প্রথম কম্পিউটারের সাহায্য নিয়ে কৃত্রিমভাবে ব্যাক্টেরিয়া জিনোম তৈরি করা হল

গত ১ এপ্রিল, ২০১৯-এ বিজ্ঞানীগণ ঘোষণা করেলেন যে, তারা প্রথম কম্পিউটারে তৈরি ব্যাকটেরিয়া জিনোম তৈরি করেছেন। এবং, শুধু পরিষ্কার করার জন্য বলছি, তারা আসলে ব্যাকটেরিয়াম তৈরি করেন নি। তারা একটি রিং মত আকারের ডিএনএ এর একটি বড় টুকরা সত্যিই তৈরি করেছেন, এবং তারা Proceedings of the National Academy of Sciences জার্নালে এর বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন। এখনও, এটি সিন্থেটিক জীববিজ্ঞান ক্ষেত্রের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ এবং এটি দেখায় যে, জেনেটিক্স প্রযুক্তির কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে। নতুন সিন্থেটিক জিনোম সত্যিকারের স্বাদু জলের ব্যাকটেরিয়াম, Caulobacter crescentus এর জিনোমের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। তাই বিজ্ঞানীরা জাল প্রাণীর নাম দিয়েছেন Caulobacter ethensis-2.0।

তাদের লক্ষ্য ছিল ডিএনএর একটি রিং তৈরি করা যা এখনও ব্যাকটেরিয়া জিনোমের মতো প্রোটিনগুলির জন্য কোড করবে। কিন্তু তার জন্য এটি মূল ব্যাক্টেরিয়ামের চেয়ে কম সংখ্যক প্রকৃত নিউক্লিওটাইড ব্যবহার করবে। সুতরাং, জিনিসগুলোকে কমিয়ে ফেলার জন্য তারা কেবলমাত্র সেই জিনগুলি দিয়ে শুরু করেছিল যা C. crescentus এর বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন – যাকে তার মিনিমাল জিনোম বা ন্যূনতম জিনোম বলা হয়। বিজ্ঞানীরা মূল ব্যাক্টেরিয়ার প্রায় ৪০০০ জিনকে কমিয়ে প্রায় ৬৭৬টি জিনে নিয়ে আসেন। ফলে সেখানে প্রায় ৭৮৫ কিলোবেজ জিনোম ছিল – কিন্তু যখন তারা সংশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন, তখন তারা দেখলেন যে তারা আসলে সেটা করতে পারছেন না।

না পারার কারণ হল প্রাকৃতিক জিনোমগুলিতে বেজগুলোর নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থাকে যেগুলো সিনথেসিস বা সংশ্লেষণকে সত্যিই কঠিন করে তোলে। তাই তারা নিজেদের তৈরি করা একটি কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে জিনোমটিকে পুনরায় লিখলেন। একটি নির্দিষ্ট এমিনো এসিডের জন্য কোড করতে পারে এরকম একাধিক অক্ষর ক্রম বা কোডন থাকে, তাই এই অ্যালগরিদমটি একই এমিনো এসিডের জন্য একাধিক কোডনের বদলে একটি কোডনকে ব্যবহার করে, এতে জেনেটিক কোডের অর্ধেকেরও বেশি কোডন সমার্থক কোডন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। আর এর ফলে এই জিনোম খুব সুসজ্জিতও হয়ে যায়।

ডিএনএ এর কিছু অংশ আছে যেগুলো অন্য অংশের মত একই প্রোটিনকে কোড করে, কিন্তু ভিন্ন উপায়ে করে। এগুলো কোড করার কাজের ব্যাকাপ হিসেবে কাজ করে এবং জিনের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিয়ন্ত্রণ এর কাজের মধ্যে আছে জিনের প্রকাশকে দ্রুত করা বা এর ফাইন টিউনিং করা। এবং বিজ্ঞানীরা মনে করেন ডিএনএ-তে এমন একটি সিকুয়েন্স রয়েছে যা প্রোটিন তৈরি করে তবে তারা তাদের কার্যকারিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত নন। অ্যালগরিদমটি এগুলোর প্রায় সবগুলোকেই ছেটে ফেলে। সর্বোপরি, তারা ১২০,০০০ টি নিউক্লিওটাইডকে পরিবর্তিত করেছেন এবং সংশ্লেষণে বাধা দেয় এমন হাজার হাজার বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলেছে। এই সুবিধাটির জন্যই গবেষকগণ ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ এর ৩ থেকে ৪ কিলোবেস এর বিভাগ বা অংশ তৈরি করতে এবং তারপরে তাদের একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে পুরো ৭৮৫ কিলোবজ Caulobacter ethensis-2.0 জিনোম তৈরি করতে সমর্থ হন।

এই গবেষণা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক বিষয়টি হল, এই পুরো প্রক্রিয়াটির জন্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম সময় লেগেছে। ১১ বছর আগে যখন বিজ্ঞানীরা একটি ভিন্ন ব্যাকটেরিয়ামের প্রথম সিন্থেটিক জিনোম তৈরি করেছিলেন, তখন তাদের দশ বছর সময়, ২০ জন বিজ্ঞানী এবং ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার লেগেছিল। এবং পূর্ববর্তী দলটি যেখানে একটি প্রাকৃতিক জিনোমের সঠিক কপি তৈরি করেছিল, সেখানে এই নতুন দলটি তাদের কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে জিনোমটিকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলেছে। এই জিনোমটি তৈরি হতে লাগল মাত্র এক বছরে সময়, ১৩ জন বিজ্ঞানী এবং প্রায় ১২০ হাজার ডলার। অবশ্য দেখা গেল, এই নতুন জিনোমের প্রায় ৮১.৫% সক্রিয়ভাবে কাজ করে। এটি আসলে একটি ভাল ব্যাপার, কারণ এটি বিজ্ঞানীদের দেখিয়েছে যে, কিছু জেনেটিক উপাদানকে যে তারা প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন নি, সেগুলো আসলেই প্রয়োজনীয়।

এখন গবেষকরা তাদের কম্পিউটার অ্যালগরিদম উন্নত করতে চেষ্টা করবেন, যাতে তাদের পরবর্তী পুনর্বিবেচিত প্রচেষ্টা আরও কার্যকরী জিনোম তৈরি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, জিনোমগুলিকে এভাবে অনেক ছোট এবং সরল করে তারা আসলে পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকরী ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে সক্ষম হতে পারেন। এবং এই ব্যাকটেরিয়া বেশ কিছু দরকারী জিনিস করতে পারে, যেমন এগুলো এমন অণু তৈরি করতে পারে যেগুলোকে আমরা ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করতে পারি।

তবে কৃত্রিমভাবে নতুন জিনোম তৈরির ক্ষমতাটি এখন যতই কম হোক, এটিকে অপব্যবহার করা যেতে পারে। সবসময়ই একটি দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ কাজ করছে যে এরকম একটি কৃত্রিমভাবে জিনোম তৈরি কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি ধ্বংসাত্মক প্যাথোজেন বা বাস্তুসংস্থান ধ্বংসকারী জীবাণু তৈরি করতে পারে। ইতিমধ্যেই কিছু কঠোর নিয়ম আছে যেগুলো ইতিমধ্যে পরিচিত ক্ষতিকারক অরগানিজম এর সংশ্লেষণ করায় নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে। এবং অনেক দেশেই জেনেটিকালি সংশোধিত ও সিন্থেটিক ওরগানিজম সহ বিভিন্ন বিক্রয়যোগ্য জৈব পণ্যগুলো বিভিন্ন সংস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

কিন্তু যখন গবেষণাগারে ক্ষতিকারক নয় এমন প্রজাতির জিনোম সংশোধন বা সংশ্লেষ করার কথা আসে, তখন গবেষকগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রমাণ বৈজ্ঞানিক নীতি ও চর্চা অনুসরণ করেই কাজ করেন। এই ব্যাপারটি হয়তো এখনকার জন্য ঠিকই আছে, কিন্তু গবেষকগণ বলছেন যে, তাদের এই সাফল্যগুলো নির্দেশ করছে, গবেষণাগার থেকে তৈরি হওয়া কোন কিছু যাতে কোথাও ক্ষতি না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য আরও বেশি বেশি আলোচনা হওয়া দরকার।

জার্নাল লিংক –
https://www.pnas.org/content/early/2019/03/29/1818259116

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.