একটি জাহাজের গল্প

গল্পের শুরুটা হয়েছিল গ্রীকবীর থিসিয়ুসের জাহাজে আর শেষ হলো জ্ঞানবীর লিবনিজে!
তবে আদৌ কি শেষ হয়েছিল? উত্তরটা পরে দেই, আগে গল্পটা শুরু হোকঃ
অর্ধেক মানব সে যে অর্ধেক বৃশ্চিক! নাম তার মিনোসৌর, সে দ্বীপরাজ্য ক্রিটের রাজা মিনোসের পুত্র। এথেন্স রাজপুত্র থিসিয়ুস তাকে হত্যার জন্যে একটি জাহাজে করে ক্রিটে যায় এবং অনেক কাহিনীর পর তাকে হত্যা করে সেই জাহাজে করেই ফিরে আসে। কেন যায় আর কিভাবে হত্যা করে সেটা গ্রিক মিথের খুবই জনপ্রিয় কাহিনী।
যাইহোক, থিসিয়ুসের এই বীরত্ব অমর করে রাখতে জাহাজটি বন্দরে রেখে দেওয়া হয় কয়েকশ’ বছর। এর মাঝে যে অংশটিই ক্ষয়ে যেতো তাকে বদলে ফেলা হতো। কখনো দাড়, কখনো পাল, কখনো তক্তা। এভাবে চলতে চলতে একসময় দেখা গেলো জাহাজের প্রতিটি অংশই প্রতিস্থাপন করা হয়ে গেছে। এবারে উদ্ভব ঘটলো সেই বিখ্যাত প্রশ্নের, এটিই কি সেই জাহাজ যাতে করে থিসিউস ক্রিটে গিয়েছিলেন?
প্রাচীন এই প্রশ্নের উত্তরে এরিস্ট্যটল সহ অনেক দার্শনিক অনেক মত দিয়েছেন। তবে সেগুলোতে চোখ বুলানোর আগে তোমরা বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করো, ভেবে বের করো, সত্যি কি এটা সেই জাহাজ? নাকি অন্য কোনো জাহাজ?
( ১ )
হেরাক্লিটাস এই সমস্যার সমাধানে টেনে নিয়ে আনলেন নদী। নদীতে পানি অবিরত প্রবাহিত হয়ে চলে যায়। তিনি বললেন, “এক নদীতে কেউ দুইবার নামতে পারে না”। কারণ একজন যখন নেমেছিল তখন যে পানিকণিকার সমন্বয়ে নদীটি ওইজায়গায় দৃশ্যমান ছিল, আরেকজন নামার সময় সেই কণিকাগুলো বহুদুরে। অবশ্য তার এই উদাহরণটা নিজেই জন্ম দিলো আরেকটা প্যারাডক্সের!
এরিস্ট্যটল আসলেন এরপর। তিনি তো একটু বেশিই জ্ঞানী। তাই তিনি ঘোষণা দিলেন, একটি বস্তুর বর্ণনায় চারটি বিষয় দরকারঃ
  • বস্তুটির নকশাঃ জাহাজটির ক্ষেত্রে এর পরিবর্তন হয় নাই।
  • তার গঠন উপাদানঃ জাহাজের প্রতিটি অংশ প্রতিস্থাপিত হলেও নকশা এবং উপাদানগুলো কিন্তু একই আছে, কাঠের তক্তার জায়গায় অনুরূপ কাঠের তক্তাই বসানো হয়েছে, পালের জায়গায় অনুরূপ পাল।
  • বস্তুর কাজের পরিধি বা উদ্দেশ্যঃ জাহাজের ক্ষেত্রে এটা আগে পরে কিন্তু একই আছে। জাহাজ সবকিছুই প্রতিস্থাপিত হয়েছে, কিন্ত জাহাজটির উদ্দেশ্য কিন্ত পরিবর্তন হয় নাই। থিসিয়ুস ইচ্ছা করলে কিন্ত তক্তাগুলো বদলানোর পরও জাহাজে করে ঐ দ্বীপে যেতে পারেন।
  • এর প্রথম বানানো ও পরবর্তী পরিবর্তনের পার্থক্যঃ যেমন যাদের দ্বারা ও যে প্রক্রিয়ায় জাহাজটি তৈরী হয়েছিল, পরবর্তীতে যেকোনো মেরামত(যেকোনো কাঠ বদলানো, পাল তোলা) কিন্ত একই ধরনের শ্রমিক দ্বারা একই পদ্ধতিতে করা যায়। উভয় কাজ কিন্তু শ্রমিকরাই করেছে, রাঁধুনীরা না।
সুতরাং এরিস্ট্যাটলের যুক্তি অনুযায়ী এটিই থিসিয়ুসের সেই জাহাজ। ঠিক তেমনিভাবে, নদীতে অনবরত প্রবাহ চললেও নদী কিন্তু সেই একটাই!
( ২ )
আচ্ছা এবার আরেকটু এগিয়ে যাওয়া যাক। যদি এমন হয় যে, জাহাজটি মেরামতের সময় যে অংশগুলো বদলে ফেলা হয়েছিল সেই বাতিল অংশগুলো ফেলে দেয়া হয়নি, বরং সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এভাবে মূল জাহাজটার প্রতিটা অংশ প্রতিস্থাপনের পর, সেই পরিত্যক্ত অংশগুলো(যেগুলো মূল জাহাজের প্রকৃত অংশ ছিল) একত্র করে হুবুহু আরেকটা জাহাজ তৈরী করে ফেলা হলো! এবার বলুন, নতুন এই দুটো জাহাজের মধ্যে কোনটিকে থিসিয়ুসের জাহাজ বলা হবে?
13606719_1142629682445596_836750384269983783_n
ধরি, থিসিয়ুসের মূল জাহাজটি , মেরামতের পর জাহাজটি , আর পরিত্যক্ত অংশগুলো নিয়ে বানানো জাহাজটি
তাহলে, ক = খ, নাকি ক = গ, নাকি ক = খ = গ?
আচ্ছা, লিবনিজ এর কথা মনে আছে? ক্যালকুলাস জগতের ট্র্যাজিক হিরো? উপরের প্রশ্নটির সমাধানকল্পে লিবনিজ একটি সূত্র দিয়েছিলেনঃ
ক এবং খ একই বস্তু হবে, যদি ও কেবল যদি, ক এবং খ এর মধ্যে একই বৈশিষ্ট্য ও সম্পর্কাবলি বিদ্যমান থাকে
লিবনিজের সূত্রানুযায়ী, অবশ্যই ভিন্ন দুইটি জাহাজ। এজন্য জাহাজের একটি পাল বিবেচনা করি, মূল পালটি আরেকটি পাল দ্বারা প্রতিস্থাপিত। মূল পালটি থিসিয়ুসের সাথে সাগর পাড়ি দেওয়ায় কাজে লেগেছ, দ্বিতীয়টির সেরকম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। সুতরাং পাল দুইটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। অর্থাৎ ক ও খ দুইটি ভিন্ন জাহাজ।
বরং, জাহাজটি অর্থাৎ যেটি পরে পরিত্যক্ত অংশগুলো নিয়ে বানানো হয়েছিল, সেই জাহাজটির সমস্ত বৈশিষ্ট্য ক এর মতো, সুতরাং একই জাহাজ, নয়।
সুতরাং, অবশেষে লিবনিজে এসে হাজার বছরের সমস্যার সমাধান ঘটে গেল।
( ৩ )
কিন্তু তাই কী? না, তা নয়। শেষ হইয়াও এই বস্ত হইলো না শেষ। নিচের ঘটনা দুইটি বিবেচনা করা যাকঃ
ডেভি জোনস সেই জাহাজের মালিক, তিনি ঘোষণা দিলেন যে, একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন হতে হলে একই জাহাজে ন্যুনতম পাঁচ বছর ফার্স্টমেট থাকতে হবে। উইল টার্নার জাহাজে পাঁচবছর ফার্স্টমেট হিসেবে কাজ করলো, এবং এই সময়ে সংস্কারের ফলে জাহাজ জাহাজে পরিণত হলো, আবার ওইদিকে জাহাজটিও তৈরি করে ফেলা হলো। এখানে, ক্যাপ্টেন নির্বাচনের ক্ষেত্রে থিসিয়ুসের কাছে কিন্তু ক = খ, কারণ এর সাথে টার্নারের কোনো সম্পর্ক নেই।
দ্বিতীয় উদাহরণে মনে করি, জাহাজটি আসলে চুরির মাল, পুলিশ জাহাজটি উদ্ধার করে একজনের হেফাজতে রেখে দেয়। সেখানে জাহাজ থেকে অপভ্রংশ চলে এসেছে। এবারে, অনেকদিন পর জাহাজের মালিক জাহাজটি ফিরিয়ে দেবার আবেদন করে। এখন পুলিশ তাকে কোন জাহাজটি ফিরিয়ে দেবে? না ? অর্থাৎ পুলিশকে বের করতে হবে, একই জাহাজ, নাকি একই জাহাজ?
খ এর বর্তমান মালিক এভাবে যুক্তি দিতে পারে যে, ক এর মালিক খ এর কোনো অংশের জন্যই শ্রম ও অর্থ খরচ করেননি, বরং গ এর উপাদানগুলো প্রকৃতপক্ষে ক এর মালিকের। সুতরাং এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পুলিশের নিকট ক = গ, কিন্ত ক = খ নয়।
সুতরাং, কখনো ক = খ, কখনো ক = গ, কখনো দুটোই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্মলগ্ন, এমনকী প্রতিটা মানুষের জন্মলগ্ন থেকে সত্ত্বা, পরিবর্তন এবং আস্তিত্বের এই যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব চলে আসছে তাকে একসূত্রে বাঁধা এখনো সম্ভব হয়নি। আমাদের চারপাশের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ থেকেই হয়তো বেরিয়ে আসবে বহু আকাঙ্খিত সেই সূত্রটি।
সবশেষে, তিনটি প্রশ্নঃ
  • একটি কোমল শিশু যখন কালের ব্যবধানে বুড়ো হয়ে যায়, তখন কি সে ভিন্ন কেউ হয়ে যায়?
  • সকালেবেলায় শুকতারা আর সন্ধ্যাবেলায় সন্ধ্যাতারা, দু’টো আসলে একই, শুক্রগ্রহ। তাদের এই ভিন্নতা কিভাবে ব্যাখ্যা করা হবে?
  • জাহাজের বিষয়টি অপেক্ষবাদ, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সুপারপজিশন, চতুর্মাত্রিক স্থান-কাল এই তিনটি তত্ত্ব দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
বরং দ্বিমত হও,
আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো,
সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ পরিস্কার করে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.