কীভাবে মানুষেরা আমেরিকা মহাদেশে সর্বপ্রথমে প্রবেশ করেছিল?

উত্তর আমেরিকায় হিউম্যান মাইগ্রেশন রুট

প্রায় এক লক্ষ বছর পূর্বে আধুনিক মানুষ আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আর এই ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে প্রায় ৭০ হাজার বছর। আমরা এও জানি যে, ২৫ হাজার বছর পূর্বে কোন একটি সময়ে একটি দল শেষ আইস এজ বা বরফ যুগে সাইবেরিয়া থেকে আমেরিকায় চলে যায়।

যাই হোক, ঠিক কখন এটা হয়েছিল এবং ঠিক কোন পথ দিয়ে এই দলটি আমেরিকায় পৌঁছেছিল তা অনেক দিন থেকেই একটি বিতর্কের বিষয়। এখন লেকের কাদায় পাওয়া প্রাচীন ডিএনএ এবং উদ্ভিদ অবশেষ এর উপর ভিত্তি করে করা নতুন গবেষণাটি আমাদেরকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সাহায্য করবে। গবেষণাটি নেচার  জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণাটিতে ১৫০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ ভূমি নিয়ে কাজ করা হয়। এটা আইজ এজ বা বরফ যুগের সময় একটি আইস ফ্রি করিডর বা বরফমুক্ত অঞ্চল ছিল। এই জায়গাটি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া-আলবার্টা অঞ্চলে। অনেক বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা এই অঞ্চলটিকে এমন একটি অঞ্চল হিসেবে ধরে আসছিলেন যেখানে শেষ আইস এজে কানাডার প্রায় পুরো অংশকে ঢেকে রাখা বিশাল আইস শিট দুটি মিলিত হয় নি। আর তাই মাইগ্রেশনের মতবাদ সাজেস্ট করছে যে সাইবেরিয়া থেকে আসা এই প্রাচীন অভিযানকারীরা আলাস্কা হয়ে, বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ হয়ে আমেরিকায় এসেছিল। এই অঞ্চলটি সেই সময় নিম্ন সমুদ্রপৃষ্ঠ বা লোয়ার সি লেভেলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এরপর তারা এই ওপেন করিডরে চলে আসে। আর তারপর তারা উত্তর আমেরিকায় বসতি স্থাপন করে।

যাই হোক, নতুন এভিডেন্সগুলো জোগাড়ের পর বিজ্ঞানীরা ভাবছেন এই ব্যাখ্যাগুলো বিশ্বাসযোগ্য কিনা। রেডিওকার্বন ডেটিং সাজেস্ট করছে যে করিডরটাতে যে আইস শিটদুটি মিলিত হয়নি বলে মনে করা হয়েছিল তা আসলে মিলিত হয়েছিল এবং এর ফলে এই করিডরটি আজ থেকে ২৩ হাজার বছর পূর্ব থেকে ১৪-১৫ হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। এদিকে নতুন আর্কিওলজিকাল আবিষ্কারগুলো বলছে আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন মানব অবশেষগুলো ১৪,৭০০ বছরের পুরনো। আর এগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে চিলি থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দক্ষিণে। সেই সময় যেহেতু তারা এত দূরের পথ অতিক্রম করে চিলিতে চলে গিয়েছিল, বোঝা যায় যে তারা অবশ্যই আমেরিকায় আরও অনেক আগেই চলে এসেছিল, তাও যখন কিনা এই বরফের মধ্য দিয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করা অসম্ভব ছিল।

এছাড়াও পুরো উত্তর আমেরিকা জুড়ে প্রাচীন আর্কিওলজিকাল অবশেষগুলোর ডিস্ট্রিবিউশন সেই আইসফ্রি করিডর অঞ্চলের আশেপাশে ক্লাস্টারড নয়। এটাও সাজেস্ট করছে যে এদিক দিয়ে মানুষ দক্ষিণ দিকে গম করে নি।

 

প্রাচীন জলবায়ু ট্রেস করে

গবেষণাটিতে প্রাচীনকালের পরিবেশের অবস্থা নিয়ে কাজ করা হয়। যদি এটা আসলেই মানুষের জন্য একটি মাইগ্রেশন পাথওয়ে বা পরিযায়ী পথ হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই একে মানুষের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর অবস্থানের উপযোগী হতে হবে। অন্যান্য অঞ্চল থেকে আর্কিওলজিকাল এভিডেন্সগুলো দেখায়  যে, উত্তর আমেরিকার মানুষেরা আইস এজ বা বরফ যুগের শেষ ধাপে বাইসন ও ম্যামথের মত বড় বড় প্রাণীদের শিকার করত। এসময় তারা মাছ এবং জলজ প্রাণীদেরও ধরত।

এক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে লেক সেডিমেন্টস বা জলাশয়ের তলানি। এই লেক সেডিমেন্ট এর একটির উপর একটি স্তর বা সাকসেসিভ লেয়ারগুলো থেকে সেই প্রাচীন সময়ের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব কারণ জলাশয়ের কয়েকস্তর নিচের মাটিই অনেক কাল পূর্বে উপরে অবস্থান করত।  গবেষকগণ সেই বরফ মুক্ত বলে ধরে নেয়া করিডরটির একটি এলাকা থেকে ১৩ হাজার বছরের পুরনো সেডিমেন্ট কোর উদ্ধার করেন। সেখানকার পোলেন গ্রেইন বা পরাগ রেণু এবং উদ্ভিদের ছোট ছোট অংশগুলো সেই প্রাচীন পরিবেশে ভেজিটেশন ডেভেলপমেন্ট বা উদ্ভিদের বিস্তার হয়েছিল কিনা সেই বিষয়ে তথ্য দিতে পারে।

দেখা যায় এই লেক সেডিমেন্টে আংশিক পচে যাওয়া বা ডিকম্পোসড বস্তুর মিশ্রণ এবং জৈবিক অবশেষ রয়েছে। এখানে টিস্যুর ডিএনএ এবং বিভিন্ন প্রাণী থেকে নিষ্কৃত রসও আছে যেগুলো সেখানে প্রাণের উপস্থিতিকে নির্দেশ করে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে ডিএনএটি ভেঙ্গে ছোট ছোট টুকরায় বিভক্ত হয়ে গেছে, যার ফলে তথ্য উদ্ঘাটন করাও কঠিন হয়ে যায়। গবেষকগণ এক্ষেত্রে “শটগান সিকোয়েন্সিং” নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন যা এই ভেঙ্গে যাওয়া ডিএনএ অংশের ককটেইল থেকে একটি জানা ডিএনএ ডেটাবেজের অনুকরণে একটি ডিএনএ স্ট্রাকচার দাঁড় করায়।

এই বিশ্লেষণগুলো দেখায় যে প্রায় ১২,৯০০ বছর পূর্বে এই অঞ্চলে একটি বড় লেক ছিল যা গ্লেসিয়াল মেল্টওয়াটার (গ্লেসিয়ার বা বড় বড় বরফ খণ্ডের গলে যাওয়া পানি) দ্বারা তৈরি হয়েছিল। এর আশেপাশের উদ্ভিদগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় খুব অল্প পরিমাণে ছিল। এখানে কেবল কিছু ঘাস এবং বিরুৎ শ্রেণীর উদ্ভিদই ছিল।   ১২,৭০০ বছর পূর্বে এখানে স্তেপ (বা প্রেইরি) এর বিকাশ ঘটে। তখন এখানে সেজব্রাশ, বার্চ এবং উইলো গাছ ছিল। এরফলে সেখানে ১২,৬০০ বছর পূর্বে বাইসন ঘুড়ে বেড়াত এবং ১২,৪০০ বছর পূর্বে সেখানে ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, ম্যামথ, এলক এবং বাল্ড ঈগল বসবাস করত।

সুতরাং এখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে এই করিডরটি মানুষের গমনের উপযোগী হয়েছিল প্রায় ১২,৭০০ বছর পূর্বে। অর্থাৎ এটি আমেরিকায় আসার প্রথম মাইগ্রেশন রুট হতে পারে না। বরং কিছুসময় পরে এটি একটি অল্টারনেটিভ রুটে পরিণত হয়েছিল।

তাহলে কোন পথ দিয়ে মানুষ প্রথম আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল? বর্তমানে সবচেয়ে উপযোগী থিওরিটি হল যখন সি লেভেল নিচু ছিল তখন মানুষ সেখানে বেরিং ল্যান্ড ব্রিজ হয়ে ওয়েস্টার্ন পেসিফিক কোস্ট লাইন হয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করে। সি লেভেল বা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কম থাকায় কোস্টলাইনটি বরফমুক্ত ছিল এবং তখন পানির উপর দিয়ে গমনেরও একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এই থিওরিটির নাম হল “কেল্প হাইওয়ে হাইপোথিসিজ”। এটা আরও সাজেস্ট করছে যে তখন সামুদ্রিক সম্পদও অনেক বেশি ছিল এবং এগুলো সহজেই মাইগ্রেট করা মানুষদের সাপোর্ট দিতে পারত। আর্কিওলজিস্টরা এখন পর্যন্ত এই হাইপোথিসিজটিকে তদন্ত করার জন্য অনেক কষ্ট করে আসছেন কারণ এক্ষেত্রে বেশিরভাগ অবশেষই সমুদ্রে নিমজ্জিত এবং এখন এই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও এখন আইস এজের সময়কার উচ্চতার চেয়ে ১২০ মিটার বেশি।

এই গবেষণাটি থেকে পরবর্তীতে আমেরিকা মহাদেশে আসা মানুষদের সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়। এইসব মানুষদের মধ্যে একটি হল “ক্লোভিস পিপল”। এরা ১৩,৪০০ থেকে ১২,৮০০ বছর পূর্বে অবস্থান করত। বর্তমান তথ্য উপাত্ত থেকে আমরা জানতে পারছি যে এই লোকগুলোও সেই করিডোরকে খুব একটা ব্যবহার করে নি। কারণ স্তেপ অঞ্চল ১২,৭০০ বছর পূর্বের সময়ের আগে ডেভলপ করে নি। কিন্তু এখানেও যে বিতর্ক নেই তা নয়। কারণ এই এলাকায় বাইসনের অবশেষ থেকে করা জেনেটিক এনালাইসিস সাজেস্ট করছে যে, ১৩,৪০০ বছর পূর্বে করিডোরটিতে বিভিন্ন প্রাণী ঘুরে বেড়াত।  অর্থাৎ সেই সময়ে এই অঞ্চলটি মানুষের চলাচলের উপযোগী ছিল।

এখনও অনেক কিছু অজানা থাকলেও খুব দ্রুতগতিতেই যেন আমাদের অজ্ঞতার ধোঁয়াশাগুলো কেটে যাচ্ছে। প্যালিওন্টোলজি, আর্কিওলজি এবং প্যালিওএনভায়রনমেন্টাল কাজের আরও গবেষণার মাধ্যমেই এইসমস্ত সাংঘর্ষিক এভিডেন্সের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

 

তথ্যসূত্র:

  1. http://nature.com/articles/doi:10.1038/nature19085
  2. https://ows.edb.utexas.edu/site/hight-kreitman/land-bridge-theory
  3. https://anthropology.net/2008/05/08/earliest-known-archaeological-evidence-of-americans-found-in-monte-verde-chile/
  4. http://www.medicinenet.com/script/main/art.asp?articlekey=20667
  5. http://natural-history.uoregon.edu/research/paleocoastal-research-project/kelp-highway-hypothesis
  6. http://news.nationalgeographic.com/news/2007/02/070223-first-americans.html
  7. http://www.pnas.org/content/113/29/8057.abstract?sid=22382f85-3627-471d-a342-03e1d56de356

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.