শুরু হল মানবভ্রূণের ডিএনএ এডিটিং এর বিতর্কিত অধ্যায়

এটাই প্রথমবারের মত মানবভ্রূণে ডিএনএ পরিবর্তন করার প্রক্রিয়া

মানুষের ডিএনএ কি এডিট বা পরিবর্তন করা উচিৎ? এটা আমাদের বর্তমান সময়ের একটি অন্যতম বিতর্কিত প্রশ্ন। কখনও কখনও কেবল এই প্রশ্নের উপর ভিত্তি করেই অনেক গভীর এবং তুমুল তর্কাতর্কি ঘটে যেতে দেখা গেছে।

ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (NPR) অনুসারে, একজন সুইডিশ সাইন্টিস্ট এটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। স্টকহোম এর ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজিস্ট ফ্রেডরিক ল্যানার সকলের সামনে পাবলিকলি স্বীকার করেছেন যে তিনি ইতিমধ্যেই হেলথি হিউম্যান এমব্রায়ো বা সুস্থ মানব ভ্রূণের জিন এডিটিং এর কাজ শুরু করে দিয়েছেন এবং হাইপোথেটিকালি বলা যায় এর জিন এডিটেড ভ্রূণ থেকে একটি শিশুর জন্মও হওয়া সম্ভব। আর এর চেয়েও বড় কথা হল, এখন বোঝাই যাচ্ছে যে তিনিই যে একাই এরকম বিতর্কিত কাজটি করছেন এটাও নিশ্চিন্ত ভাবে বলার কোন উপায় নেই। অনেক বেশি সম্ভাবনা আছে যে, এরকম বিতর্কিত কাজটি আরও অনেক বিজ্ঞানীই করে যাচ্ছেন।

পূর্বে কিছু চাইনিজ রিসার্চারদের আনভায়াবল হিউম্যান এমব্রায়ো এর জিন এডিটিং এর কাজের রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল। আনভায়াবল হিউম্যান এমব্রায়ো হল সেই সব ভ্রূণ যেখান থেকে মানুষের জন্ম হওয়া সম্ভব নয়। গত বছর কিছু রিসার্চ পেপার সহ এই খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল। রিসার্চ পেপারগুলোর মধ্যে একটিতে জানানো হয় যে, গবেষকগণ এই হিউম্যান এমব্রায়োগুলোকে এইচ আই ভি রেজিস্টেন্ট বানাতে বা এদের মধ্যে এইডস এর জীবাণু প্রতি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এই জিন এডিটিং করেছিলেন।

যাই হোক, এই গবেষণার সবগুলোই হয়েছিল অনেক গোপনে, আর এটাও বোঝার কোন উপায় ছিল না যে এই গবেষণায় কোন ভায়াবল হিউম্যান এমব্রায়ো, অর্থাৎ যেসব এমব্রায়ো থেকে  সুস্থ শিশুর জন্ম হতে পারে সেইসব এমব্রায়ো ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা। অনেকের মধ্যে এটা নিয়ে সন্দেহও ছিল।

অন্যদিকে, ল্যানারই প্রথমবারের মত মুক্তভাবে এবং পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছেন যে তিনি ভায়াবল হিউম্যান এমব্রায়ো বা সুস্থ শিশুর জন্ম সম্ভব এমন ভ্রূণকে জিন এডিটিং এর কাজে ব্যবহার করছেন। ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও এর একজন রিপোর্টারকে ল্যাবরেটরিতে জিন এডিটিং প্রক্রিয়া দেখতে দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সেই রিপোর্টারকে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) এর একটি হিউম্যান এমব্রায়ো বা মানবভ্রূণে CRISPR/Cas9 উপাদানকে ইনজেক্ট করতে দেখানো হয়েছে। এই CRISPR/Cas9 হল একটি শক্তিশালী জিন এডিটিং টুল যার দ্বারা জেনেটিক্স এর অসাধারণ সব কাজ করা সম্ভব হয়েছে এবং যা বর্তমান জেনেটিক্সকে পৌঁছে দিয়েছে তার সর্বোচ্চ শিখড়ে।

এই ক্রিসপারের আছে কোন জেনেটিক কোডের প্রতিটি ক্ষুদ্রতম অংশকে কেটে বের করে নতুন অংশ দিয়ে সেটাকে রিপ্লেস করার দ্রুত এবং অতি সূক্ষ্ম কার্যক্ষমতা। এই জিন এডিটিং টেকনিকের মাধ্যমে হাইপোথেটিকালি মানুষের জিনোমকে কোন রোগ বা কন্ডিশনের প্রতি প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করে সেই জিনোমটিকে উন্নত করা যায়।

ল্যানার বলেন, তিনি আশা করছেন যে ক্রিসপার ব্যবহার করে তিনি নতুন ইনফারটাইলিটি ট্রিটমেন্ট বা বন্ধ্যাত্ব সমস্যা এর নতুন চিকিৎসা আবিষাক্র করতে সক্ষম হবেন। এছাড়াও তিনি আশা করছেন যে এই গবেষণার দ্বারা তিনি এমব্রায়োনিক স্টেম সেল সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন, যে স্টেম সেল থেকে মানবদেহের প্রায় সকল ধরণের কোষই তৈরি করা সম্ভব।

ল্যানার NPR কে জানান, “আমরা যদি বুঝতে পারি যে কিভাবে এই প্রাথমিক কোষগুলো এমব্রায়ো বা ভ্রূণে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে সেই জ্ঞান আমাদেরকে ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস, পারকিনসন’স, বিভিন্ন ধরণের অন্ধত্ব সহ আরও বিভিন্ন ধরণের রোগের আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় আমাদেরকে সহায়তা করবে।”

যাই হোক, এই গবেষণার সমালোচকরাও চুপ করে ছিলেন না। সমালোচকগণ দাবী করেন, এই গবেষণার ফলে দুর্ঘটনাবশত মানবভ্রূণগুলো পরবর্তী ফিটাল ডেভেলপমেন্টের ধাপে চলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মানবভ্রূণের ডেভেলপমেন্টের একটা নির্দিষ্ট দশা অতিক্রমের পরে একে পারসন বা ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এজন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযাযী মানবভ্রূণের ডেভেলপমেন্টের প্রথম ১৪ দিন পর এর ইন ভিট্রো রিসার্চ করা আইনত নিষিদ্ধ। যাই হোক, এক্ষেত্রে ল্যানার বলেছেন, এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই, তার রিসার্চ গ্রুপটি কোন এমব্রায়োকেই ডেভেলপমেন্টের ১৪ দিন সময় অতিক্রম করতে দেবে না।

 

এখানে স্টেম সেলকে দেখানো হয়েছে, একে মেডিকেল রিসার্চের ভবিষ্যৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। ক্রেডিট: এলেনা পাভলোভিচ/ শাটারস্টক 

গত ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন ডিসি এর একটি গ্লোবাল সামিট বা আন্তর্জাতিক সমিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, কোন হিউম্যান এমব্রায়ো যা একজন ব্যক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে তাকে মোডিফাই বা পরিবর্তিত করা অবৈধ। কিন্তু, অনেক রিসার্চ গ্রুপই ভায়াবল হিউম্যান এমব্রায়ো এর উপর জিন এডিটিং এক্সপেরিমেন্ট করার অনুমতি চাইছেন।

যুক্তরাজ্যের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউট সম্প্রতি  ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি কর্তৃক এই জিন এডিটিং এর অনুমতি লাভ করেছে। বিশ্বে এরকম অনুমতিদান এটাই প্রথম, এক্ষেত্রে পোস্ট ফার্টিলাইজেশনের ৭ম দিনের মধ্যে ভ্রূণটিকে হত্যা করতে হবে।

এই ধরণের গবেষণার উপকার সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। তাত্ত্বিকভাবে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোন ডেভেলপমেন্টাল শিশুর জন্মের পূর্বেই তার ভবিষ্যতে দেখা দেয়া জেনেটিক ডিজর্ডার বা জিনগত সমস্যাগুলোকে এডিট করে বাদ দেয়া সম্ভব। আর এর মাধ্যমে তাদেরকে সারাজীবনের যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই দেয়া সম্ভব।

কিন্তু ক্রিসপারের একটি দুর্ভাগ্যবশত হওয়া ভুল একটি ডিএনএ এররও ঘটাতে পারে, যার ফলে মানুষের মাঝে দেখা দিতে পারে সম্পূর্ণ নতুন একটি অসুখের। আবার নিজের পছন্দ মত ভাল ভাল জেনেটিক কোড ব্যবহার করে তৈরি করা “ডিজাইনার বেবিজ” এর ধারণাটি ইউজেনিক্স এর ধারণাকে নির্দেশ করে যা বিজ্ঞানমহলে প্রচণ্ড সমালোচিত।

ল্যানার NPR কে জানান, “এটা হালকাভাবে নেয়ার মত কোন প্রযুক্তি নয়। আর তাই অবশ্যই আমি এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যক্তির এসথেটিক পারপাজ বা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ভ্রূনের ডিএনএ এডিট করা বা ডিজাইনার বেবিজকে ডিজাইন করার কোন রকম চিন্তার বিরুদ্ধে থাকব।”

 

 

তথ্যসূত্র:

  1. http://www.npr.org/sections/health-shots/2016/09/22/494591738/breaking-taboo-swedish-scientist-seeks-to-edit-dna-of-healthy-human-embryos
  2. http://www.nature.com/news/gene-editing-research-in-human-embryos-gains-momentum-1.19767
  3. http://www.nature.com/news/second-chinese-team-reports-gene-editing-in-human-embryos-1.19718
  4. https://www.sciencenews.org/article/new-era-human-embryo-gene-editing-begins
  5. http://www.iflscience.com/health-and-medicine/secret-meeting-scientists-discuss-creating-synthetic-human-genome-fuels/
  6. http://www.nature.com/news/uk-scientists-gain-licence-to-edit-genes-in-human-embryos-1.19270
  7. http://www.nationalacademies.org/gene-editing/gene_167925

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.