চীনে উপনিবেশ অধিকার, প্রথম ও দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিমের যুদ্ধ এবং চা এর উদ্ভব, বিকাশ ও ইতিহাস

ট্‌ষেচিয়াং-এ ৯৮তম রেজিমেন্টের আক্রমণ
প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধে চৈনিক রণতরীর ধ্বংসপ্রাপ্তি

Table of Contents

নজরানা প্রথা

চীনারা নিজেদের সভ্য জাতি বলে মনে করত। আত্মগর্বে গর্বিত চীনা জাতি বিদেশিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেনি। তারা বিশ্বাস করত পথিবীর মধ্যভাগে অবস্থিত চীন হল সভ্যদেশ এবং অন্য সব দেশ হল বর্বর এবং চীনের করদ রাজ্য। সুসভ্য ও স্বর্গের সন্তান চীন কোনােদিনই সমমর্যাদার ভিত্তিতে বিদেশি করদ রাজ্যগুলাের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। তাই চীন বিদেশিদের কাছে তার দরজাকে বন্ধ করে রেখেছিল। চীনের বক্তব্য ছিল প্রতিবেশী ও বিদেশি রাজ্যগুলাে যেহেতু তার করদ রাজ্য তাই তারা চীনকে সম্মান প্রদর্শনে বাধ্য। চীনের এই ধারণা থেকেই নজরানা বা Tribute System-এর জন্ম হয়েছিল। চীন দেশের প্রাচীন রীতি অনুসারে চীনা সম্রাট সামন্তপ্রভু ও জমিদারকে জমি দান করতেন। এর বিনিময়ে তিনি তাদের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য নজরানা হিসাবে পেতেন। কনফুসীয় দর্শন অনুসারে সামন্তপ্রভু ও জমিদাররা নজরানা প্রদান। করে চীনা সম্রাটের কাছে আনুগত্য দেখাতে বাধ্য ছিলেন। নজরানা প্রদান চীনাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল। নজরানা প্রথার মাধ্যমে এটাই প্রতীয়মান হয়েছিল যে চীনা সম্রাট হলেন পৃথিবীশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তিনি স্বর্গপুত্র। তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। অন্য সব দেশের শাসক তার অনুগত করদ শাসক।

এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলাের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণেও নজরানা প্রথা কার্যকর ছিল। চীন তার দুর্বল প্রতিবেশী দেশগুলােকে নিয়ে ‘একটি জাতি সমূহের পরিবার’ অর্থাৎ Family of Nations গড়ে তুলেছিল। এই পরিবারের কর্তা হিসাবে চীন নিজেকে জাহির করেছিল। এই পরিবারের সদস্য ছিল কোরিয়া, লিউচিউ, আন্নাম, জাপান, শ্যাম, ব্রহ্মদেশ, লাওস ইত্যাদি। এই পরিবারেও কনফুসীয় বিধান কার্যকর ছিল। কনফুসীয় বিধান অনুসারে পরিবারের সব সদস্যদের মধ্যে ভালাে সম্পর্ক থাকবে। পরিবারের কর্তাকে সম্মান দেখাতে হবে। এই রীতি অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশগুলাে চীনকে মর্যাদা দিতে বাধ্য ছিল। চীনকে মর্যাদার স্বীকৃতি হিসাবে তারা বিভিন্নভাবে নজরানা’ প্রদান করত। মূলত এই পদ্ধতি ছিল আনুগত্য বিষয়ক। চীন যে শ্রেষ্ঠ নজরানার মাধ্যমে এই সত্য স্বীকৃত হয়েছিল। সেজন্য চীনা সম্রাট তার প্রতিবেশী সহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলােকে তার সমকক্ষ বলে মনে করতে পারেনি।

চীনারা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত না। তাদের চোখে পাশ্চাত্য দেশগুলােও ছিল করদ রাজ্য। চীন তাই পাশ্চাত্য দেশগুলাের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে কোনাে আগ্রহ দেখায়নি। চীনের বক্তব্য ছিল তাদের সঙ্গে পশ্চিমি দেশগুলাে সম্পর্ক স্থাপনে ইচ্ছুক হলে তাদের নজরানা দিতে হবে। চীনের প্রচলিত প্রথা ‘কাওটাও’ তাদের পালন করতে হবে। কাওটাও প্রথা হল নতজানু হয়ে মাটিতে মাথা নত করা এবং সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করা। যেকোনাে বিদেশি সীমান্ত পেরিয়ে চীনা সাম্রাজ্যে প্রবেশ করলে তাকে তিনবার এই পদ্ধতি পালন করতে হত। চীনা দরবারেও একই প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা পরবর্তীকালে বিদেশিদের সাথে চীনাদের তিক্ত সম্পর্কের মূল কারণ হয়ে উঠেছিল। একটি বিশেষ দিনে চীন সম্রাট বিদেশিদের কাছ থেকে নজরানা গ্রহণ করতেন। প্রতিবেশী দেশগুলাে কী ধরনের নজরানা চীনকে দেবে এবং কখন তা পাঠাবে এবং কোন পথ ধরে সেই নজরানা চীনে আসবে তা ঠিক করতেন চীনা সম্রাট। প্রতিবেশী দেশগুলাে কতবার নজরানা প্রদান করবে তাও চীন নির্ধারণ করত। সচরাচর দেখা যায় যে দেশের সাথে চীনের সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল সেই দেশকে তত বেশি নজরানা পাঠাতে হত। দেখা গেছে কোরিয়া বছরে চার বার, ভিয়েতনাম বা আন্নাম প্রতি দু বছরে একবার, শ্যাম বা থাইল্যান্ড প্রতি তিন বছরে একবার চীনকে নজরানা পাঠাত। নজরানা প্রদানকারী দল চীনা রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে ‘কাওটাও’ প্রথাকে মান্য করে নতজানু হয়ে চীনা সম্রাটকে নজরানা প্রদান করতেন। নজরানা পদ্ধতির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল – যা এই পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রতিবেশী দেশগুলাে যখন চীনকে নজরানা পাঠাত সেই দলের সঙ্গে বহু বণিক তাদের পণ্য নিয়ে চীনে আসত। চীন এই বাণিজ্যপণ্যের ওপর কোনাে শুল্ক ধার্য করত না। নজরানা প্রদানকারী প্রতিনিধি দলের সমস্ত খরচ চীন বহন করত। প্রতিনিধি দলের সভ্যদের ও বণিকদের Comrnon Residence for Tributary Envoys নামক আবাস স্থলে থাকার ব্যবস্থা চীনা কর্তৃপক্ষ করতেন। প্রতিনিধি দলের বণিকেরা তাদের পণ্যসম্ভার চীনের বাজারে বিক্রি করতেন। এই বাণিজ্য থেকে বিদেশি বণিকেরা যেমন লাভ করতেন তেমনি চীনের নাগরিকরাও বিদেশি পণ্য কিনে নিজেদের চাহিদা পূরণের সুযােগ পেতেন। তাই বলা যায় নজরানা প্রথা চীনের বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নজরানা প্রদানকারী প্রতিনিধি দলকে চীনা সম্রাট বহুবিধ উপহার প্রদান করতেন। শুধু তাই নয় নজরানা দানকারী দেশগুলাের অলিখিত অভিভাবক হয়ে পড়েছিল চীন। নজরানা প্রদানকারী দেশগুলাের আইনশৃঙ্খলা বজার রাখা, শান্তি অক্ষুন্ন রাখা, রাজন্যবর্গের রাজ্যাভিষেকে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করা ও তাদের বৈধ শাসক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া ইত্যাদি দায়িত্ব চীন পালন করত। এছাড়া ঐ দেশগুলােকে বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষার নৈতিক দায়িত্ব চীনের ছিল। এমনকি ঐ দেশগুলােতে দুর্ভিক্ষ, মহামারি প্রতিরােধেও চীন তার দায়িত্ব পালন করত। সব ধরনের সাহায্য চীন নজরানা প্রদানকারী দেশগুলােকে দিত।

ইউরােপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাে সকল দিক দিয়ে চীনের থেকে শ্রেষ্ঠ হয়েও তারা এই প্রথাকে মানতে বাধ্য হয়েছিল। চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রধান শর্তই ছিল নজরানা প্রথা। পাশ্চাত্য দেশগুলাে নিজেদের স্বার্থে এই শর্তকে মেনে ছিল। পর্তুগাল, হল্যান্ড, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড এই প্রথা মানতে বাধ্য হয়েছিল। পশ্চিমি দেশগুলাে নজরানা ও কাওটাও প্রথাকে মানতে রাজি না হলে চীন তাদের পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিল চীন তাদের এদেশে আসতে আমন্ত্রণ জানায়নি। তারা নিজেদের স্বার্থে এসেছে। তাই তারা চীনের প্রথা মানতে বাধ্য। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ১৬৫৫ সাল থেকে ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত পাশ্চাত্য দেশগুলাে ১৭ বার চীনে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। মাত্র একবার ছাড়া প্রতিবারই তারা চীনকে শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শনস্বরূপ নজরানা প্রদান করতে বাধ্য হয়েছিল এবং কাওটাও প্রথা মেনে নিয়েছিল। অনিচ্ছা সহকারে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ এই পদ্ধতি মানতে বাধ্য হয়েছিল। বিদেশি শক্তিবর্গের তাই মূল লক্ষ্য ছিল নজরানা প্রথা ও কাওটাও প্রথার বিলােপ সাধন করা।

নজরানা প্রথার বিলুপ্তির কারণ

পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাের কাছে নজরানা প্রথা অসহনীয় হলেও চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলাের কাছে এই পদ্ধতি খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক ছিল না। প্রতিবেশী দেশগুলাে নজরানা প্রদানের বিনিময়ে চীনের কাছ থেকে অনেক সুযােগ সুবিধা পেত। চীন ‘বড়ােদাদার’ ভূমিকা পালন করত। প্রতিবেশী দুর্বল দেশগুলােকে চীন বহিরাক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করত। দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মােকাবিলায় চীন তাদের সাহায্য করত। চীন নজরানা প্রদানকারী প্রতিবেশী দেশগুলােকে বহু মূল্যবান উপহার দিত। নজরানা বহনকারী প্রতিনিধি দলের যাবতীয় খরচ চীন বহন করত। প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আগত বণিকদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার চীন দিয়েছিল। ঐ দেশগুলাের রাজন্যবর্গের রাজ্যাভিষেকের সময় চীনা সম্রাট নিজে উপস্থিত থাকতেন কিংবা তার প্রতিনিধি পাঠাতেন। ফলে ঐ দেশগুলাের জনগণ তাদের রাজাকে বৈধ শাসক হিসাবে মানতে বাধ্য হতেন। জনগণের কাছে চীনা সম্রাট কর্তৃক স্বীকৃত রাজার শাসন মর্যাদা পেত। প্রতিবেশী দেশগুলাের তুলনায় সব দিক দিয়ে চীন শ্রেষ্ঠ ছিল। চীনের সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য ছিল। নজরানা প্রথার জন্য ঐ দেশগুলাের সঙ্গে চীনা সংস্কৃতির পরিচয় ঘটত এবং তার প্রভাবে ঐ দেশগুলােতে চীনাদের অনুকরণে সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ রাষ্ট্রের পক্ষে মঙ্গলদায়ক এতে কোনাে সন্দেহ নেই।

নজরানা প্রথার প্রয়ােজনীয়তা থাকলেও কালক্রমে এই প্রথা তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল। পরিণামে এই প্রথার অবলুপ্তি ঘটেছিল। যেসব কারণ নজরানা প্রথার বিলুপ্তির পিছনে দায়ী ছিল সেগুলাে হল এরূপ –

  • (১) বিদেশিদের বিরােধিতা ছিল এই প্রথার অবসানের মূল কারণ। পাশ্চাত্য বণিকেরা এই প্রথাকে অপমানজনক ও আপত্তিকর বলে মনে করত। তারা বাণিজ্যের স্বার্থে বাধ্য হয়ে এই প্রথাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তারা সবসময়ই এই প্রথার বিরােধিতা করে এসেছিল। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বণিকেরা প্রথম থেকেই এই নজরানা প্রথাকে মানতে রাজি ছিল না। শিল্পবিপ্লবের দ্বারা সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডের কাছে এই প্রথা ছিল রীতিমতাে অপমানজনক। তারা চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে নজরানা প্রথার অবসানের দাবি করলে চীনাদের বক্তব্য ছিল চীনা জাতি পাশ্চাত্য দেশগুলােকে বাণিজ্যের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। তা সত্ত্বেও তারা যখন চীনে বাণিজ্য করতে এসেছে তখন তাদের চীনা প্রথা মেনে চলতে হবে। ইংল্যান্ডের বক্তব্য ছিল আন্তর্জাতিক বিধি অনুযায়ী চীনের সাথে তাদের বাণিজ্য চলবে। তারা চীনাদের জানিয়ে দিয়েছিল এই বাণিজ্য তারা বন্ধ করবে না। ফলে বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীন ও পাশ্চাত্য দেশগুলাের সম্পর্ক বিশেষকরে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে নজরানা প্রথার অবসান আসন্ন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত চীনের সাথে ইংল্যান্ডের আফিম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের পরিণতিতে চীন দীর্ঘদিনের নজরানা প্রথার অবসান ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল। 
  • (২) নজরানা প্রথা ছিল যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ। চীনের প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলাের পক্ষে এই প্রথাকে টিকিয়ে রাখা ছিল খুবই অসুবিধাজনক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোরিয়া যখন চীনে নজরানা পাঠাত তখন তার প্রচুর খরচ হত। কোরিয়ার রাজধানী সিওল থেকে পিকিং-এর দূরত্ব ছিল প্রায় ৭৫০ মাইল। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগত ৬০ দিনেরও বেশি। এই নজরানা বাহিনীতে কম করে ২০০-৩০০ জন থাকতেন। তাদের সব খরচ বহন করতে হত কোরিয়ান সরকারকে। নজরানাস্বরূপ যে সামগ্রী তারা চীনা সম্রাটকে দিত তার অর্থমূল্যও ছিল অনেক বেশি। সেজন্য প্রতিবেশী দুর্বল রাষ্ট্রগুলাে এই ধরনের প্রথা মেনে চলতে ক্রমশই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবেশী করদ রাজ্যগুলাের রাজাদের অভিষেক অনুষ্ঠানে চীনা সম্রাটের প্রতিনিধিরা যােগ দিতেন। তাদের জন্য প্রচুর অর্থ প্রতিবেশী দেশগুতে অহেতুক খরচ করতে হত। ফলস্বরূপ ঐ দেশগুলােকে আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়তে হত। পরিণতিতে অনেক দেশ তাদের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানকে বেশ কিছু কাল পিছিয়ে দিতে বাধ্য হত। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় লিউচিউ তাদের রাজার আভষেক অনুষ্ঠান প্রায় দু বছর পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তাই দেখা যায় নজরানা প্রথার বিরােধিতা কেবল পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলােই করেনি। চীনের প্রতিবেশী করদ রাজ্যগুলাের কাছেও এই প্রথার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছিল। কেবল নজরানা প্রদানকারী প্রতিবেশী দেশগুলাের অনীহা নয় এই প্রথায় চীনেরও তেমন আর্থিক লাভ হচ্ছিল না। নজরানা বহনকারীদের জন্য চীনাদের যে আর্থিক খরচ হত তার তুলনায় চীনারা কম মূল্যের উপহার পেত। ফলস্বরূপ এই প্রথার অবসান আসন্ন হয়ে পড়েছিল। 
  • (৩) চীনের কনফুসীয় সমাজ ব্যবস্থায় বাণিজ্যের গুরুত্ব তেমন ছিল না। কিন্তু ১৮শ শতকের মধ্যভাগ থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছিল। এই সময়ে চীনা বণিকেরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেমন শ্যাম, মালয়, জাভা ইত্যাদি দেশে বাণিজ্য শুরু করেছিল। চীনা বণিকদের এই বাণিজ্যকে ‘জাঙ্ক বাণিজ্য’ (Junk trade) বলা হত। চীন দেশের বিশেষ ধরনের বাণিজ্য জাহাজকে ‘Junk’ বলা হত। চীন দেশের বণিকদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে বাণিজ্যের জন্য কোনাে নজরানা প্রদান করতে হত না। স্বাভাবিক কারণে চীন দেশের এই বণিকেরা নজরানা প্রথার বিরােধিতা করেছিল। জাঙ্ক বাণিজ্যের প্রসার নজরানা প্রথার বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিল।
  • (৪) দক্ষিণ চীনের বন্দর শহর ক্যান্টন বিদেশিদের সাথে বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। চীনারা বিদেশিদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে ইচ্ছুক ছিল না। তবে নানা কারণে চীনা কর্তৃপক্ষ বিদেশিদের ক্যান্টনে বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছিল। ক্যান্টন বাণিজ্যের মাধ্যমে ইউরােপীয় বণিকেরা চীনের সাথে ব্যাপকভাবে না হলেও সীমিত পরিসরে বাণিজ্য চালিয়েছিল। ক্যান্টন বাণিজ্য ছিল নজরানা প্রথা বহির্ভূত। ক্যান্টন বাণিজ্যে ইংল্যান্ডের ছিল একাধিপত্য। ইংল্যান্ড কোনােদিনই নজরানা প্রথাকে মানতে পারেনি। আফিম বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পরিণতিতে প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়েছিল এবং নজরানা প্রথা রদ করতে বাধ্য হয়েছিল। চীনের সাথে বিদেশিদের সম্পর্ক স্থাপনে নজরানা প্রথার এতদিন যে গুরুত্ব ছিল তা আর থাকেনি। নজরানা প্রথার পরিবর্তে সন্ধি পদ্ধতি গুরুত্ব পেয়েছিল।

এভাবে দেখা যায় পাশ্চাত্য বণিকদের বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিরােধিতা, জাঙ্ক বাণিজ্যের প্রাধান্য, চীনের প্রতিবেশী করদ রাজ্যগুলাের নজরানা প্রথার প্রতি অনীহা এবং ক্যান্টন বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ইঙ্গ-চীন সম্পর্কের অবনতি চীন থেকে নজরানা প্রথার বিলুপ্ত ঘটিয়েছিল।

ক্যান্টন বাণিজ্য

চীন বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেনি। কিন্তু বিদেশি বণিকেরা চীনের বিশাল বাজারকে তাদের বাণিজ্যের স্বার্থে কাজে খাবার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে চীনা সম্রাট বিদেশিদের ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করার সুযােগ দিয়েছিল। ক্যান্টন বন্দর ছিল দক্ষিণ চীনে অবস্থিত। অবশ্য Tang যুগ (৬১৮-৯০৭) থেকেই এই বন্দর বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই বন্দরে প্রথম হাজির হয়েছিল পর্তুগিজ বণিকরা। উত্তমাশা অন্তরীপ হয়ে ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কৃত হওয়ার পর ১৫১৭ সাল নাগাদ পর্তুগিজ বণিকরা ক্যান্টন বন্দরে এসেছিল। পর্তুগিজের চীনা কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ক্যান্টনের নিকটবর্তী ম্যাকাওতে বাণিজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। তারা অন্যান্য ইউরােপীয় বণিকদের ক্যান্টনে প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পর্তুগিজদের বাধা কার্যকর হয়নি। কারণ অন্যান্য ইউরােপীয় বণিকরা যেমন ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসিগণ ক্যান্টনে এসে উপস্থিত হয়েছিল।

দূর প্রাচ্যে বাণিজ্য করার জন্য ১৬শ শতাব্দীতে ইংরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল। ১৬৩২ সালে ক্যাপটেন ওয়েডেলের (Captain Weddell) নেতৃত্বে একটি বণিক দল ক্যান্টনে এসে উপস্থিত হয়েছিল। তারা জোর করে সেখানে বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছিল। শুধু তাই নয় এ্যাময় (Amoy) এবং নিংপােতে (Ningpo) তারা বাণিজ্য বিস্তারে উদ্যোগ নিয়েছিল। ১৭৫৯ সালে জেমস ফ্লিট নামে এক ইংরেজ বণিক নিংপােতে বাণিজ্যে বাধা পেয়ে সে আদালতের দারস্থ হয়েছিল। এইসব ঘটনা চীনা সরকারকে বিরক্ত করেছিল। সরকার এই নির্দেশ দিয়েছিল যে বিদেশিরা একমাত্র ক্যান্টন ছাড়া চীনের অন্য কোথাও বাণিজ্য করতে পারবে না। এই নির্দেশ ১৮৪২ সালের নানকিং চুক্তি পর্যন্ত কার্যকর হয়েছিল। 

ক্যান্টন বাণিজ্যে বিদেশিদের বেশ প্রতিকূলতার মধ্যে এবং সমঝােতা করে বাণিজ্য করতে হয়েছিল। অথচ অন্যান্য দেশে বিদেশি বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহ থাকে এবং তারা দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্য বিদেশি বাণিজ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু চীন ছিল তার ব্যতিক্রম। কনফুসীয় দর্শনে বিশ্বাসী চীনা সমাজে বাণিজ্যের তেমন গুরুত্ব ছিল না। তাই চীনাবাসীদের কাছে বিদেশি বণিকরা ছিল অবাঞ্ছিত। চীনারা নিজেদের অতি শ্রেষ্ঠ ও সভ্য বলে মনে করত সেজন্য তারা বিদেশি বণিকদের তাদের সমপর্যায়ভুক্ত বলে মনে করত না। তারা বিদেশিদের ওপর নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ আরােপ করেছিল। তাদের বক্তব্য ছিল চীনারা বিদেশিদের কৃপা করে বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছে।

ক্যান্টন বাণিজ্যের মাধ্যমে চীনা সরকার বিদেশিদের ওপর অনেক বাধানিষেধ আরােপ করেছিল। বিদেশিদের ক্যান্টন ছাড়া অন্য কোনাে চীনা বন্দরে বাণিজ্যের অধিকার দেওয়া হয়নি। এমনকি ক্যান্টনেও বিদেশিরা নিজেদের ইচ্ছামতাে বাণিজ্য করতে পারত না। তাদের কো-হং (Co-Hung) নামক বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে বাণিজ্য করতে হত। ক্যান্টন শহরে কতকগুলাে চীনা বাণিজ্যিক সংস্থা একত্রিত হয়ে কো-হং নামে একটি সংগঠন তৈরি করেছিল। কো-হং সংস্থার সদস্যদের ‘হং’ বলা হত। ক্যান্টনের আবগারি অধিকর্তাকে বলা হত হপ্পো (Hoppo)। বিদেশি বণিকদের ক্যান্টনে বাণিজ্য করার জন্য হপ্পোর কাছে আবেদন করতে হত। তারা ছিল আকণ্ঠ দুনীতিপরায়ণ।

ক্যান্টন বাণিজ্যে ‘হং’-দের অপ্রতিহত প্রাধান্য ছিল। হং বণিকদের মাধ্যমেই বিদেশিরা বাণিজ্য করতে বাধ্য ছিল। হং বণিকদের কাছে বিদেশিরা তাদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করত। হং বণিকদের এই একচেটিয়া প্রাধান্য স্বাভাবিক কারণে বিদেশিদের কাছে অভিপ্রেত ছিল না। সুযােগ বুঝে হং বণিকরা বিদেশিদের শােষণ করত। ক্যান্টন বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা প্রচুর মুনাফা অর্জন করেছিল। তারা বিদেশিদের কাছে কম দামে পণ্য কিনত এবং তাদের কাছে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করত। বিদেশিদের কাছে তারা উৎকোচ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল না। ঐতিহাসিক জ্যা শ্যেনাের (Jean Chesneaux) মতে হং বণিকরা ক্যান্টনে বিশেষ অবস্থার সুযােগ নিয়ে অসম্ভব প্রতাপশালী হয়ে পড়েছিল। এর পরিণামে চীনে একধরনের ‘বণিক অভিজাততন্ত্র’ বা Trading Aristocracy তৈরি হয়েছিল। অবশ্য এটা ঠিক যে পরিস্থিতি হং বণিকদের দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠতে বাধ্য করেছিল। কারণ একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার ধরে রাখার জন্য তাদের চীনা রাজদরবারে এবং হপ্পোকে প্রচুর অর্থ উৎকোচ প্রদান করতে হত। হং বণিকরাই ছিল ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রধান পরিচালক। বিদেশি বণিকেরা তাদের কাছে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে বাধ্য ছিল, এমনকি হং বণিকদের মাধ্যমে তারা স্থানীয় প্রশাসন ও রাজদরবারের সঙ্গে যােগাযােগ করত। সব ক্ষেত্রেই বিদেশিদের হং বণিকদের অর্থ দিতে হত। সমস্ত চিঠিপত্র, আবেদনপত্র, এমনকি হং বণিকদের বিরুদ্ধে অভিযােগপত্রও তাদের মাধ্যমে করতে হত। হং বণিকদের কাছে বিদেশি বণিকেরা ছিল দয়ার পাত্র। হং বণিকদের অঙ্গুলি হেলনেই ক্যান্টন বাণিজ্য চলত।

ক্যান্টন বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিদেশি বণিকদের পর বহু বাধা নিষেধ চীনা সরকার আরােপ করেছিল। বাণিজ্য কুঠিতে বিদেশিনী মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। বিদেশি বণিকদের স্বাধীনভাবে নৌকা বিহারের অধিকার ছিল না। বিদেশিরা চীনা ভাষা শেখার অধিকার পায়নি। চীনা আইনের প্রয়ােগ ও বাধ্যবাধকতা বিদেশিদের কাছে অসহনীয় ছিল। কোনাে বিদেশি বণিক চীনা আইন ভাঙলে বা অপরাধ করলে তাকে চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে হাজির করানাের দায়িত্ব ছিল তার ঊর্ধ্বতন আধিকারিকের। তিনি যদি সেই দায়িত্ব পালনে অক্ষম হতেন তাহলে চীনা কর্তৃপক্ষ অপরাধীর পরিবর্তে আধিকারিককে শাস্তি দিত। এই ধরনের অদ্ভুত আইন ও বিচার পদ্ধতি বিদেশিরা মানতে চায়নি। তাদের মনে চীনাদের সম্পর্কে অসন্তোষ ক্রমশই বেড়েছিল।

ক্যান্টন বাণিজ্যে বিদেশিদের মধ্যে ইংরেজদের প্রাধান্য ছিল বেশি। ব্যক্তিগত বরসা বা Private Trade-এর মাধ্যমে তারা বাণিজ্য পরিচালনা করত। ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত জাহাজ এই বাণিজ্যে প্রধান ছিল। ব্যক্তিগত ব্যবসাকে বলা হত Country Trade এবং বাণিজ্য জাহাজগুলােকে বলা হত Country Ship. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন কম ছিল। তাই কোম্পানির কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছিল। ১৮শ শতকের শেষ দিকে ক্যান্টন, ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই বাণিজ্য বুদ্ধির মূল কারণ ছিল চীনে উৎপাদিত চা-এর জন্য ইংল্যান্ডের চাহিদা এবং ভারতে উৎপাদিত তুলা ও আফিম-এর জন্য চীনের চাহিদা। ইংল্যান্ড ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে চীন থেকে আমদানি করত চা, রেশম, চীনামাটির বাসন, দারুচিনি ইত্যাদি। চীনে রপ্তানি করত পশমজাত দ্রব্য, সীসা, টিন, লােহা, তামা, পশুর ললাম, নানাবিধ খেলনা ইত্যাদি। ইংল্যান্ড ভারতে রপ্তানি করত কার্পাস বস্ত্র, ফিটকিরি, কর্পূর, গােলমরিচ, লংকা, সিন্দুর, মিছরি, ওষুধ ইত্যাদি। ভারত থেকে আমদানি করত তুলা, আফিম, রূপা, চন্দন কাঠ, হাতির দাঁত ইত্যাদি।

ইংল্যান্ডের বাজারে চীনের উৎপাদিত চা-এর ভালাে চাহিদা ছিল। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ১৬৮৪ সাল নাগাদ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্যান্টন থেকে বছরে ৫ থেকে ৬ পেটি চা কিনেছিল। সাধারণত এক পেটিতে ১৩৩ পাউন্ড চা থাকত। ১৮শ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ড বছরে ৪০০,০০০ পাউন্ড চা চীন থেকে কিনেছিল। ইউরােপের দেশগুলােতে চা-এর চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেলে চা আমদানির জন্য ক্যান্টন বন্দরে বিদেশি বাণিজ্য জাহাজের ভিড় লেগে যেত। ১৭৫১ সালে ক্যান্টন বন্দরে যেখানে বিদেশি বাণিজ্যের জাহাজের সংখ্যা ছিল ১৯টি সেখানে ১৭৮৭ সালে জাহাজের সংখ্যা ছিল ৮১টি। ১৮শ শতকের শেষ দিকে চীনে আমেরিকা বাণিজ্যের জন্য উপস্থিত হয়েছিল। আমেরিকার বাণিজ্য জাহাজ ‘Empress of China’ নিউ ইয়র্ক থেকে ১৭৮৪ সালে চীনে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের সাথে আমেরিকার বাণিজ্যের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল একচেটিয়া রাণিজ্যের পৃষ্ঠপােষক। অন্যদিকে মার্কিনরা ছিল অবাধ বাণিজ্য নীতির সমর্থক।

স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় যে ক্যান্টন বাণিজ্যের প্রকৃতি ছিল চীনের অনুকূলে এবং বিদেশিদের প্রতিকুলে। বিদেশিদের কোনাে পণ্য সাধারণত চীনারা কিনতে চাইত না। চীনে কোনাে নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক শুল্ক ছিল না। ক্যান্টন বাণিজ্য চলত হং বণিকদের ইচ্ছানুযায়ী। পাশ্চাত্য বণিকরা বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বণিকেরা চীন থেকে চা, সিল্ক, মসলিনজাত দ্রব্য কিনত। কিন্তু তার বিনিময়ে চীনে যথেষ্ট পণ্য তারা বিক্রি করতে পারত না। ফলে ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর সােনা ও রূপা চলে এসেছিল। চীনাদের বিশ্বাস ছিল পাশ্চাত্য দেশগুলাে তাদের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। বিদেশের বাজারে চীনা পণ্যের চাহিদা ছিল। এককথায় বলা যায় যে ক্যান্টন বাণিজ্যের ভারসাম্য ছিল চীনাদের পক্ষে। 

ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথায় চীনারা closed door policy বা রুদ্ধদ্বার নীতি অনুসরণ করেছিল। চীনারা নিজেদের সুসভ্য জাতি এবং বিদেশিদের অসভ্য বলে মনে করত। ক্যান্টন বাণিজ্যকে পরিচালনার জন্য বিদেশিরা অর্থাৎ ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইডেন, ডেনমার্ক, স্পেন ইত্যাদি দেশগুলাে হং বণিকদের কাছ থেকে বছরে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে বাণিজ্য কুঠি ভাড়া নিত। হং বণিকরা পার্ল নদীর তীরে এই বাণিজ্য কুঠিগুলাে নির্মাণ করেছিলেন। বিদেশি বণিকরা এই কুঠিগুলাের মাধ্যমে ক্যান্টন বাণিজ্য পরিচালনা করত। চীনারা এই বাণিজ্য কুঠিগুলােকে “বর্বরদের সংস্থা” বলে উপহাস করত। বিদেশিদের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনােভাব ক্যান্টন বাণিজ্যকে প্রভাবিত করেছিল। আধুনিক কালের অনেক ঐতিহাসিক ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথায় closed door policy কার্যকর হয়েছিল বলে মনে করেন না। তারা মনে করেন এই বাণিজ্যে চীনারা বিদেশিদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল। জা শ্যেনাে এই মতকে সমর্থন করেছেন। 

বিদেশিদের ওপর ক্যান্টন বাণিজ্যে চীনা কর্তৃপক্ষ বহু নিয়ন্ত্রণ জারি করেছিল। তাদের অনেক অসুবিধার মধ্যে বাণিজ্য করতে হত। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে যে এত বাণিজ্যের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিদেশি বণিকেরা বিশেষ করে ইংল্যান্ড কেন চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিল? উত্তরে বলা যায় –

  • (ক) ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব এর পিছনে মূল কারণ ছিল। ইংল্যান্ডের পুঁজিপতি ও বণিকেরা চীনের বিশাল বাজারে তাদের শিল্পজাত পণ্য বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল।
  • (খ) ১৮শ শতকের শেষ দশকে ফরাসি বিপ্লবের ফলে ইউরােপের বাজারে ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্য বিক্রির পথে অনেক বাধার সৃষ্টি হয়েছিল। তাই ইংল্যান্ডের পক্ষে ভালাে বাজার প্রয়ােজন ছিল। বিশাল চীন তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে বলে মনে হয়েছিল। সেজন্য ক্যান্টন বাণিজ্যে এত বাধা সত্ত্বেও চীনের সাথে বাণিজ্য চালিয়ে গিয়েছিল।
  • (গ) নানা বাধা সত্ত্বেও ক্যান্টন বাণিজ্য বিদেশিদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় ও লাভজনক ছিল। বিদেশিরা বিশেষ করে ইংল্যান্ড এই লাভজনক বাণিজ্যকে হাতছাড়া করার মতাে বােকা ছিল না। বরং শক্তিশালী ইংল্যান্ড তাদের বাণিজ্যের পথে বাধা অপসারণের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ করেছিল এবং তারা সফল হয়েছিল। 

ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের কারণ

প্রথম থেকেই বিদেশিরা ক্যান্টন বাণিজ্যের ওপরে চীনাদের মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণকে মানতে পারেনি। বিদেশিরা ক্যান্টন ছাড়া অন্য কোথাও বাণিজ্যের অধিকার পায়নি। বিদেশিদের ব্যক্তিগত জীবনেও চীনা কর্তৃপক্ষ বহু ধরনের অমূলক বাধানিষেধ আরােপ করেছিল। এই ধরনের বাধানিষেধ ও নিয়ন্ত্রণকে বিদেশিরা বিশেষ করে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের বণিককুল মানতে পারেনি। চীনারা নিজেদের সুসভ্য বলে মনে করত। তারা ইংরেজ বণিকসহ সমস্ত পাশ্চাত্য বণিকদের অত্যন্ত খারাপ চোখে দেখত। পাশ্চাত্য বণিকরা চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করতে পারত না। তারা নজরানা প্রথা ও কাওটাও প্রথা মানতে পারেনি। অনেকের মতে কাওটাও প্রথা ও চীনা রাজকর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার ছিল পাশ্চাত্য বণিকদের সাথে চীনাদের তিক্ত ব্যবহারের মূল কারণ।

ক্যান্টন বাণিজ্য পরিচালনা করত হং বণিকরা। তারা ছিল দুর্নীতিপরায়ণ। তাদের চাপানাে শর্তে বিদেশিদের বাণিজ্য করতে হত। তারা যে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করে দিত তাকে বিদেশিরা মেনে চলতে বাধ্য হত। হং বণিকদের মাধ্যমে বিদেশিদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হত। হং বণিকরা বিদেশিদের কাছ থেকে বাণিজ্যের জন্য প্রচুর অর্থ উৎকোচ স্বরূপ গ্রহণ করত। ক্যান্টন বাণিজ্যে হং বণিকদের আচরণ বিদেশিদের ক্ষুব্ধ করেছিল। ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসানে হং বণিকদের দুর্নীতি বিশেষভাবে যে দায়ী ছিল তা বলাই বাহুল্য। 

ক্যান্টন বাণিজ্যের অহেতুক বিধিনিষেধগুলাে বিদেশিরা মানতে চায়নি। ক্যান্টনে বাণিজ্যরত বণিকদের চীনা আইনে বিচার করা হত। চীনা আইন ছিল খুবই কঠোর। বিশেষ করে ফৌজদারি আইন। শাস্তিদান ছিল মধ্যযুগীয়। স্বভাবতই বিদেশিরা চীনা আইনের হাত থেকে মুক্তি দাবি করেছিল। কিন্তু বিদেশিদের কোনাে দাবিকে চীনা কর্তৃপক্ষ মানতে রাজি ছিল না। চীনের বক্তব্য ছিল, বিদেশিদের চীনে আগমন অবাঞ্ছিত। চীনে বিদেশি পণ্যের কোনাে দরকার নেই। এই অপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের জন্য চীনকে দিতে হচ্ছে মহামূল্যবান চা। এতেও যখন বিদেশিরা চীনে খুশি মনে থাকতে নারাজ, তখন তাদের এই দেশে না থাকাই ভালাে। চীনা কর্তৃপক্ষ ক্যান্টন বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ সামান্যতম শিথিল করতে রাজি ছিল না। বরং তারা সবসময় বিদেশিদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করার হুমকি দিত। স্বাভাবিক কারণে বিদেশি বণিকদের সঙ্গে চীনা কর্তৃপক্ষের মতভেদ ক্রমশ বেড়েছিল। উভয়পক্ষের মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক ক্যান্টন বাণিজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল তা বলাই বাহুল্য। 

ক্যান্টন বাণিজ্যে ইংরেজ বণিকদের প্রাধান্য ছিল অন্য বিদেশি বণিকদের তুলনায় বেশি। তারা প্রথম থেকেই ক্যান্টন বাণিজ্যের ওপরে চীনাদের অন্যায় বাধানিষেধ মানতে পারেনি। বাধানিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ ইংরেজ বণিকরা নানা কারণে নানা অজুহাতে চীনাদের সাথে বিরােধে জড়িয়ে পড়ত। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে ১৭৮৪ সালে Lady Hughes-কে কেন্দ্র করে ক্যান্টনে ইংরেজ বণিক এবং চীনাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়েছিল। ১৭৮৪ সালের ১৭ নভেম্বর ওই জাহাজ থেকে তােপধ্বনি হওয়ার সময় দুজন চীনা কর্মচারী গােলন্দাজদের ভুলে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে ক্যান্টনে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। দোষী গােলন্দাজকে চীনারা হত্যা করেছিল। স্বভাবতই এই ঘটনায় ইংরেজরা বিব্রত হয়ে পড়েছিল এবং নিজেদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এছাড়াও নানা কারণে ইংরেজরা চীনাদের প্রতি বিরক্ত ছিল। অসম বাণিজ্য, বাণিজ্যের ওপর কঠোর বাধানিষেধ, উপটৌকন প্রদান, মধ্যযুগীয় চীনা আইনের প্রয়ােগ ইত্যাদির জন্য ইংরেজ বণিকেরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাত। ইঙ্গ-চীন সম্পর্ককে ভালাে করার জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর ইংরেজ কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়েছিল। চীনের সাথে ব্যবসাবাণিজ্যের প্রয়ােজনীয়তার ওপরে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়েছিল। ১৭৮৭ সালে ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার কঠোরতা লাঘবের জন্য এবং চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইংরেজ সরকার কর্নেল চার্লস ক্যাথকাটকে পিকিং দরবারে ব্রিটিশদের প্রতিনিধি হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু চীন যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হলে এই মিশনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। ১৭৯২ সালে ব্রিটিশ সরকার একই উদ্দেশ্যে লর্ড ম্যাকআর্টনিকে চীনে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চীনে ভালাে অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি চীনা সম্রাটকে ইঙ্গ-চীন বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য কতকগুলাে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এগুলি হল ও ক্যান্টন ছাড়াও ব্রিটিশ বাণিজ্যের সম্প্রসারণ করতে হবে, পিকিং শহরে ব্রিটিশ পণ্য বিক্রির জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, ব্রিটিশ বণিকদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, নিয়ম বহির্ভূত বাণিজ্য শুল্ক আদায় বন্ধ করতে হবে, শুল্ক নীতির প্রতিলিপি ব্রিটিশ বণিকদের দিতে হবে। ম্যাকআর্টনির এই প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবে চীনা সম্রাট অগ্রাহ্য করেছিলেন। কেবল তাই নয় চীনা সম্রাট চিয়েন লুং ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে জানিয়েছিলেন চীনের স্বর্গীয় সাম্রাজ্যে কোনাে কিছুরই অভাব নেই, চীনে ব্রিটিশ পণ্যের প্রয়ােজন নেই। চীনা সম্রাট ব্রিটিশ সম্রাট তৃতীয় জর্জকে তার করদ নৃপতি বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন যে ব্রিটিশ সম্রাট যেন ভবিষ্যতে চীনা সম্রাটকে আরও বেশি আনুগত্য দেখান। এই মিশনের ব্যর্থতার পরও ব্রিটিশরা হাল ছাড়েনি। ১৮১৬ সালে তারা পুনরায় আর্মহার্স্টকে চীনে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তিনি চীনের কাওটাও’ প্রথা মানতে রাজি হননি। ফলস্বরূপ এই মিশনও ব্যর্থ হয়েছিল।

তাই বলা যায় যে ইংল্যান্ডের চীনা সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কাগ্রতা ক্যান্টন বাণিজ্যের পতন আসন্ন করেছিল। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইংল্যান্ড চীনে যেসব মিশন পাঠিয়েছিল সেগুলাে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল চীনা সম্রাটের অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি। শিল্পবিপ্লবের পরিণতিতে ইংল্যান্ডের অবস্থার যে আমূল পরিবর্তন হয়েছিল সে সম্পর্কে চীনাদের কোনাে ধারণা ছিল না। এজন্যই চীনা কর্তৃপক্ষ সম মর্যাদার ভিত্তিতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হয়নি। ইংল্যান্ড যে নিছক চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল তা নয় বরং ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্য ছিল চীনে ব্রিটিশ বণিকদের অবাধ বিচরণের পথকে পরিষ্কার করা। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সহজে চীনে কার্যকর হয়নি। তাই পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড শেষ পর্যন্ত চীনে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য যুদ্ধের পথই বেছে নিয়েছিল। পরিণতিতে চীনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে চীন পরাজিত হয়েছিল এবং তার পরিণতিতে ক্যান্টন বাণিজ্যের অবসান হয়েছিল। 

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের কারণ

ভিন্ন স্বার্থ ও অবস্থা : আফিমের যুদ্ধ পর্যন্ত ইঙ্গ-চীন সম্পর্ককে পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে সাম্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ড এবং প্রাচীন ঐতিহ্যসম্পন্ন চীন সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘাতের পেছনে অনেক কারণ ছিল। প্রাচীন চীন নিজেকে বিশ্বের অন্যান্য জাতিদের তুলনায় সুসভ্য বলে মনে করত। আত্মকেন্দ্রিক চীন নিজেকে যতটা সম্ভব বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে চেয়েছিল। অন্যদিকে শিল্পবিপ্লব দ্বারা সমৃদ্ধ ইংল্যান্ড তার বাণিজ্য বিস্তারের জন্য চীনের বিশাল বাজারকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। চীন ও ব্রিটেনের এই পরস্পরবিরােধী মনােভাবকে প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করা যায়। ১৮শ শতকের শুরু থেকে ইংরেজ পুঁজিপতিরা ও বণিকেরা চীনের বিশাল বাজারে তাদের শিল্পজাত পণ্য বিক্রি করতে চেয়েছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর চীনের সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠায় সেখানকার সাধারণ মানুষ পাশ্চাত্যের শিল্পজাত পণ্য কিনতে কোনাে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

বণিকদের সম্পর্কে খারাপ মনোভাব, রাজকর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার ও কাওটাও প্রথা : চীনারা নিজেদেরকে সব সময় অন্যান্য জাতিদের তুলনায় অনেক সভ্য বলে মনে করত। কনফুসীয় দর্শনে বিশ্বাসী চীনা সমাজে বণিকদের ভালাে চোখে দেখা হত না। তাদের কোনাে মর্যাদা ছিল না। পরিণতিতে চীনারা ইংল্যান্ড সহ বিদেশি বণিকদের অত্যন্ত অবজ্ঞা ও হীন চোখে দেখত। ইংরেজ বণিকেরা চীনে অপমান ও খারাপ ব্যবহার সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিল। ইংরেজ বণিক ও ইংরেজ সরকারি প্রতিনিধিরা চীনের প্রশাসনের সাথে এবং চীনা সরকারি কর্মচারীদের সাথে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেনি। কো-হং বণিকদের মাধ্যমে তারা সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে যােগাযােগ করতে বাধ্য ছিল। এজন্য তাদের উৎকোচ দিতে হত। স্বাভাবিক কারণে ইংরেজ বণিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া চীনের প্রচলিত অনেক প্রথা ব্রিটিশদের কাছে ছিল অপমানজনক বিশেষ করে কাওটাও প্রথা। এই প্রথা তাদের কাছে ছিল অত্যন্ত আপত্তিকর। এই প্রথার বৈশিষ্ট্য হল নতজানু হয়ে চীনা সম্রাটের কাছে মাটিতে মাথা ঠেকানাে এবং সাষ্টাঙ্গে সম্রাটকে প্রণাম করা। এই প্রসঙ্গে J. Q. Adams-এর বক্তব্য হল চীনা রাজকর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার এবং কাওটাও প্রথা প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড়াে কারণ ছিল। 

বাণিজ্য ঘাটতি ও শুল্ক নীতি : ইংরেজ বণিকরা চীন থেকে চা, চীনা সিল্ক, মসলিনজাত দ্রব্য ইত্যাদি কিনত। কিন্তু তার বিনিময়ে তারা চীনের বাজারে তাদের শিল্পজাত পণ্যকে বেশি মাত্রায় বিক্রি করতে পারত না। এই বাণিজ্য ইংল্যান্ডের প্রতিকূলে ছিল সেজন্য ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর সােনা ও রূপা চীনে চলে এসেছিল। বাণিজ্যের এই প্রতিকূল অবস্থা ইংল্যান্ডের বণিকদের চীনের প্রতি বিক্ষুব্ধ করেছিল। এছাড়া ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন কোনাে নির্দিষ্ট শুল্ক নীতি অনুসরণ করত না। স্বভাবতই চীনে বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে এই শুল্ক নীতি অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কো-হং বণিক গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও উৎকোচ প্রদান : বিদেশি বণিকরা চীনে বাণিজ্য করার জন্য চীনের একচেটিয়া কো-হং বণিক গােষ্ঠীর সাহায্য নিতে বাধ্য ছিল। কো-হং বণিকেরা ছিল চীনে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। তাদের কাছেই বিদেশিরা তাদের পণ্য বিক্রি করত এবং চীনাপণ্য কিনত। কো-হং বণিক গােষ্ঠীই বাণিজ্যপণ্য কী দামে বিক্রি হবে তা নির্ধারণ করত। কো-হং বণিকরা এই সুযােগে বিদেশিদের কাছ থেকে উৎকোচ হিসাবে প্রচুর অর্থ আদায় করে নিয়েছিল। তারা দালালি হিসাবে অগ্রিম হিসাবে প্রচুর অর্থ বিদেশি বণিকদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করেছিল। ইংরেজ বণিকরা অগ্রিম হিসাবে যে অর্থ কো-হং বণিকদের দিয়েছিল তার বিনিময়ে তারা তাদের কাছ থেকে কোনাে পণ্য পেত না। কো-হং বণিকরা অগ্রিম হিসাবে পাওয়া অর্থ বিদেশিদের ফেরত দেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা বােধ করত না। এই আদায় সংক্রান্ত সমস্যা শেষপর্যন্ত ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া হারানো, নতুন বণিক গোষ্ঠীর উদ্যোগ ও ব্যর্থতা : ১৮৩৩ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার হারিয়েছিল। এরপর থেকে বহু বণিক এককভাবে কিংবা ছােটো ছােটো বণিক গােষ্ঠী মিলিতভাবে চীনের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়েছিল। এই সময় তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার উদ্যোগী হয়েছিল। তারা সরকারিভাবে প্রতিনিধি চীনে প্রেরণ করেছিল। সরকারি প্রতিনিধি দল চীনা সরকারি প্রশাসনের সাথে সমমর্যাদার দিক দিয়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের চেষ্টা সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। এইভাবে সরকারি পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যর্থতা ইংরেজদের সাথে চীন সরকারের সম্পর্ককে তিক্ত করে দিয়েছিল। ইংরেজ বণিকেরা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতাে চীনেও ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করতে চেয়েছিল। এ কারণে সেখানে তারা অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার অর্থাৎ Extra territorial rights প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল। এই সাম্রাজ্যবাদী মনােভাব ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের পটভূমিকা তৈরি করেছিল।

আফিম ব্যবসা এবং চীনে রূপার হ্রাস ও আর্থিক সংকট : প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধকে আফিমের যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে। তাই এই যুদ্ধের পেছনে আফিমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা বলাই বাহুল্য। ৭ম শতকের শেষে এবং ৮ম শতকের শুরুতে চীনে আরব ও তুর্কি বণিকেরা আফিম গাছ চীনে আমদানি করেছিল। চীনারা আফিমকে ব্যথা ও উদ্বেগ কমানাের ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করত। চীনে আফিম-কে Ying-su, Mi-nang বা Po-pi বলা হত। পরবর্তীকালে চীনারা আফিমকে নেশার সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার করেছিল। প্রথম দিকে চীনে ইংরেজদের বাণিজ্য প্রতিকূল অবস্থায় ছিল। চীনে এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সক্রিয় হয়েছিল। তারা চীনের বাণিজ্যকে নিজেদের অনুকূলে আনার জন্য বাংলা থেকে চীনের বাজারে আফিম এনেছিল। চীনারা আফিম খেয়ে নেশায় মত্ত হয়ে পড়েছিল। চীনা সমাজের নৈতিক অধঃপতন শুরু হলে চীনা কর্তৃপক্ষ এই ব্যবসার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ বণিকরা চীন সরকারের নির্দেশ অমান্য করে গােপনে চীনে যথেষ্ট আফিম আনা অব্যাহত রেখেছিল। এই আফিম ব্যবসা থেকে তাদের যথেষ্ট লাভ হয়েছিল। সেজন্য তারা এই ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করতে উদ্যোগ নিয়েছিল। এই আফিম কেনার জন্য চীনারা সাধারণত রূপার মুদ্রা ব্যবহার করত। এর ফলে চীন দেশ থেকে রূপা ক্রমশ চলে যায়। চীন থেকে রূপার এই নির্গমন চরমে উঠলে চীনের অর্থনীতির ওপরে তার প্রভাব পড়েছিল। বাজারে রূপা ও তামার বিনিময় হারে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। ১৭৪০-এ এক টেইল রূপার বিনিময়ে ৮০০ তামার মুদ্রা পাওয়া যেত। সেখানে ১৮২৮ সালে এই বিনিময়ের হার দাঁড়ায় চিলিতে এক টেইল রূপাতে ২৫০০ তামার মুদ্রা এবং শানটুং-এ এক টেইল রূপাতে ২৬০০ তামার মুদ্রা। ফলে চীনে আর্থিক সংকট শুরু হয়েছিল। এই সংকট মােকাবেলার জন্য চীন সরকার বাধ্য হয়ে তামার মুদ্রার মূল্য কমায়। চাষি এবং কুটির শিল্পীরা তাদের পণ্য বিক্রি করে তামার মুদ্রা পেত। কিন্তু সরকারকে তাদের খাজনা দিতে হত রূপার মুদ্রায়। এর ফলে দরিদ্র শ্রেণীর ওপর করের বােঝা বেড়ে গিয়েছিল। তারা স্বভাবতই করভারে জর্জরিত হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে সরকারেরও কর আদায়ের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। এসবের পরিণতিতে চীনে আর্থিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছিল। আফিম থেকে প্রচুর অর্থ আসায় ইংরেজরা চোরাপথে এ ব্যাবসা চীনে অব্যাহত রেখেছিল। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৮০০-১৮২০ সালের মধ্যে চীনে প্রতি বছরে গড়ে ৪৫০০ পেটি আফিম এসেছিল। প্রতি পেটিতে ১৩৩ থেকে ১৬০ পাউন্ড আফিম থাকত। ১৮৩৮-৩৯ সালে আফিম এসেছিল ৪০,০০০ পেটি। আফিম ব্যবসার দ্রুত প্রসার হলে চীনের লােকেরা আফিমের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিল। আফিম এর নেশায় জনগণের নৈতিক মান কমে গিয়েছিল। চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

আফিম ব্যবসা বন্ধ করার জন্য মাঞ্চু সরকারের প্রণীত আইনের ব্যর্থতা : চীনা সরকার বিচলিত হয়ে আফিম ব্যবসাকে বেআইনি বলে ঘােষণা করে এই ব্যবসা বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিল। মাঞ্চু সরকার চোরাপথে আফিম ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য কতকগুলাে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছিল। যেমন –

  • (১) কোনাে বিদেশি যুদ্ধজাহাজ চীনে প্রবেশ করতে পারবে না,
  • (২) বিদেশি উৎপাদনকারী সংস্থাগুলােতে কোনাে বন্দুক ও আগ্নেয়াস্ত্র রাখা যাবে না,
  • (৩) বিদেশিদের সমস্ত নৌকা ও জাহাজকে চীনে রেজিস্ট্রি করাতে হবে,
  • (৪) প্রতিটি বিদেশি উৎপাদনকারী সংস্থাগুলােতে চীনা ভৃত্যের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হবে।

এই আইনগুলোর প্রণয়নের পরও আফিমের বেআইনি ব্যবসা বন্ধ হয়নি। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির জন্য চোরাপথে আফিম আসা বন্ধ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ভারতী পত্রিকায় ১২৮৮ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে চীনে মরণের ব্যবসায়’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “একটি সমগ্র জাতিকে অর্থের লােভে বলপূর্বক বিষ পান করানাে হইল। এমনতর নিদারুণ ঠগবৃত্তি কখনাে শুনা যায় নাই। অর্থ সঞ্চয়ের এইরূপ উপায়কে ডাকাইতি না বলিয়া যদি বাণিজ্য বলা যায় তবে সে নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে। ইহা আর কিছু নয়, একটি সবল জাতি দুর্বলতর জাতির নিকট মরণ বিক্রয় করিয়া কিছু লাভ করিতেছেন।”

লিন্‌-সে-সু এর দায়িত্ব গ্রহণ ও কার্যাদি এবং ক্যাপ্টেন এলিয়ট ও আফিম বণিকদের সাথে বিরোধিতা : মাঞ্চু সরকার ১৮৩৮ সালে এই বেআইনি আফিম ব্যবসা উচ্ছেদ করার জন্য কঠোর নীতি গ্রহণ করেছিল। চীন সরকার লিন্‌-সে-সু (Lin-Tse-hsu) নামে এক অত্যন্ত দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিকে ক্যান্টনে কমিশনার বা রাজপ্রতিনিধির দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি বিদেশিদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কোনাে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাননি। কারণ তিনি বিদেশিদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। তিনি বিদেশিদের সমস্ত আফিম তার কাছে জমা দেয়ার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আদেশ বিদেশি বণিকরা মানতে রাজি ছিলেন না। লিন্-সে-সু বাধ্য হয়ে প্রায় দেড় মাস বিদেশিদের ক্যান্টনে অবরুদ্ধ অবস্থায় রেখে দিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ বণিকেরা তাদের রাজপ্রতিনিধি ক্যাপটেন চার্লস এলিয়টের হাতে তাদের সমস্ত আফিম জমা দিয়েছিল এবং সেগুলাে লিনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। বিশ হাজার পেটি বাজেয়াপ্ত আফিমকে লিন-সে-সু প্রকাশ্যে নষ্ট করেছিলেন। লিন্‌-সে-সু ইংরেজ বণিকদের এই মর্মে এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেছিলেন যে তারা ভবিষ্যতে চীনে আর আফিম আনবে না। কিন্তু ইংরেজ প্রতিনিধি ক্যাপটেন চার্লস এলিয়টের পরামর্শে ইংরেজ বণিকেরা এই ধরনের কোনাে শর্তে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিল। এই ঘটনা ইঙ্গ-চীন সম্পর্ককে তিক্ত করে দিয়েছিল।

মূল কারণ নিয়ে বিতর্ক : চীনা ঐতিহাসিকদের মতে আফিম আমদানির প্রশ্নটি ছিল প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের মূল কারণ। কিন্তু Adams-এর বক্তব্য হল কেবলমাত্র আফিম আমদানির প্রশ্নেই এই যুদ্ধ হয়েছিল তা বলা যায় না। তার মতে বােস্টন বন্দরে চা-এর পেটি ফেলে দেওয়া যেমন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল কারণ ছিল না, তেমনি আফিম আমদানির প্রশ্নটিও ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের প্রকৃত কারণ ছিল না। ইংরেজদের তরফে বিচার করলে তার বক্তব্যের যাথার্থ্যকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ চীনে আফিমের ব্যবসা করা ছাড়াও ইংরেজদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাদের শিল্পজাত পণ্য চীনের বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে সেখানে রাজনৈতিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা। অবশ্য Adams এর এই বক্তব্য বহুলাংশে সত্য হলেও এটা অস্বীকার করা যায় না যে, আফিমের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এদিক দিয়ে বিচার করলে বলতে হয় যে এই যুদ্ধের জন্য চীনের নৈতিক অপরাধ ছিল না। এর জন্য পুরােপুরি দায়ী ছিল ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী মনােভাব।

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ (১৮৩৯-৪২ খ্রি.)

বণিকদের ম্যাকাওতে বিতারন : আফিম ব্যবসা ও অন্যান্য বহু প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ইংরেজদের সঙ্গে চীনাদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। লিন্-সে-সু ইংরেজ বণিকদের কাছ থেকে তারা ভবিষ্যতে চীনে আর আফিম আমদানি করবে না এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে অক্ষম হয়ে তাদের ক্যান্টন ছেড়ে ম্যাকাওতে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। এই ঘটনায় ইংরেজ বণিকেরা অপমানিত বােধ করেছিল এবং তারা প্রতিশােধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

মদ বিক্রিকে কেন্দ্র করে সংঘাত : এই সময় কোলুনের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ১৮৩৯ সালের ৭ জুলাই মদ বিক্রিকে কেন্দ্র করে ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে লিন-ওয়ে-সি (Lin-Wei-hsi) নামে কোলুনের এক মদ ব্যবসায়ীর ঝগড়া হয়েছিল। পরিণতিতে ইংরেজ বণিকেরা তাকে হত্যা করেছিল। ক্যান্টনের কমিশনার লি-সে সু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের তার হাতে সমর্পণের জন্য ইংরেজদের প্রতিনিধি ক্যাপটেন এলিয়টকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না এই অজুহাতে এলিয়ট বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। স্বভাবতই ইংরেজদের আচরণে লিন্‌-সে-সু ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ইংরেজদের বক্তব্য ছিল ব্রিটিশদের বিচার করার কোনাে অধিকার চীনাদের নেই। দোষীদের বিচার ইংরেজদের প্রতিনিধি এলিয়ট করবেন। তিনি বিচারের নামে প্রহসন করেছিলেন।

চীনা যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস ও যুদ্ধের সূচনা : ইংরেজদের যােগ্য জবাব দেওয়ার জন্য লিন-সে-সু তাদেরকে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এমনকি ব্রিটিশদের ম্যাকাও থেকে বিতাড়িত করার জন্য তিনি পর্তুগিজদের ওপর চাপ দিয়েছিলেন। ফলস্বরূপ ইংরেজরা অসুবিধায় পড়েছিল। ক্যাপটেন এলিয়ট চীনা কর্তৃপক্ষকে ভয় দেখানাের জন্য চীন সাগরে সদ্য আগত ইংরেজ নৌবাহিনীকে চীনা নৌবাহিনীর ওপর আক্রমণের আদেশ দিয়েছিলেন। এর ফলে ১৮৩৯ সালের ৩ নভেম্বর ক্ষুদ্র ইংরেজ বাহিনী ক্যান্টন দরিয়াতে উপস্থিত সমস্ত চীনা যুদ্ধ জাহাজকে ধ্বংস করেছিল। পরিণামস্বরূপ প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। 

যুদ্ধ : ১৮৪০ সালের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট চীনা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজরা তাদের এতদিনের সমস্ত অভিযােগ দূর করতে চেয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এই যুদ্ধ ঘােষণার ফলে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তাকে অনেকেই সঠিক কারণে এশিয়াতে ইংরেজদের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধকে মােটামুটিভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ১৮৪০ সালে যুদ্ধ ঘােষণার পর থেকে ১৪১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত উভয়পক্ষের সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করেছি। কিন্তু চুয়েনপি কনভেনশনের (Chuenpi – Convenition 1841) মাধ্যমে দুপক্ষের মধ্যে সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতি ঘটেছিল। এই যুদ্ধবিরতির অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আবার দুপক্ষের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ১৮৪১ সালের ২৭ মে আবার এক যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু এই চুক্তিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নতুন করে দুপক্ষের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। প্রথম দিকে এই সংগ্রাম ক্যান্টন ও সন্নিহিত এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। স্যার হেনরি পটিংগার ক্যান্টন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় যুদ্ধকে সীমাবদ্ধ না রেখে চীনের উপকূল বরাবর উত্তরে অভিযান চালান এবং এ্যাময়, নিংপাে, সাংহাই ইত্যাদি অঞ্চল দখল করেছিলেন। ব্রিটিশরা বিখ্যাত চীনা শহর নানকিং দখলের উদ্যোগ নিলে চীনা রাজদরবার শান্তির জন্য আবেদন করেছিল। সঠিকভাবে মাঞ্চু রাজদরবার উপলব্ধি করেছিল বিদেশিদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয়। চীন সরকারের শান্তি স্থাপনের আবেদনের পরিণতিতে ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্ট নানকিং চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিম যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছিল।

নানকিং চুক্তি (Nanking Treaty) (১৮৪২ খ্রি.)

চীনারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেও ব্রিটিশদের উন্নত রণকৌশল ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। এই যুদ্ধে ২০,০০০ চীনা এবং মাত্র ৫০০ জন ইংরেজ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। ক্যান্টনের কমিশনার লিন্‌-সে-সু উল্লেখ করেছেন আধুনিক রণসজ্জায় ও রণকৌশলে ইংল্যান্ড চীনের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। চীন ইংল্যান্ডের কাছে শান্তির জন্য আবেদন করতে বাধ্য হয়েছিল। পরিণতিতে ১৮৪২ সালের ২৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয়েছিল নানকিং চুক্তি। এই চুক্তির শর্তগুলাে ছিল –

  • ১. চীন ব্রিটেনকে হংকং প্রদান করেছিল। একই সাথে চীন ক্যান্টন, ফুচাও (Foochow), নিংপাে (Ningpo), এ্যাময় (Amoy) এবং সাংহাই (Shanghai) – এই পাঁচটি বন্দর বিদেশি বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করেছিল। এই বন্দরগুলোকে ‘Treaty Ports’ বলা হত। চীনের সাথে পাশ্চাত্য দেশের বাণিজ্যের বিস্তারে এই বন্দরগুলাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই বন্দরগুলােতে ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধি এবং বণিকদের বসবাস ও ব্যবসা করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এই বন্দরগুলােতে বিদেশিদের জন্য আবাসন পল্লি গড়ে উঠেছিল। এই বন্দগুলাের মাধ্যমে প্রচুর বিদেশি পণ্য চীনের বাজারে এলে চীনের কুটির শিল্পের ধ্বংস আসন্ন হয়ে পড়েছিল।
  • ২. আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক যাতে বিধিসম্মতভাবে আদায় করা হয় সে সম্পর্কে চীন ব্যবস্থা নিতে স্বীকৃত হয়েছিল।
  • ৩. চীন বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে রাজি হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারি কর্মচারীরা চীনা সরকারি কর্মচারীদের মতাে সমান মর্যাদা পাবে বলে চীন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অপমানজনক কাওটাও প্রথা চীন তুলে দিয়েছিল।
  • ৪. যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ চীন ১২ মিলিয়ন ডলার দিতে বাধ্য হয়েছিল। নষ্ট আফিমের মূল্য স্বরূপ ৬ মিলিয়ন ডলার এবং কো-হং বণিকদের কাছে প্রাপ্য ৩ মিলিয়ন ডলার চীন দিতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে চীন মােট ২১ মিলিয়ন ডলার অর্থ ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দিয়েছিল।
  • ৫. কো-হং বণিকদের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকারকে হরণ করা হয়েছিল।
  • ৬. বেআইনি দ্রব্য চীনে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে ব্রিটেন চীনের সাথে সহযােগিতায় রাজি হয়েছিল। 

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধকে আফিমের যুদ্ধ বলা হয়ে থাকে, কিন্তু নানকিং চুক্তিতে আফিমের ব্যবসা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ইংল্যান্ডের বক্তব্য ছিল, চীন আফিমের ব্যবসাকে আইনসিদ্ধ করতে পারে বা এই ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিংবা আফিম আমদানিকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু এই ধরনের আদেশ জারি করার অধিকার সম্পূর্ণ চীনের এক্তিয়ারভুক্ত। চীন আফিমের ব্যবসাকে আইনসিদ্ধ করেনি। চীন সাম্রাজ্যে বেআইনি আফিমের আমদানি অব্যাহত ছিল। ব্রিটেন নানকিং চুক্তিতে আফিমের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করে নীতিহীনতার পরিচয় দিয়েছিল। নানকিং চুক্তির পর থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে চীনে আফিমের আমদানি শতকরা তিনশাে ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের ফলাফল

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিমের যুদ্ধ চীনের ইতিহাসের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই যুদ্ধের আগে পর্যন্ত চীন নিজেকে সুসভ্য ও শক্তিশালী বলে মনে করত। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল এবং অপমানজনক নানকিং চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়েছিল। এই চুক্তি দ্বারা চীন এক নতুন যুগে পা দিয়েছিল। এই চুক্তির পরিণতিতে চীন একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। এই যুদ্ধের পর এনে বিদেশি আক্রমণকে রােধ করা যায়নি। চীনের দুর্বলতার সুযােগে পশ্চিমি রাষ্ট্রবর্গ একে একে চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ঐতিহ্যবাহী চীনের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছিল।

ভৌগােলিক অখণ্ডতার ওপর আঘাত : এই যুদ্ধ চীনের ভৌগােলিক অখণ্ডতার ওপর আঘাত হেনেছিল। হংকংকে চীন ব্রিটেনের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। চীন বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক ধার্য করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছিল। বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রকে নানাবিধ সুযােগ সুবিধা দিতে চীন বাধ্য হয়েছিল। চীনের সার্বভৌমত্ব যে এসবের কারণে ক্ষুন্ন হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিদেশিদের কাছে শােষণের মৃগয়াভূমি : নানকিং চুক্তি দ্বারা চীন তার পাঁচটি বন্দর বিদেশিদের কাছে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করতে রাজি হলে চীন ক্রমশ বিদেশিদের কাছে শােষণের মৃগয়াভূমিতে পরিণত হয়েছিল। চীনে এতদিন যে closed door policy কার্যকর ছিল তার অবসান হয়েছিল এবং চীনে open door policy বাস্তবায়িত হয়েছিল। বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত বন্দরগুলােতে বিদেশিদের বসবাসের অধিকার চীন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ফলস্বরূপ চীনের অভ্যন্তরে বিদেশিরা বসবাস আরম্ভ করলে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি চীনে অনুপ্রবেশ করেছিল। পাশ্চাত্যের প্রভাবে চিরায়ত চীনা সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। কেবল তাই নয় চীনের সামগ্রিক ব্যবস্থার ওপর এই যুদ্ধ আঘাত হেনেছিল। চীন বিদেশিদের কাছে মাথা নত করে নজরানা প্রথা ও কাওটাও প্রথা অবলুপ্তি ঘােষণা করতে বাধ্য হয়েদিন। কো-হং বণিক গােষ্ঠীর একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লােপ পেয়েছিল। এর ফলে এতদিন চীন যেভাবে বিদেশিদের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছিল সেই ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল।

ব্রিটেনের উদ্দেশ্য সফল : ব্রিটেন দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। সে দুটি হল চীনের রুদ্ধ দরজাকে উন্মুক্ত করা এবং বাণিজ্যের ব্যাপারে স্বাধীনতা অর্জন করা। এই দুই ক্ষেত্রেই তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। 

চীনের অর্থনীতি চরম ক্ষতি : এই যুদ্ধের পর চীনের অর্থনীতি চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। আফিমকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কিন্তু আফিম সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং দেখা যায় এই যুদ্ধের পরও চীনে চোরাপথে আফিম আমদানি অব্যাহত ছিল। আফিম আমদানি বেড়েছিল। হংকং চীনের হাত থেকে ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াতে চীনের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। হংকং আফিম চোরাকারবারের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। মার্কসের রচনা থেকে জানা যায় যে প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের পর দক্ষিণ চীনে আফিম ব্যবসা জাঁকিয়ে বসেছিল। পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ১৮৪০-এর দশকে চীনে বছরে আফিম আসত ৩৭,০০০ পেটি। ১৮৫০-এর দশকে তা গিয়ে দাঁড়ায় বছরে ৭০,০০০ পেটিতে। এর ফলে চীনের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল। এছাড়া চীন নানকিং চুক্তি দ্বারা পাঁচটি বন্দর বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করলে চীনের বাজারে বিদেশি পণ্য এত চলে এসেছিল। বিদেশি শিল্পজাত পণ্যের সঙ্গে চীনের কুটির শিল্পজাত পণ্য প্রতিযােগিতায় টিকতে পারেনি। পরিণতিতে ধীরে ধীরে চীনা কুটির শিল্পের ধ্বংস আসন্ন হয়ে পড়েছিল। হাজার হাজার চীনা নাগরিক কর্মচ্যুত হয়ে বেকারে পরিণত হয়েছিল। চীনের আকাশে অশান্তির কালাে মেঘ জমেছিল। জীবন যুদ্ধে পরাজিত হতাশাগ্রস্ত অসহায় চীনারা তাদের লাঞ্ছনার জন্য বিদেশি ও মাঞ্চু শাসকদের দায়ী করেছিল। নানকিং চুক্তিতে চীনকে যে মােট ২১ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ দিতে হয়েছিল তার আঘাত চীন-অর্থনীতি সহ্য করতে পারেনি।

অন্যান্য শক্তিদের বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে চিনে প্রবেশের পথের উন্মুক্ত হওয়া : প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধে চীনের পরাজয় চীনের অভ্যন্তরে অন্যান্য শক্তিদের বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে প্রবেশের পথকে উন্মুক্ত করেছিল। নানকিং চুক্তিকে চীনের ওপর জোরপূর্বক চাপানাে প্রথম অসম এবং বৈষম্যমূলক চুক্তি বলা যায়। পরবর্তীকালে এরূপ আরও অনেক অসমমূলক চুক্তি পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীরা চীনের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। এই সময় থেকে চীন তার রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বাধীনতা হারিয়ে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ছিল।

ঐতিহ্যগত সামাজিক জীবনে প্রভাব : এই যুদ্ধের প্রভাব চীনের ঐতিহ্যগত সামাজিক জীবনের ওপরেও পড়েছিল। কনফুসীয় দর্শনে বিশ্বাসী চীনা সমাজ বণিকদের মর্যাদা ভালাে ছিল না। কিন্তু এই যুদ্ধের পর চীনে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছিল। চীনে বিদেশি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। ফলে চীনের সমাজে তখন এক নতুন শ্রেণীর জন্ম কয়ছিল। তারা বিদেশি বণিকদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করছিল। এই শ্রেণীকে বলা হত Comprador Class বা বেনিয়ান শ্রেণী। এই শ্রেণী বিত্তশালী ছিল। মাও-সে-তুং-এর মতে এই শ্রেণীর সমৃদ্ধি সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাদের সাথে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের যােগ ছিল। তারা অবশ্য চীনকে আধুনিক করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। 

মধ্যযুগীয় জীবনধারা থেকে মুক্তি : অনেকের মতে এই যুদ্ধ হয়তাে চীনের আর্থিক-সামাজিক সকল ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ ছিল। তবুও অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে এই যুদ্ধের পর চীন তার মধ্যযুগীয় জীবনধারা থেকে মুক্তির আস্বাদ পেয়েছিল। ফেয়ারব্যাঙ্ক, ভিনাক, ইম্যানুয়েল শ্যু প্রমুখ পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক, জ্যাঁ শ্যেনাে, ইজরায়েল এপস্টেইন, জিয়ান বােজান প্রমুখ মার্কসীয় পণ্ডিতেরাও প্রথম আফিম যুদ্ধকে আধুনিক চীনের সূচনা পর্ব বলে উল্লেখ করেছেন। এই যুদ্ধের পর চীনে সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন এসেছিল। চীন তার মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা থেকে ধীরে ধীরে আধুনিকতার দিকে এগিয়েছিল।

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধে লিন্-সে-সুর ভূমিকা

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিম যুদ্ধের পেছনে লিন-সে-সুর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। মাঞ্চু সরকার ১৮৩৮ সাল বেআইনি আফিম ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা চালায়। চীন সরকার লিন্‌-সে-সু নামক এক দক্ষ অফিসারকে ক্যান্টনের কমিশনার নিয়ােগ করলে ইঙ্গ-চীন সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা পেয়েছিল। আফিম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চীনা রাজদরবার দুটি পরস্পরবিরােধী গােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদল চেয়েছিল আফিম ব্যবসাকে আইনসিদ্ধ করা হােক। তাহলে চোরাপথে আফিম আমদানি যেমন বন্ধ হবে তেমনি অন্যদিকে সরকারের আয় বাড়বে। অন্য একদল নৈতিকতার দিক দিয়ে চালিত হয়ে এই ব্যবসাকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। নৈতিকতার পতনকে অধিকাংশ চীনা বুদ্ধিজীবী মানতে পারেন নি। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সরকার চীন থেকে বেআইনি আফিম ব্যবসা বন্ধ করার। জন্য লিন-সে-সুকে দায়িত্ব দিয়েছিল। সেই সময় একাজে লিনের থেকে অন্য কেউ দক্ষ ছিলেন না তা বলাই বাহুল্য। 

লিন-সে-সু (১৭৮৫-১৮৫০) ছিলেন তৎকালীন চীনের এক বিশেষ শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব। এই পণ্ডিত ব্যক্তি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সমসাময়িক ঘটনাবলি, পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি তার জ্ঞান ছিল। পাশ্চাত্য বণিকদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি দায়িত্বশীল সরকারি কাজে নিযুক্ত ছিলেন। কিয়াংশুর গভর্নর বা হু কোয়াং-এর গভর্নর জেনারেল হিসাবে তিনি নিজ যােগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। এই সৎ অকপট ব্যক্তিত্বকে চীনবাসী নীল আকাশের সঙ্গে তুলনা করেছিল। তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব ছিল নীল আকাশের মতাে নির্মল ও পরিচ্ছন্ন। তাকে যে Lin the blue sky বলা হত তা ছিল সার্থক।

মাঞ্চু সরকার লিন কে বেআইনি আফিম ব্যবসা রদ করার দায়িত্ব দিয়ে ক্যান্টনের কমিশনার পদে পাঠান। ১৮৩৯ সালের ১০ মার্চ ৫৪ বছর বয়স্ক লিন কমিশনার হিসাবে ক্যান্টনে এসেছিলেন। তিনি আফিম ব্যবসা বন্ধ করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যেসব চীনা বণিক এই অসৎ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি উয়েহুয়া অ্যাকাডেমিতে প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন বিদেশিরা বেআইনি আফিম ব্যবসা করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে। এই ব্যবসা বন্ধ করে দেয়ার অর্থ বিদেশি তথা ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া এবং যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। প্রথম দিকে দিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে জড়িত হতে চাননি। তিনি বিদেশিদের শক্তি সম্পর্কে বেশি সচেতন ছিলেন। তিনি প্রথম দিকে আফিম ব্যবসার ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে প্রচার চালিয়েছিলেন। তাতে কাজ হয়েছিল। এই ক্ষতিকারক ব্যবসার সঙ্গে যেসব চীনা বণিক জড়িত ছিলেন তিনি তাদের কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। তিনি দেশি ও বিদেশি বণিকদের মজুত আফিম তার হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার আদেশ বিদেশি বণিকরা মানতে চায়নি। দেশের স্বার্থে তিনি বেআইনি আফিম ব্যবসাকে বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে বিদেশিদের এই ব্যবসা তিনি বন্ধ করবেন। তিনি প্রয়ােজনে বিদেশিদের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতেও রাজি ছিলেন। তিনি বিদেশীদের আদেশ দেন তাদের মজুত করা সমস্ত বেআইনি আফিম তার হাতে তুলে দিতে হবে। ভবিষ্যতে বিদেশিরা এই ধরনের ব্যবসা করবে না এই অঙ্গীকার তাদের করতে হবে।

লিন্‌-সে-সু বিদেশিদের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। তিনি বিদেশি সংবাদপত্র ও তাদের বিভিন্ন লেখাগুলােকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। তিনি ভ্যাট্টেল (Vattel)-এর রচিত আন্তর্জাতিক আইনের গ্রন্থগুলোকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করিয়ে পড়েছিলেন। এইসব গ্রন্থগুলো পড়ার উদ্দেশ্যে ছিল কীভাবে চোরা কারবার বন্ধ করা যায় এবং এক্ষেত্রে কী পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ঘােষণা করা যায় তার জটিল দিকগুলােকে অনুধাবন করা। তিনি সমগ্র পরিস্থিতিকে জানিয়ে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়াকে দুটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই পত্রগুলো ইংল্যান্ডের রানির কাছে পৌছেছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে। তিনি দ্বিতীয় চিঠিতে ইংল্যান্ডের রানিকে লিখেছিলেন, অন্য দেশের লােকেরা যদি আপনার দেশে আফিম নিয়ে গিয়ে আপনার প্রজাদের আফিমের নেশায় অভ্যস্ত করে তােলে আপনি নিশ্চয় তাদের ঘৃণা করবেন, প্রতিবাদ জানাবেন। আপনি নিজে যা চান না তা অন্যদেশের উপর চাপাবেন না।

সমঝােতার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে লিন্‌-সে-সু কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তৈরি হয়েছিলেন। ১৮৩৯ সালের ২৪শে মার্চ তিনি বেআইনি আফিম ব্যবসা বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ কুঠি বা ফ্যাক্টরিগুলোকে অবরােধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রায় দেড় মাস বিদেশিদের ক্যান্টনে অবরুদ্ধ অবস্থায় রেখেছিলেন। বাধ্য হয়ে ইংরেজরা তালের রাজপ্রতিনিধি ক্যাপ্টেন চার্লস এলিয়েটের হাতে তাদের সমস্ত আফিম জমা দিয়েছিল এবং সেগুলো লিনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। বিশ হাজার পেটি বাজেয়াপ্ত আফিমকে লিন প্রকাশ্যে নষ্ট করেছিলেন। এই ঘটনায় ইংরেজ বণিকেরা ক্ষুব্ধ ও অপমানিত হয়েছিল এবং কীভাবে এই অপমানের প্রতিশােধ নেওয়া যায় তার প্রহর গুনেছিল। লিন্-সে-সু ইংরেজ বণিকদের এই মর্মে এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেছিলেন যে তারা ভবিষ্যতে চীনে আর আফিম আনবে না। কিন্তু ইংরেজ বণিকরা এই ধরনের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেনি। এই ঘটনা ইঙ্গ-চীন সম্পর্ককে খারাপ করেছিল। লিন ইংরেজ বণিকদের কাছ থেকে তারা ভবিষ্যতে চীনে আর আফিম আমদানি করবে না এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে অক্ষম হয়ে তাদের ক্যান্টন ছেড়ে ম্যাকওয়েতে চলে যেতে বাধ্য করেছিলেন। এই ঘটনাও ইংরেজদের অপমানিত করেছিল। এইসব ঘটনাবলি থেকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে লিন্‌-সে-সু বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। লিন-সে-সু ব্রিটিশ জাতির আত্মাভিমানে আঘাত করেছিলেন। একে মুখ বুজে সহ্য করার শিক্ষা তাদের অভিধানে ছিল না।

ইঙ্গ-চীন সম্পর্ক এই ঘটনার পর কোলুনে মদ বিক্রিকে কেন্দ্র করে আরও তিক্ত হয়েছিল। ১৮৩৯ সালের ৭ই জুলাই ইংরেজরা লিন-ওয়ে-সি নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। ক্যান্টনের কমিশনার এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ইংরেজদের তার হাতে তুলে দিও যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজ প্রতিনিধি এলিয়ট নানা অজুহাতে বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আসলে ইংরেজদের বক্তব্য ছিল ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার করার কোনাে অধিকার চীনাদের নেই। দোষীদের বিচার এলিয়ট করবেন। দিনি বিচারের নামে প্রহসন করেছিলেন। ইংরেজদের যােগ্য জবাব দেওয়ার জন্য লিন তাদেরকে খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি পর্তুগিজদেরকে ব্রিটিশদের ম্যাকাও থেকে তাড়াবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৮৩৯ সালের ২৬ আগস্ট ব্রিটিশরা ক্যান্টন থেকে হংকং-এ চলে গিয়েছিল। কমিশনার লিন্‌-সে-সু ওই দিন বিজয়ীর মতাে ক্যান্টন পরিভ্রমণ করেছিলেন। এইসময় পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে চীনাদের বিরােধের সকল স্তরে লিনের সাফল্য ছিল প্রশ্নাতীত। ইম্যানুয়েল শু-র ভাষায় : Upto this point Lin had won at every stage of the conflict.

আফিম যুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে লিন্‌-সে-সুর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। লিন্‌-সে-সুর ভূমিকা ইংরেজদের অসুবিধায় ফেলেছিল। বেআইনি আফিম আমদানি করে ইংরেজ বণিকেরা প্রচুর মুনাফা লাভ করেছিল। লিন্‌-সে-সু তাদের অসাধু ব্যবসায় বাধা দিয়েছিলেন। সামরিকভাবে ইংরেজরা পিছু হটলেও বাস্তবে দেখা যায় লিনের ভূমিকা প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করেছিল। প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিমের যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়েছিল। নানকিং চুক্তি দ্বারা ইংরেজরা চীনের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল তাদের অপমানের জবাব। 

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের কারণ

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ ছিল এশিয়াতে ইংরেজদের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। কারণ ব্রিটিশ সরকার ১৮৪০ সালের এপ্রিল মাসে চীনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তি জয়লাভ করেছিল এবং চীনারা পরাজিত হয়েছিল। চীনাদের পরাজয়ে কোনাে রহস্য ছিল না। বরং তাদের পরাজয় ছিল অনিবার্য। চীনাদের পরাজয়ের পেছনে যে কারণগুলোকে উল্লেখ করতে হয় সেগুলো হল –  

  • ১. চীন নিজেকে খুবই শক্তিশালী বলে মনে করত। তাদের ধারণা ছিল তাদের সাম্রাজ্য স্বর্গীয় এবং তারা অপরাজেয়। প্রতিপক্ষ ব্রিটিশ শক্তি সম্পর্কে তাদের কোনাে ধারণা ছিল না। চীনারা ভেবেছিল বিদেশি শক্তিকে তারা হেলায় হারাবে। তাদের এই আত্মবিশ্বাস ও অন্ধ ধারণা তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
  • ২. ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্ক আফিম যুদ্ধে চীনাদের পরাজয়ের কারণ হিসাবে সামরিক বাহিনীর দুর্বলতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। চীনের সামরিক সংগঠন ছিল দুর্বল। চীনা সামরিক সংগঠন ছিল মধ্যযুগীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন। আফিম যুদ্ধের সময় মাঞ্চু সরকারের ছয় লক্ষ সেনা ছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীতে কোনাে শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা ছিল না। মাঞ্চু সৈন্যবাহিনীকে বলা হত গ্রিন স্ট্যান্ডার্ড আর্মি। এদের সৈনিক না বলে পুলিশ বাহিনী বলাই সংগত। সেনাদের মধ্যে কোনাে সমন্বয়, দেশপ্রেম ছিল না। দুর্নীতির আকর ছিল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতাে সেনা নিয়ােগ করতেন। যােগ্য ব্যক্তিদের অনেক সময় সেনা হিসাবে নিয়ােগ করা হত না। উৎকোচ বা ঘুষের মাধ্যমে সেনা সংগ্রহ করা হত। পাচক ও ভৃত্যদের কেউ সেনা হিসাবে দেখিয়ে অফিসাররা অর্থ আত্মসাৎ করত। শৃঙ্খলার কোনাে নমুনা মাঞ্চু বাহিনীর মধ্যে ছিল না। সৈনিক হয়েও তারা যুদ্ধকে ভয় করত। এমনকি যুদ্ধক্ষেত্র থেকেও পালিয়ে যেত। সমসাময়িকদের রচনা বিশেষ করে সাে-সুং-টাং নামক এক দেশপ্রেমিকের রচনা থেকে জানা যায় যে স্থলবাহিনী ঘােড়ায় চড়তে জানে না, তীর নিক্ষেপ করতে পারে না, নৌসেনা জাহাজ চালাতে জানে না, কামান দাগতে পারে না। এই ধরনের সৈন্যরা ব্রিটিশদের মতাে দক্ষ সেনাদের সঙ্গে জিতবে এই আশা দুরাশার নামান্তর। 
  • ৩. চীনাদের দক্ষ নৌবহরের অভাব ছিল। ভারতের মােঘল শাসকদের মতাে মাঞ্চুরাও নৌবহরকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। মাঞ্চুরা ছিল উত্তর চীনের লােক। নদী বা সমুদ্রের সঙ্গে তাদের তেমন পরিচয় ছিল না। সে জন্য তারা নৌবহর গঠনে তেমন উৎসাহী ছিল না। চীনা নৌবাহিনী কতকগুলো সেকেলে কাঠের জাঙ্ক (Junk) এবং নৌকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ নৌবাহিনী মতাে বাষ্পচালিত জাহাজ চীনের ছিল না। চীনা নৌবহরে কোনাে সমন্বয় ছিল না।
  • ৪. মাঞ্চু গোলন্দাজ বাহিনীও শক্তিশালী ছিল না। কামান গুলো ছিল পুরােনাে। সবদিক দিয়ে তাদের দ্রুত ঘােরানো যেত না। এগুলাে ছিল অকেজো। পক্ষান্তরে ব্রিটিশ বাহিনী ছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। ব্রিটিশ মর্টার, মাস্কেট্‌স এবং কার্বাইনসকে চীনা সেনারা তীর, ধনুক বা বর্শা দিয়ে মােকাবেলা করতে পারেনি। তাই তাদের পরাজয় ছিল সুনিশ্চিত। আফিমের নেশায় চীনা সেনারা তাদের স্বাভাবিক বীরত্বকেও হারিয়ে ফেলেছিল।
  • ৫. চীনাদের মধ্যযুগীয় মানসিকতাও তাদের পরাজয়ের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মাঞ্চু শাসকগােষ্ঠী মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় আবদ্ধ ছিল। তাদের ধারণা ছিল ইংরেজ সেনারা রাত্রিবেলায় ভালাে দেখতে পায় না। ইংরেজ সেনাদের পা কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকার জন্য তারা ভালাে যুদ্ধ করতে পারে না। তাদের পায়ে আঘাত করলে পরাস্ত হবে। এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব মানসিকতার জন্য তাদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। সিয়াং-টিং-ফু (Tsiang-Ting Fu) ‘The English and the Opium War’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন চীনাদের মধ্যযুগীয় মানসিকতাই তাদের পরাজয়ের প্রধান কারণ। তার মতে “There was no mystery in our defeat, it was inevitable.” 
  • ৬. চীনাদের পরাজয়ের পেছনে মূল কারণ ছিল ব্রিটিশদের সহজাত জেতার নেশা। চীনের পার্শ্ববর্তী বিশাল দেশ ভারতকে তারা ইতিমধ্যে পরাস্ত করে তাদের মানদণ্ডকে রাজদণ্ডে পরিণত করেছিল। ভারত থেকে শিক্ষা নেওয়ার কোনাে অভিপ্রয়াস চীনাদের ছিল না। ব্রিটিশ সরকারের মদতপুষ্ট আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় পারঙ্গম ব্রিটিশ সেনারা খুব সহজেই চীনাদের পরাজিত করেছিল।
  • ৭. চীনা সরকারের কৌশলগত ভুলও এই যুদ্ধের ভাগ্যকে স্থির করেছিল। লিন সে-সুর মতাে দক্ষ দেশপ্রেমিক অফিসার প্রথম ব্রিটিশদের চরম শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্রিটিশদের পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল। 
  • ৮. চীন তথা মাঞ্চু শাসকদের ধারণা ছিল তারা সভ্য, তাদের সংস্কৃতি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত সংস্কৃতি। তারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশকে অবজ্ঞার চোখে দেখত। নিজেদেরকে তারা বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। সময়ের সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নেয়ার শিক্ষা চীনাদের ছিল না। তাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতা তাদের ক্রমশ কূপমণ্ডুক করে দিয়েছিল। ডাঃ সান-ইয়াৎ-সেন ১৯১২ সালের ৫ জানুয়ারি এক ইস্তাহারে লিখেছিলেন – মাঞ্চুরা মুর্খতা ও স্বার্থপরতায় অন্ধ হয়ে বিশ্ববাসীর সঙ্গে চীনের সব সংযােগকে বন্ধ করে দিয়েছিল। ডাঃ সান আরও লিখেছিলেন ও চীনের রাজকর্মচারীরা ঘুষখাের – এটা জেনেও সম্রাটরা কোনাে সংস্কারের ব্যবস্থা করেনি। বরং ঘুষ খেয়ে চরিত্রহীন কর্মচারী নিয়ােগ করতেই তারা ব্যস্ত ছিলেন। যােগ্যতা বা গুণ অনুযায়ী কর্মচারী বাছাই মাঞ্চুদের সময় হয়নি। সান-ইয়াৎ সেনের এই বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে মাঞ্চু শাসনের দুর্বলতা এবং তাদের পশ্চাৎপদ মানসিকতা তাদের পতন সুনিশ্চিত করেছিল। 

নানকিং চুক্তি থেকে পিকিং কনভেনশন পর্যন্ত চীনের ইতিহাস

নানকিং চুক্তি চীনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছিল। এই চুক্তিতে ইংরেজ বণিকেরা বহুবিধ সুযােগ সুবিধা পেলেও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হয়নি। তাদের সাম্রাজ্যবাদী লালসা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা চীনে বৈদেশিক বাণিজ্যকে কেবলমাত্র পাঁচটি বন্দরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়নি। তারা চীনে অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার দাবি করেছিল। নানকিং চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছর পর ব্রিটিশ শক্তি চীনকে ১৮৪৩ সালে আর একটি চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করেছিল। এই চুক্তিটির নাম হল ‘বক চুক্তি’ (Treaty of Bogué, 1843)। এই চুক্তিতে ব্রিটিশ নাগরিকেরা চীনে ‘অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার’ (Extra Territorial Rights) পেয়েছিল। এতে ঠিক হয় যে Treaty Ports সমূহে অবস্থিত ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচারের অধিকার চীনের থাকবে না। তাদের ইংরেজদের আইন অনুযায়ী ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বিচার করবে। এই ধারণাটি চীনের সার্বভৌমত্বের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর ছিল। এই চুক্তি দ্বারা ব্রিটেন চীনকে তাদের সর্বাপেক্ষা সুবিধাপ্রাপ্ত জাতির (the most favoured Nation) অধিকার দিতে বাধ্য করেছিল। এর দ্বারা বলা হয় যে চীন অন্য যেকোনাে পাশ্চাত্য দেশকে যেসব সুযােগ সুবিধা দেবে ব্রিটেনকেও তারা সেই সব সুযােগ সুবিধা দিতে বাধ্য থাকবে। এই ধারাটিও চীনের সার্বভৌমত্বের পক্ষে যথেষ্ট অবমাননাকর ছিল। ইংল্যান্ডের সঙ্গে নানকিং চুক্তি ও বক চুক্তি স্বাক্ষরের পর চীনের দুর্বলতা অন্যান্য দেশের কাছেও প্রকট হয়ে পড়েছিল। তারাও চীনের কাছ থেকে এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর করে ‘অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার’ ও ‘সর্বাপেক্ষা সুবিধাপ্রাপ্ত জাতির মর্যাদা দাবি করেছিল। ইউরােপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাের চাপের কাছে নতি স্বীকার করা ছাড়া দুর্বল চীনের আর কোনাে উপায় ছিল না।

চীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি মিঃ কালেব কুসিং (Mr. Caleb Cushing) চীনের সাথে ১৮৪৪ সালে ওয়াংহিয়া চুক্তি (Treaty of Wanghia) স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তিতে আমেরিকা অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার লাভ করেছিল। এর ফলে চীনে বসবাসকারী কোনাে মার্কিন নাগরিক যদি কোনাে চীনার সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে তবে তার বিচার করবে মার্কিন কনসাল। মার্কিন অপরাধীদের বিচার করার অধিকার চীনা আদালতের থাকবে না। এই চুক্তি দ্বারা মার্কিনিরা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি’র মর্যাদা পেয়েছিল। শুল্ক ধার্য করার অধিকার চীন হারিয়েছিল। আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর শুল্ক ধার্য করার সময় বা শুল্কের হার পরিবর্তনের সময় চীনা কর্তৃপক্ষ মার্কিন কনসালের সঙ্গে পরামর্শ করতে বাধ্য থাকবেন। বিদেশ থেকে আসা যেকোনাে জাহাজ চীনে প্রবেশ করতে পারবে এবং চীনা সরকারের বিনা অনুমতিতে সেই জাহাজ চীন ত্যাগ করতে পারবে। মার্কিনরা বিদেশিদের বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত পাঁচটি বন্দরে গির্জা তৈরির অধিকার পায়। ১২ বছর পর এই সন্ধির পুনর্মূল্যায়ন করা হবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। 

ফ্রান্সও চীনের কাছে অনুরূপ সুযােগ সুবিধা অর্জনের জন্য দাবি জানিয়েছিল। চীন সেই দাবি মেনে নিয়ে ১৮৪৪ সালে ফ্রান্সের সঙ্গে স্বাক্ষর করেছিল Whampoa চুক্তি। এই চুক্তিতে ফ্রান্সও অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি রূপে গণ্য হওয়ার অধিকার পেয়েছিল। এই চুক্তিতে ফরাসিরা আর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পেয়েছিল। তারা Treaty Port গুলােতে যে ক্যাথলিক গির্জা নির্মাণের অধিকার পেয়েছিল সেগুলােকে রক্ষা করার অপ্রত্যক্ষ দায়িত্ব বর্তেছিল চীনা সরকারের উপর। এরপর বেলজিয়াম, নরওয়ে, সুইডেন, পাের্তুগাল প্রভৃতি দেশও চীনের কাছ থেকে অনুরূপ সুযােগ সুবিধা লাভ করেছিল। এইসব চুক্তিগুলােকে অসম বা বৈষম্যমূলক চুক্তি বলা যায়। কারণ বিদেশিদের চীন তার দেশে যেসব সুযােগ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছিল তার পরিবর্তে চীন ঐ সব দেশের কাছ থেকে কোনাে সুযােগ সুবিধা পায়নি।

চীন এতগুলাে বিদেশি রাষ্ট্রকে (এর মধ্যে কয়েকটি দুর্বল দেশও ছিল) এইসব সুযােগ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছিল তার প্রধান কারণ হল চীনের সামরিক দুর্বলতা। এ ছাড়া চীন চিরন্তন প্রাচ্য কূটনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ‘Divide and Survive’-এর নীতি অনুসরণ করে নিজের স্বাধীন অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তার এই নীতি অন্তত কিছুটা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল তা বলা যায়। তবে এটাও ঠিক যে এইসব অসম ও বৈষম্যমূলক চুক্তি স্বাক্ষর করায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে চীনের মর্যাদা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছিল। এইসব অসম চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হওয়ায় পরবর্তীকালে চীনকে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। চীন পাশ্চাত্য দেশগুলােকে অল্প শুল্কে অবাধ বাণিজ্যের অধিকার দেওয়াতে চীনে শিল্পের উন্নতি ব্যাহত হয়েছিল।

চীন নানকিং চুক্তিতে প্রথম পাঁচটি বন্দর বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে সে আরও বহু বন্দরকে বহুভাবে মুক্ত বন্দর হিসাবে ঘােষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। এইসব মুক্ত বন্দরে বিদেশি বণিকেরা পরিবারবর্গসহ বসবাসের অধিকার পেয়েছিল। বন্দরের এক একটি এলাকা ক্রমশ একই রাষ্ট্রের বণিকদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে যেসব এলাকাকে নির্দিষ্ট করে দেয় হয়েছিল সেগুলােকে পরবর্তীকালে বিদেশি কনশেসন (Concessions) বলা হত। এই কনশেসনগুলাের শাসনের সম্পূর্ণ অধিকার ছিল ঐসব বিদেশি রাষ্টের। কনশেসনগুলােতে বিদেশি শক্তিসমূহ নিজেদের পুলিশবাহিনী এবং শাসন ও বিষয় ব্যবস্থা রেখে সেগুলােকে নিজেদের পছন্দমতাে শাসন করত। এইভাবে চীনে Treato port গুলােতে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদেশি উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল। কার্যত এই কনসেশনগুলো ছিল চীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। কনশেসনগুলাের অস্তিত চীনের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে অবমাননাকর ছিল। ১৮৫৪, ১৮৬০ এবং ১৮৮১ সালে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে এইসব কনশেসনের ওপর বিদেশিদের অধিকার চীন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

Treaty Port গুলােতে বিদেশিদের এই ধরনের সুযােগ সুবিধা দেওয়ার পেছনে চীনা কর্তৃপক্ষের কিছু উদ্দেশ্য ছিল ও তারা এই কনশেসনগুলাের প্রতিষ্ঠার অধিকার বিদেশিদের দিয়েছিল এই ভেবে যে, বিদেশিরা এই কনশেসনের মধ্যেই বাস করবে এবং তার ফলে চীনের অন্যান্য অঞ্চলে পাশ্চাত্যের প্রভাব অনুপ্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু চীনের এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এইসব কনশেসনে বহু চীনা বাস করত। কনশেসনে বাস করার ফলে এইসব চীনাদের ওপর চীন কর্তৃপক্ষের কোনােরকম নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এর ফলে চীনা সাম্রাজ্যে পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত একদল চীনাবাসীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব চীনের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

কনশেসনে বসবাসকারী বিদেশিদের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত খারাপ। তারা হঠকারী আচরণ করত। চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে বিদেশিরা ক্রমশই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দুর্বল চীনের পক্ষে এই অবস্থার প্রতিকার করা সম্ভব হয়নি। এইসব Treaty Port এবং সেখানে অবস্থিত বৈদেশিক কনশেসনসমূহ চীনের সাথে পাশ্চাত্য দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুবিধ তিক্ততার সৃষ্টি করেছিল। তাই পরবর্তীকালে চীন এইসব সুযােগ সুবিধা প্রত্যাহার করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চীন যতদিন দুর্বল ছিল ততদিন পর্যন্ত পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তাদের এইসব অধিকার ও বিশেষ সুযােগ সুবিধা বজায় রাখতে পেরেছিল। ২০শ শতকে চীন যখন চিয়াং-কাই-শেকের নেতৃত্বে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল তখন বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলাে এইসব অসম চুক্তির ধারাগুলো ক্রমশ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তারা চীনে Extra Territorial Rights ভােগ করেছিল। এভাবে দেখা যায় যে চীনের সাথে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলাের সম্পর্কের ক্ষেত্রে Treaty Port-গুলাের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। 

দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ (১৮৫৬-৬০ খ্রি.)

নানকিং চুক্তি এবং তার পরে স্বাক্ষরিত ‘বক চুক্তি’, ‘ওয়াংহিয়া’ এবং Whampoa পভতি চুক্তিতে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ চীনের কাছ থেকে বহু সুযােগ সুবিধা পেলেও তাতেও তারা খুশি বা চরম পরিতৃপ্ত হয়নি। কারণ এইসব চুক্তির পরও সমগ্র চীন বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। তাই পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ চীনে তাদের বাণিজ্যকে আরও বেশি মাত্রায় সম্প্রসারিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। অন্যদিকে চীন বৈদেশিক শক্তিসমূহকে আর অতিরিক্ত সুযােগ সুবিধা দিতে আদৌ ইচ্ছুক ছিল না। স্বাভাবিকভাবে দুপক্ষের এই পরস্পরবিরােধী মনােভাবের জন্য যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিণাম হল দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ।

দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পেছনে বিবিধ কারণ বর্তমান ছিল। বিদেশিরা বিশেষ করে ইংরেজ বণিক ও শিল্পপতি পুঁজিপতিরা আশা করেছিল যে, নানকিং চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি বন্দর বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হওয়ায় এবং কো-হং বণিক গােষ্ঠীর একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার হরণ করায় চীনের বাজারে দ্রুত ব্রিটিশ বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং ইংরেজ পুঁজিপতিরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে যে এই চুক্তির পরবর্তী দশকে চীনে রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি না পেয়ে বরং তা হ্রাস পেয়েছে। এর প্রধান কারণ হল ওই সময় চীনে রূপার অভাব দেখা দিয়েছিল। রেশম বস্ত্র এবং চা রপ্তানি করে চীনারা যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করত তার প্রায় সবটাই বেআইনি আফিম কিনতে ব্যয় হয়ে যেত। তাই তারা পাশ্চাত্য দেশগুলাে থেকে বেশি পরিমাণে শিল্পজাত পণ্য কিনতে পারত না। এছাড়াও চীনের অভ্যন্তরে পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য যে অভ্যন্তরীণ শুল্ক দিতে হত সেটাও বিদেশি পণ্য চীনে রপ্তানির পক্ষে বাধাস্বরূপ হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই ইংরেজ শিল্পপতিরা এই অভ্যন্তরীণ শুল্কের বাধা অপসারিত করতে উদ্যোগী ছিল। তারা সমগ্র চীনকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করতে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ দিয়েছিল।

এছাড়া নানকিং চুক্তি পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ বা চীনা কর্তৃপক্ষ কোনাে পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। চীনে তখনও বেআইনিভাবে আফিম আমদানি বন্ধ হয়নি এবং দরিদ্র চীনাদের কুলি মজুর হিসাবে বিভিন্ন উপনিবেশে প্রেরণ করা অব্যাহত ছিল – সেজন্য চীনা কর্তৃপক্ষ ক্ষুব্ধ ছিল। পাশ্চাত্য বণিক ও নাবিকদের উদ্ধত ব্যবহার এবং চীনাদের হেয় জ্ঞান করার জন্য সাধারণ চীনারাও স্বাভাবিকভাবে বিদেশিদের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। অপরদিকে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ পিকিং-এর রাজদরবারে পূর্ণ মর্যাদায় তাদের রাজপ্রতিনিধি প্রেরণ করতে চেয়েছিল। পাশ্চাত্য বণিক ও খ্রিস্টান মিশনারিগণ বিনা বাধায় চীনের সর্বত্র ব্যবসা ও ধর্মপ্রচার করার অধিকার দাবি করেছিল। এইসব দাবি ও অধিকার অর্জনের জন্য পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ বিশেষ করে ব্রিটেন যে চীনের ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করেছিল তাকে দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ বলা যায়।

এভাবে উভয়পক্ষই যখন নানা কারণে অসন্তুষ্ট ছিল তখন সামান্য এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ডের সঙ্গে চীনের দ্বিতীয় বার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ইংল্যান্ড চীনের সামরিক দুর্বলতার সুযােগকে কাজে লাগিয়ে তার সঙ্গে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করেছিল। ‘লর্চা অ্যারাে’ (Lorcha-Arrow) ঘটনা তাদের সেই সুযােগ এনে দিয়েছিল। লর্চা অ্যারাে ছিল চীনা মালিকানায় কিন্তু হংকং-এর রেজিস্ট্রিকৃত একটি জাহাজ। ১৮৫৬ সালে এই জাহাজটি বেআইনি ব্যবসায় লিপ্ত আছে এই অভিযােগে চীনা কর্তৃপক্ষ জাহাজটিকে আটক করেছিল এবং এই জাহাজের সমস্ত নাবিককে বন্দি করেছিল। এই জাহাজে ব্রিটিশদের জাতীয় পতাকা উড্ডীন ছিল। চীনারা ব্রিটিশদের জাতীয় পতাকাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। ক্যান্টনের ব্রিটিশ কনসাল হ্যারি পার্কাস এই ঘটনাকে ইংরেজদের সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং ব্রিটেনের মর্যাদার প্রতি হানিকর বলে মনে করেন। এর জন্য ইংরেজ সরকার চীনের কাছে লিখিত ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। সে সময়ে ক্যান্টনে চীনা ভাইসরয় ইয়া-মিন-চিং (Yeih-Min-Ching) ছিলেন অত্যন্ত সাহসী পুরুষ। তিনি ইংরেজদের প্রস্তাবকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার চীনাদের এই অনমনীয় মনােভাবের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ব্রিটিশদের সম্মান রাখার জন্য চীনের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এই ঘটনা ছিল দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণ। প্রথমদিকে এই যুদ্ধ ১৮৫৬ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ দুবছর ধরে চলেছিল। 

কিছুদিন যুদ্ধ চলার পর ফ্রান্স চীনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে যােগ দিয়েছিল। কারণ ওই সময়ে এক ফরাসি ক্যাথলিক যাজক চ্যাপ ডেলেইন (Chap delaine) চীনের অভ্যন্তরে নিহত হয়েছিলেন। ফরাসি সরকার এই হত্যাকাণ্ডকে ‘Judicial Murder’ হিসাবে গণ্য করেছিল। তারা এর জন্য চীনের কাছে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করলে চীন তা অগ্রাহ্য করেছিল। এর ফলে ফরাসিরা ইংরেজদের সাথে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যােগ দিয়েছিল। ইঙ্গ-ফরাসি যৌথ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশদের পক্ষে লর্ড এলগিন এবং ফরাসিদের পক্ষে ব্যারন গ্রস। আমেরিকা ও রাশিয়া এই অভিযানে অংশ না নিলেও চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তাদের প্রতিনিধি উইলিয়াম রিড ও এ্যাডমিরাল পুটিয়াটিনকে পাঠিয়েছিল। 

ইঙ্গ-ফরাসি বাহিনী ক্যান্টন শহর দখল করেছিল। ১৮৫৮ সালের মধ্যে এই যৌথ বাহিনী চীনাদের জলে ও স্থলে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করেছিল। চীন নিরুপায় হয়ে সন্ধির জন্য আবেদন জানিয়েছিল। এই সময়ে অন্যান্য বিদেশি শক্তিবর্গও রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়ে চীনাদের হুমকি দিয়ে বলেছিল যে চীন ইঙ্গ-ফরাসিদের যেসব সুযােগ সুবিধা দেবে তাদেরকেও সেইসব সুযােগ সুবিধা দিতে হবে। অবশেষে ১৮৫৮ সালে এ তিয়েনসিনে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার সাথে পৃথক পৃথক চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। এইগুলাে সামগ্রিকভাবে তিয়েনসিন চুক্তি বা ‘Tient Sein Treaties’ নামে পরিচিত। ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে নিম্নলিখিত ধারাগুলাে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য –

  • ১. চীন আরও দশটি নতুন বন্দর বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করেছিল।
  • ২. চীন পিকিং দরবারে ব্রিটিশ রাজদূত রাখার অধিকার মেনে নিতে রাজি হয়েছিল।
  • ৩. ব্রিটিশ বণিক এবং খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের চীনের অভ্যন্তরে সর্বত্র বিনাবাধায় ব্যবসা করার এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অধিকার মেনে নেওয়া হয়েছিল।
  • ৪. চীন ব্রিটেনকে প্রচুর অর্থ ক্ষতিপূরণস্বরূপ দিতে বাধ্য হয়েছিল।
  • ৫. চীন তার বাণিজ্য শুল্ক হার পণ্যমূল্যের শতকরা ৫ ভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে রাজি হয়েছিল। এই ধারাটি চীনের সার্বভৌমত্ব এবং আর্থিক স্বাধীনতার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর ছিল। এই ধারাটি মেনে নেওয়াতে চীনের কুটির শিল্পের বিকাশে বাধার সৃষ্টি হয়েছিল।
  • ৬. চীনের ইয়াংসিকিয়াং উপত্যকা সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিল। এই উপত্যকার সম্পদ বিনা বাধায় ব্যয় করার অধিকার ইংরেজরা পেয়েছিল।
  • ৭. চীন ব্রিটেনের চাপে আফিম-এর ব্যবসাকে আইনসম্মত করতে রাজি হয়েছিল। এই ধারাটির সংযােজন ব্রিটেনের নৈতিক মর্যাদার পক্ষে লজ্জাকর ছিল।

ফ্রান্সও চীনের কাছ থেকে প্রায় অনুরূপ সুযােগ সুবিধা লাভ করেছিল। রাশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছ থেকে বহু সুযােগ সুবিধা আদায় করেছিল। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাের কাছে চীন তখন ছিল কামধেনুর মতাে। যত পার চীনকে দোহন কর’ এই ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের দৃষ্টিভঙ্গি।

ঠিক হয়েছিল যে এইসব চুক্তি পিকিং দরবারে অনুমােদি হবে এবং সেখানে বিদেশি রাজপ্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবে। কিন্তু পিকিং-এ কোনাে পশ্চিমি প্রতিনিধির স্থায়ী উপস্থিতির শর্তটি চীনারা মানতে পারেনি। তাই চীনা কর্তৃপক্ষ পিকিং-এ বিদেশি রাজপ্রতিনিধিদের আসায় অনুমতি দিতে আগ্রহী ছিল না। তাই তারা এই চুক্তিসমূহকে পিকিং-এর পরিবর্তে ক্যান্টন, সাংহাই বা তিয়েনসিনে অনুমােদনের প্রস্তাব দিয়েছিল। 

ইংরেজ ও ফরাসিরা চীনের এই বক্তব্যকে বিশ্বাসভঙ্গের শামিল বলে মরে করেছিল। ইংরেজ ও ফরাসিরা তিয়েনসিন থেকে নদীপথে পিকিং-এ জোর করে যাওয়ার চেষ্টা করলে টাকু নামক স্থানে চীনারা তাদের ওপর গােলাবর্ষণ করেছিল। এই ঘটনার প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য ইংরেজ ও ফরাসিরা চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল। ইঙ্গ-ফরাসি  বাহিনী পিকিং-এর দ্বারদেশে এসে উপস্থিত হয়েছিল। তারা চীন সম্রাটদের গ্রীষ্ম প্রাসাদ ধ্বংস করেছিল। চীনা সম্রাট রাজধানী ত্যাগ করে মাঞ্চুরিয়াতে পালিয়ে যান। সম্রাটের ছােটো ভাই যুবরাজ কুং পিকিং ত্যাগ করেননি। গ্রীষ্মকালীন রাজপ্রাসাদ ধ্বংসে পর তিনিও পিকিং ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই ইগনাটিয়ে তাঁকে পিকিং না ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং ইঙ্গ-ফরাসিদের দাবি মেনে নিতে বলেছিলেন। রুশ রাষ্ট্রদূত বিদেশি ও চীনাদের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। অবশ্য তিনি এই সুযােগে চীনের কাছ থেকে রুশদের জন্য বেশ কিছু সুযােগ সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিলেন। পরাজিত চীন ও বিজয়ী ইঙ্গ-ফরাসিদের মধ্যে ১৮৬০ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল পিকিং কনভেনশন (Convention of Peking) বা পিকিং চুক্তি। চীনের সম্রাটের হয়ে এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রিন্স কুং।

পূর্ব বছরের ঘটনার জন্য মাঞ্চু সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছিল এবং তারা পিকিং দরবারে স্থায়ী ব্রিটিশ রাজদূত রাখতে সম্মত হয়েছিল। চীন ক্ষতিপূরণস্বরূপ দেয় অর্থের পরিমাণ বাড়াতে এবং তিয়েনসিন বন্দরকে উন্মুক্ত করতে রাজি হয়েছিল। হংকং-এর বিপরীতে চীনের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত কোন উপদ্বীপ চীন ব্রিটেনকে দিতে বাধ্য হয়েছিল। ফরাসিদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে ওপরের অধিকাংশ ধারাগুলাে থাকা ছাড়াও চীন ফরাসি মিশনারিদের চীনের অভ্যন্তরে জমি কেনার ও তার উপর গির্জা তৈরি করার অধিকার দিয়েছিল। 

পিকিং কনভেনশন স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রুশ দূত ইগনাটিয়েভের পরামর্শে ইংরেজ ও ফরাসিরা পিকিং ত্যাগ করেছিল। রুশ দূত তাদের বুঝিয়েছিলেন যে আসন্ন শীতে পিকিং-এ তাদের অসুবিধা সৃষ্টি হবে। সেই সুযােগে চীনারা তাদের ওপর আক্রমণ হানবে। ইংরেজ ও ফরাসিরা রুশ দূতের পরামর্শ মতাে পিকিং ত্যাগ করলে ধূর্ত রুশ দূত চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে উসুরি (Ussuri) নদীর পূর্বদিকের সমস্ত অঞ্চল লাভ করেছিল। চীনের কাছ থেকে রাশিয়া বেশ কিছু বাণিজ্যিক সুযােগ সুবিধা পেয়েছিল। রাশিয়া চীনের সাথে যুদ্ধ না করে কেবলমাত্র কূটনীতির প্রয়ােগে চীনের কাছ থেকে অনেক সুযােগ সুবিধা লাভ করেছিল। 

এইভাবে দেখা যায় যে নানকিং চুক্তি থেকে শুরু করে পিকিং কনভেনশন স্বাক্ষরিত হওয়ার সময়ের মধ্যে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের চাপ সহ্য করতে না পেরে চীন তাদেরকে বহু সুযােগ সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছিল। এইসব সুযােগ সুবিধা দানের ফলে চীনে সার্বভৌমত্ব বহুগুণ ক্ষুন্ন হয়েছিল বলা যায়। বিশেষ করে বিদেশিদের অতিরাষ্ট্রীয় অধিকার, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত জাতির অধিকার এবং অতি নিম্নহারে বাণিজ্য শুল্ক আরাে করতে রাজি হয়ে তার স্বাধীনতা বহুলাংশে হারিয়েছিল। 

প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ বা আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর নানকিং চুক্তির মাধ্যমে চীনের বদ্ধদরজা (closed door) কিছুটা খুলেছিল কিন্তু তিয়েনসিন এবং পিকিং কনভেনশন স্বাক্ষরিত হওয়ার পর চীন প্রায় সম্পূর্ণরূপে বিদেশি বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়েছিল।

তিয়েনসিন সন্ধি ও পিকিং কনভেনশনের দ্বারা চীন কেবলমাত্র আরও বেশি বন্দর উন্মুক্ত করতে রাজি হয়নি, সে দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি পণ্যের অবাধ চলাচলের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। বিদেশিরা চীনের অভ্যন্তরে বসবাস, অবাধে ভ্রমণ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরির অধিকার পেয়েছিল। এর ফলে চীনের অভ্যন্তরে পাশ্চাত্যের প্রভাব বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল। পিকিং দরবারে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের বসবাসের অনুমতি দিয়ে চীন বিদেশি রাজপ্রতিনিধিদের আইনের চোখে সমান মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত চীন সমস্ত বিদেশিদের রাজধানী থেকে দূরে সরিয়ে রেখে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যে বাধা বা অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল তা আর বজায় ছিল না। তাই বলা যায় নানকিং চুক্তি যদি চীনের রুদ্ধ দরজা উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হয় তাহলে দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধের পরাজয়ের পর সে বিদেশিদের চীনে প্রবেশ সম্পর্কে সমস্ত বিধিনিষেধ অপসারিত করতে বাধ্য হয়েছিল। 

সবদিক দিয়ে বিবেচনা করলে ১৮৬০ সালকে চীনের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর বলে অভিহিত করা যায়। এর আগে পর্যন্ত বিদেশিদের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চীন অনেকটা তার মর্জিমতাে চলত। কিন্তু এরপর থেকে সে তার বৈদেশিক সম্পর্ক পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী দেশগুলাের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত করতে থাকে। ১৮৬০ সালের পর থেকে প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী চীন দেশ পাশ্চাত্যের কাছে পুরােপুরি পরাজিত ও অপমানিত হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে চীনের ঐতিহ্যবাহী কনফুসীয় চিন্তা সম্বলিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আদর্শ ভেঙে পড়েছিল। চীনের মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজে আধুনিকতা প্রবেশ করেছিল। মাঞ্চু শাসকেরা জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে জনরােষ ধূমায়িত হয়েছিল। বার বার বিদেশিদের কাছে চীনা সরকারের মাথা নত করাকে জনগণ মানতে পারেনি। ফলস্বরূপ মাঞ্চু সরকারের বিরুদ্ধে জনরােষ বিদ্রোহের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল।

উপকূলকেন্দ্রীয় অর্থনীতি ও মুৎসুদ্দি শ্রেণীর (Compradore class) উত্থান

১৮৪২ সালের নানকিং থেকে ১৮৬০ সালের পিকিং কনভেনশন পর্যন্ত সময় পর্বে চীনে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ নিজেদের শক্তিকে সব দিক দিয়ে বাড়িয়েছিল। তারা চীনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে সুদৃঢ় করলে তাদের বাণিজ্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। নানকিং চুক্তির পর থেকে চীন বাধ্য হয়েছিল বিদেশিদের কাছে বহু বন্দরকে উন্মুক্ত করতে। এই ধরনের উন্মুক্ত বন্দরগুলােকে বলা হত চুক্তি বন্দর বা Treaty Ports। এগুলো বিদেশিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত আর্থিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এইসব অঞ্চলের অর্থনীতিকে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করত বিদেশিরা। তাদের নিয়ন্ত্রণে চীনের উপকূল অঞ্চলে এক বিশেষ ধরনের অর্থনীতির জন্ম হয়েছিল। একে বলা হয় Coastal Enclave Econony বা পরিবেষ্টিত অর্থনীতি।

এই উপকূল কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় বন্দর সংলগ্ন এলাকায় বিদেশিরা জমি কিনে বসবাস করত। তারা মুক্ত বন্দর এলাকায় পরিবারবর্গসহ বাস করত এবং নিজেদের ধর্মাচরণের জন্য গির্জা নির্মাণ করেছিল। বন্দরের এক একটি এলাকা ক্রমশ এক একটি দেশের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল। একে ‘কনসেশন ব্যবস্থা বলা হত। এই কনসেশনগুলাের শাসনের সম্পূর্ণ অধিকার ছিল ঐসব বিদেশি রাষ্ট্রের। এখানে তারা বাণিজ্য সংস্থা, পরিবহন সংস্থা, শিল্প কেন্দ্র, কুঠি, ব্যাংক, বিমা ইত্যাদি নির্মাণ করেছিল। চীনের Treaty port গুলােতে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদেশি উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। এগুলো ছিল চীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এইসব বন্দর শহরে বিদেশিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তি নির্ভর উপকূল কেন্দ্রীয় অর্থনীতি গড়ে তুলেছিল। বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে চীন বিদেশিদের এই অধিকারকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। 

Treaty ports গুলােতে চীনারা বিদেশিদের সব ধরনের সুযােগ দিতে বাধ্য হয়েছিল। তাছাড়া চীনা কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল, বিদেশিরা এইসব কনসেশনের মধ্যে বাস করবে। ফলে বিদেশিদের প্রভাব চীনের অন্যসব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু চীনের এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ফলে বিদেশিদের নিয়ন্ত্রিত এই অর্থনৈতিক এলাকায় বহু চীনা নানা কাজে বিদেশিদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এইসব চীনাদের উপর চীনা কর্তৃপক্ষের কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এর ফলে চীনা সাম্রাজ্যে পাশ্চাত্যের প্রভাবে প্রভাবিত একদল চীনাবাসীর আবির্ভাব ঘটেছিল। চীনাদের এই শ্রেণীকে বলা হয় মুৎসুদ্দি শ্রেণী বা Compradore class. Compradore’ শব্দটি হল আসলে পর্তুগিজ শব্দ।

বিদেশি পুঁজিপতিদের লেজুড় বৃত্তি করার জন্য এই শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল। এই শ্রেণী কখনও বিদেশি বাণিজ্য সংস্থায় চাকুরি করত, কখনও বিদেশি পণ্য কেনাবেচায় দালালি করত। মাও-সে-তুং তার ‘Analysis of the classes in Chinese Society’ প্রবন্ধে এই শ্রেণীর চরিত্রগত দিককে বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে এই শ্রেণী আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া শ্রেণীর লেজুড় হিসাবে নিজেদের বেঁচে থাকা ও সম্মান জন্য সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভর করত। তার মতে বিদেশিরা চীনে যেসব বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিল এই শ্রেণী ছিল তার দোসর। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ দেখেছিল। এই শ্রেণী ক্রমশ ধনী হয়ে উঠেছিল। তারা পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিল। এদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব চীনের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

চীনে বিদেশি বণিকদের সঙ্গে প্রথমে বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল হং বণিকেরা। তারা কো-হং সংস্থার মাধ্যমে বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্য করত। প্রথম ইঙ্গ-চীন যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়ে যে অপমানজনক নানকিং চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল তাতে কো-হং বণিকদের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার হরণ করা হয়েছিল। এই শূন্য স্থানকে ভরাট করেছিল মুৎসুদ্দি শ্রেণী। তারা ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, হংকং, ম্যাকাও-তে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। বিদেশিদের সহযােগী হিসাবে তার বাণিজ্যে শামিল হয়েছিল। তাদের হাত ধরেই চীনে বুর্জোয়া সমাজের পত্তন হয়েছিল। চীনে পুঁজিবাদের বিকাশে এই শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই শ্রেণী চীনে বিদেশিদের সঙ্গে সহযােগী হয়ে বাণিজ্য করেছিল। বাজার ও পণ্যের যাবতীয় বিষয় তারা নিয়ন্ত্রণ করত। চীনা রাজদরবার ও চীনা শুল্ক বিভাগের সঙ্গে তারা বিদেশিদের হয়ে কথা বলত। তারা নিজেরাও বাণিজ্য করত। দালালি করা থেকে স্বাধীন বণিক হিসাবে এই শ্রেণীর উথান হয়েছিল। বিদেশি পুঁজিপতিরা এই শ্রেণীকে শিখণ্ডী হিসাবে দাঁড় করিয়ে চীনকে অবাধে লুণ্ঠনের সুযােগ পেয়েছিল।

বিদেশিদের শােষণের পরিণতিতে চীনে একের পর এক বিদ্রোহ হয়েছিল। এই বিদ্রোহগুলাের মধ্যে স্মবাণীয় হল তাইপিং বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ দমিত হওয়ার পর চীনে শান্তি কিছুটা ফিরে এসেছিল। চীনে পুনরায় বিদেশি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়েছিল। বিদেশি বাণিজ্যের সম্প্রসারণের সূত্রে মুৎসুদ্দি শ্রেণীর ভূমিকা উজ্জ্বল হয়েছিল। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৮৬৪ সালে চীনে বহির্বাণিজ্যের মূল্য ছিল ১১০ মিলিয়ন টেইল। ১৮৭৫ সালে এর পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৪০ মিলিয়ন টেইল। ১৮৮৭ সালে এর পরিমাণ হয় ১৯০ মিলিয়ন টেইল। বাণিজ্য বাড়া সত্ত্বেও চীনে বাণিজ্যের ঘাটতি ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর জন্য দায়ী ছিল মুৎসুদ্দি শ্রেণীর ভূমিকা। কারণ এই শ্রেণী বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল বলে চীনের জাতীয় সম্পদে মন্দা এসেছিল। 

বিদেশিদের সহযােগী হিসাবে এই শ্রেণী বাণিজ্যেও নিজেদের নিযুক্ত করেছিল। তারা চড়া হারে সুদ নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায় অর্থ লগ্নি করেছিল। মহাজনি কারবার, জমি কেনাবেচা, ব্যাংক, বিমা এসব ক্ষেত্রে তারা অর্থলগ্নি করেছিল। তাদের উদ্যোগে চীনের বিভিন্ন বন্দর শহরে অনেক নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠেছিল। রেশম, বস্ত্র, ময়দাকল, চিনির কারখানা, গৃহ নির্মাণ শিল্প, বন্দর, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ইত্যাদি মুৎসুদ্দি শ্রেণীর উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। হংকং, সাংহাই প্রভৃতি স্থানে যেসব বিমা কোম্পানি গড়ে উঠেছিল তাতেও এই শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ব্যাংক পরিষেবার ক্ষেত্রেও এই শ্রেণীর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। ইয়াংসি নদীতে বাস্পীয় পােত পরিবহনের ব্যবসায় এই শ্রেণী অর্থলগ্নি করেছিল। উপকূলবর্তী শহরগুলোতে জাহাজ কোম্পানি, জাহাজ-ঘাট নির্মাণেও তারা বিনিয়ােগ করেছিল। 

উপকূলকেন্দ্রিক অর্থনীতির বিকাশে মুৎসুদ্দি শ্রেণী বিদেশিদের সহযােগী হিসাবে কাজ শুরু করে ক্রমশ স্বাধীন বণিকে পরিণত হয়েছিল। এই শ্রেণীর সূত্রে চীনে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছিল। এই শ্রেণী ছিল বিদেশি পুঁজিপতিদের এজেন্ট। বিদেশি পুঁজিপতিরা এদেরকে সামনে রেখে চীনকে লাগামছাড়া শােষণ করেছিল। এই শ্রেণীর উত্থানে চীনের আর্থিক বিকাশ কীভাবে চীনের উপর প্রভাব ফেলেছিল তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সমালােচকরা এই শ্রেণীর ভূমিকা নিয়ে সরব হলেও বলতে কোনাে দ্বিধা নেই যে এই শ্রেণীর হাত ধরেই চীনে সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশের পতন হয়েছিল এবং আধুনিক জীবনের পথে পা বাড়িয়েছিল। এই শ্রেণীর উদ্যোগেই চীনে শিল্পায়নের বনিয়াদ রচিত হয়েছিল। এই শ্রেণী খুব কাছে থেকে বিদেশি পুঁজিপতিদের উদ্যোগকে অবলােকন করেছিল এবং শিল্প পরিচালনায় প্রয়ােজনীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল। আধুনিক শিল্প প্রতিষ্ঠার সময় এই শ্রেণী তাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিল। এই শ্রেণীর নেতৃত্বে ধীর পদক্ষেপ চীন আধুনিক শিল্পায়নের পথে পা দিয়েছিল।

কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় এই শ্রেণী পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে চীনের অভ্যন্তরে নিয়ে এলে চীনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনেও পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। ঐতিহ্যবাহী কনফুসীয় জীবনদর্শন যে অচল এই শিক্ষা চীনের আধুনিক জনজীবনকে প্রভাবিত করেছিল। কনফুসীয় দর্শনে বাণিজ্যকে অবহেলা করা হয়েছিল। কিন্তু মুৎসুদ্দি শ্রেণী প্রমাণ করে দিয়েছিল ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। এককথায় বলা যায় মুৎসুদ্দি শ্রেণীর উত্থান চীনের জীবনযাত্রায় এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিল। 

চা এর উদ্ভব, বিকাশ ও ইতিহাস

উদ্ভিদবিদ্যাগত উদ্ভব

চা পূর্ব এশিয়ায় নেটিভ এবং সম্ভবত দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় চীন ও উত্তর বার্মার সীমান্ত অঞ্চলে এর উদ্ভব। চাইনিজ স্মল-লিফ টাইপ চা (C. sinensis var. sinensis) দক্ষিণাঞ্চলীয় চীনে সম্ভবত অচেনা বুনো চা প্রজাতির সাথে হাইব্রিডাইজেশনের মাধ্যমে উদ্ভুত হয়েছে। কিন্তু চায়ের কোন চেনা বুনো প্রজাতি না থাকায় এর উদ্ভব সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা যায়না। চাইনিজ আসাম টাইম চা (C. sinensis var. assamica) এর দুটো ভিন্ন পূর্বপুরুষ থেকে থাকতে পারে – একটি পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউনান-এ (Xishuangbanna, Pu’er City), আরেকটি পাওয়া যায় পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনানে (Lincang, Baoshan)। দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউনান আসাম চা এর অনেক প্রকরণকে চা এর নিকটাত্মীয় প্রজাতি Camellia taliensis এর সাথে হাইব্রিডাইজ করা হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউনান আসাম চা এর মত না হয়ে পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান আসাম চা এর সাথে ইন্ডিয়ান আসাম টাইপ চা (C. sinensis var. assamica) এর সাথে অনেক জেনেটিক সাদৃশ্য দেখা যায়, এবং ইউনান আসাম চা ও ইন্ডিয়ান আসাম চা – উভয়ই একই প্যারেন্ট প্ল্যান্ট থেকে উদ্ভুত হয়ে থাকতে পারে, যা আজকের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় চীন, ইন্দো-বার্মা ও তিব্বতের সংযোগস্থলে জন্ম নেয়। তবে যেহেতু ইন্ডিয়ান আসাম চা যেহেতু পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান আসাম চা এর সাথে কোন হ্যাপ্লোটাইপ শেয়ার করেনা বলে সম্ভবত ইন্ডিয়ান আসাম চা একটি স্বাধীন ডোমেস্টিকেশনের মাধ্যমেও উদ্ভুত হয়ে থাকতে পারে। কিছু ইন্ডিয়ান আসাম চা Camellia pubicosta প্রজাতির সাথে হাইব্রিডাইজড হয়েছে বলে দেখা যায়। ১২ বছর নিয়ে একটি জেনারেশন গঠিত বিবেচনা করে চাইনিজ স্মল লিফ টি প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে আসাম টি এর এর থেকে বিচ্যুত হয় বলে হিসাব করা হয়, যেখানে চাইনিজ আসাম টি, ইন্ডিয়ান আসাম টি এর সাথে ২,৮০০ বছর পূর্বে বিচ্যুত হয়। চাইনিজ স্মল লিফ টি ও আসাম টি এর বিচ্যুতি ঘটে লাস্ট গ্লেশিয়াল ম্যাক্সিমামের সময়ে।

প্রাথমিক চা পান

ইউনান অঞ্চলে চা পান শুরু হয়ে থাকতে পারে, যেখানে এটিকে ঔষধী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সিচুয়ানেও এটিকে ব্যবহার করা হতো। সেখানে মানুষ চাপাতাকে সেদ্ধ করে অন্য কোন হার্ব যুক্ত না করেই ঘন তরল বানিয়ে পান করত, এভাবে তৈরি চা তেতো হলেও উত্তেজক ছিল, যদিও ওষুধ হিসেবে সেটার ব্যবহার হতোনা। চিনা কিংবদন্তি অনুসারে ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য ও উত্তর চীনের পৌরাণিক চরিত্র শেনং চায়ের উদ্ভাবক, যদিও এভিডেন্স বলছে চা দক্ষিণপশ্চিম চীনেই (সিচুয়ান বা ইউনান এলাকা) উদ্ভাবিত হয়ে থাকতে পারে। চায়ের সর্বপ্রথম লিখিত রেকর্ড পাওয়া যায় চীনেই। শিজিং ও অন্যান্য প্রাচীন টেক্সটে একরকম “তেতো সবজি” (苦菜) অর্থে tú 荼 শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়, এবং এটা সম্ভব যে শব্দটি চা ছাড়াও বিভিন্ন চাড়া যেমন sow thistle, chicory, বা smartweed বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। হুয়াইয়াং এর ক্রোনিকলসে আছে সিচুয়ানের বা জাতি ঝৌ রাজাকে এই tu উপহার দিয়েছিল। এরপর চিন (Qin) বা জাতির রাজ্য ও তার প্রতিবেশী শু-কে দখল করে নেয়, এবং রি ঝি লু এর লেখক ১৭শ শতকের পণ্ডিত গু ইয়ানউ লেখেন, চিন রাজবংশ শু রাজ্য দখল করার পরই চা পান শেখে। চা এর আরেকটি সম্ভাব্য প্রাথমিক রেকর্ড পাওয়া যায় চিন রাজবংশের জেনারেল লিউ কুন এর লেখা একটি চিঠিতে যেখানে তিনি তার কাছে কিছু “আসল চা” পাঠাবার অনুরোধ করেছিলেন। ২০১৬ সালে শিয়ানে হান এর সম্রাট জিং এর সমাধিসৌধে চা এর সর্বপ্রথম ফিজিকাল এভিডেন্স আবিষ্কৃত হয়, যা নির্দেশ করে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের মত অতীতে হান রাজবংশের সম্রাটগণ ক্যামেলিয়া গণ এর উদ্ভিদ থেকে উদ্ভুত চা পান করতেন। ৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ওয়াং বাও হান রাজবংশের সাহিত্য “দ্য কনট্রাক্ট ফর এ ইয়থ” রচনা করেন, সেখানে সেদ্ধ চা এর উল্লেখ আছে। গ্রন্থে তরুণদের উদ্দেশ্যে যেসব কাজ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে চা সেদ্ধ করে পাত্র ভরে রাখা ও উইয়াং থেকে চা কেনার কথা আছে। চা চাষের প্রথম রেকর্ডও সেই সময়েরই, চেংদূর নিকট মেং পর্বতে সেই চা চাষ করা হয়। চা পানের আরেকটি বিশ্বাসযোগ্য রেকর্ড পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় ৩য় শতকে। হুয়া তুও একটি চিকিৎসাশাস্ত্রে এটির উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন, “বারবার তেতো t’u পান করার ফলে উত্তম চিন্তার উদ্ভব হয়।” তবে ৮ম শতকের মাঝামাঝিতে ট্যাং রাজবংশের পূর্বে চা-পান মূলত একটি দক্ষিণাঞ্চলীয় চীনা আচার ছিল। উত্তরাঞ্চলীয় রাজবংশের সম্ভ্রান্তরা চাকে ঘৃণা করত, তারা চা-কে দাস-দাসীদের পানীয় হিসেবে দেখতো যা দই এর চেয়েও নিম্নতর। ট্যাং রাজবংশের সময়ে চা সর্বত্র জনপ্রিয়তা লাভ করে, আর এই সময়েই এটি কোরিয়া, জাপান ও ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়ে। ৭৬২ সালে লু ইউ চা ও এর প্রস্তুতির ওপর “দ্য ক্লাসিক অফ টি” রচনা করেন।

বিকাশ

শত শত বছর ধরে চা উৎপাদনের অনেক রকম কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে, আর সেটা বিভিন্ন রকমের চা এর চাড়া থেকেই। ট্যাং রাজবংশের সময় কেক সেদ্ধ করা হতো, এরপর একে পিষে কেইকের আকার দেয়া হতো। এদিকে সং রাজবংশে লুজ-লিফ চা এর বিকাশ ঘটে ও জনপ্রিয় হয়। উয়ান ও মিং রাজবংশের সময় অজারিত বা আনঅক্সিডাইজড চাপাতাকে প্রথমে উষ্ণ শুষ্ক কড়াইতে নাড়া হতো, এরপর একে রোল ও এয়ার-ড্রাই করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় অক্সিডেশন বা জারণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে পাতাগুলোকে কালো বানানো আটকাতো, এর বদলে এগুলো সবুজ রঙ এরই থাকতো। ১৫শ শতকে উলং (oolong) চা এর বিকাশ ঘটে, সেক্ষেত্রে পাতাগুলোকে কড়াইতে উষ্ণ করার পূর্বে আংশিকভাবে জারিত করা হতো। এদিকে ওয়েস্টার্ন টেস্টে কেক পুরোপুরি জারিত করে কালো বানানো হয়, এবং পাতাগুলোকে আরও জারিত করা হয়। এদিকে হলুদ চা ছিল মিং রাজবংশের দ্বারা একটা এক্সিডেন্টাল ডিসকাভারি। গ্রিন টি তৈরি করতে গিয়ে তারা যত্নের অভাবে ভুল করে পাতাগুলোকে হলুদ বানিয়ে ফেলে, এর ফলে ভিন্ন রকমের ফ্লেভরের বিকাশ ঘটে।

ইউরোপে চা

গ্লোবাল এক্সপ্যানশন : ফার ইস্টের বাইরে চায়ের সর্বপ্রথম বিবরণ পাওয়া যায় একজন আরব ভ্রমণকারীর বর্ণনায়, ৮৭৯ সালের সেই বিবরণে লেখা হয় ক্যান্টনের রেভেন্যু এর মূল উৎস্য ছিল রপ্তানি করা চা ও লবনের ওপর শুল্ক। মার্কো পোলো লেখেন ১২৮৫ সালে একজন চীনা অর্থমন্ত্রীর পদ হারানোর কারণ ছিল চায়ের কর যাদৃচ্ছিকভাবে বৃদ্ধ। ১৫৫৭ সালে পর্তুগাল ম্যাকাউতে একটি বাণিজ্য বন্দর প্রতিষ্ঠা করে, এবং তখন চাইনিজ পানীয় “chá” শব্দটি দ্রুত ছড়িয়ে যায়, ১৬শ শতকে প্রথম চীনে অবস্থিত পাশ্চাত্যের ধর্মযাজক ও বণিকদের কাছে চা পরিচিত হয়, সেই সময় একে চা (chá)-ই বলা হতো। কিন্তু এরা যে চায়ের কোন স্যাম্পল ইউরোপে নিয়ে এসেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চায়ের সর্বপ্রথম ইউরোপিয়ান রেফারেন্স পাওয়া যায় chiai হিসেবে, যা ১৫৪৫ সালে ভেনেশিয়ান ব্যক্তি Giambattista Ramusio এর গ্রন্থ Delle navigationi e viaggi-তে পাওয়া যায়। ইউরোপে চায়ের প্রথম শিপমেন্ট হয় ১৬০৭ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির দ্বারা, তারা চা এর একটি কার্গো প্রথমে চীনের ম্যাকাও থেকে জাভায় নিয়ে এসেছিল, এরপর দুই বছর পর চায়ের প্রথম এসাইনমেন্ট জাপানের হিরাডো থেকে ইউরোপের আমস্টারডামে নিয়ে আসা হয়। এভাবে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে চা একটি ফ্যাশনেবল ড্রিংকে পরিণত হয়, এবং ডাচরাই এই পানীয়কে জার্মানি, ফ্রান্স ও আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউ আমস্টারডামে (নিউ ইয়র্ক) পরিচিত করায়। ১৬৩৬ সালে ফ্রান্সে চা পরিচিত হয়, ১৬৪৮ সালের দিকে এটি প্যারিসে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৫৬৭ সালে কসাক আতামান্স পেত্রভ ও ইয়ালিশেভ চীনে ভ্রমণ করলে রুশরা চায়ের সংস্পর্শে আসে। মঙ্গোলিয়ান খান জার প্রথম মাইকেলকে ১৬৩৮ সালে ৬৫-৭০ কেজি চা ডোনেট করেছিলেন। জেরেমিয়াহ্‌ কারটিনের মতে, সম্ভবত ১৬৩৬ সালে ভাসিলি স্টারকভকে আলতিন খানের কাছে দূত হিসেবে পাঠানো হয়। জারের প্রতি উপহার হিসেবে তাকে ২৫০ পাউন্ড চা দেয়া হয়। স্টারকভ প্রথমে এটি প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন এই মরা পাতাগুলো নিয়ে কোন লাভ নেই, কিন্তু খান তাকে জোর করেন। এভাবে রাশিয়ায় চায়ের প্রচলন ঘটে। পরে এই রাশিয়াই ১৬৭৯ সালে রাশিয়া চীন থেকে ক্যারাভান ক্যামেল দিয়ে পশমের বিনিময়ে নিয়মিত চা সাপ্লাই এর চুক্তি সম্পাদন করে। ১৬৫৭ সালের মধ্যে জার্মান অ্যাপোথেকারিতে চা দেখা যাচ্ছিল তবে অস্টফ্রিজল্যান্ডের মতো উপকূলীয় অঞ্চলগুলি ছাড়া কখনও খুব বেশি সম্মান অর্জন করেনি। ১৬৫০-এর দশকে ইংল্যান্ডে চা প্রথম প্রকাশ্যে প্রকাশিত হয়, যেখানে এটি কফিহাউসেরমাধ্যমে প্রবর্তিত হয়। সেখান থেকে এটি আমেরিকা এবং অন্যত্র ব্রিটিশ উপনিবেশের সাথে পরিচিত হয়।

পর্তুগাল ও ইতালি : ইতালীয় ভ্রমণকারী জিওভান্নি বাতিস্তা রামুসিও প্রথম ইউরোপে চা প্রবর্তন করেন, যিনি ১৫৫৫ সালে ভয়েজেস অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রকাশ করেন, যেখানে চায়ের প্রথম ইউরোপীয় রেফারেন্স ছিল, যাকে তিনি “চাই ক্যাটাই” বলেন; তার বিবরণ এডেন উপসাগর, ইয়েমেন এবং সোমালিয়ার পলিটি এর সেকেন্ড হ্যান্ড রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল। ১৬শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ যাজক এবং বণিকরা চীনে চায়ের সাথে তাদের প্রথম যোগাযোগ করেছিলেন, যে সময়ে এটিকে chá বলা হত। প্রথম পর্তুগিজ জাহাজ ১৫১৬ সালে চীনে পৌঁছায় এবং ১৫৬০ সালে পর্তুগিজ মিশনারি গাসপার দা ক্রুজ চীনা চায়ের প্রথম পর্তুগিজ বিবরণ প্রকাশ করেন; ১৫৬৫ সালে পর্তুগিজ মিশনারি লুই আলমেইদা জাপানে চায়ের প্রথম ইউরোপীয় বিবরণ প্রকাশ করেন।

যুক্তরাজ্য ও আফিম যুদ্ধ : ইংরেজিতে চায়ের প্রথম রেকর্ডটি এসেছে রিচার্ড উইকহ্যামের লেখা একটি চিঠি থেকে, যিনি জাপানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস পরিচালনা করেছিলেন, ১৬১৫ সালে ম্যাকাওয়ের এক ব্যবসায়ীকে তিনি “সেরা ধরণের চাউ” (“the best sort of chaw”) অনুরোধ করে চিঠি লিখেছিলেন। ১৬৩৭ সালে ফুজিতে চা খেয়ে আসা একজন ভ্রমণকারী ও বণিক পিটার মুন্ডি লিখেছিলেন, “চা হল নিতান্তই এক ধরনের ভেষজ, যা জলে সিদ্ধ করা হয়”। ১৬৫৭ সালে থমাস গারওয়ে নামে একজন “টোবাকোনিস্ট এবং কফি-ম্যান” লন্ডনে এক্সচেঞ্জ অ্যালিতে তার বাড়িতে প্রথম চা বিক্রি করেন, যা প্রতি পাউন্ডে ১৬ থেকে ৫০ শিলিং চার্জ করতেন তিনি। একই বছর লন্ডনের একটি কফি হাউজে চা-কে মূল্য তালিকায় একটি আইটেম হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং ১৬৫৮ সালে চায়ের প্রথম বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। ১৬৬০ সালে স্যামুয়েল পেপিস তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন : “আমি এক কাপ টি (একটি চীনা পানীয়) পাঠিয়েছিলাম যা আমি আগে কখনও পান করিনি।” সম্ভবত আমস্টারডাম হয়ে বা পূর্বাঞ্চলীয় নৌকায় আগত নাবিকদের মাধ্যমে চা-কে প্রাথমিকভাবে চোরাকারবারি করে আনা হয়েছিল। ১৬৬২ সালে ব্রাগাঞ্জার পর্তুগিজ রাজকুমারী ক্যাথরিনের সাথে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিবাহ হয়, আর এর মাধ্যমে রানী ইংল্যান্ডের রাজসভায় চা পানের অভ্যাস নিয়ে আসেন। ১৬৬৪ সালে রাজার কাছে উপস্থাপনার জন্য মাত্র দুই পাউন্ড দুই আউন্স আমদানির মাধ্যমে চায়ের সরকারী বাণিজ্য শুরু হয়, যা ১৮০১ সালের মধ্যে প্রতি বছর ২৪ মিলিয়ন পাউন্ডে উন্নীত হয়। ক্যান্টনে (বর্তমানে গুয়াংজু) চায়ের নিয়মিত বাণিজ্য শুরু হয় যেখানে এটি দুটি একচেটিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়: চীনা কোহং (ট্রেডিং কোম্পানি) এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোহং বণিকরা ‘টি-ম্যানদের’ কাছ থেকে চা নিত, যারা তাদের পাহাড় ও প্রদেশে চা চাষ করত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোহং বণিকদের দিয়ে অনেক পণ্যের বাণিজ্য করে, যেগুলোর মধ্যে চা ছিল মাত্র একটি, যা সবচেয়ে সফল প্রমাণিত হয়। এটি নিয়ে প্রাথমিকভাবে ঔষধি পানীয় বা টনিক হিসেবে কোম্পানি বাণিজ্য করেছিল, কিন্তু ১৭শ শতাব্দীর শেষের দিকে এটিকে একটি সর্ব-উদ্দেশ্যমূলক পানীয় হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তবে ১৮শ শতকের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে চা-পান সার্বজনীন ছিলনা, আর ১৮শ শতকের শেষাংশের আগ পর্যন্ত এর দামও ছিল চওড়া। ইংলিশ ড্রিংকাররা ব্ল্যাক টি-তে চিনি ও দুধ দেয়া পছন্দ করত। ১৮শ শতাব্দীর মধ্যে চায়ের বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়, যখন লন্ডনের মুদি খানা এবং চায়ের দোকানগুলো চা বিক্রি করছিল। ১৭২০-এর দশকে কালো চা বা ব্ল্যাক টি এর দাম কমে যাওয়ার সাথে সাথে সেটা জনপ্রিয়তায় গ্রিন টি-কে ছাড়িয়ে যায় এবং প্রথম দিকে ব্রিটিশ পানকারীরা চায়ে চিনি এবং দুধ যোগ করতে শুরু করে, যা চীনে কখনও করা হয়নি। ১৭২০-এর দশকে চীনের সাথে ইউরোপীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যে চায়ের জন্য রূপা বিনিময়ের প্রাধান্য ছিল। দাম কমতে থাকায় চা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ১৭৫০ সালের মধ্যে চা ব্রিটিশদের জাতীয় পানীয়ে পরিণত হয়। একটি ছত্রাক সিলনে কফি উৎপাদন ৯৫% হ্রাস করে, এর ফলে চায়ের জনপ্রিয় দৃঢ়তর হয়। ১৬৯০ থেকে ১৭৫০ সময়কালে চা আমদানি ও বিক্রয় বৃদ্ধি ইক্ষুর চিনির আমদানি ও বিক্রয়কেও বাড়িয়ে দেয়, কেননা ব্রিটিশরা কেবল চা পান করছিল না বরং চিনি সমেত মিষ্টি চা পান করছিল। এইভাবে, ব্রিটেনের দুটি বাণিজ্যিক ত্রিভুজ একত্রিত হয়: ব্রিটেন, আফ্রিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ঘিরে ব্রিটেনের ট্রেডিং ত্রিভুজ থেকে প্রাপ্ত চিনি এবং ব্রিটেন, ভারত এবং চীনকে ঘিরে থাকা ত্রিভুজ থেকে চা। ১৮শ শতকে চায়ের চোরা কারবারি শুরু হয়, এর ফলে সাধারণ মানুষ চাপান এর ব্যয় বহন করার সামর্থ লাভ করে। ১৭৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার চা থেকে ট্যাক্স সরিয়ে নেয়, ফলে চায়ের চোরাকারবারি বন্ধ হয়। ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডে চা-কে প্রাথমিকভাবে বিলাস দ্রব্য হিসেবে গ্রহণ করা হতো, এবং স্পেশাল অকেশনগুলোতে, যেমন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ডোমেস্টিক ওয়ার্ক গ্যাদারিং – এসবে পান করা হতো। তবে ১৯শ শতকে, বিশেষ করে ভারতীয় চা ইউরোপে প্রচুর পরিমাণে আমদানি হবার সাথে সাথে ইউরোপে চায়ের দাম অনেক কমে আসে। ১৯শ শতকের শেষের দিকে সমাজের সর্বস্তরে চা একটি প্রাত্যহিক পানীয়ে পরিণত হয়। চীনে, চিং (Qing) রাজবংশ কিয়ানলং সম্রাট ১৭৯৩ সালে ম্যাকার্টনি মিশনের বাণিজ্যের অনুরোধের প্রতিক্রিয়ায় রাজা তৃতীয় জর্জকে লিখেছিলেন : “আমাদের স্বর্গীয় সাম্রাজ্যের সমস্ত কিছু প্রচুর পরিমাণে রয়েছে এবং এর সীমানার মধ্যে কোনও পণ্যের অভাব নেই। তাই আমাদের নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে বাইরের বর্বরদের উৎপাদন আমদানি করার প্রয়োজন নেই।” চিং কাংশি (Qing Kangxi) সম্রাট চীনে বিদেশী পণ্য বিক্রয় বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ১৬৮৫ সালে ডিক্রি জারি করা হয়েছিল যে চীন থেকে যত পণ্য নেয়া হবে তাদের সবকটি রৌপ্যমুদ্রা বা বুলিওন দিয়ে কিনতে হবে। অর্থাৎ এখন থেকে ব্রিটেইনকে চায়ের দাম সিলভার বুলিয়নে দিতে হবে। এটা ইউরোপীয় বণিকদের জন্য সংকট তৈরি করে। এর উপায় হিসেবে বণিকরা একটি পণ্য খুঁজতে শুরু করল যা চীনে বিক্রি করে দিয়ে রূপা কেনা যায়, কিন্তু সমস্যা হলো চীনে চীনাদের প্রয়োজনীয় সবই আছে, তাই সেখানে কিছু আমদানিরও প্রয়োজন নেই। শেষ মেষ তারা একটা পণ্য খুঁজে পেলো যা চীনে পাওয়া যায়না, আর চীনাদের মধ্যে তার বেশ চাহিদাও আছে। সেটা হলো আফিম। আর তাই তারা চীনে আফিম বিক্রি করে রৌপ্যমুদ্রা আয় করা শুরু করল যা দিয়ে চীন থেকে তারা চা ও অন্যান্য পণ্য ক্রয় করতে পারে। আর চায়ের জন্য অর্থ প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় রূপা উৎপাদনের উপায় হিসেবে ব্রিটেন ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহ্যবাহী ক্রমবর্ধমান অঞ্চল (বর্তমান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে) থেকে চীনে আফিম রপ্তানি শুরু করে। যদিও চীনে আফিম ব্যবহারের একটি দীর্ঘ ইতিহাস ছিল, ১৮২১ থেকে ১৮৩৭ সালের মধ্যে ব্রিটিশ আফিম আমদানি পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পায়, এবং চীনা সমাজ জুড়ে এই মাদকের ব্যবহার আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে। আফিমের প্রতি চিং সরকারের মনোভাব প্রায়শই দ্বিধান্বিত ছিল, এই মনোভাব মাদক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট সামাজিক সমস্যার কারণে কঠোর হয়েছিল এবং ১৮৩৮-৩৯ সালে আফিম আমদানি হ্রাস করার জন্য চিনা সরকার গুরুতর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। চা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য কর রাজস্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছিল, এবং আফিম বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা এবং এইভাবে চা আমদানিকারকদের জন্য তহবিলের সমস্যা তৈরি করে। আর এভাবেই আফিমের বাণিজ্য দমন করার জন্য চীনা সরকার এরপর যেসব প্রচেষ্টা হাতে নেয় তার থেকেই আফিম যুদ্ধের সূচনা ঘটে। অর্থাৎ চায়ের বাণিজ্য ঘাটতির সমস্যার কারণে চীনের সাথে ইংল্যান্ডের আফিম যুদ্ধ-দুটি, অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় ইঙ্গ-চীন যুদ্ধ ঘটা।

ভারতীয় উপমহাদেশে চা

মেন্ডেলস্লো (Mendelslo) ১৬৬২ সালে ভারতে, চা ব্রু করার আধা ঔষধি ব্যবহার সম্পর্কে বলেন, “প্রতিদিন আমাদের সাধারণ সভায় আমরা কেবল থাই (thay) গ্রহণ করতাম, যা সাধারণত সারা ইন্ডিজে ব্যবহৃত হয়, কেবল দেশের মধ্যে নয়, ডাচ এবং ইংরেজরাও এটি গ্রহণ করে, এটিকে তারা এমন একটি ওষুধ হিসাবে গ্রহণ করে যা পেট পরিষ্কার করে, এবং অত্যধিক রস (superfluous humours) হজম করে, বিশেষ করে নাতিশীতোষ্ণ তাপীয় পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে।” (আচায়া কে টি. রচিত ইন্ডিয়ান ফুড আ হিস্টোরিকাল কম্প্যানিয়ন)। ১৬৮৯ সালে, ওভিংটন রেকর্ড করেন যে সুরাটের বানিয়ারা চিনি ছাড়াই চা পান করত, অথবা অল্প পরিমাণে লেবুর রস মিশিয়ে চা পান করত। আর মাথাব্যথার মত সমস্যার ক্ষেত্রে তারা মশলা যুক্ত চা পান করত। এই চা পাতাগুলো চীন থেকে এসে থাকতে পারে।

ভারতে চা চালু করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা লক্ষ্য করেছিলেন যে অসমে ঘন পাতা যুক্ত চা গাছগুলিও বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এগুলি যখন ভারতে রোপণ করা হয়, তখন খুব ভাল সাড়া দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এই একই উদ্ভিদ আসামের সিংফোস (Singphos) উপজাতি চাষ করে আসছিল, এবং এর আদিবাসী শাসক নিংরুলার (Ningroola) চা এর বাক্স সরবরাহ করত। অতীতে অসমিয় চা ও চীনা চা-কে সম্পর্কিত কিন্তু ভিন্ন প্রজাতির বলে মনে করা হয়েছে, কিন্ত এখন সাধারণত উদ্ভিদবিদরা এই দুটিকে একই প্রজাতি ক্যামেলিয়া সিনেনসিস হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেন।

চীনের বিরুদ্ধে আঁফিম যুদ্ধ চালানো ব্রিটেনের একটি অন্যতম কৌশল ছিল, ব্রিটেন আবার চা চাষের জন্য ভারতকেও ব্যবহার করতে শুরু করে। ব্রিটিশরা চায়ের ওপর চীনের একচেটিয়া ভাঙ্গার জন্য ১৮২০ এর দশকের শুরুতে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের আসামে বড় আকারের চা উৎপাদন শুরু করে, যা ঐতিহ্যগতভাবে সিংফো জনগণের দ্বারা তৈরি করা চা জাতের। ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইয়ান্দাবু চুক্তির মাধ্যমে আহোম রাজাদের কাছ থেকে এই অঞ্চল দখল করে। ১৮৩৬ সালে চাইনিজ স্মল-লিফ টাইপ চা এর সূচনা ঘটায়। ১৮৩৭ সালে আপার আসামের ছাবুয়ায় প্রথম ইংরেজ চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়; ১৮৪০ সালে আসাম টি কোম্পানি এই অঞ্চলে চা বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন শুরু করে। ভারতে চীন থেকে চা গাছ পাচার করে এনে ভারতের দার্জিলিং, আসাম এবং সিলনের মতো অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ স্থাপন করা হয়। চা-কে চুরি বা পাচার করতে হয়েছিল কারণ চা চীনা সাম্রাজ্যের সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হত, একে বিদেশে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ১৮৪১ সালে আর্চিবাল্ড ক্যাম্পবেল চাইনিজ চা এর বীজ কুমাউন অঞ্চল থেকে নিয়ে আসেন এবং দার্জিলিং এ চা রোপন করে পরীক্ষা করেন। ১৮৫০ এর দশকে শুরু হয়ে চা শিল্প দ্রুত প্রসারিত হয়, তা চা বাগানের জন্য বিশাল জমি অধিগ্রহণ করে, আর শতাব্দীর শেষের দিকে আসাম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় চা উৎপাদনকারী অঞ্চলে পরিণত হয়। ১৮৫৬ সালে আলুবাড়ি চা বাগান তৈরি হয়, এবং দার্জিলিং চা উৎপাদন শুরু হয়।

ভারতবর্ষে ভারতীয় চায়ের থেকে আলাদা চীনা চা উদ্ভিদের প্রবর্তন করার কৃতিত্ব সাধারণত রবার্ট ফরচুনকে দেওয়া হয়, যিনি ১৮৪৮ থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর ধরে লন্ডনে রয়্যাল হর্টিকালচারাল সোসাইটির হয়ে কাজ করেছেন। চীনা চায়ের উপর নির্ভরতা ফাঁকি দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে ১৮৪৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্কটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী রবার্ট ফরচুনকে চীনে পাঠায় চীনের চা গাছ ক্রয় করে সেখান থেকে নিয়ে আসার জন্য। তিনি খুব গোপনীয়তা বজায় রেখে প্রথম ও দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে মিশনটি সম্পাদনা করেন। ফরচুন চা গাছ এবং চারা চুরি করার জন্য বিভিন্ন উপায় ব্যবহার করেছিলেন, তিনি উদ্ভিদটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ন্যাথানিয়েল বাগশ ওয়ার্ডের পোর্টেবল ওয়ার্ডিয়ান কেসগুলিও ব্যবহার করেছিলেন। এই ছোট গ্রিনহাউসগুলি ব্যবহার করে ফরচুন হিমালয়ের পাদদেশে খাড়া ঢালে ভারতের দার্জিলিং অঞ্চলে ২০,০০০ চা গাছ এবং চারা চালু করেন, ক্যামেলিয়া উদ্ভিদের জন্য যেরকম অ্যাসিডিক মাটির দরকার সে রকম মাটি ব্যবহার করা হয়। তিনি একদল প্রশিক্ষিত চীনা চা শ্রমিককেও নিয়ে এসেছিলেন যারা চা পাতা উৎপাদন করত। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বাগানগুলোতে টিকে থাকা কয়েকটি উদ্ভিদ ব্যতীত, ভারতে প্রবর্তিত বেশিরভাগ চীনা চা গাছ ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশরা আবিষ্কার করে, একটি ভিন্ন প্রকরণের চা আসাম ও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে এন্ডেমিক। সেটাকে চীনের স্মল-লিফ টাইপ চা এর সাথে হাইব্রিডাইজ করা হয়। এরপর চাইনিজ রোপন ও চাষাবাদ পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার আসামে একটি চায়ের ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে যেকোন ইউরোপীয়কে চা চাষের জন্য সুযোগ দেয়া হয়, শর্ত হচ্ছে চা চাষ করতে হবে রপ্তানির জন্য। এভাবে চীনা চা এর জ্ঞান ও প্রযুক্তি ভারতীয় চা শিল্পের পরবর্তী সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশরা শ্রীলঙ্কায় (তদকালীন সিলন) চায়ের ইন্ডাস্ট্রি চালু করেছিল।

প্রথমে কেবল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা চা পান করত। তবে পরে ১৯৫০ এর দশকে এটি ভারতে ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়, কারণ ইন্ডিয়া টি বোর্ড সেই সময়ে সাফল্যের সাথে একটি বিজ্ঞাপন প্রচারনা চালিয়েছিল। চা ব্রিটেনের বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা ১৮শ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটেনের বৈশ্বিক আধিপত্যে কিছুটা অবদান রাখছে। প্রথম থেকেই ভারতে উৎপাদিত চা তার অধিকতর শক্তির জন্য ও সাম্রাজ্যের মধ্যে তৈরি হবার জন্য ব্রিটেনে অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়। চা যখন প্রথম প্রবর্তিত হয় তখন তা একটি উচ্চ মর্যাদার পানীয় ছিল, কিন্তু ক্রমাগত এর দাম কমে গিয়েছিল এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯শ শতকে দেশটিতে মদ্যপানের বিরুদ্ধে যে টেম্পারেন্স মুভমেন্ট শুরু হয় তা ব্যাপকভাবে চা-পানকে উৎসাহিত করে। অনেক পুরুষ চীনের চা-কে স্বাদহীন বলে মনে করেন, এবং ভারতীয় চায়ের অধিকতর শক্তি এবং কম দাম তাদেরকে অনেক বেশি আবেদন করেছিল। ১৯শ শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশের মধ্যে, লিয়ঁস, লিপটনস এবং মাজাওয়াতির মতো বড় ব্র্যান্ডগুলি চা এর বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। ভিক্টোরিয়ান যুগে চা ছিল সমস্ত শ্রেণীর জন্য প্রভাবশালী পানীয়, শ্রমিক শ্রেণীর পরিবারগুলি প্রায়শই চা কেনার জন্য অন্য কোন খাবার কিনত না। এর অর্থ হচ্ছে ভারতীয় চায়ের সম্ভাব্য বাজার বিশাল ছিল। ভারতীয় চা (কার্যকরভাবে শ্রীলঙ্কা থেকে সিলন চা সহ) শীঘ্রই একটি “আদর্শ” হয়ে ওঠে, আর চীনা চা একটি মাইনোরিটি টেস্টে পরিণত হয়। ১৯৭০ এর দশকে ইনস্ট্যান্ট কফির উত্থান পর্যন্ত, ভারতীয় চা গরম পানীয় বাজারের প্রায় একমাত্র অধিপতি ছিল। এর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কোকো, কফি এবং বোভ্রিল এবং অক্সোর মতো স্বাদযুক্ত পানীয়। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে সস্তা আফ্রিকান চা, বিশেষ করে কেনিয়ান চা এর কারণে ইউরোপীয় বাজারের এশিয়ান চা তার অনেক বাজারই হারিয়ে ফেলেছে। আজ পর্যন্ত চা বিশ্বব্যাপী ‘ব্রিটিশত্ব’ প্রতীক হিসাবে দেখা হয়, তবে কেউ কেউ চা-কে পুরানো ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রতীক হিসাবে দেখেন।

আমেরিকা ও আফ্রিকায় চা

আমেরিকা : চায়ের জনপ্রিয়তা ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোতে ভূমিকা রাখে, যা চীনের মত আমেরিকাতেও দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চা পান মূলত চা আইন পাস এবং আমেরিকান বিপ্লবের সময় এর পরবর্তী প্রতিবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ১৭৭৩ সালের চা আইন বস্টন টি পার্টিকে উত্তেজিত করে, যা আমেরিকান বিপ্লবের জন্ম দেয়। বিপ্লবের সময় এবং পরে আমেরিকায় চা খাওয়া দ্রুত হ্রাস পেয়েছে, যখন অনেক আমেরিকান চা পান থেকে কফি পানের দিকে ঝুঁকে পড়ে, চা পানকে দেশাত্মবোধহীন বলে মনে করে। ১৯৯৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আমেরিকান স্পেশালিটি চায়ের বাজার চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মূল্য এখন বছরে ৬.৮ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ের মধ্যে বিশেষ চা ঘর এবং খুচরা বিক্রেতারাও গজিয়ে উঠতে শুরু করে। কানাডিয়ানরা ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের দিন থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বড় চা পানকারী ছিল, যখন তারা দক্ষিণে তাদের আমেরিকান প্রতিবেশীদের মতো আরও কফি পান করতে শুরু করে। ১৯৯০ এর দশকে, কানাডিয়ানরা কফির পরিবর্তে আরও বিশেষ চা কিনতে শুরু করে। দক্ষিণ আমেরিকায়, পর্তুগালে দেশটির উৎপত্তি, জাপানি অভিবাসীদের শক্তিশালী উপস্থিতি এবং আর্জেন্টিনার ইয়েরবা মেট সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে ব্রাজিলের চা উৎপাদনের শিকড় বেশ শক্তিশালী। ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত ব্রাজিলে একটি বড় চা উৎপাদন ছিল, কিন্তু গত কয়েক দশকে এটি দুর্বল হয়ে পড়েছে।

আফ্রিকা : সোমালি আজুরান সাম্রাজ্য ১৩শ শতাব্দীতে মিং রাজবংশের আমলে চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল ও এর মাধ্যমে তারা চীন থেকে চা সহ অসংখ্য পণ্য নিয়ে এসেছিল। আফ্রিকায় সাম্প্রতিক দশকগুলিতে চা উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যথাক্রমে ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় রপ্তানিতে বিশাল সাফল্য অর্জন করেছে।

তথ্যসূত্র

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.