“হলদে গোলাপ” – রুপান্তরকামীদের জীবন নিয়ে একটি মনস্তাত্বিক আখ্যান

গত দুইদিনে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর “হলদে গোলাপ” বইটা পড়ে ফেললাম। গত বছর আনন্দ পুরষ্কার পাওয়া এই বইটা LGBT কমিউনিটির যাপিত জীবনের উপরে আধারিত। LGBT বললেও মূলত Transgender বা মৌখিক প্রচলিত বাংলায় হিজড়ে, কোতি, ধুরানি, রূপান্তরকামীদের বাস্তবতা, তাদের মানবীয় বা আমাদের তথাকথিত স্বাভাবিক যৌনতার মানুষের কাছে অবমানবীয় জীবন নিয়েই বইটি।

আমার প্রিয়তম বন্ধুর কর্মসূত্রে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে ট্রান্সজেন্ডারদের সম্পর্কে টুকরো টুকরো কথা শুনতে শুনতে প্রচন্ড আগ্রহ অনুভব করতাম এদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব জানবার। এই বইটা খুব চমৎকার বাংলা রেফারেন্স বুক হতে পারে, প্রান্তিক যৌনতার এই মানুষগুলো সম্পর্কে। প্রচুর রিসার্চ নাকি করেছিলেন লেখক ভদ্রলোক, দেখে নাক সিঁটিকেছিলাম। কিন্তু, পুরো ৬০০ পৃষ্ঠা পড়ার পরে মনে হচ্ছে, লেখককে কুর্নিশ তাঁর প্রচেষ্টার জন্যে। হয়তো এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেলার মত ঠাস বুনোট বাঁধুনি নেই গল্পের, এত বড় উপন্যাস হিসেবে একেবারেই ক্লাইম্যাক্সবিহীন, ন্যারেটিভও একটু খাপছাড়া, এমনকি অনেকখানেই মনে হয়েছে, আমার পরিচিত একজন আছেন যিনি এর চাইতেও ভালো লিখতে পারতেন হয়তো, কিন্তু মোটের উপরে বিপুল পরিমাণে বায়োলজিকাল এবং সাইকোসোশাল এবং সাইকোসেক্সুয়াল তথ্য ও পরিস্থিতিকে উপন্যাসের মোড়কে তুলে ধরার কাজটা চমৎকারভাবেই উৎরে গেছেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী।

আমরা তথাকথিত স্বাভাবিকেরা তো সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছি , এই তথাকথিত অস্বাভাবিক প্রান্তিক যৌনতার মানুষগুলোকে। প্রান্তিক যৌনতা ভাবলেও আমাদের মনে লেসবিয়ান বা গে মানুষ এমনটাই ফুটে ওঠে চোখের সামনে। কিন্তু এদের বাইরেও এমন মানুষ আছেন, যাঁরা প্রকৃতির ভুলে বা কোন অদ্ভুত খেয়ালেই দ্বৈত স্বত্বা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, বায়োলজিকাল লিঙ্গ পরিচয় এক, অন্তর আরেক। একটা খুব সুন্দর কথা আছে এঁদের নিয়ে “পুরুষ শরীরের খাঁচায় বন্দী নারীর মন”, বিপরীতটাও অনেক দেখা যায়, তবে তুলনামূলক এই এফিমিনেট মেলরাই বেশি। এই পুরুষাঙ্গধারীরা শারীরিকভাবে তো পুরুষের চিহ্নই বপ্যে চলেন, কিন্তু মনটা তো খাঁচা থেকে মুক্তি চায়, নিজেকে তো নারীর ভাবতে থাকেন তাঁরা, পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হন, কিন্তু সমকামী হিসেবে নয় বরং নিজেকে নারীরূপে ভেবেই। নিজেদের অপ্রযোজনীয় এবং অযাচিত পুরুষাঙ্গ নিয়ে থাকেন লজ্জিত, অনেকে তো এই পুরুষচিহ্ন ছিন্নও করে ফেলেন। আমরা তাঁদেরকে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে, তাদের সামাজিক নির্যাতন করে, অপচিকিৎসা, অনাচার করে সামাজিক আস্তাকুড়ে ফেলে দিই। কি ঘটে তাঁদের জীবনে? কিভাবে ভাবেন তাঁরা? আমাদের সম্পর্কেই বা তাঁদের মনোভাব কেমন? কেমন তাঁদের যাপিত জীবন? কেন কলেজ শিক্ষক ড: সোমনাথ ব্যানার্জী, সেক্স রিএরেঞ্জমেন্ট করিয়ে ড: মানবী ব্যানার্জী হয়ে যান? যাঁরা এতটা বোল্ড হতে পারছেন তাদেরকে সমাজ কিভাবে নিচ্ছে?

স্বপ্নময় চক্রবর্তী খানিকটা কাঁচা উপন্যাসে চমৎকারভাবে গভীর দর্শন, বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান উপস্থাপন করেছেন। এত তথ্য পেয়েছি বইটাতে, লেখার সাবলীলতা নিয়ে প্রশ্নটা তাই ছুঁড়ে আমি আস্তাকুড়ে ফেলে দিচ্ছি। সাথে একটা পিডিএফ ডাউনলোড লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি নামিয়ে পড়বেন, যদি আগ্রহ হয়। আশা রাখি পড়ার পরে এই বইটা সংগ্রহে রাখতে ইচ্ছা করবে। আমার নিজেরই করছে

http://www.amarboi.com/2015/12/holde-golap-shopnomoy-chakrabarty.html?m=1

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.