এখানে কেবল জন লকের রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে বলা হচ্ছে। জন লকের সামগ্রিক দর্শন নিয়ে জানতে যান এখানে – জন লক: যে দার্শনিক আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন
Table of Contents
ভূমিকা: সরকার জিনিসটা কী?
প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা মোটেও সহজ নয়। চলুন, একটা খেলা খেলি। মনে করুন, কোনো এক অদ্ভুত সকালে আপনার ঘুম ভাঙল। আপনি দেখলেন, পৃথিবীতে কোনো সরকার নেই। পুলিশ নেই, কোর্ট-কাচারি, সংসদ, মন্ত্রী—কিচ্ছু নেই। আপনি যা খুশি করতে পারেন। আপনার ওপর কোনো আইন চাপিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। বাহ! কী দারুণ, বাঁধনহারা স্বাধীনতা! কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই? কোনো ট্র্যাফিক আইন নেই, ট্যাক্স দেওয়ার তাড়া নেই, কোনো বসের খবরদারি নেই। জীবনটা যেন হঠাৎ করেই একটা লম্বা ছুটি হয়ে গেছে।
কিন্তু একটু থামুন। একটু গভীরে ভাবুন। আপনার প্রতিবেশীও তো একই স্বাধীনতা ভোগ করছে। তার যদি আপনার শখের বাগানটা বা আপনার অতি যত্নে পোষা কুকুরটা ভীষণ পছন্দ হয়ে যায়? সে যদি গায়ের জোরে সেগুলো নিয়ে নিতে চায়, আপনি কাকে ডাকবেন? পুলিশ তো নেই। বিচারক নেই। তখন আপনাকেই আপনার শক্তি দিয়ে নিজের অধিকার রক্ষা করতে হবে। বিষয়টা কেমন যেন একটা গোলমেলে দিকে চলে যাচ্ছে, তাই না? যে স্বাধীনতাকে প্রথমে এত সুন্দর মনে হচ্ছিল, তা হঠাৎ করেই অনিরাপদ, ভয়ংকর মনে হতে শুরু করেছে। যেখানে সবাই স্বাধীন, সেখানে হয়তো কেউই নিরাপদ নয়। শক্তিমানের জয় আর দুর্বলদের টিকে থাকার লড়াই—এই তো হয়ে উঠবে জীবনের মূলমন্ত্র।
এই ভয়ংকর সুন্দর স্বাধীনতার ধারণা নিয়েই গভীরভাবে ভেবেছিলেন একজন মানুষ। সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে তাঁর জন্ম। চারদিকে তখন ভীষণ অস্থিরতা। রাজার সঙ্গে প্রজাদের ক্ষমতার লড়াই চলছে তো চলছেই। গৃহযুদ্ধ, রক্তপাত, ষড়যন্ত্র—সব মিলিয়ে এক গুমোট, দমবন্ধ করা পরিবেশ। এই মানুষটি পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক, কিন্তু তাঁর মনটা ছিল দার্শনিকের। তিনি কেবল মানুষের শরীরের অসুখ নয়, সমাজের অসুখ সারানোর কথাও ভাবতেন। আর তাই সমাজের এই গুরুতর অসুখের জন্য তিনি একটি প্রেসক্রিপশন লেখার চেষ্টা করলেন। তাঁর নাম জন লক (John Locke)।
লক এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে সরকার থাকবে, কিন্তু মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেবে না। সরকার হবে জনগণের পাহারাদার, প্রভু নয়। তাঁর চিন্তাভাবনা এতটাই যুগান্তকারী ছিল যে তা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লব এবং আধুনিক পৃথিবীর প্রায় সমস্ত গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছে। চলুন, আমরা লকের সেই বিস্ময়কর রাষ্ট্রচিন্তার জগতে একটু ডুব দেই।
সেই অস্থির সময়ের গল্প এবং একজন দার্শনিকের জন্ম
লককে বুঝতে হলে তাঁর সময়টাকে বুঝতে হবে। সময়কে না বুঝলে মানুষকে বোঝা যায় না। জন লকের জন্ম ১৬৩২ সালে, ইংল্যান্ডের এক পিউরিটান পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন আইনজীবী এবং সংসদীয় বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন, যিনি ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধে (English Civil War) রাজার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই লক রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতার বাড়াবাড়ি এবং তার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রাম দেখে বড় হয়েছেন। তিনি দেখেছেন কীভাবে ঈশ্বরের নামে একচ্ছত্র ক্ষমতা দাবি করে রাজা প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারেন।
তাঁর যৌবন কেটেছে অলিভার ক্রমওয়েলের (Oliver Cromwell) কমনওয়েলথ এবং তারপর আবার রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেখে। এই যে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা—কখনো রাজার শাসন, কখনো সংসদের—তা লকের মনে গভীর প্রশ্ন তৈরি করেছিল: শাসনের আসল ভিত্তিটা কী? কে শাসন করার অধিকার পায়? আর সেই অধিকারের সীমাটাই বা কোথায়? এই প্রশ্নগুলোই তাঁর সারাজীবনের অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠেছিল। শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতাই নয়, তাঁর সময়টা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবেরও। একদিকে রেনে দেকার্তের মতো বুদ্ধিবাদীরা, অন্যদিকে ফ্রান্সিস বেকনের মতো অভিজ্ঞতাবাদীরা—সবাই মিলে ইউরোপের চিন্তার জগতে ঝড় তুলেছিলেন। লক নিজেও ছিলেন একজন অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricist), যিনি মনে করতেন আমাদের সমস্ত জ্ঞান আসে অভিজ্ঞতা থেকে। তাঁর এই বৈজ্ঞানিক ও পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
লকের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিল তাঁর সঙ্গে আর্ল অফ শ্যাফটসবারি (Earl of Shaftesbury)-র পরিচয়। শ্যাফটসবারি ছিলেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী, ধুরন্ধর এবং বিতর্কিত রাজনীতিবিদ। লক তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করলেও, ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শ্যাফটসবারি ছিলেন রাজার সীমাহীন ক্ষমতার ঘোর বিরোধী এবং সংসদের ক্ষমতার পক্ষে। তিনি এমন একটি রাজনৈতিক দলের (পরবর্তীতে হুইগ পার্টি নামে পরিচিত) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যারা ক্যাথলিক রাজা দ্বিতীয় জেমসের সিংহাসনে বসার বিরোধিতা করছিল। এই সময়টা ‘এক্সক্লুশন ক্রাইসিস’ (Exclusion Crisis) নামে পরিচিত। রাজার সমর্থক এবং বিরোধীদের মধ্যে তখন তীব্র সংঘাত।
এই রাজনৈতিক ঝড়ের কারণেই লককে একসময় তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য হল্যান্ডে পালিয়ে যেতে হয়। সেখানেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বই লেখেন—An Essay Concerning Human Understanding এবং Two Treatises of Government। বই দুটি তিনি বেনামে প্রকাশ করেছিলেন, কারণ তাঁর কথাগুলো ছিল তৎকালীন রাজতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। যদি ধরা পড়তেন, তবে তাঁর মৃত্যুদণ্ডও হতে পারত।
অবশেষে ১৬৮৮ সালে ইংল্যান্ডে এক রক্তপাতহীন বিপ্লব ঘটে, যা ‘গৌরবময় বিপ্লব’ (Glorious Revolution) নামে পরিচিত। এই বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচারী রাজা দ্বিতীয় জেমসকে সরিয়ে জনগণের সম্মতিতে উইলিয়াম এবং মেরিকে সিংহাসনে বসানো হয়। এই বিপ্লব প্রমাণ করে যে, রাজার ক্ষমতা ঈশ্বরপ্রদত্ত নয়, বরং তা জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল। লক এই বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং তাঁর লেখাগুলো তখন এই নতুন শাসনব্যবস্থাকে একটি দার্শনিক ভিত্তি দেয়। তাই অনেকেই বলেন, লকের Two Treatises of Government বইটি গৌরবময় বিপ্লবের একটি তাত্ত্বিক সমর্থন বা জাস্টিফিকেশন। তিনি যেন বিপ্লবের পরে এসে বললেন, “আপনারা যা করেছেন, তা ঠিকই করেছেন, এবং কেন ঠিক করেছেন, তার কারণটা আমি ব্যাখ্যা করছি।”
যে ঝড় থেকে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতার দর্শন
কোনো বড় নদীর উৎস খুঁজতে গেলে যেমন অনেক ছোট ছোট ঝর্ণা আর পাহাড়ি স্রোতের দেখা মেলে, তেমনি কোনো বড় দার্শনিকের চিন্তার উৎস খুঁজতে গেলেও তার সময়ের উত্তাল রাজনীতি আর আগের দার্শনিকদের রেখে যাওয়া ভাবনার স্রোত খুঁজে পাওয়া যায়। জন লক (John Locke) নামের সেই মানুষটি, যিনি আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গেছেন, তাঁর দর্শন আকাশ থেকে পড়েনি। এর শেকড় ছড়িয়ে ছিল তাঁর সময়ের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর কিছু পুরনো কিন্তু শক্তিশালী দর্শনের মাটিতে।
চলুন, আমরা একটা টাইম মেশিনে চড়ে বসি। ফিরে যাই সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে। চারদিকে বারুদের গন্ধ, ষড়যন্ত্রের ফিসফাস আর সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস। এই ঝড়ের কেন্দ্রেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জন লক। তাঁর চিন্তার জগৎটাকে বুঝতে হলে আমাদের এই ঝড়টাকে বুঝতে হবে, আর বুঝতে হবে সেইসব নাবিকদের, যারা তাঁর আগেই ভাবনার সমুদ্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
রক্তের কালিতে লেখা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভাবুন তো, আপনার চোখের সামনে আপনার দেশটা দুই টুকরো হয়ে গেল। রাজা আর সংসদ—কার ক্ষমতা বেশি, এই নিয়ে শুরু হলো রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ (English Civil War)। আপনি ছোটবেলা থেকে দেখে বড় হচ্ছেন যে, আপনার বাবা রাজার বিরুদ্ধে লড়ছেন। দেশের রাজা, যাকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে মানা হতো, তাঁর শিরশ্ছেদ করা হলো। এরপর এলো এক নতুন শাসনব্যবব্যবস্থা, যা দেখতে গণতন্ত্রের মতো হলেও আদতে ছিল একনায়কতন্ত্র। তারপর আবার সেই রাজতন্ত্রের ফেরা। এই যে টালমাটাল অবস্থা, যেখানে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, সবকিছুই প্রশ্নবিদ্ধ—এমন একটি সময়ে বড় হলে আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগবে না? ক্ষমতার আসল উৎস কী? কে আমাদের শাসন করার অধিকার রাখে? আর সেই শাসনের সীমাটাই বা কোথায়?
ঠিক এই প্রশ্নগুলোই জন লকের মনে তোলপাড় তুলেছিল। তাঁর দর্শনকে বুঝতে হলে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে চারটি ভাগে ভাগ করে দেখা যেতে পারে।
১. গৃহযুদ্ধ এবং রাজার পতন (The English Civil War, 1642-1651): লকের জন্মের মাত্র দশ বছর পর ইংল্যান্ড এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। একদিকে ছিলেন রাজা প্রথম চার্লস (King Charles I), যিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর শাসন করার ক্ষমতা ঈশ্বরপ্রদত্ত (Divine Right of Kings) এবং তিনি সংসদের ঊর্ধ্বে। অন্যদিকে ছিল সংসদ (Parliament), যারা মনে করত দেশের আইন এবং করারোপের ক্ষমতা থাকবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। এই সংঘাতের ফল ছিল ভয়াবহ। নয় বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যায় এবং শেষ পর্যন্ত রাজার পরাজয় ঘটে। ১৬৪৯ সালে রাজা প্রথম চার্লসকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করা হয়।
এই ঘটনাটি ছিল ইউরোপের জন্য এক ভূমিকম্পের মতো। এটি প্রমাণ করে দিয়েছিল যে, রাজা অপরাজেয় নন, তাঁর ক্ষমতাও চিরস্থায়ী নয়। প্রজারা চাইলে রাজাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে, এমনকি তাঁর বিচারও করতে পারে। এই ধারণাটিই লকের মনে ‘শাসিতের সম্মতি’ (Consent of the Governed) এবং ‘বিপ্লবের অধিকার’ (Right to Revolution) তত্ত্বের বীজ বুনে দিয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, যখন শাসক তার ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন করে, তখন জনগণ চুপ করে বসে থাকে না (Laslett, 1988)।
২. ক্রমওয়েলের কমনওয়েলথ এবং একনায়কতন্ত্রের অভিজ্ঞতা (Cromwell’s Commonwealth, 1649-1660): রাজাকে হত্যার পর ইংল্যান্ড একটি প্রজাতন্ত্র বা কমনওয়েলথ (Commonwealth) হিসেবে ঘোষিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন অলিভার ক্রমওয়েল (Oliver Cromwell)। প্রথমে এটিকে একটি দারুণ ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল—রাজা নেই, সবাই স্বাধীন। কিন্তু খুব শীঘ্রই ক্রমওয়েল একজন ‘লর্ড প্রোটেক্টর’ (Lord Protector) হিসেবে প্রায় একনায়কের মতো ক্ষমতা ব্যবহার করতে শুরু করেন। তাঁর পিউরিটান নৈতিকতা জনগণের ওপর কঠোরভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়। থিয়েটার বন্ধ করে দেওয়া হয়, উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়।
এই অভিজ্ঞতা লককে শিখিয়েছিল যে, শুধু রাজতন্ত্রই স্বৈরাচারী হতে পারে তা নয়, যেকোনো ধরনের সরকারই, এমনকি প্রজাতন্ত্রের নামেও, জনগণের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে। ক্ষমতা যে কারও হাতেই কেন্দ্রীভূত হোক না কেন, তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এই উপলব্ধিই তাঁকে পরবর্তীতে ‘ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ’ (Separation of Powers) এবং ‘সীমিত সরকার’ (Limited Government) নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করেছিল।
৩. রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নতুন সংঘাত (The Restoration and Exclusion Crisis): ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ড আবার বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে আবার রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনে। ১৬৬০ সালে প্রথম চার্লসের পুত্র দ্বিতীয় চার্লস (Charles II) সিংহাসনে বসেন। কিন্তু পুরনো সংঘাত আবার নতুন করে ফিরে আসে। দ্বিতীয় চার্লসের কোনো বৈধ সন্তান না থাকায় তাঁর ভাই জেমস (James) ছিলেন পরবর্তী উত্তরাধিকারী। কিন্তু জেমস ছিলেন একজন ক্যাথলিক, যা প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডের বেশিরভাগ মানুষ মেনে নিতে পারছিল না।
এই সময়টা ‘এক্সক্লুশন ক্রাইসিস’ (Exclusion Crisis) নামে পরিচিত। লকের রাজনৈতিক গুরু আর্ল অফ শ্যাফটসবারি (Earl of Shaftesbury) ছিলেন সেই দলের নেতা, যারা জেমসকে সিংহাসন থেকে দূরে রাখার জন্য আইন পাশ করার চেষ্টা করছিল। তাঁরা যুক্তি দিচ্ছিলেন যে, সংসদের অধিকার আছে উত্তরাধিকারের আইন পরিবর্তন করার। অন্যদিকে, রাজার সমর্থকরা বলছিল, উত্তরাধিকারের নিয়ম অলঙ্ঘনীয়। এই বিতর্কের কেন্দ্রেই ছিল প্রশ্নটি—সার্বভৌম ক্ষমতা (Sovereign Power) কি রাজার হাতে, নাকি সংসদের হাতে? জন লক তাঁর বিখ্যাত বই Two Treatises of Government именно এই সময়েই শ্যাফটসবারির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য লিখতে শুরু করেন বলে মনে করা হয় (Ashcraft, 1986)। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা বংশানুক্রমিক কোনো সম্পত্তি নয়, এটি জনগণের দেওয়া একটি আমানত (Trust)।
৪. গৌরবময় বিপ্লব (The Glorious Revolution, 1688): সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে যখন ক্যাথলিক রাজা দ্বিতীয় জেমস (James II) সিংহাসনে বসে স্বৈরাচারী আচরণ শুরু করলেন, তখন ইংল্যান্ডের প্রধান রাজনৈতিক নেতারা মিলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা জেমসের প্রোটেস্ট্যান্ট কন্যা মেরি এবং তাঁর স্বামী, হল্যান্ডের শাসক উইলিয়াম অফ অরেঞ্জকে (William of Orange) ইংল্যান্ড আক্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। জেমস প্রায় বিনাযুদ্ধে পালিয়ে যান এবং উইলিয়াম ও মেরি সংসদের শর্ত মেনে সিংহাসনে বসেন। এই রক্তপাতহীন বিপ্লবটিই ‘গৌরবময় বিপ্লব’ নামে পরিচিত।
এই বিপ্লব লকের তত্ত্বকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। এটি প্রমাণ করেছিল যে:
- শাসকের ক্ষমতা জনগণের সম্মতির ওপর নির্ভরশীল।
- জনগণ স্বৈরাচারী শাসককে সরিয়ে নতুন শাসক বসাতে পারে।
- সরকার আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং তাকে জনগণের অধিকারকে সম্মান করতে হবে, যা ‘বিল অফ রাইটস ১৬৮৯’ (Bill of Rights 1689)-এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়।
লক যখন হল্যান্ড থেকে নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন, তখন তাঁর বেনামে লেখা বইগুলো এই নতুন শাসনব্যবস্থার দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি যেন সময়ের নাড়ি টিপে সঠিক ঔষধটি তৈরি করে রেখেছিলেন।
ভাবনার জগতে পূর্বসূরীদের ছায়া
লকের দর্শন শুধু রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফসল ছিল না। তিনি তাঁর আগের এবং সমসাময়িক দার্শনিকদের সঙ্গে এক নীরব সংলাপে লিপ্ত ছিলেন। কাউকে তিনি গ্রহণ করেছেন, কাউকে আবার প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করেছেন।
প্রধান প্রতিপক্ষ: স্যার রবার্ট ফিলমার (Sir Robert Filmer): লকের First Treatise বইটির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্যার রবার্ট ফিলমারের তত্ত্বকে ধ্বংস করা। ফিলমার তাঁর Patriarcha (১৬৮০ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত) বইতে রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের পক্ষে এক অদ্ভুত যুক্তি দেন। তিনি বলেন, ঈশ্বর আদমকে পৃথিবীর প্রথম রাজা বানিয়েছিলেন এবং তাঁর সন্তানদের ওপর শাসন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আজকের রাজারা হলেন আদমের সরাসরি বংশধর, তাই তাঁদেরও প্রজাদের ওপর একইরকম পৈতৃক (Patriarchal) ক্ষমতা রয়েছে।
লক বুঝেছিলেন, উদারনৈতিক বা সীমিত সরকারের কোনো তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার আগে এই ভিত্তিহীন কিন্তু প্রভাবশালী ধারণাটিকে উপড়ে ফেলতে হবে। তিনি যুক্তি, বিদ্রূপ আর বাইবেলের জ্ঞান দিয়ে ফিলমারের তত্ত্বকে ছিন্নভিন্ন করে দেন। এই কাজটি না করলে তাঁর নিজের ‘সামাজিক চুক্তি’র (Social Contract) প্রাসাদটি তিনি গড়তে পারতেন না।
যার কাঁধে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে দেখেছিলেন: টমাস হব্স (Thomas Hobbes): লকের দর্শনের সঙ্গে যাঁর সবচেয়ে বেশি তুলনা করা হয়, তিনি হলেন টমাস হব্স। হব্সও ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ দেখে আতঙ্কিত হয়েছিলেন এবং স্থিতিশীলতার সন্ধানে তাঁর বিখ্যাত বই Leviathan (1651) লিখেছিলেন। লক এবং হব্সের মধ্যে কিছু মিল ছিল। দুজনেই ‘প্রকৃতির রাজ্য’ (State of Nature) এবং ‘সামাজিক চুক্তি’র ধারণা ব্যবহার করেছেন। দুজনেই মনে করতেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস ঈশ্বর নন, বরং মানুষের চুক্তি।
কিন্তু তাঁদের উপসংহার ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন:
-
হব্সের চোখে প্রকৃতির রাজ্য ছিল এক ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে জীবন ছিল “একাকী, দরিদ্র, নোংরা, পাশবিক এবং ক্ষণস্থায়ী” (solitary, poor, nasty, brutish, and short) (Hobbes, 1651)। এখান থেকে বাঁচতে মানুষ চুক্তির মাধ্যমে তাদের সমস্ত অধিকার এক সার্বভৌম শাসকের হাতে তুলে দেয়, যার ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ (Absolute)। কারণ হব্সের কাছে স্বৈরাচারও অরাজকতার চেয়ে ভালো।
-
অন্যদিকে, লকের চোখে প্রকৃতির রাজ্য অতটা ভয়ংকর ছিল না। এটি ছিল স্বাধীনতা ও সাম্যের রাজ্য, যা ‘প্রকৃতির আইন’ (Law of Nature) দ্বারা পরিচালিত। সমস্যা হলো, এই রাজ্যে আইন প্রয়োগ করার কোনো নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছিল না। তাই মানুষ তাদের সম্পত্তি (জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পদ) আরও ভালোভাবে রক্ষা করার জন্য একটি সীমিত সরকার গঠন করে। তারা তাদের সব অধিকার বিসর্জন দেয় না, বরং সরকারের কাছে কিছু নির্দিষ্ট ক্ষমতা আমানত হিসেবে রাখে।
সহজ ভাষায় বললে, হব্স চেয়েছিলেন খাঁচাটা মজবুত হোক, পাখিটা মরে গেলেও সমস্যা নেই। আর লক চেয়েছিলেন, পাখিটাও বাঁচুক, আবার খাঁচাটাও থাকুক, কিন্তু খাঁচার দরজাটা থাকবে পাখিরই হাতে। লক সচেতনভাবেই হব্সের চরমপন্থী সিদ্ধান্তের বিকল্প খুঁজছিলেন (Tuck, 1999)।
সুদূর অতীতের প্রতিধ্বনি: অ্যারিস্টটল এবং সিসেরো (Aristotle and Cicero): লকের চিন্তায় প্রাচীন গ্রিক ও রোমান দর্শনেরও প্রভাব ছিল। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মানুষ স্বভাবতই একটি ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ (Political Animal) এবং রাষ্ট্র তৈরি হয় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য নয়, বরং একটি ‘ভালো জীবন’ (Good Life) যাপনের জন্য। লকের ‘জনগণের মঙ্গল’ (Public Good) ধারণার মধ্যে অ্যারিস্টটলের এই ভাবনার ছায়া দেখা যায়।
রোমান দার্শনিক সিসেরোর কাছ থেকে ‘প্রকৃতির আইন’-এর ধারণাটি আরও বিকশিত রূপ পায়। সিসেরো মনে করতেন, একটি সার্বজনীন এবং অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক আইন আছে, যা মানুষের যুক্তির মাধ্যমে জানা যায়। এই আইনই সব মানবসৃষ্ট আইনের ভিত্তি হওয়া উচিত। লকের ‘প্রকৃতির আইন’-এর ধারণাটি এই ধ্রুপদী ঐতিহ্যেরই একটি আধুনিক সংস্করণ।
রিচার্ড হুকার এবং অ্যাংলিকান ঐতিহ্য (Richard Hooker and the Anglican Tradition): লকের ওপর আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী ছিলেন ষোড়শ শতকের ইংরেজ ধর্মতত্ত্ববিদ রিচার্ড হুকার (Richard Hooker)। হুকার তাঁর Laws of Ecclesiastical Polity বইতে আইন, যুক্তি এবং সম্মতির ওপর ভিত্তি করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থার কথা বলেন। তিনি দেখান যে, এমনকি রাজাকেও আইনের অধীন থাকতে হবে এবং শাসন করতে হবে সম্মতির ভিত্তিতে। লকের অনেক যুক্তি, বিশেষ করে সম্মতি এবং আইনের শাসন বিষয়ে, হুকারের লেখার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল (Dunn, 1969)। হুকার যেন হব্সের স্বৈরাচার এবং উগ্র পিউরিটানদের অরাজকতার মধ্যে একটি মধ্যপন্থা তৈরি করে রেখেছিলেন, যা লক পরবর্তীতে আরও বিকশিত করেন।
এক নতুন দর্শনের জন্ম
শেষ পর্যন্ত আমরা কী দেখতে পাই? জন লকের রাষ্ট্রচিন্তা কোনো শূন্য থেকে তৈরি হওয়া দর্শন নয়। এটি ছিল তাঁর উত্তাল সময়ের এক অনিবার্য ফসল। একদিকে গৃহযুদ্ধের আগুন, স্বৈরাচারের অভিজ্ঞতা আর বিপ্লবের পদধ্বনি তাঁকে বাধ্য করেছিল একটি স্থিতিশীল কিন্তু স্বাধীন সমাজের পথ খুঁজতে। অন্যদিকে, ফিলমারের পৈতৃক স্বৈরাচার এবং হব্সের লৌহ-কঠিন লেভায়াথান—এই দুই চরমপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি একটি ভিন্ন পন্থা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
তিনি যেন একজন দক্ষ কারিগরের মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। হব্সের কাছ থেকে নিলেন চুক্তির কাঠামো, কিন্তু তাতে ভরে দিলেন হুকার আর সিসেরোর আইনের আত্মা। তারপর ফিলমারের পুরনো, জরাজীর্ণ প্রাসাদটিকে যুক্তির ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সেই জায়গায় নির্মাণ করলেন তাঁর নিজের সীমিত সরকার, সম্মতি আর প্রাকৃতিক অধিকারের নতুন ইমারত।
এই ঝড়, এই বিতর্ক, এই রক্তপাত না থাকলে হয়তো জন লক কেবল একজন সাধারণ চিকিৎসক হয়েই থেকে যেতেন। কিন্তু সময় তাঁকে দার্শনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছিল। আর তাই তাঁর দর্শন আজও আমাদের কাছে এত জীবন্ত মনে হয়। কারণ এটি কোনো পুঁথিগত তত্ত্ব নয়, এটি রক্ত-মাংসের মানুষের স্বাধীনতা আর নিরাপত্তার চিরন্তন দ্বন্দ্ব থেকে জন্ম নেওয়া এক কালজয়ী সমাধান।
এক ঐশ্বরিক মিথ ভাঙার গল্প (The First Treatise)
আমরা সাধারণত লকের রাষ্ট্রচিন্তা বলতে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ বা Second Treatise-এর কথাই বেশি আলোচনা করি। কিন্তু তাঁর প্রথম গ্রন্থটি না বুঝলে দ্বিতীয়টির আসল উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন। First Treatise of Government ছিল একটি বিধ্বংসী রচনা। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্যার রবার্ট ফিলমার (Sir Robert Filmer) নামে এক রাজতন্ত্রের সমর্থকের তত্ত্বকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া।
ফিলমার তাঁর Patriarcha নামক বইতে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, রাজার শাসন করার ক্ষমতা আসে সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে। এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘রাজার ঐশ্বরিক অধিকার’ (Divine Right of Kings)। ফিলমারের যুক্তিটা ছিল বেশ অদ্ভুত এবং সরল, কিন্তু তৎকালীন সময়ে খুবই প্রভাবশালী। তিনি বলেছিলেন:
১. ঈশ্বর পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদমকে (Adam) শুধু পৃথিবীর অধিপতিই বানাননি, তাঁকে তাঁর সন্তানদের ওপর শাসন করার ক্ষমতাও দিয়েছিলেন।
২. এই ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ এবং পৈতৃক। ঠিক যেমন একজন বাবা তাঁর সন্তানদের ওপর কর্তৃত্ব রাখেন।
৩. বর্তমান রাজারা হলেন আদমের সরাসরি বংশধর। তাই তাঁরাও প্রজাদের ওপর শাসন করার সেই একই ঐশ্বরিক ও পৈতৃক অধিকার লাভ করেছেন। প্রজাদের কাজ হলো কোনো প্রশ্ন না করে রাজার আদেশ মেনে চলা, কারণ রাজা হলেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। রাজার বিরোধিতা করা মানে ঈশ্বরেরই বিরোধিতা করা।
এই তত্ত্বটা শুনতে যতই দুর্বল লাগুক, তৎকালীন সময়ে এর প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। এটা রাজাকে যেকোনো অত্যাচার বা স্বৈরাচারী কাজের লাইসেন্স দিয়ে দিত। কারণ তাঁর কাজের কৈফিয়ত তিনি শুধু ঈশ্বরকেই দেবেন, প্রজাদের নয়।
লক তাঁর প্রথম গ্রন্থে একজন সার্জনের মতো ঠাণ্ডা মাথায় ফিলমারের এই তত্ত্বকে ব্যবচ্ছেদ করলেন। তিনি যুক্তি ও বাইবেলের উদাহরণ দিয়ে একের পর এক আঘাতে এই তত্ত্বকে ভেঙে চুরমার করে দিলেন:
-
আদমের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না: লক দেখালেন যে, বাইবেলে কোথাও বলা নেই যে, ঈশ্বর আদমকে কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তাঁকে পৃথিবীর পশুপাখি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অন্য মানুষদের ওপর শাসন করার অধিকার নয়।
-
ক্ষমতা যদি থাকতও, তা বংশানুক্রমিক নয়: যদি ধরেও নেওয়া হয় আদমের সেই ক্ষমতা ছিল, তাহলে সেই ক্ষমতা তাঁর কোন সন্তান পাবে? জ্যেষ্ঠ সন্তান? নাকি সব সন্তান সমানভাবে পাবে? এর কোনো সুস্পষ্ট নিয়ম বাইবেলে নেই। ফিলমারের তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীতে শুধুমাত্র একজনই আদমের সত্যিকারের উত্তরাধিকারী হতে পারেন। তাহলে বাকি সব রাজাই তো অবৈধ!
-
উত্তরাধিকার প্রমাণ করা অসম্ভব: সবচেয়ে বড় এবং অকাট্য যুক্তি হলো, হাজার হাজার বছর পর আজকের দিনের কোনো রাজা কীভাবে প্রমাণ করবেন যে তিনি আদমের সরাসরি বংশধর? এটা প্রমাণ করা একেবারেই অসম্ভব। বংশের ধারা খুঁজে বের করার কোনো নির্ভরযোগ্য পথ নেই।
এভাবে একের পর এক যুক্তি দিয়ে লক ফিলমারের তত্ত্বকে এমনভাবে খণ্ডন করলেন যে, রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের ধারণাটি একেবারে ভিত্তিহীন ও হাস্যকর বলে প্রমাণিত হলো। তিনি দেখালেন, রাজনৈতিক ক্ষমতা আর পারিবারিক ক্ষমতা (যেমন, বাবার ক্ষমতা) এক জিনিস নয়। রাষ্ট্র কোনো বিশাল পরিবার নয়, আর শাসকও কোনো পিতা নন। শাসকের ক্ষমতা সম্মতি ও চুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, রক্তের সম্পর্কের ওপর নয়।
এই পুরনো প্রাসাদটি ভেঙে ফেলার পরই লক তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থে একটি নতুন প্রাসাদ গড়ার কাজে হাত দিলেন। যদি শাসকের ক্ষমতা ঈশ্বর বা বংশানুক্রম থেকে না আসে, তাহলে তা আসে কোথা থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই তিনি আমাদের নিয়ে যান সেই কাল্পনিক ‘প্রকৃতির রাজ্যে’।
প্রকৃতির রাজ্য – এক নিখুঁত কিন্তু অসুবিধাজনক স্বাধীনতা (The State of Nature)
লকের দর্শন বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে তাঁর ‘প্রকৃতির রাজ্য’ (State of Nature) নামক ধারণাটি বুঝতে হবে। এটা এমন একটা কাল্পনিক পরিস্থিতি যেখানে কোনো রাষ্ট্র বা সরকার নেই। এই ধারণাটি লকের আগে আরেকজন বিখ্যাত দার্শনিক টমাস হব্সও (Thomas Hobbes) ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু দুজনের দেখার ভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হব্সের চোখে প্রকৃতির রাজ্য ছিল এক ভয়ংকর জায়গা, যেখানে মানুষ স্বার্থপর, হিংস্র এবং সারাক্ষণ একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত (“war of all against all”)। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন হবে “একাকী, দরিদ্র, নোংরা, পাশবিক এবং ক্ষণস্থায়ী” (solitary, poor, nasty, brutish, and short)।
কিন্তু লক এতটা হতাশাবাদী ছিলেন না। তিনি বললেন, না, বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। প্রকৃতির রাজ্য মানেই বিশৃঙ্খলা বা যুদ্ধক্ষেত্র নয়। এটা আসলে একটা নিখুঁত স্বাধীনতার রাজ্য (a state of perfect freedom)। এখানে সব মানুষ সমান। কেউ কারও ওপর প্রভুত্ব করার অধিকার নিয়ে জন্মায় না। এখানে প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে নিজের জীবনযাপন করতে পারে, নিজের সম্পত্তি ভোগ করতে পারে, যতক্ষণ না সে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে।
আপনি হয়তো ভাবছেন, তাহলে তো দারুণ ব্যাপার! সরকার ছাড়াই যদি শান্তিতে থাকা যায়, তবে সরকারের দরকার কী?
লক বললেন, এখানেই একটা ‘কিন্তু’ আছে। প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীনতা থাকলেও, তা বিশৃঙ্খল নয়। কারণ এই রাজ্যটা একটা অদৃশ্য আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই আইনের নাম ‘প্রকৃতির আইন’ (Law of Nature)। এই আইন কোনো মানুষ তৈরি করেনি, এটা স্বয়ং ঈশ্বর বা আমাদের ভেতরের যুক্তি (Reason) আমাদের শিখিয়েছে। আইনটা খুব সহজ এবং সুন্দর: যেহেতু সব মানুষ সমান এবং স্বাধীন, তাই কেউ অন্যের জীবন, স্বাস্থ্য, স্বাধীনতা বা সম্পত্তির (life, health, liberty, or possessions) ক্ষতি করতে পারবে না।
অর্থাৎ, আপনার যেমন নিজের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার অধিকার আছে, তেমনি অন্যের জীবন ও সম্পত্তিকে সম্মান করাও আপনার দায়িত্ব। এটা কোনো রাজা বা পুলিশ এসে আপনাকে শেখাবে না, আপনার ভেতরের বিবেক বা যুক্তিই আপনাকে এই শিক্ষা দেবে। এই আইনটি সার্বজনীন; এটা পৃথিবীর সব মানুষের জন্য, সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
প্রকৃতির রাজ্য শুনতে খুব আদর্শ মনে হলেও এর তিনটি বড় অসুবিধা (inconveniences) আছে, যা একে ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য করে তোলে। লক এই অসুবিধাগুলোকে খুব স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন:
১. নির্দিষ্ট, জ্ঞাত আইনের অভাব (Want of an established, settled, known law): প্রকৃতির আইন সবার মনে গাঁথা থাকলেও, প্রত্যেকে নিজের স্বার্থ অনুযায়ী এর ব্যাখ্যা করতে পারে। কোনো একটা নির্দিষ্ট, লিখিত এবং সবার দ্বারা স্বীকৃত আইন নেই। ফলে, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। আপনার কাছে যা ন্যায্য মনে হচ্ছে, আপনার প্রতিবেশীর কাছে তা অন্যায় মনে হতে পারে। আবেগের বশে বা অজ্ঞতার কারণে মানুষ এই আইনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
২. পরিচিত ও নিরপেক্ষ বিচারকের অভাব (Want of a known and indifferent judge): মনে করুন, আপনার সঙ্গে আপনার প্রতিবেশীর ঝগড়া লাগল। দুজনেই প্রকৃতির আইন অনুসারে নিজেদের সঠিক বলে দাবি করছেন। এই অবস্থায় কে বিচার করবে? প্রকৃতির রাজ্যে কোনো নিরপেক্ষ বিচারক নেই। প্রত্যেকেই নিজের মামলার বিচারক। আর মানুষ যখন নিজের বিচার নিজেই করে, তখন পক্ষপাতিত্ব (partiality), রাগ (passion), আর প্রতিশোধ (revenge) ন্যায়বিচারের পথ আটকে দাঁড়ায়। নিজের প্রতি আমরা যতটা সদয়, অন্যের প্রতি ততটা নই। ফলে ন্যায়বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
৩. বিচার কার্যকর করার শক্তির অভাব (Want of power to back and support the sentence): আচ্ছা, ধরে নিলাম কোনোভাবে একটা বিচার হলো। কিন্তু সেই রায় কার্যকর করবে কে? প্রকৃতির রাজ্যে কোনো পুলিশ বা নির্বাহী শক্তি নেই। যদি অপরাধী শক্তিশালী হয়, তবে সে হয়তো কোনো শাস্তিই মানবে না। ফলে, দুর্বল মানুষ সবসময়ই সবলের অত্যাচারের ভয়ে থাকবে। একজন মানুষ হয়তো প্রকৃতির আইন ভঙ্গকারীকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাখে, কিন্তু তার সেই শাস্তি কার্যকর করার মতো শক্তি নাও থাকতে পারে।
এই তিনটি অসুবিধার কারণে প্রকৃতির রাজ্যের নিখুঁত স্বাধীনতা ধীরে ধীরে অনিরাপদ এবং অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। মানুষ তখন বুঝতে পারে, এই স্বাধীনতাকে ঠিকভাবে ভোগ করতে হলে একটি সংঘবদ্ধ সমাজ এবং একটি সরকার দরকার। আর এখান থেকেই শুরু হয় লকের বিখ্যাত ‘সামাজিক চুক্তি’র ধারণা।
সম্পত্তি – শুধু টাকা বা জমি নয়, জীবনের অধিকার (The Concept of Property)
সামাজিক চুক্তিতে যাওয়ার আগে লকের দর্শনের একটা কেন্দ্রীয় স্তম্ভ আমাদের বুঝতে হবে। সেটা হলো ‘সম্পত্তি’ (Property) বিষয়ক ধারণা। আমাদের কাছে সম্পত্তি মানে সাধারণত জমি, বাড়ি বা টাকা-পয়সা। কিন্তু লকের কাছে সম্পত্তির ধারণা ছিল অনেক ব্যাপক। তিনি ‘সম্পত্তি’ বলতে বুঝিয়েছেন একজন মানুষের জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পদ (Life, Liberty, and Estate) এই সবকিছুকে। অর্থাৎ, আপনার জীবন আপনার সম্পত্তি, আপনার চিন্তা করার স্বাধীনতা আপনার সম্পত্তি, এবং আপনার অর্জিত জিনিসপত্রও আপনার সম্পত্তি। প্রকৃতির আইন আমাদের এই সামগ্রিক সম্পত্তিকে রক্ষা করার কথাই বলে।
এখন প্রশ্ন হলো, প্রকৃতির রাজ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম হয় কীভাবে? লক বলছেন, ঈশ্বর এই পৃথিবীটা সমস্ত মানবজাতিকে একসঙ্গে বা যৌথভাবে (in common) দান করেছেন। অর্থাৎ, পৃথিবীর সব জিনিস শুরুতে ছিল সবার। তাহলে কোনো একটা জিনিস কীভাবে একজনের ব্যক্তিগত হয়ে যায়?
লকের উত্তর হলো: শ্রমের মাধ্যমে (through Labor)।
এটাকে বলা হয় ‘শ্রমতত্ত্ব’ (Labor Theory of Property)। বিষয়টা খুব মজার এবং বিপ্লবী। ধরুন, একটা বনে অনেক আপেল গাছ আছে। সেই আপেলগুলো সবার। কিন্তু আপনি যখন কষ্ট করে একটি গাছ থেকে একটি আপেল পেড়ে আনলেন, তখন সেই আপেলে আপনার শ্রম মিশে গেল। যে মুহূর্তে আপনার শ্রম—যা আপনার শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ—কোনো প্রাকৃতিক বস্তুর সঙ্গে মিশে যায়, সেই মুহূর্তেই বস্তুটি আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। কারণ আপনার শ্রম আপনার একান্তই নিজের, আর তাই শ্রমের ফলও আপনার।
একইভাবে, যে জমিটা পতিত ছিল, আপনি যখন সেটা চাষ করলেন, বেড়া দিলেন, ফসল ফলালেন, তখন সেই জমি আপনার হয়ে গেল। কারণ আপনি আপনার শ্রম দিয়ে জমিটিকে সাধারণ প্রকৃতি থেকে পৃথক (distinguish) করেছেন এবং এর মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। লকের মতে, শ্রমই বস্তুর মূল্যের প্রায় সবটুকু তৈরি করে।
কিন্তু এর কি কোনো সীমা আছে? আমি কি যা খুশি তাই নিতে পারি?
না, লক দুটি গুরুত্বপূর্ণ সীমার (limitations or provisos) কথা বলেছেন, যা নিশ্চিত করে যে কেউ যেন অন্যের অধিকার হরণ না করে।
১. নষ্ট না হওয়ার সীমা (The Spoilage Limitation): আপনি ঠিক ততটুকুই প্রকৃতি থেকে নিতে পারবেন, যতটুকু আপনি নষ্ট হওয়ার আগে ব্যবহার করতে পারবেন। যদি আপনি এত ফল সংগ্রহ করেন যে তা পচে নষ্ট হয়ে যায়, তবে আপনি প্রকৃতির আইন লঙ্ঘন করলেন। কারণ যা নষ্ট হলো, তা অন্যের কাজে লাগতে পারত বা প্রকৃতির যৌথ ভাণ্ডারে থাকা উচিত ছিল।
২. অপরের জন্য যথেষ্ট রাখার সীমা (The Sufficiency Limitation): আপনি যখন কোনো কিছু ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে নেবেন, তখন খেয়াল রাখতে হবে যেন অন্যদের জন্যও ‘যথেষ্ট এবং সমান ভালো’ (enough, and as good) জিনিস অবশিষ্ট থাকে। আপনি পুরো বনটা বা নদীর সব মাছ দখল করে নিতে পারেন না, যদি তাতে অন্যদের সম্পদ আহরণের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
লকের এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সম্পত্তিতে খুব বেশি বৈষম্য হওয়ার কথা নয়। কারণ একজন মানুষ খুব বেশি জিনিস ভোগ করতে বা জমাতে পারে না, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু মানবজাতি এক অদ্ভুত বুদ্ধি বের করল। তারা এমন কিছু জিনিসকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করল যা সহজে নষ্ট হয় না—যেমন সোনা, রুপা বা অন্যান্য মুদ্রা (Money)।
টাকার আবিষ্কার পুরো খেলাটাই বদলে দিল। এখন একজন কৃষক তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফসল বিক্রি করে টাকা জমাতে পারে। টাকা তো পচে না! ফলে, নষ্ট না হওয়ার সীমাটি (spoilage limitation) আর কার্যকর থাকল না। মানুষ তার শ্রমের বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ বা টাকা জমাতে শুরু করল, যা দিয়ে সে আরও জমি কিনতে পারে, আরও মানুষকে কাজে লাগাতে পারে। এর ফলে সমাজে বিশাল অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হলো। লক মনে করতেন, মানুষ যেহেতু এই টাকার ব্যবহারে মৌনভাবে সম্মতি (tacit consent) দিয়েছে, তাই এই বৈষম্যও তারা মেনে নিয়েছে।
এই সম্পত্তির ধারণাটি লকের রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রে অবস্থিত। কারণ মানুষ সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে সরকার গঠন করে মূলত তাদের এই ব্যাপক অর্থে ‘সম্পত্তি’ (জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পদ) রক্ষা করার জন্যই।
সামাজিক চুক্তি – স্বেচ্ছায় বাঁধা পড়ার এক অদ্ভুত দলিল (The Social Contract)
আমরা দেখেছিলাম প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীনতা থাকলেও নিরাপত্তা ছিল না। মানুষ তাদের জীবন ও সম্পত্তি নিয়ে সারাক্ষণ এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করত। এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি বা সমঝোতায় (agreement) আসে। এটাই হলো ‘সামাজিক চুক্তি’ (Social Contract)।
বিষয়টা অনেকটা এরকম: পাড়ার সবাই মিলে ঠিক করল, ‘ভাই, আমরা আর নিজেরা মারামারি করে চোরের বিচার করব না। এতে শত্রুতা বাড়ে। চলুন, আমরা সবাই মিলে একটি কমিটি গঠন করি এবং একজন পাহারাদার নিয়োগ করি। আমাদের সবার পক্ষ থেকে কমিটি আইনকানুন তৈরি করবে আর পাহারাদার সেই আইন প্রয়োগ করবে, চোর ধরবে এবং বিচার করবে। বিনিময়ে আমরা সবাই তাকে বেতন দেব এবং তার কথা মেনে চলব।’
লকের সামাজিক চুক্তিও ঠিক এমনই। প্রকৃতির রাজ্যের স্বাধীন মানুষগুলো স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়ে একটি রাজনৈতিক সমাজ (political society) বা রাষ্ট্র (commonwealth) গঠন করে। এই চুক্তির মাধ্যমে তারা তাদের দুটি প্রাকৃতিক অধিকার ছেড়ে দেয়:
১. প্রকৃতির আইন নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করার এবং নিজের জীবন পরিচালনার অধিকার।
২. প্রকৃতির আইন ভঙ্গকারীর বিচার বা শাস্তি দেওয়ার অধিকার (the power of punishing)।
এই অধিকার দুটো তারা সমাজের বা সরকারের হাতে তুলে দেয়। বিনিময়ে সরকার তাদের জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি রক্ষা করার মহান দায়িত্ব নেয়। সরকার গঠিত হয় একটি ‘আস্থা’ বা ‘ট্রাস্ট’ (Trust) হিসেবে। জনগণ হলো ট্রাস্টের মালিক বা দাতা (trustor), আর সরকার হলো ট্রাস্টি (trustee)।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি হলো ‘সম্মতি’ (Consent)। লকের মতে, কোনো সরকারই বৈধ (legitimate) হতে পারে না, যদি তা শাসিতের সম্মতির (Consent of the Governed) ওপর ভিত্তি করে গড়ে না ওঠে। জোর করে কারও ওপর শাসন চাপিয়ে দেওয়া যায় না। কারণ মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন ছিল, সে স্বেচ্ছায় তার স্বাধীনতা কিছুটা বিসর্জন দিয়েছে শুধু বৃহত্তর নিরাপত্তার জন্য। সে দাস হওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়নি। নিখুঁত কিন্তু অনিরাপদ স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে সে সুরক্ষিত স্বাধীনতা পেতে চেয়েছে।
তাহলে কি সবার সম্মতি লাগে?
লক বলছেন, একটি রাষ্ট্র গঠনের শুরুতে সর্বসম্মত (unanimous) সম্মতি প্রয়োজন। কারণ কাউকে জোর করে রাজনৈতিক সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কিন্তু একবার রাষ্ট্র গঠিত হয়ে গেলে, এরপর থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তই (will of the majority) সবার ওপর বর্তাবে। কারণ সবাইকে সবসময় একমত করা অসম্ভব। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন না মানা হয়, তবে সমাজ আবার ভেঙে প্রকৃতির রাজ্যে ফিরে যাবে।
এখানে একটা প্রশ্ন আসে। আমরা তো কেউ এই ধরনের চুক্তিতে সই করে জন্মাইনি। তাহলে আমরা কেন আমাদের দেশের সরকারকে মানতে বাধ্য?
এর উত্তরে লক দুই ধরনের সম্মতির কথা বলেছেন:
-
প্রত্যক্ষ সম্মতি (Express Consent): যখন কোনো ব্যক্তি স্পষ্টভাবে, কথা বা লেখার মাধ্যমে কোনো রাষ্ট্রের আইন মেনে চলার শপথ নেয়। যেমন, অন্য দেশ থেকে এসে নাগরিকত্ব নেওয়ার সময় যে শপথ নেওয়া হয়, বা কোনো সরকারি পদে যোগ দেওয়ার সময় যে শপথ নেওয়া হয়।
-
পরোক্ষ বা মৌন সম্মতি (Tacit Consent): যখন কোনো ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে বসবাস করে, তার রাস্তাঘাট ব্যবহার করে, বা তার ভূখণ্ডের কোনো অংশ ভোগ করে, তখন ধরে নেওয়া হয় যে সে মৌনভাবে বা নীরবে সেই রাষ্ট্রের আইন মেনে চলার সম্মতি দিয়েছে। আপনি যতক্ষণ একটি দেশের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, ততক্ষণ আপনি তার আইন মানতে বাধ্য। তবে এই সম্মতি শর্তসাপেক্ষ। আপনি যদি সেই দেশ ত্যাগ করেন, তবে আপনার এই মৌন সম্মতিও শেষ হয়ে যায়। যদিও সমালোচকরা বলেন, একজন দরিদ্র মানুষের পক্ষে দেশ ত্যাগ করা প্রায় অসম্ভব, তাই এই মৌন সম্মতি আসলে বাধ্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই সম্মতির ধারণাটি ছিল বিপ্লবী। কারণ এটি রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের তত্ত্বকে শুধু বাতিলই করেনি, ক্ষমতার উৎসকে স্বর্গ থেকে নামিয়ে এনে একেবারে জনগণের হাতে স্থাপন করেছে। জনগণই সার্বভৌম (sovereign)।
সরকারের সীমানা – ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরার কৌশল (The Limits of Government)
জনগণ সরকার তৈরি করেছে তাদের পাহারাদার হিসেবে, প্রভু হিসেবে নয়। তাই সরকারের ক্ষমতা কখনোই নিরঙ্কুশ (absolute) বা স্বেচ্ছাচারী (arbitrary) হতে পারে না। সরকার হলো জনগণের একজন ‘ট্রাস্টি’। যদি সরকার সেই আমানতের খেয়ানত করে, তবে জনগণ তাকে বরখাস্ত করার অধিকার রাখে।
লক সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত রাখার জন্য কয়েকটি পদ্ধতির কথা বলেছেন, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ (Separation of Powers) এবং আইনের শাসন (Rule of Law)।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: লক সরকারকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করার কথা বলেন:
১. আইনমূলক ক্ষমতা (Legislative Power): এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা (supreme power)। এর কাজ হলো সমাজের জন্য সর্বজনীন আইন তৈরি করা। তবে এই ক্ষমতাও সীমাহীন নয়। আইনগুলোকে হতে হবে সুস্পষ্ট, সবার জন্য সমান (ধনী-গরিব নির্বিশেষে) এবং জনগণের মঙ্গল (public good) সাধনই হবে এর একমাত্র উদ্দেশ্য। এই ক্ষমতা সাধারণত একটি সংসদ বা অ্যাসেম্বলির হাতে থাকে, যা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত।
২. নির্বাহী ক্ষমতা (Executive Power): এর কাজ হলো সংসদে তৈরি হওয়া আইনগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ এবং কার্যকর করা। যেহেতু আইন সবসময় কার্যকর রাখতে হয়, তাই নির্বাহী বিভাগকে সার্বক্ষণিক (always in being) থাকতে হয়। এই ক্ষমতা সাধারণত রাজা বা সরকারের প্রধানের হাতে থাকে।
৩. ফেডারেটিভ ক্ষমতা (Federative Power): এই ক্ষমতার দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা—যেমন, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ, শান্তি বা চুক্তি করা। অর্থাৎ, এটি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে। লক এই ক্ষমতাকেও নির্বাহীর হাতেই রাখতে চেয়েছেন, কারণ দুটিই রাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের সঙ্গে জড়িত।
(এখানে উল্লেখ্য যে, লকের মডেলে বিচার বিভাগের (Judicial Power) কথা আলাদাভাবে বলা নেই, যা আমরা আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দেখি। তিনি বিচারিক কাজকে নির্বাহী বিভাগের অংশ হিসেবেই দেখেছেন। ফরাসি দার্শনিক মঁতেস্কু (Montesquieu) পরবর্তীতে লকের এই ধারণাকে আরও বিকশিত করে আইন, নির্বাহী এবং বিচার—এই তিনটি বিভাগের সুস্পষ্ট বিভাজনের তত্ত্ব দেন)।
লকের মতে, আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ দুটি ভিন্ন হাতে থাকা জরুরি। কারণ একই ব্যক্তি বা সংস্থা যদি আইন তৈরি করে এবং তা প্রয়োগ করে, তবে তাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়বে এবং তারা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করবে।
আইনের শাসন: লকের তত্ত্বের আরেকটি ভিত্তিপ্রস্তর হলো আইনের শাসন। এর অর্থ হলো, সরকার যা খুশি তাই করতে পারবে না। সরকারকেও তার নিজের তৈরি করা আইন মেনে চলতে হবে। আইন সবার জন্য সমান। রাজা বা শাসক কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। স্বেচ্ছাচারী ডিক্রি বা হুকুম দিয়ে শাসন করা যাবে না, শাসন করতে হবে প্রতিষ্ঠিত এবং ঘোষিত আইনের মাধ্যমে।
এছাড়া, সরকারের ক্ষমতার আরও একটি বড় সীমা হলো সম্পত্তি। সরকার জনগণের সম্পত্তি তাদের সম্মতি ছাড়া কেড়ে নিতে পারবে না। এর একটি আধুনিক উদাহরণ হলো করারোপ (taxation)। লক মনে করতেন, সরকার জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্যই তৈরি হয়েছে। তাই তাদের সম্পত্তি (টাকা) নিতে হলে তাদের বা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের (অর্থাৎ, সংসদের) সম্মতি লাগবে। এই ধারণাটিই পরবর্তীতে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম স্লোগান হয়ে ওঠে: “No taxation without representation” (প্রতিনিধিত্ব ছাড়া করারোপ নয়)।
বিপ্লবের অধিকার – স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শেষ অস্ত্র (The Right to Revolution)
লকের রাষ্ট্রচিন্তার সবচেয়ে র্যাডিকাল এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত অংশ হলো ‘বিপ্লবের অধিকার’ (Right to Revolution)।
প্রশ্ন হলো, সরকার যদি চুক্তি ভঙ্গ করে? যদি সে জনগণের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষা না করে উল্টো সেগুলো কেড়ে নিতে শুরু করে? যদি সে ট্রাস্টি থেকে স্বৈরাচারী (tyrant) হয়ে ওঠে? তখন কী হবে?
লকের উত্তর দ্ব্যর্থহীন এবং সাহসী: জনগণ সেই সরকারকে ভেঙে ফেলার বা উৎখাত করার অধিকার রাখে।
যখন সরকার বা শাসক জনগণের সঙ্গে করা চুক্তি বা ট্রাস্ট (trust) ভঙ্গ করে, তখন শাসক এবং জনগণের মধ্যে একটি যুদ্ধাবস্থা (state of war) তৈরি হয়। সরকার তখন আর বৈধ সরকার থাকে না, সে পরিণত হয় একজন আগ্রাসনকারীতে। এই অবস্থায় জনগণ প্রকৃতির রাজ্যে ফিরে যায় না, বরং সমাজ অটুট থাকে। শুধু সরকার বিলুপ্ত (dissolved) হয়। তখন জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করে সেই স্বৈরাচারী সরকারকে সরিয়ে একটি নতুন সরকার গঠন করার অধিকার পায়।
লক খুব পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এটা ছোটখাটো কোনো সরকারি ভুলের জন্য প্রযোজ্য নয়। সামান্য অব্যবস্থাপনা বা দু-একটি ভুল আইনের জন্য জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। মানুষ স্বভাবগতভাবেই স্থিতিশীলতা পছন্দ করে। কিন্তু যখন শাসকের পক্ষ থেকে একটি “দীর্ঘ ধারাবাহিক নির্যাতন, ছলচাতুরি এবং কৌশলের” (a long train of abuses, prevarications and artifices) মাধ্যমে স্বৈরাচারী হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নকশা দেখা যায়, যখন জনগণের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয় বা তাদের দাসে পরিণত করার ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন জনগণের ঘুম ভাঙে এবং তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
কে বিচার করবে যে সরকার চুক্তি ভঙ্গ করেছে কি না?
এই প্রশ্নের উত্তরে লক বলেন, এর বিচারক স্বয়ং জনগণ (the people shall be judge)। কারণ জনগণই সরকারকে এই ক্ষমতা দিয়েছিল, তারাই বিচার করবে তাদের দেওয়া আমানতের সদ্ব্যবহার হচ্ছে কি না। চূড়ান্ত ক্ষমতার মালিক জনগণই। ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কখন তরবারি হাতে তুলে নেওয়ার সময় হয়েছে।
এই ধারণাটি ছিল তখনকার রাজতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাতের মতো। এটি আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতাদের (Founding Fathers) ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। টমাস জেফারসন যখন আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (Declaration of Independence) লেখেন, তখন তিনি প্রায় সরাসরি লকের ভাষা ব্যবহার করেন। তিনি লেখেন, সরকার মানুষের কিছু অবিচ্ছেদ্য অধিকার (unalienable Rights) রক্ষার জন্য গঠিত হয়, যার মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের অন্বেষণ (Life, Liberty and the pursuit of Happiness)। আর যখন কোনো সরকার এই উদ্দেশ্যগুলো ধ্বংস করতে চায়, তখন সেই সরকারকে পরিবর্তন বা বিলুপ্ত করার অধিকার জনগণের রয়েছে।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা – রাষ্ট্র এবং উপাসনালয়ের দেয়াল (Religious Toleration)
লক শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বলেননি, তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতারও একজন বড় প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর সময়ে ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে সংঘাত ছিল তীব্র। রাষ্ট্র ঠিক করে দিত প্রজারা কোন ধর্ম পালন করবে। যারা ভিন্নমত পোষণ করত, তাদের ওপর চলত নির্যাতন। লক এর তীব্র বিরোধিতা করেন তাঁর বিখ্যাত লেখা A Letter Concerning Toleration (সহিষ্ণুতা বিষয়ে একটি পত্র)-এ।
লকের যুক্তি ছিল খুব সহজ ও স্পষ্ট, যা আজও প্রাসঙ্গিক:
১. রাষ্ট্র ও গির্জার কাজ ভিন্ন: সরকারের কাজ হলো মানুষের জাগতিক বিষয়গুলো (civil interests)—জীবন, স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য, সম্পত্তি—রক্ষা করা। একজন মানুষের আত্মার মুক্তি (salvation of souls) সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সরকার বন্দুকের নল ঠেকিয়ে কাউকে ধার্মিক বানাতে পারে না, কারণ বিশ্বাস মনের ভেতর থেকে আসে, জোর করে তৈরি করা যায় না। জোর করে ধর্ম পালন করানোটা ভণ্ডামির জন্ম দেয়, সত্যিকারের বিশ্বাসের নয়।
২. গির্জা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন: গির্জা বা যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হলো একটি স্বেচ্ছাসেবী সমাজ (voluntary society)। মানুষ স্বেচ্ছায় সেখানে যোগ দেয় ঈশ্বরের উপাসনা এবং আত্মার শান্তির জন্য। রাষ্ট্রের উচিত নয় কোনো বিশেষ গির্জার পক্ষ নেওয়া বা অন্য কোনো গির্জার ওপর অত্যাচার করা।
এভাবেই লক রাষ্ট্র এবং গির্জার মধ্যে একটি সুস্পষ্ট বিভাজনের (separation of Church and State) কথা বলেন, যা আধুনিক সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি।
তবে লকের সহিষ্ণুতারও একটি সীমা ছিল। তিনি দুটি গোষ্ঠীকে এই ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না:
-
ক্যাথলিক (Catholics): এর কারণ ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক। তিনি মনে করতেন, ক্যাথলিকরা রোমের পোপের প্রতি অনুগত। পোপ যেহেতু একজন বিদেশী শাসক, তাই ক্যাথলিকদের আনুগত্য নিজ দেশের প্রতি নয়, বরং একজন বিদেশী শক্তির প্রতি। এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
-
নাস্তিক (Atheists): কারণ লক মনে করতেন, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তারা কোনো শপথ, চুক্তি বা নৈতিকতার বন্ধনে আবদ্ধ নয়। তাদের কাছে প্রতিজ্ঞার কোনো মূল্য নেই। তাই তাদের বিশ্বাস করা যায় না এবং তারা সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ লকের পুরো ব্যবস্থাটিই প্রকৃতির আইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যার উৎস হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বরকে অস্বীকার করলে এই নৈতিক ভিত্তিই ধসে পড়ে।
এই সীমাবদ্ধতাগুলো থেকে বোঝা যায়, লক নিজেও তাঁর সময়ের বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তবুও, তাঁর ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ধারণাটি ছিল তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর এবং সাহসী।
লকের প্রভাব, সমালোচনা এবং আজকের দিনে প্রাসঙ্গিকতা
জন লকের চিন্তাভাবনা পশ্চিমা বিশ্বে, এবং ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে, এক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে গেছে। তাঁকে উদারতাবাদের জনক (Father of Liberalism) বলা হয়। তাঁর সম্মতি, প্রাকৃতিক অধিকার এবং সীমিত সরকারের ধারণা আমেরিকার সংবিধান, ফরাসি বিপ্লবের ‘মানুষ ও নাগরিকের অধিকারের ঘোষণা’ (Declaration of the Rights of Man and of the Citizen) এবং বিশ্বের প্রায় সমস্ত গণতান্ত্রিক সংবিধানকে প্রভাবিত করেছে। ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে যে রাষ্ট্রের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া যায়, এই ধারণাটিই ছিল লকের সবচেয়ে বড় অবদান।
কিন্তু লকের দর্শন সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। অনেক আধুনিক তাত্ত্বিক তাঁর দর্শনের কিছু গুরুতর দুর্বলতা তুলে ধরেছেন:
-
সম্পত্তির ধারণা ও ঔপনিবেশিকতা: সমালোচকরা, যেমন বারবারা আর্নিল (Barbara Arneil), বলেন, লকের শ্রম দিয়ে সম্পত্তি তৈরির তত্ত্বটি আমেরিকার আদিবাসী মানুষদের জমি থেকে উচ্ছেদ করাকে এক ধরনের দার্শনিক বৈধতা দিয়েছিল। ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীরা দাবি করত যে, আদিবাসীরা যেহেতু জমিকে ‘সঠিকভাবে’ চাষ করছে না (অর্থাৎ, ইউরোপীয়দের মতো করে শ্রম মেশাচ্ছে না), তাই সেই জমি আসলে ‘পতিত’ বা ‘বর্জ্য’ (waste land) এবং যে কেউ শ্রম দিয়ে তা দখল করতে পারে। এভাবে লকের তত্ত্ব ঔপনিবেশিকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এমনকি লক নিজে ক্যারোলিনা উপনিবেশের সংবিধান রচনায় সাহায্য করেছিলেন এবং রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির একজন শেয়ারহোল্ডার ছিলেন, যা দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এটি তাঁর স্বাধীনতার দর্শনের সঙ্গে এক বিরাট স্ববিরোধিতা তৈরি করে।
-
ধনী শ্রেণীর দর্শন: কানাডিয়ান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সি. বি. ম্যাকফারসন (C.B. Macpherson) যুক্তি দেন যে, লকের দর্শন মূলত উদীয়মান বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়েছিল। তাঁর ‘সম্পত্তি’-র ধারণা শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের চেয়ে সম্পদশালী মালিকদেরই বেশি সুবিধা দেয়। টাকার আবিষ্কারের মাধ্যমে যে অসীম সম্পদ আহরণকে তিনি বৈধতা দিয়েছেন, তা পুঁজিবাদী সমাজে বৈষম্যকে স্বাভাবিক করে তোলে। ম্যাকফারসন এই চিন্তাকে ‘স্বত্বাধিকারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ (possessive individualism) বলে অভিহিত করেছেন, যেখানে ব্যক্তিকে তার নিজের সত্তা এবং শ্রমের একমাত্র মালিক হিসেবে দেখা হয়, সমাজের প্রতি তার কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।
-
নারীর অনুপস্থিতি: নারীবাদী সমালোচকরা, যেমন ক্যারল পেটম্যান (Carole Pateman), দেখিয়েছেন যে লকের ‘সামাজিক চুক্তি’ আসলে একটি ‘যৌন চুক্তি’ (Sexual Contract)-ও বটে। তাঁর লেখায় ‘ব্যক্তি’ (individual) বলতে মূলত পুরুষদেরই বোঝানো হয়েছে, যারা পরিবারের প্রধান। নারীরা এই চুক্তির অংশীদার নয়, বরং তারা পারিবারিক পরিসরে পুরুষের অধীনস্থ। অর্থাৎ, নাগরিক সমাজ গঠনের আগেই পিতৃতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, যা রাষ্ট্র দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। লকের জগতে নারীরা রাজনৈতিক কর্তা নয়, বরং রাজনৈতিক কর্তাদের অধীনস্থ।
-
মৌন সম্মতির দুর্বলতা: ‘মৌন সম্মতি’র ধারণাটি কি খুব শক্তিশালী? একজন দরিদ্র মানুষ, যার দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই, সে কি সত্যিই একটি দেশের আইন মেনে চলার জন্য ‘সম্মতি’ দেয়? নাকি সে বাধ্য হয়ে মেনে নেয়? এই ধারণাটি সরকারের প্রতি আনুগত্যকে প্রায় স্বয়ংক্রিয় করে তোলে এবং প্রতিবাদের নৈতিক জোরকে দুর্বল করে দেয়।
আজকের দিনে প্রাসঙ্গিকতা ও শেষ কথা
এত সমালোচনা সত্ত্বেও, জন লক আজও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। আজকের দিনেও আমরা সরকারের ক্ষমতা কমানো বা বাড়ানোর বিতর্ক করি। আমরা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (privacy), যা এক ধরনের সম্পত্তি, তা রক্ষার জন্য লড়াই করি। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যখন কোনো দেশের মানুষ রাস্তায় নামে, তখন তারা প্রকারান্তরে লকের ‘বিপ্লবের অধিকার’কেই ব্যবহার করে। ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল সম্পদের যুগে, ‘শ্রম’ এবং ‘সম্পত্তি’র ধারণা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আমাদের ডিজিটাল শ্রমের (digital labor) ফল কার মালিকানায় থাকবে—আমাদের, নাকি বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর? এই প্রশ্নগুলোও লকের তত্ত্বের নতুন পাঠ দাবি করে।
জন লকের পৃথিবী থেকে আমরা কয়েকশ বছর দূরে চলে এসেছি। আমাদের পৃথিবী অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি কোলাহলপূর্ণ। কিন্তু কিছু মৌলিক প্রশ্ন রয়ে গেছে আগের মতোই। স্বাধীনতা এবং শৃঙ্খলার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য কোথায়? একজন ব্যক্তির অধিকারের সীমা কতটুকু? একটি সরকার ঠিক কতটা ক্ষমতা জনগণের ওপর প্রয়োগ করতে পারে? আর কখন একটি সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা শুধু অধিকার নয়, দায়িত্ব হয়ে ওঠে?
জন লক এই প্রশ্নগুলোর যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা হয়তো নিখুঁত নয়। তাঁর দর্শনে তাঁর নিজের সময়ের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তিনি আমাদের একটি পথ দেখিয়েছিলেন। তিনি আমাদের একটি কম্পাস দিয়ে গেছেন, যা দিয়ে আমরা ক্ষমতার গোলকধাঁধায় নিজেদের পথ খুঁজে নিতে পারি। তিনি শিখিয়েছেন যে, রাষ্ট্র কোনো ঐশ্বরিক বা রহস্যময় প্রতিষ্ঠান নয়, এটি মানুষের প্রয়োজনে মানুষের তৈরি একটি হাতিয়ার। আর যেকোনো হাতিয়ারের মতো, এটিকেও সাবধানে ব্যবহার করতে হয়। এর লাগাম সবসময় জনগণের হাতেই থাকা উচিত।
লকের দর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা কোনো সস্তা জিনিস নয়। একে অর্জন করতে হয়, এবং ক্রমাগত পাহারা দিয়ে রক্ষা করতে হয়—কখনো সরকারের কাছ থেকে, কখনো বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার থেকে। এই পাহারা দেওয়ার কাজটিই হলো গণতন্ত্রের মূল চেতনা। আর সেই চেতনার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন এই চিকিৎসক-দার্শনিক—জন লক। তাঁর সেই অদ্ভুত চুক্তিপত্রের গল্প তাই আজও ফুরোয়নি, বরং নতুন নতুন রূপে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে প্রতিদিন, পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে, যেখানেই মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে।
তথ্যসূত্র
- Ashcraft, R. (1986). Revolutionary Politics and Locke’s Two Treatises of Government. Princeton University Press.
- Arneil, B. (1996). John Locke and America: The Defence of English Colonialism. Oxford University Press.
- Dunn, J. (1969). The Political Thought of John Locke: An Historical Account of the Argument of the ‘Two Treatises of Government’. Cambridge University Press.
- Filmer, R. (1680). Patriarcha; or, The Natural Power of Kings. (Modern editions are available, e.g., in Patriarcha and Other Writings, edited by J.P. Sommerville, Cambridge University Press, 1991).
- Hobbes, T. (1651). Leviathan. (Any modern edition, for instance, edited by C.B. Macpherson, Penguin Classics, 1985).
- Laslett, P. (1988). Introduction. In J. Locke, Two Treatises of Government (pp. 3-133). Cambridge University Press.
- Locke, J. (1689). Two Treatises of Government. (The critical edition by Peter Laslett, Cambridge University Press, 1988, is the standard scholarly text).
- Locke, J. (1689). A Letter Concerning Toleration. (Various modern editions available, for instance, edited by James H. Tully, Hackett Publishing, 1983).
- Locke, J. (1690). An Essay Concerning Human Understanding. (The edition by P. H. Nidditch, Oxford University Press, 1975, is widely cited).
- Macpherson, C. B. (1962). The Political Theory of Possessive Individualism: Hobbes to Locke. Oxford University Press.
- Pateman, C. (1988). The Sexual Contract. Stanford University Press.
- Tuck, R. (1999). The Rights of War and Peace: Political Thought and the International Order from Grotius to Kant. Oxford University Press.
- Waldron, J. (2002). God, Locke, and Equality: Christian Foundations of John Locke’s Political Thought. Cambridge University Press.
Leave a Reply