Table of Contents
ভূমিকা
এক অদ্ভুত ফরাসি যুবকের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। বয়স মাত্র পঁচিশ। চোখেমুখে অভিজাত্যের ছাপ, কিন্তু চাহনিতে এমন এক গভীর বিষণ্ণতা যা তার বয়সকে ছাড়িয়ে গেছে। নাম তার শার্ল অ্যালেক্সিস অঁরি ক্লেহেল ডি টোকভিল (Charles Alexis Henri Clérel de Tocqueville)। সালটা ১৮৩১। তার দেশ ফ্রান্স তখন এক চিরস্থায়ী ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দু। ফরাসি বিপ্লব নামক মহাপ্রলয় এবং তার পরবর্তী নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও বুরবোঁ পুনঃপ্রতিষ্ঠার টালমাটাল দশকগুলো তার শৈশবের স্মৃতিতে এক দগদগে ঘা। সেই বিপ্লবের উন্মত্ততায় তার প্রপিতামহ, বিখ্যাত আইনজীবী মালশের্ব (Malesherbes), যিনি স্বয়ং রাজা ষোড়শ লুইকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন, তাকে গিলোটিনে চড়ানো হয়। টোকভিলের বাবা-মাকেও কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং তারা অল্পের জন্য গিলোটিন থেকে রক্ষা পান; এই আতঙ্ক তার মায়ের মনে এক স্থায়ী ছাপ ফেলে গিয়েছিল। তিনি নিজে এমন এক নরম্যান্ডির অভিজাত (Aristocrat) পরিবারে জন্মেছেন, যার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। তিনি নিজের চোখে দেখছেন, পুরনো পৃথিবীটা ভাঙা কাঁচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। অভিজাততন্ত্রের সোনালী দিন অস্তমিত। আসছে নতুন এক যুগ—গণতন্ত্রের যুগ।
টোকভিল ছিলেন দুই পৃথিবীর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানুষ। তার মন পড়ে ছিল অভিজাততন্ত্রের সেই হারানো জগতে, যেখানে সম্মান (honor), মহত্ত্ব (greatness) এবং ঐতিহ্যের কদর ছিল। কিন্তু তার শাণিত বুদ্ধি বলছিল, ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রেরই। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই গণতান্ত্রিক জোয়ারকে ঠেকানো যাবে না। এটি ইতিহাসের এক অমোঘ পরিণতি। কিন্তু এই গণতন্ত্র জিনিসটা ঠিক কী? এর শক্তি কোথায়? এর দুর্বলতা কী? এই নতুন পৃথিবীর আত্মাটা কেমন হবে? এই প্রশ্নগুলো তাকে ভূতের মতো তাড়া করে বেড়াত। তিনি ইতিহাসের এই অনিবার্য পরিবর্তনকে ভয় পেতেন, কিন্তু একজন চিকিৎসকের নির্লিপ্ত কৌতূহল নিয়ে একে ব্যবচ্ছেদ করতে চাইতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “এক নতুন পৃথিবীর জন্য এক নতুন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রয়োজন” (a new political science is needed for a world itself quite new)। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়াটা জরুরি।
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি তার বন্ধু গুস্তাভ ডি বিউমোন্টকে (Gustave de Beaumont) নিয়ে পাড়ি জমালেন এক নতুন দেশে, যে দেশটি ছিল গণতন্ত্রের এক বিশাল পরীক্ষাগার—আমেরিকা। কাগজে-কলমে তাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার জেল ব্যবস্থা (Penal System) নিয়ে গবেষণা করা, যা ফরাসি সরকারের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য কারণ ছিল। কিন্তু টোকভিলের আসল উদ্দেশ্য ছিল আরও অনেক গভীর এবং মহৎ। তিনি আসলে আমেরিকান গণতন্ত্রের নাড়িনক্ষত্র বুঝতে চেয়েছিলেন। দেখতে চেয়েছিলেন ভবিষ্যতের পৃথিবীর একটি সম্ভাব্য চিত্র, যা হয়তো একদিন তার নিজের দেশ ফ্রান্সকেও গ্রাস করবে।
এই নয় মাসের ভ্রমণ এবং তার পরবর্তী বছরের পর বছরের গভীর পর্যবেক্ষণ ও লেখালেখি থেকেই জন্ম নেয় বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা’ (De la démocratie en Amérique)। এটি নিছক কোনো ভ্রমণকাহিনী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নয়; এটি একাধারে সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ভবিষ্যতের এক দার্শনিক মানচিত্র। টোকভিল যেন একজন চিকিৎসক, যিনি গণতন্ত্র নামক নতুন শিশুটির শরীর পরীক্ষা করে তার সম্ভাব্য রোগগুলো, তার শক্তি এবং তার দীর্ঘ জীবন লাভের উপায়গুলো বলে দিচ্ছেন। চলুন, আমরা সেই চিকিৎসকের রিপোর্টটি আজ বিস্তারিতভাবে পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করি, তার দেখানো গোলকধাঁধায় নিজেরাও একটু পথ হারাই।
এক বিষণ্ণ তরুণের চশমা: যে আয়নায় টোকভিল পৃথিবীকে দেখেছিলেন
একটা তরুণের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তরুণটি অভিজাত, বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু তার চোখে রাজ্যের বিষণ্ণতা। দেখলে মনে হয়, সে এমন কিছু দেখে ফেলেছে যা তার বয়সী কারো দেখার কথা নয়। এই তরুণের নাম অ্যালেক্সিস ডি টোকভিল। আচ্ছা, ভাবুন তো, একজন মানুষ কেন তার চেনা-জানা জগৎ ছেড়ে, সাগর পাড়ি দিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা এক দেশে পাড়ি জমায় শুধু তার জেলখানা দেখতে? ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না, তাই না? আসলে জেলখানা দেখাটা ছিল একটা অজুহাত মাত্র। টোকভিল আসলে গিয়েছিলেন আমেরিকার আত্মাকে দেখতে, বুঝতে। কারণ তিনি এক ভয়ানক ধাঁধার সমাধান খুঁজছিলেন। যে ধাঁধা তার নিজের দেশ ফ্রান্সকে প্রায় গিলে ফেলেছিল।
এই ধাঁধাটা বুঝতে পারলেই আমরা বুঝব, কেন টোকভিলের চিন্তাগুলো এমন গভীর, এমন কালো মেঘে ঢাকা, আবার কখনো কখনো আশার আলোয় ঝলমলে। কোনো মানুষের চিন্তাই তো আকাশ থেকে পড়ে না। তার চিন্তা তৈরি হয় তার সময়, তার চারপাশের ঘটনা আর আগের প্রজন্মের জ্ঞানী মানুষদের রেখে যাওয়া বইয়ের পাতার ওপর ভিত্তি করে। টোকভিলের চশমাটা তৈরি হয়েছিল মূলত দুটি জিনিস দিয়ে: প্রথমত, তার দেশের রক্তাক্ত ও টালমাটাল রাজনৈতিক ইতিহাস, আর দ্বিতীয়ত, তার পূর্বসূরি কয়েকজন বড় মাপের দার্শনিকের রেখে যাওয়া জ্ঞান। চলুন, এই দুটো জিনিসকেই একটু তলিয়ে দেখা যাক।
ঝড়ের কেন্দ্রে ফ্রান্স
কল্পনা করুন, আপনি এমন এক বাড়িতে জন্মেছেন যেখানে আপনার গ্র্যান্ডপাকে খুন করা হয়েছে, আপনার বাবা-মাকে প্রায় মেরেই ফেলা হয়েছিল, আর বাড়ির আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সবকিছুই ভাঙাচোরা। আপনার শৈশব কাটছে এই ভাঙা বাড়ির মেরামত দেখতে দেখতে। টোকভিলের ফ্রান্স ছিল ঠিক তেমনই এক ভাঙা বাড়ি।
ফরাসি বিপ্লবের ভূত (The Ghost of the French Revolution): টোকভিলের জন্মের মাত্র ১৬ বছর আগে ফরাসি বিপ্লব (French Revolution) নামক এক মহাপ্রলয় ঘটে গেছে। এই বিপ্লব সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতার (Liberty, Equality, Fraternity) কথা বলে শুরু হলেও, এর শেষটা হয়েছিল রক্তগঙ্গায়। গিলোটিনের নিচে কাটা পড়েছে হাজার হাজার মাথা, যার মধ্যে ছিলেন টোকভিলের প্রপিতামহও। এই ‘ত্রাসের রাজত্ব’ (Reign of Terror) ফরাসিদের মনে এক গভীর দাগ কেটে গিয়েছিল। টোকভিল ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছেন সেই ভয়ংকর সময়ের গল্প। তিনি বুঝেছিলেন, স্বাধীনতার নামে লাগামছাড়া আবেগ কতটা বিধ্বংসী হতে পারে। গণতন্ত্রের নামে উচ্ছৃঙ্খল জনতা কীভাবে স্বৈরাচারের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এই অভিজ্ঞতা তাকে গণতন্ত্রের প্রতি একই সাথে আশাবাদী এবং সন্দিহান করে তুলেছিল। তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন দেখতে যে, কীভাবে একটি দেশ রক্তপাত ছাড়াই স্বাধীনতা ও সাম্যকে একসাথে ধরে রাখতে পারে (Kahan, 2015)।
নেপোলিয়নের উত্থান ও পতন (The Rise and Fall of Napoleon): বিপ্লবের বিশৃঙ্খলার পর ফ্রান্সকে একনায়কের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। তিনি একদিকে যেমন বিপ্লবের কিছু আদর্শকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনই এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলে প্রায় পুরো ইউরোপকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন। টোকভিল দেখেছেন, কীভাবে একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো জনগণকে সম্মোহিত করে নিজের সামরিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তিনি বুঝেছিলেন, বিশৃঙ্খলার পর মানুষ নিরাপত্তার জন্য যেকোনো শক্তিশালী শাসকের হাতে নিজেদের স্বাধীনতা তুলে দিতে পারে। গণতন্ত্রের পথ কতটা পিচ্ছিল, তা নেপোলিয়নের শাসন তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। এই ভয়টাই পরবর্তীতে তার ‘নরম স্বৈরতন্ত্র’ (Soft Despotism) তত্ত্বে রূপান্তরিত হয়েছিল।
বুরবোঁ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নতুন বিপ্লব (Bourbon Restoration and Another Revolution): নেপোলিয়নের পতনের পর ফ্রান্সে আবার পুরনো রাজবংশ ফিরে আসে, যা ‘বুরবোঁ পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ (Bourbon Restoration) নামে পরিচিত। কিন্তু ফরাসিরা আর পুরনো যুগে ফিরে যেতে রাজি ছিল না। ফলে ১৮৩০ সালে আরেকটি বিপ্লব (July Revolution) হয় এবং নতুন একজন রাজা ক্ষমতায় আসেন। টোকভিল তখন তরুণ আইনজীবী। এই চিরস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। তিনি দেখছিলেন, ফ্রান্স যেন এক পেন্ডুলামের মতো একবার চরম বিপ্লব, আরেকবার চরম প্রতিক্রিয়ার (Reaction) মধ্যে দুলছে। কোনো স্থিরতা নেই, কোনো শান্তি নেই। কেন ফ্রান্স পারছে না, যা আমেরিকা পেরেছে? এই প্রশ্নই তাকে আমেরিকামুখী করেছিল। তার কাছে ফ্রান্স ছিল গণতন্ত্রের একটি ব্যর্থ পরীক্ষা, আর আমেরিকা ছিল একটি সফল পরীক্ষা। তিনি এই দুইয়ের পার্থক্যটা বুঝতে চেয়েছিলেন (Welch, 2001)।
এই রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তই ছিল টোকভিলের ল্যাবরেটরি। তিনি এখান থেকেই তার গবেষণার মূল প্রশ্নগুলো খুঁজে পেয়েছিলেন: কীভাবে একটি সমাজ একই সাথে স্বাধীন ও স্থিতিশীল হতে পারে? সাম্য কি সব সময় স্বাধীনতার বন্ধু, নাকি শত্রু?
জ্ঞানীদের কাঁধে দাঁড়িয়ে
টোকভিল শূন্য থেকে তার তত্ত্ব নির্মাণ করেননি। তিনি তার আগের বড় বড় চিন্তাবিদদের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন। কারো কাছ থেকে তিনি নিয়েছেন প্রশ্ন, কারো কাছ থেকে নিয়েছেন বিশ্লেষণের যন্ত্রপাতি, আবার কারো ভুল থেকে নিয়েছেন শিক্ষা।
মঁতেস্কু (Montesquieu): পথপ্রদর্শক গুরু: যদি টোকভিলের একজন গুরু নির্বাচন করতে হয়, তিনি হবেন ব্যারন ডি মঁতেস্কু। টোকভিল যখন ‘ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা’ লিখছেন, তার টেবিলে সবসময় মঁতেস্কুর বিখ্যাত বই ‘দ্য স্পিরিট অব দ্য লজ’ (The Spirit of the Laws) খোলা থাকত। মঁতেস্কুর কাছ থেকে তিনি কয়েকটি মূল ধারণা পেয়েছিলেন:
-
Mœurs বা হৃদয়ের অভ্যাস: মঁতেস্কুই প্রথম বলেন যে, একটি দেশের আইন-কানুনের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তার জনগণের অলিখিত নিয়ম, অভ্যাস, এবং মানসিকতা, যাকে তিনি ফরাসিতে বলেছেন ‘Mœurs’। টোকভিল এই ধারণাটিকে আমেরিকার সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, আমেরিকার সংবিধান নয়, বরং তাদের ‘Mœurs’—যেমন তাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা, ধর্মীয় নৈতিকতা, এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অভ্যাস গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে (Pangle, 2000)।
-
ক্ষমতার পৃথকীকরণ (Separation of Powers): মঁতেস্কুর এই বিখ্যাত তত্ত্ব টোকভিলকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি আমেরিকায় গিয়ে দেখেন, কীভাবে ফেডারেল সরকার, রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কীভাবে বিচার বিভাগ (Judiciary) সংখ্যাগরিষ্ঠের অত্যাচার থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য একটি শক্তিশালী বর্ম হিসেবে কাজ করছে।
-
সমাজের সামগ্রিক বিশ্লেষণ: মঁতেস্কু শিখিয়েছিলেন যে, একটি সমাজকে বুঝতে হলে শুধু তার রাজনীতি দেখলে চলবে না; তার ভূগোল, জলবায়ু, অর্থনীতি, ধর্ম, এবং সামাজিক গঠন – সবকিছুকে একসাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। টোকভিল ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তিনি আমেরিকাকে একটি সামগ্রিক সত্তা হিসেবে দেখেছেন, যা তার বিশ্লেষণকে এত গভীর ও কালজয়ী করেছে।
মঁতেস্কু যেন টোকভিলের হাতে একটি মানচিত্র তুলে দিয়েছিলেন, যা দিয়ে তিনি আমেরিকার জটিল ভূখণ্ডে পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।
জ্যাঁ-জ্যাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau): এক বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ: ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম প্রধান দার্শনিক প্রেরণা ছিলেন রুশো। তার ‘সাধারণ ইচ্ছা’ (General Will) এবং ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব’ (Popular Sovereignty) তত্ত্ব বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র ছিল। রুশোর মতে, ‘সাধারণ ইচ্ছা’ সবসময় অভ্রান্ত এবং জনগণের ইচ্ছাই চূড়ান্ত।
টোকভিল রুশোর এই ধারণার মধ্যে এক ভয়ংকর বিপদ দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এই ‘সাধারণ ইচ্ছা’র ধারণাটি খুব সহজেই ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার’ (Tyranny of the Majority)-এ পরিণত হতে পারে। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাই অভ্রান্ত হয়, তাহলে সংখ্যালঘুর অধিকার বা ভিন্নমতের কোনো স্থান থাকে না। যে ব্যক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে একমত নয়, তাকে ‘সাধারণ ইচ্ছা’র শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের ‘ত্রাসের রাজত্ব’ ছিল এর বাস্তব প্রমাণ (Kahan, 2015)।
তাই টোকভিল যখন আমেরিকায় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের ক্ষমতা দেখেছেন, তার মনে রুশোর তত্ত্বের ভয়ংকর পরিণতির কথাই ভেসে উঠেছে। তিনি রুশোর সরল আশাবাদের বিপরীতে গিয়ে দেখিয়েছেন, জনগণের শাসনও কত সহজে নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। এক অর্থে, ‘ডেমোক্রেসি ইন আমেরিকা’ গ্রন্থটি ছিল রুশোর রাজনৈতিক দর্শনের একটি প্রচ্ছন্ন কিন্তু শক্তিশালী সমালোচনা।
ব্লেইজ প্যাসকেল (Blaise Pascal): মানব আত্মার গাইড: এই প্রভাবটা একটু সূক্ষ্ম, কিন্তু খুব গভীর। সপ্তদশ শতাব্দীর গণিতবিদ ও দার্শনিক প্যাসকেল মানব প্রকৃতির এক অন্ধকার কিন্তু বাস্তব ছবি এঁকেছিলেন। প্যাসকেলের মতে, মানুষ একই সাথে মহৎ এবং তুচ্ছ (great and wretched)। সে অসীমকে জানতে চায়, কিন্তু জাগতিক ছোট ছোট বিষয়ে ব্যস্ত থেকে নিজের নিয়তিকে ভুলে থাকতে চায়। এই অবস্থাকে প্যাসকেল বলেছিলেন ‘ডাইভার্সন’ (Diversion)।
টোকভিল গণতান্ত্রিক মানুষের মধ্যে প্যাসকেলের এই বর্ণনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি দেখেছেন, গণতান্ত্রিক মানুষ সাম্যের কারণে অসীম সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখে (মহত্ত্ব), কিন্তু একই সাথে সে বস্তুগত আরাম-আয়েশ আর ছোট ছোট ভোগবিলাসের পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবন পার করে দেয় (তুচ্ছতা)। এই যে সার্বক্ষণিক অস্থিরতা (restlessness) এবং বস্তুবাদের (materialism) পেছনে ছোটা, এটা প্যাসকেলের ‘ডাইভার্সন’ ছাড়া আর কী? মানুষ যেন তার নিজের একাকিত্ব এবং স্বাধীনতার বিশাল দায়িত্বের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। তাই সে নিজেকে ব্যস্ত রাখে টাকা-পয়সা আর ছোটখাটো সুখের পেছনে (Siedentop, 2000)। টোকভিলের বিশ্লেষণে যে মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা পাওয়া যায়, তার পেছনে প্যাসকেলের বড় অবদান রয়েছে।
ফ্রাঁসোয়া গিজো (François Guizot) ও মতবাদীরা (The Doctrinaires): টোকভিলের সমসাময়িক একদল চিন্তাবিদ ছিলেন, যারা ‘ডকট্রিনেয়ার’ বা মতবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাদের নেতা ছিলেন ফ্রাঁসোয়া গিজো, যিনি নিজেও একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। এই দলটি বিপ্লবের বাড়াবাড়ি এবং রাজতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া—দুয়েরই বিরোধী ছিল। তারা একটি মধ্যপন্থা খুঁজছিল, যা স্বাধীনতা ও স্থিতিশীলতাকে মেলাতে পারে।
গিজো এবং তার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারিত হয় সামাজিক শক্তির পরিবর্তনের মাধ্যমে। তারা দেখিয়েছেন, কীভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির (Middle Class) উত্থান ইউরোপের ইতিহাসকে বদলে দিচ্ছে। তাদের মতে, এই উত্থান ছিল অনিবার্য (inevitable)। টোকভিল এই ‘ঐতিহাসিক অনিবার্যতা’র ধারণাটি গ্রহণ করেন, কিন্তু তাকে আরও ব্যাপক রূপ দেন। তিনি বলেন, শুধু মধ্যবিত্তের উত্থান নয়, বরং ‘অবস্থার সমতা’র (equality of conditions) বিস্তারই হলো আধুনিক ইতিহাসের মূল চালিকাশক্তি, এবং এটি একটি ‘ঈশ্বরের বিধান’ (Providential Fact)। গিজোর কাছ থেকে তিনি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের একটি কাঠামো পেয়েছিলেন, কিন্তু সেই কাঠামোকে তিনি নিজের মতো করে আরও গভীর ও দার্শনিক রূপ দিয়েছেন (Welch, 2001)।
পুরোনো চশমায় নতুন পৃথিবী
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? টোকভিল ছিলেন একজন সৃজনশীল সংকলক। তিনি তার ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাকে একটি পরীক্ষাগার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আর সেই পরীক্ষাগারে কাটাছেঁড়া করার জন্য তিনি যন্ত্রপাতি ধার করেছেন মঁতেস্কু, রুশো, প্যাসকেল এবং গিজোর মতো চিন্তাবিদদের কাছ থেকে।
তিনি মঁতেস্কুর মতো সমাজকে সামগ্রিকভাবে দেখেছেন, কিন্তু গণতন্ত্রের মনস্তত্ত্ব নিয়ে এমন সব প্রশ্ন তুলেছেন যা মঁতেস্কু ভাবেননি। তিনি রুশোর ‘সাধারণ ইচ্ছা’র বিপদকে শনাক্ত করেছেন এবং তাকে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার’ নাম দিয়ে একটি নতুন তত্ত্বে পরিণত করেছেন। তিনি প্যাসকেলের মানব প্রকৃতির বিশ্লেষণকে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক মানুষের আত্মার ভেতরটা দেখতে চেয়েছেন। আর গিজোর ঐতিহাসিক অনিবার্যতাকে তিনি ‘সাম্যের জোয়ার’ নামক এক মহাকাব্যিক রূপ দিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত, টোকভিলের মহত্ত্ব এখানেই যে, তিনি কারো অন্ধ অনুকরণকারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক বিরল প্রতিভা, যিনি পুরনো জ্ঞান আর নতুন বাস্তবতাকে মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব সংশ্লেষণ (synthesis) তৈরি করতে পেরেছিলেন। তার চশমাটা হয়তো পুরনো কাঁচ দিয়ে তৈরি ছিল, কিন্তু সেই চশমা দিয়ে তিনি ভবিষ্যতের পৃথিবীকে এমন স্পষ্টভাবে দেখেছিলেন, যা আজও আমাদের বিস্মিত করে। সেই বিষণ্ণ তরুণটি আসলে কোনো ধাঁধার সমাধান করতে পারেননি, বরং ধাঁধাটিকে আমাদের সবার সামনে মেলে ধরেছেন—আর এটাই হয়তো তার সবচেয়ে বড় অবদান।
মহান গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সাম্যের জোয়ার
‘অবস্থার সমতা’ (Equality of Conditions): ইতিহাসের অমোঘ বিধান
টোকভিলের চিন্তার একদম কেন্দ্রে রয়েছে একটি ধারণা, যা তার পুরো দর্শনকে একটি একক সূত্রে গেঁথে রেখেছে—‘অবস্থার সমতা’ (l’égalité des conditions)। তার মতে, আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় এবং অপ্রতিহত শক্তি হলো এই সাম্য। তিনি যখন আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন, প্রথম যে জিনিসটি তাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করে, তা হলো সমাজের সর্বস্তরে এক ধরনের সমতার অনুভূতি। ফ্রান্সে যেখানে জন্মপরিচয়, বংশমর্যাদা আর উপাধি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিত, সেখানে আমেরিকায় তিনি দেখলেন মানুষ তার নিজের চেষ্টায় উপরে উঠছে। কঠোর সামাজিক স্তরবিন্যাস (Rigid Social Hierarchy) প্রায় নেই বললেই চলে। একজন সাধারণ শ্রমিকও স্বপ্ন দেখে তার সন্তান একদিন দেশের কর্ণধার হবে, এবং সেই স্বপ্নকে কেউ অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয় না।
টোকভিলের কাছে এই ‘অবস্থার সমতা’ কেবল আর্থিক সমতা বা রাজনৈতিক অধিকারের সমতা ছিল না। এটি ছিল একটি মানসিক, সামাজিক এবং আত্মিক অবস্থা। এটি এমন এক সর্বব্যাপী বিশ্বাস যে, কোনো মানুষই জন্মসূত্রে অন্যের চেয়ে উঁচু বা নিচু নয়। সবাই আইনের চোখে সমান এবং সবারই সুযোগ আছে জীবনে উন্নতি করার। এটি ছিল এমন এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ যেখানে অভিজাততন্ত্রের কৃত্রিম বিভাজনগুলো ভেঙে পড়েছে। তার কাছে, এই সাম্যের বিস্তার ছিল মানব ইতিহাসের গত সাতশো বছরের কেন্দ্রীয় ঘটনা।
তিনি এই সাম্যের জোয়ারকে একটি ‘ঈশ্বরের বিধান’ (Providential Fact) বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, এটি ইতিহাসের এক অমোঘ গতি, যা শত শত বছর ধরে ধীরে ধীরে পৃথিবীকে গ্রাস করছে। তিনি তার বইয়ের ভূমিকায় এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটি বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি বড় ঘটনাই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে এই সাম্যের পথকে প্রশস্ত করেছে। ক্রুসেডের সময় রাজারা অভিজাতদের জমিজমা কেড়ে নিয়ে তাদের ক্ষমতা খর্ব করেছে; বন্দুকের আবিষ্কার সাধারণ পদাতিক সৈন্যকে বর্ম-পরা নাইটদের সমকক্ষ করে তুলেছে; ছাপাখানার আবিষ্কার জ্ঞানের দরজা সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দিয়েছে এবং চার্চের একাধিপত্য ভেঙে দিয়েছে; প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার ঈশ্বরের সামনে সবাইকে সমান ঘোষণা করেছে; এবং নতুন বাণিজ্যপথের আবিষ্কার বণিক শ্রেণিকে অভিজাতদের চেয়েও ধনী ও প্রভাবশালী করে তুলেছে। অভিজাত, রাজা, পুরোহিত, বণিক—সমাজের প্রতিটি শক্তিই নিজের অজান্তে এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সেবা করেছে। ইতিহাসের প্রতিটি পদক্ষেপই যেন সাম্যের দিকে এক একটি লাফ। তাই এই গতিকে ঠেকানোর চেষ্টা করা মানে বাতাসের বিরুদ্ধে দুর্গ তৈরি করার মতো নির্বুদ্ধিতা; স্বয়ং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। অভিজাততন্ত্রের পতন এবং গণতন্ত্রের উত্থান এই সাম্যেরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি (Tocqueville, 1835)।
আমেরিকা ছিল এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রূপ। সেখানে অভিজাততন্ত্রের কোনো অতীত ছিল না। পিউরিটানরা যখন নিউ ইংল্যান্ডের উপকূলে পা রেখেছিল, তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল এক মধ্যবিত্ত মানসিকতা এবং ঈশ্বরের চোখে সবাই সমান—এই বিশ্বাস। সেই মাটি থেকেই আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্ম। তাই টোকভিলের কাছে আমেরিকা কোনো ব্যতিক্রম ছিল না, বরং ইউরোপের ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে, তার একটি পরিষ্কার ছবি ছিল।
কিন্তু এই সাম্যই আবার জন্ম দেয় নানা রকম জটিলতার, নানা রকম মনস্তাত্ত্বিক সংকটের। এখানেই টোকভিলের দূরদর্শিতার আসল পরিচয়। তিনি কেবল গণতন্ত্রের জয়গান করেননি, এর অন্তর্নিহিত বিপদগুলোকেও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি সাম্যকে ভালোবাসতেন, কিন্তু স্বাধীনতার প্রতি তার প্রেম ছিল আরও গভীর। আর তার সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, সাম্যের প্রতি মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা একদিন স্বাধীনতাকেই গলা টিপে হত্যা করবে।
গণতান্ত্রিক আত্মার সংকট: অতৃপ্তি, ঈর্ষা এবং বস্তুবাদ (Materialism)
সাম্যের যুগ মানুষকে যেমন অভূতপূর্ব মুক্তি দেয়, তেমনি এক নতুন ধরনের অস্থিরতা আর অতৃপ্তিতেও ডুবিয়ে দেয়। টোকভিল গণতন্ত্রের মনস্তত্ত্বকে যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছেন, তা আজও বিস্ময়কর।
১. অনন্ত অতৃপ্তি ও অস্থিরতা (Perpetual Restlessness): অভিজাত সমাজে একজন সাধারণ মানুষ তার ভাগ্যকে প্রায়শই মেনে নিত। সে জানত, সে একজন কৃষকের সন্তান এবং সম্ভবত কৃষক হয়েই মারা যাবে। তার জীবনে উন্নতির আশা সীমিত ছিল, তাই তার অতৃপ্তিও ছিল সীমিত। সে তার সামাজিক অবস্থানকে প্রকৃতির বিধানের মতোই স্বাভাবিক বলে মনে করত। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে যখন সবাই সমান, তখন প্রত্যেকের সামনেই খুলে যায় অসীম সম্ভাবনার দরজা। প্রত্যেকেই দেখে যে তার প্রতিবেশীরা উন্নতি করছে, এবং সে বিশ্বাস করে যে সে-ও তা করতে পারে। এই বিশ্বাস তাকে একদিকে যেমন উদ্যমী করে তোলে, অন্যদিকে এক অনন্ত অতৃপ্তির আগুনে পোড়ায়।
এর ফলে জন্ম নেয় এক অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা। মানুষ যা পায়, তাতে সন্তুষ্ট থাকে না। সে সবসময় আরও বেশি কিছু চায়। তার দৃষ্টি সবসময় থাকে উপরের দিকে। এই অনন্ত upward mobility-র আকাঙ্ক্ষা সমাজে এক ধরনের সার্বক্ষণিক অস্থিরতা (Restlessness) তৈরি করে। টোকভিল আমেরিকানদের বর্ণনা করেছেন এমন এক জাতি হিসেবে, যারা “গুরুগম্ভীর বিষণ্ণতার মাঝেও আমোদ-প্রমোদ করে” (grave and sad, even in their pleasures)। তারা সুখের পেছনে এমনভাবে ছোটে যে, সুখ উপভোগ করার ফুরসতটুকুও পায় না। লক্ষ্যের চেয়ে লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়াটিই তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে। এই অস্থিরতা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ছায়া ফেলে, তেমনি রাজনৈতিক জীবনেও স্থিরতার অভাব ঘটায়। অভিজাততন্ত্রের শান্ত, ধীরস্থির জীবনযাত্রার বিপরীতে গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রা হলো এক অবিরাম দৌড়, যার কোনো শেষ নেই।
২. সাম্যের প্রতি তীব্র আবেগ ও ঈর্ষা (Passion for Equality and Envy): টোকভিল লক্ষ্য করেন যে, গণতান্ত্রিক মানুষ স্বাধীনতার চেয়ে সাম্যকে অনেক বেশি ভালোবাসে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হয়, দায়িত্ব নিতে হয়, এটি কষ্টসাধ্য। কিন্তু সাম্যের আনন্দ তাৎক্ষণিক এবং সহজলভ্য। তিনি বলেন, সাম্যের প্রতি এই আবেগ “একই সাথে প্রবল এবং সার্বজনীন”। আর এই সাম্যের প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় ঈর্ষা (Envy)। যখন সমাজে বৈষম্য অনেক বেশি এবং অনতিক্রম্য, তখন মানুষ তাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। কিন্তু যখন বৈষম্য কমে আসে, তখন সামান্যতম পার্থক্যও অসহনীয় হয়ে ওঠে।
গণতান্ত্রিক মানুষ তার প্রতিবেশীর সামান্য একটু বেশি সাফল্যকেও সহ্য করতে পারে না। সে চায় সবাই যেন ঠিক তার সমান হয়। এই ঈর্ষা সমাজে এক ধরনের নিচুমুখী চাপ তৈরি করে, যা অসাধারণত্বকে (Excellence) দমিয়ে দিয়ে মেডিওক্রিটি বা মাঝারি মানের জয়গান গায়। যদি কাউকে ছাড়িয়ে যাওয়া না যায়, তাহলে তাকে টেনে নামিয়ে নিজের সমান করে আনার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। এই মানসিকতা সমাজের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাগুলোকে বিকশিত হতে দেয় না। সবাই চায় গড়পড়তা হতে, কারণ গড়পড়তা হওয়াই নিরাপদ। এই ঈর্ষার চূড়ান্ত রূপ হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা কোনো ব্যতিক্রমী বা ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারে না।
৩. সর্বগ্রাসী বস্তুবাদ (Rampant Materialism): এই অস্থিরতা ও ঈর্ষার স্বাভাবিক পরিণতি হলো লাগামহীন বস্তুবাদ। যেহেতু বংশমর্যাদা, উপাধি বা অন্য কোনো সামাজিক পরিচয় আর মানুষকে আলাদা করে না, তাই সম্পদই হয়ে ওঠে মর্যাদা ও সাফল্যের প্রধান মাপকাঠি। মানুষ পার্থিব আরাম-আয়েশ এবং ছোটখাটো ভোগবিলাসের (petite jouissances) পেছনে ছুটতে শুরু করে। টোকভিল দেখেছেন, আমেরিকানরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সম্পদ আহরণের চেষ্টায় এতটাই মগ্ন যে, জীবনের মহৎ দিকগুলো—যেমন শিল্প, দর্শন বা গভীর আধ্যাত্মিক চিন্তন থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে। অভিজাত সমাজে যেখানে মানুষ প্রায়শই অবজ্ঞাভরে সম্পদকে দেখত এবং মহৎ কর্মের (great deeds) পেছনে ছুটত, সেখানে গণতান্ত্রিক মানুষ বস্তুগত আরামকে জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য বলে মনে করে।
এই বস্তুবাদ মানুষকে তার ব্যক্তিগত সুখের ছোট গণ্ডিতে আটকে ফেলে এবং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বের কথা ভুলিয়ে দেয়। তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজের ও পরিবারের জন্য একটু আরামদায়ক জীবন নিশ্চিত করা। এই মানসিকতা ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তাকে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’ নামক এক নতুন রোগের দিকে ঠেলে দেয়, যা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় বিপদগুলোর জন্ম দেয়।
গণতন্ত্রের কালো মেঘ: টোকভিলের সতর্কবাণী
টোকভিল গণতন্ত্রের প্রশংসার চেয়ে এর বিপদগুলো নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, মানুষ স্বাধীনতার চেয়ে সাম্যকে বেশি ভালোবাসে। আর এই সাম্যের অতিরিক্ত আকাঙ্ক্ষাই স্বাধীনতাকে হত্যা করতে পারে। তার বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডটি প্রায় পুরোটাই এই বিপদগুলোর এক হিমশীতল বিশ্লেষণ।
সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার (Tyranny of the Majority): আত্মার কারাগার
গণতন্ত্রের কথা বললেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে স্বাধীনতার কথা, ব্যক্তির অধিকারের কথা। কিন্তু টোকভিল এক সম্পূর্ণ নতুন ও সূক্ষ্ম বিপদের কথা বললেন, যার নাম ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার’ (Tyranny of the Majority)। এটি তার সবচেয়ে বিখ্যাত ধারণাগুলোর একটি।
সাধারণত স্বৈরাচার বলতে আমরা বুঝি একজন রাজা বা একনায়কের অত্যাচার। কিন্তু টোকভিল বললেন, গণতন্ত্রেও স্বৈরাচার সম্ভব, এবং এই স্বৈরাচার আরও ভয়ংকর হতে পারে। কারণ এখানে অত্যাচারী কোনো একজন ব্যক্তি নন, স্বয়ং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা। যখন দেশের বেশিরভাগ মানুষ একটি নির্দিষ্ট মতকে চরম সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তখন ভিন্নমত পোষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের নৈতিক কর্তৃত্ব (moral authority) এতই প্রবল হয়ে ওঠে যে, তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলাকে শুধু ভুল নয়, অনৈতিক এবং দেশদ্রোহী হিসেবেও দেখা হয়।
এই স্বৈরাচারের প্রধান অস্ত্র আইন বা শারীরিক বলপ্রয়োগ নয়, এর প্রধান অস্ত্র হলো সামাজিক চাপ (Social Pressure) এবং মানসিক বিচ্ছিন্নকরণ (Moral Isolation)। ধরুন, একটি সমাজে ৯৯ শতাংশ মানুষ একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। এখন যে একজন ব্যক্তি ভিন্নমত দেবেন, তাকে হয়তো জেলে পাঠানো হবে না বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হবে না। কিন্তু তাকে সামাজিকভাবে একঘরে করে দেওয়া হবে। মানুষ তার সাথে মিশবে না, ব্যবসায়ীরা তার সাথে ব্যবসা করবে না, রাজনৈতিক দল তাকে মনোনয়ন দেবে না, এমনকি তার বন্ধুরাও হয়তো তাকে এড়িয়ে চলবে। তার কণ্ঠকে এমনভাবে উপেক্ষা করা হবে যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই। ভিন্নমত প্রকাশ করার এই সামাজিক মূল্য (Social Cost) এতটাই বেশি যে, মানুষ ভয়ে নিজের মনের কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই নিজের মত বলে চালিয়ে দিতে শুরু করে।
টোকভিলের ভাষায়, “রাজারা কেবল শরীরকে শৃঙ্খলিত করতে পারতো, কিন্তু গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানুষের আত্মাকেও শৃঙ্খলিত করে” (Tocqueville, 1835)। এটি মানুষের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ইচ্ছাকেই (will to think) ধ্বংস করে দেয়। তিনি বলেন, “আমি আমেরিকায় এমন কোনো দেশ দেখিনি যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা এর চেয়ে কম।” এটি মননকে এমন এক অদৃশ্য বৃত্তের মধ্যে বন্দী করে (draws a formidable circle around thought), যার বাইরে যাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও সাহস পায় না। এর ফলে সমাজে নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সবাই একই রকম ভাবতে শুরু করে, একই রকম কথা বলতে শুরু করে। বৈচিত্র্য হারিয়ে গিয়ে এক ধরনের নিষ্প্রাণ সমরূপতা (Monotonous Uniformity) তৈরি হয়। সমাজে আর মহান ব্যক্তিত্ব, সাহসী চিন্তাবিদ বা অসাধারণ শিল্পীর জন্ম হয় না। কারণ অসাধারণ হতে গেলেই সংখ্যাগরিষ্ঠের গণ্ডির বাইরে যেতে হয়, যা প্রায় অসম্ভব।
টোকভিলের এই পর্যবেক্ষণ আজ একবিংশ শতাব্দীর ‘Echo Chamber’ বা ‘Filter Bubble’ এর যুগে এসে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা কেবল তাদের মতই শুনি, যারা আমাদের মতো চিন্তা করে। ভিন্নমত প্রায়ই তীব্র আক্রমণের শিকার হয়, যাকে আমরা ‘cancel culture’ বা ‘অনলাইন মব’-এর তাণ্ডব বলি। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই অদৃশ্য স্বৈরাচার আজ আমাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে প্রতিনিয়ত সংকুচিত করে চলেছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism): একাকিত্বের শীতল চাদর
গণতন্ত্রের আরেকটি বড় ফসল হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ (Individualism)। টোকভিল এই ধারণাটিকে খুব যত্ন করে স্বার্থপরতা (Egoism) থেকে আলাদা করেছেন। স্বার্থপরতা হলো একটি প্রাচীন প্রবৃত্তি, একটি নৈতিক ত্রুটি, যেখানে মানুষ কেবল নিজের কথাই ভাবে। এটি সব সমাজেই কমবেশি বিদ্যমান। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ গণতন্ত্রের ফসল। এটি একটি শান্ত, পরিণত এবং যুক্তিপূর্ণ অনুভূতি, যা প্রত্যেক নাগরিককে বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার পরিবার ও বন্ধুদের এক ছোট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে।
সাম্যের যুগে মানুষ আর কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, গিল্ড বা গোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধ থাকে না। অভিজাততন্ত্রের যুগে একজন কৃষক তার প্রভুর প্রতি, প্রভু তার রাজার প্রতি এক ধরনের দায়িত্ব অনুভব করত। সমাজের সবাই অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা ছিল, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। একজন ব্যক্তি নিজেকে এক দীর্ঘ শৃঙ্খলের অংশ হিসেবে দেখত, যা তার পূর্বপুরুষ থেকে শুরু হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু গণতন্ত্র এই শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলে (breaks the chain and severs every link of it)। মানুষ ভাবতে শুরু করে, তার ভাগ্য তার নিজের হাতে। সে তার পূর্বপুরুষকে ভুলে যায় এবং তার উত্তরসূরীদের সম্পর্কেও ভাবে না। সে কেবল নিজের সমসাময়িকদের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পায় এবং ধীরে ধীরে নিজেকে বৃহত্তর সমাজ থেকে গুটিয়ে নেয়।
সে ভাবতে শুরু করে, “আমার নিজের পরিবার আর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আমি ভালো থাকলেই হলো। বাকি সমাজের (the rest of society) কী হলো, তা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।” এই মনোভাবকেই টোকভিল বলেছেন ‘Individualism’। এটি মানুষকে একাকী করে তোলে। সে নিজের একটি ছোট্ট জগৎ (a small society for his own use) তৈরি করে এবং বাইরের বিশাল জগৎকে ভুলে যায়।
এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ যখন নাগরিকেরা সর্বজনীন বিষয় বা পাবলিক অ্যাফেয়ারস নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তখন সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। নাগরিকেরা আর একে অপরের সাথে মিলে কোনো কাজ করতে চায় না। তারা নিজেদের ছোট ছোট ব্যক্তিগত জগতে সুখী থাকতে চায়। এই বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্বই গণতন্ত্রের জন্য আরেকটি ভয়ংকর বিপদের দরজা খুলে দেয়। কারণ বিচ্ছিন্ন মেষপালকে শাসন করা সব সময়ই সহজ।
নরম স্বৈরতন্ত্র (Soft Despotism): মখমলের কারাগার
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পথ ধরে যে বিপদটি আসে, টোকভিল তার নাম দিয়েছেন ‘নরম স্বৈরতন্ত্র’ (Soft Despotism)। এটি টোকভিলের সবচেয়ে মৌলিক, দূরদর্শী এবং ভয়ংকর ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর একটি। এই ধারণাটি তিনি তার বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের একেবারে শেষ দিকে বর্ণনা করেছেন, যা তার চূড়ান্ত সতর্কবাণী হিসেবে বিবেচিত হয়।
যখন নাগরিকেরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ডুবে গিয়ে নিজেদেরকে সমাজ থেকে গুটিয়ে নেয়, তখন রাষ্ট্র বা সরকারের ক্ষমতা কল্পনাতীতভাবে বেড়ে যায়। নাগরিকেরা যেহেতু সার্বজনীন দায়িত্ব পালনে আগ্রহী নয়, সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসে সরকার। সরকার ধীরে ধীরে নাগরিকদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করে।
এই স্বৈরতন্ত্র কিন্তু পুরনো দিনের মতো নিষ্ঠুর, হিংস্র বা অত্যাচারী নয়। এটি এক বিশাল, তত্ত্বাবধায়ক এবং অভিভাবকস্বরূপ ক্ষমতা (Immense and Tutelary Power)। এই সরকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, তাদের প্রয়োজন মেটায়, তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করে, তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে, এবং তাদের উত্তরাধিকারের বিষয়গুলোও ঠিক করে দেয়। টোকভিলের ভাষায়, এই সরকার চায় “নাগরিকদের সুখী রাখতে, কিন্তু শর্ত হলো, এই সুখের একমাত্র কারিগর হবে সরকার এবং নাগরিকেরা হবে চিরকালের শিশু” (Tocqueville, 1840)। সরকার নাগরিকদের মাথার ওপর এক অদৃশ্য, জটিল, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এবং সর্বব্যাপী জাল বিছিয়ে রাখে, যা তাদের জীবনের প্রতিটি ছোটখাটো বিষয়কেও নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মানুষের কর্মোদ্যোগকে চূর্ণ করে না, বরং তাকে নরম করে, পথ দেখায় এবং নিস্তেজ করে দেয়। এটি ইচ্ছাশক্তিকে ভাঙে না, বরং তাকে দুর্বল করে, বাঁকিয়ে দেয় এবং পরিচালনা করে।
এই ‘নরম স্বৈরাচার’ নাগরিকদেরকে এক আরামদায়ক দাসত্বে (Comfortable Servitude) আবদ্ধ করে ফেলে। মানুষ আর কষ্ট করে চিন্তা করতে চায় না, কারণ সরকারই তাদের হয়ে সব ভেবে দিচ্ছে। তারা আর ঝুঁকি নিতে চায় না, কারণ সরকার তাদের সবকিছুর নিরাপত্তা দিচ্ছে। এর ফলে নাগরিকেরা ধীরে ধীরে তাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা (faculty of exercising their will), সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা হয়ে ওঠে একদল ভীতু ও কর্মহীন প্রাণী (a flock of timid and industrious animals), যার মেষপালক হলো স্বয়ং রাষ্ট্র।
সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো, এই পরাধীনতাকে মানুষ পরাধীনতা বলে মনে করে না। কারণ এই স্বৈরাচারী শাসককে তারাই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। তারা ভাবে, যেহেতু শাসক তাদেরই নির্বাচিত, তাই তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়াটা নিরাপদ। তারা নিজেদের স্বাধীনতাকে একটু একটু করে বিসর্জন দেয় আরাম ও নিরাপত্তার বিনিময়ে। তারা বছরে একবার তাদের মনিবকে বেছে নেওয়ার জন্য পরাধীনতার খোলস থেকে বেরিয়ে আসে, এবং তারপর আবার সেই খোলসে ঢুকে পড়ে। টোকভিল এই অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন এমন এক ব্যবস্থা হিসেবে যেখানে “সার্বভৌমত্বের চর্চা এবং দাসত্ব” একসাথে সহাবস্থান করে।
আজকের দিনে আমরা যখন দেখি, কীভাবে ওয়েলফেয়ার স্টেট, বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানি এবং রাষ্ট্র আমাদের জীবনের প্রতিটি তথ্য নিয়ন্ত্রণ করছে, আমাদের পছন্দ-অপছন্দকে প্রভাবিত করছে এবং আমাদের জন্য ‘নিরাপদ’ পরিবেশ তৈরি করার নামে আমাদের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করছে, তখন টোকভিলের এই ‘নরম স্বৈরতন্ত্রের’ ধারণাটিকে আর কাল্পনিক বলে মনে হয় না।
আমেরিকান প্রতিষেধক: স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখার উপায়
টোকভিল কেবল সমস্যাগুলোই চিহ্নিত করেননি, তিনি এর থেকে মুক্তির কিছু উপায়ও বাতলে দিয়েছেন। তার মতে, আমেরিকানরা নিজের অজান্তেই গণতন্ত্রের এই বিপদগুলো মোকাবিলা করার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান ও অভ্যাস গড়ে তুলেছে। এগুলোই হলো গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিষেধক (Antidotes)।
১. সংগঠন ও সংঘ (Civil Associations): একাকিত্বের মহৌষধ
টোকভিলকে যে জিনিসটি আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল, তা হলো আমেরিকানদের সংঘবদ্ধ হওয়ার বিস্ময়কর প্রবণতা। তিনি লিখেছেন, “আমেরিকানরা যেকোনো বয়সে, যেকোনো অবস্থায় এবং যেকোনো ধরনের মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রতিনিয়ত সংঘ বা সংগঠন (Associations) তৈরি করে।” (Tocqueville, 1840)। একটি রাস্তা তৈরি করা, একটি স্কুল বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা, একটি বই প্রকাশ করা, মদ্যপান নিবারণ করা, এমনকি কোনো নৈতিক বা ধর্মীয় সত্য প্রচার করার জন্যও তারা একত্রিত হয়। ফ্রান্সে যেখানে মানুষ কোনো সমস্যার জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেখানে আমেরিকায় দশজন মানুষ একত্রিত হয়ে একটি কমিটি গঠন করে ফেলে।
এই ছোট ছোট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো (Civil Associations) গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ:
-
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রতিহত করে: এগুলো মানুষকে তাদের ব্যক্তিগত খোলস থেকে বের করে এনে বৃহত্তর সমাজের সাথে যুক্ত করে। মানুষ শেখে কীভাবে একে অপরের সাথে মিলে কাজ করতে হয়, কীভাবে একটি সাধারণ লক্ষ্যের জন্য নিজের স্বার্থকে কিছুটা ত্যাগ করতে হয়। এটি বিচ্ছিন্ন পরমাণুর মতো নাগরিকদেরকে একত্রিত করে একটি সমাজ তৈরি করে।
-
স্বাধীনতার শিক্ষানবিশকাল: এই সংগঠনগুলো হলো ‘স্বাধীনতার পাঠশালা’ (Free Schools of Liberty)। এখানে নাগরিকেরা অংশগ্রহণের মাধ্যমে শেখে কীভাবে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কাজ করে—কীভাবে সভা ডাকতে হয়, কীভাবে আলোচনা করতে হয়, কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকে সম্মান করতে হয় এবং সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে টোকভিল বলেছেন ‘স্বাধীনতার শিক্ষানবিশকাল’ (Apprenticeship of Liberty)। তিনি এই সংঘবদ্ধ হওয়ার দক্ষতাকে “the mother of all sciences” বলেছেন।
-
রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমিত করে: এই সংগঠনগুলো সরকার ও ব্যক্তির মাঝখানে একটি বাফার জোন তৈরি করে। তারা এমন অনেক কাজ করে, যা অন্যথায় সরকারকে করতে হতো। এর ফলে রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী ক্ষমতা সীমিত থাকে এবং ‘নরম স্বৈরতন্ত্রের’ উত্থানকে প্রতিহত করে।
এই ধারণাটি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘নাগরিক সমাজ’ (Civil Society) নামে পরিচিত, যার অন্যতম প্রথম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রবক্তা ছিলেন টোকভিল। আজকের দিনে রবার্ট পুটনামের মতো সমাজবিজ্ঞানীরা যখন সমাজে সংঘবদ্ধতার অবক্ষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং একে ‘বোলিং অ্যালোন’ (Bowling Alone) বলে অভিহিত করেন (Putnam, 2000), তখন তারা আসলে টোকভিলের চিন্তারই প্রতিধ্বনি করেন।
২. ধর্মের পরোক্ষ কিন্তু শক্তিশালী ভূমিকা (The Indirect Role of Religion)
টোকভিল নিজে খুব ধার্মিক ছিলেন না, বরং তার মধ্যে এক ধরনের সংশয়বাদ কাজ করত। কিন্তু তিনি আমেরিকান গণতন্ত্রে ধর্মের ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখেছেন। ইউরোপে যেখানে ধর্ম ও স্বাধীনতাকে প্রায়শই শত্রু হিসেবে দেখা হতো (বিশেষ করে ফরাসি বিপ্লবের অভিজ্ঞতার পর, যেখানে চার্চ পুরনো শাসনব্যবস্থার অংশ ছিল), সেখানে আমেরিকায় তিনি দেখলেন এ দুটো একে অপরের হাত ধরে চলছে।
আমেরিকায় ধর্ম সরাসরি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করত না। গির্জা ও রাষ্ট্র ছিল পৃথক (Separation of Church and State)। টোকভিলের মতে, এই পৃথকীকরণই ছিল আমেরিকায় ধর্মের শক্তির মূল কারণ। রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কারণে ধর্ম নৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব বজায় রাখতে পেরেছিল। এটি কীভাবে গণতন্ত্রকে সাহায্য করত?
-
নৈতিকতার উৎস হিসেবে: ধর্ম মানুষকে একটি নৈতিক দিশা (Moral Compass) দিত। এটি লাগামহীন বস্তুবাদ এবং চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ওপর একটি অদৃশ্য লাগাম পরিয়ে রাখত। ধর্ম মানুষকে শেখাত যে, পার্থিব সুখই জীবনের সবকিছু নয়, এবং কিছু নৈতিক সীমানা আছে যা লঙ্ঘন করা উচিত নয়। এটি পরিবারকে শক্তিশালী করত এবং সামাজিক শৃঙ্খলাকে বজায় রাখত।
-
স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে: ধর্ম মানুষকে সরকারের ঊর্ধ্বে একটি উচ্চতর কর্তৃপক্ষের (Higher Authority) কথা স্মরণ করিয়ে দিত। এই বিশ্বাস মানুষের মনে এই ধারণা জন্মায় যে, তার স্বাধীনতা এবং মর্যাদা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত নয়, বরং তা ঈশ্বরপ্রদত্ত। তাই কোনো সরকারই তা কেড়ে নিতে পারে না। এটি সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একটি নৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলত।
-
‘স্বার্থকে সঠিকভাবে বোঝা’ (Self-Interest Rightly Understood): টোকভিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেন, যার নাম ‘l’intérêt bien entendu’ বা ‘self-interest rightly understood’। এটি বিশুদ্ধ পরার্থপরতা নয়, বরং এক ধরনের আলোকিত স্বার্থপরতা। আমেরিকানরা বুঝতে পেরেছিল যে, কেবল নিজের স্বার্থ দেখলে দীর্ঘমেয়াদে নিজেরই ক্ষতি। অন্যের উপকার করলে বা সমাজের জন্য কাজ করলে প্রকারান্তরে নিজেরই ভালো হয়। যেমন, কর দেওয়া, সৎ থাকা বা প্রতিবেশীকে সাহায্য করা শেষ পর্যন্ত নিজের জন্যই লাভজনক। ধর্ম এই পরোপকারী মনোভাবকে উৎসাহিত করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে একটি স্বাস্থ্যকর ও সামাজিক পথে চালিত করত।
টোকভিলের মতে, স্বাধীনতা যদি নৈতিকতার বন্ধন ছাড়া হয়, তবে তা বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয়। ধর্ম সেই নৈতিকতার যোগান দেয়। “স্বাধীনতা ধর্মকে তার প্রধান সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করে,” তিনি লিখেছিলেন, “কারণ এটিই নৈতিকতার রক্ষাকবচ এবং অধিকারের নিশ্চয়তা।” (Tocqueville, 1835)।
৩. ‘ম্যুরস’ (Mœurs): হৃদয়ের অভ্যাস এবং স্বাধীনতার পাঠশালা
টোকভিলের কাছে আইন বা সংবিধানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটি দেশের মানুষের ‘ম্যুরস’ (Mœurs)। এই ফরাসি শব্দটির সরাসরি কোনো ইংরেজি বা বাংলা প্রতিশব্দ নেই। এর অর্থ হলো একটি সমাজের মানুষের সম্মিলিত অভ্যাস, মূল্যবোধ, মানসিকতা এবং দৈনন্দিন জীবনের অলিখিত নিয়মকানুন। এক কথায়, ‘হৃদয়ের অভ্যাস’ (Habits of the Heart)।
টোকভিলের মতে, আমেরিকার গণতন্ত্রের সাফল্যের পেছনে তার চমৎকার সংবিধানের চেয়েও বেশি অবদান ছিল আমেরিকানদের এই ‘ম্যুরস’-এর। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল:
-
স্থানীয় স্ব-শাসন (Local Self-Government): নিউ ইংল্যান্ডের ‘টাউনশিপ’ (Township) মিটিংগুলো ছিল গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পাঠশালা। এখানে সাধারণ নাগরিকেরা তাদের নিজেদের রাস্তা, স্কুল বা অন্যান্য স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করত, একসাথে সিদ্ধান্ত নিত এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য কাজ করত। এই ছোট পরিসরে অংশগ্রহণের অভ্যাসই তাদের শিখিয়ে দিত কীভাবে বড় পরিসরে দেশের জন্য কাজ করতে হয়। এটিই ছিল নরম স্বৈরতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক, কারণ এটি নাগরিকদের নিষ্ক্রিয় থাকতে দিত না, বরং তাদের সক্রিয় ও দায়িত্বশীল করে তুলত।
-
স্বাধীন গণমাধ্যম (Free Press): একটি স্বাধীন এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ গণমাধ্যম বিভিন্ন মতকে মানুষের সামনে তুলে ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচারকে প্রতিহত করে। এটি নাগরিকদেরকে তাদের স্থানীয় সম্প্রদায়ের বাইরেও বৃহত্তর জগতের সাথে যুক্ত রাখে এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।
-
জুরি ব্যবস্থা (The Jury System): টোকভিল জুরি ব্যবস্থাকে কেবল একটি বিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের জন্য এক অসাধারণ শিক্ষালয় হিসেবে। জুরির সদস্য হিসেবে একজন সাধারণ নাগরিককে আইন বুঝতে হয়, যুক্তি বিশ্লেষণ করতে হয় এবং ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে হয়। এই প্রক্রিয়া তাকে দায়িত্বশীল নাগরিকে পরিণত করে এবং তাকে শেখায় যে আইন কেবল দূরবর্তী কোনো শক্তি নয়, বরং তা সমাজেরই একটি অংশ। টোকভিলের ভাষায়, জুরি ব্যবস্থা হলো “জনগণের শাসনক্ষমতার একটি অংশ, যা তাদেরকে নিজেদের শাসন করতে শেখায়।”
টোকভিলের দৃষ্টির প্রসার: বিপ্লব, জাতি এবং সংস্কৃতি
টোকভিলের বিশ্লেষণ কেবল আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি তার আমেরিকান পর্যবেক্ষণকে ব্যবহার করে আরও বৃহত্তর ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন।
ফরাসি বিপ্লব এবং পুরনো শাসনব্যবস্থা (The Ancien Régime and the Revolution)
আমেরিকা নিয়ে কাজ করার প্রায় দুই দশক পর টোকভিল তার নিজের দেশ ফ্রান্সের দিকে মনোযোগ দেন এবং রচনা করেন তার দ্বিতীয় বিখ্যাত গ্রন্থ—‘দি ওল্ড রেজিম অ্যান্ড দ্য ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন’ (L’Ancien Régime et la Révolution, 1856)। এই বইটিতে তিনি এক বৈপ্লবিক যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ফরাসি বিপ্লব কোনো আকস্মিক ঘটনা বা পুরনো ব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ছিল না, বরং এটি ছিল পুরনো শাসনব্যবস্থারই এক যৌক্তিক পরিণতি।
তার মূল বক্তব্য ছিল, বিপ্লবীরা যে কেন্দ্রীভূত (Centralized) রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করেছিল, তার ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছিল বিপ্লবের শিকার হওয়া ফরাসি রাজতন্ত্রই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফরাসি রাজারা স্থানীয় অভিজাতদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে প্যারিস থেকে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসন (administrative centralization) গড়ে তুলেছিল। তারা সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণিতে এমনভাবে বিভক্ত করে রেখেছিল যে, কোনো শ্রেণির মানুষ অন্য শ্রেণির সাথে মিশতে পারত না। অভিজাতরা কর দিত না কিন্তু সম্মান পেত, বুর্জোয়ারা শহরে থাকত এবং কৃষকদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সবাই বিচ্ছিন্ন ছিল এবং কেবল সরকারের দিকেই তাকিয়ে থাকত।
এই কেন্দ্রীভূতকরণ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাই বিপ্লবের আসল কারণ ছিল। যখন পুরনো শাসনব্যবব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, তখন ফরাসিদের কাছে একত্রিত হয়ে নিজেদের শাসন করার কোনো অভিজ্ঞতা বা ‘ম্যুরস’ ছিল না, যা আমেরিকানদের ছিল। তারা একমাত্র যে মডেলটি চিনত, তা হলো শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের মডেল। তাই জ্যাকোবিন থেকে শুরু করে নেপোলিয়ন পর্যন্ত সবাই খুব সহজেই পুরনো রাজাদের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী রূপে ফিরিয়ে আনল। টোকভিল দেখালেন, বিপ্লব আসলে যতটা না পরিবর্তন এনেছিল, তার চেয়ে বেশি ধারাবাহিকতা (Continuity) বজায় রেখেছিল (Tocqueville, 1856)। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে, স্বাধীনতা কেবল স্বৈরাচারকে উৎখাত করলেই অর্জিত হয় না। স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন সমাজের অভ্যন্তরে শক্তিশালী স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অভ্যাস।
আমেরিকার গভীরতম ক্ষত: জাতি-সমস্যা (The Problem of Race)
টোকভিল আমেরিকার উজ্জ্বল দিকের পাশাপাশি এর অন্ধকার দিকটিও দেখতে পেয়েছিলেন। তার বইয়ের প্রথম খণ্ডের সবচেয়ে বিষণ্ণ এবং হতাশাপূর্ণ অধ্যায়টি হলো আমেরিকার তিন জাতি—শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ (আফ্রিকান-আমেরিকান) এবং আদিবাসী আমেরিকানদের (Native Americans)—সম্পর্ক নিয়ে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাম্য এবং স্বাধীনতার এই স্বর্গরাজ্যে দাসপ্রথা (Slavery) হলো এক মারাত্মক স্ববিরোধিতা এবং এক গভীর ক্ষত।
তিনি অত্যন্ত দুঃখের সাথে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, এই জাতি-সমস্যা আমেরিকার ভবিষ্যৎকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। তিনি আদিবাসী আমেরিকানদের করুণ পরিণতি দেখেছেন, যাদেরকে সভ্যতার নামে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছিল। আর কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাপারে তার বিশ্লেষণ ছিল আরও ভয়ংকর। তিনি লক্ষ্য করেন, দাসপ্রথা কেবল দাসকেই নয়, তার মনিবকেও নৈতিকভাবে ধ্বংস করে। এটি মনিবের মধ্যে অলসতা, ঔদ্ধত্য এবং স্বৈরাচারী মনোভাব তৈরি করে, যা গণতান্ত্রিক চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি আরও দেখেছেন, উত্তরে যেখানে দাসপ্রথা ছিল না, সেখানেও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বিদ্বেষ (Prejudice) আরও বেশি প্রকট। কারণ দক্ষিণে দাসপ্রথা কৃষ্ণাঙ্গদের একটি নির্দিষ্ট সামাজিক স্থানে আটকে রাখত, কিন্তু উত্তরে আইনগত সাম্য থাকা সত্ত্বেও সামাজিক বিদ্বেষ তাদের আরও বেশি বিচ্ছিন্ন ও কোণঠাসা করে ফেলত।
তিনি বলেন, দাসপ্রথা তুলে দিলেও এই বর্ণবিদ্বেষ থেকে যাবে এবং এটিই হবে আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে, এই দুই জাতির মধ্যে হয় ভয়ংকর সংঘাত লাগবে, নয়তো তারা সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। তিনি লিখেছিলেন, “আমার মনে হয়, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যে নিয়তি অপেক্ষা করছে, তা হলো: হয় তারা সম্পূর্ণ মিশে যাবে, নয়তো সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে।” তার এই পর্যবেক্ষণ প্রায় ৩০ বছর পর আমেরিকান গৃহযুদ্ধের (Civil War) মাধ্যমে এবং পরবর্তী এক শতাব্দীর বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাসের মাধ্যমে মর্মান্তিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
গণতন্ত্রের সংস্কৃতি: শিল্প, সাহিত্য, ভাষা ও নারী
টোকভিল এটাও বিশ্লেষণ করেছেন যে, গণতন্ত্র কীভাবে মানুষের রুচি, শিল্প, সাহিত্য এমনকি ভাষাকেও প্রভাবিত করবে।
-
শিল্প ও সাহিত্য: তিনি মনে করতেন, অভিজাত সমাজে শিল্প ও সাহিত্য হতো মহৎ, পরিশীলিত এবং মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য। এর বিষয়বস্তু হতো পৌরাণিক, ঐতিহাসিক বা আদর্শায়িত। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে শিল্প ও সাহিত্য হবে গণমানুষের জন্য। তাই তা আর মহাকাব্যিক বা কালজয়ী হওয়ার চেষ্টা করবে না, বরং তা হবে বাস্তবধর্মী, আবেগপ্রবণ এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকেন্দ্রিক। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে, গণতন্ত্রে ছোট ছোট আবেগ, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ এবং বাস্তব জীবনের ছবিই হবে সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য।
-
ভাষা ও ইতিহাস: তিনি লক্ষ্য করেন, গণতান্ত্রিক মানুষ বিমূর্ত এবং সাধারণীকৃত (abstract and general) শব্দ ব্যবহার করতে পছন্দ করে। এটি তাদের চিন্তার আলস্য এবং সবকিছুকে সহজবোধ্য করার প্রবণতা থেকে আসে। একইভাবে, গণতান্ত্রিক ঐতিহাসিকরা ইতিহাসের গতিপথ ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো মহান ব্যক্তির ভূমিকার চেয়ে বৃহত্তর, নৈর্ব্যক্তিক শক্তি বা সাধারণ কারণের (general causes) ওপর বেশি জোর দেন। এটিও ব্যক্তিকে ক্ষুদ্র করে এবং সমষ্টিকে বড় করে দেখার গণতান্ত্রিক প্রবণতারই অংশ।
-
নারীর ভূমিকা: তিনি আমেরিকান পরিবার এবং নারীর ভূমিকা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি দেখেছেন, আমেরিকান নারীরা ইউরোপীয় নারীদের মতো চাকচিক্যময় সামাজিক জীবনে অংশ না নিলেও, তাদের নৈতিক দৃঢ়তা, স্বাধীনতা এবং শিক্ষার কারণে তারা পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। তিনি ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে গিয়ে বলেন, আমেরিকান নারীরা পুরুষদের সমান, কিন্তু ভিন্ন (equal but different)। তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের ভূমিকা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে, কিন্তু সেই পরিসরে তাদের কর্তৃত্ব এবং প্রভাব অপরিসীম। তিনি মনে করতেন, এই শক্তিশালী পারিবারিক কাঠামো এবং নারীর নৈতিক শক্তিই আমেরিকান সমাজের নৈতিক ভিত্তি এবং গণতন্ত্রের অস্থিরতার বিরুদ্ধে একটি বড় রক্ষাকবচ।
এক বিষণ্ণ আশাবাদী
টোকভিলকে প্রায়শই ‘গণতন্ত্রের নবী’ বলা হয়, কিন্তু তিনি কোনো হতাশাবাদী নবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ‘বিষণ্ণ আশাবাদী’। তিনি গণতন্ত্রের অনিবার্যতায় বিশ্বাস করতেন, কিন্তু এর বিপদ সম্পর্কে ছিলেন সদা সতর্ক। তিনি ছিলেন একজন অভিজাত, যিনি নিজের শ্রেণির অবসানকে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু অভিজাততন্ত্রের কিছু গুণাবলি, যেমন – ব্যক্তির সম্মান, মহৎ আকাঙ্ক্ষা (Great Ambition), শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আকর্ষণ এবং স্বাধীনতার প্রতি গভীর ভালোবাসাকে, গণতন্ত্রের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন (Aron, 1965)।
তার লেখা পড়লে এক ধরনের বিষণ্ণতা কাজ করে। কারণ তিনি এমন এক বিশ্বের ছবি এঁকেছেন যেখানে মানুষ সমান কিন্তু একাকী, স্বাধীন কিন্তু ক্ষুদ্র, এবং নিরাপদ কিন্তু নিষ্ক্রিয়। তিনি কোনো সহজ সমাধান দেননি। তিনি শুধু পথ দেখিয়েছেন, বিপদের সংকেত দিয়েছেন। তার বার্তাটি খুব স্পষ্ট: স্বাধীনতা কোনো ঈশ্বরের দান নয় যে, একবার পেলেই তা চিরকাল থাকবে। স্বাধীনতা একটি ভঙ্গুর শিল্পকর্মের মতো, যাকে প্রতিনিয়ত যত্ন করতে হয়। একে প্রতিদিনের চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়, রক্ষা করতে হয়। আর এই চর্চার ক্ষেত্র হলো আমাদের স্থানীয় সরকার, আমাদের পাড়ার ক্লাব, আমাদের নাগরিক সংগঠন এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া।
যদি আমরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের শীতল চাদরে নিজেদের গুটিয়ে ফেলি, যদি আমরা আরামদায়ক নিরাপত্তার বিনিময়ে আমাদের সমালোচনামূলক চিন্তাকে রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিই, তবে টোকভিলের বর্ণিত ‘নরম স্বৈরতন্ত্র’ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক মখমলের কারাগার নিয়ে। আর যদি আমরা সচেতন নাগরিক হিসেবে একে অপরের হাত ধরি, নিজেদের সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করি এবং ভিন্নমতকে সম্মান জানিয়ে একটি প্রাণবন্ত ও কোলাহলপূর্ণ নাগরিক সমাজ গড়ে তুলি, তবেই গণতন্ত্রের মহৎ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হতে পারে।
টোকভিলের সেই পঁচিশ বছরের ফরাসি যুবকটি আজও যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার বিষণ্ণ কিন্তু গভীর চাহনি দিয়ে। তিনি আমাদের প্রশ্ন করছেন, “তোমরা কোন পথটি বেছে নেবে? স্বাধীনতার কণ্টকাকীর্ণ কিন্তু মহৎ পথ, নাকি আরামদায়ক পরাধীনতার মসৃণ কিন্তু হীন পথ?” এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের প্রজন্মকে, এবং আগামী প্রতিটি প্রজন্মকে, নিজেদের কাজের মাধ্যমেই দিয়ে যেতে হবে।
তথ্যসূত্র
- Aron, R. (1965). Main Currents in Sociological Thought, Vol. 1: Montesquieu, Comte, Marx, Tocqueville, and the Sociologists and the Revolution of 1848. (R. Howard & H. Weaver, Trans.). Basic Books.
- Bellah, R. N., Madsen, R., Sullivan, W. M., Swidler, A., & Tipton, S. M. (1985). Habits of the Heart: Individualism and Commitment in American Life. University of California Press.
- Kahan, A. S. (2015). Tocqueville, Democracy, and Religion: Checks and Balances for Democratic Souls. Oxford University Press.
- Pangle, L. S. (2000). The Political Philosophy of Montesquieu. In L. Strauss & J. Cropsey (Eds.), History of Political Philosophy (3rd ed., pp. 553-574). University of Chicago Press.
- Putnam, R. D. (2000). Bowling Alone: The Collapse and Revival of American Community. Simon & Schuster.
- Siedentop, L. (2000). Tocqueville. Oxford University Press.
- Tocqueville, A. de. (2000). Democracy in America. (H. C. Mansfield & D. Winthrop, Trans.). University of Chicago Press. (Original work published 1835 & 1840).
- Tocqueville, A. de. (1955). The Old Régime and the French Revolution. (S. Gilbert, Trans.). Doubleday Anchor Books. (Original work published 1856).
- Welch, C. B. (2001). De Tocqueville. Oxford University Press.
Leave a Reply