কিউবিজম ও অর্ফিজম

কিউবিজম

কিউবিজমের জন্ম

কিউবিজম শুধু বিশ শতকের নয়, শিল্প ইতিহাসের সমগ্রতায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পধারা, যা শিল্পের চরিত্র প্রায় আমূল বদলে দেয়। সব শিল্পধারার মতো কিউবিজমেরও অতীতের কাছে সামান্য হলেও ঋণ ছিল, ধারণা সৃষ্টিতে ও তত্ত্ব নিরূপণে। পূর্বতন যে শিল্পকর্মের কাছে কিউবিজম বিশেষভাবে ঋণী সেটি একজনের বা কোনো গোষ্ঠীর সৃষ্টি নয়, পোস্ট-ইমপ্রেসনিস্ট শিল্পী হিসেবে পরিচিত পল সেজাঁর। সেজাঁ যখন রেনেসাঁ-পরবর্তী শিল্পে, বিশেষ করে ইমপ্রেসনিস্টদের চিত্রকলায় বাস্তব বা ফর্ম প্রায় গৌণ হয়ে যাওয়ার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে স্পেসে স্ট্রাকচার বা গঠন পদ্ধতির পুনরুদ্ধার করলেন তা থেকেই কিউবিজমের যাত্রা শুরু, এ কথা হার্বাট রিড থেকে আরো অনেকেই বলেছেন। সেজাঁর এই প্রয়াসকে এবং এই ক্ষেত্রে অর্জিত সফলতাকে রিড বলেছেন, “রিয়েলাইজেশন অব মোটিফ’ অর্থাৎ চিত্র বিষয়ের আপন সত্তার পুনরুজ্জীবন। কিন্তু কিউবিজমের আবির্ভাবে তার উৎস সন্ধানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কেন ইমপ্রেসনিস্ট (রঙের ব্যবহারে), পোস্ট-ইমপ্রেসনিস্ট (ভ্যান গগের উদ্বেলিত অস্থির মানসের প্রকাশ এবং গগাঁর আদিমতার দিকে ঝোঁক) শিল্পীদের কাজ, সিম্বলিস্ট শিল্পীদের মনোজাগতিক চিন্তা ও অনুভবকে প্রতীকের সাহায্যে প্রতিফলন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তিবাদীদের মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনার ভিত্তিতে মানসলোকের অনুভব ও আবেগের প্রকাশময়তার প্রভাব থেকে সরে এসে কিউবিজমের মতো একান্তই বুদ্ধিবৃত্তিক (যদিও পিকাসো তা মনে করেননি) শিল্পধারার সূচনা করা হলো? আগের শিল্পধারাগুলো মূলত অনুকরণভিত্তিক সৃজনশীল পদ্ধতির যদিও তাদের বাস্তবায়নে বুদ্ধিবৃত্তিকতার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিউবিজমের সমস্ত প্রক্রিয়াতেই, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগ ছিল প্রধান। কল্পনা ও আবেগের যে ভূমিকা এই শিল্পে তা ইনসিডেন্টাল এবং মার্জিনাল, অন্যান্য নন-রিপ্রেজেন্টেশনাল ছবির ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে। এমন বিপরীতমুখী ধারার দিকে কিউবিজমের যাত্রার কারণ কি হতে পারে? এখানে দুটি উত্তর দেওয়া যায়। প্রথমত, শিল্পীদের মধ্যে প্রচলিত পদ্ধতি ও শৈলীর বিপরীতে নতুন কিছু করার যে প্রবণতা তার জন্যই এমন হয়েছে, এ কথা বলা যায়। এটি একটি চিরাচরিত নিয়মে দাঁড়িয়েছে, শিল্পের এবং সৃজনশীলতার অন্যান্য ক্ষেত্রে। দ্বিতীয়ত, আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে, বলতে হয় শিল্পে উদ্দেশ্য হিসেবে উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে আবেগ ও অনুভূতির অভিব্যক্তির ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এর আগে প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিতে রিপ্রেজেন্টেশন বা বাস্তবের প্রতিফলনের যে ঐতিহ্য ছিল, শিল্পের এই দুই বিপরীতমুখী উদ্দেশ্যের মধ্যে দোদুল্যমানতা ও শেষ পর্যন্ত একটিকে বেছে নেওয়ার প্রবণতার মধ্যেই কিউবিজমের আবির্ভাবের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় নতুন তথ্য ও তত্ত্ব (যেমন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব) কিউবিজমের আবির্ভাবে পরোক্ষে হলেও ভূমিকা রেখেছে। কিউবিজম ছিল এক্সপ্রেশনিজমের উত্তরে বা প্রতিক্রিয়ায় শিল্পীদের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা বাস্তবতার প্রতিফলনে ব্যবহৃত নতুন এক পদক্ষেপ।

সেজাঁর কাজের প্রভাব ছাড়াও হারবার্ট রিড পিকাসোর কিউবিস্ট ধারার কাজে অন্যান্য ধারার প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ছিল পিকাসোর জন্মস্থান ক্যাটালনিয়ার গথিক শিল্পের প্রভাব, ষষ্ঠদশ শতকের স্প্যানিশ শিল্প বিশেষ করে, এল গ্রেকোর শিল্পকর্ম, নিকট অতীতের পোস্ট-ইমপ্রেসনিস্ট শিল্পী তুলো লোত্রাক এবং ফভ শিল্পীদের চিত্রকলা। রিড বলেছেন, এই সব প্রভাব ছিল বিক্ষিপ্ত ধরনের অর্থাৎ নিরবচ্ছিন্ন নয় এবং উপরিতলের অর্থাৎ ভাসা ভাসা। প্রধান প্রভাব হিসেবে তিনি সেজাঁর শেষ জীবনের শিল্পকর্মকেই শনাক্ত করেছেন। প্রথমে পিকাসোর কাজে আফ্রিকার শিল্পকর্ম, বিশেষ করে ভাস্কর্যের প্রভাবের কথা তিনি উল্লেখ করেননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই প্রভাবের গভীরতা ও তাৎপর্য সম্পর্কে তিনি বেশ বিশদভাবে মন্তব্য করেছেন। শুধু পিকাসো নয়, তাঁর সহযোগী শিল্পী জর্জ ব্রাকের ওপরও আফ্রিকার শিল্পকর্ম গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁরা দু’জনই এই শিল্পকর্মের নিদর্শন দেখেছেন প্যারিসে পুরোনো জিনিস (অ্যান্টিক) বিক্রির দোকানে। এই শিল্পকর্মের তাৎপর্যের প্রতি জর্জ ব্রাকই পিকাসোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বলে কথিত।

‘কিউবিজম’ কথাটি এসেছে একজন শিল্প সমালোচকের মন্তব্য থেকে, যেমন ‘ইমপ্রেসনিজম’ কথাটি চালু হয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে। ১৯০৮ সালে প্রদর্শনীতে পাঠানো ব্রাকের নতুন ধরনের ছবি দেখে মাতিস ‘কিউবস্’ এবং ‘বিজারে বিজ কিউবিজম’ কথা দুটি ব্যবহার করেন বলে কথিত। সেই থেকে শিল্প-সমালোচকদের আলোচনায় নতুন এই ধারার নামকরণ হয়ে যায় ‘কিউবিজম’। প্রথমে ১৯০৭ সালে পাবলো পিকাসো এবং পরের বছরে জর্জ ব্রাক কিউবিজম ধারার ছবি আঁকার সূত্রপাত করেন যদিও তাঁরা এই নামে তাঁদের ছবি অভিহিত করেননি।

প্রথম কিউবিস্ট শিল্পী ব্রাক ও পিকাসো

১৯০৮ সালে গ্রীষ্মে প্যারিসের স্যালো দি অটোমে প্রদর্শনীর জন্য জর্জ ব্রাক Houses at l’Estaque নামে একটি ছবি পাঠান। নির্বাচকমণ্ডলীর প্রধান অঁরি মাতিস ছবিটির অপ্রচলিত শৈলী দেখে পছন্দ করেননি এবং ছোট কিউবের ব্যবহার করা হয়েছে, এ কথা প্রায় সমালোচনার ভঙ্গিতেই উল্লেখ করেন। অসন্তুষ্ট হয়ে ব্রাক প্রদর্শনীতে অংশ না নিয়ে একই বছর শীতকালে অন্য এক গ্যালারিতে বিতর্কিত ছবিটির সঙ্গে অন্যান্য ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনী করেন। প্রদর্শনীর ক্যাটালগ লেখেন কবি গিওঁম অ্যাপলোনিয় আর রিভিউ করেন শিল্প সমালোচক ভসচেলে। মাতিসের ব্যবহৃত কিউব কথাটি পুনরাবৃত্তি করে ভসচেলে বলেন ব্রাক ল্যান্ডস্কেপ, ফিগার, বাড়িঘর, সবকিছুই জ্যামিতিক প্যাটার্ন, কিউবে রূপান্তরিত করেছেন। এই মন্তব্য থেকেই কিউবিজম নামটি গৃহীত ও চূড়ান্ত হয়ে যায়। ব্রাকের যে ছবি মাতিস পছন্দ করেননি কিউব ব্যবহারের জন্য তার বর্ণনা দেওয়া এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। এটি নিসর্গ দৃশ্য যেখানে কিছু বাড়িঘর দেখানো হয়েছে এবং গাছপালা। ছবিটির সামনে রয়েছে কয়েকটি বাড়ি যার ছাঁদ ত্রিভুজ আর চতুর্ভুজের সমাহার। ছবির ওপরের দিকেও রয়েছে একই জ্যামিতিক প্যাটার্নের কয়েকটি বাড়ির আভাস। ছবির নিচ থেকে বাঁ পাশ ঘেঁষে ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে একটি পাতাহীন গাছ। বাড়িঘর এবং সবকিছুর ফর্ম ছবিতে জ্যামিতিকভাবে প্রতিফলিত করা হয়েছে। রঙের ব্যবহারও ছিল জ্যামিতিক শৃঙ্খলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ব্রাকের ছবিতে এই সব বৈশিষ্ট্য ফভশিল্পী মাতিসের কাছে পছন্দ হয়নি যদিও তিনি প্রকৃতি ও মানুষের অবয়ব সরলীকৃত করেছেন। কিন্তু মাতিসের ছবিতে আবেগের ও অনুভূতির প্রকাশ ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য যা ব্রাকের এই ছবিতে তিনি দেখতে পাননি। ব্রাকের ছবিতে, সেজাঁর মতোই, আবেগকে সরিয়ে রেখে নৈর্ব্যক্তিকভাবে মেধা ও বোধের মাধ্যমে প্রকৃতির সংহতিকে ধারণ করা হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়ায় তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে প্রকৃতি নিরপেক্ষ ও স্বায়ত্তশাসিত, বাইরের কোনো দৃশ্য বা বস্তুর কাছে নির্ভরশীল নয়। ব্রাকের এই ছবিটিই যে কিউবিজমের শৈলীর প্রথম নিদর্শন, তা নয়। এর আগের বছর, ১৯০৭ সালে, পিকাসো এঁকেছেন Les Demoiselles d’Avignon শীর্ষক ছবি, যা ছিল ব্রাকের তুলনায় আরো বৈপ্লবিক। এই ছবিতে কিউবের ব্যবহার আরো স্পষ্ট এবং কম্পোজিশনটি ফর্মের ভঙ্গিসহ প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ ঘোষণা।

কিউবিজমের শৈলী ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর দুই প্রধান প্রবক্তা, পিকাসো ও ব্রাক, দু’জনের ছবি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন যা সময়ের ধারানুক্রমে করা হলে তাদের দু’জনের তো বটেই কিউবিজমেরও শিল্পশৈলীর ক্রমবিবর্তন জানার জন্য সহায়ক হবে। তার আগে সংক্ষেপে এই দুই শিল্পীর ব্যক্তিগত স্বভাব, শিল্প-চেতনা এবং পদ্ধতি নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। পিকাসোর ধমনিতে ছিল স্পেনের মানুষের উদ্দামতা ও উচ্ছ্বাস। আবেগজড়িত হয়ে তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে। কিন্তু যেহেতু তাঁর পিতা শিল্পী ছিলেন এবং নিজেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা নিয়ে ছাত্রজীবনেই খ্যাতি অর্জন করেছেন সেই কারণে তাঁর শিল্প-চেতনায় ও শিল্প পদ্ধতিতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ছিল ঐক্য, উদ্দামতার সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছিল শিথিলভাবে হলেও স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ। ফরাসি জর্জ ব্রাক স্বভাবে ছিলেন পিকাসোর বিপরীত। ধৈর্য, ধীরস্থির চিন্তাভাবনা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। উদ্দাম উচ্ছ্বাস নয়, আত্মগত তন্ময়তা থেকে তিনি ছবি এঁকেছেন। এই বিপরীত স্বভাবের দুই শিল্পী যখন স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছিলেন, তাদের মধ্যে যে একই শিল্পবোধ ও প্রত্যয় সক্রিয় ছিল সেটি বিস্ময়ের। দু’জনের কাজেই আয়তনময়তার দিকে ছিল ঝোঁক, সেইসঙ্গে কৌণিকতার কৌশল দিয়েছিল ছবিতে স্ট্রাকচারাল ইউনিটি বা গাঠনিক ইউনিটি। ১৯১৪ সালে ব্রাক যুদ্ধে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দু’জন একসঙ্গে কাজ করেছেন এবং কিউবিজমের শৈলীকে বিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কিউবিজমের প্রাথমিক পর্বের পর আরো অনেক শিল্পী এই আন্দোলনে এবং শিল্পচর্চায় যোগ দিয়েছেন। কিউবিজমের বিবর্তনে এবং শেষ পরিণতিতে তাদের ভূমিকাই ছিল প্রধান, কেননা তারা শেষ পর্যন্ত কিউবিজমকে অর্ধ-বিমূর্ত থেকে বিমূর্ততার দিকে নিয়ে যান।

অ্যানালিটিকাল ও সিনথেটিক কিউবিজম

অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজম : কিউবিজমের সময়কাল ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত। এর প্রথম পর্বকে বলা হয়েছে ‘অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজম’। এই পর্বের শৈলীতে বাস্তবকে ভেঙে মৌলিক জ্যামিতির আকারে বিন্যস্ত করতে দেখা যায় যেন বস্তু বা ফিগার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সম্ভব হয়। বিভিন্ন মুহূর্তে ও স্পেসের কোণ থেকে যুগপৎ এইভাবে বস্তু ও ফিগারের বিভিন্ন দিক দেখায় অভিজ্ঞতা ও সংহতি এনে বাস্তবের বিশ্বস্ত প্রতিফলন ঘটেছে বলে দাবি করা হয়। বাস্তবের এই আপেক্ষিক কিন্তু তাৎক্ষণিক উপস্থাপনায় সেই সময়ে আবিষ্কৃত ও প্রচারিত আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিয়োরির সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল অর্থাৎ বাস্তবের অভিজ্ঞতা আপেক্ষিকতানির্ভর। অ্যানালিটিক কিউবিজমে রঙের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করা হয়েছে, ফভ বা এক্সপ্রেশনিস্টদের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে মুক্ত ভঙ্গিতে নয়। স্পেসও সংকুচিত করা হয়েছে ফর্মকে সংহত রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যেসব জ্যামিতিক শেপ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোও সংখ্যায় স্বল্প। স্পেসের ভলগুলো একে অন্যকে ছেদ করেছে এবং স্বচ্ছতা সৃষ্টি করে বস্তুর বা ফিগারের বিভিন্ন দিক একই সঙ্গে দেখার উপায় করে দিয়েছে। বস্তু বা ফিগার স্পষ্টরূপে না, আভাসে প্রতিফলিত করে দর্শককে ছবি দেখে এবং চিন্তা করে সেইসব ফর্মের সম্পূর্ণ আকার বা রূপ নির্মাণ করার জন্য যেন আহ্বান জানানো হয়েছে। বিমূর্ততা কিউবিজমের এই পর্বে লক্ষ্য ছিল না কিন্তু অর্ধ বিমূর্ততাকে প্রয়োজনে বহুমাত্রিক বাস্তবতার রূপ প্রতিফলনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় হিসেবে দেখানো হয়েছে। ব্রাক বলেছেন তার কাছে বস্তু বা ফিগারের খণ্ডিত রূপ দেখার উপায় মাত্র। অ্যানালিটিক কিউবিজম ১৯১১ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল যেসময় তার মধ্যে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি, অন্তত পিকাসো ও ব্রাকের কাজে।

সিনথেটিক কিউবিজম : ১৯১২ থেকে শুরু হয় কিউবিজমের নতুন পর্ব যার নাম দেওয়া হয় ‘সিনথেটিক কিউবিজম’। এই পর্বে এসে ব্রাক ও পিকাসো তাদের শিল্পপদ্ধতি ও শৈলী প্রায় উল্টে দিয়ে বিপরীত দিকে যাত্রা করেন। বস্তু ও ফিগারকে অর্ধ-বিমূর্ততায় পর্যবসিত বা রূপান্তরিত না করে তারা খণ্ডিত বিমূর্ত রূপের ভিত্তিতে ছবির কম্পোজিশন তৈরি করলেন। নতুন প্রজন্মের শিল্পী হুয়ান গ্রিস এই দুই প্রবীণ শিল্পীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার ভিত্তিতে বললেন, আমরা সিলিন্ডার থেকে বোতল তৈরি করতে পারি। সিনথেটিক কিউবিজমের সূত্রপাত হয়। ১৯১২ সালে আঁকা পিকাসোর Still Life with Caned Chair দিয়ে যেখানে তিনি ফেলে দেওয়া ব্যবহৃত বস্তু আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছেন ক্যানভাসের ওপর। এই ছবিতে একটি কাপড়ের ওপর বেতের চেয়ারের ছবির আংশিক দৃশ্য দেখা যায় যার ওপর একজন উপবিষ্ট মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব রয়েছে। এখানেও অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজমের মতো ব্যবহার করা হয়েছে জ্যামিতিক বিন্যাস এবং রঙের ব্যবহারে মিতব্যয়িতা। প্রায় মনোক্রোম রঙে কোলাজটি তৈরি। সিনথেটিক কিউবিজম শিল্পপদ্ধতি এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। ফরাসিতে কোলাজ মানেই লাগানো বা সেঁটে দেওয়া। কোলাজ ছবিতে বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট থাকে। এখানে রং ব্যবহারে উদারতার আশ্রয় নেওয়া হয়। বাস্তব জগৎ থেকে গ্রহণ করা হয় টেক্সট অথবা ব্যবহৃত বস্তুর খণ্ডিত অংশ যা উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয় ক্যানভাসের ওপর। জর্জ ব্রাক অবশ্য তাঁর নিজের উদ্ভাবিত কোলাজ পদ্ধতিতে শুধু টুকরো কাগজ ব্যবহার করেছেন। যে বিশ্লেষণাত্মক প্রক্রিয়া থেকে শুরু হয়েছিল অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজমের পর্ব এবং তার মধ্যে যেভাবে ক্রমান্বয়ে বিমূর্তায়ন আসছিল সেই প্রবণতা আরো অগ্রসর হলো সিনথেটিক কিউবিজমে। ছবি শুধু রং-তুলিতে প্রতিমাকল্প নির্মাণের মধ্যে আর বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ থাকল না। তা হয়ে উঠল নির্মাণের একটা প্রক্রিয়া। কোলাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন বস্তুর অংশ সাঁটা হলো। ছাপানো অক্ষর বা অক্ষরমালা সেঁটে দিয়ে বুনটের বৈচিত্র্য আনার বৈশিষ্ট্যও দেখা গেল। এই সব প্রতীকের মাধ্যমে চেষ্টা করা হলো বাস্তবের কিছু দৃশ্যের প্রতিফলন ঘটানোর। ছবি আর সরাসরি কোনো অর্থ বিন্যাসের দিকে গেল না, কোনো ন্যারেটিভের সাহায্যও গ্রহণ করল না, হয়ে উঠল স্বকীয় সরাট এক শিল্প প্রক্রিয়া (মৃণাল ঘোষ, ২০১৪)।

  • এই প্রসঙ্গে পিকাসোর Still Life with Caned Chair শীর্ষক কোলাজ ছবিটির আরো বিশদ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এই ছবিতে ক্যানভাসের ওপর সাঁটা হয়েছে অয়েলক্লথের ওপর ছাপা বেতের চেয়ারের উপরিতলের ছিদ্রযুক্ত অংশের আদল। এর ওপর অস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে একজন উপবিষ্ট মানুষের অবয়ব যা তার ছায়াও হতে পারে। ছবিটির মূল বিষয় অবশ্য বেতের চেয়ার। স্টিল লাইফ হিসাবে বেতের চেয়ারের এই খণ্ডিত অংশকেই বোঝানো হয়েছে। এটি বিশেষ এক বুনট হিসেবেও ছবিতে যুক্ত। এর পর ক্যানভাসের ওপর আঁকা হয়েছে জ্যামিতিক আকারে একটি ছুরি, লেবুর টুকরো, ঝিনুক এবং একটি পাইপ। বড় তিনটি অক্ষরে লেখা Jou যা জার্নাল কথাটির সংক্ষিপ্তসার। এর দ্বারা একটি পত্রিকা না রেখেও প্রতীকের সাহায্যে তার উল্লেখ করা হয়েছে। ক্যানভাসের ভেতর এই সব কাজ শেষ করার পর পিকাসো উপবৃত্তাকার ক্যানভাসটির প্রান্ত ঘিরে জড়িয়ে দিয়েছেন একটি রশির বাঁধন। শুধু চিত্রপ্রতিমায় নয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মূর্তির প্রতীকে দৃশ্য জগতের আবহ বা আভাস গড়ে তোলা ছিল সিনথেটিক কিউবিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য। একে প্রচলিত পদ্ধতিতে চিত্র অঙ্কন বলা যাবে না, বলতে হয় চিত্রপ্রতিমা নির্মাণ। প্রচলিত শিল্প পদ্ধতির আঙ্গিক ও প্রকরণ থেকে এটি একেবারেই ব্যতিক্রমী।
  • এই প্রসঙ্গে ১৯১২-তে আঁকা ব্রাকেরও একটি কোলাজের উল্লেখ করা যায়। ছবিটির নাম Fruit Dish and Glass। ছবিটিতে কাগজের ওপর কাগজ সেঁটে চারকোনা ফর্ম সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানেও পিকাসোর মতোই অক্ষরের প্রতীকে অন্য বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। ছবির ওপরের দিকে লেখা BAR এবং তার নিচে বিপরীত প্রান্তে লেখা ALE। এইভাবে পিকাসোর মতো ব্রাকের এই ছবিটিও হয়ে উঠেছে নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট। পিকাসোর মতোই এই ছবিতেও আবেগের তুলনায় মেধার ভূমিকা প্রধান্য পেয়েছে। অর্থাৎ ছবিটি প্রকাশবাদী হলেও বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এইভাবে সিনথেটিক কিউবিজমে দেখা গেল নিরবয়ব প্রতিমা-নিরপেক্ষ এবং আখ্যান-নিরপেক্ষ চিত্রনির্মাণ যার সঙ্গে এই দুই শিল্পীর আগের ছবির কোনো মিল নেই।

কিউবিজমের ছড়িয়ে পড়া ও পরিচিতি

হিউ হনার এবং জন ফ্লেমিংয়ের মতে, ‘কিউবিজম’ কথাটি বেশ ভ্রান্ত কেননা এর দ্বারা এমন একটি শিল্পধারার পরিচয় দেওয়া হয়েছে যা সঠিক সংজ্ঞার অতীত। বরং এই অভিধায় পরিচিত নতুন শিল্প আন্দোলন সম্বন্ধে ভুল ধারণা দেওয়া হয়েছে। পিকাসো কিংবা ব্রাক, কেউই খোলাখুলি বলতে চাননি তাদের উদ্ভাবিত নতুন শিল্প পদ্ধতি দ্বারা কি বোঝানো হয়েছে, ঠিক যেমন টি এস এলিয়ট ব্যাখ্যা করেননি তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘দি ওয়েস্ট ল্যান্ড’ দ্বারা তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু এই দুই শিল্পী যা-ই বলুন না কেন অথবা নিশ্চুপ থেকে যে ধারণাই দিন না কেন, কিউবিজম বেশ স্বয়ংব্যাখ্যিক। বলা যায় পিকাসো ও ব্রাকের এই সম্বন্ধে নীরবতা শব্দটির অন্তর্নিহিত এবং সাধারণভাবে গৃহীত অর্থের প্রতি তাদের সমর্থনেরই ইঙ্গিত দেয় (হিউ অনার এবং জন ফ্লেমিং। সে যাই হোক ১৯১১ সালের মধ্যে পিকাসো ও ব্রাক ছাড়া যেসব শিল্পী কিউবিস্ট নামে পরিচিত হয়েছিল তারা প্যারিসে যৌথভাবে তাঁদের ছবির একটি প্রদর্শনী করেন। এই প্রসঙ্গে সমালোচকরা কাগজে লেখে কিউবিস্টদের শিল্প প্রদর্শনী। যে কারণেই হোক ব্রাক কিংবা পিকাসো এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেননি কিন্তু এর ভিত্তিতে এই প্রদর্শনী কিংবা অংশগ্রহণকারী কিউবিস্ট শিল্পীদের প্রতি তাদের সমর্থনের অভাব ছিল, এ কথা বলা যায় না। এর পরের বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিউবিস্ট শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী আয়োজন করা হয় এবং এই ধারার শিল্পকর্মের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অ্যালবার্ট গ্লেইজে এবং জা মেতজিঙ্গার, এই দুই কিউবিস্ট শিল্পী ড কিউবিসাস’ নামে একটি বই লেখেন যেখানে এই নতুন ধারার শিল্পপদ্ধতি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। ১৯১৩ সালে আর্মারি প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমেরিকায় কিউবিস্ট শিল্পপদ্ধতি ও শৈলী পরিচিত হয়।

রিপ্রেজেন্টেশনাল কিউবিজমের প্রভাবে নন-রিপ্রেজেন্টেশনাল ও বিমূর্ত শিল্পধারাগুলোর সৃষ্টি

হিউ অনার ও জন ফ্লেমিংয়ের ধারণা পিকাসো এবং ব্রাক অন্য কিউবিস্ট শিল্পীদের প্রদর্শনী থেকে দূরে থাকতেন, কেননা তাঁদের ধারণা হয়েছিল কিউবিজম বিমূর্ততার দিকে অগ্রসর হয়ে যেতে পারে। তাদের কেউই ফিগারেটিভ শিল্প সচেতনভাবে সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে চাননি। এক ইন্টারভিউতে পিকাসো স্পষ্টভাবে বলেছেন, বিমূর্ত শিল্প বলে কিছু নেই। শিল্পীকে একটা কিছু নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করতে হয়।’ কিউবিস্ট শিল্পীরা পরবর্তী সময়ে বিমূর্ততার দিকে যেভাবে ঝুঁকে পড়ে তা হয়তো পিকাসো কিংবা ব্রাক, কারো মনঃপূত ছিল না। তবে তাঁরা এর বিপক্ষেও কোনো মন্তব্য করেননি। এ থেকে মনে হয় বিষয়টি নিয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। তারা যদিও বলেছেন নন-রিপ্রেজেন্টেশনাল অর্থাৎ অপ্রতিনিধিত্বকারী শিল্প সৃষ্টির জন্য কিউবিজমের উদ্ভাবন করা হয়নি কিন্তু অচিরেই এর অনুসারী শিল্পীরা অর্ফিজম, ডি স্টিল, কনস্ট্রাকটিভিজম ইত্যাদি নামে যেসব শিল্পধারার প্রচলন করে সেগুলি কিউবিজমেরই অপ্রতিরোধ্য ফলশ্রুতি। অ্যানালিটিকাল পর্বে কিউবিজম যখন পিকাসো ও ব্রাকের নেতৃত্বে রূপ পরিগ্রহ করছে সেই সময় ফভিজম এবং এক্সপ্রেশনিজম রঙের ক্ষেত্রে উদ্দামতা ও মুক্তভাব এবং ফর্মের ক্ষেত্রে শৈথিল্য, এমনকি উপেক্ষার প্রবণতার বিপরীতে রঙের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ এবং সীমিত জ্যামিতিক আকারের ভেতরে ফর্ম সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা দু’জনই প্রথমে বস্তু ও ফিগারকে নিজেদের দেখা দৃষ্টির ভিত্তিতে উপস্থাপিত করতে চেয়েছেন। কিউবিজমের দ্বিতীয় পর্ব সিনথেটিজমেও তাদের কেউই বস্তু ও ফিগারের প্রতি ঔদাসীন্য বা উপেক্ষা প্রদর্শন করেননি যদিও সেই পর্বে সেগুলি জ্যামিতিক বিন্যাসে আরো অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। দর্শকরা যেন এই সব ছবিতে বস্তু বা ফিগারের উপস্থিতি বুঝতে পারে সেই জন্য কোলাজে প্রতীকের সাহায্য নেওয়া হয়েছে যা দেখে বস্তু বা ফিগার সম্বন্ধে অনুমান করা সম্ভব হবে। অবশ্য অনেক দর্শক তাদের পরিচিত বস্তুর এমন খণ্ডিত ও বিকৃত রূপ দেখে খুব যে খুশি হয়নি, তা বলাই বাহুল্য। শিল্প ঐতিহাসিক ডেল ক্লিভার বলেছেন, সিনথেটিক কিউবিজম ছিল বাস্তব জগতের বস্তুর (ন্যাচারাল অবজেক্টস) কল্পনাপ্রসূত পুনর্নির্মাণ অথবা তাদের ফর্মের দ্রুত নতুন উদ্ভাবন। রং এবং স্পেস কিউবিজমের প্রথম পর্বের মতো এই পর্বে সীমিত ছিল না এবং আকারও প্রাথমিক শ্রেণির জ্যামিতিক প্যাটার্নে সীমাবদ্ধ থাকেনি’ (ডেল ক্লিভার, প্রাগুক্ত)। কোলাজ, যে নামে সিনথেটিক কিউবিজমের পরিচিত হয়েছে, তা ছিল ব্যবহারিক জগতের প্রকৃত বস্তু বা উপাদান (যেমন, কাপড়ের টুকরো, কাঠের টুকরো, ছেঁড়া কাগজ) দিয়ে তৈরি। ১৯১৩ সালে গিওমঁ অ্যাপলোনিয়ের প্রকাশ করেছিলেন তাঁর বই ‘লেজ পেইন্ট্রে কিউবিস্ট’ যেখানে কিউবিজমের তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও পরিপ্রেক্ষিত এবং এর অন্তর্গত বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই বইতে তিনি পিকাসো ও ব্রাককে ‘সায়েন্টেফিক কিউবিস্ট’ অভিধায় অভিষিক্ত করেন। তাঁর ব্যাখ্যায় তিনি অবশ্য বলেননি যে তারা বিমূর্ততার দিকে অগ্রসর হয়েছেন। শুধু উল্লেখ করেছেন যে এরা দুজন ভবিষ্যৎ ও অসীমের দিগন্তের কাছে পৌঁছানোর সংগ্রামে রত।’ এই উক্তি এতই বিস্তৃত পরিসরের যে এর মধ্যে যে কোনো অর্থ বা ইঙ্গিত অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

কিউবিজমে বাস্তরের প্রতিফলন গুরুত্ব পেয়েছে, না তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনা ও আবেগপ্রসূত কল্পনার প্রকাশ পেয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর আগেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে তার পুনরুক্তি করা হলে আরো বিশদভাবে ইতিহাসের চলমান প্রেক্ষিত থেকে বিষয়টি সম্পর্কে জানা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ইউরোপে রেনেসাঁর সময় থেকে প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতার (ন্যাচারালিজম) প্রতিফলন ছিল গুরুত্বে সবার ওপরে। শিল্পী প্রকৃতিকে যেভাবে দেখছেন তার আলোকেই বাস্তবের প্রতিরূপ তৈরি করতে হবে, এই ছিল শিল্পের ভূমিকা বা উদ্দেশ্য। শিল্পীর অন্তচেতনার বা নিজস্ব অনুভবের প্রতিফলন পড়েছে কখনো কখনো প্রকৃতির ওপর যার ফলে শিল্পীর দৃষ্টিতে প্রকৃতি ও বাস্তবতা রূপান্তরিত হয়েছে। রোমান্টিক আন্দোলন হয়েছে এই রূপান্তরের প্রক্রিয়ায়। ইংল্যান্ডে টার্নারের নিসর্গ চিত্র এর নিদর্শন। দেলাক্রোয়াঁ ছবিতে শিল্পীর আবেগের প্রকাশ করেছেন সীমিতভাবে হলেও। সূর্যের আলোর খেলায় প্রকৃতির যে রূপান্তর, সেই স্বাভাবিকতার অতিক্রান্ত রূপ হয়েছিল ইমপ্রেসনিস্টদের শিল্পপদ্ধতি ও শৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। পোস্ট-ইমপ্রেসনিস্ট শিল্পীরা দৃশ্যমান প্রকৃতি, বস্তু ও ফিগারের ওপর স্থাপন করেন মানসিক প্রক্রিয়ায় উৎসারিত অনুভব ও আবেগকে। এর প্রকৃষ্ট প্রকাশ দেখা গিয়েছে ভ্যান গগেঁর ছবিতে। অপরদিকে পল গগাঁ আদিমতার সরলতা প্রয়োগ করে প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে রূপান্তরিত করেছেন। মনোজগতে উদ্ভূত চিন্তা, ধারণা ও অনুভবের এই সব প্রকাশ মাঝে মাঝে কোনো শিল্পীর অথবা গোষ্ঠীর শিল্পকর্মে দেখা গেলেও ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকের আগে শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনের জন্য যে অনুকরণবাদ (মাইমেসিস) প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছিল তার প্রাধান্যে বড় রকমের কোনো হেরফের হয়নি। হুবহু অথবা সৃজনশীলতার মাধ্যমে বাস্তবের প্রতিফলন করা শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে অপরিবর্তিত থেকেছে। উনিশ শতকের শেষে বাস্তবের প্রতিফলনের প্রতি শিল্পীদের পুঞ্জীভূত প্রতিক্রিয়ায় এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মনের আবেগ ও অনুভূতি ক্রমেই প্রাধান্য পেয়ে প্রকাশবাদ শিল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে পুরোভাগে আসে। এর ফলে বাস্তবের প্রতিফলনে প্রচলিত অনুকরণ পদ্ধতি সম্পূর্ণ ত্যাগ করা না হলেও তার ব্যবহারে পদ্ধতি ও শৈলীগতভাবে বিশাল পরিবর্তন আসে। এই সময় থেকে শিল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে বাস্তবের প্রতিফলনের পাশাপাশি দেখা দিল আইডিয়া ও মনের আবেগের প্রকাশ। পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এবং ব্যবহার করা হয়েছে যার জন্য প্রথমটি অর্থাৎ অনুকরণবাদের ভিত্তিতে বাস্তবের প্রতিফলন আগের অবস্থায় ও রূপে থাকেনি। শিল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে প্রকাশবাদ শুধু নিজের পদ্ধতি অনুযায়ী শিল্পচর্চায় ভূমিকা ও প্রভাব রাখেনি, প্রাচীন ও প্রচলিত অনুকরণবাদেও আমূল পরিবর্তন এনেছে। ফলে বাস্তববাদী শিল্প বা ফিগারেটিভ শিল্প আগের মতো নেই।

ইমপ্রেসনিজম ধারা যখন আবেগ বা অনুভবের প্রকাশ প্রধান উদ্দেশ্য করে উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়ে বাস্তবকে (স্বাভাবিকতাবাদ) সম্পূর্ণ বা অনেকটাই ত্যাগ করে অর্ধ বিমূর্ততার দিকে চলে যেতে থাকল, তার প্রতিক্রিয়ায় সেজাঁর মতো শিল্পী বাস্তবের গঠন অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রয়াস পেয়েছেন। এই জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর মোটিফ রিয়েলাইজে’ অর্থাৎ বাস্তবের রূপ গঠন ও তা প্রতিফলনের পদ্ধতির মাধ্যমে। এটা করতে গিয়ে তিনি আগের মতো অনুকরণবাদের আশ্রয় নেননি, জ্যামিতিক গঠনের মধ্যে বাস্তবকে উপস্থাপিত করেছেন। এর ফলে বাস্তবের প্রতিফলন হয়েছে স্টাইলাইজড যার দৃষ্টান্ত শিল্পের ইতিহাসে আগেও দেখা গিয়েছে, যদিও জ্যামিতিক বিন্যাসে নয়। সেজাঁর এই পদ্ধতি ও রীতি পিকাসো এবং ব্রাককে অনুপ্রাণিত করেছে, কেননা তারাও সিম্বলিজম, ফভিজম এবং এক্সপ্রেশনিজমের উচ্ছ্বসিত রং ব্যবহার ও বাস্তবের স্বাভাবিকতার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনে বিচলিত হয়েছিলেন। সুতরাং তারা প্রকৃতির হুবহু অনুকরণ বা পুনঃসৃষ্টি করতে না চাইলেও নতুন রূপের ভেতর তা অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছেন। তাঁরা সেজাঁর নতুন শিল্পীদের প্রতি দেওয়া উপদেশ অনুযায়ী সিলিন্ডার, স্ফিয়ার ও কোণের সাহায্যে অর্থাৎ বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের মাধ্যমে প্রকৃতির স্বাভাবিকতা ধারণ করতে চেয়েছেন। পিকাসোর সামনে বাস্তবের অনুকরণ ও সৃজনশীলতার মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের সমাধান হিসেবে এসে যায় আরো একটি সম্ভাবনা, আফ্রিকার শিল্পকর্ম বিশেষ করে ভাস্কর্য। ব্রাক তাকে আদিম এই সব শিল্পকর্ম দেখিয়ে এসবের ভিত্তিতে চিন্তাভাবনা করার কথা বলেছিলেন। পিকাসো স্বীকার না করলেও তাঁর অ্যানালিটিকাল পর্বের কিউবিস্ট শিল্পকর্মে আফ্রিকার ভাস্কর্যের প্রভাব শুধু স্পষ্ট ছিল না, ফলশ্রুতিতেও হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আফ্রিকার শিল্প তাঁকে এবং ব্রাককেও প্রতিনিধিত্বমূলকতা আর প্রতিনিধিত্বহীনতার মধ্যের দ্বন্দ্ব নিরসনের উপায় দেখিয়েছে। সুতরাং কিউবিজমের সূচনাপর্বে পিকাসো কিংবা ব্রাক, দু’জনের কেউই সম্পূর্ণভাবে বিমূর্ততার দিকে যাত্রার কথা ভাবেননি, অ্যানালিটিক পর্বে তো নয়ই, পরবর্তী সিনথেটিক পর্বেও নয়। কিন্তু পরিণামে বিমূর্ততার প্রভাব যে এসে গিয়েছে তাঁদের ভবিষ্যতের কাজে তার পেছনে ছিল কিউবিজমের বিমূর্ততার অন্তর্নিহিত প্রবণতা। তাদের অনুসারীরা অবশ্য সম-সময়ে অথবা পরবর্তী সময়ে বিমূর্তধারার শিল্প সৃষ্টি করেছে নির্দ্বিধায়। তারা নতুন শিল্প আন্দোলনের সূত্রপাত করেছে কিউবিজমের ছত্রছায়ায়। তাদের প্রতি পিকাসো বা ব্রাকের সমর্থন ছিল বলে জানা যায়নি, সমর্থন না থাকারই সম্ভাবনা বেশি। পিকাসো ও ব্রাকের শিল্পকর্মের ধারাবাহিকতা নিয়ে অর্থাৎ তাদের বিভিন্ন পর্বের শিল্পকর্মের উল্লেখ করা হলে তাদের শিল্পচিন্তার পটভূমি ও অগ্রগতি সম্বন্ধে জানা যাবে।

পিকাসোর শিল্পের বিবর্তন

স্পেন থেকে প্যারিসে এসে তরুণ পাবলো পিকাসো নিকট অতীতের প্রায় সব শিল্পপদ্ধতি ও শৈলীর অনুসরণে ছবি এঁকেছেন। প্রথমে তিনি ইমপ্রেসনিস্ট শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন কিন্তু অচিরেই তার বলয় থেকে সরে আসেন। ১৯০৩ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত তার নিজস্ব শৈলীতে আঁকা ছবিগুলো ‘ব্লু পিরিয়ডের’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। তার এই সময়ের ছবিতে বিষণ্নতা ও হতাশা ছিল কেননা, তাঁর বিষয় ছিল সমাজের খেটেখাওয়া মানুষ ও তাঁদের জীবন। The Old Guitarist ছবিটি এই পর্বের প্রতিনিধিত্বকারী। এখানে ব্যক্তির শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্লান্তি এবং হতাশা ফুটে উঠেছে। ব্লু পিরিয়ডের পরেই আসে তার সার্কাস পিরিয়ড। এখানে তিনি সার্কাস খেলোয়াড়দের নিয়ে একাধিক ছবি এঁকেছেন। যদিও খেলোয়াড়দের পোশাক জাঁকজমকপূর্ণ এবং বহু রঙে চিত্রিত, কিন্তু তাঁদের মুখাবয়বের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয়েছে ক্লান্তি, অবসাদ এবং দৈন্যের প্রকট চেহারা। এই পর্বের ছবিতে যে প্রাণবন্ত ও অন্তরঙ্গ রঙের ব্যবহার তা আগের পর্বের ছবির সঙ্গে পার্থক্য সূচিত করেছে, যদিও বিষয়গতভাবে বিশাল কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

১৯০৫ সাল থেকে শুরু হয় তার রোজ পিরিয়ড যখন তিনি নানা রঙের ব্যবহারে সংবেদনশীল কন্টুর তৈরি করেছেন এবং ক্রমেই ছবির ফর্মে যুক্ত হয়েছে জড় ও কঠিন বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে ফিগারের মুখ আঁকায়, যা মুখোশের আকার ধারণ করেছে। এই পর্বের ছবিতে যে প্রফুল্লতার আমেজ তা আগের পর্বে দেখা যায়নি। রোজ পিরিয়ড ছিল ১৯০৫ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে আঁকা Portrait of Gertrude Stein ছবিতে মুখ আর মুখোশের পার্থক্য ঘুচে যাওয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যায়। ১৯০৬ সালে রোজ পিরিয়ডের শেষে তিনি আঁকেন Two nude women এবং Self-Portrait with Palette শীর্ষক দুটি ছবি। এই সব ছবি দেখে ধীরে হলেও তার শৈলীর যে পরিবর্তন হচ্ছিল তা বোঝা যায়। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বা স্বতন্ত্র কোনো রূপ তখনো গ্রহণ করেনি এই শৈলী। আফ্রিকার শিল্পকর্ম দেখে তাঁর ভেতর নতুন যে আইডিয়া দেখা দেয় তার ভিত্তিতেই মনে হয় তিনি আঁকেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং যুগান্তকারী ছবি Les Demoiselles d’Avignon অর্থাৎ দাভিনোর নারীরা। এই বিষয়ে তিনি প্রথম যে ছবি আঁকেন সেখানে ডানদিকে একজন নাবিক ও উপবিষ্ট ছাত্রকে দেখানো হয়েছিল। কয়েকবার আঁকার পর চূড়ান্তরূপে যখন ছবিটি ১৯০৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে সেখানে কখনো পুরুষের ফিগার ছিল না, দেখানো হয়েছে পাঁচজন প্রায় নগ্নিকা পতিতাকে। তাদের ফিগার এবং মুখাবয়ব স্বাভাবিক নয়, বেশ বিকৃত ও অস্বাভাবিক। মুখের অভিব্যক্তিতে রয়েছে ভয়ংকর এবং বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গি। ছবিটি দেখে জর্জ ব্রাক স্তম্ভিত হন এবং অকপটে বলেন যে এটি দেখতে কুৎসিত। তার নিকট বন্ধুরাও ছবিটি সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করেন। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্যই পিকাসো ছবিটি জনসমক্ষে আনেন ১৯১০ সালে অর্থাৎ ছবিটি আঁকার কয়েক বছর পর। ছবিটিতে প্রচলিত শিল্পে ব্যবহৃত ফর্ম, রং এবং কম্পোজিশন এই সব কিছুই ছিল না; যা এই ছবিকে কিউবিজমের অভিধায় অভিষিক্ত করে তা হলো ফিগারের ফর্ম ভেঙেচুরে জ্যামিতিক বিন্যাসে উপস্থাপন। একই সময়ে আঁকা তাঁর Three women ছবিতে আয়তনিক বিশ্লেষণ আছে, আলো অন্ধকারের বৈপরীত্যও দেখা যায় কিন্তু তলবিন্যাসের জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য নেই। ১৯০৭ সালে আঁকা Nude with Raised Arms ছবিতে অবশ্য Les Demoiselles d’Avignon এর জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আয়তনিক বিশ্লেষণ এখানে আরো প্রগাঢ়। এই ছবিতে আফ্রিকার শিল্পের দৃশ্যভিত্তিক (পিকটোরিয়াল) বাস্তব প্রতিফলনের সরলতা আছে কিন্তু তার মতো ফর্মকে ফ্ল্যাট প্যাটার্নে রূপান্তরিত না তরে ঘনত্ব ও গভীরতা দেওয়া হয়েছে। এর জন্য পিকাসো সাহায্য নিয়েছেন সেজাঁর উপদেশমূলক নির্দেশনা : জ্যামিতিক স্ফিয়ার, সিলিন্ডার ও কোণের ব্যবহার। সেজাঁর মতো তিনিও চোখে দেখা দৃশ্যের প্রতিফলন না করে করতে চেয়েছেন ছবি নির্মাণ। যার জন্য নির্দিষ্ট মোটিফকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে আনুষঙ্গিক অংশগুলো যোগ করা হয়েছে নিরেট ও ঘন আকারে। এর ফলে কোনো বস্তু বা ফিগার একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সম্ভব হয়েছে। এইভাবে ছবি একই সঙ্গে বাস্তবের হুবহু প্রতিফলন না হয়ে হয়েছে দেখার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি। প্রকৃতি, বস্তু ও ফিগার দেখার রূপ সৃষ্টি হলো মূর্ততাকে বিসর্জন না দিয়েই, কিন্তু এই মূর্ততা চোখে দেখা মূর্ততা নয়, শিল্পীর দৃষ্টিতে যেমন ধরা পড়েছে সেই রূপ- আংশিক, খণ্ডিত, আঁকাবাঁকা এবং বহুতল ও কোণবিশিষ্ট। পিকাসো অবশ্য কিউবিজমের জ্যামিতি, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি তত্ত্ব, সংগীতের সূত্র এইসবের উল্লেখ করে ব্যাখ্যা প্রদানের বিরোধী ছিলেন যদিও অনেক সমালোচক তা-ই করেছেন। ১৯২৩ সালে আমেরিকান সমালোচক মারিউস জয়াসকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে তিনি বলেন কিউবিজম প্রচলিত একটি পেইন্টিং পদ্ধতি হিসেবে শিল্পের নিয়মকানুন ও সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে, এসবের বাইরে যাওয়ার কথা ভাবা হয়নি। অন্যান্য ধারায় যেমন কিউবিজমেও রং, ড্রইং, ডিজাইন একইভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা অবশ্য চোখ খোলা রেখেছি পরিপার্শ্বের প্রতি এবং মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রেখেছি সেই উদ্দেশ্যে। তাঁর শেষোক্ত কথার মধ্যেই নিহিত কিউবিজমের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা যা পিকাসো প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি। কিউবিজমের দুই পর্বের ছবি দেখে এই সব যে বুদ্ধির ফসল, নিছক আবেগ বা কল্পনাপ্রসূত নয় তা বুঝতে কষ্ট হয় না। আবেগ অবশ্যই রয়েছে কিউবিজমে, যা না থাকলে কোনো শিল্পই শিল্পগুণসম্পন্ন হতে পারে না। কিন্তু ফভিজম বা এক্সপ্রেশনিজমের মতো কিউবিজমে কল্পনা ও আবেগের প্রাধান্য নেই, উপলব্ধিতে আছে।

১৯১০ সালে আঁকা পিকাসোর Girl with Mandolin অ্যানালিটিক কিউবিজমের শ্রেণিভুক্ত। এখানে জ্যামিতিক প্যাটার্ন আরো স্পষ্ট এবং অভিব্যক্তিতে বিষয় অর্ধ বিমূর্ততার কাছাকাছি। যদিও পিকাসো বলেছেন যে শিল্পে বিমূর্ত বলে কিছু নেই, শিল্পীকে একটা কিছু থেকে আঁকা শুরু করতে হয়, দেখা যাচ্ছে তিনি প্রায় নিজের অজান্তে বিমূর্ত না হলেও অর্ধ-বিমূর্ত এবং প্রায় বিমূর্ততার দিকে অগ্রসর হয়েছেন ধীরে ধীরে কিউবিজম পদ্ধতির ছবি আঁকায়। ১৯১০ সালে আঁকা ‘ফিমেল ন্যুড’ ছবিটিতে জ্যামিতিক প্যাটার্নের ভেতর ফিগারকে এমনভাবে ভেঙেচুরে উপস্থাপন করেছেন যে ফর্ম শনাক্ত করা কঠিন। শিরোনাম না পড়লে বোঝা যাবে না যে এখানে নগ্নিকা নারীদেহ প্রতিফলিত হয়েছে। বিমূর্তের বৈশিষ্ট্য এখানে এত প্রবল যে একে অন্য কিছু বলে ভাবা যায় না। ফিগারের ভাঙচুর এবং প্যাটার্নের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য করে রাখার প্রক্রিয়ায় কোনো ভিসুয়াল মডেলের উপস্থিতি বা ভূমিকার কথা মনে আসতে দেয় না যার জন্য বিমূর্ততার ইফেক্টই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। এই ছবিটি এবং এই ধরনের অন্য অ্যানালিটিক্যাল কিউবিস্ট ছবি পরিণত হয়েছে একান্তই বুদ্ধিবৃত্তির সৃষ্টিতে যেখানে প্রতিফলিত বস্তু বা ফিগার ভেঙেচুরে বিকৃত হয়ে প্রায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে, শুধু সামান্য ইঙ্গিতটুকু ছাড়া। শিরোনাম দিয়ে এই ছবির মূর্ততা, এমনকি অর্ধ-বিমূর্ততার পরিচয় দেওয়া যায় না। এইভাবে পিকাসো ভাস্কর্যসুলভ যে বৈশিষ্ট্য এর আগের, এমনকি প্রথমদিকের কিউবিস্ট ছবিতে দেখিয়েছেন সেসব ১৯১০ এবং তার পরবর্তী পর্বের ছবিতে দেখা যায় না। পরবর্তী সময়ে আঁকা কিউবিস্ট ছবিতে ভর নেই, রঙের ব্যবহার সাংঘর্ষিক এবং তলদেশের সমাহার পরস্পরের আবৃতকারী (ওভারল্যাপিং), যার জন্য ফর্ম স্তরে স্তরে ঠেস দিয়ে, একটি অন্যের ওপর স্থাপিত হয়ে স্থাপত্যের মতো নির্মাণ করেছে ছবি। তলদেশগুলো বেঁকে এবং হেলে গিয়ে রেখার সাহায্যে সূক্ষ্ম একট দুজ্ঞেয় সিঁড়ি তৈরি করেছে বলে মনে হয়। (হিউ অনার এবং জন ফ্লেমিং)। শিল্পে বিমূর্ততার স্থান নেই, বলে পিকাসোর যে মন্তব্য প্রকৃতপক্ষে কিউবিজমের পর্বে তাঁর শিল্পে সেই বিমূর্ততার প্রভাবই বেশি, যদিও অর্ধ-বিমূর্ততার দিকে যাত্রা দিয়ে তাঁর শুরু। অপরদিকে তার ছবিতে বুদ্ধিবৃত্তির ভূমিকা নেই বলে তিনি যা বলেছেন, তার সপক্ষেও কোনো প্রমাণ দেখা যায় না, কেননা কিউবিজম এমন এক পদ্ধতি ও শৈলী যেখানে বুদ্ধিবৃত্তির ভূমিকাই প্রধান, যদিও কল্পনা ও আবেগ কিছুটা হলেও সেখানে কাজ করে, যেমন করে সব শিল্পে। পিকাসোর অ্যানালিটিকাল কিউবিজম ছবিতে বিমূর্ততার প্রসঙ্গে হিউ অনার এবং জন ফ্লেমিং বলেছেন, তাঁর Seated female nude ছবিতে নগ্নিকা নারীদেহের অস্তিত্বের পরিবর্তে সেখানে মা ও শিশুর ফিগারের কল্পনাও করা যেতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় কিউবিস্ট শিল্পীরা বিষয়কে কতটা গৌণ করে দেখেছে, আঙ্গিকই তাদের কাছে প্রধান এবং সেটি ব্যবহারের জন্য একটা কিছু বিষয় বা তার ইঙ্গিতসূচক চিহ্ন বেছে নেওয়া হয়েছে। যেমন, গিটারের খণ্ডাংশ।

বিষয় তাদের কাছে ছিল একটা অজুহাত এবং সেই অর্থে একান্ত সীমিত ও স্টুডিওর ভেতর কল্পিত, বাইরের জগতের দৃশ্য বা কোনো ফিগার নয়। বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে পিকটোরিয়াল স্ট্রাকচার বা চিত্রগত গঠনের প্রতি এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যময় আঙ্গিক ব্যবহার করে কিউবিস্ট শিল্পীরা শিল্পের স্বায়ত্তশাসিত চরিত্রের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। এই দিক দিয়ে তারা সিম্বলিস্ট ধারার শিল্পীদের কাছাকাছি এবং ১৯শ শতকের শেষ দিকের এসথেটিসিজমের (আর্ট ফর আর্টস সেক) অনুসারী বলে মনে হয়। সিম্বলিস্ট শিল্পীদের মতোই কিউবিস্টদের ছবিতে বাস্তবের কিছু মোটিফ থাকে যার সাহায্যে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক খোঁজা যায়। পিকাসোর সিনথেটিক পর্বের খ্রি মিউজিশিয়ানস’ ছবিতে বাস্তবের প্রতিনিধিত্বকারী মোটিফ হিসেবে দেখা যায় সংগীতের নোটেশন এবং তিন বংশীবাদকের জ্যামিতিক ফিগার। ছবির কম্পোজিশনে রয়েছে ফভিস্টের তুলনায় কঠোর শৃঙ্খলা। বিমূর্ততার দিকে কিউবিজমের যে অপ্রতিরোধ্য যাত্রা তার প্রতি পিকাসো কিংবা ব্রাকের আন্তরিক সমর্থন ছিল না যার জন্য তারা তাদের ছবিতে হরফের লেখা, সাইনবোর্ড ইত্যাদি ব্যবহার করে মূর্ততার প্রকাশ করতে চেয়েছেন প্রতীকের সাহায্যে হলেও। যেমন ১৯২০ সালে আঁকা পিকাসোর Three Musicians ছবিতে কোলাজের ইফেক্ট আনা হয়েছে নোটেশনের ব্যবহার যার উল্লেখ আগে করা হয়েছে। এইভাবে শিল্পের ভূমিকা বাস্তবের প্রতিফলন না আবেগের বিমূর্ত প্রকাশ, এই দুইয়ের মধ্যে ব্রাক ও পিকাসো দোদুল্যমান ছিলেন, এ কথা বলা যায়। তাঁরা চেয়েছেন তাঁদের কাজে বাস্তবের প্রতিফলন হোক, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির ভিত্তিতে, কিন্তু কিউবিজমের আঙ্গিক এমনই যে তার প্রবণতা অর্ধ-বিমূর্ততা (দে মইজেল দাভিনৌ) থেকে বিমূর্ততার (ফিমেল ন্যুড) দিকে যাত্রা ছিল প্রায় অপ্রতিরোধ্য। তাদের অনুসারী যারা, সেই সব কিউবিস্ট শিল্পী বিমূর্ততা গ্রহণ করেছে নির্দ্বিধায়।

কিউবিজমের দ্বিতীয় পর্ব সিনথেটিক কিউবিজমের সূত্রপাত হয় পিকাসোর কাজের মাধ্যমে। ১৯১২ সালে তিনি তৈরি করেন প্রথম কিউবিস্ট কোলাজ Still Life with Caned Chair যেখানে ক্যানভাসে আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হয়েছে ছাপানো কাপড়ের টুকরো এবং ওভাল আকৃতির ক্যানভাসের চারদিকের সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছে রশি দিয়ে। কাপড়ের ওপর যে বেতের চেয়ারের ফর্ম দেখানো হয়েছে এবং এক পাশে বড় হরফে লেখা Jou-এর মধ্যে বাস্তব প্রতিফলনের চেষ্টা রয়েছে। ছবিতে একজন উপবিষ্ট মানুষের অবয়বও শনাক্ত করা যায় অস্পষ্টভাবে যদিও তার পাশের জটিল নকশার অর্থ অত স্পষ্ট নয়। এর পরবর্তী কোলাজে পিকাসো কাপড় বা কাগজের ওপর ছাপা ছবি দিয়ে নয়, বাস্তব বিভিন্ন বস্তুর ভাঙা অথবা টুকরো অংশ সরাসরি ক্যানভাসে সেঁটে চিত্রগত সত্যের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দেখিয়েছেন। Still Life with Caned Chair ছবির ভেতর প্রকৃত বস্তু অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তব অথবা চিত্রগত বাস্তবের প্রতিফলন করতে চেয়েছেন তিনি, কিংবা উভয়ই। তাঁর এই নতুন পদক্ষেপ কোলাজ শিল্পকে নতুন মাত্রা দিয়েছে যদিও বাস্তবের প্রতিফলনে এখানে কল্পনা আর আবেগের মিশ্রণ ঘটেছে অর্থাৎ কিউবিস্ট কোলাজে বাস্তবের প্রতিফলন ও ভাবের প্রকাশময়তা, উভয়েরই সহাবস্থান দেখা যায় যদিও শেষেরটাই ওজনে ভারী বলে মনে হয়। কোলাজ সৃষ্টিতে আবেগ আর কল্পনার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহার করা হয়েছে বেশি। Three Musicians শীর্ষক কোলাজ ছবিটি দেখে বোঝা যায় ১৯১৪ সালে কিউবিস্ট ধারায় ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলেও এর ধারাবাহিকতায় পিকাসো কিছু ছবি এঁকেছেন। পিকাসোর উদ্ভাবিত ‘সিনথেটিক কিউবিজম’-এ বিমূর্ততা থেকে রিপ্রেজেন্টেশনের বা বস্তুভিত্তিক প্রতিফলনের দিকে যাত্রা করা ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোলাজে যে ফর্ম দেখা যায় সেগুলো হুবহু বাস্তবজগৎ থেকে নেওয়া নয়, কল্পনার ভিত্তিতে এবং শিল্পবোধ দ্বারা জারিত করে নির্মাণ। ফ্ল্যাট এবং রঙিন শেপ অলংকৃতভাবে সাজানো হয়েছে যেন ক্যানভাসে ভিত্তি হিসেবে একটি স্ট্রাকচার বা গঠন গড়ে ওঠে যার মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় বস্তু বা ফিগার। সামঞ্জস্যময় করার উদ্দেশ্যে ফর্মের অদলবদল করা এবং সংশ্লিষ্ট চিহ্নের সাহায্য নেওয়া হয়। ছবির জমিনে বস্তুর ফর্মের সমতল বিন্যাসে সৃষ্ট হয় ছবি যার সঙ্গে পৃথকভাবে ফিগারের অথবা বস্তুর কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। দেখে মনে হয় যেন ফর্মগুলো কেটে ক্যানভাসের ওপর পৃথকভাবে সেঁটে দেওয়া হয়েছে। ১৯১৫ সালে আঁকা Harlequin কোলাজকেই পিকাসো মনে করেছেন সিনথেটিক কিউবিজমের সবচেয়ে সরল প্রকাশ। ছবিটির ফর্মের মধ্যে অনৈক্যের সম্পর্ক উজ্জ্বল রঙের অলংকরণ পুষিয়ে নিয়েছে এবং অর্ধ-বিমূর্ততার সৃষ্টি হয়েছে। এই শৈলীরই নতুন নতুন সংস্করণ দেখা যায়। পিকাসোর পরবর্তী পর্বের ছবিতে যেগুলো কিউবিস্ট ধারার অন্তর্ভুক্ত নয়, যেমন তার বিখ্যাত ছবি Guernica কিউবিস্ট ধারার অন্তর্ভুক্ত না হলেও সেই ধারার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য এখানে দেখা যায়।

কিউবিজমের কোলাজ শৈলী যোগ করার পর পিকাসো ভাস্কর্যে কিউবিজমের ব্যবহার করে এই মাধ্যমে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। কোলাজ ধারার ছবির আগেই ১৯১২ সালে তিনি কিউবিস্ট স্কাল্পচার তৈরি করেন। প্রথম যে কিউবিস্ট স্কাল্পচার জনসমক্ষে নিয়ে আসেন সেটি ১৯১৩ সালে তৈরি The guitar। এখানে তিনি প্রচলিত উপাদান যেমন, স্টিল, ব্রোঞ্জ, পাথর কিংবা মাটি ব্যবহার না করে এনেছেন কার্ডবোর্ড, টিন, কাঠ, তার এবং পড়ে পাওয়া অন্যান্য ব্যবহৃত বস্তু, যার সাহায্যে তৈরি করেছেন কিউবিস্ট ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্য কোলাজের মতো আঠা দিয়ে বিভিন্ন অংশ সেঁটে দেওয়ার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। আফ্রিকার ‘ওবে’ মুখোশের সাহায্য তিনি নিয়েছেন কিউবিস্ট ভাস্কর্য নির্মাণে। এইভাবে ভাস্কর্যকে পিকাসো ট্র্যাডিশনাল নির্মাণ সামগ্রীর ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করে দেন। কিউবিস্ট স্কাল্পচারে বাস্তবের প্রতিফলন ঘটেছে অর্ধ-বিমূর্ততায় এবং বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যেই বেশি নির্ভর করে, যদিও বিভিন্ন অংশের উপস্থাপনায় কল্পনাও থাকে যার ফলে প্রতিফলিত বাস্তব হয় শিল্পীর কল্পিত বাস্তব। এ সত্ত্বেও The guitar-এর মতো কিউবিস্ট ভাস্কর্যে কিউবিস্ট চিত্রকলার স্ববিরোধিতা (বাস্তব ও কল্পনা; মূর্ত ও বিমূর্ততার মধ্যে) এর দুর্জ্ঞেয় চরিত্রের মধ্যে দেখা যায়। এই ভাস্কর্য ফ্লাটসদৃশ্য মনে হলেও ফ্লাট নয়, একইভাবে নিরবয়ব ভাসমান মনে হলেও নিরেট ও ভারী বস্তুর চরিত্রসম্পন্ন। শৈলীতে কঠোর সরলতা বৈপরীত্যের মধ্যে সামঞ্জস্যময়তা নিশ্চিত করেছে এই পর্বের ভাস্কর্যে।

জর্জ ব্রাকের শিল্পের বিবর্তন

জর্জ ব্রাক পিকাসোর সমকালেই কিউবিস্ট ধারার ছবি আঁকেন এই ধারার নামকরণ হওয়ার আগেই, কেননা তাঁরা ১৯০৭ সাল থেকে একই চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে যৌথভাবে কাজ করা শুরু করেন। পিকাসোর মতোই জর্জ ব্রাক প্রথমে ইমপ্রেসনিস্টদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। এরপর (১৯০৭) ফভ শিল্পীদের শিল্প পদ্ধতি তাঁকে আকৃষ্ট করে। ১৯০৭-এ পর পিকাসোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তিনি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য একসঙ্গে কাজ করেন। পিকাসো ১৯০৭ সালে আঁকেন Les Demoiselles d’Avignon যা কিউবিস্ট ধারার প্রথম ছবি বলে বিবেচিত, যদিও তখন সেই নামকরণ হয়নি। ব্রাক ১৯০৮ সালে আঁকেন তাঁর Houses at l’Estaque ছবিটি যার জ্যামিতিক বিন্যাসের সঙ্গে পিকাসোর উল্লিখিত ছবির সাদৃশ্য রয়েছে এবং এই ছবিরই সূত্রে পরবর্তী সময়ে কিউবিজম নামকরণ হয়। ১৯০৮ সালে Houses at l’Estaque শীর্ষক ছবিটির মাধ্যমে কিউবিজমে তার অভিষেকের সূত্রপাত, যে সম্বন্ধে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই ছবিটিতে জ্যামিতিক কিউব (ঘনক) ব্যবহারের আতিশয্যের জন্য মাতিস নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে প্যারিস স্যালো-র প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত করার অনুমোদন দেননি, এ কথাও আগে বলা হয়েছে। তিনি ছবিটি প্রত্যাখ্যানের সময় কয়েকবার ‘কিউব’ কথাটি ব্যবহার করেন যার ভিত্তিতে পরে সমালোচকরা এই ধারার নামকরণ করেছেন। যেহেতু পিকাসো এবং ব্রাক ১৯০৪ সাল থেকে একসঙ্গে কাজ শুরু করেন সেই জন্য কিউবিজমের দুটি পর্বেই পিকাসোর পাশাপাশি ব্রাকও অবদান রেখে একই ধারায় ছবি এঁকেছেন, যদিও দু’জনের শৈলীতে কিছু পার্থক্য ছিল। যেমন, ব্রাকের Houses at l’Estaque ছবিতে কিউবিস্ট ফর্ম থাকলেও এবং একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণের পরিধিতে একাধিক দৃষ্টিকোণের ব্যবহার করা হলেও বাস্তবের প্রতিফলন ছিল স্পষ্ট কেননা, বাড়িঘর, গাছ-পালা এই সব ফর্ম শনাক্ত করা গিয়েছে ত্রিভুজ ও আয়তকার জ্যামিতিক বিন্যাস সত্ত্বেও। কিন্তু সিনথেটিক পর্বে এসে ব্রাকের কাজও পিকাসোর মতো অর্ধ বিমূর্ততা থেকে প্রায় বিমূর্ততার দিকে যাত্রা করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ তাঁর The Portuguese শীর্ষক ছবি যেখানে জ্যামিতিক বিন্যাসের জটিলতা থেকে ফর্ম উদ্ধার করে বাস্তবের পরিচয় পাওয়া কঠিন। পিকাসোর Seated female nude এর মতো এই ছবিতেও তলগুলো হেলে পড়েছে এবং রেখার সাহায্যে দুর্ভেয় এক সোপানের সৃষ্টি হয়েছে যা পিরামিডের মতো ঊর্ধ্বমুখী। এই ছবিতে ফিগার ও পটভূমির মধ্যে প্রচলিত সম্পর্কের পরিবর্তে দেখা যায় চিত্রময় (পিকটোরিয়াল) নকশা যার ভেতর ফর্মগুলো সংকুচিত করা স্পেসে বিভিন্ন তলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ব্রাকের এই ছবিতেও পিকাসোর Seated female nude এর মতো একক রঙের (পিঙ্গল) প্রাধান্য দেখা যায় যা ছবির বিষয়কে আরো জটিলতায় ফেলে দিয়েছে এবং বিমূর্ততার দিকে টেনে নিয়েছে। কারণ, রং এখানে বাস্তবের প্রকাশ না করে অনুভবের প্রকাশই করেছে বেশি। ছবিতে কয়েকটি হরফের ও গাণিতিক সংখ্যার ব্যবহার করা হলেও তার ভিত্তিতে বাস্তবের ইঙ্গিত পাওয়া কঠিন। পিকাসোর মতো ব্রাকও বাস্তবতার প্রতিফলনে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এবং নান্দনিকতার আলোকে, বিশ্বাসী হলেও কিউবিজমের জ্যামিতিক পদ্ধতির অপ্রতিরোধ্য যাত্রা তাকেও অর্ধ-বিমূর্ত থেকে বিমূর্ততার দিকে নিয়ে গিয়েছে প্রায় নিজের অজান্তেই। কিউবিজম সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্রাক লিখেছেন, ছবি তৈরির উদ্দেশ্য কাহিনিভিত্তিক বাস্তবের বর্ণনা নয়, চিত্রগত বাস্তবতা সৃষ্টি। অর্থাৎ দৃশ্যমান বাস্তবের চেয়ে চিত্রে উপস্থাপিত বাস্তবই অধিকতর সত্য। কিন্তু তিনি এ-ও স্বীকার করেছেন যে পেইন্টিং এক ধরনের প্রতিনিধিত্বকারীর ভূমিকা পালন করে। উপরের উক্তির পরই তিনি বলেছেন, যা দেখা যায় তা-ই অনুকরণ করা হয় না শিল্পে, দৃশ্যকে সৃষ্টি করাই শিল্পের উদ্দেশ্য। এরপর তিনি বলেছেন বিশুদ্ধ অনুকরণ হতে হলে শিল্পকে বাস্তব দৃশ্য থেকে বিমূর্ত হতে হবে’ (ই ফ্রাই, কিউবিজম, ১৯৬৬)। ব্রাকের এই সব উক্তি থেকে কিউবিজম ধারার ছবিতে বাস্তবের প্রতিফলন ও বিমূর্ততা সম্বন্ধে তাঁর ধারণাতেও পিকাসোর মতো স্ববিরোধিতা দেখা যায়। ব্রাক ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধে যাওয়ার আগে পর্যন্ত পিকাসোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন এবং অ্যানালিটিক কিউবিজম থেকে সিনথেটিক কিউবিজমে উত্তোরণে তার অবদান রাখেন।

ব্রাকও পিকাসোর মতো কিউবিজমের দ্বিতীয় অর্থাৎ সিনথেটিক পর্বে কোলাজ তৈরি করেছেন কিন্তু তাঁর কোলাজ পদ্ধতি ছিল পিকাসোর থেকে উপকরণের ব্যবহারে পৃথক। বলা যায় এটি ছিল পিকাসোর উদ্ভাবিত প্রথম পর্বের কোলাজের পরিশীলিত রূপ। তিনি ক্যানভাসে বিভিন্ন বস্তু আঠা দিয়ে সেঁটে কোলাজ তৈরির পরিবর্তে শুধু ছেঁড়া কাগজের টুকরো সেঁটে দেওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করে কোলাজ তৈরি করেন। এর নামকরণ হয় কাগজের কোলাজ। এগুলো দেখতে সমতলবিশিষ্ট অর্থাৎ টেক্সচারবিহীন। মায়া সৃষ্টিকারী স্পেস ত্যাগ করলেন তিনি তার উদ্ভাবিত এই কোলাজে যদিও একটি কাগজের টুকরো অন্যটির ওপর স্থাপিত হওয়ার ফলে স্পেসভিত্তিক সম্পর্ক সূচিত হলো। ব্রাকের পেপার কোলাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াল এর পদ্ধতির জটিলতা অর্থের দুর্জ্ঞেয়তা। কাগজের টুকরোগুলো কোনো নান্দনিক সূত্রনিরপেক্ষভাবে অথবা বিমূর্ততার ভিত্তিতে সাজানো হয়েছে তার কোলাজে কিন্তু যে বিষয় বা বস্তুর ছবি আঁকা হয়েছে সেঁটে দেওয়া কাগজের ওপর তাদের ফর্ম ও রং অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। Le Courrier কোলাজে ব্রাকের উদ্ভাবিত কোলাজের এই নতুন শৈলীর নিদর্শন দেখা যায় যা দৃষ্টিনন্দন বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। ফুলদানি, ওয়াইন গ্লাস ও ক্যারাফে, সিগারেটের প্যাকেট ও খবরের কাগজের অংশ দিয়ে যে বিষয় তৈরি হয়েছে কোলাজে তা যেন নিরালম্বভাবে চৌকোনা টেবিলের ওপর ঝুলছে। এই সব বস্তুর স্বরূপ সেঁটে দেওয়া রঙিন কাগজের বিমূর্ত বিন্যাসে স্বচ্ছ নকশার আকারে দেখা না গেলেও বেশ অনুভব করা যায়। পিকাসোর কোলাজের তুলনায় ব্রাকের পেপার কোলাজ পদ্ধতিগতভাবে সরল কিন্তু তার অর্থময়তা সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয় না।

ব্রাকের প্রথমদিকের অ্যানালিটিক্যাল কিউবিস্ট ছবিতে যে অর্ধ-বিমূর্ততা দেখা যায় তা পরবর্তী সময়ে বিমূর্ততায় পর্যবসিত হয়। যদিও তিনি এই সব ছবি ফিগারভিত্তিক বা বস্তুভিত্তিক করে এঁকেছেন সে সবের ফর্ম এমনভাবে জ্যামিতিক বিন্যাসের ভেতর প্রচ্ছন্ন যে তা শনাক্ত করা কঠিন। প্রথম দৃষ্টিতে তো বটেই, অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরও জ্যামিতিক বিন্যাসেই চোখ আটকে থাকে, ফর্মের আউটলাইন দেখা গেলেও ফিগার বা বস্তুর আউটলাইন ধরা পড়ে না। প্রায় একই রঙে আঁকার ফলে এই অর্ধ বিমূর্ততা থেকে মূর্ত ফিগার বা বস্তু বের করে আনা আরো কষ্টকর হয়। ডিজাইন হিসেবে অবশ্যই এইগুলো উন্নত মানের কিন্তু সেইসঙ্গে জটিলও। এমন ছবির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে আবার ১৯১১ সালে আঁকা The Portuguese ছবিটির উল্লেখ করতে হয়। মাসেই শহরে এক পানশালায় একজন পর্তুগিজ বাদককে দেখার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্রাক এই ছবিটি আঁকেন। বাদককে হ্যাট পরা অবস্থায় দেখলেও ছবিতে তার ফিগার দেখানো হয়েছে ভেঙেচুরে, বিভিন্ন কৌণিকভায়, যেমন, করা হয়েছে অন্যান্য কিউবিস্ট পদ্ধতির ছবির ক্ষেত্রে। শুধু বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ নয়, বিভিন্ন মুহূর্তে দেখার অভিজ্ঞতা এবং আলো-ছায়ার খেলা প্রদর্শনও ছিল ছবিটির উদ্দেশ্য। যদিও পটভূমিতে পর্দা এবং দেয়ালে স্টিললাইফের ইমেজ আভাসে বোঝা যায়, বাদকের হ্যাটপরা ফিগার শনাক্ত করতে দর্শককে হিমশিম খেতে হবে। ছবিটির ওপরে ডানদিকে পোস্টারের অংশে ‘গ্রান্ড বল’ লেখা যার দ্বারা কম্পোজিশনে প্রাণবন্ততা আনার চেষ্টা করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে ছবিটি যে ক্যাফের দৃশ্য সেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এই সব কৌশল সত্ত্বেও পিকাসোর Seated female nude-এর মতোই ব্রাকের The Portuguese অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজমের পরিণত পর্যায়ের জটিল এক নির্মাণ যেখানে আগের ছবির অর্ধ-বিমূর্ততা প্রায় বিমূর্ততায় পর্যবসিত হয়েছে।

পিকাসোর মতো ব্রাকও সিনথেটিক কিউবিস্ট শৈলীতে ছবি এঁকেছেন যার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কোলাজ ছবিতে শুধু কাগজের টুকরো ব্যবহারের জন্য তার সঙ্গে পিকাসোর কোলাজের যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে সে কথাও বলা হয়েছে। তবে পিকাসো তার Three Musicians শীর্ষক কোলাজে যেমন শুধু রং ব্যবহার করে কোলাজের বৈশিষ্ট্য এনেছেন, ব্রাক সেই পদ্ধতিতে কোনো কোলাজ আঁকেননি। সুতরাং তাঁর পেপার কোলাজ একই পদ্ধতি ও শৈলীর অনুসরণে সীমাবদ্ধ থেকেছে। এখানে তাঁকে পিকাসোর তুলনায় কম উদ্ভাবনপ্রবণ বলে মনে হয়েছে। এর কারণ হয়তো এই যে ব্রাক যুক্তিসংগতভাবে ধীরেসুস্থে কোলাজকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন দৃশ্যগত ঐকা (ভিজুয়াল হারমনি) সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। তার বিপরীতে পিকাসোর কোলাজে ফর্মের পৃথক বৈশিষ্ট্যই প্রাধান্য পেয়েছে। ব্রাকও পিকাসোর মতো ভাস্কর্য তৈরি করেন এবং লিথোগ্রাফ, এনগ্রেভিংস, স্টেইনগ্লাস ইত্যাদির মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। পেপার কোলাজ মাধ্যম ব্যবহারের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বাস্তবের যতটুকু কাছাকাছি আসা যায় তার জন্য আমার ছবিতে আমি অক্ষর ব্যবহার করেছি। তিনি এ-ও বলেছেন, ‘যা দৃশ্যমান তা অনুকরণ করা হয় না, শিল্পের উদ্দেশ্য নতুন কিছু দৃশ্যমান করে তোলা।’ (ই ফ্রাই, ১৯৬৬)।

ব্রাক ফভিজমের উজ্জ্বল উচ্ছ্বসিত রঙের ও প্রসারিত ফর্মের আকর্ষণ থেকে সরে ১৯০৭ সালে সেজাঁর প্রভাবে ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯০৮ সালে স্যালো দি অটোমে প্রদর্শনীতে পাঠানো কয়েকটি ছবিতে সেজাঁর স্ট্রাকচারাল পদ্ধতির অনুসরণ ছিল, যে অপ্রচলিত পদ্ধতি নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতি অঁরি মাতিসের অনুমোদন লাভ করেনি। জ্যামিতিক প্যাটার্নে তিনি প্রথমে ল্যান্ডস্কেপের ছবি আঁকেন। Houses at l’Estaque ছাড়াও এর অন্য দৃষ্টান্ত The Viaduct at L’Estaque (১৯০৮) ছবিটি। মাতিসের মন্তব্যের অনুসরণে পরবর্তী সময়ে আর্ট ক্রিটিক লুই ভক্সশেলে ছবির বর্ণনায় ‘কিউবিজম’ কথাটি ব্যবহার করেন, যদিও তার আগে ১৯০৭ সালে পিকাসো একই পদ্ধতিতে Les Demoiselles d’Avignon ছবিটি এঁকেছেন। পিকাসোর মতো ব্রাক একের পর এক শৈলী নিয়ে নিরীক্ষা করেননি। তিনি দীর্ঘদিন একই শৈলীর ভেতর হেরফের করে ছবি এঁকেছেন। তাঁর Girl with Mandolin (১৯১০) অ্যানালিটিক্যাল কিউবিজম পর্বের একটি ছবি যেখানে অগভীর স্পেস, রঙের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ এবং বহুমাত্রিকতার বৈশিষ্ট্য প্রধান।

কিউবিস্ট শিল্পধারায় পিকাসো না ব্রাক বড় অথবা তাদের কে বেশি সফল, সেই প্রশ্ন দেখা দিলেও পিকাসোর খ্যাতির কাছে ব্রাক যে ম্লান হয়ে গিয়েছেন তার জন্য এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়নি। যৌথভাবে একই শিল্প পদ্ধতির উদ্ভাবন তাঁরা দু’জন করেছেন, এই স্বীকৃতি ছাড়া তারা যে ভিন্ন স্বভাবের শিল্পী এ কথার ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। পিকাসো ১৯১৪-এর পর কিউবিস্ট ধারার অতিরিক্ত অন্যান্য পদ্ধতি ও শৈলী নিয়ে নিরীক্ষার ভিত্তিতে তাঁর শিল্পচর্চায় পরিবর্তন অব্যাহত রেখেছেন। তবে কিউবিস্ট ধারার প্রভাব সামান্যভাবে হলেও পরবর্তী পর্বে কোনো কোনো ছবিতে শনাক্ত করা যায়। যেমন, ১৯৩৭ সালে আঁকা তাঁর বিখ্যাত যুদ্ধবিরোধী ছবি Guernica যেখানে জ্যামিতিক বিন্যাস, বিশেষ করে কৌণিকতার ব্যবহার করা হয়েছে।

পরবর্তী কিউবিস্টগণ ও হুয়ান গ্রিজ

পিকাসো ও ব্রাক যখন যৌথভাবে কিউবিস্ট ধারায় কাজ করছেন এবং সেখানে পরিবর্তন আনছেন তখন থেকেই ফ্রান্স সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিউবিস্ট ধারার অনুসারীরা নতুন পদ্ধতিতে ছবি এঁকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হন। এদের কেউ কেউ কিউবিস্ট ধারাকে আরো সামনে নিয়ে রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন শিল্পধারার সূচনা করেন। পিকাসো ও ব্রাক ছাড়া যেসব শিল্পী কিউবিস্ট ধারায় কাজ করে খ্যাত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন হুয়ান গ্রিজ, আলবার্ত গ্লেইজেস, জা মেটজিঙ্গার (এই দুইজন কিউবিজম নিয়ে একটা বইও লেখেন), রজার দিলা সনায়ে, চার্লস-এডওয়ার্ড জিনারেট, আমেদি ওজেনফেল্ট, রবার্ট ডেলানে, সোনিয়া ডেলানে, ফ্রানটিসেক কুপকা, মার্শেল দুশী, জ্যাক ভিলোঁ, ফ্রান্সিস পিকাবিয়া প্রমুখ শিল্পী। এদের কাজের মধ্য দিয়ে কিউবিজমের বহুমুখী বিস্তার ঘটে। কয়েকটি নতুন ধারার সূচনাও হয় এবং সেসব কেন্দ্র করে শিল্প আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আলোচনায় হুয়ান গ্রিজ সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। তিনি পিকাসো এবং ব্রাকের নিকট সাহচর্যে কাজ করেছেন প্রথম থেকেই। তিনি গর্ব করে বলেছেন, ‘আমি সিলিন্ডার থেকে বোতল সৃষ্টি করতে পারি।’ অর্থাৎ কিউবিজমে বস্তুর বাস্তবতা প্রতিফলিত করা যে খুবই সহজ তিনি তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তিনি অর্ধ-বিমূর্ততা এমনকি প্রায় বিমূর্ততার ভিত্তিতে ছবি এঁকেছেন। The Smoker ছবিতে দেখা যায় ফিগারের মুখকে ভেঙেচুরে জ্যামিতিক বিন্যাসে সাজিয়ে মুখাবয়বের আভাস দেওয়া হয়েছে। গলার নিচের অংশ ছাড়া ফিগারের ওপরের সব অংশই পরস্পর বিচ্ছিন্ন, জিগজ্যাগ পাজলের অংশের মতো সেগুলি দর্শককে একত্র করে সাজিয়ে প্রতিকৃতি আঁকার আহ্বান জানানো হয়েছে যেন। প্রথম পর্বের কিউবিস্ট ছবির তুলনায় হুয়ান গ্রিজের এই ছবিতে যে রং ব্যবহার করা হয়েছে তা উজ্জ্বল যার জন্য ছবিটি পিকাসো ও ব্রাকের অ্যানালিটিক কিউবিক ধারার ছবির মতো গম্ভীর ও নিরানন্দের হয়নি।

অর্ফিজম বা অর্ফিক কিউবিজম

যেসব নতুন ধারা কিউবিজমের ওপর ভিত্তি করে আবির্ভূত হয় তার মধ্যে ‘অর্ফিক কিউবিজম’ বা ‘অর্ফিজম’ একটি। এ ধরনের নতুন ধারাকে বলা হয়েছে কিউবিজমের দলছুট সংস্করণ অথবা অতিরিক্ত প্রকাশ। প্রথম যে দলছুট ধারার আবির্ভাব হয় সেটি সহজেই শনাক্ত করা গিয়েছে, যার নাম ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯১২ সালেই এর আবির্ভাবের কথা ঘোষণা করেন গিওমঁ অ্যাপলনিয়ের। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে, এটি হলো ‘বিশুদ্ধ পেইন্টিং’ যেখানে বিষয় একেবারেই গৌণ’ (গিওমঁ অ্যাপলনিয়ের, ১৯১৩)। এই ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রবার্ট দেলনে, সোনিয়া দেলনে, ফার্নান্দ লেজার, মার্শেল দুর্শাম্প এবং ফ্রান্সিস পিকাবিয়া।

রবার্ট ও সোনিয়া দেলনে : পিকাসো ও ব্রাকের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে দুই ডেলনে রংকে প্রাধান্য দিলেন। উজ্জ্বল রংকে ঘুরন্ত অবস্থায় একে অন্যের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে তাদের ছবিতে। রবার্ট দেলনের (Robert Delaunay) Le Premier Disque (১৯১৪) ছবিতে বিভিন্ন রঙে আঁকা গোলাকার বলয়ের ভেতর অর্ধ-চক্রাকার বৃত্ত দেখা যায় যেগুলো ছোট থেকে বড় হয়ে বর্তুল শেপ তৈরি করেছে। প্রায় বিমূর্ততার ভেতর এই সব রঙিন শেপ ছন্দময় গতির সৃষ্টি করেছে। তিনি তাঁর ছবির বর্ণনা করতে গিয়ে ‘যুগপৎ বৈপরীত্য’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। এটি ছিল ফরাসি রং বিশারদ শেভরিউলের প্রতি তাঁর সচেতন রেফারেন্স। রবার্ট দেলনে এবং রাশিয়ান স্ত্রী সোনিয়া দেলনে (Sonia Delaunay) উভয়েই রঙের ব্যবহারে বিমূর্ততার সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁদের ছবিতে বিমূর্ততার প্রকাশেই রং বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। রবার্ট দেলনে নিও-ক্লাসিসিজম অপটিকস্ ও রঙের এবং আলোর গতির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি এর ভিত্তিতেই আঁকেন Simultaneous Contrasts: Sun and Moon (১৯১৩) যেখানে প্রকাশের প্রধান মাধ্যম ছিল রঙের ছন্দময় কম্পোজিশন। অ্যাপলোনিয়ের দেলনের এই ছবির নাম দেন ‘রঙিন কিউবিজম’, কিন্তু দেলনে তার নিজের দেওয়া নাম ‘যুগপৎ বৈপরীত্য’-ই পছন্দ করেছেন। ১৯১২ থেকে ১৯১৪ সালে সোনিয়া দেলনে অর্ফিক শৈলীতে তাঁর প্রথম ছবি আঁকেন। তিনি কোলাজ ও গ্রাফিকের মাধ্যমেও কাজ করেছেন। এমি ডেম্পসে অফিজেম-এর প্রধান বৈশিষ্ট্যের উল্লেখে নিখুঁত কম্পোজিশন, উজ্জ্বল রং এবং উড্ডীয়মান ঘুরন্ত শেপের কথা বলেছেন। অর্ফিজমের সঙ্গে গ্রিক উপকথার বীণাবাদক অর্ফিউসের সম্পর্ক ছিল। তিনি যেমন সংগীত দ্বারা বন্যপ্রাণী বশে আনতে পারতেন, অ্যাপলেনিয়রের মতে, অর্ফিজমের পদ্ধতিতে আঁকা ছবিও তাদের সামঞ্জস্যময় কম্পোজিশনের মাধ্যমে একই সুরভিত্তিক জাদুময়তার প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম।

ফার্নান্দ লেজার : কিউবিজমের সঙ্গে ফার্নান্দ লেজারের (Fernand Léger) সম্পর্ক ছিল দেলনে দম্পতির তুলনায় আরো ঘনিষ্ঠ। তিনি কিউবিজমের ধারার প্রতি অনুগত থেকেই একটি বিকল্প ধারার সৃষ্টি করেন। ১৯১০ সালে তিনি তাঁর ছবিতে উজ্জ্বল কিন্তু কঠিন জ্যামিতিক ফর্মের ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং ফিগারকে ভেঙেচুরে কিউবের আকার দিয়ে কম্পোজিশন তৈরি করেন। তিনিও দেলনেদের মতো বিশ্বাস করতেন যে পেইন্টিংয়ে বৈপরীত্য সৃষ্টি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাদের মতো তিনি বৈপরীত্য সৃষ্টিতে শুধু রং নয়, ফর্ম ও রেখার ব্যবহারের প্রতিও গুরুত্ব দেন। আলোর প্রাণবন্ততার পরিবর্তে তিনি গুরুত্ব দেন আধুনিক নগর জীবনের উত্তেজনা ও সংঘর্ষে সৃষ্ট প্রাণবন্ত আবহের। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর ছবি থেকে প্রতিনিধিত্বকারী সব মোটিফ বর্জন করে ফর্মের বৈপরীত্য সৃষ্টিকে মুখ্য উদ্দেশ্য করে তোলেন। ক্যানভাসে ফ্লাট স্পেসে টিউব-সদৃশ ফর্ম তৈরি করে একটিকে অন্যের সঙ্গে ছন্দময় ভঙ্গিতে মুখোমুখি করে তিনি বৈপরীত্যের তীব্রতার সঞ্চার করেছেন। ফলে তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে বিশুদ্ধভাবে বিমূর্ত চরিত্রের। কিন্তু তিনি সমকালীন প্রযুক্তিভিত্তিক যন্ত্রসভ্যতার প্রতিও আগ্রহী ছিলেন যার জন্য ১৯১৭-এর পর নাগরিক কাহিনি থেকে ফিরে এসে যে ধরনের কাজ করেন তার জন্য ‘আর্টিস্ট অব মেশিন এজ’ নামে অভিষিক্ত হন। তাঁর ছবিতেই প্রথম শিল্প-কারখানার মেশিন ও যন্ত্রপাতি এবং মোটরগাড়ির মতো যানবাহন ফর্ম হিসেবে গুরুত্ব লাভ করে। ১৯১৩ সালে আঁকা Contrast of Forms তার প্রথম পর্বের ছবি এবং ১৯১৮ সালে আঁকা The Bargeman ছবিতে তাঁর উপাধি ‘আর্টিস্ট অব মেশিন এজ’-এর সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। শেষের ছবিটি অর্ধ-বিমূর্ত যেখানে নদীতে বজরা এবং পটভূমিতে বাড়িঘর দেখানো হয়েছে। বাঁদিকে ওপরে জ্যামিতিক প্যাটার্নের ওপর বজরার চালককে হুইল ধরে রাখতে দেখা যায়। এই ছবিতেও সব ফর্মই তার ট্রেডমার্ক টিউব আকারের এবং বৃত্তাকার। কিন্তু তার মধ্যেই বস্তু ও ফিগারের আদল খুঁজে পাওয়া যায়।

মার্শেল দুশাঁ : মার্শেল দুশাঁ (Marcel Duchamp) বিশ শতকের একজন প্রথম সারির শিল্পী এবং আভা-গার্দ হিসেবে খ্যাতি ও বিরূপ সমালোচনা, দুই-ই কুড়িয়েছেন। ১৯১০ সালে পল সেজাঁর ছবি দেখে আকৃষ্ট হয়ে তিনি কিউবিস্ট শৈলী নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯১৭ সালের মধ্যে তিনি এই শৈলী ত্যাগ করে দাদা ধারার ছবি আঁকা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্যুররিয়ালিজম ধারায়ও কাজ করেছেন। সুতরাং দুশাকে শুধু কিউবিস্ট ধারার শিল্পী বলে বিবেচনা করা যায় না। তাঁর পরবর্তী পর্বের ছবিতে হাস্যরস ও কৌতুকবোধ ছিল প্রবল। তিনি শিল্পের বহিরঙ্গ প্রকাশের তুলনায় তাঁর পেছনের বা অন্তর্নিহিত আইডিয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন যার জন্য তাঁর প্রাসঙ্গিকতা একবিংশ শতাব্দীতেও স্বীকার করা হয়। ১৯১৩ সালে আমেরিকায় আর্মারি প্রদর্শনীতে Nude Descending a Staircase, No. 2  নামে অর্ধ-বিমূর্ত যে ছবিটি প্রদর্শিত হয় সেখানে কিউবিস্ট ধারার প্রভাব দেখা যায় জ্যামিতিক বিন্যাসে। ছবিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল জ্যামিতিক বিন্যাসের ভেতর অর্ধ-বিমূর্ত নারীদের ফিগারে গতিশীলতার সঞ্চার। এই নতুনত্ব সত্ত্বেও ছবিটি তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এক সমালোচক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে যে, এটি যেন নুড়ি পাথরের কারখানায় এক বিস্ফোরণ।’ ছবিটিকে কেন্দ্র করে যে তুমুল আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে তার ভিত্তিতে দুশা রাতারাতি খ্যাতির চূড়ায় উঠে যান।

রজার দে লা ফ্রেসনে : রজার দে লা ফ্রেসনে (Roger de La Fresnaye) কিউবিস্ট ধারার প্রতি অনুগত থেকেই নিজস্ব শৈলী সৃষ্টিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি পৌঁছান ছবির অর্ধ-বিমূর্ত বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে এবং রঙের উজ্জ্বল ব্যবহারের মাধ্যমে। পিকাসো কিংবা ব্রাকের মতো নিরানন্দ এক রঙের বা জটিল ফর্মের ছবি তিনি আঁকেননি, ফার্নান্দ লেজারের মতো টিউবসদৃশ ফর্মও নয়। তাঁর The Conquest of the Air (১৯১৩) ছবিতে দুইজন পুরুষকে জ্যামিতিক বিন্যাসের ভেতর বসে থাকতে দেখা যায় টেবিলের দু’দিকে, তাদের পেছনে শূন্যে ফ্রান্সের পতাকা আর বেলুন উড্ডীয়মান, পটভূমিতে নীল আকাশ। সব কিছু মিলে বৈপরীত্যের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে একতা এবং সামজ্ঞস্যময়তা।

অন্যেরা : জঁ মেতজিঙ্গার (Jean Metzinger) কিউবিজমের শৈলী ব্যবহার করেছেন অলংকরণের উদ্দেশ্যে যার জন্য তাঁর ছবিতে জ্যামিতিক বিন্যাস সত্ত্বেও প্রাধান্য পেয়েছে মুক্ত ভঙ্গির প্রসন্নতা। তিনি সহশিল্পী আলবার্ত গ্রেজের সঙ্গে যৌথভাবে লেখেন ‘অন কিউবিজম’ শীর্ষক বই (১৯১২) যা কিউবিজমের ওপর বিশ্লেষণমূলক প্রথম লেখা। আমেসিও মদিগলিয়ানি (amedeo modigliani) ছিলেন চরমভাবে বোহেমিয়ান। ভেনিস ও ফ্লোরেন্সে শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯১৬ সালে তিনি প্যারিসে চলে আসেন। সেখানে হুয়ান গ্রিস, কিউবিস্ট ভাস্কর জর্জ নিপচিক এবং অন্যান্য কিউবিস্ট শিল্পীর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। যদিও তিনি সক্রিয়ভাবে কিউবিজম ধারার অনুসরণ করেননি (সেই অর্থে কোনো ধারার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল না), পিকাসোর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল, কেননা তিনি তাঁর সাহচর্যে এসে তাঁর উদ্ভাবিত শৈলী দ্বারা সাময়িকভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তাঁর Portrait of Leopold Zborowski (১৯১৭) ছবিতে কিউবিস্ট শিল্পীদের মতো আফ্রিকার মুখোশের ব্যবহার করা হয়েছে ফিগারের মুখাবয়ব আঁকায়। এর ফলে মুখের অভিব্যক্তিতে নিরাসক্ত ও নৈর্ব্যক্তিক ভাব ফুটে উঠেছে। দারিদ্র্য, অক্লান্ত কাজের চাপ এবং পানাসক্তির জন্য অসুস্থ হয়ে তিনি মাত্র ৩৫ বছরে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর কয়েক বছর পরই ইউরোপের অন্যতম সেরা মৌলিক শিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি হয়।

তথ্যসূত্র

  • গিওমঁ অ্যাপলনিয়ের, লেজ পেইন্টে কিউবিজম, ১৯১৩
  • হার্বার্ট রিড, মডার্ন পেইন্টিং, ১৯৫৯
  • ই ফ্রাই, কিউবিজম, ১৯৬৬
  • যে গোল্ডিং, কিউবিজম, ১৯৫৯
  • হিউ অনার ও জন ফ্লেমিং, এ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি অব আর্ট, ১৯৮৪
  • মৃণাল ঘোষ, পাশ্চাত্য শিল্পে আধুনিকতাবাদী আন্দোলন ও ভারতের শিল্পকলা, ২০১৪
  • এমি ডেম্পসে, মডার্ন আর্ট, ২০১৮
  • হাসনাত আবদুল হাই, শিল্পকলার নান্দনিকতা, ২০১৯

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.