রহস্যময় দাঁতের সূত্র ধরে পাওয়া যেতে পারে এক প্রাচীন অজানা জনজাতি|ডেনিয়েল দত্ত

এই দাঁতগুলো হোমো গণের কোন পরিচিত শ্রেণীতে পড়ে না

মানুষের বিবর্তনকে বরাবরই একটা সরলসোজা রূপে দেখানোর চল আছে, বানরজাতীয় প্রাণি থেকে কুঁজো লোমশ মানুষ হয়ে বল্লম হাতে তুলনামূলক কম লোমশ সোজা হয়ে দাঁড়ানো মানুষ। কিন্তু বাস্তবতার প্রেক্ষিতে হোমিনিনদের ইতিহাস বেশ জটিল একটা ছবি প্রকাশ করে , অনেকটা যেন জড়িয়ে থাকা অজস্র শাখাপ্রশাখাময় ঝাঁকড়া একটা গাছ।

অধুনা, চিনের এক গুহায় আবিষ্কৃত হওয়া কিছু দাঁত নিয়ে নতুন করে গবেষণার আলোকে ধারণা করা হচ্ছে মানব বিবর্তনের ক্রমবর্ধমান চরিত্রতালিকায় আরেকটি নতুন চরিত্র সংযোজিত হতে চলেছে।

দাঁত চারটে আবিষ্কৃত হয় ১৯৭২ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে, চিনের দক্ষিণাঞ্চলের টংজি প্রদেশের ইয়ানহুই গুহায়। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি জার্নালে[১] গবেষকরা জানাচ্ছেন, তাঁরা Geometric Morphometical Analysis এবং Micro-CT Scan এর মত আধুনিক ও পরিমার্জিত পদ্ধতি ব্যবহার করে সম্প্রতি ফের একবার ঐ চারটি দাঁতের অস্বাভাবিক অবশিষ্টকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন।  আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপে প্রাপ্ত তুলনামূলক প্রাচীন ও সাম্প্রতিক দাঁতের সাথে চীনে প্রাপ্ত এই দাঁতগুলোর আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যও তুলনা করে দেখেছেন।

এই দাঁতগুলো ১৭২০০০ থেকে ২৪০০০০ বছর আগেকার, প্লেইস্টোসিন যুগের মধ্যবর্তি সময়ের। প্রায় ১.৫ মিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ানো হোমো ইরেকটাস (Homo erectus ) থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens ) বা আধুমিক মানুষ রূপান্তরের মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ভাগ এটা।

কিন্তু এই দাঁতগুলো না ইরেকটাস’এর না স্যাপিয়েন্স’এর। বস্তুত, কোনধরণের প্রাচীন মানবের দাঁতের সাথেই এগুলো পুরোপুরি মিল খায় না। এই দাঁতগুলোর সাথে আলাদা করে একদম আদিযুগের হোমো থেকে নিয়ে তুলনামূলক আধুনিক নিয়ান্ডারথালের অঙ্গসঙ্গস্থানগত বৈশিষ্টের বেশ খানিকটা মিল আছে

ছবি – বিগত ২০০০০০০ বছরের হোমো বর্গ বিবর্তনের মডেল (ছবিসূত্রঃ উইকিমিডিয়া)

যদিও এখনো খানিকটা ধোঁয়াটে অবস্থান, তবে গবেষকরা দাবী করছেন সদারহস্যময় ডেনিসোভান হোমিনিন গোষ্টির সাথে এই দাঁতের বংশগত মিল থাকতে পারে।

স্পেনের একটি আধাসরকারী মানব-বিবর্তন গবেষনা সংস্থা  CENIEH (Centro Nacional de Investigación sobre la Evolución Humana)-এর একজন গবেষক মারিয়া মার্টিনন-টোরেস এক বক্তব্যে[২] জানিয়েছেন, “টংজি হোমিনিড  ডেনিসোভানের সম্ভাব্য পূর্বপুরুষ হতে পারে। কিন্তু প্লেইস্টোসিন যুগের মধ্যবর্তি সময়ের এসমস্ত নন-ইরেকটাস অধিবাসীদের শ্রেণীবিন্যাস মূল্যায়ন করতে আরো প্রচুর পরিমাণে ফসিল এবং জিনগত আবিষ্কার প্রয়োজন।“

ডেনিসোভান সম্পর্কে এপর্যন্ত আমাদের প্রাপ্ত তথ্যের উৎস মূলতঃ সাইবেরিয়ার আটালি পর্বতমালার একটি গুহায় আবিষ্কৃত হওয়া ৪০০০০ বছরের পুরনো একজোড়া দাঁত, আঙ্গুলের হাড়ের একটি চিলতে এবং করোটির একটি টুকরো। তবুও বলা চলে, মানব বিবর্তনের ইতিহাসে ডেনিসোভানের একটি প্রগাঢ় ভূমিকা আছে।

২০১৮ সালে পুরাতাত্বিকেরা একটি কিশোরীর দেহাবশেষ বিশ্লেষন করে দেখতে পান, তার মা ছিল নিয়ান্ডারথাল এবং বাবা ছিল ডেনিসোভান। নিয়ান্ডারথাল এবং ডেনিসোভানের মধ্যকার আন্তপ্রজননের সুস্পষ্ট প্রমাণ এটা। আমরা এটাও জানি আধুনিক মানুষ এবং ডেনিসোভানের মধ্যে নিয়মিত যৌনসম্পর্ক ছিল। দক্ষিণপশ্চিম এশিয়ার বর্তমান কিছু অধিবাসী অন্তত ৫ শতাংশ জিনোম ডেনিসোভান থেকে উত্তরলব্ধ হয়েছেন।  ডেনিসোভানের দেহাবশেষের অপ্রতুলতা একদিকে তাদের নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, অপরদিকে টংজি হোমিনিনের দাঁতের পরিপূর্ণ তথ্য খুঁজে পেতেও সমস্যা সৃষ্টি করছে, কেননা তুলনা করার মত উপাদান খুব সীমিত। এও হতে পারে, টংজি হোমিনিন মানুষগুলো আসলে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা বর্ণসংকর জাতি।

তবে একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত, মানবজাতির উৎপত্তির ইতিহাসের হাজার হাজার পাতা এখনো অলিখিতই রয়ে গ্যাছে।

তথ্যসূত্র

১) https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0047248418303464?via%3Dihub
২) https://phys.org/news/2019-04-tongzi-hominids-potentially-human-ancestor.html

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.