দুই বন্ধুতে কানেকশন ও কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট তত্ত্ব……

কাউকে যদি পাগল বানাইতে চান, ধইরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে ছাইড়া দেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এইরকমই আরেক মাথা পাগল করা থিওরি কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট তত্ত্ব। মাথা পাগল করা এই জন্য বললাম যে, তত্ত্ব বা থিওরিটা পড়ে আপনার মনে হবে, এ কিভাবে সম্ভব?? ক্যামনে ম্যান ক্যাম্নে??

যাক ভূমিকা ছেড়ে এইবার তত্ত্বে আসি। প্রথমেই বুঝে নেয়া দরকার এনট্যাঙ্গলমেন্ট মানে কি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ব্যবহৃত Entanglement শব্দটাকে আসলে Connected বলেও ভাবা যায়। জিনিসটা অনেকটাই টিভি সিনেমায় দেখা যাওয়া ব্যাপার স্যাপারের মতন, যেখানে দেখা যায় অনেক দূরে অবস্থান করা একজন প্রিয় মানুষের কষ্ট আরেকজন কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়! যদি আসলেই এমনটা টের পেয়ে যায় আমরা বলতে পারি যে তারা দু’জন হচ্ছে Entangled। একজনের প্রভাবে আরেকজন প্রভাবিত হচ্ছে। বাংলালিংকের নতুন এড টা এনট্যাঙ্গলমেন্ট বোঝানোর জন্য পারফেক্ট।
“দুই বন্ধুতে কানেকশন
ইন্সট্যান্ট তার রিঅ্যাকশন ”

এইটাই হইলো এনট্যাঙ্গলমেন্ট। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে বন্ধু নয়, তারা হইলো দুইটা কণিকা। যেমন হতে পারে দুইটা ইলেকট্রন। Entanglement বলতে কী বোঝায় তা বোঝা গেল। এবার আসা যাক Quantum Entanglement এ। যেমনটা আগেই বলেছি যে, একজোড়া পার্টিকেলকে Entangled বলা যায় যদি তারা এমনভাবে Connected থাকে যে একটির কোন বৈশিষ্টের পরিবর্তন আরেকটিকে প্রভাবিত করে।

ধরা যাক, একটির স্পিনের যে দিক আছে তাকে আমরা পরিবর্তন করে একেবারে উলটো করে দিলাম। সাথে সাথে দেখা যাবে অপরটির স্পিনের দিকও উল্টে গেছে।এই পরিবর্তন কণা দুইটি কাছাকাছি থাকুক আর বিশ্বজগতের দুই বিপরীত প্রান্তে থাকুক, হবে কিন্তু সাথে সাথেই। এই অদ্ভূত ব্যাপারটাকেই বলা হয় Quantum Entanglement।

একটির পরিবর্তনের তথ্য আরেকটির কাছে পৌছে যাচ্ছে কিন্তু সাথে সাথেই, তারা হয়ত বিশ্বজগতের দুই বিপরীত প্রান্তে রয়েছে তাও। এখন লক্ষ্য করা যাক, বিশ্বজগতের এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে কিন্তু আলোরও যেতে অসীম সময় লাগবে। কিন্তু এই তথ্য চলে যাচ্ছে সাথে সাথেই।অর্থাৎ তথ্যের ট্রান্সফার হচ্ছে আলোর বেগের চেয়ে দ্রুতবেগে! এই ঘটনার ব্যাখ্যা একদম শেষের দিকে দিচ্ছি। তার আগে কিছু ঘটনা বলে নেই।

বলাই বাহুল্য, এই অদ্ভুতুড়ে থিওরি কেউই প্রথম দিকে তেমন পাত্তা দেন নি। স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি যেখানে বলে যে কোনো কিছুর বেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না; সেখানে এই তত্ত্ব তার দিকেই ইঙ্গিত করছে! ফলে চাপা পড়ে গেল এ তত্ত্ব।মানে গবেষণাগারেই বন্দি পড়ে রইল দীর্ঘদিন।

এইবার আরেকখানা কাহিনী বলি ……

ইউরোপিয়ান রবিন পাখি ছোট্টো পরিযায়ী পাখি। ওরা প্রতি বছর স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে আফ্রিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে এসে পড়ে শরতে, শীত কমলে বসন্তকালে আবার ফিরে যায় নিজভূমিতে। যেতে আসতে মোট ১৩০০০ কিমি রাস্তা এরা উড়ে যায় একেবারে অনায়াসে, একটুও দিক ভুল হয় না। এইসব পাখিদের যারা কিনা এরকম হাজার হাজার কিমি পরিযান করে, তাদের কি তবে ভিতরে জৈব কম্পাসের মতন কিছু আছে?

৭০ এর দশকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক, Wolfgang আর Roswitha Wiltschko এই নিয়ে কাজ করতেন। আফ্রিকা থেকে ফিরেছে এমন কয়েকটা রবিন ধরে এই গবেষক দম্পতি তাদের কৃত্রিম চৌম্বকক্ষেত্রে রাখলেন। আর দেখলেন এইসব রবিনরা চৌম্বক্ষেত্রের অভিমুখ উলটে দিলেও কিছু পাত্তা দেয় না, তার মানে উত্তরও যা দক্ষিণও তা এদের কাছে। তাহলে?

তাহলে এরা কীভাবে ওরকম নির্ভুল যায় আসে? গবেষক দম্পতি আরো পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন এই পাখিদের উপরে। দেখলেন পৃথিবীর চৌম্বক বলরেখা যে কোণ করে পৃথিবীর উপরিতলের সঙ্গে, এই পাখিরা সেটা বুঝতে পারে। শুধু এইটুকুই দরকার হয় এদের ঐ হাজার হাজার কিমি পথ ঠিকভাবে চিনে চিনে আসতে যেতে। বিজ্ঞানীদ্বয় আরো পরীক্ষা করে দেখলেন পাখিদের চোখ বেঁধে দিলে আর পাখিগুলো এই চৌম্বক বলরেখার কোণ বুঝতে পারে না। তার মানে কি এদের চোখের ভিতরে কোনো সংবেদী জৈবযন্ত্র রয়েছে যাতে এরা এই চৌম্বক বলরেখার কৌণিক ব্যাপারটা ধরতে পারে?

২০০০ সালে, Thorsten Ritz আর তার সহকর্মীরা বললেন এই রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের মধ্যে। এই তত্ত্ব আগেই প্রস্তাব করেছিলেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের Klaus Schulten, সেই তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করেই রিটজ ও তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানীরা বললেন, ঐ পাখির চোখে এমন কিছু জৈব অণু আছে যেখানে দুটি ইলেকট্রন এমনভাবে জুড়ি হয় যেন তাদের মোট স্পিন শূন্য হয়। এরা হয়ে পড়ে এনট্যাঙ্গলড পেয়ার। যখন জৈব অণুটি বাইরে থেকে আলো পায়, ফোটন গ্রহণ করে, তখন এই এনট্যাঙ্গলড ইলেকট্রনজুড়ি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, দু’খানা ইলেকট্রন বাইরের চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে দুইরকম ভাবে সাড়া দেয়। পৃথিবীর চৌম্বকবলরেখার কোণ যেরকম হবে পৃথিবীর উপরিতলের সঙ্গে, ইলেকট্রন দুটির সাড়া দেবার তফাৎটিও হবে ঠিক সেরকম।
দুটি কণা এমনভাবে কো-রিলেটেড হয়ে থাকে যেন তারা একই। এই কণাদুটির মধ্যে দূরত্ব যদি হাজার কিলোমিটার হয় বা হাজার আলোকবর্ষ হয়, কিছুই এসে যায় না। এরা জুড়ে থাকে অদ্ভুত কণাজুড়ি হয়ে, এদের আলাদা করা যায় না। বিনা সুতার মালার দু’খানি পুঁতি যেন। দেশকাল যেন কিছুই না এদের কাছে, মূল ব্যাপার হলো এই এনট্যাঙ্গলমেন্ট। এসব জিনিস বৈজ্ঞানিকেরা কি আর সহজে নিতে চান?? সত্যি বলতে কি আইনস্টাইনের মতন বড় বড় বৈজ্ঞানিক এইধরনের প্যারাডক্স দেখিয়েই কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অসম্পূর্ণ বলতেন। তখন তাঁরা এসব দেখাতেন থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে। তখনো টেকনোলজি এমন অবস্থায় আসেনি যে সত্যি করে চেক করা যাবে।

এখন যেই না সত্যি সত্যি এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে গেছেন বৈজ্ঞানিকেরা, দেখেন ঠিক সেই সেই অদ্ভুত কান্ডগুলোই হচ্ছে। কোয়ান্টামই সত্য, যতই অদ্ভুত আর অসম্ভব বলে মনে হওয়া আউটকামই হোক এই তত্ত্বের, সেইসবই চাক্ষুষ দেখা যাচ্ছে। মেনে না নিয়ে উপায় কোথায়?
২০০৩ সালে লন্ডনের একদল গবেষক একটা পরীক্ষা করলেন। একখন্ড লিথিয়াম ফ্লোরাইড লবণ নিয়ে একটা চৌম্বকক্ষেত্রে রাখলেন। এই লবণখন্ডের মধ্যে কোটি কোটি অণু, কোটি কোটি পরমাণু দিয়ে গড়া। পরমাণুগুলোর নিজের নিজের স্পিন আছে যেন ছোটো ছোটো চুম্বক। বাইরের এই চৌম্বকক্ষেত্রের সঙ্গে তারা নিজেদের একরেখায় আনে। গবেষকরা বাইরের চৌম্বকক্ষেত্রের তীব্রতা বাড়ালেন, পরমাণুরা এত দ্রুত নিজেদের একরেখায় এনে ফেললো যে পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ার গণিত যে হিসেব দেয় কতক্ষণে নিজেদের একলাইনে আনবে, সেই হিসাবে বিলকুল গরমিল দেখা দিলো, বাস্তবে ওরা অনেক তাড়াতাড়ি লাইনে এসে গেছে।

গবেষকরা নানারকম আঁক কষে মেপে টেপে দেখে সিদ্ধান্তে এলেন এখানে এনট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটেছে, এত এত পরমাণুরা সব এনট্যাঙ্গলমেন্টের দ্বারা জুড়ে এক হয়ে গেছে। তাপীয় ঝামেলা যাতে এড়ানো যায় তাই এই গবেষকেরা এক্সপেরিমেন্টটা করেছিলেন খুব কম তাপমাত্রায়, মিলিকেলভিনে। তারপরে ব্রাজিলের গবেষকেরা এইধরনের পরীক্ষা করলেন ঘরের তাপমাত্রায় মানে প্রায় ৩০০ কেলভিনে। কিন্তু সেখানেও দেখা গেল এনট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটেছে। ব্রাজিলের এঁরা ব্যবহার করেছিলেন কপার
কার্বক্সিলেট, এই পদার্থে পরমাণুএর স্পিনের আন্ত:ক্রিয়া এত তীব্র যে তাপীয় ছটফটানিকে দাবিয়ে দেয়। পদার্থবিদেরা ক্রমাগতই বড় বড় বস্তুতে আর উচ্চ উচ্চ তাপমাত্রায় পরখ করে দেখতে পাচ্ছেন যে এই কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট ঘটছে।

সেই ১৯৯৯ সালেই ফুলারিন অণুর ইনটারফেরেন্স প্যাটার্ন দেখান বিজ্ঞানীরা। ২০০৫ সালে ক্যালসিয়ামের আটটি আয়নকে এনট্যাঙ্গলড করলেন। ২০০৯ সালে বেরিলিয়াম আর ম্যাগনেশিয়ামের আয়নদের। ২০১০ আর ২০১১ সালেও উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা হয়েছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স সমস্ত ক্ষেত্রেই উপস্থিত, বড় বা ছোটো। সাম্প্রতিক পরীক্ষানিরীক্ষায় এসব ব্যাপার যত
বেশি করে দেখা যাচ্ছে তত বাড়ছে ক্যাচাল আর বোঝা চাপছে তাত্ত্বিকদের ঘাড়ে। লাও ঠ্যালা, এখন মাথাগোলানো এই তত্ত্বের রহস্যগুলোর জট ছাড়াও।

যাক, আর কথা বাড়াবো না। কিভাবে এত দ্রুত তথ্য কোরিলেটেড পার্টিকেলগুলোর কাছে পৌঁছে যায় অর্থাৎ এই Entanglement এর যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় তা এর চেয়েও অদ্ভুত। দু’টো টেনিস বল যদি একটা আরেকটার গা ঘেষে লাগালাগি অবস্থায়
ঘুরতে থাকে এবং তখন যদি আমরা একটার ঘোরার দিক উল্টে দেই তাহলেই কিন্তু আরেকটার ঘোরার দিকও উল্টে যাবে।এভাবে বলা যায় জিনিসটাকে যে যখন বল দু’টোর মধ্যে কোন স্পেস না থাকে তখনই কিন্তু একটার চেঞ্জ আরেকটাকে প্রভাবিত করে। এখানে বল দু’টোকে কণাদু’টোর সাথে তুলনা দেয়া যায়।

কিন্তু এর মানে যা দাঁড়াচ্ছে তা হল যখন কণা দু’টি বিশ্বজগতের দুই বিপরীত প্রান্তে থাকে তখনও তাদের মাঝে স্পেস বলে কিছু থাকে না। অর্থাৎ স্পেস বলে যে জিনিসটা আমরা বুঝি তা আসলে আমাদের কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। বাস্তবে স্পেস বলে কিছুই নেই। আপনার ক্লাসে লেকচার দিতে থাকা প্রফেসর এবং শেষ বেঞ্চে মোটামুটি নিরাপদ জায়গায় বসে মোবাইলে গেম খেলতে থাকা আপনার মাঝে কোন স্পেস নেই। এর চেয়ে অদ্ভূতুড়ে আর ভয়াবহ কী হতে পারে?

অতি সম্প্রতি এই এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট নিয়ে আরও অনেক নতুন নতুন গবেষণা হয়েছে। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ সাসকিন্ড দাবী করেন কেবল পার্টিকেলই এনট্যাংগলড হয়ে থাকে না, ব্ল্যাকহোলের মত বড় বড় বস্তুও ওয়ার্মহোলের সাহায্যে এনট্যাংগল্ড হতে পারে। আর এর মাধ্যমে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও জেনারেল রিলেটিভিটির মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। কয়েকজন গবেষক ম্যাক্রোস্কোপিক লেভেলে এন্ট্যাঙ্গেলড স্টেটে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোড লিখতে সক্ষম হন। এই ফলাফলের উপর ভিত্তি করে এখন সিলিকন কার্বাইডে এনট্যাংগল্ড স্টেট তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা করা গেলে তা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম সেন্সরের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়া সিলিকন কার্বাইড বিষাক্ত নয় বলে বায়োমেডিকেল গবেষণাতেও এটা সাহায্য করবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্র উভয় জায়গাতেই কোয়ান্টাম এন্ট্যাংগলমেন্ট আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে, দিতে পারে অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর। যাই হোক, সম্প্রতি কোয়ান্টাম এন্ট্যাংগলমেন্ট সহ আরও বেশ কিছু কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কিত পরীক্ষা বড় পরিসরে করার জন্য চীন একটি কোয়ান্টাম স্যাটেলাইট লাঞ্চ করছে। আশা করা যায় শীঘ্রই আমরা এর মাধ্যমে নতুন অনেক তথ্য জানতে পারব।

 

তথ্যসূত্র :

  1. http://www.physicscentral.com/explore/action/pia-entanglement.cfm
  2. http://www.sciencealert.com/watch-this-is-how-birds-use-quantum-mechanics-to-navigate
  3. http://www.sciencealert.com/this-new-equation-might-finally-unite-the-two-biggest-theories-in-physics-says-physicist
  4. http://english.nssc.cas.cn/missions/FM/
  5. http://www.iflscience.com/technology/quantum-computers-one-step-closer-after-australian-breakthrough

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.