তরুণ-তরুণীদের যৌন আচরণের ট্রেন্ড অনুযায়ী যৌনশিক্ষাকে হালনাগাদ করা উচিৎ

ধীরে ধীরে পর্নোগ্রাফি মানুষের একেবারে হাতের নাগালে চলে এসেছে। আর উৎসুক টিনেজারদের কাছে এটা দিনকে দিন সুলভ থেকে সুলভতর হচ্ছে। গবেষকগণ দাবী করেন, সম্ভবত এটাই এখনকার ১৬ থেকে ২৪ বছরের তরুণ তরুণীদের “গতানুগতিক” যৌনতার থেকে দূরে সরে যাবার কারণ। আর এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে গবেষকগণ বলছেন, সেক্সুয়াল হেলথ বা যৌনস্বাস্থ্যের ক্লাসগুলোতে সেক্স এডিকেটররা ছাত্রছাত্রীদেরকে যে তথ্যগুলো বা শিক্ষা দিয়ে আসছেন সেগুলোকে হালনাগাদ করতে হবে, যাতে এই তরুণ-তরুণীদের স্বাস্থ্য ও যৌনজীবনে ভাল থাকাকে নিশ্চিত করা যায়।

নতুন এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয় জার্নাল অফ এডোলেসেন্স হেলথ এ। এখানে বলা হয়, পূর্বে ভাজাইনাল পেনিট্রেশন বা যোনিগত অনুপ্রবেশ এবং ওরাল সেক্স বা মৌখিক যৌনতা সাধারণ থাকলেও এনাল সেক্স বা পায়ু যৌনতা তেমন সাধারণ ছিল না। ১৯৯০ থেকে ১৯৯১ এর জরিপে দেখা যায় ১০ জনের এক জন নারী ও পুরুষ যোনিগত, মৌখিক ও পায়ুগত যৌনতার তিনটিতেই অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এই হারটি পুরুষের ক্ষেত্রে চার জনের মধ্যে একজন ও নারীর ক্ষেত্রে পাঁচ জনের মধ্যে একজন।

লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিকাল মেডিসিন এবং ইউনিভারসিটি অফ কলেজ লন্ডন এর গবেষকদের এই দলটি গবেষণায় এও লেখেন যে, শেষ কয়েক দশকে টিনেজদের প্রথম যৌন অভিজ্ঞতার বয়স খুব একটা পরিবর্তিত হয় নি। প্রায় ২৫ বছর পূর্বে (১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল) প্রথম যৌনক্রিয়ার গড় বয়স ছিল ১৪। আর বর্তমানে যোনিগত,  মৌখিক বা পায়ুগত যেকোন উপায়ে প্রথম যৌনক্রিয়ার গড় বয়স হচ্ছে ১৬।

গবেষণাটির প্রধান লেখক, ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগো এর এমআরসি/সিএসও সোশ্যাল এন্ড পাবলিক হেলথ সায়েন্স ইউনিট এর ডঃ রুথ লুইস বলেন, বর্তমান প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ-তরুণীদের ট্রেন্ড বা ঝোঁক অনুযায়ী যৌনতা ও সম্পর্ক সম্পর্কিত শিক্ষার হালনাগাদ করা উচিৎ। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা যেসব বিষয় নিয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করছে তাদের প্রাপ্ত শিক্ষাতেও সেগুলোর প্রতিফলন থাকবে।

লুইস তার বিবৃতিতে জানান, “তরুণ-তরুণীদের যৌনতার সময় এবং এরা কী ধরণের যৌনতায় অংশ নেয় তা পর্যালোচনা করার মাধ্যমে এই গবেষণাটিতে সঠিক যৌনতা ও সম্পর্ক সম্পর্কিত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাটি উঠে এসেছে, যেখানে অনেক বিস্তৃত পরিসরের যৌন আচরণ সম্পর্কিত বিষয় ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত আলোচনা থাকবে। এর দ্বারা তরুণ-তরুণীরা তাদের সর্বোচ্চ ভাল, নিরাপদ ও সুখী যৌনজীবন লাভের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও দক্ষতা লাভ করবে।”

এই বছরের মার্চ মাসে, বিবিসিতে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, যুক্তরাজ্যের সকল স্কুলে সরকার যৌন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। তখন অবশ্য ছাত্রছাত্রীর পিতামাতার হাতে তাদের সন্তানদেরকে এই শিক্ষার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। তবে ২০১৯ সালেই সঠিক বয়স হলেই সকল স্কুলেই যৌনশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়ে যাবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকেও নতুন নিয়মের আওতায় নিয়ে আসা হয়, এতে চার বছরের শিশুকেও নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়।

 

শেষ করার আগে যৌন শিক্ষা বা সেক্স-এড সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলে যাই। আমাদের সমাজে যৌন শিক্ষা একটি ট্যাবুর মত বিষয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরেও আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌনশিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হয়। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের যৌনশিক্ষাকে হালনাগাদ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেখানে মৌখিক ও পায়ুগত যৌনতার মত বিভিন্ন যৌন আচরণ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলিও উঠে আসছে, সেখানে আমাদের দেশে যৌন শিক্ষা সম্পর্কিত ন্যুনতম জ্ঞানটুকু দানে গরিমশি লক্ষ্য করা যায়। আর এর ফল হয়  ভয়াবহ।

তরুণ-তরুণীরা স্বভাবতই বয়োসন্ধির পর এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে, আর এই বিষয়ে কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না থাকায় তাদেরকে দ্বারস্থ হতে হয় পর্নোগ্রাফির জগতে। আর সমস্যা হল এই পর্নোগ্রাফি দাঁড়িয়ে আছে সম্পূর্ণভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ও ভয়ারিজম সহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধের উপর নির্ভর করে। এখানে যে যৌনতা ও যৌনজীবনের প্রতিফলন ঘটে তা প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক থাকে না, এখানকার বাস্তবতা হচ্ছে উদ্দীপিত বাস্তবতা বা অগমেন্টেড রিয়ালিটি। এখানে যৌনক্রিয়া, নারী ও পুরুষ দেহ, নারী ও পুরুষ জননাঙ্গ দেখে তরুণ তরুণীরা মনে করে বাস্তবটাও আসলে এরকমই। আর বাস্তবতা সম্পর্কিত তাদের এই ভ্রান্ত ধারণা ও বিভ্রম তাদেরকে বঞ্চিত করে স্বাস্থ্যকর ও সুখী যৌনজীবন থেকে। এই পর্নোগ্রাফিক জগতের ভ্রমাত্মক সুখানুভূতিতে অভ্যস্ত হওয়ায় তারা ব্যর্থ হয় বাস্তব জগতের সুখানুভূতি অর্জন থেকেও। পর্নোগ্রাফিক জগতের অপরাধ সমূহ সবসময় দেখতে দেখতে তাদের কাছে স্বাভাবিকৃত হয়ে যায় এই অপরাধগুলোও। এগুলো প্রভাব ফেলে তাদের আচরণেও।

আজ যদি আমাদের সমাজে পর্যাপ্ত যৌনশিক্ষার সুযোগ থাকত তাহলে উৎসুক তরুণ-তরুণীদেরকে যৌনতা সম্পর্কে জানতে পর্নোগ্রাফির দ্বারস্থ হতে হত না। তরুণ সমাজের উপর এখন পর্নোগ্রাফির যেরকম কুপ্রভাব পড়ছে তা অনেকটাই কমে আসত। পাশ্চাত্য সমাজে পর্নোগ্রাফির প্রবেশযোগ্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সেখানে বৃদ্ধি পেয়েছে যৌনশিক্ষার প্রবেশযোগ্যতাও। আমাদের সমাজে পর্নোগ্রাফির প্রবেশযোগ্যতা ঠিকই বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এর সাথে তাল মিলিয়ে বাড়েনি যৌনশিক্ষার প্রবেশযোগ্যতা। এই গবেষণাটি আমাদেরকে তরুণ সমাজের ঝোঁক অনুযায়ী যৌন শিক্ষার হালনাগাদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেছে, যুক্তরাজ্যের মত পাশ্চাত্য দেশগুলো শিক্ষা ও ঝোঁকের মধ্যকার অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে এখনই খুব সচেতন। কিন্তু আমাদের সমাজে ন্যুনতম যৌনশিক্ষাটাও দেখা যায় না। দিনকে দিন আমাদের সমাজের এই ঝোঁক বনাম শিক্ষার অসামঞ্জস্যতা তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের আইনপ্রস্তুতকারকগণ কবে এই বিষয়ে সচেতন হবেন?

 

তথ্যসূত্র:

  1. https://www.lshtm.ac.uk/
  2. https://medicalxpress.com/news/2017-11-young-people-sexual-years-revealed.html
  3. http://www.bbc.co.uk/news/education-39116783

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.