কিলার বি কেলেঙ্কারি

পঞ্চাশের দশকে এক ব্রাজিলিয়ান এন্টমোলজিস্ট (পোকামাকড় নিয়ে গবেষণা করে যারা তাদেরকে এন্টমোলজিস্ট বলে) একটা কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে বসেন। তিনি ভাবছিলেন, কিভাবে হানি বি বা মৌমাছিদের তৈরি মধুর স্বাদ আরও বেশি বাড়ানো যায়। নরমাল টেস্টে মন ভরছিল না আরকি… তাই তিনি একটা কাজ করে বসলেন। তিনি ইউরোপিয়ান হানি বি এর এর বিভিন্ন প্রজাতির সাথে আফ্রিকান হানি বি এর ক্রস করে হাইব্রিড জাত তৈরি করেন। কিন্তু এর রেজাল্ট যা হল তা ছিল ভয়ানক। এই ক্রসিং এর ফলে যে মৌমাছি তৈরি হয় তারা ছিল অবিশ্বাস্য রকমের আক্রমণাত্মক ও বদরাগী। এদের নাম দেয়া হয় আফ্রিকানাইজড হানি বি। তবে সাধারণ মানুষ এদের আরেক নামে চেন… কিলার বি…

যাই হোক, এই কিলার বি-দেরকে বন্দী করেই রাখা হয়েছিল, কিন্তু ১৯৫৭ সালে এরা পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া কিলার বি এর সংখ্যা একটা দুটো ছিল না, পুরো ২৬টা ঝাক! এরপর এরা বংশবিস্তার করে, উত্তর-দক্ষিণ উভয় আমেরিকাতেই ছড়িয়ে পরে, আর এভাবেই ১৯৮৫ সালে এরা চলে আসে যুক্তরাষ্ট্রে।

এই কিলার বি সম্পর্কে কিছু কথা বলা যায়। এদের আকার ইউরোপিয়ান হানি বি এর চেয়ে ছোট, আর এদের বিষও কম প্রাণঘাতী। কিন্তু তাতে নিশ্চিন্ত হবার কিছু নেই, এদের হিংস্রতা, তাদের রাগী মেজাজই তাদেরকে “কিলার বি”-তে পরিণত করেছে। এরা মানুষকে ৪০০ মিটার অবধি তাড়া করতে পারে, আর সাধারণ মৌমাছিদের চেয়েও এরা ১০ গুণ বেশি হুল ফোটায়। এপর্যন্ত কিলার বি এর “কামড়ে” প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গেছে, সেই সাথে ঘোড়া বা অন্যান্য প্রাণী তো আছেই…

কিন্তু কেন এরা এত বেশি এগ্রেসিভ? সেই ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাই এটা বের করার দায়িত্ব নিয়েছেন। গবেষণা করে তারা কি পেলেন সেটা পড়েই আজকে এটা নিয়ে লেখার আগ্রহ তৈরি হল আরকি… গবেষকগণ কিলার বি এর মৌচাকের পাশে একটা চামড়ার বল ছুড়ে দেয়, এরপর কিলার বিরা ক্ষেপে গিয়ে সেই বলে হুল ফোটায়। সেখান থেকে গবেষকগণ কয়েকটা কিলার বি তুলে নিয়ে লিকুইড নাইট্রোজেনে জমিয়ে ফেলেন।

এরপর এই গবেষকগণ এদের মস্তিষ্কের প্রোটিনগুলোর দিকে নজর দেন, যাদেরকে নিউরোপেপটাইড বলা হয়। এটা তারা করেন মাস স্পেকটাল ইমেজিং নামে একটি পদ্ধতিতে। আর দেখেন এই নিউরোপেপটাইড এর দুটো গ্রুপের দৈর্ঘ্যে পার্থক্য রয়েছে।

প্রথম গ্রুপটির নাম হচ্ছে এলাটোস্টেটিনস এ। এই প্রোটিনটি এদের শিক্ষা, স্মৃতি, সাধারণ বিকাশ এর সাথে সম্পর্কিত। আর দ্বিতীয় প্রকরণের প্রটিনকে বলা হয় টাকিকিনিন-রিলেটেড পেপটাইড। এই টাইপের প্রোটিনটি একটু রহস্যময়। কিন্তু সবাই জানেন, এই প্রোটিনটির সাথে সেন্সরি স্টিমুলি এর সম্পর্ক আছে, মানে যেকোন ধরণের সেন্স এর সাথে সম্পর্কিত উদ্দীপনার সাথে এর সম্পর্ক। গবেষকগণ আবিষ্কার করলেন কিলার বি-দের ক্ষেত্রে এই দুরকম প্রোটিন এর দৈর্ঘ্যই নরমাল মৌমাছিদের বেলায় এর যে দৈর্ঘ্য থাকে তার চেয়ে কম। এটা ছাড়াও অবশ্য তারা এদের ব্রেইন ক্লাস্টার বা নিউরোপিলসেও সামান্য পার্থক্য পেয়েছেন।

যাই হোক, এইটুকু পেলেই তো হবে না, আরও দূরে যেতে হবে। গবেষকরা বুঝলেন যে এই প্রোটিনগুলো কিলার বিদের বেলায় খাটো তাই এরা এত রাগী, কিন্তু এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেতে এই জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটানো চাই, নাকি? তারা এবারে কিছু শান্ত শিষ্ট হানি বি-কে ধরে এনে, এদেরকে অজ্ঞান করে দিয়ে এদের মধ্যে ঐ খাটো ভারশনের প্রোটিনগুলোকে ইনজেক্ট করে দিল। ব্যাস, দেখা গেল, ঘুম থেকে ওঠার পর এই শান্ত শিষ্ট মৌমাছিগুলোও কিলার বি-দের মত সাংঘাতিক রকমের আক্রমণাত্মক হয়ে গেছে। এই বছরের ১৮ই মে-তে জার্নাল অফ প্রটিওম রিসার্চ নামক জার্নালে এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।

কী অসাধারণ আবিষ্কার… আগে কিলার বি বানাতে কষ্ট করে বিভিন্ন প্রজাতির হানি বি ধরে এনে ক্রসিং করতে হত, এখন সেটারও দরকার নেই, এই প্রোটিনগুলোর ইনজেকশন দিলেই চলবে… ইউরেকা!! তবে এখনও পরিষ্কার নয় যে খাটো ভারশনের প্রোটিনগুলোই কেন মৌমাছিদের আচরণে এতটা প্রভাব ফেলছে। এটা জানতে আরও গবেষণা দরকার। যদি জানা যায়, তাহলে শুধু মৌমাছি নয়, আরও অনেক কীটপতঙ্গের আচরণ, তাদের মস্তিষ্কের প্রকৃতি বিষয়ক অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যাবে, তখন এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার, এদেরকে ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করার আরও অনেক নতুন উপায়ও হয়তো আবিষ্কার হবে। দেখা যাক, কিলার বি কেলেঙ্কারি থেকে আরও ভাল কিছু পাওয়া যায় কিনা…

তথ্যসূত্র:

১। কিলার বি এর উদ্ভব: http://www.badbeekeeping.com/kerr.htm
২। প্রায় এক হাজার মানুষ হত্যা: http://www.badbeekeeping.com/kerr.htm
৩। জার্নাল অফ প্রটিওম রিসার্চ-এ প্রকাশিত পেপারটি: https://pubs.acs.org/doi/10.1021/acs.jproteome.8b00098

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.