জন লক: যে দার্শনিক আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন

Table of Contents

ভূমিকা

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু মানুষ আসেন, যাঁরা আমাদের চিন্তার জগতে একটা তোলপাড় করে দিয়ে যান। তাঁরা আমাদের হাতে ধরিয়ে দেন নতুন এক চশমা, যা দিয়ে আমরা পরিচিত পৃথিবীটাকে একদম নতুন করে দেখতে শিখি। জন লক ছিলেন ঠিক তেমনই একজন। নামটা শুনলেই গুরুগম্ভীর, কঠিন তত্ত্বের কথা মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে, তাঁর কথাগুলো ছিল মাটি থেকে উঠে আসা মানুষের জন্য, সাধারণ জীবনের সহজ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য। তাঁর দর্শন কোনো বিচ্ছিন্ন একাডেমিক অনুশীলন ছিল না; এটি ছিল তাঁর সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া এবং একটি নতুন, আরও যৌক্তিক ও মানবিক সমাজ গঠনের এক আন্তরিক প্রচেষ্টা।

আমাদের জ্ঞান কোথা থেকে আসে? একটা শিশু যখন জন্মায়, তখন তার মনটা ঠিক কেমন থাকে? সরকার কেন দরকার? আমাদের অধিকারই বা কী এবং তার উৎস কোথায়? এই প্রশ্নগুলো তো আমাদের সবার। লক এই প্রশ্নগুলোকেই তাঁর দর্শনের কেন্দ্রে রেখেছিলেন। তিনি এমনভাবে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন, যা কোনো রাজপ্রাসাদের জটিল দর্শন নয়, বরং যেন আমাদের বৈঠকখানায় বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে করা এক সহজ আলাপ। তিনি আমাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন যে দর্শন কোনো বিশেষ শ্রেণীর মানুষের জন্য নয়, বরং যুক্তিবোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের নাগালের মধ্যেই এর অবস্থান।

চলুন, আজ আমরা সেই আলাপে যোগ দিই। কোনো জটিল তত্ত্বের কচকচানি নয়, বরং গল্পের মতো করে তাঁর চিন্তার জগতে ডুব দেব। আমরা বোঝার চেষ্টা করব, কীভাবে তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব তাঁর রাজনৈতিক দর্শনকে ভিত্তি দিয়েছিল, কীভাবে তাঁর ধর্মীয় সহনশীলতার ধারণা তাঁর সীমিত সরকারের তত্ত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এবং কীভাবে এই সমস্ত চিন্তার বুনন মিলেমিশে এক আধুনিক, উদারনৈতিক বিশ্ববীক্ষার জন্ম দিয়েছিল। এমনভাবে, যেন এই অসাধারণ মানুষটি আমাদের পাশেই বসে আছেন আর বলছেন—ভাবুন তো, আপনার মাথার ভেতরের এই যে এত চিন্তা, এত স্মৃতি, এত ধারণা, এর শুরুটা ঠিক কোথায়?

যে ঝড়ের দিনে জন্মাল নতুন ভাবনা: জন লকের পেছনের গল্প

লকের দর্শন আকাশ থেকে পড়া কোনো ঐশী বাণী নয়, বরং তাঁর সময়কার উত্তাল ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক সংঘাত আর তার আগের দার্শনিকদের সঙ্গে এক নিরন্তর বিতর্কের ফসল। ব্যাপারটা বুঝতে হলে আমাদের একটু সময় ভ্রমণ করতে হবে। চলুন ফিরে যাই সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে। একটা অদ্ভুত সময়। একদিকে কুয়াশা, অন্যদিকে বারুদের গন্ধ। একদিকে শেক্সপিয়রের কবিতা, অন্যদিকে গৃহযুদ্ধের দামামা। এই গোলমেলে সময়ের ক্যানভাসেই আঁকা হয়েছিল লকের চিন্তার ছবি। চলুন আপাতত সেই দর্শনের পেছনের গল্প নিয়ে জানা যাক। কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে ভাবতে বাধ্য করেছিল? কোন দার্শনিকদের সঙ্গে তিনি মনে মনে ঝগড়া করেছিলেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না জানলে লকের আসল উদ্দেশ্যটা ঠিকমতো ধরা যায় না।

এক অগ্নিগর্ভ সময়: যখন রাজার মাথা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে

জন লক জন্মেছিলেন ১৬৩২ সালে, ইংল্যান্ডের এক ছোট্ট গ্রাম রিংটনে। তাঁর সময়কার ইংল্যান্ড ছিল আজকের শান্ত, সাজানো-গোছানো ইংল্যান্ড নয়। সেটা ছিল এক অগ্নিগর্ভ সময়। একদিকে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা, যাকে বলা হতো ‘রাজাদের ঐশ্বরিক অধিকার’ (Divine Right of Kings), অন্যদিকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি সংসদ বা পার্লামেন্টের ক্রমবর্ধমান অধিকারের আকাঙ্ক্ষা—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে পুরো দেশ তখন উত্তাল।

লকের জন্মের মাত্র দশ বছরের মাথায়, ১৬৪২ সালে, শুরু হয় ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধ (English Civil War)। এই যুদ্ধ ছিল কেবল ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি ছিল দুটি ভিন্ন বিশ্ববীক্ষার সংঘাত। একদিকে ছিলেন রাজতন্ত্রীরা (Royalists), যাঁরা বিশ্বাস করতেন রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং তাঁর ক্ষমতা প্রশ্নাতীত। অন্যদিকে ছিলেন সাংসদ বা পার্লামেন্টারিয়ানরা (Parliamentarians), যাঁরা মনে করতেন রাজার ক্ষমতা জনগণের সম্মতি এবং দেশের আইনের অধীন। প্রায় এক দশক ধরে চলা এই রক্তাক্ত সংঘাতের শেষে ঘটল এক অকল্পনীয় ঘটনা। ১৬৪৯ সালে রাজা প্রথম চার্লসকে প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ করা হলো।

একটু থামুন। ব্যাপারটা ভাবুন তো। দেশের মানুষ তাদের রাজাকে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে! এর আগে ইউরোপের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। এই একটা ঘটনাই ‘রাজার ঐশ্বরিক অধিকার’ তত্ত্বের কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিল। এর মানে দাঁড়াল, রাজা কোনো অতিমানব নন। তিনিও ভুলের ঊর্ধ্বে নন এবং জনগণের কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হতে পারে। এই ঘটনা লকের মতো তরুণ চিন্তাবিদদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল (Hill, 1961)। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, ক্ষমতার উৎস নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

এরপর অলিভার ক্রমওয়েলের নেতৃত্বে কিছুদিন এক ধরনের প্রজাতন্ত্র (Commonwealth) চলল, কিন্তু সেটাও টিকল না। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ডে অরাজকতা দেখা দেয় এবং ১৬৬০ সালে আবার রাজতন্ত্র ফিরে আসে (The Restoration)। কিন্তু ভেতরের দ্বন্দ্বটা রয়েই গেল। এই সময়ে লকের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিল দুটি ঘটনা: এক্সক্লুশন ক্রাইসিস (Exclusion Crisis) এবং ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লব (Glorious Revolution)। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের কোনো বৈধ সন্তান না থাকায় তাঁর ভাই জেমস, যিনি ছিলেন একজন কট্টর ক্যাথলিক, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হন। প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডে একজন ক্যাথলিক রাজার শাসন মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। তাই জেমসকে সিংহাসন থেকে বাদ দেওয়ার জন্য পার্লামেন্টে তীব্র চেষ্টা চলে, যা এক্সক্লুশন ক্রাইসিস নামে পরিচিত। লকের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক, প্রভাবশালী হুইগ নেতা লর্ড শ্যাফটসবারি ছিলেন এই আন্দোলনের সামনের সারিতে। এই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার পর শ্যাফটসবারিকে দেশ ছাড়তে হয় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত লককেও প্রাণের ভয়ে ১৬৮৩ সালে নেদারল্যান্ডসে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। এই নির্বাসিত জীবনেই তিনি তাঁর বিখ্যাত দুটি বই—”An Essay Concerning Human Understanding” এবং “Two Treatises of Government”—লেখার কাজ অনেকটাই এগিয়ে নেন (Ashcraft, 1986)। এই সময়েই লককে সরাসরি স্যার রবার্ট ফিলমারের (Sir Robert Filmer) দর্শনের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। ফিলমার তাঁর “Patriarcha” গ্রন্থে যুক্তি দিয়েছিলেন যে রাজার ক্ষমতা ঈশ্বরপ্রদত্ত এবং এটি আদম থেকে শুরু করে বংশপরম্পরায় চলে আসছে, ঠিক যেমন বাবা তাঁর সন্তানদের ওপর স্বাভাবিক কর্তৃত্ব রাখেন। লকের “Two Treatises of Government”-এর প্রথম গ্রন্থটি ছিল ফিলমারের এই পিতৃতান্ত্রিক এবং ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বের এক বিস্তারিত ও ধারালো খণ্ডন।

এরপর ১৬৮৮ সালে ঘটে সেই বিখ্যাত গৌরবময় বিপ্লব (Glorious Revolution)। রক্তপাত ছাড়াই ইংল্যান্ডের জনগণ স্বৈরাচারী ক্যাথলিক রাজা দ্বিতীয় জেমসকে সরিয়ে দেয় এবং তাঁর প্রোটেস্ট্যান্ট কন্যা মেরি ও তাঁর স্বামী উইলিয়াম অফ অরেঞ্জকে যৌথভাবে সিংহাসনে বসায়। তবে একটা শর্তে। নতুন রাজা ও রানিকে একটি ‘অধিকারের বিল’ (Bill of Rights, 1689) মেনে নিতে হলো, যা পরিষ্কার করে দিল যে রাজার ক্ষমতা পার্লামেন্ট এবং আইনের অধীন। এই বিল পার্লামেন্টের ক্ষমতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে, নিয়মিত পার্লামেন্ট অধিবেশন নিশ্চিত করে, রাজার কর আরোপের ক্ষমতা সীমিত করে এবং নাগরিকদের অধিকারকে (যেমন, অবাধে কথা বলার অধিকার) স্বীকৃতি দেয়। এই বিপ্লব ইংল্যান্ডে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের (Constitutional Monarchy) ভিত্তি স্থাপন করে।

লক এই বিপ্লবের একজন অন্যতম বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থক ছিলেন। তিনি ১৬৮৯ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং তাঁর বিখ্যাত বইগুলো প্রকাশ করেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল এই বিপ্লবেরই এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ইশতেহার বা দার্শনিক প্রতিধ্বনি। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন, এই বিপ্লব কোনো অবৈধ বিদ্রোহ ছিল না, বরং চুক্তি ভঙ্গকারী স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের ন্যায্য প্রতিরোধ (Ashcraft, 1986; Aaron, 1971)।

তাহলে দেখুন, লকের রাজনৈতিক দর্শনের শেকড় লুকিয়ে আছে তাঁর নিজের দেশের মাটিতে। গৃহযুদ্ধ, রাজার শিরশ্ছেদ, স্বৈরাচারের প্রচেষ্টা এবং সবশেষে একটি সফল বিপ্লব—এই ঘটনাগুলোই তাঁকে শিখিয়েছিল যে সরকারের ক্ষমতা জনগণের সম্মতি (Consent of the Governed) ছাড়া বৈধ হতে পারে না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ক্ষমতার উৎস কোনো ঐশ্বরিক অধিকার নয়, বরং জনগণ। সরকারের কাজ প্রজাদের ওপর খোদায়ি কর্তৃত্ব করা নয়, তাদের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি রক্ষা করা। এই উত্তাল সময়ের ক্যানভাসেই তিনি এঁকেছিলেন তাঁর যুগান্তকারী দর্শনের ছবি।

দার্শনিকদের যুদ্ধ: কার সঙ্গে লড়ছিলেন লক?

লক শুধু তলোয়ার বা বন্দুকের যুদ্ধ দেখেননি, তিনি নিজেও একটি কলমের যুদ্ধ লড়েছিলেন। তাঁর সময়ে বা তার ঠিক আগে দুজন প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন, যাঁদের চিন্তাকে মোকাবেলা না করে লকের পক্ষে নিজের তত্ত্ব দাঁড় করানো সম্ভব ছিল না। এই দুজন হলেন স্যার রবার্ট ফিলমার এবং টমাস হব্‌স

স্যার রবার্ট ফিলমার: রাজা বনাম বাবা

স্যার রবার্ট ফিলমার ছিলেন রাজতন্ত্রের এক কট্টর সমর্থক। তাঁর বিখ্যাত বই ‘প্যাট্রিয়ার্কা’ (Patriarcha)-তে তিনি এক অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ঈশ্বর প্রথম মানুষ আদমকে সৃষ্টি করে তাঁকে তাঁর সন্তানদের ওপর শাসন করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। এই ক্ষমতা অ্যাডাম থেকে তাঁর বংশধরদের হাত ঘুরে বর্তমান রাজাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, রাজার ক্ষমতা অনেকটা পরিবারের বাবার ক্ষমতার মতো—স্বাভাবিক, ঐশ্বরিক এবং প্রশ্নাতীত (Filmer, 1680)। বাবার বিরুদ্ধে যেমন সন্তানের বিদ্রোহ করার অধিকার নেই, তেমনি রাজার বিরুদ্ধেও প্রজার বিদ্রোহ করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না।

লকের বিখ্যাত বই “Two Treatises of Government”-এর প্রথম অংশটিই লেখা হয়েছিল ফিলমারের এই যুক্তিকে তিলে তিলে খণ্ডন করার জন্য। লক দেখালেন, বাবা আর শাসকের ভূমিকা এক নয়। পারিবারিক ক্ষমতা আর রাজনৈতিক ক্ষমতা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। বাবার ক্ষমতা সাময়িক (সন্তান বড় হওয়া পর্যন্ত), কিন্তু শাসকের ক্ষমতা তা নয়। তাছাড়া, আদমের কোন সন্তান এই ক্ষমতা পেয়েছিল, তা জানার কোনো উপায় নেই। তাই এই বংশানুক্রমিক ক্ষমতার তত্ত্বটা একটা আস্ত কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। ফিলমারের এই পিতৃতান্ত্রিক ধারণাকে বিধ্বস্ত করেই লক তাঁর নিজের তত্ত্বের জন্য জায়গা তৈরি করেছিলেন, যেখানে সরকারের ভিত্তি কোনো দৈব অধিকার নয়, বরং চুক্তি (Contract)।

টমাস হব্‌স: বিশৃঙ্খলা বনাম স্বৈরাচার

টমাস হব্‌স ছিলেন লকের চেয়েও অনেক বড় মাপের একজন দার্শনিক। গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে তিনি মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, যদি কোনো সরকার বা আইন না থাকত, তাহলে মানুষের জীবন কেমন হতো? এই কাল্পনিক অবস্থাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘প্রকৃতির রাজ্য’ (State of Nature)।

হব্‌সের উত্তর ছিল ভয়াবহ। তাঁর মতে, প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ স্বার্থপর, হিংস্র আর ক্ষমতালোভী। সেখানে জীবন হবে “একাকী, দরিদ্র, নোংরা, পাশবিক এবং ক্ষণস্থায়ী” (solitary, poor, nasty, brutish, and short)। চলবে শুধু ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতি, অর্থাৎ এক সার্বক্ষণিক যুদ্ধাবস্থা (a war of all against all)। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত অধিকার একজন কর্তৃত্বকারী শাসকের (যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন লেভায়াথান বা Leviathan) হাতে তুলে দেবে। এই শাসকের ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ (Absolute), কারণ একমাত্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতাই পারে মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে (Hobbes, 1651)। হব্‌সের কাছে, স্বৈরাচার বিশৃঙ্খলার চেয়ে ভালো।

লক হব্‌সের এই ধারণার সঙ্গে তীব্রভাবে দ্বিমত পোষণ করলেন। তিনিও ‘প্রকৃতির রাজ্য’ আর ‘সামাজিক চুক্তি’র ধারণা ব্যবহার করলেন, কিন্তু ঠিক উল্টো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য। লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্য মানেই বিশৃঙ্খলার রাজ্য নয়। সেখানেও এক ধরনের আইন আছে, যাকে তিনি বলেছেন ‘প্রকৃতির আইন’ (Natural Law)। এই আইন কোনো সরকার তৈরি করেনি, এটা আমাদের যুক্তিবোধ (Reason) থেকেই আসে। আর এই যুক্তিবোধ আমাদের শেখায় যে, যেহেতু সবাই সমান ও স্বাধীন, তাই কারোরই অন্যের জীবন, স্বাধীনতা বা সম্পত্তি নষ্ট করার অধিকার নেই (Locke, 1689a)।

তাহলে সমস্যাটা কোথায়? লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে কিছু ‘অসুবিধা’ (inconveniences) আছে। যেমন, সেখানে কোনো নিরপেক্ষ বিচারক নেই। ফলে বিবাদ হলে সবাই নিজের মামলার বিচারক নিজেই হয়ে ওঠে, যা থেকে সংঘাত তৈরি হতে পারে। এই অসুবিধাগুলো দূর করার জন্যই মানুষ সরকার তৈরি করে।

কিন্তু এখানেই হব্‌স আর লকের পার্থক্যটা আকাশ-পাতাল। হব্‌সের মতে, মানুষ তাদের সব অধিকার সরকারের হাতে তুলে দেয়। লকের মতে, মানুষ তাদের সব অধিকার দেয় না। তারা শুধু আইন প্রয়োগ করার এবং বিচার করার ক্ষমতাটা সরকারের হাতে দেয়। তাদের জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার (Natural Rights) তারা নিজেদের কাছেই রাখে। সরকার এই অধিকারগুলো রক্ষা করার জন্যই তৈরি হয়েছে। যদি কোনো সরকার এই অধিকার রক্ষা না করে উল্টো তা কেড়ে নিতে চায়, তাহলে সেই সরকারের আর কোনো বৈধতা থাকে না এবং জনগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে (Tuck, 1999)।

দেখুন, একই কাঠামোর (প্রকৃতির রাজ্য, সামাজিক চুক্তি) ওপর দাঁড়িয়ে দুজন দার্শনিক কীভাবে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। হব্‌স চেয়েছিলেন নিরাপত্তা, তা স্বৈরাচারের বিনিময়ে হলেও। আর লক চেয়েছিলেন স্বাধীনতা, যা সীমিত সরকারের (Limited Government) মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকবে।

বিজ্ঞানের নতুন আলো: যুক্তির পথে হাঁটা

সতেরো শতক শুধু রাজনৈতিক বিপ্লবের যুগ ছিল না, এটা ছিল বৈজ্ঞানিক বিপ্লবেরও (Scientific Revolution) যুগ। আইজ্যাক নিউটন, রবার্ট বয়েল, ফ্রান্সিস বেকন – এই বিজ্ঞানীরা তখন বিশ্বকে দেখার এক নতুন পদ্ধতি শেখাচ্ছিলেন। তাঁরা বলছিলেন, কোনো কিছু অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে পর্যবেক্ষণ (observation), পরীক্ষা (experiment) এবং যুক্তির (reason) ওপর নির্ভর করতে হবে।

লক নিজে একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং এই নতুন বৈজ্ঞানিক ধারার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি রয়্যাল সোসাইটির (Royal Society) একজন সদস্যও ছিলেন, যা ছিল তৎকালীন বিজ্ঞানীদের প্রধান মিলনকেন্দ্র। এই বৈজ্ঞানিক মানসিকতাই তাঁর দর্শনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।

তাঁর আগে দেকার্তের (Descartes) মতো বুদ্ধিবাদী (Rationalist) দার্শনিকেরা মনে করতেন, আমাদের কিছু ধারণা জন্মগত (Innate Ideas)। যেমন, ঈশ্বরের ধারণা বা গণিতের কিছু মৌলিক সত্য আমাদের মনের মধ্যেই দেওয়া থাকে। লক এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করলেন। তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব ‘ট্যাবুলা রাসা’ (Tabula Rasa) বা ‘শূন্য স্লেট’ এই বৈজ্ঞানিক মানসিকতারই ফসল। তিনি বললেন, মনটা একটা সাদা কাগজের মতো। সেখানে কোনো কিছুই আগে থেকে লেখা থাকে না। আমাদের সমস্ত জ্ঞান আসে অভিজ্ঞতা (Experience) থেকে—হয় বাইরের জগৎকে দেখে (সংবেদন) অথবা নিজের মনের কার্যকলাপকে পর্যবেক্ষণ করে (প্রতিফলন) (Locke, 1689)।

এই কথাটা শুনতে সহজ মনে হলেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। যদি কোনো ধারণাই জন্মগত না হয়, তাহলে রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের ধারণাও জন্মগত হতে পারে না। যদি জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে, তাহলে অভিজাত পরিবারের সন্তান আর সাধারণ কৃষকের সন্তানের মধ্যে জন্মগত কোনো পার্থক্য থাকে না। সবাই একই শূন্য স্লেট নিয়ে জীবন শুরু করে। এই অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism) ছিল লকের গণতন্ত্রসাম্যের ধারণার দার্শনিক ভিত্তি (Aaron, 1971)।

সব মিলে কী দাঁড়াল?

তাহলে গল্পটা কী দাঁড়াল? জন লক কোনো শূন্য ক্যানভাসে ছবি আঁকেননি। তাঁর ছবির পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ আর গৌরবময় বিপ্লব। তাঁর তুলি আর রঙের জোগান দিয়েছিল ফিলমার আর হব্‌সের মতো দার্শনিকদের সঙ্গে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই। আর তাঁর ছবি আঁকার পদ্ধতিটা তিনি শিখেছিলেন নতুন বিজ্ঞানের যুক্তিবাদী আলো থেকে।

তিনি তাঁর সময়ের সংকটকে দেখেছিলেন এবং একটি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। এমন এক সমাধান যেখানে ক্ষমতা থাকবে, কিন্তু তা নিরঙ্কুশ হবে না। যেখানে মানুষ স্বাধীন থাকবে, কিন্তু সেই স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নেবে না। যেখানে সরকার মানুষের ওপর প্রভুত্ব করবে না, বরং তাদের অধিকার রক্ষা করার জন্য একজন বিশ্বস্ত পাহারাদার (trustee) হিসেবে কাজ করবে।

এই সবকিছুর মিশেলেই তৈরি হয়েছিল জন লকের দর্শন—যা শুধু একটি তত্ত্ব নয়, বরং আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর। তাই পরেরবার যখন আপনি ভোট দেওয়ার কথা ভাববেন, বা সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা করবেন, কিংবা নিজের অধিকারের কথা বলবেন, তখন একবার হলেও এই মানুষটির কথা স্মরণ করবেন। ঝড়ের দিনে জন্ম নেওয়া এই দার্শনিকটিই আমাদের হাতে সেই চশমাটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা নিজেদের শুধু প্রজা হিসেবে নয়, একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে দেখতে শিখেছি।

মনের সাদা পাতা: জ্ঞানতত্ত্বের দুনিয়ায় এক নতুন বিপ্লব (Theory of Knowledge: Epistemology)

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, আপনার মাথায় ‘টেবিল’, ‘কুকুর’, ‘ভালোবাসা’, ‘ন্যায়বিচার’—এই ধারণাগুলো (Ideas) কীভাবে তৈরি হলো? আপনি কীভাবে জানেন যে আগুন গরম বা বরফ ঠান্ডা? এই প্রশ্নগুলো দর্শনের যে শাখায় আলোচনা করা হয়, তাকে বলে জ্ঞানতত্ত্ব বা এপিস্টেমোলজি (Epistemology)

লকের আগে দর্শনের জগতে একদল প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ছিলেন, যাঁদের বলা হয় বুদ্ধিবাদী (Rationalists)রেনে দেকার্ত (René Descartes), স্পিনোজা (Spinoza), লাইবনিজ (Leibniz)—তাঁরা মনে করতেন, আমাদের কিছু মৌলিক ধারণা জন্ম থেকেই মনের মধ্যে দেওয়া থাকে। ঈশ্বর, আত্মা, গণিতের স্বতঃসিদ্ধ (axioms), নৈতিকতার কিছু মৌলিক নীতি—এগুলো হলো সহজাত ধারণা (Innate Ideas)। এগুলো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখা নয়, বরং আমাদের আত্মার অংশ, যা যুক্তি দিয়ে আবিষ্কার করা যায়। এই মত অনুযায়ী, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা প্রায়শই প্রতারণাপূর্ণ, তাই প্রকৃত জ্ঞান কেবল বিশুদ্ধ যুক্তি থেকেই আসতে পারে।

লক এই ধারণাটিকে একেবারে গোড়া থেকে নাড়িয়ে দিলেন। তাঁর মাস্টারপিস, “An Essay Concerning Human Understanding”-এর প্রথম বাক্যেই তিনি যেন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, মানুষের মনে কোনো সহজাত ধারণা নেই। একটি শিশু যখন জন্মায়, তখন তার মনটা থাকে একটি সাদা কাগজের মতো। ল্যাটিন ভাষায় তিনি একে বলেছেন ‘ট্যাবুলা রাসা’ (Tabula Rasa) বা শূন্য স্লেট (Blank Slate)। এই সাদা কাগজে অভিজ্ঞতার কালিতেই ধীরে ধীরে লেখা হয় আমাদের সমস্ত জ্ঞানের অক্ষর (Locke, 1689)।

ভাবতে পারেন, কথাটা কতটা বৈপ্লবিক? এর মানে দাঁড়ায়, কোনো রাজপুত্র জন্মগতভাবে কোনো কৃষকের সন্তানের চেয়ে জ্ঞানী বা উন্নত নয়। জ্ঞান বা প্রতিভা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোনো সম্পত্তি নয়, বরং তা অর্জন করতে হয়। আমাদের সবার শুরুটা একই—একটা শূন্য মন নিয়ে। এই তত্ত্ব আভিজাত্য এবং বংশগত ক্ষমতার ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছিল। যদি কোনো সহজাত ঐশ্বরিক বা নৈতিক ধারণা না থাকে, তাহলে কোনো রাজাই দাবি করতে পারেন না যে তাঁর শাসন করার অধিকার জন্মগত। এভাবেই লকের জ্ঞানতত্ত্ব তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

তবে ‘ট্যাবুলা রাসা’ তত্ত্বের একটি সাধারণ ভুল বোঝাবুঝি হলো, এটি মানুষের সব ধরনের জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে। লক তা করেননি। তিনি অস্বীকার করেছিলেন সহজাত ধারণা, জন্মগত প্রতিভা বা প্রবণতাকে (tendencies) নয়। একজন ব্যক্তির হয়তো স্বাভাবিকভাবেই সঙ্গীত বা গণিতের প্রতি ঝোঁক থাকতে পারে, কিন্তু ‘ঈশ্বর’ বা ‘ন্যায়বিচার’ সম্পর্কে কোনো তৈরি ধারণা নিয়ে সে জন্মায় না।

অভিজ্ঞতার দুটি পথ: সংবেদন ও প্রতিফলন

যদি সবকিছুই অভিজ্ঞতা থেকে আসে, তবে অভিজ্ঞতা কীভাবে কাজ করে? লক বললেন, অভিজ্ঞতা আমাদের মনে প্রবেশ করে দুটি প্রধান দরজা দিয়ে:

১. সংবেদন (Sensation): এটা হলো বাইরের জগৎ থেকে তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া। আমাদের পঞ্চ-ইন্দ্রিয়—চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক—হলো সেই জানালা, যা দিয়ে বাইরের জগতের আলো-বাতাস আমাদের মনে প্রবেশ করে। একটি হলুদ ফুল দেখে ‘হলুদ’ আর ‘নরম’—এই ধারণা, একটি ঘণ্টা শুনে ‘শব্দ’-এর ধারণা, চিনি খেয়ে ‘মিষ্টি’-র ধারণা—এই সবই হলো সংবেদনের ফল। এগুলোকে লক বলেছেন সরল ধারণা (Simple Ideas)। মন এগুলোকে নিছক গ্রহণ করে, নিজে থেকে তৈরি বা ধ্বংস করতে পারে না। এগুলো জ্ঞানের পরমাণুর মতো, সবচেয়ে মৌলিক একক, যা আর ভাঙা যায় না।

২. প্রতিফলন (Reflection): শুধু বাইরের জগৎ থেকে তথ্য নিলেই তো পূর্ণজ্ঞান হয় না। মনকে সেই তথ্য নিয়ে কাজ করতে হয়। আমাদের মন যখন নিজের ভেতরের কার্যকলাপের দিকে তাকায়—অর্থাৎ, যখন আমরা আমাদের চিন্তা করা (Thinking), বিশ্বাস করা (Believing), সন্দেহ করা (Doubting), ইচ্ছা করা (Willing) ইত্যাদি মানসিক প্রক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করি—তখন যে ধারণাগুলো জন্মায়, তাকেই লক বলেছেন প্রতিফলন। একে বলা যেতে পারে ‘অন্তর্দর্শন’ বা ‘মনের ভেতরের ইন্দ্রিয়’। যেমন, ‘সন্দেহ’ বা ‘বিশ্বাস’—এই ধারণাগুলো আমরা কোনো কিছু ছুঁয়ে বা দেখে পাই না। এগুলো আমাদের মনের নিজস্ব কার্যকলাপের প্রতিফলন। সংবেদনের মতো, প্রতিফলন থেকেও আমরা সরল ধারণা পাই, যেমন—’চিন্তা করা’ একটি সরল ধারণা।

লকের মতে, এই সংবেদন এবং প্রতিফলন—এই দুটি উৎসই হলো আমাদের সমস্ত জ্ঞানের ভিত্তি। এর বাইরে জ্ঞানের আর কোনো গোপন রাস্তা নেই। একজন মানুষ যদি জন্ম থেকে অন্ধ ও বধির হয়, তাহলে তার মনে রঙ বা শব্দ সম্পর্কে কোনো ধারণা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, কারণ তার কাছে সংবেদন পৌঁছানোর সেই পথগুলোই খোলা নেই (Locke, 1689, Book II)।

সরল থেকে জটিল: জ্ঞানের ইমারত গড়া

মন তাহলে এই সরল ধারণাগুলো নিয়ে কী করে? লকের উত্তর হলো, মন এখানে নিষ্ক্রিয় দর্শক নয়। মন সক্রিয়ভাবে এই সরল ধারণাগুলোকে বিভিন্নভাবে একত্রিত করে (combining), তুলনা করে (comparing) এবং বিমূর্ত করে (abstracting) নতুন নতুন জটিল ধারণা (Complex Ideas) তৈরি করে।

ব্যাপারটা অনেকটা একটা শিশুর খেলার মতো। তাকে যদি লাল, নীল, হলুদ—এরকম কয়েকটি রঙের ব্লক (সরল ধারণা) দেওয়া হয়, সেগুলোকে সে নানাভাবে সাজিয়ে একটা বাড়ি, একটা গাড়ি বা একটা রঙিন টাওয়ার (জটিল ধারণা) তৈরি করতে পারে। আমাদের মনও ঠিক তাই করে। যেমন, সংবেদন থেকে পাওয়া ‘হলুদ’, ‘ভারী’, ‘ঠান্ডা’, ‘চকচকে’—এই সরল ধারণাগুলোকে মন একত্রিত করে ‘সোনা’ নামক একটি জটিল ধারণা তৈরি করে।

লক তিন ধরনের জটিল ধারণার কথা বলেছেন:

  • মোড (Modes): এগুলি এমন ধারণা যা অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল, নিজে নিজে টিকে থাকতে পারে না। যেমন, ‘সৌন্দর্য’, ‘কৃতজ্ঞতা’, ‘ত্রিভুজ’ বা ‘ডজন’। সৌন্দর্য কোনো বস্তুর গুণ হিসেবেই থাকে, কৃতজ্ঞতা কোনো ব্যক্তির মনেই জন্মায়। এগুলো সরল ধারণাগুলোর সংমিশ্রণ। যেমন, ‘কৃতজ্ঞতা’ হলো উপকার পাওয়ার (সংবেদন) পর মনে এক ধরনের আনন্দ (প্রতিফলন) এবং প্রতিদান দেওয়ার ইচ্ছা (প্রতিফলন)—এই ধারণাগুলোর সমন্বয়।

  • সাবস্টেন্স বা দ্রব্য (Substances): এগুলি হলো স্বাধীন বস্তুর ধারণা, যেমন—‘মানুষ’, ‘ঘোড়া’, ‘সোনা’, ‘জল’। মন যখন দেখে যে কতগুলো সরল ধারণা সবসময় একসাথে পাওয়া যায়, তখন সেগুলোকে একত্রিত করে একটি দ্রব্যের ধারণা তৈরি করে। আমাদের মন ধরে নেয়, এই গুণগুলোর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো একটি আধার বা দ্রব্য আছে যা এদের ধারণ করে আছে।

  • রিলেশন বা সম্বন্ধ (Relations): যখন মন দুটি ধারণাকে পাশাপাশি রেখে তাদের তুলনা করে, তখন সম্বন্ধের ধারণা জন্মায়। যেমন—‘বড়’, ‘ছোট’, ‘বাবা’, ‘ছেলে’, ‘কারণ’ ও ‘ফল’ (Cause and Effect)। একটি জিনিস আরেকটি জিনিসের চেয়ে লম্বা, বা একজন আরেকজনের আগে জন্মেছে—এই সবই সম্বন্ধের ধারণা।

বস্তুর গুণাবলী: আমরা যা দেখি, তা কি সত্যি?

এই পর্যায়ে এসে লক একটি অসাধারণ এবং খানিকটা গোলমেলে পার্থক্য টানেন। তিনি বলেন, বস্তু থেকে আমরা যে ধারণা পাই, তা আসে বস্তুর গুণাবলী (Qualities) থেকে। কিন্তু এই গুণাবলী দুই প্রকারের।

১. মুখ্য গুণ (Primary Qualities): এগুলি হলো বস্তুর আসল, অবিচ্ছেদ্য এবং বস্তুনিষ্ঠ গুণ। আমরা বস্তুটিকে উপলব্ধি করি বা না করি, এই গুণগুলো বস্তুর মধ্যেই থাকবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—কঠিনতা (Solidity), বিস্তৃতি (Extension), আকৃতি (Figure), গতি (Mobility) এবং সংখ্যা (Number)। একটি পাথরের টুকরোকে আপনি দেখেন বা না দেখেন, তার একটি নির্দিষ্ট আকার, ওজন ও আয়তন আছে। এগুলো আপনার মনের ওপর নির্ভর করে না। আমাদের মনে এই গুণগুলোর যে ধারণা তৈরি হয়, তা বস্তুর আসল গুণের অনুরূপ (Resemblance) হয়। অর্থাৎ, বস্তুর আকৃতি যেমন, আমাদের মনে তার ধারণাও তেমনই হয় (Locke, 1689, Book II, Ch. VIII)।

২. গৌণ গুণ (Secondary Qualities): এগুলি বস্তুর আসল গুণ নয়। বরং, এগুলি হলো বস্তুর মুখ্য গুণগুলোর (অর্থাৎ, তার অণু-পরমাণুর গঠন, বিন্যাস, গতি) এমন এক শক্তি (Power) যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের ওপর কাজ করে বিশেষ ধরনের সংবেদন তৈরি করে। যেমন—রঙ (Color), গন্ধ (Smell), স্বাদ (Taste), শব্দ (Sound), উষ্ণতা (Warmth)।

বিষয়টা একটু ভেঙে বলা যাক। লকের মতে, একটি গোলাপের ‘লাল’ রঙটা গোলাপের নিজের কোনো প্রকৃত গুণ নয়। বরং, গোলাপের পৃষ্ঠতলের অণু-পরমাণুর (মুখ্য গুণ) গঠন এমন যে তা থেকে আলোকরশ্মি একটি নির্দিষ্ট উপায়ে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়ে এবং আমাদের মনে ‘লাল’ নামক একটি সংবেদনের জন্ম দেয়। যদি কোনো পর্যবেক্ষক না থাকতো, তাহলে জগতে গোলাপের আকার-আকৃতি থাকতো, কিন্তু ‘লাল’ রঙ বা ‘মিষ্টি’ গন্ধের কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। রঙ, গন্ধ, স্বাদ—এগুলো বস্তু ও আমাদের মনের এক যৌথ প্রযোজনা। এগুলো বস্তুর মধ্যে নেই, এগুলো আমাদের মনে তৈরি হয় (Uzgalis, 2020)। এই ধারণার সপক্ষে একটি বিখ্যাত যুক্তি হলো ‘perceptual variation’-এর যুক্তি। যেমন, একই পাত্রের জল আপনার গরম হাত ডোবালে ঠান্ডা লাগবে, আবার ঠান্ডা হাত ডোবালে গরম লাগবে। এর মানে হলো, ‘উষ্ণতা’ জলের কোনো বস্তুনিষ্ঠ গুণ নয়, বরং এটি বস্তু ও পর্যবেক্ষকের সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।

এই ধারণাটি আমাদের সাধারণ জ্ঞানের পৃথিবীকে একটা বড় ঝাঁকুনি দেয়। তার মানে, আমরা যে রঙিন, সুগন্ধী, সুস্বাদু জগৎটাকে দেখি, তার অনেকটাই আমাদের নিজেদের মনের তৈরি? বাস্তব জগৎটা আসলে বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন অণু-পরমাণুর এক খেলা? লক আমাদের এই গভীর প্রশ্নটির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন।

দ্রব্য বা সাবস্টেন্স: এক রহস্যময় আধার

লক এখানে এসে নিজেই একটি সমস্যায় পড়েন, যা তাঁর দর্শনের সততাকে প্রমাণ করে। তিনি বলেন, আমরা কেবল বস্তুর গুণাবলীকেই জানতে পারি—মুখ্য বা গৌণ। কিন্তু এই গুণগুলো কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে? যে আধারটি (Substratum) এই মুখ্য গুণগুলোকে (আকার, আকৃতি) ধারণ করে, সেটি আসলে কী? আমরা বলি ‘সোনা’ একটি দ্রব্য। কিন্তু ‘সোনা’ বলতে আমরা বুঝি হলুদ, ভারী, চকচকে ইত্যাদি গুণের সমষ্টি। এই গুণগুলো বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, সেই আসল ‘সোনা’টা কী?

লক সততার সাথে স্বীকার করেছেন, এটা আমরা জানি না। তিনি এই আধারকে বলেছেন “something, I know not what” (এমন কিছু, যা আমি জানি না কী)। আমাদের মন কেবল গুণাবলীকে উপলব্ধি করতে পারে, তার পেছনের আসল দ্রব্যকে নয়। কারণ দ্রব্য নিজে অভিজ্ঞতার বস্তু নয়। এটি লকের অভিজ্ঞতাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা, যা তিনি নিজেই চিহ্নিত করেছেন। পরবর্তী দার্শনিকেরা, যেমন জর্জ বার্কলি ডেভিড হিউম, এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগিয়ে লকের দর্শনকে আরও এগিয়ে (বা চ্যালেঞ্জ) নিয়ে যাবেন (Chappell, 1994)।

প্রকৃতির রাজ্য ও সামাজিক চুক্তি: রাজনীতির নতুন ভিত্তি (State of Nature and Social Contract)

লকের জ্ঞানতত্ত্ব যদি চিন্তার জগতে বিপ্লব আনে, তবে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এনেছিল বাস্তব জগতে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “Two Treatises of Government” আধুনিক গণতন্ত্রের বাইবেল হিসেবে পরিচিত।

এই বইয়ের শুরুতে লক আমাদের একটি মন-পরীক্ষা (Thought Experiment) করতে বলেন। ভাবুন তো, এমন এক সময়ের কথা, যখন কোনো সরকার ছিল না, কোনো পুলিশ ছিল না, ছিল না কোনো আদালত বা আইন। মানুষ তখন কীভাবে বাস করত? এই কাল্পনিক অবস্থাকেই রাজনৈতিক দর্শনে বলা হয় ‘প্রকৃতির রাজ্য’ (State of Nature)।

হব্‌সের অন্ধকারের বিপরীতে লকের আলো

লকের ঠিক আগেই আরেকজন প্রভাবশালী ইংরেজ দার্শনিক টমাস হব্‌স (Thomas Hobbes) এই প্রশ্নের এক ভয়াবহ উত্তর দিয়েছিলেন। হব্‌সের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে জীবন হবে “একাকী, দরিদ্র, নোংরা, পাশবিক এবং ক্ষণস্থায়ী।” মানুষ সেখানে স্বার্থপর নেকড়ের মতো একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। চলবে শুধু ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতি। কারণ সেখানে কোনো আইন বা নৈতিকতা নেই, আছে শুধু টিকে থাকার আদিম প্রবৃত্তি। এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে বাঁচতে মানুষ চুক্তির মাধ্যমে এক কর্তৃত্ববাদী শাসকের (Leviathan) হাতে নিজেদের সমস্ত অধিকার তুলে দেয়, যার ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ।

লক এই নৈরাশ্যবাদী ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি অনেক বেশি আশাবাদী ছিলেন। তাঁর মতে, প্রকৃতির রাজ্য বিশৃঙ্খলার রাজ্য নয়, বরং স্বাধীনতার রাজ্য। সেখানে প্রত্যেকেই ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে সমান এবং স্বাধীন। কিন্তু এই স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। কারণ প্রকৃতির রাজ্য বিশৃঙ্খল নয়, এটি পরিচালিত হয় প্রাকৃতিক আইন (Natural Law) দ্বারা। এই আইন কোনো বইয়ে লেখা নেই, এটি হলো মানুষের সহজাত যুক্তিবোধ (Reason), যা ঈশ্বর প্রত্যেককে দিয়েছেন। এই যুক্তিবোধই আমাদের শেখায় যে, যেহেতু প্রত্যেকেই সমান ও স্বাধীন, তাই কারোরই অন্যের জীবন (Life), স্বাস্থ্য (Health), স্বাধীনতা (Liberty) বা সম্পত্তি (Possessions) নষ্ট করার অধিকার নেই (Locke, 1689a, Second Treatise, Ch. II)।

প্রাকৃতিক অধিকার: জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি

এটাই লকের রাজনৈতিক দর্শনের মূল কেন্দ্র। তিনি বললেন, মানুষ রাষ্ট্র বা সমাজ তৈরি করার আগেই কিছু অধিকার নিয়ে জন্মায়। এগুলো কোনো রাজা বা সরকারের দান নয়, এগুলো প্রাকৃতিক বা ঈশ্বরপ্রদত্ত। এগুলো হলো অবিচ্ছেদ্য অধিকার (Unalienable Rights)

  • ১. জীবনের অধিকার (Right to Life): প্রত্যেকেরই আত্মরক্ষা করার এবং বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার আছে।
  • ২. স্বাধীনতার অধিকার (Right to Liberty): প্রাকৃতিক আইনের সীমার মধ্যে থেকে প্রত্যেকেরই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার এবং বাঁচার অধিকার আছে। কেউ কারো দাস হতে পারে না।
  • ৩. সম্পত্তির অধিকার (Right to Property): লকের কাছে এই অধিকারটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, পৃথিবী যদি ঈশ্বর সবাইকে যৌথভাবে দিয়ে থাকেন, তাহলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির জন্ম হয় কীভাবে? তাঁর উত্তর ছিল—শ্রম (Labour)। মানুষ যখন প্রকৃতির কোনো সাধারণ জিনিসের সাথে নিজের শ্রম মেশায়, তখন তা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। যেমন, বনের একটি ফলগাছ হয়তো সবার, কিন্তু যখন একজন ব্যক্তি নিজের পরিশ্রমে সেই গাছ থেকে ফল পেড়ে আনে, তখন সেই ফলগুলো তার হয়ে যায়। কারণ সে তার শরীরের শ্রম, যা একান্তই তার নিজের, সেটিকে ফলের সাথে মিশিয়েছে। একইভাবে, যে ব্যক্তি এক টুকরো অনাবাদি জমিতে চাষ করে ফসল ফলায়, সেই জমি ও ফসল তার সম্পত্তি (Locke, 1689a, Second Treatise, Ch. V)।

লকের মতে, এই সম্পত্তির ধারণা শুধু জমি বা অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের জীবন আমাদের সম্পত্তি, আমাদের স্বাধীনতা আমাদের সম্পত্তি, এবং আমাদের শ্রমও আমাদের সম্পত্তি। তাই সম্পত্তি রক্ষার অধিকার আসলে জীবন ও স্বাধীনতা রক্ষার অধিকারেরই নামান্তর।

তবে লক এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বা প্রভাইজো (Proviso) জুড়ে দিয়েছিলেন।

  • প্রথমত, পর্যাপ্ততার শর্ত (Sufficiency Limitation): একজনকে ততটুকুই সম্পদ সংগ্রহ করতে হবে যাতে অন্যের জন্য “পর্যাপ্ত এবং সমান ভালো” (enough and as good) জিনিস অবশিষ্ট থাকে। অর্থাৎ, কেউ পুরো জঙ্গলটা নিজের বলে দাবি করতে পারে না।

  • দ্বিতীয়ত, অপচয় না করার শর্ত (Spoilage Limitation): সংগৃহীত সম্পদ নষ্ট করা যাবে না। একজন ব্যক্তি ততটুকুই আপেল পেড়ে নিজের করতে পারে, যতটুকু সে নিজে বা তার পরিবার নষ্ট হওয়ার আগে খেতে পারবে। এর বেশি নিলে তা অন্যের অধিকার হরণ করবে।

কিন্তু পরবর্তীতে লক বলেন, মুদ্রার (Money) আবিষ্কার এই দুটি শর্তকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। কারণ সোনা বা রুপার মতো মুদ্রা পচে যায় না, তাই এটি অসীম পরিমাণে জমানো যায়। একজন মানুষ তার অতিরিক্ত পচনশীল পণ্য (যেমন, আপেল) মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে সেই মুদ্রা সঞ্চয় করতে পারে। এটি সমাজে ব্যাপক বৈষম্য তৈরির পথ খুলে দেয়, যা নিয়ে সমালোচকরা (যেমন C. B. Macpherson) লকের তত্ত্বকে ‘ধনিক শ্রেণীর দর্শন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন (Macpherson, 1962)।

সরকার কেন দরকার?

যদি প্রকৃতির রাজ্য এতই ভালো হয়, যেখানে আইন ও অধিকার দুই-ই আছে, তাহলে মানুষ কেন রাষ্ট্র বা সরকার তৈরি করতে গেল?

লক বললেন, প্রকৃতির রাজ্যের আদর্শ অবস্থা সত্ত্বেও কিছু ‘অসুবিধা’ (inconveniences) আছে:

  • প্রথমত, প্রাকৃতিক আইন থাকলেও, সবাই সেই আইন সম্পর্কে সমানভাবে সচেতন বা শ্রদ্ধাশীল নয়। অজ্ঞতা বা স্বার্থপরতার কারণে মানুষ আইন ভাঙতে পারে। অর্থাৎ, একটি প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনবিদিত আইনের অভাব।

  • দ্বিতীয়ত, সেখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত, পরিচিত এবং নিরপেক্ষ বিচারক (impartial judge) নেই। প্রত্যেকেই যখন নিজের মামলার বিচারক, তখন পক্ষপাতিত্ব ও প্রতিশোধস্পৃহা জন্মাবেই।

  • তৃতীয়ত, সঠিক বিচার হলেও, সেই রায় কার্যকর করার মতো কোনো নির্দিষ্ট শক্তি বা কর্তৃপক্ষ (executive power) নেই। একজন দুর্বল মানুষ একজন শক্তিশালী অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারবে না।

এই তিনটি অসুবিধা দূর করার জন্যই মানুষ স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি (Contract) করে। এটাই হলো ‘সামাজিক চুক্তি’ (Social Contract)। এই চুক্তির মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতির রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে একটি রাজনৈতিক সমাজ (Political Society) বা রাষ্ট্র গঠন করে। তারা তাদের প্রাকৃতিক আইন প্রয়োগ ও বিচার করার ক্ষমতা একটি সম্মিলিত কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু এই ক্ষমতা হস্তান্তরের একটাই শর্ত—সরকার তাদের জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি, অর্থাৎ তাদের প্রাকৃতিক অধিকার রক্ষা করবে (Gough, 1957)।

সীমিত সরকার এবং জনগণের সম্মতি

এখানেই লকের সবচেয়ে বড় অবদান, যা তাকে হব্‌সের মতো নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের সমর্থকদের থেকে আলাদা করে। হব্‌সের মতে, মানুষ একবার সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলে আর তা ফেরত নিতে পারে না। কিন্তু লক বললেন, সরকারের ক্ষমতা কখনোই অসীম হতে পারে না। সরকার জনগণের একজন বিশ্বস্ত প্রতিনিধি বা ট্রাস্টি (Trustee) মাত্র, যার কাজ জনগণের দেওয়া শর্ত পালন করা। সরকারের প্রতিটি কাজের পেছনে থাকতে হবে শাসিতদের সম্মতি (Consent of the governed)

এই সম্মতি দুই প্রকার হতে পারে: প্রকাশ্য (Express) এবং মৌন (Tacit)। কেউ যখন সরাসরি শপথ বা ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, তা হলো প্রকাশ্য সম্মতি। আর কেউ যখন কোনো রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে বাস করে, তার সম্পত্তি ভোগ করে এবং তার আইনের সুরক্ষা গ্রহণ করে, তখন সে মৌনভাবে সেই রাষ্ট্রের আইন মেনে চলার সম্মতি দেয়। যদিও এই মৌন সম্মতির ধারণাটি পরবর্তীতে ডেভিড হিউমের মতো দার্শনিকদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে, কারণ একজন সাধারণ কৃষক বা শ্রমিকের পক্ষে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, তাই তার থাকাকে সম্মতি হিসেবে ধরা যায় কিনা তা একটি বড় প্রশ্ন।

লক সরকারের ক্ষমতাকে তিনটি ভাগে ভাগ করার কথা বলেন: আইন বিভাগ (Legislative), নির্বাহী বিভাগ (Executive) এবং ফেডারেটিভ (Federative) (যা বৈদেশিক সম্পর্ক পরিচালনা করে)। লকের মতে, আইন বিভাগই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু সেই ক্ষমতাও জনগণের অধিকার দ্বারা সীমিত। কোনো সরকারই খেয়ালখুশি মতো আইন তৈরি করতে বা জনগণের সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারে না।

বিপ্লবের অধিকার: স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শেষ আশ্রয়

যদি সরকার এই চুক্তি ভঙ্গ করে? যদি সে জনগণের অধিকার রক্ষা না করে উল্টো তাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে, অর্থাৎ স্বৈরাচারী (Tyrannical) হয়ে ওঠে?

লকের উত্তর ছিল দ্ব্যর্থহীন এবং বৈপ্লবিক। তিনি বললেন, যখন সরকার এবং জনগণের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং তার কোনো জাগতিক সমাধান থাকে না, তখন জনগণ ‘স্বর্গের কাছে আবেদন’ (appeal to heaven) করতে পারে। এর অর্থ হলো, যে সরকার জনগণের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা বিপ্লব করার অধিকার জনগণের আছে। কারণ সরকার যখন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, তখন সে নিজেই জনগণের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সমাজকে আবার প্রকৃতির রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই অবস্থায় আত্মরক্ষার জন্য জনগণ বলপ্রয়োগ করতে পারে (Locke, 1689a, Second Treatise, Ch. XIX)।

এই বিপ্লবের অধিকারের ধারণাটি ছিল এক প্রচণ্ড শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র। এটি কোনো সামান্য কারণে সরকারকে ফেলে দেওয়ার লাইসেন্স নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদী এবং পরিকল্পিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে এটিই জনগণের শেষ আশ্রয়। এই ধারণাই আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা (American Declaration of Independence) এবং ফরাসি বিপ্লবকে (French Revolution) বুদ্ধিবৃত্তিক বৈধতা দিয়েছিল। টমাস জেফারসন যখন লিখেছিলেন, “জীবন, স্বাধীনতা এবং সুখের অন্বেষণ” (Life, Liberty and the pursuit of Happiness) মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার, তখন তিনি সরাসরি লকের ‘জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তি’র প্রতিধ্বনি করছিলেন (Becker, 1922)।

সহনশীলতা, শিক্ষা ও ভাষা: একটি সভ্য সমাজের স্তম্ভ

লকের চিন্তার পরিধি শুধু জ্ঞানতত্ত্ব আর রাজনীতিতে থেমে থাকেনি। তিনি একটি আধুনিক, যুক্তিবাদী এবং সভ্য সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, যার ভিত্তি হবে সহনশীলতা, সঠিক শিক্ষা এবং স্বচ্ছ ভাষা।

ধর্মীয় সহনশীলতা (Religious Toleration)

লকের সময়ে ইউরোপে ধর্মের নামে চলছিল ভয়াবহ সংঘাত ও রক্তপাত। ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের লড়াইয়ে মহাদেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। এই হিংসার পরিবেশে লক লিখলেন তাঁর বিখ্যাত “A Letter Concerning Toleration”। এখানে তিনি রাষ্ট্র এবং গির্জার (Church) কাজকে সম্পূর্ণ আলাদা করার পক্ষে এক শক্তিশালী যুক্তি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রের কাজ হলো মানুষের জাগতিক বা নাগরিক স্বার্থ (Civil Interests) রক্ষা করা—যেমন জীবন, স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য এবং সম্পত্তি। রাষ্ট্রের হাতে আছে তলোয়ার বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতা। অন্যদিকে, গির্জা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো আত্মার মুক্তি (Salvation of Souls)। আত্মার মুক্তি নির্ভর করে আন্তরিক বিশ্বাসের ওপর। তলোয়ার দিয়ে আইন কার্যকর করা যায়, কিন্তু বিশ্বাস তৈরি করা যায় না। জোর করে কাউকে গির্জায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তার মনে প্রকৃত বিশ্বাস জন্মানো যায় না। একটি ধর্ম সত্য হলেও, জোর করে চাপিয়ে দিলে তা আত্মার মুক্তি আনতে পারে না। তাই, রাষ্ট্রের উচিত নয় কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে চাপিয়ে দেওয়া বা ভিন্নমতের অনুসারীদের ওপর অত্যাচার করা (Locke, 1689b)।

তবে লকের এই সহনশীলতার ধারণারও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যা তাঁর সময় দ্বারা প্রভাবিত। তিনি দুটি গোষ্ঠীকে এই সহনশীলতার বাইরে রেখেছিলেন: ক্যাথলিক এবং নাস্তিক (Atheists)। তাঁর যুক্তি ছিল, ক্যাথলিকরা পোপের প্রতি অনুগত, যিনি একজন বিদেশী শাসক। তাই তাদের আনুগত্য রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আর নাস্তিকরা, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তারা কোনো শপথ, চুক্তি বা প্রতিশ্রুতির মূল্য বোঝে না বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর মতে, নাস্তিকতা সমাজের নৈতিক বুননকে ধ্বংস করে দেয়, কারণ নৈতিকতার ভিত্তি হলো ঈশ্বর (Waldron, 2002)। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ থাকার যে নীতি তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, তা ছিল সময়ের চেয়ে বহু ধাপ এগিয়ে এবং আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অন্যতম ভিত্তি।

শিক্ষা দর্শন (Philosophy of Education)

যেহেতু লকের মতে মন একটি ‘ট্যাবুলা রাসা’, তাই শিক্ষার ভূমিকা তাঁর কাছে ছিল অপরিসীম। সাদা পাতায় কী লেখা হবে, তা তো শিক্ষার মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে। তাঁর “Some Thoughts Concerning Education” বইয়ে তিনি তৎকালীন মুখস্থ-নির্ভর, শাস্তিমূলক শিক্ষার কঠোর সমালোচনা করেন। সেই যুগে ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষা শেখার ওপর যে অতিরিক্ত জোর দেওয়া হতো, তার পরিবর্তে তিনি বাস্তবমুখী শিক্ষার কথা বলেন।

তিনি বলেন, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু তথ্য বা জ্ঞান দেওয়া নয়, বরং শিশুর মধ্যে চারটি জিনিস তৈরি করা: সদগুণ (Virtue), প্রজ্ঞা (Wisdom), শিষ্টাচার (Breeding) এবং জ্ঞান (Learning)—এই ক্রম অনুসারে। অর্থাৎ, একজন ভালো, সৎ ও নৈতিক মানুষ হওয়াটা একজন বিদ্বান মানুষ হওয়ার চেয়েও বেশি জরুরি। তিনি শিশুর শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিয়েছেন। খেলাধুলা, মুক্ত বাতাস এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, শিশুদের কৌতূহলকে উৎসাহিত করতে হবে, তাদের প্রশ্ন করতে শেখাতে হবে, জোর করে কিছু গেলানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। শিক্ষা হওয়া উচিত আনন্দদায়ক, শাস্তিমূলক নয়। তাঁর শিশুকেন্দ্রিক এই শিক্ষা দর্শন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম পথপ্রদর্শক (Locke, 1693)।

ভাষার দর্শন (Philosophy of Language)

লক তাঁর Essay-এর তৃতীয় বইটি উৎসর্গ করেছেন ভাষার আলোচনার জন্য। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, আমাদের সমস্ত জ্ঞান ও চিন্তাভাবনা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কিন্তু ভাষা প্রায়শই জ্ঞানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং ভুল বোঝাবুঝির কারণ হয়।

লকের মতে, শব্দগুলো বস্তুর চিহ্ন নয়, বরং আমাদের মনের ধারণার চিহ্ন। আমি যখন ‘কুকুর’ শব্দটি ব্যবহার করি, তখন সেটি বাইরের কোনো আসল কুকুরকে নির্দেশ করে না, বরং আমার মনে ‘কুকুর’ সম্পর্কে যে ধারণাটি আছে, তাকেই নির্দেশ করে। সমস্যা হয় তখন, যখন আমার মনের ‘ন্যায়বিচার’ ধারণাটির সাথে আপনার মনের ধারণার মিল থাকে না। বিশেষ করে, ‘ন্যায়বিচার’, ‘সৌন্দর্য’ বা ‘ধর্ম’-এর মতো জটিল ও বিমূর্ত ধারণাগুলোর ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট হয়। প্রত্যেকেই এই শব্দগুলো ব্যবহার করে, কিন্তু তাদের মনের ধারণাগুলো হয় ভিন্ন ভিন্ন। এর ফলেই জন্মায় অন্তহীন বিতর্ক ও সংঘাত। লক ভাষার এই ‘অপব্যবহার’কে (abuse of words) জ্ঞানের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা হিসেবে দেখেছিলেন। স্বচ্ছ যোগাযোগের জন্য শব্দের অর্থ পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করার ওপর তিনি জোর দিয়েছিলেন (Locke, 1689, Book III)।

ব্যক্তিগত পরিচয়: আমি কে? (Personal Identity)

লকের দর্শনের আরও একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং আধুনিক দিক হলো ব্যক্তিগত পরিচয় (Personal Identity) নিয়ে তাঁর অনুসন্ধান। সময়ের সাথে সাথে আমাদের শরীর পুরোপুরি বদলে যায়, আমাদের বিশ্বাস ও চিন্তাভাবনাও বদলায়। তাহলে কোন জিনিসটা সেই ছোট্ট ‘আমি’ আর আজকের ‘আমি’কে একই ব্যক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখে?

প্রচলিত উত্তর ছিল দুটি: হয় আমাদের শরীর (Body) অথবা আমাদের আত্মা (Soul)। লক এই দুটিকেই নাকচ করে দেন। তিনি বললেন, শরীরের কণাগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আজ আমার শরীরের কোনো কণা দশ বছর আগের শরীরে ছিল না। আর আত্মা? যদি একই আত্মা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শরীরে প্রবেশ করে (যেমন, সক্রেটিসের আত্মা যদি বর্তমান কোনো ব্যক্তির শরীরে থাকে) এবং পূর্বজন্মের কথা মনে না রাখতে পারে, তাহলে কি তারা একই ব্যক্তি হবে? লকের মতে, না।

লকের যুগান্তকারী উত্তর ছিল—আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের ভিত্তি হলো চেতনা (Consciousness) এবং সেই চেতনার ধারাবাহিকতা, অর্থাৎ স্মৃতি (Memory)। আমি ততক্ষণ পর্যন্ত একই ব্যক্তি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার চেতনা বা স্মৃতি অতীতের কোনো কাজ বা চিন্তাকে নিজের বলে চিনতে পারে। আমার শৈশবের স্মৃতি আছে বলেই আমি বলতে পারি যে, সেই শিশুটি আর আমি একই ব্যক্তি।

তিনি সেই বিখ্যাত রাজপুত্র ও মুচির মন-পরীক্ষার (Thought Experiment) কথা বলেন। যদি কোনো রাজপুত্রের চেতনা ও স্মৃতি একজন মুচির শরীরে আর মুচির চেতনা ও স্মৃতি রাজপুত্রের শরীরে স্থানান্তরিত হয়, তাহলে আমরা কাকে রাজপুত্র হিসেবে গণ্য করব? লক বলেন, মুচির শরীরে থাকা ব্যক্তিটিই হবে আসল রাজপুত্র, কারণ তার মধ্যেই রাজপুত্রের চেতনা ও স্মৃতির ধারাবাহিকতা রয়েছে। ব্যক্তি হলো তার চেতনা, তার শরীর বা আত্মা নয় (Locke, 1689, Book II, Ch. XXVII)।

এই ধারণাটি আইন ও নীতিশাস্ত্রের জন্য গভীর প্রভাব ফেলে। যদি কোনো ব্যক্তি স্মৃতিভ্রংশ (Amnesia) রোগে আক্রান্ত হয়ে কোনো অপরাধ করে, তাহলে কি তাকে শাস্তি দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য? যদি সে তার কাজের কোনো স্মৃতিই বহন না করে, তাহলে সে কি আর সেই একই ‘ব্যক্তি’ আছে যে অপরাধটি করেছিল? এই জটিল প্রশ্নগুলোর সাথে আজও আমরা লড়াই করছি, যার বীজ বুনেছিলেন লক।

প্রভাব, সমালোচনা ও উত্তরাধিকার (Legacy, Criticism, and Influence)

জন লকের প্রভাব এতটাই ব্যাপক ও গভীর যে তাঁকে ছাড়া আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাস কল্পনা করা কঠিন। তাঁকে প্রায়শই ‘উদারতাবাদের জনক’ (Father of Liberalism) এবং ‘অভিজ্ঞতাবাদের জনক’ (Father of Empiricism) হিসেবে অভিহিত করা হয়।

জ্ঞানদীপ্তি ও বিপ্লব: ভলতেয়ার, রুশো, মঁতেস্কু, ডেভিড হিউম জ্ঞানদীপ্তি (The Enlightenment) যুগের প্রায় সমস্ত বড় চিন্তাবিদই লকের কাছে ঋণী ছিলেন। লকের যুক্তিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, প্রাকৃতিক অধিকার এবং সীমিত সরকারের ধারণা জ্ঞানদীপ্তি আন্দোলনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল। এই চিন্তাই পরবর্তীতে আমেরিকা ও ফ্রান্সের বিপ্লবে আগুন জ্বালিয়েছিল (Zuckert, 1994)।

আধুনিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকার: আজকের বিশ্বের প্রায় সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন ব্যবস্থার গভীরে লকের দর্শন প্রোথিত। জনগণের সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন, ক্ষমতার বিভাজন (যা পরবর্তীতে মঁতেস্কু আরও বিকশিত করেন), মানবাধিকারের সুরক্ষা—এই সবকিছুই লকের চিন্তার ফসল।

মনোবিজ্ঞান: তাঁর ‘ট্যাবুলা রাসা’ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের ধারণা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের আচরণবাদ (Behaviorism) শাখার অন্যতম ভিত্তি স্থাপন করেছিল, যা মনে করে যে পরিবেশ ও শিক্ষাই মানুষের আচরণকে রূপ দেয়।

তবে এত বিশাল প্রভাব সত্ত্বেও লকের দর্শন সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়।

  • জ্ঞানতত্ত্বের সমালোচনা: বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজ (Leibniz) ‘ট্যাবুলা রাসা’র সমালোচনা করে বলেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া মনে কিছুই আসে না, ঠিক আছে, কিন্তু “স্বয়ং মন ছাড়া” (except the intellect itself)। অর্থাৎ, মন নিছক একটি সাদা কাগজ নয়, তার নিজস্ব কিছু কাঠামো বা প্রবণতা আছে যা অভিজ্ঞতাকে সংগঠিত করে। আধুনিক জ্ঞানীয় বিজ্ঞান (Cognitive Science) এবং ভাষাতত্ত্ব (যেমন নোম চমস্কির কাজ) এই ধারণাকেই সমর্থন করে যে, মানুষের ভাষা শেখার মতো কিছু ক্ষমতা জন্মগত।

  • পুঁজিবাদের দার্শনিক?: সি. বি. ম্যাকফারসনের মতো মার্ক্সবাদী সমালোচকরা লকের সম্পত্তির তত্ত্বকে ‘স্বত্বাধিকারী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ (Possessive Individualism) বলে আখ্যা দেন। তাঁদের মতে, লকের দর্শন আসলে উদীয়মান পুঁজিবাদী শ্রেণীর স্বার্থকেই রক্ষা করেছিল, যা অসীম সম্পদ আহরণ এবং বৈষম্যকে বৈধতা দেয়। মুদ্রার মাধ্যমে সম্পত্তির ওপরকার প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা তুলে দেওয়ার যুক্তিটি এই সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু (Macpherson, 1962)।

  • নারীবাদী সমালোচনা: আধুনিক নারীবাদী সমালোচকরা দেখান যে, লকের ‘ব্যক্তি’ বা ‘নাগরিক’ মূলত ছিলেন ইউরোপীয়, পুরুষ এবং সম্পত্তিওয়ালা পুরুষ। তাঁর তত্ত্বে নারী, দরিদ্র এবং দাসদের তেমন কোনো স্থান ছিল না। যদিও তিনি নারীর কিছু অধিকারের কথা বলেছেন, সামগ্রিকভাবে তাঁর রাজনৈতিক কাঠামো ছিল পিতৃতান্ত্রিক।

  • ঐতিহাসিকতার প্রশ্ন: ডেভিড হিউমের মতো দার্শনিকরা প্রশ্ন তুলেছেন, এই সামাজিক চুক্তি কি আদৌ ঐতিহাসিকভাবে কখনো ঘটেছিল? আর যদি না-ই ঘটে থাকে, তাহলে একটি কাল্পনিক চুক্তির ভিত্তিতে বর্তমান প্রজন্ম কেন কোনো সরকারকে মানতে বাধ্য থাকবে? তাদের আনুগত্যের ভিত্তি কী – একটি অলীক চুক্তি, নাকি বাস্তবতা ও উপযোগিতা?

শেষ কথা

এত সমালোচনা, এত বিতর্ক সত্ত্বেও জন লকের প্রাসঙ্গিকতা আজও অম্লান। তিনি হয়তো সব প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দিয়ে যাননি, কিন্তু তিনি আমাদের সঠিক প্রশ্নগুলো করতে শিখিয়েছেন। তিনি আমাদের হাতে এমন কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক হাতিয়ার তুলে দিয়েছেন, যা দিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের উত্তর খুঁজে নিতে পারি এবং আমাদের চারপাশের জগৎকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি।

তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, জ্ঞান আকাশ থেকে পড়ে না, তাকে অভিজ্ঞতা ও যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হয়। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, আমরা কেউ কারও দাস নই; আমাদের প্রত্যেকেরই সম্মান, স্বাধীনতা এবং নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার অধিকার আছে। সরকার আমাদের প্রভু নয়, আমাদের সম্মিলিত ইচ্ছার একটি প্রকাশ মাত্র, যার একমাত্র বৈধতা জনগণের সেবা করার মধ্যে নিহিত। একটি সরকারের অস্তিত্ব তখনই ন্যায্য, যখন তা শাসিতদের অধিকার রক্ষা করে ও তাদের সম্মতি নিয়ে চলে।

যখনই আমরা অন্যায় দেখলে প্রশ্ন তুলি, যখনই আমরা স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, যখনই আমরা ভিন্নমতকে সম্মান করতে শিখি, আর যখনই আমরা বিশ্বাস করি যে শিক্ষার আলোয় একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব—তখনই আমরা সচেতনভাবে বা অজান্তেই জন লকের দেখানো পথেই হাঁটি।

তাঁর দর্শন তাই তিন শতাব্দীরও বেশি সময় পরেও বইয়ের পাতায় আটকে থাকা কিছু নীরস তত্ত্বকথা নয়। এটি একটি জীবন্ত দর্শন, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, আমাদের অধিকারের সংগ্রামে এবং একটি শ্রেয়তর সমাজ গড়ার স্বপ্নে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। সেই যে সাদা কাগজের মতো মনের কথা তিনি বলেছিলেন, সেই সাদা কাগজে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী লিখে যাব—সুন্দর, মানবিক ও ন্যায্যতার এক গল্প, নাকি ঘৃণা ও বৈষম্যের—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুদায়িত্বটি তিনি আমাদের সকলের হাতেই দিয়ে গেছেন। আর এখানেই জন লকের আসল এবং চিরস্থায়ী উত্তরাধিকার।

তথ্যসূত্র

  • Aaron, R. I. (1971). John Locke. Oxford University Press.
  • Ashcraft, R. (1986). Revolutionary Politics and Locke’s Two Treatises of Government. Princeton University Press.
  • Becker, C. L. (1922). The Declaration of Independence: A Study in the History of Political Ideas. Harcourt, Brace and Company.
  • Chappell, V. (Ed.). (1994). The Cambridge Companion to Locke. Cambridge University Press.
  • Filmer, R. (1680). Patriarcha; or the Natural Power of Kings. Walter Davis. (Published posthumously).
  • Gough, J. W. (1957). The Social Contract: A Critical Study of its Development. Oxford University Press.
  • Hill, C. (1961). The Century of Revolution, 1603-1714. Thomas Nelson and Sons.
  • Hobbes, T. (1651). Leviathan, or the Matter, Forme, and Power of a Common-Wealth Ecclesiasticall and Civill. Andrew Crooke.
  • Locke, J. (1689). An Essay Concerning Human Understanding. (P. H. Nidditch, Ed., 1975). Oxford University Press.
  • Locke, J. (1689a). Two Treatises of Government. (P. Laslett, Ed., 1988). Cambridge University Press.
  • Locke, J. (1689b). A Letter Concerning Toleration. (J. Tully, Ed., 1983). Hackett Publishing Company.
  • Locke, J. (1693). Some Thoughts Concerning Education. (J. W. & J. S. Yolton, Eds., 1989). Clarendon Press.
  • Macpherson, C. B. (1962). The Political Theory of Possessive Individualism: Hobbes to Locke. Oxford University Press.
  • Tuck, R. (1999). The Rights of War and Peace: Political Thought and the International Order from Grotius to Kant. Oxford University Press.
  • Uzgalis, W. (2020). John Locke. In E. N. Zalta (Ed.), The Stanford Encyclopedia of Philosophy (Winter 2020 ed.). Stanford University. Retrieved from https://plato.stanford.edu/archives/win2020/entries/locke/
  • Waldron, J. (2002). God, Locke, and Equality: Christian Foundations of John Locke’s Political Thought. Cambridge University Press.
  • Zuckert, M. P. (1994). Natural Rights and the New Republicanism. Princeton University Press.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.