গেইম থিওরি, চিকেন মডেল ও প্রিজনারস ডিলেমা

গেইম থিওরি বা ক্রীড়া তত্ত্ব

ক্রীড়া তত্ত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিবার (Robert J. Lieber) বলেন, “আন্তর্জাতিক রাজনীতির দর কষাকষি এবং দ্বন্দ্বের বিশেষ বিশ্লেষণই ক্রীড়া তত্ত্ব” (Game Theory is a special kind of analysis of bargaining and conflict of international politics.) নিউম্যান (John Von Neuman) ও মরগেনস্টারণ (Oscar Morgenstern)-এর মতে, “ক্রীড়াতত্ত্ব হলো দ্বন্দ্ব এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিস্থিতিতে যেখানে প্রত্যেক প্রতিযোগী নিজের লাভের পরিমাণকে বৃদ্ধি এবং ক্ষতির পরিমাণকে হ্রাস করতে সচেষ্ট এবং প্রতিযোগীরা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে সে যৌক্তিক সিদ্ধান্তের কৌশল সম্পর্কে চিন্তরাজি। (Game Theory is a body of thought dealing with rational decision strategies in situation of conflict and competition, when each participant or player seeks to maximise and minimise loss.)। এখান থেকে বোঝা যায় যে, ক্রীড়া তত্ত্বের মৌলিক ধারণা একটি বিশেষ ধরনের যৌক্তিকতার ওপর নির্ভর করে এবং এ যৌক্তিকতার ভিত্তিতেই ক্রীড়া তত্ত্ব যেকোনো দ্বন্দ্ব পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। ক্রীড়া বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। খেলোয়াড়ের সংখ্যার দিক বিবেচনা করলে এটি দু’ধরনের হতে পারে, যথা, দু-ব্যক্তির মধ্যে খেলা ও অনির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে খেলা। আলাপ, প্রাপ্য ফলাফল অনুযায়ীও এটি দু’ধরনের হতে পারে, যথা— শূন্য ফলাফল (Zero-Sum) খেলা ও পরিবর্তনশীল ফলাফল (Variable-Sum) খেলা। যেখানে খেলোয়াড়দের প্রাপ্য ফলাফলের যোগফল শূন্য, তাই শূন্য ফলাফল খেলা নামে পরিচিত। আর যেখানে তাদের প্রাপ্য ফলাফল তারা খেলার সময় যে কৌশল অবলম্বন করে তার ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়, যেখানে তাদের প্রাপ্য ফলাফল দ্বারা লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্তও হতে পারে তাই পরিবর্তনশীল খেলা নামে পরিচিত।

চিকেন মডেল

ক্রীড়া তত্ত্বের ‘চিকেন মডেল’ ক্রীড়া তত্ত্বের দু-ব্যক্তির মধ্যে খেলা (two person variable sum game) এর একটি বিশেষ দিক। আমেরিকান মিথোলজিতে এ খেলার প্রচলন লক্ষ করা যায়। এ খেলার বর্ণনায় বলা হয়, একটি সরু রাস্তা দিয়ে দুজন বালক দুটো গাড়ি নিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বিপরীত দিক থেকে পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে। এ পরিস্থিতিতে প্রত্যেকের সামনে দুটি বিকল্প পথ খোলা থাকে, তা হলো : এক পার্শ্বে সরে পড়া, অথবা সরে না পড়া। কিন্তু যে প্রথমে সরে পড়বে সে চিকেনে (Chicken) এবং যে সোজা গাড়ি চালিয়ে যাবে সে বীরে (hero) পরিণত হবে।

খেলোয়াড়দ্বয়কে A ও B দ্বারা সূচিত করা যাক। যেহেতু প্রত্যেকের দুটি করে বিকল্প পথ আছে, তাই এ খেলার ফলাফল চার প্রকার হতে পারে। A খেলোয়াড়ের সরে পড়া এবং না পড়া বিকল্পদ্বয়কে a1 ও a2 দ্বারা এবং B-এর সড়ে পড়া ও না পড়া বিকল্পদ্বয়কে b1 ও b2 দ্বারা সূচিত করা যায়।

  • ১. a1b1 – A ও B উভয়ই সরে পড়বে। কারও ক্ষতি হবেনা, আবার কারও লাভ হবেনা, দুজনের টাই হবে। A ও B উভয়ের পয়েন্ট জিরো।
  • ২. a1b2 – A সরে পড়বে, B সোজা যাবে। তাতে A এর লস হবে, B এর গেইন হবে। ধরলাম এতে B এর পয়েন্ট হলো ১০, A এর পয়েন্ট -১০।
  • ৩. a2b1 – A সরবে না, B সরে পড়বে। তাতে A এর লাভ হবে, B এর লস হবে। তাহলে এখন A এর পয়েন্ট ১০, B এর পয়েন্ট -১০।
  • ৪. a2b2 – A ও B কেউই সরবে না। তারা দুজনই চলতে থাকবে ও ধাক্কা খাবে, মরে যাবে। এক্ষেত্রে A ও B উভয়ের লস। মরার কারণে ধরলাম উভয়ের পয়েন্ট -১০০০ করে।

মজার ব্যাপার হলো A ও B এর কেউই জানেনা যে অন্যপক্ষ কী ভাবছে, তারা সরে পড়তে চায় নাকি গাড়ি চালিয়ে যেতে চায়। এই অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকলে উভয়ের জন্যই সম্ভাব্য অপশন দুটো হচ্ছে – অপর পক্ সরে যাওয়ায় ১০ পয়েন্ট লাভ, আর অপর পক্ষ সরে না যাওয়ায় ১০০০ পয়েন্ট লস। যেখানে অপর পক্ষের সরে পড়া আর না পড়ার চান্স ফিফটি-ফিফটি। কিন্তু লসের পয়েন্ট লাভের পয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি। অন্যদিকে আমি যদি সরে পড়ি তাহলে যে দুটো অপশন থাকে তার একটির পয়েন্ট ০ (যদি অপরপক্ষও থেমে যায়) আর একটির পয়েন্ট -১০ (যদি অপর পক্ষ না থামে)। এক্ষেত্রেও অপরপক্ষের থামার চান্স ফিফটি-ফিফটি। কিন্তু এখানে আমার যে লস হতে পারে, তা আমি না থামলে যে লসটা হতে পারত তার থেকে অনেক কম। শেষ পর্যন্ত দুজনের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে যৌক্তিক পথটা হচ্ছে থেমে যাওয়া। আর তারা তাই করে।

চিকেন মডেলের বাস্তব প্রয়োগ

ক্রীড়া তত্ত্বের চিকেন মডেলের সাহায্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদ্ভুত বিশেষ ধরনের দ্বন্দ্ব পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করা সম্ভব। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৬২ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট’ (Quban Missile Crisis of 1962) এর কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে যা স্বাভাবিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আমেরিকাও হুমকি প্রতিহত করার জন্য রাশিয়াকে কিউবা থেকে ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নিতে বলে। এছাড়া পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আমেরিকা রাশিয়ার ওপর ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগের হুমকি প্রদান করে। এ পরিস্থিতিতে একটি আণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয়। পূর্বের চিকেন মডেলের সাথে মিলিয়ে এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে যথাক্রমে A ও B ধরা যাক, যেখানে গাড়ির জায়গায় হবে ক্ষেপণাস্ত্র। চিকেন মডেল অনুসারেই দুপক্ষেরই ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নেবার কথা। অর্থাৎ চিকেন মডেলের তাত্ত্বিক জ্ঞানের আলোকে এই সংকটের সমাধান হবে উভয়পক্ষের আত্মসংযম বজায় ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের ভাষায় বলা যায় mutual restriant. বাস্তব ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। উভয় রাষ্ট্রই পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি আণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। একই কথা ওয়ার অফ এট্রিশনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দুপক্ষ দীর্ঘদিন যুদ্ধের ফলে যদি যুদ্ধ কন্টিনিউ করলেই উভয়ের লাভের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে হয় তাহলে এরা শান্তি স্থাপন করে, যদি যুদ্ধ চালিয়েও যায় তবুও দেখা যায় এরা ধীর হয়ে যায়। তাই বলা যায়, সংকট নিরসনের জন্য উভয়ের দ্বারা গৃহীত নিকৃষ্ট পছন্দটাই উভয়ের জন্য উৎকৃষ্ট নিশ্চয়তা প্রদান করছে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে এটি হচ্ছে জেতার লাভের চেয়ে হারের ক্ষতি অনেক বেশি হবার কারণেই।

প্রিজনারস ডিলেমা

এটাও একটি গেইম থিওরির উদাহরণ। এখানে কেইস হচ্ছে, ধরি A ও B দুজন বন্ধু, তারা একই সাথে চুরি করেছে, চুরির টাকা কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, এরপর দুজনই পুলিসের কাছে ধরা পড়েছে। পুলিস দুজনকে আলাদা আলাদা ঘরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। উভয়কেই নিম্নোক্ত শর্তগুলো দেয়া হলো –

  • ১. যদি দুজনই কিছু না বলে তাহলে দুজনের এক বছরের জেইল হবে।
  • ২. যদি একজন চুরির টাকার সন্ধান দেয়, কিন্তু আরেকজন না দেয়, তাহলে যে সন্ধান দিয়েছে সে ছাড়া পাবে, কিন্তু যে দেয়নি তার ৩ বছরের জেইল হবে।
  • ৩. যদি দুজনই চুরির টাকার সন্ধান দেয় তাহলে দুজনেরই ২ বছরের জেইল হবে।

এখানে দুজন চোরের কেউই জানেনা যে অপর পক্ষ কী করবে। এক্ষেত্রে অপরপক্ষের সব বলা আর না বলার চান্স ফিফটি ফিফটি। এক্ষেত্রে দুজন লাভ লোকশান এনালাইজ করবে। যদি অপরজন কিছু না বলে সেক্ষেত্রে আমি কিছু না বললে আমার লস ১ বছর, কিন্তু যদি বলি তাহলে আমার লস নেই। আর যদি অপরজন কিছু বলে, সেক্ষেত্রে আমি যদি কিছু না বলি তাহলে আমার লস ৩ বছর, কিন্তু আমি যদি কিছু বলি সেক্ষেত্রে আমার লস ২ বছর। মানে আমি কিছু না বললে আমার ১ বছর ও ৩ বছরের মধ্যে যে কোন একটি ক্ষতি হচ্ছে, কিন্তু চুরির টাকার সন্ধান ফাঁস করে দিলে আমার ক্ষতি হচ্ছে ০ বা ২ বছর লস। মানে মুক্তি পাবার একটা চান্স থেকে যাচ্ছে। সেজন্য সেই চোর যদি নিজের উপকার চায় তাহলে তার জন্য এক্ষেত্রে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত হবে সম্পদের সন্ধান পুলিসের কাছে ফাঁস করে দেয়া। কিন্তু সেই চোর যদি উভয়ের সামষ্টিক উপকার চায় তাহলে তার উচিৎ হবে ফাঁস না করা, কারণ তাতে দুজনই মাত্র এক বছর বাদে বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো গবেষণায় দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষ এক্ষেত্রে কেবল নিজের উপকারটাই দেখে, সমষ্টির উপকারটা দেখে না। অর্থাৎ যে অপশনটা গ্রহণ করলে নিজের যতটা না ভাল হলো তার চেয়ে বেশি যদি সমষ্টির ক্ষতি হয় তবুও সে নিজের ভালটাই দেখে। এটাকে বলা হয় ট্র্যাজেডি অফ দ্য কমনস। অন্যদিকে চিকেন মডেলের ক্ষেত্রে এরকম নিজের লাভ বনাম সমষ্টির লাভের কোন ডিকোটমি নেই। সেখানে যাতে সমষ্টির সর্বোচ্চ লাভ, তাতেই নিজের সর্বোচ্চ লাভ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.