Table of Contents
ভূমিকা
আকাশের দিকে তাকিয়ে কখনো ভেবেছেন, এর কোনো আইনকানুন আছে কি? সূর্যটা কেন রোজ পূর্ব দিকে ওঠে আর পশ্চিমে ডোবে? কেন ভরা বর্ষায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, আর কেনই বা ঋতু বদলের সাথে সাথে প্রকৃতির রূপ পাল্টায়? এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা, প্রতিটি নক্ষত্র, সবকিছুই যেন এক অদৃশ্য, অমোঘ নিয়মের সুতোয় বাঁধা। এই নিয়ম আছে বলেই মহাবিশ্বে এক অপূর্ব শৃঙ্খলা বিরাজ করে। নিয়ম না থাকলে থাকত কেবলই বিশৃঙ্খলা, যাকে আমরা বলি ‘ক্যাওস’ (Chaos)। প্রকৃতির এই নিয়ম ভাঙার সাধ্য কারও নেই।
প্রকৃতির যেমন নিয়ম আছে, মানুষের সমাজেরও নিয়ম লাগে। মানুষ একা বাঁচতে পারে না, সে সমাজবদ্ধ জীব। কিন্তু হাজারো বা লক্ষ কোটি মানুষ একসাথে থাকতে গেলেই তৈরি হয় সংঘাতের আশঙ্কা। আমার ইচ্ছা আর আপনার ইচ্ছার মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব হয়, আমার স্বার্থ আর আপনার স্বার্থ যখন বিপরীতমুখী হয়, তখন তার সমাধান কী? এখানেই প্রয়োজন হয় নিয়মের, এক সাধারণ বিধির যা সবার জন্য প্রযোজ্য এবং যা বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত। এই নিয়মকেই আমরা বলি ‘আইন’। আইন হলো সমাজের সেই অদৃশ্য সুতো, যা আমাদের সবাইকে একসাথে বেঁধে রাখে এবং একটি কাঠামো দেয়, একটি প্রেডিক্টেবিলিটি দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আইন কে বানায়? কারা চালায়? আর সেই আইন যদি সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার বদলে কোনো এক কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছার পুতুলের মতো নাচতে শুরু করে, তখন কী হবে? যদি আইন নিজেই অত্যাচারের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হাতিয়ার হয়ে ওঠে? এই সহজ কিন্তু ভয়ংকর প্রশ্নটি এক ফরাসি ভদ্রলোককে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছিল। আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগে, এমন এক সময়ে যখন ফ্রান্সের ‘সূর্য রাজা’ চতুর্দশ লুই-এর বিখ্যাত উক্তি “L’état, c’est moi” (“আমিই রাষ্ট্র”) তখনও বাতাসে ভাসছে, যখন রাজার কথাই ছিল ঈশ্বরের কথার সমতুল্য, তখন এই প্রশ্ন তোলা ছিল এক অভাবনীয় দুঃসাহসিক কাজ। সেই ভদ্রলোকের নাম শার্ল-লুই দ্য সেকোঁদা, ব্যারন দে লা ব্রেদ এ দ্য মঁতেস্কু (Charles-Louis de Secondat, Baron de La Brède et de Montesquieu)। আমরা অবশ্য তাঁকে এত বড় নামে ডাকার জটিলতায় না গিয়ে ভালোবেসে ডাকি শুধু ‘মঁতেস্কু’ (Montesquieu) বলে।
তিনি ছিলেন একাধারে একজন বিচারক, লেখক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক দার্শনিক। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ক্ষমতাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শিখিয়েছিলেন। ক্ষমতাকে ভয় পেয়ে দূরে থাকতে নয়, বরং তাকে একজন শল্যচিকিৎসকের মতো ব্যবচ্ছেদ করে তার ভেতরের কার্যকারণ বুঝতে শিখিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন, ক্ষমতা একটি ভয়ঙ্কর শক্তি, যার নিজস্ব এক নিয়ম আছে, নিজস্ব এক গতি আছে। একে লাগামছাড়া ছেড়ে দিলে এটি সবকিছু গ্রাস করে, সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। অনেকটা দাবার ছকের মতো। রাজা, মন্ত্রী, গজ, ঘোড়া – সবার চাল নির্দিষ্ট, সবার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। কেউ নিজের ক্ষমতার বাইরে এক পা-ও ফেলতে পারে না। গেলেই খেলা নষ্ট। মঁতেস্কু চেয়েছিলেন রাষ্ট্রের ক্ষমতাকেও ঠিক ওরকম এক দাবার ছকের মতো নিয়মে বেঁধে ফেলতে, যেখানে কোনো একটি ঘুঁটিই সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে পারবে না।
আজ আমরা তাঁর সেই জগৎবিখ্যাত দর্শন নিয়ে এক দীর্ঘ এবং গভীর গল্পে ডুব দেব। চেষ্টা করব সহজ ভাষায় বুঝতে, কেন জ্ঞানদীপ্তির (The Enlightenment) যুগের এই চিন্তানায়ক আজও এত প্রাসঙ্গিক। কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতা থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর কোনো আইনের ছাত্র পর্যন্ত, সবাই তাঁর কাছে কোনো না কোনোভাবে ঋণী।
কে ছিলেন এই মঁতেস্কু? এক অভিজাত বিচারকের বেড়ে ওঠা
কোনো মানুষের দর্শন বুঝতে হলে আগে মানুষটাকে এবং তাঁর সময়টাকে একটু চেনা দরকার। মঁতেস্কুর জন্ম ১৬৮৯ সালে, ফ্রান্সের বর্দো (Bordeaux) শহরের কাছে শ্যাতো দে লা ব্রেদ (Château de La Brède) নামক এক সুরম্য প্রাসাদে। তিনি জন্মেছিলেন এক অভিজাত পরিবারে, তবে তাঁর পরিবার প্রচলিত তলোয়ারধারী সামরিক অভিজাতদের (noblesse d’épée) মতো ছিল না, যারা বংশপরম্পরায় যুদ্ধ করে খ্যাতি ও জমিদারি পেয়েছেন। তারা ছিলেন ‘noblesse de robe’ বা ‘পোশাকী অভিজাত’—অর্থাৎ, যে পরিবারের সদস্যরা বংশপরম্পরায় বিচারক বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে অভিজাতের মর্যাদা পেয়েছেন। এই পারিবারিক পরিমণ্ডলটি তাঁর চিন্তাভাবনা গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তিনি ছোটবেলা থেকেই আইন, বিচার আর প্রশাসনের জটিল জগৎটাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন; দেখেছিলেন কীভাবে আইন তৈরি হয়, কীভাবে তার ব্যাখ্যা হয় এবং কীভাবে তা প্রয়োগ করা হয়।
তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় বিখ্যাত ওরেটোরিয়ান কলেজ অফ জুইলিতে (College of Juilly), যা ছিল তৎকালীন ফ্রান্সের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে তিনি ধ্রুপদী সাহিত্য, ল্যাটিন, ইতিহাস এবং দর্শনের উপর গভীর জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি বর্দো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি নেন এবং প্যারিসে গিয়ে আইন পেশার চর্চা শুরু করেন। ১৭০৮ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি ব্যারন দে লা ব্রেদ উপাধি লাভ করেন এবং পারিবারিক জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর কয়েক বছর পর, ১৭১৬ সালে, তিনি তাঁর নিঃসন্তান আংকলেএ কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস পান: একটি বিশাল সম্পত্তি এবং বর্দো পার্লেমেন্ট (Parlement of Bordeaux)-এর ‘প্রেসিডেন্ট এ মর্টিয়ের’ (président à mortier) বা প্রধান বিচারকের পদ।
এই ‘পার্লেমেন্ট’ আজকের দিনের মতো আইন প্রণয়নকারী সংসদ ছিল না। এটি ছিল মূলত ফ্রান্সের প্রাদেশিক উচ্চ আদালত, যার বিচারিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল প্রচুর। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ছিল droit de remontrance বা রাজকীয় ডিক্রি বা আইনকে নিবন্ধন করার আগে তার বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর অধিকার। যদিও রাজা চাইলেই এই আপত্তি অগ্রাহ্য করতে পারতেন, তবুও এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটি বাধা। এই বিচারকের আসনে বসে মঁতেস্কু প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি দেখেছিলেন কীভাবে ক্ষমতা মানুষের চরিত্রকে বদলে দেয়, কীভাবে আইনের জটিল মারপ্যাঁচে শক্তিশালীরা সবসময় পার পেয়ে যায় আর দুর্বলদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তিনি ফরাসি বিচারব্যবস্থার অসংগতি, দুর্নীতি এবং রাজার একচ্ছত্র আধিপত্যের কুফলগুলো নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর মনে আইনের প্রকৃতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়।
কিন্তু মঁতেস্কু কেবল আদালত আর বইয়ের জগতেই আটকে থাকার মানুষ ছিলেন না। তাঁর ছিল জানার এক অদম্য কৌতূহল। ১৭১৭ সালে তিনি বর্দো একাডেমি অফ সায়েন্স-এর সদস্য হন, যেখানে তিনি শারীরবিদ্যা থেকে শুরু করে পদার্থবিজ্ঞান, এমনকি ঝিনুকের প্রজনন নিয়েও গবেষণাপত্র পাঠ করেন। এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক চিন্তায় গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি মানব সমাজকেও একটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কার্যকারণ সম্পর্ক দিয়ে বুঝতে চেয়েছিলেন।
১৭২১ সালে তাঁর প্রথম সাড়া জাগানো বই ‘পার্সিয়ান লেটার্স’ (Persian Letters বা ফরাসিতে Lettres persanes) ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। এটি ছিল একটি ছদ্মবেশী ব্যাঙ্গাত্মক উপন্যাস। তিনি দুজন কাল্পনিক পারস্যদেশীয় পর্যটক, উজবেক এবং রিকার চোখে তৎকালীন ফরাসি সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম এবং সংস্কৃতির তীব্র সমালোচনা করেন। রাজার অসীম ক্ষমতা, অভিজাতদের অন্তঃসারশূন্য জীবন, পোপের কর্তৃত্ব এবং সামাজিক ভণ্ডামিকে তিনি শাণিত বিদ্রূপের কষাঘাতে জর্জরিত করেন। যেমন, এক চিঠিতে রিকা লেখে, “রাজা একজন মহান জাদুকর… তিনি যদি বলেন এক মিলিয়ন ক্রাউন মূল্যের এক টুকরো কাগজ মূল্যবান, তবে মানুষ তাই বিশ্বাস করে।” এটি ছিল কাগজের মুদ্রা নিয়ে জন ল-এর অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির প্রতি তীব্র কটাক্ষ। যেহেতু সমালোচনাটি ভিনদেশিদের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছিল, তাই তিনি সরাসরি রাজার রোষানল থেকে বাঁচতে পেরেছিলেন। এই বইটি তাঁকে রাতারাতি প্যারিসের বুদ্ধিজীবী মহলে বিখ্যাত করে তোলে।
বিচারকের একঘেয়ে কাজ তাঁর আর ভালো লাগছিল না। জানার ক্ষুধা তাঁকে টানছিল বাইরের জগতের দিকে। ১৭২৬ সালে তিনি তাঁর বিচারকের লাভজনক পদটি বিক্রি করে দেন এবং ইউরোপ ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েন। তিনি অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণগুলো ছিল তাঁর জীবনের এক সন্ধিক্ষণ। তিনি নিছক পর্যটকের মতো ঘুরে বেড়াননি, বরং একজন সমাজবিজ্ঞানীর অনুসন্ধিৎসা নিয়ে প্রতিটি দেশের শাসনব্যবস্থা, তাদের আইন, মানুষের রীতিনীতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। ইতালিতে তিনি দেখেছিলেন প্রাচীন রোমান প্রজাতন্ত্রের ধ্বংসাবশেষ আর শিল্পের মহিমা। কিন্তু তাঁকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল ইংল্যান্ড, যেখানে তিনি প্রায় দেড় বছর কাটান। তিনি সেখানে দেখেন এক জীবন্ত সংসদ, যেখানে রাজার ক্ষমতা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়; দেখেন স্বাধীন সংবাদপত্র, যা সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে ভয় পায় না; দেখেন জুরি ব্যবস্থা, যেখানে সাধারণ নাগরিকেরা বিচারের অংশীদার। এই নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিবেশ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, যা তাঁর মাতৃভূমি ফ্রান্সের নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। এই ভ্রমণলব্ধ জ্ঞানই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ, তাঁর magnum opus-এর ভিত্তি স্থাপন করে।
দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছরের গবেষণা ও পরিশ্রমের পর ১৭৪৮ সালে জেনেভা থেকে বেনামে প্রকাশিত হয় সেই গ্রন্থ—‘দ্য স্পিরিট অব দ্য লজ’ (The Spirit of the Laws বা ফরাসিতে L’Esprit des lois)। এই একটি বই-ই রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে তাঁকে অমর করে রেখেছে। চলুন, এবার আমরা সেই বইয়ের গভীর জগতে প্রবেশ করি।
মঁতেস্কু সাহেবের দর্শনের রেসিপি: কী কী মসলা মিশেছিল সেই চিন্তার হেঁশেলে?
কোনো বড় আইডিয়া, কোনো যুগান্তকারী চিন্তা কি আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে? নাকি এর পেছনে থাকে লম্বা এক প্রস্তুতি? অনেকটা পাকা রাঁধুনির রান্নার মতো। সেরা খাসির রেজালা বানাতে যেমন লাগে বাছাই করা মাংস, ঠিকঠাক পরিমাণ মসলা, আর সঠিক আঁচে লম্বা সময় ধরে রান্না করার ধৈর্য—সেরা দর্শনও ঠিক তেমনি। এর জন্য লাগে সময়ের চাহিদা, আগের দিনের চিন্তার নির্যাস আর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে খুঁটিয়ে দেখার মতো একজোড়া সজাগ চোখ।
আমাদের মঁতেস্কু সাহেব ছিলেন সেই রকমই একজন দার্শনিক শেফ। তাঁর জগৎবিখ্যাত ‘ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি’ (Separation of Powers) বা ‘আইনের আত্মা’র (The Spirit of the Laws) ধারণাগুলো রাতারাতি তাঁর মাথায় গজিয়ে ওঠেনি। এর পেছনে ছিল এক বিশাল আয়োজন। সেই আয়োজনের কিছু উপাদান ছিল তেতো, কিছু ছিল মিষ্টি। কিছু এসেছিল তাঁর নিজের দেশ ফ্রান্সের রাজনৈতিক রান্নাঘর থেকে, আর কিছু মসলা তিনি ধার করেছিলেন গ্রিস, রোম আর ইংল্যান্ডের মতো দূরের দেশ থেকে।
এখন আমরা সেই হেঁশেলে একটু উঁকি দেব। দেখব, কোন কোন উপাদান মিশে তৈরি হয়েছিল মঁতেস্কুর সেই কালজয়ী দর্শন, যা আজও দুনিয়াজুড়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রেসক্রিপশন হিসেবে কাজ করে।
ফ্রান্সের তেতো বাস্তবতা: যখন রাজা মানেই রাষ্ট্র
কোনো চিন্তাবিদকে বুঝতে হলে তাঁর সময়টাকে বুঝতে হয়। মঁতেস্কু জন্মেছিলেন এমন এক ফ্রান্সে, যার নিশ্বাসে মিশে ছিল একজনেরই ক্ষমতার দাপট। তিনি ‘সূর্য রাজা’ চতুর্দশ লুই (Louis XIV)। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল, “L’état, c’est moi” – অর্থাৎ, “আমিই রাষ্ট্র।” তাঁর সময়ে ফ্রান্স হয়ে উঠেছিল নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের (Absolute Monarchy) এক নিখুঁত উদাহরণ।
ব্যাপারটা কেমন ছিল?
ধরুন, একটা দেশের সমস্ত ক্ষমতা—আইন বানানো, আইন প্রয়োগ করা, বিচার করা, কর বসানো, যুদ্ধ ঘোষণা করা—সবকিছুই একজনের হাতে। তিনি যা বলবেন, সেটাই আইন। তাঁর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। তাঁর ক্ষমতার উৎস ঈশ্বর, তাই তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। এটাই ছিল চতুর্দশ লুইয়ের ফ্রান্স।
মঁতেস্কু খুব কাছ থেকে এই ব্যবস্থার কুফলগুলো দেখেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন, কীভাবে রাজার সীমাহীন ক্ষমতা অভিজাতদের (Nobility) মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। একসময় ফরাসি অভিজাতরা ছিলেন রাজার ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক বড় বাধা। তাঁদের নিজস্ব দুর্গ, নিজস্ব সৈন্য এবং প্রভাব ছিল। কিন্তু চতুর্দশ লুই তাঁদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে এক জমকালো খাঁচায় বন্দী করে ফেললেন। সেই খাঁচার নাম ভার্সাই প্রাসাদ (Palace of Versailles)। অভিজাতরা সেখানে রাজার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য একে অপরের সাথে চাটুকারিতায় লিপ্ত থাকতেন। তাঁদের তলোয়ারের ধার কমে গিয়ে পোশাকের বাহার বেড়ে গিয়েছিল।
মঁতেস্কু বুঝেছিলেন, রাজা আর সাধারণ মানুষের মাঝে যে ‘মধ্যবর্তী সংস্থাগুলো’ (Intermediate Bodies) ছিল—যেমন, শক্তিশালী অভিজাত শ্রেণি, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীন পৌরসভা—সেগুলোকে দুর্বল করে দেওয়ার ফলেই রাজার ক্ষমতা এমন লাগামছাড়া হয়ে গেছে (Rahe, 2009)। এই মধ্যবর্তী শক্তিগুলো অনেকটা গাড়ির শক অ্যাবজর্বারের মতো কাজ করে। এরা রাষ্ট্রের ঝাঁকুনি সামলায় এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে সরাসরি চাপ পড়তে দেয় না। এগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে রাজা আর প্রজার সম্পর্কটা হয়ে যায় সরাসরি, এবং ভয়ংকর।
চতুর্দশ লুইয়ের মৃত্যুর পর যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেটাও মঁতেস্কুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর প্রথম বিখ্যাত বই ‘পার্সিয়ান লেটার্স’ (Persian Letters, 1721) ছিল এই অবক্ষয় হতে থাকা ফরাসি সমাজের এক তীব্র শ্লেষাত্মক ছবি। তিনি দেখিয়েছিলেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা শুধু প্রজাদের জন্যই খারাপ নয়, এটি পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকেই ভেতর থেকে ঘুণে ধরিয়ে দেয়।
এ ছাড়া, মঁতেস্কু নিজে ছিলেন একজন বিচারক। তিনি বর্দো শহরের ‘পার্লেমেন্ট’ (Parlement of Bordeaux) বা উচ্চ আদালতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই পার্লেমেন্টগুলো ছিল রাজার ক্ষমতাকে সীমিত রাখার শেষ উপায়। তাদের ক্ষমতা ছিল রাজকীয় আইন বা ডিক্রি নিবন্ধন করার আগে সেটিকে পর্যালোচনা করা এবং প্রয়োজনে আপত্তি জানানো, যাকে বলা হতো ‘remonstrance’। যদিও রাজা চাইলেই এই আপত্তি অগ্রাহ্য করতে পারতেন, তবুও এটি ছিল ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটি প্রাতিষ্ঠানিক উপায়। এই বিচারকের আসনে বসেই তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের বিপদটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এমন কোনো ব্যবস্থা কি তৈরি করা যায় না, যেখানে ক্ষমতা ক্ষমতার অপব্যবহার করতে চাইলেও অন্য কোনো ক্ষমতা এসে তার হাত চেপে ধরবে?
এই তেতো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাই ছিল মঁতেস্কুর দর্শনের প্রধান কাঁচামাল। তিনি এমন এক সমাধান খুঁজছিলেন, যা ফ্রান্সকে স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
দার্শনিকদের মসলাদানি: পূর্বসূরীদের চিন্তা
মঁতেস্কু শূন্য থেকে শুরু করেননি। তাঁর আগে আরও অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ রাষ্ট্র আর ক্ষমতা নিয়ে ভেবেছেন। তিনি সেইসব পুরোনো ভাবনাকে নতুন করে চেখে দেখেছেন, কিছু গ্রহণ করেছেন, কিছু বর্জন করেছেন, আর নিজের মতো করে মিশিয়ে এক নতুন রেসিপি তৈরি করেছেন।
প্রাচীন গ্রিস ও রোমের ছোঁয়া: মঁতেস্কু ছিলেন ক্লাসিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি প্রাচীন গ্রিস ও রোমের ইতিহাস ও দর্শন খুব ভালোভাবে জানতেন।
-
অ্যারিস্টটল (Aristotle): রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল সর্বপ্রথম সরকারগুলোকে একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভাগ করার চেষ্টা করেন। তিনি তিনটি ভালো সরকার (রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, পলিটি) এবং তাদের তিনটি বিকৃত রূপের (স্বৈরতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, গণতন্ত্র) কথা বলেন। অ্যারিস্টটল শুধু আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দেননি, তিনি বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করতেন কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা কোন পরিস্থিতিতে ভালো কাজ করে। মঁতেস্কু অ্যারিস্টটলের এই অভিজ্ঞতাবাদী বা প্রায়োগিক (Empirical) পদ্ধতিটি গ্রহণ করেছিলেন। তিনিও আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন না দেখে বাস্তব দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের আইন ও শাসনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে তার পেছনের কার্যকারণ সম্পর্ক (Causal Relationship) খুঁজেছিলেন (Pangle, 1973)।
-
পলিবিয়াস (Polybius) ও সিসেরো (Cicero): রোমান প্রজাতন্ত্রের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গ্রিক ঐতিহাসিক পলিবিয়াস এক চমৎকার ধারণা দিয়েছিলেন। তা হলো ‘মিশ্র সংবিধান’ (Mixed Constitution)। তাঁর মতে, রোমের শক্তির রহস্য ছিল তার শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্র (কনসালদের ক্ষমতা), অভিজাততন্ত্র (সিনেটের ক্ষমতা) এবং গণতন্ত্রের (জনগণের অ্যাসেম্বলির ক্ষমতা) এক অপূর্ব মিশ্রণ। এই তিনটি শক্তি একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করত, ফলে কোনো একটি শক্তিই নিরঙ্কুশ হয়ে উঠতে পারত না। রোমান দার্শনিক সিসেরোও এই ধারণার বড় সমর্থক ছিলেন। এই ‘মিশ্র সংবিধানের’ ধারণাটিই কিন্তু মঁতেস্কুর ‘ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ’ ও ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য’ (Checks and Balances) নীতির এক আদি সংস্করণ।
আধুনিক চিন্তার প্রভাব: ম্যাকিয়াভেলি থেকে লক
-
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolò Machiavelli): ম্যাকিয়াভেলিকে প্রথম আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলা হয়। তিনি রাজনীতিকে ধর্ম ও নৈতিকতার জগৎ থেকে আলাদা করে দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, ক্ষমতা দখলের এবং ধরে রাখার নিজস্ব এক নিষ্ঠুর যুক্তি আছে। মঁতেস্কু ম্যাকিয়াভেলির মতো নিষ্ঠুরতার সমর্থক ছিলেন না, কিন্তু তিনি তাঁর কাছ থেকে এই বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিটা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, শুধু ভালো ভালো উপদেশ দিয়ে ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ক্ষমতার মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
-
জন লক (John Locke): মঁতেস্কুর উপর যদি কোনো একক দার্শনিকের সবচেয়ে বেশি প্রভাব থাকে, তিনি হলেন ইংরেজ দার্শনিক জন লক। লকের দুটি বই (Two Treatises of Government, 1689) ছিল মঁতেস্কুর জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা। লক বলেছিলেন:
-
মানুষের কিছু প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Rights) আছে—জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি। সরকার এই অধিকারগুলো রক্ষা করার জন্যই তৈরি হয়েছে।
-
সরকার শাসিতদের সম্মতির (Consent of the Governed) উপর ভিত্তি করে তৈরি। শাসকেরা যদি অত্যাচারী হয়ে ওঠে, তবে জনগণের অধিকার আছে সেই সরকারের পতন ঘটানোর।
-
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লক-ই প্রথম স্পষ্টভাবে সরকারের ক্ষমতাকে ভাগ করার কথা বলেন। তিনি তিনটি বিভাগের কথা বলেছিলেন: আইন বিভাগ (Legislative), যা আইন তৈরি করবে; নির্বাহী বিভাগ (Executive), যা আইন প্রয়োগ করবে; এবং ফেডারেটিভ বিভাগ (Federative), যা বৈদেশিক সম্পর্ক (যুদ্ধ, শান্তি, চুক্তি) দেখাশোনা করবে (Locke, 1689/1988)।
মঁতেস্কু লকের এই কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই তাঁর নিজের তত্ত্ব দাঁড় করান। কিন্তু তিনি দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। প্রথমত, তিনি লকের ফেডারেটিভ ক্ষমতাকে নির্বাহী বিভাগের সাথেই যুক্ত করেন। দ্বিতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তিনি বিচার বিভাগকে (Judicial Power) একটি সম্পূর্ণ আলাদা, স্বাধীন এবং সমান গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। লকের তত্ত্বে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগের অংশ ছিল। মঁতেস্কুই প্রথম বলেন যে, নাগরিকদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। এটিই ছিল লকের ধারণার উপর মঁতেস্কুর সবচেয়ে বড় এবং মৌলিক অবদান (Bok, 2018)।
-
ইংল্যান্ডের জীবন্ত উদাহরণ: যখন তত্ত্ব বাস্তবে রূপ নেয়
বইপত্রে তো অনেক তত্ত্ব পড়া যায়। কিন্তু সেই তত্ত্ব যখন চোখের সামনে বাস্তবে কাজ করতে দেখা যায়, তার প্রভাব হয় অনেক বেশি। মঁতেস্কুর জন্য সেই জীবন্ত উদাহরণ ছিল ইংল্যান্ড।
১৭২৯ থেকে ১৭৩১ সাল পর্যন্ত তিনি ইংল্যান্ডে কাটান। এই ভ্রমণ তাঁর চোখ খুলে দেয়। ফ্রান্সে তিনি দেখে এসেছিলেন রাজার কথাই আইন। আর ইংল্যান্ডে এসে দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য!
- রাজা আছেন, কিন্তু তাঁর ক্ষমতা অসীম নয়। তাঁর ক্ষমতা পার্লামেন্টের আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ।
- পার্লামেন্টে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে। সরকারের সমর্থক এবং বিরোধী দল—দু’পক্ষই নিজেদের যুক্তি তুলে ধরছে।
- সংবাদপত্রগুলো স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা করছে।
- সাধারণ মানুষের বিচার হচ্ছে জুরির (Jury) মাধ্যমে, যেখানে তারই মতো সাধারণ নাগরিকেরা রায় দিচ্ছেন।
তিনি যা এতদিন ধরে বইয়ে পড়ছিলেন বা তত্ত্ব হিসেবে ভাবছিলেন, তার এক বাস্তব রূপ তিনি ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থায় খুঁজে পেলেন। তিনি দেখলেন, কীভাবে হাউস অফ কমন্স (জনগণের প্রতিনিধি), হাউস অফ লর্ডস (অভিজাতদের প্রতিনিধি) এবং রাজা একে অপরের উপর নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় রেখে দেশ চালাচ্ছে। এই ব্যবস্থা যে নিখুঁত ছিল তা নয়, এবং মঁতেস্কু হয়তো একে কিছুটা আদর্শায়িত করে দেখেছিলেন (Shackleton, 1961)। কিন্তু তাঁর কাছে এটি ফ্রান্সের নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের চেয়ে হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের এই অভিজ্ঞতা তাঁর তত্ত্বকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। এটি সঠিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ফল। যে দেশে ক্ষমতা বিভক্ত এবং ভারসাম্যপূর্ণ, সে দেশেই স্বাধীনতা টিকে থাকতে পারে। তাঁর বিখ্যাত The Spirit of the Laws বইয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত অধ্যায়টিই (Book 11, Chapter 6) হলো ইংল্যান্ডের সংবিধানের উপর, যদিও তিনি সরাসরি ইংল্যান্ডের নাম খুব বেশি ব্যবহার করেননি।
সেই আশ্চর্য রেসিপি
তাহলে মঁতেস্কুর দর্শনের রেসিপিটা কী দাঁড়াল?
মূল উপাদান ছিল তাঁর নিজের দেশের তেতো অভিজ্ঞতা—ফ্রান্সের নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের ভয়াবহতা। এর সাথে তিনি মেশালেন প্রাচীন গ্রিস ও রোমের জ্ঞান—অ্যারিস্টটলের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আর পলিবিয়াসের মিশ্র সংবিধানের ধারণা। এই মিশ্রণে তিনি যোগ করলেন আধুনিক চিন্তার মসলা—বিশেষ করে জন লকের ক্ষমতা ভাগের ধারণা। আর সবশেষে, ইংল্যান্ডের বাস্তব উদাহরণ দিয়ে পুরো রেসিপিটাকে ভালোভাবে কষিয়ে নিলেন।
ফলাফল? এক অপূর্ব রাজনৈতিক দর্শন, যা বলে যে কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা থাকা বিপজ্জনক। স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে ক্ষমতাকে ভাগ করতে হবে, এবং প্রতিটি ভাগকে এমন ক্ষমতা দিতে হবে যাতে সে অন্য ভাগকে চোখে চোখে রাখতে পারে।
মঁতেস্কু কোনো বিপ্লবী ছিলেন না। তিনি রাতারাতি রাজতন্ত্র ধ্বংস করে দিতে বলেননি। তিনি ছিলেন একজন সংস্কারক, একজন বাস্তববাদী চিকিৎসক। তিনি সমাজের রোগটা সঠিকভাবে নির্ণয় করেছিলেন এবং তার নিরাময়ের পথ বাতলেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, ভালো প্রতিষ্ঠান ছাড়া ভালো মানুষের সদিচ্ছা দিয়ে একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না।
তাই পরেরবার যখন কোনো দেশের সংবিধানে আইন, নির্বাহী আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা পড়বেন, তখন একবার মঁতেস্কু সাহেবের কথা স্মরণ করবেন। এই সহজ কিন্তু শক্তিশালী ধারণাটি আমাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাঁকে অনেক পথ হাঁটতে হয়েছিল, অনেক তেতো অভিজ্ঞতা গিলতে হয়েছিল আর অনেক রাতের ঘুম নষ্ট করে পুরোনো জ্ঞানীদের বইয়ের পাতা ওল্টাতে হয়েছিল। তাঁর সেই পরিশ্রমের ফলেই আজ আমরা ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে শিখেছি—ভয় পেতে নয়।
আইনের আত্মা (The Spirit of the Laws): এক বৈপ্লবিক ধারণা
বইটির নামটাই তো অদ্ভুত এবং কাব্যিক। আইনের আবার আত্মা থাকে নাকি? আইন তো কিছু শুষ্ক, কঠোর নিয়মকানুনের সমষ্টি। মঁতেস্কু বললেন, না, এখানেই আমাদের বুঝতে ভুল হয়। প্রতিটি দেশের আইনের পেছনে একটি ‘আত্মা’ বা ‘স্পিরিট’ (Spirit) কাজ করে। এই আত্মাটি কী? এটি কোনো রহস্যময় বা অতিপ্রাকৃত বিষয় নয়। এই আত্মা হলো সেই দেশের ভৌত ও সামাজিক পরিবেশের এক জটিল সম্পর্কের জাল। মঁতেস্কুর মতে, একটি দেশের আইনকে বুঝতে হলে তাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না। তাকে দেখতে হবে সেই দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে। আইন হলো একটি নির্ভরশীল চলক (dependent variable), যা অন্যান্য অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। এই প্রেক্ষাপটের উপাদানগুলো হলো:
-
জলবায়ু ও ভূগোল: দেশের আবহাওয়া কেমন—শীতল, উষ্ণ না নাতিশীতোষ্ণ? মাটি উর্বর না অনুর্বর? দেশটি কি সমতল, পাহাড়ি, নাকি দ্বীপবেষ্টিত? এই ভৌত কারণগুলো মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠনে প্রভাব ফেলে।
-
অর্থনীতি: দেশের মানুষ কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করে? তারা কি শিকারি, কৃষক, বণিক না শিল্পজীবী? একটি বাণিজ্যিক জাতির আইন আর একটি কৃষিভিত্তিক জাতির আইন এক হতে পারে না।
-
ধর্ম: মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের নৈতিকতা, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক আচরণকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
-
রীতিনীতি ও ঐতিহ্য (Mœurs et Manières): দেশের মানুষের বহুদিনের চলে আসা আচার-আচরণ, অভ্যাস এবং অলিখিত নৈতিকতার মানদণ্ড কেমন? অনেক সময় এই অলিখিত নিয়মগুলো লিখিত আইনের চেয়েও শক্তিশালী হয়।
-
জনসংখ্যা: দেশের জনসংখ্যা কম না বেশি? জনসংখ্যার ঘনত্বও আইনের প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে।
-
শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি: সরকারটি কি প্রজাতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক না স্বৈরাচারী? কারণ আইন সরকারের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়।
এই সমস্ত উপাদানের সম্মিলিত মিথস্ক্রিয়াই একটি দেশের আইনের ‘আত্মা’ বা মূল চরিত্রকে গঠন করে (Montesquieu, 1748/1989)। মঁতেস্কু এখানে যা করতে চেয়েছেন, তা হলো রাজনৈতিক দর্শনের জগৎ থেকে আইনকে নামিয়ে এনে সমাজবিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে স্থাপন করা। তিনি প্লেটো বা হবসের মতো আদর্শ আইন কী হওয়া উচিত, তা বলার চেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন বাস্তব পৃথিবীতে আইন কেন এমন হয়, তা ব্যাখ্যা করতে। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসকের মতো, যিনি কোনো ঔষধ দেওয়ার আগে রোগীর শরীর, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেন।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: একজন দক্ষ দর্জি যেমন একজন মানুষের মাপ না নিয়ে তার জন্য পোশাক তৈরি করতে পারেন না, তেমনি একজন আইনপ্রণেতাও একটি দেশের সামাজিক-ভৌগোলিক পরিস্থিতি না বুঝে তার জন্য উপযুক্ত আইন তৈরি করতে পারেন না। শীতের দেশের মানুষের জন্য যে মোটা পশমি পোশাক আরামদায়ক, গরমের দেশের মানুষের জন্য তা অত্যাচার। তেমনি, একটি ছোট, সমভূমির কৃষিভিত্তিক দেশের জন্য যে আইন কার্যকর, তা একটি বিশাল, পার্বত্য, বাণিজ্যিক দেশের উপর হুবহু চাপিয়ে দিলে তা খাপ খাবে না।
এই সহজ কিন্তু গভীর সত্যটি সে যুগে ছিল এক বৈপ্লবিক ধারণা। কারণ তৎকালীন ইউরোপের শাসকেরা, বিশেষ করে ফ্রান্সের রাজা, মনে করতেন ‘রাজার ইচ্ছাই আইন’। আইন হলো শাসকের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ। মঁতেস্কু এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করলেন। তিনি বললেন, আইন শাসকের ব্যক্তিগত খামখেয়ালিপনার প্রকাশ নয়, বরং তা একটি দেশের বহুদিনের গড়ে ওঠা বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আইন আকাশ থেকে পড়ে না, তা সমাজের মাটি থেকে জন্মায়। এই যুক্তিবাদী এবং প্রায়-সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল মঁতেস্কুর সবচেয়ে বড় অবদান।
এই মূল ধারণাটিকে কেন্দ্র করেই তিনি তাঁর দুটি বিশ্ববিখ্যাত তত্ত্ব দিয়েছিলেন। একটি হলো ‘ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি’ এবং অন্যটি হলো ‘জলবায়ু তত্ত্ব’। তবে তার আগে, আইন যে সরকারের ধরনের উপর নির্ভরশীল, সেই সরকারের প্রকারভেদ নিয়ে তাঁর ভাবনাটা একটু বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।
সরকার কত প্রকার ও কী কী: মঁতেস্কুর চোখে
আমরা ছোটবেলায় পড়েছি, সরকার নানা প্রকারের হয়—গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ইত্যাদি। অ্যারিস্টটলও সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছিলেন। মঁতেস্কুও সরকারকে তিনটি মূল ভাগে ভাগ করেছিলেন, তবে তাঁর ভাগ করার ভিত্তিটা ছিল অনন্য। তিনি শুধু সরকারের বাহ্যিক কাঠামো (কে শাসন করে?) দেখেননি, তিনি প্রতিটি শাসনব্যবস্থার ভেতরের চালিকাশক্তি বা মনস্তাত্ত্বিক ‘নীতি’ (Principle) কী, তা খুঁজেছিলেন। এই নীতিটিই সরকারকে সজীব ও কর্মক্ষম রাখে, আর এর অবক্ষয়ের সাথেই সরকারের পতন শুরু হয়।
১. প্রজাতন্ত্র (Republic): এই ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা (Sovereign Power) সমগ্র জনগণের হাতে (গণতন্ত্র বা Democracy) অথবা জনগণের একটি নির্দিষ্ট অভিজাত অংশের হাতে (অভিজাততন্ত্র বা Aristocracy) ন্যস্ত থাকে।
-
চালিকাশক্তি বা নীতি (Principle): ‘সদ্গুণ’ বা ‘রাজনৈতিক পুণ্য’ (Virtue)। মঁতেস্কুর কাছে এই Virtue মানে ব্যক্তিগত ধার্মিকতা বা সততা নয়। এর অর্থ আরও গভীর ও রাজনৈতিক। এটি হলো দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, সাম্যের প্রতি অনুরাগ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, দেশের স্বার্থকে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার মানসিকতা। নাগরিকেরা যদি এই রাজনৈতিক পুণ্য ধারণ না করে, যদি তারা শুধু নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে প্রজাতন্ত্র টিকতে পারে না। যখন এই Virtue ক্ষয় হতে শুরু করে, তখন গণতন্ত্রে দেখা দেয় ‘চরম সাম্যের মনোভাব’ (spirit of extreme equality)—যেখানে নাগরিকেরা আর কোনো কর্তৃপক্ষকে সম্মান করে না, যা দেশে বিশৃঙ্খলা ও স্বৈরাচারের জন্ম দেয়। আর অভিজাততন্ত্রে Virtue-র অবক্ষয় মানে হলো, শাসকেরা আর সংযমী না থেকে প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করে। মঁতেস্কুর মতে, এই Virtue জন্মগতভাবে মানুষের মধ্যে আসে না; একে কঠোর শিক্ষা ও আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হয়। এজন্যই একটি সফল প্রজাতন্ত্রের জন্য সুশিক্ষিত এবং নীতিবান নাগরিক অপরিহার্য। তিনি প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স এবং রোমান প্রজাতন্ত্রকে (তার স্বর্ণযুগে) এর উদাহরণ হিসেবে দেখতেন (Pangle, 1973)।
২. রাজতন্ত্র (Monarchy): এখানে একজন মাত্র ব্যক্তি (রাজা) শাসন করেন, কিন্তু তিনি একা এবং নিজের ইচ্ছামত শাসন করেন না। তিনি পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত এবং অপরিবর্তনীয় আইনের মাধ্যমে শাসন করেন। তাঁর ক্ষমতা অসীম নয়, বরং আইন দ্বারা এবং অন্যান্য সামাজিক শক্তির দ্বারা সীমাবদ্ধ।
-
চালিকাশক্তি বা নীতি (Principle): ‘সম্মান’ বা ‘মর্যাদাবোধ’ (Honor)। এখানে দেশপ্রেম বা Virtue প্রধান নয়। এখানকার চালিকাশক্তি হলো প্রতিটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নিজ নিজ মর্যাদা, গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষা। রাজা একা দেশ চালান না। তাঁর নীচে থাকে বিভিন্ন ‘মধ্যবর্তী সংস্থা’ (Intermediate Bodies) যেমন—শক্তিশালী অভিজাত শ্রেণি (Nobility), প্রভাবশালী পাদ্রী সম্প্রদায় (Clergy) এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক আদালত (Parlements)। এই প্রত্যেক গোষ্ঠীর নিজস্ব সম্মান, মর্যাদা এবং বিশেষ অধিকার (Privilege) থাকে। তারা রাজার সেবা করে দেশের জন্য নয়, বরং নিজেদের সম্মান, পদমর্যাদা এবং গৌরব বৃদ্ধির জন্য। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গোষ্ঠীর সম্মান রক্ষায় তৎপর থাকে। এই প্রতিযোগিতামূলক সম্মানবোধই পুরো কাঠামোটিকে একটি গতিশীল ভারসাম্য দেয় এবং প্রকারান্তরে রাজার ক্ষমতাকে একটি সীমার মধ্যে রাখে। অভিজাতরা রাজার স্বৈরাচারী হওয়ার পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করে, কারণ রাজার কোনো পদক্ষেপ যদি তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তবে তারা নিজেদের সম্মান রক্ষার্থেই তার বিরোধিতা করবে। আইন এখানে রাজার ইচ্ছার চেয়েও বড়, কারণ এই আইনই সকলের সম্মান ও অধিকারকে রক্ষা করে।
৩. স্বৈরতন্ত্র (Despotism): এখানেও একজন মাত্র ব্যক্তি শাসন করেন, কিন্তু কোনো আইন বা নিয়ম ছাড়াই। শাসকের মুহূর্তের ইচ্ছাই এখানে আইন। তাঁর কথাই প্রথম এবং শেষ কথা। এটি আসলে সরকারের একটি বিকৃত রূপ।
-
চালিকাশক্তি বা নীতি (Principle): ‘ভয়’ (Fear)। স্বৈরাচারী শাসক ভয়ের মাধ্যমে প্রজাদের সম্পূর্ণ নিস্তেজ, বিচ্ছিন্ন ও অনুগত করে শাসন করেন। এখানে কোনো সম্মান, গৌরব বা সদ্গুণের স্থান নেই। প্রজারা আইন মেনে চলে শাস্তির ভয়ে, হৃদয়ের ভালোবাসা বা সম্মানের জন্য নয়। শিক্ষা, জ্ঞান, শিল্প-বাণিজ্যের প্রসারকে এখানে চরম সন্দেহের চোখে দেখা হয়, কারণ এগুলো মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায় এবং তাদের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে। আর স্বাধীন চিন্তা ও সাহসী নাগরিক স্বৈরাচারের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। প্রজাদের রাখা হয় বিচ্ছিন্ন, অজ্ঞ এবং ভীত; তাদের মধ্যে কোনো সামাজিক বন্ধন গড়ে উঠতে দেওয়া হয় না, যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করতে না পারে। মঁতেস্কুর মতে, বিশাল সাম্রাজ্য এবং উষ্ণ জলবায়ুর দেশগুলিতে (যেমন, তাঁর ধারণায় তুরস্ক, পারস্য, রাশিয়া) এই ধরনের শাসনব্যবস্থা বেশি দেখা যায় (Carrithers, 2010)।
মঁতেস্কুর এই শ্রেণিবিভাগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি দেখিয়েছেন, একটি সরকারের পতন তখনই শুরু হয়, যখন তার মূল চালিকাশক্তি বা ‘নীতি’ নষ্ট হয়ে যায়। গণতন্ত্র থেকে যখন ‘Virtue’ হারিয়ে গিয়ে সবাই স্বার্থপর হয়ে ওঠে, রাজতন্ত্র থেকে যখন ‘Honor’ মুছে গিয়ে অভিজাতরা রাজার দাসে পরিণত হয় এবং মধ্যবর্তী সংস্থাগুলো ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সেই ব্যবস্থার পতন অনিবার্য এবং তা স্বৈরতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়।
এই শ্রেণিবিভাগ করার পর মঁতেস্কুর মনে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি এলো—কোন ব্যবস্থাটি মানুষের স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ? স্বৈরতন্ত্র যে নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। প্রজাতন্ত্র আদর্শগতভাবে সেরা, কিন্তু সেখানে নাগরিকদের সবসময় virtuous বা অতি সদ্গুণসম্পন্ন হতে হয়, যা বাস্তবে দীর্ঘকাল ধরে রাখা কঠিন। রাজতন্ত্রও মন্দ নয়, যদি আইন মেনে চলা হয় এবং মধ্যবর্তী সংস্থাগুলো শক্তিশালী থাকে। কিন্তু বিপদ হলো, রাজতন্ত্র খুব সহজেই স্বৈরতন্ত্রে পরিণত পারে। রাজা যদি আইনকে তোয়াক্কা না করে মধ্যবর্তী সংস্থাগুলোকে ধ্বংস করে নিজের ইচ্ছামতো চলতে শুরু করেন, তখন কী হবে?
এই জটিল সমস্যার এক অসামান্য সমাধান হিসেবেই তিনি তাঁর জগৎবিখ্যাত ‘ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি’ (Separation of Powers)-র প্রস্তাব করেন, যা মূলত ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থার একটি আদর্শায়িত রূপ।
ক্ষমতার লাগাম: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (The Doctrine of Separation of Powers)
এটিই মঁতেস্কুর দর্শনের প্রাণকেন্দ্র, তাঁর সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং কালজয়ী অবদান। তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ এবং মানব প্রকৃতি সম্পর্কে বাস্তববাদী ধারণা থেকে তিনি এক শাশ্বত সত্য আবিষ্কার করেন: “যেকোনো মানুষের হাতে ক্ষমতা দিলেই সেটির অপব্যবহার করার একটি চিরন্তন প্রবণতা তার মধ্যে দেখা যায়। সে ততক্ষণ পর্যন্ত ক্ষমতার ব্যবহার চালিয়ে যায়, যতক্ষণ না সে একটি সীমানায় এসে ধাক্কা খায়।” (Constant experience shows us that every man invested with power is apt to abuse it… He goes on until he finds limits.) (Montesquieu, 1748/1989, Book 11, Chapter 4)।
এই উক্তিটি কতটা গভীর, একবার ভেবে দেখুন। ক্ষমতা জিনিসটা মদের মতো, মানুষের বিবেক ও বিবেচনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশের বা নির্দিষ্ট কালের সমস্যা নয়, এটি মানব প্রকৃতির একটি সার্বজনীন সত্য। তাই মঁতেস্কু বললেন, ক্ষমতাকে বিশ্বাস করা যাবে না, কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদিচ্ছার উপর ভরসা করা বোকামি। ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কে করবে এই নিয়ন্ত্রণ? একজন সৎ রাজা? একদল জ্ঞানী মানুষ? মঁতেস্কু বললেন, না। কোনো মানুষ বা নৈতিকতা দিয়ে ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে রোখা যাবে না। ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ক্ষমতা দিয়েই (Power should be a check to power)।
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাক। ধরুন, একটি শক্তিশালী গাড়ি রাস্তায় চলছে। এর একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন আছে, যা গাড়িটিকে প্রচণ্ড গতিতে ছোটানোর ক্ষমতা রাখে। এই ইঞ্জিন হলো রাষ্ট্রের ‘নির্বাহী বিভাগ’ (Executive Branch) – যেমন, রাজা, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রীসভা। তাঁরা দেশ চালান, আইন প্রয়োগ করেন, যুদ্ধ ঘোষণা করেন, বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করেন।
এখন, এই গাড়িটি যদি শুধু ছুটতেই থাকে, কোন পথে চলবে তার কোনো নির্দেশনা না থাকে, তাহলে তো সে সোজা গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খাবে বা খাদে পড়বে। গাড়িটিকে কোন পথে চলতে হবে, তার জন্য একটি মানচিত্র এবং সেই অনুযায়ী পথ দেখানোর জন্য একটি স্টিয়ারিং হুইল দরকার। এই স্টিয়ারিং হুইল ও মানচিত্র হলো রাষ্ট্রের ‘আইন বিভাগ’ (Legislative Branch) – যেমন, সংসদ বা পার্লামেন্ট। তারা দেশের জন্য আইন তৈরি করে, কর আরোপ করে, বাজেট অনুমোদন করে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের চলার পথনির্দেশ দেয়।
কিন্তু শুধু ইঞ্জিন আর স্টিয়ারিং থাকলেই কি একটি গাড়ি নিরাপদ? গাড়িটিকে প্রয়োজনে থামানোর জন্য বা এর গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি শক্তিশালী ব্রেক তো লাগবে! এই ব্রেক হলো রাষ্ট্রের ‘বিচার বিভাগ’ (Judicial Branch) – অর্থাৎ, আদালত। আইন ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা, নির্বাহী বিভাগ বা আইন বিভাগ কেউ তাদের ক্ষমতার বাইরে যাচ্ছে কিনা, নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। তারা আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি দেয় এবং আইনের ব্যাখ্যা করে। মঁতেস্কুর কাছে বিচার বিভাগ একই সাথে “ভয়ংকর” এবং “প্রায় অদৃশ্য” এক শক্তি।
মঁতেস্কু বললেন, একটি রাষ্ট্রে যদি নাগরিকদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হয়, তাহলে এই তিনটি বিভাগকে অবশ্যই আলাদা এবং স্বাধীন রাখতে হবে। তাদের ক্ষমতা এবং কাজ সুস্পষ্টভাবে ভাগ করে দিতে হবে।
-
আইন বিভাগ (Legislative): শুধু আইন তৈরি করবে।
-
নির্বাহী বিভাগ (Executive): সেই আইন প্রয়োগ করবে এবং দেশ পরিচালনা করবে।
-
বিচার বিভাগ (Judiciary): আইন অনুযায়ী বিচার করবে এবং এটি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তি করবে।
কেন এই পৃথকীকরণ স্বাধীনতার জন্য নিঃশর্ত পূর্বশর্ত? মঁতেস্কু কয়েকটি ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতে বললেন:
১. যদি আইন ও নির্বাহী ক্ষমতা একই ব্যক্তির বা সংস্থার হাতে থাকে: তাহলে স্বৈরাচারী আইন তৈরি হবে এবং সেই শাসক নিজেই তা নিষ্ঠুরভাবে প্রয়োগ করবেন। যেমন, শাসক একটি আইন করলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে সমালোচনা করলেই দশ বছরের জেল’। তারপর নিজেই সেই আইনে আপনাকে গ্রেফতার করে জেলে পুরলেন। আপনার কিছুই করার থাকবে না, কারণ আইন প্রণেতা এবং প্রয়োগকারী একই।
২. যদি বিচার ও আইন ক্ষমতা এক হয়ে যায়: তাহলে বিচারকই হয়ে যাবেন স্বেচ্ছাচারী আইনপ্রণেতা। তিনি নিজের ইচ্ছামতো আইনের ব্যাখ্যা দেবেন বা কোনো নির্দিষ্ট মামলার জন্য নতুন নিয়ম বানিয়ে বিচার করবেন। ফলে নাগরিকের জীবন ও স্বাধীনতা হয়ে পড়বে সম্পূর্ণ অনিরাপদ এবং বিচারকের মর্জির উপর নির্ভরশীল।
৩. যদি বিচার ও নির্বাহী ক্ষমতা এক হয়ে যায়: তাহলে বিচারক ভয়ঙ্কর অত্যাচারী হয়ে উঠতে পারেন। কারণ তখন তিনি যাকে ইচ্ছা গ্রেফতার করে, নিজের ইচ্ছামতো বিচার করে শাস্তি দিতে পারবেন। নির্বাহী বিভাগের পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী তাঁর হাতে থাকায় কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। এটি হবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নামান্তর।
আর যদি এই তিনটি ক্ষমতাই কোনো এক ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। মঁতেস্কুর ভাষায়, সেটাই হবে স্বৈরতন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ। সেখানে স্বাধীনতার সম্পূর্ণ মৃত্যু ঘটবে (Vileplass, 2017)।
মঁতেস্কু এই তত্ত্বের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মূলত ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। তিনি দেখেছিলেন, সেখানে রাজা (নির্বাহী), দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট (আইন) এবং স্বাধীন আদালত ও জুরি ব্যবস্থা (বিচার) একে অপরকে কীভাবে একটি ভারসাম্যের মধ্যে রাখে। এই বাস্তব পর্যবেক্ষণকেই তিনি একটি সার্বজনীন তাত্ত্বিক রূপ দেন।
তাঁর এই তত্ত্বের সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তা হলো ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য’ (Checks and Balances)। তিনটি বিভাগ শুধু আলাদা থাকলেই হবে না, তাদের একে অপরকে সীমিত করার বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও থাকতে হবে। এটিই ক্ষমতার অপব্যবহার রোখার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। যেমন:
-
আইন বিভাগ কোনো আইন পাশ করলেও, নির্বাহী বিভাগের প্রধান (যেমন, রাষ্ট্রপতি) তাতে ভেটো (Veto) দিয়ে সাময়িকভাবে আটকে দিতে পারেন।
-
নির্বাহী বিভাগ কোনো বড় পদে নিয়োগ (যেমন, বিচারপতি বা রাষ্ট্রদূত) দিলে, আইন বিভাগের উচ্চকক্ষের অনুমোদন লাগতে পারে।
-
নির্বাহী বিভাগ বা আইন বিভাগের যেকোনো কাজকে বিচার বিভাগ ‘অসাংবিধানিক’ (Unconstitutional) ঘোষণা করে বাতিল করে দিতে পারে (Judicial Review)।
-
অন্যদিকে, বিচারকদের নিয়োগ দেয় নির্বাহী বিভাগ এবং অনুমোদন দেয় আইন বিভাগ। আবার আইন বিভাগ চাইলে বিচারপতিদের অভিশংসন (Impeachment) করতে পারে।
এই জটিল জালিকার কারণে কোনো একটি বিভাগই সর্বশক্তিমান হয়ে উঠতে পারে না। সবাই সবাইকে একটি অদৃশ্য শৃঙ্খলে বেঁধে রাখে, যা স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতারা (Founding Fathers) যেমন জেমস ম্যাডিসন, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, টমাস জেফারসন প্রমুখ মঁতেস্কুর এই তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। The Federalist Papers-এ বারবার মঁতেস্কুর উল্লেখ করা হয়েছে। আমেরিকার পুরো শাসনব্যবস্থাই এই Separation of Powers এবং Checks and Balances নীতির উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে, যা আজও পৃথিবীর বহু গণতান্ত্রিক দেশের জন্য একটি মডেল (Madison, Hamilton, & Jay, 1788/2003)।
মঁতেস্কুর জলবায়ু তত্ত্ব: একটি বিতর্কিত অধ্যায়
মঁতেস্কু ছিলেন তাঁর সময়ের সন্তান। সে যুগ ছিল জ্ঞানদীপ্তি বা The Enlightenment-এর যুগ। তখন নিউটনের পদার্থবিদ্যার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে চিন্তাবিদরা মানব সমাজ ও ইতিহাসকেও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সুনির্দিষ্ট নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন। মঁতেস্কুও এই ধারার একজন পথিকৃৎ ছিলেন। এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা থেকেই জন্ম নেয় তাঁর বিখ্যাত (এবং বর্তমানে সবচেয়ে সমালোচিত) জলবায়ু তত্ত্ব (Climate Theory)।
তাঁর মূল বক্তব্য ছিল, একটি দেশের মানুষের শারীরিক গঠন, মানসিক চরিত্র, তাদের সাহস, তাদের আবেগ এবং তাদের জন্য উপযুক্ত আইন ও শাসনব্যবস্থা – এই সবকিছুই অনেকাংশে সেই দেশের জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। তিনি তৎকালীন শারীরবিদ্যার তত্ত্ব ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন যে, ঠান্ডায় মানুষের শরীরের তন্তু (fibers) সংকুচিত ও শক্তিশালী হয়, আর গরমে তা প্রসারিত ও দুর্বল হয়ে যায়। এই শারীরিক পার্থক্যের কারণেই নাকি মানসিক ও চারিত্রিক পার্থক্য তৈরি হয়।
-
শীতল জলবায়ু (Cold Climates): তাঁর মতে, ঠান্ডা দেশের মানুষেরা হয় শারীরিকভাবে শক্তিশালী, সাহসী, কর্মঠ, অকপট এবং কিছুটা অনুভূতিহীন বা অসামাজিক। তারা যন্ত্রণার প্রতি সহনশীল এবং স্বাধীনতাপ্রিয়। তাদের শাসন করা কঠিন। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেশি, কিন্তু প্রতিশোধপরায়ণতা কম। মঁতেস্কুর মতে, এই ধরনের সাহসী ও স্বাধীনচেতা মানুষদের জন্য গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রই সবচেয়ে উপযুক্ত শাসনব্যবস্থা। উত্তর ইউরোপের জাতিগুলোকে তিনি এর উদাহরণ ভাবতেন।
-
উষ্ণ জলবায়ু (Hot Climates): গরম দেশের মানুষের শরীরের তন্তুগুলো হয় ঢিলে ও দুর্বল। ফলে তারা হয় শারীরিকভাবে দুর্বল, অলস, ভীরু, অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং কামুক। তাদের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা কম এবং তারা কল্পনাবিলাসী হয়। তারা কঠোর শাসনের অধীনে থাকতে পছন্দ করে, কারণ তাদের মধ্যে সাহস ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব থাকে। তাদের জন্য স্বৈরতন্ত্রই (Despotism) উপযুক্ত ব্যবস্থা। মঁতেস্কুর মতে, এশিয়া এবং আফ্রিকার বিশাল সাম্রাজ্যগুলোতে স্বৈরতন্ত্রের উপস্থিতির কারণ এই জলবায়ু।
-
নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু (Temperate Climates): এই অঞ্চলের মানুষের চরিত্র হয় পরিবর্তনশীল ও অস্থিতিশীল। তারা কখনো শীতল জলবায়ুর মানুষের মতো সাহসী ও স্বাধীনচেতা, আবার কখনো উষ্ণ জলবায়ুর মানুষের মতো দুর্বল ও অনুগত। ইউরোপের অবস্থান এই নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে হওয়ায়, এখানকার মানুষরা সবসময় স্বাধীনতা ও শাসন—এই দুয়ের মধ্যে এক চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে (Bok, 2018)।
আজকের দিনে এই তত্ত্বকে অত্যন্ত সরলীকৃত, বর্ণবাদী (racist) এবং কঠোর ভৌগোলিক নির্ধারণবাদ (geographical determinism) বলে সমালোচনা করা হয়। এটা ঠিক যে, মঁতেস্কুর কাছে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য ছিল না। তিনি মূলত পর্যটকদের পক্ষপাতদুষ্ট বর্ণনা এবং নিজের সীমিত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেছিলেন। মানুষের চরিত্র ও সমাজ গঠনে যে অর্থনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি এবং সর্বোপরি মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ ও সংগ্রামের মতো আরও অনেক জটিল উপাদান কাজ করে, তা তিনি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেননি।
তবে এই বিতর্কিত তত্ত্বের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। প্রথমত, তিনি সর্বপ্রথম আইন ও সমাজকে একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেন। সমাজকে কার্যকারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে ব্যাখ্যার এই প্রয়াসটিই সমাজবিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তিনি পরিবেশের প্রভাবকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মঁতেস্কু কট্টর নির্ধারণবাদী ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, “উত্তম আইনপ্রণেতা প্রকৃতির বিরুদ্ধে আইন তৈরি করেন।” অর্থাৎ, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবগুলোকে ভালো আইন, শিক্ষা ও রীতিনীতি দিয়ে জয় করা সম্ভব। যেমন, উষ্ণ জলবায়ু যদি মানুষকে অলস করে তোলে, তবে আইনপ্রণেতা এমন আইন করতে পারেন যা পরিশ্রমকে উৎসাহিত করে। এটি তাঁর চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যা প্রায়শই সমালোচনায় উপেক্ষিত হয় (Krause, 2010)।
স্বাধীনতা, বাণিজ্য এবং অন্যান্য মুক্তচিন্তা
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ এবং জলবায়ু তত্ত্ব ছাড়াও মঁতেস্কুর আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা ছিল, যা আধুনিক উদারনৈতিক চিন্তার ভিত্তি স্থাপন করেছে।
-
স্বাধীনতার প্রকৃত সংজ্ঞা (Definition of Liberty): আপনার কাছে স্বাধীনতা মানে কী? যা ইচ্ছা তাই করা? মঁতেস্কু বললেন, একদমই না। ওটা স্বাধীনতা নয়, ওটা উচ্ছৃঙ্খলতা। তাঁর মতে, প্রকৃত রাজনৈতিক স্বাধীনতা হলো, “আইন যা করার অনুমতি দেয়, তা করতে পারা এবং আইন যা করতে বারণ করে, তা করতে বাধ্য না হওয়া।” (Liberty is the right of doing whatever the laws permit) (Montesquieu, 1748/1989, Book 11, Chapter 3)। এর সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘নিরাপত্তার অনুভূতি’। আপনি তখনই স্বাধীন, যখন আপনার মনে কোনো ভয় থাকে না—না সরকারের ভয়, না অন্য কোনো নাগরিকের ভয়। যদি সমাজে প্রত্যেকেই যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা পায়, তাহলে সবল মানুষ দুর্বলের উপর অত্যাচার করবে এবং কারও কোনো স্বাধীনতাই থাকবে না। তাই প্রকৃত স্বাধীনতা কেবল আইনের শাসনের (Rule of Law) অধীনেই সম্ভব। তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতা (সাংবিধানিক কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত) এবং নাগরিক স্বাধীনতা (নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক) এর মধ্যে পার্থক্য করেন। তিনি মনে করতেন, নাগরিক স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে একটি দেশের ফৌজদারি আইনের উপর। তাই তিনি অভিযুক্তের অধিকার, নির্দোষ অনুমান (presumption of innocence) এবং শাস্তির আনুপাতিকতার উপর জোর দিয়েছিলেন।
-
বাণিজ্যের শান্তিদূত ভূমিকা (Role of Commerce): মঁতেস্কু ছিলেন বাণিজ্যের একজন বড় সমর্থক। তাঁর সময়ে যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্য বিস্তারকেই যেখানে গৌরবের বিষয় বলে মনে করা হতো, সেখানে তিনি বাণিজ্যকে একটি সভ্য ও নম্র শক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব হলো doux commerce বা ‘মধুর বাণিজ্য’। তাঁর মতে, বাণিজ্য দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে এবং তাদেরকে একে অপরের উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল করে তোলে। ফলে তাদের মধ্যে যুদ্ধ করার প্রবণতা কমে আসে। তিনি বলেন, “বাণিজ্যের স্বাভাবিক প্রভাব হলো শান্তির দিকে পরিচালিত করা।” (The natural effect of commerce is to lead to peace)। এছাড়াও বাণিজ্য মানুষকে কঠোর পরিশ্রম, মিতব্যয়িতা, নিয়মানুবর্তিতা এবং সহনশীলতা শেখায়। এটি মানুষের মন থেকে ধ্বংসাত্মক কুসংস্কার দূর করে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ায়। এটি স্বৈরতন্ত্রের ভীতি এবং রাজতন্ত্রের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বিপরীতে একটি শক্তিশালী প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
-
ধর্মের সামাজিক কাজ ও সহিষ্ণুতা: মঁতেস্কু নিজে ক্যাথলিক পরিবারে জন্মালেও, তিনি ধর্মকে একজন সমাজবিজ্ঞানীর নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তাঁর মতে, ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের চেয়েও বড় একটি সামাজিক শক্তি। এটি মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেয় এবং এমন অনেক সামাজিক বন্ধন তৈরি করে, যা অনেক সময় রাষ্ট্রের আইনের চেয়েও ভালোভাবে কাজ করে। একটি ভালো ধর্ম তার অনুসারীদের ভালো নাগরিক হতে সাহায্য করে এবং সরকারকে সংযত রাখতে পারে। তবে তিনি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা (Religious Intolerance) এবং ধর্মান্ধতার (Fanaticism) ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি মনে করতেন, জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করানো বা ধর্মবিশ্বাসের জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া চরম অন্যায়। তাঁর মতে, রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
মঁতেস্কুর প্রাসঙ্গিকতা: কেন তিনি আজও আমাদের শিক্ষক?
প্রায় তিনশ বছর তো হয়ে গেল। পৃথিবী আমূল বদলে গেছে। ফরাসি বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, দুটি বিশ্বযুদ্ধ, ঠান্ডা যুদ্ধ, উপনিবেশবাদের পতন, প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য উন্নতি—কত কিছুই না ঘটে গেল। তাহলে কেন আমরা আজও এই বয়োবৃদ্ধ ফরাসি ব্যারনকে নিয়ে এত আলোচনা করি?
কারণ, মঁতেস্কুর তোলা মূল প্রশ্নগুলো এবং তাঁর দেওয়া সতর্কবার্তাগুলো আজও আগের মতোই, এমনকি আরও বেশি, জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক।
ক্ষমতা আজও মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। আজও পৃথিবী জুড়ে স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা সব ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আর তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার জন্য, একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য লড়াই করে। মঁতেস্কু সেই লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক অস্ত্রটি—ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি—আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
আজ যখন কোনো দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, যখন বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কথায় চলতে বাধ্য করার চেষ্টা চলে, যখন সংসদকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র অধ্যাদেশ (Ordinance) জারি করে দেশ চালানো হয়, বা যখন একজন নেতার cult of personality তৈরি করে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেওয়া হয়, তখন আমরা বুঝি মঁতেস্কু কতটা দূরদর্শী এবং সঠিক ছিলেন। তাঁর তত্ত্ব শুধু একটি বিমূর্ত রাজনৈতিক মডেল নয়, এটি স্বৈরাচারের রূপরেখার বিরুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট সতর্কবার্তা। যখন আমরা দেখি কোনো দেশে বিরোধী দলকে দমন করা হচ্ছে, স্বাধীন গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো হচ্ছে এবং আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে, তখন আমরা আসলে মঁতেস্কুর বর্ণিত ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের প্রক্রিয়াটিই প্রত্যক্ষ করি।
যখন কোনো শক্তিশালী উন্নত দেশ তাদের নিজেদের আইন, সংস্কৃতি এবং শাসনব্যবস্থাকে ‘একমাত্র সঠিক মডেল’ হিসেবে অন্য কোনো দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন মঁতেস্কুর ‘আইনের আত্মা’ বা ‘Spirit of the Laws’ তত্ত্বটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রতিটি সমাজের নিজস্বতা, নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে। বাইরে থেকে ধার করা সমাধান সবসময় কাজ করে না; সমাধান আসতে হবে ভেতর থেকে, সেই সমাজের মাটির রস থেকেই।
মঁতেস্কু আমাদের শিখিয়েছেন যে, স্বাধীনতা কোনো উপহার নয় যা শাসকেরা দয়া করে দেয়। এটি একটি অর্জন। আর এই ভঙ্গুর অর্জনকে রক্ষা করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান (Institution) তৈরি করা। এমন প্রতিষ্ঠান, যা ব্যক্তির খামখেয়ালিপনা বা জনপ্রিয়তার জোয়ারের ঊর্ধ্বে থাকবে। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ, একটি কার্যকর আইনসভা এবং একটি জবাবদিহিমূলক নির্বাহী বিভাগ—এই তিনটি স্তম্ভের উপরই স্বাধীনতার প্রাসাদ দাঁড়িয়ে থাকে। এর যেকোনো একটি দুর্বল হয়ে পড়লে পুরো কাঠামোটিই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে।
তিনি ছিলেন একজন বাস্তববাদী চিন্তাবিদ। তিনি প্লেটোর মতো কাল্পনিক আদর্শ রাষ্ট্র বা ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখাননি। তিনি মানুষের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলেন। তিনি জানতেন, মানুষ ভালো-মন্দের এক জটিল মিশ্রণ। তাই তিনি এমন একটি ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন, যেখানে মানুষের মন্দ প্রবণতাগুলোকেও (যেমন, ক্ষমতার লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা) সমাজের মঙ্গলের জন্য ব্যবহার করা যায়। যেখানে এক বিভাগের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অন্য বিভাগের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্বারা প্রতিহত হয়। যেখানে ক্ষমতার লোভকে আরেকটি ক্ষমতার লোভ দিয়ে আটকে রাখা হয়, যাতে সাধারণ নাগরিকেরা শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারে।
শেষ কথা
মঁতেস্কু নামের এই মানুষটি ছিলেন এক কথায় একজন ‘আশাবাদী নৈরাশ্যবাদী’। তিনি মানুষের ক্ষমতা লিপ্সার শাশ্বত প্রবণতা দেখে মানব প্রকৃতি নিয়ে হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু আবার মানুষের বিবেক, যুক্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক নকশার মাধ্যমে সেই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব বলে আশাও খুঁজেছিলেন।
তাঁর লেখা পড়লে মনে হয়, তিনি যেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা একজন চিকিৎসক। যিনি আধুনিক রাষ্ট্রের রোগটা—ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা—সঠিকভাবে নির্ণয় করেছিলেন এবং তার নিরাময়ের সবচেয়ে কার্যকর পথও বাতলে দিয়েছিলেন। সেই পথটি হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, আইনের শাসন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রতি নিঃশর্ত শ্রদ্ধা।
আজকের এই জটিল পৃথিবীতে, যেখানে গণতন্ত্র নানা সংকটের মুখে, যেখানে পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদের উত্থান ঘটছে এবং যেখানে শক্তিশালী নেতারা প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাহ্য করে সরাসরি ‘জনতার নামে’ শাসন করার দাবি তুলছেন, সেখানে মঁতেস্কুর ভাবনাগুলো যেন বাতিঘরের মতো পথ দেখাচ্ছে। তিনি যেন দূর থেকে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন—ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরো, নতুবা এই ক্ষমতাই একদিন তোমার স্বাধীনতা, তোমার মর্যাদা, তোমার মনুষ্যত্ব—সবকিছু কেড়ে নেবে। আর সেই লাগামটি হলো বিবেক, আইন এবং বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলা সুচিন্তিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। আমাদের মঁতেস্কু সাহেবের এই শিক্ষা মানবজাতি যতদিন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখবে, ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে।
তথ্যসূত্র
- Bok, H. (2018). Baron de Montesquieu, Charles-Louis de Secondat. In E. N. Zalta (Ed.), The Stanford Encyclopedia of Philosophy (Winter 2018 ed.). Metaphysics Research Lab, Stanford University. https://plato.stanford.edu/archives/win2018/entries/montesquieu/
- Carrithers, D. W. (2010). Montesquieu’s Philosophy of Punishment. History of Political Thought, 31(2), 213–240.
- Krause, S. R. (2010). The Spirit of Separate Powers in Montesquieu. The Review of Politics, 72(2), 231–256.
- Locke, J. (1988). Two Treatises of Government (P. Laslett, Ed.). Cambridge University Press. (Original work published 1689).
- Madison, J., Hamilton, A., & Jay, J. (2003). The Federalist Papers (C. Rossiter, Ed.). Signet Classics. (Original work published 1788).
- Montesquieu, C. de S. (1989). The Spirit of the Laws (A. M. Cohler, B. C. Miller, & H. S. Stone, Trans. & Eds.). Cambridge University Press. (Original work published 1748).
- Pangle, T. L. (1973). Montesquieu’s Philosophy of Liberalism: A Commentary on The Spirit of the Laws. University of Chicago Press.
- Rahe, P. A. (2009). Montesquieu and the Logic of Liberty: War, Religion, and Commerce in the “Spirit of the Laws”. Yale University Press.
- Shackleton, R. (1961). Montesquieu: A Critical Biography. Oxford University Press.
- Vileplass, F. (2017). Montesquieu’s The Spirit of the Laws: separation of powers and constitutionalism. In A Treatise of Legal Philosophy and General Jurisprudence (pp. 239-253). Springer, Dordrecht.
Leave a Reply