প্লাস্টিক দূষণ: এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রধান ফোকাস- পর্ব ১

আজ ৫ই জুন মঙ্গলবার বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে “Moving towards a plastic-free future”, অর্থাৎ “প্লাস্টিকবিহীন ভবিষ্যতের দিকে অগ্রযাত্রা”। এই উপলক্ষে সাম্প্রতিক আলোচনায় আসা প্লাস্টিক নিয়ে বিভিন্ন রকম সমস্যা নিয়ে এই সিরিজটি লিখছি।

 

সমুদ্রের তলদেশে প্লাস্টিক

 

প্রথমেই যাচ্ছি জাপানের ইওসুকায় অবস্থিত  Japan Agency for Marine-Earth Science and Technology (JAMSTEC) এর একটি আবিষ্কারে, যা এই বছরের ৬ এপ্রিল মেরিন পলিসি জার্নালে প্রকাশিত হয়। সেখানে উঠে এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর মহাসাগরীয় খাঁদ মেরিয়ানা ট্রেঞ্চের ১০,৮৯৮ মিটার (৩৫,৭৫৫ ফুট, বা ৬.৭ মেইল) তলদেশেও প্লাস্টিক ব্যাগ রয়েছে! JAMSTEC এর গবেষকগণ ডিপ সি সাবমারসিবল ও রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকলস (ROB) থেকে ১৯৮৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত মহাসাগরের বিভিন্ন তলদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে ডেটা সংগ্রহ করে, যেখান থেকে উঠে আসে প্লাস্টিক আমাদের মহাসাগরের পরিবেশে কতটা সমস্যা তৈরি করেছে।

মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে ওয়েস্টার্ন নর্থ পেসিফিকই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, যেখানে প্রতি এক বর্গ কিলোমিটারে সর্বোচ্চ ৩৩৫টি প্লাস্টিক আইটেম পাওয়া গেছে। এই কয়েক বছরের গবেষণায় গবেষকগণ ৬,০০০ মিটারেরও বেশি গভীরে গিয়ে অন্তত ৩,৪২৫টি ডেব্রিস খুঁজে পেয়েছে যাদের এক তৃতীয়াংশই ছিল প্লাস্টিক প্রোডাক্ট দিয়ে তৈরি। এছাড়াও সেখানে রয়েছে ধাতব, রাবার, ফিশিং গিয়ার, কাঁচের বোতল, মানুষের মল ইত্যাদি, যেগুলো একত্রে মিলে এই ডেব্রিসগুলো তৈরি করেছে।

সব থেকে বেশি চিন্তার যে বিষয়টি, তা হল সমুদ্রে বসবাসরত প্রাণীগুলো এসব মানব সৃষ্ট আবর্জনার কারণে ক্ষতির শিকার তো হচ্ছেই, সেই সাথে অনেক স্টারফিশ, মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর দেহের অভ্যন্তরেও পাওয়া যাচ্ছে এসব প্লাস্টিক! পূর্বের একটি গবেষণায় গবেষকগণ সমুদ্রের ৭ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে বসবাসরত ৯০টি ক্রাস্টাসিনের (চিংড়ী জাতীয় প্রাণী) দেহের ইন্টেস্টিনাল ট্র্যাক্টে বিভিন্ন রকমের সিনথেটিক ফাইবার খুঁজে পেয়েছিলেন যাদের মধ্যে রেয়ন, লিওসেল এর মত মাইক্রোফাইয়ারও রয়েছে। এই রেয়ন, লিওসেল প্রভৃতি মাইক্রোফাইবার দিয়ে নাইলন, পলিএমাইড, পলিথিলিন (পলিথিন ব্যাগ এর মেটারিয়াল) ও পিভিসি (প্লাস্টিক এর পাইপ তৈরির মেটারিয়াল) তৈরি হয়।

এই গবেষণায় আরও একটা বিষয় উঠে আসছে, আর তাহল, মানুষের প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে এমন অঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যেখানে মানুষের তেমন কোন আনাগোনাই নেই। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ ছিল এমনই একটা অঞ্চল। গবেষণাটিতে আরও উঠে আসে, ওয়েস্টার্ন নর্থ পেসিফিকের সকল পেলাজিক, মেসোপেলাজিক ও ডিপ সি স্পিসিজই ঝুঁকিতে আছে।

যাই হোক, এই সমস্যার সমাধানের জন্য যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজন, তা হল প্রতিটি রাষ্ট্রেই রাজনৈতিকভাবে প্লাস্টিক ব্ল্যাগ সহ বিভিন্ন প্লাস্তিক আইটেমের উপর বিভিন্ন বিধি নিষেধ আরোপ করা। অনেক দেশেই এটা করা হচ্ছে, এর মধ্যে একটি অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাজ্যের প্লাস্টিক ব্যাগ ট্যাক্স বিধি, যা অনেকটাই সফল হয়েছে।

 

মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমস্যা

এদিকে নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে প্লাস্টিক নিয়ে আরেকটা আশঙ্কাজনক গবেষণা। এটা বলছে আর্কটিক অঞ্চলের বরফে এখন রেকর্ড পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিক ডেব্রিস থেকে বের হওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাইক্রোস্কোপিক কণা (১১ মাইক্রোমিটার রেঞ্জের প্রস্থের হয় যার আকার চুলের ব্যাসের ছয় ভাগের এক ভাগ), যা প্লাস্টিক আবর্জনার ভাঙ্গনের ফলে তৈরি হয়। ২০১৪-১৫ সালে সেন্ট্রাল আর্কটিক থেকে নর্থ আর্কটিকের পঁচটি আলাদা আলাদা স্থান থেকে বরফের স্যাম্পল নিয়ে গবেষণাটি করা হয়। দেখা যায়, প্রতি লিটার বরফে ১২,০০০ এর মত মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা রয়েছে। ইনফ্রারেড স্পেকট্রোমিটার দিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলোকে ট্রেস করা হয়, ফিরে আসা ভিন্ন ধরণের ওয়েভলেঙ্গথ এটি নিশ্চিত করে, আর এভাবেই বোঝা যায় যে সেখানকার বরফগুলো কী বিশাল মাত্রায় দূষিত।

এই মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলোর উপাদান ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে গবেষকগণ এও বের করার চেষ্টা করেছেন যে এগুলো আসছে কোথা থেকে। উপাদান ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে এগুলোকে তারা দুটো ক্যাটাগরিতে ভাগ করে, যার ভিত্তিতে এগুলোর দুটো উৎস্যের কথা বলা যায়। এক হল ক্যানাডিয়ান বেসিনের কাছে যেসব বরফ ভেসে আসে সেগুলোতে প্যাকেজিং মেটারিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত একটি প্লাস্টিক এর পরিমাণ অনেক বেশি পাওয়া যায়, যার নাম হচ্ছে পলিথিলিন। গবেষকগণ মনে করেন, এই প্লাস্টিকগুলো গ্রেট পেসিফিক গারবেজ প্যাচ থেকে বের হয়ে বেরিং স্ট্রেইট (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী স্থান) হয়ে আর্কটিক মহাসাগরে যাচ্ছে। এই গ্রেট পেসিফিক গারবেজ প্যাচ এর বিষয়টা আবার এই প্লাস্টিক দূষণের আলোচনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই স্থানটি পেসিফিক ওশিনেই অনেকটা উত্তর দিকে (চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বলা যায়) অবস্থিত। এটা নিয়ে একটু পরেই আসছি। অগভীর সাইবেরিয়ান অঞ্চলের সমুদ্রগুলোর বরফে আবার পাওয়া যায় জাহাজের রং ও ফিশ নেট থেকে আসা নাইলন ওয়েস্ট এর পার্টিকেল, আর এটাই হল দ্বিতীয় উৎস্য। এই অঞ্চলে বর্ধিষ্ণু শিপিং ও ফিশিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর কারণেই এত এত মাইক্রোপ্লাস্টিক আর্কটিকে গিয়ে মিশছে।

এই বরফগুলোতে মোট ১৭ রকমের মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যেগুলো গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশে (পলিপ্রোপিলিন), পোশাকে (নাইলন), সিগারেট ফিল্টারস (সেলুলোজ এসিটেট) ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। দুই থেকে সর্বোচ্চ এগারো বছরের মধ্যে সমুদ্রের বরফের সাথে এইসব প্লাস্টিক যুক্ত হয়, আর এই সময়ে বরফগুলো সাইবেরিয়ার প্রান্তিক সমুদ্র থেকে বা নর্থ আমেরিকান আর্কটিক থেকে ফ্র্যাম স্ট্রেইটে (গ্রীনল্যান্ড ও নরওয়ে অধিকৃত স্‌ভালবার্ড এর মধ্যবর্তী অঞ্চল) গিয়ে পৌঁছে, যেখানে এই বরফগুলো গলে।

এখনও পর্যন্ত এটা নিশ্চিত না যে, বরফগুলো গলে যাবার পর এই প্লাস্টিক পার্টিকেলগুলো বরফ থেকে মুক্ত হয়ে আবার আর্কটিকেই চলে যায় নাকি মহাসাগরীয় স্রোতের টানে আরও দক্ষিণ দিকে চলে যায়, কিন্তু গবেষকগণ বলছেন যে শৈবাল এবং ব্যাক্টেরিয়ারা এই প্লাস্টিক পার্টিকেলে কলোনি তৈরি করে একে মহাসাগরের গভীরে ডুবিয়ে দেয়, এর সম্ভাবনাও অনেক বেশি।

 

প্লাস্টিক খাচ্ছে সামুদ্রিক মাছ

মাইক্রোপ্লাস্টিক সমুদ্রের গভীর তলদেশে চলে যাচ্ছে, এই প্রসঙ্গ উঠতেই সাম্প্রতিক আরেকটি গবেষণার কথা মনে পড়ল। প্লাস্টিকের কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিক পৃথিবীর সকল মহাদেশ, মহাসাগরেই এখন পাওয়া যাচ্ছে। আর এই বছরেরই ১৯ ফেব্রুয়ারিতে ফ্রন্টিয়ারস ইন মেরিন সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি হতাশার আবিষ্কার, যা বলছে নর্থ ওয়েস্ট আটলান্টিক এর ৭৩ শতাংশ গভীর জলের মাছই এই মাইক্রোপ্লাস্টিক খাচ্ছে! প্লাস্টিক খাওয়া মাছের এত বেশি পারসেন্টেজ এর আগে কখনও দেখা যায় নি।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ আয়ারল্যান্ড এর গবেষকগণ সমুদ্রের ৬০০ মিটার গভীরে গিয়ে ২৩০টি মৃত গভীর জলের মাছ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন, যাদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম ১.৪ ইঞ্চির গ্লেসিয়ার ল্যানটার্নফিশ থেকে শুরু করে দীর্ঘতম ২৩ ইঞ্চির স্টাউট সপ্যালেট ছিল। এই মাছগুলোর পাকস্থলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক এর সন্ধান করা হয়, আর এগুলো থেকে বিভিন্ন রকমের মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়, যেমন একটি টাইনি স্পটেড লান্টার্নফিশ থেকেই ১৩ রকমের মাইক্রোপ্লাস্টিক বের করা হয়েছে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক কী জিনিস সেটা আগেই বলেছি, মাইক্রোবিড থেকেও এই মাইক্রোপ্লাস্টিক এর উৎপত্তি হতে পারে। আমাদের টুথপেস্ট, ফেইস স্ক্রাব, ফেইস ওয়াশ ইত্যাদি বিভিন্ন রকম ওয়াশিং মেটারিয়ালে এরকম মাইক্রোবিড দেয়া হয় যাতে আমাদের স্কিন, জামাকাপড় ভাল পরিষ্কার করা যায়। এগুলোর আকার ১ মিলিমিটারের হয়, আর বিভিন্ন পরিষ্কারক দ্রব্যে এগুলোকে সহজেই বোঝা যায়। আমাদের ব্যবহারের পর এগুলো জলের সাথে মিশে গিয়ে, ড্রেইনেজ সিস্টেম হয়ে শেষে সমুদ্রেই পতিত হচ্ছে।

সমুদ্রের সারফেসে থাকা প্লাস্টিককে খাচ্ছে মেসোপেলাজিক মাছ। এই মেসোপেলাজিক মাছ রাতের বেলায় যখন উলম্ব পথে উপরের দিকে ওঠে, তখন কার্বন ও অন্যান্য পুষ্টি পরিবাহিত হয়ে গভীর সমুদ্রে চলে যায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ বা সারফেসে গিয়ে এই মাছগুলো প্লাস্টিককে প্লাঙ্কটন মনে করে খেয়ে ফেলে। এদিকে প্লাস্টিককে হজম করা যায় না, বরং ধীরে ধীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক জমে পরিপাক নালীকে ব্লক হয়ে যায়, আর তার ফলে এরা মারা যায়। এরা মরে গেলে গভীর সমুদ্রেও আবার পুষ্টি পৌঁছাতে সমস্যা হয়। গবেষকগণ বলেন এই মাছগুলো উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে যেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি, আর এই মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলোর মধ্যে ব্ল্যাক ও ব্লু মাইক্রোফাইবারের পরিমাণই বেশি  যেগুলো রেয়ন, পলিএস্টার ও নাইলনের মত সিন্থেটিক মেটারিয়ালেই বেশি পাওয়া যায়।

সম্প্রতি অনেক সামুদ্রিক প্রাণীকেই প্লাস্টিক ভক্ষণের ফলে মরতে দেখা যাচ্ছে বলে রিপোর্ট হয়েছে। একবার একটি মৃত স্পার্মহোয়েলের পাকস্থলি থেকে প্লাস্টিক সহ ১৭ কেজি আবর্জনা বের করা হয়েছিল যা হজম সম্ভব না, এগুলো ভূমধ্যসাগর থেকে এসেছিল। এরপর নেদারল্যান্ডেও আরেকটা স্পার্মহোয়েল পাওয়া যায় যার স্টোমাক থেকে প্রচুর প্লাস্টিক বের হয়। ওটা ছিল নেদারল্যান্ডে পাওয়া ৫ম মৃত তিমি, যার মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্লাস্টিককেই নিশ্চিত করা হয়। ২০১২ সালের একটা গবেষণায় দেখা যায় সামুদ্রিক কচ্ছপেরা ভাসমান প্লাস্টিককেই অন্যান্য প্লাস্টিকের থেকে বেশি পছন্দ করে, এগুলো পরে সেই কচ্ছপদের গলায় আটকে যায়, আর সেজন্য অনেক কচ্ছপ শ্বাসকষ্টে মারা যায়। এরপর সামুদ্রিক প্রাণী ছাড়াও আলবাট্রস পাখিদের উপরেও প্লাস্টিকের ইমপ্যাক্ট নিয়ে গবেষণা করা হয়। এই পরিযায়ী পাখিরা এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাবার সময় যখন সেই গ্রেট পেসিফিক গারবেজ প্যাচ দিয়ে উড়ে যায় (এদের চলার পথই সম্ভবত ওটা), তখন পথে খাবার খাওয়ার ১২% সময়ে এরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্লাস্টিক তুলে এনে খায়। এরকম বহু উদাহরণ দেয়া যায়, আর এখন যুক্ত হল ৭৫% ডিপ সি ফিশ।

সমুদ্রের প্লাস্টিকের কারণে কত প্রাণীই যে মৃত্যুর মুখে পতিতে হয় তা নির্ণয় করা কঠিন। তবুও কোন কোন গবেষক বলেন এর সংখ্যা বছরে এক লক্ষের মত বেশি হবে। পূর্ববর্তী গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, সকল প্রকার সামুদ্রিক প্রাণীই মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে থাকে, সে জুপ্লাঙ্কটনই হোক, কৃমিই হোক আর মাছই হোক। এই মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো প্রাণীদের দেহে গিয়ে তাদের পরিপাকতন্ত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে, গৃহীত প্লাস্টিক দেহের অভ্যন্তরে ফিজিকাল ড্যামেজ করে, অন্ত্র ফুলে যায়, যার কারণে খেতে সমস্যা হয়। প্লাস্টিকগুলোর সাথে লেগে থাকা এডিটিভগুলোও (কালারিং বা ফ্লেম রিটারডেন্টস) অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে।

যাই হোক, এই গবেষণার কাজ এখানেই শেষ নয়। গবেষকদের এই দলটি আরও বৃহৎ একটি গবেষণায় ব্যস্ত যার উদ্দেশ্য হচ্ছে সকল ইউরোপিয়ান মেরিন স্পিসিজের উপরেই মাইক্রোপ্লাস্টিক কী প্রভাব ফেলছে তা বের করা। এতক্ষন যা বলছিলাম তা এর একটি অংশ ছিল মাত্র।

 

বৃদ্ধি পাচ্ছে গ্রেট পেসিফিক গারবেজ প্যাচের আকার

আগেই বলেছিলাম গ্রেট পেসিফিক গারবেজ প্যাচ (GPGP) বা জিপিজিপি নিয়ে বেশ কিছু কথা বলার আছে। এখন সেটাই শুরু করছি। এটা হল প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত একটি বিশালাকার প্যাচ, যার আয়তন ১৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার (প্রায় তিনটি ফ্রান্সের সমান)। এটা নিয়ে খারাপ সংবাদটি হচ্ছে, এর আকার আগে যা ভাবা হয়েছিল এটা তার থেকেও চার গুণ বিশাল, আর এর আকার জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জিপিজিপি নিয়ে টানা তিন বছরের সারভে করে গবেষকগণ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, আর এর রেজাল্ট প্রকাশিত হয় নেচার সাময়িকীতে এই বছরের ২২ মার্চে। গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে, এই অঞ্চলে প্রায় ১.৮ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের অংশ রয়েছে, যার ভর হবে প্রায় ৮০ হাজার টন! আর এটাই সেই ১৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার স্থান অধিকার করে আছে। আগে যে পরিমাণ প্লাস্টিক এখানে ভেসে এসে জমা হয় বলে তারা মনে করতেন, এর পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি। ফেলে দেয়া ফিশিং নেট থেকে শুরু করে, প্লাস্টিক ক্রেট, বোতল, এমনকি টয়লেট সিটও এখানে পাওয়া যায়। এই প্যাচের সবচেয়ে বেশি স্থান দখল করে আছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যেগুলোর আকার ০.৫ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট।

ভাববেন না যে এই প্লাস্টিকগুলো কেবলমাত্র প্রশান্ত মহাসাগরে ভেসে বেড়ানো জাহাযগুলো থেকেই আসে, এগুলো আসে প্রশান্ত মহাসাগরের আশেপাশে থাকা সকল দেশের সকল সমুদ্রতট থেকে, এমনকি এসব দেশের নদীগুলো থেকেও। এরপর স্রোতের টানে এই সকল গারবেজ এসে এই প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল জায়ারে এসে ঘনীভূত হয়, আর গঠন করে জিপিজিপি।

এই জিপিজিপি বা গ্রেট পেসিফিক গারবেজ প্যাচকে প্রথম প্রেডিক্ট করা হয় ১৯৮৫ সালে, আর আবিষ্কার করা হয় ১৯৯৭ সালে। তখন থেকে এই প্যাচের আকার কমার কোন চিহ্ন দেখা যায় নি, বরং বিপরীতটাই দেখা গেছে। এর কারণ হিসেবে গবেষকদের প্রধান লরাঁ লেব্রেটন জানান, জিপিজিপিতে প্লাস্টিক এক্যুমুলেশন রেট উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়ে এসেছে, যা আশেপাশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি ছিল। এই ব্যাপারটা এটাই নির্দেশ করছে যে এই প্যাচে প্লাস্টিকের ইনফ্লো (ভেতরে আসা) আউটফ্লো (বাইরে যাওয়া) এর তুলনায় বেশি ছিল।

আরেকটা জিনিস পরিষ্কার করছি, এই জিপিজিপিই একমাত্র মেরিন গারবেজ প্যাচ নয়। এরকম মোট চারটি গারবেজ প্যাচ আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলোর প্রত্যেকটাই এরকম প্লাস্টিকে পরিপূর্ণ। অন্য তিনটি হল ইন্ডিয়ান ওশিন গারবেজ প্যাক, নর্থ আটলান্টিক গারবেজ প্যাচ আর সাউদ পেসিফিক গারবেজ প্যাচ। এছাড়া অন্যান্য ওশিন জাইরাতেও মেরিন গারবেজ প্যাচের অস্তিত্ব থাকতে পারে (মহাসাগরে বৃহৎ স্থান ব্যাপী স্রোতের বলয়কে জাইরা বলে)। বাংলাদেশ, ভারত সহ ভারত মহাসাগরের আশপাশের দেশ থেকে আসা প্লাস্টিক নিয়ে গঠিত হয়েছে ইন্ডিয়ান অশিন গারবেজ প্যাচ। দিনকে দিন এই ঘনীভূত প্লাস্টিকের পরিমাণ কমানোর জন্য বা আমাদের প্লাস্টিক ব্যবহার কমানোর জন্য প্রায় সব দেশই চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু সরকারগুলো খুব কম ক্ষেত্রেই সাফল্য দেখাতে পেরেছে। তবে আশার খবর হচ্ছে ওশিন ক্লিনাপ নামে একটি নন প্রোফিট অর্গানাইজেশন জিপিজিপি পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ রকমের জাহাজ সেখানে পাঠাচ্ছে যার ফলে আশা করা যায় ৫ বছরেই জিপিজিপি এর অর্ধেক পরিষ্কার করা সম্ভব হবে। এরপর তারা অন্যান্য জাইরাসের দিকে অগ্রসর হবে।

যাই হোক, গবেষণা এও বলছে যে, যদি এর প্রতিকারের জন্য কিছুই না করা হয়, বা এখন যা চলছে তেমনি যদি চলতে থাকে, তাহলে সামনের ১০ বছরের মধ্যে মহাসাগরে প্লাস্টিকের পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে, আর ২০৫০ সালে এই প্লাস্টিকের ভর সকল সামুদ্রিক মাছের ভরের চেয়ে বেশি হবে। তখন মহাসাগরের পরিবেশের কী অবস্থা ঘটবে, আশা করি বুঝতেই পারছেন।

(চলবে)

 

তথ্যসূত্র: 

১।  মেরিন পলিসি জার্নালের লিংক: https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0308597X17305195?via%3Dihub

২। JAMSTEC অনলাইন ডেটাবেজ, এখানে ডিপ সি ডেব্রিসের বিস্তৃত ক্যাটালগ পাবেন: http://www.godac.jamstec.go.jp/catalog/dsdebris/metadataList?lang=en

৩। সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরে প্লাস্টিক: https://www.ncl.ac.uk/press/articles/archive/2017/11/plasticocean/

৪। যুক্তরাজ্যে প্লাস্টিক ব্যাগ ট্যাক্স: http://www.bbc.com/news/science-environment-36917174

৫। নেচার জার্নালে প্রকাশিত মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে পেপার: https://www.nature.com/articles/s41467-018-03825-5

৬। ফ্রন্টিয়ারস ইন মেরিন সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত পেপার: https://www.frontiersin.org/articles/10.3389/fmars.2018.00039/full

৭। সকল সামুদ্রিক প্রাণীই প্লাস্টিক খায় : https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/21067782 

৮। জিপিজিপির আকার বাড়ছে: https://www.nature.com/articles/s41598-018-22939-w

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.