সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী নিয়ে দুটো খবর: তাদের উপর প্লাস্টিকের প্রভাব ও সন্তানের মৃত্যুর পর তাদের শোক প্রকাশ

আমরা, মানে বুদ্ধিমান মানুষেরা প্লাস্টিকের সাথে পরিচিত। কিন্তু সামুদ্রিক প্রাণীরা প্লাস্টিক চেনেনা, কাজেই তারা খাদ্য ভেবে প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে। এর ফলে তাদের পেটে প্লাস্টিক পাওয়া যায়, এই প্লাস্টিক অনেক সময়ই তাদের মৃত্যুর কারণ হয়। তবে এখানেই যদি ব্যাপারটা থেমে থাকত তাহলে ফুড চেইনের নিচের দিকের প্রাণী যেমন কাকড়া, ঝিনুক ইত্যাদির মধ্যেই প্লাস্টিক পাওয়া যেত, কেননা মূলত এরাই প্লাস্টিক টুকরো মাইক্রোপ্লাস্টিককে (৫ মিমি এর চেয়ে ছোট প্লাস্টিক টুকরো) খাদ্য ভেবে ভুল করে। কিন্তু প্লাস্টিক পাওয়া যায় ফুড চেইনের উপরের দিকের প্রাণীগুলোতেও। যেমন গত কয়েক বছরে পৌষ্টিক নালীতে প্লাস্টিক আটকে সামুদ্রিক কচ্ছপ, তিমি মাছের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ফুড চেইনের উপরের দিকের প্রাণীগুলো যখন নিচের দিকের প্রাণীগুলোকে খায় তখন নিচের দিকের প্রাণীর ভেতরের প্লাস্টিকও তাদের পেটে চলে যায়, এদিকে সেই খেয়ে ফেলা প্রাণীটি হজম হয়ে গেলেও তার ভেতরের প্লাস্টিক হজম হয়না, আর এভাবে ফুড চেইনের উপরের দিকের প্রাণীগুলোর পেটেও প্লাস্টিক চলে এসেছে। গত বছরের একটি গবেষণায় বিষয়টি উঠে আসে, এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ট্রফিক ট্রান্সফার।

যাই হোক, যে খবরটা পড়ে এত কিছু মাথায় আসল তাই বলা হয়নি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সমুদ্রের তীরে ভেসে আসা মৃত সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীগুলো নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে সাইন্টিফিক রিপোর্ট জার্নালে। গবেষণায় বের হয়ে এসেছে যে, এই মৃত সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীদের প্রত্যেকের পেটেই রয়েছে প্লাস্টিক! ডলফিন, সিল এবং তিমির ১০টি প্রজাতির মোট ৫০টি প্রাণী নিয়ে গবেষণাটি করা হয়। তাদের পেটে থাকা প্লাস্টিক নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক এসেছে পোশাক, মাছ ধরার জাল, টুথব্রাশ ইত্যাদিতে থাকা সিনথেটিক ফাইবার থেকে যেগুলো নাইলন থেকে তৈরি হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক ছাড়াও প্লাস্টিকের বড় টুকরোগুলো এসেছে ফুড প্যাকেজিং ও প্লাস্টিক বোতল থেকে। এই সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীরা বিভিন্ন কারণে মারা গেছে, প্লাস্টিকের কারণেই যে মারা গেছে তা বলা যাবে না। তবে এদের সকলের পেটেই প্লাস্টিক থাকার ব্যাপারটা ভীষণভাবে আশঙ্কাজনক। গবেষণাটি নির্দেশ করছে, আমাদের প্লাস্টিক প্রোডাক্ট এর ব্যবহার কমিয়ে সমুদ্রকে সুরক্ষিত ও পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা উচিৎ, তা না হলে সামুদ্রিক প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকিতে তো পড়বেই, সেই সাথে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যেও তা ক্ষতিকর হবে।

সমুদ্রের তীরে ভেসে আসা মৃত সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী

তথ্যসূত্র:
1. https://www.nature.com/articles/s41598-018-37428-3
2. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0269749117343294

নিউজিল্যান্ডের তীরে একটি নারী বটলনোজ ডলফিনকে তার মৃত বাচ্চাকে টানা কয়েকদিন ধরে বহন করতে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত ডলফিনটি মৃত বাচ্চা প্রসব করেছিল, আর সেই বাচ্চাটাকে এখনও তার মা ত্যাগ করতে পারেনি। নিউজিল্যান্ডের যেখানে এটা দেখা গেছে সেই “বে অফ আইল্যান্ডস”-এ বেশ জনসমাগম হয়। তাই দেশটির ডিপার্টমেন্ট অফ কনজারভেশন থেকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে ডলফিন মা এর জন্য যথেষ্ট জায়গার ব্যবস্থা করা হয় ও তাকে সম্মান দেয়া হয়। দেখা গেছে, ডলফিনটি বারবার তার সন্তানকে ছেড়ে দিচ্ছে, এরপর তার চারদিকে একবার ঘুরে এসে আবার সেই মৃত সন্তানকে ধরে ফেলছে। হয়তো মা আশা করছে যে এবার সন্তানটি একটু নড়াচড়া করবে বা সাঁতার কাটবে, কিন্তু বারবার তাকে হতাশ হতে হচ্ছে। তাছাড়া, ডলফিন মাকে তার সন্তানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেও দেখা গেছে (ওদের ভাষায় আরকি)। তার দলের অন্যান্য ডলফিনরা কয়েকবার তাকে ছেড়ে চলে গেছে, যার কারণে ডলফিনটি যেকোন শিকারি সামুদ্রিক প্রাণী ও মেরিন ভেসেল এর শিকারে পরিণত হতে পারে। সেজন্য ডিপার্টমেন্ট অফ কনজারভেশন থেকে তার খেয়াল রাখা হচ্ছে।

ডলফিন, তিমি ও অরকাদের মধ্যে এরকম ম্যাটারনাল বন্ড বিহ্যাভিয়র এর আগেও দেখা গেছে। কয়েক দিন আগে একটি অরকাকে তার মৃত সন্তানকে তিন মাস ধরে বহন করতে দেখা গেছে। দুই বছর আগে আরেকটি বটলনোজ ডলফিনকে গ্রীসের উপকূলে মৃত সন্তানকে নিয়ে এভাবে শোক পালন করতে দেখা গিয়েছিল। ২০১৫ সালে পর্তুগালের উপকূলে ৪টি স্পটেড ডলফিনকে মৃত শাবককে নিয়ে শোক পালন করতে দেখা যায়। গত বছর জুনে ডলফিন ও তিমির মত সিটাসিনদের এরকম শোকপালনের আচরণ নিয়ে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয় জুলোজি জার্নালে। সেখানে লেখা হয় এই প্রাণীরা তাদের নিজেদের প্রজাতির মৃত বা মৃত্যুশয্যায় থাকা প্রাণীদের জন্য শোকপালন করে, তাদের খেয়াল রাখে, আদর করে, মৃত প্রাণীটি ডুবে যেতে থাকলে তাকে ঠেলে উপরে পাঠায় বা ভাসিয়ে দেয়। মৃত বা মৃত্যুশয্যায় থাকা প্রাণীটির জন্য প্রজাতির অন্য প্রাণীরা একত্রিত হয়, আবার এমনকি সেই মৃত বা মৃত্যুশয্যায় থাকা প্রাণীটির জন্য প্রজাতির কোন কোন প্রাণীকে যৌন উত্তেজনাও বোধ করতে দেখা যায়।

মৃত সন্তানকে বহন করা অবস্থায় মায়ের শোক

তথ্যসূত্র:
1. https://twitter.com/docgovtnz/status/1091172701182541825?ref_src=twsrc%5Etfw%7Ctwcamp%5Etweetembed%7Ctwterm%5E1091172701182541825&ref_url=https%3A%2F%2Fwww.iflscience.com%2Fplants-and-animals%2Fgrieving-mother-dolphin-seen-carrying-her-dead-calf%2F
2. https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0944200618300473?via%3Dihub

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.