ভাজা-পোড়া খাবার কি আসলেই ক্যান্সার ঘটায়?

ক্যান্সার নিয়ে গত ৫০ বছরে অনেকেই অনেক সময় নষ্ট করেছেন সায়েন্স হেডলাইন গুলো ক্লিক করতে করতে এবং আপনি হয়তো সন্দেহ করাই শুরু করে দিয়েছেন যে ভাজা-পোড়া খাবার ক্যান্সারের কারণ। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ধারণা সম্প্রতি বেশ প্রচার হচ্ছে—এই ধারনা হচ্ছে যে পোড়া বা অতিরিক্ত রান্না করা খাবারে ভয়ানক কার্সিনোজেন (যে সব পদার্থ ক্যান্সার ঘটায় তাদেরকে কার্সিনোজেন বলা হয়) থাকে। তো এটা কি সত্যি?

আপনাকে যদি এক প্লেট  আগুনে সেঁকা উপরের স্তর পুড়ে যাওয়া বার্বিকিউ খেতে দেওয়া হয়, এটি খেতে হয়তো আপনি দুইবার ভাববেন। একটা সাধারণ ধারণা তৈরি হয়েছে যে এই সব প্রায় পোড়া কালো খাবার খেলে ক্যান্সার হয়। যখন খাবার রান্না করা হয় উচ্চ তাপমাত্রায় একটা নির্দিষ্ট অণু গঠিত হয় যা এক্রিলামাইড নামে পরিচিত। এই রাসায়নিকটিকে আমরা সম্ভাব্য বিষ বলেই জানি এবং এর উপাদান হিসেবে এর মধ্যে থাকে কার্সিনোজেন। এটা খাবারের সাথে গ্রহণ করা এবং ক্যান্সার তৈরি হওয়া এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক এখনো অনেকটা  কম স্পষ্ট।

bbqkebobs2

২০০২ সালে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ আবিষ্কার করেন, কোন খাবার যদি ১২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রান্না করা হয় তাহলে তার ফলে তা বেশ অনমনীয় হয় এবং এক ধরণের কেমিকেল উপাদান তৈরি হয়। আর এই উপাদানটি হলো এক্রিলামাইড। এই রাসায়নিকটি উৎপাদন হয় এসপারাজিন (একটি নন এসেনশিয়াল এমাইনো এসিড) এবং নির্দিষ্ট চিনি (যেমন ফ্রুকটোজের) বিক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে এইটি কাঁচা বা সেদ্ধ খাবারে পাওয়া যায়  না।

এক্রিলামাইডের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে জানা হয়েছিল একটি রেলওয়ে টানেলের নিচে। প্রায় ২০ বছর আগে নির্মাণ শ্রমিকরা হল্যানডাস শৈলশিরা বরাবর সাউদার্ন সুইডেনের বিজার পেনিনসুলার উপরে টানেলে কাজ করছিল । সে সময় কাছাকাছি স্থানীয় গরুগুলো মধ্যে কোন এক অজানা উপসর্গ দেখা যায়, সেগুলো চারদিকে টালমাটাল করছিল এবং কিছু কিছু মারা গিয়েছিল। এর ফলে এই বিষয়ে তদন্ত করার অনুরোধ জানানো হয়। তদন্তে দেখা গেল গরুগুলো দুষিত জলধারার পানি পান করে এবং এই পানি বিষাক্ত অণু এক্রিলামাইড দিয়ে বিষক্রিয়া হয়।

নির্মাণ শ্রমিকরা পলিমার, পলিএক্রিমাইড ফাটল সিল করার জন্য ব্যবহার করে, এটা বেশ নিরাপদই ছিল। কিন্তু পলিমার-গঠন বিক্রিয়াটি অসম্পূর্ণ ছিল, তাই কিছু অ-বিক্রিয়াশীল এক্রিলামাইড থেকে যেত। শ্রমিকদের রক্তে অনিরাপদ এক্রিলামাইড কত মাত্রায় ছিল তা পরীক্ষা করা হয় এবং পরীক্ষা করা হয় তাদের রক্তও যারা এই এক্রিলামাইডের সংস্পর্শে আসেনি। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যারা শিল্পপণ্য উৎপাদনকারী এক্রিলামাইডের সংস্পর্শে এসেছেন তাদের রক্তে এক্রিলামাইডের মাত্রা অবিশ্বাস্য রকমের বেশী।

প্রথমত মনে হতো বার্গারই এর উৎস। এর পর এক্রিলামাইডের উচ্চমাত্রা পাওয়া গেল আলুর পণ্য গুলোয় যেমন ফ্রাইড পটাটোতে, এবং কফিতে। এর পর পরিষ্কার হওয়া গেল এক্রিলামাইড গঠন করে কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারে বেশী, সেই তুলনায় আমিষ বা প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারে কম। এটা নতুন আবিষ্কার কিন্তু এক্রিলামাইড রান্নার পদ্ধতির কারনেই গঠন করে, এটা অবশ্য রান্না আবিষ্কার হওয়ার সময় থেকেই।

1-doesburnedfo

আগেই বলা হয়েছে যে এক্রিলামাইড গঠিত হয় প্রাকৃতিক এমাইনো এসিড এসপারাজিন এবং কিছু কার্বোহাইড্রেটের বিক্রিয়ার মাধ্যমে। কাঁচা বা সিদ্ধ করা খাবারে এক্রিলামাইড পাওয়া যায় না। দুগ্ধ জাতীয়, মাংশ বা মাছ জাতীয় খাবারে খুবই কম এক্রিলামাইড থাকে। খাদ্য বস্তুটি  ওর্গানিক হোক বা না হোক এটা বিষয় নয়। ধুমপান গ্রহণ করার সময়ও এক্রিলামাইড গঠিত হয়।

যখন বিজ্ঞানীরা এক্রিলামাইডের উৎস আবিষ্কার করলেন, তারা নির্দিষ্টভাবে বলেননি যে কার্সিনোজেন মানুষের মধ্যে খাবারের সাথে যায় কি না। ২০১৫ সালে অনেক তথ্য ঘাটাঘাটি করে একটি রিভিউ প্রকাশ পায় তাতে বলা হয় এক্রিলামাইড সাধারণ ক্যান্সারের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। যদিও কিছুটা যুক্ত থাকে কিডনি ক্যান্সার এবং এনড্রোমেট্রিয়াল এবং ওভারিন ক্যান্সারে যারা কখনোই স্মোকিং করে নি তাদের মধ্যেও।

বার্বিকিউতে ফিরে আসি, এখানে অন্য একটা কেমিকেল আছে যেটা উদ্বেগের কারন। এদের সাধারণত দুইটা শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, পলিসাক্লিক এরোমেটিক হাইড্রোকার্বন (PAHs) যেমন ন্যাপথলিন এবং বেঞ্জোপিরিন। আরেকটা হচ্ছে হেট্রোসাইক্লিক এমাইনিস(HCAs)। PAHs গঠিত হয় রান্না করতে গিয়ে আগুনে মাংশের চর্বি এবং রস ক্ষরণে, এবং HCAs উৎপন্ন হয় রান্নার সময় অণুর বিক্রিয়ার এর মধ্যে থাকে এমাইনো-এসিড ও সুগার।

প্রাণীদের পরীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক যা এই ক্যান্সারের সাথে যুক্ত, কিন্তু মানুষের প্রায় পোড়া মাংশ খাওয়ার তুলনায় অনেক বেশী মাত্রায় প্রকাশিত হয়। কিচ্ছু গবেষণায় দেখা গেছে পোড়া, ভাজা বা বার্বিকিউ করা মাংশ খাওয়া এই ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশ উচ্চ মাত্রার কিন্তু সেটা প্রমাণ করা কঠিন।

আপনি যদি সত্যিই খাবার নিয়ে চিন্তিত হোন, তাহলে যুক্তিপূর্ণ রান্না করা খাবারের পদ্ধতি পরিবর্তন করুন। ভাজা পোড়া খাবারের তুলনায় মাইক্রোওয়েব ওভেনে সিদ্ধ করা খাবার খান এবং মাংসের তুলনায় সবজি বেশী খান। এতে অবশ্য খাবারটি ভাল স্বাদ করবে না,  গ্রিল, টোস্টিং বা বেকিং কররা সময় প্রচুর অণু উৎপন্ন হয়,  অবশ্য এতে খাবারের ফ্লেভার বৃদ্ধি পায়। মাংশ গ্রিল করার আগে যদি বিয়ার দিয়ে মেরিনেট করে রাখা যায় এতেও ক্যান্সার ঘটানো উপাদানের মাত্রা কমে যেতে সাহায্য করে। কম মাংশ খান, প্রচুর ফল, সবজি এবং সকল শস্য খাদ্য খেতে পারেন, এগুলো এক্রিলামাইড থাকে না। এটাই হচ্ছে সহজ সমাধান স্বাস্থ্যকর ডায়েটের জন্য।   _98625d42-8c47-11e5-8626-d6ed0b59308e

তাহলে খাবার কিভাবে রান্না করা উচিত? খাবার রান্না করা উচিত হয় যখন এটা হলুদ রঙ ধারণ করবে, কিন্তু ব্রাউন বা কালো যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যদিও বিজ্ঞানীরা এক্রিলামাইডের উৎস সনাক্ত করেছে, তারা এভাবে রান্না করা খাবার গ্রহণের মাত্রা কার্সিনোজেন মানুষের জন্য নির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। ২০১৫ সালের রিভিউ তথ্যে উপসংহারে আসেন খাদ্যতালিকাগত এক্রিলামাইড সাধারণ ক্যান্সারের ঝুকির সাথে সম্পর্কিত নয়।

 

তথ্যসূত্র:

  1. http://www.worldhealth.net/news/does-burned-food-really-give-you-cancer/
  2. http://www.kalerkantho.com/online/lifestyle/2015/11/18/292004
  3. http://medicalxpress.com/news/2016-08-food-cancer.html
  4. http://www.seeker.com/can-burnt-food-really-give-you-cancer-1998512788.html

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.