল।” (অনুদিত, পৃ. XII)। ইটন অনুমান করছেন যে ১৭শ শতকে নবগঠিত বদ্বীপ অঞ্চলে নতুন আবাদ হচ্ছে। অন্যদিকে ঐতিহাসিক গবেষণায় এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত যে তখন সে অঞ্চলে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছিল। এই অঞ্চলে ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁ আরাকানের রাজাকে (যিনি মগ রাজা হিসেবে পরিচিত) পরাজিত করেন। তারপর আস্তে আস্তে এ অঞ্চলে নতুন করে জনবসতি শুরু হয়। তবে এই জনবসতি পশ্চিম বাংলার মৃতপ্রায় বদ্বীপ থেকে আগত অভিবাসীরা করেনি, করেছে এই অঞ্চলেরই নদীভাঙা কৃষকেরা। কিংসবেরি লেখেন, মেঘনা নদীর এক পাড় ভিল অন্য পাড় গড়ছিল। যারা নদী ভাঙায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, তারাই চর এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল। (পৃ. ২৪)। এই বসতি স্থাপন প্রায় দেড় শ বছর ধরে চলার পর নবগঠিত অঞ্চলে উল্লেখযােগ্য জনসংখ্যা দেখা যায়। তবে সামুদ্রিক জলােচ্ছাস কখনাে থামেনি। কিংসবেরি বলেন, ১৯শ শতাব্দীতে ১৮২২, ১৮২৫, ১৮৪৮. ১৮৬৭ ও ১৮৭৬ সালে বড় ধরনের জলােচ্ছ্বাস হয়। (পৃ. ২৬)। এই তথ্যসমূহ বিবেচনা করলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত অভিবাসীরা মেঘনার মোহনায় মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠা করে—ইটনের এ অনুমানের পক্ষে আদৌ কোনাে ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
  • (গ) ইটন দাবি করছেন যে মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চল থেকে বিশাল জনগােষ্ঠী পীরদের নেতৃত্বে দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে অভিবাসন করেছে। এ ধরনের অভিবাসন ঘটলে মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব কমে যেত এবং পূর্ব বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়ত। ১৮৭২ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলায় মৃতপ্রায় ও সক্রিয় বদ্বীপে জনসংখ্যার ঘনত্বের সারণিতে যে তথ্য দেখা যায় তা পশ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় বদ্বীপ হতে বড় ধরনের অভিবাসন হয়েছে এ ধরনের অনুমান আদৌ সমর্থন করে না। এখানে দেখা যায় নদীয়া, যশোহর ও মুর্শিদাবাদের মত মৃতপ্রায় বদ্বীপগুলোতে বর্গমাইল প্রতি জনসংখ্যা যথাক্রমে ৫৩০, ৫৬৮ ও ৫২৫ জন, যেখানে বাকেরগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, রাজশাহী বিভাগ, ঢাকা বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের মত সক্রিয় বদ্বীপে জনসংখ্যার ঘনত্ব যথাক্রমে ৪৮২, ৪৫১, ৪৫৯, ৫০৩, ৪২৭ ও ১৯০ জন। (১৮৭২ সালে হেনরী বেভারলি কর্তৃক প্রকাশিত Census of Bengal 1871)। দেখা যাচ্ছে যে ১৮৭০ সালে নদীয়া, যশােহর ও মুর্শিদাবাদের মৃতপ্রায় বদ্বীপে জনসংখ্যার ঘনত্ব যেসব অঞ্চলে ইটনের তত্ত্ব অনুসারে অভিবাসীরা ঘর বেঁধেছে তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। লক্ষণীয় যে গােটা চট্টগ্রাম বিভাগে জনসংখ্যার ঘনত্ব খুবই কম ছিল। 

৪. বাংলায় জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ইটনের ভুল ধারণা

(ক) ইটন স্বীকার করছেন যে জঙ্গল পরিষ্কার করে জমিতে আবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে চলছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ কাজ হাজার হাজার বছর ধরে করেছে। ৬ষ্ঠ শতকে ফরিদপুর শিলালিপিতে নব্যবাসিকা বা নবগঠিত ভূমিতে বসতি স্থাপনের বর্ণনা রয়েছে মুসলমানরা বাংলায় আসার অনেক আগে। থেকেই বাংলায় জঙ্গল পরিষ্কার করে নতুন বসতি করা হচ্ছিল। মোহাম্মদ মোহর আলী লিখছেন, ১৩৪৯-৫০ সালে একজন চীনা পরিব্রাজক বাংলায় এসেছিলেন। তিনি বাংলার কৃষকদের সম্পর্কে লেখেন, ‘এই লোকেরা তাদের সমস্ত প্রশান্তি এবং সমৃদ্ধির জন্য নিজেদের কাছে ঋণী, কারণ এর উৎস কৃষির প্রতি তাদের ভক্তির মধ্যে রয়েছে যার মাধ্যমে মূলত জঙ্গলের সাথে যুক্ত একটি জমি তাদের অবিরাম পরিশ্রম দ্বারা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।” (অনুদিত, পৃ. ৯৩২)। তবে ১৬শ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় যেসব চর জেগে ওঠে তা ছিল উপকূলীয় বাদা অঞ্চল (mangrove forest)। আকবর আলী খান তার Discovery of Bangladesh গ্রন্থে বলছেন, এ ধরনের অঞ্চলে শুধু বন পরিষ্কার করাই বসতির জন্য যথেষ্ট ছিল না, বাঘ ও কুমিরের হাত থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হতাে, লােনা জল যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হতাে। এবং বাদাবনের গাছের সব শিকড় তুলতে অনেক কষ্ট করতে হতাে। পাঁচশ বছর ধরে বাংলায় শুধু বাদাবন পরিষ্কার করেই বসতি স্থাপন করা হয়নি। বাংলায় আরও দুই ধরনের বন ছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন উচু জায়গাতে শালবন ছিল। পাহাড়ি অঞ্চল (বিশেষ করে আসামসংলগ্ন অঞ্চলে) চিরসবুজ বন ছিল। এ ধরনের জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগই যথেষ্ট ছিল। (পৃ. ৫৫-৫৬)। এ ধরনের বন পরিষ্কারের জন্য উদ্যোগী-পীরের দরকার ছিল না। বাংলায় মােট বনভূমির মাত্র পাঁচ শতাংশ ছিল বাদাবন। ১৬শ ও ১৭শ শতকে এই বাদাবনের অধিকাংশই চাষের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৯শ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার বাদাবন পরিষ্কার করা, উৎসাহিত করে কৃষি ভূমির পরিমাণ বাড়িয়েছে। কাজেই পীরদের (যা ইটন অনুমান করছেন ঘটেছে) প্রতিষ্ঠিত বসতি বাংলার মুসলমান জনসংখ্যার বড়জোর একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে।

(খ) উদ্যোক্তা পীরদের ভূমিকা সম্পর্কে ইটন কোনাে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিতে পারেননি। তার লেখায় উদ্যোক্তা পীরদের নাম পাওয়া যায় না। ইটন দাবি করেছেন যে উদ্যোক্তা পীরেরা মােগল যুগের ইতিহাসের নায়ক ছিল। কিন্তু এই নায়কদের পরিচয় তিনি পেশ করতে পারেননি। তিনি লিখেছেন, “১৬শ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য ও লোক-ঐতিহ্যগুলি বনকে বশ করার সাথে যুক্ত নায়কদের সাথে পরিপূর্ণ, চাষযোগ্য প্রসারিত করে এবং নতুন ধর্ম ধর্ম গুলি প্রতিষ্ঠা করে।” (অনুদিত, পৃ. ২২৬)। তার বইয়ে তিনি বাংলায় মুসলমান শাসনামলে পাঁচজন পীরের নাম উল্লেখ করেছেন। একজন হলেন খানজাহান আলী খান, যিনি ১৪৫৯ সালে অর্থাৎ ভারতে মােগল শাসন প্রতিষ্ঠার (১৫২৭) ৬৮ বছর আগে গত হন।কাল করেন। আরেকজন পীরের নাম উমর শাহ, যিনি পলাশীর যুদ্ধের দুই দশক পরেও জীবিত ছিলেন। আর তিনজন পীর হলেন। মেহেরপুরের মেহের আলী, হবিগঞ্জের নাসিরউদ্দিন শাহ এবং টাঙ্গাইলের খন্দকার শহীদ আলী। এঁরা কেউই দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে ধর্ম প্রচার করেননি। অথচ এই বইয়ের সারণি-৬ এ বাংলার প্রখ্যাত ৫১ জন পীরের সময় চিহ্নিত করা হয়েছে। সারণি-৬ থেকে দেখা যাচ্ছে যে এসব পীরের ৮২%। মােগল শাসন প্রতিষ্ঠার পুর্বে বাংলায় এসেছে। মাত্র ১৭.৭ শতাংশ প্রখ্যাত পীর মােগল আমলে এ দেশে আসে। কাজেই মােগল আমলের পীরদের। প্রণােদনায় বেশির ভাগ লােক দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে এ ধরনের দাবির কোনাে ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। ইটনের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মােগল যুগের যেসব পীর বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বসতি স্থাপন। করেছে, তার একটি গ্রহণযােগ্য তালিকা প্রয়ােজন। সাহিত্য ও লােকসাহিত্যে যেসব বীরের কাহিনি বিবৃত হয়েছে, তারা সবাই দক্ষিণ পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন না, তার ভাটি অঞ্চলের সর্বত্র পরিচিত ছিলেন। 

৫. ধর্মান্তরের জন্য আধ্যাত্মিক প্রণােদনা

(ক) ইটনের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে তিনি মনে করেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বড় ধরনের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতির প্রয়ােজন নেই। ইটন তাই ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকে ভারতের বাইরে ধর্মান্তর প্রক্রিয়া থেকে ভিন্ন মনে করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “এই প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করা হলে ধর্মান্তর শব্দটি সম্ভবত বিভ্রান্তিকর। যেহেতু এটি সাধারণত একটি আকস্মিক এবং সম্পূর্ণ রূপান্তরকে বোঝায় যেখানে একটি পূর্ব ধর্মীয় পরিচয় পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং একটি নতুন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। বাস্তবে, বাংলায়, যেমন দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সাধারণত, একটি সামাজিক ঘটনা হিসাবে ইসলামীকরণের প্রক্রিয়াটি এত ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় যে প্রায় অবোধ্য হয়।” (অনুদিত, পৃ. ২৬৯)। অসীম রায়ের মতাে ইটনও মনে করেন যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে হিন্দুদের বড় কোনাে সমস্যা ছিল না। কেননা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হিন্দুরা একই নামে ভিন্ন ভিন্ন দেবতার পূজা করে। আসলে হিন্দুদের ধর্মান্তরের মূল সমস্যা ধর্মীয় মতবাদ ও দর্শন নয়। মূল সমস্যা হলাে জাতি ও বর্ণের পবিত্রতা রক্ষা করা। মনু সংহিতায় দেখা যায়, একজন হিন্দু যেকোনাে দেবতাকে পূজা করতে পারে, এমনকি নাস্তিক হতে পারে, কিন্তু যদি একবার সমাজচ্যুত হয়, তবে সাত জন্মেও তা সংশােধন সম্ভব নয়। সমাজ থেকে কেউ নির্বাসিত হলে তা হবে অত্যন্ত কঠিন শাস্তি। এ. সি. বুকে তার Comparative Religion (1964) গ্রন্থে বলছেন, হিন্দুদের ক্ষেত্রে অন্তরে ধর্মবােধের বৈপুর্বিক পরিবর্তনের চেয়ে সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন গ্রহণ ছিল অধিকতর শক্ত। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিত বুকে যথার্থই বলেছেন, সর্বজনীন ধর্মবিশ্বাস হিসাবে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও হিন্দুধর্ম দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ইহুদি ধর্মের মতাে অত্যন্ত রক্ষণশীল। সত্য বটে, এর কতগুলাে মৌলিক ধ্যানধারণা আছে যা সহজে অন্যত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি হিসেবে তা অনেকটা নাৎসিবাদেরই মতাে, জাতি ও রক্তের বিষয়’; যারা একটি নির্দিষ্ট বর্ণে অন্তর্ভুক্ত শুধু তাদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। এ ধর্মে অন্তর্ভুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে নতুন একটি বর্ণের সদস্য হিসেবে যুক্ত হওয়া। এই অনমনীয় ক্রমবিন্যস্ত কাঠামােতে ঢােকার পর কেউ গভীর বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারে, আবার কোনাে কিছু বিশ্বাস না করলেও চলে, সেই বিশ্বাসে কম অনুরক্ত হলেও চলে। এতে স্থূলতম পৌত্তলিকতার যেমন স্থান আছে, তেমনি স্থান আছে নাস্তিক্যবাদী দর্শনের ও ভক্তিপূর্ণ আস্তিকতার। (পৃ. ১৪১)। একই সুরে ই. এ. গেইট ১৯০১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে লিখেছেন যে হিন্দুদের ধর্ম সম্পর্কে ধারণা অনেকটা আমাদের religion-এর কাছাকাছি; এ শব্দ দ্বারা ধর্মীয় মতবাদের চেয়ে বেশি করে আচার-আচরণই বােঝানাে হয়। ভারতে ভেদরেখা ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক, এখানে কোনাে প্রতিবেশীকে কেউ তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রেণীকরণ করে না, বরং তাকে বিচার করে তার সামাজিক মর্যাদা ও জীবনযাপন পদ্ধতির আলােকে। প্রতিবেশীরা কী বিশ্বাস লালন করে, সে ব্যাপারে কারও কোনাে আগ্রহ নেই, বরং সেই প্রতিবেশীর সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা যাবে কি না, তা বিচার করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দেখা দেয়। (পৃ. ১১৩)। ধর্মান্তরের কারণে বর্ণচ্যুত হয়ে অবধারিতভাবে যে মূল্য দিতে হয় তা বিবেচনা করলে আধ্যাত্মিক প্রেরণা বা হৃদয়ের সত্যিকার পরিবর্তন ব্যতীত একজন মানুষের পক্ষে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত বলে মনে হয়। ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নবদীক্ষিতদের জীবনে নিশ্চিতভাবেই নতুন অর্থ ও ভাবাবেগের জন্ম দিয়েছিল। ফলে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তর শুধু সামাজিক দলের বদল ঘটিয়েছে, আধ্যাত্মিক কোনাে সান্তনা দেয়নি বা আধ্যাত্মিক প্রদীপ্তি ঘটায়নি – এ কথা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। কাজেই মুসলমান হওয়ার জন্য হিন্দুদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নয়, বিরাট আধ্যাত্মিক প্রণােদনার প্রয়ােজন ছিল।

(খ) পশ্চিম বাংলা থেকে অভিবাসনের আগে সচ্ছল জীবনের প্রতিশ্রুতি দিলেই হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা সম্ভব ছিল না। তাদের আধ্যাত্মিক প্রেরণার প্রয়ােজন ছিল। ইটন এ সমস্যা সম্পূর্ণ অবহেলা করেছেন। এ প্রসঙ্গে Richard W. Bulliet তার পেপার Review on the Rise of Islam and Bengal Frontier-এ যথার্থই লিখেছেন : “যদিও ইটনের যুক্তিটি অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সাথে করা হয়েছে, তবে এটি যে প্রশ্নটি সম্বোধন করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তার পুরোপুরি উত্তর দেয় না: কেন মুসলিম উদ্যোক্তারা কৃষক শ্রমিক নিয়োগে এত ভাল সফল হয়েছিল, যাদের অনেকেই অবশ্যই ইসলামের সাথে সামান্য পরিচিত ছিল।” (অনুদিত)। প্রশ্ন হলাে, ধর্মান্তর কখন ঘটেছিল। যদি অভিবাসনের আগে ঘটে থাকে তবে আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎস অবশ্যই খুঁজতে হবে। যদি অভিবাসনের পরে ধর্মান্তর হয়ে থাকে, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে হিন্দু হয়েও তারা মুসলমান পীরের কথায় কেন পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে বিপৎসংকুল দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে অভিবাসন করে।

৬. অতি অল্প সময়ে গণধর্মান্তরের ভিত্তিতে বাংলায় ইসলাম প্রচার সম্পর্কে ইটনের ধারণা

(ক) ইটন মনে করেন যে বাংলায় মােগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একশ থেকে দুইশ বছর সময়ের মধ্যে পূর্ব বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণত দুধরনের ধর্মান্তর হতে পারে। (১) ওপর থেকে ধর্মান্তর (২) নিচে থেকে ধর্মান্তর। নিচে থেকে ধর্মান্তরে বেশির ভাগ মানুষের ধর্মান্তরিত হতে অনেক সময় লাগে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হয়। বিশেষ করে ধর্মান্তরিত হলে তার সমাজচ্যুতি হবে। তাই অনেক টানাপােড়েনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে অন্য ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু ওপর থেকে ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে কোনাে রাজা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে এবং তার ধর্ম প্রজাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। অথবা কোনাে উপজাতি (tribe) একসঙ্গে নতুন ধর্মে দীক্ষা নেয়। এমনকি সংঘবদ্ধ গ্রাম সমাজে একত্রে ধর্মান্তর হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সমাজের নেতারা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। তাই অতি দ্রুত ধর্মান্তর ঘটতে পারে। বাংলাদেশে গােত্র বা উপজাতি (tribe) পল্লি অঞ্চলে বাস করত না। এখানে এমন শক্তিশালী রাজা ছিল না যার ধর্ম প্রজাদের ওপর চাপানাের ক্ষমতা ছিল। সংঘবদ্ধ গ্রাম-সমাজ ছিলনা। কাজেই পূর্ব বাংলায় একসঙ্গে গণধর্মান্তর ঘটেনি। এখানে আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণায় আস্তে আস্তে ব্যক্তিপর্যায়ে ধর্মান্তর হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে বাংলায় হিন্দুরা সব সময়ে জীবিত পীরদের মাজেজায় অভিভূত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। এই অঞ্চলে মৃত পীরদের মাজারে মানত করে ফল পাওয়াতেই অনেক হিন্দু মুসলমান হয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ বিবেচনা করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, এখানে ইসলাম ধর্ম প্রসারে ছয়শ থেকে সাতশ বছর সময় লেগেছে। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে ইটনের বক্তব্য নিয়ে অনেক প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব এখনাে পাওয়া যায়নি। বাংলায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মান্তর সম্পর্কে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান নেই। পক্ষান্তরে গণধর্মান্তর সম্পর্কেও কোনাে উল্লেখযােগ্য সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। ব্যক্তিক ধর্মান্তর প্রক্রিয়ায় সাধারণ লােকেরা দীর্ঘদিন ধরে নতুন ধর্ম গ্রহণ করে। কাজেই এর সমর্থনে ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া অত্যন্ত শক্ত। তবু পীরদের সম্বন্ধে যেসব সাহিত্যিক উপাদান রয়েছে, সেসব উপাদান ব্যক্তিক ধর্মান্তরকরণের ধারণা সমর্থন করে। গােষ্ঠীগত ধর্মান্তর একটি বড় ধরনের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে তা ঐতিহাসিক উপাদানে দেখা যেত কিন্তু এ ধরনের কোনাে উপাদানই পাওয়া যায় না।

(খ) বাংলায় ঐতিহাসিক মসজিদসমূহের তারিখের ভিত্তিতে ইটন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন বাংলায় ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে সবচেয়ে বেশি ধর্মান্তর ঘটেছে। ১২০০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় ঐতিহাসিক মসজিদগুলাে নির্মাণের তারিখের সারণী –

সময়কাল ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত সমীক্ষার ভিত্তিতে মােট মসজিদের সংখ্যা  সক্রিয় বদ্বীপে মােট মসজিদের সংখ্যা ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত সমীক্ষার ভিত্তিতে মােট মসজিদের সংখ্যা  সক্রিয় বদ্বীপে মােট মসজিদের সংখ্যা
১২০০ থেকে ১২৫০ খ্রি.
১২৫০ থেকে ১৩০০ খ্রি.
১৩০০ থেকে ১৩৫০ খ্রি.
১৩৫০ থেকে ১৪০০ খ্রি.
১৪০০ থেকে ১৪৫০ খ্রি.
১৪৫০ থেকে ১৫০০ খ্রি. ৫৩ ৬১
১৫০০ থেকে ১৫৫০ খ্রি. ৩৯ ৫৬
১৫৫০ থেকে ১৬০০ খ্রি. ১২ ১৭
১৬০০ থেকে ১৬৫০ খ্রি.
১৬৫০ থেকে ১৭০০ খ্রি. ১৭
১৭০০ থেকে ১৭৫০ খ্রি.
১৭৫০ থেকে ১৮০০ খ্রি. 
মোট ১২৭ ১৮৮  ১২

উৎস –

  • (ক) Richard M. Eaton. 1995. “Approaches to the Study of Conversion to Islam in India”, in Richard, C. Martin (ed.), Approaches to Islam in Religious Studies, Tucson: University of Arizona Press, 1985. P-115
  • (খ) Richard M. Eaton. 1994. The rise of Islam and the Bengal Frontier, P. 67 (Delhi: Oxford University Press)
  • (গ) সক্রিয় বদ্বীপে ব্রিটিশ আমলের খুলনা, বাকেরগঞ্জ, নােয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা অন্তর্ভুক্ত। মসজিদের সংখ্যাসমূহ ইটন কর্তৃক ব্যবহৃত উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছে।

ইটনের ১৯৮৫ সালের সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বাংলায় যেসব ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে, তার ৫২ শতাংশ মােগল আমলে আনুমানিক প্রথম একশ বছরে (১৪৫০ থেকে ১৫৫০ সময়কালে) নির্মিত হয়েছে। ইটনের সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বাংলায় ৬৭.৩ শতাংশ মসজিদ মােগল আমলে (১৪৫০ থেকে ১৫৫০ সময়কালে) মাত্র একশ বছরে নির্মিত হয়। এ দুটি সারণি থেকে ইটন ইঙ্গিত দিচ্ছেন, মােগল আমলেই বেশির ভাগ লোক ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তাই এই সময়েই বাংলায় অধিকাংশ ঐতিহাসিক মসজিদ নির্মিত হয়। তবে ইটন এ কথাও বলেছেন যে মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চল থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উদ্যোক্তা-পীরেরা পূর্ব বাংলার সক্রিয় বদ্বীপে অভিবাসনের মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। মসজিদ সম্পর্কে ইটন যে সারণি তৈরি করেছেন, সেটি কিন্তু সক্রিয় বদ্বীপে ইসলামের দ্রুত সম্প্রসারণ সম্পর্কে তার বক্তব্য সমর্থন করে না। ইটনের বক্তব্য সঠিক হলে চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, বরিশাল ও খুলনা জেলায় যেখানে নতুন নতুন চর জেগে উঠছিল, সে অঞ্চলে মসজিদের সংখ্যা বেশি হওয়া উচিত ছিল। ইটনের ১৯৮৫ সালের সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৪ শতাংশ মসজিদ সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়েছিল। ইটনের ১৯৯৩ সালের সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৩.৬ শতাংশ মসজিদ সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে নির্মিত হয়। আসলে ঐতিহাসিক মসজিদ নির্মাণের তারিখের সঙ্গে বাংলায় ইসলাম প্রচারের কোনাে উল্লেখযােগ্য সম্পর্ক নেই। সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলের জলাভূমিতে গ্রামগুলাে ছিল ছােট ছােট। সেখানে মসজিদগুলােও ছিল ছােট ছােট। নিয়ত নদীপথের গতি পরিবর্তনের ফলে অনেক মসজিদ হারিয়ে যায়। উপরন্তু দরিদ্র মুসলমানদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ী পাকা ইমারতে মসজিদ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। কাজেই এখনাে যেসব পুরােনাে মসজিদ টিকে রয়েছে, তার ভিত্তিতে ইসলাম প্রচার সম্পর্কে অনুমান করা ঠিক নয়। ইটনের ইতিহাস রচনার একটি বড় সমস্যা হলাে যে তিনি তাত্ত্বিক ইতিহাস চর্চায় বিশ্বাসী। তিনি ম্যাক্সভেবারের সামাজিক চিন্তা এবং ফ্রান্সের এনালস ঘরানার ঐতিহাসিকদের প্রণালির ভিত্তিতে ইতিহাস রচনা করতে চান। বিশ্বজনীন (Universal) ইতিহাস রচনার প্রয়ােজনে বাংলার ধর্মান্তরকরণ সম্পর্কে অনেক ছােট ছােট বিষয় তিনি এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু এই ছােট ছােট বিষয়গুলাের যথার্থতা তার বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যক। এর ফলে তার বক্তব্য ত্রুটিপূর্ণ। এখানে তার বক্তব্যের ১৪টি ক্রটি উল্লেখ করা হয়েছে। এই ত্রুটির যেকোনাে একটি মেনে নিলে ইটনের তত্ত্ব ধােপে টেকে না। অথচ উল্লিখিত ১৪টি যুক্তিই তথ্যভিত্তিক এবং বাস্তব। বাংলায় ইসলাম প্রচার সম্পর্কে ইটন তার বক্তব্য পরিবর্তন করেছেন। ১৯৮৫ সালে তিনি ‘Approaches to the Study of Conversion to Islam in India’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন বাংলায় ইসলাম প্রচারে সুফি, দরবেশদের ভূমিকা অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। ভাব মতে জীবিত সুফি পীরদের তুলনায় ইসলাম প্রচারে মৃত সুফিদের ভূমিকা ছিল বেশি। তিনি লিখেছেন, “যদি একজন জীবিত সুফি অমুসলিম ভারতীয়দের ধর্মীয় জীবনে ন্যূনতম প্রভাব বিস্তার করতেন, একজন মৃত সুফি, বিশেষ করে স্থানীয় জনগণের সাধুত্বে আশীর্বাদপ্রাপ্ত, আক্ষরিক অর্থে অলৌকিক কাজ করতে পারতেন। এর কারণ ছিল আধ্যাত্মিকভাবে সম্পৃক্ত সুফি সাধুর ক্যারিশমা বা বারাকা সময়ের সাথে সাথে তার সমাধিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল।” (অনুদিত, পৃ. ১১৭)। উপরন্তু একই প্রবন্ধে ইটন লিখেছেন, “ধর্মান্তরণ প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি প্রভাবশালী এজেন্ট ছিলেন কাদি বা বিচারক গ্রাম, স্থানীয় শক্তি হিসাবে মুসলিম শাসকদের প্রতিষ্ঠার সাথে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। যদিও মধ্যযুগীয় ভারতীয় উলামা এবং বিশেষ করে কাদির ভূমিকা সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন এখনও লেখা হয়নি, প্রাথমিক প্রমাণগুলি বিভিন্ন গ্রামীণ লোকদের মধ্যে অভিন্নতার একটি পরিমাপ প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় বিচারকরা যে কেন্দ্রীয় এবং অব্যাহত ভূমিকা পালন করেছিলেন তার দিকে ইঙ্গিত করে, যারা বিভিন্ন কারণে ইসলামকে অনানুষ্ঠানিকভাবে মেনে চলে।” (অনুদিত, পৃ. ১১৬)। ইটন ইসলাম প্রচারে মুসলমান কাজিদের ভূমিকা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনাে ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থাপন করেননি। পরবর্তীকালে তিনি The Rise of Islam and the Bengal Frontier বইয়ে ইসলামের সাফল্য সম্পর্কে যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তাতে কাজিদের অথবা মৃত পীরদের ভূমিকা নেই। সর্বশেষ তত্ত্ব অনুসারে ইটন বলেছেন, উদ্যোক্তা-পীরেরা পশ্চিমবঙ্গের মৃতপ্রায় বদ্বীপ থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের স্বপ্ন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করেছেন। এবং পূর্ব বাংলার সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে তাদের বসতি স্থাপন করেন। অথচ এই পীরদের কোনাে বিশ্বাসযােগ্য তালিকা তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি।

বাংলায় ইসলাম প্রচার সম্পর্কে ইটনের তত্ত্ব অভিনব। কিন্তু এই অভিনব বক্তব্য যেসব অনুমানের ভিত্তিতে করা হয়েছে, সেসব অনুমান ইতিহাস কর্তৃক মাখত নয়। ইটনের বক্তব্য তাই ইসলামের সাফল্যের কারণ ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট নয়। 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.