শিল্পবিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লব

(সম্প্রসারিত হবে)

Table of Contents

ভূমিকা

অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের কেন্দ্রে ছিল উৎপাদনের সরঞ্জামের প্রায় অলৌকিক উন্নতি, যার সাথে সাধারণ মানুষের জীবনের এক ভয়াবহ বিচ্যুতি ঘটে। (Karl Polanyi- The Great Transformation, P. 33)

জাতীয় সার্বভৌমত্ব ফরাসি বিপ্লবের একটি মূল তত্ত্ব ছিল; এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব মানে জাতির পরম শক্তি।… কিন্তু বিপ্লবও ছিল এর অন্য দিকে। এটা সেই গণতান্ত্রিক ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যেটি বলে, সরকারে একটি জাতির নিজস্ব প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিৎ। আর জাতিরই উচিৎ তার নিজস্ব সংবিধান তৈরি করা। (Barker-Principles of Social and Political Theory, P. 18.)

শিল্প বিপ্লব : সূচনা ও স্বরূপ

শিল্প বিপ্লবের সূচনা

পিউরিটান বিপ্লব ও গৌরবােজ্জল বিপ্লব ব্রিটেনের রাজনীতিক চিন্তাজগতে বিরাট পরিবর্তন আনে। এই দুই বিপ্লব চিন্তার জগতে স্বাতন্ত্র ও বিবেকের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ১৭শ শতাব্দীর স্বৈরতন্ত্র বিরােধী আন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল এই দুই বিপ্লব। এই দুই বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণী শক্তি সুসংহত হয়। এরপর শিল্প বিকাশের মাধ্যমে সমাজের দুত অগ্রগমন ঘটে।

জ্ঞানালােক বা এনলাইটেনমেন্টের প্রসার মানুষকে নতুন নতুন আবিষ্কার করে সমাজের বৈপ্লবিক প্রগতি ত্বরান্বিত করতে উৎসাহিত করে, এর প্রভাবে মানুষ চার্চের অশভ থেকে মুক্তি লাভ করে, ধর্মের প্রভাব সম্পূর্ণরপে অন্তর্হিত না হলেও যুক্তিবাদিতা ও বিবেক মানুষের আচরণের পরিচালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। জ্ঞানালােকের ফলে মানুষ সীমাবদ্ধ স্বয়ম্ভব মানবিক বিচারবুদ্ধিতে নিজেকে সত্তার রহস্য, জীবনের রহস্য ও ঐশ্বরিক রহস্যের উপরে নিজেকে স্থাপন করে, এর ফলে সমগ্র জাতির জীবন ও সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়।

জ্ঞানালোকের যুগে মানুষ জ্ঞানের সন্ধান, উন্নততর চিন্তার সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। উংপাদন-ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করার জন্য নানান যন্ত্রপাতি আবিস্কৃত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ ইংলণ্ডে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের এক ঢেউ আসে। অল্প কয়েক বছরের মধ্যে অনেক রকম যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়। এই সমস্ত যন্ত্রপাতি অতীতের গ্রামকেন্দ্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থার পতন ঘটায়, উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে।

প্রচুর শিল্প স্থাপিত হয় এবং সেই সমস্ত শিল্পে হাজার হাজার শ্রমিক নিযুক্ত হয়ে বিপুল পরিমাণ দ্রব্যস্যমগ্রী উৎপাদন করতে থাকে যা এর আগে কোন দিন হয় নি। শিল্পের ক্ষেত্রে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল বলে একে শিল্প বিপ্লব বলে। তবে বিপ্লব শেষ পর্যন্ত শিল্পজগতে বন্দী হয়ে থাকে নি। গােটা সমাজের আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন।

শিল্প বিপ্লবের স্বরূপ, সময়ের অনির্দিষ্টতা, যন্ত্রবিপ্লবের সাথে সম্পর্ক

ফরাসী বিপ্লব বা রুশ বিপ্লব একটি নির্দিষ্ট বছরে দেখা দিয়েছিল এবং আবির্ভাব হঠাৎ করেই হয়েছিল। এদিকে ১৭৬০ সাল নাগাদ ইংলণ্ডে শিল্প বিপ্লব প্রথম দেখা গেলেও এই বছরকে শিল্প বিপ্লবের বছর বলা যায় না। লিন্ডসে মনে করেন শিল্প বিপ্লবের পেছনে অনেক দিনের প্রস্তুতি ছিল।

শিল্প বিপ্লবের স্বরপ বর্ণনা প্রসঙ্গে এইচ. জি. ওয়েলস যন্ত্র বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবকে আলাদা করেছেন। তার মত হচ্ছে, শিল্প বিপ্লব যন্ত্র বিপ্লবের থেকে ভিন্ন কিন্তু যন্ত্র বিপ্লবের উপর নির্ভরশীল। তার মতে, বিজ্ঞান সুসংগঠিত হলে, মানুষের মনের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনা সম্প্রসারিত হলে যন্ত্রের আবিষ্কার হয় এবং এই আবিষ্কার একটার পর একটা ঘটতে থাকে। যন্ত্র বিপ্লব মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণকে বদলে দিতে সাহায্য করে এবং এর প্রতিক্রিয়া সমগ্র সমাজের উপর গিয়ে পড়ে, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য মানুষ যন্ত্রকে কাজে লাগায়। উৎপাদন বাড়িয়ে তােলার জন্য শিল্পে যন্ত্র প্রযুক্ত হয়। এভাবে যন্ত্র বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লব হাত ধরাধরি করে চলে। যন্ত্র বিপ্লবের এরকম সফল প্রয়ােগ ঘটলে শিল্প বিপ্লব হয়, কিন্তু তা অসফলও হতে পারে, এমন হতে পারে যে, যন্ত্র বিপ্লব ঘটে গেছে কিন্তু সমাজের উপর এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নি এবং আর্থব্যবস্থা বা শিল্পােন্নয়ন আশানুরুপ স্তরে উঠতে পারে নি, এক্ষেত্রে শিল্প বিপ্লব হয়না। যন্ত্র বিপ্লব ছাড়াও শিল্পের বিকাশ হতে পারে, কিন্তু সেই বিকাশের গতি এত মন্থর যে তাকে বিপ্লব বলা চলে না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংলণ্ডে যন্ত্রপাতি এমন দ্রুতগতিতে আবিষ্কৃত হচ্ছিল যে অতীতে তেমনটি কখনও দেখা যায় নি।

শিল্প বিপ্লবের কারণ

শিল্প বিপ্লব কেন ব্রিটেনে সবার আগে দেখা দিয়েছিল এ প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। নিচে কারণগুলো উল্লেখ করা হল –

১। ১৭শ শতাব্দীর গৌরবােজ্জ্বল বিপ্লব ও অন্যান্য নানা কারণে ব্রিটেনে রাজনীতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল এবং এটি শিল্প বিকাশের পক্ষে এক অনুকুল
পরিবেশ তৈরী করেছিল। হবস লেভিথান গ্রন্থে বলেছেন,- নৈরাজ্য ও অশান্তির দরুন ব্রিটেনে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধিলভ করতে পারে নি। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরু থেকে সমাজের শান্ত অবস্থা শিল্পােন্নয়নের সহায়ক ছিল।

২। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কয়েকটি আবিষ্কার যন্ত্রের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছিল এবং এই যন্ত্র বিপ্লব শিল্প বিপ্লবের উপাদান হিসেবে কাজ করেছিল।

৩। মানুষের সচেতনতা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভােগ্যবস্তুর চাহিদা অনেক সম্প্রসারিত হয় এবং শিল্প বিপ্লবকে সাহায্য করে।

৪। কৃষির ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির প্রয়ােগ কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং শিল্পের জন্য যে কাঁচামালের দরকার হত তা কৃষি থেকে আসত। শিল্প বিপ্লবের এটি একটি কারণ।

৫। সামন্তপ্রথার পতন ও বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান শিল্পােন্নয়নের অন্য একটি কারণ। সামন্তপ্রভুরা পরম্পরাগত কৃষির উপর নির্ভরশীলতা ছেড়ে দিয়ে শিল্পে মূলধন লগ্নী করতে আরম্ভ করে। একই সঙ্গে বুর্জোয়া শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। ১৭শ শতাব্দীর স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জোর লড়াই-এর পেছনে বুর্জোয়া শ্রেণীর হাত ছিল। ব্যক্তি স্বাধীনতার বিকাশ শিল্প বিপ্লবকে সাহায্য করেছিল।

৬। পরিশেষে বলা যায় যে ১৮শ শতাব্দীতে ব্যক্তিস্বাতবাদের দ্রুত বিকাশের ফলে বিজ্ঞানের এক্তিয়ার থেকে চার্চ ও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ন্যুনতম স্তরে নামিয়ে আনা হয়। এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া হয় নি। পক্ষান্তরে দাবি জানানাে হয় যে রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক কলাকৌশলের বিকাশের জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরী করবে – এই মানসিকতার দরুন বৈজ্ঞানিক উর্বরতা দ্রুত বেড়ে যায়।

৭। লিন্ডসের মতে স্বাধীন আর্থনীতিক ক্রিয়াকর্মের কারণে স্বাধীন অনুসন্ধানের উন্নয়ন হয়, এর ফলে যে আবিষ্কারগুলো হয় তাকে লাভজনক কাজে ব্যবহার করা হয়। ১৭শ শতাব্দীতে যে অবাধ স্বাধীনতার গােড়াপত্তন হয়েছিল শিল্প বিপ্লব অতিক্রম করে তা উনিশ শতকের উদারনীতিবাদে পর্যবসিত হয়েছিল।

শিল্প বিপ্লবের সামাজিক ও আর্থনীতিক ফলাফল

জনসংখ্যা বৃদ্ধি

জনসংখ্যাবিশারদরা দেখান শিল্পবিপ্লবের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে। জনগণ স্বাস্থ্য সচেতন হয় এবং উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানকে স্বাস্থ্যোন্নতির কাজে লাগায় এবং এই কারণে মৃত্যুর হার কমে যায়। অতীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বহু লোক মারা যেত। শিল্প বিপ্লবের পরে মানুষ বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে শেখে। ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত ইউরােপের জনসংখ্যা ১৮০ মিলিয়নের মধ্যে ছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে জনসংখ্যা ৪০০ মিলিয়নে উপস্থিত হয়। ১৯৩৩ সালে ৫০০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। ব্রিটেনের গ্লাসগো শহরের জনসংখ্যা অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল ১০ থেকে ১২ হাজার, কিন্তু শিল্প বিপ্লরের পরে জনসংখ্যা প্রচণ্ড হারে বেড়ে যায়। ইউরােপ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও নিউজিল্যান্ডের মত বিশ্বের যে সমস্ত দেশ শিল্প বিপ্লবের আওতায় আসে সেই সমস্ত দেশেরই জনসংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। শিল্প বিপ্লব প্রাচীনকালের গ্রামকেন্দ্রিক শিল্পকাঠামােকে ধংস করে দেওয়ায় জীবিকার সন্ধানে মানুষ শহরে ভিড় জমাতে থাকে ও শহরের জনসংখ্যা বেড়ে যায়। তাই দেখা যায়, শহরেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে, গ্রামগুলোতে জনসংখ্যা হ্রাস পায়।

সম্পদ বৃদ্ধি

মধ্য যুগে চার্চের যাজকরা মানুষকে ইহলােক সম্পর্কে নিস্পৃহ করে তুলেছিল বলে সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধিতে মনােনিবেশ করার সুযোেগ কেউ পায় নি। আধুনিক যুগের আবির্ভাবের সাথে সাথে মানুষের মনে জড়বাদী চিন্তার উন্মেষ ঘটে ও রুজি-রােজগার বৃদ্ধির দিকে মন দেয়। শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষ বিজ্ঞান ও কারিগরি কলাকৌশলকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে যা তার সম্পদ বৃদ্ধিতে সরাসরি সহায়তা করে। এতে মানুষের মাথাপিছু প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায় ও তার ফলে রাষ্ট্রের জাতীর আয় ও জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া যােগাযােগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণেও সম্পদ বৃদ্ধি ঘটে।

দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অন্যান্য কুফল

সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি সমৃদ্ধিকে নিশ্চিত করেনা, এর প্রমাণ শিল্প বিপ্লবােত্তর ব্রিটিশ সমাজ। শিল্প বিকাশজাত সম্পদের সিংহভাগ মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক কুক্ষিগত করে এবং এই সম্পদ উৎপাদনে নিয়োজিত শ্রমিকরা কেবল সামান্য মজুরি লাভ করত। মজুরি বাড়াবার কোন উপায় তাদের ছিল না। বুর্জোয়া চিন্তক (সমাজবাদীর নয়) লিন্ডসের মতে, শিল্পায়ন সমাজে সম্পদের বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি করে, যা সমাজে আগে কখনও দেখা যায়নি, ধনীরা আরও ধনী হতে চাওয়ায় এই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, মুনাফার প্রায় সবটাই শিল্পপতিরা ভােগ করত।

সামন্ত যুগে ভূমিদাস ও কৃষকদের যে অবস্থা ছিল শিল্প যুগে শ্রমিকদের অবস্থা তার চেয়ে উন্নত হলেও জীবনধারণের মান ও অন্যান্য অবস্থার পরিবর্তনের ফলে সমাজের বস্তুবাদী পরিবেশ বদলে যায়। এই পরিবর্তিত অবস্থায় শ্রমিকদের অবস্থা শিল্পপতিদের অবস্থার তুলনায় নিকৃষ্ট ছিল।

দারিদ্র্য ছাড়াও অন্যান্য কুফল ছিল। চাকরীর জন্য গ্রাম থেকে মানুষ শহরে ভিড় জমাতো। এই জনসংখ্যার চাপে শহরে বস্তি এলাকার সৃষ্টি হয়। ফলে শিল্প বিপ্লব সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে খোলা আবহাওয়া ও পরিবেশ নষ্ট করে দিয়ে ঘিঞ্জি পরিবেশ তৈরী করে। আলাে-বাতাস বর্জিত স্থানে বসবাস ও অপুষ্টির জন্য রােগের পরিমাণ বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধি ইত্যাদি স্বাস্থ্যজনিত কুফল দেখা যায়। অপুষ্টি ও রােগ কারখানার শ্রমিকদের চির সাথি হয়ে দাঁড়ায়। এদেরকে ভাল পরিবেশে রেখে সুস্থ ও সবল করে ভােলার জন্য মালিকপক্ষের দিক থেকে তেমন কোন চেষ্টা দেখা যায় নি।

পোলানি বলেন, “…শ্রমিকরা নতুন নির্জন জায়গায় একসাথে জড়ো হয়।… গ্রামবাসীরা বস্তিবাসী হয়ে অবমানবায়িত হয়, পরিবারগুলো ধ্বংসের পথে ছিল, এবং দেশের বৃহৎ অংশ শয়তানী কারখানার বর্জের চাপায় দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছিল। রক্ষণশীল থেকে উদারপন্থী, পুঁজিবাদী থেকে সমাজতান্ত্রিক সকল দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক দলের লেখকই শিল্প বিপ্লবের অধীনে সামাজিক অবস্থাকে মানবিক অবক্ষয়ের একটি প্রকৃত বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করেন।” (Polanyi, The Great Transformation, p. 39)।

সমাজের শ্রেণী বিভাজন

মার্ক্স ও এঙ্গেলস বস্তুবাদী দৃষ্টি দিয়ে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর প্রতিটি সমাজে দুটি প্রধান শ্রেণী দেখা গিয়েছে। সামন্ত যুগের পর শিল্প বিপ্লব আসে এবং শিল্প সমাজ স্থাপিত হয়। এই সমাজেও বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত নামে দু’টি প্রধান শ্রেণী সষ্টি হয়। সামন্ত যুগে বুর্জোয়া শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকলেও ও এই যুগের শেষের দিকে এই শ্রেণী কিছু পরিমাণে প্রাধান্য স্থাপন করলেও তারা সেই যুগে মুখ্য শ্রেণীর মর্যাদা লাভ করতে পারে নি। পুঁজিবাদ পর্যাপ্ত পরিমাণে বিকশিত হওয়ায় বুর্জোয়ারা শ্রেণীর ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয় ও প্রলেতারিয়েত ছাড়া অন্যান্য শ্রেণী গৌণ শ্রেণীর পর্যায়ে নেমে আসে। এভাবে শিল্প বিপ্লব সমাজকে মােটামুটি দুটি শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলে।

প্রাযুক্তিক প্রগতির প্রাধান্য স্থাপন

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশের সাথে সাথে সমাজের সংহতি সাধন ও মানুষের নৈতিক চরিত্রের উন্নতির জন্য নীতিবোধ ও মূল্যবােধের বিকাশ দরকার, এতেই সমাজের সুষম বিকাশ নিশ্চিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশের আগে সমাজে মূল্যবােধ ও নীতিবোধ সংক্রান্ত বিষয়লো ছিল এবং এদেরকে কেন্দ্র করে মানুষ নানা সংগঠন গড়ে তুলত। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পরে প্রাযুক্তিক বিকাশ এত দ্রুততার সঙ্গে এগােতে লাগল ও সমাজের প্রায় সকল স্তরের মানুষ একে নিয়ে এত বেশি পরিমাণে ব্যস্ত থাকল যে তার সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের নীতিবোধ ও মূল্যবােধের বিকাশ হল না, ফলে এই বোধগুলোর অবক্ষয় দেখা দিল।

আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধিকে মানুষ একমাত্র ধ্যানজ্ঞান বলে মনে করতে লাগল। শিল্পবিপ্লবের ফলে প্রাযুক্তিক উন্নতি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর চেয়ে এগিয়ে যাওয়ায় প্রযুক্তিবিদ্যা মানুষের সেবায় ব্যবহৃত না হয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। সমাজের পক্ষে এটি কল্যাণজনক হয় নি।

অপ্রীতিকর ফলাফল

লিস্টহাইম (Lichtheim) তার “A Short History of Socialism” গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে শিল্প বিপ্লবের কয়েকটি অপ্রীতিকর ফলাফলের উল্লেখ করেন। শিল্প বিপ্লবের পূর্বে কৃষক, হস্তশিল্পী, ছােট ব্যবসায়ী ইত্যাদি ভিত্তিক ক্ষুদ্রাকারে ব্যক্তি মালিকানা গড়ে ওঠে, যেখানে এই ক্ষুদ্র সংস্থা বা ক্ষেত খামারের মালিকেরা নিজে বা অল্প দু’একজন শ্রমিক রেখে উৎপাদন করত। সেসময় মূলধন, শ্রমিক প্রত্যয়গুলো ও বাজার অর্থনীতিতে স্বনিয়ন্ত্রিত আইনের ধারণা শিল্পোযুগোত্তর পর্বের মত ছিলনা। তাই শিল্প বিপ্লবের পূর্বে বাজার অর্থনীতি ও বৃহদায়তন উৎপাদনব্যবস্থার অনাকাঙ্ক্ষিত দিকগুলো ছিলনা, আর্থ-ব্যবস্থা ছিল খুব সহজ। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের ফলে এই উৎপাদন ব্যবস্থায় আকস্মিক পরিবর্তন আসে, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর এর একটি মর্মান্তিক প্রভাব পড়ে ও তার অভ্যস্ত জীবনযাত্রা পরিবর্তিত হয়। এর ফলে স্বনিযুক্তি কর্মকেন্দ্র থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অতীতে পুঁজি ও শ্রম থাকলেও তা এত খারাপ অবস্থা ছিল না, দারিদ্র্য থাকলেও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে এত বেশি বৈষম্য ছিলনা। শিল্প বিপ্লবের পরে বাজার অর্থনীতির বিকাশ পূর্ণাঙ্গ হয় এবং একদল আশাবাদী সােচ্চারে প্রচার করে যে মানুষের আর কোন প্রকার দারিদ্র্য থাকবে না। কিন্তু এই বাজার অর্থনীতি সমাজকে ধনী ও দরিদ্র এই দুটি গােষ্ঠীতে ভাগ করে দেয়।

হতাশা ও মোহমুক্তি ঘটিয়েছিল

শুরুতে শিল্প বিপ্লব অনেক আশার সঞ্চার করেছিল। নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপিত হয়ায় নিয়ােগের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নেমে এসেছিল। জীবন ধারণের মান উন্নতিলাভ করেছিল। কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নি। শিল্প বিপ্লবের আগে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীলতা প্রবল ছিল না। শিল্প সমাজে এটি তীব্র আকার ধারণ করে। অর্থাৎ একজনের জীবন ধারণের মান ও হতাশা ও স্বাচ্ছন্দ্য বহুলাংশে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মানুষ অসহায় বােধ করতে থাকে। বিজ্ঞান ও কারিগরি কলাকৌশলের সাহায্যে সে প্রকৃতিকে জয় করতে শিখলেও তার ক্ষমতাহীনতাও একই সঙ্গে বেড়ে যায়। একজন অন্যের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গীকে নিজের মত করে গড়ে তুলতে পারে না এবং সম্ভবও নয়। “মানুষ প্রকৃতিকে জয় করে এবং নিজের শক্তিহীনতার বোধ দ্বারা পরাজিত হয়। বিজ্ঞান তার অবিশ্বাস্য অগ্রগতি করে এবং পরিশেষে তাকে জানায় যে তিনি সে কোন যৌক্তিক প্রাণী নয়, বরং অযৌক্তিক প্রাণী।” অথাৎ শিল্প বিপ্লব মানুষের মনে পুরােপুরি আশার সঞ্চার করতে পারে নি। একদিকে মানুষের ক্ষমতা বিপুল পরিমাণে বাড়লেও অন্যদিকে সমগ্র সমাজকে সে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় নি। সমাজ থেকে অযৌক্তিকতা দূর করা যায় নি। এখানেই তার নিজস্ব ও বিজ্ঞানপ্রদত্ত ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। বিদ্যমান রাজনীতিক কাঠামাে শিল্প বিকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে ব্যর্থ হওয়ায় উভয়ের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টি হয়। আর্থনীতিক ব্যবস্থা এত শক্তিশালী হয় যে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার পক্ষে একে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বহু ক্ষেত্রে রাজনীতিক কাঠামাে অসহায় হয়ে পড়ে। অথচ শিল্প বিপ্লব জাত কুফলগলি দূর করার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যম্ভাবী ছিল। রাষ্ট্র-ব্যবস্থার অসহায়তা জনগণের মনে হতাশা সৃষ্টি করে।

শিল্প বিপ্লবের রাজনীতিক ফলাফল

শ্রেণী সংগ্রাম

শিল্প বিপ্লবের একটি অবধারিত ফসল হল শ্রেণী সংগ্রাম। শিল্প বিকাশের ফলে সামন্ততান্ত্রিক আর্থব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে ও জীবিকার সন্ধানে মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ভিড় জমায়। পুঁজিপতি ও শিল্পপতিরা এই সুযােগ নিয়ে স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক নিয়ােগ করতে থাকে। অন্যদিকে তাদের মুনাফার কলেবর স্ফীত হয়ে ওঠে।

“এটা একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে বিবেচিত হয় যে নিষ্ঠুর শোষকদের শোষণে জনগণ তাদের অসহায়তার ঘাম ঝরাচ্ছিল এবং ক্ষুধার্ত হচ্ছিল। প্রায় সত্তর বছর ধরে পণ্ডিতগণ এবং রাজকীয় কমিশন সমানভাবে শিল্প বিপ্লবের ভয়াবহতার নিন্দা জানিয়ে আসছে এবং কবি, চিন্তাবিদ এবং লেখকদের একটি বিশাল অংশ তার নিষ্ঠুরতা কে ব্র্যান্ডিং করেছে।” Polanyi, The Great Transformation, p. 157

শ্রমিক শ্রেণী অসংগঠিত ও জীবিকার প্রয়ােজন বেশি হওয়ায় মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে পারে নি। কিন্তু শিল্পের অগ্রগতির সাথে শ্রমিকদের রাজনীতিক ও সামাজিক সচেতনতা বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের অবস্থার উন্নতিকল্পে সংগ্রামকে একমাত্র হাতিয়ার বলে মনে করে। শ্রমিকদের মনে এই প্রত্যয় জন্মায় যে শােষণ বন্ধ করতে হলে সমস্ত শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালাতে হবে। এই মনােভাব থেকে জন্ম নেয় শ্রেণী সংগ্রাম। পুঁজিবাদী কাঠামােতে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত এই দুই পরস্পর বিরােধী শ্রেণী এবং এদের স্বার্থও বিপরীতমুখী। তাই দুই শ্রেণীর মধ্যে কোনরকম সমাঝােতা সম্ভব নি। সংগ্রাম অনিবার্য। শ্রেণী সংগ্রামে রাষ্ট্র মালিকপক্ষকে অবলম্বন করে। কারণ বুর্জোয়া সমাজে রাষ্ট্র হল শােষণের হাতিয়ার। তাই শ্রেণী সংগ্রাম আসলে শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে রাষ্ট্রের সংগ্রামে পরিণত হয়। রাষ্ট্রই শােষণের প্রতীক। শ্রমিক শ্রেণী মনে করে শােষণের অবসান ঘটাতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দখল করে ফেলতে হবে। রাষ্ট্রকে দখল না করলে শােষণের অবসান ঘটানাে যাবে না। এইভাবে শিল্প বিপ্লব শ্রেণীর আবির্ভাব ও শ্রেণী দ্বন্দ্ব অনিবার্য করে তুলেছিল।

সরকারী ক্ষমতার সম্প্রসারণ

মধ্যযুগে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরােধ ও চার্চের আধিপত্যহেতু রাষ্ট্রশক্তি সম্প্রসারিত হতে পারে নি। আধুনিক যুগ ও শিল্প বিপ্লবােত্তর যুগে রাষ্ট্রক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যায়। শ্রমিক শ্রেণীর শােষণ ও বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থের সুরক্ষা করতে হলে সামরিক ও আরক্ষা বাহিনীকে সদৃঢ় করা দরকার। এগুলি রাষ্ট্রের অধীনে থাকে। তাই বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্যের সঙ্গে রাষ্ট্রক্ষমতার বৃদ্ধি ওতপ্রােতভাবে জড়িত। কিন্তু বুর্জোয়ারা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার বৃদ্ধি চায় নি। যেটুকু বৃদ্ধি বুর্জোয়া স্বার্থের পক্ষে সহায়ক সেই বৃদ্ধি তারা সুনিশ্চিত করেছে। তাছাড়া রাষ্ট্রশক্তিকে পুরােপুরি বুর্জোয়া স্বার্থের রক্ষক করে রাখার জন্য বুর্জোয়ারা প্রশাসন ও আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। নানাবিধ উপায়ে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নাগরিকের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। সমাজের নানাপ্রকার সংগঠনগুলিও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। যে কোন নাগরিককে প্রাত্যহিক জীবনে বহুরকম শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুনের মধ্যে থাকতে হয়। সংগঠনগুলি রাষ্ট্রের মৌলিক ও সাধারণ আইন অনুসারে গঠিত এবং সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত নাগরিকরা নিয়ম ও বিধি সহজে লঙ্ঘন করে না।

শিল্প বিপ্লব ও অগণতান্ত্রিকতা

শিল্প বিপ্লবের আগে পর্যন্ত নবজাগরণ, সংস্কার আন্দোলন ও জ্ঞানালােকের প্রভাবে মানুষের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা বিবেকবােধ জেগে উঠেছিল। কিন্তু শিল্প বিপ্লব এসে সেই প্রবণতাকে বাধা দেয়। যে কোন কলকারখানা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে সেখানকার নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতেই হবে। কারখানার মালিকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, বাধ্যতামূলক। শ্রমিকের নিজস্ব বক্তব্য বা স্বাধীনতা মূল্যহীন। আজকাল যেমন পরিচালনা ব্যবস্থায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের কথা বলা হচ্ছে অতীতে তা ছিল না। শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা সম্পর্কে শ্রমিকের কোন মত গ্রাহ্যের মধ্যে না আনা ছিল রীতি। অথচ এই শ্রমিকের পরিশ্রমে গড়ে ওঠে কারখানার শ্রীবৃদ্ধি। এই ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলা হয়। তাছাড়া একজন দক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক এক শিল্প প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে না। নানাপ্রকার প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে সে করতে বাধ্য হয়। কেবল যন্ত্রের মত শ্রমিক শ্রম বিক্রী করে যায়। উনিশ শতকে শিল্পােন্নত দেশগুলােতে রাজনীতিক কাঠামো যেখানে গণতান্ত্রিক ছিল এবং গণতান্ত্রিকতাকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালানাে হত সেখানে শিল্প সংগঠনগুলােতে স্বৈরতান্ত্রিক নীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল (A. D. Lindsay, P. 184)। শিল্প সংগঠনের মালিকেরা শ্রমিকদের মতামতকে মূল্য দিতে চায় না অথবা এদের প্রতি কোন প্রকার দায়দায়িত্ব আছে তাও মনে করে না।

শ্রমিক ঐক্য ও আন্দোলন

শিল্প বিপ্লবের কয়েকটি ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে আমরা আলােচনা করেছি। প্রথম পর্যায়ে শ্রমিকরা শােষিত হলেও সংগঠন ও ঐক্যের অভাবে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারে নি। কিন্তু সচেতনতা ও শিক্ষা বিস্তারের ফলে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শােষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। একে বলা হয় শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলন। বিভিন্ন সময়ে এই আন্দোলন নানাভাবে প্রকাশ লাভ করে। শ্রমিকরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে মালিকের উপর চাপ সৃষ্টি করে। শ্রমিক সত্ব ছাড়া সমবায় আন্দোলন, ক্লাব ইত্যাদি গঠিত হয়। এগুলি গণতান্ত্রিক উপায়ে হতে থাকে। শ্রমিক শ্রেণীর ন্যায়সঙ্গত দাবিদাওয়ার প্রতি মালিকপক্ষের অনমনীয় মনােভাব শ্রমিক শ্রেণীকে বাধ্য করেছিল সংগঠন গড়ে তুলতে। পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠন তৈরী করা শিল্প বিপ্লবের আগে হয় নি। শিল্প বিপ্লবের কুফলগলি প্রকট হয়ে দেখা না দিলে গণতান্ত্রিক সংগঠন আবির্ভূত হত না। (পরিচালক ও পরিচালিত শ্রেণীর মধ্যকার বিভাজনের অশুভ এবং অসুবিধা স্পষ্ট। কিন্তু এটি শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ গণতান্ত্রিক সংগঠন তৈরি করে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদেরকে তাদের নিজস্ব নেতা খুঁজে নিতে হয়েছে।) গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলি শ্রমিক শ্রেণীর অভাব-অভিযােগ প্রকাশের একটি বড় মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। শ্রেণী সংগ্রামের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। মনে রাখা প্রয়ােজন যে শ্রেণী সংগ্রাম হঠাৎ করে দেখা দেয় নি। গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন করার পর শ্রমিক শ্রেণী ব্যর্থ হয়ে সংগ্রামের পথে পা বাড়ায়। ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল এবং সংগঠনের জন্ম আগে সেখানে হয়। কিন্তু পরে যে কোন শিল্প সমাজের মধ্যে এগুলি গড়ে ওঠে। অতএব বলা যেতে পারে শিল্পােন্নয়ন, শ্রমিক আন্দোলন ও শ্রমিক সঙ্ঘ ইত্যাদি পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

ইউটোপীয় সমাজবাদ ও মার্ক্সবাদের উপর শিল্প বিপ্লবের প্রভাব

ইউটোপীয় সমাজবাদ

সামন্ততন্ত্রের পর আসে শিল্প বিপ্লব এবং গঠিত হয় শিল্প সমাজ বা শিল্পবাদ (Industrialism)। নতুন সমাজ এলেও অতীতে সেই শােষণ থাকে অব্যাহত। তবে শােষণের চরিত্র যায় বদলে। সামন্ত যুগে সামন্তপ্রভুদের দ্বারা কৃষক ও ভূমিদাসরা শােষিত হত যেমন দাসযুগে ক্রীতদাসরা মালিকদের দ্বারা শােষিত হত। শিল্প সমাজে শ্রমিক শ্রেণী বুর্জোয়াদের দ্বারা শােষিত হয়। সাঁ সিমোঁ, শাল ফুরিয়ে ও রবার্ট ওয়েন প্রমুখ ইউটোপীয় চিন্তকগণ শিল্প সমাজের শােষণের হাল হকিকত দেখে বেদনাতুর হন। এরা সকলেই শিল্প সমাজের সন্তান। সিমোঁর জন্ম ১৭৬০ সালে, ফুরিয়ের জন্ম ১৭৭২ সালে এবং ওয়েন-এর জন্ম ১৭৭৯ সালে। শ্রেণী বৈরিতার প্রকটতা শিল্প বিপ্লবের অবদান। অতীতে এই বৈরিতা ছিল কিন্তু এমন প্রকট আকারে দেখা দেয় নি। কারণ তখন শােষিতদের সচেতনতা ও সঙ্ঘবদ্ধতা গড়ে ওঠে নি। পুঁজিবাদের উত্তরােত্তর শ্রীবদ্ধি ও শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য সাঁ সিমোঁ সহ অন্যান্য ইউটোপীয় চিন্তকের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং পুঁজিবাদের কবল থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য তারা সমাজবাদী পথের সুপারিশ করেন।

ইউটোপীয় সমাজবাদীরা মনে করতেন শ্রমিকরা বস্তুগত ও বুদ্ধিগত উভয় দিক থেকে শােষিত এবং এই শােষণের হাত থেকে তাদের মুক্তি প্রয়ােজন। শিল্প বিপ্লবের আগে যে ইউটোপীয় সমাজবাদ প্রচলিত ছিল তাকে উল্লেখযােগ্য বলা চলে না। টমাস মুর, কামপানেল্লা প্রমুখ ইউটোপীয়রা কাল্পনিক সমাজ গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাঁ সিমোঁ, ফুরিয়ে ও ওয়েন শিল্প বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজবাদ গঠনের কথা ভেবেছিলেন। শ্রমিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে ওয়েন-প্রদত্ত সুপারিশগলি শিল্প বিপ্লব উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে করা। শ্রমিক শ্রণীর শােচনীয় অবস্থা ও সমাজের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখে ফুরিয়ে উনিশ শতকের গােড়ায় ফালাঞ্জ গঠনের কথা বলেন। ফুরিয়ের ফালাঞ্জ হল সাম্যবাদী সমাজের চূড়ান্ত রপ। ফালাঞ্জ যে কেবল শােষণ মুক্ত হবে তা নয়, তা বৈষম্য মুক্তও হবে।

মার্ক্সবাদের উপর প্রভাব

ইউটোপীয় চিন্তকরা শিল্প বিপ্লবের কুফলগুলি সম্পর্কে অবহিত থাকলেও যথার্থ মুক্তির পথ বাতলে যেতে পারেন নি। তারা ভীষণ কল্পনাবিলাসী ছিলেন। বিশেষ করে গাল ফুরিয়ে ও রবার্ট ওয়েনের কল্পনা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া তারা পুঁজিবাদের বিকাশ ও শােষণ থেকে মুক্তি কোনটাই বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশ্লেষণ করেন নি। মার্কস ও এঙ্গেলস ব্রিটেনের শিল্প সমাজে পুঁজিবাদের বিকাশকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে অনুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে। মার্ক্স ওয়েডেমারকে লেখা চিঠিতে স্বীকার করেছেন যে তিনি কোন নতুন কথা বলেন নি। শিল্প বিপ্লবের পরে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যে বৈষম্য গড়ে উঠেছিল তার থেকে বৈরিতা ও সংঘর্ষের সূচনা।

ম্যানিফেস্টোতে মার্ক্স ও এঙ্গেলস বলেছেন যে শিল্পপতিরা বাঁচার জন্য যে সমস্ত পথ অবলম্বন করত সেগুলি সাময়িকভাবে তাদের সমস্যার সুরাহা করলেও শেষ পর্যন্ত এগুলি শ্রমিক শ্রেণীর হাতে সংগ্রামের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে যে সমাজ আবির্ভূত হয়েছিল মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাকে শােষণ ও শ্রেণী বৈরিতার চুড়ান্ত প্রকাশ বলেছেন। সামন্ত যুগে রাষ্ট্র থাকলেও শােষণের ব্যাপারে তার তেমন কোন বিশেষ ভূমিকা ছিল না। কিন্তু পুঁজিবাদে শােষণ অব্যাহত রাখার ব্যাপারে বাষ্ট্রের ভূমিকা লক্ষণীয় এবং এই বিষয়টি মার্ক্স ও এঙ্গেলস বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন। বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রের সাহায্যেই শােষণ চালাত। সুতরাং শােষণের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। শ্রমিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে কতকগুলি আইন প্রণয়নের জন্য ওয়েন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিকট আবেদন জানান এবং ব্যর্থ হন। কারণ তদানীন্তন পার্লামেণ্ট ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর কুক্ষিগত। জাতীয় রাষ্ট্রের সবোচ্চ বিকাশ বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য স্থাপনের পরে হয়। শিল্প বিপ্লব বুর্জোয়ার প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। এই কারণে মার্কস ও এঙ্গেলস শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির জন্য বিপ্লব ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার অবলুপ্তির কথা বলে গেছেন।

ফরাসী বিপ্লবের উদ্ভব

দুই বিপ্লবের রাষ্ট্রচিন্তা

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে তিনটি বিপ্লব কেবল সরকার পরিবর্তন বা স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটায় নি, রাষ্ট্রচিন্তার উপর বহুল প্রভাব বিস্তার করে গেছে। এই তিনটি বিপ্লব হল ইংরেজ বিপ্লব, আমেরিকান বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লব। ইংরেজ বিপ্লব দুটি – একটি ১৬৪০ সালের পিউরিটান বিপ্লব ও অন্যটি যা এর অর্ধশতাব্দী পরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা হল গৌরবােজ্জ্বল বিপ্লব এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লব। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে আমেরিকান বিপ্লবের স্থান অনেক উচ্চে হলেও বর্তমান আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে এর তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। ইউরােপের দুটি বিপ্লব অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যেই সম্পাদিত হলেও আজও এদের সম্পর্কে আলােচনা ও বির্তকের শেষ নেই। সংবিধানতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে গৌরবােজ্জল বিপ্লবে। গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্ম দেয় ১৬৮৮ সালের বিপ্লব। গৌরবময় বিপ্লবের এক শতাব্দী পরে ফ্রান্সে স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদের জন্য বিপ্লব শুরু হয়। ফরাসী বিপ্লবের নায়ক ও অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য ও শ্রেণী আনুগত্য নিয়ে আজকাল বিস্তর আলােচনা গবেষকগণ করে চলেছেন। নানাপ্রকার কল্পনা ও পুরকথা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আবার ফরাসী বিপ্লবকে বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত ও অভিজাততান্ত্রিক বিপ্লব বলা যাবে কিনা ইতিহাসবিদরা গবেষণা করেছেন। তবে ফরাসী বিপ্লবের মার্কসবাদী ব্যাখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। মার্কস ও তার অনুগামীরা ফরাসী বিপ্লবকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে মনে করতে। রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও চার্চের সম্মিলিত শক্তিকে আঘাত হানা ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রধান উদ্দেশ্য। তাই একে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়।

বিপ্লবের সূত্রপাত

১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত সমগ্র ফ্রান্স উত্তাল হয়েছিল এক বৈপ্লবিক আন্দোলনে যা ফরাসী বিপ্লব নামে কথিত। ১৬১৪ সাল থেকে ফ্রান্সের এতা জেনেরার ( Estates General) অধিবেশন ডাকা হয় নি। ১৭৮৮ সালের আগস্ট মাসে গণবিক্ষোভের সামনে পড়ে রাজা এতা জেনেরার অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য হন। ১৭৮৯ সালের ৫ই মে এতা জেনেরার অধিবেশন শুরু হয়। ১৭ই জন এতা জেনেরা নিজেকে জাতীয় সভা (General Assembly) বলে ঘােষণা করে। এর পর কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ ঘটনা দুত ঘটতে থাকে। নেকর ছিলেন ফ্রান্সের অত্যন্ত জনপ্রিয় মন্ত্রী। তিনি রাজা কর্তৃক বরখাস্ত হন। ১৪ই জুলাই বাস্তিল-এর পতন হয়। ৫–৬ অক্টোবর এক বিরাট মিছিল পারিস থেকে বেরিয়ে রাজাকে ধরে আনে। জাতীয় সভা পুরনাে জমানাকে (ancien regime) আলাদা করে দেয়। সামন্ততন্ত্র ও চার্চের পতন ঘটে। এই হল ফরাসী বিপ্লবের সূত্রপাত।

ফরাসী বিপ্লবের কারণ

যে কোন বিপ্লবের পেছনে সব সময় কয়েকটি তাৎক্ষণিক কারণ থাকে, যদিও এগুলি একমাত্র কারণ নয়। আগেই বলা হয়েছে যে ফ্রান্সের রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা ও আচরণের অবসান ঘটানাের উদ্দেশ্যে জনগণ যখন সকল প্রকার শান্তিপূর্ণ উপায় অবলম্বন করে ব্যর্থ হ’ল তখন বিপ্লবের পথ নিয়েছিল। রাজার স্বৈরতন্ত্রের সমর্থক ছিল চার্চ ও অভিজাততন্ত্র। এদের সাহায্যে রাজা স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও উঠতি বুর্জোয়া শক্তি তা মেনে নিতে পারে নি। সামন্ত যুগে বুর্জোয়ারা মুখ্য শ্রেণীর মর্যাদা পায়নি ভিন্ন ধরনের উৎপাদন-ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের দরুন। শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন গড়ে ওঠা বুজোয়া শ্রেণী মধ্য শ্রেণীর মর্যাদা পাবার ও রাজনীতি এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে সচেষ্ট হয়। ফলে বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে রাজশক্তির বিরােধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে থাকে এবং বিচ্ছিন্নভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও চলে। কিন্তু কোন প্রতিকার হয় নি।

নবজাগরণ ও জ্ঞানালােক ইত্যাদির প্রভাবে দেশের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়। ১৮শ শতাব্দীর শুরু থেকে ফ্রান্সের কয়েকজন বস্তুবাদী দার্শনিক, সাহিত্যিক ও পণ্ডিত ব্যক্তি জনগণের অভাব-অভিযােগ ও দুঃখদুর্দশার কথা প্রচার করতে থাকেন। বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের Philosophe বলা হত। এদের ব্যাপক প্রচারের ফলে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে ওঠে ও রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। ঠিক এই সময় বুর্জোয়া শ্রেণী নিজের আধিপত্য বিস্তারের বাসনায় অসন্তোষকে উস্কানি দেয়। ভলতেয়ার, রুশাে প্রমুখ দার্শনিকগণের লেখনী বিপ্লবের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আতঙ্ক ও সঙ্কট সমগ্র ফ্রান্সকে গ্রাস করে ফেলে। সাধারণ মানুষ কৃষক শ্রমিক প্রভৃতি সবাই নানারকম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। অনেকের ধারণা জন্মায় অভিজাত সম্প্রদায়ের ষড়যন্ত্রে ও রাজার অপদার্থতার ফলে এই আতঙ্ক ও সংকট দেখা দিয়েছে এবং এই কারণে সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ে রাজার উপরে। Philosophe-দের বক্তব্যকে জনগণের কাছে পৌছে দেবার জন্য এই সময় ফ্রান্সে অনেক ক্লাব তৈরী হয়। এদের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলা। এছাড়া নানাবিধ সমিতি ও সংস্থা তৈরী হয় যেগুলি জনগণকে রাজদ্রোহী করে তােলে। সঙ্ঘ, ক্লাব ও ফিলােজফদের ভূমিকা ছাড়া বিপ্লব হত কিনা সন্দেহ। কারণ ১৭৫৩ সালেও দারিদ্র্য ও সংকট ছিল। কিন্তু বিপ্লব হয় নি।

ফরাসী বিপ্লব ও রাষ্ট্রচিন্তা

মানবাধিকারের ঘােষণা ও ফরাসী বিপ্লব

ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইতিহাসবিদ বা পণ্ডিত ব্যক্তিরা ফরাসী বিপ্লবকে মানব ইতিহাসের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে উল্লেখ করেন নি। রাষ্ট্রচিন্তা ও বিপ্লবের ইতিহাসে ফরাসী বিপ্লব একটি যুগান্তকারী ঘটনা। রাজনীতিক চিন্তার জগতে এই বিপ্লবের প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে আলােচনা করতে গেলে আমাদের প্রথমে মানবাধিকারের ঘােষণার উল্লেখ করতেই হয়।

১৭৮৯ সালের ২০শে আগস্ট জাতীয় সভা মানবাধিকারের ঘােষণা করে। জাতীয় সভা কর্তৃক ঘােষিত কয়েকটি মানবাধিকার হল –
(১) মানুষ স্বাধীনতা নিয়ে জন্মেছে এবং সারাজীবন এই স্বাধীনতা সে ভােগ করতে পারবে।
(২) স্বাধীনতা সম্পত্তি নিরাপত্তা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ করার অধিকার এগুলি যে কোন নাগরিকের থাকবে।
(৩) অন্যের স্বাভাবিক অধিকার বিনষ্ট না করে যে কোন নাগরিক তার নিজের স্বাভাবিক অধিকার ভােগ করতে পারবে।
(৪) আইন কর্তৃক যা নিষিদ্ধ নয় তা ভােগ করার অধিকার যে কোন নাগরিক পাবে। (৫) আইন হল সবজনীন ইচ্ছার অভিব্যক্তি এবং এই আইন প্রণয়নে যে কোন নাগরিক প্রতিনিধি প্রেরণের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
(৬) বে-আইনীভাবে কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার অথবা বন্দী করা যাবে না।
(৭) অপরাধীর বিচার করবে আদালত ও শাস্তি প্রদান হবে আইনানুযায়ী।
(৮) দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যে কোন ব্যক্তি নিজেকে নিদোষ ভাবতে পারবে।
(৯) স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা থেকে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা চলবে না। এমন কি ধর্ম সম্পর্কে যে কোন নাগরিক স্বাধীন মত প্রকাশের সুযােগ পাবে।
(১০) স্বাধীন মত বিনিময় সরকার স্বীকার করে নেবে।
(১১) শাসন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কৈফিয়ৎ চাইবার অধিকার নাগরিক পাবে।
(১২) সম্পত্তির অধিকার অলঙ্ঘনীয় এবং এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা সরকারের নেই। গণস্বার্থের প্রয়ােজনে সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা। হলে খেসারৎ দিতে হবে।

অধিকারগুলির মূল্যায়ন

মানবাধিকারের ঘােষণাপত্রে যে সমস্ত অধিকার স্থান পেয়েছে সেগুলি খুবই গুরত্বপূর্ণ হলেও নজিরবিহীন নয়। আমেরিকার কোন কোন অঙ্গরাজ্যের সংবিধানে এগুলির স্থান ছিল। ব্রিটেনের সাধারণ আইন এগুলিকে রক্ষা করে চলত। কিন্তু ফ্রান্স তথা সমগ্র বিশ্বের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এগুলি অনন্য। ফরাসীরা স্বৈরতন্ত্রের যাঁতাকলে পড়ে অধিকার অনুশীলন বিষয়টিকে একেবারে ভুলতে বসেছিল এবং সেই পরিস্থিতিতে এই ঘােষণাপত্র নতুন যুগের দ্বারােঘাটন করে দেয়। অধিকারের যথাযথ অনুশীলন ব্যতিরেকে মানুষের যে কোন প্রকার মর্যাদা থাকতে পারে না ও ব্যক্তিত্ব স্ফুরিত হয় না তা এই ঘােষণাপত্র পরােক্ষে বলে দিয়ে গেছে। সামাজিক রাজনীতিক ও আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি নাগরিক যাতে সকলপ্রকার অধিকার অনুশীলনের সুযোগ লাভ করে স্বমর্যাদায় আসীন হতে পারে ঘােষণাপত্রের লক্ষ্যই তাই ছিল। স্বাধীনতা ও অধিকারগুলির মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কথাও আমরা পাই। একজন নাগরিক অন্যের অনিষ্ট সাধন করা থেকে বিরত থাকবে এবং নিজেদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলবে। ১৭৮৯ সালের অধিকারের ঘােষণাপত্রকে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ কর্তৃক বিশ্বজনীন মানবাধিকারের ঘােষণার ভিত্তিপ্রস্তর বলে গণ্য করা হয়। তাছাড়া ফরাসী বিপ্লবের পরে যে সমস্ত দেশের সংবিধান রচিত হয়েছে এবং মৌলিক অধিকার স্থান লাভ করেছে সেই অধিকারগুলিকে ফরাসী বিপ্লবের অধিকারের অনুগামী বলা হয়।

সংবিধান সপর্কে ফরাসী বিপ্লবের ধারণা

মানবাধিকারের ঘােষণা ছাড়া বিপ্লব সংবিধান ও সাংবিধানিকতা প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। রাষ্ট্রের প্রশাসন এবং সরকার ও নাগরিকের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য একটি সংবিধান যে বিশেষভাবে প্রয়ােজন তা এই বিপ্লব ঘােষণা করেছে। সংবিধানের কাজ হবে নাগরিকের অধিকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করা। সংবিধানের মধ্যে একটা জাতির ভাবধারা ও দৃষ্টিভঙ্গী প্রতিফলিত হবে। সংবিধান একটি লিখিত দলিল এবং সরকারের কার্যক্রম এই দলিল অনুসারে পরিচালিত হবে। সরকারের সুসংহত একটি রপদান করা এর কাজ। ফরাসী বিপ্লব সংবিধান সম্পর্কে যে কথা বলে গেছে তা হল একে কতকগুলি আইন-কানুনের সঙ্কলন মনে করা ভুল। এটি একটি মৌলিক আইনের সঙ্কলন যাকে শাসক ও শাসিত কেউ লম্বন করতে পারবে না।

ক্ষমতা বিভাজন

ফরাসী বিপ্লব রাষ্ট্রতত্ত্বের আরেকটি দিকের উল্লেখ করে গেছে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতাগুলি সংবিধান কর্তৃক নির্দিষ্ট হয়ে থাকবে এবং সরকারী কর্মচারিগণ সংবিধান নির্দিষ্ট ক্ষমতা অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। অর্থাৎ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি হবে রাষ্ট্র প্রশাসনের অন্যতম মূলনীতি। মঁতেস্কু ক্ষমতা বিভাজনকে ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষক বলে মনে করতেন এবং বিপ্লবের নেতারা যখন সংবিধান রচনার কাজে হাত দেন তখন তাঁরা এই নীতিকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন। ক্ষমতা বিভাজন বিষয়ে বিপ্লবের আরেকটি অবদান হল সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন বিভাগের স্থান সবার উর্ধ্বে। আইন বিভাগের হাতে প্রভূত পরিমাণ ক্ষমতা তুলে দেয়ার ফলে পরে কোন কোন ক্ষেত্রে একটু আধটু জটিলতা দেখা দিলেও সামগ্রিকভাবে এই নীতিটি ফলপ্রসূ হয়েছিল। পরবর্তীকালে অনেক দেশের শাসনতন্ত্র কিছু কিছু ক্ষমতা বিভাজন নীতি অনুসরণ করেছে।

বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রবর্তন

ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিশেষ সুবিধাভােগী শ্রেণীকে সুযােগসুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল বিপ্লবের এই লক্ষ্য পুরােপুরি বাস্তবে পরিণত হতে পারে নি। অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রভাব ক্ষম হলেও বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য স্থাপিত হয়, বিশেষ করে আর্থ-ব্যবস্থা ও রাজনীতির মুখ্য নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের ও নাগরিকের অধিকার ঘােষণাপত্রের সতের নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সম্পত্তির অধিকার অলঙ্ঘনীয় ও পবিত্র এবং এই অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। ব্রিটেনে বুর্জোয়া ব্যবস্থার উত্থান নবজাগরণের পর হলেও হবস ও লক-এর আমল থেকে পাকাপাকি হতে শুরু করে। বস্তুতপক্ষে ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেণী চায়নি যে অভিজাত সম্প্রদায় অনন্তকাল ধরে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করুক। বিপ্লবের অন্যতম কারণ এটি। স্বৈরতন্ত্রের উচ্ছেদের পরে বুর্জোয়া শ্রেণী প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে নেয়। সম্পত্তির অধিকারকে পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয় অধিকার বলে ঘােষণা করে বুর্জোয়ারা কাজ শেষ করে নি, অতীতে অবাধ ব্যবসা-বাণিজ্যের পথে যে সমস্ত বাধা ছিল সেগুলি দূর করে সম্পদ বৃদ্ধিতে মন দেয়। মার্কস থেকে আরম্ভ করে সাম্প্রতিককালের বহু ভাষ্যকার এই বিপ্লবকে বুর্জোয়া শক্তির উত্থানের অনুঘটক বলে মনে করেন (Rude-Revolutionary Europe, p. 290)।

গণতন্ত্র ও ফরাসী বিপ্লব

বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীরা রুশাের গণতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের স্লোগান দিয়েছিল। স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ দশ বছর ধরে লড়াই করেছিল। সুবিধাভােগী শ্রেণীর আধিপত্য হ্রাস ও আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কাঠামাে গড়ে তােলা যায় এবং বিপ্লবীরা তাই করতে চেয়েছিল। গণতন্ত্রের পরিধিকে ব্যাপক করতে হলে ভােটাধিকার প্রথার সংশােধন করে সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক নাগরিককে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযােগ করে দিতে হবে। এবং এর জন্য প্রয়ােজন প্রচলিত আইনকামুনের সংশােধন। বিপ্লবীরা এ দাবি জানাতে দ্বিধাবােধ করে নি। ফরাসী বিপ্লবের ব্যাখ্যাকারগণ বলেন যে এটি গণতন্ত্রের খানিকটা ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছিল। শহর ও গ্রামের মধ্যেকার পার্থক্য বিপ্লবের পরে কমে এসেছিল। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য স্থাপনে বিপ্লবীরা চেষ্টার কোন ত্রুটি করে নি। তবে এই গণতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নি। প্রতিক্রিয়াশীলরা নানা চক্রান্ত করে বানচাল করেছিল।

রাজনীতির ধর্ম-নিরপেক্ষীকরণ

রাজনীতি ও প্রশাসনকে চার্চ বা ধর্মের প্রভাবমুক্ত করতে বিপ্লব সাহায্য করেছিল। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের কাছে সামন্ত ধর্মাবলম্বীরা সমান সুযােগ ও আচরণের অধিকারী হল। অতীতে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলি ক্যাথলিক যাজকদের দ্বারা পরিচালিত হত। বলা বাহুল্য, অ-ক্যাথলিকরা ন্যায়বিচার লাভে বঞ্চিত ছিল। বিপ্লবের পরে এই বৈষম্যের অবসান ঘটে। অতীতে ইহুদী সম্প্রদায়ের লােকেরা ক্যাথলিক যাজকদের নিদেশে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় শান্তিতে ও নিরাপদে বসবাস করতে পেত না। ফলে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। মােট কথা, চার্চের প্রভাব ক্ষুন্ন করে বিপ্লব রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তােলে যার প্রভাব আজও আমরা প্রত্যক্ষ করি। এর সূচনা ম্যাকিয়াভেলী করলেও ব্যাপকতার বিচারে ফরাসী বিপ্লবকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। যাজক ও পাদ্রীদেরকে রাজনীতির আওতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রকে বিপ্লবের পরে একাধিক আইন প্রণয়ন করতে হয়।

জাতীয় রাষ্ট্র ও সার্বভৌমতা

ইউরােপে জাতীয় রাষ্ট্রের সূচনা ফরাসী বিপ্লবের অনেক আগে হলেও ফ্রান্সে এর তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। অথাৎ, জাতি ও জাতীয় রাষ্ট্র প্রভৃতি ধারণাগুলি রাজতন্ত্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। একমাত্র অভিজাত সম্প্রদায়, যাজক ও পাদ্রীরা জাতির ধারণার সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রয়ােজন হলে রাজা এদের জাতীয় রাষ্ট্র ও সাবভৌমত্ব নাম নিতেন এবং রাষ্ট্রের গুরত্বপূর্ণ পরামর্শ নিতেন এবং রাষ্ট্রের গুরত্বপূর্ণ পদগুলি এদের দখলে ছিল। তৃতীয় এতার ( Third Estate) অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা সবরকম মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ছিল। পরে রাজা একাই জাতির প্রতীক হয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু বিপ্লব জাতি কথাটিকে ব্যাপক করে তােলে। একটা রাষ্ট্রের সমস্ত জনসাধারণকে নিয়ে জাতি গঠিত। এমন কি অতীতে রাজার এব্যাপারে যে বিশেষ মর্যাদা ছিল বিপ্লব তারও বিলােপ সাধন করে রাজাকে অন্যান্য নাগরিকের মত জাতির একজন সদস্যতে পরিণত করে। এর ফলে রাজা দৈব অধিকার বা ডিভাইন রাইট থেকে বঞ্চিত হন। জাতি একটি নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করায় সার্বভৌমত্বও একটি আকার নেয়। অর্থাৎ, জাতীয় রাষ্ট্র এবং সার্বভৌমত্ব উভয়েই বিপ্লবের পরে নতুন আকারে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পক্ষে একটি লাভ। তবে জাতি ও সাবভৌমত্ব নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করলেও জনগণের হাতে পুরাে ক্ষমতা বিপ্লবের পরে চলে গিয়েছিল এবং সার্বভৌমত্ব লােকায়ত হয়েছিল এমন মনে করার কোন কারণ নেই। আসলে এটি ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লবােত্তর পর্বে বুর্জোয়া শ্রেণী রাষ্ট্রব্যবস্থার আসল অনুঘটক হয়ে দাঁড়ায়।

বিচার ব্যবস্থা

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের প্রসঙ্গটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিচার-ব্যবস্থা অন্য দু’টি বিভাগ থেকে বিপ্লবের পরে আলাদা হয়ে যায় এবং বিচারকগণ বেতনভােগী সরকারী কর্মচারীতে পরিণত হন। তারা স্বাধীনভাবে ও আইন মােতাবেক বিচারকার্য সম্পাদন করতে আরম্ভ করেন। অতীতে রাজার নির্দেশ ছিল আইন এবং তিনি ছিলেন বিচারক। আবার তাঁর পক্ষে অভিজাত সম্প্রদায় ও চার্চকে বাদ দিয়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার করা সম্ভব ছিল না। বিপ্লবের পরে বিচারকের পদ সকলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। যে কোন নাগরিক বিচারক হতে পারত। সাধারণ ও দরিদ্র নাগরিকরা যাতে বিনা ব্যয়ে বা অল্প খরচে বিচারের সুযােগ-সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা বিপ্লবের পরে করা হয়। বিচারব্যবস্থার পরিবর্তন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছিল।

ফরাসী বিপ্লব এবং শ্রমিক ও কৃষক

কৃষক অসন্তোষ ও ফরাসী বিপ্লব

ফরাসী বিপ্লবকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা হলেও শ্রমিক ও কৃষকের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। পুরােপুরি শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে বিপ্লব পরিচালিত হয় নি বলে আধুনিক কোন কোন ভাষ্যকার মনে করে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সামন্তপ্রভুরা নিজেদের সম্পদ ফরাসী বিপ্লব বাড়াবার জন্য গরীর চাষী ও ক্ষেত মজুরদের বেপরােয়া শােষণ করত। ফিলােজফদের প্রচারে কৃষকদের মধ্যে চেতনাবােধ জেগে ওঠে এবং একবার বিপ্লব শুরু হওয়ায় কৃষকরা জমিদারদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া মুদ্রাস্ফীতি নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের অভাবে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। আর্থব্যবস্থার মধ্যে, পঙ্গুত্ব দেখা দেয় এবং বেকার সমস্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অনেকে কাজের সন্ধানে শহরে ভিড় জমাতে থাকে এবং চাষবাস এর ফলে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মােট কথা, ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে দেশের মধ্যে যে চরম সঙ্কট দানা বাঁধছিল আটের দশকে এসে তার বিস্ফোরণ ঘটল। জমিদাররা যদি দীর্ঘকাল ধরে কৃষকশ্রেণীকে শােষণ করে না চলত তাহলে গণরােষ তাদের উপর গিয়ে এমন প্রবলভাবে পড়ত না। আর রাজশক্তির সঙ্গে সামন্তশক্তির একটা অশুভ আঁতাত গড়ে ওঠায় গণরােষের একটা অংশ রাজাকে, ভােগ করতে হয়েছিল।

শ্রমিক অসন্তোষ ও ফরাসী বিপ্লব

মুল্যবদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি শ্রমিক ও কৃষক উভয় সম্প্রদায়কে উত্তেজিত ও বিদ্রোহী করে তুলেছিল। ঊনিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের মত ১৮শ শতাব্দীতে ব্যাপক আন্দোলন দেখা দেয় নি। তবে শ্রমিকদের স্বার্থে ঘা লাগায় তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিভিন্ন কলকারখানা ও শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকেরা বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন করে। শিল্পপতি ও প্রতিক্রিয়াশীলরা পীড়নমুলক উপায়ে শ্রমিক অসন্তোষ দমন করতে লাগল। কোন কোন শিল্পে মালিক ও শ্রমিক পুরাে আলাদা হয়ে কাজ করত এবং সেই সমস্ত শিল্পে শ্রমিক আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছিল। শ্রমিক শ্রেণীর একটা নগণ্য অংশ শ্রমিক চৈতন্যের অভাবহেতু পজিপতিদের খপ্পরে পড়ে আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাতে না পারলেও সিংহভাগ অংশ শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিল।

শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা ও সংহতি

অ্যাবেনডথ এ শর্ট হিস্ট্রি অফ ইউরােপীয়ান ওয়ার্কিং ক্লাস নামক বই বলেছেন -“ফরাসি বিপ্লব মানবাধিকারের স্বীকৃতি এবং ইউরোপে গণতান্ত্রিক আদর্শ উপলব্ধির পথ প্রশস্ত করেছিল।” ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমেই ইউরােপে শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সচেনতাবােধ জাগায় শ্রমিক শ্রেণীর মনে এই প্রত্যয় জন্মেছিল যে অধিকার আদায় করে নিতে হলে সংগ্রাম অপরিহার্য এবং এর জন্য প্রয়ােজন সংহতি ঐক্য। মার্ক্স বা লেনিন যেভাবে শ্রেণী সংজ্ঞা দিয়েছেন বিপ্লব পর্বের শ্রমিকরা হয়তাে সেই জাতীয় শ্রেণী তৈরি করে উঠতে পারে নি, তবে একথা সত্য যে শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা এককাট্টা হয়েছিল। ঐতিহাসিকেরা বলেন ফ্রান্সের শ্রমিকরা বুঝতে পেরেছিল যে সামন্তপ্রভু ও বুর্জোয়াদের স্বার্থ ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ এক নয়। সুতরাং বাঁচতে গেলে লড়াই অপরিহার্য। শিল্প বিপ্লবােত্তর যুগে ব্রিটেনে বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েরে মধ্যে যে সংগ্রাম দেখা দিয়েছিল তারই মত সংগ্রাম ফ্রান্সে বিপ্লব পর্বে দেখা দেয়। বিপ্লবের পরেও এই সংগ্রামের জের চলতে থাকে এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন শ্রেণী সংগ্রামে তার রূপান্তর ঘটে। কারণ ফরাসী বিপ্লবের পরে ফ্রান্সে শিল্প বিকাশ দুততর হয়। সমাজ মােটামুটি বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সুরাং ফরাসী বিপ্লবকে শ্রেণী সংগ্রামের অগ্রদূত বলতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।

জ্যাকোবিন ও জিরােন্দিন

ফরাসী বিপ্লবে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর ভূমিকা নিয়ে আলােচনা করতে গেলে জ্যাকোবিন ও জিরান্দিন বিষয়টি সম্পর্কে দু’এক কথা বলতে হয়। ১৭৮১ সালের বিপ্লবের শুরুতে জ্যাকোবিন ও জিরােন্দিন পন্থীদ্বয়ের মধ্যে প্রবল সংঘর্ষ দেখা দেয়। জ্যাকোবিনরা গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্লব করা ও রাজার বৈরাচারী শাসনের উচ্ছেদ সাধনের পক্ষপাতী। পক্ষান্তরে জিরােন্দিনরা জমিদার, ভূ-স্বামী ও বুজোয়া সম্প্রদায়ের স্বার্থে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। মুখে জিরােন্দিনরা রাজার স্বৈরতন্ত্রের সমালােচনা করলেও কার্যক্ষেত্রে এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি। ১৭৯১ সালে জিরােন্দিনরা ক্ষমতায় এলেও জ্যাকোবিনদের সঙ্গে বিরােধ থেকেই গিয়েছিল। ১৭৯৩ সালের সংবিধান গণতান্ত্রিক ভােটাধিকারের স্বীকৃতি দেয়। এই সঙ্গে জ্যাকোবিনদের বৈপ্লবিক একনায়কত্ব স্বীকৃতি লাভ করে। জ্যাকোবিনরা ক্ষমতায় এসে ভূমিসংস্কার করে ও শ্রমিক শ্রেণীকে কিছু কিছু সযােগসুবিধা দেয়। কিন্তু এদের পক্ষে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হয় নি। অন্তকলহে জ্যাকোবিনরা জর্জরিত হয়ে পড়ে ও জিরােন্দিনরা এর পুরাে সযােগ নেয়। জ্যাকোবিনদের ক্ষমতাচ্যুত করে জিরােন্দিনরা ক্ষমতা হস্তগত করে। ফ্রান্সের শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। তবে এটা সাময়িক ছিল। ব্যর্থ হলেও জ্যাকোবিনরা শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর মধ্যে চৈতন্যবােধ জাগিয়ে তােলে যা পরে শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী সংহতির কাজ করে। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীকে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ হল জ্যাকোবিন গাষ্ঠী। দাবি আদায় ও স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম বা আন্দোলন যে অপরিহার্য, জ্যাকোবিনরা সেই শিক্ষা দিয়ে গেছে বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন।

তথ্যসূত্র

  • রাষ্ট্রচিন্তার ইতিবৃত্ত, প্রাণগোবিন্দ দাস, নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি লিমিটেড, জুলাই ২০১৩, পৃ. ৩৬৩-৩৮১

1 Trackback / Pingback

  1. পাশ্চাত্যের ইতিহাস ও চিন্তা-ঐতিহ্যের আউটলাইন – বিবর্তনপথ

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.