আবিষ্কৃত হল সমকামিতার বিবর্তনীয় সুবিধা

ফ্রুট ফ্লাই (ড্রসোফিলা মেলানোগ্যাস্টার)

যদি কোন প্রজাতির মধ্যে থাকা কোন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা আচরণ তার প্রজননগত সাফল্য বা ফিটনেসের বিরুদ্ধে চলে যায়, আপনি আশা করবেন না যে বৈশিষ্ট্যটি প্রজাতিটির মধ্যে থেকে যাবে, কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে প্রজাতিটি থেকে সেই বৈশিষ্ট্যটি দূর হয়ে যাবে। প্রজননের খেলার উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমাদের জিনকে টিকিয়ে রাখা ও বয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই যদি হয়, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে পৃথিবীতে এতগুলো প্রজাতির মধ্যে সমকামিতা কেন দেখা যায়? পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত ১৫০০ এর বেশি প্রজাতিতে সমকামিতা দেখা গিয়েছে [১]। যেহেতু প্রজাতিভেদে যেসমস্ত প্রাণিতে সমকামিতা দেখা গিয়েছে, তাদের কাছ থেকে তো আর পরবর্তী প্রজন্ম আসার কথা না। তাহলে এত বছর পরেও কেন সমকামিতা প্রকৃতিতে বিদ্যমান রয়ে গেল? তার তো বহু আগেই সার্ভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট নীতি ফলো করে প্রকৃতি থেকে সম্যক বিদায় নেওয়ার কথা ছিল।

জীববিজ্ঞানীদের কাছে এটা ছিল যেন এক বিবর্তনীয় প্যারাডক্স।[২] তারা ধরে নেন এটা একমাত্র তখনি সম্ভব, যদি সমকামিতা এই সব প্রজাতিতে কোনো না কোনোভাবে উপযোগিতা তৈরী করে। কারণ একমাত্র তাহলেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিবর্তনীয় ছাকুনিতে সমকামিতার টিকে যাবার একটা ব্যাখ্যা দাড় করা যায়। কিন্তু কী সেই কারণ??? অবশেষে বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তরটি; অন্তত-পক্ষে একটি প্রজাতির ক্ষেত্রে হলেও খুজে পেয়েছেন, আর সেই প্রজাতিটি হলো ফ্রুট ফ্লাই (ফলের উপর যে সব মাছি বসে)। ফলের মাছির উপর (fruit flies) করা একটি গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, সমকামিতা যে কেবল হেরিটেবল বা উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্ত তা নয়, সেই সাথে সমকামিতার সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি জেনেটিক মেকাপ বহন করা নারী ফ্রুট ফ্লাইগুলো উচ্চ প্রজনন ক্ষমতা প্রদর্শন করে, যা একটি বিবর্তনগত সুবিধা। এই অসাধারণ গবেষণাটি প্রোসিডিং অব দ্য রয়াল সোসাইটি বি  জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।[৩]

বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে এটা নিয়ে কাজ করেছেন, এবং সর্বশেষ ঐক্যমতে আসতে তাদের বেশ কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। যদিও ভিন্ন ভিন্ন ধারণা প্রচলিত আছে, তবে তার মধ্যে দুইটা ধারণা সর্বাধিক প্রচলিত এবং যেখান থেকে বলা যায়, সমলৈঙ্গিক যৌন আচরণ বা সেম-সেক্স সেক্সুয়াল বিহ্যাভিয়রস বা এসএসবি-কে (same sexual behaviour – SSB) ব্যাখ্যা করা যায়।[৪] এগুলোর একটি হলো অতিপ্রকটতা বা ওভারডমিনেন্স (overdominance) এবং অপরটি হলো যৌন শত্রুতা বা সেক্সুয়াল এন্টাগনিজম (sexual antagonism)।[৫] ওভারডোমিনেন্স এর ধারণা অনুসারে, কোন প্রজাতিতে সমলৈঙ্গিক যৌন আচরণ টিকে যেতে পারে যদি এই আচরণের জন্য দায়ী জিনগুলোর এলিল প্রাণীটিতে হোমোজাইগাস হিসেবে না থেকে হেটেরোজাইগাস হিসেবে থাকে। (কোন জিনের বাবা ও মায়ের  কাছ থেকে প্রাপ্ত এলিল দ্বয় একই হলে সেই লোকাসের জন্য প্রাণীটি হোমোজাইগাস, নাহলে হেটেরোজাইগাস)। সেক্সুয়াল এন্টাগনিজম এর ধারণা অনুসারে, একটি লিঙ্গের জন্য কোন জিন ক্ষতিকারক হলেও তা যদি অপর লিঙ্গের জন্য উপকারী হয়, তাহলে সেই জিনটি প্রজাতিটিতে টিকে যেতে পারে।[৬]   

তাহলে এই প্রকল্পদুটোর মধ্যে কোনটি এই আপাত ক্ষতিকর আচরণটিকে ব্যাখ্যা করে- তা গবেষকগণ কিভাবে বের করলেন? ইউনিভারসিটি অব সেন্ট এন্ড্রুজে করা সাম্প্রতিক এই গবেষণার পেছনে গবেষকদের নির্ধারণ করা যে পদ্ধতিটি কাজ করেছে তা জিনতাত্ত্বিক ও আচরণগত পরীক্ষা উভয়েরই মিশ্রণ বলা চলে।[৭] প্রথমে তারা এসএসবি এর জন্য দায়ী জিন ভেরিয়েশন খুঁজে বের করার জন্য ইনব্রেড ফ্রুট ফ্লাই লাইনকে আলাদা করেন।

পুরুষ ফ্রুট ফ্লাই এর জিনোম পরীক্ষা এবং এরা কিভাবে অন্য পুরুষদের সাথে আচরণ করে তা পর্যবেক্ষণ কোড়ে গবেষকগণ এই কাজটি করেন। এক্ষেত্রে একটি পুরুষ ফ্রুট ফ্লাই এর প্রতি আরেকটি পুরুষ ফ্রুট ফ্লাই এর বিভিন্ন ধরণের কোর্টশিপ আচরণ যেমন লেহন, গান গাওয়া বা উপরে ওঠার চেষ্টা করাকেও বিবেচনায় আনা হয়। আর এরপর এরকম আচরণ দেখানো পুরুষ ফ্রুট ফ্লাইদের মধ্যকার জেনেটিক পার্থক্যগুলোর অনুসন্ধান করা হয়। এই তথ্যগুলোকে ফ্রুট ফ্লাইদের জেনেটিক লাইন সনাক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয় আর দেখা হয় এগুলো উচ্চ মাত্রার এসএসবি এর সাথে সম্পর্কিত নাকি নিম্ন মাত্রার এসএসবি এর সাথে সম্পর্কিত।

গবেষণার অন্তিম পর্যায়ে এই উভয় সনাক্তকৃত জেনেটিক লাইনের উপর এক্সপেরিমেন্টাল ক্রস করা হয় এবং এর ফলে যে নতুন ফ্রুট ফ্লাইদের জন্ম হয় তাদেরকে পরীক্ষা করা হয়। এর মাধ্যমে গবেষকগণ এটা দেখতে চাচ্ছিলেন যে নতুন জন্ম নেয়া ফ্রুট ফ্লাইদের মধ্যে উচ্চ মাত্রার এসএসবি এর সাথে সম্পর্কিত জেনেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, তা নতুন জন্ম নেয়া নারী ফ্রুট ফ্লাইদের প্রজনন হারে প্রভাব ফেলছে কিনা।

গবেষকগণ আবিষ্কার করেন যে তাদের প্রাপ্ত উপাত্ত ওভারডোমিনেন্স প্রকল্পের দিকে বেশি ঝুঁকলেও, ফলাফল দুটোর কোন প্রকল্পকেই বিনা মন্তব্যেই সমর্থন করেনা। প্রকৃতপক্ষে তারা ভাবছেন যে প্রকল্পগুলোর উভয়েই এদের জিন পুলে এসএসবি এর সংরক্ষণের জন্য অবদান রাখে। কিন্তু গবেষণাটিতে এটাই সব থেকে আকর্ষণীয় ফলাফল ছিল না। উচ্চ মাত্রার এসএসবি এর সাথে সম্পর্কিত জিন বহন করা পুরুষদের নারী সন্তানদের প্রজনন হার বেশি হয়, বা এরা বেশি উর্বর হয়, এটার আবিষ্কার ছিল এই গবেষণাটির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক। এই গবেষণাটি নির্দেশ করছে, পুরুষের প্রজননের জন্য ক্ষতিকর হলেও এসএসবি এর সাথে সম্পর্কিত জিনগুলোর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে যাওয়ার কারণ হচ্ছে এটি নারীদের মধ্যে ফিটনেস এডভান্টেজ বা যোগ্যতার সুবিধা প্রদান করে।

 

নির্ঘন্ট:

(১) কোর্টশিপ বিহেভিয়ার কী?? কোর্টশিপ বিহেভিয়ার শব্দের বাংলা ভাষায় কোনো অর্থ পাওয়া না গেলেও, প্রকৃতির নানা ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করে, এধরণের যে কোনো মানুষ জীবে এই আচরণ দেখেছে; যেমন: Agama Lizard (একপ্রকার গিরগিটি) নামক প্রজাতিতে পুরুষ লিজার্ড তার নারী সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য উজ্জ্বল রং ধারণ করে। গৃহপালিত পাখি যেমনঃ পুরুষ মুরগী, মহিলা মুরগীর সামনে তাকে আকৃষ্ট করতে নৃত্য করে, কোর্টশিপ বিহেভিয়ারে পিছিয়ে নেই মানুষও, তারা তাদের সঙ্গীকে আকৃষ্ট করার জন্য, নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করে, যেমন: ফ্যাশনেবল পোশাক পরা, হাল আমলের ডিজাইনে চুল আচড়ানো, নানান গেটআপ নেওয়া ইত্যাদি; এইসবকিছুই কোর্টশিপ বিহেভিয়ারের উদাহরণ।

 

তথ্যসূত্র:

(১) http://www.news-medical.net/news/2006/10/23/1500-animal-species-practice-homosexuality.aspx

(২) http://www.faculty.ucr.edu/~mzuk/Bailey%20and%20Zuk%202009%20Same%20sex%20behaviour.pdf

(৩) http://rspb.royalsocietypublishing.org/content/281/1776/20132123#ref-3

(৪) https://link.springer.com/article/10.1007%2Fs00265-013-1610-x 

(৫) http://rspb.royalsocietypublishing.org/content/282/1809/20150429

(৬) http://www.slate.com/articles/health_and_science/human_nature/2008/06/sexual_antagonism.html

(৭) http://phys.org/news/2015-05-genetic-basis-same-sex-sexual-behavior.html

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.