গলতে থাকা হিমবাহে পাওয়া প্রচুর পরিমাণে নিউক্লিও বর্জ্য এবং তেজস্ক্রিয় বুনো শুকরের গল্প

পৃথিবীর হিমবাহ বা গ্লেসিয়ার হ্রাস পাচ্ছে , এবং তা খুব দ্রুতগতিতেই হচ্ছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, হিমবাহের গলনের হার পূর্বে যা ভাবা হয়েছিল তার তুলনায় ১৮ শতাংশ[১] বেশি এবং ১৯৬০ এর দশকের তুলনায় এর গতি পাঁচগুণ বেশি।[১]

এটি মেরু ভল্লুকদের আবাসস্থলের জন্য বুলডোজার স্বরূপ,[২] এর কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে,[৩] চরম আবহাওয়া আরও চরম হচ্ছে,[৪] এবং প্রাচীন রোগগুলো আবার ফিরে আসছে।[৫] সংক্ষেপে বলতে গেলে, এটা ভাল নয়।

এখন মনে হচ্ছে এত কিছুর পরও আমাদের আরও একটা বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ। সেই হিমবাহের বরফের মধ্যে নিউক্লিয়ার বর্জ্য পদার্থকে জমা করে রাখা হয়েছে। ইউরোপীয় জিওসায়েন্সেস ইউনিয়ন (ইইউ)[৬] এর এই বছরের সাধারণ অধিবেশনে উত্থাপিত গবেষণায় দেখা যায় যে, হিমবাহে সংরক্ষিত তেজস্ক্রিয় ধ্বংসাবশেষ প্রকৃতপক্ষে একটি টাইম বোমার মত কাজ করছে। মানে একটা সময় পর কোন বড় সড় বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

প্লিমাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা প্রধান গবেষক ক্যারোলিন ক্ল্যাসন এক বিবৃতিতে বলেন, “পূর্বে নিউক্লীয় দুর্ঘটনার প্রভাব নিয়ে গবেষণাগুলো কেবল অহিমায়িত বা নন গ্লেসিয়েটেড অঞ্চলে মানুষ এবং বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাবের উপরেই মনোযোগ দেয়া হত। কিন্তু এখন পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো নির্দেশ করছে, হিমবাহের উপর যে ক্রায়োকোনাইট (ক্ষুদ্র পাথর কণার দ্বারা তৈরি বাতাসের দ্বারা বাহিত পাউডারের ন্যায় ধূলিকণা) থাকে সেগুলো রেডিওনিউক্লিওটাইডকে কার্যকরীভাবে জমা করে বিপজ্জনক মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে।”[৭]

এই প্রথমবারের মতো গবেষকদের কোন আন্তর্জাতিক দল আর্কটিক, অ্যান্টার্কটিক, আল্পস ও ককেশাস পর্বতমালা, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এবং আইসল্যান্ডের হিমবাহ বা গ্লেসিয়ারে পারমানবিক বস্তু নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে। তাদের গবেষণায় জরিপকৃত ১৭টি স্থানের প্রত্যেকের মধ্যে মানব-নির্মিত তেজস্ক্রিয় উপাদানের মাত্রা প্রকাশিত হয়েছে। দেখা যায় প্রায়ই হিমায়িত অঞ্চলে তেজস্ক্রিয় উপাদানের ঘনত্ব অহিমায়িত বা নন-গ্লেসিয়াল অঞ্চলের তুলনায় ১০ গুণ বা তারও চেয়ে বেশি।

এর ব্যাখ্যা হল, চেরনোবিল বা ফুকুশিমা মত নিউক্লীয় দুর্যোগের ঘটনার পরে মূলত উচ্চ সংকোচনের জন্য এর তেজস্ক্রিয় কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। এই কণাগুলো হালকা এবং অনেক দূরে যেতে পারে।

সাধারণত, তারা এসিড বৃষ্টি হিসেবে মাটিতে ফিরে আসে, যেখানে তারা মাটিতে শোষিত হতে পারে বা উদ্ভিদ একে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং, চেরনোবিল এবং ফুকুশিমার মত জায়গায় তেজস্ক্রিয়তা যত বেশি হবে, ক্যান্সারের হার,[৮] বন্ধাত্ব এর হার তত বেশি হবে[৯] এবং তেজস্ক্রিয় শুকরের মত প্রাণী পাওয়া যাবে।[১০] যাইহোক, এই কণাগুলির মধ্যে কিছু অংশ বরফ ঢাকা অঞ্চলে যাবে, যেখানে তারা তুষারে পরিণত হবে, বরফের উপরে পড়বে, তুলনামূল ভারি কিছুতে স্থাপিত হবে, এবং একত্রিত হয়ে আরও বেশি ঘনত্ব অর্জন করবে।

দলটি এই উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে। আর বিশ্লেষণ করার পর তারা সেখানে কেবল চেরনোবিল ও ফুকুশিমা এই দুই নিউক্লীয় দুর্ঘটনার বর্জ্য খুঁজে পায় নি, সেই সাথে তারা কয়েক দশক ধরে চলে আসা নিউক্লীয় অস্ত্র পরীক্ষার উপাদানও সেখানে পেয়েছে।

ক্ল্যাসন বলেন, “আমরা ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশক এবং তারও পরে ঘটা অস্ত্র পরীক্ষার কথা বলছি, ঠিক বোমার বিকাশের সময়ে ফিরে যাচ্ছি। আমরা যদি এই পদার্থগুলোর মধ্যে থেকে একটি সেডিমেন্ট কোর নেই, তবে (সময়ের ও তেজস্ক্রিয়তার সাথে সম্পর্কিত গ্রাফে) যেসময়ে চেরনোবিলের দুর্ঘটনা ঘটে (১৯৮৬ সালে) সেখানে আপনি একটি স্পষ্ট স্পাইক দেখতে পারবেন। কিন্তু সেই সাথে প্রায় ১৯৬৩ সালেও আপনি একটি পুরোপুরি স্পষ্ট স্পাইক দেখতে পারবেন যখন ভারি অস্ত্র পরীক্ষার সময় ছিল।”[১১]

গবেষণাগুলো বলছে, খাদ্য শৃঙ্খলে থাকা তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিঃসন্দেহে আপনার জন্য ভাল নয়,[১২] কিন্তু এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে এই নিউক্লীয় বর্জ্য এর উপস্থিতিটি আসলেই কী অর্থ বহন করে। দলটি এটি খুঁজে বের করতে পারবে আশা করে।

ক্ল্যাসন বলেন, “সাম্প্রতিক ফিল্ড স্টাডিগুলোতে অনেক উচ্চ মাত্রার রেডিওনিউক্লিওটাইড ঘনত্ব পাওয়া গেছে, কিন্তু এর প্রভাব কী তা এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি। আমরা ইতিমধ্যেই এটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি যাতে এর ফলে ভবিষ্যতে তৈরি হওয়া কোন অদেখা হুমকি সম্পর্কে জানা যায়। এই জ্ঞান স্পষ্টতই বরফ অঞ্চলের পরিবেশ ও এর ডাউনস্ট্রিমে বাস করা মানব সম্প্রদায়ের জন্য উপকারী হবে।”

চেরনোবিলের দুর্ঘটনা ও তেজস্ক্রিয় বুনো শুকরের গল্প

১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি (দুবার)[১৩] বিস্ফোরিত হয়, যা পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দেয়। এর রিয়েক্টর কোরের অন্তত ৫% পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।[১৪] দুর্ঘটনার রাতেই দুজন কর্মী মারা যায়, এবং দুর্ঘটনার তিন মাসের মধ্যেই তীব্র তেজস্ক্রিয়-বিষক্রিয়ায় আরও ২৮ জন মারা যায়।[১৪] পশ্চিম রাশিয়া এবং ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে এবং দুর্ঘটনার স্থান থেকে হাজার হাজার মাইল দূর থেকেও একে সনাক্ত করা যাচ্ছিল।[১৫] এরফলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উভয়ের উপরেই দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ে। দ্য টেলিগ্রাফে ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৮ বছর পরও, তেজস্ক্রিয়তা অবাক করা স্থানে দেখা যাচ্ছে, এমনকি চেরনোবিল থেকে প্রায় ৭০০ মাইল দূরের জার্মানির জঙ্গলের বুনো শুকরের মধ্যেও[১৬] তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যাচ্ছে।[১৬]

বুনো শুকর মাশরুম এবং ট্রাফল্‌স (চকোলেট ধরণের কিছু না, একটি ব্যয়বহুল ছত্রাক) এর মত খাদ্যের অনুসন্ধানে মাটি খনন করে।[১৭] অন্যদিকে চেরনোবিল থেকে আসা তেজস্ক্রিয়তায় বনাঞ্চলের মাটি দূষিত হয়ে থাকবে। আর সেই মাটি খোড়ার কারণেই বুনো শুকররা সম্ভবত সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল। এছাড়া, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সংরক্ষণ করার জন্য মাশরুম এবং ট্রাফল বিশেষভাবে পরিচিত।[১৭] তেজস্ক্রিয়তার দ্বারা প্রভাবিত এলাকায় জন্মানো অনেক মাশরুম ও ট্রাফলকেই মানুষের খাবার জন্য অনুপযোগী বলে মনে করা হয়। এই মাশরুম ও ট্রাফল্‌স খাওয়ার জন্যেও বুনো শুকরগুলো প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে।

বুনো শুকরের মাংস জার্মানের একটি সুস্বাদু খাদ্য,[১৬] যা প্রায়শই সালামি রূপে পরিবেশন করা হয়। খাদ্য পণ্যে পরিণত করবার আগে শুকরের মাংসকে পরীক্ষা করে নেয়া হয়। স্যাক্সনি রাজ্য সরকারের দ্বারা এই বাধ্যতামূলক পরীক্ষাটি করা হয়। দেখা গেছে শিকার করে আনা তিনটি শুকরের মধ্যে একটিরও বেশি তাদের উচ্চ তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার কারণে খাদ্য হিসেবে অনুপযোগী।[১৬]

প্রতি কিলোগ্রাম মাংসের জন্য তেজস্ক্রিয়তার নিরাপদ সীমা ঠিক করা হয়েছে ৬০০ বেকেরেল। কোন প্রাণীতে প্রতি কেজিতে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ এর চেয়ে বেশি হলে তাকে অবশ্যই নষ্ট করে ফেলতে হবে। কেবল একটি বছরেই স্যাক্সনিতে পরীক্ষা করা ৭৫২টি শুকরের ২৯৭টিতেই তেজস্ক্রিয়তা ৬০০ বেকেরেল/কেজি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। টেলিগ্রাফের রিপোর্ট অনুযায়ী, কোন কোন শুকরে এর নিরাপদ সীমার কয়েক ডজনগুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গিয়েছিল।

বুনো শুকরের জন্য জার্মানির কেবল এই দিক থেকেই ক্ষতি হয়নি। জার্মানিতে অনেক শিকারিই বুনো শুকর শিকারকে খেলা হিসেবে নেয়। তারা তাদের শিকার করা শুকর বিক্রি করে অর্থও উপার্জন করে। এখন যেসব শিকারীর শিকার করা প্রাণীকে কর্তৃপক্ষ তেজস্ক্রিয়তার জন্য নষ্ট করে ফেলছে তার ক্ষতিপুরণও বহন করতে হচ্ছে জার্মান সরকারকেই। বর্তমানে বুনো শুকরদের মধ্যে যে মাত্রায় তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে তা বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ বলছেন, নিকট ভবিষ্যতের মধ্যে এই সমস্যাটা দূর হবে না। বুনো শুকরদের মধ্যে এই তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে আরও ৫০ বছর লাগতে পারে।

তথ্যসূত্র

১। https://www.bostonglobe.com/news/nation/2019/04/09/study-global-warming-melting-glaciers-faster-than-thought-many-could-gone-end-century/tCXsnPRLKTC77l2UUpBoLK/story.html
২। https://www.theguardian.com/environment/2016/sep/14/polar-bears-losing-crucial-sea-ice-study-arctic
৩। https://www.iflscience.com/environment/200-billion-tonnes-of-antarctic-ice-is-melting-into-the-sea-each-year-and-its-expected-to-increase/
৪। https://www.scientificamerican.com/article/melting-ice-sheets-could-worsen-extreme-weather/
৫। http://www.bbc.com/earth/story/20170504-there-are-diseases-hidden-in-ice-and-they-are-waking-up
৬। https://www.egu2019.eu/
৭। https://www.plymouth.ac.uk/news/nuclear-disasters-could-leave-a-lasting-legacy-of-contaminants-in-glaciers
৮। https://www.iflscience.com/health-and-medicine/what-we-learned-chernobyl-about-how-radiation-affects-our-bodies/
৯। https://www.iflscience.com/plants-and-animals/chernobyl-and-fukushima-radioactivity-has-seriously-harmed-wildlife/
১০। https://www.iflscience.com/environment/wild-boar-roaming-forests-germany-are-too-radioactive-eat/
১১। https://www.afp.com/en/news/826/siren-sounds-nuclear-fallout-embedded-melting-glaciers-doc-1fi9e91
১২। https://www.iflscience.com/health-and-medicine/food-grown-near-chernobyl-still-dangerously-radioactive-30-years-disaster/
১৩। http://www.livescience.com/39961-chernobyl.html
১৪। http://www.world-nuclear.org/info/safety-and-security/safety-of-plants/chernobyl-accident/
১৫। https://www.asme.org/engineering-topics/articles/nuclear/chernobyl-25-years-later
১৬। http://www.telegraph.co.uk/news/worldnews/europe/germany/11068298/Radioactive-wild-boar-roaming-the-forests-of-Germany.html#
১৭। http://www.popsci.com/article/science/german-boars-are-too-radioactive-eat?src=SOC&dom=fb

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.