কিভাবে ঘোড়া বিবর্তনের সবচাইতে বড় প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটির উত্তর দিতে সাহায্য করতে পারে?

৬০০ মিলিয়ন বছর ধরে পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে আমাদের জীবন খাপ খাইয়ে চলছে। প্রাণী এবং উদ্ভিদের বৈচিত্র্যের ফলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি কোণা ভরে গেছে প্রাণের স্পন্দনে। উদ্ভিদ ও প্রাণীরা যেহেতু সবসময়ই টিকে থাকার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তাই এনভায়রনমেন্টাল শিফট বা পরিবেশের পরিবর্তন এবং মাস এক্সটিংকশন বা ব্যাপক বিলুপ্তি উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য আরও নতুন বিবর্তনগত সুবিধার সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু কিভাবে অরগানিজম বা জীবরা এই সব সুবিধাগুলো গ্রহণ করে? তারা কি নতুন পরিবেশের চাপে নতুন বৈশিষ্ট্যে বিবর্তিত হয়? নাকি তারা নতুন পরিবেশের নতুন আবাসে চলে যেতে সক্ষম হয় কারণ তারা ইতিমধ্যেই সঠিক অভিযোজন লাভ করে ফেলেছে? অর্থাৎ আগে নতুন পরিবেশ ও তার ফলে বিবর্তন নাকি আগে বিবর্তন ও তার ফলে নতুন পরিবেশ? বেশিরভাগ বিবর্তনগত গবেষণা বলে, এই দুটোর মধ্যে প্রথমটাই সঠিক, অর্থাৎ আগে নতুন পরিবেশ লাভের মাধ্যমে পরিবেশের চাপ, পরে বিবর্তন। কিন্তু ঘোড়ার বিবর্তন ইতিহাস নিয়ে করা একটি নতুন গবেষণা বলছে যে এরকম ডিম আগে না মুরগি আগে টাইপের প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা আরও অনেক বেশি জটিল।

নতুন পরিবেশে অরগানিজমের টিকে থাকার সম্ভাবনা সেই স্থানের জীববিজ্ঞানগত এবং পরিবেশগত অবস্থার উপর এবং সেই অবস্থাগুলো অরগানিজমটির মৌলিক প্রয়োজনীয়তা বা ইকোলজিকাল নিচ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তার উপর নির্ভর করে। যদি তারা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে সেই অরগানিজম হয়তো স্থানটিতে টিকে থাকতে, খাপ খাইয়ে নিতে এবং উন্নতিলাভ করতে সক্ষম হবে। ইকোলজিকাল নিচ (ecological niche) হল কোন পরিবেশের মধ্যে একটি প্রজাতির ভূমিকা এবং অবস্থান। কিভাবে প্রজাতিটি তার খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা মেটায়, কিভাবে বংশবৃদ্ধি করে তাও ইকোলজিকাল নিচ এর অন্তর্গত।  একটি প্রজাতির ইকোলজিকেল নিচের মধ্যে সেই প্রজাতিটির সাথে পরিবেশের সমস্ত বায়োটিক ও এবায়োটিক ফ্যক্টর বা জৈব-অজৈব উপাদানের মিথোস্ক্রিয়া অন্তর্ভূক্ত। এখন কোন অরগানিজমের ইকোলজিকাল নিচ তার পরিবেশের জন্য যত বেশি বিশেষায়িত বা স্পেশালাইজড হবে, প্রজাতিটির পক্ষে নতুন পরিবেশে স্থানান্তরিত হওয়া ততটাই কঠিন হয়ে যেতে পারে।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। মোনার্ক বাটারফ্লাইদের শুয়োপোকারা বলতে গেলে কেবল মিল্কউইড (দুধের মত রস বিশিষ্ট একপ্রকার গুল্ম) খেয়েই বাঁচে। এটা কল্পনা করা খুবই কঠিন যে এই শুয়োপোকারা এমন একটি নতুন স্থানে বসতি স্থাপন করেছে যেখানে তাদের এই খাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উৎস্য মিল্কউইডই অনুপস্থিত। আরেকটি বিষয়ও মাথায় আনতে হবে, একটি অরগানিজম একটি নতুন পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম, এর মানে এই নয় যে, অরগানিজমটি সেই স্থানে পৌছাতেও সক্ষম হবে। যেমন, পোলার বিয়ার বা মেরুভল্লুকদের প্রাকৃতিকভাবে উত্তর মেরু থেকে এন্টার্কটিকায় এসে বসতি স্থাপন করা একেবারেই অসম্ভব।

কিভাবে অরগানিজমরা নতুন পরিবেশ এবং ইকোলজিকাল নিচ অর্জন করার জন্য নতুন বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত করে এবিষয়ে আমাদের বেশিরভাগ জ্ঞান বা ধারণাই পাওয়া যায় এডাপটিভ রেডিয়েশন নিয়ে গবেষণাগুলোর মাধ্যমে। এডাপটিভ রেডিয়েশন হচ্ছে একটি বিবর্তনগত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে অরগানিজমরা দ্রুতগতিতে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিভিন্ন ধরণে ডাইভার্জ বা অপসৃত হয়। আর এটার ক্ষেত্রে অনেকগুলো অসাধারণ উদাহরণ আছে যেমন গেলাপেগস দ্বিপপুঞ্জে ডারউইনের ফিঞ্চ, পূর্ব আফ্রিকার লেকের চিচলিড মাছ এবং ক্যারিবীয় দ্বিপপুঞ্জের এনোলিস লিজার্ড।

এধরণের গবেষণা থেকে এটা দেখানো হয়েছে যে, প্রাথমিক ভাবে এডাপটিভ রেডিয়েশনগুলো ইকোলজিকাল অপোরচুনিটি বা বাস্তুসংস্থানিক সুবিধাগুলোর দ্বারাই শুরু হয়। এই ইকোলজিকাল অপোর্চুনিটি দ্বারা পরিবেশগত ঘটনাগুলোর পরিবর্তনের সময় প্রজাতিটির টিকে থাকার সম্ভাবনা বোঝানো হয়। এই অপোরচুনিটিগুলোর মধ্যে আছে একটি মাস এক্সটিংকশন ইভেন্টের ফলে পরিবেশে প্রতিযোগী বা শিকারির সংখ্যা কমে গিয়ে একটি ভ্যাকান্ট নিচ (vacant niche) তৈরি হলে, সেই শূন্যস্থানকে পূরণ করার সুযোগ, একটি নতুন আসা খাদ্যসম্পদের সুযোগ ইত্যাদি।

যেহেতু প্রাণী বা উদ্ভিদরা এইসব ইকোলজিকাল অপোর্চুনিটিগুলোকে ব্যবহার করে, আমরা আশা করতে পারি যে তারা তাদের নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য দ্রুত দৈহিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে। এরপর অপোরচুনিটিগুলো ফুরিয়ে গেলে দৈহিক পরিবর্তনের গতিও কমে যাবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী বা প্রেডিকশনটি অনেকগুলো বিবর্তনগত গবেষণার মূল ভিত্তি স্থাপন করে, যদিও এখন একটি গবেষণা এই এজাম্পশনগুলোর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

 

ঘোড়ার ইতিহাস

ঘোড়ার বিবর্তন খুব ভালভাবেই তাদের ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায় এবং কিভাবে ট্রেইট ইভোল্যুশন এর সাথে বিবর্তনগত সাফল্য সম্পর্কযুক্ত এবিষয়ে ঘোড়ার বিবর্তন একটি টেক্সটবুক এক্সাম্পল। গত ৫০ মিলিয়ন বছরেরও পূর্ব থেকে, ঘোড়া একটি কুকুরের আকৃতির বন্য প্রাণী থেকে আজকের এই বহুল পরিচিত ঘোড়ায় বিবর্তিত হয়েছে।

ঘোড়া তার বিবর্তনের পথে প্রচুর এনভায়রনমেন্টাল এডভান্টেজ বা পরিবেশগত সুবিধা লাভ করেছে, যেমন মাঠে ঘাস খাওয়ার জন্য তাদের দাঁত পরিবর্তিত হয়েছে, দ্রুতগামিতার জন্য তাদের খুরের পরিবর্তন হয়েছে। যদিও বর্তমানে এই এডাপটিভ রেডিয়েশনের মাত্র ৭টি প্রজাতিই জীবিত (ঘোড়া, গাধা, প্লেইনস জেব্রা, মাউন্টেইন জেব্রা, গ্রেভিস জেব্রা, কিয়াং এবং অনেজার), তবুও এদের কয়েকশো বিলুপ্ত প্রজাতির ফসিল খুঁজে পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি সায়েন্স  জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে ১৮ মিলিয়ন বছর ধরে চলা ঘোড়ার বিবর্তনের উপর নজর দেয়া হয়েছে এবং এটা বের করার চেষ্টা করা হয়েছে যে নতুন ঘোড়ার প্রজাতির বিবর্তনের সাথে দ্রুত শারীরিক পরিবর্তনের কোন সম্পর্ক আছে কিনা। আপনি যেমনটা আশা করতে পারেন, যখন ঘোড়া নতুন ইকোলজিকাল অপোরচুনিটি লাভ করে তখন তার বিবর্তন প্রচুর বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে যায়, বলতে গেলে তার ডাইভারসিফিকেশনের বিষ্ফোরণ ঘটে। আর এক্ষেত্রে তাদের অপোরচুনিটিগুলোর মধ্যে ছিল খাদ্যের বর্ধিত প্রাচুর্যতা, যার অর্থ হল ঘোড়ার আরও বেশি সংখ্যক এবং আরও বৈচিত্রপূর্ণ পপুলেশন সেই পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম হবে।

ঘোড়া আরেকটি ইকোলজিকাল অপোরচুনিটি লাভ করেছে, তা হল তারা বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ ব্যবহার করে আমেরিকা থেকে সাইবেরিয়ায় যাবার সক্ষমতা অর্জন। এই সাইবেরিয়া থেকে তারা পরবর্তীতে ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বসতি স্থাপন করতে সক্ষম হয়।

কিন্তু ফসিল রেকর্ড বলছে ঘোড়ার এই ডাইভারসিফিকেশন বা বৈচিত্র্যের বিষ্ফোরণ নতুন শারীরির বৈশিষ্ট্য যেমন শরীরের আকার ও দাঁতের আকৃতির মত বিষয়ের দ্রুত বিবর্তনের ফলে হয় নি। ওল্ড ওয়ার্ল্ডে বংশ বিস্তার করতে ঘোড়ার পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল না। আর এর কারণ সম্ভবত আমেরিকার পরিবেশে এরা ইতিমধ্যেই একইরকম তৃণভূমিতে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল।

যেসব শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিভিন্ন এলাকায় আধুনিক ঘোড়াদের প্রজাতিগুলোকে আলাদা করে দেয়, সেগুলো পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়েছে। সেগুলো সম্ভবত এক্সট্রিম বা চরম পরিবেশগত অবস্থা এবং সম্পদের প্রাচুর্যতার জন্য একটি সল্পমেয়াদী প্রতিক্রিয়া।

সাম্প্রতিক এই গবেষণাটির ফলাফল আমাদেরকে কেবল পৃথিবীর একটি অন্যতম সফল স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনগত ইতিহাস সম্পর্কে নতুন জ্ঞানই দেয় নি, সাথে কখন এবং কেন অরগানিজমরা তাদের প্রতিবেশে খাপ খাইয়ে নেয় সে বিষয়েও আমাদের জ্ঞান আরও বর্ধিত করেছে। তাই যখন বিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘নতুন পরিবেশ ও বিবর্তনের মধ্যে কোনটি আগে?’ এই প্রশ্ন আসে, তখন সম্ভবত এর উত্তর হবে, “উভয়ই”।

 

তথ্যসূত্র:

  1. http://science.sciencemag.org/cgi/doi/10.1126/science.aag1772
  2. http://monarchjointventure.org/images/uploads/documents/MilkweedFactSheetFINAL.pdf
  3. http://www.blc.arizona.edu/courses/schaffer/182h/grantsciamer.pdf
  4. https://www.researchgate.net/publication/6938718_African_cichlid_fish_A_model_system_in_adaptive_radiation_research
  5. http://www.ichthus.info/Evolution/DOCS/Replicated-evolution-01.pdf
  6. http://www.journals.uchicago.edu/doi/pdfplus/10.1086/652433
  7. http://www.amnh.org/exhibitions/horse/the-evolution-of-horses/

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.