সাংখ্য দর্শন ও যোগ দর্শন

Table of Contents

সাংখ্য দর্শন

ভূমিকা

ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম সাংখ্যদর্শন বা সাংখ্যশাস্ত্রকে প্রাচীনতম ভারতীয় দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহর্ষি কপিল হচ্ছেন এই দর্শনের সূত্রকার। তাই সাংখ্যকে কখনও কখনও কপিল–মত বা কপিল–দর্শন নামেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, কপিলের শিষ্য ছিলেন আসুরি এবং আসুরির শিষ্য ছিলেন পঞ্চশিখ। কথিত আছে যে, মুনি কপিল দুঃখে জর্জরিত মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তার শিষ্য আসুরিকে পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান সাংখ্যশাস্ত্র প্রদান করেছিলেন। আসুরি সেই জ্ঞান পঞ্চশিখকে প্রদান করেন। এরপর পঞ্চশিখের দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র নানাভাবে বহু শিষ্যের মধ্যে প্রচার হয়েছিলো। পঞ্চশিখের কাছ থেকে শিষ্যপরম্পরাক্রমে মুনি কপিল প্রণীত এই সাংখ্যশাস্ত্র ভালোভাবে জেনে ঈশ্বরকৃষ্ণ আর্যা ছন্দে ‘সাংখ্যকারিকা’ নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন, সেটাই এখন পর্যন্ত সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। সাংখ্যদর্শনের পরিচয় প্রসঙ্গে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেন–”কপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞান) আসুরিকে প্রদান করেন, আসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেন) এবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখ) দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।” (সাংখ্যকারিকা–৭০)। সাংখ্যদর্শন কতোটা প্রাচীন তা নিয়ে বহুমত থাকলেও এর প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ ইত্যাদিতে সাংখ্য দর্শনের বহুল উল্লেখ পাওয়া যায় –

  • শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ : শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (আনুমানিক ২০০–১০০ খ্রিষ্টপূর্ব) কপিল একজন খ্যাতনামা ঋষি এবং সেই উপনিষদে তার দর্শনের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে।
  • ভাগবত : ভাগবতে কপিল মুনিকে চব্বিশজন অবতারের একজন বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তার পিতার নাম কর্দম ঋষি এবং মাতার নাম দেবহুতি। আবার মহাভারতে কপিল ও আসুরির সাংখ্যমতের উল্লেখ পাওয়া যায় ভালোভাবেই।
  • মহাভারত : মহাভারতের শান্তিপর্বে আচারজ্ঞ পিতামহ ভীষ্মের জবানিতে সাংখ্যমত সম্পর্কিত যে দীর্ঘ উদ্ধৃতি রয়েছে, তার খানিকটা এরকম–”সেই সময়ে কপিলানাম্নী কোন ব্রাহ্মণীর পুত্র মহর্ষি পঞ্চশিখ সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করে পরে মিথিলানগরে এলেন। . . . সেই যে পঞ্চশিখ ঋষিদের মধ্যে অদ্বিতীয় ও মনুষ্যমধ্যে সকল কামনা থেকে বিরত ছিলেন এবং নিত্য, অত্যন্ত ও অতিদুর্লভ নির্বাণমুক্তি কামনা করতেন, তা সেকালের লোকেরা বলতো। সাংখ্যমতাবলম্বীরা যাকে মহর্ষি ও প্রজাপতি কপিল বলেন; আমি মনে করি, স্বয়ং সেই কপিলই পঞ্চশিখরূপে এসে জ্ঞানালোকের প্রভাবে সকল লোককে বিস্ময়াপন্ন করছেন; তাও তখন কেউ কেউ বলতো। . . . একদা আসুরি আপন তপোবনে উপবিষ্ট ছিলেন; এমন সময়ে সাংখ্যমতাবলম্বী বহুতর মুনি সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পুরুষরূপ অব্যক্ত, পরম পদার্থ বলবার জন্য নিবেদন করলেন। . . . সেই যে একাক্ষরময় ব্রহ্ম নানাপ্রাণীতে নানারূপে দৃষ্ট হন, সেই অবিনশ্বর ব্রহ্মের বিষয় আসুরি সেই মুনিগণের নিকট বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করেছিলেন। . . . ভগবান্ মার্কণ্ডেয় এই পঞ্চশিখের উৎপত্তি এবং তার কাপিলেয়ত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞত্ব বিষয় আমাকে বলেছিলেন।” (শান্তিপর্ব : ২১৫/৬,৮,৯,১১,১৩,১৬)।
  • আয়ুর্বেদশাস্ত্র : মহাভারতে সাংখ্যমতের বিস্তৃত আলোচনা থেকে এ দর্শনের প্রভাব ও প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় অবশ্যই। অন্যদিকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের প্রাচীন সূত্রগ্রন্থ চরক সংহিতার দার্শনিক অনুক্রমে এই সাংখ্যশাস্ত্রেরই ভিত্তি পরিলক্ষিত হয়। যেমন–”মন, আত্মা ও শরীর– এরা ত্রিদণ্ডের ন্যায়। অর্থাৎ যেমন তিনটি দণ্ডের সংযোগে একটি ত্রিদণ্ড (ত্রিপদী বা তেপায়া) প্রস্তুত হয় এবং তার উপর দ্রব্যাদি রাখা যায়, তেমনি মন, আত্মা ও শরীরের সংযোগেই লোক সকল জীবিত রয়েছে এবং এই সংযোগের উপরই কর্মফল, বিষয়বাসনা সুখ, দুঃখ, জ্ঞানাজ্ঞান প্রভৃতি সবকিছু নির্ভর করছে। এদের সংযুক্ত অবস্থাকেই পুরুষ বলে। এই পুরুষই চেতন, তিনিই সুখ দুঃখাদির আধার এবং এরই জন্য এই আয়ুর্বেদ প্রকাশিত হয়েছে।” (চরক সংহিতা : প্রথম অধ্যায়, পৃষ্ঠা–৬)।
  • মনুসংহিতা : বৈদিক সংস্কৃতিতে সকল শাস্ত্রের সার বলে কথিত প্রাচীন মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতায়ও সাংখ্যদর্শনের প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। মূলত মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের দার্শনিক প্রপঞ্চটাই সংখ্যদর্শন ভিত্তিক। যেমন–”মহত্ত্ব, অহঙ্কারতত্ত্ব এবং পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটি অনন্তকার্যক্ষম শক্তিশালী পুরুষতুল্য পদার্থের সূক্ষ্ম মাত্রা থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে; অবিনাশী পুরুষ (পরমাত্মা) থেকে এই রকম অস্থির জগতের উৎপত্তি হয়েছে। আকাশাদি পঞ্চভূতের মধ্যে পর–পর প্রত্যেকে পূর্ব–পূর্বের গুণ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে যে সৃষ্টিক্রমে যে স্থানীয়, সে ততগুলো গুণ পায়। –প্রথম ভূত আকাশের ১ গুণ,- শব্দ। দ্বিতীয় ভূত বায়ুর ২ গুণ,- শব্দ ও স্পর্শ। তৃতীয় ভূত অগ্নির ৩ গুণ– শব্দ, স্পর্শ এবং রূপ। চতুর্থ ভূত জলের ৪ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ এবং রস। পঞ্চম ভূত পৃথিবীর ৫ গুণ– শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস এবং গন্ধ।” (মনুসংহিতা : ১/১৯,২০)।
  • অর্থশাস্ত্র : খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের বিখ্যাত প্রামাণিক গ্রন্থ কৌটিল্য প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্র’–এ সাংখ্যদর্শনের প্রশস্তি দেখা যায়। কৌটিল্য সাংখ্যশাস্ত্রকে অনুমোদিত বিদ্যাচতুষ্টয়ের অন্যতম আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন–”সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকী–বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।” (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)। কৌটিল্যের এই বিদ্যাচতুষ্টয় হলো–”আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্–যজুঃ–সামবেদাত্মক বেদ–বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।” (অর্থশাস্ত্র: ১/২/১)। কৌটিল্যের মতে আন্বীক্ষিকী সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ–”আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।” (অর্থশাস্ত্র: ১/২/২)।

এসব প্রাচীন সাহিত্যে সাংখ্যমতের বহুতর উল্লেখ থেকে অনুমান করাটা অসম্ভব নয় যে, অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকের পূর্ব থেকেই ভারতীয় দর্শন জগতে সাংখ্যদর্শনের জোরালো উপস্থিতি ছিলো। এবং প্রাচীন পুঁথিপত্রে এই দর্শনের প্রভাব এতো ব্যাপক ও বিশাল যে, সাংখ্যমতের পেছনে অতি সুদীর্ঘ যুগের ঐতিহ্য স্বীকার না করলে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তার ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। ফলে সাংখ্যদর্শনকে খুবই প্রাচীন বলে স্বীকার করা অমূলক হবে না। আধুনিক বিদ্বানদের কেউ কেউ সাংখ্যকে গৌতম বুদ্ধের চেয়ে অনেক প্রাচীন কালের দর্শন বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাদের মতে সাংখ্য–সম্প্রদায়ের প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিলো।

সাংখ্য সাহিত্য ও নামকরণ

সাংখ্যদর্শনের আদি সাহিত্য নিয়ে সমস্যা : সুপ্রাচীন কাল থেকে সাংখ্যদর্শনের এই যে সুবিস্তৃত প্রভাব, তা সত্ত্বেও আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ দর্শনের মূল গ্রন্থ সংখ্যা যৎসামান্যই বলা যায়। মহর্ষি কপিলকে এ দর্শনের সূত্রকার বলা হলেও কপিল রচিত কোন সাংখ্যসূত্র গ্রন্থের খোঁজ পাওয়া যায় না। ‘তত্ত্বসমাস’ নামের ক্ষুদ্র একটি সূত্র–সংগ্রহ গ্রন্থকে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ ম্যাক্সমুলার সাংখ্যমতের প্রাচীনতম গ্রন্থ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে এই তত্ত্বসমাসই মহর্ষি কপিলকৃত মূল সাংখ্যসূত্র। কিন্তু এই প্রস্তাব মানতে নারাজ ‘কীথ’, ‘গার্বে’ প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানেরা। একে তো তত্ত্বসমাসের প্রাচীনত্ব অনিশ্চিত, তার উপর সাংখ্যমতের প্রাচীন রূপটি সনাক্ত করার জন্য এই সংক্ষিপ্ত সূত্র–সংগ্রহের মূল্যও নগন্য। বিদ্বানদের মতে কেবলমাত্র ২২টি ক্ষুত্র ক্ষুদ্র সূত্রের এই সমষ্টিকে পূর্ণ গ্রন্থ না বলে গ্রন্থের বিষয়সূচিই বলা যায়।

আশার আলো সাংখ্যকারিকা : এছাড়া কপিলের শিষ্য আসুরি এবং আসুরির শিষ্য পঞ্চশিখের রচিত কোন গ্রন্থেরও সন্ধান পাওয়া যায় না। হতে পারে তাদের রচিত গ্রন্থ এখন বিলুপ্ত। এক্ষেত্রে ১৬শ শতাব্দির সাংখ্য দার্শনিক বিজ্ঞানভিক্ষুর বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। সাংখ্যপ্রবচনসূত্রের ভাষ্যগ্রন্থ সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যের ভূমিকায় ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু স্বয়ং বলেছেন–”সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যেও গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কলামাত্রই অবশিষ্ট আছে, আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।” (সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য)। তবে ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকায় পঞ্চশিখ প্রণীত কপিলের উপদেশসমূহের এক বৃহৎ সংগ্রহ ‘ষষ্ঠিতন্ত্র’–এর উল্লেখ পাওয়া যায়–”(পঞ্চশিখ রচিত) সমগ্র ষষ্টিতন্ত্রে যে সমস্ত বিষয় (বা তত্ত্ব) বর্ণিত, আখ্যায়িকা ও পরমত খণ্ডন ছাড়া, সেই সমস্ত তত্ত্বই সত্তরটি কারিকায় বলা হয়েছে।” (সাংখ্যকারিকা–৭২)। মূলত ঈশ্বরকৃষ্ণ প্রণীত সাংখ্যকারিকাই বর্তমানে সাংখ্যশাস্ত্রের প্রাচীনতম নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। ষষ্ঠিতন্ত্র নামে যে বৃহৎ সংগ্রহ গ্রন্থ ছিলো, ঈশ্বরকৃষ্ণ সেই ষষ্ঠিতন্ত্রের কাহিনী ও প্রবাদসমূহ বর্জন করে দর্শনের আসল তত্ত্বকে সত্তরটি শ্লোকে গ্রথিত করেছেন। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে, ‘এতে বোঝা যায় যে ষষ্ঠীতন্ত্র ছিলো বৌদ্ধ পিটক ও জৈন আগমের মতো এক বৃহৎ সাম্প্রদায়িক পিটক, যার মধ্যে বুদ্ধ ও মহাবীরের মতো কপিলের এবং সম্ভবত তার শিষ্য আসুরির উপদেশ ও তত্ত্ব সংগৃহীত  হয়েছিলো।’ ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় ৩য় থেকে ৫ম শতাব্দির মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে ঈশ্বরকৃষ্ণ কর্তৃক ‘সাংখ্যকারিকা’ রচিত হয়েছে। সত্তরটি শ্লোকের সাহায্যে (মোট শ্লোকের সংখ্যা ৭২) এই গ্রন্থে সাংখ্যের সমুদয় তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে এই সাংখ্যকারিকা গ্রন্থটি ‘সাংখ্যসপ্ততি’ নামেও পরিচিত। ঈশ্বরকৃষ্ণের এই সাংখ্যকারিকার উপর পরবর্তীতে বহু টীকাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। বর্তমানে প্রাপ্য গ্রন্থাদির মধ্যে পরমার্থ (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতক) মতান্তরে বিন্ধ্যবাসী কর্তৃক চীনা ভাষায় রচিত ‘সুবর্ণসপ্ততি’ সর্বপ্রাচীন টীকাগ্রন্থ বলে গৃহীত হয়েছে। চীনে সুরক্ষিত ভারতীয় বৌদ্ধ পরম্পরা থেকে জানা যায় যে, সুবর্ণসপ্ততির সাংখ্যমত খণ্ডনের জন্য সমকালীন বৌদ্ধ দার্শনিক বসুবন্ধু ‘পরমার্থসপ্ততি’ নামে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সাংখ্যকারিকার উপর রচিত অন্যান্য ভাষ্য বা বৃত্তি ও টীকাগ্রন্থের মধ্যে নবম শতকে রচিত বাচস্পতি মিশ্রের ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’, মাঠর রচিত ‘মাঠরবৃত্তি’, অজ্ঞাত রচয়িতার ‘যুক্তিদীপিকা’ এবং গৌড়পাদ রচিত ‘গৌড়পাদভাষ্য’ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সাংখ্য-দর্শনের অন্যান্য গ্রন্থ : সাংখ্যদর্শনে ‘সাংখ্যপ্রবচনসূত্র’ নামে অপর একটি আকরগ্রন্থের নাম জানা যায়। এই গ্রন্থে সাংখ্যতত্ত্ব সমূহের তুলনামূলক বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। তার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানভিক্ষু ১৬শ শতাব্দিতে ‘সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য’ নামে একটি ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন। তার মতে সাংখ্যপ্রবচনসূত্রই মহর্ষি কপিল কৃত প্রাচীন সাংখ্য দর্শন। কিন্তু পণ্ডিতদের কাছে এই অভিমত যুক্তিগ্রাহ্য হয়নি। কেননা খ্রিস্টীয় ১২শ, ১৩শ বা ১৪শ শতকে রচিত যে সকল সাংখ্য গ্রন্থ পাওয়া যায়, তার কোনটাতেই এই গ্রন্থের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি মাধবাচার্যও তার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ এ গ্রন্থের উল্লেখ করেন নি। এ থেকে অনুমিত হয় যে খ্রিস্টীয় ১৫শ বা ১৬শ শতকই এই গ্রন্থের রচনাকাল। অনিরুদ্ধ ভট্ট এই গ্রন্থের উপর ‘সাংখ্যসূত্রবৃত্তি’ নামে একটি টীকাগ্রন্থ রচনা করেন। বিজ্ঞানভিক্ষুর ‘সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য’ ছাড়াও ‘সাংখ্যসার’ নামে স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়া সীমানন্দ প্রণীত ‘সাংখ্যতত্ত্ববিবেচন’, ভাবাগনেশ প্রণীত ‘সাংখ্যতত্ত্ব যথার্থদীপন’ হরিহরানন্দের ‘সাংখ্যতত্ত্বালোক’ অনিরুদ্ধের ‘সাংখ্যপ্রদীপ’, পঞ্চানন তর্করত্নের ‘পূর্ণিমাটীকা’ প্রভৃতি সাংখ্য দর্শনের উপর ব্যাখ্যামূলক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বর্ণিত সকল গ্রন্থই যথারীতি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। তবে বাচস্পতি মিশ্রের কৃত ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ই ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার উপর রচিত অতি বিস্তৃত, প্রাঞ্জল টীকাগ্রন্থ হিসেবে সর্বজনসমাদৃত।

সম্প্রদায়ের নামকরণ: সাংখ্য সম্প্রদায়ের নামকরণের ব্যাপারে একাধিক মত প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে ‘সাংখ্য’ শব্দটি এসেছে ‘সংখ্যা’ থেকে। এই সম্প্রদায় যেহেতু তত্ত্বের সংখ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তাই এই সম্প্রদায়ের নাম ‘সাংখ্যসম্প্রদায়’। সাংখ্য মতে তত্ত্বের সংখ্যা পঁচিশ। এই পঁচিশটি তত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানের মাধ্যমে জীবের মুক্তি বা মোক্ষলাভ হয়। কিন্তু অন্যেরা এই মতকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে করেন না। কেননা, প্রতিটি দর্শন সম্প্রদায়েই কতকগুলো নির্দিষ্ট তত্ত্ব স্বীকৃত এবং সেইগুলোকে সংখ্যার দ্বারা প্রকাশ করা যায়। যেমন, ন্যায়মতে ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান নিঃশ্রেয়সের হেতু। আবার বৈশেষিকমতে পদার্থের সংখ্যা সপ্ত বা সাত। এ কারণে কেউ কেউ মনে করেন, ‘সাংখ্য’ বলতে এখানে সম্যক জ্ঞান (সাং+খ্য = সম্যক+জ্ঞান) বা যথার্থ জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে। সাংখ্যমতে জ্ঞান দ্বিবিধ– তত্ত্বজ্ঞান ও ব্যবহারিক জ্ঞান। তত্ত্বজ্ঞান এ দর্শনে ‘বিবেকজ্ঞান’ নামে পরিচিত। বিবেকজ্ঞানের মাধ্যমে জীবের দুঃখনিবৃত্তি হয়। যেহেতু এ দর্শনে বিবেকজ্ঞানকেই মোক্ষের হেতু বলা হয়েছে, তাই এ দর্শনকে সাংখ্যদর্শন বলা হয়। এখানে উল্লেখ্য, ব্যাপক অর্থে ‘সাংখ্য’ শব্দের দ্বারা যোগ দর্শনকেও নির্দেশ করা হয়। মহর্ষি কপিল সাংখ্যসূত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন নি, তাই সাখ্য সম্প্রদায় ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন বলে এই দর্শনকে ‘নিরীশ্বর সাংখ্য’ বলা হয়। অন্যদিকে যোগদর্শনে যেহেতু ঈশ্বর স্বীকৃত, তাই যোগদর্শনকে ‘সেশ্বর সাংখ্য’ বলা হয়। ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শনের মতোই মূলত সাংখ্য ও যোগ দর্শন সমানতন্ত্র দর্শন। উভয় দর্শনে পার্থক্য সামান্যই। কপিলের সাংখ্য দর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয় তত্ত্বসমূহ, কিন্তু পতঞ্জলির যোগদর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয় যোগ।

দুঃখ ও দুঃখনিবৃত্তি

দুঃখ ও এর প্রকৃতি : দুঃখের অনুভূতি হলো মানবজীবনের সবচাইতে তীব্র ও কষ্টকর অনুভূতি। মূলত জীবন মানেই অসংখ্য দুঃখের সমষ্টি। এই দুঃখানুভূতির আবির্ভাবও ঘটেছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। তাই চিরকালই প্রাণীমাত্রেই এই দুঃখকে জয় বা অতিক্রম করে সুখলাভের উপায় অনুসন্ধান করেছে। এবং এই অনুসন্ধিৎসা থেকেই ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিক চিন্তাধারারও উৎপত্তি হয়েছে। সাংখ্যশাস্ত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকার প্রথম কারিকাটিই এই দুঃখকেন্দ্রিক–”ত্রিবিধ দুঃখের অভিঘাতের ফলে সেগুলোর নিবৃত্তির উপায় সম্পর্কে প্রশ্ন (বা জিজ্ঞাসা) তৈরি হয়। লৌকিক উপায়ে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয় না বলে দুঃখ নিবৃত্তির সেই উপায় বিষয়ে জিজ্ঞাসা ব্যর্থ হয় না।” (সাংখ্যকারিকা–১)। সহজ কথায় কারিকাকারের মতে জন্ম থেকেই জীবকুল নানা ধরনের দুঃখতাপে দগ্ধ হয়। শুধু যে বিচিত্র দৈহিক জরা ও যন্ত্রণাই ভোগ করে তাই নয়। যুদ্ধ, মহামারী, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। শুধু লৌকিক উপায়ে সমস্ত দুঃখের স্থায়ী নিবৃত্তি বা পরিত্রাণ সম্ভব হয় না বলে সাংখ্যশাস্ত্রে এই সব ধরনের দুঃখের আত্যন্তিক বা পূর্ণ বিনাশের উপায় বলা হয়েছে। সাংখ্যকারিকায় বলা হচ্ছে দুঃখ ত্রিবিধ বা তিন প্রকার, কিন্তু এর ব্যাখ্যা সাংখ্যকারিকায় পাওয়া যায় না। সাংখ্য শাস্ত্রকারদের মতে এই ত্রিবিধ দুঃখ বলতে এখানে দুঃখের সংখ্যা তিন–একথা বলা হয় নি। কারণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালে স্থিত অসংখ্য প্রাণীর অসংখ্য দুঃখ। এই তিন কালে স্থিত অসংখ্য প্রাণীর অসংখ্য দুঃখ ঈশ্বরকৃষ্ণের মতে তিন প্রকার–এটাই বক্তব্য। কিন্তু কারিকায় এই তিন প্রকার দুঃখও চিহ্নিত না থাকায় বাচস্পতি মিশ্র তার ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে–”দুঃখসমূহের ত্রয় দুঃখত্রয় বা ত্রিবিধ দুঃখ। এই ত্রিবিধ দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)। সাংখ্যশাস্ত্র অনুসারে আন্তর উপায়ে অর্থাৎ শরীরের ভেতর থেকে উৎপন্ন রোগ জরাদি বিষয়ের অপ্রাপ্তি হেতু মানসিক দুঃখ–তাপসমূহ হলো আধ্যাত্মিক দুঃখ। এই আধ্যাত্মিক দুঃখ দুই প্রকার– শারীর ও মানস। বাত, পিত্ত ও শ্লেষ্মার তারতম্যের ফলে শারীর দুঃখ জন্মে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ভয়, ঈর্ষা, বিষাদ এবং কাঙ্ক্ষিত বিষয় না পাওয়ার ফলে মানস দুঃখ জন্মে। অন্যদিকে আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক দুঃখ হলো বাহ্য উপায়ে সাধ্য অর্থাৎ শরীরের বাইরের কোন কারণ থেকে উৎপন্ন দুঃখ। মানুষ, পশু–পক্ষী, সরীসৃপ ও স্থাবর উৎস থেকে উৎপন্ন যে দুঃখ, তা হলো আধিভৌতিক দুঃখ। আর মহামারী, ভূমিকম্প, যক্ষ, রাক্ষস, বিনায়ক প্রভৃতি দৈব বা গ্রহাদির সংস্থান থেকে উৎপন্ন যে দুঃখ, তাই আধিদৈবিক দুঃখ। জন্ম থেকেই জীব এই দুঃখত্রয়ের ত্রিতাপ জ্বালায় জর্জরিত। এই ত্রিতাপ দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তিই তার চরম লক্ষ্য বা পরম পুরুষার্থ। প্রশ্ন হলো, এই দুঃখ নিবৃত্তির উপায় কী?

দুঃখ নিবৃত্তির উপায়:

দুঃখের অভিভব বা নিবারণ সম্ভব এবং তিন প্রকার দুঃখের নিবারণের তিন প্রকার উপায় আছে। যথা–(১) দৃষ্টবৎ বা লৌকিক উপায়, (২) আনুশ্রবিক উপায় তথা বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি কর্মকলাপ এবং (৩) সাংখ্যশাস্ত্রবিহিত উপায়– তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান। এগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হলো –

  • (দুঃখ নিবৃত্তির দৃষ্টবৎ বা লৌকিক উপায় : দুঃখ নিবৃত্তির দৃষ্ট বা লৌকিক উপায় সর্বাপেক্ষা সহজসাধ্য। তিন প্রকার দুঃখের অভিভব বা নিবৃত্তির তিন প্রকার দৃষ্ট উপায় রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বাচস্পতি মিশ্র তার ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে বলেন–”(আধ্যাত্মিক) শারীর দুঃখ নিবারণের জন্য শত শত সহজ উপায় আছে, যেমন বৈদ্যদের (অর্থাৎ আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞদের) দ্বারা উপদিষ্ট ভেষজাদি সেবন। (আধ্যাত্মিক) মানস দুঃখ নিবৃত্তির জন্য মনোজ্ঞ স্ত্রী (অথবা পুরুষ), পানীয়, সুস্বাদু খাদ্য সামগ্রী, প্রসাধন সামগ্রী, বস্ত্র, অলঙ্কার ইত্যাদি (অনেক) সহজলভ্য ভোগ্য বিষয় রয়েছে। এইরূপ আধিভৌতিক দুঃখ নিরাকরণের জন্য নীতিশাস্ত্রপাঠ, নিরাপদ স্থানে বাস ইত্যাদি বিবিধ সহজ উপায় আছে। অনুরূপভাবে আধিদৈবিক দুঃখ নিবৃত্তির জন্য সহজলভ্য মণি, মন্ত্র, ঔষধাদির ব্যবহাররূপ অনেক সহজ উপায় আছে।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)। দুঃখ নিবৃত্তির দৃষ্ট বা লৌকিক উপায় সর্বাপেক্ষা সহজসাধ্য হলেও দৃষ্ট উপায়ে দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব হয় না, অর্থাৎ সকল দুঃখের চিরনিবৃত্তি হয় না।
  • (দুঃখ নিবৃত্তির আনুশ্রবিক উপায় তথা বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি কর্মকলাপ : এটা মূলত মীমাংসকগণের দুঃখ নিবৃত্তির অনুসৃত উপায়। অনেক মুহূর্ত, প্রহর, দিন, রাত্রি, মাস এবং বছর ধরে অনুষ্ঠিতব্য বৈদিক জ্যোতিষ্ঠোমাদি, অর্থাৎ যাগযজ্ঞানুষ্ঠানের কর্মকলাপ দুঃখত্রয়কে নিবৃত্ত করতে সমর্থ। এর ফল হলো স্বর্গলাভ। শ্রুতির ভাষ্য অনুযায়ী স্বর্গকামী ব্যক্তি যজ্ঞ করবেন। যে সুখ দুঃখের সঙ্গে মিশ্রিত নয়, যে সুখ পরে দুঃখের দ্বারা অভিভূত হয় না এবং যে সুখ ইচ্ছামাত্র উপস্থিত হয়, সেই সুখকে স্বর্গ বলে। এই আনুশ্রবিক উপায়ের বিরোধিতা করে সাংখ্যাচার্য তথা বাচস্পতি মিশ্র বলেন–”আনুশ্রবিক (তথা বেদবিহিত) জ্যোতিষ্টোমাদি কর্মকলাপ অর্থাৎ যাগযজ্ঞাদি দৃষ্ট উপায়ের মতোই হয়ে থাকে। একান্ত ও অত্যন্তভাবে দুঃখের নিবৃত্তি করতে পারে না বলে দৃষ্ট ও আনুশ্রবিক উভয়েই সমান।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)। আনুশ্রবিক উপায়ে কেন দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না, তার কারণ হিসেবে সাংখ্যাচার্যরা বলেন আনুশ্রবিক উপায় অবিশুদ্ধ, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত। এটা অবিশুদ্ধ কেননা সোমাদি যাগে পশুহত্যা করা হয়। এক্ষেত্রে ‘কোন জীবকে হিংসা করবে না’– এই সামান্য বা সাধারণ শাস্ত্রবাক্য ‘অগ্নিসোম যজ্ঞে বলি দেবে’– এই বিশেষ শাস্ত্রবাক্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। যদিও এই হিংসায় (সাধারণভাবে) পুরুষের পাপ জন্মালেও তা যজ্ঞের উপকার করে। অন্যদিকে পঞ্চশিখাচার্যের মতে–‘যাগাদিক্রিয়া স্বল্পসঙ্কর, সপরিহার ও সপ্রত্যবমর্ষ’। জ্যোতিষ্টোমাদি যাগ থেকে উৎপন্ন প্রধান অপূর্বের (বা পূণ্য) সঙ্গে যজ্ঞে করা পশুহত্যার ফলে উৎপন্ন দুঃখের কারণে অল্প পরিমাণ পাপের যোগ থাকে বলে তাকে স্বল্পসংকর বলে। যজ্ঞের পশুহত্যা থেকে উৎপন্ন পাপকে প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা কিছু পরিমাণে দূর করা যায় বলে তা হলো সপরিহার। আবার ভুল করে যদি যজ্ঞের পশুহত্যা জনিত পাপ নাশের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করা না হয় তাহলে যজ্ঞের প্রধান কর্মফল স্বর্গ ভোগের সময় সেই পশুহত্যার পাপের ফল হিসেবে দুঃখ ভোগ হয়। তবু সেই পাপ থেকে যে দুঃখ উৎপন্ন হয়, তাকে সহজেই সহ্য করা যায়। সহিষ্ণুতার সঙ্গে বর্তমান বলে আনুশ্রবিক উপায়ে সাধ্য সুখকে সপ্রত্যবমর্ষ বলে। এছাড়া যজ্ঞের ফল স্বর্গাদির ক্ষয় আছে– এটা লক্ষণার দ্বারা বোঝায়। যেহেতু স্বর্গ জন্য–পদার্থ অর্থাৎ যজ্ঞাদির ফলে স্বর্গ উৎপন্ন হয় বলে ভাবরূপ কার্য করে, সেহেতু অনুমিত হয় যে স্বর্গের ক্ষয় আছে। আবার যজ্ঞের ফল স্বর্গাদির অতিশয় আছে– এটাও লক্ষণার দ্বারা বোঝায়। যেহেতু জ্যোতিষ্টোমাদি যাগ কেবল স্বর্গ লাভের উপায়, কিন্তু বাজপেয়াদি যাগ স্বর্গের আধিপত্য লাভের উপায়– তাই এদের মধ্যে অতিশয় আছে। কেননা পরের অধিক সম্পদ দেখে স্বল্প সম্পদের অধিকারী পুরুষ যেমন দুঃখ পায়, তেমনি স্বর্গাধিপতির অধিক সম্পদ দেখে সাধারণ স্বর্গবাসীরাও দুঃখ পায়, তা যুক্তিযুক্ত। আনুশ্রবিক উপায় দৃষ্ট উপায়ের মতো সহজসাধ্য না হলেও তা বহু জন্ম যাবৎ অনুষ্ঠিতব্য কষ্টসাধ্য তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান থেকে সহজসাধ্য। সাংখ্যাচার্যদের মতে, শুধু কর্মের দ্বারা দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ সম্ভব নয়। যজ্ঞাদি ক্রিয়াকাণ্ড দ্বারা সাময়িকভাবে স্বর্গাদিসুখলাভ হতে পারে, কিন্তু তার দ্বারা দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হতে পারে না। সাংখ্যমতে স্বর্গাদিসুখভোগ জীবের পুনর্বন্ধন সূচিত করে, আত্যন্তিক নিবৃত্তি সূচিত করে না।
  • (সাংখ্য শাস্ত্রবিহিত উপায়– তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান সাংখ্যমতে লৌকিক বা বৈদিক কোন প্রকার কর্মের দ্বারাই জীবের মুক্তিলাভ হতে পারে না। জ্ঞানের দ্বারাই জীব দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তি লাভ করতে পারে। ব্যক্ত জগৎ, অব্যক্ত প্রকৃতি এবং জ্ঞ বা পুরুষের স্বরূপ অনুধাবনের মাধ্যমেই দুঃখের হাত থেকে জীবের চিরনির্বত্তি লাভ হতে পারে। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর এই ভেদজ্ঞানই সাংখ্য দর্শনে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞান বলে বিবেচিত হয়। এ বিষয়ে ঈশ্বরকৃষ্ণ সাংখ্যকারিকার দ্বিতীয় কারিকায় বলেন–”বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপও লৌকিক উপায়ের মতো ত্রিবিধ দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সাধনে অসমর্থ। সেই যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ যেহেতু অবিশুদ্ধি, ক্ষয় ও অতিশয়যুক্ত, সেহেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের বিপরীত দুঃখ নিবৃত্তির সেই সাংখ্যশাস্ত্রীয় উপায় ব্যক্তাব্যক্তজ্ঞবিজ্ঞান–ই শ্রেয়। কারণ ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী ও চির নিবৃত্তি হয়।” (সাংখ্যকারিকা–২)। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ– এই ত্রিবিধ তত্ত্বের বিভেদ জ্ঞান হলে দুঃখের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব হয়। দুঃখের ঐকান্তিক নিবৃত্তি হলো দুঃখের অবশ্য নিবৃত্তি এবং দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হলো নিবৃত্ত দুঃখের পুনরায় উৎপত্তি না হওয়া। তবে তত্ত্বজ্ঞান অর্জন অনেক জন্মব্যাপী অভ্যাসপরম্পরা–রূপ আয়াসসাধ্য হওয়ায় তা অতি দুষ্কর।

কার্যকারণ তত্ত্ব

কার্যের সঙ্গে কারণের সম্বন্ধ অর্থাৎ কার্যকারণতত্ত্ব দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। আমরা কার্য প্রত্যক্ষ করি, কিন্তু সেই কার্যের কারণ কী এবং সেই কারণের সঙ্গে ঐ কার্যের সম্বন্ধ কী ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করতে পারি না। তা জানার জন্য মানুষ যা ভেবেছে, সেই ভাবনার সমষ্টিই দর্শন। কার্যকারণভাবকে অবলম্বন করে জগতের মূলতত্ত্বে উপনীত হওয়াই দর্শনের লক্ষ্য। ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়গুলো দৃশ্যমান বস্তুর কার্য–কারণভাবের দ্বারাই তাদের স্বরূপ অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি সম্প্রদায়ই স্বীকৃত তত্ত্ব ও স্বীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাগতিক কার্যকারণভাবকে ব্যাখ্যা করেছেন। ফলে স্বভাবতই ভারতীয় দর্শনসমূহে নানা ধরনের কার্য–কারণভাব পরিলক্ষিত হয়। উৎপত্তিঘটিত কার্যকারণ বিষয়ে ভারতীয় দর্শনে অনেকগুলো মত প্রচলিত আছে। বেদান্ত ও সাংখ্যসম্প্রদায়–স্বীকৃত কার্য–কারণভাব ‘সৎকার্যবাদ’ নামে পরিচিত। সাংখ্যসম্মত সৎকার্যবাদকে ‘পরিণামবাদ’ এবং অদ্বৈতবেদান্তসম্মত সৎকার্যবাদকে ‘বিবর্তবাদ’ বলা হয়। অন্যদিকে ন্যায়–বৈশেষিকবৌদ্ধ সম্প্রদায়স্বীকৃত কার্য–কারণভাব ‘অসৎকার্যবাদ’ বা ‘আরম্ভবাদ’ নামে পরিচিত। তবে সম্প্রদায়ভেদে তারও প্রকারভেদ রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কার্য–কারণবাদগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য –

  • (১) সাংখ্যদর্শনের সৎকার্যবাদ বা পরিণামবাদ
  • (২) নৈয়ায়িক ও বৈশেষিকদের পরমাণুবাদ বা আরম্ভবাদ
  • (৩) বৈদান্তিক সম্প্রদায়ের বিবর্তবাদ
  • (৪) বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সংঘাতবাদ বা পরমাণুপুঞ্জবাদ
  • (৫) কাশ্মীরীয় পণ্ডিতদের আভাসবাদ।

সাধারণত যে কোন উৎপন্ন বস্তুকে বলা হয় কার্য এবং যা থেকে ঐ কার্য উৎপন্ন হয় তাকে বলা হয় ঐ কার্যের কারণ। বস্তুর কার্য–কারণভাব আপেক্ষিক। জগতের প্রায় সকল বস্তুই দেশ, কাল ও নিমিত্তভেদে কখনো কারণ, আবার কখনো কার্য হয়ে থাকে, একান্ত কারণ বা একান্ত কার্য হয় না। আবার কারণ থেকে যে সকল কার্য উৎপন্ন হয় তারাও সকলে একরূপ নয়, ফলে কারণও নানাবিধ। সাংখ্য সম্প্রদায় উপাদান ও নিমিত্তভেদে দুই প্রকার কারণ স্বীকার করে। কার্যের যা উপাদান অর্থাৎ যা থেকে কার্য উৎপন্ন হয়, তাই তার উপাদান কারণ। উপাদানই কার্যের অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। ন্যায়মতে কার্যের উপাদান যেহেতু কার্যের সঙ্গে সমবায় সম্বন্ধে সংবদ্ধ হয়ে তার আশ্রয় হয়, সেহেতু কার্যের উপাদান কার্যের সমবায়ী কারণ। অপরদিকে যে ক্রিয়াশক্তির দ্বারা উপাদান থেকে কার্য উৎপন্ন হয়, সেই ক্রিয়াশক্তি হলো কার্যের নিমিত্ত কারণ। উপাদান আপনা–আপনি কার্যে পরিণত হয় না, এর জন্য প্রয়োজন উপাদানে ক্রিয়াশক্তির প্রয়োগ। এই ক্রিয়াশক্তি কার্যের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে না, কার্যের বাইরে থেকে কার্যকে ঘটায় মাত্র। একটি মৃত্তিকানির্মিত ঘটের ক্ষেত্রে মৃত্তিকা হলো উপাদান কারণ এবং দণ্ডচক্রাদি হলো তার নিমিত্ত কারণ।

কারণ ও কার্য যে ভিন্ন এবং উভয়ই যে সৎ, সে বিষয়ে ন্যায় ও সাংখ্য সম্প্রদায় একমত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণে বর্তমান থাকে কি না। এই প্রশ্নের যারা সদর্থক উত্তরে বিশ্বাসী, অর্থাৎ যারা মনে করেন উৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণেই বর্তমান থাকে তাদের বলা হয় সৎকার্যবাদী। অপরদিকে যারা এই প্রশ্নের নঞর্থক উত্তরে বিশ্বাসী, অর্থাৎ তারা মনে করেন উৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণে বর্তমান থাকে না তাদের বলা হয় অসৎকার্যবাদী। সৎকার্যবাদী সাংখ্য সম্প্রদায় মনে করেন, কার্য আবির্ভূত হবার পূর্বে অব্যক্তাবস্থায় কারণে বর্তমান থাকে। অন্যদিকে অসৎকার্যবাদী ন্যায়–বৈশেষিক ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় মনে করেন, উৎপন্ন হবার পূর্বে কার্যের কোন অস্তিত্বই থাকে না, কার্য সম্পূর্ণভাবে নতুন সৃষ্টি বা আরম্ভ। ক্ষণিকবাদী বৌদ্ধমতে, বস্তু উৎপত্তির পরমুহূর্তেই যেহেতু বিনষ্ট হয়, সেহেতু অসৎ কারণ থেকে সৎকার্যের উৎপত্তি হয়। আবার সৎকার্যবাদী অদ্বৈতবেদান্তমতে কার্য উৎপত্তির পূর্বে কারণে বর্তমান থাকলেও কারণ ও কার্য সমসত্তাক নয়। কারণের সত্তা কার্যের সত্তার অপেক্ষা অধিক এবং কার্যের সত্তা কারণের সত্তার অপেক্ষা ন্যূন – অদ্বৈতবেদান্তীদের এই কার্য–কারণতত্ত্ব বিবর্তবাদ নামে পরিচিত। এদিকে সাংখ্যমতে কারণ ও কার্য উভয়ই সৎ। কার্য উৎপত্তির পূর্বে শুধু যে কারণের মধ্যে বর্তমান থাকে তাই নয়, কারণ ও কার্য সমসত্তাক বা সমপ্রকৃতিক। কার্যের মধ্যে কারণের যথার্থ ও বাস্তব পরিণাম ঘটে থাকে। অর্থাৎ সৃষ্টিকালে সৎ কারণ সৎ কার্যে পরিণাম প্রাপ্ত হয় এবং প্রলয়কালে সৎ কার্য সৎ কারণে পরিণাম প্রাপ্ত হয়। তাই সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদ পরিণামবাদ নামে পরিচিত।

সাংখ্যদর্শনে সৎকার্যবাদ : যে মতবাদ অনুসারে উৎপত্তির পরের মতো উৎপত্তির পূর্বেও কার্য তার উপাদান কারণে সৎ, তাকে বলে সৎকার্যবাদ। আর যে মতবাদ অনুসারে উৎপত্তির পূর্বে কার্য তার উপাদান কারণে অসৎ, তাকে বলে অসৎকার্যবাদ। সাংখ্য সম্প্রদায় সৎকার্যবাদী। সাংখ্য দার্শনিকদের সিদ্ধান্ত হলো– সৎ বস্তু থেকে সৎ বস্তু উৎপন্ন হয়। সাংখ্যমতে কারণ কার্যেরই অব্যক্ত অবস্থা। অর্থাৎ, উৎপত্তির পূর্বে কার্য, কারণের মধ্যে অব্যক্তভাবে বা সূক্ষ্মভাবে থাকে বলে তাকে কেউ দেখতে পায় না। তাছাড়া কারণে কার্য কখনও অসৎ নয়। কার্য কারণেরই পরিণাম। কার্য নতুন আরম্ভ বা নতুন সৃষ্টি নয়। দুধ থেকে যখন দই উৎপন্ন হয়, তখন দুধ দইরূপে পরিণত হয়, দই নতুন সৃষ্টি নয়। দই উৎপন্ন হওয়ার আগে দুধের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে, পরে সেটি দইরূপে অভিব্যক্ত হয়। সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, পরিদৃশ্যমান শব্দ প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ সুখদুঃখমোহস্বভাব। তাদের মতে ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতিও সুখদুঃখমোহস্বভাব। সুতরাং কার্য ও কারণ সমসত্তাক বা সমপ্রকৃতিক। এটি স্বীকৃত হলে কার্যের প্রতি প্রকৃতির কারণতা যুক্তিসিদ্ধ হয়। কার্য যে উৎপত্তির পূর্বে কারণে বর্তমান থাকে, কার্য যে কারণের বাস্তব পরিণাম এবং কারণ ও কার্য যে সমসত্তাক– সৎকার্যবাদী এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সাংখ্যাচার্যগণ প্রধানত পাঁচটি যুক্তির অবতারণা করেছেন। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ তার সাংখ্যকারিকার নবম কারিকায় এই পাঁচটি যুক্তি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন–”যা নেই তাকে উৎপন্ন করা যায় না, কার্য উৎপাদনে সমর্থ বস্তু থেকেই উৎপাদনযোগ্য বস্তু উৎপন্ন হতে পারে, যে কোন কিছু থেকে যে কোন কিছু উৎপন্ন হয় না, একটি বস্তু যে কার্য উৎপাদনে সমর্থ সেই বস্তুটি কেবলমাত্র সেই কার্যই উৎপাদন করে এবং কার্য স্বরূপত কারণ থেকে অভিন্ন বলে একটি কার্য উৎপত্তির পূর্বে তার উপাদান কারণে অস্তিত্বশীল থাকে।” (সাংখ্যকারিকা–৯)। মোটকথা, এই কারিকায় কার্যমাত্রে সত্ত্ব প্রতিপাদনের উদ্দেশ্যে যে পাঁচটি হেতু প্রদর্শন করা হয়েছে, সেগুলো হলো –

  • (১) অসৎঅকরণাৎ, অসৎ বস্তুর অনুৎপত্তিহেতু, অর্থাৎ যা নেই বা অসৎ তা উৎপন্ন হয় না,
  • (২) উপাদানগ্রহণাৎ, কার্যমাত্রই উপাদানজন্য হেতু, অর্থাৎ কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ স্বীকার্য,
  • (৩) সর্বসম্ভবাভাবাৎ, যে কোন বস্তু থেকে যে কোন বস্তুর অনুৎপত্তিহেতু, অর্থাৎ বিশেষ কারণ থেকে বিশেষ কার্যই উৎপন্ন হয়,
  • (৪) শক্তস্যশক্যকরণাৎ, শক্য কারণ থেকে কার্যের উৎপত্তিহেতু, অর্থাৎ শক্য কারণের মধ্যেই কার্যশক্তি নিহিত থাকে এবং
  • (৫) কারণভাবাৎ, কার্য–কারণ–ভাব, অর্থাৎ উপাদান কারণ ও কার্য অভিন্ন।

সৎকার্যবাদের সমর্থনে এবং বিভিন্ন পূর্বপক্ষ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে সাংখ্য দার্শনিকদের পক্ষ থেকে এই হেতুগুলো প্রদর্শন করা হয়েছে। যেসব প্রেক্ষিতে এসব যুক্তির উত্থাপন হয়েছে তা দেখা যেতে পারে –

প্রথমহেতু (অসদকরণাৎ) :  সংকার্যবাদের পক্ষে সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রথম যুক্তি হলো, কার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হয়, তাহলে কার্যের উৎপত্তি আদৌ সম্ভব হয় না। যা অসৎ তাকে কোনভাবেই উৎপন্ন করা যায় না, যেমন– গগনকুসুম। সহস্র শিল্পীও গগনকুসুমকে সৃষ্টি করতে বা নীলবর্ণকে পীতবর্ণ করতে পারে না। অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায় এই যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, সাংখ্য দার্শনিকরা তাদের মতকে খণ্ডনও করেছেন –

  • অসৎকার্যবাদীরা : এরূপ যুক্তির উত্তরে অসৎকার্যবাদীরা বলতে পারেন না, যা সর্বকালেই অসৎ তাকে কেউ উৎপন্ন করতে পারে না–একথা ঠিক। কিন্তু উৎপত্তির পূর্বে কার্য গগনকুসুমাদির ন্যায় সর্বকালে থাকে না। কার্য উৎপত্তির পূর্বে অসৎ, কিন্তু উৎপত্তির পরে সৎ হয়। সত্তা ও অসত্তা উভয়ই কার্যের ধর্ম। তার মধ্যে উৎপত্তির পূর্বকালে কার্যে অসত্তাধর্ম থাকে, আর উৎপত্তিকাল থেকে স্থিতিকাল পর্যন্ত কার্যে সত্তাধর্ম থাকে। অসৎকার্যবাদীদের এরূপ আপত্তির উত্তরে সাংখ্য সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলো, উৎপত্তির পূর্বে কার্যে অসত্তাধর্ম থাকতেই পারে না। কেননা, কার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হয়, তাহলে অসত্তাধর্ম উৎপত্তি–পূর্বকালীন কার্যে বর্তমান থাকে, একথা বলতে হয়। কিন্তু একথাও বলা যায় না। অসৎধর্মীতে কোন ধর্ম থাকা সম্ভব নয়। আর উৎপত্তির পূর্বে কার্য যদি সৎ হয়, তাহলে তাতে অসত্তাধর্ম থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং অসত্তা কোনভাবেই কার্যবস্তুর ধর্ম হতে পারে না।
  • অসৎকার্যবাদী বৌদ্ধ দার্শনিকরা : সৎকার্যবাদের বিপক্ষে অসৎকার্যবাদী বৌদ্ধ দার্শনিকরা বলেন যে, অসৎ কারণ থেকে সৎ কার্যের উৎপত্তি হয়। উক্ত বক্তব্যের সমর্থনে দৃষ্টান্তস্বরূপ তারা বলেন যে, বীজের বিনাশ থেকে অঙ্কুরের উৎপত্তি হয় অথবা মৃৎপিণ্ড বিনষ্ট হলে তবে ঘট উৎপন্ন হয়। এর উত্তরে সাংখ্য দার্শনিকদের বক্তব্য হলো, বিনাশের কোন কার্যোৎপাদন ক্ষমতা থাকতে পারে না। বীজ, মৃৎপিণ্ড ইত্যাদি ভাববস্তুরই কার্যোৎপাদন সামর্থ্য আছে। কিন্তু বিনাশ অভাব, অবস্তু। বিনাশ থেকে যদি বস্তু উৎপন্ন হতো, তাহলে অসংখ্য বিনাশ বা অভাব জগতের সর্বত্র থাকায় জগতে সর্বত্রই সব কার্য উৎপন্ন হতে পারতো। কিন্তু তা হয় না। সুতরাং, অসৎ থেকে সৎ উৎপন্ন হয়, এই মত গ্রাহ্য নয়।
  • বৈদান্তিকরা : অন্যদিকে বৈদান্তিকরা যে জগৎকার্যকে মায়িক বলেন, সাংখ্য দার্শনিকরা তা স্বীকার করেন না। তারা বলেন যে, জগৎ যে সৎ বস্তু নয়– একথা স্বীকারের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি নেই। অতএব সৎ কারণ থেকে অনির্বচনীয় কার্য উৎপন্ন হয়, এই মতও গ্রাহ্য নয়।
  • ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায় : সৎকার্যবাদের অন্যতম প্রতিপক্ষ হলো ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়। এই মতে উৎপত্তির পূর্বে কারণে কার্যের প্রাগভাব থাকে। কার্য যদি কারণে আগে থেকেই থাকে, তাহলে কার্য উৎপন্ন হলো, একথা বলা নিরর্থক হয়ে যায়। ‘অবয়বী’ একটি নতুন আরম্ভ, এটি অবয়বের অতিরিক্ত। তাছাড়া ঘট, পট, ইত্যাদি যদি মাটি, সুতো ইত্যাদিতে আগে থেকেই থাকে তাহলে কুম্ভকার, তন্তুবায় ইত্যাদির প্রযত্ন নিরর্থক হয়ে যায়। এই মতকে খণ্ডন প্রসঙ্গে ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে বাচস্পতি মিশ্র বলেন–”যদি কারণ–ব্যাপারের পূর্বে কার্য (উপাদান কারণে) অসৎ হয়, তবে কেউ তাকে উৎপন্ন করতে পারে না। সহস্র শিল্পীও নীলকে পীত (বা হলুদ) করতে পারে না।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)।

সুতরাং, কারণে কার্য উৎপত্তির আগে থেকেই অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। কুম্ভকার, তন্তুবায় প্রভৃতি সেই অব্যক্ত কার্যকে ব্যক্ত করেন মাত্র। আমাদের অভিজ্ঞতায় এরকম অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়ার একাধিক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে বাচস্পতি মিশ্র তার তত্ত্বকৌমুদী গ্রন্থে আরো বলেন–”কারণ–ব্যাপারের ফলে এই সৎ কার্যেরই অভিব্যক্তি উৎপন্ন হয়। যেমন, পীড়ন বা পেষণের দ্বারা তিল থেকে তেল উৎপন্ন হয়, আঘাতের দ্বারা ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয়, দোহনের দ্বারা গাভী থেকে দুধ পাওয়া যায়। কিন্তু অসদ্বস্তু উৎপন্ন হচ্ছে, এমন কোথাও দেখা যায় না।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)। তার মতে, কেউ বলবে না যে ঐ তেল, চাল বা দুধ আগে থেকে তিলে, ধানে বা গাভীতে ছিলো না। কারণ তা যদি না থাকতো, তাহলে তেল, চাল, দুধ আমরা ঐভাবে পেতাম না। সুতরাং যা অসৎ তা কখনো উৎপন্ন হয় না। এ প্রেক্ষিতে অসৎকার্যবাদীরা বলতে পারেন যে কার্য উৎপত্তির পূর্বে অসৎই। যেখানে ঘটসংযোগ ছিলো সেখান থেকে ঘটকে অপসারিত করার পর সেখানে যেমন ঘটাভাব থাকে, তেমনি ঘট উৎপত্তির পূর্বেও কপালে ঘটাভাব থাকে। যেখানে ঘটাভাব থাকে, সেখানে ঘট থাকতে পারে না। সুতরাং, উৎপত্তির পূর্বে কপালে ঘট থাকতে পারে না। উক্ত বক্তব্যের প্রতিবাদে স্বমতস্থাপনের উদ্দেশ্যে সাংখ্যকারিকায় দ্বিতীয় হেতুটি উপস্থাপন করা হয়।

দ্বিতীয়হেতু (উপাদানগ্রহণাৎ) : সৎকার্যবাদ সমর্থনে সাংখ্য সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় যুক্তি হলো, কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ অবশ্যস্বীকার্য। উপাদান অর্থ কারণ, গ্রহণ অর্থ সম্বন্ধ। কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ থাকার জন্য কার্যকে উৎপত্তির পূর্বে সৎ বলতে হবে। যে কারণ যে কার্যের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত, সেই কারণই সেই কার্যের জনক হতে পারে। অন্যথা মৃত্তিকা হতে পট বা বস্ত্রের উৎপত্তি এবং তন্তু হতে ঘটের উৎপত্তি হয় না কেন? উৎপত্তির পূর্ব থেকে কার্যের সঙ্গে কারণের সম্বন্ধ স্বীকার করলে আর ঐ আপত্তি ওঠে না। কপাল প্রভৃতির সঙ্গে ঘট প্রভৃতির কার্যকারণ সম্বন্ধ অনস্বীকার্য। সম্বন্ধ সর্বদা উভয়বৃত্তি। কার্যটি উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হলে কিন্তু ঐ সম্বন্ধ সম্ভব হয় না। আবার উক্ত কার্যকারণ সম্বন্ধ স্বীকার না করলে নির্দিষ্ট কারণ থেকে নির্দিষ্ট কার্যের উৎপত্তি উৎপন্ন হবে না। বস্তুতপক্ষে যে কারণের সঙ্গে যে কার্যের সম্বন্ধ আছে সেই কারণ থেকেই সেই কার্য উৎপন্ন হতে পারে। ঘটের সঙ্গে মৃত্তিকার সম্বন্ধ আছে, কিন্তু বস্ত্রের সঙ্গে নেই। তাই মৃত্তিকা থেকে ঘটেরই উৎপত্তি হয়, বস্ত্রের হয় না। কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ যেহেতু অবশ্যস্বীকার্য, সেহেতু উৎপত্তির পূর্বেও কার্যের সত্তা স্বীকার করতে হয়। উৎপত্তির পূর্বে ঘট অসৎ হলে তার সঙ্গে সৎ মৃত্তিকার সম্বন্ধ স্থাপিত হতে পারে না, কারণ সৎ ও অসতের মধ্যে কোন সম্বন্ধ সম্ভব নয়। অতএব উৎপত্তির পূর্বেও কার্য কারণে সৎ থাকে একথা স্বীকার করতে হয়। এখন আপত্তি হতে পারে যে, কারণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না হয়েই কার্য উৎপন্ন হোক। তা খণ্ডনকল্পেই সাংখ্যকারিকায় তৃতীয় হেতুর উপস্থাপন।

তৃতীয়হেতু (সর্বসম্ভবাভাবাৎ) : স্বীয় সিদ্ধান্ত সৎকার্যবাদের পক্ষে সাংখ্য সম্প্রদায়ের তৃতীয় যুক্তিটি হলো, একমাত্র বিশেষ কারণ থেকেই বিশেষ কার্য উৎপন্ন হয়। পশম–তন্তু থেকে পশম–বস্ত্র হয়, তিল থেকে তেল হয়। তিল থেকে পশম–বস্ত্র বা ধূলিকণা থেকে তেল হয় না। এ থেকে মনে হয়, কার্য নিশ্চয়ই উপাদান কারণে কোন না কোন ভাবে বিদ্যমান থাকে। যদি তা না থাকতো, তাহলে যে কোন কারণ থেকেই যে কোন কার্য উৎপন্ন হতে পারতো। অর্থাৎ, উপাদানের সঙ্গে সম্বন্ধহীন কার্যের উৎপত্তি স্বীকার করলে সকল কার্যের সঙ্গে সকল কারণের থেকে উৎপত্তির আপত্তি হবে। কিন্তু সংসারে এরূপ অব্যবস্থা দেখা যায় না। কোন কারণ থেকে কোন কার্য হবে নির্দিষ্টভাবে সে ব্যবস্থা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কার্য উৎপত্তির পূর্বে কারণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকে, কার্য উৎপত্তির পর কারণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয় না। সাংখ্যমতে কারণ ও কার্যের এই সম্বন্ধ হলো তাদাত্ম্য সম্বন্ধ। অতএব, উৎপত্তির পূর্বেই কারণে কার্যের উপস্থিতি স্বীকার করতে হয়। এ যুক্তির বিপক্ষে পূর্বপক্ষী বলতে পারেন যে, উৎপত্তির পূর্বে কার্য সৎ নয়। সুতরাং, তখন কারণে কার্যের সম্বন্ধ থাকে না। কিন্তু কার্য নিজের উপাদানকারণে সম্বন্ধযুক্ত না হলেও কারণব্যাপারের দ্বারা ঐ অসৎ কার্যেরই উৎপত্তি হয়, যেহেতু ঐ কারণে ঐ কার্য উৎপাদনের শক্তি আছে। অর্থাৎ, কারণত্ব সম্বন্ধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, তার শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন মাটিতে ঘট জনন শক্তি থাকায় মাটি ঘটের প্রতি কারণ। পূর্বপক্ষকে নিরাস করার লক্ষ্যে সাংখ্যকারিকাকার পরবর্তী চতুর্থ হেতুটি উপস্থাপন করেন।

চতুর্থহেতু (শক্তস্যশক্যকরণাৎ) : সৎকার্যবাদের পক্ষে সাংখ্য সম্প্রদায়ের চতুর্থ যুক্তি হলো, শক্য কারণের মধ্যেই কার্যশক্তি নিহিত থাকে। একটি কার্যের কার্যশক্তি যে কোন কারণের মধ্যে নিহিত থাকতে পারে না। এটা অবাস্তব। যে কোন কারণে যে কোন কার্যশক্তি নিহিত থাকলে কার্যের উৎপত্তির অব্যবস্থা দেখা দেয়। এজন্য স্বীকার করতে হয় যে, মৃত্তিকাই ঘটের শক্য কারণ এবং এই শক্য কারণেই ঘটকার্যের ঘটজননশক্তি নিহিত। ঐ ঘটকার্যের সঙ্গে ঘটজননশক্তির যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে, তা অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে। এই সম্বন্ধ উৎপাদনের জন্য একথা স্বীকার করতে হবে যে, উপাদান কারণ মৃত্তিকাতে ঘট তথা ঘটজননশক্তি উৎপত্তির পূর্বেই বর্তমান থাকে এবং তা মৃত্তিকারই ধর্মবিশেষ। বস্তুত ঘটজননশক্তি ঘটকার্যের সম্ভাবনা ও সুপ্তাবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই শক্তিই কালক্রমে ঘটকার্যরূপে অভিব্যক্ত হয় মাত্র। অর্থাৎ, শক্তি কোন নির্দিষ্ট কারণে থাকে। যে কারণটির যে কার্যটি উৎপন্ন করার শক্তি আছে, সেই কারণটি কেবল সেই কার্যটিই উৎপন্ন করতে পারে, অন্য কোন কার্য সে উৎপন্ন করতে পারে না। কারণে নিহিত শক্তি যদি এইভাবে কেবল তার শক্য কার্যের উপরই ক্রিয়া করতে সমর্থ হয়, তাহলে স্বীকার করতে হবে যে শক্তিবিশেষ শক্যবিশেষের সঙ্গেই সম্বন্ধযুক্ত। এক্ষেত্রে প্রতিবাদী পূর্বপক্ষীয় বলতে পারেন যে, মৃত্তিকা বা মাটি থাকলে এবং মাটির অতিরিক্ত অন্যান্য কারণ থাকলে ঘট হয়, আবার মাটি না থাকলে এবং মাটির অতিরিক্ত অন্যান্য কারণ থাকলেও ঘট হয় না। এরূপ অন্বয়–ব্যাতিরেকের দ্বারাই মাটির কারণত্ব ও ঘটের কার্যত্ব সিদ্ধ হয়। এর জন্য কার্যকারণের তাদাত্ম্যসম্বন্ধ এবং তার অনুরোধে উৎপত্তির পূর্বে কার্যের সত্ত্বস্বীকার অনাবশ্যক।উক্ত আক্ষেপের সমাধানে ও সৎকার্যবাদের সমর্থনে সাংখ্যকারিকাকার এ বিষয়ক সর্বশেষ পঞ্চম হেতুটির উপস্থাপন করেন।

পঞ্চমহেতু (কারণভাবাৎ) : সৎকার্যবাদের সমর্থনে সাংখ্যাচার্যগণের পঞ্চম ও চরম যুক্তি হলো, উপাদান কারণ ও কার্য বস্তুত অভিন্ন। এখানে ‘ভাব’ অর্থ হলো তাদাত্ম্য বা স্বরূপ। যেহেতু কার্য সর্বদা নিজের উপাদানকারণের সঙ্গে তাদাত্ম্য বা অভেদ সম্বন্ধে থাকে, সেহেতু কার্য সকল সময়েই কারণাত্মক। সৎ কারণের সঙ্গে অভিন্ন কার্য অসৎ হতে পারে না। সুতরাং কার্য সৎ। সুবর্ণনির্মিত বলয় যেমন তার উপাদান সুবর্ণ থেকে অভিন্ন, তেমনি সকল ক্ষেত্রেই উপাদান ও তার কার্য অভিন্ন। উপাদান কারণ ও কার্য যে অভিন্ন, সাংখ্যাচার্যগণ তা একাধিক যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। যে বস্তু যা থেকে ভিন্ন, সে বস্তু তার ধর্ম হয় না। অপরদিকে যে বস্তু যার ধর্ম, সে বস্তু ঐ ধর্মের সঙ্গে অভিন্ন। পট বা বস্ত্র তন্তুর ধর্ম হওয়ায় পটকে তন্তুর সঙ্গে অভিন্ন বলতে হয়। এখানে পটকে তন্তুর ধর্ম বলতে তন্তুতে পটের বৃত্তিকে বোঝানো হয়েছে। বৃত্তি হেতু তন্তু ও পট অভিন্ন। অনুরূপভাবে সাংখ্যাচার্যরা উপাদান–উপাদেয়ভাব, সংযোগ–প্রাপ্তাভাব ও গুরুত্বান্তর–কার্যাগ্রহণ হেতুর দ্বারাও কারণ ও কার্য যে অভিন্ন, তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কার্য ও কারণের মধ্যে উপাদান–উপাদেয়ভাব থাকে বলে তারা অভিন্ন হয়। আবার যাদের মধ্যে সংযোগ ও বিভাগের অভাব থাকে, তারাও অভিন্ন বলে বিবেচিত হয়। সর্বশেষে যাদের মধ্যে গুরুত্বের ভেদ থাকে না, তারা ভিন্ন হতে পারে না। কারণ ও কার্যের মধ্যে উপাদান–উপাদেয়ভাববশত কারণ ও কার্যকে অভিন্ন বলতে হয়। আবার কারণ ও কার্যের মধ্যে সংযোগ বা বিভাগ কখনো দেখা যায় না। উভয়ই তাই অভিন্ন বলে বিবেচিত। পরিশেষে কারণ ও কার্যের গুরুত্ব বা পরিমাণগত অভিন্নতাবশত উভয়কে অভিন্ন বলে স্বীকার করতে হয়। সাংখ্যকারিকা ও সাংখ্যসূত্রে এসব যুক্তির সাহায্যে সৎকার্যবাদে কারণ ও কার্য অভিন্ন প্রমাণিত করে কার্য যে উৎপত্তির পূর্বে কারণে বিদ্যমান থাকে তা প্রতিপাদন করা হয়েছে।

ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়ের অসৎকার্যবাদ ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায় সাংখ্য সম্প্রদায়ের সৎকার্যবাদী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কার্য ও কারণকে অত্যন্ত ভিন্ন বলে দাবি করেছেন। তাদের মতে ক্রিয়া (উৎপত্তি), নিরোধ (ধ্বংস), ব্যপদেশ (ব্যবহার), অর্থক্রিয়াভেদ (প্রয়োজন সাধনের ভিন্নতা) এবং ক্রিয়াব্যবস্থা (প্রয়োজন সাধনের নিয়ম)- এই পঞ্চহেতুর দ্বারা কারণ ও কার্যের মধ্যে ভেদ সিদ্ধ হয়। ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলো, উৎপত্তির পূর্বেও কার্য কারণে বিদ্যমান থাকে, একথা যদি স্বীকার করা হয়, তাহলে কার্যোৎপত্তির কোন অর্থ থাকে না। কারণ ও কার্য দুটি ভিন্ন কালে উৎপন্ন ও ভিন্ন কালে ধ্বংস হয়। সুতরাং তাদের অভিন্ন বলার পক্ষে কোন যুক্তি থাকতে পারে না। যদি বস্তুতই উৎপত্তির পূর্বে ঘট মৃত্তিকাতে থাকে, তাহলে ঘটের কার্যকরি শক্তি মৃত্তিকাতে থাকে না কেন? ঘটের দ্বারা যে জল আনয়নাদি ক্রিয়া সম্পাদিত হয়, মৃত্তিকার দ্বারা তা হয় না, পটের দ্বারা যে গাত্রনিবারণাদি ক্রিয়া সম্পাদিত হয়, তন্তুর দ্বারা তা হয় না। বস্তুত প্রতিটি কার্যেরই এক একটি নির্দিষ্ট আকৃতি থাকে। কোন কার্যের নির্দিষ্ট আকৃতিহীন উপাদান কখনোই ঐ কার্যরূপে বিবেচিত হতে পারে না। ঘটাকারবিশিষ্ট মৃত্তিকাকেই ঘট বলা হয়, ঘটাকৃতিহীন মৃৎপিণ্ড কখনোই ঘট বলে বিবেচিত হয় না। কার্যবস্তুমাত্রই কতকগুলো অংশ বা অবয়বের দ্বারা নির্মিত। কারণ ও কার্য ভিন্ন না হলে অবয়ব ও অবয়বীর ভেদ উপপন্ন হয় না। বস্তুত আরম্ভক অবয়ব ও উৎপন্ন অবয়বীর ভেদ প্রত্যক্ষ–অভিজ্ঞতাসিদ্ধ। আরম্ভক অবয়বের সংখ্যার দ্বারাই অবয়বীর পরিমাণ নির্ধারিত হয়। সৎকার্যবাদ স্বীকার করলে সিদ্ধ এই অভিজ্ঞতা বাধিত অর্থাৎ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অতএব স্বীকার করতে হয় যে, উৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণে থাকে না এবং কার্য সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি।

সাংখ্যের প্রতিবাদ : সাংখ্য সম্প্রদায় ন্যায়াচার্যদের প্রদত্ত উপরিউক্ত যুক্তিগুলো ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন। তাদের মতে, বস্তুর উৎপত্তি ও ধ্বংস প্রকৃতপক্ষে বস্তুর বিনাশ ও সংকোচন বা ব্যক্ত ও অব্যক্ত অবস্থান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। কুর্ম্মশরীরে মস্তকাদি অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ যেমন কখনো বিকশিত বা আবির্ভূত, আবার কখনো সংকুচিত বা তিরোহিত হয়, তেমনি ঘট–পটাদি কার্য কখনো আবির্ভূত ও কখনো তিরোহিত হয়। কার্যের এই আবির্ভাব ও তিরোভাবকেই উৎপত্তি ও বিনাশ বলা হয়। নতুন উৎপত্তি ও চিরকালীন বিনাশ বলে কিছু নেই। অসতের কখনো উৎপত্তি হয় না, আবার সৎ–এর কখনো বিনাশ হয় না। অর্থক্রিয়াভেদাদির দ্বারাও কারণ ও কার্যের একান্তভেদ সিদ্ধ হয় না। একই বস্তুর বহুবিধ ব্যবহার দেখা যায়, আবার একক ও সম্মিলিত শক্তিভেদে ক্রিয়াব্যবস্থারও ব্যতিক্রম দেখা যায়। সুতরাং নৈয়ায়িকগণ যে সকল যুক্তিতে কারণ ও কার্যের অত্যন্ত ভেদ সিদ্ধ করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।

ন্যায়–বৈশেষিক দার্শনিকদের মতে সাংখ্য দার্শনিকদের যুক্তি মতে সৎকার্যবাদ প্রমাণিত হয়না : ন্যায়–বৈশেষিক দার্শনিকরা কিন্তু মনে করেন যে, সাংখ্য দার্শনিকের যুক্তিগুলোর দ্বারা সৎকার্যবাদ প্রমাণিত হয় না। যা প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে, কার্য উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হলেও সেটি আকাশকুসুম বা বন্ধ্যাপুত্রের মতো অলীক নয়। সাংখ্যদার্শনিকরা বলেছেন অসৎ–এর উৎপত্তি হয় না। অসৎ বলতে যদি অলীক বোঝানো হয় তাহলে কথাটি ঠিক। আকাশ–কুসুম, বন্ধ্যাপুত্র, শশশৃঙ্গ ইত্যাদি অলীক পদার্থের উৎপত্তি কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু ঘট, পট ইত্যাদি কার্য কখনোই অলীক নয়। এই পদার্থগুলো উৎপত্তির পূর্বে অসৎ, কিন্তু উৎপত্তির পরে সৎ। উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে কার্যের যে অভাব তাকে বলা হয় প্রাগভাব। যার প্রাগভাব আছে তাকে আমরা অলীক বলতে পারি না। কারণ যে সমবায়িকারণে কার্যের প্রাগভাব আছে, সেই সমবায়ী বা উপাদান কারণ যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি, তখন প্রাগভাবের যে বোধ আমাদের হয় তা হলো, ‘এখানে কার্যটি হবে’ বা ‘এখানে কার্যটি এখনও হয়নি’। জ্ঞানের এই আকার থেকেই বোঝা যায়, যার অভাব উপলব্ধ হচ্ছে তা অলীক নয়। অতএব বন্ধ্যাপুত্রের মতো অলীকের উৎপত্তি অসম্ভব বলে, যা উৎপত্তির পূর্বে থাকে না, তার উৎপত্তিই হতে পারে না, একথা বলা যায় না।

সাংখ্য দর্শনে কারণে কার্যের উপস্থিতির বিরুদ্ধে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের প্রতিবাদ : সাংখ্যদার্শনিকরাও বলেন যে, উৎপত্তি অর্থ হলো যা অনভিব্যক্ত ছিলো তাই অভিব্যক্ত হলো। কিন্তু এর প্রতিবাদ আছে –

  • প্রথমত, প্রশ্ন হলো, এই অভিব্যক্তিটি কি পূর্বে ছিলো? অভিব্যক্তিটি যদি পূর্ব থেকেই না থেকে থাকে, তাহলে বলতে হবে পূর্বে অসৎ যে অভিব্যক্তি, তাই পরে সৎ হলো। অর্থাৎ, যা ছিলো না তাই হতে পারে। কিন্তু এটা অসম্ভব। অপরপক্ষে অসৎ অভিব্যক্তি যদি কারকব্যাপারের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারে, তাহলে অসৎ কার্যের উৎপত্তিতেও বাধা নেই। কারণ ঘটের অভিব্যক্তিটি অসৎ হওয়া সত্ত্বেও কুম্ভকার তাকে উৎপন্ন করতে পারলে, অসৎ ঘটও কুম্ভকারের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারবে। কিন্তু এই কল্পও অসম্ভব হওয়ায় স্বীকার করা যায় না। আর যদি বলা হয় যে, কার্যটির মতো তার অভিব্যক্তিও পূর্ব থেকেই সৎ, তাহলে প্রশ্ন হবে, ঐ অভিব্যক্তির জন্য কারকব্যাপারের প্রয়োজন কী? অথচ কারকব্যাপারের প্রয়োজন সর্বত্রই দেখা যায়। সুতরাং, এই কল্পও গ্রহণযোগ্য নয়। যদি বলা হয় ঐ অভিব্যক্তিটি আছে বটে, তবে কার্যের মতো তাও প্রচ্ছন্ন অবস্থায় আছে, তাহলে ঐ প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তির আবার অভিব্যক্তি হয়, একথা স্বীকার করতে হবে। আবার এই দ্বিতীয় অভিব্যক্তি সম্বন্ধেও প্রশ্ন করা যাবে, সেটি পূর্ব থেকে সৎ কিনা? এক্ষেত্রে বলতে হবে যে, তাও পূর্বেই প্রচ্ছন্ন ছিলো। সেক্ষেত্রে ঐ প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তিরও আবার অভিব্যক্তি ঘটতে হবে। এইভাবে অনাবস্থা দোষ ঘটবে।
  • দ্বিতীয়ত, বিশেষ বিশেষ উপাদান থেকে বিশেষ বিশেষ কার্যের উৎপত্তিও ঐ উপাদানে পূর্ব থেকেই কার্যের সত্তা প্রমাণ করে না। আপত্তি হয়েছিলো যে যদি তিলে তেলের অভাব থাকে, মাটিতেও তেলের অভাব থাকে। তাহলে তিল থেকে তেল হয় কেন? মাটি থেকে হয় না কেন? এর উত্তর হলো, তিলে তেলের যে অভাব, তা হলো প্রাগভাব। অপরপক্ষে মাটিতে তেলের অভাব হলো তেলের অত্যন্তাভাব। ন্যায়–বৈশেষিক মতে যেখানে কার্যের প্রাগভাব থাকে, সেখানেই কার্য উৎপন্ন হয়। কার্যের প্রাগভাব ঐ কার্যের একটি কারণ। সুতরাং, বিশেষ উপাদান থেকে বিশেষ কার্যের উৎপত্তিকে ব্যাখ্যা করার জন্য উপাদান বা সমবায়িকারণে উৎপত্তির পূর্বে কার্যের সত্তা স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই।
  • তৃতীয়ত, সাংখ্যদার্শনিকরা বলেন যে, উৎপত্তির পূর্বে কার্যের সত্তা স্বীকার না করলে উপাদান কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ স্বীকার করা যাবে না। কারণ, বিশেষ বিশেষ উপাদান বিশেষ বিশেষ কার্য উৎপাদনে সমর্থ একথা আমরা সকলেই স্বীকার করি। এই সামর্থই প্রমাণ করে যে, উপাদান কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ আছে। এই বক্তব্যের উত্তরে ন্যায়–বৈশেষিকরা বলেন, দুটি পদার্থের মধ্যে সম্বন্ধ হতে গেলে ঐ দুটিকে বিদ্যমান হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যেমন, আমরা সকলেই জানি যে ভবিষ্যতে আমাদের মৃত্যু হবে। সুতরাং, ভবিষ্যৎ মৃত্যু আমাদের জ্ঞানের বিষয়। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণ হয় না যে ভবিষ্যৎ মৃত্যুও সৎ। সম্বন্ধ নানারকম হতে পারে। দুটি বিদ্যমান পদার্থের মধ্যে যেমন সম্বন্ধ হয়, তেমনি বিদ্যমান ও অবিদ্যমান পদার্থদ্বয়েরও সম্বন্ধ হয়।
  • চতুর্থত, উৎপত্তির পূর্বে কার্যের উপাদানরূপে সত্তা স্বীকারের অর্থ হলো উপাদান কারণ ও কার্যকে অভিন্ন বলে মানা। কিন্তু তারা কখনোই অভিন্ন নয়, ভিন্ন। যেমন সুতোর জ্ঞান এবং কাপড়ের জ্ঞান ভিন্ন। একথা ঠিক যে গরু যেমন ঘোড়া থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারে, কাপড় তেমন সুতো থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে কাপড় ও সুতো অভিন্ন। সুতো ও কাপড়ের সম্বন্ধ যেহেতু সমবায়, সেহেতু সুতোকে ছেড়ে কাপড় থাকতে পারে না। কিন্তু এই কারণে সমবায়ের সম্বন্ধী দুটিকে অভিন্ন বলা যায় না।

সাংখ্য তত্ত্বসংকলন ও তত্ত্বপরিণাম (বিবর্তনবাদ)

বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় বিভিন্ন। এই প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বৌদ্ধদর্শনে প্রতিপাদ্য বিষয়কে বলা হয় ‘ধাতু’। ন্যায়–বৈশেষিক দর্শনে বলা হয় ‘পদার্থ’। সাংখ্য দর্শনে প্রতিপাদ্য বিষয় ‘তত্ত্ব’ নামে অভিহিত। এই ধাতু, পদার্থ বা তত্ত্ব জগতের মৌলিক উপাদান বলে বিবেচিত হয়। সাংখ্য দর্শনে দুই প্রকার মূল তত্ত্ব স্বীকৃত, যথা– নিত্য প্রকৃতি ও নিত্য পুরুষ। এই প্রকৃতি ও পুরুষ–এর সংযোগের ফলে সাক্ষাৎ ও পরম্পরাক্রমে উৎপন্ন হয় মোট তেইশ প্রকারের তত্ত্ব। ফলে সাংখ্য দর্শনে সর্বমোট পঁচিশ প্রকার তত্ত্ব স্বীকৃত। এই তত্ত্বগুলো পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব নামে দার্শনিক জগতে সুবিদিত। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণের তৃতীয় কারিকায় সাংখ্যের প্রতিপাদ্য বিষয়রূপে এই পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়–”মূলপ্রকৃতি কোন তত্ত্বের বিকার বা কার্য নয়। মহৎ আদিতে যাদের এমন সাতটি তত্ত্ব (যথা– মহৎ, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র কোন তত্ত্বের) কারণ এবং (অন্য কোন তত্ত্বের) কার্য। ষোলটি তত্ত্ব (যেমন– মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চমহাভূত) কিন্তু (কোন না কোন তত্ত্বের কেবলমাত্র) কার্য। পুরুষ (কোন তত্ত্বের) কারণও নয় এবং (অন্য কোন তত্ত্বের) কার্যও নয়।” (সাংখ্যকারিকা–৩)। সাধারণ দৃষ্টিতে কারিকাটি ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হলেও সহজ কথায় সাংখ্যের পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব বা পঁচিশ প্রতিপাদ্য বিষয় হলো–(১) জ্ঞ বা পুরুষ, (২) অব্যক্ত বা মূলপ্রকৃতি বা প্রধান, (৩) মহৎ বা বুদ্ধি, (৪) অহংকার, (৫) মনস্ বা মন (৬) পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক– এই পাঁচটি), (৭) পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ– এই পাঁচটি), (৮) পঞ্চতন্মাত্র বা পঞ্চসূক্ষ্মভূত (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ– এই পাঁচটি), (৯) পঞ্চস্থূলভূত বা পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ্ বা জল, তেজ বা অগ্নি, মরুৎ বা বায়ু, আকাশ বা ব্যোম্– এই পাঁচটি)। সাংখ্যমতে প্রকৃতি ও পুরুষ নিত্য ও অব্যক্ত। প্রকৃতি ও পুরুষ–এর সংযোগের ফলে মূলপ্রকৃতি থেকে সাক্ষাৎ অথবা পরম্পরা ক্রমে সৃষ্ট হয় ব্যক্ত শ্রেণীর অন্তর্গত তেইশ প্রকার তত্ত্ব। সাংখ্যকারিকার দ্বাবিংশতি বা বাইশতম কারিকায় এই উৎপত্তিক্রম দেখানো হয়েছে এভাবে–”প্রকৃতি থেকে মহৎ, মহৎ থেকে অহঙ্কার, অহঙ্কার থেকে (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্র– এই) ষোলটি গণ (বা বিকার) এবং ষোলটি বিকারের অন্তর্গত পঞ্চতন্মাত্র থেকে (আকাশাদি) পঞ্চমহাভূত (উৎপন্ন হয়)।” (সাংখ্যকারিকা–২২)। সাংখ্য দর্শনে দিক্ ও কালকে পৃথক তত্ত্ব বলে স্বীকার করা হয়নি। সাংখ্যমতে দিক্ ও কাল অন্যতম মহাভূত আকাশতত্ত্বের অন্তর্গত। প্রকৃতি থেকে পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় পর্যন্ত তত্ত্বসমূহকে অর্থাৎ প্রকৃতি, মহৎ, অহংকার, মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় তত্ত্বগুলোকে সাংখ্য দর্শনে প্রত্যয় সর্গ বা বুদ্ধি সর্গ বলা হয়। অপরদিকে পঞ্চতন্মাত্র ও পঞ্চমহাভূতকে ভৌতিক সর্গ বলা হয়।

এই পঞ্চবিংশতি তত্ত্বকে সাংখ্যশাস্ত্রে প্রধান চারটি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ঈশ্বরকৃষ্ণের উপরে উদ্ধৃত তৃতীয় কারিকার ব্যাখ্যাকল্পে বাচস্পতি মিশ্র তার ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’–তে বলেন–”(সাংখ্য) শাস্ত্রের (বিষয় বা) তত্ত্ব সংক্ষেপে চার প্রকার। কোন তত্ত্ব কেবল প্রকৃতি (বা কারণ), কোন তত্ত্ব কেবল বিকৃতি (বা কার্য), কোন কোন তত্ত্ব প্রকৃতি ও বিকৃতি উভয়ই এবং কোন তত্ত্ব প্রকৃতিও নয় বিকৃতিও নয়।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)। উপরিউক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী সাংখ্যের পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের চারটি বিভাগ হলো–(১) কেবল প্রকৃতি (কেবল কারণ), (২) কেবল বিকৃতি (কেবল কার্য), (৩) প্রকৃতি–বিকৃতি (কারণ ও কার্য) ও (৪) অনুভয়রূপ বা প্রকৃতিও নয় বিকৃতিও নয় (কারণও নয়, কার্যও নয়)।

  • (কেবল প্রকৃতি : মূল প্রকৃতি হলো কেবল প্রকৃতি। যে তত্ত্ব কোন তত্ত্বের বিকার বা কার্য নয়, কেবল প্রকৃতি, তথা কেবল কারণ তাকে মূলপ্রকৃতি বলে। মূল প্রকৃতি কোনকিছুর কার্য নয়, তা কেবল কারণরূপ প্রধান বলে বিবেচিত। প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থা বলে প্রকৃতি ত্রিগুণাত্মিকা। আবার সকল কার্যই যেহেতু প্রকৃতিতে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে, তাই প্রকৃতিকে অব্যক্তও বলা হয়। সাংখ্যমতে প্রকৃতি নিত্য, উৎপত্তিহীন চরম কারণ। প্রকৃতির কারণান্তর স্বীকার করলে অনবস্থা দোষ দেখা দেয়। এই অনবস্থা দোষাবহ ও পরিহারযোগ্য। তাই প্রকৃতিকে অকারণ ও সকল কার্যের আদি কারণ বীজস্বরূপ বলা হয়। ব্যক্ত শ্রেণীর অন্তর্গত তেইশ প্রকার তত্ত্বের মূল কারণ মূলপ্রকৃতি।
  • (প্রকৃতিবিকৃতি : যে তত্ত্ব কোন তত্ত্বের কারণ রূপ প্রকৃতি এবং অন্য কোন তত্ত্বের কার্য রূপে বিকৃতি সেটিই প্রকৃতি–বিকৃতি। মহৎ, অহংকার ও পঞ্চতন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) এই সপ্ত তত্ত্ব প্রকৃতি–বিকৃতি, অর্থাৎ এগুলো কারণও বটে, আবার কার্যও বটে। সাংখ্যমতে প্রধান থেকে মহৎতত্ত্বের উৎপত্তি হয়, মহৎতত্ত্ব থেকে অহংকারের উৎপত্তি হয়, অহংকার থেকে একাদশ ইন্দ্রিয় (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়) ও পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি হয় এবং পঞ্চতন্মাত্র থেকে পঞ্চমহাভূতের উৎপত্তি হয়। ফলে–মহৎ অহংকারের কারণ রূপে প্রকৃতি এবং মূলপ্রকৃতির কার্য রূপে বিকৃতি। অহংকার মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্র–এর কারণ রূপে প্রকৃতি এবং মহৎ–এর কার্য রূপে বিকৃতি। এবং পঞ্চতন্মাত্র পঞ্চমহাভূত–এর কারণ রূপে প্রকৃতি এবং অহংকার–এর কার্য রূপে বিকৃতি। এই কারণে মহদাদি সপ্ততত্ত্ব প্রকৃতি–বিকৃতি বলে পরিচিত।
  • (বিকার বা কেবল বিকৃতি : যে তত্ত্ব কোন তত্ত্বের কারণ নয়, কিন্তু অন্য কোন তত্ত্বের কার্যরূপে বিকৃতি তাকে বিকার বলে। ষোলটি তত্ত্ব কেবলমাত্র কার্য, যেমন – মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, অহংকার–এর কার্য রূপে বিকৃতি এবং পঞ্চমহাভূত পঞ্চতন্মাত্র–এর কার্য রূপে বিকৃতি। ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম্– এই পাঁচটি হলো পঞ্চমহাভূত। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক্– এই পাঁচটি হলো পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়। বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ– এই পাঁচটি হলো পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়। মন হলো উভয়–ইন্দ্রিয়। মোট এই ষোলটি তত্ত্ব পদার্থান্তরের উপাদান কারণ হয় না, এইজন্য এগুলোকে কেবল কার্য বা বিকৃতি বলা হয়েছে।
  • (অনুভয়রূপ বা প্রকৃতিও নয় বিকৃতিও নয় : যে তত্ত্ব কোন তত্ত্বের কারণ বা প্রকৃতিও নয় এবং অন্য কোন তত্ত্বের কার্য বা বিকৃতিও নয়, যেমন– পুরুষতত্ত্ব। যেহেতু পুরুষ কারও কার্য বা কারণ হয় না, সেহেতু পুরুষকে অনুভয়রূপ বলা হয়েছে। পুরুষ ব্যতীত সাংখ্যসম্মত চব্বিশটি তত্ত্ব সবিকার ও সক্রিয় তত্ত্ব। একমাত্র পুরুষই নির্বিকার ও নিষ্ক্রিয় তত্ত্ব।

সাংখ্যমতে উপরিউক্ত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব মূলত দ্বিবিধ তত্ত্বের অন্তর্গত। এই দ্বিবিধ তত্ত্বের একটি হলো প্রকৃতি এবং অপরটি হলো পুরুষ। এই কারণে সাংখ্য দর্শনকে বলা হয় দ্বৈতবাদী। সাংখ্যমতে প্রকৃতি ও পুরুষ উভয় তত্ত্বই অকারণ, অলিঙ্গ এবং নিত্য। প্রকৃতি হলো বিষয় এবং পুরুষ বিষয়ী। পরিণামী প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের নেপথ্যে পুরুষ হলো এক অপরিণামী, অপরিবর্তনীয় সত্তা। পুরুষ প্রকৃতির পরিপূরক। তাই সাংখ্য দর্শনে পুরুষকে নেতিবাচকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকৃতিতে যার অভাব, তাই পুরুষে বর্তমান। সাংখ্যকারিকার ঈশ্বরকৃষ্ণও প্রকৃতির বিরুদ্ধরূপে পুরুষকে বর্ণনা করেছেন–”ব্যক্ত তত্ত্ব মাত্রই সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণাত্মক (হওয়ায়) ত্রিগুণ থেকে অভিন্ন, ভোগ্য বা বিষয় (অনেক পুরুষের জ্ঞানে গৃহীত হবার যোগ্য), অচেতন ও পরিমাণস্বভাব। অব্যক্ত বা প্রকৃতিও সেইরূপ। কিন্তু জ্ঞ বা পুরুষ সেইরূপ হওয়া সত্ত্বেও (ব্যক্ত ও অব্যক্ত তত্ত্ব মাত্রের) বিপরীত।”

উল্লেখ্য, ব্যক্ত (প্রকৃতি–বিকৃতি ও বিকৃতি বা বিকার) ও অব্যক্ত (মূলপ্রকৃতি বা প্রধান)-এর লক্ষণ দেখাতে গিয়ে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ দশম কারিকায় বলছেন–”ব্যক্ত (তত্ত্ব মাত্রই) হেতুমৎ বা কারণযুক্ত, অনিত্য, অব্যাপি বা কারণের একাংশে স্থিত, সক্রিয় বা চলনক্রিয়াযুক্ত, অনেক, আশ্রিত, লিঙ্গ বা লয়শীল ও অনুমাপক, সাবয়ব বা অবয়বযুক্ত এবং পরাধীন। তার বিপরীত (ধর্মবিশিষ্ট তত্ত্বই) অব্যক্ত।” (সাংখ্যকারিকা–১০)। সাংখ্যশাস্ত্রে পঞ্চবিংশতি তত্ত্বগুলোকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, সাংখ্যকারিকার (ইতোপূর্বে উদ্ধৃত) দ্বিতীয় কারিকায় সাংখ্যশাস্ত্রে স্বীকৃত তত্ত্বগুলোকে আবার তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে, যথা– ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ। দ্বাবিংশতি বা বাইশতম কারিকায় প্রকৃতি ও পুরুষ–এর সংযোগের ফলে মূলপ্রকৃতি থেকে সাক্ষাৎ বা পরম্পরা ক্রমে সৃষ্ট যে তেইশ প্রকার তত্ত্বের উল্লেখ রয়েছে, যেমন– মহৎ বা বুদ্ধি, অহংকার, মনস্ বা মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চতন্মাত্র এবং পঞ্চমহাভূত, সেগুলোই ব্যক্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। অব্যক্ত বা মূলপ্রকৃতি এই ব্যক্ত তত্ত্বগুলোর মূল–কারণ, এবং জ্ঞ বা পুরুষ এই অব্যক্ত ও ব্যক্ত তত্ত্বগুলোর বিপরীত। সাংখ্যদর্শনকে দ্বৈতবাদী ও বস্তুবাদী বলা হয়। এইমতে চৈতন্যস্বরূপ পুরুষ যেমন সত্য, তেমনি জড় প্রকৃতিও সত্য। উভয়ই পরিণামশীল জড়জগতের মূল ও আদি কারণ। এককভাবে উভয়ই জগৎ সৃষ্টিতে অসমর্থ। সাংখ্যমতে পুরুষের সংস্পর্শে প্রকৃতির যে পরিণাম ঘটে, তাই জগৎ। আবার প্রলয়কালে এই জগৎ অব্যক্ত প্রকৃতিতেই লীন হয়ে যায়।

সাংখ্যের প্রকৃতিতত্ত্ব

প্রকৃতি

সৎকার্যবাদী সাংখ্য দর্শন প্রকৃতিকেই জগতের আদি উপাদান ও অধিষ্ঠান বলে মনে করেন। এই মতে বিচিত্র জগৎ প্রকৃতির পরিণাম ছাড়া আর কিছুই নয়। সাংখ্যমতে, জগতের আদি কারণ কোন চৈতন্যস্বরূপ পুরুষ বা জড় পরমাণু নয়। পুরুষ জগতের আদি কারণ হতে পারে না। পুরুষ চৈতন্যস্বরূপ, চৈতন্য জড় জগতের কারণ হতে পারে না। আবার অপরিণামী জড় পরমাণু থেকে মন, বুদ্ধি বা অহংকারের মতো সূক্ষ্ম তত্ত্ব উৎপন্ন হতে পারে না। সুতরাং পরমাণু জগতের আদি কারণ নয়। জগতের আদি কারণ হলো পরমাণু থেকে সূক্ষ্মতর এক পরিণামশীল জড়তত্ত্ব। এই পরিণামশীল জড়তত্ত্বই প্রকৃতি, প্রধান বা অব্যক্তরূপে পরিচিত। সাংখ্যমতে প্রকৃতি নিত্য। এই নিত্য প্রকৃতির অভিব্যক্তিই জগৎ। কারণ–প্রকৃতিতে জগৎ অব্যক্ত থাকে বলে প্রকৃতিকে অব্যক্ত বলা হয়। প্রকৃতি হলো নির্বিশেষ ও নিরবয়ব। এজন্য প্রকৃতি প্রত্যক্ষগোচর নয়। প্রকৃতি হলো এক সর্বব্যাপী, অতিসূক্ষ্ম, অসীম ও জগতের আদিকারণরূপ জড়শক্তি। প্রকৃতিতে জগতের স্থিতি এবং প্রকৃতিতেই জগতের লয়। কারণরূপ প্রকৃতি অব্যক্ত ও প্রধান, এবং কার্যরূপ প্রকৃতি সৎরূপে প্রকাশিত। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ ষোড়শ কারিকায় প্রকৃতির স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন–”অব্যক্ত প্রধান বা প্রকৃতি (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই) ত্রিগুণরূপে সমবেত হয়ে কার্যাকারে পরিণত হয়। একই জল যেমন ভিন্ন ভিন্ন আধারে নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয়, সেরূপ এক একটি গুণের প্রাধান্য অনুযায়ী ও সহকারীভেদে একই প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয়।” (সাংখ্যকারিকা–১৬)।

সাংখ্যমতে প্রকৃতির পরিণামের ফলে জগতের সৃষ্টি, আবার প্রকৃতির পরিণামের ফলে জগতের লয়। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণ যখন সাম্যাবস্থায় থাকে, তখন তাদের মধ্যে পৃথক পৃথক ভাবে পরিণাম ঘটে। অর্থাৎ সত্ত্ব সত্ত্বরূপে, রজঃ রজোরূপে এবং তমঃ তমোরূপে পরিণত হয়। এরূপ পরিণামকে বলা হয় প্রকৃতির স্বরূপ পরিণাম বা সদৃশ পরিণাম। এই পরিণাম গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থায় ঘটে। এই সাম্যাবস্থা যখন বিনষ্ট হয়, তখন প্রকৃতিতে অপর একপ্রকার পরিণাম দেখা যায়। এই পরিণামে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ–এর পারস্পরিক শক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব ঘটে। এর ফলে কখনও সত্ত্ব, কখনও রজঃ আবার কখনও তমঃ গুণের প্রাধান্য ঘটে। প্রকৃতির এরূপ পরিণামকে বিরূপ পরিণাম বা বিসদৃশ পরিণাম বলে। বিরূপ পরিণামের ফলে জগতের সৃষ্টি এবং স্বরূপ পরিণামের ফলে জগতের লয় সূচিত হয়। ষোড়শ কারিকার ব্যাখ্যাকল্পে তাই বাচস্পতি মিশ্র তার ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে বলেন–”প্রলয়কালে সত্ত্ব, রজ ও তম গুণের সদৃশ পরিণাম হয়। গুণগুলোর স্বভাব পরিণাম। পরিণত না হয়ে এরা ক্ষণকালও থাকতে পারে না। তাই সত্ত্ব সত্ত্বরূপে, রজঃ গুণ রজোরূপে ও তমঃ গুণ তমোরূপে প্রলয়কালেও পরিণাম প্রাপ্ত হয়।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)।

সাংখ্যমতে বলা হয়, প্রকৃতির লক্ষণ বা স্বভাব হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থা। কিন্তু খেয়াল রাখা আবশ্যক যে, এই মতে, প্রকৃতির দুটি অবস্থা– ব্যক্ত বা কার্যাবস্থা এবং অব্যক্ত বা অকার্যাবস্থা। প্রকৃতির অকার্যাবস্থাকে বলে মূলপ্রকৃতি বা প্রধান। মূলপ্রকৃতি বা প্রধানের লক্ষণ হলো এই ‘সত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থা’ বা সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থা। স্বভাবত, এটিকে প্রকৃতির লক্ষণ বললে লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষদুষ্ট হবে। কারণ, এই লক্ষণটি প্রকৃতির ব্যক্ত ও অব্যক্ত অবস্থা–দুটির মধ্যে কেবলমাত্র অব্যক্ত অবস্থাকে নির্দেশ করে, ব্যক্ত অবস্থাকে নির্দেশ করে না। তাই ঈশ্বরকৃষ্ণের তৃতীয় কারিকার ব্যাখ্যাকল্পে বাচস্পতি মিশ্র তার সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী–তে মূলপ্রকৃতি শব্দের অর্থ নিরূপণ প্রসঙ্গে বলেন–”মূলপ্রকৃতি অবিকৃতি (অর্থাৎ কেবল কারণ, যা কোন তত্ত্বের কার্য নয়)। যিনি প্রকৃষ্ট রূপে কার্য উৎপন্ন করেন তিনিই প্রকৃতি বা প্রধান– তিনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই তিন গুণের সাম্যাবস্থা। তিনি অবিকৃতি– অর্থাৎ তিনি কেবল কারণ।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)।

‘প্রকৃতি’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো, প্র–করোতি বা যা প্রকৃষ্ট কারণ, তাই প্রকৃতি। সাংখ্যমতে অন্যান্য কারণের তুলনায় উপাদান কারণই প্রকৃষ্ট কারণ। সুতরাং এই জগতের যা উপাদান কারণ তাই প্রকৃতি। এই প্রকৃতির স্বরূপ হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থা। এই কারণে প্রকৃতিকে ত্রৈগুণ্য বলে। যেহেতু প্রকৃতির কারণ স্বীকার করলে অনবস্থা দেখা দেয়, তাই প্রকৃতি হলো অকারণ (মূলে মূলাভাবাৎ অমূলম্ মূলম্)।

অব্যক্ত প্রকৃতির অস্তিত্বসিদ্ধি

সূক্ষ্ম প্রকৃতি যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, সেহেতু প্রকৃতির অস্তিত্ব যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সাংখ্যমতে এই প্রকৃতির নামান্তর হলো প্রধান। এই প্রধানকে অব্যক্তও বলা হয়। অব্যক্ত প্রত্যক্ষযোগ্য নয়। এখন প্রশ্ন হলো, আকাশকুসুম, বন্ধ্যাপুত্র প্রভৃতির প্রত্যক্ষ না হওয়ায় তাদের অলীকত্ব যেমন সিদ্ধ হয়, অনুরূপভাবে কেন বলা যাবে না যে, প্রধানের প্রত্যক্ষ না হওয়ায় প্রধান প্রভৃতির অলীকত্ব সিদ্ধ হোক? এই আশঙ্কার উত্তরে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ না হলেও তার অসত্ত্ব (অর্থাৎ অস্তিত্বহীনতা) প্রমাণিত হয় না। প্রত্যক্ষ না হওয়া অর্থাৎ, অনুপলব্ধির বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন– আকাশের অনেক উচ্চতায় পাখি উড়তে থাকলেও অতিদূরত্ববশত প্রত্যক্ষের দ্বারা তার উপলব্ধি হয় না। আবার অত্যন্ত নিকটে থাকায় নিজের চোখের কাজল দৃষ্টিগোচর হয় না। তৃতীয়ত, কোন ইন্দ্রিয় বিকল অর্থাৎ অপটু হলে অর্থাৎ, অন্ধত্ব, বধিরত্ব প্রভৃতি থাকলে বিদ্যমান রূপ ও শব্দ প্রত্যক্ষগোচর হয় না। চতুর্থত, অন্যমনস্কতাবশত পদার্থ প্রত্যক্ষের বিষয় হয় না। অন্যমনস্কতা দু’ভাবে হতে পারে। প্রথমত, মন যদি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়, তাহলে অন্যমনস্কতা হয়। দ্বিতীয়ত, মনের যে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ হওয়া প্রয়োজন, সেই ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ না হয়ে অন্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ হলেও অন্যমনস্কতা হয়। আবার কাম, ক্রোধ এবং লোভবশত যার মন বিবশ হয়েছে, সেই ব্যক্তি অতি উজ্জ্বল আলোর মধ্যে থাকা ইন্দ্রিয়সম্বন্ধযুক্ত বিষয়কেও দেখতে পায় না। তাছাড়া অতিসূক্ষ্ম পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না। এই কারণে কোন ব্যক্তি একাগ্রচিত্ত হলেও এবং পরমাণু, দ্ব্যণুক, আকাশ, কাল প্রভৃতির সঙ্গে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হলেও, ঐ সকল পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না। এক্ষেত্রে সূক্ষ্ম শব্দের অর্থ যে দ্রব্যে মহত্বের ও উদ্ভূতরূপের অভাব থাকে। আর দেয়াল প্রভৃতির ব্যবধানবশত গৃহের মধ্যে থাকা পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না। সর্বোপরি অভিভববশত অভিভূত পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না। সুতরাং, কোন বস্তুর প্রত্যক্ষ না হলেই তার অভাব সিদ্ধ হয় না। যে বস্তুটি প্রত্যক্ষযোগ্য অর্থাৎ, বস্তুটির প্রত্যক্ষের কারণগুলো আছে অথচ অতিদূরত্ব প্রভৃতি প্রতিবন্ধক নেই, সেই অবস্থায় যদি ঐ বস্তুটির প্রত্যক্ষ না হয়, তাহলে সেই বস্তুটির অভাব সিদ্ধ হয়। আলোচ্যস্থলে প্রধানের প্রত্যক্ষযোগ্যতা নেই। প্রত্যক্ষের অযোগ্য পদার্থের প্রত্যক্ষ না হলে প্রধানের অভাব সিদ্ধ হয় না।

সাংখ্যমতে প্রকৃতি হলো ত্রিগুণাত্মক অর্থাৎ ত্রিগুণস্বরূপ। সাংখ্যে গুণ শব্দের প্রসিদ্ধ অর্থ হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। সত্ত্ব হলো লঘু, প্রকাশ ও সুখশক্তিবিশিষ্ট। রজঃ হলো গুরুলঘুর সমাবেশ সাধক, উপষ্টম্ভক, বাধা ও বলের সমাবেশকারক, চলনশীল এবং দুঃখাত্মক। তমঃ হলো গুরু, আবরক অর্থাৎ, প্রকাশের প্রতিবন্ধক এবং মোহস্বরূপ। গুণের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে যে, এরা যথাক্রমে প্রীতি বা সুখ, অপ্রীতি বা দুঃখ এবং বিষাদ বা মোহের কারণ। জগতের যেকোন পদার্থই হয় সুখ, না হয় দুঃখ না হয় মোহের কারণ। সুতরাং, জগৎসৃষ্টির মূল কারণ প্রকৃতিকেও সুখ–দুঃখ–মোহস্বরূপ রূপে কল্পনা করা হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে দেখা যায়, কার্য কারণগুণাত্মক, যেমন– কাপড় সুতোর গুণে অন্বিত। অনুরূপভাবে সুখদুঃখমোহাত্মক মহদাদি কার্যের কারণ অব্যক্ত প্রধানও সুখদুঃখমোহাত্মক হবে। সুতরাং কার্য কারণগুণাত্মক বলে অব্যক্ত প্রধানের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।

ন্যায় ও বৈশেষিক সম্প্রদায়ের দার্শনিকগণ বলেন, ব্যক্ত থেকে ব্যক্ত উৎপন্ন হয়। পরমাণুগুলো ব্যক্ত। সেগুলো থেকে দ্ব্যণুক–ইত্যাদি ক্রমে স্থূল পৃথিবী ইত্যাদি–রূপ কার্য ব্যক্তের উৎপত্তি হয়। পৃথিবী ইত্যাদিতে কারণের গুণানুসারে রূপ ইত্যাদিরও উৎপত্তি হয়। অতএব, ব্যক্ত থেকে ব্যক্ত এবং তার গুণের উৎপত্তি সম্ভব হলে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অব্যক্ত কল্পনার প্রয়োজন কী? এরূপ আশঙ্কার উত্তরে প্রকৃতির অস্তিত্বসাধক যুক্তিগুলোকে ঈশ্বরকৃষ্ণ তার সাংখ্যকারিকার পঞ্চদশ কারিকায় প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন–”ভেদাদি (অর্থাৎ মহদাদি ত্রয়োবিংশতি কার্যবিশেষ বা বিভিন্ন বস্তু) পরিমিত বা পরিমাণবিশিষ্ট বলে, বিভিন্ন কারণ ও কার্যের মধ্যে (গুণের দিক থেকে) সমন্বয়ের উপস্থিতি বা সমতা থাকায়, (কারণের) শক্তি থেকে কার্যের উৎপত্তি হওয়ায়, সকল উৎপন্ন বস্তুতে (সৃষ্টি কালে) কারণ ও কার্যের বিভাগ থাকায় এবং (প্রলয় কালে) ঐরূপ বিভাগ না থাকায় সকল বস্তুর অধিষ্ঠানের প্রয়োজন হেতু অব্যক্ত প্রধান বা প্রকৃতির অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।” (সাংখ্যকারিকা–১৫)। উক্ত কারিকায় অব্যক্ত প্রকৃতি বা প্রধানের অস্তিত্ব স্বীকারের সমর্থনে পাঁচটি হেতুর উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন–(১) ভেদানাং পরিমাণাৎ, অর্থাৎ মহদাদি বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন পরিমাণবিশিষ্ট হেতু, (২) সমন্বয়াৎ, অর্থাৎ বিভিন্ন কারণের মধ্যে সমন্বয়ের উপস্থিতি হেতু, (৩) শক্তিতঃ প্রবৃত্তেঃ, অর্থাৎ শক্তি থেকে কার্যের উৎপত্তি হেতু, (৪) কারণকার্যবিভাগাৎ, অর্থাৎ কারণ ও কার্যের বিভাগ হেতু এবং (৫) বৈশ্বরূপ্যস্য অবিভাগাৎ, অর্থাৎ উৎপত্তির পূর্বে ও প্রলয়ের পরে সকল বস্তুর অধিষ্ঠানের প্রয়োজন হেতু। সাংখ্যকারিকা গ্রন্থের টীকাগ্রন্থ সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদীতে বাচস্পতি মিশ্র এই পাঁচটি হেতুর সাংখ্যতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।

  • প্রথম হেতু: (ভেদানাংপরিমাণাৎ)– সাংখ্যমতে কার্যবস্তু কারণে বিদ্যমান থাকে অথচ কারণ থেকে আবির্ভূত হয়ে ভিন্নভাবে প্রতীত হয়। কার্যের তুলনায় কারণ সূক্ষ্ম ও ব্যাপক। মহৎ থেকে শুরু করে সকল কার্যবস্তু কমবেশি ব্যক্ত ও স্থূল। বলা হয় মহৎতত্ত্ব পরিমিত। অর্থাৎ, মহৎতত্ত্বে পরিমাণ থাকার জন্য মহৎতত্ত্ব চরম অব্যক্ত হবে না। যে বস্তু পরিমিত, তার উৎপত্তি অবশ্যস্বীকার্য। সুতরাং, মহৎতত্ত্বের কারণরূপে পরম অব্যক্ত অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অহংকার অপেক্ষা মহৎতত্ত্ব অব্যক্ত হলেও প্রকৃতিই পরম অব্যক্ত। এইভাবে অনুমান প্রমাণের দ্বারাই মহৎতত্ত্বের তথা মহদাদি কার্যবস্তুর কারণরূপে পরম অব্যক্ত প্রকৃতিকে স্বীকার করতে হয়।
  • দ্বিতীয় হেতু: (সমন্বয়াৎ)– যদিও জগৎ বৈচিত্র্যপূর্ণ, তবুও জগতের বিচিত্র বস্তুর মধ্যে সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সমন্বয় শব্দের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের সমানরূপতা। যথা– পৃথিবী প্রভৃতি মহাভূত, গন্ধ প্রভৃতি তন্মাত্র, অহংকার, মহৎ প্রভৃতি পরস্পর ভিন্ন হলেও এদের একটা সামান্যরূপ আছে। সেই সামান্য ধর্মই হলো সুখদুঃখমোহস্বরূপতা। বুদ্ধি বা মহতের লক্ষণ হলো অধ্যবসায়, অহংকারের লক্ষণ হলো অভিমান, তন্মাত্রের লক্ষণ হলো সূক্ষ্ম গন্ধ ইত্যাদি, পৃথিবী প্রভৃতির লক্ষণ হলো স্থূলগন্ধ প্রভৃতি। প্রত্যেকটি কার্যে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ বা ধর্ম বর্তমান। এই ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশিষ্ট কার্য পরম্পরার একটি সাধারণ ধর্ম আছে। বস্তুমাত্রই আমাদের মধ্যে সুখ, দুঃখ অথবা বিষাদ উৎপন্ন করে। তাই সেই সাধারণ ধর্মটি হলো সুখদুঃখমোহস্বরূপতা। এই সাধারণ ধর্মটি পৃথিবী প্রভৃতি প্রত্যেকটিতে থাকায় সুখদুঃখমোহস্বরূপত্ববিশিষ্ট অব্যক্তকারণ অবশ্য স্বীকার্য। সাংখ্যমতে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই তিনগুণের সমন্বিত উপস্থিতিবশতই এরূপ হয়ে থাকে। জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই যদি সত্ত্ব, রজঃ ও তমোর সমন্বয় ঘটে, তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সত্ত্ব, রজঃ ও তমো গুণান্বিত কোন একটিমাত্র বিশেষ কারণ থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। জগতের এই বিশেষ কারণকেই প্রকৃতি বলা হয়।
  • তৃতীয় হেতু: (শক্তিতঃপ্রবৃত্তেশ্চ)– কারণের শক্তি থেকে কার্য উৎপন্ন হয়। কারণ যদি অশক্ত অর্থাৎ শক্তিহীন হয় তাহলে তার দ্বারা কার্য উৎপন্ন হয় না। যেমন– তিল থেকে তেল উৎপন্ন হয়, বালি থেকে তেল উৎপন্ন হয় না। কারণ তিলে তেল উৎপাদনের শক্তি আছে, বালিতে ঐ শক্তি নেই। শক্তি থাকলে কার্য হয়, শক্তি না থাকলে কার্য হয় না– এরূপ অন্বয়–ব্যতিরেকের দ্বারা শক্তি সিদ্ধ হয়। এই শক্তি স্বীকার না করলে কোন কার্যেরই উৎপত্তি সম্ভব নয়। এই জগতের সকল প্রবৃত্তিই শক্তির দ্বারা হয়ে থাকে। এইভাবে কারণে যে শক্তি অবশ্যস্বীকার্য হয়, সেই শক্তি কোন অতিরিক্ত পদার্থ নয়, কারণনিষ্ঠ ঐ শক্তি কারণে স্থিত কার্যেরই অব্যক্ত অবস্থা। অর্থাৎ এই বৈচিত্র্যময় জগৎ, সৃষ্টির পূর্বে নিশ্চয়ই সৃষ্টিক্ষমতাসম্পন্ন কোন এক অব্যক্ত কারণে সুপ্তাবস্থায় ছিলো। যে অব্যক্ত শক্তির এই বৈচিত্র্যময় জগতের অধিষ্ঠান হবার যোগ্যতা আছে, তাই প্রকৃতি।
  • চতুর্থ হেতু: (কারণকার্যবিভাগাৎ)– সাংখ্যমতে কারণ ও কার্যের মধ্যে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ বর্তমান। স্বর্ণনির্মিত অলঙ্কার যেমন স্বর্ণ থেকে অভিন্ন, তেমনি আবার আকৃতিপ্রাপ্ত অলংকার হিসেবে তা উপাদান স্বর্ণ থেকে ভিন্ন। পরিণামপ্রাপ্ত জগতের সকল বিষয়ের সঙ্গে যে উপাদান কারণ একই সঙ্গে ভিন্ন ও অভিন্নরূপে বর্তমান, তাই প্রকৃতি। যেহেতু কারণ থেকে কার্যের বিভাগ হয় অর্থাৎ, অভিব্যক্তি হয় ও ভিন্নরূপে প্রতীতি হয়, সেহেতু চরম কারণ অব্যক্ত অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এই অব্যক্তই প্রকৃতি।
  • পঞ্চম হেতু: (অবিভাগাৎ বৈশ্বরূপ্যস্য)– বৈশ্বরূপ্য এবং বিশ্বরূপ একই অর্থ বহন করে। বিশ্বরূপ শব্দের অর্থ কার্যসমূহ। মাটি থেকে উৎপন্ন ঘট যখন বিনষ্ট হয়, তখন ঐ ঘট মাটিতে প্রবেশ করে এবং অব্যক্তাবস্থা প্রাপ্ত হয়। এই মাটি অব্যক্ত হলেও তার অব্যক্ত হওয়া আপেক্ষিক। একমাত্র প্রকৃতিই প্রকৃত অব্যক্ত। প্রকৃতি কখনো কোথাও প্রবিষ্ট বা তিরোভূত হয় না। সেই কারণে প্রকৃতি সকল কার্যের চরম অব্যক্ত। সুতরাং, উৎপত্তির পূর্বে নিজের উপাদান কারণে কার্যের বিদ্যমান থাকা এবং বিনাশের পর কার্যের নিজের উপাদান কারণে লীন হওয়া– উভয়ই অব্যক্ত অবস্থা। অতএব, বিশ্বরূপ যে অধিষ্ঠানে প্রলয়কালে বিলীন হয় এবং যে অধিষ্ঠান থেকে বিশ্বরূপ সৃষ্টি হয়, সেই অধিষ্ঠানই হলো প্রকৃতি।

এভাবেই সাংখ্যদর্শনে জগৎ সৃষ্টির প্রতি উপাদানকারণরূপে প্রকৃতির অস্তিত্ব সাধিত হয়েছে।

প্রকৃতির গুণত্রয় (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ)

সাংখ্য দর্শনে ব্যক্ত ও অব্যক্তকে ত্রিগুণ এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়েছে। অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ হলো প্রকৃতির গুণত্রয়। ‘গুণ’ শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ‘গুণ’ বলতে কোন দ্রব্যের বা বস্তুর ধর্মকে বোঝানো হয়। ন্যায়–বৈশেষিক মতে, যা দ্রব্যে সমবেত ও কর্ম থেকে ভিন্ন তাকেই গুণ বলা হয়েছে। এই মতে দ্রব্য গুণের সমবায়ী কারণ ও তার আশ্রয় বা অধিষ্ঠান। কিন্তু সাংখ্য দর্শনে ‘গুণ’ শব্দটি এই অর্থে গৃহীত হয়নি। সাংখ্যসম্মত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণ দ্রব্যের বা বস্তুর ধর্ম নয়। এগুলো দ্রব্য এবং জাগতিক যাবতীয় দ্রব্য বা বস্তুমাত্রেরই উপাদান। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ দ্বাদশ কারিকায় গুণত্রয়ের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেন–”সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ– এই গুণগুলো সুখ, দুঃখ ও মোহ–স্বরূপ। প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও নিয়ম তাদের অর্থ বা প্রয়োজন। পরস্পরকে অভিভূত করা, পরস্পরকে আশ্রয় করা, পরস্পরের সাহায্যে বৃত্তির জনক হওয়া এবং পরস্পরের নিত্যসঙ্গী হওয়া তাদের বৃত্তি।” (সাংখ্যকারিকা–১২)। আবার কোন্ গুণ কীরূপ, কেনই বা এরূপ হয়, এ প্রসঙ্গে ঈশ্বরকৃষ্ণ ত্রয়োদশ কারিকায় বলেন–”সত্ত্বগুণ লঘু, প্রকাশক ও ইষ্ট, রজোগুণ চালক, আরম্ভক ও চঞ্চল, এবং তমোগুণ ভারী ও আবরক। প্রয়োজন বা কার্য–সিদ্ধির জন্য প্রদীপের মতো তাদের বৃত্তি বা কার্য হয়।” (সাংখ্যকারিকা–১৩)। এই কারিকা দুটিতে প্রাপ্ত ঈশ্বরকৃষ্ণের বক্তব্য থেকে গুণত্রয়ের স্বরূপ, প্রয়োজন ও কার্য সম্বন্ধে জানা যায়।

সত্ত্বগুণ সুখাত্মক, রজঃ দুঃখাত্মক এবং তমঃ বিষাদাত্মক। সত্ত্বগুণের কার্য প্রকাশ, রজোগুণের কার্য প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের কার্য নিয়ম বা আবরণ। গুণ মানে পরার্থ, অর্থাৎ যা অপরের অর্থ বা প্রয়োজন সাধন করে। গুণত্রয় পরস্পরবিরুদ্ধস্বভাব হলেও কার্যক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরের সহায়ক হয়। অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে কেউ কারোর বাধক হয় না। তিনটি গুণ কখনো একই সঙ্গে উদ্বুদ্ধ বা কার্যোন্মুখ হয় না। যখন একটি গুণ উদ্বুদ্ধ হয়, তখন অপর দুটি গুণ অভিভূত হয় বা তার বশ্যতা স্বীকার করে। তিনটি গুণ যদি একই সঙ্গে উদ্বুদ্ধ হতো, তাহলে তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতিবন্ধক হওয়ায় কোন কার্যই উৎপন্ন হতে পারতো না। সত্ত্বগুণ লঘু, স্বচ্ছ ও প্রকাশক। সত্ত্বগুণ স্বভাবত লঘু হওয়ায় তা উর্ধ্বগতিসম্পন্ন। সত্ত্বগুণ সব থেকে স্বচ্ছ হওয়ায় তাতে পুরুষের সুস্পষ্ট প্রতিবিম্বন সম্ভব হয় এবং তার দ্বারা সকল বস্তু প্রকাশিত হয়। রজোগুণ উত্তেজক এবং ক্রিয়াশীল। জাগতিক সকল বস্তুর গতি, ক্রিয়া ও চঞ্চলতার জন্য রজোগুণই কারণ। তমোগুণ গুরু এবং আবরক। বস্তুত তমঃ সত্ত্বগুণের প্রকাশ এবং রজোগুণের প্রবৃত্তির নিবারক। স্বচ্ছতাবশত সত্ত্বগুণকে শ্বেতবর্ণের সঙ্গে, চাঞ্চল্যবশত রজোগুণকে রক্তবর্ণের সঙ্গে এবং আবরণবশত তমোগুণকে কৃষ্ণবর্ণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। উল্লেখ্য, রজোগুণের প্রয়োজন প্রবৃত্তি, আর সত্ত্ব ও তমোগুণ নিজেরা ক্রিয়াহীন। রজোগুণ তাদের চালনা করে অর্থাৎ অবসর থেকে মুক্ত করে তাদের নিজ নিজ কার্যে উৎসাহ সঞ্চার করে। তাই বলা হয় রজোগুণ অন্য গুণের চালক। কেন রজোগুণ এরূপ করে? এর উত্তরে বলা হয়েছে, রজোগুণ চল অর্থাৎ ক্রিয়াস্বভাব। ক্রিয়াস্বভাব বলে রজোগুণ সত্ত্ব ও তমোগুণকে সকল কার্যে চালনা করতে গিয়ে গুরু ও আবরক এবং প্রবৃত্তির ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী তমোগুণের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কোন কোন বিষয়ে মাত্র প্রবৃত্ত হয়, সকল বিষয়ে প্রবৃত্ত হয় না। তাই সেই সেই বিষয় থেকে ব্যাবৃত্ত করে বলে অর্থাৎ কোন কোন বিষয়ে প্রবৃত্তির প্রতিবন্ধক হয় বলে তমোগুণকে নিয়ামক বা আচ্ছাদক বলা হয়।

জগতের কোন বস্তুই কেবল সত্ত্ব, বা কেবল রজঃ কিংবা কেবল তমোগুণের দ্বারা গঠিত নয়। জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই ত্রিবিধ গুণ বর্তমান। তবে কোন একটি বস্তুতে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সত্ত্বগুণ প্রাধান্য লাভ করে, আবার কোন এক সময় রজঃ বা তমঃ গুণ প্রাধান্য লাভ করে। তৈল, বর্তি এবং অগ্নি এই তিনটির কোন একটিমাত্র যেমন প্রদীপের কার্য সম্পাদন করতে পারে না অথচ এদের পারস্পরিক সহযোগিতায় যেমন প্রদীপের কার্য সম্পন্ন হয়, তেমনি গুণত্রয়ের কোন একটির উদ্ভব এবং অপর দুটির অভিভববশত পরিণামী প্রকৃতির কার্য সম্পন্ন হয়। মোটকথা, সাংখ্যমতে গুণগুলোর প্রত্যক্ষ হয় না। সুখ, দুঃখ এবং মোহরূপ কার্যের দ্বারা গুণগুলোর অনুমান হয়। সত্ত্ব গুণ হলো লঘু ও প্রকাশক। রজোগুণ চঞ্চল ও প্রেরণাদায়ক। আবার তমোগুণ হলো ভারী ও আবরণকারী। সুখ, সন্তোষ এবং প্রকাশ সত্ত্বগুণের বৈশিষ্ট্য। রজোগুণের জন্য দুঃখ এবং বিষাদ হয়। তমোগুণের আধিক্য থাকলে মোহ, জড়তা , উদাসীনতা দেখা যায়। তিনটি গুণের মধ্যে একটি ক্রিয়া করতে আরম্ভ করলে অন্যগুলো নিষ্ক্রিয় থাকে। আবার সত্ত্বগুণ স্বয়ং নিষ্ক্রিয় হলেও রজোগুণ সত্ত্বকে ক্রিয়াশীল করে। কিন্তু তমোগুণ সত্ত্বের ক্রিয়াশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে তিনটি গুণ কখনোই পরস্পরকে ছেড়ে থাকে না। এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সহযোগিতার পারস্পরিক সহঅবস্থানই দেখা যায়। সাংখ্যমতে গুণত্রয় নিয়ত পরিণামশীল। তবে পরিণামশীল হলেও গুণত্রয় নিত্য ও সকল বস্তুর মৌলিক উপাদান বিশেষ। তারা সকল বস্তুর উৎপত্তির বা পরিণামের কারণ হলেও তাদের নিজেদের উৎপত্তি বা বিনাশ নেই।

সাংখ্যের পুরুষতত্ত্ব

পুরুষ

সাংখ্যদর্শনে স্বীকৃত পঞ্চবিংশতি বা পঁচিশ তত্ত্বকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা– প্রকৃতি, বিকৃতি, প্রকৃতি–বিকৃতি এবং প্রকৃতিও নয় বিকৃতিও নয়। এর মধ্যে সাংখ্যদর্শনের পুরুষ হলো চতুর্থপ্রকার তত্ত্ব। প্রকৃতি অর্থ কারণ, বিকৃতি অর্থ কার্য। সাংখ্যমতে পুরুষ কারণও নয়, কার্যও নয়। পরিণামী প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও পরিবর্তনের নেপথ্যে পুরুষ হলো এক অপরিণামী অপরিবর্তনীয় সত্তা। পুরুষ প্রকৃতির পরিপূরক। তাই সাংখ্য দর্শনে পুরুষকে নেতিবাচক ভাবে দেখানো হয়েছে। প্রকৃতিতে যার অভাব, তাই পুরুষে বর্তমান। আবার বিপরীতভাবে প্রকৃতি যে সকল ধর্মবিশিষ্ট, তার কোন কোন ধর্মের অভাবাধিষ্ঠানই হলো পুরুষ।

প্রকৃতি বৈচিত্র্যের বীজরূপ হলেও তা একটি বিশেষ ধর্মবর্জিত। এই ধর্মটি হলো চৈতন্য। বিপরীতক্রমে ঐ চৈতন্যধর্মই পুরুষের স্বরূপধর্ম। ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতো সাংখ্যের পুরুষ কেবল চৈতন্যগুণসম্পন্ন দ্রব্য নয় এবং চৈতন্য পুরুষের আগন্তুক গুণ নয়। সাংখ্যমতে পুরুষ চৈতন্যময়। এদিক থেকে সাংখ্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায়ের মতৈক্য পরিলক্ষিত হয়। অদ্বৈতবেদান্তে পুরুষকে চিন্ময়সত্তা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে বেদান্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাংখ্য সম্প্রদায়ের পার্থক্য হলো, সাংখ্য সম্প্রদায় যেখানে পুরুষকে চিন্ময় বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন, সেখানে অদ্বৈতবেদান্ত সম্প্রদায় চিন্ময় পুরুষকে সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ (সচ্চিদানন্দ) বলে উল্লেখ করেছেন।

অন্যান্য সম্প্রদায়ের আত্মতত্ত্বের বিরোধিতা করে সাংখ্য সম্প্রদায় নিত্য কালত্রয়–অবাধিত, নিত্যশুদ্ধ, নিত্যবুদ্ধ, নিত্যমুক্ত, পাপপুণ্যহীন স্বসম্মত পুরুষতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। অন্যান্য দর্শনশাস্ত্রে যাকে সাধারণত আত্মা শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়, তাকেই সাংখ্যদর্শনে পুরুষ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়েছে। সাংখ্যকারিকার একাদশকারিকায় সাংখ্যের প্রকৃতি বা প্রধান থেকে পুরুষের ভেদ প্রতিপাদিত হয়েছে–”ব্যক্ত–এর ধর্ম হলো ত্রিগুণত্ব, অবিবেকিত্ব, বিষয়ত্ব, সামান্যত্ব, অচেতনত্ব, প্রসবধর্মিত্ব। অব্যক্ত বা প্রকৃতিও সেইরূপ। কিন্তু এই গুণগুলোর কোনটিই জ্ঞ বা পুরুষে থাকে না। পুরুষ হলো ব্যক্ত ও অব্যক্তের বিপরীত।” (সাংখ্যকারিকা–১১)। অতএব, পুরুষ হলো অত্রিগুণ, বিবেকী, অ–বিষয়, অ–সামান্য, চেতন, অ–প্রসবধর্মী। অর্থাৎ, পুরুষ নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত স্বভাব। পুরুষের বন্ধনও নেই, মোক্ষও হয় না। অত্রিগুণত্ব, বিবেকীত্ব, অবিষয়ত্ব, অসাধারণত্ব, চেতনত্ব এবং অপ্রসবধর্মীত্ব এই ধর্মগুলোর মধ্যে চেতনত্ব এবং অবিষয়ত্বের দ্বারা পুরুষের সাক্ষীত্ব এবং দ্রষ্টৃত্ব সিদ্ধ হয়। কারণ চেতনই দ্রষ্টা হয়, অচেতন দ্রষ্টা হয় না। যাকে বিষয় দর্শন করানো হয়, সেই সাক্ষী হয়। অন্যে যাকে নিজ বিষয় প্রদর্শন করে, দর্শনের ব্যাপারে যার নিজের কোন সক্রিয়তা নেই, তাকেই সাক্ষী বলা হয়। পুরুষ চৈতন্যস্বরূপ বলে তার দেখবার বা জানবার শক্তি রয়েছে, কিন্তু তার ক্রিয়াশক্তি নেই। লোকে যেমন বাদী ও প্রতিবাদী উভয়ের বিবাদের বিষয় সাক্ষীকে দেখায়, অর্থাৎ সাক্ষীর নিকট উপস্থাপন করে, সেভাবেই প্রকৃতি যখন নিজ রূপকে পুরুষের সম্মুখে উপস্থাপন করে, তখন পুরুষ সেইরূপ প্রকৃতিকে দর্শন করে মাত্র।

অত্রৈগুণ্যের জন্য পুরুষের কৈবল্য সিদ্ধ হয়। দুঃখত্রয়ের ঐকান্তিক ও আত্যন্তিক অভাবই কৈবল্য। এই কৈবল্য পুরুষের স্বাভাবিক ধর্ম। অত্রৈগুণ্য বা সুখদুঃখমোহ–রহিত বলে কৈবল্য পুরুষের অনায়াস–সিদ্ধ। এই অত্রৈগুণ্য থাকায় পুরুষ মধ্যস্থ অর্থাৎ নিরপেক্ষ। কারণ সুখী ব্যক্তি সুখের দ্বারা তৃপ্তি লাভ করে বলে এবং দুঃখী ব্যক্তি দুঃখের প্রতি দ্বেষ করে বলে মধ্যস্থ হতে পারে না। এই উভয় রহিত অর্থাৎ সুখদুঃখরহিত যে, তাকেই মধ্যস্থ বা উদাসীন বলা হয়। ফলে প্রকৃতির রূপ দর্শনে পুরুষ সাক্ষী হলেও স্বভাবতই পুরুষ উদাসীন। আর বিবেকীত্ব এবং অপ্রসবধর্মীত্ব থেকে পুরুষ যে অকর্তা– এটা সিদ্ধ হয়। তাই সাংখ্যকারিকার উনবিংশ কারিকায় বলা হয়েছে–”সেই (ব্যক্ত ও অব্যক্তের) বিপর্যয় ও বৈপরীত্য–বশত এই পুরুষের উদাসীন নির্লিপ্তভাব, দ্রষ্টার ভাব, কেবল একাকীত্বের (শুদ্ধ–চৈতন্যের) ভাব, মধ্যস্থের ভাব এবং অকর্তাভাব সিদ্ধ হয়।” (সাংখ্যকারিকা–১৯)। উল্লেখ্য, প্রমাণের দ্বারা কর্তব্য বিষয় জেনে ‘চেতন আমি এটা করতে চাই বলে করছি’– এভাবে চেতনার একত্র অবস্থান সবাই অনুভব করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সাংখ্যমতে তা সম্ভব হয় না। কারণ চেতন পুরুষ কর্তা নয় এবং কর্তা বুদ্ধিও চেতন নয়। এজন্যেই সাংখ্যকারিকার বিংশতি কারিকায় বলা হয়েছে–”সেইহেতু, পুরুষের সংযোগবশত অচেতন মহদাদি চেতনার মতো মনে হয় এবং ত্রিগুণের কর্ত্তৃত্ববশত উদাসীন পুরুষ কর্তার মতো প্রতিভাত হন।” (সাংখ্যকারিকা–২০)।

সাংখ্যমতে আবার পুরুষ সর্বব্যাপী ও সংখ্যায় বহু। অবিবেকবশত পুরুষ বদ্ধাবস্থাপ্রাপ্ত হয়। বদ্ধ পুরুষকে তাই একভাবে অবিবেকী বলা যায়। পুরুষের অবিবেক বিনাশ্য এবং তা বিনাশের মাধ্যমে পুরুষ মোক্ষ বা কৈবল্য লাভ করে। সাংখ্যকারিকার একবিংশ কারিকায় বলা হয়েছে–”পুরুষের মুক্তির জন্য এবং প্রধানের (তথা মূল প্রকৃতির) ভোগের জন্য পঙ্গু ও অন্ধের মতো উভয়ের (অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ হয়। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগবশত মহদাদি ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়।” (সাংখ্যকারিকা–২১)। সাংখ্যমতে সম্ভবত এখানেই জগৎসৃষ্টির মূল কারণটি লুকিয়ে আছে। স্বভাবসুলভ নিত্য মুক্ত উদাসীন দ্রষ্টা পুরুষের এই সংযোগ আপাতদৃষ্টে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। তাই এ কারিকাটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাচস্পতি মিশ্র তার ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ টীকাগ্রন্থে বলেন–”(প্রকৃতির সঙ্গে) পুরুষের (সংযোগের) অপেক্ষার (পক্ষে) যুক্তি দেখানো হয়েছে, ‘পুরুষের কৈবল্যের জন্য’ ইত্যাদি। প্রধানের সঙ্গে মিলিত হয়ে পুরুষ প্রধানের ধর্ম দুঃখত্রয়কে নিজের বলে মনে করে সেই দুঃখত্রয় থেকে মুক্তি প্রার্থনা করে। সেই কৈবল্য বুদ্ধি ও পুরুষের অন্যথাখ্যাতি (বা বিভেদজ্ঞান) থেকে হয়। বুদ্ধি ও পুরুষের অন্যথাখ্যাতি প্রধান ছাড়া হয় না। (অতএব) কৈবল্যের জন্য পুরুষ প্রধানকে অপেক্ষা করে। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ–পরম্পরা অনাদি বলে (পুরুষ) ভোগের জন্য (প্রকৃতির সঙ্গে) সংযুক্ত হয়েও কৈবল্যের জন্য পুনরায় সংযুক্ত হয়– এটাই যুক্তিযুক্ত।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)।

পুরুষের অস্তিত্বসিদ্ধি বা পুরুষের অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ

সাংখ্যাচার্যরা পুরুষের অস্তিত্ব বিষয়ে অনেক হেতুযুক্ত অনুমান প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। সাংখ্যমতে প্রমাণ ত্রিবিধ– প্রত্যক্ষ, অনুমান শব্দ বা আগম প্রমাণ। প্রশ্ন হলো, অনুমান ছাড়াও পুরুষ কি প্রত্যক্ষ ও শব্দ প্রমাণের দ্বারাও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে সাংখ্যাচার্যদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ ঘটতে দেখা যায়। পুরুষের অস্তিত্ববিষয়ে অনেক শ্রুতিবাক্য রয়েছে। তাই পুরুষের অস্তিত্ব বিষয়ে শব্দ বা আগম প্রমাণ নিয়ে বিশেষ বিচার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু প্রত্যক্ষ বিষয়ে অনেক সাংখ্যাচার্য ভিন্নমত পোষণ করেছেন। অজ্ঞাত রচয়িতা যুক্তিদীপিকাকার পুরুষ প্রত্যক্ষসিদ্ধ নয় বলে মনে করেন। কিন্তু সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বিজ্ঞানভিক্ষু পুরুষকে প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলে মনে করেন। ব্যাস–ভাষ্যে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষের আলম্বনরূপে পুরুষ প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলে গৃহীত হয়। তবে পুরুষ প্রত্যক্ষসিদ্ধ হোক বা না–হোক, তা যে অনুমানসিদ্ধ হতে পারে, সে বিষয়ে সকলেই একমত। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থসিদ্ধির ব্যাপারে অনুমানই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। তাই সাংখ্যাচার্যরা প্রধানত অনুমান বা যুক্তির সাহায্যেই পুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণে প্রয়াসী হয়েছেন। গুণযুক্ত পরিণামী জড়বস্তুই সাধারণ জীবের প্রত্যক্ষের বিষয়। ত্রিগুণাত্মক জড়বস্তুকে পক্ষ করে বিভিন্ন হেতুর সাহায্যে জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তারূপ চেতন পুরুষের অস্তিত্ব অনুমিত হতে পারে। সাংখ্যসূত্রকার মহর্ষি কপিল বলেছেন–”আত্মার নাস্তিত্ব সাধক প্রমাণ না থাকায় আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না।” কারণ, আত্মার অস্তিত্ব নিষেধ করতে সচেষ্ট হলে সেই নিষেধের কর্তা ও কর্মরূপে আত্মার অস্তিত্বই সিদ্ধ হয়। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ তার সপ্তদশ কারিকায় পঞ্চবিধ হেতুর সাহায্যে সাংখ্যসম্মত চৈতন্যস্বরূপ পুরুষের অস্তিত্ব প্রমাণের অভিপ্রায়ে বলেছেন–”সংঘাতবস্তু অপরের প্রয়োজন সাধন করে থাকে, ত্রিগুণ ইত্যাদির বিপরীত কেউ আছে, কোন চেতন অধিষ্ঠাতা ছাড়া জড়বর্গ চলতে পারে না, রূপরসাদি ভোগ্যবস্তুর ভোক্তা আছে, এবং কেবল বা শুদ্ধ আত্মার ভাব কৈবল্য বা মোক্ষ লাভের জন্য চেষ্টা আছে বলে পুরুষ আছেন– এটাই প্রমাণিত হয়।” (সাংখ্যকারিকা–১৭)। পুরুষের অস্তিত্ব সাধক হিসেবে কারিকাটিতে যে পাঁচটি হেতু বা যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো হলো–(১) সংঘাত পরার্থত্বাৎ, অর্থাৎ সংঘাত বস্তু অপরের প্রয়োজনসাধক হেতু, (২) ত্রিগুণাদিবিপর্যয়াৎ, অর্থাৎ ত্রিগুণাদি বস্তুর বৈপরীত্য হেতু, (৩) অধিষ্ঠানাৎ, অর্থাৎ জড়বস্তুর অধিষ্ঠান হেতু, (৪) পুরুষোহস্তি ভোক্তৃভাবাৎ, অর্থাৎ ভোগ্যবস্তুর ভোক্তা হেতু, (৫) কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ, অর্থাৎ বন্ধন হতে মুক্তিলাভের বা কৈবল্যের প্রচেষ্টা হেতু। আশঙ্কা হতে পারে যে, যারা পুরুষের অর্থাৎ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকারই করেন তাদের কাছে পুরুষের অস্তিত্ব সাধক অনুমান সিদ্ধসাধন দোষদুষ্ট হবে। কারণ প্রতিবাদী যা স্বীকার করেন বাদী যদি অনুমানের দ্বারা তারই সিদ্ধি করেন, তাহলে সিদ্ধসাধন দোষ হয়। এই আশঙ্কার উত্তরে বলা যে, উক্ত হেতুগুলোর দ্বারা কেবল পুরুষের অস্তিত্ব সিদ্ধ করা হয়নি, কিন্তু অব্যক্ত ইত্যাদি থেকে অতিরিক্ত পুরুষের অস্তিত্বই উক্ত হেতুগুলোর দ্বারা সিদ্ধ করা হয়।

প্রথম হেতু: (সংঘাত পরার্থত্বাৎ)– সাংখ্যকারিকা অনুসারে পুরুষের অস্তিত্বসাধক প্রথম অনুমানটি হবে, পুরুষ অস্তিত্বশীল যেহেতু সংঘাতমাত্রই অন্যের প্রয়োজন সিদ্ধ করে। যে পদার্থ মিলিতভাবে কার্য করে তাকেই সংঘাত বলা হয়। জড় পদার্থমাত্রই অন্যের সঙ্গে মিলিত হয়ে কার্য করে, এইজন্য জড়পদার্থমাত্রকে সংঘাত বলা হয়েছে। এই অনুমানে পুরুষ পক্ষ, অস্তিত্ব সাধ্য এবং সংঘাতপরার্থত্ব হলো হেতু। আশঙ্কা হতে পারে যে, উক্ত অনুমানটি স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস দোষে দুষ্ট। কারণ পক্ষে হেতু না থাকলে স্বরূপাসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়। এক্ষেত্রে পক্ষ পুরুষে সংঘাত পরার্থত্ব হেতু না থাকায় স্বরূপাসিদ্ধি দোষ হয়। এই স্বরূপাসিদ্ধি দোষ পরিহারের জন্য সাংখ্যকারিকার টীকা সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী গ্রন্থে অনুমানটি বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। অনুমানটি এইরূপ– অব্যক্ত মহৎ প্রভৃতি পরার্থ, যেহেতু তারা সংঘাত, যেমন শয্যা, বস্ত্র, আসন, ঘট, পট প্রভৃতি। যেখানে যেখানে সংঘাতত্ব, সেখানে সেখানে পরার্থত্ব– এটিই উক্ত অনুমানের ব্যাপ্তি। অর্থাৎ, যে সকল বস্তু সংঘাত তারা অপরের প্রয়োজন সাধন করে। শয্যা, আসন, ঘট, পট প্রভৃতি সংঘাত পদার্থ অচেতন এবং এরা সর্বদা অপরের প্রয়োজনই সিদ্ধ করে। প্রকৃতি এবং তার পরিণামজাত সকল পদার্থই সংঘাত বা সংহত বা মিলিত। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সমাহারই হলো প্রকৃতি। এই সংঘাতপদার্থ কোন চেতন সত্তার প্রয়োজনেই সংঘাত বা উপাদানের দ্বারা উৎপন্ন হয়ে থাকে। এই সকল সংঘাত যার প্রয়োজন সিদ্ধ করে, সেই সংঘাতভিন্ন চেতন সত্তাই পুরুষ। এই যুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি হতে পারে যে, উক্ত অনুমান অর্থান্তরতা দোষে দুষ্ট। কারণ যে সাধ্যের সাধনে অনুমানটি প্রযুক্ত হয়, ঐ অনুমানটি যদি সেই সাধ্যের সাধন না করে অন্য সাধ্যের সাধন করে, তাহলে অর্থান্তরতা দোষ হয়। আমরা বার বার প্রত্যক্ষ করে থাকি যে, একটা সংঘাত অপর সংঘাতেরই প্রয়োজন সিদ্ধি করে, আত্মা বা পুরুষের প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে না। আত্মার নিদ্রা, বসা প্রভৃতি যদি প্রয়োজন হতো, তাহলে শয্যা, আসন প্রভৃতি আত্মার প্রয়োজন সিদ্ধি করতে পারতো। কিন্তু নিদ্রা, বসা প্রভৃতি শরীরের প্রয়োজন। শয্যা, আসন প্রভৃতি সেই প্রয়োজনই সিদ্ধ করে। সুতরাং, সংঘাতরূপ পদার্থ পরার্থ হলেও সেই অপর সংঘাত বিশেষই হয়। অর্থাৎ একটি সংঘাতপদার্থ অপর একটি সংঘাতপদার্থের প্রয়োজন সাধন করতে পারে, এর জন্য সংঘাত–অতিরিক্ত কোন চেতন সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। এই আপত্তি খণ্ডনের উদ্দেশ্যেই সাংখ্যকারিকাকার এই দ্বিতীয় হেতুটি বলেছেন।

দ্বিতীয় হেতু: (ত্রিগুণাদিবিপর্যয়াৎ)–প্রথম হেতুর উল্লিখিত আপত্তি খণ্ডনের উদ্দেশ্যেই সাংখ্যকারিকাকার এই দ্বিতীয় হেতুটি বলেছেন। যদি এরূপ কথা স্বীকার করা হয় যে, একটি সংঘাতপদার্থ অপর একটি সংঘাতপদার্থেরই প্রয়োজন সাধন করে, তাহলে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, ঐ দ্বিতীয় সংঘাতপদার্থ পুনরায় অন্য কোন সংঘাতপদার্থের প্রয়োজন সাধন করে। কিন্তু এরূপ বলা হলে সংঘাত–পরম্পরায় শেষ পর্যন্ত অনবস্থা দোষ দেখা দিতে বাধ্য। সুতরাং এই অনবস্থাদোষ পরিহারের জন্য আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, যে সত্তার প্রয়োজন প্রকৃতিজাত তত্ত্বের দ্বারা সাধিত হচ্ছে, সেই সত্তা স্বরূপত সংঘাতপদার্থ থেকে ভিন্ন। ‘বিপর্যয়’ শব্দের অর্থ অভাব। সংঘাতপদার্থ ত্রিগুণাত্মক। অতএব ত্রিগুণাদিবিপর্যয় বলতে ত্রিগুণের অভাব বা ত্রিগুণশূন্যতা বুঝতে হবে। সংঘাতপদার্থ যার প্রয়োজন সাধন করে, সেই পুরুষসত্তা অ–ত্রিগুণাত্মক। আবার একই যুক্তিতে ত্রিগুণাত্মক বস্তু জড় ও অপ্রকাশস্বভাব হওয়ায় পুরুষকে চেতন ও প্রকাশস্বভাব বলে স্বীকার করতে হয়।

তৃতীয় হেতু: (অধিষ্ঠানাৎ)– ত্রিগুণাত্মক বস্তুমাত্রই কোন একজন নিয়ামকের অপেক্ষা রাখে। জড় পদার্থের অনন্ত পরিণামের ব্যাখ্যার জন্য অধিষ্ঠান হিসাবে পুরুষ স্বীকার্য। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই গুণ তিনটি জড়। জড় কখনও স্বয়ং ক্রিয়াশীল হতে পারে না। সুতরাং, ঐ সকল জড় পদার্থের অধিষ্ঠানরূপে পুরুষের অস্তিত্ব স্বীকার কার প্রয়োজন। পুরুষ অধিষ্ঠাতা না হলে জড়পদার্থগুলোর ঐরূপ পরিণাম নিয়মিতভাবে কখনোই হতো না। এখানে অধিষ্ঠাতা বলতে প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধ বিশেষই বোঝায়। কিন্তু পুরুষ, প্রকৃতি প্রভৃতি ঐরূপ পরিণামের কর্তা নয়। পুরুষের সান্নিধ্য বা সম্বন্ধই প্রকৃতি প্রভৃতির পরিণামের হেতু। যেভাবে চালকের বা ঘোড়ার সান্নিধ্যবশত রথ চলে, সেভাবেই পুরুষের সান্নিধ্যবশত প্রকৃতি প্রভৃতির পরিণাম হয়। অতএব প্রকৃতি এবং প্রকৃতির পরিণামরূপ যাবতীয় বস্তুর নিয়ামকরূপে চেতন পুরুষের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। অচেতন ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি চেতন পুরুষের সান্নিধ্য ব্যতীত বিশ্বসৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতি যে বিশ্বসৃষ্টিতে সক্রিয়, তা সিদ্ধ। অতএব প্রকৃতির অধিষ্ঠানরূপে চেতন পুরুষ স্বীকার করতেই হবে।

চতুর্থ হেতু: (পুরুষোহস্তি ভোক্তৃভাবাৎ)– সুখ, দুঃখ ও বিষাদ কোন না কোন কর্তার দ্বারা উপলব্ধ হয়ে থাকে। যে কোন অভিজ্ঞতাই কোন এক কর্তার অভিজ্ঞতা। কর্তাকে বাদ দিয়ে কোন অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করা যায় না। জাগতিক বস্তুর অভিজ্ঞতা প্রকৃতি বা প্রকৃতির পরিণামী কোন বস্তুর দ্বারা হতে পারে না। কারণ, ব্যক্ত ও অব্যক্ত অর্থাৎ প্রকৃতি ও তার পরিণামী সকল বস্তুই জড় ও অচেতন। অব্যক্ত ও ব্যক্ত সুখদুঃখমোহস্বরূপ হওয়ায় অচেতন। এইজন্য ব্যক্ত অব্যক্তকে ভোগ করতে পারে না এবং অব্যক্ত ব্যক্তকে ভোগ করতে পারে না। অতএব একজন ভোক্তার অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন। বস্তুর ভোগ করার ক্ষমতা নেই, অতএব সুখ, দুঃখ ও বিষাদের অনুভূতি কোন এক চেতন সত্তারই হয়ে থাকে। যে চেতন সত্তার সুখ–দুঃখাদি ভোগ হয়, সেই চেতন সত্তাই হলো পুরুষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘ভোগ’ শব্দটি সাংখ্য দর্শনে ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বস্তুজগৎ সম্বন্ধে চেতন সত্তার সর্ববিধ অভিজ্ঞতাই ‘ভোগ’ শব্দের দ্বারা বোঝায়। এই অর্থে পুরুষ শুধু সুখ–দুঃখাদির ভোক্তা নন, পুরুষ প্রকৃতিভূত যাবতীয় বস্তুর ভোক্তা, দ্রষ্টা ও জ্ঞাতা। অপরদিকে প্রকৃতিজাত যাবতীয় পদার্থই ভোগ্য, দৃশ্য ও জ্ঞেয়। আশঙ্কা হতে পারে যে, পুরুষের অস্তিত্ব সিদ্ধ হওয়ার আগে ভোক্তৃত্ব ধর্ম পুরুষের অস্তিত্বে হেতু হবে কীভাবে? উত্তরে বলা হয়, ভোক্তৃভাব পদের দ্বারা ভোগ্য সুখদুঃখকে বোঝানো হয়েছে। ভোগ্যরূপ সুখদুঃখকে প্রত্যেক আত্মা অনুভব করে থাকে। সুখ অনুকুল বেদনীয় এবং দুঃখ প্রতিকুলবেদনীয়। সুখদুঃখ যেহেতু ভোগ্য সেহেতু ঐগুলোর অতিরিক্ত এক ভোক্তা স্বীকার করা প্রয়োজন। ভোগ্য কখনও ভোক্তা হতে পারে না। সুতরাং যিনি ভোক্তা হবেন, তাকে সুখ দুঃখ মোহস্বরূপ বস্তু থেকে অতিরিক্ত বলতে হবে। ঐ ভোক্তাই পুরুষ। এখানে আশঙ্কা হতে পারে, সুখদুঃখ অনুকূল বেদনীয় এবং প্রতিকূল বেদনীয় হওয়ায় মহৎতত্ত্ব প্রভৃতিই ঐ সুখদুঃখের ভোক্ত হোক। সুতরাং, তার অতিরিক্ত পুরুষ স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। এই আশঙ্কার উত্তরে বলা হয়, অতিরিক্ত পুরুষ স্বীকার করা না হলে এক্ষেত্রে কর্তৃকর্মবিরোধ উপস্থিত হবে। কর্তৃত্ব ও কর্মত্ব একই অধিকরণ বা আশ্রয়ে থাকতে পারে না। সুখ–দুঃখ মোহস্বরূপ বুদ্ধি প্রভৃতি ভোগকর্মত্বরূপ ভোগ্যত্ব এবং ভোগকর্তৃত্বরূপ ভোক্তৃত্বের আশ্রয় হতে পারে না। সুতরাং সুখদুঃখের ভোগ্যত্বের জন্য যে ভোক্তার অস্তিত্ব অবশ্যস্বীকার্য, সেই ভোক্তাই পুরুষ। প্রসঙ্গত, পুরুষ ভোক্তা কী না তা বিচার করা প্রয়োজন। আপাতদৃষ্টিতে সাংখ্যের পুরুষকে ভোক্তা বলা যায় না। কারণ ভোক্তৃত্ব কর্তৃত্বসাপেক্ষ। সাংখ্যমতে পুরুষ কর্তা হতে পারে না যেহেতু পুরুষ নিষ্ক্রিয়। আবার প্রকৃতির ভোক্তৃত্বও স্বীকার করা যায় না, কারণ প্রকৃতি হলো অচেতন। কেবলমাত্র চেতনেরই ভোগ ও অপবর্গ সম্ভব, অচেতনের ভোগ ও অপবর্গ সম্ভব নয়। এই কারণে বলা যায় পুরুষের ভোক্তৃত্ব স্বীকার্য। সাংখ্যকারিকার টীকাকার বাচস্পতি মিশ্র তার সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদীতে পুরুষের এই ভোগকে স্বাভাবিক না বলে ঔপচারিক বা আরোপিত বলেছেন। তার মতে পুরুষ স্বভাবতই মুক্ত। প্রকৃত ভোগ বুদ্ধি বা অন্তঃকরণের। বুদ্ধি সঙ্গে পুরুষের অভেদ প্রতীতিবশত বুদ্ধির ভোগ পুরুষের বলে প্রতিভাত হয়। পুরুষ স্বরূপত উদাসীন। প্রশ্ন হতে পারে, ভোক্তৃত্ব প্রকৃতিতে অথবা মহতে না থাকায় আরোপিত হবে কীভাবে? উত্তরে বলা হয়, মহৎ ও পুরুষের অনাদি অবিবেকবশতই পুরুষে ভোক্তৃত্বের প্রকাশ হয়ে থাকে। বিবেকের অগ্রহ বা অজ্ঞানই অবিবেক। অবিবেকের ফলেই ভোক্তৃত্ব আরোপিত হয়ে থাকে।

পঞ্চম হেতু: (কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ)– সাংখ্যমতে, কৈবল্য বা মোক্ষের জন্য প্রবৃত্তি হওয়ায় পুরুষের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। শাস্ত্রসমূহকে অভ্রান্ত বলা হয়। শাস্ত্রে দুঃখনিবৃত্তির উপায়ের নির্দেশ আছে। সমাধি–প্রজ্ঞালব্ধ সত্যদ্রষ্টা করুণাপরায়ণ ঋষিরা দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে জেনেছিলেন যে, দুঃখ–নিবৃত্তির দ্বারাই দুঃখ–জর্জরিত জীবের পরম কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এই কারণেই তারা মোক্ষ বা কৈবল্যের উপদেশ দিয়েছেন। কৈবল্য শব্দের অর্থ আত্যন্তিক দুঃখত্রয়ের উপশম। এই কৈবল্য প্রকৃতি বা প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত কোন বস্তুর হতে পারে না। প্রকৃতি তথা প্রকৃতিজাত বস্তু ত্রিগুণাত্মক হওয়ায় তাদের দুঃখ থেকে চিরনিবৃত্তি কখনোই সম্ভব নয়। সাংখ্যদর্শনে তিন রকম দুঃখের কথা বলা হয়েছে– আদিদৈবিক, আদিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক। পুরুষ নামক তত্ত্ব স্বীকার করা না হলে কৈবল্যের প্রবৃত্তি হতে পারে না। কারণ ঐরূপ প্রবৃত্তি মহৎ ইত্যাদির দ্বারা সম্ভব নয়, যেহেতু মহৎ প্রভৃতি পদার্থ হলো দুঃখাদিস্বরূপ। দুঃখ যদি মহৎ প্রভৃতির স্বরূপগত হয় তাহলে দুঃখের আত্যন্তিক উপশম বা নিবৃত্তি কখনোই সম্ভব হয় না। কারণ দুঃখস্বরূপ পদার্থকে দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। মহৎ প্রভৃতিকে দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে মহৎ প্রভৃতির নাশ স্বীকার করতে হবে। এই কারণে, যেহেতু কৈবল্য বা মুক্তির প্রবৃত্তি হয়, সেহেতু মহৎ ইত্যাদির অতিরিক্ত অ–দুঃখাত্মক পুরুষ অবশ্যস্বীকার্য। সুতরাং সাংখ্যশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হলো, শাস্ত্রের ও মহর্ষিদের কৈবল্যের প্রবৃত্তির জন্য মহৎ প্রভৃতি থেকে অতিরিক্ত পুরুষ বা আত্মা আছে।

বস্তুত উপরিউক্ত পঞ্চবিধ হেতুর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ভোগ ও অপবর্গের তাৎপর্য প্রকৃতি তথা প্রকৃতিজাত কোন বস্তুর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ভোগ ও অপবর্গের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হলে প্রকৃতির অতিরিক্ত চেতন সত্তা স্বীকার করা প্রয়োজন। এইরূপ চেতন সত্তাই সাংখ্য দর্শনে ‘পুরুষ’ বলে অভিহিত হয়েছে।

সাংখ্যসম্মত বহুপুরুষতত্ত্ব বা পুরুষের বহুত্ব

পুরুষের অস্তিত্ব প্রতিপাদনের পর প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, পুরুষ কি সকল শরীরে এক না শরীর ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে? সাংখ্যমতে পুরুষ বহু। পুরুষ স্বভাবত সর্বব্যাপি হলেও শরীরবিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। একটি ঘরে শত দীপ একসঙ্গে জ্বললেও তারা যেমন পরস্পরের অবিরোধে অবস্থান করে অর্থাৎ কেউ কারোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না, তেমনি জীবভাবাপন্ন অনেক পুরুষ পরস্পরের অবিরোধে অবস্থান করতে পারে। একটি দীপ প্রজ্বলিত করা হলে বা নির্বাপিত হলে অন্যান্য দীপ যেমন তার সাথে প্রজ্বলিত হয় না বা নির্বাপিত হয় না, তেমনি একটি পুরুষের বন্ধনে বা মুক্তিতে অপর পুরুষের বন্ধন বা মুক্তি হয় না। পুরুষ প্রতি শরীরের ভিন্ন হওয়ায় একটি পুরুষের সুখ–দুঃখ, শোক–সন্তাপ, জন্ম–মরণ প্রভৃতি ভোগ অন্য পুরুষের সুখ–দুঃখ, শোক–সন্তাপ, জন্ম–মরণ ভোগের সহায়ক বা ব্যাঘাত্মক হয় না। এই বিষয়ে ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা প্রভৃতি সম্প্রদায় একমত। কেবলমাত্র বেদান্ত দর্শন এই মতের বিরোধী। বেদান্তমতে আত্মা বহু নয়। এই মতে একই আত্মা উপাধিযুক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জীবে পরিণত হয়। তাই এই মতে জীব অসংখ্য, কিন্তু আত্মা অসংখ্য নয়, এক। শরীর ভেদে পুরুষের বহুত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ তার অষ্টাদশ কারিকায় বলেন–”জন্ম–মরণ ও ইন্দ্রিয়সমূহের পৃথক পৃথক অস্তিত্বের জন্য, পৃথক পৃথক ভাবে অন্তঃকরণের চেষ্টা বা যত্নের জন্য এবং ত্রিগুণের বিশেষ বা তারতম্যবশত পুরুষের বহুত্ব সিদ্ধ হয়।” (সাংখ্যকারিকা–১৮)। কারিকাটিতে পুরুষের বহুত্ব স্বীকারের পক্ষে তিনটি যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে–(১) জননমরণকরণানাং প্রতিনিয়মাৎ, অর্থাৎ জন্ম মৃত্যু ও ইন্দ্রিয়াদি করণের প্রতিনিয়ম হেতু, (২) অযুগপৎ প্রবৃত্তেশ্চ, অর্থাৎ অযুগপৎ প্রবৃত্তি হেতু, (৩) ত্রৈগুণ্যবিপর্যয়াৎ, অর্থাৎ ত্রিবিধ গুণের তারতম্য হেতু।

প্রথম হেতু: (জননমরণকরণানাং প্রতিনিয়মাৎ)– এই যুক্তি অনুসারে, প্রত্যেক পুরুষের জন্ম, মৃত্যু এবং অন্তকরণ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় পুরুষের বহুত্ব অবশ্যস্বীকার্য। পুরুষ বহু। পুরুষ যদি এক হতো, তাহলে একজনের জন্ম বা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে অপর সকলের জন্ম বা মৃত্যু হতো। প্রতিটি জীবের জন্ম, মৃত্যু এবং অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ বিশেষ বিশেষ প্রকারের হয়ে থাকে। একজনের অঙ্গহানি হলে অর্থাৎ কোন একজন মূক, বধির বা অন্ধ হলে অপর সকলেই যে মূক, বধির বা অন্ধ হবে, তাও নয়। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন প্রকারের জন্ম, মৃত্যু ও করণের জন্য তাই বহু পুরুষ স্বীকার করতে হয়। আশঙ্কা হতে পারে যে, জন্ম শব্দের প্রচলিত অর্থ উৎপত্তি এবং মৃত্যু শব্দের প্রচলিত অর্থ বিনাশ। পুরুষ অনাদি, অনন্ত অর্থাৎ নিত্য। তার উৎপত্তি ও বিনাশ হতে পারে না। সুতরাং যেহেতু পুরুষ জন্ম প্রভৃতির অতীত, সেহেতু জন্ম–মৃত্যুকে পুরুষবহুত্বের হেতু বলা উচিত নয়। এই আশঙ্কার উত্তরে বলা হয়, এই স্থলে ‘জন্ম’ ও ‘মরণ’ শব্দের দ্বারা পুরুষের উৎপত্তি বা বিনাশকে বোঝানো হয়নি। পুরুষ অপরিণামী নিত্য। সুতরাং তার উৎপত্তিরূপ জন্ম বা বিনাশরূপ মৃত্যু হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে সাংখ্যকারিকার টীকাগ্রন্থ সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদীতে বাচস্পতি মিশ্র বলেন–”নিকায় বিশিষ্ট (অর্থাৎ মনুষ্যত্বাদি জাতি বিশিষ্ট) নতুন দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, অহংকার, বুদ্ধি ও সংস্কারের সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধকে জন্ম বলে। পুরুষের পরিণামরূপ জন্ম হয় না, তার অপরিণামিত্বের জন্য। এরূপ সম্বন্ধযুক্ত (অর্থাৎ নিকায়–বিশিষ্ট) উপাত্ত দেহাদির পরিত্যাগকে মৃত্যু বলে। আত্মার কিন্তু মৃত্যু হয় না, তার কুটস্থ–নিত্যত্ব স্বভাবের জন্য। বুদ্ধি ইত্যাদি ইন্দ্রিয় তেরোটি। জন্ম, মৃত্যু ও ইন্দ্রিয়গুলোর প্রত্যেকের পৃথক পৃথক ব্যবস্থা আছে। সকল শরীরে একই আত্মা স্বীকার করলে সেই ব্যবস্থা বা নিয়মের উপপত্তি হয় না।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)।

যখন দেহ, ইন্দ্রিয়, মন, অহংকার, বুদ্ধি ও বুদ্ধির পরিণামস্বরূপ জ্ঞান পরস্পর মিশ্রিতভাবে একক প্রয়োজন সাধক হয়, তখন তাকে বলা হয় নিকায়। ঐ নিকায় যদি নতুন হয়, তাহলে ঐ নিকায়কে বলা হয় অপূর্ব–নিকায়। এইরূপ অপূর্ব–নিকায়ের সঙ্গে অভিসম্বন্ধই হলো পুরুষের জন্ম। অভিসম্বন্ধ হলো অভিমানস্বরূপ সম্বন্ধ, সংযোগ সম্বন্ধ নয়। নিকায়ের সঙ্গে অভিসম্বন্ধবশত পুরুষে ভোক্তৃভাব আরোপিত হয়। নিকায়ের বহুত্বহেতু পুরুষেরও বহুত্ব সিদ্ধ হয়। জন্ম, মরণ ও করণসমূহের সঙ্গে প্রত্যেক পুরুষের নিয়মিত সম্বন্ধ বা ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থা পুরুষ এক হলে কখনোই সম্ভব হতে পারে না। একটিমাত্র পুরুষের ভোগ ও অপবর্গের পক্ষে একটি মাত্র নিকায়েই যথেষ্ট। তারপরও যদি একই পুরুষের সঙ্গে অনেক নিকায়ের সম্বন্ধ স্বীকার করা হয়, তাহলে একটি পুরুষের নিকায় পরিত্যাগে সকল নিকায়ের পরিত্যাগ স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ সকল শরীরে একই আত্মা স্বীকার করলে একজন জন্মালে সকলেই জন্মাবে, একজন মারা গেলে সকলেই মারা যাবে। একজন অন্ধ, কালা ইত্যাদি হলে সকলেই অন্ধ, কালা ইত্যাদি হবে এবং একজন উন্মাদ হলে সকলেই উন্মাদ হবে। এভাবে অব্যবস্থা হবে। এবং তা বাস্তব অভিজ্ঞতা–বিরোধী। অতএব স্বীকার করতে হবে পুরুষ বহু।

দ্বিতীয় হেতু: (অযুগপৎ প্রবৃত্তেশ্চ)– প্রতি শরীরে ভিন্ন ভিন্ন প্রবৃত্তি হওয়ায়, পুরুষও ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রবৃত্তি অর্থ হলো ক্রিয়াজনক প্রযত্ন। এই প্রযত্ন যুগপৎ সকল শরীরে একরূপ নয়। কোন বিষয়ের প্রতি পুরুষের প্রবৃত্তি বিভিন্ন প্রকার হয়। ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের যেমন ভিন্ন ভিন্ন প্রবৃত্তি হয়, তেমনি একই বিষয়ের প্রতি একই পুরুষের প্রবৃত্তিও কালভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। মোটকথা, পুরুষের প্রবৃত্তি বিচিত্র। পুরুষের বহুত্ব স্বীকার না করলে প্রবৃত্তির এই বৈচিত্র্য ব্যাখ্যা করা যায় না। অযুগপৎ প্রবৃত্তির জন্য প্রতিশরীরে পুরুষভেদ স্বীকার না করলে আত্মা একটা শরীরে প্রযত্নবান হলে (প্রযত্ন অন্তঃকরণের ধর্ম) সেটি সকল শরীরে প্রযত্নবান হবে। সকল শরীরে একই আত্মা স্বীকার করলে সেই পুরুষ একই সময়ে সকল শরীরকে চালিত করবে। কিন্তু এটা প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ হওয়ায় স্বীকার করা যায় না। সুতরাং, বহুপুরুষ অবশ্যস্বীকার্য। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, প্রবৃত্তিভেদবশত পুরুষের ভেদ কিরূপে সিদ্ধ হয়? এর উত্তরে বাচস্পতি মিশ্র বলেন–‘অন্তঃকরণের ধর্মরূপ প্রবৃত্তি পুরুষে আরোপিত হয়েই পুরুষের ভেদ সাধন করে।’–(সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)। সাংখ্যমতে প্রযত্ন অন্তঃকরণের ধর্ম। অবিবেকী বদ্ধপুরুষের সঙ্গে অন্তঃকরণের ভেদাগ্রহ থাকায় অন্তঃকরণস্থিত প্রযত্ন পুরুষে আরোপিত হয়। স্ব–স্বামিভাববশত অন্তকরণস্থিত প্রযত্নকে অন্তঃকরণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত পুরুষের প্রযত্ন বলা হয়। এরূপ প্রযত্ন সকল অন্তঃকরণে যুগপৎ হয় না। আবার পুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধহীন শরীরেও প্রবৃত্তি হয় না। সুতরাং স্বীকার করতে হয় যে, বিভিন্ন অন্তঃকরণের সঙ্গে বিভিন্ন পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন সম্বন্ধবশতই অযুগপৎ প্রবৃত্তি সম্ভব হয়।

তৃতীয় হেতু: (ত্রৈগুণ্যবিপর্যয়াৎ)– ত্রৈগুণ্য অর্থ হলো সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ– এই তিনটি গুণ। বিপর্যয় অর্থ হলো বৈচিত্র্য। অর্থাৎ গুণত্রয়ের নানাবিধ বৈচিত্র্যের জন্য পুরুষের বহুত্ব স্বীকার্য। ব্যবহারিক জীবনে যেমন আমরা সত্ত্বগুণের আধিক্যহেতু সাত্ত্বিক ব্যক্তিকে সুখী থাকতে দেখি, রজোগুণের আধিক্যহেতু রাজসিক ব্যক্তিকে অসুখী থাকতে দেখি, আবার তমোগুণের আধিক্যহেতু তামসিক ব্যক্তিকে মোহাচ্ছন্ন দেখি। এইভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন গুণের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। একেই ত্রিগুণের বিপর্যয় বলা হয়। সকল শরীরে যদি একই আত্মা বিরাজিত বলা হয়, তাহলে এইরূফ ভেদ–ব্যবহার উপপন্ন হয় না। আবার এ জগতে যখন কেউ জন্ম–যন্ত্রণা ভোগ করে, তখন অন্য কেউ বা মৃত্যু–যন্ত্রণা ভোগ করে। জন্ম–যন্ত্রণা ও মৃত্যু–যন্ত্রণা অত্যন্ত বিলক্ষণ। একই আত্মা বা পুরুষ একই ক্ষণে এইরূপ দুটি বিপরীত অনুভূতির ভোক্তা হতে পারে না। সুতরাং আমাদের স্বীকার করতে হয় যে, প্রতিটি শরীরে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষ বা আত্মা সুখ–দুঃখাদি ভোগ করে থাকে। সুতরাং পুরুষবহুত্ব অবশ্যস্বীকার্য। অষ্টাদশ কারিকায় তিনটি হেতু বা যুক্তির সাহায্যে পুরুষের বহুত্ব সিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সাংখ্যকারিকায় পুরুষ শব্দটি একবারও বহুবচন–এ ব্যবহার করা হয়নি। প্রশ্ন হতে পারে, পুরুষ যদি বহু হতো, সর্বদাই কেন ঐ শব্দটি একবচন–এ ব্যবহার করা হয়েছে? তাছাড়া পুরুষের বহুত্ব সিদ্ধি কী বেদ বা শ্রুতির অদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরোধী নয়? আস্তিক সাংখ্য কীভাবে শ্রুতি বিরোধী হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর সাংখ্যকারিকার টীকাকার বাচস্পতি মিশ্র দেননি। তবে ‘সাংখ্যপ্রবচনসূত্র’–এ এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে এই সূত্রে–‘সাংখ্য পুরুষ–বহুত্ব স্বীকার করলেও শ্রুতিবিরোধী নয়, কারণ সাংখ্যমতে পুরুষ ব্যক্তি হিসেবে বহু হলেও জাতি হিসেবে এক।’–(সাংখ্যপ্রবচনসূত্র)।

ঈশ্বরপ্রসঙ্গে সাংখ্যমত

সাংখ্যদর্শন ঈশ্বরবাদী নাকি নিরীশ্বরবাদী?

দার্শনিক মহলে মহর্ষি কপিল প্রবর্তিত সাংখ্য দর্শনকে নিরীশ্বর সাংখ্য এবং পতঞ্জলি প্রবর্তিত যোগ দর্শনকে সেশ্বর সাংখ্য বলা হয়। তবে এটি সর্বসম্মত মত নয়। কেননা, সাংখ্য দর্শন নিরীশ্বরবাদী কিনা, সে বিষয়ে সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। বলা হয়, প্রাচীন সাংখ্যাচার্যরা নিরীশ্বরবাদী এবং পরবর্তী সাংখ্যাচার্যরা ঈশ্বরবাদী। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে সাংখ্যপ্রবচনসূত্রে বলা হয়েছে–‘প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ।’–(সাংখ্যপ্রবচনসূত্র–১/৯২)। এক্ষেত্রে উক্ত সূত্রটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু তার সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বলেন–‘প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ’– এই উক্তি থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যে, সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর অস্বীকৃত হয়েছেন। বরং, এর দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হলেও কোন প্রমাণের দ্বারা তা সিদ্ধ বা প্রমাণ করা যায় না। এখানে উল্লেখ্য, ১৬শ শতকের ঈশ্বরবাদী সাংখ্য দার্শনিক বিজ্ঞানভিক্ষু তার সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যের ভূমিকায় বলেই দিয়েছিলেন যে, ‘সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যের গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কলামাত্রই অবশিষ্ট আছে;  আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।’ সাংখ্যের কলামাত্র অবশিষ্টকে অমৃতবাক্যের দ্বারা পূর্ণ করার ফলাফল সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়–এর প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিটিও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়। ‘…তার ফলে এ–দর্শন আর যাই হোক সাংখ্য–দর্শন থাকেনি– বেদান্তমতে বা অন্তত প্রায়–বেদান্তমতে পরিণত হয়েছিলো। কেননা,  নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর দর্শনে পরিণত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি;  শেষপর্যন্ত তিনি বেদান্তের সঙ্গে সাংখ্যের প্রায় সমস্ত মৌলিক প্রভেদই উড়িয়ে দেবার আয়োজন করেছিলেন।’–(দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা–২৩)।

নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর সাংখ্যে রূপায়ন–প্রচেষ্টা পরবর্তীকালের অন্যান্য ঈশ্বরবাদী ভাষ্যকারদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। যেমন সাংখ্যের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক তত্ত্ব পুরুষতত্ত্বে সাংখ্যকারিকা অনুযায়ীই পুরুষ–বহুত্ব স্বীকৃত হলেও সাংখ্যকারিকার অন্যতম ভাষ্যকার গৌড়পাদ তার গৌড়পাদভাষ্যে সংশ্লিষ্ট কারিকার ব্যাখ্যায় ঠিক বিপরীত মতই প্রস্তাব করেছেন যে (সূত্র– দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা–২৪) – ‘ব্যক্ত অনেক, অব্যক্ত এক, সেই প্রকার পুরুষও এক।’–(গৌড়পাদভাষ্য)। প্রাচীন আধ্যাত্মবাদী বা ব্রহ্মবাদী দার্শনিকদের কাছে সাংখ্য যে কেবল নিরীশ্বরবাদী দর্শনই ছিলো, সেটাই নয়, বেদ বা শ্রুতিবিরোধী দর্শন হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় ৮ম শতকের বিখ্যাত অদ্বৈত-বেদান্তবাদী দার্শনিক শংকরাচার্যও প্রাচীন আস্তিক মতের সমর্থনে সাংখ্যকে বেদমূলক দর্শন বলে স্বীকার করতে সম্মত হননি। প্রাচীন আস্তিক মতের প্রধান দার্শনিক উদ্যোক্তা হলেন ‘ব্রহ্মসূত্র’–প্রণেতা বাদরায়ণ। বাদরায়ণও সাংখ্য–দর্শনকে বেদান্ত–দর্শনের অর্থাৎ উপনিষদ বা শ্রুতি–প্রতিপাদ্য তত্ত্বের প্রধানতম প্রতিপক্ষ বলেই গ্রহণ করেছিলেন। ‘সাংখ্য–গণিতের একটি সরল হিসেব থেকেই এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। ব্রহ্মসূত্রে মোট ৫৫৫টি সূত্র আছে। তার মধ্যে অন্তত ৬০টি সূত্র প্রধানতই সাংখ্য–খণ্ডন উদ্দেশ্যে রচিত। তুলনায় বাকি সব বিরুদ্ধ মত খণ্ডনের উদ্দেশ্যে বাদরায়ণ মোট ৪৩টি সূত্র রচনা করেছেন ; তার মধ্যে জৈনমত খণ্ডনে মোট ৪টি সূত্র। এবং সমস্ত রকম বৌদ্ধমত খণ্ডনে মোট ১৫টি সূত্র দেখা যায়। এই হিসেবটুকু থেকেই বোঝা যায় সূত্রকারের কাছে বিরুদ্ধ মত হিসেবে সাংখ্যর গুরুত্ব কতখানি ছিল। সাংখ্য যদি প্রকৃতই শ্রুতিমূলক হয় তা হলে শ্রুতিতত্ত্বর ব্যাখ্যায় সাংখ্য–খণ্ডনে এমন উৎসাহ কেন?’- (ভারতীয় দর্শন,পৃষ্ঠা–২২, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)। তাছাড়া ব্রহ্মসূত্রের মূল পরিকল্পনায়ও দেখা যায়, গ্রন্থের শুরুতে প্রথম চারটি সূত্রে বাদরায়ণ ব্রহ্ম বিষয়ে কয়েকটি মূল কথা ব্যাখ্যা করে এরপর পঞ্চম সূত্রেই বলেছেন–‘ঈক্ষতেঃ ন অশব্দম্ ।’–(ব্রহ্মসূত্র: ১/১/৫)। শংকরাচার্যের ব্যাখ্যানুযায়ী সূত্রটির অর্থ : ‘জগতের আদি কারণের চিন্তা, দর্শন ইত্যাদির কথা শাস্ত্রে আছে– এই ব্রহ্ম চেতন–পদার্থ। কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত অচেতন প্রধানের কথা শাস্ত্রে নেই বলে অচেতন প্রকৃতি বা প্রধানকে জগৎসৃষ্টির আদি কারণ বললে তা অশাস্ত্রীয় উক্তি হবে।’

মোটকথা, আধুনিক বিদ্বানদের মতে, আদিতে বেদরিরুদ্ধ দর্শনের মধ্যে সাংখ্যের স্থানই প্রধান ছিলো। লুপ্তপ্রায় মূল গ্রন্থের অভাবে পরবর্তীকালের ঈশ্বরবাদী দার্শনিকদের হাতে তার ব্যাখ্যাগুলো নিজেদের মতো করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। প্রকৃতপক্ষে আদিতে সাংখ্য দর্শনের জন্ম হয়েছে নিরীশ্বরবাদী দর্শন হিসেবেই। সাংখ্যকারিকায় ঈশ্বরের কোন প্রসঙ্গ নেই। এমনকি সায়ন মাধবাচার্যও তার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’–এর সাংখ্য–প্রস্থান শেষ করেছেন এই বলে যে–‘এইভাবে নিরীশ্বর সাংখ্যশাস্ত্রের প্রবর্তক কপিলের মত প্রদর্শিত হলো।’–(সাংখ্য–প্রস্থানম্, সর্বদর্শনসংগ্রহ)। অর্থাৎ, ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদের প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে ও পক্ষে সাংখ্য দর্শনে বিভিন্ন যুক্তির উপস্থাপন ঘটেছে।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে যুক্তি

প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকদের মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেই, প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। এই মতবাদ স্থাপনের জন্য তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে কতকগুলো যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।

  • (১) সাংখ্যমতে মহৎ তত্ত্ব থেকে মহাভূত পর্যন্ত এই জগৎ সৃষ্টি প্রকৃতিরই কার্য। কার্য থাকলে এর পেছনে কারণও থাকবে। পরিণামী প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। তাই জগৎ–কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই।
  • (২) কোন কর্ম সম্পাদনে কর্তার একটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। জগৎ কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে জগৎ সৃষ্টির দ্বারা ঈশ্বরের কোন্ উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে, তা বলতে হয়। কিন্তু জগৎ সৃষ্টির মাধ্যমে ঈশ্বরের কোন উদ্দেশ্য সাধনের কথাই আমরা বলতে পারি না। প্রথমত, জীবের প্রতি করুণাবশত ঈশ্বও জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন না, কারণ জগৎ সৃষ্টির পূর্বে জীবের প্রতি করুণার প্রশ্নই ঊঠে না। আর যদি তিনি জীবের ভাবী কল্যাণের কথা ভেবে জগৎ সৃষ্টি করতেন, তাহলে জগতে বহুবিধ দুঃখের আবির্ভাব হতো না। দ্বিতীয়ত, জগৎ সৃষ্টির মাধ্যমে ঈশ্বরের কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে না, কারণ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। পূর্ণ ঈশ্বরের কোন অপূর্ণ ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। সুতরাং জীবের প্রতি করুণা বা ব্যক্তিগত কোন স্বার্থসিদ্ধি জগৎ সৃষ্টির প্রতি ঈশ্বরের প্রবৃত্তির নিয়ামক হতে পারে না।
  • (৩) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলে তাকে পুরুষ রূপেই স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ঈশ্বর মুক্ত বা বদ্ধ কোন পুরুষ রূপেই স্বীকৃত হতে পারেন না। তিনি যদি বদ্ধ পুরুষ হন, তাহলে তিনিও দুঃখত্রয়ের অধীন হবেন। কিন্তু ঈশ্বর কখনো দুঃখের অধীন হতে পারেন না। আবার ঈশ্বর যদি মুক্ত হন তাহলে তাকে নিত্য–মুক্তই বলতে হয়। তিনি যদি নিত্য–মুক্তই হন, তাহলে জগতের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।

প্রাচীন সাংখ্যাচার্যদের উপরিউক্ত যুক্তির সাহায্যে বাচস্পতি মিশ্র, অনিরুদ্ধ প্রমুখ দার্শনিকরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে, সাংখ্য নিরীশ্বরবাদী। এই মতে, অচেতন প্রকৃতি স্বভাববশেই জগৎ রূপে পরিণাম প্রাপ্ত হয়। তার এইরূপ স্বভাবের কারণ হলো পুরুষের ভোগ ও মোক্ষ সম্পাদন। গোবৎসের নিমিত্ত যেমন গাভীর দুগ্ধ ক্ষরণ হয়, তেমনি সাংখ্যকারিকার একবিংশ কারিকা অনুযায়ী–(‘পুরুষস্য দর্শনার্থং কৈবল্যার্থং তথা প্রধানস্য) পুরুষের ভোগ ও মোক্ষের নিমিত্তই প্রকৃতি পরিণাম প্রাপ্ত হয়। এই পরিণামের কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই।

ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি

সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যে কোন কোন আধুনিক ব্যাখ্যাকার ঈশ্বর সম্বন্ধে উপরিউক্ত নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যমত গ্রহণ করেন নি। যেমন–বিজ্ঞানভিক্ষুর মতে সাংখ্য ঈশ্বরবাদী। তিনি মনে করেন, সাংখ্যপ্রবচনসূত্রকার ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথা কোথাও বলেন নি। ঈশ্বরের নাস্তিত্বই যদি সূত্রকারের অভিপ্রেত হতো, তাহলে তিনি প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধির কথা না বলে সরাসরি ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথাই বলতেন। বিজ্ঞানভিক্ষুর মতে, সূত্রকারের বক্তব্য থেকে একথাই মনে হয় যে, সাংখ্য সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতো জগৎস্রষ্টারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের বিরোধী। ঈশ্বরবাদী সাংখ্যাচার্যদের মতে, ঈশ্বর হলেন আদি পুরুষ। পুরুষ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় জগৎ সৃষ্টি তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তারই ইচ্ছায় প্রকৃতির মধ্যে চাঞ্চল্য ঘটে এবং প্রকৃতি ক্রিয়াশীল হয়। চুম্বকের সান্নিধ্যে লৌহ যেমন চুম্বকধর্মবান বলে প্রতিভাত হয়, তেমনি চৈতন্যময় পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতিতে চেতনার প্রতিফলন ঘটে। এর ফলে প্রকৃতিতে চাঞ্চল্য দেখা দেয় এবং জগৎরূপে প্রকৃতির পরিণাম ঘটে। তাই প্রকৃতির গতিময়তার হেতুরূপে সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যেতে পারে। তাছাড়া স্মৃতি ও শ্রুতি থেকেও ঈশ্বরের অস্তিত্বেও কথা জানতে পারা যায়।

সাংখ্যমতে মোক্ষ বা কৈবল্য

সাংখ্যমতে, আত্মা বা পুরুষে যে সুখ–দুঃখ–মোহাদিরূপ প্রাকৃতিক ধর্ম উপচারিত হয়, তার তিরোধানই হলো মুক্তি। এই মুক্তিপ্রাপ্তিকে সাংখ্য দর্শনে কৈবল্যপ্রাপ্তি বলা হয়, এবং এই কৈবল্যই সাংখ্য দর্শনে পরম পুরুষার্থ। মহর্ষি কপিল বা অন্যান্য সাংখ্যাচার্যগণ ত্রিতাপ দুঃখভোগকে আত্মার বন্ধনের ফল বলেছেন। এই ত্রিতাপ দুঃখ কী? সকল জীবই এ সংসারে আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক– এই ত্রিবিধ দুঃখভোগ করে। শারীরিক ও মানসিক দুঃখ হলো আধ্যাত্মিক দুঃখ। বজ্রপাত, ভূকম্পন প্রভৃতি দৈব–দুর্বিপাক বশত জীবের যে দুঃখ হয়, তাকে বলে আধিদৈবিক দুঃখ। মানুষ ও অন্যান্য পশুপক্ষিজনিত প্রাপ্ত দুঃখকে বলা হয় আধিভৌতিক দুঃখ। মোটকথা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীব এই ত্রিবিধ দুঃখের কবলে পতিত হয়। এই যে দুঃখের কবলে পতিত হওয়া, সাংখ্যমতে একেই পুরুষের বদ্ধাবস্থা কিংবা সংসারদশা বলা হয়েছে। এই ত্রিবিধ দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে মানুষ যুগে যুগে নানা উপায় খুঁজেছে, উদ্ভাবন করেছে। ঔষধ সেবনে রোগাদিজনিত দুঃখ থেকে সাময়িকভাবে পরিত্রাণ পাওয়া গেলেও তা দিয়ে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয় না। সুষুপ্তিতে যে দুঃখের নিরসন হয়, তাও আত্যন্তিক নয়। পুনর্জাগরণে পুনরায় সেই দুঃখভোগ শুরু হয়। যাগ–যজ্ঞাদি ক্রিয়া এবং দৃষ্ট ও লৌকিক কোন উপায়ই দুঃখের আত্যন্তিক বা চির নিবৃত্তি দিতে পারে না। বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ে এই দুঃখের চির নিবৃত্তির উপায় খোঁজা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সাংখ্য দার্শনিকরা তত্ত্বজ্ঞানকেই মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করেন। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির উপায় নির্দেশ করতে দ্বিতীয় কারিকায় বলেছেন–”ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ–এর বিবেকজ্ঞান থেকে দুঃখের অবশ্যম্ভাবী চিরনিবৃত্তি হয়।”। ‘ব্যক্ত’ হলো পরিণামপ্রাপ্ত সূক্ষ্ম ও স্থূল পদার্থসমূহ, ‘অব্যক্ত’ হলো প্রকৃতি এবং ‘জ্ঞ’ হলো পুরুষ বা আত্মা। এই ত্রয়ের বিবেকজ্ঞান বা ভেদজ্ঞানই সর্ববিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ উপায়। অপরদিকে ব্যক্ত, অব্যক্ত এবং জ্ঞ– এই ত্রয়ের অবিবেক বা অভেদজ্ঞানই জীবের সর্ববিধ বন্ধনজনিত দুঃখের হেতু।

সাংখ্যমতে পুরুষ স্বরূপত নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত স্বভাব। সুতরাং স্বরূপত পুরুষ বদ্ধ হয় না, আবার মুক্তও হয় না। বুদ্ধির ধর্ম যখন পুরুষে প্রতিফলিত হয়, তখন অবিদ্যাবশত পুরুষ বা আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এক বলে মনে করে। এর ফলে মনের বৃত্তিগুলোকে, অর্থাৎ সুখ, দুঃখ ও মোহকে বিবেকজ্ঞানহীন পুরুষ নিজের মনে করে অর্থাৎ নিজেকে কর্তা বা ভোক্তা বলে মনে করে। পুরুষ বা আত্মার এই অবস্থার নাম বন্ধনদশা। এর ফলে ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির সুখ–দুঃখাদি পুরুষে আরোপিত হয়। পুরুষ যখন অবিদ্যামুক্ত হয়ে চৈতন্য স্বরূপে অবস্থান করে, তখন সেই পুরুষের অবস্থাকে বলা হয় মুক্তাবস্থা। সাংখ্যমতে তত্ত্বজ্ঞান বা বিবেকজ্ঞানই মুক্তির পথ। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা সূক্ষ্মতম ভেদ লক্ষিত হয়। ক্ষণে যে পরিণাম হয়, তাই সূক্ষ্মতম ভেদ। বিবেকজ্ঞান এই সূক্ষ্মতম ভেদের জ্ঞান। ব্যক্ত, অব্যক্ত ও জ্ঞ বা পুরুষের বিবেকজ্ঞান এই ত্রিতত্ত্বেও স্বরূপকে প্রকাশ করে। এর ফলে পুরুষের স্ব–স্ব রূপে অবস্থান হয় এবং পুরুষ কৈবল্য বা মোক্ষ লাভ করে। পুরুষের আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠাই হলো কৈবল্য। অপরোক্ষ বিবেকজ্ঞানের দ্বারা পরমপুরুষার্থ কৈবল্য লাভ হয় বলে এই জ্ঞান ঐকান্তিক জ্ঞান। আবার সকল দুঃখের নিবর্তক বলে এই জ্ঞান আত্যন্তিক। যমনিয়মাদি সাধ্য বলে এই জ্ঞান শুদ্ধ এবং এর দ্বারা লব্ধ মুক্তি অবিনাশী বলে এই জ্ঞান অক্ষয়। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের বিবেকজ্ঞান উৎপন্ন হলে বুদ্ধিধর্ম পুরুষ থেকে অপসৃত হয়। এ অবস্থায় পুরুষের সুখ, দুঃখ ও মোহ কিছুই অনুভূত হয় না। আত্মার এই শুদ্ধাবস্থাই সাংখ্যশাস্ত্রে মোক্ষাবস্থা বা কৈবল্যাবস্থা বলে পরিচিত। তবে সাংখ্যমতে জীবন্মুক্তি ও বিদেহমুক্তি নামে দ্বিবিধ মুক্তিই স্বীকৃত। দেহের বর্তমানে বন্ধনের মূলোচ্ছেদ হলে জীবের যে মুক্তিলাভ হয়, তাই জীবন্মুক্তি। জীবন্মুক্তিতে জীবের সূক্ষ্ম সংস্কার বর্তমান থেকে যায়। দেহের বিনাশে এই সংস্কারের বিনাশ হয়। সকল প্রকার সংস্কারমুক্ত পুরুষের স্বরূপে অবস্থানই বিদেহমুক্তি বা পরম কৈবল্যাবস্থা।

ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলো মোক্ষ বা মুক্তিকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করলেও মুক্তির স্বরূপ সম্পর্কে তারা একমত হতে পারেননি। সাংখ্য, বৌদ্ধ ও বেদান্ত দার্শনিকরা বিশ্বাস করেন যে, মোক্ষ প্রাপ্তির পর জীবের কোন দুঃখ থাকে না। কিন্তু সাংখ্য দার্শনিকরা আরো মনে করেন যে, মোক্ষ বা মুক্তি কোনরূপ সুখ অনুভূতিরও অবস্থা নয়। কারণ সুখ ও দুঃখ আপেক্ষিক শব্দ। যেখানে দুঃখ নেই সেখানে সুখ থাকতে পারে না। সাংখ্যমতে মোক্ষের দুটি দিক। একদিকে মোক্ষ বা মুক্তি বলতে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়। অন্যদিকে সাংখ্য দার্শনিকরা মোক্ষ বা মুক্তি সুখ–দুঃখের অতীত এক তৃতীয় অবস্থাকে মনে করেন। এই মতে, মুক্তাবস্থায় পুরুষের দৃষ্টি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হয়। বুদ্ধির সঙ্গে সে আর নিজেকে অভিন্ন বলে মনে করে না। এই অবস্থাকে বোঝাতে গিয়ে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ পঁয়ষট্টি নম্বর কারিকায় বলেন–”সেই তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা পুরুষ–প্রকৃতি বিবেকজ্ঞান–রূপ সিদ্ধ হওয়ায় স্ব–স্বরূপে অবস্থিত পুরুষকে তখন সপ্তভাবশূন্যা প্রকৃতি স্পর্শ বা প্রভাবিত করতে পারে না এবং দর্শকের ন্যায় পুরুষ তখন উদাসীন, অসঙ্গ ও নির্বিকার।” (সাংখ্যকারিকা–৬৫)। বিবেকজ্ঞান যুক্তির দ্বারা বা গ্রন্থাদি দ্বারা প্রামাণ্য নয়। আত্মাকে সাক্ষাৎ উপলব্ধি করতে হলে দীর্ঘ সাধনার প্রয়োজন। বিবেকজ্ঞান, সাধনবল ও সাংখ্যোক্ত পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞানের দ্বারা জীব এইরূপ মোক্ষাবস্থা লাভ করে।

সাংখ্যমতে জগতের অভিব্যক্তি

সাংখ্য দার্শনিকরা পরিণামবাদী। তাদের মতে জগৎ হলো প্রকৃতির পরিণাম। প্রকৃতি হলো জগতের উৎপত্তির প্রতি উপাদান কারণ। অর্থাৎ, জগৎ ও জগতের প্রত্যেক বস্তু ও বিষয়ের মূল কারণ প্রকৃতি। বলা হয়, সৃষ্টির পূর্বে জগৎ প্রকৃতির মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ হওয়ার ফলে জগতের অভিব্যক্তি হয়। সাংখ্যমতে একেই জগতের সৃষ্টি বলা হয়। এই সৃষ্টির পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াও সাংখ্যশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পুরুষ চেতন এবং অকর্তা, অন্যদিকে প্রকৃতি অচেতন এবং কর্তা হলে এই বিরুদ্ধ ধর্ম ও ভেদ নিয়ে পুরুষ এবং প্রকৃতির সম্বন্ধ কিভাবে সম্ভব? এর উত্তরে বলা হয়, প্রকৃতি নিজেকে ভোগ করতে পারে না, আর ভোক্তা না থাকলে ভোগ্য পদার্থের সার্থকতা থাকে না। তাই প্রকৃতিকে ভোক্তা পুরুষের প্রতীক্ষায় থাকতে হয়। এভাবে প্রকৃতি পুরুষ থেকে ভিন্ন বা বিরুদ্ধ ধর্মবিশিষ্ট হলেও পুরুষই প্রকৃতির সার্থকতা সম্পাদন করে বলে সে পুরুষের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হতে ইচ্ছুক হয়। এখানে প্রশ্ন আসে, সাংখ্যমতে পুরুষ অসঙ্গ এবং উদাসীন হলে সে প্রকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত কিভাবে হবে। উত্তরে সাংখ্য দার্শনিকরা বলেন, পুরুষ কৈবল্য বা মুক্তির জন্য প্রকৃতি বা প্রধানের ওপর নির্ভর করে। সাংখ্য দর্শনে আধিদৈবিক, আধিভৌতিক এবং আধ্যাত্মিক– এই তিনরকম দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকেই কৈবল্য বা মুক্তি বলা হয়। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, পুরুষ যদি নিত্যমুক্ত হয়ে থাকে তাহলে তার কৈবল্যের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভর করার কী প্রয়োজন? উত্তরে বলা হয়, প্রকৃতি বা প্রধান পুরুষের ভোগ্য। অনাদিকাল থেকে প্রধানের থেকে নিজের ভেদ বুঝতে না পারার জন্য আত্মা বা পুরুষ প্রকৃতি বা প্রধানের ত্রিবিধ দুঃখকে নিজের দুঃখ বলে মনে করে চলেছে। ফলে পুরুষ কৈবল্যের জন্য ভীষণভাবে আগ্রহশীল হয়।

উল্লেখ্য যে, সাংখ্যমতে প্রকৃতি পুরুষের ওপর এবং পুরুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে, কারণ উভয়ের মধ্যে উপকার্য–উপকারভাব সম্বন্ধ আছে। পুরুষ প্রকৃতির উপকার করে প্রকৃতির সার্থকতা সম্পাদন করে, সেই সাথে প্রকৃতির স্বরূপস্থিত সুখ–দুঃখ ভোগ করে, প্রকৃতি তখন কৃতার্থ হয়। আবার প্রকৃতি পুরুষের উপকার করে। সুখদুঃখময়ী হয়েও সে পুরুষকে সুখের স্পর্শের চেয়ে দুঃখের তাপ বেশি প্রদান করে, তার ফলে পুরুষের কৈবল্যলাভের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়। এই উপকার্য–উপকারভাবটি বোঝাবার জন্য সাংখ্যকারিকাকার পঙ্গু এবং অন্ধ ব্যক্তির একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন–”পুরুষের মুক্তির জন্য এবং প্রধানের (তথা মূল প্রকৃতির) ভোগের জন্য পঙ্গু ও অন্ধের মতো উভয়ের (অর্থাৎ পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগ হয়। (পুরুষ ও প্রকৃতির) সংযোগবশত মহদাদি ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়।” (সাংখ্যকারিকা–২১)। পঙ্গুর জ্ঞান আছে, ক্রিয়া নেই, অন্যদিকে অন্ধের ক্রিয়া আছে, জ্ঞান নেই। অন্ধ যদি পঙ্গুকে বহন করতে ইচ্ছুক হয় এবং পঙ্গু যদি অন্ধকে চালনা করতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে উভয়েই গন্তব্যস্থানে উপস্থিত হতে পারে। একইভাবে পরস্পরের উপকারের জন্যই পুরুষ এবং প্রকৃতির সংযোগ হয়ে থাকে। এজন্যেই সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে, “এইভাবে মহৎ থেকে (শুরু করে) পঞ্চমহাভূত পর্যন্ত এই যে সৃষ্টি তা প্রত্যেক পুরুষের মুক্তির জন্য প্রকৃতি নিজের প্রয়োজনের মতই পরের (অর্থাৎ পুরুষের) প্রয়োজনে সৃষ্টি করে।” (সাংখ্যকারিকা–৫৬)। কৈবল্যপিপাসু পুরুষের উপকারের জন্যই প্রকৃতি মহৎতত্ত্বরূপে পরিণত হয়। মহৎতত্ত্ব হলো প্রকৃতির প্রথম পরিণাম এবং জগতের যাবতীয় বস্তুর বীজ।

তবে তার আগে প্রশ্ন হলো, প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ভোগ ও কৈবল্যের কারণ হলে মহৎ প্রভৃতি সৃষ্টির প্রতি কারণ কে? উত্তরে বলা হয়, ভোগ ও কৈবল্য– এই দুটি হলো পুরুষার্থ। প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সংযোগ হলেই ভোগ ও কৈবল্য হয় না। প্রকৃতির পরিণামবশত বুদ্ধি বা মহৎ প্রভৃতি সৃষ্টি হলে তবেই ভোগ সম্ভব হয়। অন্তঃকরণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সুখ–দুঃখই ভোগ্য হয়। সুতরাং ভোগের জন্য মহৎ প্রভৃতির সৃষ্টি প্রয়োজন। আবার জ্ঞান হলো অন্তঃকরণের বৃত্তি। তত্ত্বজ্ঞান বা পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদের জ্ঞান না হলে কৈবল্য হয় না। সুতরাং কৈবল্যের জন্যও মহৎ প্রভৃতি সৃষ্টি প্রয়োজন। তাই সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে–”মহৎ বা বুদ্ধি সংসারদশায় পুরুষের সমস্ত ভোগ সাধন করে বলে সেই বুদ্ধিই পুনরায় মোক্ষদশায় প্রধান ও পুরুষের দুর্বিজ্ঞেয় ভেদ বিশেষভাবে প্রকাশ করে।” (সাংখ্যকারিকা–৩৭)। তাই স্বীকার করতে হবে যে, প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগের ফলে মহৎ প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। এর দ্বারাই পুরুষের ভোগ এবং অপবর্গ সিদ্ধ হয়ে থাকে।

বস্তুত প্রকৃতি একটি ক্ষণেও স্থির থাকে না। প্রতিক্ষণেই তার নিয়ত বা নিয়মিত পরিণতি হয়ে চলেছে। প্রলয়কালেও তার পরিণামপ্রাপ্তি অব্যাহত থাকে। কিন্তু ঐ সময়ে প্রকৃতির স্বরূপভূত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণের তারতম্য হয় না বলে ঐ পরিণামের ফলে অন্য কোন তত্ত্ব প্রকাশিত হয় না। এজন্য এই পরিণামকে বলা হয় স্বরূপপরিণাম। কিন্তু যখন সৃষ্টির সময় উপস্থিত হয়, অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ঘটলে প্রকৃতির মধ্যে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে রজঃ সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া আরম্ভ হয়। রজোগুণ চঞ্চল বলে প্রথমে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং পরে সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া আরম্ভ হয়। মোটকথা, সৃষ্টির সময় প্রকৃতির স্বরূপভূত তিনটি গুণের তারতম্য হওয়ায় যে পরিণাম হয়, তাকে বলা হয় রিরূপপরিণাম। প্রকৃতির প্রথম বিরূপপরিণাম হলো মহৎতত্ত্ব। সাংখ্যকারিকার ঈশ্বরকৃষ্ণ প্রকৃতির পরিণাম হিসেবে সৃষ্টির যে ক্রম উল্লেখ করেছেন তা হলো–”প্রকৃতি থেকে মহৎ, মহৎ থেকে অহঙ্কার, অহঙ্কার থেকে (মন, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চতন্মাত্র– এই) ষোলটি গণ (বা বিকার) এবং ষোলটি বিকারের অন্তর্গত পঞ্চতন্মাত্র থেকে (আকাশাদি) পঞ্চমহাভূত (উৎপন্ন হয়)।” (সাংখ্যকারিকা–২২)। তবে কারিকাটিতে একবাক্যে এই জগত সৃষ্টির ক্রম উল্লেখ করা হলেও সাংখ্যশাস্ত্রে এর সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিস্তৃত ব্যাখ্যা রয়েছে।

প্রথম পরিণাম মহৎতত্ত্ব : প্রকৃতির প্রথম পরিণাম যে মহৎতত্ত্ব, এই মহৎতত্ত্বেরই নামান্তর হলো মহান, বুদ্ধি ইত্যাদি। একে মহান বলা হয় কারণ সকল উৎপন্ন পদার্থের মধ্যে এই পদার্থটি মহাপরিমাণযুক্ত। বুদ্ধি বলা হয় এজন্যে যে, বুদ্ধি নিজেকে যেমন প্রকাশ করে তেমনি অন্যকেও প্রকাশ করে। সাংখ্যমতে প্রথম ব্যক্ত বুদ্ধির লক্ষণ হলো অধ্যবসায়। সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে – “অধ্যবসায় (তথা অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মক বৃত্তি) হলো বুদ্ধি। ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও (অনিমা ইত্যাদি) ঐশ্বর্য বুদ্ধির সাত্ত্বিক রূপ। এই ধর্মাদির বিপরীত–অধর্ম, অজ্ঞান, অবৈরাগ্য ও অনৈশ্বর্যরূপ চারটি অস˜গুণ বুদ্ধির তামস রূপ।” (সাংখ্যকারিকা–২৩)। এই কারিকা অনুযায়ী, প্রথম ব্যক্ত বুদ্ধির লক্ষণ হলো অধ্যবসায়। যদিও অধ্যবসায় বুদ্ধির ব্যাপার বা বুদ্ধির ধর্মমাত্র, বুদ্ধির স্বরূপ নয়, তবুও অধ্যবসায়রূপ ব্যাপার বা ধর্মের দ্বারা বুদ্ধির লক্ষণ চিহ্নিত হয়। বুদ্ধির বিশেষ ধর্ম হলো নিশ্চয়, বস্তুর স্বরূপ নিশ্চয় করা যায় জ্ঞান বুদ্ধির দ্বারা। ‘এটি আমার কর্তব্য’ এরকম নিশ্চয়ই অধ্যবসায় পদবাচ্য। প্রকৃতি যেমন ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা, প্রকৃতি থেকে প্রথম উৎপন্ন বুদ্ধি বা মহৎও ত্রিগুণাত্মক। প্রকৃতির যেমন পরিণাম হয়, বুদ্ধিরও তেমনই পরিণাম হয়।

দ্বিতীয় পরিণাম অহঙ্কার : মহৎ থেকে অহঙ্কার উৎপন্ন হয়। অহঙ্কার হলো প্রকৃতির দ্বিতীয় পরিণাম। ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই দুটি বোধ অহঙ্কারের প্রধান লক্ষণ। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ অহঙ্কারের লক্ষণ এবং অহঙ্কার থেকে উৎপন্ন দু’প্রকার তত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন–”অন্তঃকরণের অভিমানাত্মক বৃত্তি অহঙ্কার। অহঙ্কার থেকে দুই প্রকার সৃষ্টি হয় – একাদশ ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চতন্মাত্র।” (সাংখ্যকারিকা–২৪)। পঞ্চতন্মাত্র হলো– শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ। আর একাদশ ইন্দ্রিয় হলো– পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরেন্দ্রিয় মন।

একাদশ ইন্দ্রিয় : সাংখ্যকারিকায় জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে–”চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক্– এই পাঁচটিকে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলে এবং বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু ও উপস্থ (যোনি)- এই পাঁচটিকে কর্মেন্দ্রিয় বলে।” (সাংখ্যকারিকা–২৬)। মহৎ–এর মতো অহঙ্কারও ত্রিগুণাত্মক। তবে সাংখ্যশাস্ত্রে অহঙ্কারের অন্তর্গত ত্রিগুণের পৃথক পৃথক নামকরণ করা হয়েছে। এ থেকে অহঙ্কার তিনপ্রকারও বলা যায়। অহঙ্কারে সত্ত্ব গুণের প্রাধান্য ঘটলে সাত্ত্বিক অহঙ্কার, রজোগুণের আধিক্য ঘটলে রাজসিক অহঙ্কার এবং তমোগুণের আধিক্য ঘটলে তামসিক অহঙ্কারের সৃষ্টি হয়। সাংখ্যমতে, অহঙ্কারের সাত্ত্বিকভাগকে বৈকারিক বা বৈকৃত, রাজসভাগকে তৈজস এবং তামসভাগকে ভূতাদি বলা হয়েছে। সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে – “বৈকৃত নামক সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে সাত্ত্বিক একাদশ ইন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়। ভূতাদি নামক তামস অহঙ্কার থেকে সেই তামসিক পাঁচটি তন্মাত্র উৎপন্ন হয়। তৈজস বা রাজস অহঙ্কার থেকে ইন্দ্রিয় ও তন্মাত্র উভয়েই উৎপন্ন হয়।” (সাংখ্যকারিকা–২৫)। মোটকথা, সাংখ্যমতে অহঙ্কার থেকে ষোলটি তত্ত্ব উৎপন্ন হয়। সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় এবং হাত, পা, পায়ু, মুখ ও উপস্থ বা জননেন্দ্রিয় এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও মনের আবির্ভাব হয়। আর তামসিক অহঙ্কার থেকে উদ্ভব হয় পঞ্চ তন্মাত্রের। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, অহঙ্কারের অন্তর্গত রজো গুণ যদি কোন তত্ত্ব উৎপন্ন না করে, তাহলে অহঙ্কারকে কিভাবে ত্রিগুণাত্মক বলা যায়। এর উত্তর হলো, রজোগুণ না থাকলে সত্ত্বগুণের ও তমোগুণের কার্যকরতা সম্ভব নয়। কারণ সত্ত্বগুণ এবং তমোগুণ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। তাই রজো গুণকে সাক্ষাৎভাবে কারণ বলা না গেলেও সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া উৎপাদন করে বলে রজো গুণও ঐ সকল কার্যের কারণ হয়, অর্থাৎ উক্ত উভয়প্রকার কার্যের উৎপত্তিতে রজোগুণ হলো নিমিত্তকারণ। একাদশ ইন্দ্রিয় মন হলো উভয়াত্মক। মন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কার্যের যেমন সহায়ক হয়, কর্মেন্দ্রিয়ের কার্যেরও সহায়ক হয়। অর্থাৎ মনের সাহায্য না পেলে জ্ঞানেন্দ্রিয় জ্ঞান উৎপাদন করতে পারে না। আবার মনের সাহায্য না পেলে কর্মেন্দ্রিয়ও কর্মসাধনে সমর্থ হয় না। এইজন্য মনকে উভয় ইন্দ্রিয়স্বরূপ বলা হয়েছে–”মন উভায়ত্মক ও সঙ্কল্পাত্মক। ইন্দ্রিয়ের সমানধর্মবশত (জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের মত মনও সাত্ত্বিক অহঙ্কার থেকে উৎপন্ন বলে) মনও ইন্দ্রিয়। গুণত্রয়ের পরিণামবিশেষহেতু ইন্দ্রিয় নানা এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শব্দাদি বাহ্য বিষয়গুলোও বহু।” (সাংখ্যকারিকা–২৭)। সাংখ্যকারিকায় ইন্দ্রিয়গুলো বৃত্তি বা কার্য সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে–”শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ বিষয়ে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৃত্তি আলোচনজ্ঞান বা নির্বিকল্পক জ্ঞান মাত্র এবং বচন, আদান (গ্রহণ), বিহরণ (গমন), উৎসর্গ (মলাদিত্যাগ) ও আনন্দ (স্ত্রীসম্ভোগরূপ সন্তোষ) পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়ের বৃত্তি– এটাই সাংখ্য স্বীকৃত।” (সাংখ্যকারিকা–২৮)। সহজকথায়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় যথা– চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক্ এরা যথাক্রমে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ উপলব্ধি করে। আর পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় যথা– হাত, পা, পায়ু, মুখ ও জননেন্দ্রিয়ের বৃত্তি হলো গ্রহণ, গমন, ত্যাগ, কথন ও জনন প্রত্যক্ষ করা। সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয় বলতে ইন্দ্রিয়ের অন্তঃস্থিত অপ্রত্যক্ষ শক্তিকে বোঝায়। প্রত্যক্ষগোচর শরীরের বহির্দেশে অবস্থিত ইন্দ্রিয়গুলো বোঝায় না। ইন্দ্রিয়গুলো শরীর নয়, শরীরাশ্রিত। বুদ্ধি বা জ্ঞানের সাধন ইন্দ্রিয়কে বুদ্ধিন্দ্রিয় বা জ্ঞানেন্দ্রিয় বলা হয়। কর্মের সাধন ইন্দ্রিয়কে বলা হয় কর্মেন্দ্রিয়। বাচস্পতি মিশ্রের মতে জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং কর্মেন্দ্রিয় উভয়ই ইন্দ্রিয়ের বা আত্মার চিহ্ন হওয়ায় ইন্দ্রিয় পদবাচ্য হয়। তবে ন্যায়–বৈশেষিক দার্শনিকরা কর্মেন্দ্রিয় স্বীকার করেন না। কারণ, তাদের মতে যা জ্ঞানের করণ তাই ইন্দ্রিয়। তাই সাংখ্যমে ইন্দ্রিয় একাদশটি হলেও ন্যায়–বৈশেষিক মতে ইন্দ্রিয় সংখ্য ছয়টি।

পঞ্চতন্মাত্র : সাংখ্যমতে তামস অহঙ্কার থেকে পঞ্চ তন্মাত্রের আবির্ভাব হয়। এই পঞ্চ তন্মাত্র পাঁচ রকমের অনুভূতি যথা– রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ–এর সূক্ষ্ম উপাদান। তন্মাত্রগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম, তাই তাদের প্রত্যক্ষ করা যায় না। কিন্তু তাদের অস্তিত্বকে অনুমান করা যায়। পঞ্চ তন্মাত্র থেকে পঞ্চ মহাভূত যথা– ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম বা আকাশের সৃষ্টি। সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে – “(শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ– এই পাঁচটি) তন্মাত্রকে অবিশেষ (বা সূক্ষ্ম ভূত) বলে। সেই পাঁচটি (তন্মাত্র) থেকে (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম– এই) পাঁচটি স্থূলভূত উৎপন্ন হয়। এই পাঁচটি স্থূলভূত (সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণাত্মক বলে এদের) সুখ, দুঃখ ও মোহ–স্বভাব বলা হয়।” (সাংখ্যকারিকা–৩৮)। পঞ্চতন্মাত্র থেকে যে পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টি হয়, সাংখ্য দর্শনে এই কারিকাটির একাধিক ব্যাখ্যা দেখা যায়। প্রচলিত ব্যাখ্যানুযায়ী সাংখ্য দার্শনিকরা বলেন, শব্দতন্মাত্র থেকে ব্যোম বা আকাশ, শব্দতন্মাত্র ও স্পর্শতন্মাত্র থেকে মরুৎ বা বায়ু, শব্দস্পর্শরূপ তন্মাত্র থেকে তেজ, শব্দস্পর্শরূপরস তন্মাত্র থেকে অপ্ বা জল এবং শব্দস্পর্শরূপরসগন্ধ তন্মাত্র থেকে ক্ষিতি বা পৃথিবী উৎপন্ন হয়। এ প্রেক্ষিতে কোন কোন সাংখ্যদার্শনিক যেমন যুক্তিদীপিকাকার বলেছেন যে, এক একটি তন্মাত্র থেকে এক একটি স্থূলভূত উৎপন্ন হয়। আকাশ যেমন শব্দতন্মাত্র থেকে উৎপন্ন হয়, তেমনি বায়ু, তেজ, জল ও পৃথিবী উৎপন্ন হয় যথাক্রমে স্পর্শতন্মাত্র, রূপতন্মাত্র, রসতন্মাত্র ও গন্ধতন্মাত্র থেকে। এক্ষেত্রে বায়ু প্রভৃতির সৃষ্টিতে অন্য তন্মাত্রের অনুপ্রবেশ হয় না। ফলে কার্যকারণভাব সুসঙ্গত হয়। কিন্তু সাংখ্যদর্শনের অন্যান্য আচার্যদের মতে, বস্তুস্থিতির উপপাদনের জন্য হেতুরূপে অন্য তন্মাত্রের অনুপ্রবেশ স্বীকার করা প্রয়োজন। কারণ উপাদানকারণের গুণ কার্যে উপলব্ধি হয়। তাই উপাদানসংশ্লিষ্ট তন্মাত্রের কারণেই আকাশে শব্দ, বায়ুতে শব্দ স্পর্শ, তেজে শব্দ স্পর্শ রূপ, জলে শব্দ স্পর্শ রূপ রস এবং পৃথিবীতে শব্দ স্পর্শ রূপ রস গন্ধ এই গুণগুলোর উপলব্ধি হয়। সাংখ্য দার্শনিকরা স্থূল মহাভূতের একাধিক গুণ আছে বলে স্বীকার করলেও ন্যায়মতে প্রত্যেকটি মহাভূতের জন্য একটি করে গুণ স্বীকার করা হয়। সাংখ্যমতে স্থূল ভূতগুলো শান্ত ঘোর এবং মূঢ় হওয়ার জন্যই বিশেষত্ব বিশিষ্ট হয়। অর্থাৎ আকাশ প্রভৃতি স্থূল ভূতগুলো উক্ত তিনপ্রকার হলেও সকলের কাছে সমভাবে প্রতীত হয় না, কয়েকটি সত্ত্বগুণপ্রধান, কয়েকটি রজোগুণপ্রধান, আর কয়েকটি তমোগুণপ্রধান। শান্তভূতগুলো সুখ, প্রকাশ এবং লঘু। এগুলো সুখময় হওয়ায় সন্নিকৃষ্ট পুরুষকে সুখী করে, প্রকাশময় হওয়ায় পুরুষের নিকট স্বচ্ছভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করে, আবার লঘু হওয়ায় দ্রুতগতি উর্ধ্বগতি প্রভৃতির আশ্রয় হয়ে থাকে। এইভাবে শান্তত্ববিশিষ্ট ভূতগুলো উপভোগ্য হয়। কিন্তু ঘোর ভূতগুলো দুঃখময় ও অনবস্থিত। রজোগুণ পরিস্ফুট হওয়ায় সে সন্নিকৃষ্ট পুরুষকে দুঃখী করে এবং অনবস্থিত, চঞ্চল বা ক্রিয়াশীল হয়। এভাবে ঘোরত্ববিশিষ্ট গুণগুলো উপভোগ্য হয়। আবার মূঢ় ভূতগুলো বিষণ্নও গুরু। বিষাদময় হওয়ায় সন্নিকৃষ্ট পুরুষকে মুগ্ধ করে এবং গুরু হওয়ায় সত্ত্ব ও রজোগুণের সতত কার্যকারিতায় প্রতিবন্ধক হয়। এভাবে ভূতগুলো পরস্পর ভিন্ন হয়ে প্রতীয়মান হয়। বলাবাহুল্য যে এইরূপ উপভোগযোগ্যতারূপ বিশেষ না থাকায় তন্মাত্রগুলোকে অবিশেষ এবং সূক্ষ্ম বলা হয়।

সৃষ্টি : সাংখ্যমতে সৃষ্টিকে সর্গ বলা হয়েছে। সর্গ দুই প্রকার যথা– প্রত্যয়সর্গ বা বুদ্ধি সর্গ এবং তন্মাত্র সর্গ বা ভৌতিক সর্গ। প্রত্যয় সর্গ বা বুদ্ধি সর্গের আওতাভুক্ত হলো মহৎ, অহঙ্কার, পঞ্চ ইন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও উভয়েন্দ্রিয় মন এই তেরোটি পরিণাম। আর তন্মাত্র সর্গ বা ভৌতিক সর্গের আওতায় পড়ে পঞ্চ তন্মাত্র, পঞ্চ মহাভূত এবং মহাভূত থেকে উৎপন্ন সকল দ্রব্য। পঞ্চতন্মাত্র অতীন্দ্রিয় বলে তা ‘অবিশেষ’ নামে পরিচিত। অন্যদিকে পঞ্চমহাভূত ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট দ্রব্যগুলোকে ‘বিশেষ’ বলা হয়। সাংখ্যকারিকায় বলা হয়েছে–”বিশেষ তিন প্রকার (যথা-) সূক্ষ্মশরীর, মাতা–পিতা থেকে জাত স্থূলশরীর ও পাঁচটি মহাভূত। এদের মধ্যে সূক্ষ্মশরীর প্রলয়কাল পর্যন্ত (আপেক্ষিক) নিত্য, স্থূলশরীর (কিছুদিন থেকে) নষ্ট হয়।” (সাংখ্যকারিকা–৩৯)। সাংখ্যমতে সৃষ্টি বলতে প্রলয়ের পর প্রথম সৃষ্টি বোঝানো হয়। সৃষ্টির পরে প্রলয় হয় এবং প্রলয়ের পর সৃষ্টি হয়। এভাবে এই প্রবাহ অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। প্রলয়ের পর যখন সৃষ্টি আরম্ভ হয়, তখন সূক্ষ্মশরীর নির্মিত হয়। তখন হতে আরম্ভ করে মহাপ্রলয় পর্যন্ত এই সূক্ষ্মশরীর বর্তমান থাকে। প্রশ্ন হতে পারে যে, প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই নিত্য হলে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগও নিত্য, ফলে সর্বদা কেবল সৃষ্টি হওয়ায়, প্রলয়ব্যবস্থার উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। উত্তরে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেছেন–”নর্তকী যেমন দর্শকগণকে নৃত্য দেখিয়ে নৃত্য থেকে নিবৃত্ত হয়, প্রকৃতিও সেইরূপ পুরুষের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে (সৃষ্টি ব্যাপার থেকে) নিবৃত্ত হয়।” (সাংখ্যকারিকা–৫৯)। সুতরাং, সাংখ্যাচার্যের মতে, সৃষ্টির ন্যায় প্রলয়ও সম্ভব। আর জগৎকার্যরূপ সৃষ্টির কারণও সাংখ্যকারিকায় দৃষ্টান্ত দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে–”লোকে যেমন কৌতুহল বা আগ্রহ নিবৃত্তির জন্য কার্যে প্রবৃত্ত হয়, তেমনি প্রকৃতিও পুরুষের মোক্ষের জন্য কার্যে প্রবৃত্ত হয়।” (সাংখ্যকারিকা–৫৮)। এই কার্যই হলো সৃষ্টি। বস্তুত সাংখ্যদর্শনের অভিব্যক্তিবাদ সৎকার্যবাদের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তাই এই মতে উৎপত্তি নতুন কোন সৃষ্টি নয়, কেবল অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া। আবার বিনাশ কখনোই পরিপূর্ণ বিনাশ নয়, কেবল ব্যক্তের অব্যক্তে বিলীন হওয়া। সাংখ্যমতে প্রকৃতির জগৎ সৃষ্টির উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। পুরুষের ভোগ এবং পুরুষের মুক্তি। যদিও পুরুষ স্বরূপত ভোক্তা নয়, তবুও বুদ্ধি বা মহৎ স্বগত সুখ এবং দুঃখরূপ ভোগকে পুরুষে প্রতিবিম্বিত করে। এভাবে পুরুষে ভোক্তৃত্ব উৎপন্ন হয়। আবার পুরুষ এবং প্রকৃতির ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি উৎপন্ন কওে প্রকৃতি পুরুষের মুক্তিসাধন করে। অর্থাৎ প্রকৃতির সৃষ্টির ফলে পুরুষ ভোগ কওে এবং পুরুষের ভোগের ফলে পুরুষের মুক্তি বা কৈবল্য সম্ভব হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতির সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে উদ্দেশ্যমূলক বলা যায়। এই অভিব্যক্তি প্রক্রিয়া কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। অপরিণামী পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতির চব্বিশটি তত্ত্বের সাহায্যে সাংখ্য দার্শনিকরা এভাবেই জগতের অভিব্যক্তি বর্ণনা করেছেন।

সাংখ্য জ্ঞানতত্ত্ব

সাংখ্য দর্শনে মোক্ষ–উপযোগী বিবেকজ্ঞান ছাড়াও একপ্রকার ব্যবহারিক জ্ঞান স্বীকার করা হয়েছে। ঘট–পট ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ক যে জ্ঞানের দ্বারা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার নিষ্পন্ন হয়, তাকেই ব্যবহারিক জ্ঞান বলা হয়। ন্যায়–বৈশেষিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাংখ্য সম্প্রদায়ও এ বিষয়ে একমত যে, জ্ঞান মাত্রই সবিষয়ক। বিষয় বিহীন কোন জ্ঞানের অস্তিত্ব নেই। জ্ঞানের বিষয়কে বলা হয় জ্ঞেয় এবং জ্ঞানের কর্তাকে বলা হয় জ্ঞাতা। সাংখ্যমতে পুরুষই একমাত্র জ্ঞাতা হতে পারে। পুরুষ বা আত্মার বহুত্ব সাংখ্যশাস্ত্রে স্বীকৃত। পুরুষ ব্যতীত বাকি সকল তত্ত্বই অচেতন বলে প্রকৃতিজাত মহৎ ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুই অচেতন ও কেবলমাত্র জ্ঞানের বিষয় বা জ্ঞেয় হতে পারে। সাংখ্যমতে একটি জ্ঞেয়বস্তু একাধিক জ্ঞাতার দ্বারা জ্ঞাত হতে পারে। তবে একই বিষয়ের জ্ঞান যে সকলের একই রূপ হবে এমন কোন কথা নেই। একই বিষয় থেকে বিভিন্ন জ্ঞাতার বিভিন্নরূপ জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে। যেমন বলা যেতে পারে যে, সুন্দরী রমণীকে দেখে স্বামীর সুখ, সপত্নীর দুঃখ, কামুকের মোহ এবং উদাসীনের ঔদাসীন্য দেখা যায়। আবার কোন বস্তু যদি কখনো কারোর জ্ঞানের বিষয় না হয়, তাহলেও তা অস্তিত্বশীল হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেন–”অতি দূরে অথবা অতি নিকটে থাকায়, ইন্দ্রিয় আহত হওয়ায়, মনোযোগের অভাবে, সূক্ষ্মতার জন্য, ব্যবধান বা আড়াল থাকায়, (উচ্চ শক্তি দ্বারা নিম্নশক্তি) অভিভূত হওয়ায় এবং সমান বস্তুতে মিশে যাওয়ায় সৎ বস্তুর অনুপলব্ধি হয় (অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বাধা প্রাপ্ত হয়)।” (সাংখ্যকারিকা–৭)। এ কারণে, সাংখ্যমতে, কোন জ্ঞাতার উপলব্ধিতে না এলেই বিষয়কে অনস্তিত্বশীল বলা যায় না। এজন্য বিষয়কে স্বতন্ত্র বলা হয়।

সাংখ্যমতে পরিণামী প্রকৃতির প্রথম উৎপন্ন তত্ত্ব হলো মহৎ বা বুদ্ধি। প্রকৃতিজাত বুদ্ধিও প্রকৃতির ন্যায় পরিণামী ও গতিশীল। বিষয়ের সংস্পর্শে বুদ্ধির বৃত্তি হয়। ইন্দ্রিয়ার্থ–সম্বন্ধাদিকে দ্বার করে বুদ্ধিবৃত্তি বহির্গমন করে এবং ঘট–পট ইত্যাদি বিষয়াকার ধারণ করে। অর্থাৎ, যখন বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ পায় এবং ইন্দ্রিয়ের সাথে মনের সংযোগ হয় তখন বুদ্ধি বিষয়াকারে পরিণত হয়। বুদ্ধি দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছ, নির্মল ও সংকোচ–বিকাশ স্বভাব। ফলে বিষয়টি যে আকার বা প্রকারের হয়, বুদ্ধি বা চিত্ত সেই আকার বা প্রকার গ্রহণ করে। বুদ্ধির এইরূপ বিষয়াকার গ্রহণকে বলা হয় বুদ্ধিবৃত্তি। বিষয়াকারে আকারপ্রাপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিতে যখন পুরুষ প্রতিবিম্বিত হয়, তখন আমাদের ঐ বিষয়ের জ্ঞান বা উপলব্ধি হয়। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তি ও বিষয় উভয়ই জড় পদার্থ হওয়ায় চৈতন্যস্বরূপ পুরুষের প্রতিবিম্বন ব্যতীত পুরুষ বা আত্মার বোধরূপ উপলব্ধি সম্ভব নয়। তাই বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞানের করণ বা উপায় এবং পুরুষের উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞান বলা হয়। সাংখ্যকারিকার টীকাকার বাচস্পতি মিশ্র মনে করেন, কেবল বুদ্ধিতে পুরুষের প্রতিবিম্বনের ফলেই জ্ঞান উৎপন্ন হয়। কিন্তু বিজ্ঞানভিক্ষুর মতে, জ্ঞানোৎপত্তির জন্য বুদ্ধিতে যেমন পুরুষের প্রতিবিম্বন প্রয়োজন, তেমনি পুরুষের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিবিম্বন প্রয়োজন। বিজ্ঞানভিক্ষুর এই মতবাদ অন্যোন্যপ্রতিবিম্ববাদ নামে পরিচিত।.

প্রমাণ (Source of Knowledge) : যার দ্বারা যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় তাকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। আর যথার্থ জ্ঞান বা উপলব্ধি হলো প্রমা। সাংখ্যমতে বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞানের করণ বা প্রমাণ এবং পুরুষের উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃত্তিকে জ্ঞান বা প্রমা বলা হয়। এই মতে চৈতন্যের দ্বারা উদ্ভাসিত বুদ্ধিবৃদ্ধিমাত্রই প্রমাপদবাচ্য নয়। অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত ও অনধিগত বিষয়ক চিত্তবৃত্তিই প্রমাণ এবং তার উদ্ভাসিত ফল হলো প্রমা। এ বিষয়ে বাচস্পতি মিশ্র তার কৌমুদীতে বলেন–”অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত, অনধিগত বিষয়ের আকারে আকারিত চিত্তবৃত্তিকে প্রমাণ বলে। প্রমাণের পুরুষনিষ্ঠ বোধরূপ ফলই প্রমা। তার (প্রমার) সাধনই প্রমাণ।” (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী : কারিকা–৪)। সংশয়, ভ্রম বা জ্ঞাতবিষয়ের জ্ঞান সাংখ্যমতে প্রমাপদবাচ্য নয়। সংশয় হলো সন্দিগ্ধ জ্ঞান, ভ্রম হচ্ছে বিষয়–বিপরীত জ্ঞান এবং স্মৃতি হলো অধিগত বিষয়ের জ্ঞান। সংশয়, ভ্রম বা স্মৃতি যাতে প্রমাপদবাচ্য না হয়, সে কারণে অসন্দিগ্ধ, অবিপরীত ও অনধিগত বিষয়ক চিত্তবৃত্তিজন্য জ্ঞানকে প্রমা বলা হয়েছে। সাংখ্যমতে প্রমাণ ত্রিবিধ– প্রত্যক্ষণ (Perception), অনুমান (Inference) ও শব্দ বা আগম (Testimony)। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেন–”(উপমান, অর্থাপত্তি, অনুপলব্ধি ইত্যাদি) সকল প্রকার প্রমাণ দৃষ্ট, অনুমান ও আপ্তবচনের দ্বারা সিদ্ধ হওয়ায় সাংখ্যশাস্ত্রে কেবলমাত্র এই তিনপ্রকার প্রমাণ অভিলষিত, যেহেতু প্রমাণের দ্বারাই প্রমেয় সিদ্ধি হয়।” (সাংখ্যকারিকা–৪)। সাংখ্যকারিকাকার আবার এই ত্রিবিধ প্রমাণ তথা প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আপ্তবাক্য বা শব্দ প্রমাণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন–”বিষয়ের সঙ্গে সন্নিকৃষ্ট ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান দৃষ্ট বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ। লিঙ্গ ও লিঙ্গী পূর্বক অনুমান তিন প্রকার (যথা– পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট) বলা হয়। কিন্তু, (বেদবাক্য বা) ঋষিবাক্যই আপ্তবচন বা শব্দ প্রমাণ।” (সাংখ্যকারিকা–৫)।

প্রত্যক্ষ প্রমাণ (Perception) : প্রত্যক্ষকে প্রমাণ–জ্যেষ্ঠ বলা হয়, এবং তা অন্যান্য প্রমাণের উপজীব্য বলে প্রত্যক্ষণই প্রমাণগুলোর মধ্যে প্রথম প্রমাণ। বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের ফলে যে সাক্ষাৎ জ্ঞানের উদ্ভব হয়, তাকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয়। সাংখ্যকারিকাকার তাই পঞ্চম কারিকার সংশ্লিষ্ট অংশে বলেন–”বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষজনিত যে অধ্যবসায়, তাই প্রত্যক্ষজ্ঞান।” সাংখ্যমতে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও মন হলো জ্ঞানের করণ। তার মধ্যে পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় এবং বুদ্ধি, অহঙ্কার ও মন– এই ত্রিবিধ অন্তঃকরণ জ্ঞানসামান্যের কারণ। একমাত্র পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ই প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিশেষ কারণ। মন অন্তঃপ্রত্যক্ষেও বিশেষ কারণ এবং তা সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়গুলোর সঙ্গে স্ব স্ব বিষয়ের সন্নিকর্ষের ফলে তমোগুণের অভিভবপূর্বক সত্ত্বগুণের যে পরিণাম হয়, তাই প্রত্যক্ষরূপ অধ্যবসায়। প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে কেবল ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই বুদ্ধি বা চিত্ত বিষয়াকার গ্রহণ করে, কিন্তু অনুমিতি ও শাব্দবোধের ক্ষেত্রে ব্যাপ্তিজ্ঞান ও পদজ্ঞানের প্রয়োজন হয়। তবে বাচস্পতি মিশ্রের মতে ইন্দ্রিয়কে প্রত্যক্ষেও করণ বলা যায় না। তার মতে, ইন্দ্রিয়গুলো কোন কোন সময় যথার্থ জ্ঞান উৎপন্ন করলেও সব সময় তা করে না। তাই ইন্দ্রিয়গুলোকে করণ বলা যায় না। এই মতে বুদ্ধিবৃত্তিই প্রমাণ এবং ইন্দ্রিয়গুলো বুদ্ধিবৃত্তিরূপ প্রমাণের দ্বারস্বরূপ। একটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে তিনি প্রত্যক্ষের উৎপত্তিক্রম ব্যাখ্যা করেছেন। একটি বস্তু বা ঘট যখন চক্ষুরিন্দ্রিয়ের গোচর হয়, তখন বস্তুটি আমাদের চক্ষুরিন্দ্রিয়ের মধ্যে এক প্রকার ঘটাকার আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর ফলে অন্তরিন্দ্রিয় মনে সেই আলোড়ন বা সংবেদনের ব্যাখ্যারূপ একপ্রকার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। মন তখন ঐ ঘটাকারটিকে অহঙ্কারের কাছে প্রেরণ করে। অহঙ্কার সেই আকারে আকারিত হয়ে বুদ্ধিতে উপস্থিত হয়। বুদ্ধি যখন এই ঘটাকারে আকারিত হয়, তখন তাকে বলে ঘটাকার বুদ্ধিবৃত্তি। ঘটাকারে আকারিত এই বুদ্ধিবৃত্তি প্রকৃতিগতভাবে সত্ত্বগুণান্বিত এবং দর্পণের মতো অতি স্বচ্ছ। এই স্বচ্ছ বুদ্ধিবৃত্তিতে যখন পুরুষের চৈতন্য প্রতিবিম্বিত হয়, এর ফলে বুদ্ধিবৃত্তি চেতনাভাবাপন্ন হয় এবং তখনই ঘটটি প্রকাশিত হয়। ঘটটির এভাবে যথাযথ প্রকাশকেই ঘটের প্রত্যক্ষ প্রমা বলে। যে বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা এইরূপ প্রকাশ হয়, তাকে বলা হয় প্রত্যক্ষ প্রমাণ। প্রমাণ হলো বুদ্ধির অচেতন বৃত্তি এবং প্রমা ঐ বৃত্তিরই প্রকাশিত চেতন রূপ। যদিও বিজ্ঞানভিক্ষু এই মতের অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, জ্ঞান বুদ্ধিতে সম্ভব নয়, একমাত্র পুরুষেই জ্ঞান সম্ভব। সাংখ্যমতে ইন্দ্রিয়াদি করণবৃত্তি কখনো যুগপৎ, আবার কখনো ক্রমশ হয়ে থাকে। ক্রমশ বৃত্তির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়ের বৃত্তিকে আলোচন এবং পরবর্তী মনের বৃত্তিকে সংকল্প বলা হয়। বাচস্পতি মিশ্র ও বিজ্ঞানভিক্ষু আলোচন ও সংকল্প বৃত্তিকে যথাক্রমে নির্বিকল্পক ও সবিকল্পক প্রত্যক্ষ সদৃশ বলে বর্ণনা করেছেন। ন্যায়–বৈশেষিক মতে, যে প্রত্যক্ষণে বস্তুর কেবল অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হয়, তাকে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণ বলে। এই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষণে বস্তুর কোন বৈশিষ্ট্যকে জানা যায় না। অর্থাৎ বস্তুটি কী রকমের, এর জাতি বা নাম কী, সংজ্ঞা কী ইত্যাদি সম্পর্কে জানা যায় না। নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অন্যদিকে, যে প্রত্যক্ষণে বস্তুর নাম, লক্ষণ, জাতি প্রভৃতি যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ হয়, তা সবিকল্পক প্রত্যক্ষণ। সবিকল্পক প্রত্যক্ষণে বিশ্লেষণ, সাদৃশ্য, তুলনা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়াকে প্রয়োগ করে বস্তু সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান লাভ হয়। সবিকল্পক প্রত্যক্ষকে ভাষায় প্রকাশ করা যায়। সাংখ্য দর্শনে সবিকল্প প্রত্যক্ষণকে ‘বিবেচনা’ও বলা হয়।

অনুমান প্রমাণ (Inference) : অনুমান হলো ব্যাপ্তিজ্ঞান ও পক্ষধর্মতা জ্ঞানজন্য বুদ্ধিবৃত্তি। দুটি বস্তুর মধ্যে যদি নিয়ত সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তি সম্বন্ধ দেখা যায়, তবে একটিকে প্রত্যক্ষ করে অন্যটির অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়, এই জ্ঞানকে অনুমানলব্ধ জ্ঞান বলা যায়। যেমন, একটি পর্বতে ধোঁয়া বা ধূম প্রত্যক্ষ করে ধারণা করা হয় যে, সেখানে আগুন রয়েছে। যেখানে ধোঁয়া সেখানে আগুন, ধোঁয়া এবং আগুনের মধ্যে নিয়ত সম্বন্ধ আছে বলে ধোঁয়া প্রত্যক্ষ করে আগুনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হয়। সাংখ্যকারিকার পঞ্চম কারিকায় সংশ্লিষ্ট অংশে অনুমানের সামান্য লক্ষণে বলা হয়েছে–”লিঙ্গ ও লিঙ্গি পূর্বক অনুমান।”। ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ ব্যাপ্য বা হেতু। ‘লিঙ্গি’ শব্দের অর্থ ব্যাপক বা সাধ্য। ধূম বহ্নির লিঙ্গ এবং বহ্নি ধূমের লিঙ্গি। এইরূপ লিঙ্গ–লিঙ্গি বা ব্যাপ্য–ব্যাপক সম্বন্ধের পারিভাষিক নাম ব্যাপ্তি। ব্যাপ্তি স্বাভাবিক সম্বন্ধ। অর্থাৎ ব্যাপ্তি সম্বন্ধ উপাধিরহিত বা অনৌপাধিক। যাদের মধ্যে শর্ত বা উপাধি থাকে, তাদেও সম্বন্ধকে স্বাভাবিক বলা যায় না। ধূমের সঙ্গে বহ্নি বা আগুনের সম্বন্ধ উপাধিশূন্য, মানে এখানে কোন শর্ত নেই। ধূম থাকলে সেখানে আগুন থাকবেই। কিন্তু বহ্নির সঙ্গে ধূমের সম্বন্ধ আর্দ–ইন্ধন উপাধিযুক্ত। মানে, আগুন থাকলেই সেখানে ধূম থাকবে না, যদি না কোন ভেজা জ্বালানি থাকে। অগ্নিতপ্ত গলন্ত লোহার আগুনে কোন ধূম থাকে না, ভেজা জ্বালানি না থাকায়। অর্থাৎ যে অগ্নি সেখানে ধূম থাকবে যদি সেখানে ভেজা জ্বালানি থাকার শর্ত বা উপাধি যুক্ত হয়। তাই ধূম ও বহ্নির মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ থাকে। কিন্তু বহ্নি ও ধূমের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ থাকে না। এই কারণে ধূম থেকে আগুনের অনুমান হয়, কিন্তু আগুন থেকে ধূমের অনুমান হয় না। ন্যায়মতের অনুরূপ সাংখ্যমতেও অনুমান ত্রিবিধ– পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট। অনুমানের ব্যাপ্তি যখন কার্য–কারণ সম্বন্ধের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় তখন আমরা যেমন কারণ থেকে কার্যকে অনুমান করতে পারি, তেমনি কার্য থেকে কারণকেও অনুমান করতে পারি। প্রথম প্রকার অনুমানকে বলা হয় পূর্ববৎ এবং দ্বিতীয় প্রকার অনুমানকে বলা হয় শেষবৎ। প্রচণ্ড খরা দেখে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষেও অনুমান হলো পূর্ববৎ অনুমানের দৃষ্টান্ত। আবার নদীর জলের মলিনতা ও খরস্রোত দেখে অতীত বৃষ্টির অনুমান হলো শেষবৎ অনুমানের দৃষ্টান্ত। যে অনুমানের ব্যাপ্তি কার্য–কারণ সম্বন্ধের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় না, বা যে অনুমানের হেতু ও সাধ্য কার্য–কারণ সম্বন্ধে সংবদ্ধ নয়, কেবল সাদৃশ্যের উপর ভিত্তি করে অনুমানটি গড়ে ওঠে, সেই অনুমানকে বলা হয় সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান। বিভিন্ন সময়ে গ্রহাদির অবস্থান বিভিন্ন স্থানে বা দেশে পর্যবেক্ষণ করে আমরা যখন গ্রহাদিও গতির অনুমান করি, তখন সেই অনুমানকে বলা হয় সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান। একটি বস্তুর বিভিন্ন স্থানে অবস্থানের সঙ্গে ঐ বস্তুর গতির কোন কার্য–কারণ সম্বন্ধ নেই। কিন্তু দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আমরা গতিশীল বস্তুকে বিভিন্ন স্থানে দেখে থাকি এবং এই অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা গ্রহাদিও বিভিন্ন স্থানে অবস্থান দেখে অনুমান করি যে গ্রহাদি গতিশীল। এটাই সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান। পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট– এই ত্রিবিধ অনুমানকে সাংখ্যাচার্যরা আবার বীত ও অবীত ভেদে দুইভাগে ভাগ করেছেন। যে অনুমান হেতু ও সাধ্যেও অন্বয় সাহচর্যের ভিত্তিতে ভাবরূপে সাধ্যের সাধন করে, অর্থাৎ সদর্থক সামান্য বাক্যকে অবলম্বন করে যে অনুমান গড়ে ওঠে তাকে ‘বীত’ অনুমান বলা হয়। অপরদিকে নঞর্থক সামান্য বাক্যকে অনুমান করে যে অনুমান গড়ে ওঠে, অর্থাৎ যে অনুমান হেতু ও সাধ্যের ব্যতিরেক সাহচর্যেও ভিত্তিতে সাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়, কিন্তু কারোর বিধায়ক না হয়ে প্রতিষেধক হয় তাকে ‘অবীত’ অনুমান বলে। পূর্ববৎ ও সামান্যতোদৃষ্ট অনুমান হলো বীত অনুমান। অন্যদিকে শেষবৎ অনুমান হলো অবীত অনুমান।

শব্দ বা আগম প্রমাণ (Testimony) : সাংখ্যসম্মত তৃতীয় প্রকার প্রমাণ হলো শব্দ, আগম বা আপ্তবাক্য। যে সমস্ত বিষয় বা বস্তুকে প্রত্যক্ষ বা অনুমানের সাহায্যে জানা যায় না, তাদেরকে শব্দ প্রমাণের সাহায্যে জানা যায়। এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেন–”সামান্যতোদৃষ্ট অনুমানের দ্বারা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের অতীত (প্রকৃতি, পুরুষাদি) তত্ত্বের জ্ঞান হয়। সামান্যতোদৃষ্ট এবং শেষবৎ অনুমানের দ্বারা অতীন্দ্রিয় কোন তত্ত্ব অসিদ্ধ হলে সেই অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব আপ্তবচনরূপ আগম বা শব্দ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ হয়।” (সাংখ্যকারিকা–৬)। যথার্থ জ্ঞান লাভ করতে হলে শব্দ বা আপ্তবাক্যেল অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে হবে। আপ্তবাক্য হলো বিশ্বস্ত ব্যক্তির উপদেশ। যে ব্যক্তি ভ্রম–বিপ্রলিপ্সাদি দোষমুক্ত, তিনিই আপ্ত। এরকম আপ্তব্যক্তির উপদেশ হলো শব্দ প্রমাণ। বলাই বাহুল্য যে, উপদেশজন্য জ্ঞানের পক্ষে একদিকে বাক্যের পদজ্ঞান এবং অপরদিকে আকাক্সক্ষা, যোগ্যতা, সন্নিধি ও তাৎপর্য, বাক্যান্তর্গত এই চার প্রকার সম্বন্ধের জ্ঞান প্রয়োজন। সুতরাং যে বুদ্ধিবৃত্তি এই সকল জ্ঞানসাপেক্ষ প্রমার করণ হয়, তাই শব্দ প্রমাণ। ন্যায় সম্প্রদায়ের অনুরূপ সাংখ্যমতেও শব্দ প্রমাণ দু’প্রকার–লৌকিক ও বৈদিক। লৌকিক শব্দ হলো বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বাসযোগ্য লোকের বচন। লৌকিক শব্দ প্রত্যক্ষণ ও অনুমানের সাহায্যেও লাভ করা যায়। সাংখ্য দার্শনিকরা লৌকিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে মনে করেন না, কিন্তু বৈদিক শব্দকে স্বতন্ত্র প্রমাণ মানেন। বৈদিক শব্দ হলো বেদের বচন। বেদ, দেবতা, স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য প্রভৃতি প্রত্যক্ষের অতীত এবং অনুমানের অগম্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। বৈদিক শব্দ কোন মানুষের কৃত নয়। মানুষের কৃত নয় বলে মানুষ যে জাতীয় ভুল করে সে জাতীয় ভুল বেদে থাকতে পারে না। সত্যদ্রষ্টা ঋষিদেও অভিজ্ঞতাকেই বেদে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই বৈদিক শব্দ অভ্রান্ত ও স্বতঃপ্রমাণ।

যোগ দর্শন

ভূমিকা

ভারতীয় আধ্যাত্মদর্শনে অন্যতম প্রভাবশালী দর্শন হলো যোগ দর্শন। মহর্ষি পতঞ্জলি এই দর্শনের সূত্রকার। ‘যোগসূত্র’ বা ‘পাতঞ্জলসূত্র’ই এই দর্শনের মূল বা সূত্রগ্রন্থ। পতঞ্জলির নাম অনুসারে এই দর্শনকে পাতঞ্জল দর্শনও বলা হয়। দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্য ও যোগ দর্শনের মধ্যে প্রভেদ খুবই সামান্য। তাই এ দুটোকে পরস্পর সমানতন্ত্র দর্শন বলা হয়। মহর্ষি কপিলের সাংখ্য দর্শনে স্বীকৃত পঞ্চবিংশতি তত্ত্বে কোন ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় নি। সাংখ্যের পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব বা পঁচিশ প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- (১) জ্ঞ বা পুরুষ, (২) অব্যক্ত বা মূলপ্রকৃতি বা প্রধান, (৩) মহৎ বা বুদ্ধি, (৪) অহংকার, (৫) মনস্ বা মন (৬) পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক- এই পাঁচটি), (৭) পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ- এই পাঁচটি), (৮) পঞ্চতন্মাত্র বা পঞ্চসূক্ষ্মভূত (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ- এই পাঁচটি), (৯) পঞ্চস্থূলভূত বা পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ্ বা জল, তেজ বা অগ্নি, মরুৎ বা বায়ু, আকাশ বা ব্যোম্- এই পাঁচটি)। অন্যদিকে পতঞ্জলির যোগ দর্শনে সাংখ্যের পঁচিশটি তত্ত্বের সাথে অতিরিক্ত একটি তত্ত্ব ঈশ্বরতত্ত্ব যুক্ত করে ঈশ্বর স্বীকৃত হয়েছে বলে নিরীশ্বর-সাংখ্যের বিপরীতে যোগ দর্শনকে ‘সেশ্বর-সাংখ্য’ও বলা হয়ে থাকে।

প্রাচীন ভারতে ‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’ এই দুটি ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ের নাম প্রায় সম অর্থে ব্যবহৃত হতো। তাই যোগ-সম্প্রদায়ের এই ঈশ্বর-স্বীকৃতির ইতিহাস ঠিক কতোটা প্রাচীন- তা নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও, প্রাচীন উপনিষদ পুরাণ ইত্যাদিতে যোগ ও যোগানুষ্ঠান বিধানের উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়া প্রাচীন সাহিত্য ও শাস্ত্র গ্রন্থগুলোতে যথা- মহাভারত, গীতা ইত্যাদিতে এই দুই সম্প্রদায়কে এক বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে – “অজ্ঞ ব্যক্তিগণ সাংখ্য ও যোগকে পরস্পরবিরুদ্ধ ও ভিন্ন-ফল-বিশিষ্ট বলে থাকেন, কিন্তু আত্মজ্ঞানীগণ তা বলেন না। কারণ উভয়ের ফল এক মোক্ষ। সেজন্য একটি সম্যক্ রূপে অনুষ্ঠিত হলে উভয়ের ফল মোক্ষ লাভ হয়। সাংখ্য যার অধিগম্য, যোগও তার অধিগম্য। সাংখ্য ও যোগের ফল একই মোক্ষ বলে উভয়কে যিনি অভিন্ন দেখেন, তিনিই যথার্থদর্শী, সম্যক্ জ্ঞানী।” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ৫/৪-৫)। তবে সেসব শাস্ত্রগ্রন্থে দুটোকে এক বলা হলেও, দর্শন-সম্প্রদায়গত আলোচিত তত্ত্বের গুরুত্ব অনুযায়ী ভারতীয় দর্শন জগতে এ দুটি পৃথক সম্প্রদায়, দুটি পৃথক প্রস্থান। কেননা দুই সম্প্রদায়ের ভিত্তি এক হলেও এদের ব্যবহারিক প্রয়োগ ভিন্ন। তাই মোক্ষশাস্ত্রেও বলা হয় – “সাংখ্যতত্ত্বের তুল্য জ্ঞান নেই, যোগের তুল্য বল বা শক্তি নেই।”

যে দর্শন কেবল তত্ত্ব-নিদিধ্যাসন এবং বৈরাগ্য-অভাসের দ্বারা আত্মসাক্ষাৎকারে বিশ্বাসী, তাকে সাংখ্য এবং যে দর্শন তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বর-প্রণিধানরূপ ক্রিয়ার সাহায্যে আত্মসাক্ষাৎকারে বিশ্বাসী, তাকে যোগ বলা হয়। সাংখ্য বর্ণিত পুরুষতত্ত্ব, প্রকৃতিতত্ত্ব, জগৎ পরিণাম, সৎকার্যবাদ এবং মোক্ষ এসব যোগসম্মত। তবে কৈবল্যলাভের উপায় সম্পর্কে যোগ দর্শনে সাংখ্যের অতিরিক্ত কিছু নির্দেশ আছে। সাংখ্য দর্শনে বিবেকজ্ঞানকেই ত্রিবিধ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি এবং কৈবল্যলাভের উপায় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে যোগ দর্শনে বিবেকজ্ঞান লাভ ও কৈবল্য প্রাপ্তির জন্য অতিরিক্ত কিছু প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলোকে এককথায় ‘যোগ’ বলা হয়। যোগশাস্ত্র মতে এই যোগ-ই তত্ত্বজ্ঞান লাভ এবং দুঃখ-নিবৃত্তির প্রধান উপায়। যোগের দ্বারাই পুরুষ বা আত্মা স্ব-স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে। এই মতে ঈশ্বর-প্রণিধান পুরুষের প্রত্যক্ষলব্ধ অভিজ্ঞতা। তাই সাংখ্য দর্শনকে তত্ত্বমূলক দর্শন এবং যোগ দর্শনকে প্রয়োগমূলক দর্শন বলা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও জগতের বিবর্তন, ভ্রমের ব্যাখ্যা, মোক্ষের স্বরূপ এবং ঈশ্বর-কর্তৃত্বের বিষয়ে সাংখ্য ও যোগের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সাংখ্য-পরিণামবাদ হলো অচেতন উদ্দেশ্যবাদ, কিন্তু যোগ-পরিণামবাদ হলো সচেতন উদ্দেশ্যবাদ। যোগমতে ঈশ্বরই যেহেতু বিবর্তন-প্রক্রিয়ার কর্তা, তাই জগতের বিবর্তন কখনোই অচেতন হতে পারে না। মোটকথা, পতঞ্জলি তার যোগসূত্রে জগৎ বহির্ভূত যে অতিরিক্ত ঈশ্বরতত্ত্ব স্বীকার করেছেন, তার ফলে জগতের অভিব্যক্তি, কল্পান্তে প্রলয় ও তার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যোগমত, সাংখ্যমত থেকে ভিন্ন হয়ে পড়েছে।

কিন্তু এই ভিন্নতা সত্ত্বেও দার্শনিক তত্ত্বের দিক থেকে সাংখ্য ও যোগ প্রায় অভিন্ন হওয়ায় সুপ্রাচীন কাল থেকে প্রকৃত বেদপন্থী দার্শনিকেরা যে বিবেচনায় নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যকে একান্তভাবেই বেদ-বিরোধী বলে চিহ্নিত করেন, সেই একই বিবেচনায় যোগকেও তাই বেদ-পন্থী বলে স্বীকার করার খুব সুযোগ থাকে না। এবং তা যে ছিলোও না, দার্শনিক সাহিত্যে এর নমুনা বিরল নয়। ব্রহ্মবাদী দার্শনিক বাদরায়ণ তার ব্রহ্মসূত্রে ব্রহ্মবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বেদ বা শ্রুতি-বিরোধী সাংখ্যমত খণ্ডনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় সাংখ্য-খণ্ডনের ফলে যে যোগ-দর্শনও খণ্ডিত হয় তা প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে একটি সূত্র রচনা করেছিলেন – “এর দ্বারা যোগদর্শনকেও খণ্ডন করা হলো।” (ব্রহ্মসূত্র : ২/১/৩)। এই সূত্রটির ভাষ্যে প্রখ্যাত অদ্বৈতবাদী বেদান্ত দার্শনিক শংকারাচার্যের বক্তব্য প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অভিমতটিও প্রাসঙ্গিক – ‘তত্রাপি শ্রুতিবিরোধেন প্রধানং স্বতন্ত্রমেব কারণং মহদাদীনি চ কার্যানি অ-লোকবেদ প্রসিদ্ধানি কল্পান্তে’। অর্থাৎ, যোগদর্শনেও শ্রুতি বিরুদ্ধ–বস্তুত লোকপ্রসিদ্ধি বিরুদ্ধ এবং বেদ-বিরুদ্ধও–প্রধান বা প্রকৃতির এবং প্রধানোৎপন্ন মহত্তত্ত্ব প্রভৃতির (সাংখ্যসম্মত) উপদেশ আছে। এই কারণেই যোগের প্রত্যাখ্যান প্রয়োজন। শংকর প্রশ্ন তুলেছেন, সাংখ্য-প্রত্যাখ্যানের ফলে যোগও যদি প্রত্যাখ্যাত হয় তাহলে এই অতিদেশ-সূত্রটির অবতারণা কেন? উত্তরে তিনি বলছেন, প্রয়োজন এই যে শ্রুতিতে সম্যক-দর্শনের-উদ্ভব-উপায় হিসেবে–অর্থাৎ সাধনপদ্ধতি অর্থে–যোগের প্রশংসা আছে; কিন্তু তা থেকেই কেউ যেন কল্পনা না করেন যে যোগের দার্শনিক তত্ত্বও শ্রুতি-সমর্থিত। প্রসঙ্গত, যোগদর্শনের বেদ-বিরুদ্ধতা বিষয়ে শংকরের সঙ্গে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী বেদান্ত দার্শনিক রামানুজ সম্পূর্ণ একমত। যোগ-দর্শন স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যাখ্যান করবার প্রয়োজন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি স্পষ্টই ‘অবৈদিকত্বাৎ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।- (ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৬)।

বৈদিক সংস্কৃতিতে যোগ-সাধনার অন্তর্ভুক্তি এবং একইসাথে দর্শনতত্ত্বে যোগদর্শন বেদবিরোধী হওয়ার এই স্ববিরোধী বিষয়টির একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আর্যপূর্ব সিন্ধু-সভ্যতার ধ্বংসস্তুপ থেকেই অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনা হিসেবে যোগসাধনার প্রাচীনতম মূর্ত নিদর্শন পাওয়ায়। প্রাচীন সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আধুনিক বিদ্বানদের ধারণা, অবধারিতভাবেই সিন্ধু-সভ্যতা বেদপূর্ব। যোগ-সাধনার আদিপর্ব থেকেই যদি তার সঙ্গে সাংখ্য-তত্ত্বের সম্পর্ক থাকে এবং সুপ্রাচীন সিন্ধু-যুগেই যদি যোগ-সাধনার অবধারিত প্রমাণ পাওয়া যায় তা হলে সেই যুগ থেকেই সাংখ্য-তত্ত্বের সূত্রপাত অনুমিত হতে পারে। আগন্তুক আর্যরা সেই সিন্ধু-অধিবাসীদের কাছ থেকেই এই সাধন-পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো। যা পরবর্তীকালের বেদনিষ্ঠ সাধন-পদ্ধতিতে যুক্ত হয়ে গেছে।

যোগ সাহিত্য ও যোগ শাস্ত্র

যোগ দর্শনের উপর বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তবে মূল গ্রন্থ হচ্ছে মহর্ষি পতঞ্জলির ‘যোগসূত্র’ বা ‘পাতঞ্জলসূত্র’। মহর্ষি বেদব্যাস যোগসূত্রের উপর অনবদ্য ভাষ্যগ্রন্থ ‘যোগভাষ্য’ রচনা করেন। অনেকের মতে যোগভাষ্য হচ্ছে যোগশাস্ত্রের উপর রচিত প্রাচীনতম ভাষ্যগ্রন্থ। এটিকে ব্যাসভাষ্যও বলা হয়। ব্যাসভাষ্যের উপর রচিত দুটি প্রামাণ্যটীকা গ্রন্থ হলো বাচস্পতি মিশ্রের ‘তত্ত্ববৈশারদী’ এবং বিজ্ঞানভিক্ষুর ‘যোগবার্তিক’। যোগবার্তিক ছাড়া যোগশাস্ত্রের উপর রচিত বিজ্ঞানভিক্ষুর অন্যান্য তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘যোগসার সংগ্রহ’ ও ‘ভোজরাতকৃত বৃত্তি’ প্রভৃতি। ভোগরাজের ‘যোগবৃত্তি’ ও রামানন্দ সরস্বতীর ‘যোগমণিপ্রভা’ যোগ দর্শনের উপর দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া রাঘবানন্দের ‘পাতঞ্জলরহস্য’, অনন্তের ‘যোগচন্দ্রিকা’, আনন্দশিষ্যের ‘যোগসুধাকর’, উদয়শংকরের ‘যোগবৃত্তিসংগ্রহ’, উমাপতি ত্রিপাঠীর ‘যোগসূত্রবৃত্তি’, গণেশ দীক্ষিতের ‘পাতঞ্জলবৃত্তি’, জ্ঞানানন্দের ‘যোগসূত্রবিবৃতি’, হরিহরানন্দ আরণ্য ও ধর্মমেঘ আরণ্যের ‘ভাস্বতী’ প্রভৃতি যোগ দর্শনের উপর রচিত মূল্যবান গ্রন্থরাজি।

যোগশাস্ত্র মতে ‘আত্মার বন্ধন বিবেকজ্ঞান দ্বারা মুক্তি সম্ভব’ এবং যোগ সাধনার দ্বারা বিবেকজ্ঞান লাভ হয়। এ জন্য যোগ দর্শন যোগ সাধনার পদ্ধতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। বলা হয়, আত্মশুদ্ধির জন্য যোগ দর্শনের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া খুবই সহায়ক। মহর্ষির যোগসূত্র বা পাতঞ্জলসূত্রে যোগ দর্শনের উপর মোট ১৯৪টি সূত্র রয়েছে। এই সূত্রগুলোকে কোন অধ্যায়ে বিভক্ত না করে চারটি পরিচ্ছদ বা পাদে বিভক্ত করা হয়েছে। এই চারটি পাদ হলো- (১) সমাধিপাদ, (২) সাধনপাদ, (৩) বিভূতিপাদ এবং (৪) কৈবল্যপাদ। সমাধিপাদে ৫১টি, সাধনপাদে ৫৫টি, বিভূতিপাদে ৫৪টি এবং কৈবল্যপাদে ৩৪টি সূত্র আছে। যোগশাস্ত্র চারটি অঙ্গবিশিষ্ট- হেয়, হেয়হেতু, হান ও হানোপায়। হেয় হলো সংসার, হেয়-হেতু হলো সংসার হেতু। এখানে হেতু বলতে প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ বোঝায়। হান হলো মোক্ষ বা কৈবল্য এবং হানোপায় হলো মোক্ষের বা কৈবল্যের উপায়। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে – “সংসার দুঃখময় বলে তা পরিত্যাজ্য। পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ হলো হেয়-হেতু বা দুঃখের কারণ।” (যোগসূত্র : সাধনপাদ-১৬-১৭), “পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগাভাব হলো হান বা কৈবল্য। পুরুষ ও প্রকৃতির ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হলো কৈবল্যলাভের উপায় বা হানোপায়।” (যোগসূত্র : সাধনপাদ-২৫-২৬)।

পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে যোগের লক্ষণ বর্ণনা করা হয়েছে। এজন্য সমাধিপাদকে যোগপাদও বলা হয়। যোগের লক্ষণ, প্রকারভেদ, প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, চিত্তভূমির প্রকারভেদ, প্রমাণের লক্ষণ ও প্রকারভেদ, ঈশ্বরের লক্ষণ, ঈশ্বরপ্রণিধানের ফল, চিত্তবৃত্তি নিরোধের উপায় প্রভৃতি এই পাদে আলোচিত হয়েছে। সাধনপাদে প্রধানত ক্রিয়াযোগের কথা আলোচিত হয়েছে। যোগের জন্য যে সব ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় তাদের পরিচয়, আবশ্যিকতা ও ফল এবং এছাড়াও অবিদ্যার লক্ষণ, কর্মফল, দুঃখের হেতু এবং দুঃখ-নিবৃত্তির উপায় এই পাদে আলোচিত হয়েছে। বিভূতিপাদ প্রধাণত যোগলব্ধ অলৌকিক শক্তির বর্ণনা। এর সাথে ধারণার লক্ষণ, ধ্যানের লক্ষণ, সমাধির লক্ষণ, সংযম সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এবং বিবেকজ্ঞান আলোচিত হয়েছে। আর কৈবল্যপাদে রয়েছে মোক্ষের স্বরূপ, মোক্ষের প্রকারভেদ, পরলোক প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা।

শুধু যোগদর্শনই নয়, আত্মসাক্ষাৎকারের উপায়রূপে যোগের প্রয়োজনীয়তা চার্বাক ব্যতীত বাকি সব ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ই স্বীকার করেন। বেদ, উপনিষদ, স্মৃতি এবং পুরাণেও যোগের প্রয়োজন স্বীকৃত হয়েছে। আত্মশুদ্ধির প্রশস্ত পথ হলো যোগসাধনা। এই মতে, যোগসাধনা দেহ ও মনকে শুদ্ধ করে এবং আত্মসাক্ষাৎকারের যথাযোগ্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ‘যুজ্’ ধাতুর সঙ্গে ‘ঘঞ্’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘যোগ’ শব্দ নিষ্পন্ন হয়। ‘যুজ্’ ধাতুর বিবিধ অর্থ হয়, যেমন- সংযোগ, সমাধি প্রভৃতি। তাই ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘যোগ’ শব্দটির অর্থ করা হয় জীবাত্মা ও পরমাত্মার সংযোগ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও শ্রীকৃষ্ণ অর্জুণকে বিভিন্নভাবে যোগের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক জায়গায় তিনি যোগের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন – “নিষ্কাম কর্মযোগী ঐহিক জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় হতে মুক্ত হন। সুতরাং তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান করো। কর্মের কৌশলই যোগ।” (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : ২/৫০)। এখানে কর্মের কৌশলকেই যোগ বলা হচ্ছে – “কোনও কাজে নৈপুণ্য অর্জনের নাম যোগ।” অতএব, কী কৌশলের দ্বারা, কোন্ জ্ঞানার্জনের দ্বারা বা কোন্ সাধনার দ্বারা মনের বশ্যতা-জাল থেকে মুক্ত হওয়া যায়, তা-ই যোগ দর্শনের প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। এক্ষেত্রে যোগসূত্রকার মহর্ষি পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন – “চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ।” (যোগসূত্র)। যোগের এই লক্ষণ বা সংজ্ঞা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিত্ত কী, তার বৃত্তিই বা কী এবং তার প্রকারভেদ, কীভাবে চিত্তবৃত্তির নিরোধ করা যায়, ইত্যাদি বিবিধ প্রশ্ন যোগশাস্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর চিত্তবৃত্তি-নিরোধের জন্যই চিত্তশুদ্ধি, সংযম ও ধ্যানের আলোচনা এই শাস্ত্রে গুরুত্ব পেয়েছে।

যোগ মনস্তত্ত্ব

চিত্ত : মহর্ষি পতঞ্জলির মতে চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ। অতএব প্রশ্ন ওঠে, চিত্ত কী? মহর্ষি পতঞ্জলি ও ভাষ্যকার ব্যাসদেব বিভিন্ন স্থলে বুদ্ধি ও মনকে চিত্ত বলেছেন। মূলত পাতঞ্জল দর্শনে প্রকৃতির কিছু বিকারকে একত্রে চিত্ত শব্দের অভিধেয় বলে গণ্য করা হয়। সাংখ্যমতে ত্রিগুণময়ী প্রকৃতির প্রথম বিকার হলো মহৎ। মহতের বিকার বুদ্ধি এবং বুদ্ধির বিকার অহংকার। আর অহংকারের অন্যতম বিকার হলো মন। এগুলোকে একসঙ্গে সাংখ্য দর্শনে চিত্ত বলা হয়। সাংখ্যের এই মত যোগ দর্শনেও স্বীকৃত হয়েছে। সুতরাং যোগসম্মত চিত্ত সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণময়ী। স্বাভাবিকভাবেই চিত্ত জড় ও অচেতন। তবে চিত্ত ত্রিগুণময়ী হলেও তাতে কালবিশেষে সত্ত্বগুণের আধিক্য থাকে। সত্ত্বের আধিক্যবশত পুরুষের সান্নিধ্যে পুরুষের চৈতন্য চিত্তে প্রতিবিম্বিত হয়। এর ফলে চিত্তকেও তখন চেতন বলে মনে হয়। বলাবাহুল্য, চিত্তে সর্বদা সত্ত্বের আধিক্য থাকে না। সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের তুলনামূলক আধিক্যে যোগ দর্শনে পাঁচপ্রকার চিত্তভূমি স্বীকার করা হয়।

চিত্তভূমি : সাধারণত চিত্তের ভূমি বা অবস্থাকে বলে চিত্তভূমি। কিন্তু যোগমতে চিত্তের সহজ ও স্বাভাবিক অবস্থাই হলো চিত্তভূমি- “(চিত্তভূমি) চিত্তের সহজ অবস্থা।” চিত্তভূমি বা চিত্তের স্বাভাবিক অবস্থা পাঁচ প্রকার- (১) ক্ষিপ্ত, (২) মূঢ়, (৩) বিক্ষিপ্ত, (৪) একাগ্র ও (৫) নিরুদ্ধ।

  • ক্ষিপ্তভূমি : যে ভূমিতে চিত্ত স্বভাবতই অত্যন্ত অস্থির, তাকেই ক্ষিপ্ত বলা হয়। ক্ষিপ্ত অবস্থায় চিত্ত রজঃ ও তমোগুণের প্রভাবে বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ধাবিত হয়। কোন বিষয়ের প্রতিই স্থিরভাবে আকৃষ্ট হয় না বলে অতীন্দ্রিয় বিষয়ে চিন্তা করার মতো স্থৈর্য বা ধীশক্তি থাকে না। চিত্তের এই অবস্থা এতো বলবান যে, সাধারণ মানুষ এর প্রভাবে পাগলের মতো বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে বিচরণ করে। চিত্তের এই ক্ষিপ্ত অবস্থা যোগ সাধনার উপযোগী নয়।
  • মূঢ়ভূমি : প্রবল রাগ ও মোহের বশীভূত চিত্তের যে মুগ্ধ অবস্থা, তাই মূঢ়ভূমি। মূঢ় অবস্থায় তমোগুণের প্রাধান্যহেতু ইন্দ্রিয়বিষয়ে অতি মুগ্ধ চিত্ত ভালো-মন্দ বিচার করতে সমর্থ হয় না। মোহাচ্ছন্ন চিত্তে নিষ্ক্রিয়তা, আলস্য, তন্দ্রা রাজত্ব করে। চিত্তের এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা তত্ত্বচিন্তায় অক্ষম বলে এ অবস্থা যোগ সাধনার অনুপযোগী।
  • বিক্ষিপ্তভূমি : চিত্তের তৃতীয় ভূমি হলো বিক্ষিপ্ত। এই অবস্থা ক্ষিপ্ত অবস্থা সদৃশ হলেও তা থেকে কিঞ্চিৎ উন্নত। বিক্ষিপ্ত চিত্তের সাথে ক্ষিপ্তের ভেদ হলো, ক্ষিপ্ত চিত্ত সর্বদাই অস্থির এবং চঞ্চল থাকে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত চিত্ত কোন কোন সময়ে স্থির, আবার কোন কোন সময়ে চঞ্চল। ক্ষিপ্ত ও মূঢ় চিত্ত তত্ত্বচিন্তায় সম্পূর্ণ অক্ষম। এ কারণে তাদের সমাধি হতেই পারে না। কিন্তু বিক্ষিপ্ত চিত্ত সাময়িকভাবে কোন বিষয়ে নিবিষ্ট হয়ে তত্ত্ববিষয়ক জ্ঞানে চিত্তের আগ্রহ দেখা গেলেও তা স্থায়ী হয় না। বিক্ষিপ্ত অবস্থায় চিত্ত তমোগুণের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়, কিন্তু রজঃ-এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। তাই বিক্ষিপ্ত অবস্থায়ও যোগ সম্ভব নয়।
  • একাগ্রভূমি : যে চিত্তের অগ্র বা অবলম্বন এক তাই একাগ্র চিত্ত। একাগ্র অবস্থায় চিত্ত তমের প্রভাবের সঙ্গে রজের প্রভাব থেকেও সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। এ অবস্থায় সত্ত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটে। একাগ্রভূমিতে চিত্ত কোন একটি বিশেষ বিষয়ে নিবিষ্ট থাকে অর্থাৎ চিত্ত একটিমাত্র বিষয়ের আকারে আকারিত হয়ে স্থির ও অচঞ্চলভাবে অবস্থান করে। এ অবস্থায় চিত্তের অনেক বৃত্তির নিরোধ হলেও সব বৃত্তির নিরোধ হয় না। তা সত্ত্বেও চিত্তের একাগ্র অবস্থা যোগানুকূল। বস্তুত এই অবস্থায় চিত্ত সমাধিস্থ হয় এবং এই সমাধিকে বলা হয় সম্প্রজ্ঞাত সমাধি।
  • নিরুদ্ধভূমি : চিত্তের পঞ্চম তথা শেষভূমির নাম নিরুদ্ধ। এই অবস্থায় চিত্তের সর্বপ্রকার বৃত্তি নিরুদ্ধ হয়। এই স্তরে চিত্ত শান্ত ও সমাহিত। যখন অভ্যাসের দ্বারা চিত্তের সকল বৃত্তিই নিরুদ্ধ করে চিত্তকে সম্পূর্ণ স্থির রাখা হয়, তখন চিত্তের নিরুদ্ধভূমিক অবস্থা হয়। এ অবস্থায় চিত্তের কোন অবলম্বন থাকে না। এ অবস্থা সম্পর্কে যোগসূত্রে বলা হয়েছে – “অবলম্বনহীন এই চিত্তভূমিতে পুরুষ স্বরূপে অবস্থান করে।” (যোগসূত্র : ১/৩)। 

পাতঞ্জল শাস্ত্রে ‘যোগ’ বলতে এইরূপ চিত্তবৃত্তি নিরোধকেই বোঝানো হয়। এ অবস্থায় চিত্তবৃত্তি সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ হলেও দেহের কোন বিকার হয় না। কারণ দেহে তখন আত্মা অবস্থান করে। যোগ সম্প্রদায়ের মতে যোগীর এই অবস্থা প্রমাণ করে যে, আত্মা চিত্ত থেকে ভিন্ন। তাদের মতে আত্মা চিত্ত থেকে ভিন্ন না হলে চিত্তের নিরোধে দেহের বিনাশ হতো। চিত্তবৃত্তির নিরোধে আত্মার যে অবস্থান, তা-ই আত্মার স্বরূপে অবস্থান। এ অবস্থাতেই চিত্ত কৈবল্যলাভে অর্থাৎ মুক্তিলাভে সক্ষম হয়। এ অবস্থায় যে সমাধি হয়, তাকে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়।

চিত্তবৃত্তি : বৃত্তি হলো পরিণাম। সুতরাং চিত্তবৃত্তি হলো চিত্তের পরিণাম। বলা হয় – “বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হওয়ার ফলে চিত্তের যে বিষয়াকারে পরিণতি, তাই চিত্তের বৃত্তি।” সাংখ্য-যোগমতে গলিত ধাতু যে পাত্রে ঢালা হয়, ধাতু যেরূপ সেই পাত্রের আকার ধারণ করে, সেরূপ জীবের চিত্তের সঙ্গে যখন কোন বস্তুর সংযোগ ঘটে, তখন চিত্ত সেরূপ বস্তুর আকার ধারণ করে। বিষয়ের সঙ্গে সংযোগের ফলে চিত্তের এই বিষয়াকার প্রাপ্তিই হলো চিত্তবৃত্তি। সাধারণভাবে এই বৃত্তিকেই জ্ঞান বলা হয়। চিত্তের এই বিকার বা বৃত্তির মাধ্যমে আত্মার বিষয়জ্ঞান হয়ে থাকে। আত্মা স্বরূপত মুক্ত, শুদ্ধ এবং আত্মার কোন বিকার বা পরিণাম নেই। কিন্তু গতিশীল তরঙ্গে চন্দ্র প্রতিফলিত হলে চন্দ্রকে যেমন গতিশীল মনে হয়, তেমনি আত্মা চিত্তে প্রতিফলিত হলে আত্মাকেও পরিণামী মনে হয়। চিত্তের বৃত্তি হলো জ্ঞানরূপ অবস্থাগুলো। যোগশাস্ত্রের পরিভাষায় পরিদৃষ্ট চিত্তভাব বা বোধসমূহকেই বৃত্তি বলা হয়। এই বৃত্তিগুলো প্রাথমিকভাবে ক্লিষ্ট ও অক্লিষ্ট ভেদে দ্বিবিধ। যে বৃত্তি কর্মসংস্কার সমূহের দ্বারা ক্লিষ্ট, তাকে ক্লিষ্টবৃত্তি বলে। যে বৃত্তির মূলে বিবেকজ্ঞান থাকে, তাকে বলে অক্লিষ্টবৃত্তি। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা অবিদ্যার নাশ হয়। বিবেকজ্ঞানের দ্বারা অবিদ্যা নষ্ট হলে যে বিবেকখ্যাতিরূপ বৃত্তি উৎপন্ন হয়, তা মুখ্য অক্লিষ্টবৃত্তি। যোগমতে ক্লিষ্ট বৃত্তির ছিদ্রে অক্লিষ্ট বৃত্তি এবং অক্লিষ্ট বৃত্তির ছিদ্রে ক্লিষ্ট বৃত্তি উৎপন্ন হয়। ক্লেশ থেকেই ক্লিষ্ট শব্দের উৎপত্তি। ক্লিষ্ট মানে ক্লেশপ্রাপ্ত। যোগমতে ক্লেশ পাঁচ প্রকার। পাতঞ্জলসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে – “অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশই পঞ্চপ্রকার ক্লেশের পঞ্চনাম।” (পাতঞ্জলসূত্র-২/৩)। এই পঞ্চক্লেশ যে বৃত্তিগুলোর মধ্যে থাকে, তাদেরকেই বলা হয় ক্লিষ্টবৃত্তি। ক্লেশগুলো দুঃখদায়ক। এবং যোগমতে সব ক্লেশের মূলেই অবিদ্যা বর্তমান।

পঞ্চক্লেশ : যোগমতে পঞ্চক্লেশ হলো- (১) অবিদ্যা, (২) অস্মিতা, (৩) রাগ, (৪) দ্বেষ ও (৫) অভিনিবেশ। তবে অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ- এই চারটি ক্লেশের মূল হলো অবিদ্যা। তাই পাতঞ্জলসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে – “অবিদ্যা থেকেই অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ এবং অভিনিবেশ উৎপন্ন হয়। এগুলো সকল সময় একভাবে থেকে কখনো প্রসুপ্ত, কখনো সূক্ষ্ম, কখনো বিচ্ছিন্ন এবং কখনো বা উদারভাবে চিত্তে বিরাজিত থাকে।” (পাতঞ্জলসূত্র-২/৪)। 

  • অবিদ্যা : অবিদ্যা নিজে ক্লেশ এবং অন্যান্য ক্লেশের প্রসবভূমি। যে বস্তু যা নয়, তাকে সেইরূপে জানাই হলো অবিদ্যা। অনাত্মাতে আত্মার, অনিত্যতে নিত্যের জ্ঞান হলো অবিদ্যাপ্রসূত। অবিদ্যার ব্যাখ্যায় যোগসূত্রকার পতঞ্জলি বলেছেন- ‘অনিত্য, অশুচি, দুঃখকর ও অনাত্ম বিষয়ে যথাক্রমে নিত্য, শুচি, সুখকর ও আত্মস্বরূপতাখ্যাতি হলো অবিদ্যা।’- (যোগসূত্র : ২/৫)। অনিত্যকে নিত্যরূপে জ্ঞান করা যথা স্বর্গবাসীরা অমর অথবা চাঁদ-তারাযুক্ত আকাশ নিত্য এরূপ জ্ঞান অবিদ্যা। আবার অশুচিকে শুচিরূপে জ্ঞান করাও অবিদ্যা। যথা- সুন্দরী নারীর অবয়বকে অমৃতের দ্বারা তৈরি বলে জ্ঞান করা। তৃতীয়ত, দুঃখকে সুখরূপে জ্ঞান করাও অবিদ্যা। যেমন- অন্নগ্রহণ বা পান প্রভৃতিতে সুখের জ্ঞান করা হলো অবিদ্যা। চতুর্থত, অনাত্মাকে আত্মারূপে জ্ঞান করা হলো অবিদ্যা। যথা- পুত্র বা সম্পত্তিতে আমি বা আমার জ্ঞান করা। এগুলো সবই ভ্রান্তজ্ঞান, যা অবিদ্যাপ্রসূত। উল্লেখ্য, সাধারণ ভ্রান্তজ্ঞানকে যোগীরা অবিদ্যা বলেন না। কিন্তু পারমার্থিক ও যোগসাধনসম্বন্ধীয় জ্ঞানের দ্বারা নাশ্য ভ্রান্তিকেই তারা অবিদ্যা বলেন।
  • অস্মিতা : দ্বিতীয় ক্লেশ হলো অস্মিতা। পুরুষ এবং বুদ্ধিকে ভ্রমক্রমে এক জ্ঞান করাই হলো অস্মিতা নামক ক্লেশ। অস্মিতার ব্যাখ্যায় যোগসূত্রকার বলেন- “দৃক্শক্তি ও দর্শনশক্তি অভেদ নয়, তবু অভেদ বা একাত্মতার জ্ঞানই হলো অস্মিতা।” (যোগসূত্র : ২/৬)। পুরুষ বা আত্মা দৃক্শক্তি, বুদ্ধি দর্শনশক্তি। সুতরাং আত্মাকে বুদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করাই হলো অস্মিতা। অস্মিতা ক্লেশের ফলে প্রকৃতির গুণবশত যা ঘটে, অহঙ্কারের বশে নিঃসঙ্গ ও উদাসীন পুরুষ বা আত্মা নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা বলে মনে করে।
  • রাগ : তৃতীয় ক্লেশ হলো রাগ। সুখ ভোগের বাসনা ও সুখ লাভের আসক্তি হলো রাগ। রাগের ব্যাখ্যায় যোগসূত্রে বলা হয়- “সুখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো রাগ। পূর্বানুভূত সুখস্মৃতি অনুসারে সেইরূপ সুখভোগের পুনরেচ্ছাই রাগ।” (যোগসূত্র : ২/৭)। নির্লিপ্ত আত্মাকে অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের প্রতি আরোপ করে ইন্দ্রিয়সুখকেই আত্মার সুখ মনে করে লুব্ধ হওয়া এবং তৃষ্ণার্ত হওয়া হলো রাগ। অস্মিতা থেকে উৎপন্ন হয় রাগ ক্লেশ। রাগকে তৃষ্ণাও বলা হয়। 
  • দ্বেষ : চতুর্থ ক্লেশ হলো দ্বেষ। দ্বেষ হলো রাগের বিপরীত। দুঃখজনক বস্তুর প্রতি যে বিরাগ বা বিতৃষ্ণা, তাকেই বলে দ্বেষ। যোগসূত্রে দ্বেষের পরিচয়ে বলা হয় – “দুঃখানুশয়ী ক্লেশবৃত্তি হলো দ্বেষ। অনুভূত দুঃখ স্মরণপূর্বক পুনর্বার আর তা ভোগ করতে হয়, এরূপ বীতরাগের সাথে তা নিবারণের যে আন্তরিক চেষ্টা, তারই নাম দ্বেষ।” (পাতঞ্জল-২/৮)। দ্বেষ হলো দুঃখের সাধনগুলোর প্রতি প্রতিঘাত ও হননের ইচ্ছা এবং ক্রোধের অনুভূতি। এখানেও রাগের মতো অনাত্মা ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আত্মার ভ্রান্ত একীকরণ এবং অকর্তা আত্মাকে কর্তাজ্ঞান করার জন্য এই ক্লেশ উৎপন্ন হয়।
  • অভিনিবেশ : পঞ্চম ক্লেশ অভিনিবেশ হলো একপ্রকার সহজাত ক্লেশ। অভিনিবেশ অর্থ মৃত্যুভয়। যোগসূত্রে অভিনিবেশের পরিচয় দিতে গিয়ে যোগসূত্রকার বলেন – “অবিদ্বানের ন্যায় বিদ্বানেরও যে সহজাত ও প্রসিদ্ধক্লেশ, তাই অভিনিবেশ।” – (যোগসূত্র : ২/৯)। মরণের প্রতি আমাদের যে ভীতি তাকেই বলে অভিনিবেশ। চিত্তে দ্বেষ বদ্ধমূল থাকায় অভিনিবেশ নামক পঞ্চম ক্লেশ উৎপন্ন হয়। জগতে সকল প্রকার দুঃখের মধ্যে মৃত্যু-ভীতিজনক যে দুঃখ, তা-ই সব থেকে তীব্র। বার বার মরণদুঃখ ভোগ করায় চিত্তে একপ্রকার সংস্কার বা বাসনা বদ্ধমূল হয়। ঐ সংস্কারকে বলে স্বরস। এই স্বরসের জন্য জ্ঞানী ও অ-জ্ঞানী সকলেরই মরণের প্রতি একটি ভীতি জন্মায়। এই ভীতিহেতু মরণের প্রতি যে বিতৃষ্ণা-বৃত্তির উদয় হয়, তাকেই অভিনিবেশ বলে। বস্তুত জীবের ‘মরণ-অভিজ্ঞতা’ জীবনকালে হয় না। কিন্তু যোগমতে, জন্মান্তরের মরণ-অভিজ্ঞতার সংস্কার জীবের চিত্তে থাকে বলেই মরণ-দুঃখের প্রতি অভিনিবেশ ক্লেশ থাকে।

যোগশাস্ত্র মতে, এই অস্মিতাদি পঞ্চক্লেশের চারটি অবস্থা- প্রসুপ্ত, তনু, বিচ্ছিন্ন ও উদর। যখন ক্লেশ বীজ বা শক্তিরূপে চিত্তে অবস্থান, আলম্বন বা বিষয় পেলেই পুনরায় উজ্জীবিত হয়, তাকে বলে ক্লেশের প্রসুপ্ত অবস্থা। বিদেহলয় ও প্রকৃতিলয় যোগীদের চিত্তে যে ক্লেশ থাকে, তা বীজের মধ্যে বৃক্ষশক্তি যেভাবে প্রসুপ্ত থাকে সেইভাবে প্রসুপ্ত থাকে। বীজ থেকে যেমন অঙ্কুরের উদ্গম হয়, তেমনি প্রসুপ্ত ক্লেশ নিজে নিজে বিষয় লাভ করলে পুনরায় অভিব্যক্ত হয়। পাতঞ্জলসূত্রে এভাবে বলা হয়েছে- আত্মার সাথে বুদ্ধির সংযোগই দুঃখের কারণ (পাতঞ্জল-২/১৭)। যখন ক্লেশ ক্রিয়াযোগের দ্বারা ক্ষীণ হয়, তখন তা সংস্কাররূপে চিত্তে অবস্থান করে, তাকে বলে ক্লেশের ‘তনু’ অবস্থা। দগ্ধ বীজের যেমন কোন শক্তি থাকে না, তেমনি তনুক্লেশেরও কোন শক্তি থাকে না। আবার অন্য ক্লেশের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হলে অন্তরালে যে ক্লেশ থাকে, তাকে বলা হয় বিচ্ছিন্ন ক্লেশ। আর ব্যাপারযুক্ত ক্লেশ অর্থাৎ যে ক্লেশ পরিপূর্ণ অবস্থায় থাকে, বলা হয় উদার ক্লেশ। যেমন ক্রোধের সময় দ্বেষ উদার হয় এবং রাগ বিচ্ছিন্ন হয়। আবার রাগ তনু হয়ে যায় যদি বৈরাগ্য অভ্যাস করা হয়। যতক্ষণ সম্পূর্ণ ভেদজ্ঞান না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সংস্কাররূপ সকল ক্লেশই প্রসুপ্ত অবস্থায় থাকে।

চিত্তবৃত্তির প্রকারভেদ

যোগশাস্ত্রে পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই পঞ্চপ্রকার বৃত্তি হলো- (১) প্রমাণ, (২) বিপর্যয়, (৩) বিকল্প, (৪) নিদ্রা ও (৫) স্মৃতি। (পাতঞ্জল-১/৬)। এদের প্রত্যেকটি আবার ক্লিষ্ট (ক্লেশদায়ক) ও অক্লিষ্ট (ক্লেশ বিনাশক) হতে পারে। (পাতঞ্জল-১/৫)। চিত্তের ভোগের প্রতি প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তির স্বভাব অনুযায়ী এই বৃত্তিগুলো ক্লিষ্ট বা অক্লিষ্ট হয়। যেমন রাগযুক্ত অথবা দ্বেষযুক্ত প্রত্যক্ষাদি প্রমাণবৃত্তি ক্লিষ্ট, এবং যা রাগদ্বেষের নিবৃত্তিকারক প্রমাণবৃত্তি তা অক্লিষ্ট। অর্থাৎ প্রমাণাদি বৃত্তি যে বিষয়ক হবে ও যেদিকে প্রযুক্ত হবে সে অনুযায়ী তা ক্লিষ্ট বা ক্লেশবর্ধক এবং অক্লিষ্ট বা ক্লেশনিবৃত্তিকারক বলে পরিগণিত হবে।

(১) প্রমাণ : প্রমার করণকে প্রমাণ বলে। প্রমাণের দ্বারা অনধিগত যথার্থ বিষয়ের নিশ্চয় হয়। অর্থাৎ, প্রমাণ থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করি। প্রমাণ অনধিগত বিষয়ক হওয়ায়, বোঝা যায়, প্রমাণ স্মৃতি থেকে ভিন্ন। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- প্রমাণবৃত্তির অন্তর্গত প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম (পাতঞ্জল-১/৭)। অতএব, যোগদর্শনে স্বীকৃত প্রমাণ তিনপ্রকার- (১) প্রত্যক্ষ, (২) অনুমান ও (৩) আগম।

  • প্রত্যক্ষ : ইন্দ্রিয় প্রণালীর দ্বারা বাহ্য ও মানস বিষয়ের যে বৃত্তি তা-ই প্রত্যক্ষ। বাহ্যবস্তুর দ্বারা ইন্দ্রিয় উপরঞ্জিত হলে ইন্দ্রিয় প্রণালীর দ্বারা চিত্তে আগত বিষয়ের যে বৃত্তি উৎপন্ন হয় তাকেই প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে। সহজ কথায়, ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভ হয় তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রধানত বিশেষ বিষয়ক। কিন্তু অনুমান এবং আগম প্রমাণের বিষয় সামান্য। বিশেষ বিষয় বলতে আমরা বুঝি যার মূর্তি ও ব্যবধি আছে। অর্থাৎ বাস্তব গুণসকল। আর সামান্য বিষয় হলো জাতি, সত্তাদি। প্রত্যেক বস্তুর অন্য সব বস্তুর থেকে পৃথক যে শব্দ, স্পর্শ, রূপ প্রভৃতি গুণ, তাই হলো তার মূর্তি। অপরপক্ষে ব্যবধি অর্থ হলো আকার। যে কোন একটি বস্তুর, যেমন একটি বই-এর মূর্তি ও আকার শত শত শব্দের সাহায্যেও যথাযথভাবে প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু স্বচক্ষে দেখলে তৎক্ষণাৎ তার জ্ঞান হয়। এজন্যেই অন্ধকে রঙের বর্ণনা দিয়ে রঙের জ্ঞান অথবা বধিরকে শব্দের বর্ণনা দিয়ে শব্দের জ্ঞান দেওয়া যায় না। এ কারণে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ প্রধানত বিশেষ বিষয়ক। তবে প্রত্যক্ষে যে সামান্যজ্ঞান একেবারেই থাকে না, তা নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রাধান্য থাকে বিশেষজ্ঞানের।
  • অনুমান : প্রত্যক্ষের দ্বারা অগৃহীত কিন্তু হেতুগম্য বিষয়ের জ্ঞান হলো অনুমান। কোন স্থানে অগ্নি যদি অগৃহ্য বা আড়াল হয় কিন্তু ধূমের সঙ্গে অগ্নির ব্যাপ্তিজ্ঞান যদি থাকে তাহলে ধূম প্রত্যক্ষ করে অগ্নির যথার্থজ্ঞান হতে পারে। এরূপ প্রমাণই অনুমান প্রমাণ। এজন্য অনুমানকে হেতু-পূর্ব বৃত্তি বলা হয়। অনুমান বৃত্তিতে সামান্যজ্ঞানেরই প্রাধান্য।
  • আগম : কোন ব্যক্তির বাক্যে শ্রোতার যদি সংশয়হীন নিশ্চয়জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাহলে সেই জ্ঞানকে বলা হয় আগম। ঐরূপ বক্তাকে বলা হয় আপ্ত। যথার্থবক্তা বা আপ্তের দ্বারা দৃষ্ট বা অনুমিত বিষয় যখন বাক্যের দ্বারা শ্রোতার প্রমাজ্ঞান উৎপন্ন করে, তখন ঐ প্রমা-জ্ঞানকে বলা হয় আগম। এককথায় শব্দ শুনে শব্দার্থ-বিষয়ক যে বৃত্তি শ্রোতার চিত্তে উৎপন্ন হয়, তা-ই আগম।

(২) বিপর্যয় : বলা হয়, ইন্দ্রিয় বৈকল্যের জন্য প্রত্যক্ষজ্ঞান ভ্রান্ত হতে পারে। সাধ্য ও হেতুর সম্বন্ধজ্ঞানের দোষ ঘটলে অনুমানের দোষ হয়। আবার আগমের বক্তা যদি অজ্ঞ বা প্রবঞ্চক হন তবে আগমও দুষ্ট হয়। এ ধরনের ভ্রান্ত জ্ঞানকে বলা হয় বিপর্যয়। বিপর্যয়ের লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার পতঞ্জলি বলেন- বিপর্যয় হলো অতদ্রুপ, অপ্রতিষ্ঠ মিথ্যাজ্ঞান। (যোগসূত্র : ১/৮)। সোজাকথায়, যে কোন প্রকার ভ্রান্তজ্ঞানই হলো বিপর্যয়, যেমন রজ্জুতে সর্পভ্রম। রজ্জুতে সর্পভ্রম কালে বস্তু প্রকৃতপক্ষে রজ্জু, কিন্তু জ্ঞান তদ্রূপ হয় না। রজ্জুর যথার্থজ্ঞান উৎপন্ন হলে রজ্জুতে সর্পের জ্ঞান খণ্ডিত হয়। এজন্য বলা হয় প্রমাণের বিষয় যথাভূত, কিন্তু বিপর্যয়ের বিষয় তার বিপরীত।

(৩) বিকল্প : অনেক শব্দ বা বাক্য আছে যাদের অভিধেয়ের বাস্তব কোনও সত্তা নেই, অথচ ঐ সব শব্দ বা বাক্য শুনলে একপ্রকার অস্ফুট জ্ঞানবৃত্তি আমাদের চিত্তে হয়। ঐ বৃত্তিগুলোই বিকল্পবৃত্তি। বিকল্পের লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার বলেন- শব্দজ্ঞানানুপাতী ও বস্তুশূন্য অর্থাৎ অবাস্তব পদার্থ-বিষয়ক বৃত্তিই বিকল্প। (যোগসূত্র : ১/৯)। যেমন আকাশকুসুম কোন বাস্তব পদার্থ নয়। ‘আকাশ’ ও ‘কুসুম’ শব্দ দুটিকে একত্রিত করে একটি পৃথক আকাসকুসুমের যে কল্পনা, সেই কল্পনাই হলো বিকল্প। বস্তুর অভাবে যেমন বিকল্প হয় তেমনি একপ্রকার বস্তুর স্থলে দু-প্রকার বৃত্তি এবং একপ্রকার বৃত্তির স্থলে দু’প্রকার বস্তুর বিকল্প হয়। এই বিকল্প শব্দ জন্য। যোগমতে, আত্মা ও চৈতন্য এক হওয়া সত্ত্বেও যখন ‘আমার চৈতন্য’ এরূপ ব্যবহার করা হয়, তখন আমি ও চৈতন্য বিষয়ক দুটি পৃথক বৃত্তি জন্মায়। এরূপ বৃত্তিই বিকল্পবৃত্তি। বিকল্প বস্তুস্বরূপের অপেক্ষা করে না। তাই তা বিপর্যয় থেকে ভিন্ন। আবার বিকল্প যেহেতু বস্তুশূন্য সেহেতু তা প্রমাণ নয়।

(৪) নিদ্রা : জাগ্রত ও স্বপ্নের অভাবে তমোমূলক যে চিত্তবৃত্তি তা-ই নিদ্রা। সেই নিদ্রা হলো স্বপ্নহীন সুষুপ্তি। নিদ্রার লক্ষণ প্রসঙ্গে যোগসূত্রকার বলেন- অভাবপ্রত্যয়ের আলম্বনা বৃত্তিই নিদ্রা। (যোগসূত্র : ১/১০)। অভাবের যে প্রত্যয় তাকে অবলম্বন করে যে বৃত্তি হয় তাকেই নিদ্রা বলে। অভাব অর্থে জাগ্রত এবং স্বপ্নের অভাবকেই বোঝানো হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, চিত্তবৃত্তিমাত্রই কোন না কোন প্রকার প্রত্যয়। অথচ নিদ্রা হলো প্রত্যয়ের অভাব। তাহলে নিদ্রাকে চিত্তবৃত্তি বলা হয় কিভাবে? উত্তরে যোগভাষ্যকার ব্যাসদেব বলেন, নিদ্রাকালে যদি কোন প্রত্যয়ই না থাকতো তাহলে নিদ্রাভঙ্গের পর নিদ্রাকালীন তামসভাবের স্মরণ হতো না। অথচ নিদ্রাভঙ্গের পর যেহেতু নিদ্রাকালীন তামসভাবের স্মরণ হয়, সেহেতু নিদ্রাকালেও প্রত্যয় হয়, এটা স্বীকার করতে হবে। সংস্কার ব্যতীত স্মরণ হয় না, আবার পূর্বানুভব ব্যতীত সংস্কার হয় না। নিদ্রার যেহেতু স্মরণ হয়, সেহেতু নিদ্রা হলো অনুভূতি বিশেষ। নিদ্রার পূর্বে শরীরের যে আচ্ছন্নভাব বোধ হয়, তাই তমঃ। সেই তমোগুণই এতো গাঢ়তর হয়ে নিদ্রায় পর্যবসিত হয় যে, জাগরিত হয়েও বুঝতে পারে না কোথায় আছে। এই তমোগুণের ফলে সকল বিষয়ের সম্পর্কে আমাদের প্রত্যয়ের অভাব ঘটে। এই অভাব বা তমঃ যে বৃত্তির বিষয়ীভূত, চিত্তের সেই বৃত্তির নামই নিদ্রা।

(৫) স্মৃতি : স্মৃতির লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে যোগসূত্রকার বলেন- অনুভূত বিষয়ের অসম্প্রমোষ অর্থাৎ অনুভূতি বিষয়ের অনুরূপ আকারযুক্ত যে বৃত্তি তা-ই স্মৃতি। (যোগসূত্র : ১/১১)। অসম্প্রমোষ অর্থ হলো নিজস্বমাত্রের গ্রহণ এবং পরস্বের অগ্রহণ। বিষয়ের অনুভব যে পরিমাণ হয়, স্মৃতি তার চেয়ে অধিক পরিমাণ হতে পারে না। আবার অগৃহীত বা অননুভূত বিষয়ের স্মৃতি হতে পারে না। এজন্যেই স্মৃতি প্রমাণের অন্তর্গত নয়। স্মৃতির দ্বারা যেমন ঘটাদি বিষয়ের স্মরণ হয় তেমনি ঘটাদি বিষয়ের জ্ঞানেরও স্মরণ হয়। আমরা জাগরিত অবস্থায় যা কিছু দেখি বা অনুভব করি, তাদের সংস্কার চিত্তে অবস্থান করে। কোন উদ্বোধকের উপস্থিতিতে সেই সংস্কার চিত্তপটে উদিত হয় এবং পূর্বানুভূত বস্তুর পুনরুদ্রেক ঘটায়। সংস্কার থেকে উৎপন্ন এই সকল চিত্তবৃত্তিই স্মৃতি। যোগমতে এই পঞ্চপ্রকার বৃত্তির অতিরিক্ত কোন বৃত্তি নেই। উল্লেখ্য, চিত্তের নানা বৃত্তি হলেও চিত্ত নানা নয়, এক। আবার দ্রষ্টা পুরুষ নানাবৃত্তির প্রকাশক হলেও বিষয়ের নানাত্ব পুরুষে নানাত্ব বা পরিণাম আনে না। কারণ নানাত্ব থাকে ইন্দ্রিয়ে ও অন্তকরণে। এই চিত্তবৃত্তির নিরোধ হবে কিভাবে? এর উত্তরে যোগসূত্রকার অভ্যাস ও বৈরাগ্যের কথা বলেছেন। অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা উক্ত পঞ্চপ্রকার চিত্তবৃত্তিসমূহের নিরোধই হলো যোগ। বৃত্তির নিরোধের অর্থ হলো বৃত্তিশূন্যতা। অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্ত বৃত্তিশূন্য হয়। যোগমতে, বৃত্তিমুক্ত চিত্ত শান্ত ও স্থিত।

চিত্তবৃত্তি নিরোধ ও সমাধি

যোগদর্শনে চিত্তের কতগুলো বিকারকে একত্রে চিত্ত বলা হয়। এই বিকারগুলো হলো মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার। এবং যোগমতে চিত্তবৃত্তির নিরোধকে যোগ বলা হয়েছে। যোগসূত্রকার পতঞ্জলি যোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে তাই বলেন- চিত্তের বিভিন্ন প্রকারের বৃত্তির নিরোধই যোগ। (যোগসূত্র)। এই যোগ বা চিত্তবৃত্তির নিরোধ কিভাবে হবে? যোগশাস্ত্রকারদের মতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারাই চিত্তবৃত্তির নিরোধ হয়। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের সাহায্যে প্রত্যেক মনোবৃত্তিই নিরুদ্ধ হতে পারে (পাতঞ্জল-১/১২)। এ বক্তব্যের প্রতিফলন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও দেখা যায়- হে মহাবাহো, মন যে দুর্নিরোধ ও চঞ্চল তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হে কৌন্তেয়, অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা তাকে সংযত করা যায়। (৬/৩৫)। অসংযত ব্যক্তির পক্ষে সমাধি দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু পুনঃ পুনঃ যত্নশীল ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্যসাধন দ্বারা এই সমাধি লাভ করতে পারেন। (৬/৩৬)।

সাংখ্য-যোগ দার্শনিকগণ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ- এই ত্রিতাপ ব্যাপী দুঃখের উপস্থিতি উপলব্ধি করে জগতকে দুঃখময় বলে অভিহিত করেন। এই ত্রিতাপ হলো- তাপ-দুঃখ, পরিণাম-দুঃখ এবং সংস্কার-দুঃখ। সংস্কার-দুঃখ অতীত, তাপ-দুঃখ বর্তমান ও পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত। জন্ম মৃত্যু তাপ জরা ইত্যাদিই বর্তমানের তাপ-দুঃখ। জগতে সুখ ও দুঃখ দুটোই আছে বলে সাধারণ ধারণা। কিন্তু যোগশাস্ত্রকারদের মতে চিরায়ত সুখপ্রদ এমন কোন বস্তু জগতে নেই। জগৎ যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি সুখপ্রদ বস্তুও পরিবর্তনশীল। সুখপ্রদ বস্তু আপাতত সুখের কারণ হলেও পরিণামে বিয়োগজনিত দুঃখেরই কারণ। সুখ ভোগের তৃষ্ণা বৃদ্ধির জন্য পরিণামে দুঃখ বাড়ে। এটাই পরিণাম-দুঃখ। সে কারণে পরিণাম-দুঃখ ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত।

সুখ ও দুঃখের অনুভূতির ফলে জীবের মনে সংস্কার উৎপন্ন হয়। সুখানুভূতি সুখ সংস্কারের এবং দুঃখানুভূতি দুঃখ সংস্কারের সৃষ্টি করে। যোগশাস্ত্রকারগণ বাসনাকে সংস্কার মনে করেন। তাই সুখ-সংস্কারের ফলে জীব বারবার সুখপ্রদ বস্তুর প্রতি আসক্ত হয় এবং দুঃখ-সংস্কারের ফলে দুঃখপ্রদ বস্তুর প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয়। এর ফলে পুনরায় দুঃখ ভোগ করে। সংস্কার হতে এই যে দুঃখের সৃষ্টি তা-ই সংস্কার-দুঃখ। এসব দুঃখের নিবৃত্তিই হলো জীবের পরম পুরুষার্থ। এর উপায়ই হলো চিত্তবৃত্তি নিরোধ বা যোগ। ধ্যানাভ্যাস ও বৈরাগ্য সাধনের মাধ্যমে তার নিরোধ করা সম্ভব বলে যোগশাস্ত্রে স্বীকৃত। অভ্যাস প্রসঙ্গে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- চিত্ত স্থিার করবার জন্য রজস্তমোবৃত্তিশূন্য যে যত্ন, তাকেই অভ্যাস বলা হয় (পাতঞ্জল-১/১৩)। প্রযত্নসহকারে মনোনিবেশপূর্বক দীর্ঘকাল ঐ প্রকার অভ্যাস করতে করতে তবে তা সুদৃঢ় ও নিশ্চল হয় (পাতঞ্জল-১/১৪)। এবং বৈরাগ্য প্রসঙ্গে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- যার সমস্ত শাস্ত্রীয় অশাস্ত্রীয় বিষয়ে বিতৃষ্ণা জন্মেছে, যিনি সমস্ত দৃষ্টবিষয়ে বীতস্পৃহ হয়েছেন, তারই বশীকার সংজ্ঞক বৈরাগ্য জন্মেছে (পাতঞ্জল-১/১৫)।  পরমবৈরাগ্য স্ফূরিত হলে, প্রকৃতি পুরুষ যে পরস্পর অভেদ নয়, সে সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান জন্মে। সেই জ্ঞানপ্রভাবে প্রাকৃতিক গুণনিচয়ের প্রতিও বীতস্পৃহ হতে হয় (পাতঞ্জল-১/১৬)।

যোগমতে, বৈরাগ্য দু’প্রকার- বশীকার বা অপর এবং পর বা ধর্মমেষ। ভোগের বিষয়গুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা- দৃষ্ট অর্থাৎ যা সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতায় গম্য এবং আনুশ্রবিক অর্থাৎ শ্রুতির উপর আস্থার ফলে যে বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান ও আকর্ষণ হয়। দৃষ্ট বিষয়গুলো হলো খাদ্য, পানীয়, কাপড়, শয্যা, বাড়ি, রথ বা গাড়ি ইত্যাদি। আনুশ্রবিক বিষয় হলো যথাক্রমে স্বর্গ, প্রকৃতিলয়, বিদেহলয় ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো আপাতমনোরম হলেও এরা ত্রিতাপের আকার।

এই বিষয়গুলো যখন আমাদের আয়ত্তে আসে তখন যদি তত্ত্বজ্ঞানের ফলে আমরা তাদের দোষ দেখে তাদের প্রতি বিরক্ত বা নিরাসক্ত হয়ে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের চিত্তে বশীকার বৈরাগ্য হয়েছে বলে বোঝা যাবে। পরবৈরাগ্য হলো আরও উচ্চস্তরের অবস্থা। যে জ্ঞান বা বুদ্ধির দ্বারা পুরুষতত্ত্বের সাক্ষাৎকার হয়, তাকে অগ্র্যাবুদ্ধি বা চরমজ্ঞান বলে। পুরুষ-সাক্ষাৎকার হলে ত্রিগুণাপ্রকৃতি থেকে আত্মা বা পুরুষের ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হয় এবং তার ফলে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। পরবৈরাগ্যের ফলও দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি। পরবৈরাগ্যে প্রবৃত্তির আত্যন্তিক নাশ হয় এবং খ্যাতি বা জ্ঞানবিষয়েও বৈরাগ্য দেখা যায়।

চিত্তের বৃত্তিগুলোর পরিপূর্ণ লয় বা নিরোধই মূলত সমাধি অবস্থা। যোগদর্শন মতে, সহজ বা স্বাভাবিক অবস্থা থেকেই চিত্ত সমাধি স্তরে উন্নীত হয়। চিত্তের সহজ বা স্বাভাবিক অবস্থাকে বলা হয় চিত্তভূমি। চিত্তভূমি পাঁচ প্রকার। যথা- ক্ষিপ্ত, মূঢ়, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র এবং নিরুদ্ধ। সকল জীবের চিত্তই স্থূলত এই পাঁচ অবস্থায় থাকে। যোগমতে এই পঞ্চবিধ চিত্তভূমির শেষোক্ত দুটি ভূমি অর্থাৎ একাগ্র ও নিরুদ্ধ অবস্থাই যোগ সাধনার অনুকূল। তবে এই দুই ভূমি যোগানুকূল হলেও যোগপ্রক্রিয়া অতি জটিল। একাগ্র অবস্থায় বিষয়মাত্র অবশিষ্ট থাকায় চিত্তের পরিপূর্ণ লয় সম্ভব হয় না। নিরুদ্ধ অবস্থায় চিত্তের পরিপূর্ণ লয় হয় এবং পুরুষ স্বস্বরূপে অবস্থান করে। একাগ্র অবস্থা থেকে চিত্তের পূর্ণ লয়ের অবস্থা পর্যন্ত যোগের অনেকগুলো পর্যায় বর্তমান। যোগের বিভিন্ন পর্যায় অনুযায়ী যোগের নানা প্রকারভেদ যোগদর্শনে স্বীকৃত হয়েছে।

অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তি নিরোধের পর্যায় অনুযায়ী যোগ বা সমাধিকে প্রধাণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি ও (২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি।

(১) সম্প্রজ্ঞাত সমাধি 

যোগশাস্ত্রমতে অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিগুলো নিরুদ্ধ হলে প্রথমে সম্প্রজ্ঞাত সমাধি হয়। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়স্রোত মন্দীভূত হয় এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেকস্রোত উদ্ঘাটিত হয়। এই উপায়দ্বয়ের দ্বারা প্রথম যে যোগ বা সমাধিপ্রাপ্তি ঘটে তাকেই সম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। এই অবস্থায় একই বিষয়াকারে বৃত্তি দীর্ঘকাল ধরে একাগ্র চিত্তভূমিতে অবস্থান করে। ‘সম্প্রজ্ঞাত’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো সম্যক্ বা প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত। এ অবস্থায় ধ্যেয় বস্তুকে সম্যক্ ভাবে জানা যায় বলে এই সমাধিকে সম্প্রজ্ঞাত বলে। এ বিষয়ে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে- বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা এই ভাবচতুষ্টয়ানুগত সমাধি হলো সম্প্রজ্ঞাত সমাধি। (যোগসূত্র : ১/১৭)।

যোগাভ্যাসের প্রাথমিক স্তরে কোন স্থূল দেবমূর্তি বা ভৌতিক পদার্থকে অবলম্বন করে অগ্রসর হতে হয়। স্থূলবস্তু থেকেই ক্রমশ সূক্ষ্ম বস্তুর দিকে চিত্ত প্রবাহিত হয়। তাই যোগমতে ধ্যেয় বা ভাব্য বস্তু দ্বিবিধ- স্থূল ও সূক্ষ্ম। এই দ্বিবিধ বস্তুই আবার বাহ্য ও আন্তর ভেদে দ্বিবিধ। সুতরাং মোট চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তু বর্তমান। এগুলো হলো- (১) স্থূল বাহ্যবস্তু, যেমন- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূত, (২) স্থূল আন্তরবস্তু, যেমন- একাদশ ইন্দ্রিয়সমূহ, চক্ষু-কর্ণ-নাসিকা-জিহ্বা-ত্বক এই পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, বাক্-পানি-পাদ-পায়ু-উপস্থ এই পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও উভয়-ইন্দ্রিয় মন, (৩) সূক্ষ্ম বাহ্যবস্তু, যেমন- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ এই পঞ্চতন্মাত্রসমূহ ও (৪) সূক্ষ্ম আন্তরবস্তু, যেমন- অহং ও বুদ্ধি।

এই চারপ্রকার ধ্যেয় বস্তুকে বিষয় হিসেবে বলা হয় যথাক্রমে- বিতর্ক, বিচার, আনন্দ ও অস্মিতা। এই চারপ্রকার বিষয় তথা অবলম্বন ভেদে যোগ বা সমাধিও চারপ্রকার- (১) সবিতর্ক, (২) সবিচার, (৩) সানন্দ ও (৪) সাস্মিত।

  • সাধারণত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে সকল বিষয় গৃহীত হয় তারা স্থূল বিষয়। যেমন গরু, ঘোড়া, ঘট ইত্যাদি। এইসব স্থূল বিষয় যখন শব্দের বাচ্যরূপে অর্থাৎ নামজ্ঞান ও সংকেতজ্ঞান হিসেবে সমাধিপ্রজ্ঞার বিষয় হয় তখন সেই সমাধিকে বলা হয় সবিতর্ক সমাধি। অর্থাৎ, এই অবস্থায় যোগীর কোন একটি শব্দের বাচ্য স্থূল বিষয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও সম্যক্ জ্ঞান হয়।
  • এরপর, অর্থাৎ স্থূলবিষয়ক সমাধি আয়ত্ত হলে যোগীর বিচারবিশেষের দ্বারা তন্মাত্র প্রভৃতির সূক্ষ্ম বিষয়ের জ্ঞান হয়। একেই বলে সবিচার সম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যেহেতু শব্দ ব্যতীত বিচার হয় না, তাই সবিচার সমাধিতেও বাচকশব্দের অপেক্ষা থাকে।
  • সানন্দ অবস্থা হলো অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরের অবস্থা। এই অবস্থায় বাচক শব্দের ততো অপেক্ষা নেই। আমাদের শরীর হলো জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয়, চিত্ত ও প্রাণের অধিষ্ঠাতা। অভ্যাসের ফলে ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণাদির সঙ্গে অধিষ্ঠাতা শরীরের যখন বিশেষ একপ্রকার স্থৈর্য সিদ্ধ হয় তখন এক সর্বব্যাপী সাত্ত্বিক সুখ অনুভূত হয়। সর্বশরীরে ঐ আনন্দময় সাত্ত্বিক ভাবের সহজ বোধই সানন্দ সমাধির বিষয়।
  • সাস্মিত সমাধির বিষয় হলো মহান আত্মা বা ব্যবহারিক গ্রহীতা। এই ব্যবহারিক গ্রহীতা কিন্তু স্বরূপত পুরুষ নন। সাংখ্যদর্শনে এঁকে মহৎ-তত্ত্ব বলা হয়েছে। ‘আমি’ এই বোধমাত্রই সাস্মিত সমাধির বিষয়। এইটি হলো বুদ্ধি বা মহৎ-এর অভিমান। সত্ত্বগুণের আধিক্য থাকায় একে পুরুষ বলে ভ্রম হয়। এই সাস্মিত অবস্থাই সম্প্রজ্ঞাত সমাধির সর্বোচ্চ অবস্থা।

কিন্তু সম্প্রজ্ঞাত সমাধি অবস্থায় চিত্তবৃত্তি কখনই সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ হতে পারে না। কারণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম আকারে হলেও বিষয়াকার আলম্বন থেকেই যায়। এই সমাধিতে সংসার বীজ সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয় না, সুপ্ত অবস্থাপ্রাপ্ত হয় বলে এই সমাধিকে সবীজ সমাধিও বলা হয়।

(২) অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি

সম্প্রজ্ঞাত সমাধির দ্বারা চিত্ত যখন বিষয় চিন্তা থেকে মুক্ত হয় তখন অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির উদ্ভব হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি সম্পূর্ণ আলম্বন বা বিষয়হীন। এটি পরবৈরাগ্যের অভ্যাসসাধ্য সংস্কার। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির বর্ণনায় যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে- অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি হলো পরবৈরাগ্যের অভ্যাসের দ্বারা সংস্কার শেষ স্বরূপ সমাধি। প্রবল বৈরাগ্যবশত যখন সমস্ত চিত্তবৃত্তির নিবৃত্তি হয়, তখন চিত্ত প্রত্যেক সংস্কার পরিশূন্য, সেই অবলম্বনরহিত অপূর্ব অবস্থাকেই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি বলা হয়। (যোগসূত্র : ১/১৮)।

সকলপ্রকার চিত্তবৃত্তির নিরোধকে বলা হয় বিরাম। এই বিরাম লাভের উপায় হলো বৈরাগ্য। বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তবৃত্তিসমূহ নিরুদ্ধ হয়। অভ্যাসের দ্বারা এই বৈরাগ্য দৃঢ় হয়। বৈরাগ্য দৃঢ় হলে চিত্তবৃত্তির পুনরুৎপত্তির সম্ভাবনা থাকে না। চিত্ত তখন দগ্ধবীজের ন্যায় শক্তিশূন্য হয়ে পড়ে। যে অবস্থায় বিষয়ের কোন অস্তিত্ব থাকে না।

এইরূপ নিরালম্ব ও নির্বীজ সমাধিকে বলা হয় অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। সম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে স্থূলতত্ত্ব থেকে ক্রমান্বয়ে অস্মিভাবে চিত্ত সমাহিত হয়। অস্মিভাবে কোন স্থূল ইন্দ্রিয়জাত জ্ঞান থাকে না। কিন্তু ঐ অবস্থায়ও অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিজ্ঞানের জ্ঞান বা সংস্কার থাকে। যখন ঐ অস্মিভাবও চাই না মনে করে যোগী নিরোধ আনতে পারেন, তখন তার চিত্তবৃত্তি রুদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থাই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। যোগমতে, এই অবস্থায় মনের সঙ্গে শরীরযন্ত্রের ক্রিয়াও রুদ্ধ হয়ে যায় এবং স্থম্ভিতপ্রাণ অবস্থায় থাকে। নিরোধ ভঙ্গ হলে আবার শরীরের যান্ত্রিক ক্রিয়া ফিরে এসে আগের অবস্থা হয়। অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে পুরুষ প্রকৃতির সকল প্রকার সংযোগ ছিন্ন করে স্ব স্ব রূপে অবস্থান করে। প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পুরুষ জন্ম-মৃত্যু ও সুখ-দুঃখকে অতিক্রম করে কৈবল্যপ্রাপ্ত হয়। এইরূপ কৈবল্য-প্রাপ্তিকে যোগদর্শনে মোক্ষ বলা হয়।

তবে যোগশাস্ত্রে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- ভবপ্রত্যয় এবং উপায়প্রত্যয়। ভব অর্থ জন্ম এবং প্রত্যয় অর্থ কারণ। বিদেহলীন ও প্রকৃতিলীন যোগীদের এজাতীয় ভবপ্রত্যয় হয়। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে- সম্প্রজ্ঞাত সমাধিমূলক বিদেহলয়, কিংবা প্রকৃতিলয় উভয়ই মুক্তির কারণ হয় না। যেহেতু উভয়ই অবিদ্যা পরিশূন্য নয়। নিদ্রার পর জাগরণ হলে যেমন নানা কার্যে ব্যাপৃত থাকতে হয়, তেমনি ঐ উভয়বিধ অনাত্মলয়ের পরেও চিত্ত বারবার সাংসারিক ব্যাপারে আসক্ত হয় (পাতঞ্জল-১/১৯)।

যে যোগী সব বিষয়ের ত্যাগকে চূড়ান্ত মনে করে তাতেই আনন্দ লাভ করেন, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়ের অস্তিত্ব না থাকায় ইন্দ্রিয় প্রভৃতি করণগুলো লয়প্রাপ্ত হয়ে যায়। তাদের দেহের নাশ হলে তারা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভ করেন। এঁরাই বিদেহলীন নামে পরিচিত। কিন্তু পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎকার না হওয়াতে এরা কৈবল্য লাভ করতে পারেন না। আবার যে সব যোগী পরমপুরুষতত্ত্ব-সাক্ষাৎ করেননি কিন্তু বিষয়ের ত্যাগ জন্য তাদের অন্তঃকরণ মূলা প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়েছে, তারা প্রকৃতিলীন নামে পরিচিত। এঁদেরও মুক্তিলাভ সম্ভব নয়।

অপরপক্ষে উপায়প্রত্যয় হলো প্রকৃত অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি। উপায় অর্থ যথাবিহিত উপায় এবং প্রত্যয় অর্থ কারণ। উপায়প্রত্যয় প্রকৃত যোগীর হয়ে থাকে। এর উপায়গুলো হলো শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। শ্রদ্ধা অর্থ হলো প্রসন্নচিত্তে ও আসক্তিসহ বিষয়ের গুণ আবিষ্কার করে জানার ইচ্ছা। বীর্য হলো অন্য বিষয়ের থেকে সরিয়ে নিয়ে চিত্তকে সাধনে নিযুক্ত করা। স্মৃতি হলো ধ্যেয় বিষয়কে বারবার অনুভব করা। বীর্য হলো শ্রদ্ধার ফল এবং স্মৃতি হলো বীর্যের ফল। যখন স্মৃতি স্থির এবং ধ্রুব হয়, তখন সমাধি হয়। সমাধি অবস্থাতেই প্রজ্ঞা বা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের প্রকাশ হয়। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে- যিনি যোগ সম্বন্ধীয় শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধিবলে অতুল প্রজ্ঞা লাভ করেছেন, তিনিই মুক্ত হয়েছেন। কোন প্রাকৃতিক প্রলোভন আর তাকে প্রলোভিত করতে পারে না। তিনিই বিদেহলয় এবং প্রকৃতিলয় বিহীন উপায় প্রত্যয়শীল নিত্যমুক্ত যোগী হয়েছেন। তিনিই চিরকালের জন্য স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন (পাতঞ্জল-১/২০)।

এই সমাধিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগশাস্ত্রে বলা হয়, তীব্র সম্বেগসম্পন্ন যোগীরই শীঘ্র সমাধিলাভ ঘটে। সম্বেগ হলো তীব্র কার্যশক্তিসম্পন্ন সংস্কারের নাম। পাতঞ্জলসূত্রের সমাধিপাদে তাই বলা হয়েছে- তীব্র সম্বেগশালী যোগীরই শীঘ্র সমাধি হয় (পাতঞ্জল-১/২১)।  মৃদু, মধ্য ও অধিমাত্র ভেদে তিন প্রকার সম্বেগ আছে। মৃদু সম্বেগশীল যোগীর সমাধি বিলম্বে হয়। মধ্য সম্বেগবিশিষ্ট হলে তারচেয়ে শীঘ্র হয়। যার অধিমাত্র সম্বেগ হয়েছে, অতি শীঘ্রই তিনি সমাধিমগ্ন হন (পাতঞ্জল-১/২২)।

অভ্যাস, বৈরাগ্য, শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি ইত্যাদি ছাড়াও ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধির অন্যতম সাধন বলেছেন যোগসূত্রকার পতঞ্জলি। শুদ্ধভক্তি সহকারে ঈশ্বরের অর্চনা করলেও সম্প্রজ্ঞাত সমাধির অধিকারী হওয়া যায় (পাতঞ্জল-১/২৩)।  তিনি ওঙ্কারের বাচ্য। তার নাম ওঁ (পাতঞ্জল-১/২৭)।  ঈশ্বরবাচক প্রণব জপ করতে করতে, সেই ঈশ্বরবাচক প্রণবের অর্থ ভাবতে ভাবতে একাত্ম হওয়া যায়। সম্যক্ একাগ্রতার উদয়ে সমাধি হয় (পাতঞ্জল-১/২৮)। এজন্যেই এ প্রসঙ্গে যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্বের আলোচনা স্থান পেয়েছে। সুতরাং, বিবেকখ্যাতি বা সম্পূর্ণ ভেদজ্ঞানলব্ধ হয়ে পুরুষ সাক্ষাৎকার হলে তবেই সম্পূর্ণ সমাধিলাভ হয়। এই অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির ফলে দ্রুত প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হওয়ার ফলে কৈবল্যলাভের পথ প্রশস্ত হয়।

অষ্টাঙ্গিক যোগ

যোগদর্শন হলো প্রধানত সাধনশাস্ত্র ও প্রয়োগবিদ্যা। যোগমতে প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি হলো কৈবল্য লাভ বা মুক্তিলাভের উপায়। বিবেকখ্যাতির অর্থ হলো পুরুষ বা আত্মা দেহ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার থেকে পৃথক শুদ্ধ চৈতন্য সত্তা। এই বিবেকখ্যাতির জন্য প্রয়োজন চিত্তবৃত্তির নিরোধ। যোগশাস্ত্র অনুযায়ী চিত্তবৃত্তি নিরোধের দুটি প্রধান উপায় হলো অভ্যাস ও বৈরাগ্য। বৈরাগ্যের দ্বারা বিষয়ে বৈরাগ্য আসে এবং অভ্যাসের দ্বারা বিবেক-জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। কিন্তু ধারণা, ধ্যান, সমাধি প্রভৃতি অভ্যাস করার মতো চিত্তশুদ্ধি যাদের হয়নি তাদের জন্য প্রথমে চিত্তবৃত্তি নিরোধের সাক্ষাৎ উপায় হিসেবে আটটি যোগাঙ্গ অভ্যাসের মাধ্যমে অগ্রসর হবার কথা বলা হয়েছে। এগুলো একসঙ্গে অষ্টাঙ্গ-যোগ নামে পরিচিত। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি- এই আটটি হলো যোগের অঙ্গ। (যোগসূত্র : ২/২৯)

যোগের এই অষ্টাঙ্গ যথা- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি অনুশীলনের মাধ্যমে চিত্তের মলিনতা নষ্ট হয় এবং জ্ঞানের দীপ্তি বৃদ্ধি পায়। যোগশাস্ত্রকাররা বলেন, যোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে অষ্টাঙ্গিক যোগের অনুষ্ঠানের দ্বারা অশুদ্ধি অর্থাৎ অজ্ঞান এবং তার থেকে উৎপন্ন সংস্কার যতোই ক্ষয় হয়, প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞান ততোই দীপ্তিমান হয়ে ওঠে। জ্ঞানের দীপ্তির চরম সীমাই হলো বিবেকখ্যাতি বা ভেদজ্ঞান। বিবেকখ্যাতি লাভের উপায় হিসেবে যোগের এই অষ্টাঙ্গের অনুশীলন অপরিহার্য।

যম : প্রথম যোগাঙ্গ হলো যম। যম হলো একপ্রকার নিষেধাত্মক বিধি। যম সম্পর্কে যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে- অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ- এই পাঁচটি সাধনকে একসঙ্গে বলা হয় যম। (যোগসূত্র : ২/৩০)।

  • (ক) অহিংসা : অহিংসা হলো সর্বপ্রকারে, সর্বদা, সর্বভূতের প্রতি হিংসা থেকে বিরত থাকা। হিংসা বলতে এখানে কায়িক, বাচিক ও মানসিক- তিনপ্রকার হিংসার কথাই বলা হয়েছে। এই তিনপ্রকার হিংসাই বর্জনীয়। অর্থাৎ কোনপ্রকারেই অপরকে আঘাত না করা বা অপরকে ব্যথা না দেয়া। অহিংসার ইতিবাচক ভাব হলো মৈত্রী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যোগী পুরুষরা যেভাবে অহিংসা মহাব্রত পালন করেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা পালন করা সম্ভব নয়। যেমন আততায়ীকে বধ করা, খাবার জন্য ফসল, গাছ প্রভৃতি নাশ করা, অপকারী প্রাণীকে বধ করা ইত্যাদিকে সাধারণ মানুষ হিংসারূপে গণ্যই করেন না। কেননা দেহধারণের জন্য কিছু না কিছু খেতেই হবে। আবার প্রতি পদক্ষেপে কিছু না কিছু জীবাণুর প্রাণহানি হয়। এমনকি গৃহস্থের বাড়িতে অসময়ে ও অনাহূতভাবে অন্নগ্রহণ করলেও তা একপ্রকার পীড়নই বলা চলে। বস্তুত এক্ষেত্রে এরূপ বিধান দেয়া হয়েছে যে, অবশ্যম্ভাবী কিছু হিংসা ত্যাগ করা না গেলেও যোগীপুরুষ যথাসম্ভব হিংসাকে বর্জনের সংকল্প করে চিত্তশুদ্ধি করবেন। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- যোগবিঘ্ন হিংসা প্রভৃতি বিতর্ক নিবারণ করতে হলে যোগের অনুকূল অবিতর্ক অহিংসা প্রভৃতির যাতে স্ফূরণ হয়, তারই চেষ্টা করতে হয় (পাতঞ্জল-২/৩৩)।  লোভ, মোহ এবং ক্রোধ বশতই নিজ ইচ্ছাক্রমে অন্য কারো অনুরোধে অথবা নিজ অনুমোদনের দ্বারা হিংসা প্রভৃতি বিবিধ বিতর্ক সম্পাদিত হয়ে থাকে। ঐ লোভ, মোহ এবং ক্রোধ, মৃদু, মধ্য অথবা উগ্রভাবে উৎপন্ন হয়। মৃদুভাবে লোভ, মোহ কিংবা ক্রোধের উদয় হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও মৃদু হয়। ঐগুলো মধ্যভাবে উদিত হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও মধ্য হয়। আর সেগুলো উগ্রভাবে উদিত হলে হিংসা প্রভৃতি বিতর্কও উগ্র হয়। হিংসা প্রভৃতি বিতর্কবৃত্তি যেভাবেই স্ফূরিত হোক না কেন, তারা দুঃখ অজ্ঞান এবং ঐ উভয়ের অনন্ত ফল উৎপন্ন করে, এইভাবে ভাবনার নামই প্রতিপক্ষভাবনা। এই প্রতিপক্ষভাবনাবলে হিংসা বিতর্কসমূহের দোষ অনুসন্ধানে সেইসব থেকে যেসব দুঃখ হয়, তাদের আলোচনায় সমস্ত বিতর্কেরই নিবৃত্তি হয় (পাতঞ্জল-২/৩৪)।  যে মহাপুরুষ সম্পূর্ণ হিংসাশূন্য হয়েছেন, তার কাছে হিংস্র বন্য জন্তুরাও হিংসা পরিত্যাগ করে, তিনি হিংস্র জন্তুদের সহবাসেও নিরাপদে অবস্থান করতে পারেন (পাতঞ্জল-২/৩৫)।
  • (খ) সত্য : সত্য হলো চিন্তায় এবং বাক্যে কোনরূপ মিথ্যাচরণ না করা। তবে যোগশাস্ত্রে সত্য কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত। কাল ও পরিবেশ নির্বিশেষে সত্য যেন অপরের কল্যাণকর হয়। যথাদৃষ্ট, যথাশ্রুত এবং যথাউপলব্ধকে ব্যক্ত করাকে বলা হয় সত্যনিষ্ঠ। সৎ উদ্দেশ্যেও অসত্যের কথন বর্জনীয়, এমনকি অর্ধসত্যও অসত্যের মতোই বর্জন করা উচিত। তত্ত্ব বা সত্য যদি অপ্রিয় হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে যোগশাস্ত্রে মৌন থাকার বিধান দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- সত্যে প্রতিষ্ঠা জন্মিলে, সত্য ছাড়া মিথ্যা কথা না বললে, বাকসিদ্ধি হয়। কেউ যদি কোন ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান না করেন, অথচ কোন বাকসিদ্ধ পুরুষ যদি তার ভক্তি হবে বলেন, তাহলে সেই ভক্তি প্রাপ্তির অনুকূল কার্য না করেও সেসব কার্যের ফল ভক্তি লাভ করেন (পাতঞ্জল-২/৩৬)।
  • (গ) অস্তেয় : অস্তেয় হলো চৌর্যবৃত্তি পরিত্যাগ। যা নিজের নয় এমন দ্রব্য, এককথায় যা পরদ্রব্য তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা, এমন কি তাতে স্পৃহাও না করাই হলো অস্তেয়। এর দ্বারা চিত্তমল দূরীভূত হয়। এ সম্পর্কে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- সম্পূর্ণরূপে চৌর্য ত্যাগ হলে সমস্ত রত্নই প্রাপ্ত হওয়া যায় (পাতঞ্জল-২/৩৭)।
  • (ঘ) ব্রহ্মচর্য : ব্রহ্মচর্য হলো জননেন্দ্রিয়ের সংযম। কাম-আচরণ ও কাম-চিন্তা থেকে বিরত থাকা। রমণীসম্ভোগ ত্যাগ এবং বীর্য-ধারণকে ব্রহ্মচর্য বলে। ব্যাপক অর্থে ব্রহ্মচর্য হলো শরীর ও মনের পবিত্রতা। এইজন্য সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করে অল্প আহার এবং অল্প নিদ্রার বিধান দেয়া হয়েছে। ব্রহ্মচর্যের দ্বারা বাক্য ও সংকল্পের শক্তি বৃদ্ধি হয়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- যিনি নিষ্কাম হয়েছেন, যিনি জিতেন্দ্রিয় হয়েছেন, যিনি সর্বতোভাবে ব্রহ্মচর্যে সিদ্ধিলাভ করেছেন, তার অতুল বিক্রম, অদ্ভূত শক্তিলাভ হয়েছে। যে শক্তিপ্রভাবে কতো অলৌকিক কার্য করতে পারেন (পাতঞ্জল-২/৩৮)।
  • (ঙ) অপরিগ্রহ : অপরিগ্রহ হলো দেহরক্ষার বা প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয় ছাড়া সমস্ত প্রকার ভোগ বিলাসের আকাঙ্ক্ষা বর্জন, এবং অপরের দান অগ্রহণ। যোগসাধনাকালে উপলব্ধি করতে হবে যে, বিষয় অর্জন করলে দুঃখ, বিষয়ের রক্ষণে দুঃখ, বিষয়ের ক্ষয়ে দুঃখ এবং বিষয়ের গ্রহণেও দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। অর্থাৎ, অধিক ভোগ্য বস্তুর অধিকারী হলে মোক্ষে সিদ্ধিলাভ অসম্ভব হয়ে পড়ে। অপরিগ্রহের দ্বারা চিত্তে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত হয়। পাতঞ্জলসূত্র অনুসারে- দৃঢ়রূপে অপরিগ্রহ বৃত্তির স্ফূরণে যখন সর্বত্যাগ হয়, যখন সকল প্রকার ভোগবিলাসে বীতরাগ হয়, তখন নিজের সকল জন্মবৃত্তান্তই সুগোচর হয় (পাতঞ্জল-২/৩৯)।

যম হলো নিষেধাত্মক বিধি। কতকগুলো কর্ম থেকে প্রতিনিবৃত্ত হওয়ার সাধনাই হলো যম। যম যোগাঙ্গের প্রথম অঙ্গ এই কারণে যে, ইন্দ্রিয়াসক্ত, বিষয়ভোগী ও অসংযতচিত্ত ব্যক্তি কখনো যোগ সাধনার দুর্গম পথে অগ্রসর হতে পারে না। পাঁচপ্রকার যম জাতি, দেশ ও কাল অতিক্রান্ত হলে তা মহাব্রত বলে গণ্য হয়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- এই পাঁচপ্রকার যম যদি জাতি, দেশ, কাল ও সময় কর্তৃক বিচ্ছিন্ন না হয়ে সর্বাবস্থায় সমানভাবে আচরিত হয়, তাহলে তাদের প্রত্যেকটিকে একেকটি মহাব্রত বলা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৩১)।

নিয়ম : যোগের দ্বিতীয় অঙ্গ হলো নিয়ম। নিয়ম অর্থ নিয়মিত ব্রতপালনের অভ্যাস। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে- শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপ্রণিধানকে বলা হয় নিয়ম। (যোগসূত্র : ২/৩২)

  • (ক) শৌচ : ‘শৌচ’ শব্দের অর্থ শুচিতা বা শুদ্ধি। যোগের জন্য দেহ ও মন উভয়েরই শুচিতা দরকার। এ কারণে শৌচ দ্বিবিধ- বাহ্য ও আন্তর। প্রাত্যহিক স্নান হলো বাহ্য শৌচ। বাসগৃহ নির্মল রাখা এবং সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করা যোগীর বাঞ্ছনীয়। কারণ মদ, মাংস ইত্যাদি তামসিক আহার চিত্তের স্থিরতা নষ্ট করে এবং তার ফলে ব্রহ্মচর্যের হানি হয়। অপরপক্ষে আন্তর শৌচ হলো অহঙ্কার, অভিমান এবং হিংসা ইত্যাদি চিত্তের মলীনতা থেকে মুক্ত হওয়া। অহঙ্কারে উন্মত্ত, অভিমানী এবং হিংসাযুক্ত চিত্ত সর্বদা বিক্ষুব্ধ থাকায় সমাধিস্থ হতে পারে না। শৌচের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয় এবং চিত্তশুদ্ধির ফলে চিত্তে প্রসন্নতা আসে। পাতঞ্জলসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন- শৌচ সিদ্ধ হলে নিজ শরীর পর্যন্ত অশুচি বোধ হয়। সেজন্য নিজ শরীরের প্রতিও ঘৃণা ও বীতরাগ হয়। শৌচসিদ্ধের পর পরসঙ্গ-ইচ্ছাও ত্যাগ হয়ে থাকে (পাতঞ্জল-২/৪০)।  বাহ্যশৌচ সিদ্ধ হয়ে, পরে আন্তর শৌচ সিদ্ধ হলে সত্ত্বশুদ্ধি (অপূর্ব সুখপ্রকাশিনী সাত্তিকী বুদ্ধি শুদ্ধি) হয়। সত্ত্বশুদ্ধি থেকে সৌমনস্য (খেদ সম্পর্ক বিহীনা মানসী প্রীতি) হয়। সৌমনস্য থেকে একাগ্রতা (স্থৈর্য) হয়। ইন্দ্রিয়জয় থেকে আত্মদর্শন-শক্তি (আত্মজ্ঞান) হয় (পাতঞ্জল-২/৪১)।
  • (খ) সন্তোষ : ‘সন্তোষ’ বলতে বোঝায় অহেতুক আকাঙ্ক্ষাকে বর্জন করে যা পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। কেবলমাত্র সন্তোষের দ্বারাই সুখ পাওয়া যায়। কারণ সমস্ত কাম্য বিষয় পেলে তবেই তুষ্ট হবো এরূপ ভাবলে সমস্ত কাম্য বিষয় কখনোই পাওয়া যায় না। সন্তোষ সম্বন্ধে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- পূর্ণ সন্তোষ থেকে উত্তম সুখ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠসুখ লাভ হয়, যে সুখের অপর নাম দিব্যসুখ (পাতঞ্জল-২/৪২)। তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধানকেই ক্রিয়াযোগ বলা হয় (পাতঞ্জল-২/১)।  ঐ ক্রিয়াযোগের অন্তর্গত তপস্যা, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বরপ্রণিধান অভ্যাস করতে করতে নানাপ্রকার ক্লেশের ক্ষয় হতে থাকে এবং তার সাথে সাথে সমাধির অনুকূলশক্তিও বৃদ্ধি হতে থাকে (পাতঞ্জল-২/২)।
  • (গ) তপঃ : ‘তপঃ’ শব্দের অর্থ হলো তপস্যা বা ব্রত। যে যে কর্মে আপাতত সুখ হয় সেই সেই কর্মের নিরোধের চেষ্টাকে বলা হয় তপের চর্যা। যেমন, উপবাস করা বা শয্যাগ্রহণ না করা ইত্যাদি। বস্তুত শরীরের ত্রিধাতুর বৈষম্য না ঘটিয়ে চিত্তকে রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি থেকে মুক্ত করে যে কষ্টসাধন করা হয়, তাই তপঃ। এই যোগ শরীরসংক্রান্ত বলে একে শারীর ক্রিয়াযোগ বলা হয়। তপস্যা বা ব্রতাচারের মাধ্যমে চিত্ত দৃঢ় হয়। বস্তুত বিচলিত না হয়ে শান্তভাবে শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা সহকারে মহাব্রতের সাধনই হলো তপস্যা। মহর্ষি পতঞ্জলি তপস্যার ব্যাখ্যায় পাতঞ্জলসূত্রে বলেছেন- কঠোর তপস্যা দ্বারা শরীর ও ইন্দ্রিগণের অশুদ্ধি ক্ষয় হলে, শরীর ও ইন্দ্রিয়গণ সম্বন্ধেও সিদ্ধ হওয়া যায়। তখন শরীর ও ইন্দ্রিয়গণকে নিজ বশে আনা যায়। নিজ ইচ্ছানুসারে শরীরকে অতি স্থূল কিংবা অতি সূক্ষ্ম করা যেতে পারে। ইন্দ্রিয়দেরকে সুদূরবর্তী অতি সূক্ষ্ম ব্যবহিত পদার্থ মধ্যেও নিয়োগ করা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৪৩)।
  • (ঘ) স্বাধ্যায় : স্বাধ্যায় হলো বাচিক ক্রিয়াযোগ। ‘স্বাধ্যায়’ শব্দের অর্থ অধ্যয়ন ও জপ। প্রণব বা ওঁকারের জপ এবং আধ্যাত্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করাই মূলত স্বাধ্যায়। অধ্যয়ন আত্মজ্ঞানের প্রতি স্পৃহার উদ্রেক করে এবং জপ আত্মতত্ত্বে অনুপ্রবেশ ঘটায়। এর ফলে বিষয়চিন্তা ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে এবং পরমার্থ সত্যে আগ্রহ ও জ্ঞান বাড়ে। এ বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- স্বাধ্যায় সিদ্ধ হলে, ইষ্টদেবতা সন্দর্শন এবং তার সাথে সম্ভাষণ ঘটে থাকে (পাতঞ্জল-২/৪৪)।
  • (ঙ) ঈশ্বরপ্রণিধান : আর ক্রিয়াযোগ ঈশ্বরপ্রণিধান হলো একপ্রকার মানসক্রিয়াযোগ। ঈশ্বরের ধ্যান এবং সকল কর্ম ও কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণই হলো ঈশ্বরপ্রণিধান। ‘যা কিছু হচ্ছে সব ঈশ্বরের দ্বারাই হচ্ছে, আমি অকর্তা’- প্রত্যেক কর্মে এরূপ ভাবনা করে সমস্ত কর্মের ফল ঈশ্বরে সমর্পণ করে এইভাবে বার বার ঈশ্বর-প্রণিধান করতে করতে যোগীর চিত্তের মালিন্য দূর হয়ে স্বরূপদর্শন হয়। যোগীর তখন এরূপ উপলব্ধি হয় যে ঈশ্বর যেমন শুদ্ধ অর্থাৎ ধর্ম এবং ধর্মরহিত, প্রসন্ন অর্থাৎ অবিদ্যা ইত্যাদি ক্লেশশূন্য, কেবল এবং বিপাকবর্জিত অর্থাৎ জাতি আয়ু ভোগরূপ কর্মফল শূন্য, তেমনি পুরুষ বা প্রত্যগাত্মাও নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্তস্বভাব। এভাবেই বুদ্ধি থেকে পুরুষ ভিন্ন হয়ে সমাধি লাভ করেন। ঈশ্বরপ্রণিধান থেকে সমাধি সিদ্ধি হয়। সমাধি সিদ্ধির ফলে দেহান্তরে, দেশান্তরে এবং কালান্তরে যা ঘটে তা সবই জানা যায়। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- ঈশ্বর প্রণিধান বা ভগবানে চিত্ত নিবেশ দ্বারা সমাধি হয় (পাতঞ্জল-২/৪৫)।

আসন : অষ্টাঙ্গের তৃতীয় যোগাঙ্গ হলো আসন। এ প্রেক্ষিতে যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে- দেহের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে স্থির রেখে নিশ্চলভাবে সুখজনক অবস্থায় উপবেশনই আসন। (যোগসূত্র : ২/৪৬)। আসনের দ্বারা সুস্থ ও নীরোগ দেহ লাভ করা যায়। আসন নানা প্রকারের রয়েছে, যেমন- পদ্মাসন, ভদ্রাসন, বীরাসন, স্বস্তিকাসন, দণ্ডাসন প্রভৃতি। সুস্থ ও শুচি দেহ যোগীদের সমাধিলাভের পক্ষে বিশেষভাবে অনুকূল। স্থির হয়ে আসন করতে করতে যোগীর নিজের শরীরকে শূন্য মনে হয় এবং তিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীত, তাপে কাতর হন না। ক্রমশ যোগীর শারীরবোধ বিলীন হয়ে যায় এবং তার মনে হয় যে তিনি অনন্ত আকাশে মিলিয়ে গিয়ে আকাশের মতো সর্বব্যাপী হয়ে গিয়েছেন। একেই বলা হয় অনন্ত সমাপত্তি। আসন একপ্রকার যৌগিক ব্যায়াম। আসন অভ্যাসের দ্বারা নির্বিঘ্নে সমাহিত হওয়া যায়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়- স্বাভাবিকভাবে যেসব পদ্ধতিক্রমে উপবেশন করা হয়, সেসব পরিহারপূর্বক যোগীদের পদ্ধতি অনুসারে আসন অভ্যাস করতে করতে অনন্তে মগ্ন হতে পারলে, অচৈতন্যবারক তদাত্ম্য (তন্ময়তা) প্রাপ্তি হয়। তদাত্ম্য প্রাপ্তি হলে আসন অভ্যাসে কোন কষ্টবোধই হয় না (পাতঞ্জল-২/৪৭)।  আসন সিদ্ধি দ্বারা শীত গ্রীষ্মে অভিভূত হতে হয় না। তার দ্বারা ক্ষুৎপিপাসাও ব্যাকুল করতে পারে না। তা প্রাণায়ামের বিশেষ অনুকূল (পাতঞ্জল-২/৪৮)।

প্রাণায়াম : চতুর্থ যোগাঙ্গ হলো প্রাণায়াম। যোগী আসন সিদ্ধ হলে তবে তার প্রাণায়াম হয়। প্রাণায়াম হলো বায়ুর শ্বাসরূপ আভ্যন্তরিক গতি এবং প্রশ্বাসরূপ বহির্গতির বিচ্ছেদ। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে- শ্বাসগতি ও প্রশ্বাসগতির যে বিচ্ছেদ তাকেই বলে প্রাণায়াম। (যোগসূত্র : ২/৪৯)। স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস একটা ছন্দ অনুসারে বিরামহীনভাবে চলে। ঐ শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে গতিবিচ্ছেদ আনাই প্রাণায়ামের উদ্দেশ্য। শ্বাস নিয়ে প্রশ্বাস না ফেলে থাকা অবস্থায় যে গতিবিচ্ছেদ হয়, সেটি একপ্রকার প্রাণায়াম। আবার প্রশ্বাস ফেলে শ্বাস না নিয়ে থাকলে যে গতিবিচ্ছেদ হয়, সেটাও একপ্রকার প্রাণায়াম। পরম্পরাক্রমে এই প্রাণায়ামগুলো অভ্যাস করা হয়। তবে এই গতিবিচ্ছেদের সময় চিত্তকে অবশ্যই অচঞ্চল ও একাগ্র অবস্থায় রাখতে হয়। প্রাণায়ামের এই গতিবোধ তিন প্রকার- বাহ্যবৃত্তি, আভ্যন্তরবৃত্তি এবং স্তম্ভবৃত্তি। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- একই প্রাণায়াম তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগের নাম রেচক বা বাহ্যবৃত্তি, দ্বিতীয় ভাগের নাম পূরক বা অভ্যন্তরবৃত্তি, তৃতীয় ভাগের নাম কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি। ঐ তিন আবার দীর্ঘ ও সূক্ষ্মরূপে দেশ কাল এবং সংখ্যার দ্বারা সাধিত হয়ে থাকে। রেচক প্রাণায়ামের দেশ বহির্ভাগে, রেচক প্রাণায়াম করবার সময় বহির্ভাগে রেচিত বায়ু যদি অধিক দূর যায় তাহলে তার নাম দীর্ঘ, অল্পদূরে গেলে তার নাম সূক্ষ্ম। অভ্যন্তরই পূরক ও কুম্ভকস্থান। পূরক ও কুম্ভক করবার সময় শরীরের মধ্যে সর্বত্র বায়ু পূর্ণ হলে দীর্ঘ বলা যায়। তার বিপরীত হলে সূক্ষ্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। কালের দ্বারা ঐ তিন প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা স্থির করতে হলে, ঐ তিনের স্থিতিকাল নির্বাচন করতে হয়। ঐ তিন অধিক স্থায়ী হলে তাদের দীর্ঘ বলা যায়, অল্পস্থায়ী হলে সূক্ষ্ম। সংখ্যা অনুসারে মন্ত্র জপ দ্বারা ঐ তিনের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা নির্ণয় হতে পারে। নির্দিষ্ট অধিক জপে যে সকল প্রাণায়াম শেষ হয়, সেগুলো দীর্ঘপ্রাণায়াম। অল্প সংখ্যক জপে শেষ হলে সূক্ষ্ম প্রাণায়াম বলা যেতে পারে (পাতঞ্জল-২/৫০)।

  • (ক) রেচক বা বাহ্যবৃত্তি : শাস্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে শ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে ভিতরের বায়ুকে বাইরে স্থাপন করার নাম বাহ্যবৃত্তি বা রেচক।
  • (খ) পূরক বা আভ্যন্তরবৃত্তি : অপরদিকে বাইরের বায়ুকে শ্বাসগ্রহণের মাধ্যমে ভিতরে স্থাপন করাকে বলা হয় আভ্যন্তরবৃত্তি বা পূরক।
  • (গ) কুম্ভক বা স্তম্ভবৃত্তি : আর রেচক ও পূরক কিছুকাল অভ্যাস করে তাদের সাহায্য ব্যতীতই দেহস্থ বায়ুকে ধরে রেখে সারা শরীরকে বায়ুপূর্ণ করার নাম স্তম্ভবৃত্তি বা কুম্ভক। এ অবস্থায় শরীর জলপূর্ণ কুম্ভের ন্যায় স্থির ও নিষ্কম্প থাকে। দেশ, কাল ও সংখ্যার দ্বারা প্রাণায়ামের দীর্ঘতা ও সূক্ষ্মতা নির্মিত হয়। মূলত প্রাণায়াম হলো শরীর এবং ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়াহীনতা। প্রাণায়ামের দ্বারা চিত্ত ক্রমশ বৃত্তিশূন্য হয়।

পাতঞ্জলসূত্রে এই তিনপ্রকার প্রাণায়াম ছাড়াও চতুর্থ এক প্রকার প্রাণায়ামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন- প্রাণায়ামকর্তা যদি নিজ শরীরের অন্তর বাহ্য বিশেষরূপে পর্যালোচনা করে এই ত্রিবিধ প্রাণায়ামের অনুষ্ঠান করেন, তাহলে সেই অনুষ্ঠান চতুর্থ শ্রেণির প্রাণায়াম হিসেবে পরিগণিত হতে পারে (পাতঞ্জল-২/৫১)।

প্রাণায়াম অভ্যাসের ফললাভ সম্বন্ধে পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- ঐ চতুর্বিধ প্রাণায়াম অভ্যাস করতে করতে যখন সিদ্ধ হওয়া যায়, তখন সর্বশক্তিসম্পন্ন সর্ববস্তুপ্রকাশক বুদ্ধিসত্ত্বের প্রকাশ হয়। বুদ্ধিসত্ত্বের প্রকাশে মানসস্বরূপ অপ্রচ্ছন্ন হলে, তার অদ্ভূত ক্ষমতা তৈরি হয়। সেই ক্ষমতাবলে ধারণাশক্তি স্ফূরিত হয় (পাতঞ্জল-৫২-৫৩)।

প্রত্যাহার : যোগমতে প্রত্যাহার হলো পঞ্চম যোগাঙ্গ। ইন্দ্রিয়গুলোকে নিজ নিজ বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তের অনুগত করাই প্রত্যাহার। যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে- স্ববিষয় অসংযুক্ত হয়ে চিত্তের স্বরূপানুকার লাভকেই ইন্দ্রিয়সমূহের প্রত্যাহার বলা হয়। যেসব বিষয়ে যেসব বস্তুতে ইন্দ্রিয়গণ আসক্ত, সেসব বিষয় সেসব বস্তু থেকে তাদেরকে বিরত করে, সম্যক প্রকারে বিকৃতিহীন করে, নির্বিকার চিত্ত স্বরূপের অধীন করার নামই প্রত্যাহার (পাতঞ্জল-২/৫৪)। যোগের জন্য ইন্দ্রিয়সমূহের প্রত্যাহার প্রয়োজন। বিষয়সমূহ থেকে পঞ্চ বাহ্য ইন্দ্রিয় ও আন্তরিন্দ্রিয় মনকে বিযুক্ত বা নিবৃত্ত করা প্রয়োজন। তাই বিষয়বিযুক্তি সাধনের উপায় দুটি- (১) বাহ্য বিষয় লক্ষ্য না করা, (২) মানসভাব নিয়ে থাকা। এইভাবে চিত্ত যখন ইন্দ্রিয়গুলোকে চালনা করে তখন বিষয়ের প্রতি আসক্তি দূর হওয়ার ফলে যোগসাধনা সম্ভব হয়। অনেক সময় অন্যমনস্কতাবশত ইন্দ্রিয়সমূহ বিষয় থেকে নিবৃত্ত হয়। এইরূপ নিবৃত্তি প্রত্যাহার নয়। ইন্দ্রিয়সমূহকে নিজের বশীভূত করে বিষয় গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত হওয়াকেই প্রত্যাহার বলে। উল্লেখ্য যে, যম, নিয়ম ইত্যাদি অভ্যাস করার পর প্রত্যাহার অভ্যাস করলে তবেই যথাযথ ফল পাওয়া যায়। তাই পাতঞ্জলসূত্রে মহর্ষি পতঞ্জলি বলেন- এই প্রত্যাহার প্রভাবে অবশীভূত ইন্দ্রিয়রা সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হয় (পাতঞ্জল-২/৫৫)।

ধারণা : ধারণা হলো, যে দেশে ধ্যেয়বস্তুকে ধ্যান করতে হবে, সেই দেশে চিত্তকে আবদ্ধ করা। যেমন, পূজার সময় দেখা যায় অন্য বিষয় থেকে সরিয়ে এনে চিত্তকে শরীরের মধ্যে নাভিচক্র বা নাকের ডগায় স্থাপন করা হয় অথবা বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রভৃতি মূর্তিতে চিত্তকে স্থির রাখা হয়। ধারণার ব্যাখ্যায় যোগসূত্রের বিভূতিপাদে বলা হয়েছে- চিত্তকে কোন দেশে (নাড়ীচক্রে, ভ্রূমধ্যে, নাসাগ্রে অথবা কোন দিব্যমূর্তিতে) আবদ্ধ বা সংস্থিত রাখাকেই বলা হয় ধারণা (পাতঞ্জল-৩/১)। চিত্তকে বাহ্য বা আন্তর দেশ বিশেষে আবদ্ধ রাখা যায়। পূর্ববর্ণিত যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার এই পঞ্চ যোগাঙ্গের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়ের প্রত্যাহার ও চিত্তশুদ্ধি ঘটলে চিত্তকে নাসিকাগ্র, ভ্রূমধ্য, নাভিচক্র, জিহ্বাগ্র বা হৃদপদ্মে স্থাপন করাকেই ধারণা বলা হয়। যোগশাস্ত্রে গ্রাহ্য, গ্রহণ এবং গ্রহীতা ভেদে ত্রিবিধ ধারণার কথা বলা হয়েছে। আবার তত্ত্বজ্ঞানময় ধারণা ও বৈষয়িক ধারণা ভেদে ধারণাকে দ্বিবিধ বলা হয়। অন্যদিকে যৌগিক তন্ত্রশাস্ত্রে ষট্চক্রকে ধারণার বিশেষ কেন্দ্ররূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ষট্চক্র : আমাদের স্নায়ুরজ্জুর প্রধান ধারক মেরুদণ্ড মস্তিষ্কের নিম্নাংশ থেকে বের হয়ে গুহ্যদেশে এসে শেষ হয়েছে। যোগ-শাস্ত্রকারীদের মতে মেরুদণ্ডের বাঁদিকে ইড়া (Ida Nadi), মধ্যে সুষুম্না (Sushumna Nadi) ও ডানদিকে পিঙ্গলা (Pingala Nadi) নাড়ী বিরাজমান। আমাদের সঞ্চারণমান প্রাণবায়ু ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ীর মধ্যে দিয়ে চক্রাকারে সতত আবর্তিত হচ্ছে। সুষুম্না একটি অতি সূক্ষ্ম, জ্যোতির্ময়, সূত্রাকার ও প্রাণময় পথ- মেরুদণ্ডের পথে যার অবস্থান। সুষুম্না নাড়ীর এই প্রাণময় পথে ছয স্থানে ছয়টি চক্র বিরাজ করছে, যাকে ষট্চক্র বলা হয়। বিমুক্তিসোপান গ্রন্থে বলা আছে- ভ্রূমধ্যে, কণ্ঠদেশে, হৃদয়ে, নাভিমূলে, লিঙ্গদেশে ও গুহ্যস্থানে ষট্চক্র বিরাজ করেন। (বিমুক্তিসোপান)। এই ষট্চক্র হচ্ছে,

  • (১) ললাটে অর্থাৎ ভ্রূমধ্যে আজ্ঞাচক্র (Agnya Chakra),
  • (২) আজ্ঞাচক্রের নিচে কণ্ঠমূলে বিশুদ্ধিচক্র (Vishuddhi Chakra),
  • (৩) বিশুদ্ধিচক্রের নিচে হৃদিস্থানে অনাহত চক্র (Anahata Chakra),
  • (৪) অনাহত চক্রের নিচে নাভিমূলে নাভিচক্র বা মণিপুর চক্র (Nabhi Chakra/Manipura Chakra),
  • (৫) মণিপুর চক্রের নিচে লিঙ্গমূলে সুষুম্নার মধ্যে স্বাধিষ্ঠান চক্র (Swadhisthana Chakra),
  • (৬) স্বাধিষ্ঠান চক্রের নিচে গুহ্য ও লিঙ্গের মধ্যস্থলে কুন্দস্থানে সুষুম্নানাড়ীর মুখদেশে মূলাধারচক্র (Mooladhara Chakra)। এই মূলাধার প্রদেশেই মুখব্যাদান করে ব্রহ্মদ্বারে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনীর অধিষ্ঠান।

ধ্যান : ধ্যেয় বস্তুতে চিত্তকে নিরবচ্ছিন্নভাবে আবদ্ধ করাই ধ্যান। যোগসূত্রের বিভূতিপাদে বলা হয়েছে- ধারণাতে প্রত্যয় বা জ্ঞানবৃত্তির স্থির আলম্বন বা একতানতাকেই ধ্যান বলে। (যোগসূত্র : ৩/২) ধারণা গভীরতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হলে ধ্যানে পর্যবসিত হয়। সাধারণভাবে ধারণাতে জ্ঞানবৃত্তি কেবল অভীষ্ট বিষয়েই আবদ্ধ থাকে। এইরূপ বিষয়ক জ্ঞান খণ্ড খণ্ড ভাবে ধারাবাহিক ক্রমে চলতে থাকে। অভ্যাসের দ্বারা যখন তাদের মধ্যে একতান বা অখণ্ড ধারা প্রবাহিত হয় তখনই তাকে যোগের পরিভাষায় ‘ধ্যান’ বলে। ধ্যান তাই চিত্তস্থৈর্যের অবস্থা বিশেষ। ধ্যানশক্তির বলে সাধক যে কোন বিষয় অবলম্বন করে ধ্যান করতে পারেন। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- নিজের অভিমত যে কোন দিব্যবস্তু ধ্যান করো না কেন, তার প্রভাবে অবশ্যই একাগ্রশক্তি প্রবল হবে (পাতঞ্জল-১/৩৯)। ধারণা ও ধ্যানের মধ্যে পার্থক্য হলো, ধ্যান অবিচ্ছিন্ন আর ধারণা বিচ্ছিন্ন। একই বিষয় সম্পর্কে চিন্তা হলেও ধারণার ক্ষেত্রে খণ্ড খণ্ড জ্ঞানের উদ্ভব হয়, আর ধ্যানের ক্ষেত্রে জ্ঞানের বিষয় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহের মতো চলতে থাকে। ধারণার প্রত্যয়কে বিন্দু বিন্দু জল বা তেলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। অন্যদিকে ধ্যানের প্রত্যয় হলো অবিচ্ছিন্ন জলধারা বা তৈলধারার ন্যায়।

সমাধি : অষ্টাঙ্গিক যোগের সর্বশেষ যোগাঙ্গ হলো সমাধি। এ অবস্থায় ধ্যাতা অর্থাৎ ধ্যানকর্তা এবং ধ্যেয় বিষয়ের ভেদ লুপ্ত হয়ে যায়। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুতে লীন হওয়ার ফলে ধ্যেয়স্বরূপতা প্রাপ্ত হয়। যোগসূত্রের কৈবল্যপাদে বলা হয়েছে- ধ্যান যখন ধ্যেয়ের স্বভাবের আবেশে জ্ঞানাত্মক স্বভাবশূন্য হয় তখন তাকে সমাধি বলা হয়। (যোগসূত্র : ৩/৩)। সমাধি হলো ধ্যানের চরম উৎকর্ষ, চিত্তস্থৈর্যের সর্বোত্তম অবস্থা। প্রগাঢ় ধ্যানে বিষয়ের স্বভাবে চিত্ত আবিষ্ট হয়ে যখন আত্মহারা হয় তখন তাকে বলে সমাধি। এ অবস্থায় ধ্যেয় বিষয়ের সত্তারই উপলব্ধি হয়। আত্মসত্তা অভিভূত হয়। ধ্যেয় বস্তুর সঙ্গে ধ্যানকর্তার কোন ভেদ থাকে না। তাই সমাধিতে ধ্যানের জ্ঞানও থাকে না, ধ্যানকর্তার জ্ঞানও থাকে না। চিত্ত ধ্যেয় বস্তুতে সম্পূর্ণ লীন হয়ে ধ্যেয়-স্বরূপই প্রাপ্ত হয়। অষ্টাঙ্গিক যোগের যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম ও প্রত্যাহার এই পঞ্চ যোগাঙ্গকে যোগের বহিরঙ্গ সাধন বলা হয়। কারণ এগুলোর সেরূপ কোন বিষয় নেই। যোগের এই বহিরঙ্গ মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সাধনপাদে বর্ণিত হয়েছে। আর ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই তিনটি যোগাঙ্গ হচ্ছে যোগের অন্তরঙ্গ সাধন। কেননা এগুলো চিত্তবৃত্তিনিরোধের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে সম্পর্কিত। এই তিনটি যোগাঙ্গকে একসঙ্গে বলা হয় সংযম। পাতঞ্জলসূত্রে সংযমের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- পার্থিব কিংবা অপার্থিব কোন বস্তুতে বা বিষয়ে ধারণা, ধ্যান ও সমাধির যে সন্মিলিত প্রয়োগ, তারই এক নাম সংযম (পাতঞ্জল-৩/৪)। সংযম আয়ত্ত হলে দিব্যজ্ঞানময়ী পরমাবুদ্ধি স্ফূরিত হয়। সেই বুদ্ধিপ্রভাবে অসম্ভব সম্ভব হয়। অসাধ্য সাধ্য হয়। তার প্রভাবে করা যায় না এমন কার্য নেই (পাতঞ্জল-৩/৫)। উপরিউক্ত অষ্টাঙ্গ যোগ সবীজ বা সম্প্রজ্ঞাত সমাধির উপযোগী। নির্বীজ বা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি এই অষ্ট যোগাঙ্গের লক্ষ্য নয়। যোগমতে সম্প্রজ্ঞাত সমাধির মাধ্যমেই কেবল অসম্প্রজ্ঞাত সমাধিতে উন্নীত হওয়া যায়। অর্থাৎ, উপরিউক্ত অষ্ট যোগাঙ্গ সম্প্রজ্ঞাত সমাধির পথ প্রস্তুতকারক। পাতঞ্জলসূত্র অনুসারে- সংযম অপেক্ষা যমনিয়মাদি সমাধির অন্তরঙ্গ নয়। সংযম-বলে অতি সূক্ষ্ম বস্তুতেও চিত্ত সমাহিত হয় (পাতঞ্জল-৩/৭)।  সর্বমনোবৃত্তির নিরোধের নাম নির্বীজ সমাধি। সংযম সেই নির্বীজ সমাধির বহিরঙ্গ ব্যতীত অন্তরঙ্গ নয় (পাতঞ্জল-৩/৮)।  বারবার চিত্ত নিরোধপরিণাম উৎপন্ন হলে তার প্রভাবে যে সুদৃঢ় সংস্কার জন্মায়, সেই সংস্কার-বলে সেই চিত্ত নিরোধপরিণামের প্রশান্ত স্থৈর্যস্রোত নিরন্তর প্রবাহিত হতে থাকে (পাতঞ্জল-৩/১০)।  নানা বস্তু সম্বন্ধীয় নানা প্রকার মনোবৃত্তির নিবৃত্তি হলে যে এক পরমবস্তু বিষয়ক পরমাবৃত্তি উদিত হয়, তা-ই সমাধি-পরিণাম (পাতঞ্জল-৩/১১)।

যোগদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব

ভারতীয় জনশ্রুতি অনুসারে সাংখ্যদর্শন নিরীশ্বর সাংখ্য এবং যোগদর্শন সেশ্বর সাংখ্যরূপে গণ্য হয়। অর্থাৎ, সাংখ্যদর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু সাংখ্যকথিত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব ছাড়াও যোগ দর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব স্বীকৃত হয়েছে। তবে অন্যান্য ঈশ্বরবাদী দর্শনের মতো যোগদর্শনে জগতের সৃষ্টিকর্তারূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয়নি। এখানে ঈশ্বর প্রধান নয়, আবার পুরুষমাত্র নন। তিনি ঐশ্বর্যযুক্ত, চিত্তবান, সদামুক্ত, পুরুষবিশেষ। যোগসূত্রকার মহর্ষি পতঞ্জলি ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধি লাভের অন্যতম উপায় বলে মনে করেন। যোগসূত্রের সমাধিপাদে ঈশ্বরের উল্লেখ ও নিরূপণ করে বলা হয়েছে- সমাধি ও তার ফললাভের জন্য ঈশ্বর-উপাসনা ও ঈশ্বরে সর্বসমর্পণ করা। (যোগসূত্র : ১/২৩)।

পতঞ্জলি বর্ণিত সম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভের উপায় অষ্টাঙ্গিক যোগের একটি তথা দ্বিতীয় যোগাঙ্গ হলো নিয়ম। ঈশ্বরপ্রণিধান নিয়মেরই অন্তর্ভুক্ত। ঈশ্বরচিন্তা সমাধিলাভে সহায়ক হয়। তাছাড়া ঈশ্বর ধারণারও বিষয় হতে পারেন এবং তার ফলে সমাধিপ্রাপ্তি ত্বরান্বিত হতে পারে। পতঞ্জলি ঈশ্বরের এই ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়া কোন তাত্ত্বিক প্রয়োজনের কথা বলেন নি। সমাধি লাভের বিকল্প উপায়রূপেই তিনি ঈশ্বরপ্রণিধানের কথা বলেছেন। ঈশ্বরপ্রণিধান হলো ঈশ্বরে সর্বকর্ম অর্পণপূর্বক তার নিরন্তর ভাবনা, শুধু কর্ম অর্পণমাত্র নয়। তাই ঈশ্বরপ্রণিধান হলো একপ্রকার ভক্তি।  ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ বা আমিত্বকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদনের ফলে ঈশ্বর সাধককে ইচ্ছার দ্বারা অনুগৃহীত করেন এবং সাধকের সমাধিলাভ সমাসন্ন হয়। পতঞ্জলির পরবর্তীকালের যোগ দার্শনিকরা যোগদর্শনে উক্ত ব্যবহারিক প্রয়োজন ছাড়াও ঈশ্বরের তাত্ত্বিক প্রয়োজন স্বীকার করেছেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নানা প্রমাণও উপস্থাপন করা হয়েছে।

ঈশ্বরের লক্ষণ প্রসঙ্গে পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে- ঈশ্বর হলেন ক্লেশ, কর্ম, বিপাক এবং আশয় দ্বারা অপরামৃষ্ট পুরুষ বিশেষ। (যোগসূত্র : ১/২৪)। অপরামৃষ্ট অর্থ প্রভাবিত না হওয়া। যোগশাস্ত্রে ঈশ্বর কখনোই পুরুষ বা প্রকৃতির স্রষ্টা নয়। তবে তিনি পুরুষবিশেষ। ক্লেশ, কর্ম, বিপাক ও আশয়ের দ্বারা বদ্ধ না হওয়াই তার বৈশিষ্ট্য। যোগশাস্ত্রে পঞ্চবিধ ক্লেশের কথা বলা হয়। এই পঞ্চক্লেশ হলো- অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ বা মৃত্যুভয়। এই পঞ্চক্লেশ ঈশ্বরকে কখনোই স্পর্শ করে না, যেহেতু ঈশ্বর ঐ সকল ক্লেশের মূল অবিদ্যারহিত।

কর্ম হলো পাপ ও পূণ্য। যোগদর্শনে কর্মকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- ধর্ম এবং অধর্ম। ধর্ম হলো বেদবিহিত কর্ম এবং অধর্ম হলো বেদনিষিদ্ধ কর্ম। ঈশ্বরের ক্ষেত্রে বিধি অথবা নিষেধ সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ ঈশ্বর যেহেতু আপ্তকাম, সেহেতু তার কর্মে প্রবৃত্তি অসম্ভব। ফলে ঈশ্বর পাপ-পূণ্যরহিত। বিপাক অর্থ কর্মফল। কর্মফল তিনটি, যথা- জাতি, আয়ু এবং ভোগ। জাতি বলতে বোঝায় আমরা কোন্ পরিবেশে জন্মাবো। যেমন, আমি সৎ ও শুচি পিতামাতার সংসারে জন্মাবো না-কি কৃমিকীটের সন্তান হয়ে জন্মাবো তা নির্ভর করে আমারই কর্মের উপর। সৎ কর্মের ফল হলো পূণ্য এবং অসৎ কর্মের ফল হলো পাপ। এই পূণ্য এবং পাপ সঞ্চিত থাকার ফলে আমাদের সুখ এবং দুঃখভোগ হয়। সুখভোগ এবং দুঃখভোগের দ্বারাই সঞ্চিত কর্মফলের ক্ষয় হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ভোগের জন্য প্রয়োজন হলো নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল। এইজন্য দ্বিতীয় বিপাক হিসেবে আয়ুর কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, কর্মের ফলের জন্য ব্যক্তির আয়ু নির্দিষ্ট হয় এবং সুখ-দুঃখের ভোগের ব্যবস্থা হয়। যেহেতু ঈশ্বরের কর্ম নেই, সেহেতু তার জাতি, আয়ু ও ভোগরূপ বিপাক থাকতে পারে না। আশয় হলো সংস্কার বা কর্মফল জন্য বাসনা। সংস্কার অর্থ এক্ষেত্রে পূণ্য কর্মজন্য অথবা পাপ কর্মজন্য সংস্কার। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বরের কর্ম নেই, সেহেতু আশয়ও নেই।

ঈশ্বরকে পুরুষবিশেষ বলার হেতু হলো, ঈশ্বর অন্যান্য পুরুষ বা আত্মা থেকে ভিন্ন। ঈশ্বরভিন্ন অন্যান্য পুরুষ কৈবল্যপ্রাপ্ত হন এবং যখন কৈবল্যপ্রাপ্ত হন তখন তিনিও ক্লেশাদিঅপরামৃষ্ট থাকেন। মুক্ত পুরুষের ক্লেশ প্রভৃতি মুক্তি বা কৈবল্যপ্রাপ্তির পূর্বে ছিলো, বর্তমানে নেই। কিন্তু ঈশ্বরের ক্ষেত্রে ক্লেশ প্রভৃতি কোনকালেই ছিলো না। ঈশ্বর কৈবল্যপ্রাপ্ত হন না। ঈশ্বরের সঙ্গে কৈবল্যের বর্তমান, ভূত বা ভাবী কোন সম্বন্ধই নেই। এজন্য ঈশ্বর মুক্ত পুরুষ থেকে স্বতন্ত্র। তিনি সদামুক্ত। তিনি বর্তমানে, অতীতে বা ভবিষ্যতে কৈবল্যপ্রাপ্ত হবেন এমন নন। বাচস্পতি মিশ্রের মতে জ্ঞান, ক্রিয়া, শক্তি প্রভৃতি সম্পদই ঈশ্বরের স্বরূপ বা ঐশ্বর্য। ঈশ্বরের ঐশ্বর্য সর্বাপেক্ষা মহৎ। এই ঐশ্বর্য অসাম্য ও নিরতিশয়। এই ঐশ্বর্যের তুল্য অথবা তা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ঐশ্বর্য আর কারোর থাকতে পারে না। তাই বলা যায়, কাষ্ঠাপ্রাপ্ত ঐশ্বর্যযুক্ত বিলক্ষণ পুরুষই ঈশ্বর। সুতরাং, ঈশ্বর নামক পুরুষ নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ এবং মুক্তস্বভাব।

যোগদর্শনে ত্রিবিধ বন্ধনের কথা বলা হয়েছে। এই তিনপ্রকার বন্ধন হলো- প্রাকৃতিক, বৈকৃতিক ও দাক্ষিণ। প্রকৃতিলীনদের প্রাকৃতিক বন্ধন, বিদেহলীনদের বৈকৃতিক বন্ধন এবং দক্ষিণা-নিষ্পাদ্য যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকারীদের দাক্ষিণ বন্ধন। সাধারণ কৈবল্যপ্রাপ্ত পুরুষগণ এই ত্রিবিধ বন্ধনের অধীনতার বশবর্তী ছিলেন এবং কালক্রমে তা থেকে মুক্ত হয়েছেন। কিন্তু ঈশ্বরকে এসকল বন্ধন কোনভাবেই স্পর্শ করতে পারে না। তাছাড়া ঈশ্বর সর্বজ্ঞ হলেও অন্যান্য পুরুষের ন্যায় চিত্তবৃত্তি তার থাকে না। ঈশ্বরে চিত্ত স্বীকার করলেও সে চিত্ত হবে নির্মাণচিত্ত। পরম করুণাময় জীবের দুঃখ-ক্লেশ দূর করার জন্য চিত্ত গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তার চিত্ত নির্মিত হয়। রজস্তম অপহত এরূপ সাত্ত্বিক চিত্তকেই নির্মাণ চিত্ত বলা হয়।

যোগমতে পরমপুরুষ ঈশ্বর কিন্তু জগৎস্রষ্টা নন। নৈতিক দিক থেকে জীবের অদৃষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ এবং অদৃষ্ট অনুযায়ী প্রকৃতির বিবর্তনের জন্য ঈশ্বরকে প্রকৃতি-পুরুষ সংযোগের নিমিত্ত কারণ বলা হয়। কিন্তু তিনি স্বয়ং জগৎ সৃষ্টি করেন না। জগৎ সৃষ্টি যোগমতে ব্রহ্মার কাজ। শ্রুতিতে বলা হয়েছে দেবতাদের মধ্যে হিরণ্যগর্ভ ব্রহ্মা প্রথম উৎপন্ন হয়েছিলেন। তিনিই বিশ্বের কর্তা এবং ভুবনের পালয়িতা। স্মৃতিতে আছে, জগৎস্রষ্টা ব্রহ্মা মুক্তপুরুষ নন। পরে তার মুক্তি হয়। নিত্যমুক্ত ঈশ্বরের পক্ষে জগৎ সৃষ্টি তাই যুক্তি-বিরুদ্ধ ও শাস্ত্রবিরোধী। ঈশ্বরের উপদেশ অনুযায়ী ব্রহ্মা জগৎ সৃষ্টি করেন। যোগমতে সৃষ্টিকালে ও কল্পান্তে ব্রহ্মাদি দেবগণের সৃষ্টি ও বিনাশ হয়। কিন্তু ঈশ্বর সৃষ্টি-বিনাশরহিত। তিনি কালের দ্বারা অবচ্ছিন্ন নন। তিনি শুধু সাধারণ জীবেরই গুরু বা উপদেষ্টা নন, পূর্বাপূর্ব সৃষ্টিকর্তাদের তথা গুরুদেরও গুরু বা উপদেষ্টা।

যোগশাস্ত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রমাণ

মহর্ষি পতঞ্জলি পৃথকভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে কোন প্রমাণ দেননি। ঈশ্বরের প্রণিধান প্রসঙ্গেই তিনি ঈশ্বরের লক্ষণ বা পরিচয় দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে যোগসূত্রের সমাধিপাদে তিনি বলেন- ঈশ্বরেই সর্বজ্ঞবীজ নিরতিশয়ত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। (যোগসূত্র : ১/২৫)। পরবর্তীকালে এই সূত্রটিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও পরবর্তী যোগ দার্শনিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে অনুমান ও আগমপ্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তাদের উপস্থাপিত প্রমাণগুলো নিম্নরূপ।

  • (১) প্রথমত, যে জিনিসের মাত্রাভেদ আছে তার একটি উচ্চতম বা চরমতম এবং নিম্নতম বা ন্যূনতম মাত্রা থাকতে বাধ্য। উচ্চতম বা চরমতম মাত্রাকে বলে কাষ্ঠা। জ্ঞান ও শক্তির মাত্রাভেদ আছে। ব্যবহারিক জীবনে কোন জীবের জ্ঞান ও শক্তি বেশি আবার কারো কম। যেখানেই আমরা অল্প, বহু, বহুতর, বহুতম- এইভাবে ক্রমবর্ধমান কোন গুণকে সাজাই, সেখানেই যুক্তিসঙ্গতভাবে আমাদের একটি নিরতিশয় বা পরাকাষ্ঠা স্বীকার করতে হয়। সর্বজ্ঞতার বিচারে প্রাণীদের এরূপ ক্রমিক তারতম্যের প্রেক্ষিতে পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির একটি নিরতিশয় পরাকাষ্ঠাও স্বীকার করতে হবে। পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির অধিকারী কোন সসীম জীব হতে পারে না। অতএব, পূর্ণজ্ঞান ও পূর্ণশক্তির অধিকারী এক সর্বজ্ঞবীজস্বরূপ ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
  • (২) দ্বিতীয়ত, বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয়। যোগদর্শন আস্তিক দর্শন। এই দর্শন বেদ তথা বেদানুসারী শাস্ত্রসমূহে বিশ্বাসী। শ্রুতিতে নিত্য, শুদ্ধ, মুক্তস্বভাব ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং বেদ যদি অভ্রান্ত হয় তাহলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা ছাড়া উপায় নেই।
    প্রশ্ন হতে পারে, বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি যেসব শাস্ত্র ঈশ্বরের রচিত বলে স্বীকার করা হয়, তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিভাবে প্রমাণ করে? এর উত্তরে যোগভাষ্যকার বেদব্যাস বলেন, বেদের মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। যদিও ঈশ্বর বেদের রচয়িতা তবু অস্তিত্বের দিক থেকে বিচার করলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বেদের অস্তিত্বের পূর্বে। অতএব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না।
  • (৩) তৃতীয়ত, প্রকৃতির অভিব্যক্তির নিমিত্তকারণরূপেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়। পুরুষের সঙ্গে সংযোগ ভিন্ন প্রকৃতির অভিব্যক্তি সম্ভব নয়। অচেতন প্রকৃতি ও সচেতন পুরুষের স্বাভাবিক সংযোগ সম্ভব নয়। পুরুষ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় তার পক্ষে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসা সম্ভব নয়। আবার প্রকৃতি অচেতন হওয়ায় তার পক্ষে পুরুষের অবস্থান জানা সম্ভব নয়। তাছাড়া জগৎ সৃষ্টি বা প্রকৃতির বিবর্তন জীবের অদৃষ্ট অনুসারেই হয়। জীবের অদৃষ্ট সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ছাড়া কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। সুতরাং স্বীকার করতে হয় যে, অদৃষ্টানুসারে ঈশ্বর জগতের বিবর্তনের ইচ্ছা করেন এবং তারই ইচ্ছায় প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ সম্ভব হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব ব্যতীত এসব সম্ভব নয় বলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
  • (৪) চতুর্থত, সৃষ্টির আদিতে বা অতীত সৃষ্টিতে যে মোক্ষজ্ঞান ও মোক্ষাভিলাষ পরিলক্ষিত হয়, সেই জ্ঞানের উন্মেষের জন্য কোন জ্ঞানী গুরু স্বীকার করা প্রয়োজন। কিন্তু এই জ্ঞানের কারণ হিসেবে কোন মানুষ অথবা স্বর্গের কেউ গুরু, একথা বলা যায় না। কারণ, যোগমতে কপিলাদি পূর্বাচার্যগণ এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবগণ কালাবচ্ছিন্ন। কল্পেই তাদের আবির্ভাব আবার কল্পান্তে তাদের বিনাশ হয় বলে শ্রুতিতে উক্ত হয়েছে। যেহেতু তারা সকলেই সীমিত, সেহেতু তাদেরও গুরু ছিলেন, একথা স্বীকার করা প্রয়োজন। ফলে অতীত ও অনাগত সৃষ্টিতে মোক্ষজ্ঞানের বা প্রকর্ষগতির হেতুরূপে কালের দ্বারা সীমাবদ্ধ নন এমন একজন গুরু স্বীকার করতে হবে যিনি অনাদি ও অনন্তজ্ঞানসম্পন্ন। সেই গুরুই নিত্যমুক্ত ঈশ্বর। এজন্যেই যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে- তিনি (ঈশ্বর) অনাদি গুরু, যিনি কালের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বা সীমাবদ্ধ নন। (যোগসূত্র : ১/২৬)।

যোগমতে ‘প্রণব’ বা ‘ওঁ’-কার শব্দ ঈশ্বরের বাচক শব্দ। এ প্রেক্ষিতে যোগসূত্রের সমাধিপাদে বলা হয়েছে- প্রণব বা ওঁকারই ঈশ্বরের বাচক। (যোগসূত্র : ১/২৭)। প্রতিটি বস্তুরই একটি বাচক শব্দ আছে। বাচ্য পদার্থ এবং বাচক শব্দের সম্বন্ধ হলো নিত্য অর্থাৎ স্বাভাবিক। তাই বাচক শব্দটি উচ্চারণ করলে বাচ্য পদার্থের একটি আকার বা চেহারা আমাদের মনে ভেসে ওঠে। যেমন- ‘গরু’ শব্দ উচ্চারণ করলে শিং ও লেজযুক্ত একটি পশুর আকার আমাদের মনে ভেসে ওঠে। অর্থাৎ বাচক শব্দের দ্বারা বাচ্যপদার্থ জ্ঞাত হয়। তবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থসমূহ বাচক শব্দ ছাড়াও জ্ঞাত হতে পারে, যেমন নীল সবুজ ইত্যাদি বর্ণ বা বৃক্ষাদি দ্রব্য। কিন্তু সব পদার্থ এরূপ নয়। ‘পিতা’, ‘পুত্র’ প্রভৃতি শব্দের অর্থ কেবলমাত্র শব্দশ্রবণ বা শব্দস্মরণের মাধ্যমেই হতে পারে। যিনি পুত্র উৎপাদন করেন তিনিই পিতা। তাই ‘পিতা’ শব্দের অর্থ নির্ধারণ বিষয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার উপর নির্ভর করে না। অনুরূপভাবে ‘প্রণব’ বা ‘ওঁ’ শব্দ সংকেতমাত্রের দ্বারাই বোধব্য। এ স্থলে বাচ্য-বাচক সম্বন্ধ প্রদীপপ্রকাশবৎ। প্রদীপ যেমন স্বভাবতই প্রকাশস্বভাব, তেমনি ‘ওঁ’ শব্দ শ্রবণমাত্রই ঈশ্বর বা ‘ওঁ’ শব্দের অর্থ অন্তরে প্রকাশিত হন। ‘ওঁ’ শব্দ শ্রবণমাত্রই যার নিকট সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের স্মৃতি উপস্থিত হয় তিনিই বিজ্ঞ যোগী। সেইরূপ যোগীর দ্বারা প্রণবের জপ ও তার ভাবনাই হলো ঈশ্বর-প্রণিধান। নিরন্তর প্রণব জপ থেকে চিত্তের একাগ্র সম্পাদিত হয়। এবং এইভাবে ঈশ্বরের প্রণিধানের মাধ্যমে সমাধিস্থ যোগীর আত্ম-চৈতন্য অধিগত হয়। আত্ম-চৈতন্যের এরূপ উপলব্ধি ও তার কারণরূপ পুরুষের স্বরূপতা নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত স্বভাবে অবস্থানকেই কৈবল্য বলে। উল্লেখ্য, মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের সমাধিপাদে এভাবে ঈশ্বরপ্রণিধানকে সমাধি বা কৈবল্যলাভের বিকল্প উপায় বলে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তী পরিচ্ছদ সাধনপাদে অন্যতম যোগাঙ্গ ‘নিয়ম’-এর আলোচনা প্রসঙ্গে ঈশ্বরপ্রণিধানের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে এটি সমাধিলাভের পক্ষে অবশ্যকর্তব্য। এখানে বলা হয়েছে, ঈশ্বরপ্রণিধান করতে হলে মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা- এই চারটি ভাবনার অভ্যাস করতে হবে। সর্বজীবে মৈত্রীভাবনার অর্থ শত্রুর সুখেও মিত্রের সুখের মতো সুখী হওয়া। দ্বিতীয়ত, শত্রুর দুঃখকে প্রিয়জনের দুঃখ মনে করে করুণাভাবের সাধন করতে হবে। তৃতীয়ত, সধর্মী ও বিধর্মী সকলের পূণ্য আচরণেই মনে মুদিতাভাব আনতে হবে এবং অপরের দোষ দেখেও অগ্রাহ্য করতে হবে। চতুর্থত, ক্রোধ বর্জন করে উপেক্ষাভাবের সাধনাই কর্তব্য। সুতরাং, এসব আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সৃষ্টির ব্যাপারে ঈশ্বরের বিশেষ অবদান যোগদর্শনে স্বীকৃত না হলেও যোগসাধনার ক্ষেত্রে ঈশ্বরপ্রণিধান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।

পুরুষের বন্ধন ও কৈবল্য

সাংখ্য-যোগমতে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি ও প্রকৃতিজাত সবকিছুই দুঃখদায়ক। সত্ত্বপ্রধান বুদ্ধি পুরুষের সন্নিধানে পুরুষকে প্রতিবিম্বিত করে। কিন্তু অবিদ্যাবশত পুরুষ তখন বুদ্ধির সঙ্গে নিজের অভেদ কল্পনা করে এবং এর ফলে বুদ্ধির দুঃখ পুরুষে আরোপিত হয়। তাই যোগমতে, তমোগুণ উদ্ভূত অজ্ঞানের প্রভাবে সত্ত্বপ্রধান প্রকৃতির পরিণাম বুদ্ধির সঙ্গে আত্মার অভেদজ্ঞানই হলো আত্মার বন্ধন। আত্মা বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হলে বুদ্ধিকে চৈতন্যযুক্ত এবং আত্মাকে বুদ্ধিযুক্ত বলে মনে হয়। একেই পুরুষ-প্রকৃতির অভেদজ্ঞান বলে। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে- দ্রষ্টা আত্মা দৃশ্য বুদ্ধিতত্ত্বে উপরক্ত বা প্রতিবিম্বিত হলে সেই বুদ্ধিতত্ত্ব বা চিত্ত সর্বপ্রকাশক হয় (পাতঞ্জল-৪/২২)। এই অভেদজ্ঞান বস্তুত অবিদ্যাপ্রসূত অজ্ঞান। এর ফলেই পুরুষ বুদ্ধির বৃত্তিকে নিজবৃত্তি এবং বুদ্ধির পরিণামকে নিজ পরিণাম ভেবে তা অধিগ্রহণ করে। পুরুষের এই অবস্থাই হলো পুরুষের বদ্ধাবস্থা। এই অঘটনের ঘটক হলো অনাদি অবিদ্যা।

পুরুষ বা আত্মা স্বভাবত নিত্য মুক্ত শুদ্ধ চৈতন্য সত্তা। পুরুষের বন্ধন নেই, মুক্তিও নেই। কিন্তু অবিদ্যার কারণে পুরুষের বন্ধন বা বদ্ধাবস্থা দেখা দেয়। এই অবিদ্যার কারণেই দ্রষ্টা পুরুষ এবং দৃশ্য প্রকৃতির সংযোগ ঘটে এবং সংযোগের ফলে পঞ্চক্লেশযুক্ত দুঃখের উদ্ভব হয়। যোগদর্শনে অবিদ্যাকে ত্রিতাপ অর্থাৎ পরিণাম-দুঃখ, তাপ-দুঃখ ও সংস্কার-দুঃখের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই অবিদ্যাকে দূর করতে না পারলে পুরুষ বা আত্মার মুক্তি সম্ভব হয় না। অবিদ্যাকে দূর করার উপায় হলো ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি। পাতঞ্জলসূত্রের কৈবল্যপাদে বলা হয়েছে- যার পরম বৈরাগ্য প্রভাবে প্রসংখ্যান অথবা সর্ববিজ্ঞানশক্তির প্রতিও অনাসক্তি হয়, তিনিই প্রকৃতি পুরুষে যে প্রভেদ আছে তা বুঝতে পারেন, তিনিই বিবেকখ্যাতি নাম্নী অদ্ভূত শক্তির অধিকারী হন। তিনিই সেই অদ্ভূতশক্তি-বলে ধর্মমেঘ (শ্রেষ্ঠতম সমাধি) নামক অমৃতসাগরে নিমগ্ন হন (পাতঞ্জল-৪/২৮)।  ঐ ধর্মমেঘ-বলেই অবিদ্যা প্রভৃতি পঞ্চক্লেশের এবং সর্বকর্মের নিবৃত্তি হয় (পাতঞ্জল-৪/২৯)।  তখন জ্ঞানের (বুদ্ধিসত্ত্বের) সমস্ত আবরণ ক্ষয় হয়ে জ্ঞান অনন্ত হয়। অনন্ত-জ্ঞান হলেই জ্ঞেয় অল্পই থাকে। অনন্ত-জ্ঞান হলে সহজেই সর্বজ্ঞ হওয়া যায় (পাতঞ্জল-৪/৩০)।  পুরুষ ধর্মমেঘ নামক অপূর্ব সমাধিমগ্ন হলে, প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক গুণগুলো সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান লাভ করলে, তখন আর তিনি প্রাকৃতিক প্রলোভনে প্রলোভিত হন না। সুতরাং তখন প্রাকৃতিক গুণ পরিণামক্রম একেবারেই পরিসমাপ্ত হয় (পাতঞ্জলসূত্র-৪/৩১)।

যোগমতে অষ্টাঙ্গিক যোগ বা যোগাঙ্গগুলোর দীর্ঘকাল ধরে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাধির হানিকর ক্লেশসমূহ বিনষ্ট হয়, চিত্তের অশুদ্ধি ও মালিন্য দূর হয় এবং অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা জ্ঞানের দীপ্তি বৃদ্ধি পেতে পেতে ক্রমশ বিবেকখ্যাতির উদয় হয়। সম্প্রজ্ঞাত ও অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির মাধ্যমে সর্বপ্রকার ক্লেশবীজ ও বৃত্তিসংস্কার ধ্বংস হলে পুরুষ চরমবৈরাগ্য লাভ করে। ক্লেশবীজ ও বৃত্তিসংস্কার স্ব-স্ব কারণের মধ্যে বিলীন হলে প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞানরূপ বিবেকখ্যাতি পরিপক্কতা লাভ করে। এর ফলে কার্য-কারণরূপে অবস্থিত সকল পদার্থ আপন প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়। একে প্রকৃতির দিক থেকে কৈবল্য বলা হয়। পুরুষ থেকে প্রকৃতির বিযুক্তভাবে অবস্থানকেই প্রকৃতির কৈবল্য বলা হয়। এই অবস্থায় সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণসমূহের প্রয়োজন শেষ হয় তথা ভোগ-অপবর্গ নিষ্পন্ন হয় এবং মহৎ বা বুদ্ধি, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়, ভূতাদি কার্যসমূহের স্ব স্ব কারণপ্রকৃতিতে লয় হয়। আর পুরুষের দিক থেকে চিতিশক্তি, বুদ্ধি তথা প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। বুদ্ধির প্রলয়ে পুরুষের প্রতিবিম্বপাতের আর কোন সম্ভাবনাই থাকে না। পুরুষের এই যে কেবল অবস্থা তাকেই পুরুষের কৈবল্য বা মোক্ষ বলা হয়। কৈবল্যপ্রাপ্তির পর আত্মা পুরুষের দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। প্রকৃতি ও পুরুষের এই উভয়বিধ কৈবল্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মহর্ষি পতঞ্জলি তার যোগসূত্রের কৈবল্যপাদে বলেছেন- কৈবল্যে পুরুষের কিছু অবস্থান্তর হয় না, স্বরূপে অবস্থান হয় মাত্র, কিন্তু বুদ্ধি তথা গুণত্রয়ের প্রলয় হয়। (যোগসূত্র : ৪/৩৪)। এভাবেই যোগদর্শনে পুরুষ বা আত্মার বন্ধন ও কৈবল্যের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.