নোবেল প্রাইজ ২০১৬ রিভিউ: অটোফেজি প্রক্রিয়ার কার্যপ্রণালী আবিষ্কারের জন্য চিকিৎসায় নোবেল প্রাপ্তি

২০১৬ সালে চিকিৎসায় (ফিজিওলজি এবং মেডিসিন) নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এর ইয়োশিনরি ওশুমি। “অটোফেজি” (autophagy) এর মেকানিজম বা কার্যপ্রণালী আবিষ্কারের জন্য তিনি এই পুরষ্কারটি অর্জন করেন।

অটোফেজি শব্দটির অর্থ হল “নিজেকে খাওয়া”। এটা একটি ফিজিওলজিকাল প্রোসেস বা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা একটি কোষকে তার ভেতরে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গাণুগুলো থেকে কোষটিকে পরিষ্কার রাখে এবং এই সব অঙ্গাণুর অস্বাভাবিক প্রোটিনকে (misfolded proteins) দূর করে দিয়ে কোষকে সুস্থ রাখে। এই পদ্ধতিতে কোষগুলোর উপাদানগুলোকে রিসাইকেল করা হয়।

জাপানিজ মাইক্রোবায়োলজিস্ট ইয়োশিনরি উশমি এই পদ্ধতিটির মেকানিজম আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার এই আবিষ্কারের মাধ্যমে অটোফেজি এর কাজকে যে জিনটি কোড করে (অর্থাৎ যে জিনটি অটোফেজি প্রক্রিয়ার জন্য দায়ী) সেটার অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে, এবং এই কোডে থাকা এরর বা ভুলের সাথে পারকিনসনস ডিজিস, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের সম্পর্ক বের করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের শরীরের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অটোফেজি প্রক্রিয়াটি যদি না থাকতো, তাহলে আমাদের এই সব রোগসহ বার্ধক্যজনিত আরও অনেক রোগেই আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেত।

নোবেল প্রাপ্তির সম্মান অর্জন করার সাথে সাথে তিনি ৮ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনর (৯৪০,০০০ ইউএস ডলার) পাচ্ছেন।

যদিও গবেষকগণ ষাট এর দশক থেকেই অটোফেজি সম্পর্কে জানেন, নব্বই এর দশকে ওশুমির ইস্ট (একধরণের ছত্রাক) নিয়ে গবেষণার আগ পর্যন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ বায়োলজিকাল প্রসেসটির গুরুত্ব সম্পর্কে কেউ জানতে পারত না। অটোফেজি প্রক্রিয়াটি ইস্ট থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত সকল জীবের মধ্যেই দেখা যায়। এটা কোষকে স্টার্ভেশন বা ক্ষুধা এবং এরকম স্ট্রেসের হাত থেকে রক্ষা করে। এই অবস্থায় অটোফেজি প্রক্রিয়ার দ্বারা কোষগুলো বড় মলিক্যুল বা অণুগুলোকে ভেঙ্গে এদের বেসিক বিল্ডিং ব্লক বা মৌলিক গাঠনিক উপাদানে পরিণতও করে যেগুলো সেসময় শক্তির উৎস্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ওশুমি ইস্টের মধ্যে অটোফেজি জিনগুলোকে আবিষ্কার করেছিলেন, আর তার এই আবিষ্কার দেখে আরও অনেক বিজ্ঞানী পরে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে থাকা অটোফেজি জিনগুলো আবিষ্কার করেন যেগুলোর কার্যপ্রণালী একইরকম ছিল। তার এই গবেষণা থেকেই পরবর্তীতে সারা বিশ্বের ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য এবং বিভিন্ন অসুখের ক্ষেত্রে অটোফেজি এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়।

স্তন্যপায়ীদের শরীরে অটোফেজির জন্য দায়ী জিনগুলোর তথ্য নিয়ে, গবেষকগণ ইঁদুরের কোষ থেকে সেই জিনগুলোকে সরিয়ে এর ফলাফল পরীক্ষা করে দেখেছেন। এই ধরণের গবেষণা হতে ইনফেকশন বা সংক্রামণ, ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা, নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিস, ক্যান্সার সহ আরও নানান বিষয়ে অটোফেজি এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে।

ওশুমির অটোফেজি নিয়ে গবেষণাটি কিভাবে আরও অনেক গবেষণা ও আবিষ্কারের দরজা খুলে দিয়েছে তার একটা উদাহরণ দেয়া যায়। একটি গবেষণায় পাওয়া যায়, অটোফেজি এর কারণে অনেক প্রোটিনের ভাঙ্গন ঘটে যেগুলো বিভিন্ন নিউরোলজিকাল ডিজিস যেমন ডিমেনশিয়া এর বিভিন্ন ধরণ, পারকিনসনস ডিজিস ও হান্টিংটন ডিজিসের জন্য দায়ী। গবেষণার এই ফলাফল থেকে গবেষকগণ এখন শরীরে অটোফেজি প্রোসেস বৃদ্ধি করে দিয়ে এইসব রোগের সমস্যার সমাধান করার কথা ভাবছেন।

নব্বই এর দশকে যখন ওশুমি এই আবিষ্কারটি করেন, তখন কেউই ভাবতে পারে নি যে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তার এই গবেষণার এত সুদূরপ্রসারী অবদান থাকতে পারে। আসলে তিনি ইস্টে অটোফেজি প্রক্রিয়াটি নিয়ে গবেষণা করছিলেন কেননা তিনি এই ব্যাপারে কৌতুহলী ছিলেন। এই মৌলিক গবেষণা একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাক্ষেত্রের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়, যা সাম্প্রতিক সময়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, যেকোন আনএক্সপেক্টেড বা অপ্রত্যাশিত গবেষণা থেকেই যুগান্তকারী ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

চারটি ইনস্টিটিউশন থেকে নোবেল লরিয়েটদের নির্বাচন করা হয়। দ্য রয়াল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে পদার্থ এবং রসায়নে নোবেলবিজয়ীদেরকে নির্বাচন করা হয়, সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটেট থেকে চিকিৎসায় নোবেল বিজয়ীকে নির্বাচন করা হয়, সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীকে নির্বাচন করা হয় সুইডিশ একাডেমি থেকে এবং নরওয়েজিয়ান পার্লামেন্ট থেকে নির্বাচিত ৫ জনের কমিটি ভোট দিয়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ীকে নির্বাচন করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, এক্ষেত্রে কেউ নিজেকে নমিটেট বা মনোনিত করতে পারেন না, এবং মনোনিতদের নাম ৫০ বছরের আগে প্রকাশিত হয় না।

 

তথ্যসূত্র:

  1. https://www.nobelprize.org/nobel_prizes/medicine/laureates/2016/press.pdf
  2. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/22935804
  3. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/8224160?dopt=Abstract&holding=npg
  4. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/15146184

 

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.