ওয়াভেল পরিকল্পনা ও সিমলা অধিবেশন (১৯৪৫) থেকে ভারত বিভাগ (১৯৪৭)

Table of Contents

ওয়াভেল পরিকল্পনা এবং সিমলা অধিবেশন, জুন-জুলাই, ১৯৪৫

১৯৪৫ সালের শুরুতে ইউরােপে যুদ্ধের পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয় এবং মিত্রশক্তির বিজয় লাভের সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু এশিয়ার রণাঙ্গনে যুদ্ধ সমাপ্তির আশু কোন সম্ভাবনা ছিল না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ সময় হিটলারের পরাজয় অপেক্ষা জাপানের পরাজয় অধিক কাম্য ছিল। আমেরিকানরা মনে করত ভারতের সাহায্য সহযােগিতা পেলে জাপানের পতন। ত্বরান্বিত হবে। এজন্য তারা ভারতের রাজনৈতিক অচলাচস্থা নিরসনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর পূর্বের তুলনায় অধিক চাপ প্রয়ােগ করতে থাকে।

এছাড়া, ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৪৩-৪৪ সালে ভারতের মাটিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। মালাবার, বিজানুর, উড়িষ্যা এবং বাংলায় লক্ষ লক্ষ লােক দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। সরকারি হিসেব মতে, এ দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ লােক মৃত্যুবরণ করে। এবং অর্ধকোটি লােক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু এ দুর্ভিক্ষকে ভারতের ইতিহাসে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হিসেবে অভিহিত করেন এবং এ দুর্ভিক্ষের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে দায়ী করেন। দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেন।

এমতবস্থায়, জাপানের সাথে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সহযােগিতা এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট মােকাবিলার জন্য ব্রিটিশ সরকার পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হন। এ উদ্দেশ্যে ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়াভেল সিমলায় ভারতীয় নেতৃবৃন্দের এক অধিবেশন আহবান করেন। বৈঠকে যােগদানের জন্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে জেল হতে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৪৫ সালের ২৫ জুন বৈঠক আরম্ভ হয়। বৈঠকে লর্ড ওয়াভেল যে পরিকল্পনার প্রস্তাব করেন। তা ‘ওয়াভেল পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত। পরিকল্পনাগুলো ছিল –

  • ১। বড়লাটের শাসন পরিষদ এমনভাবে পুনর্গঠন করা হবে, যাতে বড়লাট ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া এ পরিষদের সকল সদস্যই ভারতীয় হবেন। 
  • ২। শাসন পরিষদে হিন্দু ও মুসলমান সদস্যদের সংখ্যা সমান হবে। 
  • ৩। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় প্রার্থী মনােনীত করতে পারবে।
  • ৪। জাপানের সাথে যুদ্ধ শেষ না হওয়া এবং শাসনতন্ত্র সম্পর্কে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত অন্তবর্তী সরকার শাসনের দ্বায়িত্ব পালন করবে। ভারতবাসী তাদের নিজস্ব সংবিধান রচনা করবে।

সিমলা সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য দেখা দেয়। বড়লাটের শাসন পরিষদে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় দু’টির প্রত্যেকে ৫জন করে প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারবেন ঘােষণা করা হয়। লীগ সভাপতি জিন্নাহ দাবি করেন যে, যেহেতু মুসলিম লীগ ভারতের মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র সেহেতু মুসলিম লীগ বড়লাটের শাসন পরিষদে সকল মুসলিম সদস্য মনােনীত করার অধিকারী। কিন্তু কংগ্রেসের পক্ষে জিন্নাহর এ দাবি মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, এ সময় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। কংগ্রেস দাবি জানায় যে, হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত ৫ টি আসনের মধ্যে ১টিতে একজন মুসলমান সদস্য মনােনয়নের ক্ষমতা কংগ্রেসকে দিতে হবে। জিন্নাহ এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। এছাড়া, জিন্নাহ বড়লাটের পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুসলমান সদস্যদের বক্তব্য যাতে বজায় থাকে সেজন্য রক্ষাকবচের দাবি তােলেন। এভাবে জিন্নাহর একগুয়ে দাবি এবং আপসহীন মানােভাবের ফলে সিমলা সম্মেলন তথা ওয়াভেল পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ডঃ সিতারামাইয়া সিমলা অধিবেশনের ব্যর্থতার সাথে ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার সুন্দরভাবে তুলনা করেছেন। তিনি তার “History of Indian National Congress” গ্রন্থে লিখেছেন, “Three years back in April, 1942, it was the Congress that broke the Cripps Mission, if it was not Cripps himself who broke his own. In Simla, it was the League that broke the Wavell plan although Lord Wavell took blame upon himself.”

১৯৪৫-৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন : বাংলার সরকার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কিন্তু ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনে শ্রমিক দল ক্ষমতাসীন হওয়ায় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটায় ভারতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সাংবিধানিক সংকট নিরসনের এক সুযােগ উপস্থিত হয়। ১৯৪৫ সালের ২১ আগস্ট বড়লাট লর্ড ওয়াভেল ঘােষণা করেন যে, আগামী শীতকালে ভারতের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওয়াভেল প্রধানমন্ত্রী এটলির শ্রমিক সরকারের সঙ্গে ভারতের সমস্যা নিয়ে আলােচনার জন্য লন্ডনে যান। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করে এক বিবৃতিতে নির্বাচনের ব্যাপারে তার পূর্ব ঘােষণা পুনরাবৃত্তি করেন এবং জানান যে নির্বাচনের পর যত শীঘ্র সম্ভব একটি সংবিধান সভা গঠিত হবে। তিনি আরও জানান যে, প্রধান দলগুলাের সহায়তায় তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ব্যবস্থা করবেন।

১৯৪৫ সালে কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচন

ব্রিটিশ সরকারের সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তাব অনুযায়ী কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে প্রধান নির্বাচনী কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ৩০ টি আসনের সব কটি আসনে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে। ৬২টি সাধারণ আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৫৭টি লাভ করে। অন্যান্যদের মধ্যে স্বতন্ত্রে প্রার্থীগণ ৫টি, শিখদের আকালী দল ২টি ও ইউরােপীয়ানরা ৮টি আসন দখল করে। জিন্নাহ বােম্বাই হতে কেন্দ্রীয় আইনসভায় নির্বাচিত হন। কেন্দ্রীয় নির্বাচনে বিরাট সাফল্য উপলক্ষে মুসলিম লীগ ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে ‘বিজয় দিবস’ উদযাপন করে। বাংলার সর্বত্র মহাসমারােহের সাথে বিজয় দিবস পালিত হয়।

১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন ও বাংলার সরকার গঠন

১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আইনসভার এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরাট জয় হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম আসন ছিল ১১৯ টি। এ নির্বাচনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মুসলিম লীগ ১১৩ টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের অভূতপূর্ব বিজয় বাংলা তথা সমগ্র ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। অনেকে একে ‘ব্যালট বাক্সে বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন। এভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলমানদের একটি রাজনেতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং তাদের পাকিস্তান দাবি ন্যায়সঙ্গত বলে প্রমাণিত হয়। অতঃপর বাংলা প্রদেশে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। উক্ত ৮ জনের মধ্যে ছিলেন ৭ জন মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য এবং ১ জন ছিলেন তফসিলি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্য।

মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় হাই কমান্ডের তৎপরতা

১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করলে মুসলিম লীগ নেতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দিল্লির এ্যাংলাে এরাবিক কলেজে নির্বাচিত লীগ সদস্যদের এক অধিবেশন ডাকেন। এ অধিবেশন ১৯৪৬ সালের ৭,৮ এবং ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে লাহাের প্রস্তাবকে সংশােধন করে বলা হয় যে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাসমূহ, যথা-পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ এবং বাংলা ও আসামকে নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের এক প্রভাবশালী অংশ লাহাের প্রস্তাবের এই সংশােধনী মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তদকালীন বাংলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম দিল্লি সম্মেলনের বিষয় কমিটিতে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, লাহাের প্রস্তাবের সংশােধন বা পরিবর্তন করার এখতিয়ার দিল্লির কনভেনশনে উপস্থিত নির্বাচিত সদস্যদের নেই। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, যে জিন্নাহর নেতৃত্বে লাহাের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল সে জিন্নাহর নেতৃত্বে তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ আবুল হাশিমের এই আপত্তি গ্রহণ করেননি এবং মুসলিম লীগের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ এতই দৃঢ় ছিল যে, সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে আবুল হাশিম তার আপত্তি উত্থাপনের সাহস পাননি। যাই হােক, জিন্নাহর আদেশে তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সংশােধনী প্রস্তাবটি প্রকাশ্য অধিবেশনে উত্থাপন করেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা (Cabinet Mission Plan)

১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান হয়। এ সময় বৃটেনের রাজনীতির ক্ষেত্রেও পট পরিবর্তন হয়। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে চার্চিলের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং যুদ্ধাকালীন অবস্থায় তার অসামান্য নেতৃত্ব প্রদান সত্ত্বেও রক্ষণশীল দলের শােচনীয় পরাজয় ঘটে এবং শ্রমিক দল নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ক্লেমেন্ট এটলী (C. R. Atlee) ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হন। স্যার লর্ড প্যাথিক লরেন্স ভারত-সচিব পদে নিযুক্ত হন। নতুন সরকার ক্ষমতাশীন হওয়ার সাথে সাথে ব্রিটেনের ভারত নীতিরও পরিবর্তন হয়। লর্ড এটলীর সরকার বুঝতে পারেন যে, ইংরেজদের পক্ষে বেশি দিন সম্মানজনকভাবে ভারত শাসন করা সম্ভব হবে না। এ জন্য এটলি অতি সত্ত্বর ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন।

১৯৪৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারত-সচিব লর্ড প্যাথিক লরেন্স লর্ডসভায় ঘােষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতে তাদের নীতি সম্পর্কিত সকল ভুল বােঝাবুঝির অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর। ১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এটলি ঘােষণা করেন যে, ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার ব্যাপারে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলােচনার জন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতে একটি মিশন পাঠানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। মন্ত্রিমিশনের সদস্যরা হলেন (ক) স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, (খ) লর্ড প্যাথিক লরেন্স এবং (গ) এ. পি. আলেকজান্ডার। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ছিলেন এ মিশনের প্রধান।

মন্ত্রিমিশন ২৪ মার্চ করাচি হয়ে দিল্লিতে পৌঁছায়। ভারতে পৌঁছে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী, সংখ্যালঘুদের নেতা ও দেশীয় রাজ্যগুলোর রাজাদের সাথে আলােচনা ও মতবিনিময় করেন। ৩ এপ্রিল কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মন্ত্রিমিশনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আলােচনায় আজাদ সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পক্ষে তার মত প্রকাশ করেন। এরপর গান্ধী মন্ত্রিমিশনের সাথে আলােচনায় দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে তার সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেন।

৪ এপ্রিল মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ মন্ত্রিমিশনের সাথে বৈঠকে মিলিত হন এবং এ বৈঠকে তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের জোর দাবি জানান। এর পরেও মন্ত্রিমিশন কংগ্রেস ও লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা নিয়ে আলােচনা করেন এবং একটি আপসমূলক পরিকল্পনা গ্রহণে উভয়ের রাজি করানাের চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। অবশেষে মন্ত্রিমিশন ১৯৪৬ সালের ৪ মে নিজেদের রচিত পরিকল্পনা ঘােষণা করেন। তারা মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি অগ্রাহ্য করেন।

মন্ত্রিমিশনে পরিকল্পনার ৩টি প্রধান অংশ ছিল। যথা- (ক) ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কিত সুপরিশসমূহ (খ) গণ-পরিষদ সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ (গ) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কিত ঘােষণা।

(১) ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কিত সুপারিশসমূহ

  • (ক) এ পরিকল্পনায় ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলো নিয়ে ভারত ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ভারত ইউনিয়নের হাতে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যােগাযােগ সম্পর্কিত সকল বিষয় অর্পিত হবে। এ সকল বিষয় পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থ সংগ্রহের ক্ষমতা ইউনিয়নের থাকবে।
  • (খ) ব্রিটিশ ভারত এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারত ইউনিয়নের শাসন বিভাগ ও আইনসভা গঠিত হবে। সাম্প্রদায়িক কোন বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হলে আইনসভায় উভয় প্রধান সম্প্রদায়ের সংখ্যাধিক্য সদস্যদের উপস্থিতি ও সমর্থন আবশ্যক হবে।
  • (গ) ইউনিয়নের হাতে প্রদত্ত বিষয়গুলো ছাড়া অন্যান্য সব বিষয় প্রদেশগুলোর হাতে অর্পণ করা হবে।
  • (ঘ) প্রদেশগুলোর অনুরূপ ক্ষমতা দেশীয় রাজ্যগুলোও ভােগ করতে পারবে।
  • (ঙ) মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার প্রস্তাব অনুসারে ভারতের প্রদেশগুলোকে ৩টি বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করা হবে। যেমন, ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ গ্রুপ। ‘ক’ গ্রুপ মাদ্রাজ, বােম্বাই, যুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উড়িষ্যা এই ৬টি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে। ‘খ’ গ্রুপ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু এই ৩টি উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ নিয়ে এবং ‘গ’ গ্রুপ পূর্ব ভারতের মুসলমান প্রধান বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত হবে।
  • (চ) প্রতিটি গ্রুপ তাদের ইচ্ছানুযায়ী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে পারবে। গ্রুপগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলো ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে স্বায়ত্তশাসন ভােগ করতে পারবে। 
  • (ছ) ইউনিয়ন এবং গ্রুপগুলোর সংবিধানে এমন শর্ত থাকবে যে, প্রাথমিকভাবে ১০ বছর পর এবং পরবর্তী পর্যায়ে প্রতি ১০ বছর অন্তর যে কোন প্রদেশ তার আইনসভার অধিকাংশ সদস্যদের সম্মতিক্রমে সংবিধানের ধারাসমূহ পুনর্বিবেচনা করতে পারবে।
  • (জ) সংবিধান রচিত হওয়ার পর যে কোন প্রদেশ ইচ্ছা করলে তার সংশ্লিষ্ট গ্রুপ হতে বেরিয়ে যেতে পারবে।

(২) গনপরিষদ সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ

(ক) সংবিধান রচনার জন্য একটি গণপরিষদ (Constituent Assembly) গঠিত হবে। এই গণপিরষদের সদস্যগণ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের দ্বারা পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলো ও প্রদেশগুলোর ন্যায় একই ভিত্তিতে গণপরিষদের প্রতিনিধিত্ব লাভ করবে।

গণপরিষদের ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলো থেকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয় –

  • ক গ্রুপে বিভিন্ন প্রদেশে সাধারণ (অমুসলমান), মুসলমান ও মোট আসন ছিল যথাক্রমে – মাদ্রাজে ৪৫, ৪, ৪৯; বোম্বাইতে ১৯, ২, ২১; যুক্ত প্রদেশে ৪৭, ৮, ৫৫, বিহারে ৩১, ৫, ৩৬, মধ্য প্রদেশে ১৬, ১, ১৭; উড়িষ্যাতে ৯, ০, ৯ আসন নিয়ে সব মিলে অমুসলমান ১৬৭, মুসলমান ২০ ও মোট ১৮৭টি আসন। 
  • খ গ্রুপে বিভিন্ন প্রদেশে সাধারণ (অমুসলমান), মুসলমান, শিখ ও মোট আসন ছিল যথাক্রমে – পাঞ্জাবে ৮, ১৬, ৪, ২৮; উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ০, ৩, ০, ৩; সিন্ধু প্রদেশে ১, ৩, ০, ৪ আসন নিয়ে সব মিলে অমুসলমান ৯, মুসলমান ২২, শিখ ৪ ও মোট ৩৫টি আসন।
  • গ গ্রুপে বিভিন্ন প্রদেশে সাধারণ (অমুসলমান), মুসলমান ও মোট আসন ছিল যথাক্রমে – বাংলা ২৭, ৩৩, ৬০; আসাম ৭, ৩, ১০ আসন নিয়ে সব মিলে অমুসলমান ৩৪, মুসলমান ৩৬ ও মোট ৭০টি আসন।

(খ) তিন গ্রুপ মিলে ব্রিটিশ ভারতের মোট আসন হচ্ছে ২৯২টি, দেশীয় রাজ্যগুলোর মোট আসন হচ্ছে ৯৩টি, আর সব মিলে মোট আসন হচ্ছে ৩৮৫টি।

(৩) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

ক) নতুন সংবিধান প্রণীত ও প্রবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন পরিচালনার জন্য প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।

পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়া ও ব্যর্থতা

কেবিনেট মিশন পরিকল্পনা মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করলেও লীগ পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে। মুসলিম লীগ মনে করে যে, মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা নিহিত আছে। কারণ পরিকল্পনার মধ্যে বাধ্যতামূলক গ্রুপিং ব্যবস্থা, প্রদেশগুলোর নিজস্ব সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা এবং স্বায়ত্তশাসন প্রদান প্রভৃতি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সহায়ক ছিল। এছাড়া, মুসলিম লীগ আরও মনে করে যে, ১০ বছর পর শাসনতন্ত্র পুনর্বিবেচনা করার অধিকারের বলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোকে ভারত ইউনিয়ন হতে বিছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার যে অধিকার মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনায় দেয়া হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। ১৯৪৬ সালের ১৬ মে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে। এ সম্পর্কে মুসলিম লীগের প্রস্তাবে বলা হয় – “In as much as the basis and the foundation of Pakistan are inherent in the Missions plan by virtue of the compulsory grouping of the six Muslim provinces in Section B and C, it is willing to co-operate with the Constitution making machinery proposed in the scheme outlined by the mission, in the hope that it would ultimately result in the establishment of complete sovereign Pakistan, and the consummation of the goal of independence for the major nations, Muslim and Hindus, and all the other people inhabiting the vast Subcontinent. It is for these reasons that the Muslim league is accepting the scheme and will join the Constitution-making body and it will keep in view the opportunity and the right of session of provinces or groups from the union, which have been provided in the Missions plan by implication.”

অপরদিকে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনাকে আংশিকভাবে গ্রহণ করে। কংগ্রেস মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনার গ্রুপিং ব্যবস্থাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ কংগ্রেস মনে করে যে, এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাছাড়া এ ব্যবস্থার ফলে কোন কোন প্রদেশের প্রতি এবং কোন কোন সংখ্যালঘু শ্রেণির প্রতি অবিচার করা হবে। এ জন্য কংগ্রেস দাবি করে যে, কোন প্রদেশ কোন নির্দিষ্ট গ্রুপে যােগ দেবে কিনা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার প্রদেশকে প্রথমে দিতে হবে। কিন্তু ১৯৪৬ সালের ২৫ মে মন্ত্রিমিশন এক বিবৃতিতে পরিষ্কারভাবে জানায় যে, গ্রুপ তাদের পরিকল্পনার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং কেবলমাত্র দলগুলোর সম্মতির মাধ্যমেই এ ব্যবস্থা সংশােধন করা যেতে পারে। যাইহােক, কংগ্রেস স্বাধীন অখণ্ড গণতান্ত্রিক ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য প্রস্তাবিত গণপরিষদের যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

১৯৪৬ সালের ১৬ জুন বড়লাট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন সম্পর্কে নিজেদের পরিকল্পনা ঘােষণা করেন। ঘােষণায় বলা হয় যে, মােট ১৪ জন সদস্য নিয়ে প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। এই ১৪ জনের মধ্যে ১ জন তফসিলি সদস্যসহ কংগ্রেসের ৬ জন, লীগের ৫ জন এবং শিখ, খ্রিষ্টান ও পার্সিদের প্রত্যেককে ১জন করে সদস্য থাকবেন। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কংগ্রেস ১ জন মুসলমান সদস্যকে মনােনয়ন দিতে পারবে কিনা এ নিয়ে মতানৈক্য শুরু হয়। মুসলিম লীগ দাবি করে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তারাই সকল মুসলিম সদস্যকে মনােনীত করার একমাত্র অধিকারী। এ দাবী বড়লাট মেনে নিলে কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যােগদান করতে অস্বীকার করে। এমতাবস্থায়, মুসলিম লীগ বড়লাট ওয়াভেলের কাছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দাবি জানায়। কারণ মন্ত্রিমিশন পূর্বেই ঘােষণা করেছিল যে, যে কোন বৃহৎ রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাদের নিয়ে সরকার গঠন করা হবে। কিন্তু বড়লাট তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। এদিকে, ১০ জুলাই কংগ্রেসের নব-নির্বাচিত সভাপতি জহরলাল নেহেরু এক সাংবাদিক বিবৃতিতে বলেন যে, ক্যাবিনেট মিশন প্রদর্শিত পথেই তারা গণ-পরিষদে যােগদান করবেন। তবে সেখানে গিয়ে তারা কি করবেন সেটা একান্তভাবেই তাদের নিজস্ব ব্যাপার। নেহেরুর এই বিবৃতিকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মারাত্মক ‘ভুল’ বলে বর্ণনা করেন। কারণ তার মতে এই বিবৃতি ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছে। 

২২ জুলাই বড়লাট ওয়াভেল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যােগদানের জন্য নেহেরু ও জিন্নাহকে আমন্ত্রণ জানান। লীগ নেহেরুর বিবৃতির পর গণপরিষদে যােগদান করা বিপজ্জনক বলে মত প্রকাশ করে এবং মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করার পূর্ব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। এর পর লর্ড ওয়াভেল ৬ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য নেহেরুকে আমন্ত্রণ জানান। ৮ আগস্ট নেহেরু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবস (Direct Action Day) ঘােষণা করে। ফলে কলকাতা, বিহার, বাংলার নােয়াখালি ও অন্যান্য স্থানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় এবং দাঙ্গায় হাজার হাজার লােক প্রাণ হারায়। এ অবস্থা দেখে বড়লাট ওয়াভেল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যােগদানের আমন্ত্রণ জানান। মুসলিম লীগ তাদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যােগদান করে।

মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গঠিত হয় সত্য, কিন্তু এ সরকার বাস্তবে কার্যকর হতে পারেনি। সর্বক্ষেত্রে লীগের অসহযােগিতার ফলে নেহেরুর পক্ষে মন্ত্রিসভায় যৌথ দায়িত্ব প্রথা প্রচলন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে শাসন ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রদেশের গ্রুপিং ব্যবস্থা সম্পর্কে কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে তীব্র মত পার্থক্য শুরু হয়। মুসলিম লীগ দাবি করে যে, গ্রুপিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক। অপরদিকে গান্ধী ও কংগ্রেসের অপরাপর নেতারা মত প্রকাশ করেন যে, গ্রুপিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক নয়। পরিস্থিতি এত খারাপ আকার ধারণ করে যে, ব্রিটিশ সরকার ডিসেম্বর মাসে বড়লাট লর্ড ওয়াভেল, নেহেরু, বলদেব সিংহ ও জিন্নাহকে লন্ডনে এক বৈঠকে আহ্বান করেন। আলাপ-আলােচনার পর ব্রিটিশ সরকার মুসলিম লীগের পক্ষে রায় দেয় এই বলে যে, গ্রুপিং ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক।

১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। মুসলিম লীগ এ অধিবেশনে যােগদানে বিরত থাকে। লীগ কার্যনির্বাহক কমিটি গণ-পরিষদে গৃহীত উদ্দেশ্য বিষয়ক প্রস্তাবের নিন্দা করে এবং একে বে-আইনি বলে ঘােষণা করে। এর প্রতিবাদে কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হতে মুসলিম লীগের পদত্যাগ দাবি করে। মুসলিম লীগ অনুরূপ দাবি করে। ফলে সমগ্র দেশে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এভাবে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়।

এটলীর বিবৃতি (Attlee’s Statement)

মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। হিন্দু-মুসলিম বিরােধ চরম আকার ধারণ করে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝােতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় তিরােহিত হয়। এ অবস্থায় ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি পার্লামেন্টে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে বিষয়বস্তু ছিল – 

  • (১) ব্রিটিশ সরকার বদ্ধপরিকর যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে (Responsible Indian hands) ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কারণ ভারতের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত আশংকাজনক এবং এ পরিস্থিতি আর চলতে দেয়া যায় না।
  • (২) যদি দেখা যায় ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী গঠিত গণপরিষদ রচিত সংবিধান সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হচ্ছে না তাহলে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে এবং সর্বাপেক্ষা যুক্তিসঙ্গত উপায়ে নির্দিষ্ট তারিখে ব্রিটিশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কার হাতে হস্তান্তর করা উচিত তা স্থির করবেন।
  • (৩) দেশীয় রাজ্যগুলো সম্পর্কে বলা হয় যে, এদের ওপর রাজশক্তির সর্বময় ক্ষমতার অবসান ঘটবে- অর্থাৎ রাজ্যশাসিত দেশীয় রাজ্যগুলো ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বেই স্বাধীন হবে।
  • (8) ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে যে সব বিষয় উদ্ভব হবে সে সব বিষয় সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকার সংশ্লিষ্ট দলগুলোর সাথে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদন করবে।
  • (৫) ব্রিটিশ সরকার আশা পােষণ করেন যে, নতুন পরিস্থিতিতে ভারতে বৃটেনের ব্যবসা ও শিল্পস্বার্থ উভয় দেশের স্বার্থে বিবেচনা করা হবে। কারণ উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের এবং উভয়ের স্বার্থেই এ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
  • (৬) ব্রিটিশ সরকার এ আশা ব্যক্ত করেন যে, ভারতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে ব্রিটেনের সাথে ভারতের সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।
  • (৭) সর্বশেষে এটলি তার বিবৃতিতে ভারতের পরবর্তী ভাইসরয় হিসেবে লর্ড ওয়াভেলের স্থলে মাউন্টব্যাটেনের নাম ঘােষণা করেন।

মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা (Mountbatten Plan)

১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে বড়লাটের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি কংগ্রেস ও লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলােচনা শুরু করেন। ২৩ মার্চ মুসলিম লীগ পাকিস্তান দিবস পালন করে। সমগ্র দেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানি অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। দেশ ক্রমশ এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দিকে এগােতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতের সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মন্ত্রিমিশনের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা অদৌ সম্ভব নয় এবং সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ভারত বিভাগ। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে জহরলাল নেহেরু এবং বল্লভ ভাই প্যাটেলও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, দেশ বিভাগ ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প কোন রাস্তা খােলা নেই। তবে গান্ধী এই ভয়াবহ সময়ে দেশ বিভাগের তীব্র বিরােধিতা করেন। তিনি বলেন জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় দেশ বিভাগ তিনি কখনও মেনে নেবেন না। তবে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ভয়াবহতা লক্ষ্য করে গান্ধী শেষ পর্যন্ত দেশ বিভাগে তার সম্মতি জ্ঞাপন করেন। দেশ বিভাগ মেনে নেওয়া ছাড়া অবশ্য এ সময় গান্ধীর অন্য কোন উপায়ও ছিল না। কারণ ভারতীয় রাজনীতিতে তখন গান্ধীর স্থলে প্যাটেল-নেহেরু গােষ্ঠীর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বড়লাট মাউন্টব্যাটেন তার উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শক্রমে একটি শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ পরিকল্পনায় ভারতে প্রদেশগুলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব করে বলা হয় যে, ইচ্ছা করলে প্রদেশগুলো উপযুক্তরাষ্ট্র (Confederation) গঠন করতে পারবে। পরিকল্পনায় বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের প্রস্তাব করা হয়। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সম্পর্কে বলা হয় যে, জনগণের মতামত জানার জন্য সেখানে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ পরিকল্পনা ১৫ ও ১৬ এপ্রিল গভর্নরের বৈঠকে অনুমােদিত হয়।

২ মে বড়লাট তার এ পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমােদনের জন্য ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেন। ইংল্যান্ডের শ্রমিক সরকার পরিকল্পনার কিছু অংশ সংশােধন করে তা অনুমােদন করেন। পরিকল্পনাটি ভারতে এসে পৌঁছলে বড়লাট সিমলায় জহরলাল নেহেরুকে পরিকল্পনাটি দেখান। নেহেরু পরিকল্পনাটির তীব্র বিরােধিতা করেন। কারণ তার মতে এটি গৃহীত হলে ইউরােপের বলকান অঞ্চলের মত ভারতে অসংখ্য রাষ্ট্রের সৃষ্টি করবে। নেহেরুর বিরােধিতার ফলে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাটি বাতিল হয়। এমতাবস্থায় বড়লাট নতুন করে পরিকল্পনা রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ কাজের দায়িত্ব তিনি তার শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ভি. পি. মেননের ওপর অর্পণ করেন। দীর্ঘ পরিশ্রমের ওপর ভি. পি. মেনন একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এবং তা কংগ্রেস কর্তৃক অনুমােদিত হলে বড়লাট ১৯৪৭ সালের ১৮মে লন্ডনে যান। এবং পরিকল্পনাটি ব্রিটিশ সরকারে অনুমােদনের পর ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। ২ জুন বড়লাট পরিকল্পনাটি নিয়ে কংগ্রেস, লীগ ও শিখ নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা করেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন বড়লাট তার পরিকল্পনাটি ভারতীয় জনগণের কাছে প্রকাশ করেন। এটিই ৩ জুনের ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ নামে খ্যাত। পরিকল্পনাটির রূপরেখা – 

  • (১) ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে দুই অংশে বিভক্ত করে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবে। 
  • (২) বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশের জেলাগুলোকে সম্প্রদায়ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতার আলােকে বিভক্ত করা হবে। 
  • (৩) গণভােটের মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং আসামের সিলেট জেলা পাকিস্তানে যােগ দেবে কিনা স্থির হবে। 
  • (৪) ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা কমিশন গঠন করা হবে।
  • (৫) ভারতবর্ষকে ‘ডােমােনিয়ন স্টেটাস’ প্রদানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হবে।
  • (৬) ভারত ও পাকিস্তান কমনওয়েলথভুক্ত থাকবে কি থাকবে না সে সম্পর্কে স্ব স্ব রাষ্ট্রের গণপরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
  • (৭) এ পরিকল্পনা কেবল ব্রিটিশ ভারতের ক্ষেত্রেই কার্যকরী হবে। দেশীয় রাজ্যগুলোর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঘােষিত নীতি অপরিবর্তিত থাকবে।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই ৩ জুনের পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে সিন্ধু প্রদেশ এবং বেলুচিস্তান পাকিস্তানে যােগদানের পক্ষে মত প্রকাশ করে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সমস্যা ছিল কিছুটা জটিল। প্রদেশটি ছিল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। এই প্রদেশে কংগ্রেসের নেতা ছিলেন আব্দুল গফফর খান। তিনি তার অনুগামীদের ভােট বয়কট করার আহ্বান জানান। ফলে প্রদেশে মােট ভােট দাতার মাত্র ৫০ শতাংশ ভােটাধিকার প্রয়ােগ করেন। যার মধ্যে ২,৮৯,২৪৪ জন পাকিস্তানের পক্ষে এবং মাত্র ২৮৭৪ জন ভারতের পক্ষে ভােট দেন। পাঞ্জাব ও বাংলার সমস্যা ছিল আরও জটিল। পাঞ্জাবের মােট জনসংখ্যার (২ কোটি ৪৮ লক্ষ) মধ্যে মুসলমান ও অমুসলমানদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ২৬ লক্ষ ও ১ কোটি ২২ লক্ষ। মােট জনসখ্যার মধ্যে ৫৭ লক্ষ ছিল শিখ ধর্মাবলম্বী। তিন সম্প্রদায়কে খুশি করে পাঞ্জাব বিভাগ সহজসাধ্য কাজ ছিল না। যাই হােক, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঞ্জাব শেষ পর্যন্ত দু’ভাগে বিভক্ত হয়। পশ্চিম পাঞ্জাব পাকিস্তান লাভ করে এবং পূর্ব পাঞ্জাব ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়।

বাংলায় মুসলিম লীগ খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। অনেক বাঙ্গালি মুসলমান স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিল। বাংলার মুসলমানরা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং বাংলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম এ ধরনের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাংলার কিছু হিন্দু নেতা স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনা সমর্থন করেছিলেন। হিন্দু নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের প্রধান সুরেন্দ্র মােহন ঘোষ, কংগ্রেস পার্লামেন্টারি দলের কিরণশঙ্কর রায় এবং ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা শরৎচন্দ্র বসু। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার পরিকল্পনা সমর্থন করেননি। ফলে পাঞ্জাবের মত বাংলাও দু’ভাগে ভাগ হয়। পূর্ববঙ্গ পড়ে পাকিস্তানে আর পশ্চিমবঙ্গ রইলাে ভারতে। পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ করার জন্য স্যার সিরিল র‍্যাডক্লিফের নেতৃত্বে দুটি সীমান্ত কমিশন নিযুক্ত হয়। কলকাতা হাইকোর্টের দুজন হিন্দু বিচারপতি (জাস্টিস সি. সি. বিশ্বাস ও জাস্টিস বিজ্ঞান কুমার মুখােপাধ্যায়) এবং কলকাতা ও পাঞ্জাব হাইকোর্টের দুজন মুসলিম বিচারপতি (জাস্টিস আবু সালেহ মােহাম্মদ আকরা ও জাস্টিস এস. এ. রহমান) এর সদস্য ছিলেন। কিন্তু তারা কোন ঐকমত্যে না আসায় সীমানা চিহ্নিত করার ব্যাপারে স্যর সিরিল র‍্যাডক্লিফের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মনে নেয়া হয়। র‍্যাডক্লিক দিল্লিতে বসেই সীমানা চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি শুধু একবার কলকাতায় ঘুরে যান। তিনি নিয়ম করেন যে, কমিশনের সদস্যগণ কলকাতা ও লাহাের থেকে প্রত্যহ প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র তার নিকট দিল্লিতে প্রেরণ করবেন এবং তিনি সেখানে সেগুলাে পর্যালােচনা করবেন। বাংলা কমিশন ভারতের বিভিন্ন দলকে সীমানা সংক্রান্ত দাবীনামা কমিশনে পেশ করার আবেদন জানান। কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবিনামা পেশ করা হয়। জনমত যাচাইয়ের জন্য কমিশন ১৬ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই আগ্রহী ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

কংগ্রেস বাংলার মােট ৭৭৪৪২ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ৪০১৩৭ বর্গমাইল দাবি করে। কংগ্রেস যেসব এলাকা দাবি করে সেগুলাে হচ্ছে গােটা বর্ধমান বিভাগ, নদীয়া, যশাের ও খুলনা জেলাসমূহের সামান্য অংশ বাদে সমগ্র প্রেসিডেন্সি বিভাগ, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদাহ জেলা, বরিশাল জেলা থেকে গৌরনদী, স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠি থানাসমূহ এবং ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জ মহকুমা। কংগ্রেস কলকাতা শহর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি পেশ করে। অপরপক্ষে, মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিভাগের বেশিরভাগ অংশ এবং বর্ধমান জেলার হুগলি ও ভাগীরথী নদীর পূর্বাংশ পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়। মুসলিম লীগ কলকাতা শহর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকেও পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্তির দাবি করে।

মাউন্টব্যাটেনের ৩ জুন পরিকল্পনায় সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং এলাকার সংখ্যালগ্নতা (majority and contignity principles) এর ভিত্তিতে সীমানা চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এই নীতির ওপর ভিত্তি করে সীমানা নির্ধারণ করলে কয়েক মাস সময়ের প্রয়ােজন ছিল। একারণে র‍্যাডক্লিফ তার দিল্লির অফিসে বসে টেবিলের ওপর ভারতবর্ষের মানচিত্র রেখে মাত্র ১ সপ্তাহের মধ্যে হাজার হাজার মাইলের সীমানা চূড়ান্ত করেন। র‍্যাডক্লিফের ঘােষণায় কলকাতা পশ্চিমবাংলাভূক্ত করা হয়। নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ও মালদাহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলাভুক্ত করা হয়। দিনাজপুরকে দু’ভাগে ভাগ করে পশ্চিম দিনাজপুরকে পশ্চিমবাংলা এবং পূর্ব দিনাজপুরকে পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। যশাের জেলার বনগাঁও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলাভুক্ত হয়। খুলনা (৪৯.৩৯% মুসলমান) পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়। মুসলিম অধ্যুষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকা ভারতকে প্রদানের ক্ষতিপূরণস্বরূপ পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্ববাংলাকে দেয়া হয়।

বাকি থাকে দেশীয় রাজাদের সমস্যা। এ সময় ভারতে দেশীয় রাজ্যের সংখ্যা ছিল ৫৬২। ভারতীয় জনগণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাস করতাে এই সব রাজ্যে। স্থির হয় ভারত স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও স্বাধীনতা পাবে এবং ইচ্ছা করলে ভারত বা পাকিস্তান যে কোন রাষ্ট্রে যােগ দিতে পারবে। দেশীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে হায়দ্রাবাদ, ভূপাল, ত্রিবাঙ্কুর ইত্যাদি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের ঐক্যের স্বার্থে দেশীয় রাজ্যসমূহকে ভারতের অঙ্গীভূত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন জহরলাল নেহেরুর অন্তর্বর্তী সরকার একটি পৃথক বিভাগ খুলে দেশীয় রাজ্যসমূহের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলের ওপর। প্যাটেল ভি. পি. মেননকে ঐ বিভাগের সচিব নিযুক্ত করেন। মেনন শীঘ্রই দেশীয় রাজ্যগুলো ভারতভুক্তির জন্য এক পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনায় স্থির হয় যে, বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যােগযােগ এই তিনটি বিষয় ভারত সরকারের অধীনে রেখে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মহারাজাদের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে। সেই সঙ্গে মহারাজাদের সম্পত্তির অধিকার ও বিভিন্ন সুযােগ-সুবিধা অক্ষুন্ন রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। দেশীয় রাজ্যসমূহ যাতে ভারতে যােগ দেয় তার জন্য মেনন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাহায্যে কামনা করেন। মাউন্টব্যাটেন ২০ জুলাই দেশীয় মহারাজাদের এক সভায় দেশীয় রাজাদের ভারতে যােগদানের অনুরােধ জানান। বড়লাটের অনুরােধে সাড়া দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের আগেই বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্যই ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল মাত্র ৩টি দেশীয় রাজ্য কাশ্মীর, জুনাগড় ও হায়দ্রাবাদ। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর কাশ্মীরের বৃহত্তর অংশ, জুনাগর ও হায়দ্রাবাদ ভারতভুক্ত করা হয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, ১৫ আগস্টের পূর্বেই সীমানা কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশ ও বাস্তাবায়নের কথা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের কোন কর্মসূচি যাতে সীমানা সংক্রান্ত ক্ষোভের কারণে ব্যাহত না হয় সেজন্য বড়লাট মাউন্টব্যাটেন তা ১৬ আগস্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। ১৬ আগস্ট তার বাড়িতে সীমানা নির্ধারণ কমিটির এক সভায় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সীমানা কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশ করে। এই রিপাের্ট কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও শিখ প্রতিনিধিদের কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত সকল পক্ষ সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্মত হন।

ভারত বিভাগ (Partition of India)

পটভূমি

এতক্ষণ যা যা বললাম তা আবার একটু সংক্ষেপে রিপিট করছি, তবে দাঙ্গা সম্পর্কে আরও কিছু যোগ করছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের পর ১৯৪৫-৪৬ সালে ভারতে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে কংগ্রেস অখণ্ড ভারতের দাবিতে এবং মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবির ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। মুসলিম লীগ প্রায় একচেটিয়া মুসলমান আসনগুলাে দখল করে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক জীবনের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি প্রতিষ্ঠা করে। সাধারণ আসনগুলােতে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই অবস্থায় ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ সরকার শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একটি মন্ত্রিমিশন ভারতে প্রেরণ করে। কিন্তু এই মিশনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে গভীর মতানৈক্য দেখা দেয়।

মন্ত্ৰীমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট লীগের প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবসে কলকাতায় সংঘটিত হয় এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলাের হিসেবে এই দাঙ্গায় প্রায় ৫০০০ লােক হতাহত হয়। স্টেটসম্যানের হিসেব অনুযায়ী হতাহতের সংখ্যা ২০০০০ বা কিছু বেশি। কলকাতায় মুসলমানদের হত্যার খবর পূর্ববাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অক্টোবর মাসে নােয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলায় মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং ভয়ে হিন্দুগণ বাড়িঘর ত্যাগ করতে থাকে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী নােয়াখালীতে ২২০ জন এবং ত্রিপুরায় ৬৫ জন নিহত হয়। মহাত্মা গান্ধী দাঙ্গা থামানাের জন্য নােয়াখালী সফর করেন। নােয়াখালী দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিহারে কংগ্রেস মন্ত্রিসভার উদ্যোগে বিহারে ‘নােয়াখালী দিবস’ পালিত হয়। ৩০ অক্টোবর হতে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলমানদেরকে হত্যা করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুসারে ১৫০০০ লােক নিহত হয়। কংগ্রেসের মতে ২০০০ এবং জিন্নাহর মতে ৩০০০ লােক বিহারের দাঙ্গায় প্রাণ হারায়। এই সময় পূর্বাঞ্চলের জেনারেল কমান্ডিং অফিসার টুকার শান্তি রক্ষার কাজে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করেন। টুকার লিখেছেন, “১৯৪৬ সালে যতগুলাে ভয়ঙ্কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সেগুলাের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্মান্তিক ঘটনা ছিল এই যে, হিন্দুদের বিরাট জনতা রীতিমত প্রস্তুত হয়ে হঠাৎ অল্পসংখ্যক মুসলমানদেরকে আক্রমণ করে।…. এই কাজ নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। এই অল্প সময়ের হত্যাকাণ্ডে সাত হতে আট হাজার লােক নিহত হয়। স্ত্রীলােক ও শিশুদেরকে বীভৎসভাবে হত্যা করা হয়।” স্টিফেন্স মন্তব্য করেন যে, বিহারে অনুষ্ঠিত হত্যাকাণ্ডের পর ভারত বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

কংগ্রেস ও লীগ সদস্যদের মধ্যে অসহযােগিতা, অন্তর্বর্তী সরকারে অচলাবস্থা এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে যে গুরুতর প্রশাসনিক সমস্যার সৃষ্টি হয় তাতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ লর্ড মাউন্টব্যাটেন বড়লাটের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, মন্ত্রিমিশনের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভবপর হবে না এবং ভারত বিভাগ ছাড়া হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নের সমাধান করার আর কোন পথ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস ও লীগ সদস্যদের মধ্যে তীব্র মতানৈক্যের দরুন কংগ্রেস নেতাদের মনেও ভারত বিভাগের পক্ষে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হয়। মাউন্টব্যাটেনের আলাপ-আলােচনার পর নেহেরু, প্যাটেল ও গান্ধী ভারত বিভাগ মেনে নিতে প্রস্তুত হন। অতঃপর মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের একটি খসড়া পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন।

১৯৪৭ সালের ২ জুন মাউব্যাটেন কংগ্রেস ও লীগের কয়েকজন নেতাকে এক বৈঠকে আমন্ত্রণ করেন। তিনি তার শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলােচনা করেন। এই পরিকল্পনায় ভারত বিভাগ এবং বাংলাদেশ ও পাঞ্জাব বিভাগের প্রস্তাব করা হয়। মাউন্টব্যাটেন সকলের সম্মতি লাভ করতে সমর্থ হন। ৩ জুন পরিকল্পনাটি প্রকাশিত হয় এবং নেহেরু ও জিন্নাহ বেতার ভাষণে আপােষমূলকভাবে তা গ্রহণ করার কথা ঘােষণা করেন। ৪ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে মাউন্টব্যাটেন জানান যে, ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। ৪ জুলাই (১৯৪৭) ভারত স্বাধীনতা আইনের খসড়া ব্রিটিশ পার্লমেন্টে উত্থাপন করা হয় এবং ১৮ জুলাই তা আইনে পরিণত হয়।

১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ধারাসমূহ 

  • ১। এ আইনে বলা হয় যে, ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি স্বাধীন ডােমিনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হবে। পূর্ববাংলা (সিলেটসহ), পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে নিয়ে পাকিস্তান গঠিত। হবে। পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে ব্রিটিশ ভারতের অবশিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে ভারত সৃষ্টি হবে। 
  • ২। এই আইন অনুসারে ভারতীয় দেশীয় রাজ্যগুলাের ওপর হতে ব্রিটিশ রাজ্যের কর্তৃত্বের অবসান করা হয়। দেশীয় রাজ্যগুলাে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী পাকিস্তান বা ভারত যে কোন ডােমিনিয়নে যােগদান করতে পারবে বা স্বাধীন থাকতে পারবে। 
  • ৩। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হতে বাংলা প্রদেশ বিভক্ত হয়ে পূর্ববাংলা ও পশ্চিম বাংলা নামে দুইটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে। উক্ত তারিখ হতে আসাম প্রদেশের অংশ বিশেষ সিলেট জেলা (গণভােটের ফলাফল সাপেক্ষে) পূর্ববাংলার অংশ বিশেষে পরিণত হবে। একই তারিখ হতে পাঞ্জাবি বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাব নামে দুইটি নতুন প্রদেশ গঠিত হবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব পাঞ্জাব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের সীমানা কমিশনের দ্বারা নির্ধারিত হবে।
  • ৪। প্রত্যেক নতুন ডােমিনিয়নের জন্য একজন গভর্নর-জেনারেল থাকবেন। তিনি ব্রিটিশ সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং ডােমিনিয়নের শাসনক্ষেত্রে ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তবে কোন ডােমিনিয়ন কর্তৃক অন্যরূপ আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত একই ব্যক্তি উভয় ডােমিনিয়নেরই গভর্নর-জেনারেল হতে পারবেন।
  • ৫। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ভারতবর্ষের ওপর ব্রিটিশ সরকারের কোন কর্তৃত্ব থাকবে না।
  • ৬। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের সংবিধান রচনার জন্য দুইটি পৃথক গণপরিষদ গঠন করা হবে।
  • ৭। প্রত্যেক নতুন ডােমিনিয়নের আইনসভা ঐ ডােমিনিয়নের জন্য আইন প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হবে।
  • ৮। ডােমিনিয়নের নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ডােমিনিয়নের গণপরিষদ উক্ত ডােমিনিয়নের আইনসভারূপে কাজ করবে। আইনসভা হিসেবে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে গণপরিষদ পূর্বতন কেন্দ্রীয় আইনসভার ক্ষমতা ভােগ করবে।
  • ৯। নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত উভয় ডােমিনিয়ন এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলাের শাসনকার্য প্রয়ােজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে পরিচালিত হবে।
  • ১০। ভারত-সচিবের পদ বিলুপ্ত হবে এবং তার দায়িত্ব অর্পিত হবে কমনওয়েলথ সচিবের ওপর।

সকল কর্মচারী ও সশস্ত্র বাহিনীকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

ভারত স্বাধীনতা আইনের ত্রুটি ও প্রতিক্রিয়া

ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ধারাসমূহ পর্যালােচনা করলে এর কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। প্রথমত, বৃটিশরা ভারতবর্ষকে কেবল দ্বিখণ্ডিত করেই যায়নি অনেক রাজনৈতিক বিষয় অমীমাংসিত রেখে যায়। যেমন, ব্রিটিশ আমলে স্বায়ত্তশাসন ভােগ করেছে এমন দেশীয় রাজ্যসমূহ স্বাধীন হবে, নাকি ভারত বা পাকিস্তানে যােগ দেবে সে বিষয়ে স্বাধীনতা আইনে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল না। এই সুযােগে ভারত শক্তিবলে কিছু দেশীয় রাজ্য দখল করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ কাশ্মির, হায়দ্রাবাদ ও জুনাগড়ের কথা উল্লেখ করা যায়। দ্বিতীয়ত, এ আইনে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পদ বণ্ঠন (যেমন-যুদ্ধাস্ত্র, রেলওয়ে সম্পদ) বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন ধারা ছিল না। এর ফলে পরবর্তীকালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। কাশ্মির নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৮ এবং ১৯৬৫ সালে যুদ্ধ বাঁধে।

ভারত বিভক্তির প্রস্তাবটি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কখনই সমর্থন করেনি। কারণ কংগ্রেসের কাছে ভারত ছিল এক এবং অভিন্ন। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পর থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস ও লীগ সদস্যদের মধ্যে মতবিরােধ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ ধারণা জন্ম দেয় যে, ভারত বিভাগ ছাড়া তাদের সামনে বিকল্প কোন পথ খােলা নেই। বড়লাটের শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ভি.পি. মেনন লিখেছেন যে, ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে নেহেরু ও প্যাটেল ভারত বিভাগে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কারণ, কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে, মুসলিম লীগের সাথে একত্রে কাজ করার চেয়ে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাংশের কিছু এলাকা ছেড়ে দেয়া অধিকতর শ্রেয়। এছাড়া, কংগ্রেস আরও কয়েকটি কারণে দেশ বিভাগে সমর্থন জ্ঞাপন করে। সুদীর্ঘ ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের ফলে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। নতুন করে আন্দোলন শুরু করার কিংবা জেলে যাওয়ার কথা তারা ভাবতেই পারছিলেন না। এ সময় আবার ভারতের অভ্যন্তরে বামপন্থী আন্দোলন ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। সে সঙ্গে ১৯৪৬ সালের সশস্ত্র নৌবিদ্রোহ তাদের শঙ্কাকে তীব্রতর করে তােলে। এ অবস্থায় ক্ষমতা যাতে বিপ্লবী শ্রেণির হাতে না যায় সে জন্য তারা দেশ বিভাগ মেনে নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের পথে অগ্রসর হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মধ্যে দিয়ে মুসলিম লীগ সভাপতি মুহম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করে। তবে মুসলিম লীগ পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, বাংলাদেশে ও আসাম নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে দাবি করেছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। মুসলিম লীগকে ‘ছিন্নবিছিন্ন ও অঙ্গ-কর্তিত’ পাকিস্তান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগ মুসলিম লীগকে মেনে নিতে হয়। মুসলিম লীগ পরিষদের বাংলা ও পাঞ্জাবের কয়েকজন সদস্য ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের অধীনে ভারত বিভাগ বিরােধিতা করেছিলেন। কিন্তু জিন্নাহ পরিষদের সদস্যদের কাছে ব্যক্তিগত আবেদন করে বলেছিলেন, “আপনারা কি আমাদের জীবিত থাকাকালে পাকিস্তান পেতে চান?” তখন প্রায় সকল সদস্যই একস্বরে ভারত বিভাগ স্বীকার করেন। এভাবে শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ ভারত বিভাগ মেনে নেয়।

উপসংহার

১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন উপমহাদেশের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিক দলিল। এই আইনের বলেই প্রায় দুশাে বছরের (১৭৫৭-১৯৪৭) ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ভারত হয় দ্বিখণ্ডিত। বড়লাট মাউন্টব্যাটেন ১৩ আগস্ট করাচি যান এবং পরদিন (১৪ আগষ্ট) জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ হন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর-জেনারেল। এরপর মাউন্টব্যাটেন ১৪ আগস্ট ভারতে ফিরে আসেন। মধ্যরাতে (ইংরেজি মতে ১৫ আগস্ট) সবাই যখন নিদ্রামগ্ন তখন ভারত স্বাধীন হলাে। এ প্রসঙ্গে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর উক্তি এখানে প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেন যে, “মধ্যরাতের ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী যখন দ্রিামগ্ন ভারত তখন স্বাধীনতা ও নবজীবন লাভ করে আঁখি মেলে তাকালাে। এল সেই মুহূর্ত, যা ইতিহাসে কদাচিৎ আসে, যখন আমরা পুরাতনকে ত্যাগ করে নতুনকে বরণ করে নিলাম। যখন অবসান হলাে একটি যুগের। যে দেশের আত্মাকে দীর্ঘদিন ধরে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, তা হয়ে উঠল বাঙ্ময়।” ব্রিটিশ ভারতের শেষ বড়লাট মাউন্টব্যাটেন হলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর-জেনারেল। স্বাধীনতা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের ইতিহাসে শুরু হলাে এক নতুন অধ্যায়ের, এক নতুন যুগের। নব নব প্রেরণা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে উপমহাদেশের দু’টি দেশ নতুনভাবে তাদের যাত্রা শুরু করলাে। এশিয়া মহাদেশে যে নতুন মুক্তির সূর্য উঠলাে, অচিরেই তার আলাে ছড়িয়ে পড়লাে গােটা বিশ্বে। সাম্রাজ্যবাদ ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে পড়লাে দিকে দিকে।

তথ্যসূত্র

  • দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস : ১৮৫৭-১৯৪৭, দিলীপ কুমার সাহা, ঢাকেশ্বরী লাইব্রেরি, ঢাকা, ২০১৫, পৃ. ৩৭০-৪০২

1 Trackback / Pingback

  1. আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.