এই প্রথম রোগীর নিজস্ব কোষ থেকে তৈরি করা হল থ্রিডি প্রিন্ট করা হৃদপিণ্ড!

“দি আইল্যান্ড” মুভিটা দেখেছেন? ২০০৫ সালে এই সায়েন্স ফিকশন ঘরানার চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেয়েছিল। এই গল্পের পটভূমি হচ্ছে ২০১৯ সালের। এই গল্পে দেখানো হয়, বাইরের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি কম্পাউন্ডে কিছু মানুষ বাস করে (যাদের মধ্যে গল্পের প্রধান নায়ক ও নায়িকাও আছেন)। এই লোকদেরকে বলা হয়, বাইরের জগৎ এতটাই দূষিত যে সেখানে মানুষ বেঁচে থাকতে অক্ষম। তবে কেবলমাত্র একটি দ্বীপ রয়েছে যেখানে মানুষ বাস করতে পারে। কম্পাউন্ডের ভেতরে থাকা লোকদের কাছে সেই দ্বীপটি স্বর্গের মত। প্রতি সপ্তাহে সেই কম্পাউন্ডে লটারি হয়, আর সেই লটারিতে যে জেতে সে সেই দ্বীপে বাস করবার অনুমতি পায়।

কিন্তু গল্পের নায়ক, লিংকন সিক্স ইকো একসময় বুঝতে পারে যে এইসব বাইরের দূষিত দুনিয়া, স্বর্গের মত দ্বীপের গল্প সব ভাওতা। তারা হচ্ছে পৃথিবীর কিছু ধনী মানুষের ক্লোন, যাদেরকে একটি ক্লোনিং ইন্ডাস্ট্রি সেই সব ধনীদের লাইফ ইনশ্যুরেন্স হিসেবে ব্যবহার করে। সেই সব ধনী ব্যক্তির অর্থের বিনিময়ে একটি ক্লোনিং ইন্ডাস্ট্রি তাদেরকে তৈরি করে একটি কম্পাউন্ডে রেখে বাইরের বিশ্বের থেকে আলাদা করে রেখেছে। যখন এই ক্লোনিং ইন্ডাস্ট্রির ধনী ক্লায়েন্টরা অসুস্থ হয়, অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়, বা সন্তানের প্রয়োজন হয় তখন এইসব ক্লোনদেরকে লটারিতে জেতার নাম করে বের করে আনা হয় ও তাদের শরীরকে অরগান ডোনেশনের জন্য অরগান হারভেস্টিং, সন্তান ধারণের জন্য সারোগেট মাতৃত্বের জন্য ব্যবহার করা হয়।

ক্লোনদের শরীরের অঙ্গ ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য ব্যাবহার করার সুবিধা হল বায়োকম্প্যাটিবিলিটি, কারও শরীরের সাথে তার ক্লোনের শরীরের অঙ্গ সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়, তার ক্লোনের শরীরের অঙ্গ ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনে ব্যবহার করায় প্রত্যাখ্যান বা রিজেকশনের কোন ঝুঁকি থাকে না। একদম পারসোনালাইসড বা ব্যক্তি-নির্দিষ্ট অঙ্গ পাওয়া যাচ্ছে, এই ব্যবস্থায়। কিন্তু ভেবে দেখুন, এই প্রক্রিয়ায় একজনের জীবন বাঁচাতে নতুন একটি জীবন সৃষ্টি করা, ও প্রয়োজনে তাকে হত্যা করাও মানব হত্যা। এটি অমানবিক ও অনৈতিক।

সেই মুভিটা না দেখা থাকলে দেখে নিতে পারেন। সেই বিষয়ে আর কিছু বলছি না। তবে যে কারণে এই ক্লোনিং এর ব্যবস্থাটি করা হয়েছিল সেই বায়োকম্প্যাটিবিলিটির বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের হৃদপিণ্ডের ট্রান্সপ্ল্যান্টের কথাই ধরুন। বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগ হল নারী ও পুরুষের মধ্যে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ, অনেক রাষ্ট্রে মৃত্যুর প্রধান কারণই হৃদরোগ। এই রোগের অন্তিম পর্যায়ে হার্ট ফেইলিউরের ক্ষেত্রে হৃদপিণ্ডের প্রতিস্থাপনই একমাত্র চিকিৎসা। কিন্তু এই হৃদপিণ্ডের ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট করায় অনেক বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। কেবল যে হৃদপিণ্ডের দাতা বা ডোনরদের অভাবের জন্যই এই সমস্যাটি হয় তা নয়। ডোনরের হৃদপিণ্ডের সাথে রোগীর হৃদপিণ্ড অনেক সময় ম্যাচ করে না। এরফলে সেই হৃদপিণ্ডটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এই রিজেকশন বা প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি প্রতিরোধ করার জন্যেও এমন হৃদপিণ্ডের দরকার যার বৈশিষ্ট্য রোগীয় হৃদপিণ্ডের কোষীয়, গাঠনিক, রোগপ্রতিরোধী ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। আর তাই পারসোনালাইসড অরগান বা ব্যক্তিনির্দিষ্ট অঙ্গের গুরুত্ব অনেক বেশি।

এখন “দ্য আইল্যান্ড” এর গল্পের মত এই ২০১৯ সালে অসুস্থ ব্যক্তির ক্লোনিং করে সেখান থেকে কোন অরগান নিয়ে অরগান ট্রান্সপ্ল্যান্টের পদ্ধতির শুরু হয়নি। কিন্তু এই ২০১৯ সালেই একটি জিনিস আবিষ্কার হয়ে গেছে যা সেই ক্লোনিং এর মাধ্যমে অরগান হারভেস্টিং এর বিকল্প হতে পারে। থ্রিডি প্রিন্টিং এর সাহায্যে রোগীর শরীরের কোষ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে হৃদপিণ্ড যার বৈশিষ্ট্য রোগীর হৃদপিণ্ডের বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়! ১৪ বছর আগে কোন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকও হয়তো এটি ভাবতে পারেন নি।

হ্যাঁ, ইজরায়েলের তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ সফলভাবে একজন রোগীর নিজস্ব কোষ এবং জৈব পদার্থ ব্যবহার করে বিশ্বের প্রথম থ্রিডি হৃৎপিণ্ড প্রিন্ট করেছেন। আর এটি করার উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি হৃদপিণ্ড তৈরি করা যাতে তৈরি করা সেই হৃদপিণ্ডের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে “রোগীর রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত, কোষীয়, জৈবরাসায়নিক এবং শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যগুলি পুরোপুরি মিলে যায়।”

এখন পর্যন্ত, গবেষকরা শুধুমাত্র রক্তনালী ছাড়া সরল টিস্যুকেই থ্রিডি প্রিন্ট করতে পেরেছিলেন। এই গবেষণার প্রধান গবেষক তাল ভার (Tal Dvir) একটি বিবৃতিতে বলেন, “এই হৃদপিণ্ড মানব কোষ এবং রোগীর নির্দিষ্ট জৈব পদার্থ থেকে তৈরি করা হয়। আমাদের প্রক্রিয়াটিতে এই উপকরণগুলোকে জৈব-কালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই জৈব কালি হল শর্কতা এবং প্রোটিন দ্বারা তৈরি পদার্থ যা জটিল টিস্যু মডেলের থ্রিডি প্রিন্টিং এর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। মানুষ অতীতে হৃৎপিণ্ডের থ্রিডি প্রিন্ট করতে পেরেছিল, কিন্তু তাতে কোষ ও রক্তনালী ছিল না। ভবিষ্যতে পারসোনালাইজড বা ব্যক্তিনির্দিষ্ট টিস্যু ও অঙ্গ (যা একেবারে সেই ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথেই মিলবে) তৈরি করা ও প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে আমাদের আবিষ্কারটি একটি সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।”

f), g) সাপোর্ট বাথে একটি প্রিন্ট করা হৃদপিণ্ড, (h) এক্সট্র্যাকশন করার পর এর বাম ও ডান নিলয়ে যথাক্রমে নীল ও লাল রঙ ইনজেক্ট করা হয়েছে, যাতে এর ভেতরের ফাঁকা অংশ ও দুই নিলয়ের মধ্যকার সেপ্টাম বোঝা যায়

Advanced Science জার্নালের প্রকাশিত এই গবেষণায় গবেষকদের দলটি এই তাদের গবেষণা পদ্ধতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, গবেষক দলটি মানুষ এবং শূকর উভয় মধ্যে ওমেন্টাম নামে পরিচিত পেটের একরকম ফ্যাটি টিস্যুর বায়োপসি গ্রহণ করে শুরু করেন। এই টিস্যু এর কোষীয় পদার্থগুলোর মধ্যে যেগুলো থেকে প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল তৈরি বা রিপ্রোগ্রাম করা যায় না তাদেরকে বাদ দেয়া হয়। প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল হচ্ছে সেই “মাস্টার সেল” যা শরীরের তিনটি স্তরের যেকোন কোষই তৈরি করতে সক্ষম, অর্থাৎ প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেলের মধ্যে শরীরের যেকোন কোষ ও টিস্যু তৈরি করারই সক্ষমতা রয়েছে। এরপর দলটি থ্রিডি প্রিন্টিং এর “কালি” হিসেবে ব্যবহারের জন্য কোলাজেন এবং গ্লাইকোপ্রোটিন নির্মিত বহিঃকোষীয় ম্যাট্রিক্সকে হাইড্রোজেলে রূপান্তরিত করে। এরপর কোষগুলোকে হাইড্রোজেলের সাথে মেশানো হয় এবং তারপর সেখান থেকে হৃদকোষ বা এন্ডোথেলিয়াল কোষ তৈরি করা হয় (যা রক্ত এবং লসিকা নালীর অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠ তৈরি করে)। এর ফলে পূর্ণাঙ্গ রক্তনালী সহ রোগী-নির্দিষ্ট, রোগপ্রতিরোধী হৃদকলা তৈরি করা হয়, এবং চূড়ান্তভাবে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যক্তির নিজস্ব বা রোগী-নির্দিষ্ট পদার্থ ব্যবহার করে একটি সম্পূর্ণ হৃদপিণ্ড তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়।

এই প্রক্রিয়াটিতে অপার সম্ভাবনা নিহিত থাকলেও, দলটি বলছে, তাদের তৈরি হৃৎপিণ্ড এখনও মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপিত করার জন্য প্রস্তুত নয়। তাল ভার বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের তৈরি থ্রিডি হৃদপিণ্ড ছোট, খরগোসের হৃদপিণ্ডের মত। কিন্তু মানুষের বড় হৃদপিণ্ড তৈরি করার প্রযুক্তিও একই।”

শুরুতে, মানুষের হৃদপিণ্ড তৈরি করতে অনেক বেশি সময় লাগত, এবং কেবল লক্ষ লক্ষ নয়, বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের প্রয়োজন হত। উপরন্তু, চেরি আকারের হৃদপিণ্ডগুলো অবশ্যই হৃদপিণ্ডের মত আচরণ করে না, গবেষকদেরকে এগুলোকে মানুষের হৃদপিণ্ডের মত বানাতে এবং পাম্পিং করার ক্ষমতা দিতে আরও বিকশিত করার ও “প্রশিক্ষিত” করার প্রয়োজন হত। বর্তমানে, কোষগুলো সংকুচিত হতে পারে, কিন্তু একসাথে কাজ করেনা।

যাইহোক, অঙ্গ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই গবেষণাটি একটি বড় পদক্ষেপ। ডোনারের অভাবে আর ডোনারের অঙ্গের সাথে রোগীর অঙ্গ ম্যাচ না করায় অরগান ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশনে এখন যে সমস্যাগুলো হয়, এই আবিষ্কারটি সেই সমস্যাগুলো দূর করবে। ভার বলেন, “ইমপ্ল্যান্ট প্রত্যাখ্যানের ঝুঁকি নির্মূল করার জন্য এই তৈরি করা উপকরণের জৈবসামঞ্জস্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই জৈবসামঞ্জস্যতা না থাকলে এই ইমপ্ল্যান্ট জাতীয় চিকিৎসা বিফল হয়ে যায়। আদর্শগতভাবে, জৈববস্তুগুলোতে রোগীর নিজের টিস্যুর মত একই জৈবরাসায়নিক, যান্ত্রিক এবং গাঠনিক বৈশিষ্ট্য থাকা উচিৎ। এখানে আমরা থ্রিডি প্রিন্ট করা পুরু, রক্তবাহী এবং রক্তসঞ্চালনে সক্ষম হৃদপিণ্ডের টিস্যু তৈরির একটি সহজ পদ্ধতি দেখিয়েছি যা রোগীর রোগ প্রতিরোধী, কোষীয়, জৈবরাসায়নিক এবং শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়।”

আগেই বলেছি, এখনও এই হৃদপিণ্ডটি মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করার উপযোগী হয়নি। এরজন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন। গবেষকদের দলটিকে এখন এই হৃদপিণ্ডগুলোকে কার্যকরীভাবে পাম্প করার উপযোগী হবার “প্রশিক্ষণ” দিতে হবে। এই কাজটি আগেও করা হয়েছে, সেটা করতে তাদের সমস্যা হবে না। প্রশিক্ষণ দেবার পর কোন প্রাণীর দেহে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য এই হৃদপিণ্ডটিকে প্রতিস্থাপিত করা হবে। তারপর সেই প্রাণীর শরীরের অবস্থা, আচরণ এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হবে। এভাবে আস্তে আস্তে গবেষকগণ এই পারসোনালাইজড বা ব্যক্তিনির্দিষ্ট হৃদয় ও অন্যান্য অঙ্গকে মানুষের শরীরে সফলভাবে ইমপ্ল্যান্ট করার সক্ষমতা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাবে, যার ফলে ঘটবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অনন্য বিপ্লব। আর এই গবেষণাটি হচ্ছে সেই আগামী বিপ্লবের একটি পদক্ষেপ।

রোগীর ওমেন্টাম টিস্যুর কোষগুলোকে আলাদা করে তাকে ব্যক্তিনির্দিষ্ট তাপসংবেদী হাইড্রোজেলে রূপান্তরিত করা হয়। এরপর এই কোষগুলোকে প্লুরিপোটেন্ট বানাবার জন্য পুনরায় প্রোগ্রাম করা হয় ও এখান থেকে কার্ডিওমায়োসাইট ও এন্ডোথেলিয়াল কোষ তৈরি করা হয়। এরপর এগুলোকে হাইড্রোজেলের ক্যাপসুলে প্রবেশ করানো হয় (এনক্যাপসুলেশন) এবং সেখানে প্রিন্টিং এর জন্য বায়োইংক বা জৈব কালি প্রস্তুত করা হয়। এরপর এই জৈব কালি ব্যবহার করে রক্তনালী বিশিষ্ট হৃদকলা বা ভাসকুলারাইজড প্যাচেস এবং সেলুলারাইজড স্ট্রাকচার বা কোষীয় গঠন তৈরি করা হয়।

তথ্যসূত্র

1. https://onlinelibrary.wiley.com/doi/full/10.1002/advs.201900344
2. https://www.aftau.org/weblog-medicine–health?&storyid4704=2446&ncs4704=3
3. http://www.vivo.colostate.edu/hbooks/pathphys/digestion/basics/peritoneum.html
4. http://stemcell.childrenshospital.org/about-stem-cells/pluripotent-stem-cells-101/
5. https://www.khanacademy.org/science/biology/structure-of-a-cell/cytoskeleton-junctions-and-extracellular-structures/a/the-extracellular-matrix-and-cell-wall
6. https://www.cdc.gov/heartdisease/facts.html
7. https://www.imdb.com/title/tt0399201/

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.