কোয়ান্টাম টানেলিং হতে পারে আলোর বেগের চেয়েও দ্রুত গতিতে!!!

কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর অদ্ভূত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে কোয়ান্টাম টানেলিং, যেখানে সাবএটোমিক পার্টিকেলগুলো এমন বাঁধাকেও ভেদ করে বা ডিঙ্গিয়ে আসতে পারে, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স ছাড়া অন্য কোনরকম পদার্থবিজ্ঞান এর সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না, বা অন্য কোন রকম পদার্থবিজ্ঞান একে অসম্ভব বলে মনে করে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদেরকে এই ব্যাপারটি শেখানো হয়েছে আমাদের চেনা জগতের বিভিন্ন তুলনার সাহায্যে, যেমন কোন বস্তুর কোন কঠিন দেয়াল ভেদ করে চলে যাওয়া। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটার জন্য কতটুকু সময় দরকার হয় তা সবসময়ই থেকে গেছে রহস্যময়। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণায় কোয়ান্টাম টানেলিং এর জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের একটা ঊর্ধ্বসীমা কত হবে সেটা জানা গেছে, অর্থাৎ কোয়ান্টাম টানেলিং এর জন্য সর্বোচ্চ কত সময় লাগবে, বা ঠিক কত সময়ের চেয়ে বেশি সময় জুড়ে এই ঘটনাটি ঘটবে না সেটা বলছে। তবে যদি নিম্নসীমার কথায় যাই, তাহলে বলতে হয় এই কোয়ান্টাম টানেলিং এর ঘটনাটি তৎক্ষণাৎও হতে পারে। তৎক্ষণাৎ মানে হল জিরো ডিলে, অর্থাৎ এই ঘটনার জন্য কোন সময়ই লাগবে না। মানে আলোর গতিরও দ্রুত বেগে এই পার্টিকেলগুলোর কোয়ান্টাম টানেলিং হতে পারে!!! গবেষণাটি প্রকাশিত হয়ে নেচার জার্নালে, প্রদান লেখক ডঃ ইগর লিটভিনিউক।

অবশ্যই টানেলিং এতটাই দ্রুত ঘটে যে এর পরিমাপ করা খুবই কঠিন। এই সময় নির্ধারণের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ভারি ভারি পরমাণু, যাতে এগুলোর সাহায্যে পরোক্ষভাবে টানেলিং এর জন্য প্রয়োজনীয় সময় নির্ণয় করা যায়। গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয় এর ডঃ ইগর লিটভিনিউক বলেন, অস্ট্রেলিয়ান অ্যাটোসেকেন্ড সায়েন্স ফ্যাসিলিটি হচ্ছে একমাত্র ব্যবস্থা এবং একমাত্র স্থান যেখানে একটি একটি ইলেক্ট্রনের হাইড্রোজেন পরমাণুর কবল থেকে টানেলিং এর জন্য প্রয়োজনীয় সময় নির্ণয় করতে প্রয়োজনীয় তিন ধরণের সরঞ্জামই আছে।

লিটভিনিউক এইসব সরঞ্জামের সাহায্য নিয়ে এই গবেষণা করে ফলাফল পেলেন এই কোয়ান্টাম টানেলিং এর জন্য ১.৮ অ্যাটোসেকেন্ড (attosecond) এর বেশি সময় লাগে না। এক এটোসেকেন্ড হল ১০^-১৮ সেকেন্ড বা এক সেকেন্ড এর এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ করলে যা পাওয়া যায়, তারও এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। গবেষণাটির সহ-লেখক রবার্ট সাং বলেন, “এই এটোসেকেন্ডের হিসাব বোঝাটা কঠিন, কিন্তু এটা বললে হয়তো বুঝতে সুবিধা হবে যে, একটি ইলেক্ট্রনের একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে একবার ঘুরে আসতে প্রায় ১০০ এটোসেকেন্ড সময় লাগে।”

এই টানেলিং টাইম ঠিক করে দেবে যে তাত্ত্বিকভাবে ট্রাঞ্জিস্টরগুলো কত দ্রুত তাত্ত্বিকভাবে সুইচ করতে পারে। তাই টানেলিং এর সময় যদি এত কম হয় তাহলে অতিদ্রুত কম্পিউটার তৈরি করা আরও বেশি বাস্তব হয়ে ওঠে।

এছাড়া, লিটভিনিউক এবং সাং বলছেন কোয়ান্টম টানেলিং এর তাৎক্ষণিক হবার সম্ভাবনার কথা, যেখানে শূন্য সময়েই ইলেক্ট্রন একটি দূরত্ব অতিক্রম করে। অর্থাৎ এটি আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে ঘটে। লিটভিনিউক অবশ্য বলছেন, এই দাবিটা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তিনি বুঝতে পারছেন না যে, কেন এটি অসম্ভব বলে মনে করা হবে। তিনি বলেন, এটি হচ্ছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা (একটি শব্দগুচ্ছ যেখানে সবসময় অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার জড়িয়ে থাকে), আর এর মানে এই হতে হবে না যে, তথ্য বহন করার জন্য আলোর চেয়ে বেশি বেগ বা সুপারলুমিনাস বেগকে কাজে লাগানো যাবে”।
লিটভিনিউক এর কাজটি যদি আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে ধাক্কা নাও দিয়ে থাকে, এটা তারপরও কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদেরকে নতুন কিছু বিষয়ে সেখাতে পারে। কিছু কিছু সাবএটোমিক প্রক্রিয়ায় পরপর কয়েকটা ধাপ থাকে, যার মধ্যে টানেলিং এর ব্যাপারটাও অন্তর্ভূক্ত। লিটভিনিউক বলছেন, “পরীক্ষণীয় কোন পরমাণু যদি জিরো ডিলে দেয়, তাহলে তার উপর ভিত্তি করে অন্য ডিলেগুলোকে তার সাপেক্ষে ক্যালিব্রেট করা যাবে”।

এবারে এই গবেষণাটি কিভাবে করা হল সেটা নিয়ে সামান্য কিছু কথা বলে শেষ করা যাক। এই আবিষ্কারটির জন্য লিটভিনিউক একটি ঘুর্ণায়মান তরিৎ ক্ষেত্রে খুবই ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী আলো দিয়ে হাইড্রোজেন পরমাণুকে আঘাত করেন। এরপর উদ্দীপিত ইলেক্ট্রনগুলো টানেলিং শুরু করে, যেখানে ইলেক্ট্রনগুলোর এস্কেপ এংগেল বা পলায়ন কোণ টানেলিং এর সময় এর উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ব্যবস্থাটিকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে, ইলেক্ট্রন কত কোণ করে বের হয়ে যাচ্ছে তা দেখেই টানেলিং এর জন্য প্রয়োজনীয় সময়কে নির্ণয় করা যায়। সুতরাং যদি ইলেক্ট্রন এর দিক পরিবর্তিত না হয়, অর্থাৎ এটি শূন্য কোণ করে বেরিয়ে যায়, তাহলে বোঝা যাবে টানেলিং এর সময় হচ্ছে তাৎক্ষণিক, বা টানেলিং এর জন্য কোন সময়েরই প্রয়োজন হয়নি। যে আলো দিয়ে হাইড্রোজেন পরমাণুকে আঘাত করা হয় তার শক্তির পরিমাণ ছিল পরিমাণ ছিল ৩০ গিগাওয়াট, সমগ্র অস্ট্রেলিয়ার ইলেক্ট্রিসিটি গ্রিডের শক্তির থেকেও বেশি। লিটভিনিউক বলেন, প্রত্যেকটি পালস তৈরি করা হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম শক্তির তরঙ্গকে সংকুচিত করার মাধ্যমে, যার ফলে খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু প্রচণ্ড শক্তির আলো লাভ করা সম্ভব হয়।

তথ্যসূত্র:

1. https://www.nature.com/articles/s41586-019-1028-32.

2. https://app.secure.griffith.edu.au/news/2019/03/19/measuring-tunneling-time-physicists-solve-great-mystery-of-the-quantum-world/

3. ডঃ লিটভিনিউক এর আরও কাজ সম্পর্কে জানতে -https://experts.griffith.edu.au/academic/i.litvinyuk

4. ডঃ সাং এর আরও কাজ সম্পর্কে জানতে – https://experts.griffith.edu.au/academic/r.sang

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.