প্রাণীজগতে সেক্স রোল রিভার্সাল বা বিপরীত যৌন ভূমিকা

Jacana

অনেক প্রজাতির মধ্যেই নারীদের আকর্ষণ করার জন্য পুরুষরা নিজেদের যৌন বৈশিষ্ট্যকে বিকশিত করেছে এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষদের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরাস্ত করার মাধ্যমে তারা যৌনতার যুদ্ধে সফল হয়। এধরণের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ময়ুরের পাখা বা প্যারাডাইস পাখির পাখা, অথবা  প্রভাবশালী লাল পুরুষ হরিণের ধারালো শিং।

কিন্তু কিভাবে প্রকৃতিতে প্রতিটি লিঙ্গ নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে? কেনইবা সাধারণত পুরুষেরা নারীদের পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়?

গবেষকরা মনে করেন উত্তর আছে বেটম্যানের নীতি’র (Bateman’s principle) মধ্যে, এখানে প্রস্তাব করা হয়েছে যে যৌন নির্বাচন (sexual selection) সেই জেন্ডারের উপরেই বেশি গভীরভাবে কাজ করবে যারা তাদের সন্তানের জন্য কম ইনভেস্ট বা বিনিয়োগ করে।

প্যারেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট বা অভিভাবকীয় বিনিয়োগ প্রস্তাবিত হয় ১৯৭২ সালে আমেরিকান বিবর্তনীয় বায়োলজিস্ট রবার্ট ট্রিভার্স এর মাধ্যমে, এখানে উচ্চ যৌন নির্বাচনের চাপে যৌনতা নির্ধারণের একটি প্রধান কারণ নির্ধারিত হয়।

ট্রিভার্স ও বেটম্যান এর নীতি অনুসারে, যৌন নির্বাচন নারী ও পুরুষের মধ্যে সেই লিঙ্গের ক্ষেত্রেই শক্তিশালী হবে যে প্যারেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট বা অভিভাবকীয় বিনিয়গে কম সম্পদ বণ্টন করে। স্পার্ম বা শুক্রাণু (ক্ষুদ্র) তৈরিতে যে খরচ হয় তা ডিম্বাণু (বৃহৎ) তৈরিতে যে খরচ হয় তার থেকে অনেক কম। এর ফলে পুরুষেরা নারীদের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে জনন কোষ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়, যার ফলে নারী ও পুরুষ এই ফুই লিঙ্গের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের সৃষ্টি হয়।

সাধারণভাবে নারীরা তাদের সন্তানের প্রতি তুলনামূলকভাবে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বেশি বিনিয়োগ করে থাকে, যেমন সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে, সন্তানকে প্রতিপালনের ক্ষেত্রে এবং সন্তানকে সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে। আর সেকারণেই প্যারেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট নারীদের ক্ষেত্রেই অনেক বেশি থাকে। আর অন্যদিকে পুরুষেরা এই নারীদের কাছে প্রবেশাধিকার লাভের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।

বিপরীত যৌন ভূমিকা (sex-role reversal):

বিপরীত যৌন-ভূমিকার ব্যাপারটি তখনই দেখা যায়, যখন নারী যৌন সঙ্গীকে পাবার জন্য পুরুষের চেয়েও তীব্র প্রতিদ্বন্দিতায় জড়ায়। আর এটা প্রকৃতিতে বিরল নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এই তথাকথিত বিপরীত যৌন ভূমিকার বিবর্তন আসে চমৎকার অভিযোজন এর মাধ্যমে। প্রকৃতিতে বিভিন্ন ধরণের উদাহরণ আছে যেখানে পুরুষেরা কেয়ারগিভার বা সন্তানকে যত্ন প্রদানের ভূমিকায় যায় অথবা নারীরা তাদের সঙ্গী পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

উদাহরণের মধ্যে জাকানা ওয়াটার বার্ডস, নিউজিল্যান্ডের কিউই পাখি, টিনামু পাখি, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় পাখি এবং কিছু শোরবার্ড(সমুদ্র উপকূলে বেশীরভাগ সময় থাকে যে সব পাখি) প্রজাতি অন্তর্ভূক্ত।

kiwi

তারপর, সী-হর্স পুরুষেরা সন্তান ধারণ করে এবং তাদের সন্তানরা যতদিন না তারা বড় হচ্ছে ততদিন লালনপালন করে; উভচরেরা যেমন ডেনড্রোবেইটস প্রজাতির কিছু ব্যাঙের প্রজাতি এবং; স্তন্যপায়ীরা যেমন আফ্রিকান টোপি এন্টেলপদের (ডামালিসকাস লুনাটাস) মধ্যেও এমনটা দেখা যায়।

শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিপরীত যৌন ভূমিকার সাথে সম্পর্কিত সবচেয়ে আশ্চর্যজনক প্রক্রিয়াটি দেখা যায় কিছু মাছের মধ্যে যেমন হার্মাফ্রোডাইট জিল্ট-হেড ব্রিম(Sparus aurata)। ডিম ফুটে বের হবার সময় এরা প্রত্যেকেই পুরুষ, কিন্তু দেহের ওজন, হরমোন, এবং বিভিন্ন সোশ্যাল ফ্যাক্টরের প্রভাবে একটি নির্দিষ্ট বয়সে এসে এরা নারীতে পরিণত হয়।

প্রকৃতি এর সীমানাকে আরও বড় করছে:

লিঙ্গের অঙ্গসংস্থান যৌন জননের মতই প্রাণীদের মধ্যকার একটি বৈচিত্রপূর্ণ এবং দ্রুত বিবর্তিত বৈশিষ্ট্য। চিরাচরিত লৈঙ্গিক ভূমিকাসম্পন্ন প্রজাতিগুলোতে গভীর যৌন প্রতিযোগিতা (sexual competition) এর জন্য নারীর চেয়ে পুরুষের ক্ষেত্রে অধিকতর জটিল জননেন্দ্রিয় তৈরি হয়।

 

 

পুরুষ প্রাণীদের দেহে সাধারণত স্পার্ম বা শুক্রাণুকে বাহিত করার জন্য, এই বহনকে আরও উন্নত করার জন্য, নারীর স্পার্ম গ্রহণ প্রক্রিয়াকে স্টিমুলেট করার জন্য বা প্রতিদ্বন্দীদেরকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য জননাঙ্গ ও ইজাক্যুলেটসমূহ (সেমিনাল ফ্লুইড প্রোটিন) বিবর্তিত হয়েছে। কিছু কিছু প্রজাতি যেমন ড্যামশেল-মাছি নারীর মধ্যে পূর্বের কোন পুরুষ মাছির শুক্রানু থাকলে তা বর্তমান পুরুষ মাছিটি তা বেড় করে নিজের স্পার্ম স্থানান্তর করে।

মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে স্পটেড হায়েনার (Crocuta crocuta) নারীদের মধ্যে একটি সিউডো-পেনিস স্ট্রাকচার বা ছদ্মবেশী পুরুষাঙ্গ থাকে। কাব ডেভেলপমেন্টের অন্তিম পর্যায়ে হরমোনাল বুস্টের কারণে তাদের ক্লিটোরিস দীর্ঘ হয়ে এরকম পুরুষাঙ্গ-সদৃশ অঙ্গ তৈরি করে।

এই গঠনটি যা নারীর দেহ থেকে কয়েক ইঞ্চি সামনের দিকে প্রসারিত হয় এবং খুব সংকীর্ণ হয়। এই অঙ্গটির জন্য  পুরুষের সাথে সফল যৌনক্রিয়া ও সন্তান জন্মদানও এই হায়না নারীদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। যদিও তাদের জননাঙ্গ কার্যকারিতায় নারী জননাঙ্গের মত, গঠনগতভাবে এটা পুরুষাঙ্গের মত।

কিন্তু আরেকটি অসাধারণ উদাহরণ রয়েছে যেটি আমাদেরকে নারী ও পুরুষ এই দুই লিঙ্গের মধ্যে থাকা সিলেক্টিভ প্রেশার বা নির্বাচনি চাপ সম্পর্কে আরও গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। সম্প্রতি গুহায় বসবাসকারী পতঙ্গ নিওট্রোগলা (Neotrogla) নামক জেনাসের প্রাণীতে এটা দেখা গিয়েছে। এই জেনাসের প্রজাতিগুলোর ক্ষেত্রে পুরুষদের শরীরে পুরুষাঙ্গ সদৃশ বহিঃস্থ অঙ্গ অনুপস্থিত থাকে, আর নারীদের মধ্যে একটি পুরুষাঙ্গের মত দেখতে অঙ্গ থাকে যাকে গাইনোসোমা বলা হয়। এই গাইনোসোমার মাধ্যমে নারীরা পুরুষের মাঝে পেনিট্রেট করে এবং পুরুষের শরীরে তৈরি হওয়া স্পার্মাটোফোর সংগ্রহ করে।

স্পার্মাটোফোর কী জিনিস সেটা আগে একটু বলা দরকার। স্পার্মাটোফোর হচ্ছে একটা ক্যাপসুল যেখানে স্পার্ম থাকে। অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণী স্পার্মাটোফোর তৈরি করে, আবার মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে যেমন নিউট, স্যালামান্ডারদের মত মেরুদণ্ডীরাও স্পার্মাটোফোর তৈরি করে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে পুরুষেরা এই স্পার্মাটোফোর প্রদান করে। অন্যদিকে নিওট্রগলাদের এই ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে নারীরাই তাদের পুরুষাঙ্গ-সদৃশ অঙ্গের সাহায্যে পুরুষের শরীর থেকে স্পার্মাটোফোর গ্রহণ করে নেয়। এই অঙ্গে কাঁটা রয়েছে যা নারীদেরকে যৌনক্রিয়ার সময় পুরুষ যৌনসঙ্গীর শরীর ভেতর থেকে ধরে আটকে রাখতে সাহায্য করে।

 

 

এখন প্রশ্ন হল ঠিক কী কারণে নিউট্রগলা নারীদের শরীরে এরকম অঙ্গ বিবর্তিত হয়েছে। উত্তরটা খুব সহজ। এটা হয়েছে সেমিনাল ফ্লুইড নিয়ে যৌন প্রতিযোগিতা (sexual competition) এবং যৌন দ্বন্দ্বের (sexual conflict) এর কারণে।

 

Neotrogla

নিউট্রগলা গুহায় বসবাস করে যেখানে সাধারণত খাবার ও জলের বেশ অভাব রয়েছে। এই অবস্থায় সেমিনাল ফ্লুইড অর্জনের প্রতিযোগিতা সাংঘাতিক হয়ে ওঠে, আর এর ফলেই নারীরা যৌন মিলনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। একবার কোন নারী নিউট্রগলা পুরুষ নিউট্রগলাকে পেলে, তার গাইনোসোমা সেই পুরুষকে বেঁধে রেখে দীর্ঘ সময়ের জন্য সংগমে সুবিধা দান করে।

স্টেরিওটাইপ করবেন না:

বিবর্তনের মাধ্যমে যেমন সব প্রাণীর মধ্যে মোটামুটি একটা সাধারণ প্রজনন প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছে, ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে পাওয়া গেছে বেশ কিছু ব্যতিক্রমও। আর এই ব্যতিক্রম -কিভাবে প্রকৃতি ও বিবর্তন কাজ করে সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করে।

চিরাচরিতভাবে যেমনটা ভাবা হত, সেক্সুয়াল স্টেরিওটাইপ ঠিক তেমন ইউনিভার্সাল নয়। নারী ও পুরুষ লিঙ্গ হিসেবে কিভাবে আচরণ করবে বা  কী ভূমিকা পালন করবে তা ফিক্সড নয়, বরং সেগুলোও বেশ কিছু ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল যাদের মধ্যে প্যারেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট বা অভিভাবকীয় বিনিয়োগের প্রাতিসাম্যহীনতা, সেক্স রেশিও বা যৌন অনুপাত, সঙ্গীর প্রাপ্যতা প্রভৃতি রয়েছে।

তাই কোন প্রাণীর মধ্যে বহিঃস্থ বা বাইরে প্রসারিত জননাঙ্গ দেখা গেলেই তাকে নিশ্চিতভাবেই পুরুষ বলা যাচ্ছে না।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

  1. https://theconversation.com/wild-sex-when-sex-roles-get-reversed-some-females-develop-a-penis-54906
  2. https://theconversation.com/male-female-ah-whats-the-difference-12786
  3. http://roberttrivers.com/Robert_Trivers/Welcome.html
  4. https://www.nature.com/scitable/definition/gamete-gametes-311
  5. https://www.britannica.com/animal/jacana-bird-family
  6. https://www.britannica.com/animal/kiwi-bird
  7. https://www.britannica.com/animal/tinamou
  8. https://www.britannica.com/animal/sea-horse
  9. fao.org/fishery/species/2384/en
  10. https://theconversation.com/seen-one-seen-them-all-more-to-genitalia-than-meets-the-eye-2046
  11. http://animaldiversity.org/accounts/Crocuta_crocuta/
  12. https://www.nature.com/news/female-insect-uses-spiky-penis-to-take-charge-1.15064
  13. http://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0960982214003145

 

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.