বাইজান্টাইন-সাসানিয়ান যুদ্ধ ও সাসানীয় গৃহযুদ্ধসমূহ

৪২১-৪২২ সালের রোমান-সাসানীয় যুদ্ধ

৪২১-৪২২ সালের রোমান-সাসানীয় যুদ্ধ ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য এবং সাসানীয়দের মধ্যে একটি সংঘাত। যুদ্ধের কারণ ছিল সাসানীয় রাজা পঞ্চম বাহরাম (Bahram V) কর্তৃক খ্রিস্টানদের উপর নিপীড়ন, যা আবার ছিল জরথুস্ট্রিয়ান মন্দিরগুলির বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের আক্রমণ। সাসানীয় সাম্রাজ্যের এই নিপীড়ণের প্রতিক্রিয়ায় খ্রিস্টান পূর্ব রোমান সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস (Theodosius II) যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং কিছু বিজয় অর্জন করেছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত, উভয় শক্তি পূর্বের স্থিতাবস্থায় একটি শান্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিল।

৪২১ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম বাহরাম তার পিতা প্রথম ইয়াজদেগার্দের (Yazdegerd I) স্থলাভিষিক্ত হন ও ক্ষমতায় এসে তিনি তার শাসনামলে খ্রিস্টানদের দ্বারা জরথুস্ট্রিয়ান মন্দিরের উপর আক্রমণের প্রতিশোধ হিসাবে খ্রিস্টানদের উপর নিপীড়ন শুরু করেছিলেন; বাহরাম এই নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছিলেন, যার ফলে অনেকে মারা গিয়েছিলেন। মৃত খ্রিস্টানদের মধ্যে ছিলেন ইয়াজদেগার্ডের রাজনৈতিক পরামর্শদাতাজেমস ইন্টারসিসাস, যিনি জরথুস্ট্রিয়ান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন কিন্তু পরে খ্রিস্টধর্মে ফিরে এসেছিলেন।

নির্যাতিত খ্রিস্টানরা রোমান অঞ্চলে পালিয়ে যায় এবং কনস্টান্টিনোপলের বিশপ অ্যাটিকাস তাদের স্বাগত জানায়। বিশপ অ্যাটিকাস দ্বিতীয় থিওডোসিয়াসকে সাসানীয় সাম্রাজ্যে খ্রিস্টানদের এই নিপীড়ন সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। উল্লেখ্য, পূর্ব রোমান সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস সেই সময় তার ধর্মীয় বোন পুলচেরিয়া দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং খ্রিস্টধর্মে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।

ইতিমধ্যেই রোমান-সাসানীয় সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব ছিল। পারস্যরা কিছু রোমান স্বর্ণ-খননকারী নিয়োগ করেছিল, কিন্তু এখন তাদের ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেছিল; তদুপরি, সাসানীয়রা রোমান বণিকদের সম্পত্তি দখল করেছিল। এই কারণে, যখন পারস্যের রাষ্ট্রদূতরা পলাতকদের প্রত্যাবর্তনের দাবিতে রোমান রাজসভায় আদালতে পৌঁছেছিলেন, থিওডোসিয়াস তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে শান্তি ভঙ্গ এবং যুদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

রোমান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন আরদাবুর, যিনি ঘটনাক্রমে ইরানী ট্রাইব এলানের লোক ছিলেন। আরদাবুরকে তার অভিযানের জন্য অনেক সৈন্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল। থিওডোসিয়াস তাই তার সাম্রাজ্যের থ্রেসিয়ায় কিছু প্যানোনিয়ান ওস্ট্রোগোথকে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন যারা থ্রেসিয়াকে হানদের হাত থেকে রক্ষা করবে, আর এর ফলে থ্রেসিয়ায় অবস্থান করা রোমান সেনাদেরকে পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাজে লাগানো যাবে।

আরদাবুর আনাতোলিয়াসকে পারসারমেনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন, যেখানে তিনি বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। এদিকে আরদাবুর পারস্য অঞ্চলে প্রবেশ করেছিলেন এবং আরজানিনকে ধ্বংস করেছিলেন। সাসানীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল নারসেস আরদাবুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিযুক্ত হন, তবে তিনি পরাজিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন। নরসেস মেসোপটেমিয়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেন, কারণ প্রদেশটি তখন অরক্ষিত ছিল, তিনি সেখানে চলেও যান, কিন্তু আরদাবুর শত্রুর পরিকল্পনার পূর্বাভাস পান ও নারসেসকে প্রতিহত করেন।

আরদাবুর রিইনফোর্সমেন্ট পান, এবং নিসিবিসের দুর্গটি অবরোধ করেন। বাহরাম আলামুন্দারাসের লখমিদ আরবদের (হীরার প্রথম আল-মুনধির) সাথে মিত্রতা করেছিলেন, যাদেরকে রোমানরা পরাজিত করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে, হানদের রাজা রুয়া, রোমান ডায়োসিস ডাসিয়া এবং থ্রেসিয়ায় আক্রমণ করেছিলেন এবং এমনকি কনস্টান্টিনোপলকে হুমকি দিয়েছিলেন; আবার এই একই সময়ে, একটি বিশাল পারস্য সেনাবাহিনী নিসিবিসের দিকে অগ্রসর হয়। দুটি ফ্রন্টে যুদ্ধ এড়ানোর জন্য থিওডোসিয়াস তখন আরদাবুরকে ডেকে পাঠান।

একটি রোমান ধর্মীয় সূত্র অনুসারে, সাসানীয়রা হাজার হাজার সৈন্য এবং এমনকি সিজ ইঞ্জিন নিয়ে থিওডোসিওপোলিসকে ৩০ দিনের জন্য অবরুদ্ধ করেছিল। এই সূত্র অনুসারে, রোমানরা অবরুদ্ধদের সহায়তা করার চেষ্টা করেনি, তবে সাসানীয়রা অবরোধ তুলে নিতে রাজি হয়েছিল যখন শহরের বিশপ ইউনোমিয়াস, থমাস দ্য অ্যাপোসলের নামে একজন পাথর নিক্ষেপকারীকে দিয়ে সাসানীয় সেনাবাহিনীর একজন ছোট রাজাকে (lesser king) হত্যা করিয়েছিল। এই বিবরণের স্পষ্ট ধর্মীয় থিম সত্ত্বেও, অনুচ্ছেদটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি থিওডোসিওপোলিসের উপর একটি ব্যর্থ সাসানীয় আক্রমণের সাক্ষ্য দেয়। এটি আর্মেনিয়ার থিওডোসিওপোলিস হতে পারে, এবং এই ক্ষেত্রে অবরোধের তারিখ ৪২১ সাল হওয়া উচিত, যখন নারসেস মেসোপটেমিয়ায় ছিলেন, বা অস্রোয়েনের থিওডোসিওপোলিসে ছিলেন, এবং এই ক্ষেত্রে আক্রমণটি নিসিবিস থেকে রোমান বাহিনীর পশ্চাদপসরণের পরে হওয়া উচিত।

যুদ্ধের অবসান ঘটে ৪২২ সালের শান্তি চুক্তির মধ্যে দিয়ে যা নিয়ে আলোচনা করতে আসেন ম্যাজিস্টার অফিসিয়ারিয়াম হেমিও। এই চুক্তি অনুসারে যুদ্ধের আগের পরিস্থিতিতে বা পূর্ববর্তী স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়, মানে দুই পক্ষ যুদ্ধে যা যা অর্জন করেছে বা হারিয়েছে সব বাতিল হয়ে যায়। উভয় পক্ষই অন্য পক্ষের আরব ডিফ্যাক্টর বা দলত্যাগীদের প্রত্যাখ্যান করতে সম্মত হয়েছিল, পাশাপাশি তাদের অঞ্চলে ধর্মের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিতে সম্মত হয়েছিল।

এটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, যুদ্ধের ফলে দাস বাজারে আটকে পড়া ৭,০০০ পারস্য বন্দীদের কেনার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করার জন্য আমিদার বিশপ অ্যাকাসিয়াস তার গির্জার পবিত্র স্বর্ণ এবং রৌপ্য প্লেটটি গলিয়ে দিয়েছিলেন। আর এই পারস্য বন্দিদের মুক্ত করে তিনি এদেরকে পারস্য নিপীড়কদের প্রতি খ্রিস্টান উদারতার ইঙ্গিত হিসাবে তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। গিবন মন্তব্য করেছেন, এই যদি গল্পটি সত্য হয়ে থাকলে এটি সেই সময় শান্তির প্রক্রিয়াটিকে সহজতর করে থাকবে।

৪৪০ সালের রোমান-সাসানীয় যুদ্ধ

৪৪০ সালের পূর্ব রোমান-সাসানীয় যুদ্ধ ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত সংঘাত। ৩৮৭ সালের শান্তি চুক্তির পর থেকে সাসানীয় এবং রোমান সাম্রাজ্য সম্মত হয়েছিল যে তারা উভয়ই যাযাবর আক্রমণের বিরুদ্ধে ককেশাসের প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে। রোমানরা অনিয়মিত বিরতিতে ইরানিদের প্রায় ৫০০ পাউন্ড (২২৬ কেজি) স্বর্ণ প্রদান করে ককেসাসের প্রতিরক্ষায় সহায়তা করেছিল। রোমানরা এই অর্থ প্রদানকে রাজনৈতিক ভর্তুকি হিসাবে দেখলেও পারস্যরা এটিকে শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবেই দেখেছিল, যা নির্দেশ করছিল যে রোম ইরানের অধীনস্ত। রোমান সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস (Theodosius II) এই অর্থ প্রদান অব্যাহত রাখতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, যার ফলে সাসানীয় শাহ দ্বিতীয় ইয়াজদেগার্দ (Yazdegerd II) রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তবে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষ খুব কমই সাফল্য লাভ করে।

যুদ্ধটি সংক্ষিপ্ত ছিল, কেননা দক্ষিণ রোমান প্রদেশগুলি ভ্যান্ডালদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিল, যার ফলে পূর্ব রোমানদের ভান্ডাল আক্রমণের দিকে মনোনিবেশ করার জন্য দ্রুত এই যুদ্ধের সমাপ্তির চেষ্টা করতে হয়। দ্বিতীয় থিওডোসিয়াস সাসানীয়দের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ সমাপ্তির মাধ্যমে শান্তি চেয়েছিলেন। তিনি তার সেনাপতি আনাতোলিয়াসকে ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতীয় ইয়াজদেগার্ডের শিবিরে প্রেরণ করেছিলেন। ৪৪০ সালে পরবর্তী আলোচনায় উভয় সাম্রাজ্য মেসোপটেমিয়ায় কোনও নতুন দুর্গ নির্মাণ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সাসানীয় সাম্রাজ্য ককেশাসকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কিছু অর্থ পাবার প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিল।

অ্যানাস্টেসিয়ান যুদ্ধ (৫০২-৫০৬ খ্রি.)

৫০২ থেকে ৫০৬ সাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে অ্যানাস্টেসিয়ান যুদ্ধ (Anastasian War) সংঘটিত হয়। ৪৪০ সালের পর এটি ছিল দুই শক্তির মধ্যে প্রথম বড় ধরনের সংঘাত, এবং এই যুদ্ধের পর পরবর্তী শতাব্দীতে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে ধ্বংসাত্মক দ্বন্দ্বের একটি দীর্ঘ সিরিজের সূচনা ঘটে।

বেশ কয়েকটি কারণে পূর্ব রোমান এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যকার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শান্তির অবসান ঘটে। হেফথালীয়দের কাছে পারস্যের রাজা প্রথম কাভাদের ঋণ ছিল, কেননা হেফথালীয়রা ৪৯৮/৪৯৯ সালে প্রথম কাভাদকে তার সিংহাসন ফিরে পেতে সহায়তা করেছিল। এদিকে লোয়ার মেসোপটেমিয়ায় টাইগ্রিসের প্রবাহের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের কারণে দুর্ভিক্ষ এবং বন্যার সৃষ্টি হয়। তাতে পরিস্থিতি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় প্রথম কাভাদ রোমান সম্রাট বা বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথম অ্যানাস্টেসিয়াসের কাছে আর্থিক সহায়তা চান, কিন্তু অ্যানাস্টেসিয়াস তাকে কোন রকম সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তখন কাভাদ জোর করে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেন।

৫০২ সালে কাভাদ প্রথম সেনাভিযান প্রেরণ করেন। কাভাদ দ্রুত থিওডোসিওপলিসের অপ্রস্তুত শহরটি দখল করে নেন। সম্ভবত স্থানীয় সহায়তার দ্বারাই তিনি এটি দখল করেছিলেন। শহরটি সেনাদের দ্বারা অরক্ষিত ছিল এবং দুর্বলভাবে দুর্গকৃত বা ফর্টিফাইড ছিল। একই বছরে মার্টারোপোলিসেরও পতন ঘটে। এরপর ৫০২-৫০৩ সালের শরৎ ও শীতকালব্যাপী সময়ে কাভাদ দুর্গ-শহর আমিদা অবরোধ করেন এবং দীর্ঘ অবরোধের পরে এটি দখল করে নেন, এর একটা কারণ ছিল সেই নগরটির রক্ষকরা বাইজান্টাইন সৈন্যদের দ্বারা সহায়তা পায়নি। অনেক লোক, বিশেষ করে আমিদার জনগণকে পারস্যের ফার্স ও খুজিস্তানে পাঠানো হয়, এদেরকে কাভাদের নতুন প্রতিষ্ঠিত নগর ভেহ-আজ-আমিদ কাভাদে (আরাজান) পাঠানো হয়।

বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম অ্যানাস্টেসিয়াস ৫০৩ সালের মে মাসে সাসানীয়দের বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। জুলিয়ানের পারস্য আক্রমণের পর এই সেনাবাহিনীই ছিল প্রাচ্যের বৃহত্তম রোমান বাহিনী। এই সেনাবাহিনী এডেসা এবং সামোসাটায় সমবেত হয়েছিল। এই সেনাবাহিনীর তিনটি ডিভিশন ছিল যা একেকজন ম্যাজিস্টার মিলিটামের অধীনে ছিল। এই তিন ম্যাজিস্টার মিলিটাম বা জেনারেল ছিলেন ওরিয়েন্টেম আরিওবিন্ডাস, স্ট্র্যাটেজিগোস প্যাট্রিসিয়াস এবং হাইপেটিয়াস। হাইপেটিয়াস এবং প্যাট্রিসিয়াস আমিদা আক্রমণ করেছিলেন, তখন গ্লোনেসের অধীনে আমিদা ৩,০০০ সেনার শক্তিশালী গ্যারিসন দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। রোমানাস এবং আরব ফাইলার্ক আসুয়াডেসকে (আসওয়াদ) (সম্ভবত একটি কিন্দা নেতা) সাথে নিয়ে এরিওবিন্দাস নিসিবিসকে আক্রমণ করেন, যেখানে প্রথম কাভাদ বাস করছিলেন। প্রোকোপিয়াস সেলারকে চতুর্থ কমান্ডার হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই বাহিনীর সাথে যুক্ত উল্লেখযোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন “হাইপার্ক” প্রথম এপিয়ন (মিশরীয়), জাস্টিন (ভবিষ্যতের সম্রাট), প্যাট্রিসিওলাস এবং তার পুত্র ভিটালিয়ান (যিনি পরে অ্যানাস্টেসিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন), কলচিয়ান ফেরেসমানেস এবং গথ গোডিডিস্কলাস এবং বেসাস।

প্রাথমিকভাবে, নিসিবিসে আরিওবিন্দাস সাফল্য অর্জন করেন, কিন্তু কাভাদের প্রতিআক্রমণ তাকে পরাজিত করে, তার দুর্গ আপাদনাকে লুণ্ঠন করে, এবং ছিল এবং তাকে পশ্চিমদিকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করে। হাইপেটিয়াস এবং প্যাট্রিসিয়াস তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তারা আরিওবিন্দাসের সাথে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং আপাদনা এবং তেল বেশমের মধ্যে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে সামোসাতার দিকে ফিরে গিয়েছিলেন। জাকারিয়াসের মতে, পশ্চাদপসরণকালে তাদের অশ্বারোহীবাহিনী পাহাড়ের চূড়া থেকে পড়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। কাভাদ পশ্চিমদিকে কনস্ট্যান্টিয়া পর্যন্ত অগ্রসর হন, কিন্তু এটি দখল করতে ব্যর্থ হন, যদিও তিনি সেখানকার অধিবাসীদের কাছ থেকে রসদ গ্রহণ করেছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে, কাভাদ এডেসার কাছে পৌঁছেছিলেন। আরিওবিন্দাস প্রথম কাভাদের সাথে শান্তির বিনিময়ে ১০,০০০ পাউন্ড (৪,৫০০ কেজি) স্বর্ণের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। সাসানীয় এবং লাখমিদরা ওসরোয়েনের বেশিরভাগ অংশ দখল করে নিয়েছিল তবে দুর্গযুক্ত শহরটি আক্রমণ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এদিকে, ফারেসমানেসের অধীনে বাইজেন্টাইন বাহিনী আমিদাকে আক্রমণ করে, এবং ফারেসমানেস সাসানীয় কমান্ডার গ্লোনেসকে চতুরতার সাহায্যে হত্যা করেন। এর মধ্যে বাইজান্টাইন সেনাবাহিনীতে রিইনফোর্সমেন্ট চলে আসে, আর প্রথম কাভাদ সাপ্লাই এর অভাবে পড়েন। এই সমস্যাগুলো তো ছিলই, তার ওপর হূণরা পারস্যকে আক্রমণ করে বসে। এসব কারণে প্রথম কাভাদ তার সেনাবাহিনীকে পারস্যে ফিরিয়ে নেন। আর এটি এডেসাকে অভেদ্য নগরের সম্মান এনে দেয়। এই সময়ে ওসরোয়েনের ডাক্স টিমোস্ট্র্যাটাস লাখমিদদের পরাজিত করেন, এবং থ্যালাবাইট বা বাইজান্টাইন আরবগণ লাখমিদ রাজধানী আল-হিরা আক্রমণ করে।

৫০৩ সালের গ্রীষ্মে, অ্যানাস্টেসিয়াস ম্যাজিস্টার অফিসিওরাম সেলারের অধীনে রিইনফোর্সমেন্ট প্রেরণ করেন এবং মেসোপটেমিয়া এবং ওসরোয়েন থেকে কর বাতিল করেন। অন্যদিকে হাইপেটিয়াস এবং আপিয়নকে প্রত্যাহার করা হয়। প্যাট্রিসিয়াস আমিদাতে চলে যান, তার বিরুদ্ধে প্রেরিত একটি সাসানীয় সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং শহরটি অবরোধ করেন; সেলার পরে ৫০৪ সালের বসন্তে তার সাথে যোগ দেন। একদিকে সেলার বেথ আরাবিয়েতে অভিযান চালান, অন্যদিকে অ্যারিওবিন্ডাস আরজানেনে অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময়ে সাসানীয়দের পক্ষে যুদ্ধ করা বিদ্রোহী কনস্ট্যান্টাইন, একটি নির্দিষ্ট আরব প্রধান আদিদ এবং আর্মেনিয়ান মুশলেক তাদের পক্ষ ত্যাগ করে বাইজান্টাইনদের পক্ষে যোগ দিলে সাসানীয় দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে যায়। বাইজেন্টাইনরা শেষ পর্যন্ত আমিদাকে দখল করে ফেলে।

একই বছরে, ককেশাস থেকে হূণরা আর্মেনিয়ায় আক্রমণ করলে দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু রোমানরা বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহে ৫০৬ সালে পারস্যের কর্মকর্তাদের আটক করে। মুক্তি পাবার পর পারস্যের কর্মকর্তাগণ নিসিবিসে ফিরে যান। অবশেষে ৫০৬ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়, তবে চুক্তির শর্তগুলি কী ছিল সে সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। প্রোকোপিয়াস বলেছেন যে উভয় পক্ষ সাত বছরের জন্য শান্তি সম্মত হয়েছিল এবং সম্ভবত পারস্যদের কিছু অর্থ প্রদান করা হয়েছিল। পার্সিয়ানরা কোন বাইজেন্টাইন অঞ্চল রাখেনি এবং কোনও বার্ষিক নজরানা নিবেদন করা হয়নি, তাই মনে হয় শান্তি চুক্তিটি বাইজেন্টাইনদের উপর কঠোর ছিল না।

রোমান জেনারেলরা এই যুদ্ধে তাদের অনেক অসুবিধার জন্য দায়ী করেছিলেন সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায় একটি প্রধান ঘাঁটির অভাকে। পারস্যের জন্য সীমান্তের কাছে ছিল নিসিবিস, কিন্তু বাইজান্টাইনদের সীমান্তের কাছে এমন কোন ঘাটি ছিলনা। (উল্লেখ্য ৩৬৩ সালের পূর্বে নিসিবিস রোমানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল আর এটাই ছিল রোমানদের জন্য সীমান্তের কাছে থাকে সেনাঘাটি, কিন্তু ৩৬৩ সালে পারস্যরা সেটা দখল করে নেয়)। এজন্য ৫০৫ সালে অ্যানাস্টেসিয়াস বাইজান্টাইনদের অধীনস্ত সীমান্তের নিকটের অঞ্চল দারায় একটি বিশাল দুর্গ নগর দারা নির্মাণের আদেশ দেন। এডেসা, ব্যাটনি ও আমিদায় যে জরাজীর্ণ দুর্গগুলো ছিল সেগুলোরও নবায়ন করা হয়।

যদিও অ্যানাস্টেসিয়াসের শাসনামলে আর কোনও বড় আকারের সংঘাত ঘটেনি, তবে উত্তেজনা অব্যাহত ছিল, বিশেষত যখন দারাতে কাজ অব্যাহত ছিল। এই নির্মাণ প্রকল্পটি রোমান প্রতিরক্ষার একটি মূল উপাদান হয়ে ওঠে, এবং পার্সিয়ানদের সাথে সংঘাতের একটি স্থায়ী উৎস হয়ে ওঠে, যারা অভিযোগ করেছিল যে এর নির্মাণটি তাদের ৪২২ সালের সম্মত চুক্তিটি লঙ্ঘন করেছে, যে চুক্তিতে উভয় সাম্রাজ্য সীমান্ত অঞ্চলে নতুন দুর্গ স্থাপন না করতে সম্মত হয়েছিল। তবে অ্যানাস্টেসিয়াস এই নির্মাণকার্যটি অব্যাহত রাখেন, এবং অর্থ দিয়ে প্রথম কাভাদকে সন্তুষ্ট রেখেছিলেন। পার্সিয়ানরা এই কাজটি বন্ধ করতে অক্ষম হয় এবং প্রাচীরগুলোর কাজ ৫০৭/৫০৮ সালের মধ্যে সম্পন্ন করা হয়।

আইবেরীয় যুদ্ধ (৫২৬-৫৩২ খ্রি.)

আইবেরিয়ান যুদ্ধ ৫২৬ থেকে ৫৩২ সাল পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে পূর্ব জর্জিয়ান রাজ্য আইবেরিয়া নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল। আইবেরিয়া ছিল একটি সাসানীয় ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র যা বাইজেন্টাইনদের পক্ষে চলে গিয়েছিল। নজরানা নিবেদন এবং মসলা বাণিজ্য নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে দ্বন্দ্বটি ছড়িয়ে পড়ে। সাসানীয়রা ৫৩০ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থান ধরে রেখেছিল কিন্তু বাইজেন্টাইনরা দারা ও সাটালার যুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধার করেছিল এবং তাদের ঘাসানিদ মিত্ররা সাসানীয়-পক্ষের লখমিদদের পরাজিত করেছিল। ৫৩১ সালে ক্যালিনিকুমে সাসানীয়রা একটি বিজয় লাভ করে, এর ফলে যুদ্ধ শেষ না হয়ে চলতেই থাকে, আর ৫৩২ সালে উভয় সাম্রাজ্য “চিরস্থায়ী শান্তি” বা “Perpetual Peace” নামক শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করলে যুদ্ধ সমাপ্ত হয়।

অ্যানাস্টেসিয়ান যুদ্ধের পরে উভয় সাম্রাজ্য একটি সাত বছরের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। তবে সাম্রাজ্য দুটোর মধ্যে শান্তি প্রায় বিশ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এমনকি ৫০৫ সালে যুদ্ধের সময়ও সম্রাট প্রথম অ্যানাস্টেসিয়াস ইতিমধ্যে পারস্যের দুর্গ শহর নিসিবিসের বিপরীতে তাদের নিজেদের অঞ্চলে দারাকে শক্তিশালী করা শুরু করেছিলেন। ৫২৪-৫২৫ খ্রিস্টাব্দে সাসানীয় সম্রাট প্রথম কাভাদ (৪৮৮-৫৩১) প্রস্তাব করেন যে, সম্রাট প্রথম জাস্টিন তার পুত্র প্রথম খসরুকে দত্তক নেবেন; পারস্যের রাজার অগ্রাধিকার ছিল খসরুর উত্তরাধিকার সুরক্ষিত করা, যার অবস্থান তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাই এবং মাজদাকীয় সম্প্রদায় দ্বারা হুমকির মুখে পড়েছিল। এই প্রস্তাবটি প্রথমে রোমান সম্রাট এবং তার ভাগ্নে জাস্টিনিয়ান উৎসাহের সাথে স্বাগত জানান। কিন্তু জাস্টিনের কোয়াস্টার, প্রোকুলাস, এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন। আলোচনা ভেস্তে যাওয়া সত্ত্বেও, ৫৩০ সালের আগ পর্যন্ত প্রধান পূর্ব সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হয়নি। এর আগে উভয় পক্ষ প্রক্সির মাধ্যমেই যুদ্ধ করছিল। তারা দক্ষিণে আরব মিত্রদের মাধ্যমে এবং উত্তরে হূণদের মাধ্যমে যুদ্ধ করছিল। আইবেরিয়ান রাজা গৌরগেনের রোমানদের পক্ষে চলে যাওয়ার ফলে দুই শক্তির মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। প্রোকোপিয়াসের মতে, প্রথম কাভাদ খ্রিস্টান আইবেরিয়ানদের জোরাস্ট্রিয়ান হতে বাধ্য করার চেষ্টা করেছিলেন। এর ফলে খ্রিস্টান আইবেরিয়ানরা প্রতিবেশী খ্রিস্টান রাজ্য লাজিকার উদাহরণ অনুসরণ করে ৫২৪-৫২৫ সালে গৌরগেনের নেতৃত্বে পারস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গৌরগেন প্রথম জাস্টিনের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন যে তিনি আইবেরিয়াকে রক্ষা করবেন; রোমানরা আইবেরিয়ানদের সহায়তা করার জন্য ককেশাসের উত্তর থেকে হূণদের নিয়োগ করেছিল।

দুই সাম্রাজ্যের শক্তি যেখানে যেখানে মিলিত হয় সেখানে সেখানে বিভিন্ন সময়ে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়। ৫২৫ সালে একটি রোমান নৌবহর হিমিয়ারাইট ইয়েমেন জয় করার জন্য একটি আকসুমাইট সেনাবাহিনী বহন করে এবং ৫২৫-৫২৬ সালে পারস্যের আরব মিত্র, লখমিদরা মরুভূমির প্রান্তে রোমান অঞ্চলগুলিতে অভিযান চালায়। রোমানরা ইয়েমেনে খ্রিস্টানদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহী ছিল, পাশাপাশি পারস্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভারতের মসলা ও রেশম বাণিজ্যপথগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করতেও রোমানরা আগ্রহী ছিল। ৫২৬-৫২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ট্রান্সককেসাস অঞ্চল এবং আপার মেসোপটেমিয়ায় দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়; পার্সিয়ানরা তাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের জন্য রোমানদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। ৫২৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট প্রথম জাস্টিনের মৃত্যুর পর প্রথম জাস্টিনিয়ান রোমান সাম্রাজ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। যুদ্ধের প্রথম দিকের বছরগুলি পার্সিয়ানদের পক্ষে ছিল, ৫২৭ সালের মধ্যে আইবেরিয়ান বিদ্রোহ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, সেই বছর নিসিবিস এবং থেবেথার বিরুদ্ধে একটি রোমান আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছিল এবং থান্নুরিস এবং মেলাবাসাকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্ঠায় থাকা সেনাবাহিনীগুলো পারস্যের আক্রমণ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়।

৫২৮ খ্রিস্টাব্দে পারস্যরা আইবেরিয়া থেকে পূর্ব লাজিকার দুর্গ দখল করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। পারস্যের এই সাফল্যগুলি দ্বারা তাদের প্রকাশিত ঘাটতিগুলোর প্রতিকার করার চেষ্টা করে। জাস্টিনিয়ান পূর্বের ম্যাজিস্টার মিলিটামের কমান্ডকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন এবং উত্তর অংশের উপর আর্মেনিয়ার একটি পৃথক ম্যাজিস্টার মিলিটাম নিয়োগ করে পূর্ব সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। ৫২৮ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ রণাঙ্গনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোমান উদ্যোগ ছিল বেলিসারিয়াসের থান্নুরিসে অভিযান, যেখানে তিনি রোমান শ্রমিকদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন ও সীমান্তে একটি দুর্গ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। থান্নুরিসের যুদ্ধের সময় তার বাহিনী জেরক্সের কাছে পরাজিত হয় এবং তাকে দারায় পশ্চাদপসরণ করতে হয়।

৫২৯ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের আরব মিত্র লখমিদরা সিরিয়ায় একটি ক্ষতিকারক অভিযান পরিচালনা করে। এটি জাস্টিনিয়ানকে তার নিজের আরব মিত্রদের শক্তিশালী করতে উৎসাহিত করে। তিনি তার পক্ষের আরব শক্তি ঘাসানিদ নেতা আল-হারিত ইবনে জাবালাহ এর ঘাসানিদ রাজ্যকে একটি সুসংগত রাজ্যে পরিণত করতে সহায়তা করে যা পরবর্তী দশকগুলিতে লখমিদের বিরুদ্ধে উচ্চতর প্রভাব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। ৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বেলিসারিয়াস দারার যুদ্ধে পেরুজেসের অধীনে একটি বৃহত্তর পারস্য বাহিনীর উপর রোমানদের বিজয়ে নেতৃত্ব দেন, যখন সিট্টাস এবং ডরোথিয়াস সাটালার যুদ্ধে মিহর-মিহরোর অধীনে একটি পার্সিয়ান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। ৫৩১ খ্রিস্টাব্দে বেলিসারিয়াস ক্যালিনিকুমের যুদ্ধে পারস্য ও লখমিদ বাহিনীর কাছে পরাজিত হন, কিন্তু গ্রীষ্মকালে রোমানরা আর্মেনিয়ার কিছু দুর্গ দখল করে নেয় এবং পারস্য আক্রমণ প্রতিহত করে। ক্যালিনিকামে রোমান ব্যর্থতার পরে একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল, যার ফলস্বরূপ বেলিসারিয়াসকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ক্যালিনিকুমে পার্সিয়ানদের কমান্ডার আজারেথেসকেও কোনও উল্লেখযোগ্য দুর্গ দখল করতে ব্যর্থতার কারণে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

চিরস্থায়ী শান্তি (৫৩২-৫৪০ খ্রি.)

পূর্ব রোমান (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্য এবং সাসানীয় পারস্যের মধ্যে ৫৩২ সালে স্বাক্ষরিত চিরস্থায়ী শান্তি (Perpetual Peace) ছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য একটি শান্তি চুক্তি, যা দুই শক্তির মধ্যে আইবেরিয়ান যুদ্ধের (৫২৭-৫৩১) সমাপ্তি ঘটায়। এটি অপেক্ষাকৃত আন্তরিক সম্পর্কের একটি সময়ের সূচনা করেছিল, তবে এটি কেবল ৫৪০ সাল পর্যন্তই তা স্থায়ী হয়েছিল, কেননা ৫৪০ সালে লাজিকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই সাম্রাজ্যের শত্রুতা পুনরায় শুরু হয়েছিল।

৫২৪/৫ সালে পারস্যদের বিরুদ্ধে আইবেরিয়ানদের অভ্যুত্থানের দ্বারা প্ররোচিত হওয়া আইবেরিয়ান যুদ্ধ মূলত একটি সিদ্ধান্তহীনতায় পরিণত হয়েছিল। পার্সিয়ানরা দ্রুত বিদ্রোহকে চূর্ণ বিচূর্ণ করেছিল, কিন্তু তারা লাজিকায় স্ক্যান্ডা এবং সারাপানি নামে দুটি দুর্গ ব্যাতীত বাইজেন্টাইন অঞ্চলে কোনও লাভ করতে পারেনি। ৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে দারা ও সাদালায় পারসিয়ানদের উপর দুটি বড় পরাজয়ের জন্য বাইজেন্টাইনরা তাদের কিছু প্রারম্ভিক ব্যর্থতাকে পুনরুদ্ধার করেছিল। পরবর্তী সময়ে তারা পারসারমেনিয়ার বোলাম এবং ফারাঙ্গামের দুটি সীমান্ত দুর্গ দখল করে, কিন্তু ৫৩১ সালে ক্যালিনিকুমে তারা পরাজিত হয়। এই দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং আলোচনার সময়গুলিও চলছিল, তবে এর ফলে কোনও সুনির্দিষ্ট ফলাফল পাওয়া যায়নি।

জাস্টিনিয়ানের দূত, হার্মোজিনস, ক্যালিনিকুমের যুদ্ধের অব্যবহিত পরে কাভাদের সাথে সাক্ষাত করেন এবং পুনরায় আলোচনা শুরু করেন, কিন্তু তা সফল হননি। জাস্টিনিয়ান রোমান অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, একই সাথে কাভাদকে কূটনৈতিকভাবে জড়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। জাস্টিনিয়ান পারস্যদের বিরুদ্ধে ইথিওপিয়ার অ্যাক্সুমাইট এবং ইয়েমেনের হিমারাইটদের সাথে জোট করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তার জোট প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছিল। পার্সিয়ানরা মার্টারোপোলিসের অবরোধ পরিচালনা করেছিল কিন্তু কাভাদের শীঘ্রই মারা যাওয়ার সাথে সাথে এটি পরিত্যাক্ত হয়েছিল এবং ৫৩২ সালের বসন্তে, রোমান দূত এবং নতুন পারস্য রাজা প্রথম খসরুর মধ্যে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছিল, যিনি তখন প্রধানত সিংহাসনে নিজের অবস্থান সুরক্ষিত করায় মনোযোগী ছিলেন।

৫৩১ সালের শেষের দিকে পারস্যের সম্রাট প্রথম কাভাদের (৪৮৮-৫৩১) মৃত্যুর সাথে সাথে, এবং তার তৃতীয় পুত্র প্রথম খোসরুর (রা. ৫৩১-৫৭৯) রাজ্যাভিষেকের সাথে সাথে এই পরিস্থিতির পরিবর্তিত হয়। সিংহাসনে খোসরুর অবস্থান অনিরাপদ ছিল। আর বাইজেন্টাইন সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান (রা. ৫২৭-৫৬৫) সম্ভবত পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে রোমান সাম্রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া পশ্চিমার্ধ অর্থাৎ এককালের পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলোকে পুনরুদ্ধারের দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন। বাইজেন্টাইন দূত রুফিনাস, হার্মোজিনস, আলেকজান্ডার এবং টমাস আবিষ্কার করেন খসরু তার পিতার চেয়েও অধিকতর সহানুভূতিশীল স্বভাবের। তারা শীঘ্রই একটি শান্তিচুক্তিতে উপনীত হন। এভাবে ৫৩২ সালের সেপ্টেম্বরে আট বছরেরও কম সময় ধরে চলা শাশ্বত বা চিরস্থায়ী শান্তি (Perpetual Peace) নামক শান্তিচুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তির শর্ত ছিল, আপাতদৃষ্টিতে ককেশাস গিরিপথের বাইরে বসবাসকারী বর্বরদের বিরুদ্ধে এর প্রতিরক্ষায় অবদান হিসেবে জাস্টিনিয়ান এককালীন ১১০ সেন্টারিয়া (১১,০০০ পাউন্ড) স্বর্ণ প্রদান করবেন, এবং ডুক্স মেসোপটেমিয়ার সেনাঘাঁটিটিকে দারার দুর্গ থেকে কনস্ট্যান্টিনা শহরে প্রত্যাহার করতে হবে, দুই শাসক আবারও একে অপরকে সমান হিসাবে স্বীকৃতি দেবে এবং পারস্পরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেবে। খসরু প্রাথমিকভাবে দুটি লাজিক দুর্গ ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করেছিলেন, আর বাইজেন্টাইনরা পারস্যের আর্মেনিয়ায় দখল করা আরও দুটি দুর্গ ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন। জাস্টিনিয়ান প্রথমে রাজি হন, কিন্তু শীঘ্রই তার মন পরিবর্তন করেন, যার ফলে চুক্তিটি ভেঙে যায়। তবে, ৫৩২ সালের গ্রীষ্মে, হার্মোজিনস এবং রুফিনাসের একটি নতুন দূতাবাস দখলকৃত দুর্গগুলির সম্পূর্ণ বিনিময়ের জন্য খসরুকে প্ররোচিত করতে সক্ষম হয়েছিল, সেইসাথে নির্বাসিত আইবেরিয়ান বিদ্রোহীদের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে থাকার বা তাদের বাড়িতে নির্বিঘ্নে ফিরে যাবার সুযোগ প্রদান করে।

পরবর্তী কয়েক বছর মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই মহান শক্তির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ এবং সহযোগিতা বজায় ছিল। তবে সেই সময়ে জাস্টিনিয়ান তার শক্তি এবং সম্পদগুলোকে ভান্ডালদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং গথদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে ইতালিকে পুনর্দখল করার কাজে লাগান। এর ফলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রাচ্য অঞ্চলের প্রতিরক্ষার ব্যাপারটি উপেক্ষিত থেকে গিয়েছিল। এটি খসরুর জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আসে। যিনি গথিক দূতদের অনুরোধ এবং তার ক্ষয়প্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে লুঠের দ্বারা পূরণ করার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, ফলে ৫৪০ সালের গ্রীষ্মে তিনি একটি নতুন যুদ্ধ শুরু করেন।

লাজিক যুদ্ধ (৫৪১-৫৬২ খ্রি.)

লাজিক যুদ্ধ (Lazic War) বা কোলচিডিয়ান যুদ্ধ (Colchidian War) বা এগ্রিসির মহাযুদ্ধ (Great War of Egrisi) ছিল লাজিকা (Lazica) নামক প্রাচীন জর্জিয়ান অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ, যা ৫৪১ থেকে ৫৬২ সাল পর্যন্ত বিশ বছর ব্যাপী চলেছিল। এই যুদ্ধে পারস্য জয় লাভ করে এবং বার্ষিক নজরানার বিনিময়ে তারা এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। প্রোকপিয়াস অফ ক্যাসারিয়া (Procopius of Caesarea) এবং অ্যাগাথিয়াসের (Agathias) রচনায় এই যুদ্ধ নিয়ে বিস্তারিত বর্ণিত রয়েছে।

লাজিকা কৃষ্ণ সাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি যার দখলে যাবে ককেশাস এবং কাস্পিয়ান সাগর জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথ নিয়ন্ত্রণও তার হাতে থাকবে। তাই উভয় সাম্রাজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত গুরুত্ব ছিল। বাইজেন্টাইনদের জন্য এটি ছিল পারস্যদের আইবেরিয়া থেকে কৃষ্ণসাগরের উপকূলে পৌঁছবার ক্ষেত্রে পারস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় এমন একটি বাধা। আর পারস্যদের জন্য এটা ছিল এমন একটা অঞ্চল যা তারা দখল করতে পারলে সমুদ্রের স্পর্শও পাবে আবার তাদের শক্ত দখলে থাকা আইবেরিয়াকে বাইজান্টাইনদের হাত থেকে নিরাপদ রাখতে পারবে।

পার্সিয়ান সাসানীয়রা ৫৩২ সালের “শাশ্বত শান্তি” চুক্তির (“Eternal Peace” Treaty) মাধ্যমে রোমান/বাইজেন্টাইন প্রভাবের ক্ষেত্রের অংশ হিসাবে লাজিকাকে (এগ্রিসি) স্বীকৃতি দেয়। সেই সময়ে বাইজেন্টাইনরাজ সেই অঞ্চলের স্থানীয় রাজতন্ত্রের উপর তাদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য সেই অঞ্চলের রাজা প্রথম জ্যাথকে (Tzath I) ধর্মান্তরিত করার উপর জোর দিচ্ছিলেন। তিনি ৫২২/৩ সালে সম্রাট প্রথম জাস্টিন (জাস্টিনিয়ানের পূর্বসূরি) থেকে কনস্টান্টিনোপলে বাপ্টিজম বা অভিসিঞ্চন এবং রাজকীয় স্বীকৃতি উভয়ই লাভ করেন। বাইজেন্টাইন গ্যারিসনগুলি লাজিকা এবং পার্শ্ববর্তী আবাসজিয়ায় অবস্থিত ছিল, বেশিরভাগই উপকূলীয় শহর পোটি, সেবাস্তোপলিস এবং পিটিউসে অবস্থিত ছিল। বাইজান্টাইনরা সেই রাজ্যের রাজধানী আর্কিওপলিসকে সুরক্ষিত করেছিল, সেইসাথে পেত্রার (বর্তমানে সিখিসদজিরি, বাতুমির উত্তরে) উপকূলীয় রাস্তার মাধ্যমে রাজ্যে দক্ষিণের প্রবেশপথকেও সুরক্ষিত করেছিল। তবে, ৫৩৬ সালে বাইজেন্টাইন উপস্থিতির কারণে অঞ্চলটি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের একটি পূর্ণ প্রোটেক্টরেটে পরিণত হয়, যেখানে এই অঞ্চলের রাজা সেখানকার নতুন বাইজান্টাইন ম্যাজিস্টার মিলিটাম পার আর্মেনিয়াম জন জিবাস টিজিবাসের (Armeniam John Tzibus) কাছে অনেক ক্ষমতাই হারান। জিবাস বাইজেন্টাইন স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য লাজিক ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের স্বাধীনতা হ্রাস করেন। এর ফলে তখন গণবিক্ষোভের সূচনা ঘটে, এবং ৫৪১ সালে একটি পূর্নমাত্রার বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এটি সেখানকার রাজা দ্বিতীয় গুবাজেসকে (Gubazes II) দুর্বল করে দেয়, এবং তিনি গোপনে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে পারস্যের সহায়তা কামনা করেন।

সেই বছর পারস্যের রাজা প্রথম খসরু লাজিকায় প্রবেশ করেছিলেন। তিনি পেত্রার প্রধান বাইজেন্টাইন দুর্গ দখল করেছিলেন এবং লাজিকের উপর আরেকটি প্রোটেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে পরের বছর কমাজেন (Commagene) তার উপর আক্রমণ করলে তিনি পারস্যে ফিরে আসেন। ৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে আর্মেনিয়ার একটি রোমান আগ্রাসন অ্যাংলনে একটি ছোট পারস্য বাহিনীর দ্বারা পরাজিত হয়, এবং প্রথম খসরু এক বছর পরে মেসোপটেমিয়ায় এডেসা অবরোধ করে ব্যর্থ হয়। ৫৪৫ সালে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

লাজিকায় প্রথম খসরু সরাসরি পারস্যের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন এবং জরথুস্ট্রীয় যাজকদের মিশনারি উদ্যোগ শীঘ্রই খ্রিস্টান লাজিকার মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। এর ফলে রাজা দ্বিতীয় গুবেজেস (Gubazes II) ৫৪৮ সালে পারস্যদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছিলেন এবং অ্যালান এবং সাবিরদের (Sabirs) সাথে একটি জোট তৈরি করেছিলেন। জাস্টিনিয়ান গুবাগেজেসকে সহায়তা করার জন্য ডাগিস্থিয়াসের অধীনে ৭,০০০ রোমান এবং ১,০০০ জানি (Tzani) (লাজদের (Lazs) আত্মীয়) সহকারীদের পাঠিয়েছিলেন এবং পেট্রা দুর্গটি অবরুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু তাদের থেকে দুর্গটির সৈন্যের সংখ্যা বেশি ছিল এবং এরা কঠোরভাবে তাদের প্রতিহত করে। মিহর-মিহরোর (Mihr-Mihroe) অধীনে পারস্যের রিইনফোর্সমেন্ট বাহিনী গিরিপথগুলো পাহারা দেওয়া একটি ছোট বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করে এবং তারপরে অবরুদ্ধ পেত্রাকে মুক্ত করে। মিহর-মিহরো দুর্গে ৩,০০০ লোককে নিযুক্ত করেন এবং আর্মেনিয়ার দিকে যাত্রা করে লাজিকাকে লুণ্ঠনের জন্য ৫,০০০ সৈন্য রেখে যান। এই বাহিনীটিকে ৫৪৯ সালে দাগিস্থিয়াস ফাসিস নদীতে ধ্বংস করেন। পরবর্তী পারসিক আক্রমণও ব্যর্থ হয়েছিল যখন হিপ্পিস (বর্তমানে সখেনিস্টকালী) নদীতে একটি নির্ণায়ক যুদ্ধে নিহত কমান্ডার কোরিয়ানস নিহত হন। নতুন বাইজেন্টাইন কমান্ডার বেসাস আবাসগি উপজাতির একটি পারস্য-পন্থী বিদ্রোহকে দমন করেছিলেন, দীর্ঘ অবরোধের পরে পেত্রার দুর্গটি অধিগ্রহণ ও ধ্বংস করেছিলেন এবং ৫৫১ সালে আর্কিওপোলিসে মিহর-মিহরোকে পরাজিত করেছিলেন। যাইহোক, মিহর-মিহরো আবার অন্যান্য যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বি ছিলেন এবং সিমনিয়া এবং সৌয়ানিয়ার উচ্চভূমি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি অবরুদ্ধ করে কোটাইস এবং উথিমেরেওস দুর্গগুলি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি স্কিমনিয়া ও সোউয়ানিয়া অঞ্চলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ পথকে ব্লক করে দেন, আর পরে তিনি এই অঞ্চলগুলোকেও জয় করেন। ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মে, তিনি টেলিফিস এবং ওলারিয়ায় একটি উচ্চতর বাইজেন্টাইন-লাজিক বাহিনীকে বিতাড়িত করেন এবং তাদের নেসোসে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। এর কিছুদিন পর মিহর-মিহরোর অসুখে মৃত্যু হলে তার জায়গায় নাচোরাগান (Nachoragan) স্থলাভিষিক্ত হন।

রাজা গুবেজেস বাইজেন্টাইন কমান্ডার বেসাস, মার্টিন এবং রুস্টিকাসের সাথে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের প্রতি অভিযোগ করে তর্ক করেছিলেন। বেসাসকে ডেকে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু রাস্টিকাস এবং তার ভাই জন শেষ পর্যন্ত গুবেজেসকে হত্যা করেছিলেন। বাইজেন্টাইনরা ওনোগুরিসে একটি পূর্ণ-মাত্রার আক্রমণ শুরু করে, যাকে নাচোরাগান প্রতিহত করেন, আর পরবর্তিতে নাচোরাগান আর্কিওপলিসের প্রধান বাইজেন্টাইন বেইজকে ধ্বংস করেন, যাকে মিহর-মিহরো দুবার অধিগ্রহণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই পরাজয় এবং লাজিক রাজার হত্যার ফলে লাজিক এবং বাইজেন্টাইন জেনারেলদের মধ্যে একটি তিক্ত দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। লাজিক জনগোষ্ঠী সম্রাটকে গুবেজেসের ছোট ভাই জাথেসকে (Tzathes) তাদের নতুন রাজা হিসাবে মনোনীত করতে এবং তার হত্যার তদন্তের জন্য সিনেটর আথানাসিয়াসকে পাঠাতে রাজি করান। গ্রামিকাস এবং জনকে গ্রেপ্তার, বিচার করা হয় এবং তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। ৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইন-লাজিক জোট আর্কিওপলিস পুনরায় দখল করে নেয় এবং ফাসিসের তীরে পারস্য বাহিনীকে আক্রমণ করে নাচোরাগানকে পরাজিত করে। একই বছরের শরৎ ও শীতকালে, বাইজেন্টাইনরা পার্বত্য উপজাতি মিসিমিয়ানদের দ্বারা সংঘটিত একটি বিদ্রোহকে দমন করে এবং অবশেষে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে।

এরপর, ৫৫৭ সালে বাইজেন্টাইন ও পারসিয়ানদের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটে, এবং ৫৬২ সালের দারার “পঞ্চাশ বছরের শান্তি” দ্বারা, প্রথম খসরু লাজিকাকে বার্ষিক স্বর্ণ প্রদানের বিনিময়ে লাজিককে বাইজেন্টাইন ভাসাল রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেন।

দারার পঞ্চাশ বছরের শান্তি চুক্তি (৫৬২-৫৭২ খ্রি.)

দারা চুক্তি বা পঞ্চাশ বছরের শান্তি চুক্তি ছিল যা বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) এবং সাসানীয় (পারস্য) সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি ছিল যা ৫৬২ সালে দক্ষিণ তুরস্কের সীমান্তবর্তী শহর দারায় সংঘটিত হয়েছিল। বাইজান্টাইন সম্রাট প্রথন জাস্টিনিয়ানের পক্ষ থেকে পিটার দ্য পেট্রিশিয়ান এবং সাসানিয়ানরাজ প্রথম খশরুর পক্ষ থেকে ইজাদগুশাস্প এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন যার মাধ্যমে ককেশাসের লাজিকা রাজ্য নিয়ে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যকার ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তিতে ১৩টি অনুচ্ছেদ ছিল এবং এটি ভালভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। এটিতে দুটি সাম্রাজ্যের সমস্ত অংশ, পারসারমেনিয়া, লাজিকা, ক্লায়েন্ট রাষ্ট্রসমূহ এবং আরব মিত্রদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সাসানীয়রা লাজিকা থেকে সরে যেতে সম্মত হয়, কিন্তু প্রতিবেশী দেশ সুয়ানিয়ার মর্যাদা অস্পষ্ট ছিল যা ভবিষ্যতের মতানৈক্যের উৎস হয়ে ওঠে। সাসানীয়দের বার্ষিক ৩০,০০০ গোল্ড নমিস্মাটা নজরানার দেওয়ার কথা ছিল, যার মধ্যে প্রথম সাত বছরের নজরানা ছিল অবিলম্বে প্রদেয়। দেশটির উত্তরে ককেশাসের যাযাবরদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা লাইন রক্ষার পারস্য ও লাজিক দুই অঞ্চলেরই স্বার্থ ছিল, যার দায়িত্ব সাসানীয়রা গ্রহণ করে, কিন্তু ব্যয়ভার পরে লাজিকার উপর। উভয় পক্ষই সীমান্তে বিদ্যমান বসতিগুলিকে শক্তিশালী না করার জন্য নতুন দুর্গ স্থাপন বা শক্তিশালী না করার বিষয়ে একমত হয়েছিল। গুপ্তচরবৃত্তি প্রতিরোধের জন্য, বাণিজ্য ক্যালিনিকাম, নিসিবিস এবং ডিভিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যখন অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ীদের দারা (বাইজেন্টাইনদের অধীনে) এবং নিসিবিস (সাসানীয়দের অধীনে) সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। শরণার্থীদেরকে স্বাধীনভাবে তাদের বাড়িতে ফিরে যাবার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। একটি পৃথক চুক্তিতে সাসানীয় সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল।

শান্তি চুক্তিটি ৫০ বছরের জন্য স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল, তবে এটি কেবল ৫৭২ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল, কেননা ৫৭২ সালে দ্বিতীয় জাস্টিন একাধিক ফ্রন্টে বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার পরে চুক্তিটি ভঙ্গ করে ৫৭২-৫৯১ এর যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। প্রাচীন উৎসগুলির মধ্যে চুক্তিভঙ্গের জন্য মেনান্ডার প্রটেক্টর (Menander Protector) এবং থিওফিলাকটোস সিমোকাটেস (Theophylaktos Simokattes) দ্বিতীয় জাস্টিনকে দোষারোপ করে, যখন বাইজান্টিয়ামের থিওফেন্স ভিন্নমত পোষণ করেন।

আকসুমাইট-পারসিয়ান যুদ্ধ (৫৭০-৭৮ খ্রি.)

ভূমিকা 

আকসুমাইট-পারস্য যুদ্ধ ছিল খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে দক্ষিণ আরবের (বর্তমান ইয়েমেন) হ্রাসপ্রাপ্ত হিমিয়ারিট রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্য এবং আকসুমাইট সাম্রাজ্যের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের একটি দীর্ঘ সিরিজ। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে হাদ্রামাউতের যুদ্ধে (Battle of Hadhramaut) চূড়ান্ত বিজয়ের পর সাসানীয় সামরিক বাহিনী সানা ঘেরাও করে, যার পরে আকসুমাইটদের মূলত আরব উপদ্বীপ থেকে বিতারণ করা হয়। পারস্যরা সাবেক হিমিয়ারি রাজা সাইফ ইবনে ধি ইয়াজানকে (Sayf ibn Dhī Yazan) ইয়েমেনের নতুন সাসানীয় প্রদেশের গভর্নর হিসাবে ঘোষণা করেছিল। যাইহোক, ইয়াজান তার রাজত্বের চার বছর পরে তার ইথিওপিয়ান দাসদের হাতে নিহত হন, যার পরে আকসুমিরা এই অঞ্চলে তাদের শক্তি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইয়াজানের মৃত্যুর পরে সাসানীয় সেনাবাহিনী দ্বিতীয় আক্রমণ চালায় এবং ৫৭৫-৫৭৮ সালের মধ্যে ইয়েমেন পুনরায় জয় করে, যা আরবে আক্সুমাইট শাসনের অবসানকে চিহ্নিত করে। এই অঞ্চলে সাসানীয় নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে পারস্য সামরিক জেনারেল ওয়াহরেজকে (Wahrez) ইয়েমেনের সরাসরি গভর্নর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।

পটভূমি

৫২০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, আকসুমের কালেব হিমিয়ারাইট রাজ্যের ইহুদি শাসক ধু নুয়াসের (Dhu Nuwas) বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইয়েমেনে একটি সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন, যিনি নাজরানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপর চলমান নিপীড়নের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সফল আকসুমাইট আক্রমণের পরে নুওয়াসকে পদচ্যুত করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল এবং কালেব তার ভাইসরয় হিসাবে একজন স্থানীয় খ্রিস্টান হিমারীয় সুমুইয়াফা আশওয়াকে (Sumūyafa Ashwa) নিযুক্ত করেছিলেন। যাইহোক, ৫২৫ সালের দিকে, আশওয়াকে আকসুমাইট সেনাপতি আব্রাহা পদচ্যুত করেছিলেন, যিনি নিজেকে নতুন হিমারাইট-আকসুমাইট রাজ্যের রাজা হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।

আবরাহার মৃত্যুর পরে তার পুত্র মাসরুক ইবনে আবরাহ ইয়েমেনে আকসুমাইটদের প্রতি তার ভাইস-রয়ালিটি বা অধীনস্ততা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং আকসুম রাজ্যের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন পুনরায় শুরু করেছিলেন; তিনি যৌথ হিমিয়ারাইট-আকসুমাইট রাজ্যের অবসান ঘটান এবং একে আকসুমাইট রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করেন। এই ঘটনার পরে, মাসুকের সৎ ভাই মাদ-কারিব (Maʽd-Karib) তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় জাস্টিনের (Justin II) কাছে তিনি সহায়তা চান, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হলে তিনি সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্যের প্রথম খোসরোর (Khosrow I) কাছে সহায়তা চেয়েছিলেন।

যুদ্ধ

মাদ-কারিবের অনুরোধের জবাবে প্রথম খোসরো ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ৮০০ দাইলামাইট অশ্বারোহী বাহিনীর একটি ছোট অভিযানকারী বাহিনীর প্রধান হিসেবে সাসানীয় সামরিক জেনারেল ওয়াহরেজ এবং তার পুত্র নওজাদকে আকসুমাইট-শাসিত ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। সাসানীয় সামরিক বাহিনী আটটি জাহাজে করে আরব উপদ্বীপের উপকূলের চারপাশে যাত্রা করেছিল; যদিও দুটি জাহাজ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, বাকিগুলি সফলভাবে দক্ষিণ আরবের হাদ্রামাউত অঞ্চলে নোঙ্গর করেছিল। সাসানীয় অভিযাত্রী বাহিনীর শক্তি একেক জায়গায় একেক রকম – কোথাও ৩,৬০০ বা ৭,৫০০ (ইবনে কুতাইবা), আবার কোথাও ৮০০ (আল-তাবারী)। আধুনিক অনুমান অনুযায়ী সাসানীয় বাহিনীর সংখ্যা ১৬,০০০ ছিল জন। পারস্যরা ওবোলা বন্দর থেকে যাত্রা করে বাহরাইন দ্বীপপুঞ্জ দখল করে এবং পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ওমানের বন্দরের রাজধানী সোহারে চলে যায়; তারপরে তারা এডেনে অবতরণের আগে ধোফার এবং হাদ্রামাউতের অবশিষ্ট অংশ দখল করে।

প্রাথমিক আক্রমণের সময় নওজাদ আকসুমাইট বাহিনীর হাতে নিহত হন। এই ঘটনা ওয়াহরেজকে ইয়েমেনের ইথিওপিয়ান শাসক মাসরুক ইবনে আবরাহর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পরিচালিত করেছিল, যাকে হাদ্রামাউতের যুদ্ধে ওয়াহরেজ ব্যক্তিগতভাবে হত্যা করেছিলেন। হাদ্রামাউতে চূড়ান্ত পারস্য বিজয় আকসুমাইট পশ্চাদপসরণের সূচনা করে এবং পরবর্তীতে পারস্যরা সানা অবরোধ করে।

সাসানীয় বাহিনী কর্তৃক সানা দখলের পরে ওয়াহরেজ সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্যের ভাসল বা অধীনস্ত হিসেবে প্রাক্তন হিমারীয় রাজা সাইফ ইবনে ধি ইয়াজানকে তার সিংহাসনে পুনর্বহাল করেছিলেন। আল-তাবারি রিপোর্ট করেছেন যে আকসুমাইটদের উপর পারস্য বিজয়ের প্রধান কারণ ছিল পাঞ্জাগান, যা ছিল সাসানীয় সামরিক বাহিনী দ্বারা ব্যবহৃত একটি সামরিক প্রযুক্তি যার সাথে স্থানীয়রা অপরিচিত ছিল। ইয়েমেন বিজয় এবং পরে সেখানে ইথিওপিয়ান উপস্থিতি নির্মূল করার পর ওয়াহরেজ প্রচুর পরিমাণে ধন সম্পদ লুন্ঠন করে পারস্যে ফিরে আসেন।

ইথিওপিয়ান অভ্যুত্থান এবং দ্বিতীয় পারস্য আক্রমণ

৫৭৫-৭৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, হিমারীয় ভাসল বা অধীনস্ত রাজা ইয়াজানকে তার ইথিওপিয়ান দাসরা হত্যা করেছিল, যার পরে আকসুমাইটরা ফিরে এসেছিল এবং এই অঞ্চলে তাদের ক্ষমতা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল। জবাবে, সাসানীয় সামরিক বাহিনী দ্বিতীয় বার ইয়েমেন আক্রমণ করে, যা ছিল ওয়াহরেজের নেতৃত্বে ৪০০০ সেনার একটি বাহিনী। ইয়েমেন তখন সাসানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক একটি প্রদেশ হিসাবে সংযুক্ত হয়েছিল, এবং ওয়াহরেজকে সাসানীয় সম্রাট প্রথম খোসরো কর্তৃক এর সরাসরি গভর্নর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। বৃহত্তর ইয়েমেন সপ্তম শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইসলামী নবী মুহাম্মদের উত্থান না হওয়া পর্যন্ত দৃঢ় সাসানীয় নিয়ন্ত্রণে ছিল।

বাইজান্টাইন সাসানীয় যুদ্ধ (৫৭২-৫৯১ খ্রি.) এবং সাসানীয় গৃহযুদ্ধ (৫৮৯-৯১ খ্রি.)

ভূমিকা

৫৭২-৫৯১ সালের বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধ ছিল পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্য এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত একটি যুদ্ধ। পারস্যের কর্তৃত্বের অধীনে ককেশাসের অঞ্চলগুলিতে বাইজেন্টাইনপন্থী বিদ্রোহের কারণে এটি শুরু হয়েছিল, যদিও অন্যান্য ঘটনাগুলিও এর প্রাদুর্ভাবে অবদান রেখেছিল। যুদ্ধটি মূলত দক্ষিণ ককেশাস এবং মেসোপটেমিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল, যদিও এটি পূর্ব আনাতোলিয়া, সিরিয়া এবং উত্তর ইরানেও বিস্তৃত ছিল। এই যুদ্ধটিকে একটি একক যুদ্ধ ধরা ভুল হবে, বরং একে এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যকার ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত চলা যুদ্ধের একটি অংশ বলাই ঠিক হবে। এটিই ছিল দুই পক্ষের মধ্যে চলা অনেকগুলো যুদ্ধের মধ্যে শেষ যুদ্ধ যেগুলোতে এমন একটি প্যাটার্ন অনুসৃত হয় যেখানে যুদ্ধ মূলত সীমান্ত প্রদেশগুলিতে সীমাবদ্ধ থাকে এবং কোনও পক্ষই এই সীমান্ত অঞ্চলের বাইরে শত্রু-অঞ্চলের কোনও স্থায়ী দখল অর্জন করতে পারেনা। এই যুদ্ধের পরই দুই সাম্রজ্যের মধ্যে ৭ম শতাব্দীর গোড়ার দিকের অধিকতর বিস্তৃত এবং নাটকীয় চূড়ান্ত দ্বন্দ্বটি ঘটে। এই যুদ্ধ ছিল সেই দ্বন্দ্বের পূর্ববর্তী যুদ্ধ।

যুদ্ধের সূচনা

৫৬২ সালের পঞ্চাশ বছরের শান্তি চুক্তির এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে, দুটি সাম্রাজ্যের প্রভাবের ক্ষেত্রগুলির মধ্যে সংযোগের সমস্ত পয়েন্টে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছিল, যেমনটি ৫২০ এর দশকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঘটেছিল। ৫৬২-৫২০ সালে বাইজেন্টাইনরা পারস্যের বিরুদ্ধে জোটের জন্য গোকতুর্কদের সাথে একটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ আলোচনায় (জেমারচুসের দূতাবাস) জড়িত ছিল। ৫৬৮ সালে সাসানীয়রা ইয়েমেন আক্রমণ করে, বাইজেন্টাইনদের আকসুমাইট (Aksumite) মিত্রদের বিতাড়িত করে এবং ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র হিসাবে হিমিয়ারাইট (Himyarite) রাজ্য পুনরুদ্ধার করে। ৫৬৯ এবং ৫৭০ সালে সাসানীয়দের আরব ক্লায়েন্ট লখমিদরা বাইজেন্টাইন অঞ্চলে আক্রমণ শুরু করেছিল, যদিও উভয় সময়েই তারা বাইজেন্টাইনদের ক্লায়েন্ট ঘাসানিদদের কাছে পরাজিত হয়েছিল। আর ৫৭০ সালে বাইজেন্টাইনরা সাসানীয়দের বিরুদ্ধে আর্মেনিয়ান বিদ্রোহকে সমর্থন করার জন্য একটি গোপন চুক্তি করেছিল, যা আইবেরিয়ার রাজ্যে আরেকটি বিদ্রোহের সাথে ৫৭১ সালে শুরু হয়েছিল।

৫৭২ সালের গোড়ার দিকে, দ্বিতীয় ভারদান মামিকোনিয়ানের (Vardan II Mamikonian) অধীনে আর্মেনিয়ানরা আর্মেনিয়ার পারস্য গভর্নরকে পরাজিত করে এবং ডিভিনে (Dvin) তার সদর দফতর দখল করে; পারস্যরা শীঘ্রই শহরটি পুনরায় দখল করে নেয় তবে শীঘ্রই এটি সম্মিলিত আর্মেনীয় এবং বাইজেন্টাইন বাহিনী দ্বারা পুনরায় দখল করা হয় এবং বাইজেন্টাইন এবং পারস্যদের মধ্যে সরাসরি শত্রুতা শুরু হয়। ৫ম শতাব্দীতে ঘন ঘন বিদ্রোহ সত্ত্বেও, ৬ষ্ঠ শতাব্দীর পূর্ববর্তী যুদ্ধের সময় আর্মেনিয়ানরা মূলত তাদের সাসানীয় অধিপতিদের প্রতি অনুগত ছিল, যা তাদের প্রতিবেশী ও তাদের মতই খ্রিস্টান আইবেরিয়া এবং লাজিকা (কোলচিস) এর প্রতিবেশীরা ছিলনা। কিন্তু এই অঞ্চলের খ্রিস্টান জনগণের জোটে আইবেরিয়ান, লাজিকা এবং বাইজেন্টাইনদের সাথে যোগ দিয়ে আর্মেনীয়রা নাটকীয়ভাবে ককেশাসে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করে, ও এই ফ্রন্টে বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পূর্বের তুলনায় পারস্য অঞ্চলের গভীরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। এর ফলে গোটা যুদ্ধ জুড়েই বাইজেন্টাইন বাহিনী আলবেনিয়া (আধুনিক আজারবাইজান) পর্যন্ত আক্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এমনকি শীতকালেও তারা সেখানেই ছিল।

দারার পতন

তবে মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধ বাইজেন্টাইনদের জন্যই বিপর্যয়করভাবে শুরু হয়েছিল। ৫৭৩ সালে সারগাথনে বিজয়ের পরে তারা নিসিবিসকে অবরোধ করেছিল এবং স্পষ্টতই পারস্য সীমান্ত প্রতিরক্ষার এই প্রধান রক্ষাকবচটি দখলের পর্যায়ে ছিল, কিন্তু তাদের জেনারেল মার্সিয়ানকে আকস্মিকভাবে বরখাস্ত করার ফলে একটি বিশৃঙ্খল পশ্চাদপসরণ ঘটে। বাইজেন্টাইন বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে প্রথম খোসরো (Khosrow I, রাজত্বকাল ৫৩১-৫৭৯) এর অধীনে সাসানীয় বাহিনী দ্রুত পাল্টা আক্রমণ করে দারাকে ঘিরে ফেলে এবং চার মাসের অবরোধের পরে শহরটি দখল করে। একই সময়ে, আদারমাহানের অধীনে একটি ছোট পারস্য সেনাবাহিনী সিরিয়াকে ধ্বংস করে, আপামিয়া এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি শহরকে ধ্বংস ও লুণ্ঠন করে। অ্যান্টিওকের কাছে বাইজেন্টাইন প্রতিরক্ষার ফলেই তাদের কেবল সিরিয়ার মূল ভূমি থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন ৫৭২ সালে বাইজেন্টাইন সম্রাট দ্বিতীয় জাস্টিন (Justin II, রাজত্বকাল ৫৬৫-৫৭৮) ঘাসানিদ রাজা তৃতীয় আল-মুনধিরকে (al-Mundhir III) হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আল-মুনধির বাইজেন্টাইনদের সাথে তার জোট ত্যাগ করে তাদের মরুভূমির সীমানা উন্মুক্ত করে দেন। মেসোপটেমিয়ার প্রধান বাইজেন্টাইন দুর্গ দারার পতন দ্বিতীয় জাস্টিনকে উন্মাদনার দিকে ঠেলে দেয় এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ তার স্ত্রী সোফিয়া এবং টাইবেরিয়াস কনস্টান্টাইনের (Tiberius Constantine) হাতে চলে যায়। নতুন রিজেন্টরা এক বছরের যুদ্ধবিরতির জন্য ৪৫,০০০ নোমিসমাতা দিতে সম্মত হয়েছিল এবং পরে বছরে এটি পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল, যা বার্ষিক ৩০,০০০ নোমিসমাতার অর্থ প্রদানের মাধ্যমে সুরক্ষিত ছিল। যাইহোক, এই যুদ্ধবিরতি শুধুমাত্র মেসোপটেমিয়ান ফ্রন্টের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কেননা ককেশাসে যুদ্ধ চলতে থাকে।

প্রথম খোসরোর শেষ অভিযান

৫৭৫ সালে বাইজেন্টাইনরা ঘাসানিদদের সাথে তাদের পার্থক্য নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়েছিল; আর তাদের জোটের এই পুনর্নবীকরণ অবিলম্বে নাটকীয় ফল বয়ে আনে যখন ঘাসানিদরা হীরার লখমিদ রাজধানীকে ধ্বংস ও লুণ্ঠন করে। একই বছরে বাইজেন্টাইন বাহিনী ককেশাসের অনুকূল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ককেশীয় আলবেনিয়ায় অভিযান চালায় এবং স্থানীয় উপজাতিদের কাছ থেকে মানুষজনকে জিম্মি করে। ৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম খোসরো তার শেষ ও তার অন্যতম উচ্চাভিলাষী অভিযান শুরু করেন। তিনি ককেসাসের মধ্য দিয়ে আনাতোলিয়ায় একটি দূরপাল্লার আক্রমণ চালান, যেখানে প্রথম শাপুর (Shapur I, রাজত্বকাল ২৪০-২৭০) এর সময় থেকে পারস্য সেনাবাহিনী ছিল না। তার থিওডোসিওপোলিস এবং সিজারিয়া আক্রমণ করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, তবে তিনি তার সেনা প্রত্যাহারের আগে সেবাস্তিয়াকে ধ্বংস ও লুণ্ঠন করতে সক্ষম হন। বাড়ি ফেরার পথে, ম্যাজিস্টার মিলিটাম অফ দি ইস্ট জাস্টিনিয়ান তাকে বাধা দেন এবং মারাত্মকভাবে পরাজিত করেন। পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারা অরক্ষিত শহর মেলিটেনকে লুণ্ঠন করে, এদিকে বাইজেন্টাইন আক্রমণের কারণে ইউফ্রেটিস অতিক্রম করার সাথে সাথে তার সেনাবাহিনী আরও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। খোসরো এই ব্যর্থতা এবং তার নিজের এভাবে পলায়নের কারণে এতটাই মর্মাহত হয়েছিলেন যে তিনি একটি আইন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা অনুসারে যদি না অন্য কোনও রাজার মুখোমুখি হতে না হলে কোন পারস্যের সম্রাট ব্যক্তিগতভাবে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে পারবে না। বাইজেন্টাইনরা ককেশীয় আলবেনিয়া এবং আজারবাইজানের গভীরে অভিযান চালিয়ে, উত্তর ইরানের বিরুদ্ধে কাস্পিয়ান সাগর জুড়ে অভিযান শুরু করে, পারস্য অঞ্চলে শীতকাল যাপন শুরু করে এবং ৫৭৭ সালের গ্রীষ্মে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যায়। খোসরো এখন শান্তির জন্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আর্মেনিয়ায় তার সাম্প্রতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জাস্টিনিয়ানের বিরুদ্ধে তার জেনারেল তামখোসরাউয়ের বিজয় তার সংকল্পকে শক্ত করে তোলে এবং যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।

মেসোপটেমিয়ায় পুনরায় যুদ্ধ

৫৭৮ সালে মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধবিরতি শেষ হয়েছিল এবং যুদ্ধের মূল ফোকাস সেই ফ্রন্টে স্থানান্তরিত হয়েছিল। মেসোপটেমিয়ায় পারস্য অভিযানের পরে নতুন ম্যাজিস্টার মিলিটাম অফ দি ইস্ট মরিস টাইগ্রিসের উভয় পাশে অভিযান চালায়, আফুমন দুর্গ দখল করে এবং সিঙ্গারাকে ধ্বংস ও লুণ্ঠণ করে। ৫৭৯ সালে খোসরো পুনরায় শান্তির জন্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা যান এবং তার উত্তরসূরি চতুর্থ হরমিজড (Hormizd IV, রাজত্বকাল ৫৭৯-৫৯০) শান্তি আলোচনা ভেঙে দেন। ৫৮০ সালে বাইজেন্টাইন আক্রমণগুলি আবার টাইগ্রিসের পূর্ব দিকে প্রবেশ করলে ঘাসানিদরা লখমিদের বিরুদ্ধে আরও একটি বিজয় অর্জন করেছিল। তবে এই সময়ে ভবিষ্যতের দ্বিতীয় খোসরোকে (Khosrow II) আর্মেনিয়ার পরিস্থিতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যেখানে তিনি বেশিরভাগ বিদ্রোহী নেতাদের সাসানীয় আনুগত্যে ফিরে আসতে রাজি করাতে সফল হয়েছিলেন, যদিও আইবেরিয়া বাইজেন্টাইনদের প্রতি অনুগত ছিল। পরের বছর মরিসের অধীনে বাইজেন্টাইন বাহিনী এবং তৃতীয় আল-মুনধিরের অধীনে ঘাসানিদ বাহিনীর ইউফ্রেটিস বরাবর একটি উচ্চাভিলাষী অভিযান অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হয়, এদিকে আদারমাহানের অধীনে পারস্যরা মেসোপটেমিয়ায় একটি বিধ্বংসী অভিযান চালায়। মরিস এবং আল-মুন্ধির এই সমস্যার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেছিলেন এবং তাদের পারস্পরিক বিরোধের ফলে পরের বছর বিশ্বাসঘাতকতার সন্দেহে আল-মুনধিরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, যার ফলে বাইজেন্টাইন এবং ঘাসানিদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং ঘাসানিদ রাজ্যের সমাপ্তির সূচনা হয়েছিল।

অচলাবস্থা

৫৮২ সালে আদারমহান এবং তামখোসরাউয়ের বিরুদ্ধে কনস্টান্টিনায় বিজয় (যেখানে তামখোসরাউ মারা যায়) ও টিবেরিয়াস দ্বিতীয় কনস্টান্টাইন (Tiberius II Constantine, রাজত্বকাল ৫৭৪-৮২) এর মৃত্যুর পরে মরিস সম্রাট হন। এদিকে ম্যাজিস্টার মিলিটাম অফ দি ইস্ট হিসাবে তার উত্তরসূরি জন মাইস্টাকন, কার্দারিগানের কাছে নিম্ফিওস নদীতে পরাজিত হলে কনস্টান্টিনায় অর্জিত মরিসের সুবিধাটি বছরের শেষের দিকে হারিয়ে যায় । ৫৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, অভিযান এবং পাল্টা অভিযানের মাধ্যমে যুদ্ধটি অসম্পূর্ণভাবে অব্যাহত ছিল, যা ব্যর্থ শান্তি আলোচনার মাধ্যমে বিঘ্নিত হয়েছিল; একটি উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ ছিল ৫৮৬ সালে সোলাচোনের যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বিজয়। ৫৮৪ সালে আল-মুনধিরের উত্তরসূরি আল-নুমানকে (al-Nu’man) বাইজেন্টাইনরা গ্রেপ্তার করার ফলে ঘাসানিদ রাজ্যের বিভাজন ঘটে, যা একটি শিথিল উপজাতীয় জোটে পরিণত হয়, এবং আর কখনও তারা তাদের পূর্বের ক্ষমতা ফিরে পায়নি। ৫৮৮ সালে তাদের নতুন কমান্ডার প্রিসকাসের বিরুদ্ধে অবৈতনিক বাইজেন্টাইন সৈন্যদের একটি বিদ্রোহ সাসানীয়দের একটি সাফল্যের সুযোগ দিয়েছিল বলে মনে হয়েছিল, তবে বিদ্রোহীরা নিজেরাই আসন্ন পারস্য আক্রমণকে প্রতিহত করেছিল। সালকাজুরে পরবর্তী পরাজয়ের পরে বাইজেন্টাইনরা মার্টিরোপোলিসে আরেকটি বিজয় অর্জন করে। এই বছর, ১৫ বছর আগে দারার পতনের সময় নেওয়া একদল বন্দী খুজেস্তানে তাদের কারাগার থেকে পালিয়ে যায় এবং বাইজেন্টাইন অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার পথে লড়াই করে।

সাসানীয় গৃহযুদ্ধের পটভূমি

৫৮৯ সালে যুদ্ধের গতিপথ হঠাৎ রূপান্তরিত হয়েছিল। বসন্তে বাইজেন্টাইন বেতন বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছিল। বিদ্রোহের অবসান ঘটে, তবে সিত্তাস নামে একজন অফিসারের বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে মার্টিরোপোলিস পারস্যদের হাতে পড়ে যায় এবং বাইজেন্টাইনরা এটি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে বাইজেন্টাইনরা পরে সিসোরাননে একটি যুদ্ধে জয়লাভ করে। এদিকে ৫৮৯ সালে সাসানীয় সাম্রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড আলোচনা দরকার। ৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম খোসরো (Khosrow I) যখন সাসানীয় সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তিনি বেশ কয়েকটি সংস্কার শুরু করেন যা তার পিতা এবং পূর্বসূরি প্রথম কাভাধ (Kavadh I) শুরু করেছিলেন। এই সংস্কারগুলি বেশিরভাগ সাসানীয় সাম্রাজ্যের খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠা ও বেশ কয়েকটি সাসানীয় শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হওয়া অভিজাতদের লক্ষ্য করে করা হয়। খোসরো এই সংস্কারগুলিতে বেশ সফল ছিলেন, এবং ৫৭৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র চতুর্থ হরমিজড তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন, যিনি তার পিতার নীতিগুলি অব্যাহত রেখেছিলেন, তবে আরও কঠোর উপায়ে। অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনি, শাপুর শাহবাজীর ভাষায়, “কঠোরতা, অবমাননা এবং মৃত্যুদণ্ডের” আশ্রয় নিয়েছিলেন। হরমিজড অভিজাতদের প্রতি অত্যন্ত বৈরী ছিলেন এবং তাদের বিশ্বাস করতেন না; তাই তিনি ক্রমাগত নিম্ন শ্রেণীর পক্ষে চলে যান। হরমিজড খ্রিস্টানদের নিপীড়নের জন্য জরথুস্ট্রিয়ান যাজকদের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি জরথ্রুস্ট্রিয়ান যাজকদের পছন্দ করতেন না, এবং তাই প্রধান যাজক সহ তাদের অনেককে হত্যা করেছিলেন। তদুপরি, হরমিজড সামরিক বাহিনীর বেতন ১০ শতাংশ হ্রাস করেছিলেন এবং অভিজাতদের অনেক শক্তিশালী এবং বিশিষ্ট সদস্যকে হত্যা করেছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন তার পিতার বিখ্যাত কারেনিড উজির বোজর্গমেহর, পরবর্তীতে তার ভাই সিমাহ-ই বুরজিন; মিহরানিদ ইজাদগুশাস্প; স্পাবেদ (“সেনাপ্রধান”) বাহরাম-ই-মাহ আধার, এবং ইস্পাবুধন শাপুর (যিনি ভিস্তাহম এবং বিন্দুইহর পিতা ছিলেন)। মধ্যযুগীয় পারস্য ইতিহাসবিদ আল-তাবারীর মতে, হরমিজদ ১৩,৬০০ অভিজাত এবং ধর্মীয় সদস্যদের মৃত্যুর আদেশ দিয়েছিলেন।

বাহরাম চোবিন ও প্রথম পারসো-তুর্কিক যুদ্ধে তার বিজয়

৫৮৮ সালে একটি বিশাল হেফথালাইট-তুর্কি সেনাবাহিনী সাসানীয় প্রদেশ হারেভ আক্রমণ করে। মিহরান বংশের একজন প্রতিভাবান সেনাপতি বাহরাম চোবিন (Bahram Chobin) খোরাসানের কুস্তের স্পাহবেদ হিসাবে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ১২,০০০ সৈন্যের একটি সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। তারপরে তিনি তুর্কিদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন এবং সফলভাবে তাদের পরাজিত করেছিলেন, তাদের শাসক বাঘা কাঘানকে হত্যা করেছিলেন (Bagha Qaghan, সাসানীয় উৎসগুলিতে শাওয়া / সাভা / সাবা নামে পরিচিত)। এটি প্রথম প্রথম পারসো-তুর্কিক যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধটি সম্পর্কে একটু বিবরণ দেয়া যাক।

প্রথম পার্সো-তুর্কি যুদ্ধ ৫৮৮-৫৮৯ সালে সাসানীয় সাম্রাজ্য এবং হেফথালাইট রাজ্য ও এর প্রভু গোকতুর্কদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। তুর্কিদের দ্বারা সাসানীয় সাম্রাজ্যের আক্রমণের মাধ্যমে সংঘাতটি শুরু হয়েছিল এবং একটি নির্ণায়ক সাসানীয় বিজয় এবং হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। ৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাজা (শাহ) প্রথম খোসরো (রা. ৫৩১-৫৭৯) তার সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি মধ্য এশিয়ায় হেফথালাইট সাম্রাজ্যের আধিপত্যের অবসান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এইভাবে তিনি হেফথালিদের পরাজিত করার জন্য গোকতুর্কদের সাথে জোটবদ্ধ হন। অভিযানটি সফল হয় এবং এর ফলে অক্সাসের উত্তরের অঞ্চলটি তুর্কিদের এবং দক্ষিণটি সাসানীয় শাসনের অধীনে আসে। প্রথম খোসরো এবং তুর্কি খাগান ইস্তামির মধ্যে একটি চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা অক্সাসকে দুটি সাম্রাজ্যের মধ্যে সীমান্ত হিসাবে স্থাপন করেছিল। যাইহোক, ৫৮৮ সালে তুর্কি খাগান বাঘা কাঘান (পারস্য উত্সগুলিতে সাবেহ/সাবা নামে পরিচিত) তার হেফথালাইট প্রজাদের সাথে মিলে অক্সাসের দক্ষিণে সাসানীয় অঞ্চলগুলি আক্রমণ করে, যেখানে তারা বালখে অবস্থানরত সাসানীয় সৈন্যদের আক্রমণ করে ও বিতাড়িত করে, আর তারপরে তালাকান, বাদগিস, হেরাত ও সেই সাথে বাল্খ শহর জয় করতে অগ্রসর হয়।

একটি যুদ্ধ পরিষদে, বাহরামকে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং তাকে খোরাসানের গভর্নরশিপ দেওয়া হয়েছিল। বাহরামের সেনাবাহিনীতে ১২,০০০ হাতে বাছাই করা অশ্বারোহী ছিল বলে ধারণা করা হয়। তার সেনাবাহিনী ৫৮৮ সালের এপ্রিলে হিরকানিয়ান রকের যুদ্ধে তুর্কি এবং হেফথালিদের একটি বিশাল সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেন, এবং আবার ৫৮৯ সালে বালখ পুনরায় জয় করেন, যেখানে বাহরাম তুর্কি কোষাগার এবং খাগানের সোনার সিংহাসন দখল করে নেন। তারপরে তিনি অক্সাস নদী অতিক্রম করতে অগ্রসর হন, তুর্কিদের উপর একটি নির্ণায়ক বিজয় অর্জন করেন, ব্যক্তিগতভাবে বাঘা কাঘানকে তীরের আঘাতে হত্যা করেন। তিনি বুখারার নিকটবর্তী বায়কান্দ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হন এবং নিহত খাগানের পুত্র বীরমুধার আক্রমণও প্রতিহত করেন, যাকে বাহরাম বন্দী করে সাসানীয় রাজধানী টেসিফোনে প্রেরণ করেছিলেন। বীরমুধাকে সেখানে ভালভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং চল্লিশ দিন পরে তুর্কি রাজপুত্রকে ট্রান্সক্সিয়ানায় ফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়ে বাহরামের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। সাসানীয়রা এর পর থেকে চাচ এবং সমরকন্দের সোগদিয়ান শহরগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল, যেখানে হরমিজড মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছিল। ফেরদৌসির শাহনামায় (আনু. ১০১০ খ্রি.) যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধের সময় বাহরাম চোবিন এবং তুর্কি “রাজা সাওয়া” এর মিথস্ক্রিয়ার বিশদ বিবরণ আছে, যেখানে বাহরাম তার ১২,০০০ সৈন্য নিয়ে সাওয়াকে হত্যা করেছিলেন।

সাসানীয় গৃহযুদ্ধের (৫৮৯-৯১ খ্রি.) সূচনা ও টেসিফোনে সেনা-অভ্যুত্থান 

যাই হোক, গোকতুর্কদের সাথে একটি যুদ্ধকে সফল সমাপ্তিতে নিয়ে আসায় বাহরাম চোবিন মধ্য এশীয় ফ্রন্ট থেকে ককেশাসের ফ্রন্টে স্থানান্তরিত হন। তিনি ককেশাসে বাইজেন্টাইন এবং আইবেরিয়ান আক্রমণগুলি প্রতিহত করেন। তবে কিছু কাল পর আরাক্সেস নদীতে রোমানাসের অধীনে বাইজেন্টাইনদের কাছে তিনি পরাজিত হন। বাহরাম চোবিনের প্রতি ঈর্ষান্বিত চতুর্থ হরমিজদ এই পরাজয়কে বাহরাম চোবিনকে তার অফিস থেকে বরখাস্ত করার অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন এবং তাকে অপমানিত করেছিলেন।

বাহরাম হরমিজদের এই অপমানে ক্রুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করে প্রতিক্রিয়া জানান এবং তার মহৎ মর্যাদা এবং অগাধ সামরিক জ্ঞানের কারণে আরও অনেকে তার সেনাদলে যোগ দিয়েছিলেন। তারপরে তিনি খোরাসানের জন্য একটি নতুন গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন এবং পরে রাজধানী টেসিফোন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। এটি সাসানীয় ইতিহাসে প্রথম, যখন কোনও পার্থিয়ান রাজবংশ বিদ্রোহ করে সাসানীয় পরিবারের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। আজেন গুশনস্পকে বিদ্রোহ দমন করার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল, তবে হামাদানে তার নিজের একজন লোক জাদেসপ্রাস তাকে হত্যা করেছিল। বাহরামকে থামানোর জন্য সারামেস দ্য এল্ডারের অধীনে আরেকটি বাহিনীও প্রেরণ করা হয়েছিল, কিন্তু বাহরাম তাকে পরাজিত করেছিলেন এবং তাকে হাতির দ্বারা পদদলিত করে হত্যা করেছিলেন। বাহরাম যে পথটি গ্রহণ করেছিলেন তা সম্ভবত ইরানী মালভূমির উত্তর প্রান্ত ছিল, যেখানে তিনি আদুরবাদাগনে আইবেরিয়ান এবং অন্যান্যদের দ্বারা রোমান-অর্থায়নে করা আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন এবং ট্রান্সককেশিয়ায় নিযুক্ত একটি রোমান বাহিনীর দ্বারা সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তারপরে তিনি দক্ষিণ দিকে মিডিয়ার দিকে যাত্রা করেছিলেন, যেখানে হরমিজড সহ সাসানীয় রাজারা সাধারণত গ্রীষ্মকালে বাস করতেন।

রোমান সীমান্তে টেসিফোন এবং ইরানি সৈন্যদের মধ্যে যোগাযোগ কমাতে হরমিজদ গ্রেট জাবের দিকে রওনা হন। সেই সময়ে সৈন্যরা উত্তর মেসোপটেমিয়ার প্রধান ইরানি শহর নিসিবিসের বাইরে অবস্থিত ছিল; তবে তারা হরমিজদের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করেছিল এবং বাহরামের প্রতি তাদের আনুগত্য স্বীকার করেছিল। বাহরামের প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়তে থাকে; নিসিবিসে ইরানি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে উত্তরে পাঠানো সাসানীয় অনুগত বাহিনী বিদ্রোহীদের প্রপাগান্ডায় প্লাবিত হয়েছিল। হরমিজদের প্রতি অনুগত বাহিনী অবশেষে বিদ্রোহ করে এবং তাদের কমান্ডারকে হত্যা করে, যার ফলে হরমিজদের অবস্থান অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, যার ফলে তিনি টাইগ্রিস নদী তে নেভিগেট করার এবং লখমিদের রাজধানী আল-হিরায় আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে হরমিজদের টেসিফোনে থাকার সময়, আপাতদৃষ্টিতে রক্তহীন প্রাসাদ বিপ্লবে তার শ্যালক ভিস্তাম এবং ভিন্দুইহ তাকে উৎখাত করেছিলেন, “যারা হরমিজডকে সমানভাবে ঘৃণা করতেন”।

হরমিজদকে শীঘ্রই দুই ভাই একটি লাল-গরম সুই দিয়ে অন্ধ করে দিয়েছিলেন, যারা পরবর্তীতে বড় ছেলে দ্বিতীয় খোসরো (Khosrow II, রাজত্বকাল ৫৯০-৬২৮) (যিনি তার মায়ের দিক দিয়ে তাদের ভাগ্নে ছিলেন) সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। দুই ভাই শীঘ্রই দ্বিতীয় খোসরোর পরোক্ষ অনুমোদনে হরমিজডকে হত্যা করেছিলেন। তবুও, বাহরাম হরমিজদের প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি করার অজুহাতে টেসিফোনের দিকে তার যাত্রা চালিয়ে যান।

খোসরো তখন একটি ক্যারোট এন্ড স্টিক প্রবণতা গ্রহণ করেন এবং বাহরামকে চিঠিতে লিখেছিলেন; “খোসরো, রাজাদের রাজা, শাসক, জনগণের প্রভু, শান্তির রাজপুত্র, মানুষের পরিত্রাণ, দেবতাদের মধ্যে ভাল ও অনন্ত জীবিত মানুষ, মানুষের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত দেবতা, অত্যন্ত খ্যাতিমান, বিজয়ী, যিনি সূর্যের সাথে উত্থিত হন এবং যিনি রাতকে দৃষ্টিশক্তি দান করেন, যিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে বিখ্যাত, যে রাজা ঘৃণা করে, যিনি সেই উপকারকারী যিনি সাসানীয়দের নিয়ে ইরানীয়দের রাজত্ব রক্ষা করেছিযেন, তিনি আমাদের বন্ধু, ইরানীয়দের সেনাপতি বাহরামের কাছে লিখছেন… আমরাও বৈধ পদ্ধতিতে রাজকীয় সিংহাসন দখল করেছি এবং কোনো ইরানীয় রীতিনীতিকে বিঘ্নিত করিনি। আমরা এত দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ডায়াডেমটি সরিয়ে নেব না, যা অনুসারে আমরা এমনকি আশা করেছিলাম যে যদি এটি সম্ভব হয় তবে আমরা অন্যান্য বিশ্বের উপর শাসন করব। আপনি যদি আপনার কল্যাণ চান তবে কী করা উচিত তা নিয়ে ভাবুন।” বাহরাম অবশ্য দ্বিতীয় খোসরোর সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছিলেন ও কয়েক দিন পরে তিনি টেসিফোনের নিকটবর্তী নাহরাওয়ান খালে পৌঁছেছিলেন, যেখানে তিনি সংখ্যায় বেশি থাকা খোসরোর সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। খোসরোর সেনারা বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে বাহরামের সেনাদের ধরে রাখতে সক্ষম হন। তবে খোসরোর লোকেরা শেষ পর্যন্ত তাদের মনোবল হারাতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত বাহরাম চোবিনের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়। খোসরো, তার দুই আঙ্কল, স্ত্রী এবং ৩০ জন অভিজাতদের একটি দল নিয়ে বাইজেন্টাইন অঞ্চলে পালিয়ে যান, আর বাহরাম চোবিন সাসানীয় রাজধানী টেসিফোন দখল করে নেন। বাহরাম চোবিন ষষ্ঠ বাহরাম হিসাবে সিংহাসন গ্রহণ করেন, যাকে সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাসানীয় রাজবংশের শাসনের প্রথম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

বাইজান্টিয়ামে খোসরোর পলায়ন

এদিকে বাইজেন্টাইন সম্রাট মরিসের (রাজত্বকাল ৫৮২-৬০২) মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দ্বিতীয় খোসরো সিরিয়ায় যান এবং বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ বন্ধ করার জন্য সাসানীয় অধিকৃত শহর মার্টিরোপোলিসের কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করেন, কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। তারপরে তিনি মরিসের কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন এবং সাসানীয় সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য তার সাহায্যের অনুরোধ করেছিলেন, যাতে বাইজেন্টাইন সম্রাট সম্মত হন। বিনিময়ে বাইজেন্টাইনরা আমিদা, কারহাই, দারা এবং মারটিরোপোলিস শহরের ওপর পুনরায় সার্বভৌমত্ব অর্জন করবে। তদুপরি, ইরানকে আইবেরিয়া এবং আর্মেনিয়ার বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হয়েছিল, কার্যকরভাবে বাইজেন্টাইনদের কাছে লাজিকার নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করতে হয়েছিল।

৫৯১ সালে খোসরো কনস্ট্যান্টিয়ায় চলে যান এবং মেসোপটেমিয়ায় বাহরাম চোবিনের অঞ্চলগুলি আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হন, যখন ভিস্তাহম এবং ভিন্দুয়িহ বাইজেন্টাইন কমান্ডার জন মাইস্টাকনের তত্ত্বাবধানে আজারবাইজানে একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলছিলেন, যেখানে জন মাইস্টাকন আর্মেনিয়াতেও একটি সেনাবাহিনী গড়ে তুলছিলেন। কিছু সময় পরে খোসরো দক্ষিণের বাইজেন্টাইন কমান্ডার কোমেনটিওলাসের সাথে মেসোপটেমিয়া আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের সময় নিসিবিস এবং মার্টিরোপোলিস দ্রুত তাদের কাছে পরাস্ত হয়, এবং বাহরামের কমান্ডার জাতস্পারহাম পরাজিত হন এবং নিহত হন। বাহরামের অন্য কমান্ডারদের মধ্যে ব্রাইজাসিয়াস নামে একজনকে মোসিলে বন্দী করা হয়েছিল এবং তার নাক এবং কান কেটে দেওয়া হয়েছিল এবং তারপরে তাকে খোসরোর কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল, যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।

কিছু সময় পরে খোসরো কোমেনটিওলাসের দ্বারা অসম্মানিত বোধ করে মরিসকে দক্ষিণের কমান্ডার হিসাবে তার জায়গায় নরসেসকে স্থলাভিষিক্ত করতে রাজি করান। খোসরো এবং নতুন ম্যাজিস্টার মিলিটাম অফ দি ইস্ট নরসেস বাইজেন্টাইন এবং পারস্য সৈন্যদের একটি সম্মিলিত বাহিনীকে বাহরামের মুখোমুখি করার জন্য মেসোপটেমিয়া থেকে আজারবাইজান অব্দি নেতৃত্ব দিয়ে এনেছিলেন, যখন আর্মেনিয়ার ম্যাজিস্টার মিলিটামের অধীনে দ্বিতীয় বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনী উত্তর থেকে একটি পিনসার আন্দোলন শুরু করে। খোসরো এবং নারসেস তখন বাহরামের অঞ্চলে আরও গভীরে প্রবেশ করে, দারা এবং তারপরে ফেব্রুয়ারিতে মার্দিন দখল করে, যেখানে খোসরোকে পুনরায় রাজা ঘোষণা করা হয়। এর অল্প সময়ের মধ্যেই, খোসরো তার এক ইরানী সমর্থক মাহবোধকে টেসিফোন দখল করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন, যা তিনি সম্পন্ন করতে সক্ষম হন। এদিকে, খোসরোর দুই আঙ্কল এবং জন মাইস্টাকন উত্তর আজারবাইজান জয় করেন এবং এই অঞ্চলের আরও দক্ষিণে চলে যান, যেখানে তারা গানজাকের কাছে ব্লারাথনের যুদ্ধে বাহরামকে পরাজিত করেন। দ্বিতীয় খোসরো এভাবে ক্ষমতায় পুনর্বহাল হন, এবং যুদ্ধের অবসান ঘটে। বাহরাম তখন ফারঘানার তুর্কিদের কাছে পালিয়ে যান। তবে খোসরো তাকে হত্যা করে বা তুর্কিদের তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য রাজি করান।

পরবর্তী অবস্থা

দ্বিতীয় খোসরোকে সিংহাসনে পুনরুদ্ধার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পরে বাইজেন্টাইনরা পারস্যের সাথে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী অবস্থানে ছিল। খসরো কেবল মরিসের সহায়তার বিনিময়ে দারা এবং মার্টিরোপোলিসকেই ফিরিয়ে দেননি, বরং ককেশাসের একটি নতুন বিভাজনে সম্মত হন যার মাধ্যমে সাসানীয়রা টিগ্রানোকার্ট, মানজিকার্ট, বাগুয়ানা, ভালারসাকার্ট, বাগারান, ভার্দকেসাভান, ইয়েরেভান, আনি, কারস এবং জারিসাত সহ অনেকগুলি শহর বাইজেন্টাইনদের কাছে হস্তান্তর করে। আইবেরিয়া রাজ্যের পশ্চিম অংশও বাইজেন্টাইন নির্ভরশীল হয়ে ওঠে, যার মধ্যে আরদাহান, লোরি, দামানিসি, লোমসিয়া, এমটশেতা এবং টন্টিও শহরগুলি ছিল। এছাড়াও, সাইটিয়া শহরটি লাজিকাকে দেওয়া হয়েছিল, আর সেটিও একটি বাইজেন্টাইন নির্ভর শহরই ছিল। এইভাবে ককেশাসে কার্যকর বাইজেন্টাইন নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ ঐতিহাসিকভাবে তার শীর্ষে পৌঁছেছিল। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। পূর্ববর্তী যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি চুক্তিগুলিতে সাধারণত বাইজেন্টাইনরা শান্তির জন্য, অধিকৃত অঞ্চলগুলির প্রত্যাবর্তনের জন্য বা ককেশাস পাসের প্রতিরক্ষায় অবদান হিসাবে আর্থিক অর্থ প্রদান করত, কিন্তু এবারে এই উপলক্ষে এই জাতীয় কোনও অর্থ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যা ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি বড় পরিবর্তন কে চিহ্নিত করে। সম্রাট মরিস এমনকি বলকান অঞ্চলে ব্যাপক সমরাভিযানের মাধ্যমে তার পূর্বসূরির ত্রুটিগুলি কাটিয়ে ওঠার অবস্থানে ছিলেন। যাইহোক, এই শান্তির পরিস্থিতি মাত্র ৬০২ সাল অব্দি টেকে, আর শীঘ্রই নাটকীয়ভাবে উল্টে যায়, কারণ মরিস এবং খোসরোর মধ্যে জোট মাত্র এগারো বছর পরে একটি নতুন যুদ্ধ শুরু করতে সহায়তা করেছিল, যা উভয় সাম্রাজ্যের জন্য বিপর্যয়কর ফলাফল নিয়ে আসে। দখলদার ফোকাস মরিসকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করলে দ্বিতীয় খসরো বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

বাইজান্টাইন সাসানীয় যুদ্ধ (৬০২-৬২৮ খ্রি.)

ভূমিকা

৬০২-৬২৮ সালের বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধ ছিল বাইজেন্টাইন/ রোমান সাম্রাজ্য এবং ইরানের সাসানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত ধারাবাহিক যুদ্ধের চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে বিধ্বংসী যুদ্ধ। ৫৯১ সালে সম্রাট মরিস সাসানীয় রাজা দ্বিতীয় খোসরোকে তার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করার পরে দুই শক্তির মধ্যে পূর্ববর্তী যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। ৬০২ সালে মরিসকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ফোকাস হত্যা হয়েছিলেন। এরপর খসরো দৃশ্যত পদচ্যুত সম্রাট মরিসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটি কয়েক দশকের দীর্ঘ সংঘাতে পরিণত হয়েছিল, যা ছিল বাইজান্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের সিরিজের দীর্ঘতম যুদ্ধ, এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে  – মিশর, লেভান্ট, মেসোপটেমিয়া, ককেশাস, আনাতোলিয়া, আর্মেনিয়া, ঈজিয়ান সাগর এবং কনস্টান্টিনোপলের প্রাচীরের সামনে লড়াই চলেছিল।

পারস্যরা ৬০২ থেকে ৬২২ সাল পর্যন্ত যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফল প্রমাণিত হলেও (তারা লেভান্ট, মিশর, এজিয়ান সাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপ এবং আনাতোলিয়ার কিছু অংশ জয় করেছিল) ব্যর্থতা সত্ত্বেও ৬১০ সালে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের উত্থান প্রাথমিক স্থিতাবস্থার দিকে পরিচালিত করেছিল। ৬২২ থেকে ৬২৬ সাল পর্যন্ত ইরানের ভূমিতে হেরাক্লিয়াসের অভিযান পারস্যদের প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে বাধ্য করেছিল, যার ফলে হেরাক্লিয়াসের বাহিনী গতি ফিরে পেয়েছিল। আভার এবং স্লাভদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে পারস্যরা ৬২৬ সালে কনস্টান্টিনোপল দখলের চূড়ান্ত প্রচেষ্টা করেছিল, তবে সেখানে পরাজিত হয়েছিল। ৬২৭ সালে তুর্কিদের সাথে জোট বদ্ধ হয়ে, হেরাক্লিয়াস পারস্যের কেন্দ্রস্থল আক্রমণ করে। পারস্যে একটি গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যার সময় পারস্যরা তাদের রাজাকে হত্যা করেছিল এবং শান্তির জন্য চেষ্টা করেছিল।

সংঘাতের শেষে দেখা যায়, উভয় পক্ষেরই মানব ও বস্তুগত সম্পদ শেষ হয়ে গেছে, এবং তারা উভয়ই এই যুদ্ধ থেকে খুব কম অর্জন করেছিল। ফলস্বরূপ, তারা ইসলামী রাশিদুন খিলাফতের আকস্মিক উত্থানের ঝুঁকিতে পতিত হয়, যার বাহিনী যুদ্ধের কয়েক বছর পরে উভয় সাম্রাজ্য আক্রমণ করেছিল। মুসলিম সৈন্যরা দ্রুত সমগ্র সাসানীয় সাম্রাজ্যের পাশাপাশি লেভান্ট, ককেশাস, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকার বাইজেন্টাইন অঞ্চলগুলি জয় করে। পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে, বাইজেন্টাইন এবং আরব বাহিনী নিকট প্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

পটভূমি 

কয়েক দশকের অসমাপ্ত লড়াইয়ের পরে সম্রাট মরিস নির্বাসিত সাসানীয় রাজপুত্র খোসরোকে দখলদার বাহরাম চোবিনের কাছ থেকে তার সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে ৫৭২-৫৯১ সালের বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটান। বিনিময়ে সাসানীয়রা উত্তর-পূর্ব মেসোপটেমিয়া, পারস্য আর্মেনিয়া এবং ককেশীয় আইবেরিয়ার বেশিরভাগ অংশ বাইজেন্টাইনদের কাছে হস্তান্তর করেছিল, যদিও সঠিক বিবরণ স্পষ্ট নয়। বাইজেন্টাইন অর্থনীতির জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা হল, তাদেরকে আর সাসানীয়দের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ দান করতে হয়নি। সম্রাট মরিস তখন স্লাভ এবং আভারদের আক্রমণ বন্ধ করতে বলকান অঞ্চলে নতুন অভিযান শুরু করেছিলেন।

সম্রাট দ্বিতীয় টাইবেরিয়াসের উদারতা এবং সমরাভিযান দ্বিতীয় জাস্টিনের সময় থেকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট কোষাগারে উদ্বৃত্তকে শেষ করে দিয়েছিল। কোষাগারে রিজার্ভ তৈরি করার জন্য মরিস কঠোর আর্থিক ব্যবস্থা চালু করেছিলেন এবং সেনাবাহিনীর বেতন হ্রাস করেছিলেন; যার ফলে চারটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ৬০২ সালে চূড়ান্ত বিদ্রোহের ফলে মরিস বলকান অঞ্চলে তার সৈন্যদের শীতকালে ভূমির বাইরে থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। এর ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে সেনাবাহিনী থ্রাসিয়ান সেঞ্চুরিয়ন ফোকাসকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেছিল। মরিস হিপোড্রোমের দুটি প্রধান রথ দৌড় প্রতিযোগিতা বা চ্যারিয়ট রেসিং দলের সমর্থক ব্লুজ এবং গ্রিনসকে সশস্ত্র করে কনস্টান্টিনোপলকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন – তবে তারা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। মরিস পালিয়ে যান কিন্তু শীঘ্রই ফোকাসের সৈন্যরা তাকে বাধা দেয় এবং হত্যা করে।

সংঘাতের সূচনা

মরিসের হত্যার পরে মেসোপটেমিয়ার বাইজেন্টাইন প্রদেশের গভর্নর নরসেস ফোকাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং প্রদেশের একটি প্রধান শহর এডেসা দখল করেছিলেন। সম্রাট ফোকস জেনারেল জার্মেনাসকে এডেসা ঘেরাও করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার ফলে নরসেস পারস্যের রাজা দ্বিতীয় খোসরোর কাছে সাহায্যের অনুরোধ করেছিলেন। “বন্ধু এবং শ্বশুর” মরিসের প্রতিশোধ নিতে সহায়তা করতে ইচ্ছুক খোসরো মরিসের মৃত্যুকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আক্রমণ করার অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন, এবং আর্মেনিয়া এবং মেসোপটেমিয়া পুনরায় জয় করার চেষ্টা করেছিলেন।

জেনারেল জার্মেনাস পারস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মারা যান। খোসরোর বিরুদ্ধে ফোকাসের পাঠানো একটি সেনাবাহিনী আপার মেসোপটেমিয়ার দারার কাছে পরাজিত হয়েছিল, যার ফলে ৬০৫ সালে সেই গুরুত্বপূর্ণ দুর্গটি দখল করা হয়েছিল। ফোকাস কর্তৃক নিযুক্ত নপুংসক লিওনটিয়াস নরসেসকে আক্রমণ করলে নরসেস পালিয়ে যান, কিন্তু যখন নারসেস শান্তির শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করার জন্য কনস্টান্টিনোপলে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলেন, তখন ফোকাস তাকে আটক এবং জীবন্ত পুড়িয়ে মারার আদেশ দিয়েছিলেন। পার্সিয়ানদের থামাতে ব্যর্থতার পাশাপাশি নারসেসের মৃত্যু ফোকাসের সামরিক শাসনের মর্যাদাকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল।

হেরাক্লিয়াসের বিদ্রোহ

৬০৮ সালে আফ্রিকার এক্সার্ক জেনারেল হেরাক্লিয়াস দ্য এল্ডার বিদ্রোহ করেছিলেন। আর এক্ষেত্রে তাকে বিদ্রোহ করতে উস্কে দিয়েছিলেন কাউন্ট অফ দি এক্সকিউবিটর, এবং ফোকাসের জামাতা প্রিসকাস। হেরাক্লিয়াস নিজেকে এবং তার নামযুক্ত পুত্র হেরাক্লিয়াস দ্য ইয়ংগারকে কনসাল হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন – যার ফলে স্পষ্টভাবে তিনি সাম্রাজ্যবাদী উপাধি দাবি করেছিলেন – এবং নিজে ও পুত্রকে কনস্যুলার রোব পরিহিত অবস্থায় দেখিয়ে মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছিলেন।

প্রায় একই সময়ে হেরাক্লিয়াসের বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে রোমান সিরিয়া এবং প্যালাস্টিনা প্রিমাতেও বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। ৬০৯ বা ৬১০ সালে অ্যান্টিওকের প্যাট্রিয়ার্ক, দ্বিতীয় আনাস্তাসিয়াস মারা যান। অনেক সূত্র দাবি করে যে ইহুদিরা যুদ্ধে জড়িত ছিল, যদিও তারা কোথায় দলগুলির সদস্য ছিল এবং কোথায় তারা খ্রিস্টানদের বিরোধী ছিল তা স্পষ্ট নয়। ফোকাস সহিংসতা বন্ধ করার জন্য ওরিয়েন্টিস (প্রাচ্যের গণনা) হিসাবে বোনাসকে নিয়োগ করে প্রতিক্রিয়া জানান। বোনাস ৬০৯ সালে অ্যান্টিওকে সহিংসতায় একটি ঘোড়দৌড় দল গ্রিনসকে তাদের ভূমিকার জন্য শাস্তি দিয়েছিলেন।

হিরাক্লিয়াস দ্য এল্ডার তার ভাগ্নে নাইসেতাসকে মিশর আক্রমণ করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। বোনাস নাইসেতাসকে থামানোর চেষ্টা করার জন্য মিশরে গিয়েছিলেন, কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার বাইরে পরে পরাজিত হয়েছিলেন। ৬১০ সালে নিসেটাস প্রদেশটি দখল করতে সফল হন, এবং প্যাট্রিয়ার্ক জন দ্য অ্যালমসগিভারের (যিনি নিসেটাসের সহায়তায় নির্বাচিত হয়েছিলেন) সহায়তায় সেখানে একটি ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপন করেন।

প্রধান বিদ্রোহী বাহিনীটি কনস্টান্টিনোপলের নৌ আক্রমণে নিযুক্ত হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন হেরাক্লিয়াস দ্য ইয়ংগার, যার নতুন সম্রাট হওয়ার কথা ছিল। হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ শীঘ্রই ভেঙে পড়ে এবং ফোকাসকে প্যাট্রিসিয়ান প্রোবস (ফোটিয়াস) হেরাক্লিয়াসের হাতে তুলে দেয়। ফোকাসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তবে তার আগে ফোকাস ও হেরাক্লিয়াসের মধ্যে একটি বিখ্যাত সংলাপ ঘটে :

হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এভাবে  (বাজেভাবে) এই সাম্রাজ্য শাসন করেছেন?”
ফোকাস একটি অপ্রত্যাশিত মেজাজের সাথে উত্তরে বললেন, “আপনি কি একে এর চেয়ে ভালভাবে পরিচালনা করবেন?”

হেরাক্লিয়াস দ্য এল্ডারের কথা এর পরের উৎস্যসমূহ থেকে আর পাওয়া যায়নি। সম্ভবত মারা যান, তবে তারিখটি অজানা। যাই হোক, ভাগ্নি মার্টিনাকে বিয়ে করার পরে এবং প্যাট্রিয়ার্ক কর্তৃক মুকুট লাভের পর ৩৫ বছর বয়সী হেরাক্লিয়াস সম্রাট হিসাবে তার কাজ সম্পাদন করতে শুরু করেছিলেন। ফোকাসের ভাই, কোমেনটিওলাস, মধ্য আনাতোলিয়ায় একটি বড় বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তবে আর্মেনিয়ান কমান্ডার জাস্টিন তাকে হত্যা করেছিলেন, যার ফলে হেরাক্লিয়াসের রাজত্বের জন্য একটি বড় হুমকি দূর হয়। তবুও, কোমেনটিওলাসের সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর তার প্রতিস্থাপন করার জন্য যে বাহিনী পাঠানো হয়েছিল তার আসতে দেরি হয়, এর ফলে পারস্যরা আনাতোলিয়ায় আরও অগ্রসর হয়েছিল। রাজস্ব বৃদ্ধি এবং ব্যয় হ্রাস করার চেষ্টা করার জন্য, হেরাক্লিয়াস ইম্পেরিয়াল ফিস্ক বা সাম্রাজ্যের কোষাগার থেকে কনস্টান্টিনোপলের চার্চের নতুন কর্মীদের বেতন না দিয়ে চার্চটির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত কর্মীদের সংখ্যা সীমিত করেছিলেন। তিনি তার রাজবংশকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কাজে লাগিয়েছিলেন, এবং ক্ষমতার উপর তার দখলকে শক্তিশালী করার জন্য ন্যায়বিচারক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

পারস্যের উত্থান

পারস্যরা আর্মেনিয়া এবং আপার মেসোপটেমিয়ার সীমান্ত শহরগুলি জয় করে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এই গৃহযুদ্ধের সুবিধা নিয়েছিল। ইউফ্রেটিস বরাবর ৬০৯ সালে তারা মার্ডিন এবং আমিদা (দিয়ারবাকির) জয় করেছিল। কতিপয় খ্রিস্টান এডেসা বিশ্বাস করতেন যে, সমস্ত শত্রুর বিরুদ্ধে এডেসার রাজা পঞ্চম আবগারের হয়ে যীশু নিজেই এডেসাকে রক্ষা করবেন, কিন্তু ৬১০ সালে এডেসারও পতন হয়েছিল।

এক রোমান ব্যক্তি আর্মেনিয়ায় নিজেকে মরিসের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং সহ-সম্রাট থিওডোসিয়াস বলে দাবি করে, আর তার প্ররোচনার কারণে আর্মেনিয়ায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ থিওডোসিওপোলিস (এরজুরাম) শহরটি ৬০৯ বা ৬১০ সালে আস্তাত ইয়েজতায়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর পরে সেই ব্যক্তি সম্ভবত খোসরোর সুরক্ষায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। ৬০৮ সালে জেনারেল শাহীনের নেতৃত্বে পারস্যরা আনাতোলিয়ায় একটি অভিযান শুরু করে যা কনস্টান্টিনোপল থেকে বসফরাস পেরিয়ে ক্যালসেডনে পৌঁছায়। পারস্য বিজয় একটি ধীর প্রক্রিয়া ছিল; হেরাক্লিয়াসের রাজত্বের সময় পারস্যরা কাপাডোসিয়ায় যাওয়ার আগে ইউফ্রেটিসের পূর্বে এবং আর্মেনিয়ার সমস্ত রোমান শহর জয় করেছিল, কাপাডোসিয়ায় শাহীন সিজারিয়া মাজাকা শহরটি দখল করেছিলেন। এরপর সেখানে, ফোকাসের জামাতা প্রিসকাস (যিনি হেরাক্লিয়াস এবং তার বাবাকে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত করেছিলেন) সিজারিয়া মাজাকা শহরের অভ্যন্তরে পারসিদের ফাঁদে ফেলার জন্য এক বছর ব্যাপী অবরোধ শুরু করেছিলেন।

সম্রাট হিসাবে হেরাক্লিয়াসের ক্ষমতা গ্রহণ পারস্যের হুমকি হ্রাস করতে খুব কমই কাজ করেছিল। হেরাক্লিয়াস পারস্যদের সাথে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করে তার রাজত্ব শুরু করেছিলেন, যেহেতু যার ক্রিয়াকলাপই যুদ্ধের মূল কারণ ছিল মূল কাসাস বেলি ছিল, সেই ফোকাসকেই উৎখাত করা হয়েছিল। তবে পারস্যরা তাদের সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে বিজয়ী হতে থাকায় এই প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিল। ইতিহাসবিদ ওয়াল্টার কেগির মতে, এটি কল্পনাযোগ্য যে পারস্যদের লক্ষ্য ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে আখেমেনিড সাম্রাজ্যের সীমানা পুনরুদ্ধার করা বা এমনকি সেটাকেও অতিক্রম করা, যদিও রাজকীয় পারস্য সংরক্ষণাগার বা আর্কাইভ হারানোর কারণে, এটি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করার জন্য কোনও দলিল টিকে নেই।

হেরাক্লিয়াস তার সেনাপতি প্রিসকাসের সিজারিয়া মাজাকায় পারস্যদের অবরোধ করার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। প্রিসকাস অসুস্থ হওয়ার ভান করেছিলেন এবং সম্রাটের সাথে দেখা করেননি। এটি হেরাক্লিয়াসের জন্য একটি পরোক্ষ অপমান ছিল, যিনি প্রিসকাসের প্রতি তার বিতৃষ্নাকে গোপন করে ৬১২ সালে কনস্টান্টিনোপলে ফিরে এসেছিলেন। এদিকে, শাহীনের সৈন্যরা প্রিসকাসের অবরোধ থেকে পালিয়ে যায় এবং সিজারিয়া পুড়িয়ে দেয়, যা হেরাক্লিয়াসের অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রিসকাসকে শীঘ্রই কমান্ড থেকে সরানো হয়েছিল, সেই সাথে অন্যান্য যারা ফোকাসের অধীনে কাজ করেছিলেন তাদেরকেও কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। মরিসের একজন পুরানো জেনারেল ফিলিপপিকাসকে কমান্ডার-ইন-চিফ হিসাবে নিযুক্ত করা হয়, তবে তিনি যুদ্ধে জড়িত হওয়া এড়াতে নিজেকে পারস্যদের বিরুদ্ধে অযোগ্য প্রমাণ করেছিলেন। হেরাক্লিয়াস অবশেষে সেনাবাহিনীর কমান্ড দৃঢ় করার জন্য তার ভাই থিওডোরের সাথে নিজেকে কমান্ডার নিযুক্ত করেন।

খসরো পারস্যের সেনাপতি শাহরবারাজের নেতৃত্বে বাইজেন্টাইন সিরিয়ায় আক্রমণ চালানোর জন্য হেরাক্লিয়াসের সেনাপতিদের অযোগ্যতার সুযোগ নিয়েছিলেন। হেরাক্লিয়াস অ্যান্টিওকে আক্রমণ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, তবে সাইকিওনের সেন্ট থিওডোরের আশীর্বাদ সত্ত্বেও, হেরাক্লিয়াস এবং নিসেটাসের অধীনে বাইজেন্টাইন বাহিনী শাহিনের কাছে মারাত্মক পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। যুদ্ধের বিস্তারিত জানা যায়নি। এই বিজয়ের পরে পারস্যরা শহরটি লুট করে, অ্যান্টিওকের প্যাট্রিয়ার্ককে হত্যা করে এবং অনেক নাগরিককে নির্বাসিত করে। কিছু প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও রোমান বাহিনী সিলসিয়ান গেটে অ্যান্টিওকের উত্তরে অঞ্চলটি রক্ষা করার চেষ্টা করার সময় আবার হেরে যায়। পার্সিয়ানরা তখন টারসাস এবং সিলিসিয়ান সমভূমি দখল করে। এই পরাজয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে অর্ধেকে কেটে দেয়, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিশর এবং কার্থেজের এক্সারচেটের সাথে কনস্টান্টিনোপল এবং আনাতোলিয়ার স্থল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

জেরুজালেম দখল

সিরিয়ায় পারস্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তিশালী ছিল না; যদিও স্থানীয়রা দুর্গ নির্মাণ করেছিল, তারা সাধারণত পারস্যদের সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করেছিল। ৬১৩ সালে দামেস্ক, আপামিয়া এবং এমেসা শহরগুলির দ্রুত পতন হয়েছিল যা সাসানীয় সেনাবাহিনীকে আরও দক্ষিণে প্যালেস্টিনা প্রিমা আক্রমণ করার সুযোগ দিয়েছিল। নিসেতাস পারস্যদের প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছিলেন কিন্তু আধরিয়াতে পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি এমেসার কাছে একটি ছোট বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হন, তবে যেখানে উভয় পক্ষই প্রচুর হতাহতের শিকার হয়েছিল – মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২০,০০০। আরও গুরুতর যেটা, বাইজান্টাইন প্রতিরোধের দুর্বলতার কারণে ৬১৪ সালে পারস্য এবং তাদের ইহুদি মিত্ররা তিন সপ্তাহের অবরোধের পরে জেরুজালেম দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রাচীন সূত্রগুলি দাবি করে যে সেখানে ৫৭,০০০ বা ৬৬,৫০০ মানুষ নিহত হয়েছিল; প্যাট্রিয়ার্ক জাকারিয়াসহ আরও ৩৫,০০০ জনকে পারস্যে নির্বাসিত করা হয়েছিল।

শহরের অনেক গির্জা (চার্চ অফ দ্য রেজারেকশন বা হোলি সেপালক্রা সহ) পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ট্রু ক্রস, পবিত্র ল্যান্স এবং পবিত্র স্পঞ্জ সহ অসংখ্য ধ্বংসাবশেষ পারস্যের রাজধানী টেসিফনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অনেক খ্রিস্টান বাইজেন্টাইন এই ধ্বংসাবশেষের ক্ষতিকে ঐশ্বরিক অসন্তুষ্টির একটি স্পষ্ট চিহ্ন বলে মনে করেছিলেন। কেউ কেউ এই দুর্ভাগ্যের জন্য এবং সাধারণভাবে সিরিয়ার ক্ষতির জন্য ইহুদিদের দোষারোপ করেছিলেন। এমন খবর ছিল যে ইহুদিরা পারস্যদেরকে কিছু শহর দখল করতে সহায়তা করেছিল এবং ইহুদিরা এমন শহরগুলিতে খ্রিস্টানদের হত্যা করার চেষ্টা করেছিল যা পারস্যরা ইতিমধ্যে জয় করেছিল। তবে তাদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এবং তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই প্রতিবেদনগুলি ব্যাপকভাবে অতিরঞ্জিত এবং গণ হিস্টিরিয়ার ফলাফল হয়ে থাকতে পারে।

মিশর দখল 

৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে শাহরবারাজের বাহিনী মিশর আক্রমণ করে, মিশর ছিল এমন একটি বাইজান্টাইন প্রদেশ যার বেশিরভাগ তিন শতাব্দী ধরে যুদ্ধের পরও অক্ষত ছিল। মিশরে বসবাসকারী মনোফিসাইটরা ক্যালসেডোনিয়ান অর্থোডক্সের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যবাদী বাহিনীকে সহায়তা করতে আগ্রহী ছিল না। পরে তারা খোসরো দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল, তবে তারা ৬০০ থেকে ৬৩৮ সালের মধ্যে বাইজান্টাইন বাহিনীকে প্রতিরোধ করেনি এবং অনেকে পারস্য দখলকে নেতিবাচক ভাবে দেখেছিল। আলেকজান্দ্রিয়ায় বাইজেন্টাইন প্রতিরোধের নেতৃত্বে ছিলেন নিসেতাস। এক বছরের দীর্ঘ অবরোধের পরে আলেকজান্দ্রিয়ায় প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে, সম্ভবত একজন বিশ্বাসঘাতক পারস্যদের একটি অব্যবহৃত খালের কথা বলে দিলে পারস্যরা শহরটিতে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। এর ফলে নিসেতাস প্যাট্রিয়ার্ক জন দ্য আলমসগিভারের (যিনি মিশরে নিসেতাসের প্রধান সমর্থক) সাথে সাইপ্রাসে পালিয়ে যান। নিসেটাসের সাথে পরে কী হয়েছিল তা আর জানা যায় না, কেননা তার সম্পর্কে আর কোন কথা কোন নথিতে পাওয়া যায়নি। তবে হেরাক্লিয়াস সম্ভবত একজন বিশ্বস্ত কমান্ডার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। মিশর হারানো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের জন্য একটি মারাত্মক আঘাত ছিল, কারণ রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের জনসাধারণ খাদ্যের জন্য উর্বর মিশর থেকে আসা শস্যের চালানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এর ফলে এতদিন পর্যন্ত কনস্টান্টিনোপলে যে বিনামূল্যে শস্য রেশন দেয়া হতো (রোমের পূর্ববর্তী গ্রেইন ডোলের প্রতিধ্বনি) তা ৬১৮ সালে বিলুপ্ত করা হয়।

মিশর জয় করার পরে খোসরো হেরাক্লিয়াসকে এই চিঠিটি প্রেরণ করেছিলেন: “খোসরো হচ্ছেন দেবতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, এবং পৃথিবীর মালিক, আর হিরাক্লিয়াস হচ্ছেন তার নিকৃষ্ট ও নিষ্ঠুর দাস। কেন আপনি এখনও আমাদের শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করছেন এবং নিজেকে রাজা বলে অভিহিত করছেন? আমি কি গ্রীকদের ধ্বংস করিনি? আপনি বলেন যে আপনি আপনার ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখেন। কেন? তিনি কি আপনার হাত থেকে আমাকে সিজারিয়া, জেরুজালেম ও আলেকজান্দ্রিয়া হস্তান্তর করেননি? আমি কি কনস্টান্টিনোপলকেও ধ্বংস করব না? কিন্তু আমি আপনাদের পাপ ক্ষমা করে দেব, যদি আপনারা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং আপনাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে ফিরে আসেন। আর আমি আপনাদের জমি, আঙ্গুরক্ষেত ও জলপাই বাগান দেব এবং আপনাদের প্রতি সদয় দৃষ্টিতে তাকাব। সেই খ্রীষ্টের উপর নিরর্থক আশা নিয়ে নিজেকে ধোঁকা দেবেন না, যিনি সেই ইহুদীদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হননি যারা তাকে ক্রুশে পেরেক দিয়ে হত্যা করেছিল। এমনকি আপনি সমুদ্রের গভীরে আশ্রয় নিলেও আমি আমার হাত প্রসারিত করব এবং  আপনাকে নিয়ে যাব, আপনি চান বা না চান।” যাইহোক, আধুনিক পণ্ডিতরা চিঠিটির সত্যতা অস্বীকার করেছেন।

আনাতোলিয়া আক্রমণ

৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন সাসানীয়রা ক্যালসেডনে পৌঁছায়, সেবিওসের মতে, এই মুহুর্তে হেরাক্লিয়াস পদত্যাগ করতে সম্মত হয়েছিলেন এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যকে পারস্যের ক্লায়েন্ট রাষ্ট্রে পরিণত হতে দিতে প্রস্তুত ছিলেন, এমনকি দ্বিতীয় খোসরোকে সম্রাট বেছে নেবারও ব্যাপারটাও মেনে নিয়েছিলেন। ৬১৭ সালে ক্যালসেডন শাহিনের কাছে পতনের পর বাইজেন্টাইনদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে শুরু করে, যা কনস্টান্টিনোপলকে পারস্যদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। শাহীন বিনয়ের সাথে বাইজান্টাইনদের একটি শান্তি প্রতিনিধি দলকে গ্রহণ করে তাদের বলেছিলেন যে শান্তি আলোচনায় জড়িত হওয়ার এখতিয়ার তার নেই, ফলে হেরাক্লিয়াসকে সেই দলকে খোসরোর কাছে পাঠিয়েছিলেন, তবে খোসরো সেই শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর এটাই ছিল তাদের একটি বড় কৌশলগত ভুল। তবুও পারস্য বাহিনী শীঘ্রই তাদের সেনাবাহিনী আনাতোলিয়া থেকে প্রত্যাহার করে নেয়, সম্ভবত মিশরে তাদের আক্রমণের দিকে মনোনিবেশ করার জন্যই তারা এটা করেছিল। তবুও পারস্যরা তাদের সুবিধা বজায় রেখেছিল, ৬২০ বা ৬২২ সালের মধ্য তারা আনাতোলিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি আনসিরা দখল করেছিল। রোডস এবং পূর্ব ঈজিয়ানের আরও বেশ কয়েকটি দ্বীপ ৬২২-২৩ সালে পতিত হয়েছিল, যার ফলে কনস্টান্টিনোপল নৌ আক্রমণের হুমকিতে পড়ে। এর ফলে কনস্টান্টিনোপলের হতাশা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, হেরাক্লিয়াস তার সরকারকে আফ্রিকার কার্থেজে স্থানান্তরিত করার কথা বিবেচনা করেছিলেন।

বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন

খোসরোর চিঠিটি হেরাক্লিয়াসকে ভীত করেনি, তবে তাকে পারস্যদের বিরুদ্ধে মরিয়া আক্রমণের চেষ্টা করতে প্ররোচিত করেছিল। তিনি এরপর তার সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট অংশকে পুনর্গঠিত করেছিলেন যাতে তার বাহিনীগুলি লড়াই করতে পারে। ইতিমধ্যে, ৬১৫ সালে হেরাক্লিয়াস এবং তার পুত্র হেরাক্লিয়াস কনস্টান্টাইনের সাধারণ চিত্র সহ একটি নতুন, হালকা (৬.৮২ গ্রাম) রৌপ্য রাজকীয় মুদ্রা উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এখানে একটি বিশেষ খোদাই ছিল যা আগে কখনও দেখা যায়নি। সেটা ছিল মুদ্রার উপর খচিত লেখা “Deus adiuta Romanis”, অর্থাৎ “ঈশ্বর রোমানদের সাহায্য করুন”। কেগি (Kaegi) বিশ্বাস করেন যে এটি এই সময়ে সাম্রাজ্যের হতাশা প্রদর্শন করে। দেখা যায় সে সময় তামার ফলিসের ওজনও ১১ গ্রাম থেকে হ্রাস পেয়ে ৮ থেকে ৯ গ্রাম হয়েছে। হেরাক্লিয়াস প্রদেশগুলির সাসানীয়দের হাতে চলে যাবার কারণে বাইজান্টাইনদের রাজস্ব মারাত্মকভাবে হ্রাসের মুখোমুখি হয়েছিল; তদুপরি, ৬১৯ সালে একটি প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে, যা রাজস্ব আদায়কে আরও ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং ঐশ্বরিক প্রতিশোধের ভয়ও বাড়িয়ে তোলে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন বা ডিবেজমেন্ট এর মাধ্যমে বাইজেন্টাইনরা রাজস্ব হ্রাসের পরও তাদের ব্যয় বজায় রাখতে পারে।

এরপর হেরাক্লিয়াস সাসানীয়দের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের অর্থায়নের জন্য তার কর্মকর্তাদের বেতন অর্ধেক করেন, কর বৃদ্ধি করেন, জোর পূর্বক ঋণ আদায় করেন, এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের উপর চরম জরিমানা আরোপ করেন। তার ভাগ্নি মার্টিনার সাথে হেরাক্লিয়াসের ব্যভিচারমূলক বিয়ে নিয়ে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পাদ্রীরা পারস্যদের বিরুদ্ধে তার প্রচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন, সমস্ত খ্রিস্টান পুরুষদের লড়াই করার দায়িত্ব ঘোষণা করেন এবং কনস্টান্টিনোপলের সমস্ত স্বর্ণ ও রৌপ্য-প্লেটেড বস্তুর সমন্বয়ে তাকে একটি যুদ্ধ-ঋণ দেয়ার প্রস্তাব দেন। বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ এবং এমনকি হাগিয়া সোফিয়া থেকে মূল্যবান ধাতু এবং ব্রোঞ্জ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। অনেক ইতিহাসবিদ এই সামরিক অভিযানকে প্রথম “ক্রুসেড” বা কমপক্ষে ক্রুসেডের (উইলিয়াম অফ টায়ারের হাত ধরে শুরু হওয়া) পূর্বসূরী হিসাবে দেখেছেন। তবে কেগির মতো কেউ কেউ এই নামটির সাথে দ্বিমত পোষণ করেন কারণ ধর্ম এই যুদ্ধের একটি উপাদান ছিল মাত্র। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক একত্রিত হয়েছিল এবং গির্জার অর্থ দিয়ে তৈরি হওয়া অস্ত্র বহন করেছিল। হেরাক্লিয়াস নিজেই সামনের লাইন থেকে সেনাবাহিনীকে কমান্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুতরাং, বাইজেন্টাইন সৈন্যদের ঘাটতি পুনরায় পূরণ করা হয়েছিল, পুনরায় সজ্জিত করা হয়েছিল এবং এবারে একটি পূর্ণ কোষাগার বজায় রেখে একজন দক্ষ জেনারেল দ্বারা বাইজান্টিয়ান সেনাবাহিনী পরিচালিত হয়েছিল।

ইতিহাসবিদ জর্জ অস্ট্রোগোরস্কি মনে করতেন যে আনাতোলিয়ার পুনর্গঠনের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবকদের চারটি থিমে একত্রিত করা হয়েছিল, যেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের বংশগত সামরিক সেবার শর্তে জমির অবিচ্ছেদ্য অনুদান দেওয়া হয়েছিল। যাইহোক, আধুনিক পণ্ডিতরা সাধারণত এই তত্ত্বটিকে অস্বীকার করেন, এবং মনে করেন এই থিমগুলি হেরাক্লিয়াসের উত্তরসূরি দ্বিতীয় কনস্টান্সের অধীনে পরে তৈরি করা হয়েছে।

বাইজেন্টাইন পাল্টা আক্রমণ

৬২২ সালের মধ্যে, হেরাক্লিয়াস পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ৬২২ সালের ৪ এপ্রিল রবিবার ইস্টার উদযাপনের পরের দিন তিনি কনস্টান্টিনোপল ত্যাগ করেন। তার ছোট ছেলে, হেরাক্লিয়াস কনস্টান্টাইন, প্যাট্রিয়ার্ক সার্জিয়াস এবং প্যাট্রিসিয়ান বোনাসের দায়িত্বে রিজেন্ট বা ভারপ্রাপ্ত রাজা হিসেবে কনস্ট্যান্টিনোপলে কাজ করেন। হেরাক্লিয়াস গ্রীষ্মকাল জুড়ে তার সেনাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা এবং সেই সাথে নিজের জেনারেলশিপ উন্নত করেন। শরৎকালে হেরাক্লিয়াস ক্যাপাডোসিয়ায় যাত্রা করে ইউফ্রেটিস উপত্যকা থেকে আনাতোলিয়া পর্যন্ত পারস্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে হুমকির সৃষ্টি করেন। এর ফলে শাহরবারাজের অধীনে আনাতোলিয়ায় পারস্য বাহিনী বিথিনিয়া এবং গালাতিয়ার ফ্রন্ট-লাইন থেকে পূর্ব আনাতোলিয়ায় পিছু হটতে বাধ্য হয়, যাতে তারা ইরানে হেরাক্লিয়াসের প্রবেশ আটকাতে পারে।

পরবর্তীতে কী ঘটেছিল তা পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তবে হেরাক্লিয়াস অবশ্যই ৬২২ এর শরৎকালে শাহরবারাজের বিরুদ্ধে একটি দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করেছিলেন। বিজয়ের মূল কারণটি ছিল এম্বুশ করার জন্য লুকিয়ে থাকা পারস্য বাহিনীকে হেরাক্লিয়াস আবিষ্কার করে তার প্রতিক্রিয়ায় সাথে সাথে পশ্চাদপ্রসারণ করেছিলেন। পার্সিয়ানরা বাইজেন্টাইনদের তাড়া করার জন্য তাদের সেনাছাউনি ছেড়ে চলে যায়, যার ফলে হেরাক্লিয়াসের অভিজাত অপ্টিম্যাটোই অনুসরণকারী পার্সিয়ানদের আক্রমণ করে, যার ফলে তারা পালিয়ে যায়। এভাবে  হেরাক্লিয়াস আনাতোলিয়াকে পারস্যদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। যাইহোক, এই জয়ের পরও হেরাক্লিয়াসকে তার সাম্রাজ্যের বলকান অঞ্চলগুলোকে আভারদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কনস্টান্টিনোপলে ফিরে আসতে হয়েছিল, তাই তিনি পন্টাসে তার সেনাবাহিনীকে শীতকাল যাপনের জন্য ছেড়ে আসেন।

আভার হুমকি

বাইজেন্টাইনরা যখন পারস্যদের সাথে যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তখন আভার এবং স্লাভরা ৬১৪ সালে বলকান অঞ্চলে প্রবেশ করে সিঙ্গিদুনাম (বেলগ্রেড), ভিমিনাসিয়াম (কোস্তলাক), নাইসাস (নিসা) এবং সার্ডিকা (সোফিয়া) সহ বেশ কয়েকটি বাইজেন্টাইন শহর দখল করে নিয়েছিল, এবং সালোনা শহর ধ্বংস করেছিল। সেভিলের ইসিডোর তো দাবি করেছিলেন, স্লাভরা বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে “গ্রীস” কেড়ে নিয়েছিল। আভাররা থ্রেস আক্রমণ শুরু করে, এমনকি কনস্টান্টিনোপলের গেটের কাছেও তারা বাইজান্টাইনদের বাণিজ্য এবং কৃষির জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। তবে কনস্টান্টিনোপলের পরে যে শহরটি বলকানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইজেন্টাইন শহর, সেই থেসালোনিকা দখল করার জন্য আভার এবং স্লাভদের অসংখ্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, যার ফলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বলকান অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলের অন্যান্য ছোট শহর যেমন জাদার (জাদার), ট্রাগুরিয়াম (ট্রোগির), বুটুয়া (বুদভা), স্কোড্রা (শকোদার), এবং লিসাস-ও (লেজে) এদের আক্রমণ থেকে বেঁচে যায়।

এই আক্রমণগুলির বিরুদ্ধে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার কারণে, বাইজেন্টাইনরা পারস্যদের বিরুদ্ধে তাদের সমস্ত বাহিনী ব্যবহার করতে পারেনি। হেরাক্লিয়াস আভার খাগানের কাছে একজন দূত প্রেরণ করে বলেছিলেন, তারা দানিয়ুবের উত্তরে নিজেদের সেনাকে প্রত্যাহার করে নিলে তার বিনিয়ময়ে আভারদেরকে শ্রদ্ধার্ঘ দেয়া হবে। আভার সেনাবাহিনী থ্রেসের হেরাক্লিয়াতে অবস্থান করছিল। তাদের খাগান ৬২৩ সালের ৫ই জুন সেখানে একটি বৈঠকের জন্য অনুরোধ করে বাইজান্টাইনদেরকে উত্তর পাঠিয়েছিলেন। হেরাক্লিয়াস তার রাজসভা সমেত উপস্থিত হয়ে এই বৈঠকে বসতে সম্মত হন। তবে খাগানরা হেরাক্লিয়াসকে আক্রমণ এবং বন্দি করার জন্য হেরাক্লিয়ার পথে অশ্বারোহীদেরকে মোতায়ন করেছিল, যাতে তারা হেরাক্লিয়াসকে বন্দি করে বড় আকারের মুক্তিপণ দাবি করতে পারে।

ভাগ্যক্রমে হেরাক্লিয়াসকে সময়মতো সতর্ক করা হয়েছিল, ফলে তিনি পালিয়ে যান, আর আভাররা তাকে কনস্টান্টিনোপলের গেইট পর্যন্ত তাকে ধাওয়া করে ব্যর্থ হয়। তবে তার রাজসভার অনেক সদস্য, পাশাপাশি সম্রাটের সাথে দেখা করতে আসা কথিত ৭০,০০০ থ্রেসিয়ান কৃষক খাগানের সেনাদের দ্বারা বন্দী এবং নিহত হয়। এই বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও আভারদের সাথে শান্তি স্থাপনের জন্য হেরাক্লিয়াস তাদেরকে দুই লক্ষ সোলিডি এবং জিম্মি হিসেবে নিজের অবৈধ পুত্র জন অ্যাথালারিকোস, ভাগ্নে স্টিফেন এবং প্যাট্রিসিয়ান বোনাসের অবৈধ পুত্রকে বড়দের হাতে তুলে দেন। এর ফলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আভার সংকট থেকে মুক্ত হয়, এবং তাদের যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে পুরোপুরি পারস্যদের ওপর ফোকাস করতে সক্ষম হয়।

পারস্যের উপর বাইজেন্টাইন আক্রমণ

হেরাক্লিয়াস আনু. ৬২৪ সালে খোসরোকে শান্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, অন্যথায় তিনি ইরান আক্রমণ করবেন বলে হুমকি দিয়েছিলেন, তবে খোসরো প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ৬২৪ সালের ২৫ শে মার্চ, হেরাক্লিয়াস পারস্যের কেন্দ্রস্থলে আক্রমণ করার জন্য কনস্টান্টিনোপল ত্যাগ করেছিলেন। তিনি স্বেচ্ছায় তার পেছনে বা সমুদ্রের সাথে তার যোগাযোগ সুরক্ষিত করার যে কোনও প্রচেষ্টা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি আর্মেনিয়া এবং আধুনিক আজারবাইজানের মধ্য দিয়ে সরাসরি পারস্যের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ করার জন্য যাত্রা করেছিলেন। ওয়াল্টার কেগির মতে, হেরাক্লিয়াস ৪০,০০০ এর বেশি সেনা নিয়ে আক্রমণ করেননি, এবং খুব সম্ভব তার সেনাবাহিনী ছিল ২০,০০০ থেকে ২৪,০০০ জনের। খোসরো তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি ককেশাস ভ্রমণের আগে ক্যাপাডোসিয়ায় এসে সিজারিয়া পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

হেরাক্লিয়াস আরাক্স নদী বরাবর অগ্রসর হয়ে পারস্য-নিয়ন্ত্রিত আর্মেনিয়ার রাজধানী ডিভিন এবং নাখচিভানকে ধ্বংস করে দেন। গানজাকায় হেরাক্লিয়াস খোসরোর প্রায় ৪০,০০০ সেনার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন। অনুগত আরবদের ব্যবহার করে, তিনি খোসরোর কিছু রক্ষীকে বন্দী করে হত্যা করেছিলেন, যার ফলে পারস্য সেনাবাহিনী ভেঙে যায়। হেরাক্লিয়াস এরপর তাখত-ই-সুলেইমানের বিখ্যাত জরথুস্ট্রিয়ান অগ্নি মন্দির আদুর গুশনস্প (Adur Gushnasp) ধ্বংস করেন। হেরাক্লিয়াসের অভিযান আদুরবাদাগনে খোসরোর বাসভবন গাইশাওয়ান পর্যন্ত যায়।

হেরাক্লিয়াস শীতকাল ককেশীয় আলবেনিয়ায় কাটান ও পরের বছরের আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনী সংগ্রহ করেন। এদিকে খোসরো চাননি যে, হেরাক্লিয়াসকে আলবেনিয়ায় নীরবে বিশ্রাম নিন। তিনি হেরাক্লিয়াসের বাহিনীকে ফাঁদে ফেলতে ও একে ধ্বংস করার জন্য শাহরবাজ, শাহীন এবং শাহরাপ্লাকানের নেতৃত্বে তিনটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। শাহরাপ্লাকান গিৰিপথগুলো দখল করার লক্ষ্যে সিউনিক পর্যন্ত জমি অঞ্চল পুনরুদ্ধার করেন। ককেশীয় আইবেরিয়ার মধ্য দিয়ে হেরাক্লিয়াসের পশ্চাদপসরণ আটকাতে শাহরবারাজকে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং শাহীনকে বিটলিস গিরিপথ অবরোধ করতে প্রেরণ করা হয়েছিল। হেরাক্লিয়াস, আলাদা আলাদাভাবে এই পারস্য সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার পরিকল্পনা করেন, এবং তিনি তার উদ্বিগ্ন লাজিক, আবাসিয়ান এবং আইবেরিয়ান মিত্রদের এবং নিজেদের সৈন্যদেরকে বলেন, “শত্রুদের সংখ্যার কথা  ভেবে বিচলিত হবেন না, কারণ ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমাদের একেক জন শত্রুদের দশ হাজার জনকে ধাওয়া করবে।”

দু’জন বাইজান্টাইন সৈন্যকে শাহরবারাজের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল, তারা শাহরবরাজের কাছে এসে বলে, তারা বাইজান্টাইন সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসেছে, এবং বাইজান্টাইন বাহিনী পালিয়ে শাহীনের সেনাবাহিনীর দিকে যাচ্ছে। এদিকে পারস্য কমান্ডারদের মধ্যে ঈর্ষা ছিল। হেরাক্লিয়াসের বাহিনী যদি তার বাহিনীর বদলে শাহীনের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়, তাহলে বিজয়ের গৌরব তার হাতছাড়া হয়ে যাবে। তার বিজয়ের গৌরবের অংশ নিতে তিনি তাড়াহুড়ো করেন। হেরাক্লিয়াস টিগ্রানাকার্টে (Tigranakert) শাহরবরাজের বাহিনীর মুখোমুখি হন ও পরাজিত করেন, আর তারপর তিনি একে একে শাহরাপ্লাকান ও শাহীনের বাহিনীকে পরাজিত করেন। শাহীনের সাপ্লাই কানেকশন ধ্বংস করা হয়, আর শাহরাপ্লাকান (একটি সূত্র অনুসারে) নিহত হন, যদিও পরে তাকে পুনরায় উপস্থিত হতে দেখা যায়। এই বিজয়ের পরে হেরাক্লিয়াস আরাক্সেস নদী অতিক্রম করে অপর দিকের সমভূমিতে সেনাশিবির বানান। শাহীন, তার এবং শাহরাপ্লাকানের সেনাবাহিনীর অবশিষ্টাংশ নিয়ে, হেরাক্লিয়াসের সন্ধানে শাহরবারাজের সাথে যোগ দিয়েছিলেন, তবে জলাভূমি তাদের ধীর করে দিয়েছিল। আলিওভিটে শাহরবারাজ তার বাহিনীকে বিভক্ত করেছিলেন, হেরাক্লিয়াসকে আক্রমণ করার জন্য একটি ভাগে তিনি প্রায় ৬,০০০ সৈন্য প্রেরণ করেন এবং অবশিষ্ট সৈন্যরা আলিওভিটে অবস্থান করেছিল। এর জবাবে হেরাক্লিয়াস ৬২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পারস্যের প্রধান শিবিরে রাতের বেলায় আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে এটি ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে শাহরবারাজ নিজের হারেম, মালামাল ও সৈন্য হারিয়ে কেবল একাকী পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।

হেরাক্লিয়াস শীতের বাকি সময় ভ্যান হ্রদের উত্তরে কাটিয়েছিলেন। ৬২৫ সালে তার বাহিনী ইউফ্রেটিসের দিকে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। মাত্র সাত দিনের মধ্যে তিনি আরারাত পর্বত এবং আরসানিয়াস নদীর তীরবর্তী ২০০ মাইল অতিক্রম করে উচ্চ টাইগ্রিসের গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ আমিদা এবং মার্টিরোপোলিস দখল করেন। হেরাক্লিয়াস এরপর ইউফ্রেটিসের দিকে অগ্রসর হন, আর শাহরবারাজ সেনাবাহিনী নিয়ে তার পিছু নেয়। আরব সূত্র মতে, শাহরবারাজের বাহিনী হেরাক্লিয়াসকে সাতিদামা বা ব্যাটম্যান সু নদীতে আটকায় এবং পরাজিত করে; অবশ্য বাইজেন্টাইন সূত্রে এই ঘটনার উল্লেখ নেই। তারপরে আদানার কাছে সারুস নদীতে হেরাক্লিয়াস এবং শাহরবারাজের মধ্যে আরেকটি ছোটখাট সংঘর্ষ হয়েছিল। শাহরবারাজের সেনা ও বাইজেন্টাইনদের সেনা নদীর দুই পারে অবস্থান নেয়। নদীর ওপর একটি সেতু ছিল এবং বাইজেন্টাইনরা তাৎক্ষণিকভাবে নদীটি অতিক্রম করে আক্রমণ করেছিল। শাহরবারাজ বাইজেন্টাইনদেরকে এমবুশ করার জন্য পশ্চাদপসরণের ভান করেন এবং হেরাক্লিয়াসের সেনাবাহিনীর অগ্রদূত বাহিনী কয়েক মিনিটের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে পারস্যরা সেতুটি কাভার করতে অবহেলা করেছিল, এবং হেরাক্লিয়াস পারস্যদের ছোড়া তীরকে ভয় না পেয়ে রিয়ারগার্ড বা পেছনের বাহিনী দিয়ে ওপারে চার্জ করে পারস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মোর ঘুরিয়ে দিয়েছিল। শাহরবারাজ হেরাক্লিয়াসের প্রতি তার প্রশংসা প্রকাশ করে একজন বিদ্বেষী গ্রীককে বলেছিলেন: “আপনার সম্রাটকে দেখুন! তিনি এই তীর ও বর্শাগুলোকে ভয় পান না, ভয় পান কেবল অপমানকে!” বাইজান্টাইন পাবলিক-স্পিচ লেখক বা প্যানেজাইরিস্টদের মতে এই সারুসের যুদ্ধে (Battle of Sarus) হেরাক্লিয়াস সফলভাবে পশ্চাদপ্রসারণ করতে সক্ষম হন, আর যুদ্ধে ওপর বাইজান্টাইন বাহিনী ট্রেবিজন্ডে শীতকাল যাপন করে।

সাসানীয়দের কনস্টান্টিনোপল অবরোধ

বাইজেন্টাইনদের পরাজিত করার জন্য একটি নির্ণায়ক পাল্টা আক্রমণের প্রয়োজন বুঝতে পেরে খোসরো বিদেশী সহ সমস্ত সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়ে দুটি নতুন সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছিলেন। শাহিনকে ৫০,০০০ সেনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি হেরাক্লিয়াসকে ইরান আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখতে মেসোপটেমিয়া এবং আর্মেনিয়ায় অবস্থান করেছিলেন; অন্যদিকে শাহরবারাজের নেতৃত্বে একটি ছোট সৈন্যদল হেরাক্লিয়াসের পাশ কাটিয়ে চলে যায় এবং কনস্টান্টিনোপল থেকে বসফরাস জুড়ে পারস্য ঘাঁটি ক্যালসেডনের দিকে যাত্রা করে। খোসরো আভারদের খাগানের সাথেও সমন্বয় করেছিলেন যাতে ইউরোপীয় এবং এশিয়াটিক উভয় পক্ষ থেকে কনস্টান্টিনোপলে সমন্বিত আক্রমণ শুরু করা যায়। পারস্য সেনাবাহিনী ক্যালসেডনে অবস্থান গ্রহণ করেছিল, অন্যদিকে আভাররা কনস্টান্টিনোপলের ইউরোপীয় অংশে নিজেদের স্থাপন করেছিল এবং ভ্যালেনসের অ্যাকুইডাক্টকে ধ্বংস করেছিল। বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীর বসফরাস প্রণালীর নিয়ন্ত্রণের কারণে, পারস্যরা তাদের মিত্রকে সহায়তা করার জন্য ইউরোপীয় অংশে সৈন্য পাঠাতে পারেনি। এটি অবরোধের কার্যকারিতা হ্রাস করেছিল, কারণ পারস্যরা অবরোধ যুদ্ধে বিশেষজ্ঞ ছিল। তদুপরি, পারস্য এবং আভারদের এই বাইজান্টাইনদের দ্বারা সুরক্ষিত বসফরাস জুড়ে যোগাযোগ করতে অসুবিধা হয়েছিল – যদিও নিঃসন্দেহে, দুটি বাহিনীর মধ্যে কিছু যোগাযোগ ছিলই।

কনস্টান্টিনোপলের প্রতিরক্ষা প্যাট্রিয়ার্ক সার্জিয়াস এবং প্যাট্রিসিয়ান বোনাসের কমান্ডের অধীনে ছিল। খবরটি শোনার পরে হেরাক্লিয়াস তার সেনাবাহিনীকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছিলেন; যদিও তিনি বিচার করেছিলেন যে রাজধানী তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ছিল, তবুও তিনি ডিফেন্ডারদের মনোবল বাড়ানোর জন্য কনস্টান্টিনোপলে কিছু রিএনফোর্সমেন্ট প্রেরণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীর আরেকটি অংশ তার ভাই থিওডোরের কমান্ডের অধীনে ছিল এবং শাহিনের সাথে মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল, যখন তৃতীয় এবং ক্ষুদ্রতম অংশটি তার নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিল, পারস্যের কেন্দ্রস্থলে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে।

৬২৬ সালের ২৯ জুন, কনস্ট্যান্টিনোপলের দেয়ালে একটি সমন্বিত আক্রমণ শুরু হয়। প্রাচীরের অভ্যন্তরে প্রায় ১২,০০০ সুপ্রশিক্ষিত বাইজেন্টাইন অশ্বারোহী সৈন্য (সম্ভবত বিচ্ছিন্ন) ইউরোপের সমস্ত রোমান সাম্রাজ্য-ভিত্তিক শাসন অপসারণ করতে বদ্ধপরিকর প্রায় ৮০,০০০ আভার এবং স্ক্লেভেনিদের (স্লাভ, তখন আভারদের অধীনস্ত ছিল) বাহিনীর বিরুদ্ধে শহরটি রক্ষা করেছিল। যাইহোক, যখন আভাররা থিওডোসিয়ান প্রাচীরের দিকে ভারী অবরোধ সরঞ্জামগুলি এগিয়ে যেতে শুরু করে তখনই তাদের অবরোধ স্থাপনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এক মাস ধরে ক্রমাগত বোম্বার্ডমেন্ট (মূলত ক্যাটপাল্ট, মাংগোনেল ও অন্যান্য সিজ ইঞ্জিন দিয়ে স্টোন প্রজেক্টাইল ছোড়া) সত্ত্বেও তারা ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে প্যাট্রিয়ার্ক সার্জিয়াসের ধর্মীয় উৎসাহ এবং ভার্জিন মেরির আইকন নিয়ে প্রাচীর বরাবর সারজিয়াসের শোভাযাত্রার কারণে কনস্টান্টিনোপলের দেয়ালের অভ্যন্তরে সেনাদের মনোবল উঁচু ছিল, যা তাদের বিশ্বাস করে যে, বাইজেন্টাইনরা ঐশ্বরিক সুরক্ষার অধীনে রয়েছে। তদুপরি, কনস্টান্টিনোপলের আশেপাশের কৃষকদের মধ্যে ধর্মীয় উদ্যমের জন্য প্যাট্রিয়ার্কদের আর্তনাদ আরও কার্যকর হয়ে ওঠে কারণ তারা হিথেন্স বা অ-খ্রিস্টানদের মুখোমুখি হয়েছিল। যখন আভার-স্লাভিক এবং পারস্য নৌবহর দুটি ভিন্ন নৌ-যুদ্ধে ডুবে গিয়েছিল, তখন আক্রমণকারীরা আতঙ্কিত হয়ে দৃশ্যত এই বিশ্বাসে অবরোধ পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায় যে, ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের জন্য বাইজান্টিয়ানরা জয়লাভ করেছে।

৭ই আগস্ট, বসফরাস জুড়ে সৈন্যদের বহনকারী পারস্য ভেলাগুলির একটি বহরকে বাইজেন্টাইন জাহাজ ঘিরে ফেলে ও ধ্বংস করে। আভারদের অধীনে স্লাভরা গোল্ডেন হর্ন এর ওপারে থেকে সমুদ্রের দেয়াল আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল, যখন প্রধান আভার বাহিনী স্থল প্রাচীর আক্রমণ করেছিল। প্যাট্রিসিয়ান বোনাস এর গ্যালি যুদ্ধতরীগুলি স্লাভিক নৌকাগুলিকে ধাক্কা মেরে ধ্বংস করে দেয়, আর ৬ই আগস্ট থেকে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত আভার ভূমি আক্রমণও ব্যর্থ হয়েছিল। থিওডোর শাহীনের উপর চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করেন (ধারণা করা হয় শাহীন হতাশায় মারা গিয়েছিলেন)। আভাররা দুই দিনের মধ্যে বলকান পশ্চাদভূমিতে ফিরে যায়, আর কখনও কনস্টান্টিনোপলকে গুরুতর হুমকি দেয়নি। অবশ্য শাহরবারাজের সেনাবাহিনী তখনও ক্যালসেডনে শিবির স্থাপন করেছিল, তবে কনস্টান্টিনোপলের জন্য আর কোন হুমকি ছিলনা। অবরোধ তুলে নেওয়া এবং ভার্জিন মেরির কথিত ঐশ্বরিক সুরক্ষার জন্য ধন্যবাদ হিসাবে, একজন অজানা লেখক বিখ্যাত আকাথিস্ট হিম রচনা করেছিলেন, আর সেই অজানা লেখক সম্ভবত প্যাট্রিয়ার্ক সার্জিয়াস বা পিসিডিয়ার জর্জ ছিলেন।

যাই হোক, সাসানীয় সম্রাট খসরু পারস্য জেনারেল শাহরবারাজ এর হত্যার আদেশ দিয়ে একটি চিঠি পাঠান, যা বাইজান্টাইনদের হাতে পড়ে যায়, আর হেরাক্লিয়াস এটা শাহরবারাজকে দেখলে শাহরবারাজ হেরাক্লিয়াসের পক্ষে চলে যান। এরপর শাহরবারাজ তার সেনাবাহিনীকে উত্তর সিরিয়ায় স্থানান্তরিত করেছিলেন, যেখানে তিনি সহজেই এক মুহুর্তের নোটিশে খোসরো বা হেরাক্লিয়াসকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তবুও, খোসরোর সবচেয়ে দক্ষ জেনারেলকে নিরপেক্ষ করার সাথে সাথে হেরাক্লিয়াস তার শত্রুকে তার সেরা এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ সৈন্যদের একাংশ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, সেই সাথে তিনি এভাবে তার নিজের সেনাবাহিনীর একাংশকেও ইরান আক্রমণের আগে সুরক্ষিত করেছিলেন।

বাইজেন্টাইন-তুর্কি জোট ও তৃতীয় পারসো-তুর্কি যুদ্ধ

তৃতীয় পার্সো-তুর্কি যুদ্ধ ছিল সাসানীয় সাম্রাজ্য এবং পশ্চিম তুর্কি খাগানাতের মধ্যে তৃতীয় এবং চূড়ান্ত সংঘাত। কনস্টান্টিনোপল অবরোধের সময়, হেরাক্লিয়াস অধীনে বাইজেন্টাইন উৎসে জিবেলের (Ziebel) “খাজার” নামে পরিচিত লোকদের সাথে একটি জোট গঠন করেছিলেন। এই খাজাররা এখন সাধারণত টং ইয়াবঘুর (Tong Yabghu) নেতৃত্বে গোকতুর্কের পশ্চিম তুর্কি খাগানাত হিসাবে পরিচিত, অর্থাৎ টং ইয়াবঘুই হল বাইজান্টাইন উৎসের জিবেল। হেরাক্লিয়াস টং ইয়াবঘুকে অসাধারণ উপহারসামগ্রী এবং হেরাক্লিয়াস ও তার প্রথম স্ত্রী ইউডোকিয়ার একমাত্র কন্যা ইউডোক্সিয়া এপিফানিয়ার সাথে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পারস্যদের বিরুদ্ধে এই জোট তৈরি করেন। তৃতীয় পার্সো-তুর্কি যুদ্ধ সর্বশেষ বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের পটভূমির উপর হয়েছিল এবং সেই সব নাটকীয় ঘটনাগুলির (নিনেভেহর যুদ্ধ, পারস্যের ইসলামী বিজয়) সূচনা হিসাবে কাজ করেছিল যা পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যকে পরিবর্তন করেছিল।

আভার এবং পারস্যদের দ্বারা কনস্টান্টিনোপলের প্রথম অবরোধের পরে, বিপর্যস্ত বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস নিজেকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেছিলেন। তিনি ট্রান্সককেশিয়ার খ্রিস্টান আর্মেনীয় শক্তির উপর নির্ভর করতে পারতেন না, কারণ তাদেরকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অর্থোডক্স চার্চ ধর্মদ্রোহী বা হেরেটিক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল এবং এমনকি আইবেরিয়ার রাজা ধর্মীয়সহিষ্ণু পারস্যদের সাথে বন্ধুত্ব করাটাকে বেছে নিয়েছিলেন। এই হতাশাজনক পটভূমিতে হেরাক্লিয়াস পশ্চিম তুর্কি খানাতের খাগান টং ইয়াবঘুর মধ্যেই একটি প্রাকৃতিক মিত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। প্রাচ্যে, ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে, তুর্কিরা সাসানীয় দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সিন্ধু পর্যন্ত বাকট্রিয়া এবং আফগানিস্তান দখল করে এবং তোখারিস্তানের ইয়াবঘুস প্রতিষ্ঠা করে। পূর্বে ৫৬৮ সালে ইস্তামির অধীনে তুর্কিরা বাইজান্টিয়ামের দিকে ঝুঁকেছিল যখন বাণিজ্য ইস্যুতে ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছিল।  ইস্তামি সোগডিয়ান কূটনীতিক মানিয়ার নেতৃত্বে দূতেদের একটি দল সরাসরি কনস্টান্টিনোপলে প্রেরণ করেছিলেন, যা সেখানে ৫৬৮ সালে পৌঁছেছিল এবং দ্বিতীয় জাস্টিনকে উপহার হিসাবে কেবল সিল্কই দেয়নি, সেই সাথে  সাসানীয় ইরানের বিরুদ্ধে একটি জোটেরও প্রস্তাব দিয়েছিল। দ্বিতীয় জাস্টিন তাতে সম্মত হন এবং তুর্কি খাগানাতে একটি দূত দল প্রেরণ করেন, যা সরাসরি চীনা রেশম বাণিজ্য নিশ্চিত করে, যা সোগদিয়ানদের কাছে কাঙ্ক্ষিত ছিল।

৬২৫ সালে হেরাক্লিয়াস অ্যান্ড্রু নামে তার দূতকে স্তেপ অঞ্চলে প্রেরণ করেছিলেন, যিনি সামরিক সহায়তার বিনিময়ে খাগানকে কিছু “বিস্ময়কর সম্পদ” দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। খাগান, তার পক্ষ থেকে, সিল্ক রুট বরাবর চীনা-বাইজেন্টাইন বাণিজ্য সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন, যা দ্বিতীয় পারসো-তুর্কি যুদ্ধের পরে পারস্যদের দ্বারা বিঘ্নিত হয়েছিল। তিনি সম্রাটের কাছে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন যে “আমি আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব এবং আপনার সাহায্যের জন্য আমার সাহসী সৈন্যদের সাথে আসব”। ১,০০০ ঘোড়সওয়ারের একটি ইউনিট পারস্য ট্রান্সককেশিয়ার মধ্য দিয়ে লড়াই করে আনাতোলিয়ার এসে বাইজেন্টাইন শিবিরে খাগানের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল।

৬২৭ সালের গোড়ার দিকে, গোকতুর্কস এবং তাদের খাজার মিত্ররা দারবান্দে ক্যাস্পিয়ান গেটসের কাছে পৌঁছেছিল। এই নবনির্মিত দুর্গটি ছিল আঘভানিয়ার (বর্তমান আজারবাইজান) উর্বর ভূমির একমাত্র প্রবেশদ্বার। লেভ গুমিলেভ লক্ষ্য করেছেন যে আঘভানিয়ার হালকা সশস্ত্র মিলিশিয়া টং ইয়াবঘুর নেতৃত্বে ভারী অশ্বারোহী বাহিনীর কাসে কিছুই ছিলনা। তার সৈন্যরা দারবান্দে আক্রমণ করে এবং আঘভানিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও এটিকে পুরোপুরি লুণ্ঠন করে। দারবান্দের পতন এবং লুণ্ঠন আর্মেনিয়ান ইতিহাসবিদ মোভসেস কাগানকাটভাতসি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছিলেন, যিনি এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বলে মনে করা হয়:

“আমাদের সম্মুখীন সর্বশক্তিমান অভিশাপের আগমনের সাথে সাথে আক্রমণকারীরা (তুর্কিরা) সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে তাদের ভিত অব্দি ভেঙে ফেলে। ভয়ংকর কুৎসিত, নিকৃষ্ট, বিস্তৃত মুখের, চোখের পলকবিহীন এবং নারীর মতো লম্বা প্রবাহিত চুলের ভিড়ের ভয়ংকর বিপদ দেখে এক বিরাট আতঙ্ক (কাঁপুনি) এই অঞ্চল অধিবাসীদের গ্রাস করেছিল। তারা আরও ভয় পেয়ে গেল যখন তারা নির্ভুল ও শক্তিশালী (খাজার) তীরন্দাজদের দেখেছিল, যাদের তীর ভারী শিলাপাথরের মতো তাদের উপর বর্ষণ করেছিল, এবং কীভাবে তারা (খাজাররা) সমস্ত লজ্জা হারিয়ে ফেলা নেকড়েদের মতো তাদের উপর পড়ে ছিল এবং শহরের রাস্তায় এবং স্কোয়ারে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেছিল। তাদের চোখে সুন্দরী, সুদর্শন, যুবক-যুবতীদের প্রতি কোনো করুণা ছিল না; তারা অযোগ্য, নিরীহ, পঙ্গু বা বৃদ্ধদেরও রেহাই দেয়নি; তাদের কোন করুণা ছিল না এবং শিশুদেরকে তাদের নিহত মায়েদের আলিঙ্গন করতে দেখে তাদের হৃদয় সংকুচিত হয়নি; বিপরীতে, তারা দুধের মতো তাদের স্তন থেকে রক্ত চুষছিল।”

অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচিত দুর্গটির পতন সারা দেশে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। আঘভানিয়ান বাহিনী তাদের রাজধানী পার্তাভে ফিরে যায়, যেখান থেকে তারা ককেশাস পর্বতমালার জন্য যাত্রা করেছিল। গোকতুর্ক এবং খাজাররা কালানকাতুয়েক গ্রামের কাছে তাদের পরাজিত করেছিল, যেখানে তাদের হয় হত্যা করা হয়েছিল বা বন্দী করা হয়েছিল। বিজয়ীরা আঘভানিয়ার উপর একটি ভারী কর ব্যবস্থা আরোপ করেছিল, যেমনটি মোভসেস রিপোর্ট করেছেন:

“উত্তরের লর্ড সারা দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালান। তিনি তাঁর ওয়ার্ডেনদের সমস্ত ধরণের কারিগরদের সাথে কাজ করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন, বিশেষত যারা সোনা ধোয়া, রূপা এবং লোহা উত্তোলনের পাশাপাশি তামার বস্তু তৈরিতে দক্ষ ছিল। তিনি পারস্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঐতিহ্যগতভাবে আরোপিত দিদ্রাখমা ছাড়াও মহান কুরা এবং আরাস নদী থেকে মৎস্যজীবী এবং পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন।”

তুর্কি-বাইজেন্টাইন আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল আইবেরিয়া রাজ্য, যার শাসক স্টেফানাস দ্বিতীয় খোসরোর অধীনস্ত ছিলেন। মোভসেস কাগানকাটভাটসির ভাষায়, খাজাররা “তিবিলিসীর বিখ্যাত এবং মহান সাইবারিটিক বাণিজ্য নগরীকে ঘিরে ফেলে এবং অবরুদ্ধ করে,” যার পরে সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের সাথে যোগ দেন।

হেরাক্লিয়াস এবং টং ইয়াবঘু (বাইজেন্টাইন উৎসগুলিতে জিবেল নামে পরিচিত) নারিকালার দেয়ালের নীচে মিলিত হয়েছিলেন। ইয়াবঘু সম্রাটের কাছে গেলেন, তাঁর কাঁধে চুম্বন করলেন এবং মাথা নত করলেন। বিনিময়ে, হেরাক্লিয়াস বর্বর শাসককে আলিঙ্গন করলেন, তাকে তার পুত্র বলে অভিহিত করলেন এবং তাকে তার নিজের ডায়াডেম দিয়ে মুকুট দান করলেন। আসন্ন ভোজের সময় খাজার নেতারা কানের দুল এবং কাপড়ের আকারে প্রচুর উপহার পেয়েছিলেন, যখন ইয়াবঘুকে সম্রাটের কন্যা ইউডোক্সিয়া এপিফানিয়ার হাত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

অবরোধটি খুব বেশি অগ্রগতি ছাড়াই চলতে থাকে, অবরুদ্ধ অংশের পক্ষ থেকে ঘন ঘন স্যালি বা হঠাৎ আক্রমণ হচ্ছিল, যার একটিতে তাদের রাজা মারা যান। তিফলিস অবরোধের সময় বাইজেন্টাইনরা দেয়াল ভাঙার জন্য ট্র্যাকশন ট্রেবুচেট (traction trebuchets) ব্যবহার করেছিল, যা বাইজেন্টাইনদের দ্বারা এর প্রথম পরিচিত ব্যবহারগুলির মধ্যে একটি। দুই মাস পরে খাজাররা শরৎকালে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্তেপে ফিরে আসে। টং ইয়াবঘু অবরোধের সময় হেরাক্লিয়াসকে সহায়তা করার জন্য অবশিষ্ট চল্লিশ হাজারের দায়িত্বে তরুণ বোরি শাদকে (Böri Shad) রেখে গেছিলেন, যিনি তার পুত্র বা ভাগ্নে ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা চলে গেলে, বাইজেন্টাইনরা অবরোধে একা হয়ে যায়, আর এর ফলে অবরুদ্ধরা বিদ্রুপ করতে শুরু করে।

জর্জিয়ানরা যখন সম্রাটকে হাস্যকরভাবে “ছাগল” বলে সম্বোধন করেছিল, তখন হেরাক্লিয়াস ড্যানিয়েলের বইয়ের একটি অনুচ্ছেদের কথা স্মরণ করেছিলেন যেখানে এক-শিংযুক্ত ছাগল দ্বারা উৎখাত হওয়া দুই-শিংযুক্ত ভেড়ার কথা বলা হয়েছিল। তিনি এটিকে একটি ভাল লক্ষণ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। খোসরো শহরটিকে শক্তিশালী করার জন্য শাহরাপ্লাকানের অধীনে ১,০০০ অশ্বারোহী প্রেরণ করেছিলেন, তবে সম্ভবত ৬২৮ সালের শেষের দিকে এর পতন ঘটে। জিবেল সেই বছরের শেষের দিকে মারা যান, তবে এর ফলে এপিফানিয়া “বর্বর” টং ইয়াবঘুকে বিয়ে করার হাত থেকে রক্ষা পান। অবরোধ চলতে থাকার  সময় হেরাক্লিয়াস উপরের টাইগ্রিসে তার ঘাঁটি সুরক্ষিত করার জন্য কাজ করেছিলেন।

হেরাক্লিয়াস পারস্যের বিরুদ্ধে দক্ষিণ দিকে আঘাত করেছিলেন। ৬২৭ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি টাইগ্রিসের তীরে উপস্থিত হন এবং নিনেভেহ এর ধ্বংসাবশেষের কাছে পারস্য বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। জানুয়ারিতে তিনি পারস্যের রাজধানী টেসিফোনের আশেপাশের অঞ্চল ধ্বংস করেছিলেন, যা পারস্য-বাইজেন্টাইন সম্পর্কের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিল।

হেরাক্লিয়াসের বিজয়ের পরে টং ইয়াবঘু তিফলিসের অবরোধ পুনরায় শুরু করার জন্য তাড়াহুড়ো করেছিলেন এবং শীতকালে সফলভাবে শহরটিতে আক্রমণ করেছিলেন। মোভসেস বর্ণনা করেছেন “তাদের তরবারি উত্তোলন করে তারা দেয়ালের দিকে অগ্রসর হল, এবং এরা একে অপরের কাঁধে চড়ে দেয়ালের উপরে উঠে গেল। নগরের অভিবাসীদের ওপর একটি কালো ছায়া নগরের অধিবাসীদের ওপর পড়েছিল; তারা পরাজিত হয়েছিল এবং তাদের ভূমি হারিয়েছিল।” জর্জিয়ানরা আর কোন প্রতিরোধ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করলেও শহরটি লুট করা এবং এর নাগরিকদের গণহত্যা করা হয়েছিল। পারস্যের গভর্নর এবং জর্জিয়ার যুবরাজকে টং ইয়াবঘুর উপস্থিতিতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল।

হাতাহাতি যুদ্ধে দক্ষতার জন্য বিখ্যাত গোকতুর্করা কখনও সিজক্রাফ্ট বা অবরোধ-যুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারেনি। এই কারণে গুমিলেভ তিফলিস গ্রহণের জন্য খাজারদের কৃতিত্ব দেন। বিশ্বাস করার ভাল কারণ রয়েছে যে এই সাফল্য টং ইয়াবঘুকে আরও বড় পরিকল্পনার দিকে উৎসাহিত করেছিল। এবার তিনি লুণ্ঠনের সাধারণ অভিযান চালানোর পরিবর্তে আঘভানিয়াকে তার খাগানাতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ। সুয়াবে ফিরে আসার আগে তিনি বোরি শাদ এবং তার সেনাপতিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে “সেই দেশের শাসক ও অভিজাতরা আমার ছেলের সাথে দেখা করতে, আমার শাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে, তাদের শহর, দুর্গ এবং আমার সৈন্যদের কাছে বাণিজ্য ছেড়ে দিতে সম্মত হলে তাদের জীবন রক্ষা করুন”।

এই শব্দগুলি ইঙ্গিত দেয় যে টং ইয়াবঘু সিল্ক রুটের পশ্চিমতম অংশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আগ্রহী ছিলেন, কারণ তিনি চীনের পূর্ব দিকে এর অন্যান্য অংশের উপর তার দখল শক্ত করেছিলেন। ৬৩০ সালের এপ্রিলে বোরি শাদ ট্রান্সককেশিয়ার উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং আর্মেনিয়া আক্রমণ করার জন্য তার সেনাপতি চোরপান তারখানকে ৩০,০০০ অশ্বারোহী সহ প্রেরণ করেন। যাযাবর যোদ্ধাদের একটি চরিত্রগত কৌশল ব্যবহার করে চোরপান তারখান এই আক্রমণ করেন, এবং আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শাহরবারাজ কর্তৃক প্রেরিত ১০,০০০ এর একটি পারস্য বাহিনীকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেন। তুর্কিরা জানত যে সাসানীয়দের প্রতিক্রিয়া কঠোর হবে এবং তাই তারা শহরগুলি লুণ্ঠন করে তাদের বাহিনীকে স্তেপ অঞ্চলে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

নিনেভেহ এর যুদ্ধ

৬২৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, হেরাক্লিয়াস আশ্চর্যজনকভাবে ঝুঁকি নিয়েই শীতকালে ইরানের হার্টল্যান্ডে আক্রমণ করে বসেন, অন্যদিকে তিনি জিবেলকে দিয়ে তিফলিসের অবরোধ অব্যাহত রাখেন। হেরাক্লিয়াসের বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল ২৫,০০০ থেকে ৫০,০০০, আর সেই সাথে ৪০,০০০ গোকতুর্ক সেনাও ছিল। তবে অপরিচিত শীতের কারণে গোকতুর্ক সেনারা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। রাহজাদের ২৫,০০০ সেনার বাহিনী হেরাক্লিয়াসের পিছু নেয়, তবে হেরাক্লিয়াস রাহজাদকে এড়াতে সক্ষম হন ও মেসোপটেমিয়ায় (আধুনিক ইরাক) প্রবেশ করেন। হেরাক্লিয়াস গ্রামাঞ্চল থেকে খাদ্য এবং পশুখাদ্য অধিগ্রহণ করেন। এদিকে পারস্য সেনাপতি রাহজাদ (জাতিতে আর্মেনীয়) তার পিছু নিতে গিয়ে দেখেন গ্রামগুলোকে ইতিমধ্যেই হেরাক্লিয়াসের সেনারা লুঠ করেছে, ফলে তার পক্ষে তার সেনা ও প্রাণীদের জন্য খাদ্যের বন্দোবস্ত করা সহজ ছিলনা।

একটা  জিনিস বলে রাখা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ৬২৪ থেকে ৬২৬ সাল অব্দি শীতকালে হেরাক্লিয়াসের স্ট্র্যাটেজি ছিল সিজনাল রিট্রিট। সেক্ষেত্রে তিনি অন্যান্য সময়ে পারস্যে ছোটখাটো আক্রমণ করতেন, আর শীতকালে কঠোর আবহাওয়ার জন্য সেনাবাহিনী নিয়ে পশ্চাদপ্রসারণ করতেন। কিন্তু ৬২৭ সালে তিনি তার স্ট্র্যাটেজি পুরোপুরি বদলে ফেলে শীতকালেই বিশাল সৈন্য নিয়ে পারস্যের কেন্দ্র টেসিফোনের দিকে আক্রমণ পরিচালনা করলেন। এডওয়ার্ড লুটওয়াকের (Edward Luttwak) মতে এই কৌশলগত পরিবর্তনকে “high-risk, relational maneuver on a theater-wide scale” বলেছেন। অর্থাৎ তার চোখে এটি স্ট্র্যাটেজি উচ্চমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল (কারণ শীতকাল, আগে কখনও রোমান ইতিহাসে এরকমটা করার নজির বা করোও অভিজ্ঞতা নেই, হেরাক্লিয়াসের তো নেইই), রিলেশনাল ম্যানিউবভার ছিল (কারণ হেরাক্লিয়াসের এই সিদ্ধান্ত পারস্যদেরকে ভালোভাবেই প্রভাবিত করে), এবং এটা থিয়েটার-ওয়াইড স্কেলে হয় (কারণ এর কন্সিকুয়েন্স বা ফলাফল ছিল বিশাল)। লুটওয়াক বলেছেন, পূর্বের ছোটছোট কিন্তু ব্যর্থ বাইজান্টাইন আক্রমণে পারস্যরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই তারা ৬২৭ সালের শীতকালের এই বাইজান্টাইন আক্রমণকে আন্ডারএস্টিমেট করে। আর এদের এই ধরাকে সরাজ্ঞান করার কারণেই পারস্যরা বাইজান্টাইনদের এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সীমান্ত অঞ্চল থেকে বড় আকারের সেনাবাহিনী ডেকে আনেনি। আর তার ফল হয় মারাত্মক, পারস্যরা যুদ্ধে হেরে যায়, আর সাসানীয় সাম্রাজ্যের শাসকের পরিবর্তন ঘটে, বাইজান্টাইনরা কঠোর চুক্তিতে না গেলেও শান্তির জন্য বাইজান্টাইনদের থেকে জেতা অঞ্চল সহ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এগুলো সাসানীয়দের জন্য বিশাল পরিণতি ছিল, আর এর কয়েক বছর পর সাসানীয় সাম্রাজ্যই বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাই যে নিনেভেহ এর যুদ্ধের মাধ্যমে বাইজান্টাইনরা সাসানীয়দের পরাজিত করল, সেই যুদ্ধে বাইজান্টাইনদের সাফল্যের মূল কারণ ছিল হেরাক্লিয়াসের ৬২৭ সালের শীতকালে নেয়া সিদ্ধান্তটিই। আর এই যুদ্ধে বিজয়ের পর বাইজান্টাইনদের আর সাসানীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়নি। তাই বলতেই হয় হেরাক্লিয়াসের এই স্ট্র্যাটেজিকাল চেইঞ্জটা খুব বড় স্কেলেরই থিয়েট্রিকাল সিদ্ধান্ত ছিল।

১লা ডিসেম্বর, হেরাক্লিয়াস গ্রেট জাব নদী অতিক্রম করে পারস্য শাসিত আসিরিয়া/আসসুরিস্তানের নিনেভেহ এর প্রাক্তন আসিরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষের কাছে শিবির স্থাপন করেন। তার সেনাবাহিনীর এই আগমনটি যেমনটি হবার কথা সেভাবে উত্তর থেকে নয়, বরং দক্ষিণ থেকেই ঘটে। অবশ্য একে তাদের নেয়া একটি কৌশলও বলা যায়, যাতে পরাজিত হলে আর পারস্য-বাহিনীর পাতা ফাঁদে পড়তে না হয়। রাহজাদ বিভিন্ন অবস্থান থেকে নিনেভেহ এর দিকে তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। এদিকে হেরাক্লিয়াসের কাছে একটি গোপন সংবাদ পৌঁছে যে, রাহজাদের কাছে ৩,০০০  সেনার একটি রিইনফোর্সমেন্ট আসছে। খবর পেয়ে সেই রিইনফোর্সমেন্ট পেয়ে পারসিবাহিনী অধিকতর শক্তিশালী হয়ে যাবার আগেই হেরাক্লিয়াস পাল্টা-আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।

১২ই ডিসেম্বর রাহজাদ তার বাহিনীকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন ও আক্রমণ করেন। এদিকে হেরাক্লিয়াস ভান করেন যেন তিনি তার বাহিনী নিয়ে পারস্য থেকে পশ্চাদপ্রসারণ করে টাইগ্রিস ক্রস করছেন।তার এটা করার কারণ ছিল, তিনি চেয়েছিলেন পারস্য বাহিনী তাকে ধাওয়া করতে করতে তার পছন্দের যুদ্ধক্ষেত্রটিতে চলে আসে, যেখানে এলে তিনি হঠাৎ করে সারপ্রাইজ এটাক করতে পারেন। তার এই পছন্দের যুদ্ধকেত্রটি ছিল একটি সমভূমি। হেরাক্লিয়াস নিনেভের ধ্বংসাবশেষ থেকে কিছুটা দূরে গ্রেট জাবের পশ্চিমে এই সমভূমিটি খুঁজে পেয়েছিলেন। বাইজান্টাইনরা তাদের অস্ত্র ল্যান্স ব্যবহারে ও হাতাহাতি যুদ্ধে পারদর্শী ছিল। এই সমভূমি তাদেরকে তাদের এই পারদর্শিতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেয়। এদিকে পারস্যরা পারদর্শী ছিল মিসাইল ছোড়াতে। কিন্তু একদিকে শীতকালে কুয়াশার কারণে তারা দূরে ভালো করে দেখতে পারছিল না, যার ফলে মিসাইল এর সঠিক ব্যবহার কঠিন হয়ে যাবে, আর সেই সাথে বাইজান্টাইনরাও এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মিসাইল দ্বারা খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েই চার্জ করতে সক্ষম হবে। তাই সব মিলে এটাই ছিল হেরাক্লিয়াসের চোখে সবচেয়ে উপযোগী যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে পারস্যদেরকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে আসতে হবে। ওয়াল্টার কেগি মনে করেন, এই যুদ্ধটি কারামলেস ক্রিকের (Karamlays Creek) কাছে ঘটেছিল।

তো, যেমন কল্পনা তেমনই বাস্তবায়ন। ৮ ঘণ্টা ধরে টানা যুদ্ধের পর ক্ষতিগ্রস্ত পারস্য বাহিনী পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের পাদদেশে পশ্চাদপ্রসারণ করে। তবে এই পশ্চাদপ্রসারণটি বিশৃঙ্খল ছিলনা, নিয়ন্ত্রিতভাবেই এরা রিট্রিট করে, তবে যুদ্ধে ৬,০০০ পারস্য সেনা মারা যায়। নিকেফোরোসের লেখা ব্রিফ হিস্ট্রি অনুসারে, রাহজাদ হেরাক্লিয়াসকে পার্সোনাল কম্ব্যাট, মানে একাকী লড়াইতে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। হেরাক্লিয়াস এক মরেই রাহজাদকে হত্যা করেন; এরপর আরো দু’জন পারস্য তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু তারাও পরাজিত হয়েছিলেন, এদিকে হেরাক্লিয়াস কেবল তার ঠোঁটেই আঘাত পান। আরেক বাইজেন্টাইন ইতিহাসবিদ থিওফেনস দ্য কনফেসরের বিবরণও এটিকে সমর্থন করে। তবে আসলেই এটি ঘটেছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যেটাই ঘটুক না কেন, যুদ্ধের কোনও এক সময় রাহজাদ মারা যান। রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে পারস্য বাহিনীর কাছে যে ৩,০০০ এর পারস্য সেনাবাহিনীর আসার কথা ছিল তা অনেক দেরিতে পৌঁছেছিল।

যুদ্ধে বাইজান্টাইনরা জয়লাভ করলেও তা পূর্ণাঙ্গ ছিলনা, কারণ তারা পারস্য শিবির দখল করতে ব্যর্থ হয়। তবে এই বিজয় কার্যকরী ছিল, কেননা পরাজয়ের পর আর পারস্যরা বাইজান্টাইনদের প্রতিহত করতে পারেনি। তখন হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে আর কেউই ছিলোনা। ফলে হেরাক্লিয়াসের বিজয়ী বাহিনী খোসরোর প্রাসাদ দস্তাগির্দ লুণ্ঠন করে এবং বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত ৩০০টি বাইজান্টাইন বা রোমান ধ্বজা (ব্যানার বা ফ্ল্যাগ)  পুনরুদ্ধার করার সময় প্রচুর সম্পদ অর্জন করে। খোসরো ইতিমধ্যে টেসিফোনের প্রতিরক্ষার জন্য সমর্থন সংগ্রহের চেষ্টা করার জন্য সুসিয়ানার পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ৬২৮ সালের ৬ই জানুয়ারি হেরাক্লিয়াস দ্বিতীয় খসরুকে একটি আল্টিমেটাম পাঠান, যেটায় লেখা ছিল, “আমি শান্তি চাই। আপনি বাধ্য না করলে আমি পারস্যকে ধ্বংস করতে চাইনা। আমাদেরকে আমাদের অস্ত্র ত্যাগ করতে দিন ও শান্তিকে আলিঙ্গন করতে দিন। যে আগুন এখন জ্বলছে তা সবকিছু পুড়িয়ে ফেলার আগেই তাকে নিভিয়ে ফেলতে দিন।” তবে হেরাক্লিয়াস টেসিফোন আক্রমণ করতে পারেননি কারণ নাহরাওয়ান খালটি (Nahrawan Canal) একটি সেতু ধসের কারণে  অবরুদ্ধ ছিল।

পারস্য সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে দ্বিতীয় খসরুকে উৎখাত করে ও তার পরিবর্তে তার পুত্র দ্বিতীয় কাভাধকে (Kavadh II, সিরোস নামেও পরিচিত) ক্ষমতায় বসায়। খসরু পাঁচ দিন একটি অন্ধকূপে বা ডানজনে (dungeon) আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে তার কাছে খুব যৎসামান্য খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী ছিল যা নিয়ে তিনি বাঁচতে পারতেন। ৫ম দিনে তাকে তীরবিদ্ধ করে ধীরে ধীরে হত্যা করা হয়। কাভাধ অবিলম্বে হেরাক্লিয়াসের কাছে শান্তির প্রস্তাব প্রেরণ করেন। হেরাক্লিয়াস তাতে রাজি হন, তিনি কোন কঠোর শর্ত আরোপ করেননি। আর সেটাই স্বাভাবিক ছিল, কেননা তার নিজের সাম্রাজ্যেরও যুদ্ধ চালিয়ে নেবার অবস্থা ছিলনা। তাই কঠোর শর্ত দিয়ে যুদ্ধ অবিরত রাখার সম্ভাবনার চেয়ে কম লাভ নিয়ে শান্তিতে সম্মত হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করাই তার কাছে শ্রেয় ছিল। শান্তি চুক্তি হল। আর সেই চুক্তি অনুযায়ী বাইজান্টাইনরা তাদের হারানো অঞ্চল, পারস্যদের কাছে বন্দি বাইজান্টাইন সৈন্য, ৬১৪ সালে জেরুজালেমের সাথে হারানো “ট্রু ক্রস” সহ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সম্পদগুলো, এবং সেই সাথে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ লাভ করে। এই যুদ্ধটি ছিল শেষ রোমান-পারস্য সংঘাত।

যুদ্ধের তাৎপর্য ও পরিণতি

কয়েক মাস ভ্রমণের পর হেরাক্লিয়াস বিজয়ী বেশে কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেন ও শহরের লোকেদের সাথে মিলিত হন। তাঁর পুত্র হেরাক্লিয়াস কনস্টান্টাইন এবং প্যাট্রিয়ার্ক সার্জিয়াস তার সামনে আসেন এবং আনন্দে তারা হেরাক্লিয়াসের সামনে প্রণত হন। পারস্যদের সাথে তার জোটের ফলে পবিত্র স্পঞ্জ (Holy Sponge) পুনরুদ্ধার হয়েছিল যা ১৪ সেপ্টেম্বর ৬২৯ এ একটি বিস্তৃত অনুষ্ঠানে ট্রু ক্রসের সাথে আবদ্ধ করা হয় (পবিত্র স্পঞ্জ যীশুর আবেগের সাথে সম্পর্কিত একটি অন্যতম সরঞ্জাম। এটি ভিনেগার-জলে (খুব সম্ভবত রোমান সৈন্যদের একটি নিয়মিত পানীয় পোস্কায় (posca)) ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল এবং মথি ২৭:৪৮, মার্ক ১৫:৩৬, এবং যোহন ১৯:২৯ অনুসারে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার সময় যিশুকে এই পানীয় প্রদান করা হয়েছিল।) আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজটি হাইয়া সোফিয়ার (Hagia Sophia) দিকে যায়। সেখানে, ট্রু ক্রসটি ধীরে ধীরে উঁচু করতে করতে বেদীর উপরে উলম্ব করা হয়েছিল। অনেকের কাছে এটি ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের জন্য শুরু হতে যায় এক নতুন স্বর্ণযুগের লক্ষণ।

এই যুদ্ধের সমাপ্তির পর হেরাক্লিয়াস ইতিহাসের অন্যতম সফল জেনারেলের স্থান লাভ করেন। রোমান সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি নিরবিচ্চিন্নভাবে ছয় বছর ধরে বিজয় অর্জন করেন, যা আগে কোন রোমান বাহিনী করে দেখতে পারেনি। এজন্য তাকে “দ্য নিউ স্কিপিও” (“the new Scipio”) নাম ভূষিত করা হয়। হাইয়া সোফিয়ায় ট্রু ক্রসের জয়পূর্ণ উত্থান ছিল তার কৃতিত্বের একটি মুকুটস্বরূপ। হেরাক্লিয়াস যদি তখন মারা যেতেন, তবে ইতিহাসবিদ নরম্যান ডেভিসের ভাষায় তিনি “জুলিয়াস সিজারের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ রোমান জেনারেল” হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হতেন। কিন্তু তিনি মরেননি, বরং আরব আক্রমণের সময়ে বেঁচে ছিলেন, আর আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একের পর এক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি তার সেই বিজয়ের খ্যাতি নষ্ট করেছিলেন। লর্ড নরউইচ সংক্ষিপ্তভাবে হেরাক্লিয়াসকে “খুব বেশি দিন বেঁচে ছিলেন” বলে বর্ণনা করেছেন।

অন্যদিকে সাসানীয়রা এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হারায় একটি স্থিতিশীল সরকার। সিংহাসনে আরোহণের কয়েক মাস পরেই দ্বিতীয় কাভাধ মারা যান, এর ফলে পারস্যে শুরু হয় বেশ কয়েক বছরের রাজবংশীয় দ্বন্দ্ব এবং গৃহযুদ্ধ। কয়েক মাসের মধ্যে তৃতীয় আরদাশির (Ardashir III), হেরাক্লিয়াসের মিত্র শাহরবারাজ এবং খোসরোর কন্যা পুরন্দোখত এবং আরেক কন্যা আজরমিদোখত একে একে সিংহাসনে আরোহন করেন। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় খোসরোর নাতি তৃতীয় ইয়াজদগার্দ (Yazdgerd III) সিংহাসনে আরোহণ করার পরই সাসানীয় সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা আসে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সাসানীয় সাম্রাজ্যকে পুনরুদ্ধার করার আর সুযোগ ছিলনা।

৬০২-৬২৮ সালের যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব এবং প্রায় এক শতাব্দীর অবিচ্ছিন্ন বাইজেন্টাইন-পারস্য সংঘাতের সমষ্টিগত প্রভাব উভয় সাম্রাজ্যকে পঙ্গু করে দেয়। অর্থনৈতিক পতন, দ্বিতীয় খোসরোর সমরাভিযানের অর্থায়নের জন্য ভারী কর, ধর্মীয় অস্থিরতা এবং শাহের ক্ষমতা হ্রাস ও প্রাদেশিক জমিদারদের ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে সাসানীয়রা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। হাওয়ার্ড-জনস্টনের মতে: “(যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে) হেরাক্লিয়াসের বিজয় এবং এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় … নিকট প্রাচ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রধান দুর্গটিকে রক্ষা পায় এবং এর এর পুরানো জরথুস্ট্রিয়ান প্রতিদ্বন্দ্বী মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। এর পরবর্তী দুই দশকে আরবদের অধিকতর অসাধারণ সামরিক অর্জন বাইজান্টাইনদের এই সাফল্যকে স্তিমিত হয়ে যায়, কিন্তু তবুও তাদের এই উজ্জ্বলতাকে হ্রাস করতে দেয়া উচিত নয়।”

যাইহোক, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, বলকানরা তখন মূলত স্লাভদের হাতে ছিল। উপরন্তু, আনাতোলিয়া বারবার পারস্য আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এবং সাম্প্রতিক পুনরুদ্ধার অঞ্চল – ককেশাস, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, ফিলিস্তিন এবং মিশরে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও শক্তি বছরের পর বছর পারস্যের দখলের ফলে শিথিল হয়ে গিয়েছিল। এদিকে বাইজান্টাইনদের আর্থিক মজুদ বা ফাইনান্সিয়াল রিজার্ভ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে তারা পারস্যদের সাথে যুদ্ধ করা সেনাদেরকে ঠিক মতো বেতন দিতে ও বাইজান্টাইন সেনাবাহিনীতে নতুন সৈন্য নিয়োগ দিতে অসুবিধায় পড়ে। ক্লাইভ ফস এই যুদ্ধকে “যে প্রক্রিয়াটি এশিয়া মাইনরে এন্টিকুইটি বা প্রাচীনত্বের সমাপ্তি চিহ্নিত করে সেই প্রক্রিয়াটির প্রথম পর্যায়” বলে অভিহিত করেছেন।

বাইজান্টাইন বা সাসানীয় সাম্রাজ্যের কোনোটিই পুনরুদ্ধারের খুব বেশি সুযোগ পায়নি, কারণ কয়েক বছরের মধ্যে তারা ইসলাম দ্বারা নতুনভাবে একত্র হওয়া আরবদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল, যাকে হাওয়ার্ড-জনস্টন “মানব সুনামির” সাথে তুলনা করেছিলেন। জর্জ লিস্কার মতে, “অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত বাইজেন্টাইন-পারস্য সংঘাত ইসলামের পথ উন্মুক্ত করেছিল”। সাসানীয় সাম্রাজ্য দ্রুত এই আক্রমণগুলির কাছে নতি স্বীকার করে এবং পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এদিকে বাইজেন্টাইন-আরব যুদ্ধের সময় ক্লান্ত বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য সাসানীয়দের থেকে সম্প্রতি পুনরুদ্ধার করা পূর্ব ও দক্ষিণ প্রদেশ সিরিয়া, আর্মেনিয়া, মিশর এবং উত্তর আফ্রিকাও আরবদের কাছে হারায়, যার ফলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আনাতোলিয়া সহ কিছু কেন্দ্রীয় কোর অঞ্চল, কিছু ছড়িয়ে থাকা দ্বীপ এবং বলকান এবং ইতালির আধিপত্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। যাইহোক, পারস্যের বিপরীতে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য শেষ পর্যন্ত আরব আক্রমণ থেকে বেঁচে যায়, তার অবশিষ্ট অঞ্চলগুলি ধরে রাখে এবং রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলে ৬৭৪-৬৭৮ এবং ৭১৭-৭১৮ সালের দুটো আরব অবরোধকে প্রতিহত করে। পরবর্তী সংঘাতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য আরবদের কাছে ক্রিট ও দক্ষিণ ইতালিতে তাদের অঞ্চলগুলোও হারায়, যদিও এই অঞ্চলগুলোকে শেষ পর্যন্ত পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। তবে বাইজান্টাইনদের কিছু ক্ষতি স্থায়ী ছিল, যেমন ৬২৯ সালে ভিজিগথদের হাতে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের অবশিষ্ট বাইজেন্টাইন অঞ্চল স্প্যানিয়া হারানো। একইভাবে ৮ম শতকে তারা লোম্বার্ডদের হাতে কর্সিকা হারায়। ১০ম শতকে তারা আরবদের কাছে ব্যালিয়ারিক দ্বীপপুঞ্জ, সার্ডিনিয়া এবং সিসিলি হারায়।

৬২৮-৬৩২ সালের সাসানীয় গৃহযুদ্ধ

ভূমিকা

৬২৮-৬৩২ সালের সাসানীয় গৃহযুদ্ধ ছিল সাসানীয় রাজা দ্বিতীয় খসরুর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন অভিজাত ফ্যাকশনের মধ্যে শুরু হওয়া একটি দ্বন্দ্ব। এই ফ্যাকশনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো ছিল পার্থিয়ান (পাহলভ) ফ্যাকশন, পারস্য (পার্সিগ) ফ্যাকশন, নিমরুজি ফ্যাকশন এবং জেনারেল শাহরবারাজের ফ্যাকশন। শাসকদের দ্রুত পরিবর্তন এবং প্রাদেশিক জমিদার ক্ষমতা বৃদ্ধি সাম্রাজ্যকে আরও দুর্বল করেছিল। চার বছরে পরপর ১৪ জন শাসক সাসানীয় সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহন করেন। এর ফলে সাসানীয় সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা তার জেনারেলদের হাতে চলে যায় এবং সেটা এই সাম্রাজ্যের পতনে অবদান রাখে।

পটভূমি

৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের সামন্ত বংশগুলো দ্বিতীয় খসরুকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ক্ষমতাচ্যুত করার কাজে উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ইস্পাবুধান স্পাবেদ ফররুখ হরমিজদ এবং তার দুই পুত্র রোস্তম ফাররোখজাদ এবং ফারুখজাদ; মিহরান পরিবারের শাহরবারাজ, আর্মেনিয়ান ফ্যাকশনের প্রতিনিধিত্বকারী ছিলেন দ্বিতীয় ভারাজতিরোটস বাগরাটুনি (Varaztirots II Bagratuni), এবং কানারাঙ্গিয়ান বংশের কানাদবাক। ২৫শে ফেব্রুয়ারি খোসরাউয়ের পুত্র শেরো, তার কমান্ডার আসপাদ গুশনাস্পের সাথে টেসিফন দখল করেন এবং দ্বিতীয় খোসরোকে বন্দী করেন। তারপরে তিনি নিজেকে সাসানীয় সাম্রাজ্যের শাহ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন এবং দ্বিতীয় কাভাধ (Kavadh II) নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন। তিনি তার সমস্ত ভাই এবং সৎ ভাইদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেছিলেন, যার মধ্যে খোসরোর প্রিয় পুত্র ও উত্তরাধিকারী মারদানশাহও ছিলেন। এভাবে তার সমস্ত ভাইদের হত্যার মাধ্যমে “সমস্ত সুশিক্ষিত, সাহসী এবং সাহসী পুরুষদের” হত্যা করে দ্বিতীয় কাভাধ সাসানীয় রাজবংশের ভবিষ্যত যোগ্য শাসক প্রাপ্তির সম্ভাবনা ধ্বংস করেন। তার এই কাজকে “পাগল তাণ্ডব” এবং “বেপরোয়া” আচরণ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তিন দিন পরে তিনি মিহর হরমোজদকে তার পিতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়েছিলেন। তবে পিতার হত্যার পরে কাভাধ মিহর হরমোজদকেও হত্যা করতে এগিয়ে যান।

কাভাধের ক্রিয়াকলাপের কারণে, তার রাজত্বকে সাসানীয় ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে দেখা হয় এবং কিছু পণ্ডিত বলেন, তার আচরণই সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতনের মূল ভূমিকা পালন করে। খোসরোর উৎখাত ও মৃত্যুর ফলে ৬২৮-৬৩২ সালের বিশৃঙ্খল সাসানীয় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়, যখন পারস্যের শক্তিশালী অভিজাতরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন করে এবং তাদের নিজস্ব সরকার গঠন শুরু করে। পারস্য (পারসিগ) এবং পার্থিয়ান (পাহলভ) অভিজাত পরিবারগুলির মধ্যে শত্রুতাও পুনরায় শুরু হয়, যা জাতির সম্পদকে বিভক্ত করে। ইরানী অভিজাতদের সম্মতিক্রমে দ্বিতীয় কাভাধ বিজয়ী বাইজান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সাথে শান্তি স্থাপন করেন, যার ফলে বাইজেন্টাইনরা তাদের হারানো সমস্ত অঞ্চল, তাদের বন্দী সৈন্য, যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, ট্রু ক্রস এবং ৬১৪ সালে জেরুজালেমে হারিয়ে যাওয়া অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ (পুনরায়) অর্জন করে।

কাভাধ ফররুখজাদের সমস্ত সম্পত্তিও নিয়ে ছিলেন এবং তাকে ইস্তাখরে গ্রেপ্তার করেছিলেন। এই সময়কালে, পিরুজ খসরো পার্সিগ ফ্যাকশনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, আর ইস্পাবুধান ফারুখ হরমিজদ পাহলভ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এদিকে ৬২৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মাত্র কয়েক মাস রাজত্ব করার পরে দ্বিতীয় কাভাধ একটি বিধ্বংসী প্লেগে মারা যান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর আট বছর বয়সী পুত্র তৃতীয় আরদাশির (Ardashir III)।

গৃহযুদ্ধ

তৃতীয় আরদাশিরের রাজত্বকালে মাহ-আধুর গুশনস্পকে তার মন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল, যিনি সাসানীয় সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হস্তগত করেন। এক বছর পরে শাহরবারাজ ৬,০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে টেসিফনের দিকে অগ্রসর হন এবং শহরটি অবরোধ করেন। শাহরবারাজ অবশ্য শহরটি দখল করতে ব্যর্থ হন, এবং তারপরে পারসিগ গোষ্ঠীর নেতা পিরুজ খোসরো এবং আরদাশিরের পিতা দ্বিতীয় কাভাধের রাজত্বকালে সাম্রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রীর সাথে জোট করেন। তিনি নিমরুজের স্পাহবেদ নামদার গুশনস্পের সাথেও জোট করেছিলেন। শাহরবারাজ, এই দুই শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের সহায়তায় টেসিফোন দখল করেন এবং আরদাবিলের মতো অন্যান্য সাসানীয় অভিজাত, মাহ-আধুর, ও সম্রাট তৃতীয় আরদাশিরকে মৃত্যুদণ্ড দেন। চল্লিশ দিন পরে ফাররুখ হরমিজদ শাহরবারাজকে হত্যা করেন, যিনি এরপর দ্বিতীয় খসরুর কন্যা বোরানকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন, আর বোরান এই ফাররুখকে সাম্রাজ্যের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন।

দ্বিতীয় খোসরাউয়ের বোন মিররান ও শাহরবারাজের পুত্র শাপুর-ই শাহরভারাজ বোরানকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এর অল্প সময়ের মধ্যেই পিরুজ এবং তার ফ্যাকশন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, যারা তার শাসনকে স্বীকার করেনি। পিরুজ বোরানের বোন আজারমিদোখতকে ইরানের শাসক হিসেবে রাজমুকুট পরিয়ে দেন।

অভিজাতদের পরামর্শে আজারমিদখত ফারুখজাদকে মুক্ত করেন, এবং তাকে আবারও উচ্চ পদে সাসানীয়দের সেবা করার আমন্ত্রণ জানান। তবে ফররুখজাদ এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন এবং একজন নারীর অধীনে তার সার্ভিস দিতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর তিনি ইস্তাখরের একটি অগ্নি-মন্দিরে চলে যান। ফাররুখ হরমিজদ তার কর্তৃত্বকে শক্তিশালী করার জন্য এবং পাহলভ এবং পারসিগের মধ্যে শান্তি স্থাপন করার জন্য আজারমিদোখতকে (যিনি পার্সিগ মনোনীত ছিলেন) তাকে বিয়ে করতে বলেছিলেন। আজারমিদোখত অবশ্য সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরে ফাররুখ হরমিজদ “আর সিংহাসন থেকে দূরে সরে যাননি”, ঘোষণা করেছিলেন “আজ আমি জনগণের নেতা এবং ইরান দেশের স্তম্ভ”। তিনি রাজার মতো একই ভাবে মুদ্রা তৈরি শুরু করেছিলেন, বিশেষত পার্সের ইস্তাখর এবং মিডিয়ার নাহাভান্দে। ফাররুখ হরমিজদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য আজারমিদোখত নিজেকে মিহরানী রাজবংশের সিয়াভাখশের সাথে মিত্রতা করেছিলেন, যিনি বিখ্যাত সামরিক কমান্ডার (স্পাহবেদ) এবং ইরানের সংক্ষিপ্ত সময়ের শাহ বাহরাম চোবিনের নাতি ছিলেন। সিয়াবখশের সহায়তায় আজারমিদোখত ফাররুখ হরমিজদকে হত্যা করে। ফররুখ হরমিজদের পুত্র রোস্তম ফাররোখজাদ সেই সময় খোরাসানে অবস্থান করছিলেন, তিনি পাহলভদের নেতা হিসাবে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। পিতার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি “আজারমিদোখতের প্রতিটি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে” টেসিফনে চলে যান। তারপরে তিনি টেসিফনে সিয়াভাখশের বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন এবং শহরটি দখল করেছিলেন।

আজারমিদোখত শীঘ্রই রোস্তম দ্বারা অন্ধ এবং নিহত হন, আর রোস্তম বোরানকে সিংহাসনে পুণঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তবে পরের বছর টেসিফনে একটি বিদ্রোহ শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, পার্সিগ ফ্যাকশন তার সম্রাজ্ঞী বোরানের ওপর  প্রতিদ্বন্দ্বী পাহলভ ফ্যাকশনের নেতা রোস্তমের রিজেন্সি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল, বিশেষ করে বোরান বিশিষ্ট পার্সিগ ব্যক্তিত্ব বাহমান জাদহুইহকে পদচ্যুত করেছিলেন, সেজন্য। ইরানী সেনাবাহিনী যখন অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখন পার্সিগ ফ্যাকশন বোরানকে উৎখাত করতে এবং বাহমান জাদহুইহকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহের ডাক দেন। বোরান শীঘ্রই মারা গিয়েছিলেন, সম্ভবত পিরুজ খোসরোই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিলেন। এইভাবে পাহলভ ও পার্সিগ ফ্যাকশনের মধ্যে পুনরায় শত্রুতার সূচনা হয়। তবে রোস্তম এবং পিরুজ খোসরো উভয়ই নিজেদের ফ্যাকশনের লোকদের হুমকির মুখে পড়েন, কেননা তাদের নিজেদের ফ্যাকশনের লোকেরা সাম্রাজ্যের পতনশীল অবস্থার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। রোস্তম এবং পিরুজ খোসরো এর ফলে আরও একবার একসাথে কাজ করতে সম্মত হন, এবং তারা দ্বিতীয় খোসরোর নাতি তৃতীয় ইয়াজদেগার্দকে (Yazdegerd III) সিংহাসনে বসিয়ে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটান।

ফলাফল এবং প্রভাব

তৃতীয় ইয়াজদেগার্দ সিংহাসনে আরোহণের সময় সাসানীয় সাম্রাজ্য ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তরুণ রাজার হাতে তার বিস্তৃত সাম্রাজ্যে স্থিতিশীলতা আনার জন্য প্রয়োজনীয় কর্তৃত্ব ছিল না। কেননা সেই কর্তৃত্ব নিজেদের মধ্যে লড়াই করা এবং একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করতে থাকা সেনা কমান্ডার, সভাসদ এবং অভিজাতদের শক্তিশালী সদস্যদের মধ্যে ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দ্রুত ভেঙে পড়ছিল। সাম্রাজ্যের অনেক গভর্নর স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং তাদের নিজস্ব রাজ্য তৈরি করেছিলেন। মাজুন এবং ইয়েমেন প্রদেশের গভর্নররা ইতিমধ্যে ৬২৮-৬৩২ এর গৃহযুদ্ধের সময় তাদের স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন, যার ফলে আরব উপদ্বীপে সাসানীয় শাসনের পতন হয়েছিল, যা ইসলামের ব্যানারে একক ক্ষমতায় আসে। পার্থিয়ান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার সময় এর সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা যেরকম ছিল, সাসানীয় সাম্রাজ্যের অবস্থাও ঠিক সেরকম হয়ে ওঠে।

ইয়াজদেগার্দ পারসিগ এবং পাহলভ উভয় দল দ্বারা সঠিক রাজা হিসাবে স্বীকৃত ছিলেন, কিন্তু তিনি তার সমস্ত সাম্রাজ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর শাসনের প্রথম বছরগুলিতে মুদ্রাগুলি কেবল পার্স, সাকাস্তান এবং খুজেস্তানে তৈরি করা হয়েছিল, যা সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম (জোয়ারওয়ারান) এবং দক্ষিণ-পূর্ব (নেমরোজ) অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে। আর এই অঞ্চলগুলো ছিল পার্সিগ ফ্যাকশনের বেইজ। অন্যদিকে পাহলভ ফ্যাকশনের বেইজ ছিল মূলত সাম্রাজ্যের উত্তর অংশে। এই ফ্যাকশন সাসানীয় সম্রাটের মুদ্রা তৈরি করতে অস্বীকার করেছিল। এই সময়ে সাসানীয় সাম্রাজ্য একই সাথে সমস্ত ফ্রন্টে আক্রমণের শিকার হয়; পূর্বে গোকতুর্করা এবং পশ্চিমে খাজাররা (যারা আর্মেনিয়া এবং আদুরবাদাগান আক্রমণ করেছিল) আক্রমণ করে বসে। পূর্বেই বাইজেন্টাইনদের সাথে যুদ্ধ এবং গৃহযুদ্ধের কারণে সাসানীয় সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি এতটাই বিশৃঙ্খল ছিল এবং জাতির অবস্থা এতটাই উদ্বেগজনক ছিল যে “পারস্যরা খোলাখুলিভাবে তাদের সাম্রাজ্যের অবিরাম পতনের কথা বলেছিল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা দেখেছিল।” এই সাম্রাজ্য শীঘ্রই আরব আক্রমণের হাতে তার সমাপ্তির মুখোমুখি হবে, যখন ইয়াজদেগার্দ ৬৫১ সালে নিহত হবেন, তও সম্ভবত তার নিজের প্রজাদের প্ররোচনাতেই।

তথ্যসূত্র

Roman–Sasanian War of 421–422, Byzantine–Sasanian War of 440, Anastasian War, Lazic War, Fifty-Year Peace Treaty, Byzantine–Sasanian War of 572–591, Sasanian civil war of 589–591, Byzantine–Sasanian War of 602–628, Siege of Constantinople (626), Battle of Nineveh (627), Sasanian civil war of 628–632, Aksumite–Persian wars, Third Perso-Turkic War

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.