শীঘ্রই বের হতে যাচ্ছে সফল ক্যান্সার প্রতিশেধক, অপেক্ষা হিউম্যান ট্রায়ালের

ক্যান্সার কোষকে আক্রমণরত টি-কোষ
খুব সম্প্রতি চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে পাওয়া গেছে এক অবাক করা সাফল্য। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এরকম একটি ক্যান্সার প্রতিষেধক কে ইঁদুরের উপর প্রয়োগ করে অসাধারণ ফলাফল পাওয়া গেছে। আর তাই এখন একে মানুষের উপর প্রয়োগ করার চিন্তা করা হচ্ছে।
 
এই বছরেরই ৩১ জানুয়ারিতে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি এর গবেষকগণ ইঁদুরের উপর সেই ক্যান্সার প্রতিষেধক প্রয়োগের ফলাফলটি সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশ করেন। আমরা জানি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে রক্তের যে কোষ জড়িত তার নাম শ্বেত রক্তকণিকা বা হোয়াইট ব্লাড সেল। তিন রকমের হোয়াইট ব্লাড সেল রয়েছে এর মধ্যে একটি হচ্ছে লিম্ফোসাইট। আবার এই লিম্ফোসাইট কোষগুলোর মধ্যে একাধিক প্রকরণ রয়েছে যারএকটি হচ্ছে T-lymphocyte বা সংক্ষেপে T-cell।
 
ইঁদুরের উপর পরীক্ষার মাধ্যমে গবেষকগণ দেখলেন সরাসরি কোনো টিউমারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উদ্দীপনকারী বিশেষ এজেন্টকে ইনজেক্ট করা হলে আক্রান্তের দেহের টি-সেলগুলো সেই লোকাল টিউমারটিকে চিনতে পারে এবং ধ্বংস করতে পারে এবং সেই সাথে সেখান থেকে দূরে কোন স্থানে সেকেন্ডারি টিউমার কেউ এটি ধ্বংস করে দিতে পারে। এখানে বুঝতে সুবিধার জন্য লোকাল টিউমার কী এবং সেকেন্ডারি টিউমার কী – এ বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। লোকাল টিউমার বলতে বোঝায় ঠিক যেই স্থানে ক্যান্সারটি শুরু হয়েছিল সেই স্থানের টিউমার, অর্থাৎ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে টিউমারটি ব্রেস্ট বা স্তনেই তৈরি হবে। আবার এই ব্রেষ্ট ক্যান্সারের প্রভাবে দেখা যেতে পারে স্তন থেকে দূরবর্তী কোনো স্থানে, যেমন ফুসফুসে। ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারণে যদি ফুসফুসের মত দূরবর্তী কোন স্থানেও টিউমার তৈরি হয়ে যায় এক্ষেত্রে এই ফুসফুসে তৈরি টিউমারটিকে বলা হবে সেকেন্ডারি টিউমার বা সেকেন্ডারি ক্যান্সার বা সেকেন্ডারি মাস। অর্থাৎ, গবেষকগণ দেখলেন যে একটি স্থানে অর্থাৎ যেখানে ক্যান্সারের উৎপত্তি হয়েছে সেই স্থানে এই দুই প্রতিরোধ ক্ষমতা উদ্দীপনকারী এজেন্টকে ইনজেক্ট করা হলে দূরে যে স্থানে ক্যান্সারটি ছড়িয়ে গেছে সেটাকেও নির্মূল করা সম্ভব।
 
আক্ষরিক অর্থে একে ভ্যাক্সিন বা টিকা বলা যায় না। কিন্তু এই দুই এজেন্ট মিলে আক্রান্তের শরীরে একরকম ইমিউন রেসপন্স বা প্রতিরোধী সাড়াদান এর উদ্ভব ঘটায়, যা খুব সহজেই ইনজেকশন প্রদানের মাধ্যমে সম্ভবপর হচ্ছে। আর তাই গবেষকগণ এর নাম দিয়েছেন ক্যান্সার ভ্যাক্সিন।
 
সাধারণত টি-সেল গুলো ক্যান্সার টিউমার এর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে না, কারণ এ ক্যান্সার-টিউমারগুলোকে দেখতে অনেকটাই সাধারণ সুস্থ কোষগুলোর মতোই অথবা এই ক্যান্সার-টিউমারগুলো এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে যার ফলে টি-সেলগুলো এদের সনাক্ত করতে পারে না।
 
বর্তমানে যে এন্টিবডিভিত্তিক চিকিৎসা প্রচলিত রয়েছে সেগুলো খুব নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সার কোষকেই টার্গেট করতে পারে। এর ফলে সেই চিকিৎসাটি সকল রকমের ক্যান্সার সেলের ক্ষেত্রে সুফল আনতে পারেনা। খুব সম্প্রতি CAR T-cell থেরাপি নামে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য আরেকটি চিকিৎসা পদ্ধতি অনুমোদিত হয়েছে। কিন্তু এই বিশেষ চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর ইমিউন সেল বা রোগপ্রতিরোধী কোষগুলোকে জেনেটিকালি মোডিফাই করিয়ে নিতে হয়।
 
আর এজন্যই এই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এই আবিষ্কারটি অসাধারণ, যেখানে দুটো মাত্র এজেন্ট এর ইনজেকশনের ফলেই ইঁদুরের টি-সেলগুলো নিকটবর্তী ও দূরবর্তী ক্যান্সার কোষগুলোকে চিহ্নিত করে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া অনেক ধরণের ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই এই চিকিৎসাটি ফলাফল দিচ্ছে। সমগ্র ক্যান্সার চিকিৎসার ইতিহাসে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলাফল গুলোর মধ্যে এই বিশেষ চিকিৎসাটিই লিম্ফোমার ক্ষেত্রে ৯৭% কিওর রেট বা সুস্থতার হার দেখাতে পেরেছে।
 
এখন গবেষকগণ লিম্ফোমা এর একটি প্রকরণের ( low-grade B-cell Non-Hodgkin) ক্ষেত্রে এই ইনজেকশন মানুষের ক্ষেত্রে কী প্রভাব ফেলে তার মূল্যায়ন করবেন। এটি নিয়ে গবেষণার প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালের লিডার এবং ইঁদুর নিয়ে বের করে সেই গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক ডঃ রোনাল্ড লেভি জানান, তারা এই বছরের শেষের দিকে ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে এই বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতিটি পরীক্ষা করে দেখবেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী রোগীকে পরীক্ষাটি করবেন। এক্ষেত্রে প্রথমে নিম্নমাত্রার রেডিয়েশন থেরাপি দেয়া হবে যাতে তার ফলে কিছু ক্যান্সার কোষ দুর্বল হয়ে যায়। এই কোষগুলো দুইবার ইনজেকশন দেয়া সেই ট্রিটমেন্টের পরেও থেকে যায়।
 
এই পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য হবে মানুষের জন্য ইনজেকশন গুলোর সর্বোত্তম মাত্রা বা ডোজটি বের করা এবং এই চিকিৎসার সাইডএফেক্ট গুলো কী তা জানা। লেভি জানান, “এক্ষেত্রে যে দুটো ড্রাগকে মানুষের মধ্যে ইনজেক্ট করা হচ্ছে এগুলো দুটো কোম্পানি থেকে নিয়ে আসা। আর ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে এগুলো মানুষের ক্ষেত্রে নিরাপদ। এই পরীক্ষায় আমরা মানুষের ক্ষেত্রে এই দুটো ড্রাগের কম্বিনেশনে কি সাইডএফেক্ট পাওয়া যায় সেটাই পরীক্ষা করে দেখতে চাই।”
 
এই চিকিৎসার একটি অংশ হচ্ছে anti-OX40 নামে একটি এন্টিবডি যা CD4 T-cell এবং CD8 killer cell-কে সক্রিয় করে। CD4 T-cell হচ্ছে একটি সাহায্যকারী কোষ যা অন্যান্য রোগ প্রতিরোধী কোষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। আর অন্যদিকে CD8 killer cell রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ এর মাধ্যমে টার্গেটেড ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে।
 
এই চিকিৎসার আরেকটি উপাদান হচ্ছে সিন্থেটিক ডিএনএ এর একটি ছোট স্ট্র্যান্ড যা রোগ প্রতিরোধী কোষকে এক ধরনের সেল সারফেস প্রোটিন তৈরি করতে নির্দেশ দেয়। এই প্রোটিনটির নাম হচ্ছে TLR9 ligand। এটি শরীরে এন্টিবডি উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেয় এবং একটি বিশেষায়িত স্মৃতিকোষ বা স্পেশালাইজড মেমোরি সেল তৈরি করে যার কাজ হচ্ছে এরকম হুমকিস্বরূপ ক্যানসার কোষ যদি ভবিষ্যতে পুনরায় তৈরি হয় তাহলে এটি খুব দ্রুত এব্যাপারে সতর্ক করতে পারে।
তথ্যসূত্র:
১। সায়েন্স ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত ইঁদুর নিয়ে গবেষণার পেপারটি – http://stm.sciencemag.org/content/10/426/eaan4488
২। ইতিমধ্যে প্রচলিত এন্টিবডিভিত্তিক ক্যান্সার চিকিৎসা – https://en.wikipedia.org/wiki/Cancer_immunotherapy
৩। CAR T-cell থেরাপি – https://www.cancer.gov/about-cancer/treatment/research/car-t-cells
৪। Stanford Non-Hodgkin Lymphoma Vaccine Study – http://med.stanford.edu/cancer/trials/vaccine.html
৫। কী বলছেন ডঃ রোনাল্ড লেভি – https://www.sfgate.com/bayarea/article/Chemotherapy-free-cancer-vaccine-moves-from-12777406.php
৬। OX40 এন্টিবডি সম্পর্কে জানতে – https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2729757/

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.