ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র

সমাজতন্ত্র নিয়ে আগ্রহের বিষয় এখন আর নেই। সেটা আমার ব্যক্তিগত কারণেই। আসলে সমাজতন্ত্রও উন্নত সমাজের লক্ষ্য নিয়ে সাধারণ জনগণের জন্যই প্রতিষ্ঠিত। আমরা সকলেই কমবেশী মার্কস এঙ্গেলস এর সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানি । কিন্তু বৃটেনের সেই ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। কারন হতে পারে এটার প্রভাব আমাদের মতো দেশের লোকেদের পর্যন্ত পৌছুতে পারেনি, যেটা পৌছুতে পেরেছে তা হচ্ছে মার্কস এঙ্গেলস এর রক্তাক্ত বিপ্লবের সমাজতন্ত্র।

দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং তাঁর সহযোগী ফ্রেডরিক এঙ্গেলস “কমুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর” (১৮৪৮) মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের যে বাণী প্রচার করেন শতাব্দীর শেষ ভাগে তার আংশিক প্রতিক্রিয়ায় ইংল্যান্ডে “ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের” উদ্ভব ঘটে। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা হচ্ছেন সিডনী ওয়েব ও জর্জ বার্নার্ড শ’। মার্কসবাদকে ডিঙ্গিয়ে বৃটেনে নতুন ধরনের সমাজতন্ত্র প্রচারের ক্ষেত্রে ফেবিয়ান চিন্তাবিদগণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯০ সালে ফেবিয়ান স্যোসাইটি মূলধারায় চলে আসে আধুনিক হয়ে লেবার পার্টির সাথে, এটার কাজের ধরণ আধুনিকায়ন করে ১৯৮০ সালের আদর্শের উপর বেইস করে।

ফেবিয়ান স্যোসাইটির বর্তমান চেয়ারম্যান সীমা মালহোত্রা ২০১৪ সাল হতে এই স্যোসাইটির ওয়েবসাইট অনুসারে।

বৃটেনে যে সব কারণে মার্কসবাদ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নাই সেগুলোর মধ্যে নিম্নে কয়েকটি প্রধান কারনঃ
১। পুঁজিপতিদের শোষণ থেকে নিঃস্ব শ্রমজীবীদেরকে মুক্ত করার জন্য কার্ল মার্কস যে রক্তাক্ত বিপ্লবের প্রস্তাব করেন সে পদ্ধতিটি ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গগতিপূর্ণ নয়।

২। ১৮৬০ থেকে আশির দশকে ইংল্যান্ডে যে সব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয় তার ফলে ইংল্যান্ডের কৃষক ও শ্রমিকদের অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার দেয়া হয়। সরকার স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ লাভ করায় তাদের মধ্যে মার্কসের কল্পিত প্রলেতারিয়েত সুলভ অসন্তোষ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নাই। তাছাড়া ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে বৃটিশ পার্লামেন্ট যে সংস্কার আইন (Reform Act of 1867) পাস করে সে আইন অনুসারে দেশের শ্রমজীবী মানুষ ভোটাধিকার লাভ করে। এর ফলে তারা সরাসরি দেশের আইন প্রণয়নী ও সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তার করায় সুযোগ লাভ করে।

৩। মার্কসবাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পুঁজিবাদ। কিন্তু ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ অপেক্ষা ভূসম্পত্তির প্রধান্য থাকায় এখানে মার্কসবাদ তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নাই। এর ফলে ইংল্যান্ডে পৃথক ধরণের সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে উঠে। এই সমাজতন্ত্র রক্তাক্ত বিপ্লবের পরিবর্তে ক্রমবিবর্তনের পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছে। অর্থাৎ জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সমাজতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হবে। ইংল্যান্ডের এই সমাজতন্ত্রের নাম “ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র”।

আসুন আমরা এই নামের ইতিহাসটা কিছুটা জেনে নেই। হয়তো বর্তমানে সমাজতন্ত্রের অস্তিত্বই নেই। তারপরও অতীতের কিছু বিষয় আমাদের শিক্ষার প্রধান উপকরণ কি না। প্রাচীন রোমের বিখ্যাত সেনাপতি ফেবিয়াস কানক্টেটরের নাম অনুসারে এই ফেবিয়ান সমিতির নামকরণ করা হয়। সমিতির অন্যতম প্রধান সদস্য ফ্রাঙ্ক পডমোর সমিতির মূলনীতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, “কার্থেজের সেনাপতি ‘হানিবলের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় উপযুক্ত মুহূর্তের জন্য প্রাচীন রোমের সেনাপতি ফেবিয়াস যেরুপ ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতেন আমাদেরকেও ঠিক সেভাবেই অপেক্ষা করতে হবে” । এই নামকরণের মধ্য দিয়ে ফেবিয়ান সোসাইটির ধীরে চলা নীতি’র এবং বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। ফেবিয়ানগণ বিশ্বাস করেন যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে ফেবিয়াসদের ন্যায় ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে এবং শ্রেণী সংগ্রামের রক্তাক্ত বিপ্লবের মতবাদ বর্জন করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

ফেবিয়ান সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৪ জানুয়ারী ১৮৮৪ সালে লন্ডনে। তখন এটাকে বলা হতো “দ্যা ফেলোশিপ অফ দ্যা নিউ লাইফ”। তখনইংল্যান্ডের কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ‘ফেবিয়ান সোসাইটি’ নামে একট সমিতি গঠন করেন। যে সকল মনীষীদের যৌথ প্রচেষ্টার ফলে ‘ফেবিয়ান সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁদের মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জর্জ বার্ণার্ড শ’, সিডনী ওয়েব, গ্রাহাম ওয়ালাস, এইচ জি ওয়েলস, এনি বেসান্ত, বিয়াট্রিস ওয়েব, উইলিয়াম ক্লার্ক, সিডনী অলিভিয়ার, স্যার চিত্তজা মানী, রেভাঃ স্টুয়ার্ট হেডলাম, জে ক্যামবেল, জে আর ম্যাকডোনাল্ড। এই বারজন মনীষীর মধ্যে প্রথম দু’জনের নাম ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের সাথে সবচেয়ে বেশী জড়িত। কারণ ফেবিয়ানদের মূল দর্শন প্রধানত এ দুই মনীষীর দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে পরে যাঁরা যোগদান করেন, এমিল ডেভিজ, এ ডি লিন্ডসে, এইচ জে লাস্কি, আর এইচ টর্নী, হটরম্যান ফাইনার এবং লিউনার্ড উল্‌ভ। এ সকল প্রখ্যাত চিন্তাবিদগণ ফেবিয়ান সমিতিতে যোগদান করে ফেবিয়ানদের দর্শনকে আরো বেশী সমৃদ্ধশালী ও জনপ্রিয় করে তোলেন।

ফেবিয়ান সোসাইটি তার জন্মের জন্য মার্কিন চিন্তাবিদ হেনরী জর্জের কাছেও ঋণী। হেনরী জর্জ তাঁর Progress and Poverty – 1879 নামক পুস্তকে বলেন যে, বাহ্যত অসম্ভব মনে হলেও একথা সত্য যে, প্রগতি ও দারিদ্র্য হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়। কারণ ভূমির ন্যায় মূল প্রাকৃতিক সম্পদটি এমন কতিপয় লোকের হাতে গিয়ে পুঞ্জিভূত হয়, যারা এই সম্পদ ব্যবহারের জন্য অন্যদের নিকট থেকে নিজেদের ইচ্ছানুসারে মূল্য আদায় করে। এর ফলে যারা দরিদ্র তারা আরো বেশী দরিদ্র হয়ে পড়ে। হেনরী জর্জ এই বৈষম্যের প্রতিবিধান করার জন্য একক কর ব্যবস্থা (Single Tax System) প্রবর্তনের মাধ্যমে সমগ্র বাড়তি মূল্য সমাজের হাতে ন্যাস্ত করার জন্য সুপারিশ করেন। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রে হেনরী জর্জের প্রভাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সিডনী ওয়েব বলেন Progress and Poverty বইয়ের যাদুস্পর্শে হেনরী জর্জের ফুটন্ত প্রভাবগুলি দানা বেঁধে ওঠে এবং সেগুলি জনপ্রিয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

হেনরী জর্জ যেহেতু ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি মনে করতেন যে, একক কর প্রথা প্রবর্তন করেই সকল সামাজিক ব্যাধি নিরাময় করা সম্ভব, কাজেই তাঁকে প্রকৃত অর্থে একজন সমাজতন্ত্রী বলা যায় না। তথাপি একথা স্বীকার করতেই হবে যে, ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর Progress and Poverty বইয়ের প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সমিতির উৎপত্তি হয় ‘ফেলোশীপ অব দি নিউ লাইফ’ নামক একটি নৈতিক সংস্থার মাধ্যমে আগের বলা হয়েছে। এই সংস্থাটি প্রবাসী মার্কিন দার্শনিক টমাস ডেভিডসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ই আর পীজের (Pease) মতে “পার্থিব জীবনের ধৃষ্টতা ও পাপাচার থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে মানুষ কিভাবে উচ্চতর নৈতিক জীবন যাপন করতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যেই কিছু সংখ্যক উন্নত চরিত্রের মানুষের সমন্বয়ে একটি সম্প্রদায় ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই ছিল ডেভিডসনের লক্ষ্য।

ডেভিডসন একটি নৈতিক প্রচেষ্টা হিসেবে এই ফেলোশীপের মাধ্যমে যে নীতির বাস্তবায়ন কামনা করেন, সেই নীতিকে একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পুর্ণগঠনের নীতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে ডেভিডসনের কয়েকজন ভাবশিষ্য ‘ফেলোশীপের’ দ্বিতীয় অধিবেশনে এমন একটি সংঘ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যার চুড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সর্বোচ্চ নৈতিক সম্ভাবনার আলোকে সমাজকে পূর্ণগঠিত করা। সংঘ প্রতিষ্ঠার এই সংকল্পের ফলশ্রুতি হিসেবেই ‘ফেবিয়ান সোসাইটির’ জন্ম হয়। সোসাইটি সর্ব সম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, “প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা যেহেতু বহু লোকের দুঃখ কষ্টের বিনিময়ে মুষ্ঠিমেয় লোকের সুখ ও আরাম নিশ্চিত করে, কাজেই সমাজকে এমনভাবে পুর্নগঠন করতে হবে যাতে সর্বসাধারণের কল্যাণ ও সুখ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফেবিয়ান সমিতি তার সক্রিয় রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে বৃটিশ লেবার পার্টির সাথে কার্যত একীভূত হয়ে পড়ে। অধ্যাপক কোকারের ভাষায়ঃ “বাস্তব ক্ষেত্রে লেবার পার্টি নিজেকে এত পরিপূর্ণভাবে ফেবিয়ানদের কর্মসূচীর সাথে একাত্ম করে ফেলে যে, এই সোসাইটির ক্রিয়াকলাপ পূর্বের যে কোন সময় অপেক্ষা অধিক পরিমাণে গবেষণা ও তত্ত্বগত আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে”।

তথাপি একথা স্বীকার করতেই হবে যে, ইংল্যান্ডে যতটুকু সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা ক্ষেত্রে ফেবিয়ান সোসাইটির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্য সুত্রঃ

  1. Gray Alexander, Socialist Tradition, London: Longman, 1963 p. 384
  2. F.W. Cocker, Recent Political Thought, London; 1971 p.101-102 & 107
  3. Pease, E.R., The History of Fabian Society, London: Fabian Society, 1963, P.26 & 32
  4. Quoted by L.W. Lancaster, Masters of Political Thought, Vol. III, London; 1969, p. 311
  5. Quoted by Gray, Ibid., p. 386
  6. দর্শন ও প্রগতি : ১৯শ বর্ষ: ১ম ও ২য় সংখ্যা: জুন-ডিসেম্বর, ২০০২
  7. http://www.fabians.org.uk/britains-oldest-think-tank/
  8. https://en.wikipedia.org/wiki/Fabian_Society
  9. http://www.keynesatharvard.org/book/KeynesatHarvard-ch02.html

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.