ইসলামী স্বর্ণযুগে মুসলিমদের অবদানের মিথ

(ইবনে ওয়ারাকের Why I am not a Muslim গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে)

Table of Contents

ভিন্নমত এবং প্রচলিত মতের বিরোধিতা, নাস্তিক্যবাদ এবং মুক্তচিন্তা, যুক্তি এবং উদ্ঘাটন

ইসলামের সমগ্র ইতিহাস জুড়েই এর মূল নীতির বাইরে অনেক ভিন্নমত এর সন্ধান পাওয়া যায়।  রবার্টসন এর ভাষায় এগুলো হল ‘রেশনালাইজিং হেরেসি” বা “যৌক্তিক ভিন্নমত”।  ইসলামে এই বিপথগামী  ভিন্নমতগুলোর প্রতি যথেষ্ট সহনশীলতার বিধান থাকলেও (গোল্ডজিহার এর ভাষায়, “হাদিসে পারষ্পরিক সহনশীলতার নিদর্শন রয়েছে। নবীজী বলেন, “আমার সমাজে বিভিন্ন ধরণের মতামত এর অবস্থান হল  স্বর্গীয়ভাবে ক্ষমাপ্রদর্শনের একটি উদাহরণ” একারণে সুন্নি ইসলামের চারটি ভিন্ন ভিন্ন আইনশাস্ত্রের ধারাকে ইসলামে সমানভাবে সঠিক ও মূলনীতি হিসেবে ধরা হয়) অবিশ্বাসের প্রতি ইসলাম ছিল চিরকালই অসহিষ্ণু অবস্থান যার শাস্তি ছিল কেবল মৃত্যু।  আর এই অবিশ্বাসীদের মধ্যে শিয়া, খারিজি, মুরজিয়া, মুতাজিলা সম্প্রদায়ের অনেকে তো ছিলেনই, এমনকি সুন্নি সম্প্রদায়ের কিছু মানুষও এখান থেকে বাদ যান নি। এদের অনেকেই ইসলামের মৌলিক বিধানগুলো যেমন নবুয়তকে অস্বীকার করতেন আবার আত্মার এক দেহ থেকে আরেক দেহে যাবার মত ধারণাগুলোতেও বিশ্বাস করতেন। প্রকৃতপক্ষে যদি কেউ একেশ্বরবাদ, মুহম্মদের নবুয়ত এবং কোরানের স্বর্গীয় উৎপত্তিকে অস্বীকার করতেন তাহলেই তাকে ইসলামের চৌহদ্দির বাইরের বলে বিবেচনা করা হত।

আমরা এখন দেখব, ভিন্নমত ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীরনের ব্যাপারে এখনকার মুসলিম এপলোজিস্টরা যতটুকু স্বীকার করে থাকেন, এই নিপীরণ অতীতে এর চেয়েও আরও অনেক বেশি ছিল।

গ্রীক দর্শনের প্রভাবে কিছু নির্দিষ্ট সম্প্রদায় ও ব্যক্তির মধ্যে যুক্তিবাদের উত্থান ঘটে। যুক্তিবাদ হল সত্যকে জানার জন্য এবং জীবন ধারণের পথপ্রদর্শক হিসেবে যুক্তির প্রতি বিশ্বাস ও সম্মান। যুক্তিবাদী দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক ও আল মা’আরির মত সংশয়বাদীগণ প্রায়শই গোড়া ইসলামের মৌলিক স্বতঃসিদ্ধগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতেন। কিন্তু পরিশেষে গ্রীক দর্শনের সাথে গোড়া ইসলামের সংঘর্ষে এই গোড়া ইসলামকেই বিজয়ী রূপে দেখা গিয়েছে। ইসলাম তর্কাতীতভাবে এটাকেই মেনে নেয় যে সত্য কেবলমাত্র কোন স্বর্গীয় পুস্তক বা আসমানি কিতাব থেকেই পাওয়া সম্ভব । কোন মানুষ যে যুক্তির ভিত্তিতে সত্যকে উদ্ঘাটিত করতে পারে এটা এই ধর্ম বিশ্বাস করতে চায় না।  যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে গোড়া ইসলামের জয় যেই সময়েই হোক না কেন, তা সে নবম শতকে আল আশারির মতের পরিবর্তনের কারণেই হোক আর একাদশ শতকে আল গাযালির কাজের জন্যই হোক, আমার বিশ্বাস এটা শুধু মুসলিমদের জন্যই নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি ছিল। ক্ষতি এতটাই বড় ছিল যে এর ফলাফল বর্তমানে আলজেরিয়া, ইরান, সুদান, পাকিস্তান, সৌদিআরবে “পুনরুত্থানকারী ইসলাম” এর বর্বরতাগুলো দেখলেই বোঝা যায়। বিশেষ করে রাজনৈতিক ইসলাম আধুনিক বিশ্বের সাথে মানিয়ে চলতে সম্পুর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

সূচনা সময়

আমরা কোরানে দেখি, মক্কাতেই অনেক আরব সংশয়বাদী ছিলেন যারা মুহম্মদের প্রচারিত গল্পগুলোকে বিশ্বাস করেন নি। তারা দেহের পুনরুত্থান সম্পর্কিত গল্পগুলো সম্পর্কে উপহাস করতেন আর মুহম্মদের কাছে কোরান নাজিল হবার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতেন। এমনকি তারা কোরানের ক্ষেত্রে তারা মুহম্মদকে তখনকার আরব প্যাগান কবিদের লেখা নকল করার অভিযোগও করেন। এখনও কোরানের কিছু আয়াত পাওয়া যায় যেগুলো এসেছে ইসলামপূর্ব আরব কবি আল কায়েসের কাছ থেকে। রবার্টসন বলেন, মক্কার মুক্তচিন্তাকারীদের ধন্যবাদ। তাদের জন্যই আমরা ইসলামের প্রথম দিককার সময়ে মুহম্মদের উপর খুব কম সংখ্যক অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা দেখতে পাই।  মুহম্মদের এই বিরোধীরা পরকাল আর অতিপ্রাকৃতিক ঘটনায় বিশ্বাস করতেন না এবং এগুলো নিয়ে মুহম্মদকে চ্যালেঞ্জ করতেন যা আমাদের দেখায়, তারা যুক্তির সাথেই মুহম্মদের দাবীকে অবিশ্বাস করেছেন যেকারণে মুহম্মদের প্রথম সময়ে অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা বা মিরাকেল অনেক কম দেখা যায়। রবার্টসন উপসংহার টেনেছেন, “এই সব সংশয়বাদী, অবিশ্বাসী লোকদের, যাদের কবিতায় ধর্মের কোন ছাপ ছিলনা, তাদের উপর ইসলাম ধীরে ধীরে একেশ্বরবাদ এর ছায়ায় নিপীড়নমূলক অনুশাসন ও প্রচুর কুসংস্কার চাপিয়ে দেয়।”

প্যাগান বা মুর্তিপুজারি আরবদের ধর্মীয় আবেগ কম ছিল। তারা তাদের বৈশ্বিক সাফল্যের জন্য কোন উচ্চতর শক্তিকে ধন্যবাদ দিতে আগ্রহী ছিল না।  তাই ইসলামের প্রাথমিক সময়ে আরবদের মাঝে এধরণের প্যাগান স্বভাব থাকবে, একথায় অবাক হবার কিছু নেই। আরবরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল লোভ, লুণ্ঠন ও বিশ্বজয়ের সাফল্যের জন্য। তাই অনেকে কাপুরুষের ন্যায় ইসলামকে গ্রহণ করলেও ইসলামের মতবাদ, আচারের উপর তাদের আকর্ষণ ছিল না। স্প্রেঞ্জার হিসাব করে দেখেছিলেন মুহম্মদের মৃত্যুর সময় ইসলামে প্রকৃত ধর্মান্তরকারী বা ইসলামী মতবাদে প্রকৃত বিশ্বাসীর সংখ্যা এক হাজার ছাড়ায় নি। সুযোগ পেলেই বেদুঈনরা ইসলাম ত্যাগ করতে চাইত। ইসলাম মদ ও যৌনতার মত তাদের দুটো আকর্ষণীয় জিনিস নিষিদ্ধ করা করেছিল। এজন্য ইসলাম তাদের কাছে কখনই প্রিয় ছিল না।

আরবরা মুসলিমদের নামাজ নিয়ে ও নামাজের সময় তাদের বিশেষ অঙ্গভঙ্গি নিয়েও হাসাহাসি করত। গোল্ডজিহার বলেন489, “এরকম অগণিত গল্প আছে যেগুলো মরুভূমির আরবদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীনতা, মুসলিম রীতিনীতির ব্যাপারে অজ্ঞতা, এমনকি ঈশ্বর প্রেরিত পবিত্র গ্রন্থের উপর অজ্ঞতার ব্যাপারেও নির্দেশ করে। এই গল্পগুলো তাদের সত্যিকারের জীবন থেকে নির্ভুলভাবে নেয়া হয়েছে। আরবরা সবসময় পবিত্র কোরান তেলোয়াতের চেয়ে তাদের প্যাগানিজমের বীরদের গল্প শুনতে বেশি ভালবাসত। এসম্পর্কে বলা যায়, খাওয়ারিজ গোত্রের দলনেতাদের একজন উবায়দা বিন হিলাল যুদ্ধফেরত সৈন্যদেরকে বিশ্রামের জন্য তার তাবুতে আশ্রয় দিতেন। একবার দুইজন সৈন্য যুদ্ধ শেষে তার তাবুতে বিশ্রাম নিতে আসলে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন, “আপনারা কোনটা পছন্দ করবেন? আপনাদের আমি কোরান তেলাওয়াত করে শোনাব নাকি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাব?” উত্তরে সৈনিকরা বলে, “আমরা আপনাকে যেমন জানি, কোরানও তেমন জানি। কোরানের চেয়ে বরং কবিতাই আবৃত্তি করা হোক।” এই শুনে উবাইদা তাদের বলেন, “ওরে ধর্মহীনের দল, আমি জানতাম আপনারা কোরানের চেয়ে কবিতাই বেশি পছন্দ করবেন।

আমরা ইতিমধ্যে ইসলামের প্রথম দিকের বীরদের যেমন খালিদ বিন ওয়ালিদ, ওসমান বিন তালহা, আমর বিন আল আস দ্বারা চাপিয়ে দেয়া ধর্মের প্রতি আরবদের বিতৃষ্ণার কথার উল্লেখ করেছি। আমরা এক্ষেত্রে একজন মুসলিম নেতার উক্তি স্মরণ করতে পারি যিনি সেই উক্তিটির জন্যই পরিচিত ছিলেন, “যদি একজন ঈশ্বর থেকে থাকত, আমি তার নামে শপথ করে বলতাম যে আমি তাকে বিশ্বাস করি না।”

উমাইয়া খলিফারা (৬৬১-৭৫০)

উমায়াদগণ সবসময় তাদের বিরোধীদের কাছে ঈশ্বরহীণ বা নাস্তিক বলে বিবেচিত হয়ে এসেছেন। ইসলামের মতবাদ ও রীতিনীতির প্রতি অজ্ঞতার ধারাটি প্রথম ইসলামি শতাব্দিতে ভালই চলেছিল। ইসলাম সে সময় কোনরকম স্থিরকৃত রীতিনীতিতে বা মতবাদে চালিত হয় এটা জোড় দিয়ে বলা যাবে না। আমরা খলিফা দ্বিতীয় আল ওয়ালিদের (শাসনকাল শুরু ৭৪৩) সময়ে পরিবেশ কিরকম ছিল সেটা জানলে এবিষয়ে ধারণা পেতে পারি। আল ওয়ালিদ বড় হয়েছেন কোরানের ১৪.৮,৯ আয়াতটিকে উপহাস করতে করতে। সেই আয়াতটি লেখা হয়েছিল জেদি বিরোধীদেরকে নির্দেশ করে। এই আয়াতটিকে নির্দেশ করে আল ওয়ালিদ বলতেন, “তুমি তোমার জেদি বিরোধীদের বিরুদ্ধে হুমকি নিক্ষেপ করেছ। তাই যদি হয় তাহলে আমি নিজেই সেই জেদি বিরোধী। যখন তুমি শেষ বিচারের দিন ঈশ্বরের সামনে হাজির হবে তখন তাকে বলো, হে ঈশ্বর, আল ওয়ালিদ আমাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছিল।”490 ওয়ালিদ বল্লম দিয়ে কোরানে আঘাত করতেন। তীর নিক্ষেপ করে কোরানকে খণ্ডখণ্ড করতেন আর উপরে উল্লিখিত কথাগুলো বারবার উচ্চারণ করতেন। তিনি সবসময় কবি, নর্তকী, গায়কদের নিয়ে থাকতেন এবং একজন সুখী কামুকের জীবন অতিবাহিত করতেন। ধর্মের প্রতি তার কোন আগ্রহই ছিল না। উমাইয়াগণ ধার্মিক ছিলেন না এবং ধর্মে কোনরকম শ্রদ্ধা দেখাতেন না। তবু তারা মনে করতেন যে তারা ইসলামের কাজ করছেন। কিন্তু উমাইয়াদের শাসন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রপ্রত্যাশী ধার্মিকদের পরিতৃপ্ত করতে ব্যর্থ হয়।

আব্বাসিয় খলিফারা (ইরাক ও বাগদাদে, ৭৪৯-১২৪৯)

নাস্তিকতা বা ঈশ্বরহীনতা এবং ধর্মবিরোধীতার কারণে আব্বাসিয়রা উমাইয়াদের পতন ঘটান।  নতুন এই বিজয়ীরা ইসলামের নীতিকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে আরও বেশি কঠোর ছিলেন। আর এটা করতে গিয়ে তারা অন্যান্য ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে তারা আরও বেশি অসহিষ্ণুতা দেখান। গোল্ডজিহার বলেন, “নৈতিকতার ক্ষেত্রে তারা উমাইয়াদের তুলনায় আরও বেশি পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ নেন।”491 তারা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন একটি ধর্মীয় নীতির উপর ভিত্তি করে। এই নীতি অনুসারে, তারা ঈশ্বরের চূরান্ত সার্বভৌমতা দাবী করেন এবং নিজেদেরকে দাবী করেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে। তারা নিজেদেরকে তাই “পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া” বলতেন কারণ তারা ঈশ্বরের আইন অনুসারে পৃথিবীকে পরিচালনা করতেন। ধার্মিকদের দৃষ্টিতে আব্বাসিয়দের খিলাফত বৈধ কারণ তারা নবীর চাচা আল আব্বাসের বংশধর।

খারিজি সম্প্রদায়

খারিজিদেরকে ইসলামের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে প্রথম বলে বিবেচনা করা যায়। তারা খিলাফত তত্ত্বের বিকাশের জন্য এবং “কর্ম একটি অখণ্ড উপাদান” বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তাদেরকে প্রায়ই ইসলামের পিউরিটান বা বিশুদ্ধতাবাদী বলে অভিহিত করা হয়। এর কারণ হচ্ছে, তারা দাবী করেছিলেন প্রার্থনার জন্য যে শারীরিক বিশুদ্ধতার দরকার হয় সেটা অর্জনের জন্য চেতনার বিশুদ্ধতা অর্জন একটি অপরিহার্য উপাদান। তারা নিশ্চিতভাবেই চরমপন্থী ছিলেন। কারণ যারা তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বীকার করতেন না তাদেরকে তারা অবিশ্বাসী এবং নীতিবহির্ভূত বলে আখ্যায়িত করতেন। তাদের মাত্রাতিরিক্ত ধর্মান্ধতা তখনই স্পষ্ট হয় যখন তারা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু করে। তারা নারী ও শিশুদেরকেও হত্যা করতেন। খারিজিরা ৬৫৫  সালে ওসমানের  হত্যার পর আলী কর্তৃক খিলাফতের দাবীকে অস্বীকার করেন। একইভাবে তারা হত্যার পূর্বে ওসমানের আচরণেরও নিন্দা করে আসছিলেন।  ওসমানের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না।

ধীরেধীরে তাদের ধর্মান্ধ কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই আলী তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেন এবং ৬৫৮ সালে নাহ্‌রাওয়ানের যুদ্ধে তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে খারিজিদের অনেককেই হত্যা করা হয়। এরপরের দুই বছরে অনেকগুলো আঞ্চলিক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। আর নাহ্‌রাওয়ানের যুদ্ধের তিন বছর পর ৬৬১ সালে আলী নিজেই একজন খারিজি কর্তৃক গুপ্তহত্যার শিকার হন। পরবর্তী খলিফা এবং উমাইয়া খিলাফতের প্রথম শাসক মুয়াবিয়ার শাসনামলেও কয়েকটি খারিজি বিদ্রোহ মাথাচাড়া দেয় কিন্তু সেগুলোকে নৃশংসভাবে দমন করা হয় এবং অনেক বিদ্রোহীকেই হত্যা করা হয়। অষ্টম শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত তাদের বিদ্রোহ চলতে থাকে।

খারিজি সম্প্রদায়ের একটি হিংস্র উপসম্প্রদায় ছিল আজরাকি যারা অন্য সকল মতের অনুসারীদেরকে ধর্মদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং কোরানের ছায়ার বাইরে থাকা অন্যান্য সকল সম্প্রদায়কে বর্জন করেন। তারা আরও দাবী করতেন, কোরানের বর্ণনা অনুযায়ী মহাপাপীদের (কবিরা গোনা করেছেন যারা) জন্য নরক নির্দিষ্ট। এরকম মহাপাপীদেরকে ধর্মত্যাগী বলে বিবেচনা করা হবে এবং তাদেরকে তাদের স্ত্রী ও সন্তান সহ হত্যা করতে হবে।  একারণেই আজরাকিরা অনেক মর্মান্তিক গণহত্যা ঘটিয়েছেন। দেলিয়া ভিদা তাদের এই নীতিকেই ধর্মীয় হত্যার নীতি বলে আখ্যায়িত করেছেন।492

অন্যান্য মুসলিমদের তুলনায় খারিজিরা অমুসলিমদের প্রতি যথেষ্ট সহিষ্ণু ছিলেন। কখনও কখনও তারা অমুসলিমদেরকে মুসলিমদের মত সমানভাবে দেখতেন। গোল্ডজিহের বলেন, তাদের বিশ্বাস একটি নির্দিষ্ট, ধনাত্মক রীতিতে চলে যাওয়ার পূর্বে খারিজি ধর্মতাত্ত্বিকগণ একধরণের যুক্তিবাদী প্রবণতা দেখিয়েছিলেন যা পরবর্তী যুক্তিবাদী সম্প্রদায় মুতাজিলাদের প্রভাবিত করে। এদের একটি দল কোরানের একটি কথার সত্যতার বিরুদ্ধেও বলেছিলেন। তাদের দাবী ছিল সুরা জোসেফ কোরানের নিজের না। এই সুরার অংশগুলো পার্থিব এবং অসার। এটা কেবলই একটি যৌন উত্তেজক গল্প এবং এখানে পবিত্র কিছুই নেই। আর তাই ঈশ্বরের কথা হবার কোন যোগ্যতাই এর নেই। আরেকজন খারিজি ধর্মতাত্ত্বিক ইয়াজিদ বিন আবি আনিসা একটি কথা বলেছিলেন যা নিশ্চিতভাবেই ধর্মবিরোধী। তিনি বলেছিলেন ঈশ্বর পারস্যদের মধ্য থেকে একজন নবীকে একটি নতুন কোরান দান করবেন যিনি ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামের ভাবধারায় একটি নতুন ধর্মের প্রবর্তন করবেন। এটা পরিষ্কারভাবেই ইসলামের মৌলিক নীতি হিসেবে কোরানের শেষ ও চূড়ান্ত ধর্মগ্রন্থ এবং মুহম্মদের শেষ নবী হবার ধারণার বিরুদ্ধে যায়।

এভাবেই খারিজিরা বিশ্বাসকে যুক্তিবাদের পর্যায়ে স্থাপন করে মুসলিম ধর্মতত্ত্বের বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

কাদেরিয়া সম্প্রদায়

বিশেষজ্ঞ হিউবার্ট গিমির মতে, নবী মুহম্মদের নিয়তিবাদী অবস্থান তার জীবনের শেষের দিকে কঠোর রূপ ধারণ করেছিল। এবং প্রাথমিক দিকের মুসলিমদের প্রবণতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হয় তারা একধরণের আপোষহীন নিয়তিবাদে বিশ্বাস করত।493 মানুষের এধরণের অতিমাত্রায় অসহায় অবস্থান সপ্তম শতকের শেষের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে। আর একে প্রশ্নবিদ্ধ মুক্তচিন্তাকারীরা করেন নি, করেছিল খ্রিষ্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া মুসলিম ধার্মিকরা। এই ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছার ধারণার  ধারকগণ কাদেরিয়া নামে পরিচিত কারণ তারা ভাগ্য বা কাদরকে সীমাবদ্ধ করার বিরোধী ছিল। আর কাদেরিয়াদের বিরোধীদেরকে বলা হত জাবরিয়া। এরা ভাগ্যের অন্ধ বাধ্যবাধকতায় (জাবর)  বিশ্বাস করত।  গোল্ডজিহের বলেন494, “ইসলামের ইতিহাসে কাদেরীদের আন্দোলন খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা ছিল প্রচলিত প্রথাভিত্তিক ধর্মীয় আবরণের বাইরে গিয়ে স্বাধীনতার প্রথম পদক্ষেপ।”

কাদেরিয়াদের বিরুদ্ধে যায় এমন প্রচুর হাদিস আছে।  তাই কাদেরীদের কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অন্যদিকে উমাইয়াদের কাছে কাদেরীদের ঐক্যনাশক মতবাদকে ভয় পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক কারণও ছিল।  আমরা পূর্বেই জেনেছি যে উমাইয়াদেরকে ঈশ্বরহীন বা নাস্তিক বলে বিবেচনা করা হয়। এবং শাসক হিসেবে তারা ছিল তাই অবৈধ। আর এক্ষেত্রে নিয়তিবাদে বিশ্বাস তাদের বিরুদ্ধে ঘটা বিদ্রোহকে দমন করার  জন্য যথার্থ ছিল। উমাইয়ারা প্রচার করতেন, তাদের শাসন হল স্বয়ং ঈশ্বরের ইচ্ছা। এটা ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত এবং অনিবার্য। উমাইয়াদের শাসন যেন ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুই না।

লক্ষণীয় যে, কাদেরিয়া সম্প্রদায় ছিল সাধারণ ইসলামী গোড়ামির বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ রাখা সম্প্রদায়।  আর এজন্য তারা গুরুত্বপূর্ণ।

মুতাজিলা সম্প্রদায় এবং যুক্তিবাদ

১৮৬৫ সালে জুরিখের হাইনরিখ স্টেইনার তার মুতাজিলা সম্প্রদায়ের মতবাদগুলো নিয়ে  একটি গবেষণায় মুতাজিলাদের “ইসলামের মুক্তচিন্তাকারী” বলে উল্লেখ করেছিলেন। এতে উনিশ শতকের ইউরোপের উদারপন্থী চক্রে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।   ১৯০৬ সালে রবার্টসন তার এক লেখাতেও মুতাজিলা সম্প্রদায়কে ফ্রি থিংকার বা মুক্তচিন্তাকারী হিসেবে অভিহিত করেন। যাই হোক, এখন এটা পরিষ্কার যে মুতাজিলারা ছিলেন প্রথম এবং প্রধান মুসলিম সম্প্রদায় যারা ইসলামের ভাবধারার চক্রে বাস করেছেন এবং ধর্মীয় চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।  তারা চুড়ান্তভাবে মুক্তচিন্তাকারী ছিলেন বা তাদের তেমন কোন ইচ্ছা ছিল এমন কোন প্রমাণ নেই।

চিন্তায় মুক্ত না হয়ে তারা বরং অতিমাত্রায় অসহিষ্ণু ছিলেন এবং মিহনা এর সাথেও জড়িত ছিলেন। মিহনা ছিল আব্বাসিয়দের নেতৃত্বে চলা মুসলিম ইনকুইজিশন।

তবুও মুতাজিলা সম্প্রদায় ইসলামিক মতবাদগুলোর আলোচনায় গ্রীক দর্শনের পরিচিতি ঘটানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এই গ্রীক দর্শনই তাদের মাঝে সংশয়বাদ, যুক্তিবাদ, সন্দেহ নিয়ে আসে যা প্রচলিত গোড়া ইসলামের বিরুদ্ধে চলে যায়। গোল্ডজিহের এর কথায়495 “তারাই প্রথম ইসলামে ধর্মীয় চেতনার প্রসার ঘটান এবং ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান উপাদান নিয়ে আসেন যার নাম হল যুক্তি (আকল)।” এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও বলেছিলেন, “জ্ঞানের প্রথম শর্ত হল সন্দেহ”। কেউ কেউ বলেছিলেন “পঞ্চাশটি সন্দেহ একটি নিশ্চয়তার চেয়ে ভাল”। তারা বলতেন, মানুষের সাধারণ পাঁচটি ইন্দ্রিয় ছাড়াও আরেকটি ইন্দ্রিয় আছে, আর সেটা হল যুক্তি বা আকল। বিশ্বারের ক্ষেত্রে যুক্তি তাদের কাছে প্রধান বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়। তাদের প্রথমদিকের প্রতিনিধিদের একজন, বাগদাদের বিশর ইবনে মুতামির তার প্রাকৃতিক ইতিহাস নিয়ে একটি কবিতার অংশ হিসেবে যুক্তির একটি যথার্থ বিজয়গাঁথা লিখে গেছেন:

“যুক্তি কতই না চমৎকার ভাল ও খারাপ সময়ের পথপ্রদর্শক এবং সঙ্গী হিসেবে,

একজন বিচারক হিসেবে, যিনি তার বিচারের রায় এক অদৃশ্যের দিকে দিয়ে দেয় যাকে কখনও চোখে দেয়া যায় না

… তার একটি কাজ হল সে ভাল ও খারাপের পার্থক্য করতে জানে, আর সেটা করা হয়

একজন ক্ষমতার অধিকারীর মাধ্যমে যাকে ঈশ্বর আলাদা করেছেন বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতা দিয়ে।”

মুতাজিলারা প্রচলিত কুসংস্কারগুলোকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা শুরু করেন, বিশেষ করে এসকাটোলোজির (ধর্মতত্ত্বের একটি ভাগ যা সৃষ্টির শেষ দিনগুলো নিয়ে আলোচনা করে) পৌরাণিক উপাদানগুলো নিয়ে। এই পৌরাণিক উপাদানগুলোকে তারা মুসলিম বিশ্বাসের অংশ হিসেবে মনে করতেন না। তারা পুলসিরাত সেতুর একটি রূপক ব্যাখ্যা দান করেন যেই সেতুটিকে পরবর্তী বিশ্বে যাবার জন্য পাড় হতে হয় (পূর্বে এই সেতু সম্পর্কে এবং কিভাবে এই সেতু পাড় হতে হয় উল্লেখ করা হয়েছে) । মুতাজিলারা বললেন এটা আসলে একটি দাড়িপাল্লা বা মাপকাঠিকে নির্দেশ করছে যেখানে মানুষের কার্যাবলিকে মাপা হবে। তারা  আরও অনেক শিশুতোষ কল্পনামূলক কাহিনীকে বর্জন করেন।

মুতাজিলাদের প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল স্বর্গীয় বিচার এবং একতা। কিন্তু তাদের দর্শন অনুযায়ী তাদের সব নীতিকে মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম নীতিটি ছিল তাদের কঠোর একেশ্বরবাদ এবং ঈশ্বরের সাথে তার সৃষ্টির তুলনায় অস্বীকার। কোরানে ঈশ্বরের হাত, ঈশ্বরের চোখের মত পদের উল্লেখ থাকলেও এই এনথ্রপোমরফিজম বা নরাত্বরোপকে তারা রূপক বলে মনে করেন। এছাড়া প্রথম নীতিটি পারসোনাল গড বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঈশ্বরকে সমর্থন এবং নবীর উদ্ঘাটিত পথকে সমর্থন করার সাথে সম্পর্কিত।

দ্বিতীয় নীতিটি বলে, ঈশ্বর হলেন ন্যায়বিচারক। তিনি মানুষের কুকর্মের জন্য দায়ী নন। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তির কার্য সম্পাদিত হয় তার ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছার কারণে।

তৃতীয় নীতিটি ছিল ব্যাবহারিক ধর্মতত্ত্ব বা প্র্যাকটিকেল থিওলজি সম্পর্কিত। এটি বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস সংক্রান্ত সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করে। এক্ষেত্রে পাপকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়: গ্রেভ সিন বা মহাপাপ (কবিরা গোনা) এবং পেটি সিন বা ক্ষুদ্র পাপ।  মহাপাপকে এড়িয়ে চলতে হলে বিশ্বাস করতে হবে। মহাপাপ হল সেইসব কাজ যেসব কাজে ঈশ্বর নিষেধাজ্ঞা এবং শাস্তির বিধান দিয়েছেন।

চতুর্থ  নীতিটি ছিল থিওক্রেসি বা ঈশ্বরতন্ত্র (ইশ্বরের বিধানে উপর ভিত্তি করে শাসনব্যবস্থা) সংক্রান্ত এবং যে সকল মুসলিম মহাপাপ করেছে তাদের মুসলিম বলা হবে কি হবে না এই সংক্রান্ত।  মুতাজিলা সম্প্রদায়ের একজন প্রতিষ্ঠাতা, ওয়াসিল বলেছিলেন, “মহাপাপীরা অবশ্যই নাস্তিক এবং বিশ্বাসীদের মধ্যবর্তী জায়গায় পড়বে।”

পঞ্চম নীতিটি ছিল সঠিক কাজের জন্য নির্দেশ এবং ভুল কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত। নাইবার্গ বলেছেন, “বিশ্বাসকে অবশ্যই জিভ, হাত এবং তরবারি দ্বারা ছড়িয়ে দিতে হবে”। 496

অবশ্যই ইশ্বরের প্রতি ধর্মনিষ্ঠা এবং ঈশ্বরের ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই মুতাজিলা সম্প্রদায় এর যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারা স্পষ্টভাবে যুক্তিকে ধর্মের উৎস্য বলে কোথাও উল্লেখ করেন নি। কিন্তু তারা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নিয়েছিল যে ঈশ্বরের ন্যায় এর ক্ষেত্রে তাদের মানবিক ও যুক্তিবাদী ধারণাগুলো বৈধ এবং ঈশ্বর এর মত কোন শাশ্বত সত্তাকে মানুষের সসীম মন দিয়ে বোঝা সম্ভব। যখন তারা স্থির করেছিলেন, কোন অমঙ্গল ও অবিচার ঈশ্বরের উপর আরোপ করা যাবে না, তখন তারা ঈশ্বরকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রক ও শাসক হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। পাপীদের অবশ্যই বিচার হবে। কিন্তু এই পাপীদের পাপ কাজের জন্য দায়ী পাপীরাই। পার্থিব ন্যায়বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে মানুষের ব্যাপারে ঈশ্বরের সর্বময় ক্ষমতাকে অস্বীকার করার দিকে ঠেলে দেয়।

এভাবে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার নীতি তাদেরকে ঈশ্বরের সর্বময় শাসনের ধারণাকে অস্বীকারের দিকে নিয়ে যায়। ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তায় ঈশ্বরের সর্বশক্তিময়তা হয়ে যায় সীমাবদ্ধ। বিশেষ করে মুতাজিলাদের মধ্যে অন্যতম যুক্তিবাদী আল নাজ্জামের লেখায় আমরা দেখি যুক্তিই সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে: “তিনি তার যৌক্তিক ধারণাগুলো এবং মূল্যবোধে এতটাই নিরঙ্কুশতা আরোপ করেন যে স্বয়ং ঈশ্বরকেও সেগুলোর প্রতি মাথা ঝোঁকাতে হয়। মানুষের জন্য যা সর্বোত্তম তা ঈশ্বরকে করতেই হবে। ঈশ্বর অবশ্যই তার নীতিবহির্ভূতভাবে কাউকে স্বর্গ বা নরকে পাঠাতে পারবেন না”।497

আল নাজ্জামের এক ছাত্র, আহমেদ বিন হাবিত তার শিক্ষকের চাইতেও এক কদম সামনে গিয়েছিলেন। কার্যকরীভাবেই তিনি অবিশ্বাসের দিকে চলে যান যতক্ষণ পর্যন্ত না গোড়ারা এই বিষয়ে সচেতন হন। হাবিত মেটেমসাইকোসিস বা পুনর্জন্ম বা দেহান্তরের শিক্ষা দিতেন, মেসিয়াদের স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শেখাতেন, অনেক স্ত্রী থাকার জন্য নবী মুহম্মদের সমালোচনা করতেন এবং অন্যদেরকে মুহম্মদের চাইতে অধিক ধার্মিক বলে দাবী করেন। বেশিরভাগ গোড়ার কাছেই ঈশ্বরকে অবশ্যই কোন না কোন কিছু করতে হবে এরকম ধারণা ঈশ্বরনিন্দার বলে পরিগণিত হবার জন্য যথেষ্ট।  মুতাজিলাদের স্বাধীন ইচ্ছা বা ফ্রি উইলে জোড় দেয়া তাদেরকে মানবতাবাদী বিশ্বাসের দিকে ঠেলে যা বলে মানুষের ভাগ্য মানুষের উপরেই নির্ভর করে। মুতাজিলারা ঈশ্বরের সর্বময় শক্তিকে আরও বেশি সীমাবদ্ধ করে দেয় তাদের “ল অব কমপেনসেশন” বা ক্ষতিপুরণের আইন এর মাধ্যমে, যেখানে যেসব মানুষ বা প্রাণীদের প্রতি পৃথিবীতে অন্যায় করা হয়েছে পরকালে তাদেরকে এর ক্ষতিপুরণ দেয়া হবে। গোল্ডজিহের বলেন, “মুতাজিলারা শেষে ঈশ্বরকে পরাধীন করে দিয়ে নিজেরা স্বাধীন মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন”498

ভাল এবং মন্দ কী? গোড়ারা উত্তর দিলেন, “ভাল হল তা যা ঈশ্বর নির্দেশ করেছেন, আর মন্দ হল তাই যা করতে ঈশ্বর নিষেধ করেছেন”। কিন্তু মুতাজিলারা বরং নীতির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। এক্ষেত্রে তারা সক্রেটিসের যুক্তি অনুসরণ করে এবসোল্যুট গুড- এবসোল্যুট ব্যাড বা চূড়ান্ত ভাল-চূড়ান্ত খারাপ এর মতবাদ গ্রহণ করেন এবং যুক্তিকে নৈতিক মূল্যবোধ বিচারের মূল ভিত্তি হিসেবে বিশ্বাস করেন। তাদের কাছে স্বর্গীয় বিধান নয়, যুক্তিই ছিল নীতির মৌলিক ভিত্তি। কোন কিছুকে ঈশ্বর নির্দেশ দিয়েছেন বলে তা ভাল হয়ে যায় নি, বরং তা ভাল বলেই ঈশ্বর নির্দেশ দিয়েছেন। গোল্ডজিহের বলেন, “এটা কি ঈশ্বরের বাধ্যতামূলকভাবে তার নিজের আইন মান্য করার মতই হয়ে যাচ্ছে না?”499

যুক্তিবাদের অন্যান্য বিষয়গুলো তাদের মধ্যে কোরানের বিষয়েও সন্দেহের সৃষ্টি করে। যুক্তি তাদেরকে কয়েকটি আয়াতের সত্যতার ব্যাপারে সন্দিহান বানিয়ে দেয় যেখানে নবী আবু লাহাবের মত শত্রুদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন। তারা এটাও বিশ্বাস করতেন যে কোরানকে তৈরি করা হয়েছে এবং এটা ঐশ্বরিক নয়। ঈশ্বরের ঈশ্বরিক বৈশিষ্ট্যগুলোর অস্বীকারের ফলাফলস্বরূপ এটা ধারণাটির উদয় ঘটে। মুতাজিলারা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কিভাবে মোজেসকে দেয়া ঈশ্বরের বাণীগুলো শাশ্বত বা চিরন্তন হয় যেখানে মোজেস স্বয়ং একটি বিশেষ সময়ের মানুষ ছিলেন?” গোড়া মুসলিমরা ভয় পেত এই ভেবে যে মুতাজিলারা দুর্যোগ নিয়ে আসতে পারে। তারা বলত, ঈশ্বরের বাণী কোরান যদি শাশ্বত বা চিরন্তন বলে না মানা হয়, যদি এটা তৈরি করার মত কিছু বলে মনে করা হয়, বিপদ এতটাই বেশি হবে যে, যারা নিওপ্লেটোনিজম এর দিকে পা বাড়িয়েছে (মুতাজিলাদেরকে নির্দেশ করা হয়েছে) তারা হয়তো পরবর্তীতে বলবে, মুহম্মদ যেরকম ধ্যানের ফলে জিবরাইল মারফত ঈশ্বরের বচন, কোরান লাভ করেছেন সেরকম অন্যদের পক্ষেও এটা পাওয়া সম্ভব।  যদি যুক্তির কাছে কোরানের পরাজয়কে আটকাতে হয় তাহলে অবশ্যই কোরানের কোরানের “অতুলনীয় অলৌকিকত্বকে”  যেকোন মূল্যে রক্ষা করতেই হবে।500

মুতাজিলাদের যুক্তিবাদ তাদেরকে কোরানের সাহিত্যিক রচনাশৈলীর ইনিমিটেবিলিটি বা অনানুকরণযোগ্যতার (কোরানকে নকল করা সম্ভব নয় এমন ধারণা) ব্যাপারে সন্দিহান করে তোলে। তারা বলেন, “রচনাশৈলীর দিক দিয়ে বিচার করলে কোরানে অলৌকিকত্বের কিছুই নেই। … ঈশ্বর মানুষকে তাদের প্রাকৃতিক স্বাধীনতার কাছে একে ছেড়ে দিয়েছেন এবং কোন বিশেষ ভাষা এবং রচনাশৈলীতেই একে সীমাবদ্ধ করে দেন নি। আরবরা শুধু এর সমতুল্যই না বরং বাগ্মিতা, পদ্ধতি ও ভাষার পবিত্রতার দিক দিয়েও কোরানের চেয়ে উন্নতমানের কিছু রচনা করতে পারে”।501

তারা হাদিসের সত্যতার ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছিলেন কারণ অনেক স্থানীয় বিশ্বাসই সেখানে পাওয়া যাচ্ছিল। তারা এন্থ্রোপমরফিজম বা ঈশ্বরে নরত্বারোপ এর বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে, “ঈশ্বরকে জানার বাধ্যবাধকতায় মানুষের জন্য প্রধান শর্ত কী” এই প্রশ্নের উত্তরে মুতাজিলারা উত্তর দিলেন “যুক্তি”।

মিহনা বা মুসলিম ইনকুইশন (৮২৭ খ্রিষ্টাব্দ-)

আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন মুতাজিলাদের দর্শন গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের কোরানের সৃষ্ট হবার ধারণাকে তার সমগ্র সাম্রাজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক মতবাদ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যেরই প্রধান কর্মকর্তাগণকে সকলের সামনে প্রচার করতে হত যে কোরানকে তৈরি করা হয়েছে। খলিফা নিজে থেকেই বাগদাদের নেতৃত্বস্থানীয় ধর্মতাত্বিকদেরকে এটা নিয়ে যাচাই করেছেন। বাগদাদের গভর্নর তার বিচারে সকল ধর্মীয় বিচারকদেরকে এভাবে যাচাইএর কাজে নিযুক্ত ছিলেন যিনি এই আইনে সকল সাক্ষী এবং সহকর্মীদের যাচাই করতেন।

একজন বিখ্যাত কর্মকর্তা ছিলেন যিনি কোরানের সৃষ্টতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তার নাম ছিল আহমেদ বিন হানবাল যিনি এই অস্বীকারের জন্য দুই বছর কারাবাস করেন। এই সময় তাকে সম্ভবত চাবুক দিয়েও মারা হয়। হানবালকে মুক্ত করা হয় কারণ তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং কর্মকর্তাগণ এটা নিয়ে বিদ্রোহ হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন।

আল মামুনের ভাই এবং উত্তরাধিকারী আল মুতাসিম খুব কঠোরভাবে মিহনা পরিচালনা করেন বলে মনে হয় না। যাই হোক, তার পুত্র আল ওয়াথিক আল মামুনের নীতি চালিয়ে নিয়ে যান। আল ওয়াথিক ব্যক্তিগতভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক নীতকে না মানার কারণে একজন ধর্মতাত্ত্বিককে শিরশ্ছেদ করেছিলেন। খলিফা এই কাজ করতে পরে আর সক্ষম হন নি এবং এই কাজটি তিনি থামাতে বাধ্য হন। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আল মুতাওয়াক্কিল (শাসনকাল ৮৪৭-৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) এর শাসনকালে মিহনা বন্ধ হয়ে যায় এবং খলিফা কোরানের সৃষ্ট হওয়ার মতবাদ প্রচার নিষিদ্ধ করেন। ধর্মান্ধ খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের সময় নির্যাতনকারীগণই নির্যাতকে পরিণত হয়। আর একারণেই এই মিহনা মুতাজিলাদের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসে।

মুতাজিলাদের অসহিষ্ণুতা

গোল্ডজিহের সর্বপ্রথম মুতাজিলাদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং তিনি অন্যান্য স্কলারদের মত মুতাজিলারা ইসলামের বিবর্তনে ধর্মনিরপেক্ষ এবং মঙ্গলজনল ছিলেন এরকম কল্পনায় অভিভূত ছিলেন না। গোল্ডজিহের দেখিয়েছেন, অনেক মুতাজিলাই তাদের নীতির অস্বীকারকারীদের গুপ্তহত্যা করতেন এবং যেসব অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব ছিলনা সেসব অঞ্চলে তারা তাদের মতবাদের জন্য জিহাদ পরিচালনা করতেন। গোল্ডজিহের বলেন, “ইসলামের ভাগ্য ভাল যে এই মতবাদ মাত্র তিন খলিফার শাসনকালেই পৃষ্ঠপোষকতা পায়। যদি মুতাজিলাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আরও সময় ধরে বহাল থাকত, তাহলে না জানি মুতাজিলারা কতদূর পর্যন্ত যেতেন।”502

যাই হোক, এবিষয়ে নিশ্চিত থাকা যায় যে মুতাজিলারা তাদের ধর্মতত্ত্বে যুক্তিকে যে স্থানে বসিয়েছিলেন তা যদি পরবর্তী ধর্মতাত্ত্বিকদের দ্বারাও সমাদৃত হত তাহলে ইসলাম যে পথ ধরে আজ এখানে এসেছে তার বদলে সে এক ভিন্ন দিকে মোর নিত। গিব, যিনি নাস্তিক্যবাদ এবং ঈশ্বরবিরোধী যুক্তিবাদকে ভয় করতেন, তিনি বলেন, “মুতাজিলাদের যুক্তিবাদের পরাজয়ের ফলে সম্ভবত ইসলামের ভালই হয়েছে। মুতাজিলাদের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল আর তারা জানত না যে কোথায় থামতে হবে। মুতাজিলারা যদি সফল হত তাহলে না জানি ইসলামের পুনর্জাগরণ হয়তো অনেকে মেনে নিত কিন্তু গোঁড়া ইসলামের কাঠামোতে এটা কখনই সম্পূর্ণভাবে খাপ খেত না। এর ফলে আগেই হোক আর পরেই হোক, একটা সময় ইসলামী সংস্কৃতিকে একটি বড় ধরণের ভাঙ্গনের মুখোমুখি হতে হত আর শত্রুদের আক্রমণে ইসলাম হয়তো একসময় বশ্যতা শিকার করতে বাধ্য হত।503

আধুনিক বিশেষজ্ঞ ক্রস এবং গ্যাব্রিয়েলি দেখিয়েছেন যে ইবনে আল রাওয়ান্দির (পরে তাকে নিয়ে আলোচনা করা হবে) ইউরোপীয় নবজাগরণ ঘরানার যুক্তিবাদে, ধর্মতত্ত্বে মুতাজিলাদের যৌক্তিক অবস্থান এবং কিছু বিশেষ বিষয়ে তাদের ধারণা (যেমন নবীর অলৌকিকত্ব এবং এসম্পর্কিত বিষয়গুলো) এর সম্প্রসারণ ছাড়া কিছুই ছিল না। 504

ইসলামের অষ্টম শতকের যুক্তিবাদের অভাব খুব প্রকটভাবেই অনুভব করা যায়। আর এই যুক্তিবাদ ইসলামের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কিছু আধুনিক আরব দার্শনিক (যেমন ফুয়াদ জাকারিয়া) প্রায়ই মুতাজিলা সম্প্রদায়ের কথা স্মরণ করেন এবং এধরণের যুক্তিবাদ হাতে পেয়েও তা হারিয়ে ফেলার জন্য হতাশা ব্যক্ত করেন। গিব আবার এরকম যুক্তিবাদের বিজয়ী হবার ধারণাটা সমর্থন করেন না এর ফলাফলের কথা ভেবে। অবশ্য আমি এই ফলাফলের কথা ভেবেই একে স্বাগত জানাই।

মুতাজিলা সম্প্রদায়ের পরাজয়

খুব সরল করে বললেও বলা যায় যে যুক্তিবাদী মুতাজিলা সম্প্রদায়ের পরাজয়ের ফলে যুক্তিবাদ পরিত্যক্ত হয় এবং যুক্তিহীনতার রাজত্বের পত্তন ঘটে। অন্যদিকে ওয়েনসিংক এর মতে আল আশারিকে (মৃত্যু ৯৩৫ খ্রি.) মুতাজিলা সম্প্রদায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়। ওয়েনসিংক এর মতে এই আল আশারি মুতাজিলা সম্প্রদায়ের ভাবধারা অর্থাৎ যুক্তিবাদ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার অবস্থান দেখে মনে হয় যে তিনি যুক্তির সাহায্য নিয়েই কোরানকে সমর্থন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এক্ষেত্রে যুক্তিকে দেখা গেছে অনেকটা অধীনস্ত হিসেবে। আল আশারি শেখাতেন যে সবাইকে কোরান-সুন্নাহ এর দিকেই ফিরে যেতে হবে, আর এই কোরান-সুন্নাহকে বুঝতে হবে সেগুলোর আক্ষরিক অর্থেই। যেসকল যুক্তিবাদীগণ কোরান-সুন্নাহ এর বাস্তব ও স্থুল বিষয়গুলোকেও রূপক বলে মনে করতেন তাদের প্রতি আল আশারির অবজ্ঞা আর ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আল আশারির জয় এর পরিণতিকে গোল্ডজিহের সর্বনাশা বা দূর্যোগ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “সমাজের স্থানীয় বিশ্বাসগুলোকে অনুমোদন দিয়ে আল আশারি মুসলিমদের মধ্যে মুতাজিলা সম্প্রদায়ের সকল অর্জনকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। তার অবস্থানের ফলেই সমাজে জাদু ও জাদুবিদ্যার প্রতি বিশ্বাস অক্ষুণ্ণ থাকল আর পীরদের ভণ্ডামির ব্যাপারে কথা বলার ব্যাপারেও আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। মুতাজিলারা এগুলোকে কখনই প্রশ্রয় দেন নি।”505

আল আশারির তুলনায় আশারিয়া সম্প্রদায় মুতাজিলা সম্প্রদায়ের প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়। তারা মুতাজিলা সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পথকে অনুসরণ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তারা বিশ্বাস করতেন যে, কোন চিরায়ত উৎস্য থেকে যে জ্ঞান পাওয়া যায় তা অনিশ্চিত। সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব কেবল যুক্তির হাত ধরে। আশারিয়া সম্প্রদায়ের এই দৃষ্টিভঙ্গি গোড়া ধর্মতাত্ত্বিকদের মাঝে পুনরায় আতঙ্কের সৃষ্টি করে। আশারিয়া সম্রদায়ের অবস্থান ছিল মুতাজিলা ও গোড়া ধর্মতাত্ত্বিক বা ঐতিহ্যপন্থীদের মাঝামাঝি স্থানে যেকারণে দেখা যায় তারা এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই ঘৃণার স্বীকার হন। একদিকে যেমন মুতাজিলা ও দার্শনিক সম্প্রদায় তাদের ঘৃণা করত, অন্যদিকে ট্রেডিশনিস্ট বা ঐতিহ্যপন্থীরাও তাদেরকে ঘৃণা করত। স্কলাস্টিক থিওলজির জন্য ঐতিহ্যপন্থীদের কোন সময় ছিল না। গোড়াদের কাছে স্কলাস্টিক থিওলজি আর এরিস্টোটলিয়ান দর্শন এর কোন পার্থক্যই ছিল না। তাদের কাছে দুটোই এক ছিল কারণ দুটোই নিয়ে যেত অবিশ্বাসের দিকেই। শেষ পর্যন্ত ইসলামে ঐতিহ্যপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই টিকে গেল। এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যুক্তির বিরুধে সদা খড়গহস্ত। গোড়া ঐতিহ্যপন্থিদের কাছে ধর্মীয় ব্যাপারগুলো বুঝতে যুক্তির প্রয়োজন নেই। ধর্মীয় সত্য কোরান ও সুন্নাহর মধ্যেই নিহিত রয়েছে যাদের উভয়কেই কোনরকম প্রশ্ন ও সন্দেহ ছারাই মেনে নিতে হবে। এরকম প্রবণতাকে কেবল কট্টোর রক্ষণশীলতাই বলা যায়। এর ফলস্বরূপ যে দেখা গেল উলেমারা বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের প্রয়োজন অনুসারে আইনশাস্ত্র ও ধর্মতত্বকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে নি। আর. এ. নিকোলসন বলেন, “দশম শতকের মাঝামাঝি সময়ে মোহামেডান স্কলাস্টিসিজম এর জনক আবু হাসান আল আশারির মতাদর্শে মুতাজিলাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা জায়গা করে নেয় যা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল এবং যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে সেই অবস্থানটি এখনও বহাল রয়েছে”506

ম্যানেস (বা মানি) (২১৬ থেকে ২৭৬ খ্রি.) এবং ম্যানিকিজম

যদিও আমরা এই অধ্যায়ের অবশিষ্টাংশে ম্যানিকিজম নিয়ে অনেক আলোচনা করব কিন্তু তারপরও ভিন্নমত সংক্রান্ত এই আলোচনায় ম্যানিকিজম এর মতবাদ ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা যথার্থ হবে বলেই মনে করি।

ম্যানিকিজম ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন মানি। তিনি দক্ষিণ ব্যাবিলনিয়ায় ২১৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পারস্য বংশদ্ভূত ছিলেন এবং পারথিয়ার রাজকীয় পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। মানি ২৪০ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মীয় শিক্ষাদান শুরু করেন। আর এইসময় তিনি জরাথ্রুষ্টবাদী যাজকদের বিরোধিতার মুখে পড়ে পারস্য ত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর দুই বছর পর তিনি ফিরে এসে পুনরায় শিক্ষাদান শুরু করেন। তাকে সম্রাট প্রথম শাপুর স্বাগত জানান। সম্রাটের জন্য মানি একটি বই রচনা করেছিলেন। মানির প্রতি এই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ত্রিশ বছর ধরে চলেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মানি জরাথ্রুষ্টবাদী যাজকদের নিন্দা ও ঘৃণার মুখে পড়েন এবং তাকে শরীর থেকে চামড়া তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।

মানির মতবাদ ছিল পারস্যের নসটিক ট্রেডিশন বা জ্ঞানবাদী ধারার একটি প্রশাখা। এটি ডুয়েলিজম বা দ্বৈতবাদকে সমর্থন করতেন যা “শুভ ও অশুভ একই উৎস্য হতে আগত” এই ধারণাকে বর্জন করেছিল।507 এই বিশ্বাস অনুসারে সৃষ্টির আদিতে একতি আদিযুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধ হয়েছিল ঈশ্বর ও পদার্থের মাঝে, আলো ও অন্ধকারের মাঝে, সত্য ও মিথ্যার মাঝে। মানুষ সহ সমগ্র বিশ্ব হল শুভ এবং অশুভর মিশ্রণ। আর ধর্মের উদ্দেশ্য হচ্ছে জগতের এই শুভ-অশুভকে আলাদা করা এবং অশুভকে তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা হতে নিরস্ত্র করা।

শুভ অশুভর মঝের এই বিচ্ছিন্নতাকে অর্জন করার জন্য তারা কঠোর সন্ন্যাসব্রত পালন করতেন। এর মধ্যে নিরামিষভোজন ছিল। “শিষ্যদেরকে সন্ন্যাসজীবনের কঠোরতার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন স্তরে বিভাজন করার রীতি ছিল। এক্ষেত্রে নির্বাচিতরা ‘শ্রোতাদের’ দ্বারা সমর্থিত হতেন একজন ধর্মপ্রচারক এবং একজন আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে যিনি একটি আধ্যাত্মিক পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছেন”।508

মানি তার মতবাদের বিষয়বস্তুগুলো বিভিন্ন উৎস্য থেকে নিয়ে এসেছিলেন যার মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও জরাথ্রুষ্টবাদের মতবাদ ছিল। মানিকিজম ধর্মটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি সময় এটা খ্রিষ্টধর্মেরও প্রতিদ্বন্দীতা করে। উত্তর আফ্রিকায় সেন্ট অগাস্টিন কিছু সময়ের জন্য মানিকিজমের অনুগত ছিলেন।

জিন্দিক এবং জান্দাকা- দ্বৈতবাদ থেকে নাস্তিক্যবাদ

ইসলামে “জিন্দিক” শব্দটি প্রথমে যারা গোপনে ইরানিয়ান বা পারস্যের ধর্মগুলো থেকে উদ্ভূত মানিকিজমের মত দ্বৈতিবাদী মতবাদে বিশ্বাস করতেন কিন্তু প্রকাশ্যে ইসলামকে স্বীকার  করতেন তাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত। এক্ষেত্রে জিন্দিকরা ছিল ভিন্নমত সমর্থনকারী, বিধর্মী এবং পাপী। পরবর্তীতে শব্দটির প্রয়োগের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত করে প্রধান গোড়া ইসলামের মতাদর্শকে উপেক্ষা করা, আতঙ্ক সৃষ্টিকারী যেকোন মতবাদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হত। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে এই শব্দটি সকল রকম মুক্তচিন্তাকারী, নাস্তিক এবং বস্তুবাদীদের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হত। গোল্ডজিহের এক্ষেত্রে বলেছেন, “প্রথমত কিছু পুরোনো পারস্য পরিবার ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করলেও শুবিয়া সম্প্রদায়ের পথ গ্রহণ করেছিলেন। তারা তাদের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পারস্যের ধর্মীয় মতবাদগুলোকে পুনর্বহাল করতে চাইতেন এবং ইসলামের আরব্য প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান করতেন। এদের জিন্দিক বলা হত। আবার অন্যদিকে অনেক মুক্তচিন্তাকারী ছিলেন। তারা ইসলামের গোড়া, একগুঁয়ে মতবাদের বিরোধী ছিলেন, পজিটিভ রেলিজিয়নকে (যেসব ধর্ম কোন ব্যক্তি দ্বারা প্রবর্তিত তাদেরকে পজিটিভ রেলিজিয়ন বলে) অস্বীকার করতেন এবং কেবলমাত্র নৈতিক আইনগুলোকেই স্বীকার করতেন। এদেরকেও জিন্দিক বলা হত। এদের মাঝে পরবর্তীতে সন্ন্যাস ধারা বিকশিত হয় যার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্কই ছিল না। এতে বরং বৌদ্ধধর্মীয় ধারাই সনাক্ত করা যায়”।509

জাদ ইবনে দিরহাম (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর- ৭৪২ খ্রিষ্টাব্দ)

ভিন্নমত জান্দাকার জন্য যাকে প্রথম হত্যা করা হয় তিনি হলেন জাদ ইবনে দিরহাম। তাকে উমাইয়া খলিফা হিশামের আদেশে ৭৪২ অথবা ৭৪৩ সালে হত্যা করা হয়। তিনি ডুয়েলিস্ট বা দ্বৈতবাদী ছিলেন কিনা এব্যাপারে কোনরকম সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। ধারণা করা হয় কোরাণের সৃষ্টতা এবং ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছা সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে হত্যা করা হয়। বলা হয় তিনি ঈশ্বর সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণাগুলোতেও বিশ্বাস করতেন না। যেমন তিনি বলতেন, “ঈশ্বর মোজেসের সাথেও কথা বলে নি, আব্রাহামকেও নিজের বন্ধু বানায় নি”। বলা হয়, তিনি একজন বস্তুবাদী ছিলেন এবং মুহম্মদকে মিথ্যাবাদী বলা এবং রেজারেকশন বা শেষ বিচারের দিন সকলের পুনর্জাগরণকে অস্বীকার করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়।

ইবনে আল মুকাফফা (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর- ৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ)

জিন্দিকদের বিরুদ্ধে কঠোর নির্যাতন শুরু হয় আব্বাসিয় খলিফা আল মনসুর (রাজত্বকাল ৭৫৪ থেকে ৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) এর শাসনকালে। তার শাসনামলে অনেক জিন্দিককেই হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিলেন এবনে আল মুকাফফা। খলিফা আল মনসুর তার চাচার কথায় আল মুকাফফাকে রাজক্ষমা গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু মুকাফফার সর্বশেষ উক্তিতে যে ভাষা ব্যবহার করেন তা খলিফাকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। একারণে আল মুকাফফাকে সবচাইতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার অঙ্গপ্রতঙ্গগুলো একটি একটি করে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এটাও হতে পারে, মুকাফফার বিধর্মী দৃষ্টিভঙ্গিই তার প্রতি এত নৃশংসতার জন্য একটি অন্যতম কারণ ছিল।

ক্রাউস বলেন, সাসানিদ সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর শাসনামলে পারস্যে যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটেছিল। সম্রাট খসরু গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের ধারাকে লালন করতেন। পারস্যের যুক্তিবাদের যে ধারার সৃষ্টি হয়েছিল ক্রাউসের মতে তা ছিল পারস্যে মুসলিম বিজয়ের আশুপূর্বে সম্রাট খসরুর যুক্তিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফল। ইবনে আল মুকাফফা ম্যানিকিজম এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলাম, এর নবী, এর ধর্মতত্ত্বকে ও এর ঈশ্বরধারণাকে আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু আমরা কিভাবে ইবনে আল মুকাফফার যৌক্তিক সংশয়বাদ এবং তার ম্যানিকিয়ান দ্বৈতবাদ এর মধ্যে মিলনসাধন করব? এক্ষেত্রে গ্যাব্রিয়েলি দেখিয়েছেন510, ইবনে আল মুকাফফার মত বুদ্ধিজীবীরা ম্যানিকিয়ান মিথোলজির একটি রূপক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং বিশ্ব ও মানুষের অবস্থানকে নস্টিক শব্দ, যুক্তিবাদ এবং গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। এখান থেকেই বোঝা যায় মুকাফফা ম্যানিকিয়ান দ্বৈতবাদ এবং যুক্তিবাদী সংশয়বাদ এই দুটি ভিন্ন মতবাদকে একত্রিত করে একটি ভিন্ন মতবাদ তৈরি করেন যার আলোকে তিনি ইসলামের সমালোচনা করেন।

ইবনে আল মুকাফফা পেহলভি ও মিডল পারশিয়ান ভাষা থেকে আরবী ভাষায় অনুবাদ করার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। এছাড়া তার বই কালিলা এবং দিমনা ছিল সংস্কৃত উপকথার বই পঞ্চতন্ত্রের অনুবাদ। কালিলা এবং দিমনার রচনাশৈলী সাহিত্যকর্মের একটি আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়।

দ্য গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর

খলিফা আল মনসুরের পর তার উত্তরাধিকারী আল মাহদী (৭৭৫-৭৮৫) এবং আল হাদি (৭৮৫-৭৮৬) এর সময়ে দমন, নির্যাতন এবং মৃত্যুদণ্ড পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পেয়ে আরও নৃশংস আকার ধারণ করে। ভিন্নমতে বিশ্বাসীদের অন্বেষণের জন্য বিশেষ কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়। আর এক্ষেত্রে এই ইনকুইজিশন এর প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন মহান ইনকুইজিটর সাহিহ আল জান্দাকা। কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য কেবল মাত্র সামান্য গুজব ছড়ানোই যথেষ্ট ছিল। প্রায়ই জিন্দিকদের জনসম্মুখে গ্রেফতার করে বন্দী করা হত এবং তাদেরকে ইনকুইজিটর বা শাসকের কাছে নিয়ে আসা হত। এরপর বন্দীদেরকে তাদের বিশ্বাস এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হত। যদি কেউ শপথগ্রহণ পূর্বক তাদের ভিন্ন ধর্মকে ত্যাগ করত, তাহলে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হত। যদি কেউ তা ত্যাগ করতে অস্বীকার করত তাহলে তার শিরশ্ছেদ করা হত, ফাঁসিকাষ্টে ঝোলানো হত আবার কাউকে ক্রুশবিদ্ধও করা হত। আল হাদির সময়ে শ্বাসরোধ করেও হত্যা করা হত। এদের ভিন্নমতের বইগুলোকে ছুড়ি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হত।

আমরা ইনকুইজিশনের সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি একজন মহান গীতিকবি আবু নুয়াসের (জন্ম ৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু ৮০৬ থেকে ৮১৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) কৌতুক কাহিনী থেকে। আবু নুয়াসের দুটি বিষয়ে ভীষণ আগ্রহ ছিল আর সেগুলো হল সুন্দর বালক এবং মদ্যপান। একদিন তিনি মধ্যপ অবস্থায় একটি মসজিদে প্রবেশ করেন। এমন অবস্থায় মসজিদের ইমাম কোরানের ১০৯ নং সুরার প্রথম আয়াতটি পাঠ করা শুরু করেন যেটার প্রথম অংশ ছিল, “হে, অবিশ্বাসীগণ…”। এটা শুনে আবু নুয়াস বলেন, “হ্যাঁ, এই যে আমি অবিশ্বাসী!” এটা শুনে ইমাম তাকে তাড়া করে রক্ষীবাহিনীর প্রধানের কাছে নিয়ে যান এবং বলেন আবু নুয়াস একজন স্বঘোষিত নাস্তিক। রক্ষীবাহিনীর প্রধান তাই আবু নুয়াসকে ইনকুইজিটরের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু ইনকুইজিটর কবি আবু নুয়াসকে জিন্দিক বলে মানতে অস্বীকার করেন। এতে ভীর করা জনতার রোষের মুখে পড়ে একটি বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি হলে ইনকুইজিটর দ্বৈতবাদীদের নবী মানির একটি ছবি আবু নুয়াসের সামনে নিয়ে আসেন এবং তাকে বলেন ছবিটির উপর থুতু দিতে। আবু নুয়াস এর চেয়েও বেশি কিছু করেছিলেন। তিনি নিজের গলার ভিতরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ছবিটির উপর বমি করেন। আর এর ফলে ইনকুইজিটর তাকে মুক্ত করে দেন। আমরা জানি, অন্য আরেকটি ঘটনায় আবু নুয়াসকে কারাভোগ করতে হয়। ভিন্নমত এর ছোড়া সম্ভবত মুহম্মদের নিজের পরিবার, হাসেমী পরিবারকেও বিদ্ধ করেছিল। এই পরিবারের অনেক সদস্যকেই মৃত্যুদণ্ড দান করে হত্যা করা হয় বা হাজতে মৃত্যুবরণ করতে হয়।511

ইবনে আবি-ই-আওজা (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ৭৭২ খ্রিষ্টাব্দ)

ইবনে আবি-ই-আওজা একজন জিন্দিক ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আলো থেকে শুভ এবং অন্ধকার থেকে অশুভ বিষয়গুলোর উৎপত্তি। তিনি মেটেমসাইকোসিস (আত্মার দেহান্তর এবং মৃত্যুর পর পুনরায় দেহধারণ সংক্রান্ত মতবাদ) এবং স্বাধীন ইচ্ছা বা ফ্রি উইলের শিক্ষা দিতেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি স্বীকার করেছেন, তিনি চার হাজারটি হাদিস জাল করেছেন যার মধ্য দিয়ে তিনি মুসলিমদের যে সব কাজে অনুমতি ছিল সেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন এবং যেসব কাজে নিষেধ ছিল তা তাদের দিয়ে করিয়েছেন। যখন মুসলিমদের রোজা ভাঙ্গার কথা ছিল তখন ভাঙতে দেননি আর যখন ভাঙ্গার কথা ছিল না তখন তাদের রোজা ভাঙ্গিয়েছেন। তিনি বলতেন, ঈশ্বর যদি সর্বমঙ্গলকারকই হয়ে থাকেন, তাহলে পৃথিবীতে এত দুঃখ, দূর্দশা, মহামারী কেন? আল বিরুনি বলেন, ইবনে আবি ই আওজা সাধারণ ঈশ্বরের বিধান সম্পর্কিত কূট সমালোচনাপূর্ণ প্রশ্ন করে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে নাড়া দিতেন।

কথিত আছে যে, ইবনে আবি ই আওজার সাথে ইমাম জাফর আল সাদিকের আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনাটি লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তা আবি ই আওজার ভিন্নমতকে সম্পূর্ণভাবে প্রমাণ করে (অবশ্য যদি এই কথোপকথনটি একটি সত্য সাক্ষপ্রমাণ হয়ে থাকে)। এই কথপোকথনটি থেকে উঠে আসে, ইবনে আবি ই আওজা মহাবিশ্বের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই এই মতে বিশ্বাস করতেন। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন। একদিন তিনি জাফরকে হজ্জ্বযাত্রার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং ‘এটা ঈশ্বরের আদেশ’ এরকম উত্তর অস্বীকার করেন কারণ এক্ষেত্রে এমন একজনকে কারণ হিসেবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে যার উপস্থিতিই লক্ষ করা যায় নি। তিনি কোরানে বর্ণিত কিছু শাস্তি ন্যয়বিচার হিসেবে যথার্থ কিনা এ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি কোরানে উল্লিখিত নবী বিশেষ করে আব্রাহাম ও জোসেফ এর ব্যাপারেও মিথ্যাচারের অভিযোগ এনেছিলেন। আর সেসময়ের অন্যান্য জিন্দিকদের মত তিনিও কোরানের প্রাতিষ্ঠানিক মতবাদ এবং এর অনাণুকরনযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। যদি উপরের এইসব ব্যাখ্যা ইবনে আবি ই আওজার ক্ষেত্রে সত্য নাও হয়, তবুও এটা তদকালিন সময়ের জিন্দিকদের বিশ্বাস সম্পর্কে আলোকপাত করে। তাকে কারাবরণ করতে হয় রবং ৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।512

বাশার ইবনে বুর্দ (৭১৪/৭১৫ খ্রিষ্টাব্দ-হত্যা ৭৮৪/৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ)

বাশার ইবনে বুর্দ একজন কবি ছিলেন যাকে গ্রেফতার করা হয়, জান্দাকায় অভিযুক্ত করা হয়, নির্যাতন করা হয় এবং সবশেষে একটি জলাভূমিতে নিক্ষেপ করা হয়। তিনি একটি ধনী পারস্য পরিবারের বংশধর ছিলেন, কিন্তু তার পিতা মুক্তি পেয়ে রাজমিস্ত্রী হবার পূর্বে একজন দাস ছিলেন। বাশারের জাতিয়তাবাদী চেতনা খুব শক্ত ছিল আর তিনি সুযোগ পেলেই প্রাচীণ ইরানের গুণকীর্তন করতে লেগে পড়তেন। আরবদের প্রতি তার খুব একটা ভাল অভিমত ছিল না। তিনি জন্মান্ধ ছিলেন এবং দেখতেও ছিলেন কদাকার যেখারণে তিনি একটা সময় মনুষ্যবিদ্বেষী হয়ে পড়েন। বাশার স্তুতিমূলক, বিষাদমূলক এবং ব্যাঙ্গাত্মক রচনায় পারদর্শী ছিলেন।

বাশারের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল সেটা জানা খুব কঠিন কারণ তিনি একজন সুবিধাবাদী ছিলেন, এবং প্রায়ই নিজের সত্যিকারের অভিমত গোপন করতেন। ভাদজার মতে, তিনি কামিলিয়ার শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন এবং সমগ্র মুসলিম জাতিকেই অভিষাপ দিতেন। জান্দাকায় তার অভিযুক্ত হবার কারণ ছিল তিনি মূল নিয়ম অনুসারে প্রার্থনা করতেন না। জানা যায়, একবার তিনি মদ্যপ অবস্থায় আজানকে ব্যঙ্গ করেছিলেন।

তিনি হজ্জ্ব যাত্রাকে অশ্রদ্ধা করার জন্যেও অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি একবার তার বিরুদ্ধে সন্দেহ এড়ানোর জন্য হজ্জ্বযাত্রা করেন এবং পথিমধ্যে জোররায় এসে যাত্রা থামিয়ে সেখানে মদ খেয়ে সময় অতিবাহিত করেন। যখন যজ্জ্বযাত্রীগণ ফিরে আসছিল তখন তিনি আবার তাদের সাথে যুক্ত হন এবং বাসায় এসে ভান করেন যে তিনি সম্পূর্ণ হজ্জ্বযাত্রা সম্পন্ন করেছেন।

বাশারের উপর একটি অভিযোগ জিন্দিকদের সমপর্যায়ের ছিল। বাশার ইসলামের কোরানের অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলোর বিরোধী ছিলেন। কোরানকে অনানুকরণযোগ্য বা এর অনুকরণ সম্ভব নয় বলে ধরা হত, বাশার এধরণের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী ছিলেন। গোল্ডজিহের কোরানের প্রতি জিন্দিকদের অবজ্ঞার একটা উদাহরণ দেন এভাবে, “বসরায় মুক্তচিন্তাকারী, মুসলিম এবং অমুসলিম ভিন্নমতাবলম্বীরা সমবেত হত। এই সমবেতদের উদ্দেশ্যে কবিতা আবৃত্তি করা হলে বাশার কখনও কখনও বলে উঠতেন, “এই কবিতাটি কোরানের এই এই আয়াতের চেয়েও ভাল হয়েছে”। বাশার এর নিজের কবিতা একবার বাগদাদের এক গায়িকা আবৃত্তি করেছিল। এটা শুনে বাশার বলেছিলেন “এই কবিতাটিকে তো সুরা আল আশরের চাইতেও সুন্দর লাগছে”। কোরানের প্রকাশভঙ্গি, প্রকাশের প্রক্রিয়াকে ও উপমাগুলোকে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন। আল মুবাররাদ একজন ভিন্নমতাবলম্বীর কথা বলেছিলেন যিনি সুরা ৩৭.৬৩ এর নরকে থাকা জাকুম বৃক্ষের ফলের সাথে শয়তানদের মস্তকের তুলনা করা নিয়ে উপহাস করেন। সমালোচকরা বলেন, এখানে দৃশ্যমান কোন বস্তুর সাথে এমন এক জিনিসের তুলনা দেয়া হচ্ছে যাকে কেউ কোনদিন দেখেই নি। এটা আবার কী ধরণের উপমা?”513

সম্ভবত বাশার শেষ বিচারের দিন সকলের পুনরুত্থিত হওয়া এবং শেষ বিচারের বিধানকে অস্বীকার করেন। তিনি বরং পুনর্জন্ম এবং আত্মার দেহান্তর হওয়ায় বিশ্বাস করতেন। তার কিছু কবিতায় তিনি ইবলিশকে (শয়তান) সমর্থন করেন যে আগুনের তৈরি হয়ে মৃত্তিকা নির্মিত আদমকে শিজদা দিতে চাননি। তার আরেকটি কবিতায় তিনি মুহম্মদের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যাতে তিনি তার সাথে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে আক্রমণে যোগদান করেন। সম্ভবত বাশার যরাথ্রুষ্টবাদ ঘেষা ম্যানিকিজম মতবাদে বিশ্বাস করতেন।

কিন্তু ব্লাশিয়ের বলেন, “তার এরকম বিশ্বাস ছাড়াও, তার গভীর সন্দেহবাদের সাথে নিয়তিবাদের মিশ্রণ ঘটে যা তাকে নৈরাশ্যবাদ এবং ভোগবাদের দিকে ঠেলে দেয়”।514 কিন্তু তিনি দূরদর্শী ছিলেন বলেই বাইরে বাইরে ইসলামের প্রতি মৌখিক সমর্থন দিতেন। বাশারের সন্দেহবাদীতাকে ভাদজা সমর্থন করেছেন। কিন্তু ভাদজা বলেন, বাশারের মত একজন চরিত্রহীন মানুষ কখনও ম্যানিকিজমের মত একটি সন্ন্যাসগোছের ধর্মের প্রতি আগ্রহী হবেন না।

সালিহ বি. আব্দ আল কুদ্দুস (মৃতুদণ্ড কার্যকত ৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দ)

সালিহকেও ম্যানিকিজমে বিশ্বাস করার জন্য অভিযুক্ত করা হয় এবং ৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে হত্যা করা হয়। কিন্তু তার কবিতাগুলোতে ভিন্নমত সম্পর্কিত কিছুই পাওয়া যায় না। নিকলসন বলেন, তিনি সম্ভবত মুসলিম কুসংস্কারের শিকার ছিলেন যেখানে যেকোন দার্শনিক মননের মানুষকেই অবিশ্বাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হত।515

হাম্মাদ আজরাদ (হত্যা করা হয়)

হাম্মাদ বসরার মুক্তচিন্তাকারীদের চক্রের মধ্যে ছিলেন। তাদের সমবেত হবার সম্পর্কে পূর্বেই বলা হয়েছে। সেখানে ভিন্নমতাবলম্বী কবিরা যেমন বাশার, সালিহ বি. আব্দ আল কুদ্দুস, হারানের ইবনে সিনান, ইবনে নাজির প্রমুখ সমবেত হতেন। হাম্মাদকে ইসলামের মূল নিয়ম অনুসরণ করে প্রার্থনা না করার কারণে এবং তার কিছু কবিতার চরণকে কোরানের আয়াতের চাইতেও ভাল মনে করার কারণে অভিযুক্ত করা হয়। দ্বৈতবাদে বিশ্বাস করা এবং জিন্দিকদের প্রার্থনার জন্য তিনি কিছু চরণ লিখে দেয়ার জন্যও তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। হাম্মাদ যদি কঠোর ভাবে মানিকিজমে বিশ্বাসী নাও হয়ে থাকেন, তিনি অন্তত এই মতবাদে সমর্থন করতেন। তার ধর্মীয় কবিতাগুলোতে ম্যানিকিজম মতবাদ সম্পর্কিত চরণ পাওয়া যায়। বসরার গভর্নর তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

আবান বি. আব্দ আল হুমায়েদ বি. লাহিক আল রাক্কাসি

আবান ছিলেন বসরার আরেকজন মুক্তচিন্তাকা্রী। আবু নুয়াসের ব্যঙ্গাতক রচনাতে যাদের উল্লেখ ছিল তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। তিনি আংশিকভাবে একজন ম্যানিকিয়ান দ্বৈতবাদী ছিলেন, কিন্তু সেই সাথে একজন যুক্তিবাদীও ছিলেন। আবু নুয়াসের ব্যঙ্গাত্মক রচনায় পাওয়া যায়, “আমি একবার আবানের (তার উপর প্লেগ বর্ষিত হোক!) সাথে বসেছিলাম। নামাজের সময় যখন আজান দেয়া হল তখন সেই আজান খুব একটা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল না। আমরা সবাই আজান পুনরায় দিলাম। এরপর আবান বললেন, “চাক্ষুস প্রমাণ ছাড়া তুমি এগুলোকে (মুসলিম বিশ্বাসের নীতিগুলো) কিভাবে সত্য হিসেবে মেনে নাও? আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন কিছুতেই চাক্ষুস প্রমাণ ছাড়া কোন কিছু মেনে নেব না।” এরপর আমি বললাম, “ঈশ্বর মহান”, তিনি বললেন, “মানি মহান”। এরপর আমি বললাম, “জেসাস একজন নবি ছিলেন”, তিনি বললেন, “শয়তানের”। আমি আবার বললাম, “মোজেস স্বয়ং ঈশ্বরের সাথে কথা বলেছেন”, তিনি বললেন, “তাহলে তোমার ঈশ্বরের নিশ্চই একটা জিভ আর একটা চোখ আছে। আর তিনি কি নিজেই নিজেকে তৈরি করেছেন? নাহলে তাকে কে তৈরি করল?” এটা শুনে আমি এই একগুঁয়ে ঈশ্বরনিন্দাকারী সাথে কথা বলা বন্ধ করলাম।”516

আবানের সত্যিকারের ধর্মমত কি ছিল তা জানা খুব কঠিন। এক্ষেত্রে আবু নুয়াসের ব্যঙ্গাত্মক রচনাকে প্রমাণ হিসেবে নেয়া যায় না। বংশগতভাবেই আবান বিভিন্ন পারস্য এবং হিন্দু রচনার কাব্যিক রূপ দেয়ার কাজ করতেন।

বসরার অন্যান্য মুক্তচিন্তাকারীগণ

বসরার মুক্তচিন্তাকারীদের সম্পর্কিত উৎস্যগুলো থেকে কয়েকটা নাম উঠে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আমরা তাদের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারি না। আমরা জানতে পারি, কায়েস বিন জুবায়ের একজন কুখ্যাত নাস্তিক ছিলেন, আল বাকিলি শেষ বিচারের সময়কার দেহের পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেন, ইব্রাহিম বিন সায়াবা একজন জিন্দিক ছিলেন যিনি পায়ুকামকে জান্দাকার প্রথম নীতি হিসেবে দাবী করেন ইত্যাদি।

মুতি বিন ইয়াস সম্পর্কে আমরা আরও একটু বেশি জানি যিনি জিন্দিক হবার প্রতিটি চিহ্ন দেখান। কিন্তু তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ঘাটলে দেখা যায় তিনি সন্দেহবাদীতার দিকে চলে গিয়েছিলেন এবং কোন ধর্মের প্রতিই তার কোন আগ্রহ ছিল না। উমাইয়া শাসকদের অধীনে তার কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি খলিফা ওয়ালিদ বিন ইয়াজিদের ভক্ত ছিলেন যার কাছে মুতি খুব পছন্দের একজন ব্যক্তি ছিলেন। কারণ মুতি সুদক্ষ, চরিত্রহীন, সবসময় মান্য করে চলেন এমন সাথী ছিলেন, তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ছিল, নির্জল্লতা এবং ধৃষ্টতায় তিনি বেপরোয়া ছিলেন, এবং ধর্মের ব্যাপারে ছিলেন সন্দেহবাদী। যখন আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আরোহন করেন মুতি নিজেকে খলিফা মনসুরের সাথে সম্পর্কে জড়ান। জিন্দিক ও মুক্তচিন্তাকারীদের সাথে সাহচার্যে থাকার সময় তার ভ্রষ্ট ও লম্পট জীবন নিয়ে অনেক গল্প বলা হয়। লঘুতা এবং কমনীয়তার কারণে তার প্রেম ও মদ নিয়ে কবিতাগুলোকে আলাদাভাবে চেনা যায়।517

আবু ই আতাহিয়া

একটি উৎস্য থেকে আমরা জানতে পাই আবু ই আতাহিয়া গ্র্যান্ড ইনকুইজিটরের দ্বারা গ্রেফতার এড়ানোর জন্য কাপিং গ্লাস বিক্রি করে জীবন কাটাতেন এবং শহরের ভীরে মিশে থাকতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা জানিনা, কেন ইনকুইজিটর এই কবির সাক্ষাতকার নিতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়তো গোপনে ম্যানিকিয়ান মতবাদে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার কবিতাগুলোতে এমন কিছুই পাওয়া যায় নি যা গোড়া ইসলামের বিরুদ্ধে যায়। কিন্তু গোল্ডজিহের তার কবিতার বুদ্ধকে নির্দেশ করা দুটো পংক্তি পেয়েছেন:

“যে ব্যক্তি রাজা হয়ে ভিখারির পোশাকে থাকবেন,

বুঝবে তিনিই সবচাইতে মহান ব্যক্তি”

সম্ভবত আবু ই আতাহিয়া বিশ্বাস করতেন একজন ঈশ্বর দুটো বিপরীত পদার্থ থেকে মহাবিশ্বের আকার দিয়েছেন, আর তিনি এই দুটো বিপরীত পদার্থ সৃষ্টি করেছিলেন শূন্য থেকে। মহাবিশ্ব ধ্বংস হবার পূর্বে পুনরায় তা এই দুটি বিপরীতধর্মী পদার্থে রূপান্তরিত হবে। তার মত অনুসারে জ্ঞান প্রাকৃতিকভাবেই গভীর চিন্তা, যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত হয়। এটা কোন স্বর্গীয় বিধান বা স্বর্গীয় গ্রন্থের সাথে সম্পর্কিত নয়।

উপরের মতবাদগুলোকে ভিন্নমত হিসেবে গণ্য করা হয় না। নিকলসন বলেন, আতাহিয়া গোড়া মুসলিমদের কোপের মুখে পড়েন কারণ তার কবিতাগুলো ধর্মঘেষা না হয়ে অনেকটাই দার্শনিক দিকে চলে গিয়েছিল আর এটাই তাদের কাছে আতাহিয়াকে নাস্তিক হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার দর্শন যতই সাদাসিধে হোক না কেন, অন্তত গোড়া ইসলামের ছাচে এগুলোকে ফেলা যায় না।”518

আতাহিয়ার উপর আরেকটি অভিযোগ হল তিনি তার কবিতার কিছু পংক্তিকে কোরানের আয়াতের চেয়ে উন্নত বলে দাবী করেছিলেন। এছাড়া তিনি শেষ বিচারের সময়কার দেহের পুনরুত্থানেরও বিরুদ্ধে ছিলেন। আবার তার কিছু কবিতায় গোড়া ইসলামি বিশ্বাসও লক্ষ করা যায়। তার কবিতায় চূড়ান্তভাবে যা পাওয়া যায় তা হল গভীর বিষাদ, নৈরাশ্যবাদ এবং পার্থিব সুখের প্রতি অসারত্ব।

আবু ইসা মুহাম্মদ বিন হারুন ওয়ারাক বা আল ওয়ারাক

আল ওয়ারাকও জান্দাকার দায়ে অভিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন বিখ্যাত নাস্তিক আল রাওয়ান্দি এর শিক্ষক। দুর্ভাগ্যবশত আল ওয়ারাক এর খুব একটা লেখা পাওয়া যায় না। আমাদের বরং অন্যান্য আরব স্কলারদের উক্তিগুলো থেকেই তার সম্পর্কে ধারণা নিতে হয়। তার কিছু কাজ সম্পর্কে আমরা অন্যান্য আরব স্কলারদের দ্বারা তার যুক্তির খণ্ডনগুলো থেকেও জানতে পারি। আল ওয়ারাক প্রথমে একজন মুতাজিলা ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু বিরোধী মতের কারণে তাকে এই সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কৃত করা হয়।

তিনি ধর্মের একটি অসাধারণ ইতিহাস লিখে গেছেন যেখানে তার অবজেক্টিভিটি, যুক্তিবাদ এবং সন্দেহবাদ মুক্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে। খ্রিষ্টধর্মের তিনটি শাখা নিয়ে তার জটিল বিশ্লেষণ পুনরায় তার পক্ষপাতশূন্য দৃষ্টিভঙ্গী এবং যুক্তিবাদকে তুলে ধরে। এই বিশ্লেষণগুলো কোন স্বর্গীয় বিধাননির্ভর ছিল না।

আল ওয়ারাকের হয়তো শিয়াদের প্রতি দুর্বলতা ছিল কিন্তু তিনি ম্যানিকিয়ান মতবাদে বিশ্বাস করতেন কিনা এব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। তিনি সম্ভবত দ্বৈত নীতিতে বিশ্বাস করতেন, আর খুব সম্ভব মহাবিশ্বের চিরন্তনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। মাসিগনন এর মতে তিনি কোন বিশেষ ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিলেন না, বরং তিনি একজন স্বাধীন চিন্তাকারী এবং সন্দেহবাদী ছিলেন। আব্বাসীয়দের নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি আহওয়াজে নির্বাসিত হয়ে ৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান।

আবু তাম্মাম (মৃত্যু ৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দ)

আবু তাম্মাম দামেস্কে ৭৯৬ থেকে ৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বিখ্যাত কবি এবং সংকলক ছিলেন। তিনি সফলতার সাথেই খলিফা আল মুতাসিমের সভায় নিজের জায়গা করে নেন এবং প্রশংসামূলক কবিতা রচনা করাতে থাকেন। কিন্তু মারগোলিয়থ বলেন, “বিভিন্ন আঞ্চলিক রক্ষকের কাছে তার ভ্রমণ নিয়ে বিভিন্ন গল্প আছে। ফার্স এর রক্ষক ইবনে রাদজার কাছে ভ্রমণের সময় তাম্মামের কিছু আচরণ, কথাবার্তা ইসলামের বিরুদ্ধে অবজ্ঞা নির্দেশ করে। এটা নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তার স্বীকারোক্তি থেকে এবিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যা তাম্মামকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়”519। দুর্ভাগ্যবশত তার কোন সন্দেহই তার কবিতায় পাওয়া যায় নি।

আল মুতানাব্বি (৯১৫-৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ)

আল মুতানাব্বিকে অনেক আরবই আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি কুফায় জন্মগ্রহণ করেন এবং দামেস্কোতে শিক্ষালাভ করেন। তিনি আবু তাম্মামের কবিতার রীতি অনুসরণ করেন এবং নিজে কবিতা লিখে নাম করতে বেড়িয়ে পড়েন। ব্লাশেয়ারের মতে, মুতানাব্বি ধর্ম ও দর্শনের ক্ষেত্রে কুফার আবু ফাদল এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন যিনি একজন অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন। মুতানাব্বি ধর্মীয় কুসংস্কারকে ঝেড়ে ফেলেন এবং সেগুলোকে দমনের জন্য ব্যবিহৃত আধ্যাত্মিক কৌশল বলে অভিহিত করেন। এরপর তিনি নির্বিকারবাদ (স্টোয়িক ফিলোসফি) এবং নৈরাশ্যবাদী দর্শন গ্রহণ করেন। তার মতে, এই বিশ্বের সবকিছুই মোহের যা মৃত্যুর দ্বারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নির্বুদ্ধিতা এবং অশুভশক্তিই কেবল এই বিশ্বে রাজ করে।520

যে খ্যাতি তিনি আশা করেছিলেন তা না পেয়ে মুতানাব্বি হিংসাত্মক উপায়ে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেন। তিনি একটি বৈপ্লবিক পরিকল্পনা করেন এবং একজন রাজনৈতিক-ধর্মীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে আন্দোলন পরিচালিত করেন। এক্ষেত্রে তিনি একটি নতুন কোরান নিয়ে নিজেকে নিবী হিসেবে দাবী করেন (কারণ তার নাম ছিল মুতানাবি যার অর্থ হল যে নবীর ভান করে)। তিনি পরাজিত এবং বন্দী হয়ে হিমসে দুই বছরের কারাবরণ করেন। তিনি ভীষণ সৌভাগ্যবান কারণ তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল যদিও কারও নিজেকে নবী হিসেবে দাবী করা এবং নতুন কোরান প্রাপ্তি বলে দাবী করা ইসলামেরর দৃষটিতে একটি গর্হিত অপরাধ।

ছাড়া পাবার পর মুতানাব্বির আলেপ্পোর সাঈফ আল দাউলা এর দরবারে পৃষ্ঠপোষকতা পাবার সৌভাগ্যহয়। নয় বছর ধরে তিনি তার জন্য প্রশস্তিমূলক গান রচনা করেন এবং তিনি তার জন্য যে গীতিকাব্য রচনা করেছিলেন তাকে আরব সাহিত্যের মাস্টারপিস হিসেবে ধরা হয়।

সম্ভবত সাঈফ আল দাউলার সাথে বাদানুবাদের কারণে তিনি আলেপ্পো থেকে পলায়ন করে মিশরে গিয়ে ইখশিদিদ শাসক কাফুর এর পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করেন। তিনি তার সাথেও তর্কে জড়ান এবং সেখান থেকেও পালাতে বাধ্য হন। বাগদাদে ফেরার সময় তিনি ডাকাতদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন।

আল মুতানাব্বি কখনও দ্বিতীয় শ্রেণীর রক্ষক আবার কখনও শাসক সাঈফ আল দাউলাকে নিয়েই গীতিকাব্য লেখেন। লেখার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও বাগাড়ম্বর করা হয়, কোথাও তাদের মহিমান্বিত করে তোলা হয়। কিন্তু এসবের মধ্য দিয়েও সেই গীতিকবিতাগুলোতে একধরণের সংশয়বাদের প্রকাশ ঘটেছে। এখানে পৃথিবীর অজ্ঞতা, নির্বুদ্ধিতা, কুসংস্কার থেকে এক ধরণের মোহমুক্তির আভাস পাওয়া গেছে যেই মোহগুলো থেকে কেবল মৃত্যুই মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু মারগোলিয়থ বলেন, অনেক মুসলিমদের কাছেই মুতানাব্বির গিতীকবিতার পংক্তিগুলো নবী এবং তার ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিল। মুসলিমদের জন্য তার সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক লেখার মধ্যে একটি ছিল, আলিদ নামের একজন রক্ষকের জন্য লেখা, “তিহামাহ (নবী মুহম্মদ) এর সবচেয়ে বিষ্ময়কর ব্যাপার হল সে আপনার পিতা”। আরেক রক্ষকের উদ্দেশ্যে লিখতে গিয়ে তিনি লেখেন, “যদি আপনার তরবারি দ্বারা  যুদ্ধক্ষেত্রে কোন ভিখারির মস্তক ছিন্ন হয় তবে তাকে জেসাসও বাঁচাতে পারবেন না, যদি আপনার হস্ত লোহিত সাগর হয় তবে মোজেসও তা অতিক্রম করতে পারবেন না।”

আবু হায়ান আল তাউহিদি (মৃত্যু আনুমানিক ১০২৩ খ্রিষ্টাব্দ)

লিখিত উৎস্য হতে জানা যায়, আল রাওয়ান্দি, আল মাআরি এবং আল তাউহিদি ছিলেন ইসলামের তিনজন বিখ্যাত জান্দাকা (বা জিন্দিক)। আল রাওয়ান্দি এবং আল মাআরি নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখা হবে। তাই বাকি থাকল তৃতীয় বিখ্যাত জিন্দিক আল তাউহিদি। আল তাউহিদির কাজগুলো অন্যদের তুলনায় বেশি বিপজ্জনক ছিল কারণ অন্যেরা যেখানে তাদের অবিশ্বাসের ঘোষণা দিয়ে গেছেন সেখানে আল তাউহিদি কটাক্ষও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তারপরও সেই কাজগুলোকে তেমন ভিন্নমতের বলে মনে হয় নি। তার “কিতাব আল ইতমা” তে আমরা আল মুতানাব্বির নৈরাশ্যবাদের অবশেষ খুঁজে পাই। এটা সম্ভব যে গ্রীক দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রতি আল তাউহিদির আগ্রহ গোড়া মুসলিমদের কাছে তাকে সন্দেহজনক বানিয়ে তোলে। এরকম কোন আগ্রহই তাকে নাস্তিক্যবাদের দিকেও ঠেলে দিতে পারে।

ইবনে আল রাওয়ান্দি (জন্ম আনুমানিক ৮২০-৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ)

আল রাওয়ান্দি মুতাজিলা সম্প্রদায়ের হয়ে কাজ শুরু করেন কিন্তু ভিন্নমতের কারণে মুতাজিলা সম্প্রদায় তাকে বহিষ্কৃত করে। মুতাজিলার পূর্বের সহকর্মীদের বিরুদ্ধে তার লেখা বইটি “ফাদিহাত আল মুতাজিলা” বা “মুতাজিলাদের হীনতা” নামে পরিচিত। কোন বিষয় সম্পর্কে বলা নিষিদ্ধ বা বিপজ্জনক হলেও আল রাওয়ান্দি সে সম্পর্কে বলালে দ্বিধা বোধ করতেন না। আর এটার জন্যই যে তাকে নাস্তিক এবং জিন্দিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্ষুদ্র অর্থে চিন্তা করলে তাকে দ্বৈতবাদী বলা যায়, কিন্তু বিস্তৃত অর্থে তাকে নিয়ে চিন্তা করলে তাকে একজন মুক্তচিন্তাকারী বলতে হয়। তিনি জনসম্মুখে মুতাজিলা সম্প্রদায় কর্তৃক অভিযুক্ত হন। সরকার এর দ্বারা নির্যাতনের কারণে অবিলম্বে তাকে বাগদাদ থেকে পালাতে হয়। তার মুতাজিলা সম্প্রদায়ের পুরনো সহকর্মীদের বিরুদ্ধে লেখাগুলোতে তিনি মুতাজিলাদের চিন্তার অসঙ্গতিকে তুলে ধরেন এবং মুতাজিলাদের নীতি ব্যবহার করেই তিনি কিছু অনুসিদ্ধান্ত সেখানে উল্লেখ করেন যা ভিন্নমতের ছিল।

নাইবার্গ দেখান, মুতাজিলারা আল রাওয়ান্দিকে নিন্দা ও বহিষ্কৃত করেন তার এরিস্টোটল এর মতবাদ অনুসরণ করার কারণে যেটা শূন্য থেকে সব কিছু সৃষ্টি হওয়া এবং সৃষ্টিকর্তা সংক্রান্ত মতবাদকে ধ্বংসকে করে দেয়। আমরা জানি, আল রাওয়ান্দি মহাবিশ্বের চিরন্তনতা নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। কিন্তু এই লেখাটির অস্তিত্ব আর নেই।

অনেক দার্শনিক তাকে খুব গভীরভাবে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ তাকে সমর্থনও করেছেন। যেমন আল হাইথাম দেখান যে তার লেখার যে খণ্ডন করা হয়েছিল তা সম্পূর্ণ ভূল ছিল।

আল রাওয়ান্দি তার একটি বইতে দ্বৈতবাদ নিয়ে লেখেন, আবার একটা সময়ের জন্য তিনি মধ্যমন্থী ঘরানার শিয়া মতবাদের দিকে ঝোঁকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে সমস্ত বুদ্ধিগত সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং নাস্তিক হয়ে যান।

মুতাজিলা সম্প্রদায় আল রাওয়ান্দিকে নবী, কোরান, হাদিস এবং সব মিলে কিতাব আল দামিঘ, কিতাব আল ফারিদ এবং কিতাব আল জুমুরুধ এ শরিয়তের সবকিছুকে আক্রমণ করার জন্যই অভিযুক্ত করেন। কিন্তু নাইবার্গ এবং অন্যেরা দেখান, আল রাওয়ান্দি কেবল মুতাজিলা সম্প্রদায়ের নীতি থেকেই যৌক্তিক উপসংহার টেনেছেন। আল রাওয়ান্দির অবিশ্বাসকে বলা যায় মুতাজিলাদের স্বর্গীয় বিধানকে স্বীকার করার জন্য মানব যুক্তির আত্মীকরণ এবং ব্যবহারের ফল।523

আল রাওয়ান্দির লেখা কিতাব আল জুমুরুধ থেকে আমরা জানতে পারি কেন তাকে একজন গোড়া ও বিপজ্জনক ভিন্নমতাবলম্বী বলা হত। এই বইয়ে নবুয়ত বিশেষ করে মুহম্মদের নবুয়ত নিয়ে কড়া ভাষায় সমালোচনার উল্লেখ ছিল। আল রাওয়ান্দির কাছে স্বর্গীয় বিধানের চেয়ে যুক্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তথাকথিত নবীদের কথায় যে যৌক্তিক কথাগুলো পাওয়া যায় সেগুলো সাধারণ মানুষও যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করে, তাই সেগুলো অপ্রয়োজনীয়। আবার সেই তথাকথিত নবীদের যেসকল কথাগুলো অযৌক্তিক সেগুলো পরিত্যাগ করা উচিৎ। আল রাওয়ান্দি মনে করতেন, সকল ধর্মই যুক্তির বিরুদ্ধে আর তাই সকল ধর্মকেই পরিত্যাগ করা উচিৎ। তার মতে নবী ও জাদুকরদের মধ্যে যে অলৌকিকত্বগুলো আরোপ করা হয় সেগুলো একেবারেই বানোয়াট। আর কোরান একেবারেই অলৌকিক এবং অনানুকরণযোগ্য নয়। এটা সাহিত্যিক মানদণ্ডে যথেষ্ট নিকৃষ্টমানের একটি গ্রন্থ। এটা না পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় আর এর না আছে কোন বাস্তব ভিত্তি, আর এটা স্বর্গীয় নির্দেশ যুক্ত কোন বই তো নয়ই। আর এটার মিথ্যা সাহিত্যিক অলৌকিকত্ব ছাড়াও সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে বইটি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। আর ভিন্ন ভাষাভাষী ব্যক্তিদের জন্য তো আরবী ভাষার কোন গ্রন্থ একেবারেই বোধগম্য নয়।524

আল রাওয়ান্দি সমস্ত ধর্মীয় আচারকেই নিরর্থক বলে দাবী করেন। আর তথাকথিত নবীরা যে জ্ঞান অর্জন করেছেন বলে দাবী করেছেন সেগুলোকে প্রাকৃতিক এবং মানবিক উপায়ে কোন স্বর্গীয় অলৌকিকত্ব ছাড়াই ব্যাখ্যা করা যায়। একটি উৎস্য হতে জানা যায়, আল রাওয়ান্দি ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নে একটি সন্তোষজনক যৌক্তিক উত্তর এবং এধরণের যৌক্তিকতার পথকে অস্বীকার করেছিলেন।

আল রাওয়ান্দির অন্যান্য মতবাদের মধ্যে ছিল, মহাবিশ্বের চিরন্তনতা, একেশ্বরবাদের চেয়ে দ্বৈতবাদের উৎকৃষ্টতা এবং স্বর্গীয় জ্ঞানের অসারত্ব। আল মাআরি তার রিসালাতুল ঘুফরান বইতে আল রাওয়ান্দির নিচের বাক্যগুলোর উল্লেখ করেছেন যেগুলো ঈশ্বরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল: “আপনি উপার্জন করার পথ আপনার সৃষ্টিদের উপর এমন মদ্যপের মত অসভ্যভাবে ভাগ করে দিয়েছেন যে যদি কোন মানুষ এমন আজ করত তাহলে আমরা তাকে বলতাম, ‘আপনি একজন প্রতারক, আপনাকে উচিৎ শিক্ষা দেয়া উচিৎ’”। আল মা’আরি ভীত হয়ে বলেছিলেন, “আল রাওয়ান্দির লেখা এই দুতি বাক্যকে যদি ঋজুভাবে দাঁড় করিয়ে তার পাপের উচ্চতা পরিমাপ করা হত তাহলে তার উচ্চতা মিশরের পিরামিডের চেয়েও লম্বা হত”।525

গ্রীক বিজ্ঞান ও দর্শন এবং ইসলামে এদের প্রভাব

বিশিষ্ট স্কলার এফ আর রোজেনথাল526 দেখান  অষ্টম থেকে দশম শতাব্দির মধ্যবর্তী সময়ে ইসলামে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যাতার ঐতিহ্যকে আত্তীকরণ করার কারণে এই সময়টিকে ইসলামের রেনেসাঁস বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইসলামি সভ্যতা কিভাবে কোন রকম প্রাচীন চিরায়ত ঐতিহ্য ছাড়াই এতটা উন্নতি করতে পারল সেটা একেবারে অভাবনীয়। রোজেনথাল এটা খুব স্পষ্টভাবেই বলেছেন:

আমরা যখন মুসলিম সভ্যতার মহত্বের কথা বলি তখন তা বলি প্রধাণত ইসলামের যৌক্তিক পাণ্ডিত্যের কারণেই যা কিনা সম্পূর্ণভাবে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। এমনকি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বিভিন্ন জ্ঞানের শাখার মৌলিক নীতিগুলো জন্যও মুসলিম সভ্যতা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতার উপর নির্ভরশীল। তার উপর ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক অংশের গভীরতম অভিব্যক্তিগুলোও গ্রীক চেতনার কাছে মাথা নত করে…। যাই হোক, ইসলাম ও অন্যান্য সভ্যতাগুলোর ক্ষেত্রে তার আলাদা আলাদা একেকটি উপাদান গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সেই উপাদানগুলোর সমন্বয় যা সবগুলো উপাদানকে একত্র করে একটি অখণ্ড জীবনের মত একটি এককের রূপ দেয় তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ…। এই তর্কাতীত সত্যই বলে যে, আমরা যে ইসলামি সভ্যতার কথা জানি গ্রিক ঐতিহ্য ছাড়া তার অস্তিত্ব একেবারেই থাকতে পারে না।

ইসলামি দর্শন

অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিতের জন্যই, বিশেষ করে অনেক মুসলিমদের জন্যই “ইসলামি দর্শন” শব্দটি  শব্দগতভাবে স্ববিরোধী কারণ “ গোড়া সুন্নি ইসলাম কখনই দার্শনিক চিন্তাধারাকে স্বাগত জানায় নি।” মৌলবাদীরা সবসময় দর্শনের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। কারণ তাদের মতে এটা ছিল একটি “বিজাতীয় বিজ্ঞান” যা তাদেরকে ভিন্নমত, সন্দেহ এবং সম্পূর্ণ অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দেবে। এজন্যই  গোড়া ইসলামপন্থিদের এই দর্শনভীতি অনেক দার্শনিকেরই উন্নত চিন্তায় উঠে আসে যা সেই গোড়া সুন্নি ইসলাম ও অন্যান্য ধারা থেকে অনেক দূরে ছিল। “বিশেষ করে বর্ধনশীল সুন্নি ইসলামের দ্বারা ঘৃণীত এইসব দার্শনিক মতাদর্শগুলো সম্পুর্ণভাবে যুক্তির ছত্রছায়ায় পরিচালিত হয়েছিল কারণ সেগুলো গ্রিক দর্শনের সান্নিধ্য পেয়েছিল, আর এই দার্শনিক ধারাগুলো ইসলামকে একরকম মৌখিক স্বীকৃতি ছাড়া আর কিছুই দেয় নি।” আর তাই ইসলামি দর্শনের কাহিনী হল প্রকৃতপক্ষ যুক্তি ও উদ্ঘাটনের কাহিনী।

অনুবাদ

গ্রীক বিজ্ঞানের কাজগুলো শুরু হয় উমায়াদ খলিফাদের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আব্বাসিদ খলিফা আল মামুন (৮১৩-৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রথমবারের মত গ্রিক দর্শন অনুবাদ করার জন্য উৎসাহ প্রদান ও অর্থায়ন করেছিলেন। আল মামুন দ্য হাউজ অব উইসডম নামে একটি প্রতিষ্ঠান নির্মান করেছিলেন যা গবেষণা ও অনুবাদের কেন্দ্র ছিল।

অনুবাদের প্রথম দিকটা ছিল ব্যাবহারিক। চিকিৎসা ও জ্যোতির্শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনের জন্য এটা করা হয়।  কিন্তু পরে আত্মমর্জাদা আর জ্ঞানের প্রতি সত্যিকারের কৌতূহলের কারণে এই অনুবাদ এর গতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি আল মামুনের অর্থায়নে অনুবাদকার্য শুরু করার পূর্বেও অনেক মুসলিম তর্কশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের প্রয়োজনে যুক্তি ও দর্শনের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।

বেশিরভাগ অনুবাদকই ছিলেন খ্রিস্টান। এদের মধ্যে একজন বিখ্যাত ব্যতিক্রম ছিলেন থেবিত ইবনে কুরা। তিনি একজন মুক্তমনা মূর্তিপূজারি ছিলেন। স্বাধীন দার্শনিক মতামত এর জন্য তিনি হেরানের পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। একাধারে একজন গণিতবিদ, চিকিৎসক ও দার্শনিক থেবিত ইবনে কুরা এই রেনেসাঁর খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

যেসব গ্রীক দার্শনিকদের কাজগুলোকে অনুবাদ করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল এরিস্টোটল ও তার কাজের ব্যাখ্যা দানকারী যেমন থেমিস্টিয়াস, সিমপ্লিসিয়াস এবং এফ্রোদিসিয়াস এর আলেক্সান্ডার এর লেখাগুলো; প্লেটোর লেখাগুলো, বিশেষ করে তার টাইমিয়াস, রিপাবলিক এবং লজ; প্লোটিনাস এর দর্শন; প্রোক্লাস এবং পরিফিরির মত নিওপ্লেটোনিস্টদের দর্শন; সক্রেটিস পূর্ব দার্শনিক যেমন গ্যালেন, হিপোক্রেটাস, আর্কিমিডিস, ইউক্লিড ও টলেমির লেখাগুলো ইত্যাদি।

ইসলামি দর্শনের প্রথম যুগ

আল কিন্দি, আল ফারাবি, ইবনে সিনা (আভিসেনা)

ইসলামি দর্শনের প্রথম যুগ আসে পূর্ব দিকে নবম ও একাদশ শতাব্দির মধ্যে আল কিন্দি, আল ফারাবি ও ইবনে সিনার হাত ধরে। অরনালডেজ বলেছেন, “এদের দর্শন ছিল নিওপ্লেটোনিক অধিবিধ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও মরমীবাদ এর সমন্বয়, গ্যালেন ও প্রোক্লাস এর দর্শন দিয়ে প্লোটিনাস এর দর্শনের সমৃদ্ধকরণ”527

আল কিন্দি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে গ্রীক দর্শনের আবিষ্কার ও কোরানের উদ্ঘাটিত বার্তাসমূহের মাঝে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। এই দুটোর মিলন সাধনের জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। সর্বপরি তিনি ইসলামের বেশিরভাগ মতবাদকেই বিশ্বাস করতেন ও এগুলোর বিরুদ্ধের যুক্তিগুলো থেকে এগুলোকে তিনি প্রতিহত করতে চাইতেন। আর সেজন্যই তিনি আমাদের কাছে তেমন কৌতূহলোদ্দীপক নন। এই অধ্যায়ে আমরা সেইসব লেখক ও চিন্তকদের নিয়ে আলোচনা করব যারা ইসলামি মতবাদগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এরা হলেন যুক্তিবাদী, ধর্মদ্রোহী, অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক ও মুক্তমনা। যাইহোক, মুসলিমদের জন্য গ্রীক দর্শনের শিক্ষক হিসেবে, ইসলামে নিওপ্লেটোনিক ধারণাগুলোর পরিচয়কারী হিসেবে এবং একজন যুক্তির সমর্থক হিসেবে ইসলামি দর্শনে আল কিন্দির গুরুত্ব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

আল সারাখসি (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ৮৯৯ খ্রি.)

দার্শনিক অনুসন্ধিৎসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে ইসলামের মৌলিক ধারণাগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বাধ্য করে। কিছু জিনিস আল কিন্দির ছাত্র আহমেদ বিন আল তায়িব আল সারাখসিকে গভীর সমস্যার মাঝে এনে দেয়। আল সারাখসি ছিলেন গ্রীক দর্শনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট এবং খলিফা আল মুতাদিদ এর গৃহশিক্ষক। খলিফার সামনে খোলাখুলিভাবে ধর্মবিরুদ্ধ ধারণাগুলো আলোচনা করায় খলিফা আকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আল বিরুনির দেয়া তথ্য অনুসারে, আল সারাখসি প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেন যেখানে নবীদেরকে ভণ্ড বলে দাবী করা হয়েছিল। মুতাজিলা সম্রদায়ের যুক্তিবাদের পথ ধরে আল সারাকসি ধর্মীয় সংশয়বাদের পথে আসেন। দার্শনিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি মুতাজিলা সম্প্রদায়ের সাথে একাত্ম ছিলেন।

আল ফারাবি (৮৭০-৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

আল ফারাবিকে নিয়ে পড়াশুনা করলে আমরা তার এমন কিছু ধারণা পাই যা গোড়া ইসলামের সাথে একেবারেই যায় না। আরবারি দেখান528 আল ফারাবির ধারণায় মৃত্যুর পর দেহের পুনরাবির্ভাবের কোন জায়গাই নেই। কিন্তু আল ফারাবিকে তার ধারণায় সবসময় অনড় হিসেবে দেখতে পাওয়া যায় না। পাইনস বলেছেন, এর জন্য হয়তো একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। তিনি বলেন, “আল ফারাবি এসব ব্যাপারে লেখার জন্য তার যে ক্ষতি হতে পারে এ ব্যাপারে সাবধান ছিলেন। তার লেখা পড়ে মনে হয় তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে তার রচনাগুলোতে একের পর এক বিমূর্ততা ব্যবহার করেছেন, এক্ষেত্রে স্পিনোজার লেখার ধরণের সাথে তার লেখার ধরণের মিল পাওয়া যায়। এভাবে তিনি তার নিজের চিন্তাধারাগুলো তার রচনায় কৌশলে ঢেকে রেখেছিলেন কারণ তিনি জানতেন যদি এগুলোকে খোলাখুলি প্রকাশ করা হয় তবে তা গোড়া ইসলামপন্থিদের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না”।

আল ফারাবি এরিস্টোটলের চিন্তাধারাকে অনুসরণ করে বিশ্বাস করতেন যে, শুধুমাত্র আত্মার বুদ্ধিদীপ্ত অংশেরই অমরত্ব থাকে। কিন্তু শুধুমাত্র যে আত্মাগুলো একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের বুদ্ধিদীপ্ত চেতনা এবং পূর্ণতা অর্জন করেছে, তারাই কেবল সুখ লাভ করবে। এই পবিত্র আত্মাগুলো মৃত্যুর পর নিজেদের এককত্ব বা ইন্ডিভিজুয়ালিটি হারায় এবং স্বর্গরাজ্যের সক্রিয় চেতনা বা “একটিভ ইন্টেলেক্ট” এর অংশ হয়ে যায়। অন্যান্য আত্মারা জন্মান্তর বিধি অনুসারে পুনরায় দেহ ধারণ করবে।

আল ফারাবির এই সক্রিয় চেতনার ধারণা এসেছে নিওপ্লেটোনিস্টদের মতবাদ থেকে। আর এটা গোড়া একেশ্বরবাদীদের জন্য স্বভাবতই সমস্যার সৃষ্টি করল। আল ফারাবি এই সক্রিয় চেতনাকে একটি আলাদা অধিবিদ্যক সত্তা বলে মনে করতেন যা মানুষের মন এবং আদ্যাত্মিকতার মধ্যবর্তী কোন স্থানে অবস্থান করত। এবং এর মধ্য দিয়ে মানুষের মন এবং কল্পনা স্বর্গের সাথে সম্পর্কযুক্ত হত। আল ফারাবির যুক্তির প্রতি সমর্থন এবং নবী দ্বারা আনিত বিধানের চেয়ে দর্শনের প্রতি আনুগত্য তাকে গোড়া মুসলিমদের কাছে সন্দেহজনক করে তোলে। আল ফারাবির মতে কেবল যুক্তির পূর্ণতাই মানুষকে প্রকৃত সুখের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু কোন স্বর্গীয় আত্মা মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই মানুষের জীবন কেবল মাত্র যুক্তি দ্বারাই পরিচালিত হতে পারে। যুক্তির উপরে এমন কোন জ্ঞান নেই যা বোধগম্য হতে পারে।529 আল কিন্দির কাছে দর্শন ছিল গৌন, এটা তার কাছে ছিল ধর্মতত্ত্বে দাসীস্বরূপ। কিন্তু আল ফারাবীর কাছে দর্শন এমনটা ছিল না, তিনি দর্শনকেই বরং মূখ্য এবং প্রধান বলে মনে করতেন। যেকোন দার্শনিক মতের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে তার সমাধান কোন স্বর্গীয় বিধান বা স্বর্গীয় গ্রন্থ দিতে পারেনা, একে সমাধান করতে পারে কেবলই যুক্তি। যুক্তিই হল চুড়ান্ত সমাধানদাতা। তার মতে, সঠিক সময় আসলে বিশ্বে একটি সার্বজনীন রাষ্ট্র তৈরি হবে, যেখানে সকলে এক নীতি অনুস্মরন করবে। যদি তা না হয়, বিভিন্ন ধর্ম সমান্তরালেই পাশাপাশি টিকে থাকবে। আর যদি এটাও অবাস্তব হয়ে যায় তাহলে ইসলামকে দর্শনের মহান জ্ঞানের আলোকে পরিবর্তিত হতে হবে। দর্শনই মানুষকে সর্বোচ্চ পূর্ণতা দিতে পারে।530

ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রিষ্টাব্দ)

ইবনে সিনা বা আভিসেনা আল ফারাবি কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি রূপকের ব্যাখ্যার আলোকে ধর্ম এবং দর্শনের মিলনসাধন করতে চেয়েছিলেন। ইবনে সিনার পরকাল সম্পর্কিত ধারণাকে গোড়া ইসলামপন্থিরা গ্রহণ করেছিল কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। ইবনে সিনা মৃত্যুর পর কেবলমাত্র শরীরের পুনরুত্থানের ধারণাকে অস্বীকার করতেন (কোন ব্যক্তিকে যদি কোন নরখাদক খেয়ে ফেলে তাহলে কি হবে?) আবার শরীর এবং আত্মার একত্রে পুনরুত্থানকেও তিনি অস্বীকার করতেন। একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব তার আত্মায় থাকে, শরীরে নয়। আর কেবল মাত্র আত্মাই মৃত্যুর পরেও টিকে থাকতে পারে। এ.জে.আরবেরি এর মতে ইবনে সিনার মতবাদগুলো তার পূর্বের সমগ্র ইসলামের ইতিহাসের মতবাদের থেকেই পৃথক ছিল। তার মতবাদ ছিল এরিস্টোটল এর মতবাদ এবং নিওপ্লেটোনিজম মতবাদের মিশ্রণ। তিনি বলেন, “এটাও সম্ভব যে গ্রীক দর্শন তার হাতে এসে পুনর্জীবন লাভ করে, আর ইসলাম হয়তো এজন্য ডার্ক এজ বা অন্ধকার যুগ সমর্কে কিছু জানতই না”।

গোড়া ধর্মতাত্ত্বিকেরা ইবনে সিনার রূপকের মাধ্যমে ধর্ম ও দর্শনের মিলনসাধনের প্রচেষ্টাকে মেনে নেন নি। তারা এধরণের চিন্তাকে ভয় পেতেন। তারা এব্যাপারে নিশ্চিন্ত করেন নি কখন এই দার্শনিকগণ জনসাধারণের জন্য একটি সত্য এবং দার্শনিকভাবে জ্ঞানীদের জন্য আরেকটি সত্য গ্রহণের কথা তুলেছিলেন। গোড়া ইসলামপন্থিরা ভীত ছিলেন এই দ্বৈতনীতির ধারণাটি ভবিষ্যৎকে কোথায় নিয়ে যাবে। এর চেয়ে তারা কোরানের সত্যের দিকে ফিরে যাওয়াই বেশি নিরাপদ ভেবেছিলেন।

আল গাযালি এবং দার্শনিকদের মধ্যে অসঙ্গতি

আলা গাযালিকে কখনও কখনও মুহম্মদের পর দ্বিতীয় মহান মুসলিম হিসেবে অভিহিত করা হয়। তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকেও অস্বীকার করা যায় না। তার ভাল অবদানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ইসলামিক ধর্মতত্ত্বকে দর্শনের ভিত্তিতে দাঁড় করানো (তিনি এরিস্টোটলের যুক্তিবিদ্যার অনুরাগী ছিলেন, তিনি কেন্দ্রীয় সুন্নি ইসলাম এর নীতিকে নিওপ্লেটোনিজম মতবাদ ও পদ্ধতি দ্বারা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেম) এবং সুফিধারাকে মূল গোড়া ইসলামের ছায়ায় নিয়ে আসা।

কিন্তু অরনালদেজের মতে532 অনেকে গাযালিকে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে দেখেন যিনি ইসলামের সাথে গ্রীক দর্শন এবং যুক্তিবাদের মধ্যকার সম্পর্কের সমাপ্তি ঘটান। তিনি একটি চূড়ান্ত ধর্মতত্ত্ব দেন যা নিএই ছিল ইসলামের গোড়া নীতির কাছে দাসীস্বরূপ। তার বিখ্যাত রচনা, “দার্শনিকদের অসঙ্গতি” সেই সব দার্শনিকদের আক্রমণ করেছিল যাদের দর্শন ইসলামের মূলনীতিকে সমর্থন করত না। তবে এটা নিয়ে সন্দেহ আছে যে তিনি একাই ইসলাম থেকে দর্শনের সমস্ত ধারাকে মুছে ফেলেছেন কিনা। কারণ ১০৯৫ সালে গাযালির দ্বারা বইটি লেখার আগে থেকেই ইসলামি সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশে দর্শনের পতন ঘটা শুরু করেছিল, যেখানে ইসলামি সাম্রাজ্যের পশ্চিম অঞ্চলে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দর্শনের ধারা অব্যাহত থাকে। সে যাই হোক, গাযালির দর্শননিন্দা যে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে সে বিষয় আরবেরি একদম সঠিক। আরবেরি বলেন, “গাযালির কারণে পূর্ব দিকে দর্শন এবং ধর্মের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। আর এরফলে ভবিষ্যতে কেবল স্বর্গীয় বিধান বা স্বর্গীয় গ্রন্থটিরই প্রাধান্য স্থাপিত হয়”।

দার্শনিকদের বিরুদ্ধে আল গাযালি লেখেন, “তাদের নাস্তিক্যবাদের উৎস্য ছিল সক্রেটিস, হিপ্পোক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টোটল নামের ভয়ানক মানুষগুলো। এসব দার্শনিকদের অনুসারীরা আনন্দের সাথে তাদের পাণ্ডিত্য এবং বুদ্ধিমত্তাকে সেইসব দার্শনিকদের দর্শনের জন্য সঁপে দিত কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা পবিত্র ধর্মীয় নীতি, আইনকে অস্বীকার করত, পবিত্র ধর্মীয় বিশ্বাসকে পদাঘাত করত, সেগুলোকে বানোয়াট এবং ছলনা বলে মনে করত”। আল গাযালি সতেরোটি ক্ষেত্রে দার্শনিকদের মতামতকে ভিন্নমত বলে দাবী করেন এবং আরও তিনটি ক্ষেত্রে দার্শনিকদের ধর্মদ্রোহী বলে অভিহিত করেন। এইসব দার্শনিকদের দর্শন যারা সমর্থন করতেন তাদের মৃত্যুদণ্ড চাইতেও গাযালি দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি বলেন, “তিনটি কারণে তাদেরকে চূড়ান্তভাবে ধর্মদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করা যায়। প্রথমত মহাবিশ্ব ও এর সকল উপাদানকে চিরন্তন দাবী করার জন্য (এক্ষেত্রে দার্শনিকগণ শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির বিরুদ্ধে ছিলেন), দ্বিতীয়ত এমনটা দাবী করা যে ঈশ্বর ব্যক্তির জীবনে ঘটা কিছু বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না, এবং তৃতীয়ত দেহের পুনরুত্থানকে অস্বীকার করা”।

আল গাযালির মর্যাদা এতটাই বেশি ছিল যে কেউ তাকে সমালোচনা করার সাহস করত না। কিন্তু আল গাযালি সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। আল গাযালির খারাপ প্রভাবগুলো তার ভাল অবদানগুলোকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। প্রথমত তিনি মুসলিমদেরকে কোরানের নিয়ে কোন প্রশ্ন করা যাবে না, এবং কোরানকে রূপক নয়, আক্ষরিক অর্থেই মান্য করতে হবে এমন বিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এতে মুতাজিলা সম্প্রদায় এপর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছিল সব ধ্বংস হয়ে যায় এবং মুসলিমরা কোরানের প্রতি পূর্ণভাবে এবং শোচনীয় ভাবে আত্মসপর্মন করাকে উপভোগ করতে করা শুরু করে। তারা কোরানের সকল প্রকার এনথ্রোপোমরফিক বা নরত্বারোপমূলক রচনাংশ আক্ষরিকভাবে মানতে শুরু করে, আক্ষরিকভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে স্বর্গের কামুক হুরিদের এবং নরকের অস্বাভাবিক যন্ত্রণার চিত্রকে। সবচাইতে খারাপ যেটা হয়েছিল তা হল গাযালি আবার মুসলিমদেরকে ইসলামের আতঙ্কের উপাদানগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি তার প্রচারে ঈশ্বরের ক্রোধের ভয় দেখাতে শুরু করলেন, নরকের শাস্তির ভয় দেখাতে শুরু করলেন।

আল গাযালি যদিও গণিত, যুক্তি, পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে নিরপেক্ষ উপায়েই শিক্ষা দিতেন, কিন্তু এসব ক্ষেত্রেও তিনি বলতেন এর প্রক্রিয়াগুলো তাদের আসল সীমাকে অতিক্রম করেছে। তিনি মুক্তভাবে প্রশ্ন করার বিরুদ্ধে ছিলেন, বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসার বিরোধী ছিলেন। তার “ইহিয়া উলুম আল দিন” নামক গ্রন্থের সপ্তম ধারার দ্বিতীয় অধ্যায়ে গাযালি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কিছু বিষয়কে ধর্মের বিরুদ্ধে বলে দাবী করেন, এবং তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি মুক্তচিন্তা করা থেকে বিরত থাকতে এবং নবীর কথাগুলোকে স্বীকার করতে বলেছেন।

আল গাযালি বার বার বলতে থাকেন মানুষের পক্ষে কখনই সত্য উদঘাটন করা সম্ভব নয়, সত্য কেবলমাত্র ধর্মগ্রন্থেই পাওয়া সম্ভব। আল গাযালি স্বর্গীয় প্রাপ্তিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবাধ যুক্তিবাদ এবং দার্শনিক মতবাদকে আক্রমণ করলেন যুক্তি আর দর্শনের প্রক্রিয়া ব্যবহার করেই, এটা অনেকটাই প্যারাডক্স হয়ে যায়। তিনি যে অন্য সতেরোটি ক্ষেত্রে দার্শনিকদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা না দিয়ে কেবল মাত্র ভিন্নমতধারী আখ্যা দিয়েছেন, তার এই সহিষ্ণুতা অ মহানুভবতার কারণে আমাদের তাকে করতালি দিয়ে বরণ করা উচিৎ? নাকি যারা কেবল আত্মাই অমরত্ব পায়, শরীর নয় বিশ্বাস করতেন তাদের প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড দাবী করার জন্য আল গাযালিকে একজন অসহিষ্ণু হিসেবে নিন্দা করা উচিৎ?

আবু বকর মুহাম্মদ বিন জাকারিয়া আল রাজি (৮৬৫-৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ)

হয়তো ইসলামের সবচেয়ে বড় মুক্তচিন্তাকারী ছিলেন আল রাজি বা ইউরোপের মধ্যযুগের র‍্যাজেস (বা চসারের রাজিস) কারণ তার মর্যাদা এবং কর্তৃত্ব সতেরো শতক পর্যন্ত আনচ্যালেঞ্জড ছিল। মেয়ারহফ তাঁকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে মহান চিকিৎসক এবং ইতিহাসের অন্যতম মহান চিকিৎসক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আবার গ্যাব্রিয়েলির মতে তিনি ছিলেন মধ্যযুগে প্রাচ্য এবং ইউরোপের সবচাইতে মহান যুক্তিবাদী “অজ্ঞেয়বাদী”। আল রাজি ছিলেন তেহরানের নিকতবর্তী রায় এর বাসীন্দা। সেখানে তিনি গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, সাহিত্য এবং সম্ভবত আলকেমির শিক্ষা নেন। এটাও সম্ভব যে আল রাজি একজন গুপ্ত মুক্তচিন্তাকারী এরানশাহরির কাছ থেকে শিক্ষা নেন। আল বিরুনির মতে, এরানশাহরি কোন প্রচলিত ধর্মমতে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু তিনি নিজের তৈরি করা ধর্মের একজন একনিষ্ঠ ধার্মিক ছিলেন। তিনি সেই ধর্মকে ছড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা করেছেন।533 এই এরানশাহরি আল রাজিকে প্রভাবিৎ করে থাকতে পারে। বাগদাদে আল রাজি চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। সেসময় বাগদাদ ছিল জ্ঞানের মহান কেন্দ্রবিন্দু। আলরাজির কাছে পাঠাগার এবং সমৃদ্ধ হাসপাতালগুলোতে প্রবেশাধিকার ছিল। পরবর্তীতে সেই হাসপাতালগুলোরই একটি তিনি পরিচালনা করতেন।

আল রাজি বিভিন্ন বিষয়ে অন্তত দুইশত বই লিখেছেন, এক্ষেত্রে গণিতটাই শুধু ব্যতিক্রম ছিল। তার বিখ্যাত চিকিৎসাসংক্রান্ত রচনা আল হাওয়ি ছিল চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি সমৃদ্ধ বিশ্বকোষ। এই বইটি তিনি ১৫ বছর ধরে লেখেন যা ১২৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ল্যাতিন ভাষায় অনুদিত হয়। আল রাজি একজন কঠোর প্রয়োগবাদী বা এম্পিরিসিস্ট ছিলেন এবং একেবারেই গোড়া ছিলেন না। এটা তার ক্লিনিকাল নোটবুকগুলো দেখেই বোঝা যায়। তিনি রোগীর ভালো হয়ে ওঠা, তাদের পীড়া, চিকিৎসার ফলাফল সতর্কতার সাথে লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি বসন্তরোগ এবং হাম সম্পর্কিত প্রাথমিক লেখাগুলো লিখেছেন। এগুলোর সবকিছুই তিনি করেছিলেন্ম তার ক্রিয়াশীল এম্পিরিকাল পর্যবেক্ষণের দ্বারা আর এক্ষেত্রে তিনি রোগীকে সাহায্য করতে পারে এমন কোন বিষয়ই বাদ দেন নি। তিনি প্রচুর চিকিৎসাসম্পর্কীয় বিষয় নিয়ে লিখেছেন যেমন চর্মরোগ, খাদ্যাভাস, জ্বর, বিষ ইত্যাদি।

আল রাজি রসায়নের ক্ষেত্রেও একই রকম এম্পিরিকাল বা প্রয়োগবাদী ছিলেন। তিনি এই বিষয়ের সমস্ত অতিপ্রাকৃত আচারগুলোকে পরিহার করেন এবং নিজেকে পদার্থ ও প্রক্রিয়াগুলোর শ্রেণীবিভাগ এবং তার গবেষণাগুলোর সঠিক বর্ণনা লেখায় আবদ্ধ রাখতেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম সত্যিকারের রসায়নবিদ যিনি আলকেমির বিরোধিতা করেন। আল রাজির সাধারণ দার্শনিক ভাষ্য ছিল, কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তাই তিনি যে বিষয়েই মনোযোগ দিয়েছেন সেখানেই তিনি প্রচলিত ধারা ও কর্তৃপক্ষকে চ্যালঞ্জ করেছেন। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টোটল, হিপ্পোক্রেটিস এবং গ্যালেনের মত গ্রীকদের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা ছিল কিন্তু তিনি তাদের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধাবনত ছিলেন না।

তিনি যদি মনে করতেন কোন বিষয়ে তিনি আরও ভাল বোঝেন তাহলে তিনি এই গ্রীক দার্শনিকদের সিদ্ধান্তগুলোকে পরিবর্তন করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। প্রয়োজনে তিনি তাদের চিকিৎসাসংক্রান্ত জ্ঞানে নিজের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানগুলোকে যোগ করে দিতেন। যেকোন রোগ নিয়ে বসার সময় আগে তিনি গ্রীক ও ভারতীয় উৎস্যগুলো থেকে এবং প্রথমদিকের আরব চিকিৎসকদের কাজগুলো থেকে যে তথ্যগুলো পেতেন সেগুলো একত্র করতেন। দেখা যেত তিনি প্রতিবারই সেগুলোতে তার নিজের মতামত এবং বিচার যোগ করতেন।534

একজন সত্যিকারের মানবতাবাদীর মত আল রাজির ছিল মানবিক যুক্তিবোধের ছিল অগাধ আস্থা। আল রাজি নিজেই নীতিবিদ্যার উপর একটি বই লিখেছেন “স্পিরিচুয়াল ফিজিক” নামে।534

সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে যুক্তি দান করেছেন যাতে আমরা সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারি। কোন কিছু অর্জন করার জন্য আমরা প্রাকৃতিকভাবেই যুক্তিকে ব্যবহার করি। এটা আমাদের জন্য ঈশ্বরের সবচাইতে মহান দান। যুক্তির কারণেই আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে পশুদের চাইতে অধিক পছন্দের। যুক্তির দ্বারাই আমরা আমাদের জীবনে সুন্দর করি, কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাই। যুক্তিকে ব্যবহার করেই আমরা শিখি কিভাবে জাহাজ তৈরি করতে হয় যাতে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমরা দূরবর্তী অঞ্চলে যেতে পারি। যুক্তিকে ব্যবহার করেই আমরা ওষুধ প্রস্তুত করতে পারি যা শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তিকে ব্যবহার করেই আমরা শিখি বিভিন্ন ধরণের কলা যা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে লাভবান করে। যুক্তিকে ব্যবহার করে আমরা পৃথবী ও আকাশের গঠন সম্পর্কে শিখি; সূর্য, চন্দ্র, তারকাগুলোর আকৃতি সম্পর্কে জানি, তাদের দূরত্ব এবং গতি সম্পর্কে জানি।

আল রাজি শূন্য থেকে সব কিছু সৃষ্টির ইসলামিক মতবাদটিকে অস্বীকার করেছিলেন। তার মনে, একটা নির্দিষ্ট সময়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু তা একেবারে শূন্য থেকে নয়। আল রাজি পাঁচটি চিরন্তন বস্তুতে বিশ্বাস করতেন। সেগুলো হল সৃষ্টিকর্তা, আত্মা, বস্তু, সময় এবং স্থান। তার মতে, “অজ্ঞ আত্মা বস্তুকে কামনা করে। ঈশ্বর তাই তার এই কামনাকে পূর্ণ করার জন্য বস্তুর সাথে আত্মার মিলনসাধন ঘটান। কিন্তু সেই সাথে তিনি আত্মাকে বুদ্ধিমত্তা দান করেন যার সাহায্যে আত্মা বুঝতে পারে বস্তুর সাথে আত্মার বিচ্ছিন্নতাতেই কেবল আত্মার দুর্দশা মোচন হবে। যখন এই জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবে তখনই এই বিশ্ব বিলীন হয়ে যাবে”।536  যে আল রাজি মুসলিমদের ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণাকে অস্বীকার করেছেন। ইসলামে আত্মা, বস্তু, স্থান, কাল এর চিরন্তনতা সম্পর্কিত মতবাদকে সহ্য করা হয় না।

সেই সময় নীতিবিদ্যার বইগুলোতে কোরান এবং মুহম্মদের বক্তব্যগুলোর রেফারেন্স দেয়া হত। কিন্তু আল রাজি তার স্পিরিচুয়াল ফিজিকে তেমন কিছুই করেন নি। আরবেরি বলেন, আল রাজির মনোভাব সহিষ্ণু অজ্ঞেয়বাদ বা টোলারেন্ট এগনস্টিসিজম এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সুখবাদ বা ইন্টেলেকচুয়াল হেডোনিজমকে সমর্থন করত। এটার মূল উৎস্য চিরায়ত দর্শনে থাকলেও এটা পারস্যের সংস্কৃতমনা ভদ্রসম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে, এটা ইরানের লোকদের চিন্তাধারা এবং জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে”।537 তিনি আধুনিকতাকে সমর্থন করেন, সন্ন্যাসকে সমালোচিত করেন, যুক্তির সাথে আবেগের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন, এবং প্লেটোর ফিলেবাস এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি তার সন্তুষ্টি ও পীড়া বিষয়ক তত্ত্বটি দেন। তার এই তত্ত্ব অনুসারে “সন্তুষ্টি ইতিবাচক কিছু নয়, এটা কেবলি মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার ফল। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খলার ফলেই পীড়া তৈরি হয়”।

পরকালের ক্ষেত্রে তিনি বিচারকে সমর্থন করেন এবং ইপিকিউরাসের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি যুক্তির দ্বারা মৃত্যুভয়কে দমন করার চেষ্টা করেন। তার বৃদ্ধবয়সের একটি কবিতা থেকে মৃত্যু নিয়ে তার মনোভাব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়:

আমার হৃদয়ে মৃত্যু তার হাত রেখে

বার বার আমাকে সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়

যেদিন আমাকে চলে যেতে হবে।

আমি জানিনা মৃত্যুর পর আমাকে কোথায় ঘুরে বেড়াতে হবে

অথবা আমার এই দেহের গৃহ ছেড়ে

আমার আত্মা কোথায় গিয়ে থাকবে।538

এখানে যেন আল গাযালির গোড়া ইসলামী মতধারার নরকের যন্ত্রনার চিত্রের পর খোলা হাওয়ার সন্ধান।

শেষ পর্যন্ত আমরা আল রাজির সেই মতবাদগুলোতে যাচ্ছি যেগুলোকে মুসলিমরা ঈশ্বরনিন্দার অভিযোগে অভিযুক্ত করে এসেছেন। ইবনে হাজম, নাসির ই খসরু, আত কিরমানি এবং এমনকি আল বিরুনিও তাকে নিন্দা করেছেন। আল কিন্দি ধর্ম এবং দর্শন এর মিলনসাধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল রাজি ধর্ম ও দর্শনের মিলনসাধনের কোন সম্ভাবনাই দেখননি। আল রাজি তার দুটো ভিন্নমত সম্পর্কিত রচনায় আল রাজি তার ধর্মের বিপক্ষে মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেন। এই বইগুলোর একটি ইউরোপের একটি চিরায়ত মুক্তচিন্তার বই “ডে ট্রিবাস ইম্পস্টরিবাস” দ্বারা প্রভাবিত ছিল। আল রাজির ভিন্নমত সংক্রান্ত বই “অন প্রোফেসি” টিকতে পারেনি। কিন্তু আমরা জানি যে এই বইটিতে যুক্তি ঈশ্বরের বিধানের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং দর্শন শেষ বিচারকে সমর্থন করে না এ নিয়ে তার গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলো ছিল।

আল রাজির ভিন্নমত সংক্রান্ত দ্বিতীয় বইটি একজন ইসমাইলি লেখকের দ্বারা বইটির খণ্ডায়ন বা  অপ্রমাণ সংক্রান্ত লেখা দ্বারা টিকে আছে। সেই বইটির স্পর্ধা আমরা শীঘ্রই ক্রস539, পাইন্স এবং গ্যাব্রিয়েলির আলোচনা থেকে জানতে পারব।

“প্রতিটি মানুষকেই সমানভাবে যুক্তি দান করা হয়েছে য অন্ধ বিশ্বাসের দ্বারা দমিয়ে রাখা উচিৎ না। যুক্তি বরং মানুষকে খুব দ্রুত বৈজ্ঞানিক সত্য অর্জনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। দাড়িওয়ালা ছাগল নবীরা (আল রাজি অবজ্ঞাভরে নবীদের এভাবেই ব্যাখ্যা করেন) কখনই তাদের আধ্যাত্মিক বা বুদ্ধিদীপ্ত উৎকৃষ্টতা দাবী করতে পারেন না। এই ছাগলগুলো ভান করে যে তারা ঈশ্বরের কোন বাণী নিয়ে এসেছে। সকলকেই তাদের সেই মিথ্যাকে বিশ্বাস করতে হবে আর ঈশ্বরের কথাগুলো মেনে চলতে হবে। নবীদের অলৌকিকতাগুলো ছিল কেবলই ভণ্ডামি ও ছলচাতুরি আর তাদের নিয়ে গল্পগুলো হল বানোয়াট। নবীরা যে মিথ্যা বলেছেন তা নবীদের বিভিন্ন কথার মধ্যে স্ববিরোধীতা থেকেই বোঝা যায়। তাদের একটা কথা একটা জিনিস স্বীকার করলে আরেকটা কথা তা অস্বীকার করে, কিন্তু তারপরও এগুলো নাকি সত্যের আধার। আর এভাবেই নিউ টেস্টামেন্ট তোরার সাথে মেলেনা, কোরানের সাথে নিউ টেস্টামেন্ট মেলে না। আর কোরানের ক্ষেত্রে এটা তো কিছু বিমূর্ত ও অসংগত কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই না, যা আবার হাস্যকরভাবে দাবী করে এটাকে ভাষা, বাগ্মিতা, রচনাশৈলির দিক থেকে অনুকরণ করা সম্ভব না। আর এটা নাকি নিখুঁত হবার থেকেও অনেক ঊর্ধ্বে। সমাজের নীতি, আচার অনুষ্ঠান এবং বৌদ্ধিক অলসতা মানুষকে ধর্মগুরুদের অন্ধভাবে মান্য করার দিকে নিয়ে যায়। ধর্মের কারণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় যা মানবজাতিকে ধ্বংস করে। ধর্ম যেকোন দার্শনিক জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতিও শত্রুভাবাপন্ন। আর তথাকথিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি মানবজাতির জন্য ভাল তো নয়ই বরং যথেষ্ট ক্ষতি করে গেছে যেখানে প্লেটো এরিস্টোটল, ইউক্লিড এবং হিপোক্রেটিসের মত প্রাচীন মহান ব্যক্তিদের লেখাগুলো মানবজাতিরকে অনেক বড় উপকার করেছে।”

আল রাজির মতে, “যেসকল লোক ধর্মীয় নেতাদের কাছে সমবেত হয় তারা হয় কল্পনাবিলাসী নয় তো নারী বা শিশু কিশোর। ধর্ম মানুষের কণ্ঠরোধ করে এবং মানুষের মাঝে শত্রুভাবাপন্নতাকে জাগ্রত করে। যদি কোন বইয়ে তার সঠিক জ্ঞান প্রাপ্তি বা আবিষ্কার সম্পর্কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় তবে জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, এবং যুক্তিবিদ্যার বইগুলো কোরানের চেয়ে অনেক গুণে ভাল”। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কোরানের যে সাহিত্যিক সৌন্দর্যের সর্বোৎকৃষ্টতাকে আল রাজি অস্বীকার করেছেন, তাকেই কোরান যে আসলেই স্বর্গীয় বাণীর সমাহার তা প্রমাণ করতে ব্যবহৃত হয়।540

রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে আল রাজি বিশ্বাস করতেন, একজন মানুষ নবীদের দেয়া ধর্মীয় নীতি দ্বারা ভীত না হয়েই সমাজে সুসংবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে পারেন। ইসলামের নীতিগুলো যেমন মদ খাওয়া নিষেধ, এধরণের নীতিগুলো মানুষের জন্য কোন উন্নতি করতে পারে না, বরং ধর্মের চাইতে দর্শন এবং মানবিক যুক্তিগুলোই মানুষকের উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।  আল রাজি বিজ্ঞান এবং দর্শনের উন্নয়নে বিশ্বাস করতেন। বিজ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উন্নতি করে। একজনকে অবশ্যই তার মনকে খোলা রাখতে হবে এবং কখনই তাকে পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কোন বিশেষ নীতি সমর্থন করে না বলে অস্বীকার করা যাবে না। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার অনেক অবদান আছে এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভবিষ্যতে একদিন এগুলোর চাইতেও আরও ভাল তত্ত্ব এবং ভাল চিন্তা আসবে।

যাই হোক, উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে ধর্মের উপরে আল রাজির সমালোচনা ছিল মধ্যযুগের অন্যান্য সকল সমালোচকদের সমালোচনা থেকে বেশি উগ্র, তা ইউরোপের সমালোচকই হোক আর ইসলামিক সমালোচকই হোক। তার ভিন্নমত সংক্রান্ত লেখাগুলো খুব একটা টেকে নি এবং তেমনভাবে পঠিত হয় নি। তবুও সেই লেখাগুলো ছিল একটি অন্যতম সহিষ্ণু সংস্কৃতি এবং সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী যেই সহিষ্ণুতা সমসাময়িক অন্যান্য অঞ্চলে ছিল না।

ইসলামী দর্শনের দ্বিতীয় যুগ

মোটের উপর, ইসলামের দ্বিতীয় যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকগণ ছিলেন আভেমপেস (ইবনে বাজ্জা), ইবনে তুফায়েল এবং আভেরোস (ইবনে রুশদ)।

ইবনে বাজ্জা (মৃত্যু ১১৩৮)

ইবনে বাজ্জা ছিলেন এই তিনজন দার্শনিকদের মধ্যে সবচাইতে কম ধার্মিক। তার সময়ে দর্শনকে কেবল বস্তুবাদী মনোভাবের প্রতি নৈতিক সমালোচনার জন্যই ব্যবহার করা হত। দার্শনিকদের তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মসন্তুষ্টি এবং একটিভ ইন্টেলেক্ট বা সক্রিয় চেতনার সাথে একাত্ম হবার জন্য নিজেদেরকে জনসাধারণের থেকে আলাদা করে রাখতে হত। বাজ্জা শরীরের পুনরুত্থান এবং আত্মাদের আলাদা আলাদাভাবে টিকে থাকাকে তিনি অস্বীকার করেন, তিনি বিশ্বাস করতেন কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক সত্তাই টিকে থাকবে এবং এই সত্তার কোন এককত্বের বৈশিষ্ট্য বা ইন্ডিভিজুয়াল কোয়ালিটি থাকবে না। এধরণের কোন দর্শন সবসময়ই ইসলামপন্থিদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে এসেছে। ইবনে বাজ্জার শত্রুরা তাকে নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করেন কারণ তিনি কোরান এবং সমস্ত মুসলিম মতবাদকে অস্বীকার করেছেন এবং এই শত্রুরাই তাকে বিষ পান করিয়ে হত্যা করে।

ইবনে তুফেইল (মৃত্যু ১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দ)

ইবনে তুফেইল তার বিখ্যাত দার্শনিক গল্প “হেই ইবনে ইয়াকজান” এর জন্য বিখ্যাত। বইটির ইপোনিমাস নায়ক হেই ইবনে ইয়াকজান একটি মরুভূমি দ্বীপে বড় হয় এবং ধীরে ধীরে টিকে থাকার শিক্ষা পায়। সে শেষ পর্যন্ত কোন সাহায্যহীন যুক্তি দ্বারাই দার্শনিক জ্ঞান লাভ করে। এমন সময় আসাল নামে একজন সেই দ্বীপে আসেন। আসাল সেই দ্বীপে প্রচলিত ধর্মমত নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তিনি ধর্মগ্রন্থের রূপক এবং গূঢ় ব্যাখ্যার উপর আকৃষ্ট ছিলেন। আর এখন তিনি একাকিত্বে ঈশ্বরের প্রতি নিজের আত্মাকে নিয়োজিত করে আত্মতৃপ্ত হতে চান। তারা দুজনেই তাদের নিজস্ব দার্শনিক মত নিয়ে আলোচনা করার পর অনুধাবন করলেন হেই এর দার্শনিক ধর্মই হল আসালের প্রচলিত ধর্মের রূপক ব্যাখ্যা, অর্থাৎ দুটো ধর্ম একই। হেই জনবহুল দ্বীপে যান যেখানে সকলে প্রচলিত ধর্মটি পালন করে ধর্মটির ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থকে মেনে। হেই সেখানকার জনসাধারণকে তার দার্শনিক ধর্মটি শেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সফল হতে না পেরে তিনি অনুধাবন করেন যে সকলেই বুদ্ধিগতভাবে তার এই দার্শনিক ধর্মকে বুঝতে সক্ষম নন। প্রকৃতপক্ষে সেই দ্বীপের বেশিরভাগ মানুষ পশুর চাইতে খুব একটা উৎকৃষ্ট ছিল না।

ইবনে তুফেইল পরিষ্কারভাবেই দর্শনের কর্তৃত্বকে সমর্থন করলেন হেই এর তাত্ত্বিক দর্শন এবং আসালের দার্শনিক ধর্মতত্ত্বের মাধ্যমে। যদিও তিনি ধর্ম এবং দর্শনের মধ্যে মিলনসাধন করেছেন তারপরও তিনি দেখিয়েছেন যে ধর্মীয় সত্য এবং দার্শনিক সত্য একই স্তরের নয়। হেই (এবং আল তুফেইল) এর জন্য দার্শনিক সত্য যুক্তির মধ্য দিয়ে যা কেবল মাত্র কতিপয় বুদ্ধিমান ব্যক্তিই গ্রহণ করতে পারেন। অন্যদিকে ধর্মীয় সত্য হল সাধারণ চিন্তাহীন মানুষের জন্য যারা তাদের তাদের কর্মকে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। সাধারণ মুসলিমদেরকে তাই স্তুতি করার মত কিছু নেই।

ইবনে রুশদ বা এভেরোস (১১২৬ থেক ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দ)

আবু আল ওয়ালিফ মুহম্মদ বিন আহমেদ ইবনে রুশদ অথবা এভেরোস এসেছিলেন একটি আইনজ্ঞদের পরিবার থেকে এবং তিনি নিজেও লিগাল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কর্দভা এবং সেভিয়ার বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র এবং দর্শন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং তিনি এরিস্টোটলের উপর একজন বিখ্যাত ব্যাখ্যাকর ছিলেন। তার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো স্পেশালিস্ট এবং নন স্পেশালিস্টদের মধ্যে অনেক বিতর্কের ঝড় তুলেছে যেগুলো যথেষ্ট সতর্কতার সাথে নেয়ার মতই। আমাদের জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাহলে ধর্ম এবং দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক। আর এক্ষত্রে ইবনে রুশদের বিভিন্ন ধরণের মতামত পাওয়া যায়।

আর্নেস্ট রেনানের মতে, এভেরোস একজন চূড়ান্ত পর্যায়ের যুক্তিবাদী ছিলেন যিনি সকল প্রকার ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরোধিতা করেছিলেন। আর তার ধর্মতাত্ত্বিক রচনাগুলো ছিল অসহিষ্ণু গোড়া ইসলামপন্থিদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটি কৌশল। তবে বিংশ শতকের বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই এই ধারণাটিকে অস্বীকার করে দাবী করেছেন যে ইবনে রুশদ ছিলেন একজন একনিষ্ঠ মুসলিম যিনি ধর্ম ও দর্শন উভয়কেই সত্য বলে মনে করতেন। এছাড়া আধুনিক বিশেষজ্ঞগণও মনে করেন যে ইবনে রুশদ “দ্বৈত সত্য” এর তত্ত্বের প্রস্তাব করেন যাদের একটি ছিল অশিক্ষিত জনসাধারণের জন্য আর একটি ছিল কতিপয় জ্ঞানীদের জন্য। অন্যদিকে শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, জ্ঞান নির্বিশেষে কেবল একটি ধর্মীয় সত্যেরই অস্তিত্ব থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ইবনে রুশদ যেসব ধর্মতাত্ত্বিকগণ কোরানকে আক্ষরিক অর্থে সত্য বলে মনে করতেন তাদেরকে আক্রমণ করতেন, আর এটাই তার কাছে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়েছিল।

ইবনে রুশদের মতে শরিয়ার বিধিগুলো দর্শনচর্চা করতে বলে, কিন্তু এটা কেবল তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা বুঝতে সক্ষম এবং এরিস্টোটলের ডেমনস্ট্রেটিভ মেথড ব্যবহার করতে জানেন। কোরানে এমন কিছু অংশ আছে যেগুলোর ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন কিন্তু এই ব্যাখ্যা কেবল তাদেরই করা উচিৎ যাদের জ্ঞানের ভিত্তি অনেক শক্ত। কোরানের অন্য অংশগুলো এবং অন্যান্য উৎস্যগুলো থেকে শরিয়ত তৈরি করতে হবে যেগুলোকে আক্ষরিক অর্থেই সেই ধর্মগ্রন্থ থেকে নিতে হবে। এগুলোকে ব্যাখ্যা করতে চাইলে সেটা হবে অবিশ্বাস ও ভিন্নমতের আবিষ্কার।

মৃতদেহের পুনরুত্থানের ব্যাপারে ইবনে রুশদের দৃষ্টিভঙি কি ছিল সেটা জানা কঠিন, কেননা তার লেখাগুলো পড়ে মনে হয় তিনি তার ধারণা পরিবর্তন করেছিলেন অথবা তার নিজের তত্ত্বের পরিবর্তন করেছিলেন। এ বিষয়ে তার মত কি ছিল এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝেও মতানৈক্য আছে। ডি বোয়ের এর মতে541, ইবনে রুশদ সবকিছুই বিনাশশীল বলে মনে করতেন, যেখান থেকে আত্মার আলাদাভাবে অমরত্বের ধারণা বা ইন্ডিভিজুয়াল ইমমরটালিটি এর ধারণা নেয়া হয়। আবার জর্জ হোউরানি542 মনে করেন, ইবনে রুশদ বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুর পর আমাদের দেহ ক্ষয় হয়, এবং দেহের পুনরুত্থানের সময় প্রত্যেক আত্মাই নতুন দেহ পায়। এদিকে মারমুরা বলেন543, ইবনে রুশদ তার টেকনিলাল রচনাগুলোতে (যেমন এরিস্টোটলের রচনার ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে)ইবনে রুশদ কোথাও আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে বলেন নি। অন্যান্য রচনাগুলোতে তিনি আত্মার আলাদা আলাদা ভাবে অমরত্বের কথা বলেন তা কেবল আত্মাতেই সীমাবদ্ধ থাকুক আর দেহের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়েই যাক। আরেকটি লেখায়, ইবনে রুশদ দেহের পুনরুত্থানকে সমর্থন করেন। ফাখরির মতে544, ইবনে রুশদের তত্ত্ব বলে, একটিভ ইনটেলেক্ট বা সক্রিয় চেতনায় মিলিত হবার পর আত্মার কেবল বুদ্ধিগত অংশটিই অমরত্ব পায়। হোউরানি, মারমুরা এবং ডি বোয়ের এর মতে ইবনে রুশদির তত্ত্ব গোড়া ইসলামপন্থিদের সন্তুষ্ট করে এমন কিছু ছিল না। মারমুরা এদিকে রেনানের মতই একটি হাইপোথিসিস দাঁড় করান। তিনি বলেন, ইবনে রুশদ বোধ হয় নিজেকে অবিশ্বাসের অভিযোগ থেকে বাঁচানোর জন্যই একেক ধরণের লোকের জন্য একেক ধরণের মতামত দিয়েছেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইসলামে নারীর অবস্থান নিয়ে ইবনে রুশদের মতামত অবশ্যই গোড়াদের ক্ষিপ্ত করেছিল। ইবনে রুশদের মতে, “আমাদের দারিদ্র্য এবং কষ্টের একটি বড় কারণ হল নারীদেরকে পুরুষের পরিতৃপ্তির জন্য গৃহপালিত পশু বা গৃহে লাগানো চাড়ার মত গৃহে বন্দী করে রাখা। তাদেরকে যদি গৃহে এভাবে বন্দী না করে যদি সম্পদ উৎপাদন এবং বুদ্ধিদীপ্ত কাজগুলোতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হত তাহলে সমাজে এমন দারিদ্র্য, দুঃখ, কষ্ট থাকত না”545

ইবনে রুশদ তের শতকের ল্যাতিন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এভেরোসিস্ট সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল যারা ইন্ডাক্টিভ এবং এমপিরিকাল সায়েন্সের ক্ষেত্রে এরিস্টোটলের উপর ইবনে রুশদের কাজগুলোকে ব্যবহার করতেন। কিন্তু ইসলামি দর্শনের ক্ষেত্রে ইবনে রুশদের কোন প্রভাব একেবারেই ছিল না। মৃত্যুর পর ইবনে রুশদকে ইসলামি বিশ্বে একেবারেই ভুলে যাওয়া হয়। ইসলামের প্রভাবে তখন দর্শনের পতন হওয়া শুরু হয়েছিল, আশারিজম তখন ইসলামের গোড়া মূলনীতিগুলোকে নিয়ে ইসলামি দর্শনে তখন নেতৃত্ব দেয়া শুরু করে। আরবেরির মতে, “ইবনে রুশদের যুক্তির সুধাকণ্ঠকে ইবনে তাইমিয়ার প্রকাশ্য নিন্দার বজ্র দ্বারা রুদ্ধ করা হয়। প্রসিদ্ধ ইবনে খালদুন (মৃত্যু ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দ) পবিত্র এবং অপবিত্র জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শনের একটি তালিকা তৈরি করতে এগিয়ে আসেন। দর্শন এর আলোচনাগুলো যেন তখন জাদু, কবচ, আলকেমি, এস্ট্রোলজি সম্পর্কিত আলোচনার কাছে হেরে গিয়ে যেন সকলের কাছে অবজ্ঞাভরে পদদলিত হচ্ছিল”546

বিংশ শতকের শুরুর দিকে হওয়া ইসলামিক রেনেসাঁস আন্দোলন, নাহ্‌দাতে ইবনে রুশদকে পুরদস্তুর যুক্তিবাদী বানিয়ে একজন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সমর্থনকারী হিসেবে দাঁড় করানো হয়। এই আন্দোলন অনেক বেশি প্রভাবিত হয়েছিল কেনানের দ্বারা ইবনে রুশদের ব্যাখ্যার দ্বারা। সেই ব্যাখ্যায় ইবনে রুশদের যুক্তবাদকে অতিরিক্তভাবে রাঙ্গিয়ে চাঙ্গিয়ে তুলে ধরা হয় এবং তার ধর্মীয় ও আইন সংক্রান্ত কাজগুলোকে অনেকটাই গোপন করা হয়।

গ্রীক বিজ্ঞান এবং ইসলামি সভ্যতা

আমরা এখন ইসলামি সভ্যতার এক সত্যিকারের মহান অবদানের ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আর সেটা হল বিজ্ঞান। ইউরোপিয় ভাষায় আরবী থেকে যে শব্দগুলো এসেছে সেগুলোর দিকে তাকালেই বিজ্ঞানে ইসলামি সভ্যতার অবসান স্পষ্ট হয়ে ওঠে যেমন: এলকালি (alkali); জিরকন (zircon); আলেম্বিক (alembic); শারবেট (sherbet); ক্যামফার (camphor); বোরাক্স (borax); এলিক্সির (elixir); ট্যাল্ক (talc); তারকা আল্ডেবারান (Aldebaran), আলতাইর (Altair) এবং বেটেলজুস (Betelgeuse); নাদির (nadir); জেনিথ (zenith); এজার (azure); জিরো (zero); সাইফার (cipher); এলজেবরা (algebra); এলগরিজম (algorism); লুট(lute); রেবেক (rebeck); আরটিচোক (artichoke); কফি (coffee); জেসমিন (jasmine); স্যাফ্রন (saffron) এবং টারাক্সোকিউম (taraxacum)। কিন্তু অবশ্যই ইসলামি সভ্যতার এই বিজ্ঞান এর ভিত্তি ছিল প্রাচীন গ্রীকদের কাজগুলো দ্বারা এবং মুসলিমরা গ্রীকদের (এবং হিন্দুদের) এই কাজগুলোর সংরক্ষক এবং বাহক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা না থাকলে এই জ্ঞানগুলো হারিয়ে যেতে পারত। যদিও ইসলামি বিজ্ঞানীরা গ্রীকদের কাজগুলোর উন্নতি করেন, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের অনেক মৌলিক অবদানও আছে। তারা সমতলীয় এবং গোলকীয় জ্যামিতি আবিষ্কার করেন যা গ্রীকদের মধ্যে ছিল না। আল হাইথাম (আলহাজেন) (মৃতু ১০৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং আল ফারিসি (মৃত্যু ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দ) অপটিক্স বা আলোকবিজ্ঞান নিয়ে মৌলিক কাজগুলো করেছেন। আলকেমি, জাদুবিদ্যা এবং জ্যোতিশাস্ত্র নিয়ে তাদের কাজগুলো ইউরোপের বিজ্ঞানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের প্রকৃতিকে কারায়ত্ব করার ধারণা গবেষণামূলক কাজকে ত্বরান্বিত করে। তারা চিকিৎসাশাস্ত্র, বীজগণিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, বলবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদ্যার উপর অনেক কাজ করেন।

ইবনে খালদুন আমাদের মনে করিয়ে দেন, আরবরা ইসলামিক বিজ্ঞানের উন্নয়নে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নি: “এটা অদ্ভূত যে মুসলিমদের বেশিরভাগ জ্ঞানীরাই যারা ধর্ম অথবা বিজ্ঞানে দক্ষ ছিলেন তাদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া কেউই আরব ছিলেন না। আর সেই সব দাসরাও যারা নিজেদের আরব বংশধর বলে দাবী করতেন তারা বিদেশী ভাষায় কথা বলতেন, বিদেশী ভূমিতে বড় হয়েছেন এবং বিদেশী প্রভুদের কাছে পড়াশুনা করেছেন”। মারটিন প্লেসনার ইসলামি বিজ্ঞানের ইন্টারন্যাশনালিটি এবং ইন্টাররেলিজিয়াসনেস এর উপরে জোড় দিয়ে বলেছেন, ইসলামি বিজ্ঞানের বেশিরভাগ কৃতিত্ব যায় পারশিয়ান, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের কাছে: ইসলামিক বিজ্ঞান সম্পূর্ণভাবে মুসলিমদের হাতে ছিল না। এমনকি তাদের এরাবাইজেশন বা আরবীকরণের পরেও না। ইবনে গ্যাবিরল (এভিসেব্রন) এর ফন্স ভিটাই একজন মুসলিম এর অবদান বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। যদি উনিশ শতকে এস. মাংক এটাকে একজন ইহুদির কাজ বলে চিহ্নিত না করতেন তাহলে আজও সবাই সেটাই মনে করতেন। একইভাবে মাইমনিডিজ এবং ইসাক ইজরাইলির এর চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলোকেও কোনভাবে ইসলামি লেখকদের লেখার সাথে পৃথক করার করার কোন উপায় ছিল না। একই জিনিস আবার খ্রিস্টান বিশপ বারহেব্রেয়াসের বৈজ্ঞানিক লেখাগুলোর বেলাতেও সত্য। সত্যিকার অর্থে ইসলামি লেখকদের লেখাগুলোর কোন ধরণের বিশেষ পরিবর্তন ছাড়াই হিব্রু এবং ল্যাতিনে অনুদিত হওয়ার ঘটনা ইসলামি বিজ্ঞানের শুধুমাত্র ইন্টারন্যাশনালিটি বা আন্তর্জাতিকতাই না, বরং ইন্টাররেলিজিয়াসনেস বা আন্তর্ধর্মীয়তাকে নির্দেশ করে”।547

প্লেসোনার এক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এসেছেন:

বিজ্ঞান সম্ভবত এমন ধরণের একটা সাংস্কৃতিক বিশয় ছিল যা ইসলামাইজেশন বা ইসলামিকরণ দ্বারা কম প্রভাবিত হয়েছিল। তার উপর প্রাচীন বিজ্ঞানের উপর গোড়া ইসলামের অনবরত শত্রুভাবাপন্নতা ইসলামের একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেমনটা ছিল মধ্যযুগে খ্রিষ্টধর্ম এবং গোড়া ইহুদি ধর্মের ক্ষেত্রে। জ্ঞান ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যেত না এবং সামাজিক প্রথাগুলোকে কেবলমাত্র অপ্রাসঙ্গিক বলেই মনে হত না, বরং এটাই ছিল ভিন্নমতের প্রথম ধাপ।548

বর্তমানে একটি মিথ প্রচলিত আছে। আর সেটা হল ইসলাম বিজ্ঞানকে উৎসাহ দিয়েছে। এই ধারণার সমর্থকগণ কোরান ও হাদিসের উদ্ধৃতিকে তাদের ধারণাকে প্রমাণ করার জন্য উল্লেখ করেন: “বল, যাদের মধ্যে জ্ঞান আছে আর যাদের মধ্যে জ্ঞান নেই তাদের কি সমানভাবে দেখা উচিৎ?” (কোরান ৩৯.১২); “জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন হলে চীনেও গমন কর”; “জ্ঞানান্বেষণ প্রত্যেক মুসলিমের জন্যই বাধ্যতামূলক”। এসব উদ্ধৃতি দেয়া অর্থহীন কেননা এখানকার জ্ঞান গুলো এই উদ্ধৃতিগুলোর পূর্বে উদ্ধৃত ধর্মীয় জ্ঞানকেই নির্দেশ করেছে। গোড়া ইসলাম সর্বদাই এর নিজেকে রক্ষার জন্যই জ্ঞানের প্রতি সন্দিহান হয়েছে এবং যখনই জ্ঞানের কোন বিষয়কে বিশ্বাসের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করেছে তখনই এরা তাকে নিরুৎসাহিত এবং অবগা করেছে।

মুসলিমরা নিজস্ব বা ইসলামিক বিজ্ঞান এবং বিদেশী বিজ্ঞানের মধ্যে একটি পার্থক্য তৈরি করেছিল। ইসলামিক বিজ্ঞান গঠিত ছিল ধর্ম এবং ভাষা নিয়ে। এর মধ্যে কোরানের ব্যাখ্যা, হাদিসের বিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, স্কলাস্টিক ধর্মতত্ত্ব, ব্যাকরণ, লেক্সিকোগ্রাফি, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং সাহিত্য পরত। বিদেশী বিজ্ঞান বা প্রাচীনদের বিজ্ঞান ছিল সকল প্রকার মানুষ এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য কারণ এই বিজ্ঞান ইসলামের জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক ছিল। গ্রুনেবম বলেন, বিদেশী বিজ্ঞানগুলোর মধ্যে গ্রীকদের প্রকৌশলবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, অধিবিদ্যা; গণিতের বিভিন্ন শাখা, দর্শন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (প্রাণীবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ইত্যাদি), চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, সংগীত, জাদুবিদ্যা এবং আলকেমি।

কিন্তু গ্রুনেবম বলেছেন, এই বৈদেশিক বিজ্ঞানকে সবসময়ই সন্দেহ এবং বিদ্বেষপূর্ণ চোখে দেখা হত। আর এই বিদ্বেষ মধ্যযুগের শেষের দিকে বৃদ্ধি পায়। এই বিদ্বেষের একটি বড় কারণ ছিল এই বিজ্ঞান এসেছিল অমুসলিম এবং বিদেশীদের কাছ থেকে। সব বিদেশী বিজ্ঞানই ছিল বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক।549

এই বিজ্ঞানকে প্রশংসনীয়, নিন্দনীয় এবং নিরুপেক্ষ হিসেবেও ভাগ করা হত। নিন্দনীয় বিজ্ঞানকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে ধরা হত। নবী নিজেই অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ছিল সেই সব জ্ঞান যা ধর্মচর্চার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। একসময় প্রাচীন বিজ্ঞান তার ধর্মতাত্ত্বিক এবং বিজ্ঞান-দর্শনের মাঝে বন্ধন সৃষ্টি করার শাশ্বত বৈশিষ্ট্যটি হারিয়ে ফেলে। কারণ ঈশ্বক মানুষের জন্য যেধরণের জীবনব্যবস্থা দান করেছেন তাকে বোঝার জন্য এইসমস্ত জ্ঞানের আর প্রয়োজন ছিল না। আর সেকারণেই মুসলিম বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদের অনেক অবদানের পরও ইসলামী সভ্যতার চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে এসব জ্ঞানের কোনরূপ মৌলিক ভিত্তি ছিল না। ইসলাম কেবল ঈশ্বরসেবা এবং তার বিধান অনুযায়ী চলাকেই মানুষের প্রধান কাজ এবং উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করত। আর এটাই ইসলামী সভ্যতার নিজস্ব বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং ভুগোলের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যেগুলো নঃসন্দেহে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইসলাম অনুযায়ী মানুষের প্রধান কাজ হিসেবে যেটাকে ধার্য করা হয়েছে সেটার ঊর্ধ্বে যেকোন ধরণের বিজ্ঞানকেই অগ্রাহ্য করা হত।

গ্রুনেবম এবং রেনান উভয়ই কিছু সময়ের জন্য ইসলামের প্রভাব সত্ত্বেও ইসলামী বিজ্ঞানের উন্নয়ন হবার কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন। গ্রুনেন বলেন, “ইসলামে গাণিতিক এবং চিকিৎসাশাস্ত্র যা আমাদের অবাক হতে বাধ্য করে তার উন্নয়ন সেই সময়ে এবং সেই স্থানে ঘটেছিল যেখানে সমাজের অভিজাত এবং প্রধান অংশই গোড়া ইসলামী চিন্তাধারা এবং মতবাদের বিরুদ্ধে গিয়েছিল।”550 রেনানও একই রকম ব্যাখ্যাই দেন। তিনি বলেন, “ ইসলামি দুনিয়ায় বিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রসার ঘটে মধ্যযুগের প্রথমার্ধে। কিন্তু প্রসার ইসলামের কারণে হয় নি, বরং ইসলাম সত্ত্বেও ইসলামি বিশ্বে এর প্রসার ঘটে এটা দেখেই অবাক হতে হয়। কোন মুসলিম দার্শনিক এবং বিশেষজ্ঞই নির্যাতন এড়াতে পারেন নি। সেই সময়টাতে মুক্তভাবে জ্ঞানান্বেষণের প্রবণতা নির্যাতনের চাইতেও বেশি শক্তিশালী ছিল এবং যুক্তিবাদী ধারাকে জীবিত রাখা হয়েছিল। আর এরপর অসহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় গোড়ামি জয়লাভ করতে থাকে। এটাও সত্য যে খ্রিষ্টধর্মীয় চার্চও মধ্যযুগে বিজ্ঞানের অনেক সমস্যা তৈরি করেছিল। কিন্তু তারা পুরোপুরিভাবে বিজ্ঞানের শ্বাসরোধ করেনি যেমনটা করেছিল ইসলামি ধর্মতত্ত্ব। ইসলামকে ইবনে রুশদ এবং অন্যান্য আলোকিত মুক্তচিন্তাকারীদের জন্য কৃতিত্ব দেয়াটা এমন যে, একজন বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য কাউকে ইনকুইজশনে ফেলল কিন্তু তার সেই আবিষ্কারকে সে প্রতিহত করতে পারল না বলে তাকে এর কৃতিত্ব দেয়া হল।  ইসলামে আজ সেইসব মুক্তচিন্তাকারীদের অবদানকে তাদের ইসলামী বিজ্ঞানের মহিমা প্রকাশে ব্যবহার করা হয় যাদের জীবনের অর্ধেক সময় কেটেছিল জেলখানায়, বাধ্য হয়ে যাদের গোপনে বসবাস করতে হয়েছে, অপমান নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে, যাদের বইগুলোকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং যাদের লেখাগুলোকে ধর্মতাত্ত্বিক কর্তৃপক্ষ বিভিন্নভাবে অবদমিত করেছেন এবং নিশ্চিহ্ন করেছেন।551

গোড়া ইসলাম কেবল বিজ্ঞানীদের গবেষণাকেই শ্বাসরোধ করে নি তারা এটাও নিশ্চিত করেছিল যাতে তাদের গবেষণা সমাজে কোনভাবে প্রভাব ফেলতে না পারে। এই গবেষণাগুলোকে মুসলিমরা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে পারত। আমাদের চোখে এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির উদ্দ্যমের বিনাশ ছিল ইসলামি সভ্যতার একটি বড় দারিদ্র্য। কিন্তু মুসলিমদের চোখে এটা কোনধরণের ক্ষতি ছিল না কারণ এই বিজ্ঞান কখনও ঈশ্বরসেবার প্রধান লক্ষ্যের কোন কাজে আসেনি। “নিজের প্রয়োজনে বিজ্ঞান” এর ধারণাটি মুসলিম কনটেক্সটে অপ্রয়োজনীয় ছিল। সারটন তার বিজ্ঞানের ইতিহাসে মুসলিম প্রাণীবিজ্ঞান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “একজন চাইলেই প্রকৃতি এবং প্রাণীজগতের তিনটি জগত বা কিংডমে প্রাণীদের বণ্টন সম্পর্কিত অনেক আরবী এবং ফারসী লেখা খুঁজে পাবেন। কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া মুসলিমরা এই সব জিনিসের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী ছিলেন না। বরং তারা এর ধর্মতাত্ত্বিক প্রয়োগেই তারা বেশি আগ্রহী ছিল। তারা মানবিক বা প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবর্তন এর ব্যাপারে তেমন চিন্তা করতেন না যেমনটা ঈশ্বর কর্তৃক সব কিছুর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করতেন”552

পূর্বে রেনানের উদ্ধৃতি থেকে আমরা বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারে জেনেছি। এক্ষেত্রে আমরা আল হাইথাম (আলহাজেন) এর উদাহরণ দিতে পারি যার কাজগুলো ভিন্নমতাবলম্বী বলে চিহ্নিত করা হয় এবং ইসলামি দুনিয়ার পূর্ব অংশ থেকে তার লেখাগুলো একেবারে বিস্মৃত হয়ে যায়। ইহুদি দার্শনিক মাইমোনিডেস এর একজন শিষ্য বলেন, তিনি বাগদাদে ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন যখন কোন একজন দার্শনিকের (যিনি ১২১৪ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান) পাঠাগার আগুণে পোড়ানো হয়েছিল। যিনি সেই বিচারপ্রক্রিয়াটি নির্বাহ করছিলেন তিনি নিজের হাতে আগুণ ধরান। ইবনে আল হাইথামের পৃথিবীর গোলকীয় চিত্র অঙ্কিত একটি বই ছিল সেসময়ে ধর্মিবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদের প্রতীক।553

সুফিবাদ এবং ইসলামি রহস্যবাদ

সুফিবাদের একজন বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ আর এ নিকলসন বলেছেন, প্রথমদিকে সুফিরা সত্যিকারের রহস্যবাদী নয়, বরং সন্ন্যাসী এবং বৈরাগী ছিলেন। এই প্রথমদিকের সুফিরা খ্রিষ্টান ভাবধারা কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং ইন্দ্রিয়সুখ বর্জন করে মুক্তিলাভের উপায় অন্বেষণ করতেন। পরবর্তীতে এই সন্ন্যাস দীর্ঘ যাত্রাপথের কেবল প্রথম ধাপ হিসেবেই প্রতিপন্ন হয় যেই যাত্রাপথের চূড়ান্ত অভীষ্ট ছিল ঈশ্বর সম্পর্কে গভীরভাবে জ্ঞান অর্জন। ঈশ্বর, আলো, জ্ঞান এবং প্রেম ছিল নতুন সুফিবাদের প্রধান ধারণা। “শেষ পর্যন্ত তারা একটি সর্বেশ্বরবাদী বিশ্বাসে উপনীত হন এবং ইসলামের মহান ঈশ্বরকে পদচ্যূত করে তার পরিবর্তে তারা এমন একটি সত্তার উপাসনা করা শুরু করেন যিনি সর্বত্রই বিরাজমান এবং সর্বত্রই কাজ করেন এবং তার আসন স্বর্গ বা নরকে নয়, বরং মানুষের হৃদয়ে”534

সুফিরা নিঃসন্দেহেই কোরানের কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কিন্তু সুফিবাদের ঐতিহাসিক বিকাশ বরং খ্রিষ্টধর্ম, নিওপ্লেটোনিজম, নস্টিসিজম এবং বুদ্ধিজম বা বৌদ্ধ মতবাদ দ্বারাই অধিক প্রভাবিত। সুফিরা জপ বা তসবির ব্যবহার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে শিখেছিলেন যা ছিল বৌদ্ধ মতবাদ দ্বারা তাদের প্রভাবিত হবার আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি।

এই অধ্যায়ে আমরা দেখব পরবর্তীকালের সুফিরা কি করে ইসলামের নীতিগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিল। তারা বলত, “ইসলামী আইনের হাতকড়া তাদের জন্য নয় যারা জ্ঞান অর্জন করেছেন”। অনেক সুফিই ভাল মুসলিম ছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ নামমাত্র মুসলিম ছিলেন। সুফিবাদের ইতিহাসের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব আবু সাঈদ (মৃত্যু ১০৪৯ খ্রিষ্টাব্দ) ইসলামকে কেবল অবজ্ঞাই করে গেছেন। তিনি তার শিষ্যদেরকে মক্কায় হজ্জ্বে যেতে নিষেধ করতেন। এছাড়া বায়েজিদ (মৃত্যু আনুমানিক ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দ) শরিয়া আইন এর সমালোচনা করেছিলেন।

বেকতাশি অর্ডার বা বেকতাশি তরিকা সম্ভবত ষোড়স শতকের শুরুর দিকে প্রকাশ্য আসে। এটি খ্রিষ্টীয় এবং নস্টিক ধারণা দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত ছিল। বেকতাশিগণ ইসলামের ও সকল ধর্মের সমস্ত বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানকে বর্জন করেন।

দরবেশদের একটি দল ছিল যারা একত্রে মালামাতিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে জনসাধারণের ঘৃণা ও নিন্দা লাভের জন্য সবচেয়ে ভয়ানক ও জঘন্য কাজগুলো করতেন। অন্যেরা তাদের প্রতি যে ঘৃণা ও অবজ্ঞা পোষণ করত এটা সেটার প্রতি তদের ঘৃণা প্রকাশের একটি সুযোগ করে দেয়।

সুফিদের সবচাইতে বড় অর্জন হল তারা মনে করে সত্যিকারের ধর্ম সেটাই যার মধ্যে গোড়ামির কোন নিয়ম নীতি নেই যা মানুষকে একটি ধর্মীয় পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখে। রহস্যবাদী দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী স্বর্গীয় পুরস্কার এবং নরকের শাস্তি বলতে কিছু নেই। ঈশ্বরের কোন লিখিত আজ্ঞার মাধ্যমে নয়, বরং এখানে ঈশ্বরকে পেতে সরাসরিভাবে এবং আরও ঘনিষ্টতা অর্জনের মাধ্যমে। ঈশ্বরের প্রতি ভয় দ্বারা চালিত না হয়ে রহস্যবাদীগণ বরং ঈশ্বরের জ্ঞান এবং ঈশ্বরের প্রতি প্রেমে নিয়জিত হন। নিয়জিত হন আত্ম হতে নিজের বিচ্যুতিতে এবং এখানে ঈশ্বরসেবা বিবেচিত হয় হৃদয় দ্বারা সেবা হিসেবে, অন্ধভাবে বাহ্যিক আচার পালন দ্বারা নয়।

সুফিবাদ যতই সর্বেশ্বরবাদের দিকে যেতে লাগল গোড়ামির মধ্যে থেকেও এরা ততই বিভিন্ন লেখাও প্রকাশ করতে থাকল। তারা ঈসলামের পারসোনাল গড বা ব্যক্তিতুল্য ঈশ্বর এবং পরকাল এর ধারণাকে তাদের নিজেদের ধারণাগুলো দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছিলেন। গোড়া ইসলামপন্থিরা তা মেনে নিতে পারে নি। এরকম লেখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত ছিল ইবনে আল ফরিদের (১১৬১ থেকে ১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দ) কবিতাগুলো এবং ইবনে আরাবির (১১৫৫ থেকে ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রন্থ “জেমস অবন ম্যাক্সিমস”। এই দুটো লেখাই বিভিন্ন সময়ে তাদের অধিকারীদের  বিপদে ফেলে এবং দাঙ্গার জন্ম দেয় (দেখুন ইবনে ইয়াস এর হিস্টোরি অব ইজিপ্ট যেখানে জেমস অব ম্যাক্সিম বইকে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মূর্তিপূজকদের থেকেও অধিক খারাপ অবিশ্বাসী বলে বর্ণনা করা হয়েছে)। কোরান সম্পর্কিত মন্তব্য নিয়ে এই বইয়ে যা কিছু লেখা ছিল তারমধ্যে স্বর্ণের বাছুরের গল্পটির উদাহরণ দেয়াই মনে হয় যথেষ্ট হবে। আল আরবির মতে, মোজেস এর ভাই বাছুরের উপাসনা অনুমোদন করছিল না বলে মোজেস তার ভাইয়ের মধ্যে ভুল খুঁজে পান। যেহেতু এরনের জানা উচিৎ ঈশ্বর ছাড়া কারোরই উপাসনা করা উচিৎ না তাই অন্য সব কিছুর মত বাছুরটিও ঈশ্বর ছিল”।

সুফি দর্শন বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে ঢাকা সীমানাগুলোকে মুছে দেয়, এটা বলে ইসলাম মূর্তিপূজার চেয়ে ভাল কিছু না। আল আরাবির এক ছাত্র বলেন, “কোরান এর ধর্মমত হল বহুঈশ্বরবাদী, পবিত্র এবং সরল”। ইবনে আরাবি নিজেই লিখেছেন যে তার হৃদয় হল মূর্তিপূজারিদের কাছে মন্দীর এবং হজ্জ্বযাত্রীদের কাছে ক্বাবা। আর কেবল প্রেমই হল তার ধর্ম।

আরেকজন রহস্যবাদী একটি গানে গেয়েছিলেন, “আমি খ্রিস্টানও না, ইহুদিও না, মুসলিমও না”। আবু সাঈদ লিখেছিলেন, “যতদিন পর্যন্ত মসজিদ এবং মাদ্রাসা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে না, ততদিন দরভিশদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। যতক্ষণ না বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস সম্পূর্ণ এক না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ সত্যিকারের মুসলিম হতে পারবে না”। নিকলসন লিখেছেন, হাফিজ সম্ভবত রহস্যবাদী হলেও একজন মুক্তচিন্তকের মত করেই তিনি বেশি লিখেছেন,

“প্রেম হল সেই ক্ষেত্র

যেখানে পতন ঘটে

একজনের সকল গৌরবের,

যেখানে পাগড়ি পরিহিত বৈরাগী

দিন রাত ঈশ্বরের ভজন করেন,

যেখানে গীর্জার ঘণ্টা বাজে প্রার্থনার ডাকের জন্য,

যেখানে খ্রিস্টের ক্রুশ উপস্থিত থাকে”556

গোল্ডজিহেরের মতে, বেশ কয়েকজন বিখ্যাত সুফি নিষ্ঠুর ইনকুইজিশনের শিকার হয়েছিলেন। প্রথম দিকের সুফিগণ গোড়া ইসলামপন্থিদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহের উদয় ঘটিয়েছিল যা আমরা সুফি ধু ই নুন (মৃত্যু ৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ) এর ইতিহাস থেকে দেখতে পারি। এই সুফির অনেক শিষ্য ছিল, এবং মানুষের উপর তার এত বেশি প্রভাবের কারণে ঈর্শান্বিতরা তাকে জিন্দিক বলে আখ্যায়িত করে। খলিফা মুতাওয়াক্কিল তাকে জেলখানায় পাঠায় এবং তার নৈতিক অবস্থান দেখে তাকে মুক্তি দেন।

সম্ভবত সবচাইতে বিখ্যাত রহস্যবাদী যাকে ঈশ্বরের প্রতি নিন্দামূলক কথা বলার জন্য অভিযুক্ত করা হয় তিনি ছিলেন আল হাজ্জাজ557 (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ৯২২ খ্রিষ্টাব্দ)। তাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করা হয়, অঙ্গহানি করা হয় এবং গিবেটে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে অনেক বছর জেলখানায় কাটাতে হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে কতল করা হয় এবং আগুনে পোড়ানো হয়। তিনি এরকম শাস্তি পেয়েছিলেন কারণ তিনি নিজস্ব নিয়মে ঈশ্বরকে ভক্তি করতেন এবং তার রহস্যবাদী অভিজ্ঞতা অনুসারে তিনি ইসলামের মতবাদের সাথে গ্রীক দর্শনের মধ্যে মিলনসাধন করতে চেয়েছিলেন। বার বছর পর ঈশ্বরনিন্দার অভিযোগে আল শালমাঘানিকেও মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়।

আল সোহরাওয়ার্দি (মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রথমে আলেপ্পোর ভাইসরয় কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা পান। কিন্তু তার রহস্যবাদ গোড়া ইসলামপন্থিদের মধ্যে অনেক সন্দেহের সৃষ্টি করে যারা সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুদণ্ডের দাবী জানানোস শুরু করেন। ভাইসরয় এই “সত্য বিশ্বাসীদেরকে” বিরোধীতা করতে ভয় পান এবং তাই সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

বদর আল দিন নামে একজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ সুফি শেইখ হুসাইন আখতালির সাথে মিলিত হলে তিনি সুফিবাদে ধর্মান্তরিত হন। তিনি একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত হন। এর ফলে তাকে গ্রেফতার করা হয়, বিচার করা হয় এবং ১৪১৬ খ্রিষ্টাব্দে দেশদ্রোহিতার জন্য ফাঁসি দেয়া হয়। তিনি রহস্যবাদী আল আরাবির প্রভাবে মুক্তভাবে নিজের ভিন্নমতের ধারণাগুলোর বিকাশ ঘটান।

ইসলাম কি ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণু?

ইসলামের প্রথম দিকে বিদা (নতুনত্ব ও নতুন কিছু প্রবর্তন) এর ধারণা বিকশিত হয়। কিছু বিখ্যাত হাদিস অনুসারে বিদা হল ভিন্নমত, এবং প্রতিটি ভিন্নমতই হল ভুল, এবং প্রতিটি ভুলই নরকে নিয়ে যায়। কোন কিছু আবিষ্কার ছিল সুন্নাহ এর বিপরীত। প্রথমদিকের কয়েকজন ধর্মতাত্ত্বিক বিদা এর জন্য মৃত্যুদণ্ড এর দাবী করেন। সৌভাগ্যবশত এই ধারাটি বেশিদিন টেকেনি যখন নতুন ধরণের রীতির প্রয়োজন দেখা দেয়। আর তাই ভাল বিদা এবং মন্দ বিদা এর মধ্যে পার্থক্য করা শুরু হয়।

আল শাফি বলেন, “যেসকল বিদা কোরান-সুন্নাহ্ এর বিরুদ্ধে যায় সেগুলো হল ভিন্নমতের বিদা। কিন্তু যদি কোন নতুন আবিষ্কৃত কিছুতে যদি দেখা যায় তার মধ্যে খারাপ কিছু নেই এবং কোরান সুন্নাহ এর সাথেও তার কোন বিরোধিতা নেই তাহলে এটা একটি প্রসংশনীয় এবং উত্তম বিদা”। এরকম নতুন নিয়মের প্রচলনের ফলেই মুসলিমরা উত্তম বিদাকে গ্রহণ করতে শুরু করল যেগুলো তাত্ত্বিকভাবে ইসলামের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিল। গোল্ডজিহের এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, “ইসলাম এবং খ্রিস্টীয় চার্চে ধর্মীয় মতবাদ বা নীতি সমান্তরাল নয়। ইসলামে কোন কাউন্সিল বা সিনড এর মত ধর্মীয় সভা নেই যেখানে অনেক বিতর্ক এবং চুলচেড়া বিশ্লেষণের পর ঠিক হয় সকলে কি বিশ্বাস করবে, আর কি বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে এরকম কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে যেখান থেকে এমন কোন আদর্শ ধর্মীয় নীতি প্রদান করা হবে। ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানের কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বা এক্সেজিসও নেই যার উপর ভিত্তি করে কোন আদর্শ নীতি তৈরি হতে পারে। সংবিধান হল সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ যা সকল প্রকার ধর্মীয় তত্ত্ব ও বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে হবে। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে এই সংবিধান অস্পষ্ট এবং এর বিচারও খুব একটা ভালভাবে নির্ণয় করা যায় না। এর বিভিন্ন ধারণাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি বার বার আসে যে কোন ধারাটি বিনা বিতর্কে সকলের কাছে ঐকমত্যের সাথে গৃহীত হবে যা হবে একটি সর্বসম্মত সংবিধান। এখন মুসলিমদের একটি অংশ যেই নীতিগুলোকে তাদের সংবিধান হিসেবে মানে অন্য অংশগুলো সেই নীতিগুলো থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে।558

গোল্ডজিহেরের উপরের এই ব্যাখ্যাটি আমাদের একটা ভুল ধারণার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আমরা ভেবে বসতে পারি ইসলামে কোন নির্দিষ্ট সংবিধান না থাকায় আমরা যা খুশি তাই বিশ্বাস করতে পারি। যদি তাই হত তাহলে আমরা ইসলাম বলে ডাকতাম কোন জিনিসটাকে? এক্ষেত্রে শ্যাচট বলেছেন, “ইসলামি আইন আস্তে আস্তে ধক্ত হয়েছে এবং এটা শক্ত হয়ে তার ছাঁচে চূরান্ত আকারটিও পেয়ে গেছে”। এটা সত্য যে, ইসলামের ক্ষেত্রে চিরকালই তত্ত্ব ও চর্চার মধ্যে প্রচুর ফারাক ছিল। কিন্তু ইসলামি আইন এর চর্চার ধারাটিকেই প্রতিষ্টিত করতে সক্ষম হয়েছে, বিশেষ করে পরিবারের আইন।

ইসলামে বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্টান বা সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয় নি কিন্তু বাস্তবে সমগ্র ইসলামের ইতিহাসে নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় নীতি নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে খুব ভালভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন ১০৪৮ থেকে ১০৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মাগরিব অঞ্চলে মালিক এর তরিকা প্রতিষ্ঠিৎ হয়। তার ধর্মীয় নীতি অনুসারে কোরানের কোন আয়াতের রূপক ব্যাখ্যা করা যাবে না, বরং এর সব আয়াতকে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বাস করতে হবে। মালিক বিন আনাস বলেন, “আমরা জানি ঈশ্বর তার সিংহাসনে বসে আছেন, এই সিংহাসনে বসে থাকার বিষয়টি আমরা যেভাবে বুঝি তেমনটা নয়। কিন্তু তারপরও বিশ্বাস করাটা আমাদের কর্তব্য আর প্রশ্ন করা হবে ভিন্নমত”। অন্য কথায় বলা যায়, বিভিন্ন অঞ্চলে যে সব নীতিগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় সেই নীতিগুলোকেই  চর্চার ক্ষেত্রে সকলকে মেনে নিতে হয়। ইচ্ছামত ধর্মচর্চা বা উদারপন্থী হবার কোন সুযোগই এখানে নেই।

এর কিছু পরে, ১১৩০ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেইনে আলমোহাদ এর রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় যেই রাজ্যের ধর্মীয় মত প্রতিষ্ঠিত হয় ইবনে তুমার্ত এর মতবাদের ভিত্তিতে। এই ধর্মীয় নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কোন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন পরে নি, নতুন রাষ্ট্রের শাসকগণই এই কাজ করেছিলেন।

ইসলামের অনেক সমর্থনকারী যারা ইসলামকে অনেক সহিষ্ণু এবং মার্জিত ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যে কোন প্রকারের বিতর্কের জন্য প্রস্তুত থাকেন তারা বলেন ইবনে তায়মিয়া এবং আল গাযালির কাজগুলো ছিল ইসলামের মৌলিক ও ন্যুনতম প্রয়োজনীয় বিশ্বাসগুলোকে সীমাবদ্ধ করার জন্য যাতে মুসলিমরা ঈশ্বর এবং নবীর বিষয়ে একমত থাকতে পারেন। কিন্তু এই ন্যুনতম বিশ্বাসগুলোকে দ্বৈতিবাদী জিন্দিক এবং সুফিদেরকে বাতিল করার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হয় না যারা নবীদের নিয়ে তেমন কিছু বলেন নি, এবং মুক্তচিন্তাকারীদেরকে (আল রাজি, ইবনে রাওয়ান্দি) বাতিল করার জন্য যথেষ্ট ছিল না যারা যারা সব নবীকে ভণ্ড বলে মনে করতেন। এর উপর আমরা আগেই দেখেছি, আল গাযালি সহিষ্ণু তো ছিলেনই না, বরং তিনি ইসলাম থেকে তাদেরকে নির্বাসিত করেন যারা মহাবিশ্বের চিরন্তনতায় বিশ্বাস করতেন, এবং দেহের পুনরুত্থানে বিশ্বাস করতেন না। এদেরকে তিনি অবিশ্বাসী হিসেবে বিবেচনা করেন এবং এদের মৃত্যুদণ্ড দাবী করেন।  আল গাযালির সংজ্ঞা অনুসারে, ইসলামের মহান দার্শনিক এবং কবিদেরকেও ইসলামের দৃষ্টিতে মৃত্যুদণ্ডের মুখে পতিত করতে হয় এবং সবসময়কার মতই এই অবিশ্বাসীদেরকে কখনই ইসলামের সহিষ্ণুতা বিষয়ক আলোচনায় হিসাবেই আনা হয় না। নাস্তিকতা বা ধর্মদ্রোহীতা ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় পাপ, এমনকি কাউকে হত্যা করার চাইতেও। এবং এর একমাত্র শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। আর ধর্মচরচার ক্ষেত্রে ইবনে তাইমিয়া আর আল গাযালির প্রভাব ছিল তার তথ্য প্রমাণ কী? এক্ষেত্রে এই একই এপোলজিস্ট বা সমর্থনকারীগণ পুনরায় ইসলামের ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও চর্চার মধ্যে পার্থক্যকে নির্দেশ করে। এবং এখানেও তারা এই দুই ধর্মতাত্ত্বিকদের উদ্ধৃতিগুলো দেয় এটা না দেখিয়েই যে আসলেই তাদের তত্ত্বের কোন চর্চা সমাজে ছিল কি না। আসল ঘটনা হল, ইসলামী সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশে আল গাযালির লেখাগুলো সত্যিকারের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তার লেখা বিপজ্জনক ভেবে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।

ইসলাম কি ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও সহিষ্ণু ছিল না? এই প্রশ্নের সরল উত্তর হল, “না”।

গোল্ডজিহেরের পূর্বের আলোচনাগুলোতে বলা হয়েছিল, ইসলামে ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে নির্যাতন করা হয় নি। আমার মনে হয় এই অধ্যায়ে পাঠকদেরকে এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত করা হয়েছে। এমনিলি মহান গোল্ডজিহের স্বীকার করেছেন যে “ইসলামে সহিষ্ণুতা কেবলমাত্র এর প্রাথমিক সময়েই বিদ্যমান ছিল… এরপর অসহিষ্ণুতা ইসলামী সাম্রাজ্যের পূর্ব পশ্চিম দুই অঞ্চলের চলে আসে এবং এর ফলে একটি স্কলাস্টিক এবং গোড়া ধর্মতত্ত্বের সৃষ্টি হয়”। এটার জন্যই সুদিবাদে এই প্রভেদগুলোকে অস্বীকার করা হয় এবং এটি সহিষ্ণুতা প্রচার করতে শুরু করে।

যেহেতু ধর্ম এবং রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য খুব অস্পষ্ট ছিল, বিশেষ করে আব্বাসীয়দের শাসনামলে, প্রত্যেকটি বিপজ্জনক ধর্মীয় নীতিরই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থাকত। রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এরকম বিধ্বংসী কোন ধর্মীয় মতবাদ দেখলেই তাকে জনসাধারণ এবং সমাজের ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে বলে এই মতবাদগুলোর অনুসারীদেরকে নির্যাতন করতেন।

আব্বাসীয়গণ এরকম সকল রকমের উত্তেজনার সৃষ্টিকারীকেই নৃশংসভাবে দমন করেছেন। তারা অনেককে বন্দী করেছেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন বা বিষ দিয়ে হত্যা করেছেন। কিন্তু উমাইয়ারাও যে এরকম নির্যাতন একেবারেই করেন নি এমনটা ভাবা যাবে না। ৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শিয়া ধারার অনুসারী বয়ান আল তামিমিকে আল মুঘিরা বিন সাদ এবং তার কিছু অনুসারীদেরকে আগুনে পোড়ানো হয় যারা তাকে স্বর্গীয় বলে মনে করতেন। এছাড়া অবশ্যই আমরা উমাইয়া শাসনের প্রথম দিকে ইরাকের গভর্নর আল হাজ্জাজ কর্তৃক খারিজিদেরকে নৃশংসভাবে হত্যার কথাও ভুলে যাই নি।

আমরা ইতিমধ্যে আব্বাসীয়দের দ্বারা পরিচালিত দুটি ইনকুইজিশনের কথা উল্লেখ করেছি।  সেগুলো খলিফা মুতাওয়াক্কিল এর ক্ষমতায় আরোহনের পর সমাপ্ত হয় এবং তিনি মুতাজিলা সম্প্রদায়ের সমস্ত ধর্মীয় নীতিকে ভিন্নমত বলে দাবী করে এবং পূর্বের গোড়া ইসলামি ধারায় ফিরে গিয়ে পরিস্থিতিকে বিপরীত করে দেন। যাদেরকে ভিন্নমতের অনুসারী হিসেবে দেখা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে অনেক কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় তখন। নিকলসন বলেন, “ইসলামে স্বাধীন চিন্তার জন্য খুব কম জায়গাই ছিল। জনসাধারণ দর্শন এবং বিজ্ঞানকে নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মদ্রোহীতা বলে মনে করত।  যারা বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ে লিখতেন তাদেরকে জীবন ঝুঁকি নিয়ে বাঁচতে হত যদিনা তারা তাদের আসল মতামত লুকিয়ে তাদের গবেষণাগুলোকে কোরানের আয়াতগুলোর সাথে সংগতিপূর্ণ হিসেবে না দাবী করতেন”।559

এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহেই দেশ, শাসক ও কালভেদে বিভিন্ন ছিল। সাধারণভাবে উমাইয়া শাসকদেরকে আব্বাসীয় শাসকদের থেকে বেশি সহিষ্ণু হিসেবে দেখা যায় কারণ উমাইয়ারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করতেন না।  এই সহিষ্ণুতার জন্য তাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। উমাইয়াদের ইসলামবিদ্বেষী চেতনা দেখা যায় যখন দেখি উমাইয়াদের লরিয়েট এবং চ্যাম্পিয়ন একজন খ্রিস্টান ছিলেন যিনি আসলে একজন প্যাগান কবির বংশধর ছিলেন”560। উমাইয়াদের শাসনামলে আল আখতাল ছিলেন তখনকার তিনজন মহান কবির একজন। তিনিও একজন খ্রিস্টান ছিলেন। আল আখতাল খলিফার উপস্থিতিতে সভায় স্বর্ণের ক্রুশ পরিহিত অবস্থায় আসতেন এবং মদের ধুম্র ছড়াতেন। এমনকি তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু চরণও লিখেছিলেন। হেনরি ল্যামেনস বলেন, এগুলোই উমাইয়াদের মুসলিম হবার চেয়েও আরব বেশি অবার প্রমাণ”561

এই উদাহরণতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে নিয়ে আসল। যতক্ষণ পর্যন্ত একজনের মাথায় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও নিরাপত্তা ছিল ততদিন পর্যন্ত তিনি ঈশ্বরনিন্দা করতে পারেন, ভিন্নমত এবং অবিশ্বাস নিয়ে লেখালেখিও করতে পারতেন। যেমন বারমাকিদস এর একটি পারশিয়ান পরিবার কয়েকটি আব্বাসীয় খলিফার উপদেষ্টা ছিল। তারা কয়েকবার অবিশ্বাসের দায়ে অভিযুক্তও হয়েছিল। অন্ততঃ তারা গোপনে ইসলাম বিদ্বেষী অনুভূতি পোষণ করত। যখন তাদের উপর থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তুলে নেয়া হয়, তখন এই প্রভাবশালী পরিবারটির দুর্দিন নেমে আসে।

ভিন্নমতকে যেহেতু ইসলামে সহ্য করা হত না, তাই কেউ যদি তার কোন প্রতিদ্বন্দীকে সরিয়ে দিতে চাইত তাহলে তাকে ভিন্নমতের দায়ে অভিযুক্ত করত। যেমন আবু উবায়েদ নামে এক ব্যক্তি আব্বাসীয়দের সভায় দ্রুত পদন্নোতি পেয়ে বিখ্যাত হয়ে যান। তার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ কর্মকর্তাগণ আবু উবায়েদের পুত্রের নামে ভিন্নমতের অভিযোগ করেন। তার পুত্রকে খলিফার সামনে ধরে আনা হয় এবং তাকে তার সামনে কোরান পড়তে বলা হয়। কার্যত নিরক্ষর থাকায় সে কয়েকটি বাক্য বলতে গিয়ে হোচট খাচ্ছিল। এটাকে তার মুক্তচিন্তার প্রমাণ হিসেবে নেয়া হয় এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সকল ক্ষেত্রেই ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে আখ্যায়িত হবার ভীতি ছিল। এই ব্যাপারে একটি বিখ্যাত গল্প আছে। একবার দার্শনিক ইবনে রুশদকে আলমোহাদ শাসক আবু ইয়াকুব ইউসুফের দরবারে হাজির করানো হয়েছিল। আবু ইয়াকুব ইউসুফ ইবনে রুশদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন স্বর্গ সম্পর্কে তার মতামত কী।  এটা কি চিরন্তন নাকি এর একটি শুরু আছে? ইবনে রুশদ এই বিপজ্জনক প্রশ্নে এতটাই ভীত ছিলেন যে তিনি কিছুই বলতে পারছিলেন না। ইউসুফ পরিস্থিতি অনেকটা সহজ করে দেন এবং ইবনে রুশদ তার জ্ঞান এর বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ করতে শুরু করেন। সেখানকার পরিস্থিতি যদি ভীতিজনক হত তাহলে ইবনে রুশদ এভাবে আচরণ করতে পারতেন না।

আমরা ইসমাইলিদের ধারাবাহিক নির্যাতনের কথাও উল্লেখ করতে পারি। বলা হয় আল রাই শহরের শাসক আব্বাস এক লক্ষ ইসমাইলিকে হত্যা করেছিলেন। আরেকটি ভিন্নমতাবলম্বী ধারা ছিল খুবমেসিহিস যারা বলত জেসাস মুহম্মদের চেয়েও উপরে। সতের শতকে ইস্তাম্বুলকে কেন্দ্র করে এই সম্প্রদায় বসবাস করত। এই মতাদর্শে বিশ্বাসীদেরকে জেলে বন্দী করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। বলা হয় এই ধারাটি ভিন্নমতাবলম্বী কাবিদ এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দে তাকে হত্যা করা হয়।

আমরা এতক্ষণ খারিজি, শিয়া, ইসমাইলি সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের চিত্র দেখলাম। এদেরকে ধর্মীয় মতবাদের ভিন্নতার কারণে অথবা রাজনৈরিক অস্থিরতা তৈরির সম্ভাবনায় নির্যাতন করা হয়েছিল। বিভিন্ন দার্শনিক, কবি, ধর্মতাত্ত্বিক, বিজ্ঞানী, যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তাকারী এবং রহস্যবাদীদেরকেও জেলে বন্দী করা হয়, অত্যাচার করা হয়, ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, অঙ্গচ্ছেদ করা হয় এবমগ ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তাদের লেখাগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয় যেমন ইবনে রুশদ, আল হাজম, আল গাযালি, আল হাইথাম এবং আল কিন্দির অনেক লেখা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আর আল রাওয়ান্দি, ইবনে ওয়ারাক, ইবনে আল মুকাফফা এবং আল রাজির কোন ভিন্নমতকেন্দ্রিক লেখাই টিকতে পারেনি। অনেককে এক জায়গা থেকে অন্য আরেকজন অধিক সহিষ্ণু শাসকের রাজ্যে পালাতে বাধ্য হতে হয়েছিল (যেমন আল আমিদি)। কেউ কেউ নির্বাসিত হয়েছিলেন (ইবনে রুশদ)। অনেককেই তাদের লেখাগুলোকে কঠিন অথবা দ্ব্যর্থক ভাষায় প্রকাশ করে তাদের সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারাই কেবল ঈশ্বরনিন্দা করে পাড় পেতে সক্ষম হয়েছিলেন যারা কোন প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশালী মহল রক্ষা করত।

আল মা’আরি

আবুল আলা আহমেদ বিন আবদুল্লাহ আল মা’আরি (৯৭৩-১০৫৭ খ্রিষ্টাব্দ)562 প্রাচ্যের লুক্রেটিয়াস নামে পরিচিত। তিনি ইসলামের মহান জিন্দিকদের মধ্যে তৃতীয়জন। তার কবিতায় কোন সত্যিকারের মুসলিমই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন না কারণ তার কবিতায় পজটিভ ধর্মগুলোর প্রতি বিশেষ করে ইসলামের প্রতি সন্দেহবাদিতা প্রকাশ পায়।

তিনি সিরিয়ায় আলেপ্পোর অদূরে এক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। আল মা’আরি বাল্যকালে বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়েছিল যা তাকে সম্পূর্ণভাবে অন্ধ করে দেয়। তিনি আলেপ্পো, এন্টিয়ক এবং অন্যান্য সিরিয়ার শহরে পড়াশুনা করেন। আর এরপর তিনি তার নিজের শহর মারায় ফিরে আসেন। যখন তিনি একজন কবি হিসেবে নাম করতে শুরু করেন তখন তিনি বাগদাদ নগরীর সমৃদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট হন। ১০০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাগদাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু সেখানে মাত্র আঠার মাস ছিলেন। বাড়িতে ফিরে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পঞ্চাশটি বছর অর্ধ-অবসর জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু তার খ্যাতি এত বেশি ছিল যে আগ্রহী শিষ্যরা কবিতা ও ব্যকরণ বিষয়ে তার লেকচার শুনতে মারায় চলে আসত।

তার কবিতায় গভীরভাবে নৈরাশ্যবাদের উপস্থিতি পাওয়া যেত। তিনি বারবার মৃত্যুকে একটি কামনার বস্তু এবং প্রজননকে পাপ বলে উল্লেখ করতেন। একসময় তিনি দেহের পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেন। তিনি লিখেছেন,

১.

আমরা হাসি, কিন্তু আমাদের হাসি অদক্ষ;

আমাদের কাঁদা এবং ক্ষত মুছে ফেলা উচিৎ,

যিনি কাঁচের মত ভেঙ্গে যান,

পরে তাকে আর জোড়া লাগানো যায় না।

 

তিনি এই চরণটি তার কবরে ক্ষোদাই করে দিতে বলেছিলেন বলে শোনা যায়:

২.

এই ভূল কাজটি করেছিলেন আমার পিতা আমার প্রতি করেছিলেন

কিন্তু কারও প্রতি আমি কখনও এই কাজটি করি নি।

তিনি এখানে আসলে বলতে চেয়েছেন, জন্মানোর চেয়ে না জন্মানোই ভাল ছিল।

৩.

আদম এর থেকে যদি তার বংশধরগণ না আসত,

যদি পৃথিবীতে কেউই না জন্মাত তাহলেই বরং ভাল ছিল।

পৃথিবীতে মানুষের এতরকমের দুঃখ দুর্দশা দেখে

সকল ধুলিসাৎ মৃতদেহ ও অস্থিগুলো তাদের সন্তানদের কষ্ট দেখে

কিছু কি টের পায় না?

 

ধর্মের ক্ষেত্রে প্রত্যেকে স্বভাবতই তাদের বাবার মতবাদটিকেই গ্রহণ করে আর সেসময় তারা সেই ধর্মীয় মতবাদটি সত্য নাকি মিথ্যা সেটা চিন্তা করে না। আল মা’আরি বলেন,

৪.

কখনও কখনও আপনি একজন লোককে পেতে পারেন যিনি তার কাজে দক্ষ, পাণ্ডিত্য প্রচুর এবং যুক্তিতেও পারদির্শী। কিন্তু ধর্মের কথা যেই আসে সেই তিনি একগুঁয়ে হয়ে যান এবং তার সেই পুরনো বিশ্বাস করা ধর্মটিকেই সমর্থন করেন। ধর্মানুরাগ মানুষের স্বভাবগত, এটাকেই মানবজীবনের একমাত্র আশ্রয় বলে মনে হয়। একটি বর্ধিষ্ণু শিশু তার গুরুজনদের কাছ থেকে নেয়া ধর্মীয় শিক্ষাগুলোকেই তার সারাটি জীবন ধরে মেনে চলে।  মঠের ভিক্ষুগণ এবং মসজিদে থাকা ভক্তগণ সকলেই সেইসব গল্পই অন্যদের শোনান যেগুলো তাদেরকে শোনানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে তারা সেই গল্প সত্য নাকি মিথ্যা এবিষয়ে কিছুই চিন্তা করে না। যদি কারও আত্মীয় সজন ম্যাজিয়ান হয় তাহলে তিনিও ম্যাজিয়ান হবেন, আবার যদি তারই সেই আত্মীয় সজন ম্যাজিয়ান না হয়ে স্যাবিয়ান হত তবে তিনিও একজন স্যাবিয়ানই হতেন।

আল মা’আরির কাছে ধর্ম ছিল কেবলই প্রাচীনদের তৈরি উপকথা। এটা নিতান্তই অর্থহীন একটি বস্তু। এর অর্থ কেবল তাদের কাছেই আছে যারা বিশ্বাসপ্রবণ জনসাধারকে ব্যবহার করতে চান।

৫.

মানুষের মাঝে যত রকমের ধর্মবিশ্বাস, আচার আছে

এদের মধ্যে একটি প্রভাবশালী হয়।

যতক্ষণ না পর্যন্ত আরেকটি প্রভাবশালী বিশ্বাস না আসে,

ততক্ষণ এটাই চলতে থাকে।

এই পৃথিবী সবসময় নতুন নতুন কল্পকাহিনী পছন্দ করে।

 

কখনও কখনও তিনি ধর্মকে “ক্ষতিকর আগাছা” বলেছেন।

৬.

ধর্মবিশ্বাসের টুকরো টুকরো দ্বংসাবশেষের মাঝ দিয়ে

এক উট সওয়ারী বাঁশি বাজাতে বাজাতে যায়।

আর সে তার সাথীদের বলে, দেখো

সমস্তভূমি ক্ষতিকর আগাছায় ভরে গেছে।

 

আল মা’আরি ইসলামকে অন্যান্য ধর্মমতের মতই দেখতেন এবং এর কোনকিছুতেই তিনি বিশ্বাস করতেন না।

৭.

হানিফরা (মুসলিম) হোঁচট খায়, খ্রিস্টানরা গেছে বিপথে,

ইহুদিরা হিংস্র, ম্যাজিয়ানরা ভূল পথে অনেক দূরে চলে গেছে।

আমরা মরণশীলেরা দুটি ভাগে বিভক্ত,

জ্ঞানদীপ্ত প্রতারক এবং ধর্মীয় বোকা।

৮.

ধর্ম কী? ধর্ম একটি পর্দানশীল নারী

যিনি নিজেকে সবসময় অন্যদের চোখ থেকে আড়াল করে রাখেন।

তার বিবাহের উপহার এর মূল্য এবং মোহরানাআর অংক শুনে

পাণিপ্রার্থীগণ হতবাক হয়ে যান।

যাজকদের কাছ থেকে আমি অনেক ভাল ভাল ধর্মীয় নীতি শুনেছি।

কিন্তু এদের একটি শব্দও আমার হৃদয় গ্রহণ করতে পারে নি।

৯.

মুসলিম বীরগণ কত যুদ্ধ করল,

খ্রিস্টান সন্নাসী, ইহুদি ও স্যাবিয়ানরা কত ধর্মচর্চা করল।

তাদের কোন ধর্মীয় নীতিই ভারতীয়দের আচারে প্রভাব ফেলেনি,

যারা ধর্মীয় কারণে মৃত্যুর পর দেহকে জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপ করে।

তবুও মানুষের মৃত্যু একটি দীর্ঘ নিদ্রা আর জীবন হল জাগরণ।

মৃতের উদ্দেশ্যে বৃথাই প্রার্থনা করা, বৃথাই বিদায় জানানো।

একবার যে এই নিদ্রায় যাবে, আর কোন দিন সে উঠবে না।

আমি কি এই ধরণী মা এর বুকে নিদ্রায় যাওয়ার জন্য ভয় করব?

ধরণীর মায়ের বুক কতই না কোমল।

যখন আমার এই ধর্মহীন আত্মা আমার দেহ থেকে বিদায় নেবে,

নোংরা বৃষ্টিতে আমার হাড়ে পচন ধরবে!

এই ৯ নং কবিতায় আল মা’আরি ভারতীয়দেরকে মুসলিমদের থেকে বেশি প্রশংসা করেছেন। তিনি ভারতীয়দের মৃতদেহ পোড়াবার রীতির প্রশংসা করেন। কিন্তু এরপরও তিনি বলেন, মৃত্যু এত ভয়ানক কিছু নয়, এটা কেবলই ঘুমিয়ে পড়ার মত ব্যাপার। তার ‘লুজুমিইয়াত’ নামক কবিতা সংকলনে তিনি পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের কবর দেয়ার রীতির চেয়ে মৃতদেহ পোড়ানোর নীতিকে পছন্দ করার কথা বলেন। ইসলাম অনুসারে, শেষ বিচারের দিন মুনকের ও নাকির নামে দুজন দেবদ্যুত কবর খুড়ে নিষ্ঠুরভাবে মৃতের বিশ্বাস সম্পর্কে জেরা করবেন। যাদের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব থাকবে তাদেরকে ঠেলে আবার কবরেই ফিরিয়ে দেয়া হবে। তাই আল মা’আরি যে মৃতদেহের অগ্নিসৎকারকেই পছন্দ করবেন এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর অবশ্যই মুসলিমরা এই অগ্নিসৎকারের ধারণাকে অনেক ঘৃণা করে। আল মা’আরি লেখেন,

১০.

আমি ভারতের মৃতের মতই অগ্নিদগ্ধ হতে ভয় পাই না,

ভয়ংকর এবং উগ্র দেবদ্যুত মুনকের নাকিরের চেয়েও

অগ্নির দাঁত এবং জিভ কোমল।

মারগুলিথ আল মা’আরির কবিতা থেকে নিচের কিছু লেখাগুলো সংগ্রহ করেছেন,563

১১.

নবীদের কথাগুলোকে সত্য বলে ধরে নিও না। সেগুলোর সবকিছুই বানোয়াট। তারা এসে মানুষের জীবন নষ্ট করার আগে মানুষ অনেক শান্তিতেই বাস করত। ধর্মগ্রন্থগুলোর সবকটিই কিছু কল্পকাহিনীর সংকলন তার বয়স যতই হোক না কেন আর এগুলো তৈরি করা রচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যেখানে ঈশ্বরের উচিৎ ছিল কারও জীবন নিয়ে নেয়াকে নিষিদ্ধ করা সেখানে তিনি প্রত্যেক মানুষের জীবন নেবার জন্য দুজন করে দেবদ্যুতকে পাঠান, আবার পরবর্তীতে দেহ ধারণের করার সুযোগ দেয়া হবে বলে কথাও দেন। কথা দেয়া হয় যে আত্মা তার দুই অবস্থানেই অনেক ভালভাবেই দিন কাটাবে।

আল মা’আরির নবীদের নিয়ে অন্যান্য কবিতায় দেখা যায় তিনি নবীদেরকে মিথ্যেবাদী যাজকের চেয়ে ভাল কিছু বলে বিবেচনা করতেন না।

১২.

নবীরাও আমাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে আসা যাজকদের মত।

তারা প্রার্থনা করে, হত্যা করে এবং এক সময় চলে যায়।

কিন্তু এখনও আমাদের মনের খারাপ দিকগুলো

সমুদ্র সৈকতের নুড়ি-পাথরের মতই আছে।

 

ইসলামে সত্যের একচেটিয়া আধিপত্য নেই:

১৩.

মুহম্মদই হও আর মেসিয়াই হও, আমার কথা শোন

পূর্ণ সত্য কিছুই নয়, তা যাই হোক না কেন।

সকলের ত্বরে চন্দ্রসূর্য সৃজিয়া অন্তর্জামি

আলোক দিলেন একজনকে! ভাবিয়া পাইনা আমি।

 

মুসলিম যাজকদের জন্য আল মা’আরির নিকট নিন্দা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

১৪.

আমি ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি,

মানুষের আত্মায় কোন বুদ্ধিমত্তা নেই।

মানুষের আত্মা একটি মথের আত্মার মতই।

তারা ঈশ্বরের কথা বলে,

কিন্তু ঈশ্বর একজন মিথ্যাবাদী ও কলহপ্রিয় ব্যক্তি ছাড়া কিছুই না।

আর তার শব্দগুলোও ক্ষতের সৃষ্টি করে।

 

১৫.

যাজকগণ নিজে দেহের পুনরুত্থানে বিশ্বাস না করলেও

শ্রোতাদেরকে শেষ বিচারের দিনের কথা বার বার স্মরণ করিয়ে

ভয় দেখান।

১৬.

তারা তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে,

কিন্তু এগুলো শুনে আমি বুঝি যে এসব ধর্মগ্রন্থের

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কল্প কাহিনী।

হে যুক্তি, কেবল তুমিই সদা সত্য কথা দেখাও।

তাহলে কেন তুমি সেই সব বোকাদের ধ্বংস কর না

যারা এই ধর্মীয় রীতিনীতি তৈরি করে ও সেগুলোকে ব্যাখ্যা করে!

 

আল মা’আরি একজন চূড়ান্ত পর্যায়ের যুক্তিবাদী ছিলেন। তিনি সবসময় ধর্মীয় রীতিনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তির কথা বলতেন।

১৭.

সদা যুক্তির পথে চলো,

তাহলে সব সময় সঠিক পথে থাকবে

নিজে ছাড়া কাউকে আশা দেখাতে দিও না

আর সর্বশক্তিমান যে আলোকবর্তিকা দিয়েছে্ন

সেটাকে নিভতে দিও না

সেই আলোকবর্তিকা হল জ্ঞানের আলোর অলোকবর্তিকা

যা তিনি সকলকে দিয়েছেন

এই আলোকবর্তিকা ব্যবহারের জন্য এবং আনন্দের জন্য।

আমি দেখেছি মানব জাতি অজ্ঞতায় হারিয়ে গেছে।

এমনকি পরিণত বয়সেও তারা মোরা (বাচ্চাদের একটি খেলা) খেলছে।

 

১৮.

ঐতিহ্য, রীতিনীতি অতীত থেকে আসে।

সেগুলো যদি সত্য হয় তবে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু সেগুলোই দুর্বল হয় যেগুলো তাদের সত্যতা জাহির করে

এবং সত্যতার নিশ্চয়তা আছে বলে দাবী করে।

অন্যদের কথায় না গিয়ে সর্বদা যুক্তি দিয়ে বিচার কর

যুক্তিই সর্বোত্তম উপদেষ্টা এবং পথপ্রদর্শক।

 

সম্পূর্ণ বিশ্বাসপ্রবণতার চেয়ে সামান্য সন্দেহও ভাল:

১৯.

যাকে আমি বিশ্বাস করি তাকে ভয় পেয়ে

আমি সত্য খুঁজে পাই।

পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্বাস স্থাপন করে আমি

জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাসের সাথে ছলনা করি।

এর চেয়ে সন্দেহ অনেক ভাল

যা দিনের আলোয় মিথ্যাকে তুলে ধরে।

( ১৯ নং এর সাথে টেনিসনের এই উক্তিটির মিল আছে, “বিশ্বাস করুন, সন্দেহের মাঝে ধর্মবিশ্বাসের চেয়েও বেশি সত্য থাকে” )

আল মা’আরি ইসলামের অনেক ধর্মীয় বিশ্বাসেই আঘাত হানেন বিশেষ করে হজ্জ্বযাত্রার প্রতি। হজ্জ্বযাত্রাকে তিনি “ধর্মহীন ভ্রমণ” উল্লেখ করতেন। “ইসলাম এবং পজিটিভ ধর্মগুলোকে তিনি মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতেন। তিনি বলতেন এগুলো গোড়া থেকে মিথ্যা এবং পচে যাওয়া। এই ধর্মপ্রবর্তকগণ ধর্মগুলো প্রবর্তন করেন অর্থ এবং ক্ষমতালাভের জন্য। ধার্মিকগণ ধর্মকে রক্ষা করার জন্য কৃত্রিম প্রমাণাদি খুঁজে বেড়ান যাতে ধর্মের স্বর্গীয়তা প্রমাণ করা যায়। আর ধর্মের অনুসারীগণ তাই বিশ্বাস করেন যা তাদের বলা হয়”564

২০.

ওরে বোকারা, জেগে ওঠো।

তোমরা যেসব রীতিনীতিকে পবিত্র বলে মনে কর

সেগুলো কয়েকজন মানুষের প্রতারণার ফল ছাড়া

আর কিছুই নয়।

এসকল প্রতারকগণ অর্থের পেছনে ছুটেছেন

এবং নীচতায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

তাদের আইন ধূলি ছাড়া আর কিছুই নয়।

২১.

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর এবং তার প্রশংসা কর,

মন্দিরের চারদিকে সাতবার নয়, সত্তরবার হাঁটো।

কিন্তু তারপরও ধর্মহীনতা থেকেই যাবে।

সত্যিকারের ভক্ত সেই, যে তার সকল ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষাকে বর্জন করে।

যার মধ্যে সকুল কিছু থেকে বিরত থাকার সাহস আছে।

২২.

ভাগ্য খুব অদ্ভূতভাবে ঠিক করা হয়।

হজ্জ্বযাত্রায় যে পাথরকে হাত ও ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করা হয়,

জেরুজালেমের পবিত্র পাথর বা কুরাইশদের দুই দেবদ্যুতের মত,

সেই পাথরগুলোকে এক সময় পা দিয়ে লাথি দেয়া হত।

 

আল মা’আরি এখানে মক্কার কাবার দুটো কোণাকে নির্দেশ করছেন যেগুলোর একটিতে কালো পাথর স্থাপিত হয়েছে আর একটিতে ইসমাইলের কবর চিহ্নিত করার জন্য পাথর রাখা হয়েছে।

 

২৩.

খ্রিস্টানরা বলে, কুরাশ এবং তার লোকেরা এত অদ্ভূত ছিল

যে তারা গাভীর মুত্র দিয়ে মুখমণ্ডল পরিষ্কার করত।

সেখানে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে নির্যাতন করা হত,

উপহাস করা হত, এবং পরিশেষে ক্রুশবিদ্ধ করা হত।

আর ইহুদিরা ঈশ্বরিকে এমনভাবে কল্পনা করত

যেন ঈশ্বর ঝলসানো মেরুদণ্ডের ঘ্রাণ পছন্দ করেন।

আর অবাক বিষয় হল মুসলিমরা একটি কালো পাথরকে

স্বর্গীয় ভেবে চুম্বন করতে দূর দূরান্ত থেকে আসে।

হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, মানবজাতির সকলেই কী

সত্যের সবচেয়ে পবিত্র আসন থেকে সরে গিয়ে

অন্ধের মত ভুল পথে চলবে?

 

২৪.

ধর্ম যুক্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর যেহেতু এটা যুক্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় নি তাই তা শিয়া ও সুন্নির মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব মেটাতে পারছে না। অনেকে আছে যারা কালো পাথরটিকে মূর্তিপূজার একটি অবশিষ্ট ধারা বলে মনে করেন।

 

২৪ নং এ আল মা’আরি একজন সমালোচকের মতামত তুলে ধরেছেন। আর এভাবে তিনি নিজেকে ভিন্নমতের অভিযোগ নিজেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু আমরা ২২ ও ২৩ নং থেকে জানি তিনি হজ্জ্ব এর কালো পাথরকে চুম্বন করা শুরু করে বেশিরভাগ রীতিকে অর্থহীন কুসংস্কার বলে বিবেচনা করতেন এবং সেগুলো পছন্দ করতেন না।

ধর্ম কেবল ধর্মান্ধতা এবং রক্তপাত এর জন্ম দেয়। এখানে ধর্মের একটি উপসম্প্রদায় আরেকটি উপসম্প্রদায়ের সাথে মারামারি করে এবং গোড়ারা তরবারি দেখিয়ে অন্যদেরকে সেই মতে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। প্রত্যেক ধর্মই যুক্তি এবং মানসিক সুস্থতার বিরুদ্ধে। আল মা’আরি লেখেন,

২৫.

যদি একজন মানুষ বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সুবিচার করতে চান,

তবে তিনি এই বিচারে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসকে ক্ষনও বিবেচনা করবেন না।

যে যুক্তি (তোমাকে) দেয়া হয়েছে সেই যুক্তিকে তোমরা গ্রহণ কর,

যুক্তির জলাশয়ে কখনো অজ্ঞতাকে নিমজ্জিত করো না।

 

২৬.

যদি তাদের মধ্যে কেবল যুক্তিই অবশিষ্ট থাকত,

তবে তারা একটি মিথ্যাকে কখনোই গ্রহণ করত না।

কিন্তু চাবুক (তাদেকে আঘাতের জন্য) উত্তলিত হয়েছিল।

“আমরা সত্য জানি” বলে এরা তাদেরকাছে ধর্মটি নিয়ে আসে,

যদি কেউ তা স্বীকার করতে অস্বীকার করে

তবে তরবারি (তাদের রক্ত দ্বারা) রক্তপিপাসা মেটায়।

তারা বিপদের সম্ভাবনা দেখে ভীত হয়,

আর খাদ্য ও বদান্যতা পূর্ণ আধার দেখে প্রলুব্ধ হয়।

২৭.

মিথ্যা এই বিশ্বকে এতটাই দূষিত করে ফেলেছে,

দুটি ভিন্ন উপধারারর মানুষ একে অপরের বন্ধু হতে পারে না।

কিন্তু যদি তারা মানুষকে ও মানুষের প্রকৃতিকে ঘৃণা না করত,

তবে মসজিদ ও গীর্জা একে অপরের পাশে দাঁড়াত।

 

স্থানাভাবের কারণে আল মা’আরির আরও বিভিন্ন কুসংস্কার নিয়ে লেখা দেয়া যাচ্ছে না। এই কুসংস্কারগুলোর মধ্যে আছে জ্যোতিষশাস্ত্র, শুভ ও অশুভ চিহ্নে বিশ্বাস ও তার উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বাণী (অগুরি); “ঈশ্বর তুষ্ট হবেন” এধরণের দাবীর রীতি; মিথ বা পুরাকথা যেমন পূর্বে মানুষ কয়েকশো বছর বাঁচত, পবিত্র মানুষেরা জলের উপর হাঁটতে পারে এবং অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন ইত্যাদি।

আল মা’আরি কোরানের প্যারোডি লিখে মুসলিমদের সংবেদনশীলতাকে আরও আঘাত করেছিলেন। এটার লেখার মান অনেক খারাপ ছিল। আমার মতে লেখাটির মান খারাপ হবার কারণ হল এটি পরবর্তী চার শতক ধরে পাঠকদের দ্বারা পলিশ করা হয় নি। আল মা’আরি তার ভুলগুলো তার একটি লেখার দ্বারা গোড়াদের কাছে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে তিনি এমনভাবে ভুলগুলো তুলে ধরেন যেখানে বোঝানো হয় যে তার এই কাজগুলো যথেষ্ট ছিল না। তার এই কাজটির নাম, “এপিস্টল অব ফরগিভনেস”। নিকলসন বিংশ শতকের শুরুর দিকে তার এই রচনাটি প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তিনি এর বিষয় সম্পর্কে প্রশংসা করে বলেছেন, “এখানে বিশ্বাসী মুসলিমদের স্বর্গ ধর্মহীন কবিদের একটি মহিমান্বিত ভাড়া করা বৈঠকখানায় পরিণত হয়েছে যেসব কবিদের ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এধরণের চিন্তা একটি অসাধারণ উদ্ভাবনীর পরিচয় দেয় এবং এউ উদ্ধত প্যারোডি আমাদেরকে লুসিয়ান এর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কবিদেরকে শায়েখ আলি বিন মনসুরের (যাকে উদ্দেশ্য করে এটা লেখা হয়েছে) সাথে অনেকগুলো কাল্পনিক কথোপকথনে দেখা যায় যেখানে তারা তাদের কবিতাগুলোর ব্যাখ্যা করছিলেন, একে অপরের সাথে তর্ক করছিলেন এবং সাধারণভাবে ভবঘুড়ে সাহিত্যিকের মত আচরণ করছিলেন565”।

আল মা’আরির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ছিল, কোন জীবিত প্রাণীকে কোনভাবে আহত করা যাবে না বা ক্ষতি করা যাবে না। খাদ্য এবং ক্রীড়ার কারণে প্রাণীহত্যা করা হত। প্রাণীহত্যার প্রতি ঘৃণার কারণে তিনি ত্রিশ বছর বয়সে নিরামিষভোজী হয়ে যান। ফন ক্রেমার বলেন, আল মা’আরি ভারতের জৈনদের মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। জৈনমতে সকল জীবিত প্রাণীই পবিত্র। আল মা’আরি তার কবিতায় কঠোরভাবে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম এবং মধু থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। কারণ তার মতে এসব খেলে প্রাণীদের প্রতি অন্যায় করা হয়। প্রাণীরা ব্যাথা বুঝতে পারে, এবং এই সৃষ্টিগুলোকে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি করা অনৈতিক। এছাড়াও আল মা’আরি পোশাকের জন্য প্রাণীদের চামড়া ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি কাঠের জুতা পড়তে বলতেন এবং নারীদের পশমের পোশাক এর প্রতি নিন্দা জানাতেন। ফন ক্রেমার ঠিকই বলেছেন। তার কথায়, আল মা’আরি তার নিজের সময়েরও কয়েক শতক এগিয়ে ছিলেন।

আল মা’আরি ভিন্নমতের কারণে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিচার হয় নি বা শাস্তিও ভোগ করতে হয় নি। ফন ক্রেমার এবং নিকলসন তার শাস্তি না হবার কারণ সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করেছেন। আল মা’আরি প্রায়ই বলতেন কখনও কখনও কপটতা করা ভাল। আর সেকারণেই তিনি তার কবিতায় কিছু মূল ধারার ইসলামের গোড়ামির উপাদান ঢুকিয়ে দিতেন যা দিয়ে তিনি তার লেখা থেকে ভিন্নমতের গন্ধ বাতিল করে দিতেন। কিন্তু অন্তর থেকে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সন্দেহবাদী যিনি কার্যতই ইসলামের প্রতিটি ধর্মীয় নীতিকে উপহাস করেছেন। আল মা’আরি দীর্ঘজীবী হোন!

6 Comments

  1. ইবনে ওরাকের এসব কথা মডার্ন ইন্টালেকচুয়াল হিস্ট্রিতে খণ্ডিত।লল।

  2. ওরাকের এই পুরো লেখা যাস্ট ওরিয়েন্টালিস্ট স্কলারদের উপর বেইস করে।ওরিয়েন্টালিস্টরা ইসলামের ইন্টালেকচুয়াল হিস্ট্রি নিয়ে অনেক ভিত্তিহীন হাস্যকর কথা বলে।

    এজন্য আগে ওরিয়েন্টালিস্ম নিয়ে ধারণা রাখা উচিত।বায়াসড ন্যারেটিভগুলো এরাই ক্রিয়েট করে। সবচেয়ে বড় কথা হলো ইসলামের ইন্টালেকচুয়াল হিস্ট্রি কে ইসলামের বিরুদ্ধে এটাকের সময় যেসব ওরিয়েন্টালিস্ট স্কলারদের উদাহরণ টানা হয়,আসলে এদের বর্তমানে বেইল আছে কোন? এগুলো বিবেচনায় আনে ইসলাম-বিরোধীরা?
    ১৮ ও ১৯ শতকের সব স্কলার আর ২০ শতকের অনেক স্কলারই সাধারণত প্রেসেন্ট ওয়েস্টার্ন একাডেমিয়ায় একদম রিজেক্টেড – Majid Daneshgar.“ Lost Orientslism,Lost Orient,and Lost Orientals: An Overview ” In Majid Daneshgar and Aaron W. Hughes (edt.), Deconstructing Islamic Studies (Cambridge, Mass: ILEX and Harvard University Press, 2020). 338-357.

  3. সো যেহেতু তারা রিজেক্টেড একাডেমিয়ায়,সেহেতু ইবনে ওরাকের ওইসব ওরিয়েন্টালিস্টদের বেইস ধরে লেখাটাও রিজেক্টেড।পুরা খণ্ডিত হয়ে যায় ইবনে ওরাকের লেখা এভাবে। ওরিয়েন্টালিস্মের সাথে ইসলাম-বিদ্বেষীতার সম্পর্ক বোঝা দরকার এসব ডিসকোর্সের সময়– https://arifishtiyaq12.medium.com/islamophobia-and-orientalism-a0c265fc6f28

  4. ইসলামী বিশ্ব কোন কালেই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা প্রতিকূল ছিল না।বরং অনুকুল ছিল।ওরাকের মত ইসলাম-বিদ্বেষীরা সবসময় মুসলিম,ইসলামকে সবকিছু থেকে ডিসক্রেডিট করা চেষ্টা করে।বিজ্ঞানীরা ধর্মপ্রাণ ও ধর্ম থেকে অনুপ্রাণিত ছিলেন –https://medium.com/kn-owinfluence-of-islam-on-science-87aef3da897a

    ইতিহাসবিদ Ronald L. Numbers এর সম্পাদনা করা Harvard University Press থেকে পাবলিশ “Galileo Goes To Jail And Other Myths About Science And Religion” বইটিতে বিজ্ঞান ও ধর্মের ইতিহাসের ২৫ টি মিথকে হিস্ট্রিক্যালী বিশ্লেষণ করা হয়েছে।যার মাঝে একটা ডিভেস্টেটিং মিথ হলো ‘মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞান চর্চার জন্য আনহসপিটেবল ছিল ’– Syed Nomanul Haq,“ That Medieval Islamic Culture Was Inhospitable to Science” in Galileo Goes to Jail and Other Myths about Science and Religion, ed. Ronald L. Numbers (Harvard University Press,2009) 35-42.

  5. সবচেয়ে লেখার যে বিষয়টা অসহ্যকর আর ধোঁকাবাজি পূর্ণ লেগেছে তা হলো গাযালি ও তাইমিয়া রহ. কে দর্শনবিরোধী গোঁড়া হিসেবে উপস্থাপন!!

    মডার্ন স্কলাররা যারা কিনা গাযালিকে নিয়ে কাজ করেছেন তারা আরও বরং মনে করেন গাযালি রহ. এর কারণে লেটার পিরিয়ডে মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞান-দর্শনের-কালামের অগ্রগতি হয়।মুসলিমরা গ্রীকদের ব্লাইন্ড ফলো থেকে বের হয়ে দারুণ দারুণ কাজ করে।এসব কথা এখন কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই না।
    গাযালি দর্শন-লজিক সায়েন্সের বিরোধী তো ছিলেন ই না বরং এগুলোতে বিরাট কাজ করেছেন।কিছু কন্টেম্পোরারি রিসার্চ পেপার দেখা যায়:

    আরমান ফিরমান,ইমাম গাযালি,দর্শন ও মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানের পতন-https://www.minbarbd.com/article/879

    Asadullah Ali Al-Andalusi,“The Structure of Scientific Productivity in Islamic Civilization:Orientalists’ Fables”– https://yaqeeninstitute.org/amp/read/paper/the-structure-of-scientific-productivity-in-islamic-civilization-orientalists-fables

    Shoaib Malik, “Al-Ghazālī” in The Cambridge History of Atheism,ed. Michael Ruse, (Cambridge University Press,2021) 291-307–https://shrt.cx/RKenvM

    Sobhi Rayan,“Causality and Reliance (Tawakkul) in Ghazali’s Epistemological System” Journal of Islamic Studies and Culture (June,2018)–http://jiscnet.com vol-6-no-1-june-2018-abstract-6-jisc

  6. ইসলামী থিওলোজি নিয়ে বলে লেখা শেষ করবো।ইসলামিক থিওলোজির সাথে লজিক,সায়েন্সের কোন বিরোধ কোন কালে ছিলো না।মুসলিম বিশ্বে যেসব চিন্তকদের সো কল্ড মুক্তচিন্তার জন্য সাজা দেওয়া হয়েছিল সেসবের পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল।অবশ্যই কাওকে দর্শন,বিজ্ঞান চর্চার জন্য নির্যাতন,সাজা দেওয়া হয় নি।সাজা দেওয়ার পেছনে থিওলোজিক্যাল কারণ + রাজনৈতিক কারণও ছিল।

    যাইহোক, ইসলামী বিশ্বে কাওকে সায়েন্স-দর্শন চর্চার জন্য নির্যাতন করা হয়নি,ইসলামিক থিওলোজি বিজ্ঞান চর্চার অনেক বড় অনুপ্রেরণা ছিল।ইসলামের ইন্টালেকচুয়াল ট্র‍্যাডিশনে লজিক-দর্শন সবসময়ে প্রায়োরিটি পেত – Arnold Yasin Mol,Jeroen Vlug.
    “ Fake News is Nothing New: Misinformation and Islamic Critical Epistemology”– https://yaqeeninstitute.org/amp/read/paper/fake-news-is-nothing-new-misinformation-and-islamic-critical-epistemology
    এবং ইসলামী থিওলোজি সম্পর্কে বেসিক জানতে – Oxford University Press থেকে প্রকাশিত Sabine Schmidtke সম্পাদিত The Oxford Handbook of Islamic Theology (1st edition, May 24, 2016) বইটি পড়া আবশ্যক।বইটিতে ইসলামের ইন্টালেকচুয়াল ফিল্ডের সব সেরা স্কলাররা কন্ট্রিবিউট করেছেন।সব মডার্ন রিসার্চের আদতেই লেখা।

    তো এতসব মডার্ন রিসার্চ,স্পেশালিস্টদের এনালাইসিস বাদ দিয়ে সুমিত রায়দের মত মানুষেরা কেন যেন ইবনে ওরাকের মতই আনস্পেশালিস্ট ইসলাম-বিদ্বেষীদের লেখা অনুবাদ করে! সেটার মূলে ইসলাম-বিদ্বেষ,ইসলামকে ডিসক্রেডিট করার চেষ্টা এটা বুঝতে আর কিছু বাকি থাকার কথা না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.