ব্রিফোর সূত্র, বেইটম্যানের প্রিন্সিপল এবং ম্যানোস্ফিয়ারের নারীবিদ্বেষী অপপ্রয়োগ

Table of Contents

ভূমিকা

মানুষের মন এক বিচিত্র মহাদেশ। সেখানে যুক্তি আছে, আবেগ আছে, বিশ্বাস আছে, আছে কিছু আদিম প্রবৃত্তি। সেই প্রবৃত্তিগুলো কীভাবে কাজ করে, কেন করে, আর কেনই-বা ভালোবাসার মতো কোমল বিষয়কেও কখনো কখনো এক নিষ্ঠুর খেলার মাঠে পরিণত করে, এ নিয়ে গবেষণা, বিতর্ক আর মতবাদ জন্ম নিয়েছে বহু। কিছু মতবাদ সহজবোধ্য, কিছু জটিল। আবার কিছু মতবাদ এতই সরলীকৃত যে, তাকে হাতিয়ার বানিয়ে সমাজের একাংশ অন্য অংশের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচারণা চালায়। আজ আমরা এমন কিছু ধারণা, তাদের জন্মকথা, তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং বিতর্কিত প্রয়োগ নিয়ে এক দীর্ঘযাত্রায় বের হবো। এই যাত্রা মানব সম্পর্কের এক জটিল গোলকধাঁধায় প্রবেশ করার মতো।

গভীর রাতে আকাশ পানে চেয়ে কি কখনো মনে হয়েছে, এই যে অগণিত নক্ষত্র, তাদের পেছনে যেমন কিছু অমোঘ নিয়ম কাজ করে, তেমনি মানুষের সম্পর্কগুলোর পেছনেও কি কিছু অদৃশ্য নিয়ম কাজ করে? কে বেছে নেয়? কে অপেক্ষা করে? কেন কিছু সম্পর্ক পাহাড়ের মতো মজবুত হয়, আর কিছু বালির বাঁধের মতো ভেঙে যায়? যুগ যুগ ধরে মানুষ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে ফিরেছে। কখনো ধর্ম, কখনো দর্শন, আবার কখনো বিজ্ঞান নিয়ে হাজির হয়েছে। এই অনুসন্ধানযাত্রায় কিছু মানুষের চিন্তা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে এমন কিছু ধারণার জন্ম, যা একইসাথে মুগ্ধ করেছে, বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, এবং দুঃখজনকভাবে কিছু মানুষের হাতে অপপ্রয়োগের শিকার হয়েছে। রবার্ট স্টিফেন ব্রিফোর (Robert Stephen Briffault) নাম হয়তো খুব বেশি মানুষের পরিচিত নয়, অ্যাঙ্গাস জন বেইটম্যানের (Angus John Bateman) কথাও হয়তো অনেকে শোনেননি। অথচ এদের ধারণাগুলো মানুষের ভালোবাসার খেলা, প্রজননের জটিল সমীকরণ এবং লিঙ্গীয় ক্ষমতার ভারসাম্যের আলোচনায় এক গভীর প্রভাব ফেলেছে। আর আজকের ডিজিটাল যুগে, তথাকথিত ‘ম্যানোস্ফিয়ার’ (Manosphere) কীভাবে এই বৈজ্ঞানিক ও নৃতাত্ত্বিক ধারণাগুলোকে বিকৃত করে নারীবিদ্বেষী (misogynistic) এজেন্ডা চালাচ্ছে, তা আরও গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে। এই লেখায় আমরা সেই জটিল সুতোয় বোনা গল্পটা বলার চেষ্টা করব। এটি যেন এক অন্ধকার পথের গল্প, যেখানে জ্ঞানের আলো বিকৃত হয়ে কুয়াশার জন্ম দিয়েছে।

রবার্ট স্টিফেন ব্রিফো – সমাজতত্ত্বের এক অন্যরকম বিশ্লেষণ

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা। ইউরোপ জুড়ে তখন নতুন চিন্তার ঢেউ। মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব—সব শাখায় মানুষ তার নিজের অস্তিত্ব, তার সমাজ আর সম্পর্কের গভীরে ডুব দিতে চাইছে। এই সময়টাতেই রবার্ট স্টিফেন ব্রিফোর (Robert Stephen Briffault) মতো একজন মানুষ জন্ম নিলেন, যিনি পেশায় ছিলেন সার্জন (surgeon), কিন্তু তার মন ঝুঁকেছিল নৃতত্ত্ব আর সমাজতত্ত্বের দিকে। তার চিন্তাজগতে যেন অন্য এক নেশা চেপেছিল—মানুষের আদিম সমাজ আর তার ভেতরের অদ্ভুত সব নিয়মকানুন। ১৯২৭ সালে তিনি তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজটি প্রকাশ করলেন, যার নাম দ্য মাদার্স: আ স্টাডি অফ দ্য অরিজিনস অফ সেন্ট্রিমেন্টস অ্যান্ড ইনস্টিটিউশন্স (The Mothers: A Study of the Origins of Sentiments and Institutions)। এই বইটি শুধু একটি বই ছিল না, এটি ছিল মানব সমাজের বিবর্তন, পরিবার এবং লিঙ্গীয় সম্পর্কের একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। এটি ছিল মানব ইতিহাসের এক দীর্ঘ পথচলার ভিন্ন এক বিবরণ, যেখানে নারীর ভূমিকাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়েছিল।

ব্রিফোর নৃতাত্ত্বিক কনসেপ্ট (Briffault’s Anthropological Concept): নারীরা কেন বেছে নেয়?

ব্রিফোর কেন্দ্রীয় ধারণাটি, যা পরবর্তীতে “ব্রিফোর সূত্র” (Briffault’s Law) নামে পরিচিতি লাভ করে, খুবই সহজ-সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু এর গভীরতা অনেক। ব্রিফোর মতে, “নারীই বেছে নেয়, পুরুষকে প্রতিযোগীতা করতে হয়।” (The female chooses, the male competes)। এই বাক্যটি যেন মানব সম্পর্কের এক অলিখিত নিয়মের কথা বলে, যা বহু মানুষের মনে একইসাথে বিস্ময় আর কৌতূহল জাগিয়েছে। কিন্তু কেন? এই ‘কেন’-এর ব্যাখ্যায় ব্রিফো তৎকালীন প্রচলিত ধারণা থেকে সরে এসে এক নতুন দিক উন্মোচন করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন যে, আদিম মানব সমাজে নারীরা ছিল অর্থনৈতিক ক্ষমতার মূল উৎস। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শুরু করে শিকারি-সংগ্রাহক সমাজেও, নারীরা ছিল খাদ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। তারা শুধু সন্তান জন্ম দিত না, বরং তাদের লালন-পালন করত, সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করত। ফলের মতো স্থিতিশীল খাদ্য সংগ্রহ, বিভিন্ন বন্য উদ্ভিদ থেকে খাবার প্রক্রিয়াকরণ, আর সন্তান লালন-পালনের মতো অপরিহার্য কাজগুলো নারীদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। পুরুষরা তখন মূলত শিকারের উপর নির্ভরশীল ছিল, যা ছিল অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক। শিকারের সফলতা ছিল অনিয়মিত, আর তাই পুরুষদের অর্থনৈতিক অবদানও ছিল তুলনামূলকভাবে কম স্থিতিশীল।

ব্রিফোর মতে, পুরুষরা ছিল অপেক্ষাকৃত কম নির্ভরযোগ্য। শিকারের অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ এবং তাদের জীবনধারার অস্থিরতা তাদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিত। এর বিপরীতে, নারীর শ্রম (labor), তাদের প্রজনন ক্ষমতা (reproductive capacity) এবং সন্তান পালনের ক্ষমতা ছিল সমাজের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। একটি নবজাতক শিশুর জন্য মায়ের দুধ যেমন অপরিহার্য, তেমনি একটি আদিম গোষ্ঠীর স্থিতিশীলতার জন্য নারীর শ্রম আর তার প্রজনন ক্ষমতা ছিল ভিত্তিপ্রস্তর। ফলে, পুরুষদের টিকে থাকার জন্য, একটি গোষ্ঠীতে স্থান পাওয়ার জন্য, অথবা প্রজননের সুযোগ পাওয়ার জন্য নারীদের উপর নির্ভরশীল হতে হতো। এই নির্ভরশীলতার কারণেই পুরুষদেরকে নারীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য প্রতিযোগিতা করতে হতো, তাদের জন্য কিছু করতে হতো, নিজেদেরকে ‘প্রমাণ’ করতে হতো। নারীদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ, নিজেদের সাহস বা শক্তি প্রদর্শন, বা অন্য কোনো উপায়ে নিজেদেরকে ‘যোগ্য’ প্রমাণ করা ছিল পুরুষদের জন্য অপরিহার্য। এক কথায়, নারীরাই ‘বাজারের’ নিয়ন্ত্রক ছিল, কারণ তাদের ‘পণ্য’ (অর্থাৎ শ্রম, প্রজনন ক্ষমতা, স্থিতিশীলতা) ছিল বেশি মূল্যবান ও অপরিহার্য।

ব্রিফো আরও দাবি করেন যে, নারীরাই পরিবার এবং সামাজিক সংগঠনের মূল ভিত্তি স্থাপন করেছিল। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ (matriarchal society) বা মাতৃ-কেন্দ্রীক (matrifocal) কাঠামো তার এই ধারণারই অংশ। তার মতে, পৃথিবীর বহু প্রাচীন সভ্যতায় যেখানে মা বা মাতৃদেবীর পূজা হতো, তা নারীর এই ঐতিহাসিক গুরুত্বেরই প্রতিচ্ছবি। পুরুষের ভালোবাসা, আনুগত্য বা সঙ্গ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মূলত নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং সামাজিক গুরুত্বের প্রতি একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র। তার এই ধারণা তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামোর বিরুদ্ধে এক নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল।

ব্রিফোর সূত্রের সমালোচনা (Criticism of Briffault’s Law):

ব্রিফোর ধারণাগুলো যখন প্রকাশিত হলো, তখন তা দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করল। একদিকে যেমন নারীবাদীরা (feminists) এতে নারীর ঐতিহাসিক গুরুত্বের এক নতুন ব্যাখ্যা পেলেন, তেমনি অনেক নৃতত্ত্ববিদ এর সমালোচনা করলেন। কিছু সমালোচনা ছিল যুক্তিসঙ্গত, আবার কিছু ছিল চিরাচরিত ধ্যানধারণার প্রতি একটি প্রতিক্রিয়া মাত্র।

  • ঐতিহাসিক সরলীকরণ (Historical Simplification): ব্রিফোর প্রধান সমালোচকদের মধ্যে একজন হলেন ম্যালিনোফ্‌স্কি (Malinowski, 1927), যিনি দাবি করেন যে, ব্রিফো মানব ইতিহাসের বিশালতাকে মাত্র একটি সরল সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। সব আদিম সমাজে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা একই রকম ছিল না, অথবা পুরুষরা সবসময়ই নারীদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এমনটা বলা কঠিন। বরং, মানব সমাজের বিবর্তন ছিল বহুধা বিভক্ত, যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে (cultures) লিঙ্গীয় ভূমিকা (gender roles) ভিন্ন ভিন্ন রকম হতে পারে। কিছু সমাজে শিকারের গুরুত্ব ছিল অসীম, আবার কিছু সমাজে বিনিময় প্রথা (barter system) বা সম্মিলিত শ্রমের (collective labor) গুরুত্ব ছিল বেশি। এই জটিলতা ব্রিফোর ধারণায় অনেকটাই অনুপস্থিত। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা (archaeological research) এবং নৃতাত্ত্বিক ফিল্ডওয়ার্ক (ethnographic fieldwork) দেখায় যে, লিঙ্গীয় ভূমিকাগুলো অত্যন্ত নমনীয় (flexible) এবং বিভিন্ন পরিবেশগত ও সামাজিক চাপের মুখে তারা পরিবর্তিত হয়েছে।

  • পুরুষের ভূমিকা উপেক্ষা (Ignoring Male Roles): ব্রিফো পুরুষের শিকারের গুরুত্ব বা বাইরের বিশ্বের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে তাদের ভূমিকা কিছুটা উপেক্ষা করেছেন বলে মনে করা হয়। যদিও শিকার অনিশ্চিত, কিন্তু এটি বৃহৎ আকারের খাদ্য সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা একটি বৃহৎ গোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য ছিল। পুরুষরা শুধু শিকারী ছিল না, তারা প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করত, নতুন অঞ্চল আবিষ্কার করত এবং বাইরের গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করত, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদানের (social and economic exchange) জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলোর সবটাই সমাজের স্থিতিশীলতায় অবদান রাখত, যা শুধু নারীর শ্রম দ্বারা সম্ভব ছিল না।

  • আধুনিক সমাজের সাথে অসঙ্গতি (Incompatibility with Modern Society): অনেক সমালোচক দাবি করেন যে, আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজে যেখানে অর্থনৈতিক ক্ষমতা লিঙ্গের ভিত্তিতে কম নির্ধারিত হয়, সেখানে ব্রিফোর সূত্র তার কার্যকারিতা হারায়। যদিও ব্রিফো মূলত আদিম সমাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন, আধুনিক প্রেক্ষাপটে তার সূত্র প্রয়োগ করতে গেলে সমস্যা হয়। আজকের সমাজে যেখানে নারী-পুরুষ উভয়েই অর্থনৈতিক উপার্জনে সক্ষম, সেখানে শুধুমাত্র নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে সম্পর্কের চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা কঠিন।

  • প্রমাণ-ভিত্তিক সীমাবদ্ধতা (Evidential Limitations): ব্রিফো তার গবেষণার জন্য যেসব ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক তথ্য ব্যবহার করেছেন, সেগুলোর অনেকগুলোই এখন বিতর্কিত বা পুরনো হয়ে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব (archaeology) এবং আধুনিক নৃতত্ত্বের নতুন আবিষ্কারগুলো লিঙ্গীয় ভূমিকার অনেক জটিল দিক উন্মোচন করেছে। প্রাচীন সমাজের অনেক তথ্যের উৎস ছিল সীমিত এবং তাদের ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে। যেমন, কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে, কিছু শিকারি-সংগ্রাহক সমাজে নারী শিকারীর ভূমিকাও ছিল, যা ব্রিফোর সাধারণীকরণকে চ্যালেঞ্জ করে।

তবে, ব্রিফোর কাজ আধুনিক লিঙ্গীয় ক্ষমতা (gender power) এবং সম্পর্কের গতিশীলতা (relationship dynamics) নিয়ে আলোচনার পথ খুলে দিয়েছিল। তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, সেগুলো আজও প্রাসঙ্গিক: ক্ষমতা কার হাতে থাকে? কারা বেছে নেয়? এবং কেন? তার কাজটি হয়তো সরল ছিল, কিন্তু তা সমাজকে লিঙ্গীয় ভূমিকার প্রতি ভিন্নভাবে তাকাতে বাধ্য করেছিল।

অ্যাঙ্গাস জন বেইটম্যান – ফলিত বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম কাঁটাচামচ

ব্রিফোর যুগ থেকে একটু এগিয়ে আসা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। পৃথিবী তখন ধ্বংসের কিনার থেকে উঠে এসে নতুন করে গড়ছে নিজেদের। বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। জেনেটিক্স (genetics) তখন এক নতুন ক্ষেত্র। অণুজীব এবং তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণার এক নতুন জোয়ার এসেছে। এই সময়টাতে অ্যাঙ্গাস জন বেইটম্যান (Angus John Bateman) নামের একজন ব্রিটিশ জেনেটিসিস্ট ১৯৪৮ সালে এক যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন, যার শিরোনাম ছিল “সেক্সুয়াল আইসোলেশন অ্যান্ড ইনটিগ্রেটেড ক্রোমোজোম রিপ্যাটার্নিং ইন ডেটা সেটস ফ্রম ড্রোসোফিলা” (Sexual Isolation and Integrated Chromosome Repatterning in Data Sets from Drosophila)। যদিও শিরোনামটি অত্যন্ত অ্যাকাডেমিক এবং জটিল মনে হতে পারে, এর ভেতরের ধারণাটি মানব প্রজনন এবং লিঙ্গীয় সম্পর্কের আলোচনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করল। বেইটম্যানের এই গবেষণা যেন এক সূক্ষ্ম কাঁটাচামচ দিয়ে প্রকৃতির এক অদৃশ্য গ্রন্থি উন্মোচন করেছিল।

বেইটম্যানের পরীক্ষা (Bateman’s Experiment): ফলের মাছি এবং প্রজননের রহস্য

বেইটম্যানের গবেষণা ছিল ফলের মাছি (fruit flies), অর্থাৎ ড্রোসোফিলা মেলানোগ্যাস্টার (Drosophila melanogaster) নিয়ে। কেন ফলের মাছি? কারণ এরা খুব দ্রুত প্রজনন করে, এদের জীবনচক্র সরল এবং এদের জিনগত বৈশিষ্ট্য সহজেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। তিনি ফলের মাছিদের ছোট ছোট খাঁচায় রেখে তাদের প্রজননগত সফলতা (reproductive success) পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি নির্দিষ্ট জিনগত বৈশিষ্ট্য (genetic markers) ব্যবহার করে প্রতিটি পুরুষ ও নারী মাছির কতগুলো সন্তান হলো, এবং কতজনের সাথে তারা মিলিত হলো, তা ট্র্যাক করলেন। প্রতিটি মাছিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলোর বংশানুক্রমিক গতিবিধি (hereditary movement) তিনি পর্যবেক্ষণ করলেন, যাতে নিখুঁতভাবে তাদের প্রজনন ফলাফল নির্ধারণ করা যায়।

পরীক্ষার ফলাফল ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বেইটম্যান দেখতে পেলেন:

১. পুরুষদের প্রজননগত সফলতার ভিন্নতা (Greater Variance in Male Reproductive Success): পুরুষ মাছির ক্ষেত্রে, কিছু পুরুষ মাছি অনেক বেশি প্রজননগত সফল ছিল (অর্থাৎ অনেক বেশি সংখ্যক নারীর সাথে মিলিত হয়ে বেশি সন্তান জন্ম দিতে পেরেছিল), আবার কিছু পুরুষ মাছি একেবারেই সফল ছিল না। অনেক পুরুষ মাছি প্রজননের সুযোগই পায়নি। এর মানে হলো, পুরুষদের প্রজননগত সফলতার ক্ষেত্রে একটি বিশাল ভিন্নতা (variance) ছিল। তাদের সফলতা ছিল এক পিরামিডের মতো – শীর্ষে খুব কম সংখ্যক সফল পুরুষ, আর নিচে অসংখ্য ব্যর্থ পুরুষ।

২. নারীদের প্রজননগত সফলতার সীমাবদ্ধতা (Limited Female Reproductive Success): নারী মাছির ক্ষেত্রে, তাদের প্রজননগত সফলতা পুরুষদের মতো এতোটা বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল না। প্রায় সব নারী মাছিই কমবেশি প্রজননে সফল হয়েছিল, এবং তাদের সন্তান সংখ্যার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। তাদের প্রজনন সফলতার গ্রাফটি ছিল তুলনামূলকভাবে ফ্ল্যাট। এর কারণ হলো, নারীদের ডিম্বাণু উৎপাদন এবং গর্ভধারণের একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে।

বেইটম্যানের প্রিন্সিপল (Bateman’s Principle): মূলকথা

এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বেইটম্যান যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, তা “বেইটম্যানের প্রিন্সিপল” (Bateman’s Principle) নামে পরিচিতি লাভ করল। এই প্রিন্সিপলের দুটি মূল অংশ রয়েছে:

  • পুরুষের প্রজননগত সফলতার সম্পর্ক সঙ্গীর সংখ্যার সাথে (Male reproductive success is limited by the number of mates): বেইটম্যান দেখলেন যে, পুরুষ যত বেশি নারীর সাথে মিলিত হতে পারে, তার প্রজননগত সফলতা তত বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ, পুরুষদের জন্য প্রজননের মূল সীমাবদ্ধতা হলো সঙ্গীর সংখ্যা। তাদের জন্য ‘সংখ্যা’ ছিল সাফল্যের চাবিকাঠি।

  • নারীর প্রজননগত সফলতার সম্পর্ক সঙ্গীর সংখ্যার সাথে নয়, বরং সম্পদের সাথে (Female reproductive success is limited by resources/eggs, not by the number of mates): নারীরা একবার মিলিত হওয়ার পরই তাদের ডিম্বাণু (eggs) নিষিক্ত হয়ে যায় এবং গর্ভধারণ (gestation) শুরু হয়। তাদের প্রজনন ক্ষমতা সঙ্গীর সংখ্যার দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তাদের ডিম্বাণুর সংখ্যা এবং সন্তান পালনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ (resources) দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। নারীদের জন্য ‘গুণগত মান’ (quality) এবং ‘সম্পদ’ ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের প্রতিটি প্রজনন প্রচেষ্টায় উচ্চ বিনিয়োগ জড়িত ছিল।

এই দুটি পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বেইটম্যান তৃতীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে এলেন:

  • উচ্চতর প্রজননগত বিনিয়োগ (Higher Parental Investment) যার থাকে, সেই যৌন সঙ্গী নির্বাচনে বেশি সতর্ক হয়: বেইটম্যান যুক্তি দিলেন যে, যে লিঙ্গের প্রজননগত বিনিয়োগ (parental investment) বেশি (যেমন—ডিম্বাণু তৈরি, গর্ভধারণ, সন্তান লালন-পালন), সেই লিঙ্গ সঙ্গী নির্বাচনে বেশি সতর্ক ও চয়নকারী (choosier) হয়। ফলের মাছির ক্ষেত্রে, নারীদের ডিম্বাণু বড় এবং তাদের জন্মদানের প্রক্রিয়া পুরুষদের শুক্রাণু (sperm) তৈরির চেয়ে বেশি শক্তি খরচকারী। তাই নারীরাই বেশি চয়নকারী। আর যেহেতু পুরুষদের প্রজননগত বিনিয়োগ কম এবং তারা যত বেশি নারীর সাথে মিলিত হতে পারে, তত বেশি সফল হয়, তাই তারা বেশি সংখ্যক সঙ্গী পেতে প্রতিযোগিতা করে। এই প্রতিযোগিতার কারণেই পুরুষদের মধ্যে যৌন নির্বাচনের (sexual selection) চাপ বেশি থাকে।

এই ধারণার মূলে রয়েছে অ্যানিসোগ্যামি (anisogamy) – অর্থাৎ নারী ও পুরুষের জনন কোষের (gametes) আকার ও সংখ্যার পার্থক্য। নারীর ডিম্বাণু বড়, সংখ্যায় কম এবং উৎপাদনে শক্তি খরচ হয় বেশি। পুরুষের শুক্রাণু ছোট, সংখ্যায় অগণিত এবং উৎপাদনে তুলনামূলক কম শক্তি খরচ হয়। এই মৌলিক জৈবিক পার্থক্যই লিঙ্গীয় ভূমিকার বিবর্তনে (evolution of gender roles) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বেইটম্যান মনে করেন। এটি প্রকৃতির এক নীরব হিসাব, যেখানে প্রতিটি জীবের প্রজনন কৌশল তার নিজস্ব জৈবিক সীমাবদ্ধতা দ্বারা নির্ধারিত হয়।

বেইটম্যানের প্রিন্সিপলের সমালোচনা (Criticism of Bateman’s Principle)

বেইটম্যানের প্রিন্সিপল বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানে (evolutionary biology) এক প্রভাবশালী ধারণা হিসেবে স্থান করে নেয়। এটি যৌন নির্বাচন (sexual selection) এবং পিতামাতার বিনিয়োগ (parental investment) তত্ত্বের বিকাশে (Trivers, 1972) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রবার্ট ট্রিভার্সের (Robert Trivers) পিতামাতার বিনিয়োগ তত্ত্ব (Parental Investment Theory) বেইটম্যানের ধারণাকে আরও বিস্তৃত করে দেখায় যে, যে লিঙ্গ প্রজননে বেশি শক্তি, সময় ও ঝুঁকির বিনিয়োগ করে, সেই লিঙ্গই সঙ্গীর ক্ষেত্রে বেশি চয়নকারী হয়, কারণ তাদের হারাবার (to lose) ঝুঁকি বেশি। তবে, এই ধারণারও ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে, বিশেষ করে যখন এটি অন্যান্য প্রাণী এবং মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়।

প্রজাতির সীমাবদ্ধতা (Species Specificity): বেইটম্যানের গবেষণা শুধুমাত্র ফলের মাছিদের উপর পরিচালিত হয়েছিল। ফলের মাছিরা খুব দ্রুত প্রজনন করে এবং তাদের জীবনচক্র সরল। অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী (বিশেষ করে স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি) এবং মানুষের ক্ষেত্রে প্রজননগত আচরণ (reproductive behavior) অনেক বেশি জটিল। উদাহরণস্বরূপ, কিছু পাখি প্রজাতিতে (যেমন, সীহর্স বা পাইপফিশ) পুরুষরা ডিম্বাণু বহন করে এবং সন্তান লালন-পালনে মূল ভূমিকা রাখে, যেখানে তারা বেশি চয়নকারী হয়। এক প্রজাতির ফলাফল অন্য প্রজাতিতে হুবহু প্রয়োগ করা (generalize) কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে (Tang-Martinez & Lionetti, 2017)।

পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা (Methodological Limitations):

  • খাঁচার পরিবেশ (Cage Environment): ফলের মাছিদের ছোট খাঁচায় রাখা হয়েছিল, যেখানে তাদের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত ছিল এবং সঙ্গীর সংখ্যাও ছিল নির্দিষ্ট। এই কৃত্রিম পরিবেশ প্রাকৃতিক আচরণকে বিকৃত করতে পারে। প্রকৃতিতে ফলের মাছিরা হয়তো আরও জটিল আচরণ প্রদর্শন করে।

  • সীমিত সঙ্গীর সুযোগ (Limited Mating Opportunities): বেইটম্যানের পরীক্ষায় পুরুষ মাছির সংখ্যা নারীদের চেয়ে বেশি হওয়ায়, সব পুরুষ মাছির পক্ষে সঙ্গিনী পাওয়া সম্ভব হয়নি। এর ফলে প্রজননগত সফলতার ভিন্নতা কৃত্রিমভাবে বেড়ে যেতে পারে। এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের (natural selection) একটি দিক, যেখানে কিছু পুরুষ সফল হয়, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, নারীরা সব পরিস্থিতিতেই কম বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রজনন সফলতা প্রদর্শন করবে।

  • জিনগত বৈশিষ্ট্য (Genetic Strains): বেইটম্যান নির্দিষ্ট জিনগত বৈশিষ্ট্যের ফলের মাছি ব্যবহার করেছিলেন, যা অন্য জিনগত বৈশিষ্ট্যের মাছির আচরণ থেকে ভিন্ন হতে পারে। পরবর্তীতে, বিজ্ঞানীরা বেইটম্যানের পরীক্ষা পুনরুৎপাদনের (replicate) চেষ্টা করেছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে একই ফলাফল পাননি, যা মূল গবেষণার পদ্ধতির উপর প্রশ্ন তুলেছে।

পিতামাতার বিনিয়োগের সরলীকরণ (Oversimplification of Parental Investment): বেইটম্যানের ধারণা পুরুষের পিতামাতার বিনিয়োগকে (paternal investment) অনেকটাই উপেক্ষা করে। অনেক প্রজাতিতে (এবং মানুষের ক্ষেত্রে তো বটেই) পুরুষরাও সন্তান পালনে (parental care) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে, যা তাদের প্রজননগত কৌশলকে প্রভাবিত করে। শুধু শুক্রাণু উৎপাদন বা ডিম্বাণু উৎপাদনই একমাত্র বিনিয়োগ নয়। শিকার, খাদ্য সংগ্রহ, সুরক্ষা প্রদান—এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ (Gowaty, 2004)। বিশেষ করে, মানুষ ও অন্যান্য সামাজিক প্রাণীর ক্ষেত্রে, পুরুষের যত্ন এবং সম্পদ সরবরাহ সন্তানের টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য।

একপেশে পর্যবেক্ষণ (Unidirectional Observation) ও নারী একাধিক সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক: বেইটম্যানের মূল পর্যবেক্ষণে পুরুষদের ক্ষেত্রে সঙ্গীর সংখ্যা এবং প্রজনন সফলতার মধ্যে একটি সরল সম্পর্ক দেখা যায়, কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না। কিন্তু পরবর্তীতে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে নারী প্রাণীও একাধিক সঙ্গীর সাথে মিলিত হয়ে তাদের প্রজননগত সফলতার বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করতে পারে (polyandry) (Ah-King & Gowaty, 2016)। নারীরা একাধিক সঙ্গীর সাথে মিলিত হতে পারে ‘গুড জিনস’ (good genes) পাওয়ার জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ভিন্ন অভিযোজন ক্ষমতা দেওয়ার জন্য, বা অন্য পুরুষদের কাছ থেকে সুরক্ষা বা সম্পদ পাওয়ার জন্য।

প্রজননগত সফলতার সংজ্ঞা (Definition of Reproductive Success): ‘প্রজননগত সফলতা’ বলতে শুধু সন্তান জন্মদান বোঝায় না, বরং সেই সন্তানরা কতটা সুস্থভাবে বেঁচে থাকে এবং নিজেরা প্রজননে সফল হয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। বেইটম্যানের গবেষণা শুধু জন্মদানের সংখ্যার ওপর জোর দিয়েছিল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকার (long-term survival) উপর খুব বেশি জোর দেয়নি।

তবে বেইটম্যানের কাজটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা স্থাপন করেছিল: জীবজগতে লিঙ্গীয় ভূমিকার পার্থক্য মূলত জৈবিক বিনিয়োগের পার্থক্যের ফল। এটি বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করেছে এবং যৌন নির্বাচন ও পিতামাতার বিনিয়োগ তত্ত্বের বিকাশে (Trivers, 1972) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এটি ছিল এক বীজ বপন, যা থেকে পরবর্তীতে আরও জটিল তত্ত্বের জন্ম হয়েছে।

ব্রিফোর সূত্র ও বেইটম্যানের প্রিন্সিপলের মধ্যে সম্পর্ক বা মিল

ব্রিফোর সূত্র এবং বেইটম্যানের প্রিন্সিপল – দুটি ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা, ভিন্ন সময়ে জন্ম নেওয়া দুটি ধারণা। একটি সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের চশমা দিয়ে মানব সমাজের আদিম গঠনকে দেখছে, অন্যটি জীববিজ্ঞান ও জেনেটিক্সের সূক্ষ্ম যন্ত্র দিয়ে ফলের মাছির প্রজনন আচরণকে বিশ্লেষণ করছে। এদের জন্মস্থান ভিন্ন হলেও, আপাতদৃষ্টিতে এদের মধ্যে কিছু মিল খুঁজে পাওয়া গেলেও, এদের মূল ভিত্তি, ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। তাদের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বোনা সম্পর্ক আছে, যা মানব সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।

দৃষ্টিভঙ্গির মিল (Apparent Similarities in Outlook)

  • নারীই বেছে নেয়, পুরুষকে প্রতিযোগীতা করতে হয় (Female Choice, Male Competition): এই দুটি ধারণারই একটি সাধারণ থিম হলো যে, লিঙ্গীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীরাই ‘চয়নকারী’ (choosier) পক্ষ, আর পুরুষরা ‘প্রতিযোগী’ (competitive) পক্ষ। ব্রিফো তার সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে আদিম সমাজে নারীরা তাদের অপরিহার্য শ্রম ও প্রজনন ক্ষমতার কারণে এই চয়নকারী ভূমিকা অর্জন করেছিল। তার মতে, পুরুষদেরকে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য নারীদের মন জয় করতে হতো, কারণ নারীর হাতেই ছিল সমাজের মূল চাবিকাঠি। বেইটম্যান তার জৈবিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে প্রজননগত বিনিয়োগের পার্থক্যের কারণে নারীরা (বিশেষ করে ফলের মাছি) সঙ্গী নির্বাচনে বেশি সতর্ক হয় এবং পুরুষরা বেশি সঙ্গী পেতে প্রতিযোগিতা করে। এখানে যেন জৈবিক প্রবণতা সামাজিক আচরণে প্রতিফলিত হয়েছে।

  • ক্ষমতার ভারসাম্য (Power Dynamics): উভয় তত্ত্বই পরোক্ষভাবে লিঙ্গীয় ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলে। ব্রিফোর মতে, নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের চয়নকারী ভূমিকাকে শক্তিশালী করে। এটি নারীর হাতে এক ধরনের ‘দর কষাকষি’র ক্ষমতা (bargaining power) তুলে দেয়। বেইটম্যানের মতে, নারীর উচ্চ জৈবিক বিনিয়োগ তাদের প্রজননগত ক্ষমতাকে এমন এক অবস্থানে রাখে যেখানে তারা সঙ্গী নির্বাচনে বেশি দরকষাকষি (negotiation) করতে পারে। এই উভয় ক্ষেত্রেই, চূড়ান্ত নির্বাচন বা ‘ভেটো’ ক্ষমতা নারীর হাতেই থাকে, যদিও তার কারণ ভিন্ন।

গভীর পার্থক্য (Profound Differences)

কিন্তু এই আপাত মিলের আড়ালে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য:

মূল ভিত্তি (Underlying Basis):

  • ব্রিফো: সামাজিক ও অর্থনৈতিক (Sociological and Economic): ব্রিফোর সূত্র সম্পূর্ণরূপে সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, লিঙ্গীয় ভূমিকা এবং ক্ষমতা সমাজের বিবর্তনের ফল, যেখানে নারীর শ্রম এবং তাদের উপর পুরুষদের নির্ভরশীলতা মূল চালিকাশক্তি। এটি শিখবার (learned behavior) এবং সামাজিক নির্মাণের (social construct) উপর জোর দেয়। ব্রিফোর মতে, লিঙ্গীয় ক্ষমতার এই ভারসাম্য মূলত সামাজিক পরিবেশ দ্বারা তৈরি, যা প্রাকৃতিক বা জন্মগত নয়।

  • বেইটম্যান: জৈবিক ও বিবর্তনগত (Biological and Evolutionary): বেইটম্যানের প্রিন্সিপল পুরোপুরি জৈবিক। এটি অ্যানিসোগ্যামি এবং উচ্চতর প্রজননগত বিনিয়োগের মতো জৈবিক বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি প্রবৃত্তিগত (instinctual) এবং বিবর্তনগত অভিযোজনের (evolutionary adaptation) উপর জোর দেয়। এটি নির্দেশ করে যে, লিঙ্গীয় ভূমিকার পার্থক্য মূলত প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের ফল, যা জিনের গভীরে প্রোথিত।

ব্যাখ্যার ব্যাপ্তি (Scope of Explanation):

  • ব্রিফো: মানব সমাজ (Human Society): ব্রিফোর কাজ সরাসরি মানব সমাজের বিবর্তন, সামাজিক সংগঠন এবং লিঙ্গীয় ক্ষমতার গতিশীলতা নিয়ে আলোচনা করে। তার তত্ত্ব আদিম মানব সমাজের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের উপর আলোকপাত করে।

  • বেইটম্যান: সমগ্র জীবজগৎ (All Living Organisms): বেইটম্যানের প্রিন্সিপল প্রাথমিকভাবে ফলের মাছি নিয়ে হলেও, এটি বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানের একটি মৌলিক তত্ত্ব হিসেবে অন্যান্য প্রজাতিতেও (মানুষ সহ) প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছে। এটি জীবজগতের বিস্তৃত পরিসরে প্রজনন কৌশল ব্যাখ্যা করার একটি কাঠামো দেয়।

নিয়তির প্রশ্ন (Determinism):

  • ব্রিফো: পরিবর্তনশীলতা (Mutability): ব্রিফোর ধারণা অনুযায়ী, যেহেতু লিঙ্গীয় ভূমিকা এবং ক্ষমতা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ফল, সেহেতু সমাজ পরিবর্তিত হলে এই ভূমিকা এবং ক্ষমতাও পরিবর্তিত হতে পারে। এটি যেন বলে যে, মানুষ তার নিজের সমাজের নিয়ম নিজেই লিখতে পারে।

  • বেইটম্যান: সহজাত প্রবণতা (Innate Tendency): বেইটম্যানের প্রিন্সিপল অনুযায়ী, যেহেতু এটি জৈবিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাই এটি লিঙ্গীয় ভূমিকা এবং প্রজননগত আচরণের এক সহজাত প্রবণতাকে নির্দেশ করে, যা পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে। যদিও পরিবেশের প্রভাবে কিছু পরিবর্তন হতে পারে, মূল জৈবিক চালিকাশক্তি একই থাকে। এটি প্রকৃতির এক অলঙ্ঘনীয় নিয়মকে তুলে ধরে।

একত্রে দেখার যৌক্তিকতা (Can they coexist?)

ব্রিফোর সূত্র এবং বেইটম্যানের প্রিন্সিপলকে তাই একে অপরের প্রতিযোগী হিসেবে না দেখে, বরং মানব সম্পর্কের জটিলতাকে বোঝার জন্য দুটি ভিন্ন কিন্তু পরিপূরক (complementary) লেন্স হিসেবে দেখা যেতে পারে। তারা যেন একই ধাঁধার দুটি ভিন্ন টুকরা, যা একসাথে বসলে এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।

  • বেইটম্যানের প্রিন্সিপল হয়তো বিবর্তনগতভাবে কিছু জৈবিক প্রবণতা (biological predispositions) ব্যাখ্যা করে – যেমন পুরুষদের মধ্যে সঙ্গী সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা এবং নারীদের মধ্যে সতর্ক চয়নের প্রবণতা। এটি মানবজাতির একেবারে আদিম প্রজননগত চালিকাশক্তিকে বোঝায়, যা আমাদের জিনের গভীরে প্রোথিত।

  • ব্রিফোর সূত্র আবার দেখায় যে, কীভাবে এই জৈবিক প্রবণতাগুলো মানব সমাজে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক (cultural) প্রেক্ষাপটের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে এক জটিল লিঙ্গীয় ক্ষমতার কাঠামো তৈরি করে। অর্থাৎ, জৈবিক প্রবণতাগুলো কীভাবে সামাজিক রূপ নেয় এবং ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত হয়, তা ব্রিফো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। মানুষের সমাজ কিভাবে এই জৈবিক চালিকাশক্তিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ বা প্রকাশ করে, তা ব্রিফোর সূত্রে আমরা দেখতে পাই।

মানুষ শুধু জৈবিক প্রাণী নয়, সামাজিক প্রাণীও। আমাদের আচরণ শুধু জিনের দ্বারা চালিত হয় না, সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনীতি এবং নৈতিকতার দ্বারাও প্রভাবিত হয়। তাই ব্রিফো এবং বেইটম্যানের ধারণাগুলোকে একত্রিত করে দেখলে মানব সম্পর্কের একটি আরও পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া সম্ভব। তবে, এই ‘একত্রীকরণ’ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হবে, যাতে কোনো একটি ধারণাকে বিকৃত করে বা অতিরিক্ত সরলীকরণ করে একটি বিপজ্জনক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো না যায়। দুঃখজনকভাবে, ঠিক এই কাজটিই করা হয়েছে আজকের তথাকথিত ‘ম্যানোস্ফিয়ার’-এ, যেখানে এই ধারণাগুলোকে একতরফাভাবে ব্যবহার করে এক বিষাক্ত বার্তা ছড়ানো হচ্ছে।

ম্যানোস্ফিয়ার দ্বারা এদের ধারণার ব্যবহার ও তা দিয়ে নারীবিদ্বেষী প্রচারণা

একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগে, ইন্টারনেট এক বিচিত্র, রহস্যময় ভূখণ্ডের সন্ধান দিয়েছে। এখানে তথ্য যেমন মুহূর্তেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি ভুয়া তথ্য (misinformation) এবং ঘৃণা (hate speech)-ও দ্রুত শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। ইন্টারনেটের এই অন্ধকার দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘ম্যানোস্ফিয়ার’ (Manosphere)। এটি পুরুষ-কেন্দ্রিক অনলাইন সম্প্রদায়ের (online communities) একটি বৃহৎ নেটওয়ার্ক, যেখানে পুরুষদের অধিকার এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনার নামে প্রায়শই নারীবিদ্বেষী, লিঙ্গবৈষম্যমূলক (sexist) এবং চরমপন্থী (extremist) মতবাদ প্রচার করা হয়। ইনসেল (Incel – Involuntary Celibates), এমজিটিওডব্লিউ (MGTOW – Men Going Their Own Way), রেড পিল (Red Pill), পিক-আপ আর্টিস্ট (Pick-Up Artist – PUA) এবং পুরুষ অধিকার আন্দোলন (Men’s Rights Activism – MRA) এর মতো বিভিন্ন গ্রুপ এর অন্তর্ভুক্ত। এই সম্প্রদায়গুলো যেন ইন্টারনেটের গভীর অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য বিষবৃক্ষ, যা সমাজের সুস্থ সম্পর্কগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে।

ম্যানোস্ফিয়ারের একটি সাধারণ কৌশল হলো বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোকে (scientific concepts) বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা এবং ব্যবহার করা, যাতে তাদের নারীবিদ্বেষী মতবাদগুলোকে ‘বৈজ্ঞানিক’ বা ‘যৌক্তিক’ বলে মনে হয়। রবার্ট স্টিফেন ব্রিফোর সূত্র এবং অ্যাঙ্গাস জন বেইটম্যানের প্রিন্সিপল তাদের এই এজেন্ডার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তারা এই ধারণাগুলোকে তাদের নিজেদের সুবিধামত কেটে-ছেঁটে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যাতে মনে হয় বিজ্ঞান তাদের পক্ষেই কথা বলছে।

ব্রিফোর ধারণার ব্যবহার ও বিকৃতি (Misuse and Distortion of Briffault’s Law)

ম্যানোস্ফিয়ারের সদস্যরা ব্রিফোর সূত্রকে তাদের নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে, যা ব্রিফোর মূল লেখার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা ব্রিফোর “নারীই বেছে নেয়, পুরুষকে প্রতিযোগিতা করে” – এই অংশটুকু নেয়, কিন্তু এর পেছনের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। তারা যেন অর্ধেক সত্যকে নিয়ে পুরো মিথ্যা বুননের চেষ্টা করে।

বিকৃত ব্যাখ্যা: ম্যানোস্ফিয়ার দাবি করে যে, ব্রিফোর সূত্র প্রমাণ করে যে নারীরা সবসময়ই “উচ্চ ক্ষমতা” (high power) এবং “নিম্ন বিনিয়োগ” (low investment) নিয়ে সম্পর্কে প্রবেশ করে। তাদের মতে, নারীরা জন্মগতভাবে ‘সুবিধাবাদী’ (opportunistic) এবং ‘লেনদেনভিত্তিক’ (transactional) হয়। তারা পুরুষদের কেবল তাদের সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা বা সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করে। অর্থাৎ, “নারীরা সবসময়ই চালকের আসনে থাকে” এবং পুরুষদেরকে তাদের পেছনে ছুটতে বাধ্য করে। এই ব্যাখ্যা ব্রিফোর সামাজিক বিবর্তনবাদের ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলে এবং নারীর সহজাত প্রবৃত্তির উপর দোষ চাপায়।

নারীবিদ্বেষী প্রচারণার ব্যবহার:

  • নারীকে প্রতারক হিসেবে চিত্রিত করা: তারা ব্রিফোর সূত্রকে ব্যবহার করে দাবি করে যে, নারীরা সহজাতভাবে ‘প্রতারক’ (deceitful) এবং ‘ম্যানিপুলেটিভ’ হয়, কারণ তারা পুরুষদের আবেগ ও পরিশ্রমকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। তাদের মতে, নারীরা ‘সিম্প’ (simp) বা ‘বেটা পুরুষ’ (beta male) দের শোষণ করে নিজেদের ‘আলফা পুরুষ’ (alpha male) দের কাছে পৌঁছানোর জন্য।

  • পুরুষকে ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে উপস্থাপন করা: পুরুষদেরকে তারা এমন এক শ্রেণির মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করে, যাদেরকে নারীরা শোষণ করে, এবং পুরুষদের এই ‘অসহায়ত্ব’ ব্রিফোর সূত্র দ্বারা প্রমাণিত। এর মাধ্যমে তারা পুরুষদের মধ্যে এক ধরনের ‘ভুক্তভোগীর মানসিকতা’ (victim mentality) তৈরি করে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

  • ফেমিনিজমের সমালোচনা: তাদের মতে, নারীবাদীরা আরও বেশি ক্ষমতা দাবি করে, অথচ ব্রিফোর সূত্র অনুযায়ী নারীদের হাতে ইতিমধ্যেই সব ক্ষমতা রয়েছে। এটি নারীবাদের বিরুদ্ধে একটি ‘বৈজ্ঞানিক’ যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা নারীদের সংগ্রামকে তুচ্ছ করে।

বেইটম্যানের প্রিন্সিপলের ব্যবহার ও বিকৃতি (Misuse and Distortion of Bateman’s Principle)

ম্যানোস্ফিয়ারের ‘বৈজ্ঞানিক’ যুক্তিগুলোর মধ্যে বেইটম্যানের প্রিন্সিপল সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। তারা বেইটম্যানের ফলের মাছির গবেষণা থেকে আসা জৈবিক ধারণাগুলোকে মানুষের জটিল সম্পর্কের উপর সরলভাবে প্রয়োগ করে, যেন মানুষও ফলের মাছিদের মতোই সরল প্রাণ।

বিকৃত ব্যাখ্যা

  • পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা অসীম, নারীর সীমাবদ্ধ: ম্যানোস্ফিয়ার বেইটম্যানের এই পর্যবেক্ষণকে আঁকড়ে ধরে যে, পুরুষদের প্রজনন ক্ষমতা অসীম এবং তারা যত বেশি সঙ্গীর সাথে মিলিত হতে পারে, তত সফল হয়। এর বিপরীতে, নারীর প্রজনন ক্ষমতা সীমিত (ডিম্বাণু এবং গর্ভধারণের সীমাবদ্ধতার কারণে)। এই মৌলিক জৈবিক সত্যকে তারা বিকৃত করে মানুষের যৌন এবং সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করে।

  • হাইপারগ্যামি (Hypergamy): এই ধারণার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রয়োগ হলো ‘হাইপারগ্যামি’র ধারণা। তারা বেইটম্যানের প্রিন্সিপলকে ব্যবহার করে দাবি করে যে, নারীরা জৈবিকভাবেই ‘হাইপারগ্যামাস’ – অর্থাৎ, তারা সবসময়ই নিজেদের চেয়ে ‘উঁচু’ সামাজিক মর্যাদা, সম্পদ বা ক্ষমতার পুরুষ সঙ্গী খোঁজে। তারা ‘উচ্চ মূল্যের পুরুষ’ (High-Value Man) দের সাথে মিলিত হতে চায় এবং ‘নিম্ন মূল্যের পুরুষ’ (Low-Value Man) দেরকে বর্জন করে। তাদের মতে, এটি নারীর সহজাত প্রবৃত্তি, যা পরিবর্তন করা অসম্ভব।

  • পুরুষের ‘অপ্রয়োজনীয়তা’ (Male Expendability): যেহেতু পুরুষদের শুক্রাণু উৎপাদন সস্তা এবং অসীম, তাই ম্যানোস্ফিয়ার দাবি করে যে, জৈবিকভাবে পুরুষরা ‘অপ্রয়োজনীয়’ বা ‘বদলযোগ্য’ (expendable)। কিছু পুরুষ প্রজনন করলেই প্রজাতির টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট, বাকি পুরুষদের প্রয়োজন নেই। এটি ‘ইনসেল’ (Incel) সম্প্রদায়ের মূল দর্শন, যারা নিজেদের ‘অপ্রয়োজনীয়’ ভেবে হতাশায় ডুবে যায় এবং নারী ও সমাজের উপর ক্ষুব্ধ হয়।

নারীবিদ্বেষী প্রচারণার ব্যবহার:

  • নারীদের ‘সহজাত হাইপারগ্যামি’র প্রমাণ: বেইটম্যানের সূত্রকে ব্যবহার করে তারা জোর দিয়ে বলে যে, নারীরা ভালোবাসে না, তারা কেবল ‘আর্থিক সুরক্ষা’ এবং ‘সামাজিক সুবিধা’র জন্য পুরুষদের ব্যবহার করে। এটি নারীদের প্রতি এক গভীর অবিশ্বাস ও ঘৃণা জন্ম দেয়, যেখানে নারীর আবেগ বা ভালোবাসার কোনো স্থান থাকে না।

  • ‘পুরুষদের আত্ম-উন্নতি’র চাপ: যেহেতু নারীরা কেবল উচ্চ মূল্যের পুরুষদের চায়, তাই পুরুষদেরকে ‘আলফা পুরুষ’ (Alpha Male) হতে উৎসাহিত করা হয়, অন্যথায় তারা প্রজননে ব্যর্থ হবে। এর ফলে পুরুষদের উপর এক অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য (mental health) ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের শেখানো হয়, যদি তারা ‘আলফা’ না হতে পারে, তাহলে তারা ভালোবাসার যোগ্য নয়।

  • নারীদের যৌন স্বাধীনতা ও পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব: হাইপারগ্যামির ধারণা নারীদের যৌন স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে। যে নারী একাধিক সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, তাকে ‘নীতিহীন’ (immoral) বা ‘ক্ষতিকর’ (harmful) হিসেবে চিত্রিত করা হয়, এমনকি ‘হো’ (whore) বা ‘স্ল্যাট’ (slut) এর মতো অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করা হয়। এর বিপরীতে, পুরুষদের হতাশা, একাকীত্ব (loneliness) এবং ক্রোধ (anger) এই ধারণাগুলোর দ্বারা আরও উস্কে দেওয়া হয়, যা কখনো কখনো চরম সহিংসতায় রূপান্তরিত হতে পারে (যেমন ইনসেল-সংক্রান্ত আক্রমণ)।

ম্যানোস্ফিয়ারের অপপ্রয়োগের মূল সমস্যা: ম্যানোস্ফিয়ার যখন ব্রিফো বা বেইটম্যানের ধারণা ব্যবহার করে, তখন তারা কিছু মৌলিক ভুল করে:

  • ১. প্রজাতি থেকে মানুষে সরাসরি প্রয়োগ (Direct Application from Species to Humans): ফলের মাছিদের উপর বেইটম্যানের গবেষণা থেকে পাওয়া ফলাফলকে সরাসরি মানুষের উপর প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সম্পর্ক, সংস্কৃতি, শিক্ষা, নৈতিকতা এবং জটিল সামাজিক কাঠামোর কারণে তাদের প্রজননগত আচরণ শুধু জৈবিক চালিকাশক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয় না। মানুষ শুধু জিনগত প্রবণতা দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং তাদের মস্তিষ্কের জটিলতা এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়া তাদের আচরণে ব্যাপক বৈচিত্র্য আনে।
  • ২. সরলীকরণ (Oversimplification): তারা মূল ধারণাগুলোর পেছনের জটিলতা, প্রেক্ষাপট এবং সমালোচনাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। ব্রিফোর সামাজিক ব্যাখ্যাকে বাদ দিয়ে শুধু “নারীই বেছে নেয়” অংশটুকু নেওয়া, বা বেইটম্যানের গবেষণার সীমাবদ্ধতাগুলো এড়িয়ে যাওয়া – এগুলো সবই চরম সরলীকরণ। তারা যেন এক বিশাল চিত্রকর্মের শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ে পুরো ছবিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।
  • ৩. নির্বাচিত প্রমাণ (Cherry-Picking Evidence): তারা কেবল সেই তথ্যগুলোকে গ্রহণ করে যা তাদের পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তে সমর্থন দেয়, এবং বিরোধিতা করা সব তথ্যকে বাতিল করে দেয়। এটি প্রকৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পরিপন্থী। বিজ্ঞান সত্য উদঘাটন করতে চায়, কিন্তু ম্যানোস্ফিয়ার তাদের ‘সত্য’ প্রমাণ করতে চায়।
  • ৪. জৈবিক নিয়তিবাদ (Biological Determinism): তাদের যুক্তিগুলো চরম জৈবিক নিয়তিবাদের (biological determinism) উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা বিশ্বাস করে যে, মানুষের আচরণ সম্পূর্ণরূপে তাদের জিন বা জৈবিক প্রবণতা দ্বারা নির্ধারিত, যা সমাজ বা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। এই ধারণাটি আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞান এবং এমনকি জীববিজ্ঞানও প্রত্যাখ্যান করে। মানুষ জৈবিক সত্তা হলেও, তারা সংস্কৃতি আর শিক্ষার মাধ্যমে তাদের জৈবিক প্রবণতাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
  • ৫. নৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব (Ethical and Social Implications): এই বিকৃত ধারণাগুলো নারীবিদ্বেষ, ঘৃণা, সহিংসতা (violence) এবং পুরুষদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়। তারা পুরুষদেরকে নারীদের বিরুদ্ধে এক ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করতে শেখায়, যেখানে প্রেম, বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক সম্মান (mutual respect) এর কোনো স্থান থাকে না। এর পরিণতি হয় মারাত্মক।

ম্যানোস্ফিয়ারের এই প্রচারণাগুলি মানব সম্পর্কের জটিলতাকে একটি সরল এবং বিপজ্জনক ‘খেলায়’ পরিণত করে, যেখানে এক পক্ষ সবসময় ‘শোষণকারী’ এবং অন্য পক্ষ ‘শোষিত’। এই সরলীকরণ শুধুমাত্র সত্য থেকে দূরে সরে যায় না, বরং সমাজের মধ্যে বিভেদ এবং বিদ্বেষও তৈরি করে। তারা যেন এক অদৃশ্য জাল তৈরি করছে, যা নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে।

এই সব ধারণার সমালোচনা এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি

আমরা দেখেছি ব্রিফোর সূত্র ও বেইটম্যানের প্রিন্সিপল কীভাবে জন্ম নিয়েছে, তাদের মূল কথা কী, এবং তাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়। এরপর দেখলাম ম্যানোস্ফিয়ার কীভাবে এই ধারণাগুলোকে বিকৃত করে নারীবিদ্বেষী প্রচারণায় ব্যবহার করছে। এবার আমরা এই বিকৃতিগুলোর একটি বিস্তারিত সমালোচনা এবং মানব সম্পর্ককে বোঝার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার চেষ্টা করব। মনে রাখতে হবে, মানুষের মন আর তার সম্পর্কগুলো এত সহজ সমীকরণে বাঁধা যায় না।

ম্যানোস্ফিয়ারের ‘বৈজ্ঞানিক’ যুক্তির ভুল ব্যাখ্যা

জৈবিক বনাম সামাজিক বনাম সাংস্কৃতিক (Biological vs. Social vs. Cultural): মানুষের আচরণ শুধুমাত্র জৈবিক প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয় না। আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং শেখা মূল্যবোধ আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেইটম্যানের প্রিন্সিপল যেমন ফলের মাছিদের জৈবিক প্রজনন কৌশল ব্যাখ্যা করে, তেমনি এটি মানুষের জটিল সাংস্কৃতিক আচরণকে সরাসরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। মানব সমাজে প্রজননগত সফলতার সংজ্ঞা কেবল সন্তান জন্মদানে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সন্তান লালন-পালন, শিক্ষাদান এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠায়ও এর গভীরতা আছে। ব্রিফোর কাজ যদিও সমাজের উপর জোর দেয়, কিন্তু তিনি যে প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছেন, তা আজকের আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপট থেকে ভিন্ন। মানুষ তাদের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলে, আর এই মানিয়ে চলার প্রক্রিয়াতে সংস্কৃতি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পিতামাতার বিনিয়োগের জটিলতা (Complexity of Parental Investment): ম্যানোস্ফিয়ার বেইটম্যানের পিতামাতার বিনিয়োগের ধারণাকে অতিরিক্ত সরল করে। তারা কেবল ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উৎপাদনের পার্থক্যের উপর জোর দেয়। কিন্তু মানব সমাজে পুরুষদের পিতামাতার বিনিয়োগ (paternal investment) উল্লেখযোগ্য হতে পারে – যেমন সম্পদ সংগ্রহ, সুরক্ষা প্রদান, শিশুদের জন্য সময় ও শ্রম দেওয়া। এমনকি, অনেক প্রজাতির প্রাণী পুরুষরাও সন্তান পালনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে (Hrdy, 1999)। বেইটম্যানের প্রাথমিক গবেষণায় এই বিষয়গুলো ভালোভাবে ধরা পড়েনি। আধুনিক বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানীরাও স্বীকার করেন যে, পিতামাতার বিনিয়োগ একটি বিস্তৃত ধারণা, যা শুধু শারীরিক উৎপাদন নয়, বরং পরিবেশগত, সামাজিক এবং মানসিক সহায়তার মতো বিষয়গুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে।

নারীর চয়নশীলতা ও বহুমুখীতা (Female Choosiness and Diversity): ম্যানোস্ফিয়ারের দাবি যে নারীরা ‘সহজাত হাইপারগ্যামাস’ এবং কেবল সম্পদ বা সামাজিক মর্যাদার পিছনে ছোটে, এটি নারীদের পছন্দের জটিলতা এবং বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। নারীরা তাদের সঙ্গীর মধ্যে শুধু আর্থিক নিরাপত্তা নয়, ভালোবাসা, মানসিক সমর্থন (emotional support), বুদ্ধিমত্তা, রসবোধ, বিশ্বস্ততা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক (personal compatibility)-এর মতো অনেক গুণ খোঁজেন। ব্যক্তিগত পছন্দ এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট এখানে বিশাল ভূমিকা পালন করে। সব নারীই একই ধরনের পুরুষ খোঁজে না, বা তাদের পছন্দ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। একটি সমাজে যেমন বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকে, তেমনি তাদের পছন্দের ধরনও বিভিন্ন রকম হয়।

পুরুষের ‘অপ্রয়োজনীয়তা’র ভুল ধারণা (The Fallacy of Male Expendability): ‘পুরুষরা অপ্রয়োজনীয়’ – এই ধারণাটি চরম ভ্রান্ত। মানব সমাজে পুরুষদের বহুবিধ ভূমিকা রয়েছে, কেবল প্রজনন নয়। তারা সমাজ গঠন, সংস্কৃতি, শিল্প, বিজ্ঞান, এবং পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই ধারণা পুরুষদের অবদানকে তুচ্ছ করে এবং তাদের মূল্যকে অস্বীকার করে, যা সমাজে বিষাক্ততা ছড়ায়। এটি শুধু নারীদের প্রতি ঘৃণা তৈরি করে না, বরং পুরুষদের নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধ (self-esteem) নষ্ট করে দেয়। একটি সুস্থ সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েরই অপরিহার্য ভূমিকা থাকে।

নৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবের সমালোচনা

নারীবিদ্বেষের প্রসারণ (Promotion of Misogyny): ম্যানোস্ফিয়ারের এই বিকৃত ধারণাগুলো সরাসরি নারীবিদ্বেষকে উস্কে দেয়। নারীদেরকে ‘ম্যানিপুলেটিভ,’ ‘স্বার্থপর,’ ‘প্রতারক’ এবং ‘হাইপারগ্যামাস’ হিসেবে চিত্রিত করার মাধ্যমে পুরুষদের মনে নারীদের প্রতি ঘৃণা এবং অবিশ্বাস জন্ম দেয়। এটি নারী-পুরুষের মধ্যে সুস্থ সম্পর্ক স্থাপনে বাধা দেয়। এই ধরনের প্রচারণা সমাজে বিভেদ তৈরি করে এবং সহানুভূতির বদলে বিদ্বেষ ছড়ায়।

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব (Negative Impact on Mental and Physical Health): ম্যানোস্ফিয়ারের এই চরমপন্থী মতবাদগুলো পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পুরুষদেরকে ‘আলফা’ হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া, অথবা নিজেদের ‘নিম্ন মূল্যের পুরুষ’ হিসেবে দেখতে বাধ্য করা তাদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ (anxiety), রাগ এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়াতে পারে। ইনসেল আন্দোলনের সদস্যরা প্রায়শই বিষণ্ণতা এবং চরম সহিংসতার প্রতি আকৃষ্ট হয়, যা সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ (Ging, 2017)। এই মানসিক চাপ পুরুষদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পারস্পরিক সম্মান ও সমতার অভাব (Lack of Mutual Respect and Equality): এই ধারণাগুলো পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমতা এবং পারস্পরিক সম্মানের পরিবর্তে এক ধরনের ‘যুদ্ধ’ বা ‘প্রতিযোগিতা’র মানসিকতা তৈরি করে। এটি একটি সুস্থ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজের পরিপন্থী। যেখানে সম্পর্কগুলো জয়-পরাজয়ের সমীকরণ হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে প্রকৃত ভালোবাসা বা বোঝাপড়া গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অপব্যবহার (Abuse of Scientific Method): ম্যানোস্ফিয়ার বিজ্ঞানকে তাদের নিজস্ব সংকীর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট মতবাদকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করে। তারা বিজ্ঞানকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, যা শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব অনুমানকে সমর্থন করে, সত্য উদঘাটন করে না। এটি বৈজ্ঞানিক সততা এবং যুক্তিসঙ্গত বিতর্কের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এটি বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি (A Balanced Perspective):

মানব সম্পর্ক খুব জটিল। এটিকে শুধুমাত্র জৈবিক বা শুধুমাত্র সামাজিক সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এটি যেন এক বিশাল মহাকাব্য, যার প্রতিটি চরিত্র আর ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে।

  • জৈবিক প্রবণতা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া (Biological Predispositions and Social Interaction): আমাদের জৈবিক মেকআপ (biological makeup) অবশ্যই আমাদের আচরণে কিছু প্রবণতা সৃষ্টি করে, কিন্তু এই প্রবণতাগুলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে কীভাবে প্রকাশ পাবে, তা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পুরুষের সঙ্গী সংগ্রহের জৈবিক প্রবণতা সামাজিক নিয়মনীতি, নৈতিকতা এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমাদের সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং আইনের দ্বারা আমাদের আচরণ প্রভাবিত হয়, যা কেবল জৈবিক প্রবৃত্তির উপর নির্ভরশীল নয়।

  • ব্যক্তিগত বৈচিত্র্য (Individual Variation): প্রতিটি মানুষই অনন্য। কোনো একটি লিঙ্গের সব সদস্যের আচরণ একই রকম হবে, এমনটা ধরে নেওয়া ভুল। মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ, অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধ এবং ব্যক্তিত্ব তাদের সম্পর্কের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। প্রতিটি মানুষের গল্পের ভিন্নতা থাকে, আর সেই ভিন্নতা তার পছন্দের উপরও প্রভাব ফেলে।

  • অভিযোজনশীলতা এবং পরিবর্তনশীলতা (Adaptability and Changeability): মানব সমাজ এবং সম্পর্ক স্থির থাকে না, বরং সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়। লিঙ্গীয় ভূমিকা, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক প্রত্যাশাগুলো পরিবর্তিত হতে পারে, এবং এর ফলে সম্পর্কগুলোর গতিশীলতাও পরিবর্তিত হয়। আজকের যুগে যেখানে নারী-পুরুষ উভয়েই কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখছে, সেখানে আদিম সমাজের লিঙ্গীয় ভূমিকাগুলো একই রকম থাকার কথা নয়।

  • ফেমিনিজমের ইতিবাচক ভূমিকা (Positive Role of Feminism): ফেমিনিজম নারীদের অধিকার, সমতা এবং সমাজে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে চায়। এটি শুধুমাত্র নারীর ক্ষমতায়ন নয়, বরং পুরুষদেরকেও লিঙ্গীয় স্টেরিওটাইপের বোঝা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। একটি সমতাপূর্ণ সমাজ পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই ভালো, যেখানে উভয়েই তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারে।

  • সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা (Commitment to Truth): বিজ্ঞান সত্য অনুসন্ধানের একটি প্রক্রিয়া। যখন কোনো বৈজ্ঞানিক ধারণাকে বিকৃত করা হয় অথবা তাকে ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়, তখন তা শুধু সত্যকে বিকৃত করে না, বরং সমাজের মধ্যে বিভেদ ও ঘৃণা ছড়ায়। বৈজ্ঞানিক ধারণাকে তার সম্পূর্ণতা, সীমাবদ্ধতা এবং বিতর্ক সহকারে বুঝতে হবে। এটি কেবল তথ্যের বিশুদ্ধতা নয়, বরং একটি সুস্থ সমাজের ভিত্তি।

সম্পর্কের অনন্ত রহস্য এবং সচেতনতার ডাক

মানুষের সম্পর্ক – কী বিচিত্র এই পথ! এর গভীরে ডুব দিতে গেলে মনে হয় যেন এক আদিম অরণ্যের সন্ধান পেয়েছি, যেখানে ভালোবাসা, হিংসা, প্রতিযোগিতা, আর নির্ভরশীলতা একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। রবার্ট স্টিফেন ব্রিফোর নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আর অ্যাঙ্গাস জন বেইটম্যানের জৈবিক বিশ্লেষণ—এই দুটি ধারণা মানব সম্পর্কের এক রহস্যময় দিকের উপর আলো ফেলেছে। একটি দেখিয়েছে সমাজের গভীরে নারীর ঐতিহাসিক ক্ষমতা, অন্যটি দেখিয়েছে প্রজননগত বিনিয়োগের এক বিবর্তনগত দিক। কিন্তু তাদের গভীরতা, তাদের প্রেক্ষাপট এবং তাদের সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে, যখন এই ধারণাগুলোকে বিকৃত করে নারীবিদ্বেষী প্রচারণার হাতিয়ার বানানো হয়, তখন তা কেবল জ্ঞানের অপব্যবহার নয়, বরং মানব সভ্যতার জন্য এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এটি যেন জ্ঞানের এক অন্ধকার দিক, যেখানে সত্যকে বিকৃত করে বিভেদ আর ঘৃণা ছড়ানো হয়।

ম্যানোস্ফিয়ারের মতো অনলাইন সম্প্রদায়গুলো যেভাবে বেইটম্যানের প্রিন্সিপলকে ‘হাইপারগ্যামি’র নামে আর ব্রিফোর সূত্রকে ‘নারী শুধু সুবিধা খোঁজে’ – এই মিথ্যা ধারণার মাধ্যমে নারীকে ‘ভিলেন’ হিসেবে চিত্রিত করছে, তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই প্রচারণার মাধ্যমে পুরুষদের মধ্যে হতাশা, রাগ এবং নারীদের প্রতি ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে, যা সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করছে। আধুনিক সমাজ একটি জটিল জগত। এখানে মানুষের সম্পর্কগুলো কেবল জৈবিক প্রয়োজন বা আদিম প্রতিযোগিতার ফল নয়। এখানে ভালোবাসা আছে, সহানুভূতি আছে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আছে, এবং আছে অসংখ্য ব্যক্তিগত পছন্দ ও সামাজিক প্রেক্ষাপট।

হাজার বছর ধরে মানুষ প্রেম আর সম্পর্কের রহস্যের সমাধান খুঁজেছে। এই খোঁজের পথে অনেক সময় আমরা ভুল পথে হেঁটেছি, সরলীকরণের ফাঁদে পড়েছি। বিজ্ঞান আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, কিন্তু মানব হৃদয়ের সব রহস্য উন্মোচন করতে পারে না। প্রেম, সম্পর্ক, আর পারস্পরিক বোঝাপড়া এক শিল্প, যার প্রতিটি রং আর রেখা ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি আর মানবিকতার স্পর্শে তৈরি হয়। তাই এটিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট সূত্র বা নিয়ম দিয়ে বাঁধা যায় না।

পরিশেষে, মানুষের সম্পর্কগুলোর জটিলতাকে সম্মান করা এবং জ্ঞানকে দায়িত্বশীলতার সাথে ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। যখনই কোনো ধারণাকে অতি সরলীকরণ করে একপেশেভাবে প্রচার করা হয়, তখন আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ, জ্ঞানের আলো যখন বিকৃত হয়, তখন তা আর পথ দেখায় না, বরং ভুল পথে চালিত করে, আর সেই ভুল পথে হাঁটলে শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, সমাজেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এই বোধটুকু যদি আমাদের জাগে, তবেই এই দীর্ঘ লেখার উদ্দেশ্য সার্থক হবে। অন্ধকার পথের পথিক না হয়ে, আলোর পথে হাঁটতে শেখাটাই আসল জ্ঞান।

তথ্যসূত্র

  • Ah-King, M., & Gowaty, P. A. (2016). The Sexual-Selection Convention: The Battle of the Sexes Revisited. Journal of Evolutionary Biology, 29(12), 2419-2432.
  • Bateman, A. J. (1948). Intrasexual selection in Drosophila. Heredity, 2(3), 349-368.
  • Briffault, R. (1927). The Mothers: A Study of the Origins of Sentiments and Institutions. George Allen & Unwin Ltd.
  • Ging, D. (2017). Alphas, Betas, and Incels: Theorizing the Masculinities of the Manosphere. Men and Masculinities, 22(4), 638-657.
  • Gowaty, P. A. (2004). Sexual Natures: How Feminism and Evolutionary Biology Can Benefit Each Other. Signs: Journal of Women in Culture and Society, 29(4), 901-921.
  • Hrdy, S. B. (1999). Mother Nature: Maternal Instincts and the Invention of Human Bondage. Pantheon.
  • Malinowski, B. (1927). Sex and Repression in Savage Society. Routledge.
  • Tang-Martinez, Z., & Lionetti, J. M. (2017). Bateman’s Principles: An Interpretive Review. Journal of Evolutionary Biology, 30(9), 1530-1549.
  • Trivers, R. L. (1972). Parental Investment and Sexual Selection. In B. Campbell (Ed.), Sexual Selection and the Descent of Man, 1871-1971 (pp. 136-179). Aldine.

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.