বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভালবাসা কী?

image-20160511-18171-kulas4

আমরা সবাই একে জীবনের কোন না কোন সময়ে অনুভব করেছি। কবিরা একে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, গায়করা একে নিয়ে গান গেয়েছেন। কিন্তু ভালবাসা আসলে কী? এটা কোথায় থাকে? কী এর সূচনা ঘটায়? আর যখন আমরা ভালবাসা অনুভব করি তখন আমাদের মনে কী ঘটতে থাকে?

রোমান্টিক ভালবাসার ক্ষেত্রে শক্তিশালী ইমোশনাল বন্ড বা আবেগজনিত বন্ধন এর বিকাশ ঘটে যা “এটাচমেন্ট” নামে পরিচিত। সেক্সুয়াল এট্রাকশন বা যৌন আকর্ষণ এবং কেয়ার গিভিং বা যত্ন এই দুই নিয়ে হল “এটাচমেন্ট”। যারা প্রেমে পড়ে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের গভীর অনুভূতির সৃষ্টি হয়। যেমন গভীর ভাবনা, আবেগজনিত নির্ভরশীলতা এবং অধিক পরিমাণে উন্মত্ততা। যদিও এই অনুভূতিগুলো সম্পর্কের কেবল প্রথম দশাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।

যাই হোক, রোমান্টিক ভালবাসা সমগ্র পৃথিবী জুড়েই দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই রোমান্টিক ভালবাসা প্রকাশের মাত্রা বা ধরণ অঞ্চলভেদে বিভিন্ন হয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ৫ শতাংশেরও কম মানুষ রোমান্টিক ভালবাসা ছাড়া বিয়ে করেন যেখানে পাকিস্তানে এই শতকরা পরিমাণ বেড়ে ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।

ব্রেইন একটিভিটি

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে রেওয়ার্ড এন্ড মোটিভেশন এর সাথে সম্পর্কিত অঞ্চলটি রোমান্টিক পার্টনার এর সম্পর্কে চিন্তা করার সময় বা তার উপস্থিতিতে সক্রিয় হয়। এই অঞ্চলে হিপোক্যাম্পাস, হাইপোথ্যালামাস এবং এন্টেরিয়র সিংগুলেটেড করটেক্স রয়েছে। এই অঞ্চলের সক্রিয়করণের ফলে বিভিন্ন ডিফেন্সিভ বিহ্যাভিয়র বা প্রতিরক্ষামূলক আচরণ বন্ধ হয়ে যায়, উদ্বিগ্নতা কমে যায় এবং রোমান্টিক পার্টনারের প্রতি বিশ্বাস বেড়ে যায়। আবার এমিগডালা এবং ফ্রন্টাল কর্টেক্স রোমান্টিক ভালবাসার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এমিগডালা ও ফ্রন্টাল কর্টেক্স নেগেটিভ ইমোশন সৃষ্টি ও জাজমেন্টের কাজ করে থাকে। তাই এটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবার ফলে নেগেটিভ ইমোশন বা নেইবাচক আবেগ প্রকাশের সম্ভাবনা ও পার্টনারকে বিচার করার ক্ষমতা কমে যায়।

এভাবে রোমান্টিক পার্টনারের বেলায় মস্তিষ্ক সোশ্যাল ইনটারেকশন বা সামাজিক যোগাযোগের প্রতি বেশি আকর্ষণবোধ দেখায় এবং নেগেটিভ রেসপন্স বা নেতিবাচক আচরণগুলোকে বন্ধ করে দেয়। রোমান্টিক রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্কের প্রথম দিকে মস্তিষ্ক কিরকম সক্রিয় হবে তার উপর সম্পর্কটির সফলতা ও বিফলতার সম্ভাবনা নির্ভর করে। যেমন সম্পর্কে সুখ, পার্টনারের প্রতি কমিটমেন্ট (বিশ্বাস, অঙ্গীকার, দায়িত্ব) এবং সম্পর্কে সন্তুষ্টি মস্তিষ্ক কত বেশি সক্রিয় হয় তার উপর নির্ভর করে।

হরমোনের প্রভাব

অক্সিটোসিন ও ভেজোপ্রেসিন হল রোমান্টিক ভালবাসার সাথে সম্পর্কিত দুটি হরমোন। এরা হাইপোথ্যালামাস দ্বারা তৈরি হয় এবং পিটুইটারি গ্ল্যান্ড দ্বারা নিঃসৃত হয়। নারী ও পুরুষ উভয়ই অক্সিটোসিন ও ভেজোপ্রেসিন হরমোন দ্বারা প্রভাবিত হলেও নারীরা অক্সিটোসিনের প্রতি বেশি সংবেদনশীল যেখানে পুরুষেরা অধিক সংবেদনশীল ভেজোপ্রেসিনের প্রতি।

রোমান্টিক ভালবাসার ঘনিষ্ট সময়গুলোতে অক্সিটোসিন ও ভেজোপ্রেসিন উভয়ের ঘনমাত্রাই বৃদ্ধি পায়। এই হরমোনগুলো রোমান্টিক ভালবাসার সাথে সম্পর্কিত মস্তিষ্কের বিভিন্ন সিস্টেমে ও রিসেপ্টরে কাজ করে। বিশেষভাবে অক্সিটোসিন এবং ভেজোপ্রেসিন হরমোন মস্তিষ্কের ডোপামিনারজিক রিওয়ার্ড সিস্টেমের সাথে ইন্টারেক্ট করে এবং হাইপোথ্যালামাসে ডোপামিনের নিঃসরণকে স্টিমুলেট করে।

রোমান্টিক ভালবাসার ক্ষেত্রে যেসকল ডোপামিনারজিক প্যাথওয়েগুলো সক্রিয় হয় তা একধরণের রিওয়ার্ডিং প্লেজারেবল ফিলিংস বা পুরষ্কার ও সন্তুষ্টিপ্রাপ্তির অনুভুতি তৈরি করে। এই প্যাথওয়েগুলো আবার নেশাগ্রস্ত আচরণ, অবসেসিভ আচরণ ও ইমোশনাল ডিপেন্ডেন্সি বা আবেগজনিত নির্ভরশীলতার সাথেও সম্পর্কযুক্ত যেগুলোকে রোমান্টিক ভালবাসার সম্পর্কের প্রাথমিক ধাপগুলোতে দেখা যায়।

image-20160516-15906-ar5wa5

গবেষকগণ অনেকবার মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের উপর অক্সিটোসিন ও ভেজোপ্রেসিনের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেছেন। যেমন তারা প্রেইরি ও মন্টানা ভোলের (ভোল হল ইঁদুরের একটি রিলেটিভ প্রজাতি) ক্ষেত্রে এই দুটো হরমোনের প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন। প্রেইরি ভোলরা মনোগ্যামাস লাইফটাইম রিলেশনশিপ দেখায় যা পেয়ার বন্ড নামে পরিচিত। এদিকে মোনটানা ভোলদের বেলায় জীবনটা এরকম একগামী নয়। এদের জীবনে অনেকগুলো পার্টনারকে দেখা যায়। পরিষ্কারভাবে দেখা যায় এই প্রেইরি ভোলদের মধ্যে মন্টানা ভোলের তুলনায় বেশি ঘনমাত্রার অক্সিটোসিন ও ভেজোপ্রেসিন রিসেপ্টর রয়েছে, বিশেষ করে ডোপামিন রিওয়ার্ড সিস্টেমে এই ঘনমাত্রার পরিমাণ আরও বেশি লক্ষ্য করা যায়।

আবার প্রেইরি ভোলদের ক্ষেত্রে যখন অক্সিটোসিন ও ভেজোপ্রেসিন এর নিঃসরণ বন্ধ করে দেয়া হয় তখন তারাও একগামী থেকে বহুগামী হয়ে যায়। এই গবেষণাগুলো একত্রে নির্দেশ করে কিভাবে হরমোন একটিভিটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরিতে কাজ করে।

ভালবাসা ও ক্ষতি

রোমান্টিক ভালবাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনগত কাজ করে থাকে। যেমন এটা সন্তানদের প্রতি প্যারেন্টাল সাপোর্ট বৃদ্ধি করে। রোমান্টিক ভালবাসায় “ক্ষতি” সব জায়গাতেই দেখা যায়। এই ক্ষতি হয়ে থাকে হয় সম্পর্কের ব্রেক আপ বা বিচ্ছেদের দ্বারা অথবা প্রিয়জনের মৃত্যুর দ্বারা। এগুলো বেদনাদায়ক হলেও বেশিরভাগ লোকই এই লস বা ক্ষতিকে কাটিয়ে উঠতে পারে।

তবে খুব কম ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণে অনেকের মাঝে একধরণের কমপ্লিকেটেড গ্রিফ বা জটিল বিষাদের বিকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে চলমান বেদনাদায়ক অনুভূতির সাথে মৃত সঙ্গীর প্রতি নিবিষ্টতাও যুক্ত থাকে। প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটেছে এরকম প্রতিটি পার্টানারই ক্ষতি সংক্রান্ত স্টিমুলি যেমন মৃত পার্টনারের কার্ড, ফটোগ্রাফ ইত্যাদি দেখে বেদনাবোধ করেন। দেখা যায়, কমপ্লিকেডেট গ্রিফ বা জটিল বিষাদের ক্ষেত্রে এই স্টিমুলিগুলো মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সেন্টারকে সক্রিয় করে। এগুলো একধরণের ক্রেভিং একশন বা আসক্তি তৈরি করে যেকারণে তাদের মাঝে প্রিয়জন হারাবার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার ক্ষমতাও কমে যায়।

ম্যাটারনাল লাভ বা মাতৃত্বজনিত ভালবাসা

image-20160516-15906-1q1dlc

রোমান্টিক ভালবাসা ও ম্যাটারনাল ভালবাসার সাইকোলজিকাল রেসপন্স এর মাঝে বেশ কিছু সাদৃশ্য আছে। যেমন ম্যাটারনাল ভালবাসার সক্রিয় হওয়া মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলো রোমান্টিক ভালবাসায় সক্রিয় হওয়া অঞ্চলের সাথে ওভারল্যাপ করে। বিশেষ করে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড এরিয়াগুলো যেগুলোতে উচ্চ ঘনমাত্রার অক্সিটোসিন ও ভেজোপ্রেসিন থাকে সেগুলো দেখা যায় উভয় ক্ষেত্রেই সক্রিয় হয় । আবার যেসব অঞ্চল রোমান্টিক ভালবাসার বেলায় নিষ্ক্রিয় ছিল যেমন নেগেটিভ ইমোশন এবং জাজমেন্ট বা বিচারের অঞ্চল সেগুলো ম্যাটারনাল ভালবাসার ক্ষেত্রেও নিষ্ক্রিয় থাকে।  আবার এক্ষেত্রেও অক্সিটোসিন এর ঘনমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধির ফলে মাতৃত্বের আচরণেরও হ্রাসবৃদ্ধি দেখা যায়।

তবে রোমান্টিক ভালবাসা ও ম্যাটারনাল ভালবাসার মধ্যে কিছু পার্থক্যও আছে। ম্যাটারনাল ভালবাসার ক্ষেত্রে কিছু অঞ্চল যেমন পেরিয়াকুইডাক্টাল গ্রে ম্যাটার সক্রিয় হয় যা রোমান্টিক ভালবাসার ক্ষেত্রে সক্রিয় হয় না। আর এটাই ম্যাটানালার লাভ বা মাতৃত্বজনিত ভালবাসার ক্ষেত্রে ইউনিক বা অনন্য।

যাই হোক, সব কিছুই রোমান্টিক ভালবাসার প্রাথমিক স্টেজগুলোর মত “ট্রু লাভ” বা সন্তানের প্রতি মায়ের অনুভূত ভালবাসার মত হয় না। বাস্তবটা আরও জটিল। এক্ষেত্রে আরও বেশ কিছু হরমোন এবং কমপ্লেক্স সাইকোলজিকাল ইনটারেকশন কাজ করে যেগুলো ভালবাসাকে পৃথিবীর একটি বিস্ময়কর বস্তু বানিয়ে রেখেছে।

http://jcc.sagepub.com/content/26/5/554.abstract

http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/17531984

http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/22119059

Click to access Acevedo%20et%20al-MarSatisfaction.pdf

http://www.nature.com/neuro/journal/v7/n10/full/nn1327.html

Click to access Lim%20-%20Oxytocin%20and%20social%20bonding.pdf

Click to access oConnor.PDF

Click to access Bartels2004_maternalLove_%5B0%5D.pdf

http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/9071347

Click to access Bartels2004_maternalLove_%5B0%5D.pdf

– বুনোস্টেগস

 

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.




This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.