অ্যাডাম স্মিথ: যে ঋষি অর্থনীতির গল্প শুনিয়েছিলেন

Table of Contents

ভূমিকা

এক কাপ চা। আপনার সামনে টেবিলে রাখা ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা। খুব সাধারণ একটা ব্যাপার, তাই না? কিন্তু একটু থামুন। এই সাধারণ ঘটনার পেছনে যে অসাধারণ এক জগত লুকিয়ে আছে, তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?

এই চায়ের পেছনের গল্পটা কী? আছে চা পাতা, চিনি, দুধ, পানি, আগুন, আর যে পোর্সেলিনের কাপে চুমুক দিচ্ছেন, সেই কাপ। আচ্ছা, এই সবকটা জিনিস আপনার রান্নাঘরে বা আপনার টেবিলে পৌঁছাল কী করে?

চা পাতা এসেছে হয়তো সুদূর সিলেট, দার্জিলিং বা কেনিয়ার কোনো সবুজ পাহাড় থেকে। সেই বাগানে কাজ করেছেন শত শত শ্রমিক, যাদের নাম বা মুখ আপনি কোনোদিন জানবেন না। তারপর সেই পাতা কারখানায় শুকানো হয়েছে, গুঁড়ো হয়েছে, প্যাকেজিং করা হয়েছে। সেখান থেকে জাহাজে বা ট্রাকে করে হয়তো চট্টগ্রাম বন্দরে বা অন্য কোথায় এসেছে, তারপর কোনো এক পাইকারি বিক্রেতার গুদামে। সেখান থেকে আপনার পাড়ার মুদি দোকানদার কিনে এনেছেন। চিনি এসেছে অন্য কোনো চিনিকল থেকে, যার আখ চাষ করেছেন অন্য কোনো কৃষক। দুধ এসেছে কোনো খামার থেকে, কাপটা তৈরি হয়েছে কোনো এক কুমোরের বাড়িতে বা বড় সিরামিকের কারখানায়। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য যে জ্বালানি লেগেছে, তা হয়তো এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো তেলক্ষেত্র থেকে।

এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অংশীদারদের কেউ আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। আপনার ভালো-মন্দ, আপনার সুখ-দুঃখ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। চা বাগানের মালিক, ট্রাক ড্রাইভার, দোকানদার—প্রত্যেকেই কাজ করছেন নিজের লাভের জন্য, নিজের পেট চালানোর জন্য। কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার! তাদের এই লক্ষ লক্ষ বিচ্ছিন্ন, ব্যক্তিগত স্বার্থের চেষ্টা থেকেই আপনার টেবিলে এসে হাজির হয়েছে নিখুঁত এক কাপ চা।

ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত, তাই না? যেন কোনো এক অদৃশ্য জাদুকর পর্দার আড়াল থেকে সুতো নেড়ে সবকিছু মিলিয়ে দিচ্ছেন। যেন এক বিশাল অর্কেস্ট্রা, যেখানে প্রত্যেক বাদক নিজের সুর বাজাচ্ছে, কিন্তু সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এক অপূর্ব সিম্ফনি। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে স্কটল্যান্ডের এক অন্যমনস্ক অধ্যাপক ঠিক এই অদ্ভুত ব্যাপারটি নিয়েই গভীরভাবে ভাবছিলেন। তাঁর নাম অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith)। তিনি কেবল একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন একজন প্রখর নীতিবিদ ও দার্শনিক। তিনি মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক সহযোগিতার পেছনের রহস্যটা বুঝতে চেয়েছিলেন। আর সেই বুঝতে চাওয়ার ভেতর থেকেই জন্ম নিয়েছিল আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি।

চলুন, আজ আমরা এই অন্যরকম দার্শনিকের চিন্তার জগতে একটু ডুব দিই। তাঁর ভাবনাগুলো কোনো নীরস, জটিল তত্ত্বকথা নয়, বরং আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে, আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে নতুন করে আবিষ্কার করার এক আশ্চর্য সুন্দর চশমা।

কে ছিলেন এই অন্যমনস্ক অধ্যাপক?

গল্পের নায়ককে না চিনলে গল্প ঠিক জমে না। অ্যাডাম স্মিথের জন্ম হয়েছিল ১৭২৩ সালে, স্কটল্যান্ডের ফার্থ অফ ফোর্থের তীরে অবস্থিত এক ছোট বন্দর শহর কার্কক্যালডিতে (Kirkcaldy)। সময়টা ছিল দারুণ এক উত্তেজনার। ইউরোপজুড়ে তখন চলছে জ্ঞানদীপ্তি বা এনলাইটেনমেন্টের (Enlightenment) যুগ। গুটিকয়েক মানুষের বিশ্বাস বা রাজার আদেশের বদলে মানুষ তখন যুক্তি, পর্যবেক্ষণ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করছে। নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানের আবিষ্কার যেমন প্রকৃতির নিয়ম উন্মোচন করেছিল, তেমনি স্মিথের মতো চিন্তাবিদরা চাইছিলেন মানব সমাজের নিয়মগুলো আবিষ্কার করতে।

স্কটল্যান্ডে এই ঢেউটা লেগেছিল বেশ জোরে, যাকে বলা হয় স্কটিশ এনলাইটেনমেন্ট (Scottish Enlightenment)। এটি ছিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিস্ফোরণের যুগ। ডেভিড হিউম (David Hume), ফ্রান্সিস হাচিসন (Francis Hutcheson), অ্যাডাম ফার্গুসন (Adam Ferguson)-এর মতো দিকপাল চিন্তাবিদদের সঙ্গে স্মিথ ছিলেন এই ঢেউয়েরই একজন অগ্রগণ্য নাবিক। তাঁরা ক্লাব ও কফিহাউসে বসে মানুষের প্রকৃতি, নৈতিকতা, সরকার এবং বাণিজ্য নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্কে মগ্ন থাকতেন।

বাবার মুখ তিনি দেখেননি, জন্মের কয়েক মাস আগেই তাঁর বাবা মারা যান। মা-ই ছিলেন তাঁর সবকিছু। স্মিথ ছিলেন কিছুটা অন্যমনস্ক প্রকৃতির এবং শারীরিকভাবে দুর্বল। কথিত আছে, তিনি একবার এতটাই চিন্তায় মগ্ন ছিলেন যে হাঁটতে হাঁটতে শহরের বাইরে এক মাঠে চলে গিয়েছিলেন, পরনের নাইটগাউনটাও বদলাননি। আশপাশের গির্জার ঘণ্টার শব্দে তাঁর হুঁশ ফেরে। এই অন্যমনস্ক ভাবটাই হয়তো তাঁকে আর দশজনের চেয়ে গভীরের জিনিস দেখতে সাহায্য করেছিল। তিনি বাস্তব জগতের বিশৃঙ্খলা ও কোলাহলের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য শৃঙ্খলাকে দেখতে পেতেন।

চোদ্দ বছর বয়সে তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, যা তখন ইউরোপের অন্যতম সেরা শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এখানে তিনি নৈতিক দর্শনের অধ্যাপক ‘অবিস্মরণীয়’ ফ্রান্সিস হাচিসনের (the ‘never to be forgotten’ Francis Hutcheson) দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। হাচিসন বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যে এক ধরনের সহজাত নৈতিক বোধ (Moral Sense) আছে, যা তাকে ভালো-মন্দের পথ দেখায়। ঈশ্বর মানুষকে স্বার্থপরতার পাশাপাশি পরোপকারের আকাঙ্ক্ষাও দিয়েছেন। এই ভাবনা স্মিথের পরবর্তী কাজের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। এরপর তিনি অক্সফোর্ডে পড়তে যান, কিন্তু সেখানকার পরিবেশ তাঁর ভালো লাগেনি। অক্সফোর্ডের শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর কাছে প্রাণহীন ও সেকেলে মনে হয়েছিল। তিনি নিজের মতো করে পড়াশোনা করে সময় কাটান।

গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে ১৭৫১ সালে তিনি নীতিদর্শনের (Moral Philosophy) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপক হিসেবে তিনি ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল ব্যাপক—নৈতিকতা, অলঙ্কারশাস্ত্র, আইনশাস্ত্র এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি। তাঁর প্রথম বিখ্যাত বই অর্থনীতির ওপর ছিল না, ছিল মানুষের নৈতিক আচরণ নিয়ে। বইটির নাম ‘The Theory of Moral Sentiments’ (১৭৫৯)। এই বইটিই তাঁকে সে সময়ে ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয়। এটি তাঁকে ডেভিড হিউমের মতো দার্শনিকদের প্রথম সারিতে স্থান দেয়, যাঁর সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল।

এরপর তিনি ডিউক অফ বাকলু-র (Duke of Buccleuch) গৃহশিক্ষক হিসেবে একটি লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তাঁর সঙ্গে ফ্রান্স ভ্রমণে যান। এই ভ্রমণ তাঁর চিন্তাজগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তিনি জেনেভায় ভলতেয়ারের সঙ্গে দেখা করেন এবং প্যারিসে ক্যানে (François Quesnay) এবং তুরগোর (Anne-Robert-Jacques Turgot) মতো ফরাসি ফিজিওক্র্যাট (Physiocrats) চিন্তাবিদদের সঙ্গে পরিচিত হন। ফিজিওক্র্যাটরা বিশ্বাস করতেন, কৃষিকাজই হলো সম্পদের একমাত্র প্রকৃত উৎস; শিল্প ও বাণিজ্য কেবল বিদ্যমান সম্পদকে রূপান্তরিত করে, নতুন কিছু তৈরি করে না। তাদের চিন্তাভাবনা স্মিথকে প্রভাবিত করলেও তিনি তাদের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হননি। তিনি বুঝতে পারছিলেন, শ্রম – তা সে কৃষিতেই হোক বা শিল্পে – সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে।

এই সব অভিজ্ঞতা আর দীর্ঘ দশ বছরের গবেষণার ফসল হিসেবে ১৭৭৬ সালে তিনি প্রকাশ করেন সেই যুগান্তকারী বই, যা আজ পর্যন্ত অর্থনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত—‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’। আমরা ভালোবেসে বইটিকে ‘The Wealth of Nations’ নামেই ডাকি।

অনেকে মনে করেন, অ্যাডাম স্মিথ মানেই কেবল টাকার আলাপ, লাভের হিসাব, আর লাগামছাড়া পুঁজিবাদের জয়গান। এটা মস্ত বড় একটা ভুল। স্মিথকে ঠিকভাবে বুঝতে হলে তাঁর দুটো বইকেই পাশাপাশি রাখতে হবে। প্রথম বইটিতে তিনি এঁকেছেন মানুষের নৈতিকতার ছবি, দেখিয়েছেন মানুষ কীভাবে সমাজবদ্ধ হয়ে বাঁচে, কীভাবে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। আর দ্বিতীয় বইটিতে দেখিয়েছেন, সেই নৈতিক মানুষ যখন বাজারে গিয়ে লেনদেন করে, তখন কী ঘটে। একটাকে ছাড়া অন্যটা বোঝা অনেকটা এক চোখ বন্ধ করে পুরো পৃথিবী দেখার মতো।

যে ঝড়ের দিনে জন্ম নিলো এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন

অন্যমনস্ক মানুষজন আমার ভারি পছন্দের। যারা হাঁটতে হাঁটতে হয়তো জুতার ফিতা খুলে গেছে খেয়াল করে না, কিংবা চায়ের কাপে চিনি মেশাতে গিয়ে লবণ মিশিয়ে ফেলে, তারপর নির্বিকার মুখে সেই চায়ে চুমুক দিয়ে চমকে ওঠে। এই অন্যমনস্ক মানুষেরা আসলে তাদের শরীর নিয়ে হাঁটে না, তারা হাঁটে তাদের চিন্তার জগতটাকে সঙ্গে নিয়ে। তাদের চারপাশের পৃথিবীটা তখন গৌণ হয়ে যায়।

এরকমই এক অন্যমনস্ক মানুষ ছিলেন অ্যাডাম স্মিথ। স্কটল্যান্ডের এই অধ্যাপক ভদ্রলোককে নিয়ে একটা গল্প চালু আছে। একবার তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন হয়ে হাঁটছিলেন। কথা আর হাঁটা দুটোই চলছিল সমান তালে। এক পর্যায়ে তিনি খেয়ালই করেননি যে পথের ধারে এক বিশাল গর্ত, যা চামড়া রং করার রাসায়নিকে ভর্তি। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। অধ্যাপক সটান সেই নোংরা, দুর্গন্ধময় গর্তে পড়ে গেলেন। বন্ধুটি অনেক কষ্টে তাকে টেনে তুলল। এই ঘটনাটা স্মিথের চরিত্রের একটা চমৎকার ছবি তুলে ধরে। তিনি এমন এক মানুষ ছিলেন, যিনি বাস্তব জগতের গর্তের চেয়ে চিন্তার জগতের গভীরতাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কী ছিল সেই চিন্তা, যা তাঁকে এতটা মগ্ন করে রাখত? তাঁর বিখ্যাত বই ‘The Wealth of Nations’ তো আমরা অনেকেই চিনি। কিন্তু কোনো চিন্তা তো শূন্য থেকে জন্মায় না। প্রতিটি বড় নদীর যেমন অসংখ্য ছোট ছোট ঝর্ণা উৎস হিসেবে থাকে, তেমনি প্রতিটি বড় চিন্তার পেছনেও থাকে যুগ, সমাজ আর আগের মানুষদের রেখে যাওয়া ভাবনার স্রোত।

চলুন, আমরাও একটু গোয়েন্দাগিরি করি। অ্যাডাম স্মিথের ভাবনার শেকড় খুঁজতে যাই। এই খোঁজার মধ্যেই আমরা এমন এক সময়ের গল্প পাব, যখন পুরো ইউরোপ একটা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখছিল।

স্কটল্যান্ডের সেই উত্তাল হাওয়া

অ্যাডাম স্মিথের জন্ম হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন তাঁর দেশ স্কটল্যান্ড এক বিরাট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সময়টা ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। এর কিছুদিন আগেই, ১৭০৭ সালে, স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ড মিলে তৈরি হয়েছে গ্রেট ব্রিটেন। এই ঘটনা স্কটিশদের জন্য ছিল একাধারে অপমান আর সুযোগের। নিজেদের সংসদ হারিয়ে ফেলার একটা দুঃখ ছিল, কিন্তু তার বদলে তারা পেয়েছিল ইংল্যান্ড এবং তার বিশাল ঔপনিবেশিক বাজারের দরজা। কার্কক্যালডির মতো ছোট বন্দর শহরগুলো হঠাতই নতুন বাণিজ্য আর সম্ভাবনার আলো দেখতে শুরু করে। স্মিথ তাঁর ছোটবেলায় নিশ্চয়ই দেখেছেন, কীভাবে বাণিজ্য মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারে।

এর চেয়েও বড় যে ঝড়টা বইছিল, সেটা হলো চিন্তার ঝড়। এই সময়টাকে বলা হয় স্কটিশ এনলাইটেনমেন্ট (Scottish Enlightenment) বা স্কটল্যান্ডের জ্ঞানদীপ্তি। এটা ছিল এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিস্ফোরণ। ডেভিড হিউম, ফ্রান্সিস হাচিসন, অ্যাডাম ফার্গুসনের মতো প্রখ্যাত সব চিন্তাবিদরা এডিনবরা আর গ্লাসগোর কফি হাউস আর ক্লাবগুলোতে বসে পৃথিবীটাকে নতুন করে বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল—ধর্মীয় গোঁড়ামি বা রাজার মুখের কথা নয়, যুক্তি (Reason) এবং অভিজ্ঞতা (Experience) দিয়েই সবকিছু বুঝতে হবে। আইজ্যাক নিউটন যেমন প্রকৃতির নিয়ম আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁরা তেমনি ‘মানুষের বিজ্ঞান’ (Science of Man) বা মানব সমাজের নিয়মগুলো আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন (Herman, 2001)।

এই পরিবেশেই স্মিথ বড় হয়েছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় দুজন প্রভাবক ছিলেন এই স্কটল্যান্ডেরই মানুষ।

এক হলেন তাঁর সরাসরি শিক্ষক, ফ্রান্সিস হাচিসন (Francis Hutcheson)। হাচিসন ছিলেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক দর্শনের অধ্যাপক। তিনি শেখালেন যে, মানুষের মধ্যে কেবল স্বার্থপরতাই নেই, তার ভেতরে একটা সহজাত ‘নৈতিক বোধ’ (Moral Sense) আছে। এই বোধই তাকে অন্যের দুঃখে দুঃখী হতে শেখায়, অন্যের আনন্দে খুশি হতে শেখায়। হাচিসন বিশ্বাস করতেন, মানুষের সবচেয়ে বড় সুখ আসে অন্যের ভালো করার মাধ্যমে। স্মিথের প্রথম বই ‘The Theory of Moral Sentiments’-এর মূল ভিত্তিই হলো হাচিসনের এই ধারণা (Phillipson, 2010)।

আরেকজন হলেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ডেভিড হিউম (David Hume)। হিউম ছিলেন একজন কট্টর অভিজ্ঞতাবাদী (Empiricist)। তাঁর মতে, জ্ঞান আসে কেবল ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি মানুষের আবেগ (Passion) এবং যুক্তির সম্পর্ক নিয়ে যুগান্তকারী কথা বলেছিলেন। হিউমের প্রভাব স্মিথের ওপর ছিল গভীর। হিউমই স্মিথকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে ঐতিহাসিক তথ্য এবং বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়। তাঁদের দুজনের বন্ধুত্ব ছিল কিংবদন্তিতুল্য।

এই স্কটিশ জ্ঞানদীপ্তির পরিবেশ স্মিথকে একটি বৈজ্ঞানিক মন এবং একটি নৈতিক হৃদয়—দুটোই দিয়েছিল। তিনি অর্থনীতিকে কেবল টাকা-পয়সার হিসাব হিসেবে দেখেননি, দেখেছিলেন মানব আচরণের একটি অংশ হিসেবে।

রাজার সিন্দুক বনাম সাধারণ মানুষের রুটি

স্মিথের সময়ে ইউরোপের রাজারা যে অর্থনৈতিক নীতি মেনে চলতেন, তার নাম ছিল মার্কেন্টিলিজম (Mercantilism)। নীতিটা শুনতে খুব সহজ। তারা ভাবতেন, একটা দেশের সম্পদ মানে তার কোষাগারে জমানো সোনা আর রুপার পরিমাণ। সুতরাং, সম্পদ বাড়ানোর উপায় হলো দুটি—রপ্তানি করো বেশি করে (যাতে সোনা দেশে আসে) আর আমদানি করো কম করে (যাতে সোনা দেশ থেকে বেরিয়ে না যায়)।

এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য সরকার অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে নাক গলাত। নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানিকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হতো, আমদানির ওপর চড়া শুল্ক বসানো হতো, আর উপনিবেশগুলোর ওপর জোর খাটানো হতো যেন তারা কেবল মূল দেশ থেকেই পণ্য কেনে। বাণিজ্যকে দেখা হতো একটা খেলার মতো, যেখানে একজনের জয় মানেই আরেকজনের হার (Zero-sum game)।

স্মিথ এই ব্যবস্থাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন এবং এর অন্তঃসারশূন্যতা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন তুললেন, দেশের সম্পদ কি সত্যিই রাজার সিন্দুকে জমানো সোনা? নাকি দেশের সাধারণ মানুষের খাবার, পোশাক আর জীবনযাত্রার মান? তিনি দেখলেন, মার্কেন্টাইলিস্ট নীতিগুলো আসলে কয়েকজন সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী আর রাজাকে ধনী করে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। আমদানিতে বাধা দেওয়ার কারণে মানুষকে চড়া দামে জিনিস কিনতে হয়, আর একচেটিয়া ব্যবসার কারণে বাজারে প্রতিযোগিতা থাকে না।

তাঁর ‘The Wealth of Nations’ ছিল এই মার্কেন্টাইলিস্ট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক জোরালো ঘোষণা। তিনি দেখালেন, বাণিজ্য কোনো জিরো-সাম গেম নয়। মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে সব দেশই লাভবান হতে পারে। দেশের আসল সম্পদ সোনা নয়, বরং তার জনগণের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা। এই ভাবনাটি ছিল বিপ্লবী।

ফ্রান্সের সেই কৃষক-প্রেমী দার্শনিকেরা

ডিউক অফ বাকলু-র গৃহশিক্ষক হিসেবে স্মিথ ফ্রান্সে ভ্রমণের সুযোগ পান। প্যারিসে তাঁর পরিচয় হয় একদল অদ্ভুত দার্শনিকের সঙ্গে, যারা নিজেদের বলতেন ফিজিওক্র্যাট (Physiocrats)। এই দলের নেতা ছিলেন রাজদরবারের চিকিৎসক ফ্রাঁসোয়া ক্যানে (François Quesnay)

ফিজিওক্র্যাটরা বিশ্বাস করতেন, সমাজের সব সম্পদের মূল উৎস হলো কৃষি। তাঁদের মতে, কেবল জমিই ‘প্রকৃত’ সম্পদ তৈরি করতে পারে। কৃষক যখন বীজ বোনে, প্রকৃতি তাকে বহুগুণ ফসল ফিরিয়ে দেয়। অন্যদিকে, কারখানার শ্রমিক বা ব্যবসায়ী কেবল বিদ্যমান জিনিসকে এক রূপ থেকে অন্য রূপে বদলায়, তারা নতুন কিছু সৃষ্টি করে না। তাই তাঁরা শিল্প ও বাণিজ্যের ওপর সবরকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তাঁদের বিখ্যাত স্লোগান ছিল ‘লেসে-ফেয়ার, লেসে-পাসে’ (Laissez-faire, laissez-passer), যার অর্থ ‘করতে দাও, চলতে দাও’।

স্মিথ ফিজিওক্র্যাটদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম অর্থনীতিকে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা (System) হিসেবে দেখার ধারণাটি তাঁদের কাছ থেকে পান। ক্যানে একটি অর্থনৈতিক সারণি (Tableau Économique) তৈরি করেছিলেন, যা দেখাত কীভাবে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সম্পদ আবর্তিত হয়। এটি ছিল অর্থনীতির প্রথম মডেল। ‘লেসে-ফেয়ার’ বা সরকারের ন্যূনতম হস্তক্ষেপের ধারণাটিও স্মিথকে আকর্ষণ করেছিল।

কিন্তু তিনি ফিজিওক্র্যাটদের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল কৃষি নয়, কারখানার শ্রমিকের শ্রমও (Labour) নতুন মূল্য তৈরি করে। পিন কারখানার শ্রমিকের উদাহরণ দিয়ে তিনি এটাই প্রমাণ করেছিলেন। তিনি ফিজিওক্র্যাটদের মূল ধারণাটিকে গ্রহণ করলেন, কিন্তু তাকে আরও ব্যাপক ও সর্বজনীন একটি রূপ দিলেন (Muller, 1993)।

আরও গভীরের সেই শেকড়গুলো

স্মিথের চিন্তার পেছনে আরও কিছু পুরোনো কিন্তু শক্তিশালী প্রভাব ছিল।

জন লক (John Locke): ইংরেজ দার্শনিক জন লককে ছাড়া আধুনিক উদারনৈতিক চিন্তার কথা ভাবাই যায় না। লক যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মানুষের কিছু প্রাকৃতিক অধিকার (Natural Rights) আছে—জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তি। সরকার গঠিত হয় এই অধিকারগুলোকে রক্ষা করার জন্য, কেড়ে নেওয়ার জন্য নয়। স্মিথের বাজারে ব্যক্তিগত সম্পত্তি (Private Property) এবং চুক্তির স্বাধীনতার (Freedom of Contract) ওপর যে জোর, তার পেছনে লকের গভীর প্রভাব রয়েছে। একটি নিরাপদ ও আইন দ্বারা সুরক্ষিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার ছাড়া পুঁজিবাদের বিকাশ সম্ভব নয় – এই ধারণাটি লকের দর্শনেরই প্রতিধ্বনি।

বার্নার্ড ম্যান্ডেভিল (Bernard Mandeville): ইনি ছিলেন একজন বিচিত্র ও বিতর্কিত চিন্তাবিদ। ১৭১৪ সালে তিনি ‘The Fable of the Bees’ (মৌমাছিদের উপকথা) নামে একটি কবিতা লেখেন, যার একটি পরিহাসমূলক উপশিরোনাম ছিল: ‘Private Vices, Publick Benefits’ (ব্যক্তিগত পাপ, জনগণের লাভ)। তাঁর বক্তব্য ছিল ভয়ানক। তিনি বলেন, একটি সমৃদ্ধ সমাজের পেছনে মানুষের ভালো গুণগুলো নেই, আছে তার খারাপ গুণগুলো—যেমন লোভ, অহংকার, বিলাসিতা। মানুষ লোভের বশে কাজ করে, আর তাতেই সমাজের অর্থনীতির চাকা ঘোরে। একজন বিলাসী ধনী লোক অনেক কর্মসংস্থান তৈরি করে, যা একজন মিতব্যয়ী ভালো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

স্মিথ ম্যান্ডেভিলের এই কদর্য ও নিষ্ঠুর দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘৃণা করতেন। কিন্তু ম্যান্ডেভিলের মূল পর্যবেক্ষণটি তাঁকে ভাবিয়েছিল—কীভাবে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য থেকে সামাজিক মঙ্গল সাধিত হতে পারে? স্মিথ ম্যান্ডেভিলের ‘পাপ’ (Vice) শব্দটিকে সরিয়ে সেখানে বসালেন ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ’ (Self-interest), এবং দেখালেন যে এই স্বার্থপরতা কোনো নৈতিক অবক্ষয় নয়, বরং মানুষের স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি, যা একটি সঠিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হলে সমাজের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে। তাঁর ‘অদৃশ্য হাত’ (Invisible Hand) ধারণাটি ম্যান্ডেভিলের সেই বিতর্কিত ভাবনারই একটি পরিশীলিত ও নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংস্করণ (Hirschman, 1977)।

চিন্তার এক নতুন সমীকরণ

তাহলে আমরা কী পেলাম? অ্যাডাম স্মিথ যেন একজন দক্ষ রাঁধুনি। তিনি তাঁর আগের এবং সমসাময়িক চিন্তার জগৎ থেকে নানা রকম উপাদান সংগ্রহ করেছেন।

  • হাচিসনের কাছ থেকে তিনি নিয়েছেন নৈতিকতার ধারণা।

  • হিউমের কাছ থেকে নিয়েছেন অভিজ্ঞতাবাদী পদ্ধতি।

  • ফিজিওক্র্যাটদের থেকে নিয়েছেন অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র এবং ‘লেসে-ফেয়ার’-এর বীজ।

  • লকের থেকে নিয়েছেন ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও স্বাধীনতার গুরুত্ব।

  • আর ম্যান্ডেভিলের বিতর্কিত ভাবনাকে তিনি নতুন করে সাজিয়ে নিজের তত্ত্বে কাজে লাগিয়েছেন।

এই সমস্ত উপাদানকে তিনি তাঁর নিজের পর্যবেক্ষণ আর প্রতিভার আঁচে মিশিয়ে এমন এক নতুন দর্শন তৈরি করলেন, যা পৃথিবীকে দেখার চোখটাই পাল্টে দিল। তিনি দেখালেন, একটি সমৃদ্ধ এবং মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য কোনো মহানুভব স্বৈরশাসকের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই সবকিছু উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার। বরং সাধারণ মানুষকে যদি স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা দেওয়া যায়, তাহলে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের সাধনাই এক ‘অদৃশ্য হাতে’র ইশারায় সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলে পরিণত হবে।

তিনি কোনো কল্পনাবিলাসী ছিলেন না। তিনি জানতেন, মানুষ কেবলই স্বার্থপর নয়, তার মধ্যে সহানুভূতি এবং ন্যায়বিচারও আছে। তাঁর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে এই নৈতিক মানুষের ওপরেই।

সেই যে অন্যমনস্ক অধ্যাপক ভদ্রলোক, যিনি কথা বলতে বলতে গর্তে পড়ে গিয়েছিলেন, তিনি আসলে কোনো সাধারণ গর্তে পড়েননি। তিনি পড়েছিলেন তাঁর সময়ের সব জটিলতা, অসংগতি আর সম্ভাবনার গভীরে। আর সেখান থেকেই তিনি তুলে এনেছিলেন এমন কিছু মুক্তো, যা দিয়ে আগামী কয়েকশ বছরের জন্য এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন বোনা হয়েছিল।

চিন্তা জিনিসটা তো এমনই, তাই না? একলা শুরু হয়, কিন্তু ছড়িয়ে পড়ে হাজার মনে।

আমাদের ভেতরের আয়না—সহানুভূতি, বিবেক ও প্রশংসার লোভ

অর্থনীতির রাজ্যে প্রবেশ করার আগে স্মিথ আমাদের ভেতরের মানুষটাকে চিনতে বলেছেন। আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। দেখলেন একজন মানুষ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। আপনার ভেতরে কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই একটা অস্বস্তি হবে। আপনি হয়তো দৌড়ে গিয়ে তাকে সাহায্য করবেন। কেন করলেন? কারণ, আপনি মুহূর্তের জন্য নিজেকে ওই লোকটির জায়গায় কল্পনা করে নিয়েছেন। তার ব্যথাটা নিজের ভেতর অনুভব করার চেষ্টা করেছেন। অ্যাডাম স্মিথ এই ক্ষমতার নাম দিয়েছেন ‘সহানুভূতি’ (Sympathy)।

তাঁর প্রথম বই ‘The Theory of Moral Sentiments’-এর মূল ভিত্তিই হলো এই সহানুভূতি। তবে স্মিথের ‘সহানুভূতি’ কেবল করুণা বা দয়া নয়। এটি হলো অন্যের অনুভূতিকে নিজের কল্পনায় ধারণ করার ক্ষমতা (the ability to imagine ourselves in the situation of others)। আমরা অন্যের আনন্দ দেখে আনন্দিত হই, কারণ আমরা কল্পনা করি ওই পরিস্থিতিতে থাকলে আমাদের কেমন লাগত। আমরা অন্যের দুঃখে দুঃখী হই, কারণ আমরা তার কষ্টটা নিজের ভেতর অনুভব করার চেষ্টা করি। এই অনুভূতিই আমাদের সমাজবদ্ধ করে রাখে, আমাদের একে অপরের সঙ্গে জুড়ে দেয় (Smith, 1759)। এটিই হলো সামাজিক আঠা, যা ব্যক্তি মানুষকে একটি সমাজে পরিণত করে।

কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। আমি যদি শুধু অন্যের দুঃখে দুঃখী হই, তাহলে তো আমার নিজের কাজ বলে কিছু থাকবে না। আবার আমি যদি শুধু নিজের কথাই ভাবি, তাহলে তো আমি একটা স্বার্থপর দানবে পরিণত হব। এই দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হয় কীভাবে?

স্মিথ এখানে এক অসাধারণ ধারণার জন্ম দেন। তিনি এর নাম দেন ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ (The Impartial Spectator)। এটা কী জিনিস? এটা হলো আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে থাকা এক কাল্পনিক মানুষ। আমাদের বিবেক, আমাদের ভেতরের বিচারক। যখনই আমরা কোনো কাজ করতে যাই বা কোনো কাজের মূল্যায়ন করি, আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি, “একজন নিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী এবং সুবিবেচক মানুষ যদি আমার এই কাজটা দেখত, সে কি এটাকে সমর্থন করত?” এই কাল্পনিক বিচারক আমাদের আবেগ ও তাৎক্ষণিক স্বার্থপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

ধরুন, আপনার খুব লোভ হলো বন্ধুর সুন্দর কলমটা না বলে নিয়ে নেওয়ার। কিন্তু আপনার ভেতরের ওই পর্যবেক্ষক আপনাকে থামিয়ে দেবে। সে বলবে, “আরে, এটা তো চুরি! ধরা পড়লে কী লজ্জা হবে! তোমার বন্ধু কষ্ট পাবে। একজন ভালো মানুষ হিসেবে এটা কি তোমার করা উচিত?” এই ভেতরের কণ্ঠস্বরই আমাদের নৈতিকতার রক্ষাকবচ। সে আমাদের লাগামছাড়া স্বার্থপরতাকে একটা সীমার মধ্যে রাখে। এই নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকই আমাদের শেখায় ন্যায়বিচার (Justice) এবং পরোপকারের (Beneficence) মধ্যে পার্থক্য করতে।

স্মিথের মতে, ন্যায়বিচার হলো একটি সমাজের ভিত্তি। এটি অনেকটা একটি বাড়ির ফাউন্ডেশন বা ভিত্তির মতো। ন্যায়বিচার মানে অন্যের ক্ষতি না করা, তার জীবন, সম্পত্তি এবং চুক্তির অধিকারকে সম্মান করা। এটি একটি নেতিবাচক গুণ—এর জন্য কিছু না করাই যথেষ্ট। এই নিয়মগুলো ভঙ্গ করলে সমাজ টিকতে পারে না, তাই এগুলো আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য। অন্যদিকে, পরোপকার বা দানশীলতা হলো বাড়ির সাজসজ্জার মতো—এটি সমাজকে সুন্দর করে, কিন্তু অপরিহার্য নয়। এটি একটি ইতিবাচক গুণ, যা কাউকে জোর করে করানো যায় না।

এর সঙ্গে স্মিথ মানব চরিত্রের আরও একটি গভীর আকাঙ্ক্ষার কথা বলেন: আমরা কেবল প্রশংসা (to be praised) পেতে চাই না, আমরা প্রশংসার যোগ্য (to be praiseworthy) হতে চাই। কেউ যদি না জেনে কোনো ভালো কাজের জন্য আপনার প্রশংসা করে, আপনার হয়তো ততটা ভালো লাগবে না। কিন্তু আপনি যখন জানেন যে কাজটা সত্যিই ভালো এবং আপনি সেটার যোগ্য, তখন সেই প্রশংসা আপনাকে সত্যিকারের আনন্দ দেয়। এই ‘প্রশংসার যোগ্য’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই আমাদের ভেতরকার নৈতিক মানদণ্ডকে আরও শক্তিশালী করে (Smith, 1759)।

এই ধারণাটা কেন জরুরি? কারণ স্মিথের অর্থনীতির দুনিয়ায় প্রবেশ করার চাবিকাঠি এটাই। তিনি যখন ‘Wealth of Nations’-এ মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থের (Self-interest) কথা বলবেন, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে, এই স্বার্থপর মানুষটা একা নয়। সে একজন সামাজিক জীব। তার ভেতরে একজন ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ বসে আছে। সে পুরোপুরি লাগামছাড়া নয়, তার একটা নৈতিক কম্পাস আছে, সে ন্যায়বিচার ও সততার নিয়মগুলো মেনে চলে। স্মিথের বাজার ব্যবস্থার নায়ক কোনো দানবীয় স্বার্থপর জীব নয়, সে ‘The Theory of Moral Sentiments’-এর নৈতিক মানুষ।

একটি দেশ কেন ধনী হয়?

১৭৭৬ সাল। একদিকে আমেরিকা স্বাধীনতার ঘোষণা দিচ্ছে, অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাষ্পীয় ইঞ্জিন কারখানাগুলোর চেহারা পাল্টে দিতে শুরু করেছে। আর ঠিক সে সময়েই অ্যাডাম স্মিথ তাঁর magnum opus বা সেরা কাজটি প্রকাশ করলেন। বইয়ের দীর্ঘ নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মূল প্রশ্ন—একটি জাতি বা দেশের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ কী? (What are the nature and causes of the wealth of a nation?)

সেই যুগে বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষ করে শাসকরা মনে করতেন, একটা দেশের সম্পদ মানে তার সিন্দুকে জমানো সোনা-রুপার ভান্ডার। এই ধারণাকে বলা হতো মার্কেন্টাইলিজম (Mercantilism)। তারা ভাবতেন, যত বেশি সোনা দেশে জমানো যাবে, দেশ তত ধনী হবে। তাই তারা অন্য দেশ থেকে আমদানি কমাতে চাইত (কারণ তাতে সোনা দেশের বাইরে চলে যায়) আর রপ্তানি বাড়াতে চাইত (কারণ তাতে সোনা দেশে আসে)। সরকার অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করত—নির্দিষ্ট শিল্পকে ভর্তুকি দিত, আমদানির ওপর চড়া শুল্ক বসাতো, এবং উপনিবেশ স্থাপন করে তাদের বাজার দখল করত। তাদের কাছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ছিল একটা খেলার মতো, যেখানে একজন জিতলে অন্যজনকে হারতেই হবে (Zero-sum game)।

স্মিথ এসে এই ধারণাটাকে সজোরে ধাক্কা দিলেন। তিনি বললেন, “আরে না, না! দেশের সম্পদ মানে সিন্দুকে জমানো সোনাদানা নয়। ওগুলো তো বিনিময়ের মাধ্যম মাত্র। দেশের আসল সম্পদ হলো তার বার্ষিক উৎপাদন—তার জনগণ সারা বছরে মোট যা কিছু পণ্য ও সেবা (goods and services) উৎপাদন করে, সেটাই হলো দেশের প্রকৃত সম্পদ।” (Smith, 1776)। একটি দেশ ততটাই ধনী, যতটা বেশি তার নাগরিকরা মাথাপিছু উৎপাদন করতে পারে। যে দেশ তার নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে, তাদের ভালো খাবার, ভালো পোশাক, ভালো বাসস্থান দিতে পারে, সেই দেশই প্রকৃত ধনী।

ভাবুন একবার, কী যুগান্তকারী একটা চিন্তা! সম্পদের ধারণাটাই বদলে গেল। রাজার সিন্দুক থেকে ফোকাস চলে গেল সাধারণ মানুষের কাজের ওপর, কৃষকের লাঙলের ওপর, শ্রমিকের হাতুড়ির ওপর, কারখানার উৎপাদনের ওপর। এই একটি বাক্য দিয়েই স্মিথ অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু চিরদিনের জন্য পাল্টে দিলেন। এখন থেকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিমাপক হলো জিডিপি (Gross Domestic Product), মাথাপিছু আয়—ঠিক যেমনটা স্মিথ নির্দেশ করেছিলেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই উৎপাদন বাড়বে কীভাবে? স্মিথ এর উত্তরে কয়েকটি জাদুকরি ধারণার কথা বললেন, যা আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে।

পিন কারখানার সেই গল্প

স্মিথের বইয়ের প্রথম অধ্যায়টাই শুরু হয়েছে এক অতি সাধারণ জিনিস দিয়ে—পিন। একটা আলপিন তৈরি করা।

তিনি বলছেন, ধরুন একজন অদক্ষ শ্রমিক, যে এই কাজে অভ্যস্ত নয়, সে যদি একা একা একটা পিন বানাতে চেষ্টা করে, সে সারাদিনে হয়তো একটা বা বড়জোর গোটা বিশেক পিন বানাতে পারবে। কারণ তাকে লোহার তার কাটতে হবে, সেটাকে সোজা করতে হবে, এক মাথা ছুঁচালো করতে হবে, অন্য মাথায় পিনের মাথা লাগানোর জন্য প্রস্তুতি করতে হবে, তারপর সেই মাথাটা আলাদাভাবে বানিয়ে তারের সঙ্গে জুড়তে হবে, এবং সবশেষে পিনটাকে সাদা রঙে পালিশ করতে হবে। অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন কাজ।

কিন্তু এবার ভাবুন, একটা ছোট কারখানায় দশজন শ্রমিক কাজ করছে। কাজের পুরো প্রক্রিয়াটাকে আঠারোটি আলাদা ধাপে ভাগ করে দেওয়া হলো। একজন শুধু তার কাটে, আরেকজন শুধু সোজা করে, তৃতীয়জন শুধু মাথা ছুঁচালো করে, চতুর্থজন শুধু পিনের মাথা লাগায়…এভাবে। স্মিথ তাঁর পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে বলছেন, এই দশজন শ্রমিক মিলে সারাদিনে আটচল্লিশ হাজার (48,000) পিন বানিয়ে ফেলতে পারে! অর্থাৎ মাথাপিছু উৎপাদন দাঁড়াল চার হাজার আটশ (4,800) পিন।

কোথায় একজন দিনে বিশটা, আর কোথায় একজন দিনে প্রায় পাঁচ হাজার! আকাশ-পাতাল তফাৎ। এটাই হলো শ্রম বিভাজনের জাদু (The magic of the division of labour)।

কিন্তু কেন এমন হয়? উৎপাদনশীলতা কেন এভাবে রকেটের গতিতে বেড়ে যায়? স্মিথ এর পেছনে তিনটি প্রধান কারণ দেখান (Smith, 1776, Book I, Chapter I):

১. দক্ষতা বৃদ্ধি (Increased Dexterity): একই কাজ বারবার করতে করতে একজন শ্রমিক সেই কাজে অসাধারণ দক্ষ হয়ে ওঠে। তার হাতের গতি, কাজের নিখুঁত ভাব অনেক বেড়ে যায়।

২. সময় সাশ্রয় (Saving of Time): এক ধরনের কাজ থেকে আরেক ধরনের কাজে যাওয়ার জন্য যে সময় নষ্ট হতো, সেটা আর হয় না। শ্রমিককে বারবার যন্ত্রপাতি বদলাতে হয় না বা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয় না।

৩. উদ্ভাবন (Invention of Machines): যখন একজন শ্রমিক দিনের পর দিন একটা নির্দিষ্ট কাজই করে, তখন সে ভাবতে শুরু করে—এই কাজটা আরও সহজে, আরও দ্রুত কীভাবে করা যায়? এই চিন্তা থেকেই অনেক সময় নতুন নতুন যন্ত্র বা উন্নত কৌশল উদ্ভাবিত হয়, যা উৎপাদনকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

শ্রম বিভাজনই হলো আধুনিক অর্থনীতির ইঞ্জিন। আপনার হাতের স্মার্টফোন থেকে শুরু করে আপনার পরা পোশাক – সবকিছুই এই নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে স্মিথ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, যা অনেকেই ভুলে যান। শ্রম বিভাজনের সীমা নির্ধারিত হয় বাজারের আকার দ্বারা (The division of labour is limited by the extent of the market)। একটি ছোট গ্রামে একজন মানুষ শুধু ছুতারের কাজ করে বা শুধু কামারের কাজ করে চলতে পারে না, কারণ সেখানে যথেষ্ট গ্রাহক নেই। তাকে হয়তো চাষবাসের পাশাপাশি টুকটাক ছুতার বা কামারের কাজ করতে হয়। কিন্তু বড় শহরে, যেখানে লক্ষ লক্ষ গ্রাহক, সেখানে শুধু গাড়ির টায়ার বদলানোর দোকান বা শুধু চশমার ফ্রেম সারাইয়ের দোকানও চলতে পারে। অর্থাৎ, বাজার যত বড় হবে, শ্রম বিভাজন তত সূক্ষ্ম হবে এবং উৎপাদনশীলতা তত বাড়বে। এই কারণেই স্মিথ রাস্তা, সেতু, বন্দর নির্মাণের মতো সরকারি উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন, কারণ এগুলো যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করে বাজারকে প্রসারিত করে।

তবে স্মিথ শ্রম বিভাজনের একটি অন্ধকার দিক নিয়েও সচেতন ছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, যে শ্রমিক সারাজীবন ধরে শুধু একটি ক্ষুদ্র ও একঘেয়ে কাজ করে, সে মানসিকভাবে স্থবির ও সংকীর্ণমনা হয়ে পড়তে পারে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি রাষ্ট্রের সহায়তায় সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার প্রসারের কথা বলেছিলেন, যা আমরা পরে আলোচনা করব।

হীরা ও জলের ধাঁধা: কোন জিনিসের দাম কত?

বেশ, উৎপাদন তো বাড়ল। কিন্তু বাজারে এসে একটা জিনিসের দাম কীভাবে ঠিক হয়? কোন জিনিসের দাম বেশি হবে, কোনটার কম? এই প্রশ্নটা স্মিথকে ভাবিয়েছিল এবং তিনি ‘মূল্যতত্ত্ব’ (Theory of Value) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

তিনি এক বিখ্যাত ধাঁধার কথা বলেন, যা ‘হীরা-জলের ধাঁধা’ (Diamond-Water Paradox) নামে পরিচিত। তিনি বলেন, জল আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য, এর চেয়ে দরকারি জিনিস আর কিছু নেই। অথচ জলের দাম খুব কম বা প্রায় নেই। অন্যদিকে, হীরা আমাদের কোনো কাজেই লাগে না, এটা কেবলই এক বিলাসিতার বস্তু। অথচ এর দাম আকাশছোঁয়া। কেন?

এই ধাঁধার সমাধান করতে গিয়ে স্মিথ দুই ধরনের মূল্যের কথা বলেন (Smith, 1776, Book I, Chapter IV):

১. ব্যবহারিক মূল্য (Value in Use): একটি জিনিসের উপযোগিতা বা দরকার। এই হিসেবে জলের ব্যবহারিক মূল্য হীরার চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

২. বিনিময় মূল্য (Value in Exchange): একটি জিনিসের বিনিময়ে অন্য জিনিস কতটা পাওয়া যাবে, অর্থাৎ তার বাজারদর। এই হিসেবে হীরার বিনিময় মূল্য জলের চেয়ে অনেক বেশি।

স্মিথ দেখালেন, একটি জিনিসের উপযোগিতা আর তার বাজারদর সবসময় সমানুপাতিক নয়। তাহলে এই বিনিময় মূল্য বা দাম নির্ধারিত হয় কীসের ভিত্তিতে?

এখানে এসে স্মিথ কিছুটা দ্বিধায় পড়েছিলেন এবং তাঁর উত্তরটি জটিল। তিনি একটি ‘শ্রমভিত্তিক মূল্যতত্ত্ব’ (Labour Theory of Value) প্রস্তাব করেন। তাঁর মতে, একটি পণ্য উৎপাদন করতে যে পরিমাণ শ্রম, কষ্ট ও চাতুর্য (toil and trouble) লাগে, সেটাই তার প্রকৃত মূল্যের পরিমাপক। তিনি বলেন, “শ্রমই হলো সব পণ্যের বিনিময়যোগ্য মূল্যের আসল পরিমাপক” (Labour…is the real measure of the exchangeable value of all commodities)। একটি আদিম সমাজে, যেখানে পুঁজি বা জমির মালিকানা ছিল না, সেখানে একটা হরিণ মারতে যদি একটা ভালুক মারার দ্বিগুণ সময় বা শ্রম লাগে, তাহলে একটা ভালুকের বিনিময়ে দুটো হরিণ পাওয়া উচিত।

কিন্তু আধুনিক সমাজে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। কারণ এখন পণ্যের দামে শুধু শ্রমিকের মজুরিই থাকে না, তার সঙ্গে যুক্ত হয় উদ্যোক্তার মুনাফা (Profit) এবং জমির মালিকের খাজনা (Rent)। তাই স্মিথ স্বীকার করেন যে, উন্নত সমাজে পণ্যের দাম নির্ধারিত হয় এই তিনটি উপাদানের (মজুরি, মুনাফা, খাজনা) যোগফলের মাধ্যমে। তিনি এই সম্মিলিত খরচকে বলেন পণ্যের ‘প্রাকৃতিক দাম’ (Natural Price)। এটি হলো সেই দাম, যা উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয়।

অন্যদিকে, বাজারে কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে একটি পণ্যের যে দামে কেনাবেচা হয়, তা হলো তার ‘বাজারদর’ (Market Price)। এই বাজারদর নির্ধারিত হয় চাহিদা ও জোগানের তাৎক্ষণিক অবস্থার ওপর। যদি জোগান চাহিদার চেয়ে কম হয়, তাহলে ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং বাজারদর প্রাকৃতিক দামের চেয়ে উপরে উঠে যাবে। আর যদি জোগান চাহিদার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং বাজারদর প্রাকৃতিক দামের নিচে নেমে আসবে।

তবে দীর্ঘমেয়াদে, বাজারদর সবসময় প্রাকৃতিক দামের দিকেই ফিরে আসার প্রবণতা দেখায়। কারণ, যদি বাজারদর প্রাকৃতিক দামের চেয়ে বেশি থাকে, তাহলে উৎপাদকরা বেশি মুনাফা পাবে। এই বেশি মুনাফা দেখে নতুন উৎপাদকরা বাজারে প্রবেশ করবে, ফলে জোগান বাড়বে এবং দাম কমে প্রাকৃতিক দামের কাছাকাছি চলে আসবে। এভাবেই বাজার একটি স্বয়ংক্রিয় ভারসাম্য খুঁজে নেয়।

যদিও পরবর্তীকালের অর্থনীতিবিদরা (বিশেষ করে প্রান্তিক উপযোগিতার তত্ত্ব বা Marginal Utility Theory-র প্রবক্তারা) স্মিথের এই মূল্যতত্ত্বের অনেক সমালোচনা করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে দাম আসলে প্রান্তিক উপযোগিতা এবং প্রান্তিক খরচের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু তিনিই প্রথম এই প্রশ্নটি এত গভীরভাবে তুলে ধরেছিলেন এবং দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন।

উল্লেখ্য, প্রান্তিক উপযোগিতা (marginal utility) বোঝায় একটি অতিরিক্ত পণ্য ভোগ থেকে ক্রেতা যে অতিরিক্ত সন্তুষ্টি বা মূল্য অনুভব করে, আর প্রান্তিক খরচ (marginal cost) বোঝায় একটি অতিরিক্ত পণ্য উৎপাদনে যে অতিরিক্ত খরচ হয়। বাজারে কোনো পণ্যের দাম ঠিক হয় এই দুইয়ের ভারসাম্যের ওপর—যেখানে ক্রেতার সর্বোচ্চ প্রদানযোগ্য মূল্য ও বিক্রেতার সর্বনিম্ন গ্রহণযোগ্য খরচ এক বিন্দুতে মিলিত হয়।

অদৃশ্য হাতের ইশারা

এইবার আমরা স্মিথের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সম্ভবত সবচেয়ে ভুল বোঝা ধারণার কাছে এসেছি। সেই যে চায়ের দোকানের উদাহরণ দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার পেছনের রহস্যটা এখানেই।

স্মিথ বলছেন, আমরা আমাদের রাতের খাবারটা কসাই, রুটিওয়ালা বা মদ বিক্রেতার মহানুভবতা বা দয়ার কারণে পাই না। আমরা এটা পাই তাদের নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবার কারণে (“It is not from the benevolence of the butcher, the brewer, or the baker that we expect our dinner, but from their regard to their own interest”)। কসাই মাংস বিক্রি করে কারণ সে লাভ করতে চায়। রুটিওয়ালা রুটি বানায় কারণ সে নিজের পরিবারের জন্য আয় করতে চায়। (Smith, 1776)।

তারা আপনার কথা ভাবছে না, তারা নিজেদের কথাই ভাবছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, তাদের এই স্বার্থপরতাই আপনার প্রয়োজন মিটিয়ে দিচ্ছে। কসাই যদি ভালো মাংস না দেয়, আপনি অন্য দোকান থেকে কিনবেন। তাই ভালো ব্যবসা করতে হলে, অর্থাৎ নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে, তাকে আপনার সন্তুষ্টির কথা ভাবতেই হবে। তাকে ভালো মানের মাংস ন্যায্য দামে দিতে হবে।

এভাবেই বাজারে লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন নিজের স্বার্থে কাজ করে, তখন এক আশ্চর্য সমন্বয় তৈরি হয়। প্রত্যেকে নিজের ভালো করতে গিয়ে অজান্তেই সমাজের ভালো করে ফেলে। যেন কোনো এক ‘অদৃশ্য হাত’ (Invisible Hand) পেছন থেকে সবকিছুর সমন্বয় ঘটিয়ে দিচ্ছে। চাহিদা আর জোগানের ওঠানামার মাধ্যমে এই অদৃশ্য হাতই নির্ধারণ করে দেয় কোন জিনিসটা কতটা উৎপাদিত হবে, আর তার দাম কত হবে।

যদি কোনো জিনিসের চাহিদা বাড়ে, তার দাম বাড়বে। বেশি দাম দেখে উৎপাদকরা সেই জিনিস বেশি করে বানাতে শুরু করবে, কারণ তাতে লাভ বেশি। ফলে জোগান বাড়বে এবং একসময় দাম আবার একটা স্থিতিশীল জায়গায় ফিরে আসবে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা কেউ পরিকল্পনা করে করছে না। এটা বাজারের নিজস্ব নিয়মেই ঘটে চলেছে।

এই ‘অদৃশ্য হাত’ কোনো আধিভৌতিক বা ঐশ্বরিক শক্তি নয়। এটি একটি শক্তিশালী রূপক (metaphor)। এটি মূলত বাজার ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় সাধনের ক্ষমতাকে বোঝায়। এই ব্যবস্থার শক্তি হলো, এটি লক্ষ লক্ষ মানুষের বিচ্ছিন্ন জ্ঞান এবং ইচ্ছাকে একটি কার্যকর উপায়ে কাজে লাগায়, যা কোনো একক পরিকল্পনাকারী বা সরকারের পক্ষে করা অসম্ভব (Hayek, 1945)। একজন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকারী কীভাবে জানবেন যে আজ ঢাকায় কত লিটার দুধ বা কতগুলো পাউরুটি দরকার? কিন্তু বাজার ব্যবস্থা দামের সংকেতের মাধ্যমে এই তথ্যগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদকদের কাছে পৌঁছে দেয়।

তবে, স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’ কোনো জাদুর কাঠি নয় যা সবকিছু ঠিক করে দেয়। এটি কাজ করার জন্য কিছু পূর্বশর্ত লাগে। যেমন: প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। যদি কোনো ব্যবসায়ী জোট বেঁধে একচেটিয়া কারবার (Monopoly) তৈরি করে, তাহলে অদৃশ্য হাত কাজ করবে না। স্মিথ নিজে বণিক ও উৎপাদকদের এই জোট বাঁধার প্রবণতা নিয়ে অত্যন্ত সন্দিহান ছিলেন। তিনি লিখেছেন, “একই ব্যবসার লোকেরা খুব কমই একসঙ্গে মিলিত হয়, এমনকি আমোদপ্রমোদের জন্যও, কিন্তু তাদের কথাবার্তা শেষ হয় জনগণের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে, অথবা দাম বাড়ানোর কোনো কৌশলে।” তিনি বিশ্বাস করতেন, সরকারের একটি দায়িত্ব হলো এই ধরনের ষড়যন্ত্র ভেঙে দিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা।

সঞ্চয়ের শক্তি ও পুঁজির জন্ম

একটি দেশের উৎপাদন বাড়বে শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে, এটা তো বোঝা গেল। কিন্তু কারখানা বানানোর জন্য, যন্ত্র কেনার জন্য, শ্রমিকদের অগ্রিম মজুরি দেওয়ার জন্য টাকা আসবে কোথা থেকে? স্মিথের উত্তর খুব স্পষ্ট: পুঁজি (Capital) থেকে। আর পুঁজি আসে সঞ্চয় (Saving) থেকে।

তিনি বলেন, “মিতব্যয়িতা (Parsimony), এবং শ্রম নয়, পুঁজি বৃদ্ধি বা গ্রোথের প্রত্যক্ষ কারণ।” একজন মানুষ তার আয়ের সবটুকু ভোগ না করে যা সঞ্চয় করে, সেটাই বিনিয়োগ হয়ে পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। এই পুঁজি দিয়েই নতুন কারখানা তৈরি হয়, নতুন প্রযুক্তি আসে, এবং আরও বেশি শ্রমিক কাজ পায়। এর ফলে উৎপাদন বাড়ে, যা আবার নতুন সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে। এভাবেই একটি দেশ ধীরে ধীরে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।

স্মিথ এখানে ‘উৎপাদনশীল শ্রম’ (Productive Labour) এবং ‘অনুৎপাদনশীল শ্রম’ (Unproductive Labour) এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য করেন। উৎপাদনশীল শ্রম হলো সেই শ্রম যা কোনো দৃশ্যমান, টেকসই পণ্য তৈরি করে যা ভবিষ্যতে আরও সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে (যেমন, কারখানার শ্রমিকের শ্রম, কৃষকের শ্রম)। এই শ্রম সমাজের পুঁজি বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, অনুৎপাদনশীল শ্রম হলো সেই শ্রম যা সেবা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় এবং কোনো টেকসই বস্তু তৈরি করে না (যেমন, ভৃত্য, অভিনেতা, গায়ক, বা এমনকি রাজা ও সরকারি কর্মকর্তাদের শ্রম)।

স্মিথ এই অনুৎপাদনশীল শ্রমকে অপ্রয়োজনীয় বলছেন না। তিনি বলছেন, একজন রাজা বা বিচারক সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, তাদের শ্রম দেশের পুঁজি বা ভৌত সম্পদ বাড়ায় না। স্মিথের মতে, একটি দেশের সমৃদ্ধি নির্ভর করে তার মোট শ্রমে উৎপাদনশীল শ্রমের অনুপাত কতটা বেশি তার ওপর। যত বেশি মানুষ উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত থাকবে এবং যত বেশি সঞ্চয় বিনিয়োগ হবে, দেশ তত দ্রুত ধনী হবে। তিনি ‘মিতব্যয়ী’ (parsimonious) মানুষের প্রশংসা করেছেন, যে তার আয় সঞ্চয় করে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে; এবং ‘উড়নচণ্ডী’ (prodigal) মানুষের সমালোচনা করেছেন, যে তার সম্পদ বিলাসব্যসনে উড়িয়ে দেয়।

এই ধারণা পরবর্তীকালে অনেক সমালোচিত হলেও (কারণ আধুনিক অর্থনীতিতে সেবা খাতের গুরুত্ব অপরিসীম), এটি তখনকার সময়ে শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি গঠনের গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল।

দেয়াল ভেঙে দাও: মুক্ত বাণিজ্যের পৃথিবী

মার্কেন্টাইলিস্টরা ভাবত, আমদানি খারাপ, রপ্তানি ভালো। অন্য দেশের ক্ষতি করেই নিজের লাভ করতে হবে। স্মিথ বললেন, এটা একদম ভুল ধারণা। তিনি মুক্ত বাণিজ্যের (Free Trade) পক্ষে জোরালো সওয়াল করলেন। তাঁর যুক্তি ছিল খুব সহজ ও শক্তিশালী।

তিনি বললেন, একটা দেশ যদি অন্য দেশের চেয়ে কম খরচে কোনো জিনিস বানাতে পারে, তাহলে তার উচিত সেই জিনিসটাই বেশি করে বানানো এবং অন্য দেশে রপ্তানি করা। আর যে জিনিসটা বানাতে তার বেশি খরচ হয়, সেটা অন্য দেশ থেকে আমদানি করা উচিত। একে বলা হয় ‘পরম সুবিধা’র তত্ত্ব (Theory of Absolute Advantage)

একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন, বাংলাদেশে ভালো মানের পাট জন্মে এবং পাটজাত দ্রব্য বানাতে খরচ কম হয়। অন্যদিকে, জাপানে ভালো মানের গাড়ি তৈরি হয় কম খরচে। এখন বাংলাদেশ যদি গাড়ি বানাতে চেষ্টা করে আর জাপান যদি পাট চাষ করতে চেষ্টা করে, তাহলে দুজনেরই উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং পণ্যের মানও হয়তো ভালো হবে না। এর চেয়ে ভালো হয়, বাংলাদেশ পাটজাত দ্রব্য বানিয়ে জাপানে রপ্তানি করবে, আর জাপান থেকে গাড়ি আমদানি করবে। এতে দুই দেশই লাভবান হবে। বাণিজ্য এখানে ‘জিরো-সাম গেম’ নয়, বরং একটি ‘পজিটিভ-সাম গেম’ (Positive-sum game), যেখানে সবাই জিততে পারে।

স্মিথ যুক্তি দেন, “প্রত্যেক বিচক্ষণ গৃহকর্তার নীতি হলো, যে জিনিসটা নিজে বানানোর চেয়ে কিনে আনা সস্তা, সেটা কখনো নিজে না বানানো।” যা একটি পরিবারের জন্য সত্যি, তা একটি দেশের জন্যও সত্যি। মুক্ত বাণিজ্য দেশগুলোকে নিজ নিজ বিশেষায়িত ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করে, যা বৈশ্বিক শ্রম বিভাজনকে সম্ভব করে তোলে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে মোট উৎপাদন বাড়ে, পণ্যের দাম কমে এবং ভোক্তারা লাভবান হয়।

পরবর্তীকালে অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো (David Ricardo) এই ধারণাটিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘তুলনামূলক সুবিধা’র তত্ত্ব (Theory of Comparative Advantage) দেন। তিনি দেখান, এমনকি যদি একটি দেশ অন্য দেশের চেয়ে সবকিছুই বেশি দক্ষতায় বানাতে পারে, তাহলেও বাণিজ্য উভয়ের জন্য লাভজনক হতে পারে। দেশটির উচিত সেই জিনিসটি উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া, যেটিতে তার দক্ষতার পার্থক্য সবচেয়ে বেশি। স্মিথের মুক্ত বাণিজ্যের ধারণা বিশ্বজুড়ে শুল্কের প্রাচীর ভেঙে দিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করেছে, যা বিশ্বায়নের (Globalization) ভিত্তি স্থাপন করেছে।

সরকারের কাজ কী, আর কী নয়?

অ্যাডাম স্মিথকে প্রায়ই ‘লেসে-ফেয়ার’ (Laissez-faire) বা ‘সবকিছু বাজারের ওপর ছেড়ে দাও’ নীতির কট্টর প্রবক্তা হিসেবে দেখানো হয়। অনেকে ভাবেন, তিনি বুঝি চাইতেন সরকার অর্থনীতিতে কোনো হস্তক্ষেপই করবে না। এটাও একটি জনপ্রিয় ভুল ধারণা।

স্মিথ নৈরাজ্যবাদী (Anarchist) ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি কার্যকর এবং সমৃদ্ধ বাজার ব্যবস্থার জন্য একটি শক্তিশালী কিন্তু সীমিত আকারের সরকার অপরিহার্য। তাঁর মতে, সরকারের প্রধানত তিনটি দায়িত্ব পালন করা উচিত (Smith, 1776, Book IV, Chapter IX):

১. দেশরক্ষা (National Defense): বিদেশি আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করা। একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছাড়া দেশের নাগরিকরা শান্তিতে উৎপাদন করতে পারবে না।

২. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা (Administration of Justice): দেশের এক নাগরিকের হাত থেকে অন্য নাগরিককে রক্ষা করা। অর্থাৎ, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, আদালত পরিচালনা করা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির (Private Property) অধিকার নিশ্চিত করা। যদি আপনার সম্পত্তি চুরির বা দখলের ভয় থাকে, তাহলে আপনি বিনিয়োগ বা উৎপাদন করতে উৎসাহিত হবেন না। তাই ন্যায়বিচারের একটি নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা বাজারের পূর্বশর্ত।

৩. কিছু গণপূর্ত ও প্রতিষ্ঠান তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ (Public Works and Public Institutions): এমন কিছু কাজ আছে যা সমাজের জন্য অত্যন্ত দরকারি, কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা ছোট গোষ্ঠীর পক্ষে লাভজনকভাবে সেগুলো করা সম্ভব নয়। যেমন—রাস্তাঘাট, সেতু, বন্দর, খাল নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ। এই জিনিসগুলো বাণিজ্য ও যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য, কারণ এগুলো বাজারকে প্রসারিত করে এবং শ্রম বিভাজনকে আরও গভীর হতে সাহায্য করে।

এর পাশাপাশি স্মিথ সরকারের আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলেন। একটি হলো কর আরোপ (Taxation)। তিনি সরকারের আয়ের জন্য করের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন এবং কর আরোপের চারটি বিখ্যাত নীতি বা ম্যাক্সিম (Maxims of Taxation) প্রদান করেন: কর হতে হবে সমতার ভিত্তিতে (Equality), নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ (Certainty), করদাতার জন্য সুবিধাজনক (Convenience), এবং সংগ্রহের খরচ ন্যূনতম (Economy) হতে হবে। এই নীতিগুলো আজও আধুনিক কর ব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

আর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি হলো শিক্ষা (Education)। তিনি শ্রম বিভাজনের একটি অন্ধকার দিক নিয়েও গভীরভাবে সচেতন ছিলেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, কারখানায় একজন শ্রমিক যখন সারাজীবন ধরে শুধু একটা পিনের মাথা বানানোর মতো একঘেয়ে, পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ করে, তখন সে মানসিকভাবে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন এবং সংকীর্ণমনা হয়ে যেতে পারে (“drowsy and stupid”)। এই মানসিক স্থবিরতা কাটানোর জন্য এবং একজন ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি রাষ্ট্রের সহায়তায় সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার প্রসারের কথা বলেছিলেন। এটি তাঁকে তাঁর সমসাময়িক অনেক চিন্তাবিদদের থেকে আলাদা করে।

সুতরাং, স্মিথের সরকার নিষ্ক্রিয় নয়। তার কাজ হলো বাজারের জন্য খেলার মাঠ তৈরি করা, নিয়মকানুন ঠিক করে দেওয়া এবং খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু কোন দল জিতবে বা হারবে, সেটা ঠিক করে দেওয়া সরকারের কাজ নয়। সেই সিদ্ধান্ত নেবে বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’। তিনি ব্যবসায়ী বা উৎপাদকদের জোটবদ্ধ হয়ে একচেটিয়া কারবার (Monopoly) তৈরির ঘোর বিরোধী ছিলেন, কারণ এটি প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করে এবং সাধারণ ক্রেতার ক্ষতি করে।

অ্যাডাম স্মিথের চশমায় যে ধুলো জমেছিল

একজন চিন্তাবিদকে সত্যিকার অর্থে বোঝার উপায় হলো, তাঁর চিন্তার শক্তিগুলোর পাশাপাশি দুর্বলতাগুলোও খুঁজে বের করা। তাঁর চশমা দিয়ে পৃথিবীটা দেখার পর, চশমাটা খুলে লেন্সের ওপর জমে থাকা ধুলোবালিগুলোকেও একটু নেড়েচেড়ে দেখা। এখন আমরা সেই কাজটাই করব। অ্যাডাম স্মিথকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে আনার জন্য নয়, বরং তাঁকে আরও ভালোভাবে, আরও পূর্ণাঙ্গভাবে বোঝার জন্য। 

সেই বিখ্যাত দ্বিধা: এক মানুষ, দুই রূপ?

সমালোচকদের সবচেয়ে পুরোনো এবং বিখ্যাত আপত্তির শুরুটা হয় স্মিথের দুটি বইকে পাশাপাশি রাখলে। এক অদ্ভুত সমস্যা, যার জার্মান নাম ‘ডাস অ্যাডাম স্মিথ প্রব্লেম’ (Das Adam Smith Problem)।

ব্যাপারটা বেশ মজার। স্মিথ তাঁর প্রথম বই ‘The Theory of Moral Sentiments’-এ মানুষের যে ছবিটি এঁকেছেন, সে হলো এক সহানুভূতিশীল (Sympathetic) জীব। সে অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়। তার ভেতরে একজন ‘নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক’ (Impartial Spectator) বসে আছে, যে তাকে ন্যায়-অন্যায় চেনায়।

কিন্তু ১৭ বছর পর লেখা তাঁর দ্বিতীয় বই ‘The Wealth of Nations’-এ এসে আমরা যেন অন্য এক মানুষকে দেখি। এই মানুষটি চালিত হয় তার ব্যক্তিগত স্বার্থ (Self-interest) দিয়ে। কসাই মাংস বিক্রি করে দয়া করে নয়, নিজের লাভের জন্য। এই দুই ছবির মধ্যে কি এক বিরাট স্ববিরোধিতা নেই? যে মানুষ সহানুভূতি দিয়ে চলে, সে-ই আবার কেবল নিজের স্বার্থ দিয়ে চলে—এটা কীভাবে সম্ভব?

উনিশ শতকের অনেক পণ্ডিত মনে করতেন, স্মিথ হয়তো বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন আদর্শবাদী, পরের জীবনে হয়েছেন বাস্তববাদী।

কিন্তু আধুনিক কালের বেশিরভাগ গবেষক এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তাঁরা বলছেন, এটা আসলে কোনো সমস্যাই নয়, বরং স্মিথকে ভুলভাবে পড়ার ফল। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতো চিন্তাবিদরা দেখিয়েছেন, স্মিথের দুই বই আসলে মানব চরিত্রের দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে (Sen, 2010)। প্রথম বইটি আমাদের ব্যক্তিগত জগতের কথা বলে—যেখানে আমরা পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীর সঙ্গে থাকি। এই ছোট পরিসরে সহানুভূতি কাজ করে। কিন্তু বাজারের মতো এক বিশাল, নৈর্ব্যক্তিক (Impersonal) জগতে, যেখানে আমরা লক্ষ লক্ষ অচেনা মানুষের সঙ্গে লেনদেন করি, সেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থই সবচেয়ে কার্যকর চালিকাশক্তি।

কিন্তু সেই স্বার্থপর মানুষটি নৈতিকতাশূন্য নয়। সে ন্যায়বিচারের সাধারণ নিয়মগুলো (যেমন—চুরি না করা, প্রতারণা না করা) মেনেই তার স্বার্থ হাসিল করে। সুতরাং, দুটি বই সাংঘর্ষিক নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ। তবুও, এই আপাত দ্বিধাটি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে যে তুমুল বিতর্ক হয়েছে, তা স্মিথের চিন্তার একটি জটিল দিককে উন্মোচিত করে।

অদৃশ্য হাতের কারসাজি: যখন হাতটা দেখতে পায় না

স্মিথের সবচেয়ে জাদুকরী ধারণা হলো ‘অদৃশ্য হাত’। বাজার নিজেই নাকি সব ঠিকঠাক করে নেয়। চাহিদা আর জোগান সবকিছুকে এক জাদুকরী উপায়ে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসে। শুনতে দারুণ লাগে। কিন্তু এই অদৃশ্য হাত কি আসলেই সর্বদর্শী? নাকি তারও কিছু অন্ধ বিন্দু (Blind Spots) আছে?

আধুনিক অর্থনীতিবিদরা বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই এই হাত ঠিকঠাক কাজ করে না। এই অবস্থাকে বলা হয় ‘বাজারের ব্যর্থতা’ (Market Failure)। কয়েকটি উদাহরণ দেখা যাক।

১. বাহ্যিকতার সমস্যা (The Problem of Externalities): ধরুন, এক নদীর ধারে একটি রঙের কারখানা। কারখানাটি নিজের লাভের জন্য কাপড় রঙ করে, আর সব বিষাক্ত রাসায়নিক ফেলে দেয় নদীতে। নদীর জল নষ্ট হয়ে যায়। মাছ মরে যায়। জেলেদের জীবিকা বন্ধ হয়ে যায়। কারখানার মালিক নিজের লাভটাই দেখছে, অদৃশ্য হাতও তাকে লাভ করতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই যে জেলেদের ক্ষতি হলো, বা নদীর পরিবেশ নষ্ট হলো, এর দামটা কে দেবে? বাজার কি এই দামটা হিসাবের মধ্যে ধরেছে? ধরেনি।

এই প্রভাবগুলোকে বলে ‘বাহ্যিকতা’ বা Externalities। যখন কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে তৃতীয় কোনো পক্ষ (যে এই লেনদেনের অংশ নয়) ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান হয়, কিন্তু তার জন্য কোনো মূল্য দেওয়া বা নেওয়া হয় না, তখন বাজারের অদৃশ্য হাত অন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশ দূষণ হলো এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। স্মিথের জগতে দূষণের খরচ হিসাবের বাইরে থেকে যায়।

২. সরকারি পণ্যের জোগান (Provision of Public Goods): কিছু জিনিস আছে যা আমাদের সবার দরকার, কিন্তু বাজার সেগুলো তৈরি করতে চায় না। যেমন ধরুন, দেশের নিরাপত্তা বা রাস্তার আলো। কারণ, এগুলো থেকে লাভ করা কঠিন। আপনি যদি দেশের প্রতিরক্ষার জন্য চাঁদা না-ও দেন, তবুও আপনি সুরক্ষিত থাকবেন। রাস্তার আলো ব্যবহার করার জন্য আপনাকে কেউ বিল পাঠাবে না। যেহেতু মানুষকে আলাদা করে চার্জ করা যায় না, তাই কোনো বেসরকারি কোম্পানি এগুলো বানাতে আগ্রহী হয় না। স্মিথ অবশ্য এই সমস্যাটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন এবং সরকারের দায়িত্বের তালিকায় কিছু ‘গণপূর্ত’ (Public Works)-এর কথা বলেছিলেন। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষার মতো অনেক বিষয়কেই এখন আধা-সরকারি পণ্য হিসেবে দেখা হয়, যা স্মিথের কাঠামোয় পুরোপুরি খাপ খায় না।

৩. তথ্যের অসামঞ্জস্য (Information Asymmetry): স্মিথের বাজারব্যবস্থা ধরে নেয় যে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই পণ্য সম্পর্কে সমানভাবে জানে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয়? আপনি যখন একটি পুরোনো গাড়ি কিনতে যান, তখন বিক্রেতা গাড়িটির সমস্যা সম্পর্কে আপনার চেয়ে অনেক বেশি জানে। এই তথ্যের অসামঞ্জস্যের কারণে বাজার ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, এবং অনেক সময় ভালো জিনিসের বদলে খারাপ জিনিসই বাজারে টিকে থাকে (Akerlof, 1970)।

হীরা ও জলের ধাঁধা এবং মূল্যের গোলকধাঁধা

স্মিথ তাঁর ‘শ্রমভিত্তিক মূল্যতত্ত্ব’ (Labour Theory of Value) দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন, একটি জিনিসের দাম নির্ভর করে তা বানাতে কতটা শ্রম লেগেছে তার ওপর। শুনতে ভালো মনে হলেও, এটা বেশ বড়সড় একটা গোলকধাঁধা তৈরি করে।

প্রথমত, এই তত্ত্ব ‘হীরা-জলের ধাঁধা’র (Diamond-Water Paradox) ঠিকঠাক সমাধান দিতে পারে না। স্মিথ নিজেই প্রশ্নটা তুলেছিলেন, কিন্তু তাঁর উত্তর সন্তোষজনক ছিল না। দ্বিতীয়ত, অনেকেই বলেন, যদি শুধু শ্রম দিয়েই মূল্য নির্ধারিত হয়, তাহলে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রম দিয়ে একগাদা কাদা মেখে একটা বিশ্রী মূর্তি বানালে সেটার দাম কি অনেক বেশি হবে? নিশ্চয়ই না। কারণ, কেউ ওটা কিনতেই চাইবে না।

পরবর্তীকালের অর্থনীতিবিদরা, বিশেষ করে ‘প্রান্তিকতাবাদী বিপ্লব’ (Marginalist Revolution)-এর প্রবক্তারা দেখিয়েছেন, কোনো জিনিসের দাম শুধু তার উৎপাদন খরচের ওপর নির্ভর করে না, বরং ক্রেতার কাছে তার উপযোগিতা (Utility) বা চাহিদার ওপরও নির্ভর করে। একটি জিনিসের মূল্য নির্ধারিত হয় তার প্রান্তিক উপযোগিতা (Marginal Utility) এবং প্রান্তিক খরচ (Marginal Cost) দিয়ে।

তবে এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক প্রভাব ছিল ভিন্ন জায়গায়। কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) স্মিথের এই ধারণাটিকেই লুফে নিয়েছিলেন। মার্ক্স যুক্তি দেন, যদি শ্রমই সকল মূল্য তৈরি করে, তাহলে শ্রমিক তার শ্রমের পুরো মূল্য পায় না কেন? মালিক বা পুঁজিপতি মুনাফার (Profit) নামে সেই মূল্যের একটি বড় অংশ কেড়ে নেয়। এভাবেই মার্ক্স স্মিথের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে তাঁর বিখ্যাত ‘শোষণতত্ত্ব’ (Theory of Exploitation) দাঁড় করান (Marx, 1867/1990)। অর্থাৎ, স্মিথের নিজের তত্ত্বই পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় সমালোচকের হাতে একটি ধারালো অস্ত্র তুলে দিয়েছিল!

শ্রম বিভাজন: আশীর্বাদ না অভিশাপ?

পিন কারখানার গল্পটা দারুণ। শ্রম বিভাজন উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, দেশ ধনী হয়—সবই ঠিক আছে। কিন্তু এর একটা অন্ধকার দিকও আছে।

স্মিথ নিজেই এই দিকটা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, যে শ্রমিক সারাজীবন ধরে শুধু একটা পিনের আঠারো ভাগের এক ভাগ কাজ করে, সে ধীরে ধীরে তার মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলবে। তার জগৎটা ওই পিনের মাথার মতোই ছোট হয়ে যাবে। সে একঘেয়েমি আর মানসিক জড়তার শিকার হবে, যা তাকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ বা ভালো নাগরিক হতে বাধা দেবে (Smith, 1776/1981)। মার্ক্স এই ধারণাটিকেই পরে ‘বিচ্ছিন্নতা’ (Alienation) নাম দিয়েছিলেন।

যদিও স্মিথ এর সমাধান হিসেবে জনগণের জন্য শিক্ষার প্রসারের কথা বলেছিলেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেখানে লাভই শেষ কথা, সেখানে মালিকপক্ষ কি শ্রমিকের মানবিক বিকাশের জন্য সত্যিই যথেষ্ট ব্যবস্থা নেবে? এই প্রশ্নটি আজও প্রাসঙ্গিক।

বৈষম্যের জগৎ এবং বিস্মৃত নারী

স্মিথের পৃথিবী মূলত উৎপাদন আর প্রবৃদ্ধির। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ফল যদি সবার কাছে সমানভাবে না পৌঁছায়? যদি ধনী আরও ধনী হতে থাকে আর গরিব আরও গরিব?

স্মিথ হয়তো বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল চুইয়ে চুইয়ে (Trickle-down) সবার কাছেই পৌঁছাবে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের অভিজ্ঞতা দেখায়, লাগামহীন পুঁজিবাদ প্রায়শই ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্য (Economic Inequality) তৈরি করে। যাদের হাতে সম্পদ ও পুঁজি থাকে, তারা আরও বেশি সম্পদ তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে, শুধু শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকা মানুষেরা পিছিয়ে পড়তে থাকে। এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি রাজনৈতিক ক্ষমতাও তৈরি করে, যা দিয়ে ধনীরা নিজেদের স্বার্থে নিয়মকানুন বদলে নিতে পারে (Stiglitz, 2012)। স্মিথের মডেলে এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য মোকাবেলা করার তেমন কোনো জোরালো ব্যবস্থা নেই।

আরেকটি বড় সমালোচনা আসে নারীবাদী অর্থনীতির (Feminist Economics) দৃষ্টিকোণ থেকে। স্মিথ ‘উৎপাদনশীল শ্রম’ (Productive Labour) এবং ‘অনুৎপাদনশীল শ্রম’ (Unproductive Labour)-এর মধ্যে যে পার্থক্য করেছিলেন, তা আজকের দিনে প্রায় অচল। তার চেয়েও বড় কথা, তাঁর কাঠামোয় নারীর গৃহস্থালি কাজের (Domestic Labour) কোনো স্থানই নেই। শিশুর যত্ন নেওয়া, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার রাখা—এই যে বিশাল এক ‘যত্নের অর্থনীতি’ (Care Economy), যার ওপর ভর করে বাইরের ‘উৎপাদনশীল’ অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে, তা স্মিথের হিসাবে পুরোপুরি অদৃশ্য। এই অবৈতনিক শ্রমের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য তিনি নির্ধারণ করেননি, যা সমাজের অর্ধেক মানুষের অবদানকে অস্বীকার করার সামিল।

আড়াইশ বছর পরেও অ্যাডাম স্মিথ

আড়াইশ বছর পেরিয়ে গেছে। পৃথিবী অনেক বদলেছে। আমরা এখন শিল্প বিপ্লব পেরিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাস করছি। তাহলে পুরোনো দিনের এই দার্শনিকের কথা শোনার এখন আর কী দরকার?

দরকার আছে। কারণ স্মিথের মূল অন্তর্দৃষ্টিগুলো আশ্চর্য রকমভাবে আজও প্রাসঙ্গিক।

তাঁর ‘শ্রম বিভাজন’-এর ধারণা এখন বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনের (Global Supply Chain) রূপ নিয়েছে। আপনার আইফোনটির ডিজাইন হয় ক্যালিফোর্নিয়ায়, চিপ তৈরি হয় তাইওয়ানে, ডিসপ্লে আসে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে, আর সব একত্রিত হয় চীনে। এটি শ্রম বিভাজনের চূড়ান্ত বিশ্বায়ন।

তাঁর ‘অদৃশ্য হাত’-এর ধারণা আজও মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল ভিত্তি। যদিও আমরা এখন জানি, এই হাত সবসময় নিখুঁতভাবে কাজ করে না। পরিবেশ দূষণের মতো বাহ্যিকতা (Externalities) বা ২০০৮ সালের মতো আর্থিক সংকট—এগুলো বাজারের ব্যর্থতা, যা মোকাবেলায় সরকারের বিচক্ষণ হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়। স্মিথ নিজেও একচেটিয়া ব্যবসার ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারকেই আদর্শ মনে করতেন। আজকের যুগে টেক জায়ান্টদের একচেটিয়া ক্ষমতা নিয়ে যে বিতর্ক, তা স্মিথের চিন্তারই প্রতিধ্বনি।

তাঁর ‘মুক্ত বাণিজ্য’-এর ধারণা বিশ্বায়নের মূল চালিকাশক্তি। যদিও এর ফলে সৃষ্ট বৈষম্য এবং স্থানীয় শিল্পের ওপর প্রভাব নিয়ে এখন অনেক গুরুতর বিতর্ক হচ্ছে, যা স্মিথের মূল কাঠামোর মধ্যে নতুন চিন্তার দাবি রাখে।

সবচেয়ে বড় কথা, তিনি অর্থনীতিকে নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। তিনি দেখিয়েছেন, একটি সফল অর্থনীতির জন্য বিশ্বাস (Trust), সততা (Honesty) এবং আইনের শাসন (Rule of Law) অপরিহার্য। আজকের পৃথিবীতে যখন কর্পোরেট দুর্নীতি, অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি বা স্টেকহোল্ডার বনাম শেয়ারহোল্ডার বিতর্ক শুনি, তখন স্মিথের এই কথাটা আরও বেশি করে মনে পড়ে। তিনি বাজারকে একটি নৈতিক কাঠামোর মধ্যেই স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।

শেষ কথা

অ্যাডাম স্মিথ কোনো দেবতার নাম নয়। তাঁর সব কথাই বেদবাক্য – এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তাঁর তত্ত্বে সীমাবদ্ধতা আছে, অসম্পূর্ণতা আছে। তিনি হয়তো আজকের পৃথিবীর জটিল অর্থনৈতিক সংকট, যেমন – জলবায়ু পরিবর্তন বা চরম আর্থিক বৈষম্যের পূর্ণাঙ্গ সমাধান দিয়ে যেতে পারেননি।

কিন্তু তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে ভাবতে হয়। তিনি আমাদের একটি চশমা দিয়ে গেছেন, যা দিয়ে আমরা আমাদের চারপাশের এই জটিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেছনের সহজ সূত্রগুলো ধরতে পারি। তিনি দেখিয়েছেন, কোনো মহান শাসক বা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাকারীর আদেশে নয়, বরং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম, তাদের বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা, তাদের একটু ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি দেশের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।

তিনি সেই ঋষি, যিনি প্রথমবার আমাদের অর্থনীতির গল্পটা শুনিয়েছিলেন। কোনো কঠিন তত্ত্বকথা দিয়ে নয়, বরং পিন, কসাই আর রুটিওয়ালার মতো সাধারণ উদাহরণ দিয়ে। তাঁর লেখা পড়লে মনে হয়, তিনি কোনো গুরুগম্ভীর অধ্যাপক নন, বরং একজন উৎসুক পর্যবেক্ষক, যিনি মানুষের কাণ্ডকারখানা দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন আর সেই মুগ্ধতার গল্প আমাদের শোনাচ্ছেন।

সেই যে চায়ের কাপের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার রহস্য এখন হয়তো আপনার কাছে আরও পরিষ্কার হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বার্থপরতাই এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে আপনার জন্য তৈরি করেছে এক নিখুঁত, উষ্ণ মুহূর্ত। এটাই অ্যাডাম স্মিথের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাদু। আর এই জাদুর পেছনের কারিগরদের আমরা হয়তো কোনোদিন চিনব না, তাদের ধন্যবাদও দেব না। কিন্তু তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া আমাদের আধুনিক জীবন এক মুহূর্তও চলবে না।

তথ্যসূত্র

  • Akerlof, G. A. (1970). The Market for “Lemons”: Quality Uncertainty and the Market Mechanism. The Quarterly Journal of Economics, 84(3), 488–500.
  • Hayek, F. A. (1945). The Use of Knowledge in Society. The American Economic Review, 35(4), 519–530.
  • Herman, A. (2001). How the Scots Invented the Modern World: The True Story of How Western Europe’s Poorest Nation Created Our World & Everything in It. Crown Publishing Group.
  • Hirschman, A. O. (1977). The Passions and the Interests: Political Arguments for Capitalism before Its Triumph. Princeton University Press.
  • Kennedy, G. (2008). Adam Smith: A Moral Philosopher and His Political Economy. Palgrave Macmillan.
  • Marx, K. (1990). Capital: A Critique of Political Economy, Vol. 1. (B. Fowkes, Trans.). Penguin Classics. (Original work published 1867).
  • Muller, J. Z. (1993). Adam Smith in His Time and Ours: Designing the Decent Society. Princeton University Press.
  • Phillipson, N. (2010). Adam Smith: An Enlightened Life. Yale University Press.
  • Ricardo, D. (1817/2004). On the Principles of Political Economy and Taxation. Dover Publications.
  • Sen, A. (2010). Adam Smith and the contemporary world. Erasmus Journal for Philosophy and Economics, 3(1), 50-67.
  • Smith, A. (1759/1982). The Theory of Moral Sentiments. D.D. Raphael & A.L. Macfie (Eds.). Liberty Fund.
  • Smith, A. (1776/1981). An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations. R. H. Campbell & A. S. Skinner (Eds.). Liberty Fund.
  • Smith, V. L. (1998). The two faces of Adam Smith. Southern Economic Journal, 65(1), 2–19.
  • Stiglitz, J. E. (2012). The Price of Inequality: How Today’s Divided Society Endangers Our Future. W. W. Norton & Company.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.